০৪. শরিকের আমবাগানে ভুবন

কিন্তু শরিকের আমবাগানে ভুবন গিয়েছিলেন সকাল বেলা। সেখানে একটা কান্ড বাধিয়ে বসলেন।

নামেই আমবাগান, কিন্তু আম বিশেষ ফলে না। যে কটা হয় তাও হাড়ে টক। এদিকে ভালো জাতের আম বিশেষ দেখা যায় না। আগে নাকি ফলত খুব ভালো। এখনকার সবাই পূর্বকালের সুখসমৃদ্ধির কথা খুব বলে। কেউ চোখে দেখেনি, সবই বক্তাদের জন্মের আগেকার কথা।

এখন ওটা আর বাগান নয়, জঙ্গল। আমের চেয়ে অন্য আরও বারো জাতের গাছপালাই বেশি।

তিন শরিকের মধ্যে ভুবনদের কোনো শরিকানা নেই। ছিল অনেক কাল আগে, এখন কিনে নিয়েছে মহাদেব সাহা। তবু ভুবন ওখানে প্রায়ই সকালের দিকে যান আমলকী কুড়োতে।

তিন-চারটি ছেলে সেখানে তাদের নিজস্ব খেলা খেলছিল। ছোটোছেলেদের দেখলেই ভুবন আজকাল একেবারে ছেলেমানুষ হয়ে যান। একটা গাছের ডাল ভেঙে ছপটি বানিয়ে ঠিক বাঁদর তাড়াবার ভঙ্গিতে ভুবন বলতে লাগলেন, এই যা, যা, যা।

ছেলেরা একজন বুড়োলোকের এ-রকম অন্যায় আবদার সহ্য করবে কেন? তারাও ভুবনের পেছনে লাগল। ভুবন ওদের দিকে তেড়ে গেলে দৌড়ে পালায়, আবার চুপি চুপি পেছন থেকে এসে ভুবনের পিঠে খোঁচা মারে।

ভুবন একটি ছেলেকে ছপটির বাড়ি মারতেই অন্য একটি ছেলে ভুবনের ধুতি ধরে টান দিল। ভুবন প্রথমে মুক্তকচ্ছ, তারপর দিগম্বর হয়ে গেলেন। ধুতিখানা নিয়ে মাথার ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে চেঁচাতে লাগলেন, আরে হারামজাদার পাল, আয়, তোদের বাপের জন্ম দেখিয়ে দিচ্ছি! নির্বংশের ব্যাটারা, আয়, আয়—

ছেলেদের চেঁচামেচিতে আরও অনেক ছেলে জুটল। তারপর বড়োরা। সবাই মিলে পাগল খ্যাপাতে লাগল।

দ্বারিক তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। উঠোন থেকে বলাইকাকা চেঁচিয়ে ডাকলেন, ও দ্বারিক, একবার বাইরে এসো, দেখে যাও তোমার বাপের কীর্তি।

দ্বারিক সবচেয়ে অপছন্দ করে ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসা। সকালে প্রথম চোখ মেলার পর মানুষ খানিকটা আচ্ছন্নভাবে পাখির ডাক শুনবে, নতুন আলো দেখবে, আবার চোখ বুজে, বেঁচে থাকার স্বাদটা সমস্ত শরীরে অনুভব করে ফের আবার চোখ মেলবে। তারপর উঠে বসবে। এটাই তো স্বাভাবিক। পুরুলিয়া জেলে থাকার সময়ও রোজ ভোরে একটা ইষ্টিকুটুম পাখির ডাক শুনে দ্বারিকের ঘুম ভাঙত।

চোখ কচলাতে কচলাতে দ্বারিক বাইরে বেরিয়ে এল।

বলাইকাকা নিম্নস্বরে বললেন, তোমার বাবা আবার পাগলামি শুরু করেছেন। একটা কিছু চিকিৎসা করাও এবার। রণকালীপুরের গাজি সাহেব শুনেছি ভালো ওষুধ দেন।

দ্বারিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বাবাকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে আগেই। সেবারে আশিসরা যখন এসেছিল, তখনও ওদের সঙ্গে সে তার বাবার প্রসঙ্গে আলোচনা করেছিল। আশিস কেসটা বলেছিল তার এক মাস্টারমশাইকে। সবাই বলেছেন, এর এমনি কোনো চিকিৎসা নেই। হঠাৎ একদিন ভালো হয়ে যাবে।

ভুবন তখন সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ধুতিটাকে হাতের ছপটির সঙ্গে বাধিয়ে বোঁ বোঁ করে ঘোরাচ্ছেন। দেখে কে বলবে যে এই মানুষটি একটানা পঁয়ত্রিশ বছর অঙ্কের মতন একটি দুরূহ বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন।

বাবা, বাবা! ধুতিটা পরে নিন।

ভুবন একগাল হেসে বললেন, আমি কারুর বাবা নই, বাপ! আমি আমার নিজের বাবার একমাত্র ছেলে! কোনোদিন তাঁর কথার অবাধ্য হইনি!

দ্বারিক জোর করে বাবার হাত থেকে লাঠিটা ছাড়িয়ে নেয়। ভুবন টেনে এক চড় মারেন ছেলের গালে। দ্বারিক সেদিকে মনোেযোগ না দিয়ে কড়া ধমকের সুরে বলে, শিগগির, ধুতিটা পরে নিন।

দূরে দাঁড়িয়ে ছেলেরা খলখল করে হাসছে।

প্রহসনটি এখানেই শেষ হল না। দ্বারিক তার বাবাকে ধুতিটা পরিয়ে দিতে যেতেই ভুবন তার হাত ছাড়িয়ে ছুটে পালালেন। শুরু হল সারাবাগানময় দৌড়োদৌড়ি। ছেলেরা মহাকৌতুকে হাততালি দিচ্ছে, বড়োরাও হাসছে। কেউ দ্বারিককে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এল না। একটা মোটা আমগাছের গুড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে ভুবন ঠিক বাচ্চাছেলের মতন বলতে লাগলেন, ধর দেখি! ধর দেখি আমাকে!

বাবাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে দ্বারিক ফিরে যেতে পারে না। উলঙ্গ অবস্থাতেই টানতে টানতে নিয়ে যেতে হবে বাড়িতে, বীথি যাই মনে করুক। ধুতিটা মাটিতে ফেলে দু-হাতে সে বাবাকে জড়িয়ে ধরল।

ভুবন ঠাস ঠাস করে তাকে চড় মারতে মারতে চেঁচাতে লাগলেন, ছাড়! ছাড় হারামজাদা। আমি তোদের কেউ না!

ভুবন? ভুবন!

এক জলদগম্ভীর ধমকে সবাই থমকে ফিরে তাকাল। গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই। টকটকে লাল ধুতি পরা, গায়ে মুগার চাদর, পায়ে খড়ম। হাতে একটা পেতলের ফুলের সাজি। সুদীর্ঘ চেহারার পুরুষ!

যেন সাপের মাথায় লাঠির বাড়ি মারা হল। ভুবন একেবারে কুঁকড়ে গিয়ে ভীতু গলায় বললেন, গোষ্ঠদা?

ভুবন গোষ্ঠ ভট্টাচার্যকে প্রণাম করতে যেতেই তিনি দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে আবার বললেন, ঘূবি না! চুবি না আমাকে, বেল্লিক কোথাকার, সকাল বেলা সং সেজেছিস?

ভুবনকে নাম ধরে ডাকার মতন লোক গ্রামে আর বেশি নেই। গোষ্ঠ ভট্টাচার্য শুধু বয়েসের জন্যই নয়, ব্যক্তিত্বেও তিনি এ গ্রামের শিরোমণি। বহুকালের সংস্কারবশে ভুবন এখনও এঁকে ভয় পান।

ধুতিটা পরে নে! লজ্জা-ঘেন্না বলে কিছু আর নেই?

ভুবন সুড়সুড় করে অমনি ধুতিটা জড়িয়ে নিলেন কোমরে। ভুবনের ঠোঁট দুটো কাঁপছে। দ্বারিক বুঝতে পেরেছে, তার বাবা এখন আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছেন, মনের গ্লানিতে এখন তিন-চারদিন আর কারোর সঙ্গে কথাই বলবেন না। নিজের ঘরে বসে থাকবেন গোঁজ হয়ে।

গোষ্ঠ ভট্টাচার্যকে দেখেই মজা উপভোগকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। ভুবন মাথা হেঁট করে হাঁটতে লাগলেন বাড়ির দিকে, দ্বারিকও সঙ্গে যাবে ভেবেছিল, গোষ্ঠ ভট্টাচার্য তাকে দাঁড়াবার জন্য ইঙ্গিত করলেন।

তোর শরীর কেমন আছে এখন?

ভালোই আছে, জ্যাঠামশাই।

রাত্তিরে কাশির জন্য খুব কষ্ট পাস শুনেছি?

গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের নিজস্ব কোনো গোয়েন্দাবাহিনী আছে কিনা কে জানে, কিন্তু তিনি আশে পাশের তিন-চারখানা গ্রামের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি ঘটনার খবর রাখেন।

হ্যাঁ, মাঝে মাঝে খুব বাড়ে, আবার একটু কমে।

কী ওষুধ খেয়েছিস?

এক্সপেকটোরান্ট। মাঝে মাঝেই দু-এক শিশি।

ওগুলো ওষুধ নয়, বিষ। আয় আমার সঙ্গে, আমি তোকে ওষুধ দেব, একেবারে সেরে যাবে।

গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের কথার প্রতিবাদ করার কোনো প্রথা নেই এ গ্রামে। ওষুধের ব্যাপারে তিনি একজন সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি, একথা দ্বারিক ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে। তবে, ইনি নিয়মিত রুগি দেখেন না, ওষুধও দেন না। যখন যাঁর ওপর দয়া হয়, তখন ওষুধ দেন তাঁকে। সেসব ওষুধই দৈব প্রদত্ত। গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে ওষুধ পাওয়া রীতিমতন ভাগ্যের কথা।

দ্বারিক এই বিশিষ্ট দয়া প্রত্যাখ্যান করবে কিনা, তা নিয়ে দু-এক মুহূর্ত ইতস্তত করল। তারপর ভাবল, দেখাই যাক-না গিয়ে। সে একটু দূরত্ব রেখে গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। বাসি জামাকাপড় পরে কোনোক্রমে ওঁকে ছুঁয়ে ফেললেই বিপদ।

ভট্টাচার্যপাড়ায় এঁদের বাড়িটাই সবচেয়ে পুরোনো। পাতলা ইটের বাড়ি। অনেক জায়গা ভেঙে পড়েছে, বট, অশ্বথের চারা বেরিয়েছে ছাদ ফুঁড়ে, তবু এখনও যা অক্ষত আছে, তাও কম নয়। ঠাকুরদালানটি বেশ ঝকঝকে পরিষ্কার। সিঁড়িগুলো শ্বেতপাথরের।

খড়ম ঠকঠকিয়ে গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই উঠে গেলেন ঠাকুরদালানে। দ্বারিক উঠোনেই দাঁড়িয়ে রইল। সে মুখ ধোয়নি, বিছানা থেকে সোজা উঠে এসেছে। এই অবস্থায় কোনো জায়গায় বসলে যে অন্যায় বা অপবিত্র ব্যাপার হবে, সে ঠিক জানে না।

উলটোদিকের দালানে বাড়ির অন্য লোকেরা তাকে দেখতে পেয়েছে। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। বছর পাঁচেক সে জেলে কাটিয়েছে, তার আগেও দু-তিন বছর গ্রামছাড়া হয়েছিল। একসময় তার নামের সঙ্গে একটা ভয় জড়িয়ে ছিল। এখনও অনেকেই তার সঙ্গে সহজভাবে মেশে না। সমীহ করে।

জ্যাঠামশাই, বাড়িতে কিছু বলে আসিনি, আমি না হয় পরে কোনো সময় আসব।

বোস। ওই সিঁড়ির ওপরে বোস।

আপনি তো এখন পুজোয় বসবেন, অনেক দেরি হবে।

খিদে পেয়ে যাবে? কিছু খেয়ে আসিসনি?

না, সেজন্য নয়।

খালি পেটেই ওষুধটা খেতে হয়।

দ্বারিক আর কথা বাড়ালো না! গোষ্ঠ ভট্টাচার্য ইতিমধ্যে হরিণের চামড়া পেতে পুজোয় বসে পড়েছেন। কতক্ষণ ধরে এই পুজো চলবে কে জানে!

গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের ব্যক্তিত্বটা অনেকটা ক্লাসিক্যাল ধরনের। সত্তর বছরেও সরল ঋজু শরীর, যথেষ্ট লম্বা ও ফর্সা, কণ্ঠস্বর গমগমে ও তিনি বদরাগি। লাল রঙের ধুতি পরে তিনি হরিণের চামড়া পেতে পুজোয় বসেন। সবসময়ই তিনি ওইরকম টকটকে লাল রঙের ধুতি পরে বেড়ান। কেমন যেন অবাস্তব মনে হয়। অথচ উনি সত্যিই তো বসে আছেন অদূরে এবং দ্বারিক জন্ম থেকেই ওঁকে ওইরকম দেখছে। যেন গত শতাব্দী থেকে হঠাৎ ছিটকে আসা একজন মানুষ।

একটা হাত খানেক লম্বা কালীর মূর্তি, ফুল বেলপাতায় প্রায় পুরোটাই ঢাকা। দ্বারিক কোনোদিন মূর্তিটা ভালো করে দেখেনি। তবে সে শুনেছে যে মূর্তিটা নাকি কষ্টিপাথরের, জিভটা সোনার। একবার এই মূর্তিটা চুরি হয়েছিল। দু-দিনের মধ্যেই চোরের নাকি ওলাওঠা হয়, চোরের বউ নিজে এসে মূর্তিটা ফেরত দিয়ে যায়।

হয়তো ব্যাপারটা কাকতালীয়। কিংবা, দ্বারিক ভাবে, ইচ্ছে করেই এ-রকম একটা গল্প রটিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে তার স্মৃতির বয়েস থেকেই এটা শুনে আসছে।

গোষ্ঠ ভট্টাচার্য শব্দ করে মন্ত্র পড়েন না। কিন্তু তাঁর শরীরটা একটু একটু দুলছে। তার ডানপাশের একটা তামার রেকাবিতে কী যেন একটা জিনিস পুড়ছে। তার থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে গলগল করে। অত ধোঁয়ার মধ্যে বসে থাকাও সহজ কথা নয়, নিশ্চয়ই চোখ বুজে আছেন উনি।

যতটা দেরি হবে বলে দ্বারিক আশঙ্কা করেছিল, অতটা অবশ্য হল না। নিষ্ঠাবান মুসলমানদের পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়ার মতন গোষ্ঠ ভট্টাচার্যও দিনে চার-পাঁচবার পুজোয় বসেন। যখনই তাঁর মেজাজ খুব বেশি গরম হয়ে যায়, ব্রহ্মতালুতে আগুন জ্বলে, তখনই তিনি নিজেকে শান্ত করবার জন্য আশ্রয় নেন ঠাকুরঘরে।

দু-বার মা মা ডেকে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোষ্ঠ ভট্টাচার্য পেছন ফিরলেন। দ্বারিককে বললেন, দাঁড়া, ওষুধটা বানিয়ে দিচ্ছি এবার।

তামার রেকাবিতে যে জিনিসটা জ্বলছিল তার ওপর জল ছিটিয়ে দিলেন খানিকটা। তারপর সেই ছাইয়ের সঙ্গে নানারকম জিনিস মেশাতে লাগলেন। মনে হল যেন কপূর, চন্দন এইসবও মেশাচ্ছেন। একটা কলাপাতায় সেই থকথকে জিনিসটা তুলে নিয়ে দ্বারিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, রোজ সকালে একটু করে খাবি। মোট চারদিন। দেখবি, ওটা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাবে। একটু একটু করে ভেঙে নিয়ে গলায় ফেলে দিলেই হল। এখন একটু খেয়ে নে।

এখনই?

হ্যাঁ, তুলে নে একটু আঙুলে করে। জল দিচ্ছি, ধুয়ে নিবি। তারপর প্রসাদ দেব।

দ্বারিক একটু ইতস্তত করতে লাগল। এসব ছাইভস্ম খাওয়ার কোনো মানে আছে কী? অথচ অনেকের নাকি সেরেও যায়।

জ্যাঠামশাই, আপনাকে একটা কথা বলব?

কী?

যাদের বিশ্বাস নেই, তাদেরও কি এই ওষুধে কাজ হয়?

বিশ্বাস? কার বিশ্বাস নেই, তোর? চীনেরা কিংবা রাশিয়ানরা কালীঠাকুর মানে না বলে বুঝি তোরাও মানিস না?

আমাদের দেশেও অনেক নাস্তিক আছে। সেই রামায়ণ-মহাভারত-এর আমলেও ছিল।

ওসব বাজেকথা রাখ। বিশ্বাস কি সকলে করতে পারে? যেসব অজ্ঞ মূর্খের দল এসে রোজ ঠাকুরের সামনে মাথা ঠুকে যায়, তারাই কি জানে বিশ্বাসের মর্ম। সাধনার একটা বিশেষ স্তরে পৌঁছোলে তবেই প্রকৃত বিশ্বাস আসে। তোদের মতন লোকদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দায় আমরা নিয়ে নিয়েছি। নে, খা!

দ্বারিক অনুভব করল, জ্যাঠামশাই তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। গ্রামসুদ্ধ সমস্ত লোক এঁকে মানে। উনি দেখতে চান, দ্বারিক ওঁকে অমান্য করার সাহস রাখে কিনা। সেইজন্যই ছাই গুলে ওকে খেতে দিয়েছেন।

আঙুলে করে খানিকটা তুলে নিয়ে দ্বারিক মুখে দিল। জিনিসটা খেতে মন্দ নয়। একটু যেন আদা আর কপূরের স্বাদ আছে। চাটনি হিসেবে এর সবটাই দ্বারিক এক্ষুনি খেয়ে ফেলতে পারে।

কুশিতে করে জল এনে গোষ্ঠ ভট্টাচার্য সন্তুষ্ট গলায় বললেন, হাতটা ধুয়ে নে। এবার প্রসাদ দিচ্ছি।

এ বাড়ির প্রসাদ দ্বারিক ছেলেবেলায় অনেক খেয়েছে। শশা, কলা, বাতাসার সঙ্গে খুব সুন্দর নাড় থাকে। ক্ষীর আর নারকোল দিয়ে তৈরি। সেই নাড় খাওয়ার শিশুকালের লোভটা তার জেগে উঠল।

কিন্তু আজ সেই নাড় নেই। শুধুই শশা, কলা, বাতাসা। এর একটাও দ্বারিকের প্রিয় নয়।

আজ পর্যন্ত এ বাড়িতে কোনোদিন ডাক্তার-কবিরাজ ঢোকেনি। এটা সত্যি খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। এই সত্তর বছর বয়সেও জ্যাঠামশাই ভালো স্বাস্থ্য রেখেছেন। একবার সরকারের লোকেরা এ গ্রামে পক্সের টিকে দিতে এসেছিল, জ্যাঠামশাই নিজের বাড়িতে তাদের ঢুকতে দেননি। অবশ্য, জ্যাঠামশাইয়ের মেজোছেলে দিবাকরদা অনেকদিন কলকাতার হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন।

তুই তা হলে এখন গ্রামেই থেকে যাবি ঠিক করেছিস? তাই তো ভাবছি। তা ছাড়া বাড়িতে আর দেখবার কেউ নেই।

আত্মোন্নতির জন্য অনেকে বাপ-মাকে পরিত্যাগ করে। তুইও করলে পারিস। লেখাপড়া শিখেছিস, কলকাতায় গেলে চাকরি পেয়ে যাবি।

আমার দ্বারা বোধ হয় আর চাকরি-বাকরি করা সম্ভব হবে না, জ্যাঠামশাই।

আদর্শবাদীদের শেষ অবলম্বন স্কুল মাস্টারি। আজকাল অবশ্য ভোটে দাঁড়াবারও একটা ব্যাপার হয়েছে।

আমি তাহলে আজ উঠি?

খটাস খটাস শব্দ করে গোষ্ঠ ভট্টাচার্য দ্বারিকের একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, সংবাদ শুনেছিস?

আজ্ঞে?

শুনিসনি? ওই যারা ডিপটিউবওয়েল খুঁড়ছিল, কাল সন্ধ্যে বেলা তারা জলের সন্ধান পেয়েছে।

দ্বারিক খবরটা শুনে খুশি হল। এদিকে রুক্ষ অনুর্বর মাটি। সহজে জল পাওয়া যায় না। পুকুরগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। কুয়ো খুঁড়তে এসে ওরা তিন-চার জায়গায় জল পায়নি। অবশ্য দ্বারিকের সন্দেহ, তিন-শো ফুট অন্তত খোঁড়ার কথা, ওরা এক-শো-দেড়-শো ফুট খুঁড়েই ক্ষান্ত দেয়।

কিন্তু গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের পরের কথাটায় দ্বারিক আবার সাংঘাতিকভাবে চমকে উঠল।

রক্ত পেয়েছে তো! রক্ত না পেলে ধরিত্রী খুশি হবেন কেন?

রক্ত?

কেউ চুপিচুপি ওখানে নরবলি দিয়ে আমাদের মহাউপকার করে গেছে।

আপনি কী বলছেন জ্যাঠামশাই? নরবলি আবার কী?

ওখানে রক্ত পাওয়া যায়নি? তেঁতুলিয়ার মোড়ে একটা কাটা মুণ্ডু গড়ায়নি?

আপনি এইসব বাজে কথায় বিশ্বাস করেন? দারোগাটি তো ঠিক কথাই বলেছিল। রণকালীপুরের কবরখানায় একটা টাটকা কবরের মাটি খোঁড়া আছে। শেয়ালেরা হাড়গোড় বার করে আনে। একটা মুন্ডুও নিয়ে এসেছিল।

গোষ্ঠ ভট্টাচার্য গলার আওয়াজ বাঁকিয়ে বললেন, শেয়ালেরা বুঝি দাঙ্গা বাধাবার মতলব করে? মুসলমানের মুন্ডু পাঁচ মাইল দূরের হিন্দু গ্রামে এনে ফেলে?

জন্তুজানোয়ারেরা তো দাঙ্গার কথা জানে না। মানুষই এসব চিন্তা করে।

সেই কথাই তো বলছি। শেয়ালরা পাঁচ মাইল দূরে একটা মানুষের মাথা নিয়ে এল? কখনো কেউ এ-রকম শুনেছে? এ শেয়ালের কম্ম নয়। মানুষেরই কীর্তি। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে মানুষ সহজে জিততে পারে না। যেখানে জেতেও, সেখানে এমন ভাব দেখাতে হয়, যেন প্রকৃতিই বড়ো। বলতে হয়, মা, তুমিই শ্রেষ্ঠ, আমরা তোমার অনুগ্রহ চাই। সেইজন্যই পুজোআচ্চার প্রয়োজন। দামোদরের ওপর যখন অত বড়ো বাঁধ বাঁধে তখন গভর্নমেন্ট নিজে থেকে কতগুলো নরবলি দিয়েছিল তোর মনে নেই? এমনকী ব্রিটিশ গভর্নমেন্টও দিয়েছে।

এসব একেবারে গাঁজাখুরি কথা।

তখন দিবাকর বর্ধমান সেটেলমেন্টে চাকরি করে। সে নিজে দেখেছে। কাগজে বেরিয়েছিল, দুর্ঘটনায় চারজন শ্রমিকের মৃত্যু। আসলে ওই চারজনকে বলি দেওয়া হয়েছিল! আমাদের এখানে তো ভালো বংশের ছেলেকে বলি দেওয়া হয়েছে। কাজও হল সঙ্গে সঙ্গে–

ধীরেনদার ছেলে বিটু…আপনি ভাবছেন তাকে কেউ বলি দিয়েছে? সেজন্যে আপনি খুশি হয়েছেন? বিধবার একমাত্র ছেলে।

বড়ো কাজ করতে গেলে ওরকম একটা-আধটা প্রাণ যায়ই! জল পেলে গ্রামের কত চাষির উপকার হবে, সেটা ভাবতো।

অন্য দেশের লোকেরা যে কুয়ো খোঁড়ে, ব্রিজ বানায়, তারা অন্য দেশের কথা জানি না। আমি জানি আমার নিজের দেশের কথা। যে দেশের যা শাস্ত্র, যে বিয়ের যা মন্ত্র!

কিন্তু নরবলি…আমাদের গ্রামে কে নরবলি দেবে…অন্য গ্রামের কেউ এসে তো আমাদের গ্রামে…কার এমন…

গোষ্ঠ ভট্টাচার্য হাসলেন। কিন্তু তাঁর চোখ দুটো সোজা দ্বারিকের চোখের সঙ্গে গাঁথা।

নরবলি কেউ দেয় না। মা নরবলি নেন। যার হাত দিয়ে সেটা হয়, সে নিমিত্তমাত্র। এ গ্রামে সেরকম দু-জন লোকই আছে। আমি, অথবা তুই। লোকে তোর কথাই বেশি বলাবলি করছে।

এবার দ্বারিকও হাসল। গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই এবার সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়েছেন। নিছক স্নেহভরে তিনি আজ সকাল বেলা দ্বারিককে ডেকে আনেননি। তাঁর আসল মতলবটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না।

বিটু ফিরে এলেই এসব গুজব আবার ধামাচাপা পড়ে যাবে।

সে ফিরে আসবে?

তার একটা কিছু খোঁজ পাওয়া যাবেই। একটা নিরীহ সাধারণ ছেলে, তাকে তো আর কেউ এমনি এমনি মারতে যাবে না।

নিরীহ ছেলেরা বুঝি এমনি এমনি মারা পড়েনি এর আগে? এঃ হে হে হে হে! তুই একথা বলছিস? এখন তোরা সব সাধু সেজেছিস বুঝি?

আমাদের দলের ছেলেরাই বেশি মারা গেছে। আমরা একটা যুদ্ধে নেমেছিলাম…দেশের জন্য।

এটাও তো দেশের কাজ। চাষের জন্য জল ভোলা দেশের কাজ নয়?

জ্যাঠামশাই, এ বিষয়ে পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব।

যৌবনকালে আমি এক কোপে একটা পাঁঠা কাটতে পারতাম, এখন বয়েস হয়েছে, অতটা আর শক্তি নেই। কাল মল্লিকপুরের হাট ছিল। শুনলাম সেখানে লোকেরা বলছে, এ তল্লাটে মানুষ কাটার অভিজ্ঞতা একমাত্র দ্বারিক হালদারেরই আছে।

না জ্যাঠামশাই, পাঁঠা কাটা কিংবা মানুষ কাটা, কোনো অভিজ্ঞতাই আমার নেই।

মহাদেব সাহার কাকা ভূষণ সাহা, তার দেহটা তিন টুকরো হয়ে পড়েছিল কদমতলীর কাছে। তাকে কে কেটেছিল? তোর ছোটোভাই ভুতো, সে কেটেছিল।

দ্বারিকের শান্ত ভাবটা সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। সাংঘাতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল তার সারাশরীরে। এইসব সময় সে খুব দুর্বল হয়ে যায়। তার ঘাড়ের দু-পাশ টনটন করে।

সে চোয়াল শক্ত করে বলল, না। ও-ব্যাপারে ভুতোর কোনো হাত ছিল না। কিন্তু এসব পুরোনো কথা কি এখন আলোচনা করবার কোনো দরকার আছে?

লোকে যা বলছে, তাই বললাম।

লোকে যা বলছে, তা শুধু আপনি শুনলেন? আমার কানে তো কিছু আসেনি।

আসেনি, আসবে। এখন লোকে তোর আড়ালে বলছে, পরে সামনেই বলবে। সেইজন্যই বলছিলাম, তুই কিছুদিন কলকাতায় গিয়ে থেকে আয়। আর ভুতোর বউ বলে পরিচয় দিয়ে যে মেয়েটা আছে, ওকেও নিয়ে যা।

জ্যাঠামশাই একটা কথা বলুন তো। আমরা গ্রামে থাকলে আপনার কোনো অসুবিধে আছে?

আমার সুবিধে-অসুবিধের প্রশ্ন এখানে নেই। আজকাল সমাজের সেই দৃঢ় বাঁধন আর নেই। অনেক কিছুই ভেঙে পড়ছে। কিন্তু তবুও তো একটা সীমা আছে! ন্যায়-নীতি তো দেশ থেকে একেবারে উঠে যায়নি। ভুতোর বউ বলে যে মেয়েটাকে তোরা বাড়িতে রেখেছিস তার পদবি তো ছিল শীল, তাই না?

হ্যাঁ।

তুই অস্বীকার করলেও কোনো লাভ হত না। আমার চেনা একজন লোক বহরমপুরে গিয়েছিল। সে খোঁজ এনেছে। একটা শুদুরের বাড়ির মেয়ে বামুনের বাড়িতে এসে বলল, আমি তোমাদের ছেলের বউ, অমনি সবাই তাকে মেনে নিল, এদিকে সে ছেলেরই পাত্তা নেই, এ-রকম কখনো হয়? তোর বাপটা এমন পাগল, আর মা-টা তো জন্ম-দুঃখী। সেই সুযোগ নিয়ে তোরা যা-তা করছিস। তা বলে আমরা চোখ বুজে থাকব? গ্রামের ছেলে মেয়েদের সামনে এ-রকম একটা দৃষ্টান্ত ঝুলিয়ে রেখে তাদেরও উচ্ছন্নে পাঠাব?

একটি বছর পাঁচেকের ফুটফুটে ছেলে দৌড়ে এসে গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের পাশে দাঁড়াল, ওঁর কণ্ঠস্বর ক্রমশ উচ্চ গ্রামে উঠছে, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। বাড়ির লোকজন শুনছে সবই, তাই বোধ হয় ওঁকে শান্ত করার জন্য বাচ্চাছেলেটিকে পাঠিয়েছে। দিবাকরদার পর পর পাঁচটি মেয়ে হওয়ার পর এই ছেলেটি জন্মেছে। এ না জন্মালে এ বংশে বাতি দেওয়ার আর কেউ থাকত না। তাই এই নাতিটি গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের খুব আদরের।

ভুতো আজও ফিরল না, আর কোনো দিন ফিরবে কিনা সন্দেহ। তুই বিয়ে করিসনি, বাড়িতে একটা সোমত্থ মেয়ে…এসব কি ভদ্রলোকের বাড়ির ব্যাপার।

আমাদের বাড়ির ব্যাপার নিয়ে আপনাদের চিন্তা না করলে বুঝি চলে না?

নিশ্চয়ই চিন্তা করতে হবে! গাঁয়ের একটা শুচিতা বলে কিছু নেই?

গাঁয়ে শুচিতা আছে? হাজার রকমের নোংরামি।

তোদের জন্যই তো…বাপ-মার চোখের সামনেই একটা অন্য জাতের মেয়েছেলে নিয়ে ঢলাঢলি…

জ্যাঠামশাই, এই ওষুধটা আমার দরকার নেই।

ওটা তোর ভালোর জন্যই দিয়েছি। ওটা খেলে কাজ হবে। তোর ভালোর জন্যই বললাম, ওই মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে, তুইও কিছুদিন শহরে থেকে আয়। তোর বাপ-মাকে দেখার লোকের অভাব হবে না।

ছোটাছেলেটি এসে না পড়লে হয়তো দ্বারিক কলাপাতা মোড়া জিনিসটা গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের মুখে ছুড়েই মারত। তা না করে সে সেটাকে আস্তে নামিয়ে রাখল সিঁড়ির ওপরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *