আলুসেদ্ধ দিয়ে গরম ফেনাভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ল দ্বারিক! বাড়িতে আগুন লাগাবার
ব্যাপারটা থানায় একবার খবর দিতেই হবে। খবর দিলেই যে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকার করবে কিংবা অপরাধীদের ধরে ফেলবে, দ্বারিক তা আশা করে না। কিন্তু পুলিশের মনোভাবটা কী, সেটা একবার জেনে আসা দরকার অন্তত।
বেরোবার আগে বীথিকে বলে গেল, সে কোথায় যাচ্ছে, সেটা মাকে না জানাতে। থানা পুলিশের নাম শুনলেই মা উত্ত্যক্ত হয়ে ওঠেন।
বীথিও বলল, এই রোদুরের মধ্যে অতদূর যাচ্ছেন কষ্ট করে?
দ্বারিক বলল, সাইকেলটা রয়েছে, যেতে কোনো অসুবিধে নেই।
নরবলির ব্যাপারে দ্বারিকের নামজড়ানো গুজবটা বীথি শুনেছে কিনা কিছু বোঝা যায় না। বীথি কক্ষনো উল্লেখ করেনি। তবে বাবা-মা বোধ হয় এখনও শোনেননি, তা হলে মা এতদিনে বাড়ি মাথায় করতেন। বীথিই সম্ভবত মাকে আগলে রাখছে।
সাইকেলটা পেয়ে দ্বারিকের মনে একটা ফুর্তির ভাব এসেছে। ছেলেবেলায় তাদের বাড়িতেও একটা সাইকেল ছিল। সেই সাইকেল চড়া নিয়ে ভুতোর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হত তার। একটু ফাঁক পেলেই ভুতো পালিয়ে যেত সাইকেলটা নিয়ে।
পেঁয়াজের চাষটা ভালো হলে দ্বারিকও একটা সাইকেল কিনে ফেলবে।
তেঁতুলিয়া মোড়ের কাছে বেশ ভিড়। কীসের যেন একটা পুজো চলেছে। এ গ্রামে এটাই বারোয়ারি পুজোর জায়গা। বছরের এ সময়টায় কোন পুজো হয়, দ্বারিক ঠিক খেয়াল করতে পারল না।
ভিড় ভেদ করে যেতে হবে, দ্বারিক ক্রিং ক্রিং করে ঘণ্টা বাজাতে লাগল। তাতেও সহজে ভিড় সরছে না দেখে সে নেমে পড়ল সাইকেল থেকে।
সেই নুয়ে পড়া অশ্বথগাছটার গুঁড়ির ওপর আজ আবার অনেকগুলো ছেলে উঠে দাঁড়িয়েছে। গাছটা হেলে পড়েছে অনেকখানি, কয়েকটা টাটকা শিকড় ছিড়ে গেছে দ্বারিক দেখেই বুঝতে পারল। বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে যে তেজস্বী গাছটা, তাকে এরা কিছুতেই বাঁচতে দেবে না।
দ্বারিক আজ আর ছেলেগুলোকে ধমক দিতে পারল না। তার সেই জোর নেই। সে কিছু বলতে গেলে অনেকে তার মুখের ওপর খেকিয়ে উঠতে পারে। সে অনুভব করতে পারছে, অনেকগুলো চোখের দৃষ্টি তার ওপর স্থির নিবদ্ধ।
একটা কথাও কেউ বলল না তার সঙ্গে।
এটাই সবচেয়ে অস্বাভাবিক চিহ্ন। গ্রামের পথ দিয়ে কেউ গেলে অন্য যার সঙ্গেই দেখা হবে, সেই কিছু-না-কিছু কথা বলবে। যত অপ্রয়োজনীয় কথাই হোক। কোথায় চললে—এ প্রশ্ন তো করবেই। কেউ সে প্রশ্ন করল না দ্বারিককে।
ভিড় একটুখানি ফাঁক হয়ে গেছে, তার মধ্যে দিয়ে সাইকেলসুদ্ধ হেঁটে যাচ্ছে দ্বারিক। আপনিই তার মাথা নীচু হয়ে গেছে, সে কারুর দিকে তাকাতে পারছে না। তার বুকের মধ্যে তীব্র অভিমান।
দু-তিন জন স্ত্রীলোক কান্নাকাটি করছে একসঙ্গে। আরও অনেক স্ত্রীলোক তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার নাম করে চেঁচামেচি করছে খুব। বহুকালের সংস্কার থেকে দ্বারিক জানে, কোনো বাড়িতে হঠাৎ কিছু বিপদ ঘটলেই এ-রকম হয়। বিপদ কাটাবার জন্য দৌড়ে আসে এখানে পুজো দিতে।
বড়োধরনের একটা কিছুই হয়েছে মনে হচ্ছে। কোন বাড়িতে?
দ্বারিক কারুকে জিজ্ঞেস করতে পারল না। অথচ তার দারুণ কৌতূহল হল। বিপদের কথা না-শুনে চলে যাওয়া যায়?
দ্বারিক থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে। যদিও তার বুকে-পিঠে বিধছে অনেক বিদ্বেষ আর ঘৃণার দৃষ্টি, তবু সে পালিয়ে যাবে কেন? এই গ্রামে সে জন্মেছে, এখানকার প্রতি ইঞ্চি মাটি সে চেনে, এখানে যেকোনো জায়গায় দাঁড়াবার অধিকার তার আছে।
পুজো হচ্ছে মনসার। মেয়েদের চিৎকার ও কান্নার মধ্য থেকে আসল খবরটা বার করার জন্য দ্বারিক কান পেতে রইল। একটি যুবতী মেয়ে কাঁদছে মাটিতে আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে। দ্বারিক চিনতে পারল তাকে। গোষ্ঠ ভট্টাচার্যর পুত্রবধূ।
গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের একমাত্র আদরের নাতিকে সাপে কামড়েছে আজ সকাল বেলা।
দ্বারিক শিউরে উঠল। এইসব গ্রামে-গঞ্জে সাপে কামড়ালে প্রায় কেউই বাঁচে না। সবসময় সাপের বিষে মরে না, অন্য মানুষরাই মেরে ফেলে। তা ছাড়া রয়েছে ভয়।
ছেলেবেলা থেকেই দ্বারিক সাপ দেখতে অভ্যস্ত। অ্যাবসকণ্ড করে থাকার সময় তাকে মাঝে মাঝে বনেজঙ্গলেও রাত কাটাতে হয়েছে। একবার প্রায় তারই সামনে অবনীদাকে সাপে কামড়াল। অসম্ভব মনের জোর অবনীদার। ছুটে গিয়ে তিনি নিজে সাপটাকে মারলেন। দ্বারিকদের ডেকে বললেন, এটা ঢ্যামনা সাপ। এ সাপের বিষ থাকে না। ছুরি দিয়ে পায়ের সেই জায়গাটা খানিকটা চিরে দিয়ে বললেন, দেখিস যেন আমি ঘুমিয়ে না পড়ি। আমার চোখবুজে এলেই আমায় ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিবি!
দ্বারিক বলেছিল, অবনীদা, তবু একবার ডাক্তার দেখানো দরকার, আমরা আরও চারজন আছি, তোমাকে বয়ে নিয়ে যেতে পারি। ঘণ্টা দুয়েকের তো রাস্তা।
অবনীদা বলেছিলেন, আমি মরে গেলে তোরা বয়ে নিয়ে যাবি নিশ্চয়ই, কিন্তু এক্ষুনি কি মেরে ফেলতে চাস নাকি? বললাম তো, এ সাপের বিষ নেই! শতকরা সাতানব্বইভাগ সাপই বিষাক্ত নয়, যেগুলোর বিষ আছে সেগুলোও সবসময় পুরোপুরি বিষ ঢালতে পারে না। মানুষ মরে ভয়ে।
পরদিনই অবনীদা দিব্যি সুস্থ লোকের মতো হাঁটাচলা করেছিলেন।
গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের নাতিকেও নিশ্চয়ই এরা ভয় দেখিয়েই মেরে ফেলবে।
দ্বারিকের মনে পড়ল, গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, তাঁর বাড়িতে কোনো ডাক্তার কবিরাজ ঢোকে না। তিনি নিজে চিকিৎসা করেন। বাচ্চাটাকে বোধ হয় তিনি ছাইগোলা খাওয়াচ্ছেন। অথচ, বিষাক্ত সাপে কামড়ালেও সময়মতন ইঞ্জেকশন দিয়ে সারিয়ে তোলা যায়।
পাঁচ বছরের ফুটফুটে বাচ্চাছেলেটা। সুন্দর টানা টানা চোখ, গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের ভীষণ আদরের। তবু নিজের দোষেই তিনি মারলেন ছেলেটাকে। ছেলেটার মা মনসার পুজো দিয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছে, মৃত্যুকালে বোধ হয় দেখতেও পাবে না ছেলেটাকে।
দ্বারিক খুব দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। তার মনে পড়ল গতরাত্রির কথা। তার নিজের বাড়িতে আগুন লাগবার বদলে যদি অন্য কারো বাড়িতে আগুন লাগত, ধরা যাক গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতেই, সেখানে দ্বারিক ছুটে গেলে কেউ নিশ্চয়ই অপবাদ দিত যে দ্বারিকই আগুন লাগিয়েছে। দ্বারিককে শাস্তি দেওয়ার এটাই সহজতম পথ।
তা বলে কি কারোর বাড়িতে আগুন লাগার খবর শুনেও দ্বারিক যাবে না? দ্বারিকের চোয়ালটা শক্ত হয়ে এল। সে যদি না যায়, তাহলে তার সারাজীবনের সব শিক্ষাই মিথ্যে।
দ্বারিক সাইকেলের মুখটা ফেরালো। নুটু ভাগ্যিস আজ সাইকেলটা রেখে গেছে। এ দিয়ে অনেক কাজ হবে। দ্বারিক খুব তাড়াতাড়ি মল্লিকপুরে গিয়ে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনতে পারে! সবচেয়ে ভালো হয়, ছেলেটাকেই সাইকেলের ওপর বসিয়ে চট করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া।
ওকে ঘুমোতে দেবেন না! জাগিয়ে রাখুন।
কালীমূর্তির সামনে পদ্মাসনে বসে আছেন গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই। পাশেই শুয়ে আছে ছেলেটা চোখ বুজে। জ্যাঠামশাই ওর মাথায় জল ঢেলে যাচ্ছেন। জ্যাঠামশাইয়ের ছোটোছেলে থাকে আসানসোলে, তাকে খবর পাঠানো হলেও সে কালকের আগে এসে পৌঁছোতে পারবে না।
কাঠের গেটটা বন্ধ। দ্বারিক সেটা ঠেলে খুলতে যেতেই গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোমার এখানে কী চাই?
অন্যরকম কণ্ঠস্বর। যেন তিনি দ্বারিককে চেনেনই না। ধোঁয়ায় বসে থাকার জন্য তাঁর চোখ দুটো লালচে।
জ্যাঠামশাই সাপের বিষের ভালো ওষুধ বেরিয়েছে আজকাল..একটা-দুটো ইঞ্জেকশন দিলেই।
তোমায় এখানে কে আসতে বলেছে? ভেতরে ঢুকো না।
জ্যাঠামশাই, এখন রাগারাগির সময় নয়…আমি ডাক্তার ডেকে আনতে পারি।
খোকা ভালো আছে। তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই।
ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন, সেটা খুব খারাপ, ওকে জাগিয়ে রাখুন।
ভেতরে ঢুকবি না! বেরিয়ে যা হতভাগা! বাড়িতে শুদুরের মেয়ে এনে বংশের সর্বনাশ করেছিস।
জ্যাঠাইমা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ওগো, তুমি চুপ করো। মাথাগরম কোরো না! বাবা দ্বারিক, তুমি বরং এখন যাও।
জ্যাঠাইমা, ছেলেটার চিকিৎসা হওয়া দরকার—এখনও সময় আছে।
উনি ওষুধ দিয়েছেন, তাতেই ভালো হয়ে যাবে!
গোষ্ঠ ভট্টাচার্য হুংকার দিয়ে বললেন, ও আমার ওষুধ ফেলে দিয়েছিল, এতবড়ো সাহস! ওকে দূর হয়ে যেতে বলো! আমি এ পাতকীর মুখও দেখতে চাই না!
দ্বারিক বলল, জ্যাঠামশাই, আমি অন্যায় করেছিলাম সেদিন, আমি আরও অন্যায় করেছি, কিন্তু ওই বাচ্চাটাকে একবার ডাক্তার দেখালে ভালো হত—আমি ডেকে নিয়ে আসব?
গোষ্ঠ ভট্টাচার্য আবার ঠাকুরের দিকে মুখ করে চোখ বুজে বসলেন। কোনো উত্তর দিলেন না।
জ্যাঠামশাই, জ্যাঠামশাই!
জ্যাঠাইমা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন দ্বারিকের দিকে। তাঁর মুখখানাতে যেন মাকড়সার জাল আঁকা। তিনিও আর কথা বললেন না একটাও।
ক্ষুণ্ণভাবে দ্বারিক ফিরে চলল, গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই নিজের জেদ বজায় রাখবেনই। সেদিন দ্বারিক ওঁর ওষুধ নিতে প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই ওঁর এত রাগ। সেই ছাইয়ের ডেলাটা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে পরে অন্য কোথাও ফেলে দিলেই হত। ওটাই দ্বারিকের ভুল হয়েছে।
এখন সে নিজে ঝুঁকি নিয়ে মল্লিকপুর থেকে ধ্যানেশ ডাক্তারকে ডেকে আনতে পারে। কিন্তু জ্যাঠামশাই যদি তাঁকেও বাড়িতে ঢুকতে না দেন! কারোকে সাপে কামড়ালে যদি তার বাড়ির লোক ডাক্তারকে খবর না দেয়, তবে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য কোনো আইন নেই? সেরকম কিছু থাকলেও সেই আইনকে লড়তে হবে কালীঠাকুর কিংবা মা-মনসার বিরুদ্ধে।
খানিকটা পথ আসবার পর দ্বারিক দেখল এক দঙ্গল মহিলা ফিরে আসছেন তেঁতুলিয়ার মোড় থেকে। মাঝখানে রয়েছেন গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই-এর ছোটোছেলের স্ত্রী। তাঁর চুল খোলা, শাড়ির আঁচলটা লুটোচ্ছে, চোখের দৃষ্টি জলে-ডােবা মানুষের মতন! দু-হাতে ধরা একটা মাটির সরায় প্রসাদ আর ফলমূল। এঁরা মা-মনসার কৃপা নিয়ে যাচ্ছেন।
এই মহিলাকে যদি বোঝানো যায় যে আপনার ছেলের চিকিৎসার দরকার। এখনও সময় আছে।
দ্বারিক ডাকল, ছোটোবউদি।
আসলে সে ডাকল মনে মনে, তার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। সে দাঁড়িয়ে রাস্তার একপাশে, মহিলারা তার দিকে ভ্রক্ষেপও করল না। চলে গেল তাকে পেরিয়ে, প্রায় ছুটতে ছুটতে।
শীতের পর প্রথম বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই সাপগুলো বেরিয়ে পড়ে। বহুদিন উপপাসের ফলে তারা খুব বদরাগি হয়ে থাকে এই সময়টায়। দ্বারিকের মনে পড়ল, তার যখন আট-ন বছর বয়েস, সেই সময় তারই এক খেলার সঙ্গী, লস্কর বাড়ির ছেলে শিবুকে সাপে কামড়েছিল। তখন ঠিক এইভাবেই মনসা পুজো দেওয়া হয়েছিল, প্রসাদের থালা হাতে নিয়ে ঠিক এইভাবে ছুটে গিয়েছিলেন শিবুর মা আর মাসি-পিসিমা। শিবু বাঁচেনি। তারপর একুশ-বাইশ বছর কেটে গেছে একটুও বদলায়নি এই গ্রাম।
কাজ শুরু করতে হবে, অনেক কাজ বাকি, কিন্তু ঠিক কোথা থেকে কাজ শুরু করতে হবে, সেটাই হচ্ছে কথা।
থানার এ এস আই সমর দাস যেন দ্বারিকের প্রতীক্ষাতেই ছিল। দেখামাত্র ব্যস্ত হয়ে বলল, আপনি এসেছেন! যাক, ভালোই হল, আমি নিজেই যাচ্ছিলাম আপনার বাড়িতে!
দ্বারিক একটু অবাক হয়ে বলল, আপনারা খবর পেয়েছেন তাহলে?
কীসের খবর?
আমার বাড়িতে কাল আগুন লাগাবার চেষ্টা হয়েছিল।
সমর দাস তার অভ্যেসমতো ভুরু তুলে বলল, আগুন লাগানো! না, সে খবর তো শুনিনি? কেউ মারা গেছে?
না, তা যায়নি অবশ্য। কিন্তু যেতে পারত। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
এ-রকম কেস তো এদিকে আগে হয়নি। আপনি ঠিক জানেন, দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল? অনেক সময় এমনি এমনি আগুন লাগে।
আমি এত দূরে এসেছি কি মিথ্যে খবর দিতে?
না, না, সেকথা বলছি না, অনেক সময় ভুল বা…দরজা বন্ধ ছিল অথচ কেউ মারা গেল না।
আমরা বাড়িসুদ্ধ ভেতরে পুড়ে মরলে কেসটা অনেক জোরালো হত বটে।
আ হা-হা, সে-কথা বলছেন কেন, ব্যাপারটা সিরিয়াস…আগুন লাগাবার চেষ্টা গোটাবাড়িটাই পুড়ে গেছে?
না, তাও যায়নি..ক্ষতি খুব বড়ো রকমের হয়নি—আওয়াজ শুনে আমার বাবা জেগে উঠেছিলেন…ওরা পালিয়ে যায়।
তা হলে বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি।
না, কিন্তু কিছু লোক আমাদের পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল…আবার চেষ্টা করতে পারে।
কারোকে সন্দেহ করেন?
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে দ্বারিক বলল, না।
আপনি ডায়েরি করবেন?
থানায় ঢোকার পর থেকেই দ্বারিকের মেজাজ বিগড়ে গেছে। এসেই মনে হল, না এলেই ভালো হত। এই পুলিশের কাছ থেকে সে কী সাহায্য পাবে? এরা তার বাড়ি রক্ষা করবে? এখনও হরিজনদের গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
থানাটাকেই তার একটা নোংরা জায়গা বলে মনে হয়।
অস্থিরতা কমাবার জন্য সে সিগারেট ধরাতে গেল। পকেটে সিগারেট আছে, কিন্তু দেশলাই আনতে ভুলে গেছে। সমর দাস নিজেই তার দেশলাই এগিয়ে দিয়ে বলল, এই যে নিন।
প্রথম টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কাশির দমক এসে গেল। কথা বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারল না কিছুক্ষণ। এবার তাকে কাশির চিকিৎসা করাতেই হবে ভালো করে।
একটু সামলে নিয়ে সে বলল, আপনারা আগুন লাগাবার খবর পাননি—তবু আমার বাড়িতে যাচ্ছিলেন কেন?
সমর দাস একটু ইতস্তত করে বলল, আপনি আমাদের বড়োবাবুর সঙ্গে একটু দেখা করুন।
কেন, কী ব্যাপার?
বড়োবাবু শশিভূষণ দে এদিককারই লোক। বেশ বড়োবাবুসুলভ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। অনেকদিন ছিলেন মুর্শিদাবাদের দিকে, সম্ভবত ধরাধরি করে এবার নিজের বাড়ির কাছে পোস্টিং নিয়েছেন। দু-বছর বাদেই রিটায়ার করবেন।
ভুবন মাস্টারের ছেলে না আপনি? মিসায় ছিলেন?
দ্বারিক বলল, না, মিসা নয়। পলিটিক্যাল আণ্ডারট্রায়াল প্রিজনার ছিলাম।
বেলে আছেন, না খালাস পেয়েছেন?
সব কটা ফলস কেস উইথড্র করে নেওয়া হয়েছে। আমরা আনকণ্ডিশনাল রিলিজ পেয়েছি।
দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন।
দেওয়ালের একটা পুরোনো ক্যালেণ্ডারে ইন্দিরা গান্ধীর ছবি। দারোগাবাবু বোধ হয় ক্যালেণ্ডারটা সরিয়ে ফেলতে ভুলে গেছেন। দ্বারিক বেপরোয়া ভঙ্গিতে সামনের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।
আপনার নামে তো আবার কমপ্লেন এসেছে…ডি এস পি সাহেব নোট পাঠিয়েছেন।
দ্বারিক ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, এবার আমি কী করেছি? ডাকাতি না রেপ? অথবা ছোটোমেয়ের গলা থেকে হার ছিনতাই?
বড়োবাবু ধমকের সুরে বলল, প্রায় দু-শো লোক সই করে পিটিশন পাঠিয়েছে—তাও আমার কাছে নয়, খোদ এস. পি. সাহেবের কাছে, তাতে আপনার নামে অভিযোগ আছে।
দ্বারিক কিছু বলবার আগেই সমর দাস বলল, স্যার, সেই যে নরবলির ব্যাপারটা, সেটা নিয়ে আরও ঘোঁট পাকিয়েছে…লোকে বলছে আমরা কোনো অ্যাকশন নিচ্ছি না—এদিকে কলকাতার কাগজে পর্যন্ত খবর ছেপেছে…পরশুদিন এখানে কী হয়েছে জানেন স্যার, এক ব্যাটা গরিব হিন্দুস্থানি, পুরোনো কাগজ-টাগজ বিক্রি করে, তাকেই ছেলেধরা সন্দেহ করে লোকে বেধড়ক পিটিয়েছে—ব্যাটা মরেই যেত আর একটু হলে।
দ্বারিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, নরবলির ব্যাপারে কিছু প্রমাণ পেয়েছেন? যে-ছেলেটি হারিয়ে গেছে, সে-ছেলেটির মা নিজে ওই মুন্ডুটা দেখে বলেছেন, ওটা তাঁর ছেলের নয় আপনার সামনেই বলেছিলেন।
সমর দাস বলল, আমার মতে কেসটা বোগাস। আমি ঝাড়গ্রামে পোস্টেড ছিলাম, আমি জানি, এভাবে কেউ নরবলি দেয় না…পুজো-টুজোর সময়ে বলি দেওয়ার ওল্ড ট্র্যাডিশন যেখানে আছে..সেখানে ছাড়া..মাটি থেকে জল বার করার জন্য এখনও হয় রাজস্থানে, সাউথের দিকেও হয় দু-একটা। কিন্তু আমাদের ওয়েস্ট বেঙ্গলে…আমি অন্তত বিশ্বাস করি না..ছেলেটার জন্য জোর খোঁজ লাগিয়েছি।
দরখাস্তটা একটু দেখতে পারি?
কে কে সই করেছে, দেখে নিতে চান? হয়তো দেখবেন, আপনার আত্মীয়দের মধ্যেই কেউ ইন্টারেস্টেড পার্টি আছে…তবে সেটা তো আমাদের কাছে নেই, বললাম না, এস. পি. সাহেবের দফতরে জমা পড়েছে, ডি এস পি সাহেব নোটে লিখেছেন, পিপল খেপে আছে এইসময় আমরা যদি কোনো অ্যাকশন না নিই তাহলে হঠাৎ বডােরকমের গোলমাল শুরু হয়ে যেতে পারে…তখন কৈফিয়ত দিতে আমাদের জান বেরিয়ে যাবে।
আপনারা আমাকে অ্যারেস্ট করতে চান?
আমরা কেন তা করতে যাব? ডি এস পি সাহেবের কাছে আপনাকে পাঠাবার হুকুম হয়েছে, তিনি আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, তারপর তিনি যা ভালো মনে করেন।
আপনার ডি এস পি-কে বলুন আমার বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি কেন যাব?
আরে বসুন, বসুন। উঠে পড়ছেন কেন? ওসব কথা আপনারা মাঠেঘাটে লেকচারে বলতে পারেন, কিন্তু থানায় বসে বলা চলে না। আমরা হুকুম তামিল করি মাত্র। আজই আপনাকে পাঠিয়ে দিতাম…কিন্তু গাড়ি নেই, গাড়ি গেছে সদরে..রাত্তিরটা এখানেই থাকুন, কাল সকালে যাবেন!
রাত্তিরটা আমি এই থানায় থাকব?
আপনাকে হাজতে নোংরার মধ্যে থাকতে হবে না। এক ব্যাটা আবার সেখানে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বমি করছে…আপনি এখানেই ঘরের মধ্যে বেঞ্চির ওপর শুয়ে থাকবেন…দিব্যি হাওয়া পাবেন।
সমর দাস বলল, আপনার পক্ষে সেটা তো ভালোই হবে…লোকে খেপে আছে…বললাম যাকে-তাকে ছেলেধরা ভেবে পেটাচ্ছে…হঠাৎ যদি আপনার ওপরে হামলা করে? আপনি নিজেই বললেন, আপনার বাড়িতে লোকেরা আগুন লাগাতে এসেছিল।
দ্বারিক চিৎকার করে বলল, আমি কক্ষনো এখানে থাকব না। আমার বাড়িতে শুধু দু-জন মেয়েছেলে…বাবা অসুস্থ…যদি ওরা আবার আসে…আমি এক্ষুনি বাড়ি ফিরে যেতে চাই।
বড়োবাবু বললেন, সেজন্য আপনি ব্যস্ত হবেন না, সে না হয় আমি খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। গ্রামের দফাদার আপনার বাড়ির ওপর নজর রাখবে…আপনি এখানে থাকুন। আপনার কিছু ভালো-মন্দ হলে তো জবাবদিহি করতে হবে আমাদেরই!
কোন অধিকারে আমাকে আপনারা আটকাচ্ছেন? আপনাদের কাছে ওয়ারেন্ট আছে আমার নামে?
কোশ্চেনিং-এর জন্য আপনাকে সদরে পাঠানো হবে, সেজন্য ওয়ারেন্ট লাগে? আপনি একটা পাকা লোক হয়ে এ-রকম কথা বলছেন?
আমি সত্যকিঙ্করবাবুর সঙ্গে এক্ষুনি একবার যোগাযোগ করতে চাই।
কোন সত্যকিঙ্করবাবু? এম এল এ? তাঁকে পাবেন কোথায়? তিনি তো এখন কলকাতায়।
দ্বারিক অনুভব করল, এরা যেন তিনদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে। তার পিঠের কাছে দেওয়াল। তার আর বেরোবার রাস্তা নেই। সে একা একদম একা। সাহায্যের জন্য সে কার কাছে হাত বাড়াবে?
আপনি চা খাবেন, দ্বারিকবাবু?
দ্বারিক গর্জন করে উঠে বলল, না!
দ্বারিকের ইচ্ছে করল মাথার চুল ছিড়তে। কেন সে এখানে এল! পুলিশকে শত্রু ছাড়া আর কিছুই ভাবেনি এতদিন, সেই পুলিশের কাছে সে কেন এসেছিল আগুন লাগাবার কথা জানাতে!
আমি না এলে আপনারা মোরামডাঙা থেকে আমাকে ধরে নিয়ে আসতেন?
ধরে আনতাম বলাটা ভুল। ডেকে আনতাম। ডি এস পি সাহেব আপনাকে ডেকেছেন।
চুলোয় যাক আপনার ডি এস পি!
মাথাগরম করবেন না, দ্বারিকবাবু। তাতে কোনো লাভ হয় না। যান না, ওনার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলেই আসুন না। মানুষটা খুব ভদ্রলোক।
এরা ইচ্ছে করলে দ্বারিকের হাতে হাতকড়া পরাতে পারে, ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দিতে পারে, তার বুকের ওপর বুটসুদ্ধ পা তুলে দাঁড়াতে পারে, ঠিক সাত বছর আগে যেরকম হয়েছিল। দ্বারিক কিছুতেই প্রতিরোধ করতে পারবে না। পুলিশের বিরুদ্ধে কার কাছে সে নালিশ জানাবে?
দ্বারিক ভয় পাবে না, তবু তার সারাশরীরটা সংকুচিত হয়ে এল। যদি হঠাৎ মারতে আসে, যে-করেই হোক চোখ দুটো বাঁচাতে হবে। মনে পড়ল, স্বপ্নে দেখা ভুতোর সেই কালো মুখখানা।
আপনি ওই বেঞ্চিটাতে বসুন। যদি সন্ধ্যের মধ্যে গাড়িটা এসে যায়, তাহলে আজই আপনাকে পাঠিয়ে দেব…না হলে রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেবেন—একটু কষ্ট হবে আপনার।
দ্বারিক পুলিশ দু-জনের ওপর থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছে না। এদের মুখের মিষ্টি কথাই সবচেয়ে ভয়ংকর, ঠিক মারবার আগের মুহূর্তে ওরা এ-রকমভাবে কথা বলে! এর চেয়ে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডি এস পি-র কাছে চলে যাওয়াই তবু ভালো। সে-জায়গাটা তবু শহর, সেখানে কিছু ঘটলে চট করে জানাজানি হয়ে যায়। শহর আর গ্রাম দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ। এখানে পুলিশ তাকে মারতে মারতে মেরে ফেলে যদি দেহটা বাইরে ছুড়ে ফেলে। দেয়, তাতেও কোনো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে না। তার নামে যেকোনো একটা অপবাদ চাপিয়ে দেবে। তা ছাড়া, সংঘর্ষ তো আছেই। শহরে পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের সংঘর্ষ হয় না, সবসময় হয় কোনো নাম না শোনা সুদূর গ্রামে। এখনও হয়।
দ্বারিক উঠে গিয়ে লম্বা বেঞ্চটায় বসল। পাশের একটা ঘর থেকে বমির ওয়াক ওয়াক শব্দ করছে কেউ। এরা দয়া করে তাকে ওই বমি-করা লোকটির সঙ্গে থাকতে দেয়নি। দয়া করে? অর্থাৎ এরা ওই লোকটাকেও সাক্ষী রাখতে চায় না। যা অত্যাচার, বা মারধোর করবে, সব এখানেই।
রামেশ্বর।
একজন হিন্দুস্থানি সেপাই এসে ঢুকল। বড়োবাবু তাকে বলল, দু-কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়। দ্বারিকবাবু। দ্বারিকবাবু, আপনি চা খাবেন না তাহলে?
শব্দ না করে দ্বারিক দু-দিকে মাথা নাড়ল। এরা চা খেতে খেতে, সিগারেট টানতে টানতেও মারে। কাটোয়ার একজন সাবইনস্পেকটর যখন তার পেটে লাথি মেরেছিল, তখন সেই লোকটা একহাতে একটা জিলিপি ধরে খাচ্ছিল একটু একটু করে। তারপর সেই জিলিপির রস-লাগা আঙুল দ্বারিকের চুলে মুছে নেয়।
বাড়িতে মা আজ আবার একটা তুমুল কান্নাকাটি শুরু করবেন। বীথি আছে, সে একা আর কতটা সামলাতে পারবে। তবু ভাগ্যিস বীথি আছে, বীথির জন্য মা তবু অনেকখানি শান্তি পেয়েছেন। বাবা প্রায় পাগল, মা যখন-তখন কান্নাকাটি করেন, দ্বারিক একা কিছুতেই সামলাতে পারত না সংসারটা।…নিশীথরা দ্বারিককে লিখেছিল কলকাতায় চলে আসতে…কলকাতায় গেলে ভালোই হত..নুটুও তাই বলল..কিন্তু ওরা কেউ তার বাড়ির কথাটা বোঝে না…বীথি, মা, বাবার কী ব্যবস্থা হবে..মা অনেক সংস্কার ত্যাগ করেছেন, জাতের ব্যাপারে আগে দারুণ গোঁড়ামি ছিল…দিদির বিয়ের সময় কোষ্ঠী মেলানো নিয়ে অনেক ঝাট করেছিলেন…রাঢ়ি আর বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের খুঁটিনাটি তফাতের জন্য অনেক সম্বন্ধ ভেঙে গিয়েছিল…সেই মা বীথিকে মেনে নিয়েছেন…প্রথম কিছুদিন বীথির হাতের জল খেতেন না…এখন আর সেসবও নেই…সরকার বাড়ির কুয়োর সামনে মা অন্যদের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করেছেন পরশুদিন…দ্বারিক নিজের কানে শুনেছে যে মা বলছেন, বামুন শুদ্র কি কারোর গায়ের চামড়ায় লেখা থাকে? কত বামুন দেখলাম…ঘেন্না ঘেন্না…আমার ছেলের এত ভালো বউ হয়েছে, তাই লোকের চোখ টাটাচ্ছে…। মা দ্বারিককে বলেছিলেন দ্বারিক, আমাদের বাড়িতে একটা হাত-টিউকল বসাতে পারিস না? কত খরচ লাগে? আমার একজোড়া বালা আছে এখনও…কেন পরের বাড়ি থেকে জল আনতে যাব…। আজ যদি বাড়িতে এসে কেউ আবার হামলা করে? দ্বারিক বাড়িতে নেই জেনে গেলে…আসলে মানুষের কোনো স্বাধীনতা নেই…এই যে থানায় তাকে জোর করে ধরে রাখা হল, এর বিরুদ্ধে সে কোনো আইনের ব্যবস্থাও নিতে পারবে না…প্রত্যেক অভিযুক্তেরই উকিলের সাহায্য নেওয়ার অধিকার আছে…কিন্তু এখানে উকিল কোথায়? এ তল্লাটে একটিও উকিল নেই…এরা তাকে অ্যারেস্ট করেনি, অথচ আটকে রেখেছে…গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের নাতি এখনও বেঁচে আছে তো?
মল্লিকপুরের ছেলেরা যেদিন ফিরল, সেদিন আপনি গিয়েছিলেন ওদের সঙ্গে দেখা করতে?
পুলিশ জেনেশুনেই এই প্রশ্ন করছে, তবু দ্বারিকের মুখে উত্তরটা শুনতে চায়। দ্বারিক নিঃশব্দে সম্মতি জানালো।
আবার দল-টল গড়ছেন নাকি? তা গড়ন, সে ভালোকথা, কিন্তু স্কুল-স্টুল পোড়ানো…গরিব কনস্টেবলদের খুন করা…এসব যেন আবার শুরু করবেন না। গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন করুন, দেশের লোককে আপনাদের বক্তব্য জানান।
দ্বারিকের মুখে তিক্ত হাসি এসে গেলেও দাঁতে দাঁত চেপে রইল। পুলিশও গণতন্ত্রের কথা শোনাবে! তাকে জোর করে, বেআইনিভাবে থানায় আটকে রেখে গণতন্ত্র সম্পর্কে বক্তৃতা দিচ্ছে। মানুষের কান দুটো যদি বন্ধ করা সম্ভব হত, তাহলে সে এদের কথা শুনত না।
শুনলাম, বাড়িতে নাকি একটি রক্ষিতা রেখেছেন? বেশ ডাগর চেহারা!
দ্বারিক দু-হাতে মুখ ঢাকল। এরা তাকে খোঁচাচ্ছে, তাকে রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। দ্বারিক একটু মেজাজ দেখালেই এরা মারতে শুরু করবে। শুধু চোর-ডাকাতদের মেরে এদের আনন্দ হয় না…ভদ্রলোকদের মেরেই এদের আসল হাতের সুখ হয়…কাটোয়ায় তার পায়ে দড়ি বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে রেখেছিল, ভুতোর খবর জানবার জন্য…দ্বারিক তখন সত্যিই ভুতোর কোনো খবর জানত না, জানলেও নিজের ভাইকে কেউ ধরিয়ে দেয়? পুলিশের ভাই নেই? ওরা ওদের ভাইকে ভালোবাসে না?
বড়োবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি একটু কোয়ার্টার থেকে ঘুরে আসছি…সমর তুমি থাকো…দ্বারিকবাবু, আপনি স্কুলে পড়ান, ভদ্রলোকের ছেলে, হঠাৎ যেন চলে-টলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না…ডি এস পি সাহেব এমনিতেই খাপ্পা হয়ে আছেন।
মারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে দ্বারিক সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল এক সময়। ঘুমের মধ্যেও তার ভুরু দুটো কুঁচকে আছে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এল। জমাদার একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রেখে গেল টেবিলের ওপর। ঘর ফাঁকা। সমর দাস বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজনের সঙ্গে পাটালিগুড় নিয়ে দরাদরি করছে।
এইসময় থানার জিপগাড়িটা ফিরে এল সদর থেকে।
ও দ্বারিকবাবু, দেখুন কে এসেছে!
দ্বারিক চমকে জেগে উঠল, এ-রকম হঠাৎ ঘুম ভাঙলে তার বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে।
সমর দাস একটা তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলের ঘাড় ধরে আছে। ছেলেটির মাথা ন্যাড়া। সদ্য ন্যাড়া হয়েছে মনে হয়, সারাগায়ে ধুলো। অল্প আলোতেও দ্বারিক সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল লীলাবউদির ছেলে বিটু।
দ্বারিক ভালো করে কথা বলতে পারল না প্রথমে। হঠাৎ ঘুম ভাঙার ঘোরটা যেন সে তাড়াতে পারছে না। সত্যিই বিটু? নাকি, সে স্বপ্ন দেখছে।
সমর দাস বলল, কতদূর গিয়েছিল ভাবুন…সেই অন্ডাল…দোকান থেকে খাবার চুরি করে ধরা পড়েছিল, লোকেরা ন্যাড়া করে, মাথায় ঘোল ঢেলে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল…দেখুন তো, এই সে কিনা, আপনাদেরই পাড়ার ছেলে তো।
দ্বারিক আর নিজেকে সামলাতে পারল না। তড়াক করে উঠে এসে ঠাস ঠাস করে দুটো জোর থাপ্পড় কল বিটুকে।
হারামজাদা ছেলে! আমাদের সব্বাইকে জ্বালিয়েছিস!
সমর দাস হেসে বলল, তাহলে সেই ছেলেই..আমি তখনই বলেছিলাম ওসব গুজব… ভাগ্যিস চুরি করেছিল, তাই পুলিশের নজরে এল, নইলে স্টেশনে স্টেশনে ভিক্ষে করে বেড়াত।
দ্বারিক বিটুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল, আহা রে…ক-দিন খাসনি? তুই কেন গিয়েছিলি, জানিস না, তোর মা তোর জন্য…
দ্বারিক আর কথা শেষ করতে পারল না। হঠাৎ দারুণ কাশির দমক এসে গেল, কাশতে কাশতে বুক চেপে বসে পড়ল সে।