বিহার থেকে নুটু, রাজেন ওরা পাঁচজন আজ ফিরবে। দ্বারিক ওদের জন্য দাঁড়িয়েছিল মল্লিকপুরের বাস স্ট্যাণ্ডে।
আরও আট-দশ জন ছেলে জমায়েত হয়েছে সেখানে। তাদের মধ্যে দু-তিনজন দ্বারিককে দেখে সিগারেট লুকোলো। এই বেল্টে ডাইরেক্ট অ্যাকশানের সময় দ্বারিক নিজে এখানে বেশিদিন উপস্থিত ছিল না। কিন্তু এরা সবাই দ্বারিকের মুখ চেনা। দ্বারিক জেল থেকে ফেরার পর কিছুদিন এরা তাকে এড়িয়ে গেছে, সামনাসামনি দেখা হলেও কথা বলেনি। এখন আবার কাছাকাছি আসছে। তাকে সম্মান দেখাচ্ছে।
দ্বারিকের খানিকটা গোপন আনন্দ হল। আবার তাহলে দল গড়া যায়। আবার শুরু করা যায় কাজ। এবার প্রোগ্রাম অন্যরকম হবে। কিন্তু একটা কিছু তো করতেই হবে।
বাস থেকে ওরা নামল হই হই করে। নুটু, রাজেন, সুখময়, অনন্ত আর রবি।
দ্বারিকা, দ্বারিকদা বলে চেঁচিয়ে ওরা সবাই জড়িয়ে ধরল তাকে। দ্বারিক দুর্বল গলায় বলল, রেলস্টেশনে যেতে পারিনি, সুখময়ের বাড়ি থেকে খবর পেলাম অনেক দেরিতে।
অন্যান্য ছেলেরা ইনকিলাব জিন্দাবাদ ধ্বনি দিল। তারপর গান ধরল, উই শ্যাল ওভারকাম।…জেলে বসে দ্বারিকও এই গানটা গাইত, সে-ও গলা মেলালো ওদের সঙ্গে।
ওরা পাঁচজনই জিজ্ঞেস করল, দ্বারিকদা, ভুতো ফেরেনি? দ্বারিক দু-দিকে মাথা নাড়ল।
ওরা সে-সম্পর্কে আর কোনো কৌতুহল দেখালো না। সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল প্রসঙ্গান্তরে।
ওদের উল্লাসের কোলাহল শুনে বেশ একটা ভিড় জমে গেছে বাস স্ট্যাণ্ডে। অনেক দোকানদার দোকান ফেলে দেখতে ছুটে এসেছে। এই ভিড়ের অনেকেই ওদের চেনে না। থেমে-থাকা বাসটার জানলা দিয়েও অনেক অবাক চোখ এদিকে মেলা। এই পাঁচজনের বাবা কাকা-দাদা যাঁরা এসেছেন, তারা দাঁড়িয়ে আছেন একটু দুরে।
সুখময় বলল, দ্বারিকদা, তুমি কিছুদিন হাজারিবাগ জেলে ছিলে না?
দ্বারিক বলল, হ্যাঁ।
তুমি যে সেলে ছিলে, ঠিক সেটাতেই আমি ছিলাম। ইয়াসিন মিঞাকে তোমার মনে আছে। সে তোমার কথা খুব বলছিল–
এদের মধ্যে চারজনই ধরা পড়েছে শেষের দিকে, দু-আড়াই বছরের বেশি জেলে থাকেনি। একমাত্র নুটুই পাঁচ বছরের বেশি। একবার জেল ব্রেকে নুটু বাইরেও চলে এসেছিল, আবার ধরা পড়ে।
ওরা পাঁচজনেই দাড়ি রেখেছে। চুল বেশ বড়ো বড়ো। জামাকাপড় অবশ্য পরিচ্ছন্ন। রাজেন, সুখময় আর রবির স্বাস্থ্যও বেশ ভালো হয়েছে। নুটু যে আলসারে ভুগছে, সে-খবর দ্বারিক আগেই পেয়েছিল। অনন্তটা অকালে বুড়িয়ে গেছে দ্বারিকের মতন।
দলবল মিলে হাঁটা শুরু করল গ্রামের দিকে। অনেকদিন পর তৃপ্তি বোধ করছে দ্বারিক। ওরা এসে পড়ায় সে খুবই খুশি হয়েছে। এতদিন তার বড় একা একা লাগছিল। ওরা অবশ্য সবাই মল্লিকপুরের, মোরামডাঙার আর একজনও নেই, তা হোক, তবু তো কাছাকাছি।
যেন প্রাক্তন সৈনিকেরা অনেকদিন পরে দেশে ফিরছে। যুদ্ধে জয়-পরাজয় যাই হোক, নিজের বাড়িতে ফেরার আনন্দ তো আছেই। না ফিরতেও তো পারত। জেল ব্রেকের সময় নুটুর পায়ে গুলি লেগেছিল, আর দু-তিন ফুট উঁচু দিয়ে গুলিটা এলেই সে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যেত। সুখময়ের ওপর যা অত্যাচার হয়েছে, কিংবা রবি। অসাধারণ প্রাণশক্তি বলেই বেঁচে উঠতে পেরেছে। অনেকসময় পুলিশ তো অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যাওয়ার বদলে মাঠে-ঘাটে দাঁড় করিয়ে মেরেছে। নিরস্ত্র বিপ্লবীদের সেইভাবে মারার নাম দিয়েছে তারা কনফ্রন্টেশন।
এরা পাঁচজন বেঁচে আছে। বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড়োকথা।
বাড়ি ফিরে ওরা কে, কী দেখবে তা এখনও জানে না। জেল আর অজ্ঞাতবাস মিলিয়ে ওরা সবাই পাঁচ-ছ বছর ঘর ছাড়া। জেলে থাকার সময় বাড়ি থেকে চিঠি পেয়েছে মাঝে মাঝে, কিন্তু চিঠিতে তো সবসময় সত্যি কথা লেখে না। ভিজিটার গেছে কদাচিৎ।
দ্বারিক রবির কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে। তার বুকের মধ্যে শিরশির করছে। রবি কী জানে যে এর মধ্যে তার মা মারা গেছেন। যদি বা জানেও, এতদিন পর মাতৃশূন্য বাড়িতে ফেরাটা ও সহ্য করতে পারবে? একটা কান্নার রোল উঠবেই। কান্নার কথা ভাবলেই দ্বারিকের ভয়। হয়। সে তো কিছু সান্ত্বনার কথা শোনাতে পারবে না।
নুটুদের বাড়িতে অবশ্য কেউ মারা যায়নি। কিন্তু ওদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেছে। নুটুর বাবা বাতের অসুখে ভুগে অকর্মা হয়ে গেছেন। নুটুর আর কোনো ভাই নেই। এখন ওদের সংসার চলে জমি বেচে। তাও প্রায় সব ফুরিয়ে এসেছে। নুটুদের গোয়ালঘরের পেছনটায় অনেকগুলো বড়ো বড়ো গাছ ছিল। খুব বাদুড়ের বাসা ছিল সেইসব গাছে। অনেকে ওখানে দিনের বেলা বাদুড় দেখতে যেত। সেইসব গাছ কেটে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। গোয়ালঘরটাও আর নেই। সব জায়গাটা চষে ফেলে মটর ডালের চাষ হচ্ছে। দ্বারিক গতকাল দেখে এসেছে। নুটু প্রথমে নিজেদের বাড়িটাই চিনতে পারবে না।
সুখময়দের বাড়িতে আজ সকলের নেমন্তন্ন। সুখময়ের মা বিশেষ করে বলে দিয়েছেন। অন্য চারজনের বাড়িতে খবরও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই মর্মে।
প্রথমেই পড়ল অনন্তর বাড়ি। ওর মা-বাবা অনেকদিনই নেই। কাকার সংসার। এমন নিষ্প্রাণ অভ্যর্থনা দেখে দ্বারিকের কষ্ট হল খুব। এতদিন পর ফিরল ছেলেটা অথচ বাড়িতে এমনভাব যেন না ফিরলেও ক্ষতি ছিল না! দ্বারিক নিজে যেদিন ফেরে, সেদিন তার মা পাগলের মতন তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দ্বারিক যেন দু-বছরের শিশু, এইভাবে তার মুখে বার বার হাত বুলিয়েছিলেন মা।
অনন্তর কাকা একদিন দ্বারিককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমরা যেসব জেলফেরত দাগি হয়ে গেলে, এরপর তোমরা আর কোনো ভালো জায়গায় চাকরি পাবে? তুমি তো না হয় তবু বি এস সি পাস করেছ, অনন্ত তো তাও করেনি।
সকলেরই এত বেশি স্বার্থচিন্তা যে কেউ স্বার্থত্যাগের মূল্য দেয় না।
অনন্ত অবশ্য নিরুত্তাপ। আবহাওয়াটা গ্রাহ্য না-করে নিজেই সেটাকে উত্তপ্ত করে তুলল। ইস, কাকিমা, তুমি কী রোগা হয়ে গেছ! আমার জন্য খুব চিন্তা করতে বুঝি?—এইকথা বলেই সে কাকিমার দুটি ছেলে-মেয়েকে তুলে নিল দু-হাতে। এদের মধ্যে একজনের বয়েস তিন, সে অনন্তকে কখনো দেখেইনি।
সুখময়দের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া বড়ো বেশি হয়ে গেল। নারকেলচিংড়িটা এত ভালো হয়েছিল যে দু-তিনবার চেয়ে নিতেও লজ্জা হয়নি দ্বারিকের। এত বড়ো চিংড়ি সুখময়ের বড়দা জোগাড় করলেন কী করে কে জানে! এদিকের বাজারে ঘুষো চিংড়ি ওঠে মাঝে মাঝে, কিন্তু বাগদা চিংড়ি তো দেখাই যায় না।
জেলে সুখময়রা একবার অনশন করেছিল দিন দশেকের জন্য। সেও বছর খানেক আগেকার কথা। সুখময়ের মা সে-শোক আর ভুলতেই পারছেন না কিছুতেই! পরিবেশন করার সময় বারংবার বলছিলেন, নে, আর একটু নে। কতদিন না খেয়ে থেকেছিস! দশদিন কিছু খাসনি? অতদিন না খেয়ে কেউ বাঁচতে পারে?
সুখময়ের দাদা জিজ্ঞেস করলেন, দু-একদিন পরে বোধ হয় খিদের বোধটা চলে যায় না রে?
দ্বারিক সমেত ওদের ছ-জনেরই বিভিন্ন সময়ে অনশনের অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু অনশনের প্রসঙ্গে ওরা সবাই হাসছিল খুব। সুখময় বলল, না মেজদা, একদম ভোলা যায় না। সবসময় শুধু খাবার জিনিসের কথা মনে পড়ত, এমনকী যে খাবার কখনো খাইনি, যেমন ধরো কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া, সরভাজা, আমি শুধু নামই শুনেছি, চোখে দেখি নি কখনো, অথচ মনে মনে ভাবতাম, সেই সরপুরিয়া, সরভাজা খাচ্ছি।
সুখময়ের মা বললেন, আহা রে! এবার কলকাতায় কেউ গেলে ও জিনিস আনিয়ে দেব ততার জন্য।
রবি বলল, আমি তো ভাবতাম, ছাড়া পেয়ে আমি একটা তেলেভাজার দোকান খুলব! আলুর চপ, বেগুনি, ফুলুরি…।
অনন্ত বলল, ভেবেছিলাম ছাড়া পেলে কত কী করব! চেঁচাব, লাফাব, গান গাইব, মাটিতে গড়াগড়ি দেব, অথচ সেরকম কিছুই করা যাচ্ছে না! সবাই কেমন যেন সাধারণ…।
নুটু বলল, ছেলেবেলায় স্কুলের সময় যেমন ভাবতাম, পরীক্ষা শেষ হলেই কত কী করব, অথচ কিছুই করা যেত না।
সুখময়ের মা বললেন, এখন কিছুদিন ভালো করে বিশ্রাম নাও তোমরা সবাই।
দ্বারিক মনে মনে ভাবল বিশ্রাম নয়। এখন দরকার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া…জেলখানার একঘেয়েমি কাটাবার জন্য বাইরে বেরিয়ে সত্যিকারের কোনো কাজে লেগে পড়লেই শরীর ও মনের স্বাস্থ্য ভালো হবে।
গুরুজনরা ঘিরে আছে বলে দ্বারিক বিশেষ কোনো কথা বলতে পারছে না। কিন্তু তার ইচ্ছে, আজই ওদের সঙ্গে নতুনভাবে কিছু সংগঠনের বিষয়ে আলোচনা করে।
সেই সুযোগ পাওয়া গেল একটু পরে, যখন সুখময় বলল, চলো একটু কাঁঠালতলায় গিয়ে বসি। মেঘলা মেঘলা আছে, বাইরে খোলা হাওয়ায় বসলে ভালো লাগবে।
আসল উদ্দেশ্য সিগারেট টানা। কাঁঠালতলা বেশ পরিষ্কার, এখানে বেশ কিছু কাঁঠাল আর লিচুগাছ লাগিয়েছিলেন সুখময়ের বাবা। কয়েকটা গাছে বেশ সুদর্শন এঁচোড় ফলে আছে।
শুকনো লিচুপাতার ওপর বসে একটুক্ষণ আরামে ধূমপান করার পর দ্বারিক প্রসঙ্গটা উত্থাপন করল।
আমরা সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি, এভাবে থাকলে কিন্তু আমাদের এতদিনের কাজ সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের সবাই মিলে এখন একবার বসা দরকার। তোরা কিছু ভেবেছিস, ভবিষ্যতের প্ল্যান।
পাঁচজনের কেউ একটাও কথা বলল না। যেন পাঁচজন পাঁচরকমভাবে চিন্তিত।
দ্বারিক আবার বলল, আমাদের মধ্যে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু সেটাও আমরা খোলাখুলি আলোচনা করে, শেষপর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আসতে পারি। পুরোনো থিসিসগুলো এখন আবার রিভিউ করা দরকার।
এবারও কোনো সাড়া জাগল না। দু-জন মন দিয়ে সিগারেট টানছে, বাকি তিনজনের চোখ মাটির দিকে।
দ্বারিক এবার সরাসরি প্রশ্ন করল, নুটু, তুই কিছু ভেবেছিস এ সম্পর্কে?
নুটু বলল, নিরঞ্জনদার কী খবর?
নিরঞ্জন থাকে ধানকা গ্রামে। সে ছাড়া পেয়েছে মাস ছয়েক আগে। দ্বারিকের চেয়েও সে বয়সে কিছু বড়ো, এ অঞ্চলের বিপ্লবী দলের সেই ছিল স্বীকৃত নেতা। শিলিগুড়ির সঙ্গে তারই প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। দ্বারিক তিন-চারবার দেখা করতে গিয়েছিল তার সঙ্গে। কিন্তু জেল থেকে ফিরে সে যেন কেমন পাগলাটে হয়ে গেছে। বাস্তবকে কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না। সে একধার থেকে সমস্ত নেতার নাম করে তাঁদের শোধনবাদী বলে গালাগাল দিয়ে গেল দ্বারিকের সামনে। সে চায় সাঁওতালদের নিয়ে দল সংগঠন করে এক্ষুনি আবার সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। দ্বারিককে সে বলেছে। মায়ের আঁচলের তলায় গিয়ে যারা এখন লুকোতে চায়, তাদের সঙ্গে আমি কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। আমি তাদেরও শ্রেণিশত্রু বলে মনে করব।
নিরঞ্জনকেও ডাকব আমরা। তার কথা শুনব। আমি অবশ্য তার সব মতামত এখন মেনে নিতে পারি না। তোরা শুনে দেখিস।
নুটু বলল, তুমি জান দ্বারিকদা, টর্চারের সময় নিরঞ্জনদা অনেকের নাম বলে দিয়েছিল?
দ্বারিক দু-হাত তুলে বলল, প্লিজ, প্লিজ! ওসব পুরোনো কথা তুলে এখন কোনো লাভ নেই। সকলের সহ্যক্ষমতা সমান থাকে না। কেউ যদি শেষ পর্যন্ত টর্চার সহ্য করতে না পেরে থাকে, সেজন্য তাকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না। আমরা যদি এখন পরস্পরের ওপর দোষারোপ করতে থাকি, তাহলে পার্টি হিসেবে আমরা শেষ হয়ে যাব! নিরঞ্জন মানুষ হিসেবে জেনুইন।
উনি কী করছেন এখন?
আপাতত কিছুই করছে না।
আমরা তখন সবাই প্রায় ছাত্র ছিলাম। এখন এতদিন পরে আবার ক-জন নতুন করে পড়াশুনো করতে পারবে আমি জানি না। অন্তত আমি তো পারব না। আমার দ্বারা আর বইখাতা নিয়ে কলেজে যাওয়া পোষাবে না। একটা কিছু জীবিকার খোঁজ করতে হবে।
সে সমস্যা তো আছেই। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের প্রত্যেককেই একটা দাঁড়াবার জায়গা করে নিতে হবে। কিন্তু আমি বলছি দলগতভাবেও আমাদের আবার এক হওয়া দরকার।
রাজেন বলল, তার আগে দেখতে হবে দ্বারিকদা, আমাদের কী কী ভুল হয়েছিল।
দ্বারিক বলল, সে তো দেখা দরকারই। ভুল তো হতেই পারে। সেই ভুল থেকে নতুনভাবে শিক্ষা নেওয়া যায়। খাঁটি বিপ্লবীকে হতে হবে একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ও আন্তর্জাতিক, কিন্তু আমরা–
অনন্ত বলল, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, এই স্লোগান তুমিই প্রথম আমাদের শিখিয়েছিলে দ্বারিকদা। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম তখন, তুমি আমায় ধমকে দিয়েছিলে। আজ তোমরাই বলছ, ওই স্লোগান দেওয়া ভুল হয়েছিল।
দ্বারিক বলল, হ্যাঁ, স্বীকার করছি। আমাদের আরও ভুল হয়েছিল যেমন—
রবি বলল, যেমন আমরা জনসাধারণকে কনফিডেন্সে নিইনি, আমাদের কাজ বা উদ্দেশ্য তাদের বোঝাতে যাইনি, গোড়া থেকেই আমরা আণ্ডারগ্রাউণ্ড পার্টি হয়ে গেলাম।
বিভিন্ন সেল তাদের ইচ্ছেমতন কাজ শুরু করল, কোনো কোঅর্ডিনেশন ছিল না, আমি যখন মেদিনীপুরে লুকিয়েছিলাম, তখন ক্যাডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখলাম, স্টুডেন্ট ফ্রন্টের সঙ্গে পিজান্ট ফ্রন্টের কোনো সংযোগ নেই।
ভুল সম্পর্কে ওরা ওদের মতামত জানাতে লাগল তীব্র ভাষায়, খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল দ্বারিক। সদ্য জেল থেকে বেরিয়েছে বলে ওদের গলায় রয়েছে অভিমানের সুর। নইলে, যতগুলো ভুলের কথা ওরা বলছে, তার সব ক-টাই ভুল ছিল না। সার্থক না হওয়া মানেই পথটা ভুল নয়। অভিজ্ঞতার অভাবে ভুল হয়। পাঁচবার-সাতবার এ-রকম ব্যর্থ হলেও পথটা ঠিক রাখা চাই। যারা ঘন ঘন পথ বা মত বদলায় তাদের দিয়ে কোনো কাজই হয় না। পরে আস্তে আস্তে ওদের এসব বুঝিয়ে বলতে হবে।
ওরা একটু থামলে দ্বারিক বলল, আমি আর একটা জিনিস নতুনভাবে অনুভব করছি কিছুদিন থেকে। আমরা কুসংস্কার বা ধর্মীয় গোঁড়ামিতে কখনো আঘাত দিইনি। অথচ, সেগুলো দূর না করলে কি দেশের মানুষের মন পরিবর্তন করা যাবে? সবাই ভাগ্য মেনে বসে আছে। ধর্মের আসল অস্তিত্ব কিছু নেই। শুধু কতকগুলো সংস্কারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা সবাই। তোরা কি ভাবতে পারিস যে এখনও লোকে বিশ্বাস করে, নরবলি দিলেই তবে কুয়ো থেকে জল উঠবে। চরণামৃত খাবার জন্য লোকে এখনও মন্দিরের সামনে লাইন লাগায়। একটা ফিয়ার সাইকসিস, একটা সার্বজনীন ভয় যেন দেশটার ওপর চেপে বসে আছে। ভূতপ্রেতের ভয়, ঠাকুর-দেবতার ভয়, পুলিশের ভয়, পাপের ভয়, জাত যাবার ভয়, এর সঙ্গে আছে জোতদার মহাজনকে ভয় পাওয়া, গভর্নমেন্টের লোকদের ভয় পাওয়া–নিরীহ নিরীহ লোক কোনো দোষ করেনি, তবু সবসময় একটা ভীতু ভীতু ভাব—এইসব দূর করার জন্য আমরা কোনো চেষ্টা করিনি, আগেও কোনো কাজ হয়নি—তোদের কি মনে হয় না, এখান থেকেই আমাদের কাজ শুরু করা উচিত?
নুটুর ঠোঁটে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল, তার মনে হল, দ্বারিকা এখন বিপজ্জনক রাজনীতি ছেড়ে সোশ্যাল ওয়ার্কার সাজতে চাইছেন। সুবিধাবাদী ফাঁকা আইডিয়ালিস্টদের যেটা একটা সময় কাটাবার ছল।
দ্বারিক ভেবেছিল সবাই তার কথা মন দিয়ে শুনছে। তার গলার আওয়াজে অনেকখানি আবেগ এসে গিয়েছিল। হঠাৎ রবি দুম করে একটা অন্য কথা বলল।
আচ্ছা দ্বারিকদা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। ভুতো কি শেষদিকে পুলিশের স্পাই হয়ে গিয়েছিল?
দ্বারিকের সারাশরীর কেঁপে উঠল। কথাটা বুঝতে তার সময় লাগল খানিকটা। এ-রকম কথা যে কেউ বলতে পারে, তাই সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
তুই কী বলছিস রবি?
সবাই ধরা পড়ল, একমাত্র ভুতোই ধরা পড়ল না, এটা কখনো সম্ভব?
ভুতে ধরা দিতে চায়নি।
আমরাও চাইনি। কিন্তু ভুত একলা একলা কোথায় লুকিয়ে থাকবে এতদিন? সে কি বিদেশে পালিয়ে গিয়ে লক্ষ্মীছেলে হয়ে গেছে।
না। বিদেশে গেছে শহরের ছেলেরা। ভুতো গ্রামের একজন গরিব মাস্টারের ছেলে, সে বিদেশে যাওয়ার টাকা পাবে কোথায়?
পালিয়ে থাকতে হলেও অনেক টাকা লাগে। দ্বারিকদা! আমরা শুনেছি, পুলিশ থেকেই ব্যবস্থা করে এ-রকম কয়েকজনকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।
আমাদের মধ্যে বিভেদ ঘটাবার জন্য পুলিশ অনেক গুজবও ছড়িয়েছে, সেটা তো বোঝা উচিত?
পুলিশের ছড়ানো গুজব চিনে নেওয়ার মতন বুদ্ধি আমার আছে।
তা হলে ভুতো সম্পর্কে এ প্রশ্ন উঠছে কেন?
ভুতো আগেও দু-একটা এমন কাজ করেছে, যে সম্পর্কে পার্টির কোনো নির্দেশ ছিল না।
কোন কাজ? ওর বিয়ে করা?
না, না, ওর বিয়ে করা সম্পর্কে তো আপত্তির কিছু নেই। বিয়ে করেছে, বেশ করেছে। ভুতো বিয়ে না করলে ওই মেয়েটিই তখন খুব বিপদে পড়ত।
তা হলে?
ভুতো আর্মস বিক্রি করতে গিয়েছিল।
বাজে কথা, একদম বাজে কথা! এটাও গুজব।
পুলিশের কোনোরকম সাহায্য ছাড়া ভুতোর পক্ষে এতদিন পালিয়ে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়।
তুই বরাবর ভুতোকে হিংসে করতিস, আমি জানি। সেইজন্যই তুই এ-রকম একটা জঘন্য কথা বলছিস।
অনন্ত বলল, আহা, দ্বারিকদা, চটে যাচ্ছ কেন? আমরা সবাই জানি, তুমি কখনো মিথ্যে কথা বল না। সেইজন্যই তো রবি তোমাকে জিজ্ঞেস করছে। ভুতো পুলিশের স্পাই হয়েছে কিনা! আমাদের জেলে এ-রকম একটা কথা খুব ছড়িয়েছিল।
দ্বারিক ব্যাকুলভাবে বলল, অনন্ত, তুই ভুতোর সঙ্গে ক্লাস ফাইভ থেকে পড়েছিস, আমাদের বাড়িতে এসে তুই ভুতোর সঙ্গে এক খাটে শুয়েছিস কতদিন, তুই ওকে এতদিন ধরে চিনিস, তুই কি বিশ্বাস করতে পারিস যে ভুতোর পক্ষে এ-রকম কাজ করা সম্ভব?
রবি বলল, এই দেখো, দ্বারিকদা, তুমি আবার এড়িয়ে যাচ্ছ। তুমি নিজে উত্তর না দিয়ে অনন্তকে দিয়ে বলাতে চাইছ।
দ্বারিকের রোগা লম্বা শরীরটা উত্তেজনায় টানটান হয়ে উঠেছে। সে একে একে সকলের মুখের দিকে তাকাল। এরা সবাই তা হলে সন্দেহ করছে ভুতোকে? যে ভুতো ছিল ওদের হিরো। দ্বারিক এক্ষুনি ভুতো সম্পর্কে এমন একটা কথা বলতে পারে যাতে সবাই চুপ হয়ে যাবে।
কিন্তু সে-কথা এখন দ্বারিক কিছুতেই বলতে পারবে না।