বীথিকে নিয়ে ফিসফাস কানাকানি আজও থামেনি মোরামডাঙায়।
বীথি একলা রাস্তায় বেরোলেই টের পায় নানা দিক থেকে কৌতুহলী চোখ তাকে দেখছে আড়চোখে। পাড়ার বউ-ঝিদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলেও তারা নিজে থেকে কথা বলে না।
বীথি তবু রাস্তায় বেরোয়। সারাদিন বাড়িতে বসে থেকে করবেই বা কী? বাড়ি থেকে বেরিয়ে, বারোয়ারি দিঘিটার ডান পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে ভট্টাচার্যি পাড়া ছাড়িয়ে মাঠের দিকে চলে আসে। এদিকটায় ধান হয় না, উঁচু-নীচু পাথুরে জমি। এদিকে সৌন্দর্যও কিছু নেই, শুধুই অফলা মাঠ, মাঝে মাঝে কয়েকটা বাবলা আর খেজুরগাছ।
সেই মাঠের মধ্য দিয়ে খানিকটা গেলে একটা মজা নদীর খাত। শুধু মজা নয়, একেবারেই মরা। বর্ষার সময় সামান্য একটু জল জমে, অন্য সময় মনে হয় যেন একটা ঢালু রাস্তা। খটখটে শুকনো, ধুলো ওড়ে পর্যন্ত। লোকে বলে, এই নদীটা যখন জীবন্ত ছিল, তখন আশপাশের জমিতে সোনা ফলত। সে কবেকার কথা কে জানে, এখনকার কেউ সেই সুদিন দেখেনি।
বিকেল চারটে সাড়ে-চারটের পর রোদ খানিকটা দুর্বল হয়ে গেলে বীথি এসে বসে এই মরা নদীর খাতে। সে জানে, গ্রামের কোনো মেয়ে এ-রকমভাবে একা একা মাঠের মধ্যে এসে বসে থাকে না। কোনো বউয়ের পক্ষে তো আরও নিন্দের ব্যাপার। এসব জেনেশুনেও বীথি আসে। কোনো একটা সময় তার একটু ফাঁকা জায়গা দরকার, একটু নিরালা।
জায়গাটা পরিষ্কার। উন্মুক্ত বাথরুম ব্যবহার করা যাদের অভ্যেস তারাও এতটা দূরে আসে। নদীর খাতের মধ্যে গিয়ে বসলে মাঠ থেকে আর দেখাও যায় না কিছু। এইখানে রোজই এক-জায়গায় বসে বীথি একটা গর্ত খোঁড়ে।
এটা তো ফন্তু নদী নয় যে গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে জল বেরোবে। এটা বীথির একটা খেলা। এক টুকরো মরচেপড়া লোহার ডাণ্ডা দেখতে পেয়ে বীথি প্রথম একদিন এমনিই অন্যমনস্কভাবে খুঁড়তে শুরু করেছিল। এখন সেটা বেশ একটা খেলনা পুকুরের মতন হয়েছে। দু-তিন হাত চওড়া। একসময় মেয়েরা এইরকম পুকুরঘাটে পুণ্যিপুকুরব্রত করত। বীথি কোনোদিন ওসব ব্রত-ট্রত করেনি। কিন্তু নিজের হাতে একটা পুকুর তৈরি করবার ব্যাপারটা তার বেশ ভালো লাগে। এটার চারপাশে সে চারটে বনতুলসী গাছ লাগিয়েছে। এখন রোজ সে এটাকে গভীর করছে। একটু বৃষ্টি হলেই নিশ্চয়ই এটা ভরে যাবে। দু-হাত দিয়ে সে ঝুরো ঝুরো মাটি তোলে।
অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর এক-একদিন বীথি এখানে বসে কাঁদে।
কাছাকাছি কোনো বাড়ি নেই, সন্ধ্যের পর এদিকে কেউ আসে না, তবু অনেক অদৃশ্য চোখ যেন লক্ষ করে সব। ঠিক খবর রটে যায়। বাজারের চায়ের দোকানে আলোচনা হয়। যথাসময়ে তা দ্বারিকের কানেও পৌঁছোয়।
আপনাদের বাড়ির…উনি..মাঠের মধ্যে বসে কাঁদছিলেন…বোধ হয় শরীরটা এখনও সারেনি।
দ্বারিক অসহিষ্ণুভাবে সোমেশ্বরকে জিজ্ঞেস করে, তুই নিজে শুনেছিস? তুই সন্ধ্যেবেলা ওখানে কী করছিলি?
সোমেশ্বর বলে, আমি নিজে শুনিনি ঠিকই…কিন্তু অনেকেই বলাবলি করছে…
অনেকে তো অনেক কিছু নিয়েই বলাবলি করে, সব সত্যি?
আপনি চটে যাচ্ছেন কেন, দ্বারিকদা? আমি বলছিলাম, ওনার হয়তো পেটে ব্যথা-ট্যথা হয়, মুখ ফুটে বলেন না, উনি এত চাপা স্বভাবের…
প্রথম প্রথম সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ার পর দ্বারিক ব্যস্তভাবে টর্চ নিয়ে দু-একদিন খুঁজতে গিয়েছিল বীথিকে। বীথি নিষেধ করেছে।
আপনি আমার জন্য ভয় পাচ্ছেন কেন? এখানে তো রাস্তা হারাবার কোনো ব্যাপার নেই।
তা নেই, তবু এত অন্ধকারে…হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে…
যদি দু-একবার পড়েও যাই, আমি তো ননির পুতুল নই!
তবু, তোমার এ-রকম গ্রামের রাস্তায় হাঁটার অভ্যেস নেই অন্ধকারে।
এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।
দ্বারিক তখন হেসে বলেছিল, তা না হয় অভ্যেস হয়ে গেছে বুঝলাম, কিন্তু সাপ-টাপের সামনে যদি পড়ো হঠাৎ?
আমি একা বেরোলে মা কি রাগ করেন?
না, না, সেজন্য নয়। তুমি একা বেরোবে না কেন…
বীথি তারপরেও রোজ যায়। দ্বারিক মনে মনে যথেষ্ট অস্থির হয়ে থাকে বীথি না-ফেরা পর্যন্ত, কিন্তু আর টর্চ নিয়ে খুঁজতে আসে না। সে চায় না বীথির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে। মা কিছু বলতে এলে সে প্রায় ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়।
সবাই কি তোমাদের মতন ঘরকুনো হয়ে থাকবে নাকি? বিকেল বেলা তো বেড়াতে যাওয়া ভালোই!
তবু পদ্ম যদি অন্তত সঙ্গে যেত!
পদ্ম সরকারদের বাড়ির মেয়ে। বারো-তেরো বছর বয়েস। প্রায়ই এ বাড়িতে এসে বসে থাকে। খুবই বোকা মেয়েটা। বীথি নিশ্চয়ই ইচ্ছে করেই তাকে সঙ্গে নেয় না!
পদ্ম তো বকবক করে কানের পোকা বার করে দেয়। সেইজন্যই নিশ্চয়ই সঙ্গে নেয় না
পদ্মকে।
এর পর মা তাঁর অভিমানের অবধারিত বাক্যটি বললেন।
তোরাই সব বুঝিস! তোরাই সব জানিস!
মল্লিকপুরে বাস থেকে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে বীথি এসেছিল একদিন। মাকে প্রণাম করে বলেছিল, আমি এখানে থাকতে এসেছি। আমি স্বদেশের স্ত্রী।
মা আকাশ থেকে পড়েছিলেন। স্বদেশ? স্বদেশ কে?
ভাগ্যিস দ্বারিক বাড়ি ছিল সেই সময়। নইলে ভুল বোঝাবুঝির পর্ব আরও অনেক দূর গড়াত।
তার মাত্র একমাস আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দ্বারিক ফিরেছে। যুদ্ধে আহত সেনানীর মতন ক্ষতস্থান শুকোচ্ছিল সে তখন। একটু সুস্থ হলে আবার যুদ্ধে ফিরে যাওয়ার সংকল্প ছিল।
দ্বারিক তাড়াতাড়ি বলেছিল, আসুন, ভেতরে এসে বসুন।
দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে মাকে বলেছিল, স্বদেশ হচ্ছে আমাদের ভুতো।
ভুবন হালদার ছেলে-মেয়েদের নাম রেখেছেন খুবই পুরোনো ধরনের। দ্বারিকের ছোটোভাইয়ের নাম অম্বিকা। ডাকনাম ভুতো। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর ভুতো তার দুটো নামকেই অপছন্দ করত খুব। আত্মগোপন করে থাকবার সময় সে নিজেই ছদ্মনাম নিয়েছিল স্বদেশ। সেই নামেই পুলিশ, খবরের কাগজ ও বন্ধুবান্ধবরা অনেকে তাকে চেনে।
একে একে ভুলোর ইউনিটের প্রায় সকলেই ধরা পড়েছে বা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, কিন্তু ও বার বার পুলিশের ফাঁদ ডিঙিয়ে পালিয়ে গেছে। জেলে বসে দ্বারিক অনেকবার বাইরে খবর পাঠিয়েছিল, ভুতো শুধু শুধু দুঃসাহসিকতা না দেখিয়ে, যেন প্রকাশ্যে, খবরের কাগজের লোকদের জানিয়ে ধরা দেয়। জেলটাই তখন তার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা, কারণ তার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তখন অনেকেই ব্যস্ত। তবু ধরা দেয়নি ভুতো।
স্বদেশের সঙ্গে আপনার কোথায় পরিচয়?
বহরমপুরে, একসময় কয়েক মাস আমাদের বাড়িতে ছিল।
এ খবরও সঠিক। দ্বারিক যথা সময়ে খবর পেয়েছিল, ভুতো বহরমপুরে লুকিয়ে আছে। ওদিকে তাদের বেশ শক্ত ঘাঁটি ছিল।
আপনার বাবা উকিল?
হ্যাঁ ছিলেন।
উনি–
মারা গেছেন।
মানে, ওঁকে কি…
না, সেসব কিছু নয়। হার্ট স্ট্রোক।
দ্বারিক যেন একটু নিশ্চিন্ত হয়েছিল। ভুতোকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে সেই উকিল ভদ্রলোক খুন হতেও পারতেন। পার্টির ছেলেদের মুখে দ্বারিক শুনেছে, ভদ্রলোক খুব উৎসাহী আর তেজস্বী ছিলেন। ওকালতির দিকে তেমন ঝোঁক ছিল না, সমাজসেবা করতেন।
কতদিন আগে?
এই তিন মাস।
মা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না তখনও। চোখ দুটো যেন কপালে উঠে গেছে।
কী বলছিস তোরা? ভুতো বিয়ে করেছে? কবে? আমরা কিছু জানলাম না?
দ্বারিক বুঝতে পারছিল, এই মেয়েটির সঙ্গে তার কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার মায়ের আড়ালে। সব কথা মায়ের সামনে আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু মাকে এখন চলে যেতে বলাও অসম্ভব। মা একটা সাংঘাতিক খবর শুনেছেন।
সেসময় আপনার বাবা বেঁচেছিলেন?
আমাদের বিয়ের সময়? হ্যাঁ…উনি কলকাতা থেকে ওঁর এক বন্ধু ম্যারেজ রেজিস্ট্রার, তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বহরমপুরে…বাবা অবশ্য গোড়ায় একটু আপত্তি করেছিলেন, বলেছিলেন এখনই বিয়ের দরকার নেই, আরও কিছুদিন বাদে, কিন্তু আমরা দুজনেই বলেছিলাম…বিশেষত স্বদেশ।
দ্বারিকের বুকের মধ্যে এমন শব্দ হচ্ছিল যেন বাইরের সবাই শুনতে পাবে। সে বীথির মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। ভুতোর বিয়ের খুব ক্ষীণ একটা গুজব সে শুনেছিল, সে সেটাকে গুজব বলেই ধরে নিয়েছিল।
মা জিজ্ঞেস করলেন, ভুতো আমাদের কিছু জানালো না?
সেসময় আপনাদের কাছে চিঠি পাঠানো ওঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
কেন একখানা পোস্টকার্ডও লিখতে পারেনি?
মায়ের গলায় ঝাঁঝ টের পেয়ে দ্বারিক বলেছিল, তুমি ভুলে যাচ্ছ মা আজ, যখন-তখন আমাদের বাড়ি সার্চ হত…ভুতোর চিঠি পেলে হয়তো তোমাদেরও ধরে নিয়ে যেত থানায়।
তখন না হয় দেয়নি, কিন্তু তারপর এতগুলো দিন কেটে গেল।
চুপ!
কথাবার্তা তক্ষুনি বন্ধ করে দিতে হয়। বাইরে কারা যেন এসেছে।
এসেছিলেন বলাইকাকা। উনি এসেছিলেন গ্রামের নিন্দাকাতর বা অতি-কৌতুহলীদের প্রতিনিধি হয়ে। একটি অচেনা মেয়ে একলা একলা এসেছে দ্বারিকদের বাড়িতে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গল্প আছে। সে-গল্পটা তক্ষুনি তক্ষুনি না জানলে নয়।
দ্বারিক বলেছিল, মা, এঁকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও। আমি বলাইকাকাদের সঙ্গে কথা বলছি।
কারোকে পছন্দ না করলেও মুখের ওপর সে-কথা বলা যায় না। দ্বারিক একথাও বলতে পারেনি যে, বলাইকাকা, আমরা এখন খুব ব্যস্ত আছি, আপনি এখন চলে যান।
বলাইকাকা দ্বারিকের ঘরে বসে কথা তুলেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে।
তোমার সঙ্গে তো সত্যকিঙ্কর সেনের খুব খাতির। ওঁকে বলে আমাদের এই মোরামডাঙায় একটা ডিপটিউবওয়েল বসাবার ব্যবস্থা করে দাও এবার! গাঁয়ের লোক তোমার ওপর ভরসা করে আছে।
আমার সঙ্গে সত্যকিঙ্কর সেনের খাতির আছে?
এখন তো সব মিটমাট হয়ে গেছে তোমাদের মধ্যে!
কীসের মিটমাট?
আহা, তোমরা তো একসময় এক পার্টিরই লোক ছিলে! তুমি একটা অনুরোধ করলে সে কথা কি ফেলতে পারবে?
সত্যকিঙ্কর সেন স্থানীয় এম এল এ। একসময় দ্বারিক ওঁদের পার্টির কর্মী ছিল ঠিকই। সত্যকিঙ্কর সেনের কাছেই দ্বারিকের রাজনীতির দীক্ষা। কিন্তু তারপর এতদিনে দু-জনের পথ সম্পূর্ণ দু-দিকে চলে গেছে। হঠাৎ দেখা হলে সত্যকিঙ্করবাবু দ্বারিককে দেখে নিশ্চয়ই মুখ ঘুরিয়ে নেবেন। সত্যকিঙ্করবাবুরা একসময় দ্বারিকদেরই সবচেয়ে বড়ো শত্রু বলে মনে করতেন। দ্বারিকের দলের অনেক ছেলেরা এখনও নিজেদের বাড়িতে যে ফিরতে পারছে না, তার কারণ সত্যকিঙ্করবাবুর দলের ছেলেরা এখানে বদলা নেওয়ার কথা বলে। দ্বারিককেও তারা এখনও ছেড়ে দেবে কিনা তার ঠিক নেই। দ্বারিক ওদের এড়িয়ে চলে পারতপক্ষে। এসব কথা বলাইকাকাকে বলে লাভ নেই।
এ-রকম অনুরোধ আমি করতে যাবই-বা কেন?
আমাদের গাঁয়ে ডিপটিউবওয়েলের দরকার নেই? রণকালীপুরে পর্যন্ত হয়েছে একটা।
দ্বারিক বুঝতে পেরেছিল, বলাইকাকা আলগা আলগাভাবে কথা বলছিলেন মাত্র, আসলে কান খাড়া করে ছিলেন বাড়ির ভেতরের কথাবার্তা শোনবার জন্য।
আপনারা ব্লক অফিসে দরখাস্ত পাঠান।
ওসব দরখাস্ত অনেকবার দেওয়া হয়েছে…ভেতর থেকে তদবির না করলে..কংগ্রেসই বল আর বামপন্থীই বল, যে সরকারই হোক…
বিদায় নেওয়ার সময় বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে বলাইকাকা আসল কথাটি বলে দিলেন।
তোমাদের বাড়িতে একটি মেয়ে এসেছে কলকাতা থেকে..রাস্তায় লোককে এবাড়ির কথা জিজ্ঞেস করছিল।
হ্যাঁ। এসেছে, একটি মেয়ে।
আগে দেখিনি কখনো।
একটু আগে বলাইকাকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দ্বারিক দু-তিনরকম কৈফিয়ত বানিয়ে রেখেছিল। কিন্তু হঠাৎ তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। একটা বাজে লোকের কাছে সে কেন অকারণে মিথ্যেকথা বলবে?
ওই মেয়েটি আমাদের ভুতোর বউ!
শাঁখ বাজল না, গ্রামের মেয়েরা উলু দিল না, অথচ গ্রামে একজন নববধূ এল। এটা লোকের জিভের খোরাক হিসেবে চলেছিল বেশ কিছুদিন।
দ্বারিক আর বেশি জেরা করেনি বীথিকে। বরং বীথির পক্ষ নিয়ে সে মাকে, বাবাকে বোঝাবার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল। যদিও ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক। হুট করে এ রকমভাবে কেউ আসে না। আগে থেকে একটা খবর দিল না। সঙ্গে অন্য কেউ এল না, এতে সন্দেহ তো হবেই। এমনকী পুলিশের স্পাই হওয়াও বিচিত্র ছিল না। পুলিশ এ-রকম অনেক অদ্ভুত কাজও করেছে।
কিন্তু সত্যের একটা আলাদা ধ্বনি আছে। যা শুনলেই বোঝা যায়। বীথি নিরুপায় হয়েই এসেছিল।
বীথি তখন ছ-মাসের গর্ভবতী।
বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় বীথিরা বেশ অসুবিধেয় পড়েছিল। তার দাদা আজও জেলে। মা অনেক দিনের পুরোনো হাঁপানি রুগি। বাড়িতে বীথির আর একটি ছোটোবোনের বয়েস মাত্র তেরো, এইরকম অবস্থায় ওদের ফেলে হঠাৎ পৃথিবী থেকে প্রস্থান করলেন ওর বাবা।
বীথির কাছে ভুতোর লেখা এগারোখানা চিঠি আছে। সেগুলো দ্বারিককে পড়তে দিতে চেয়েছিল বীথি, দ্বারিক রাজি হয়নি। ম্যারেজ সার্টিফিকেটও বীথি সঙ্গে করে এনেছিল অবশ্য। কিন্তু সেটা তো আর হাতে করে নিয়ে গ্রামের সব লোককে ঘুরিয়ে দেখানো যায় না। তাই, বাড়িতে আর একটা ছোটোখাটো উৎসব করার জন্য মায়ের প্রস্তাবে রাজি হতে হয়েছিল দ্বারিককে। এমনকী একজন অশিক্ষিত পুরুত এসে কিছু মন্ত্রও পড়ে দিয়ে গেল পর্যন্ত। যে অনুষ্ঠানে স্বামী অনুপস্থিত, সেখানেও বিয়ের মন্ত্র উচ্চারণ করার মতন আলাদা মন্ত্র থাকতে পারে?
মা অবশ্য বীথিকে মেনে নিতে খুব বেশি দেরি করেননি। দু-দিকেই আড়ষ্টতা কেটে গিয়েছিল। বীথিকে দেখে মায়ের আশা হয়েছিল, এবার শিগগিরই নিশ্চয়ই ভুতো ফিরবে! ভুতো যাতে খুশি হয় সেইজন্য মা বেশি বেশি আদর-যত্ন করতে লাগলেন বীথিকে।
বাবাকে বিশেষ কিছু বোঝাতে হয়নি। দুই ছেলে আত্মগোপন করে থাকবার সময় পুলিশ যখন-তখন এসে ভুবন হালদারকে থানায় ধরে নিয়ে গেছে। ভুবন হালদার নিরীহ মানুষ, সেই ধরনের মানুষ, যাদের কোনো পুলিশের সঙ্গে সারাজীবনে একবারও দেখা হওয়ার কথা নয়। পুলিশের নানান কৌশলের জেরা ও অত্যাচার বেশিদিন সহ্য করতে পারলেন না ভুবন। মাথার ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। এখন সবাই তাঁকে একটি আধপাগলা বুড়ো হিসেবে ধরে নিয়েছে। বীথিকে দেখে ভুবন হালদার কোনো উচ্চবাচ্যই করলেন না। তবে, এক-এক সময় তিনি বীথিকে দ্বারিকের বউ বলে ভুল করে ফেলেন আর মার কাছে বকুনি খান।
দুই ছেলের মধ্যে মা ভুতোকেই বেশি ভালোবাসেন। কনিষ্ঠ সন্তানের প্রতি মায়ের বেশি টান থাকা স্বাভাবিক। দ্বারিক এটা বোঝে। তা ছাড়া ভুতোর চরিত্র অনেক বেশি ঝলমলে, সে
জোরে কথা বলে, চিৎকার করে হাসে, পায়ে দড়ি না বেঁধেও সে নারকেল গাছ চড়েছে, সে এক ডুব দিয়ে অন্তত পাঁচ-সাত মিনিট পুকুরের জলের তলায় থাকতে পারে। এ ছাড়া, ভুতো ন্যাশনাল স্কলার হয়েছিল। শুধু এ গ্রামে নয়, এই মহকুমায় সে-ই প্রথম। সে তুলনায় দ্বারিকের অনেক ঠাণ্ডা মাথা, সে অচঞ্চল। মা ভরসা করেন দ্বারিকের ওপর, কিন্তু ভালোবাসেন বেশি ভুতোকে।
দ্বারিকও মাকে বুঝিয়েছিল, এবার ভুতো ফিরে আসবে শিগগিরই।
ডিপটিউবওয়েলের দাবির দরখাস্ত নিয়ে গ্রামের লোক দল বেঁধে গিয়েছিল এম এল এ-র কাছে। প্রতিবেশীদের পীড়াপীড়িতে যেতে হয়েছিল দ্বারিককেও।
সত্যকিঙ্কর যেন বিস্ময়কর ব্যবহার করেছিলেন দ্বারিকের সঙ্গে। একসময় উনি দ্বারিককে তুই বলতেন, সেদিন তুমি। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এসো, এসো দ্বারিক। আমি নিজেই ভাবছিলাম একদিন তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাব। তুমি নাকি একটা স্কুলে পড়াচ্ছ এখন?
দ্বারিক বলেছিল, বাবা যে স্কুল থেকে রিটায়ার করেছেন, সেখানেই আমি কিছুদিনের জন্য স্টপ গ্যাপ।
কেন, স্টপ গ্যাপ কেন?
গভর্নমেন্ট এইডেড স্কুল, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে রেগুলার ওয়েতে লোক নিতে হয়।
তুমি লোকাল ছেলে, তোমারই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। তা ছাড়া তুমি ছাত্র হিসেবেও ভালো ছিলে…ওটা রেগুলার করে নিতে কোনো অসুবিধে হবে না মনে হয়।
এই কথা বলে সত্যকিঙ্কর সেন কি একটু সূক্ষ্মভাবে হেসেছিলেন? দ্বারিক বোঝার চেষ্টা করছিল, উনি বিদ্রুপ করছেন কিনা। উনি কী বলতে চাইছেন, খুব তত বিপ্লবীপনা দেখিয়ে অনেক অ্যাডভেঞ্চার করেছিলি, এবার স্কুল মাস্টারি নিয়ে শান্তশিষ্ট হয়ে থাক। তোরাই-না স্কুল-কলেজ পুড়িয়েছিস? তোরাই-না বলেছিলি, স্কুল-কলেজে যে-শিক্ষা দেওয়া হয়, তা সবই ভুয়ো!
কিন্তু কোনো ব্যঙ্গের আভাস দ্বারিকের চোখে পড়েনি। বরং উনি তো দ্বারিককে কিছু সাহায্য করার জন্য আন্তরিকভাবেই উদগ্রীব। ভাবখানা এই, পুরোনো শত্রুতা ভুলে গিয়ে এসো, আমরা পাশাপাশি কাজ করি। দ্বারিক তৈরি হয়েছিল, উনি কোনোরকম বাঁকা কথা বললেই সে উত্তর দেবে, বিপ্লবের পথ ছেড়ে আপনারাও তো এখন…বিপ্লবের কথা উচ্চারণ করতেই লজ্জা পান।
শরীর ঠিক আছে তোমার, দ্বারিক? বড্ড রোগা দেখাচ্ছে। অবশ্য আমি অনেকদিন পর দেখলাম।
হ্যাঁ, আমার শরীর ঠিক আছে।
ডিপটিউবওয়েল বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা হল। আলোচনা অনেকখানি সন্তোষজনক। আগামী বাজেটে আড়াইশো ডিপটিউবওয়েল খোঁড়ার ব্যবস্থা থাকছে, তার মধ্যে একটি মোরামডাঙায়।
গ্রামের লোকদের উদ্দেশ্যে সত্যকিঙ্কর বললেন, আপনারা একটু বসুন, দ্বারিকের সঙ্গে আমার আলাদা একটা কথা আছে। দ্বারিক একটু পাশের ঘরে আসবে?
এই এলাকার অবিসংবাদী নেতা সত্যকিঙ্কর সেন এখন প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায় পৌঁছেছেন। বিয়ে করেননি। ছোটো দোতলা বাড়িতে দাদার সংসারে অতিথির মতন থাকেন। মাটি ও মানুষের সঙ্গে কিছুটা যোগ আছে। শোনা যায়, উনি ইচ্ছে করলেই মন্ত্রী হতে পারতেন, এবং ইচ্ছে করেই হননি।
অম্বিকার খবর কী?
দ্বারিক জানত, সত্যদা এইকথাই জিজ্ঞেস করবেন। অম্বিকা অর্থাৎ ভুতো একদিন ওঁদের মধ্যে সত্যিই সন্ত্রাস জাগিয়েছিল। ভুতো দুঃসাহসী, ভুতো হঠকারী। সত্যদা দ্বারিককে ভালোভাবে চেনেন, প্রায় নিজের হাতেগড়া কর্মী, কিন্তু ভুতো প্রথম থেকেই উগ্রপন্থী। দ্বারিকের মতন ছেলেরা নীতি নির্ধারণ করে। আজকের নীতি কালকে বদলায়। কিন্তু ভুতোর মতন ছেলেরা যখন যা বিশ্বাস করে, তক্ষুনি সেটা কাজে পরিণত করতে নেমে পড়ে। একটা ঘটনা ঘটে গেলে, সেটা আর পালটানো যায় না।
অনেকদিন কোনো খবর পাইনি!
এখন তো আর তার পালিয়ে থাকার কোনো দরকার নেই। সে তো এখন অনায়াসেই ফিরে এসে…
অনায়াসে ফিরতে পারে? আপনি বলছেন?
কেন ফিরতে পারবে না?
জেল থেকে অনেকেই ছাড়া পেয়েছে বা পাবে, কিন্তু যাদের নামে ওয়ারেন্ট ছিল, সেগুলো তো তুলে নেওয়া হয়নি এখনও।
ওটা একটা ফর্মালিটি মাত্র…তুমি তো জান, পুলিশ অনেকের নামেই ক্রিমিনাল চার্জ দিয়েছিল…বাছাই না-করে তো সমস্ত ক্রিমিনাল চার্জ একসঙ্গে তুলে নেওয়া যায় না, তুমিই বলো, যায়? কিন্তু পলিটিক্যাল প্রিজনারদের ক্ষেত্রে…
অর্থাৎ ছাড়া পেতে গেলে ভুতোকে আগে প্রিজনার হতে হবে? সেটাই বোধ হয় সে চায়নি। তা ছাড়া..
ওয়ারেন্ট থাকলেও বোধ হয় অম্বিকাকে পুলিশ এখনও ধরবে না, সে বাড়ি ফিরলে পুলিশ বড়োজোর তাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেই চলে আসবে…অন্তত ভয় পাওয়ার মতন যে কিছু নেই, তা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।
দ্বারিকও একথা জোর দিয়ে বলতে পারে। যে ভুতো আগেও কোনোদিন ভয় পায়নি, সুতরাং তার ভয় পাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। একেবারে ভয় না পাওয়াটাই ভুতোর চরিত্রের প্রধান দোষ। বুদ্ধিমান পরিশীলিত স্বভাবের মানুষমাত্রই কিছু-না-কিছুকে ভয় পায়।
শুনলাম সে বিয়ে করেছে। তুমি বড়োভাই, তোমার বিয়ে হল না, তার আগেই অম্বিকা বিয়ে করে ফেলল?
সত্যদা সব খবর রাখেন, অর্থাৎ তাঁর দলের ছেলেরা এখনও ভুতোর ব্যাপারে রীতিমতন সজাগ। দ্বারিকের এই চিন্তাটা বুঝে ফেলেই যেন সত্যদা সঙ্গে সঙ্গেই আবার বললেন, তোমাকে আরও একটা কথা আমি জানিয়ে দিতে চাই, আমার দলের ছেলেরা অম্বিকাকে একদমই ঘাঁটাবে না। এ বিষয়ে তোমার মনে কোনোরকম সন্দেহ রেখো না। জানিয়ে দিতে পার।
আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই অনেকদিন।
যাই হোক, তবু আমি জানিয়ে দিলাম। যে সত্যিকারের কাজ করতে চায়, তার পক্ষে লুকিয়ে থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়ে কি কোনো কাজ করা এখন সম্ভব? তার তো কিছু দরকারও নেই? আমি তোমাকে–।
সত্যকিঙ্কর হঠাৎ থেমে গেলেন। ওঁর গলাটা কি একবার হঠাৎ কেঁপে উঠল? দ্বারিকের মনে হল, সত্যকিঙ্কর যেন হঠাৎ টেবিলের ওপরে থেকে ঝুকে হাত বাড়িয়ে দ্বারিকের কাঁধ ছুঁয়ে বলবেন, দ্বারিক, তোকে আমি কত ভালোবাসতাম! তুই আমার নিজের হাতেগড়া, তোর বি এস সি পরীক্ষার আগে আমি নিজে তোকে পড়িয়েছি, আর আজ আমরা পরস্পরের শত্রু? কেন? আমাদের বিশ্বাস তো একই। লক্ষ্যও এক। আয় আমরা আবার হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করি, সামনে কত কাজ রয়েছে।
কিন্তু সত্যকিঙ্কর এসব কিছুই বললেন না। চুপ করে বসে রইলেন। দ্বারিক আবার ভাবল, কেনই-বা সত্যদা ওভাবে কথা বলবেন তার সঙ্গে। সে একসময় ওঁকে সত্যদা বলে ডাকত। আজ সে একবারও সেরকমভাবে সম্বােধন করেনি। অবশ্য, সত্যকিঙ্করবাবু বলে ডাকটাও তার মুখে আসছে না ঠিক। তাই সে কোনোরকম সম্বােধনই করেনি এ পর্যন্ত। সেটা কি সত্যকিঙ্কর লক্ষ করেননি?
দ্বারিক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তা হলে আজ—
সত্যকিঙ্কর বললেন, অম্বিকা সম্পর্কে আমি আরও একটা খবর শুনেছিলাম—
কী?
না, থাক। সেটা হয়তো নিছক উড়োকথা, কোনো কনফার্মেশন নেই, সেসব নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো।
দ্বারিক আর কোনোরকম কৌতূহল দেখালো না।
পরে, গ্রামে ফেরার পথে আকস্মিকভাবে জল এসে গেল তার চোখে। তার এই দুর্বলতায় নিজে সে অবাক হয়ে গেল দারুণভাবে। এটা ঠিক কান্না নয়। কান্না ছাড়াও অন্য একরকমের চোখের জল আছে।
যাতে কেউ দেখতে বা বুঝতে না পারে, তাই দ্বারিক একটা সিগারেট ধরালো মুখ নীচু করে।
বীথি কেন এসেছিল, তা দ্বারিক বুঝতে পারে। কিন্তু বীথি থেকে গেল কেন, তার কারণটা আজও দ্বারিকের কাছে দুর্বোধ্য লাগে। এ গ্রামের নিস্তরঙ্গ বিস্বাদ জীবন কী করে ভালো লাগতে পারে বীথির? এক-এক সময় তো দ্বারিকেরই অসহ্য লাগে আজকাল, অথচ তার জন্ম এখানে, সে এই সব কিছুর মধ্যে বড়ো হয়ে উঠেছে, সব কিছু তার চেনা। বীথি তো শহরের বাইরে কখনো থাকেনি। রোমান্টিক গ্রাম-বিলাস নিয়ে যারা আসে, তাদেরও দু-দশ দিন মাত্র ভালো লাগতে পারে, মাসের পর মাস সেই ভালো লাগা তো টেকে না।
এখানে আসবার মাস দু-এক পরই বীথি প্রথমবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় উঠোনে।
এ গ্রামে হেলথ সেন্টার নেই, কোনো ডাক্তারও নেই। মল্লিকপুর থেকে ধ্যানেশ ডাক্তারকে ডেকে এনেছিল দ্বারিক। তিনি এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এনার কি আগেও ফিট হয়েছিল কখনো?
ধরনটা এপিলেপসিরই মতন। দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। মুখটা ব্যথায় নীল। মা কালোজিরে পুড়িয়ে গন্ধ শুকিয়েছিলেন, কোনো লাভ হয়নি।
পরে খানিকটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর বীথি বলেছিল, না আগে তার কখনো এ রোগ ছিল না।
ধ্যানেশ ডাক্তার খানিকটা দার্শনিক ধরনের। পুরোনো আমলের এল এম এফ মুখ ভরতি পাকা দাড়ি। তিনি দাড়ি চুমরোতে চুমরোতে কথা বলেন। তিনি বললেন, গ্রামের মেয়েদের বাড়ির আঁতুড়ঘরেই বাচ্চা-কাচ্চা হয়, ঠিকঠাক হয়ে যায়। শহরের মেয়েদের জন্য লাগে নার্সিং হোম, হাসপাতাল। যারা সিমেন্টের মেঝেতে সর্বক্ষণ পা দিয়ে হাঁটে, ফ্যানের তলায় যাদের শোওয়া অভ্যেস, তাদের জন্য লাগে সিমেন্টের আঁতুড়ঘর, তাদের পেটের ছানাটার জন্যও ফ্যানের হাওয়ার দরকার। প্রকৃতির এই নিয়ম, বুঝলে? বউমাকে তুমি এ সময়টায় বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও।
বীথি যেতে রাজি হয়নি। সে বলেছিল, ও ঠিক হয়ে যাবে।
মা বলেছিলেন, বউমার মায়ের শরীর ভালো না, সেখানে গেলে বউমাকে কে দেখাশুনো করবে এখন। এখানে তবু আমি আছি–
দ্বারিক বুঝতে পেরেছিল যে একটা কিছু ভুল হচ্ছে। কিন্তু জোর করে সে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
নিজের জন্মের দিনটার কথা তো কারুর মনে থাকতে পারে না। কিন্তু ভুতো যেদিন জন্মেছিল দ্বারিকের মনে আছে, সে-দিনটার কথা। তাদের বাড়ির উঠোনে দরমার বেড়া দিয়ে বানানো হয়েছিল আঁতুড়ঘর। মা ছিলেন সেখানে। সারাদিন ধরে তুমুল বৃষ্টি, দিনের বেলাতেই চারদিক অন্ধকার। দ্বারিকের তখন বছর ছয়েক বয়েস, আর তার দিদির বয়েস এগারো। দিদিই রান্না-বান্না করছিল ক-দিন, তারপর বাসন্তীনগর থেকে এসেছিলেন এক পিসিমা। মা একটু উঃ আঃ করলেই বাবা দ্বারিককে বলতেন, যা, শিগগির কাদুকে ডেকে নিয়ে আয়। দ্বারিক অমনি ছুটে চলে যেত কুমোরপাড়ায়। কাদু এ তল্লাটের ডাকসাইটে দাই। সে এসেই গজগজ করত, তোমাদের বলিছি যে অমাবস্যার আগে কিছু হবেনি! তবু এত তরাস!
সেই বৃষ্টির দিনে, মাঝরাতে আঁতুড়ঘর থেকে ভেসে এসেছিল ওঁয়া ওঁয়া কান্না। কাদুই নাম রেখেছিল ভুতো। বাচ্চাকে গরম সেঁক দিতে দিতে সে বলেছিল, ঘোর অমাবস্যার রাতে এল বাপ আমার! ভুতোবাবু! ভুতোনাথ। ভুতোগোবিন্দ। বেঁচে থাকো, রাজা হও!
দ্বারিকের স্পষ্ট মনে আছে সব।
কিন্তু এখন ওই উঠোনেই আবার দরমার বেড়া দিয়ে আঁতুড়ঘর বানিয়ে সেখানে ভুতোর সন্তান জন্মাবে, এটা যেন সে বিশ্বাসই করতে পারে না। ধ্যানেশ ডাক্তার ঠিকই বলেছেন, তার মনে হয়।
বীথির আত্মীয়স্বজনের দিক থেকে একবার মাত্র এক মামা ও বীথির ছোটোবোন এসেছিল দু-দিনের জন্য। দ্বারিক তখন সামান্য আভাস দিয়েছিল, বীথি যদি ওদের সঙ্গে গিয়ে কিছুদিনের জন্য তার বাপের বাড়িতে থেকে আসে। বীথি রাজি হয়নি।
বীথি দ্বিতীয়বার অজ্ঞান হল পুকুরঘাটে, সন্ধ্যে বেলা। ভাগ্যিস মা সঙ্গে ছিলেন আজ। যদি বীথি একলা থাকত, তাহলে হয়তো গড়িয়ে পড়ে যেতে পারত জলে। কিংবা একা অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকত, অনেকক্ষণ কেউ জানতেও পারত না।
বীথির পা পিছলে যায়নি, এমনিই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে ঝুপ করে বসে পড়ে হঠাৎ তারপর মাটিতে গড়াতে থাকে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল তার পেটে, যন্ত্রণার চোটে সে তার ডান বাহু কামড়ে ধরেছিল।
মা বুঝেছিলেন, ওটা প্রসব ব্যথা নয়, অন্য কোনো ব্যথা।
গ্রামে কোনো কিছুই গোপন থাকে না, বীথির অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার খবরও গোপন থাকেনি। অমনি কিছু লোক এর মধ্যে একটা ভূতের গল্প চালাবার চেষ্টা করল। বীথির গায়ে নিশ্চয়ই ভূতের ছোঁয়া লেগেছে। একটা জারুলগাছের ভাঙা ডাল পড়েছিল পুকুরপাড়ে। সেটা নাকি আপনা আপনি নীচু হয়ে ঝাপটা মেরেছিল বীথির মাথায়।
সৌভাগ্যক্রমে এই সময়ই হঠাৎ আশিস আর মলয় বেড়াতে এসেছিল এই গ্রামে। ভারি চমৎকার ছেলে দুটো, ওরা ভুতোর বন্ধু। ওদের মধ্যে আশিস সদ্য ডাক্তারি পাস করে দুর্গাপুরে একটা হাসপাতালে কাজ নিয়েছে।
দেখা গেল, ওরা বীথিকে আগে থেকেই চেনে। তুমি তুমি বলে কথা বলে। মলয় নাকি ভুতোর বিয়ের দিন উপস্থিত ছিল বহরমপুরে। ওদের পেয়ে দ্বারিক খুবই খুশি হল। বীথিকে নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় ছিল সে। বীথির সঙ্গে সব কথা সে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারে না। গ্রাম্য সংস্কারের ছোঁয়াচ থেকে বীথিকে মুক্ত রাখবার জন্য সে বদ্ধপরিকর অথচ প্রায়ই খানিকটা অসহায় বোধ করে। আশিস আর মলয় ভুলোর বন্ধু, ওরা বন্ধুর স্ত্রী ও সন্তান সম্পর্কে সঠিক ব্যবস্থা নিতে পারবে। তার ওপর আশিস আবার নিজেই ডাক্তার।
ছেলে দু-টির আর সবই ভালো, খুব সুন্দর স্বভাব, কিন্তু একটা শুধু অদ্ভুত ব্যাপার, ওরা ভুতোর সম্পর্কে খুব কম কথা বলে। প্রসঙ্গটা উঠলেই হুঁ হাঁ করে এড়িয়ে যায়। মা ওদের কাছে অন্তত হাজার বার ভুতোর কথা জিজ্ঞেস করেছেন, ওরা হেসে বলেছে, আপনি অত চিন্তা করছেন কেন মাসিমা? ঠিক এসে যাবে! এখনও সময় হয়নি।
মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমাদের সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছে ভূতোর, ঠিক করে বলো তো!
আশিস মলয়ের দিকে ফিরে বলেছিল, তোর সঙ্গে মাস খানেক আগেই দেখা হয়েছিল না?
মলয় বলেছিল, তারও কম, পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন আগে।
তাহলে কেন সে একবার এখানে আসে না?
আশিস বলেছিল, অনেকগুলো স্টেট থেকে মামলা ঝুলিয়েছে তো ওর নামে, শুধু আমাদের এখানে ছেড়ে দিলেই তো হবে না–
কেন চিঠি লেখে না আমাদের। আর তো পুলিশ আসে না।
আচ্ছা ওকে খবর পাঠিয়ে দেব, যাতে আপনাকে চিঠি লেখে খুব শিগগির।
বীথিকে আশিস হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার গায়ে নাকি পেতনির বাতাস লেগেছে?
বীথি উত্তর দিয়েছিল, হতেও পারে।
মলয় বলেছিল, পেতনিরা বোধ হয় টের পায়নি যে তুমি ভুতোর বউ! তাহলে আর তোমাকে ঘাঁটাতে আসত না!
তিনদিন পর ওরা দু-জন ফেরার সময় বীথিকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল দুর্গাপুরে। দু-দিন বাদে মলয় বীথিকে আবার পৌঁছে দিয়ে গেল। হাসপাতালে সব পরীক্ষা-টরীক্ষা করে দেখা হয়েছে সবই ঠিকঠাক আছে। অকারণ দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আশিস অনেক ওষুধপত্র ও টনিক পাঠিয়ে দিয়েছে বীথির সঙ্গে।
দিন পনেরো ভালো থাকার পর ফের এক সপ্তাহের মধ্যে দু-বার অজ্ঞান হল বীথি। রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে দ্বারিক একটা টেলিগ্রাম পাঠাল আশিসকে। সিমেন্টের আঁতুড়ঘর এবং ফ্যানের হাওয়ার নীচেই সে ভুতোর সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে চায়। ভুতো এখানে উপস্থিত থাকলে সে যা খুশি করতে পারত। দ্বারিক একা দায়িত্ব নিতে পারে না।
দ্বিতীয়বার আশিস আর মলয় এসে থাকল পাঁচদিন। সেই ক-দিন বীথি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকলেও দ্বারিক জোর করতে লাগল, বীথিকে শহরেই নিয়ে যেতে হবে। মা কিংবা বীথির কোনো আপত্তিতেই সে কান দিল না। এবার বীথির সঙ্গে সে নিজেও গেল দুর্গাপুরে। উঠল গিয়ে আশিসের কোয়ার্টারে। সেখানে আশিসের মা থাকেন, সুতরাং কোনো অসুবিধেই নেই।
দশদিন পর বীথি একটি মৃত কন্যা সন্তান প্রসব করল।
তারপরও দ্বারিক বীথিকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিছুদিন অন্তত সে বহরমপুরে তার মায়ের কাছে গিয়ে থেকে আসতে চায় কিনা। বীথি বলেছিল, না। আমি কাছাকাছি থাকলে মা তবু খানিকটা সান্ত্বনা পাবেন। ওঁর তো কথাবলারও কোনো সঙ্গী নেই।
এখানে মা অর্থে বীথির মা নয়, দ্বারিকের মা।
একটু থেমে বীথি আবার বলেছিল, শেষ চিঠিতে আপনার ভাই আমায় লিখেছিল, তুমি। মোরামডাঙায় আমার মায়ের কাছে থেকো। সেখানেই আমি প্রথমে ফিরব।
সময় থেমে থাকেনি। এরপরও কেটে গেল সাড়ে তিন মাস।