কুকুরগুলো যে বস্তুটি নিয়ে ঝগড়া করছিল, সেটা একটি মানুষের মুন্ডু। এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত যে চেনবার আর উপায় নেই কোনো। তবু অনেকেরই ধারণা, সেটি কোনো পূর্ণবয়স্ক মানুষের নয়, বারো-তেরো বছরের কোনো কিশোরের। যে-গুজবটা কয়েকদিন ধরে ধোঁয়াচ্ছিল, দপ করে সেটায় আগুন জ্বলে উঠল। আগে ছিল ছেলে চুরি, এখন সেটা হল নরবলি।
পুলিশ এল দুপুর বেলা। একজন এএসআই দু-জন কনস্টেবল। জিপে আসেনি, হেঁটে এসেছে। তেঁতুলিয়ার মোড়ে সাংঘাতিক ভিড়, পাশের দু-খানা গ্রাম থেকেও ছুটে এসেছে মানুষ।
দ্বারিক সকালে একবার অকুস্থল ঘুরে দেখে এসেছিল। মাথাটা যে মানুষেরই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিটুরই কিনা, তা লীলাবউদিও বলতে পারবেন না বোধ হয়।
দ্বারিক আর স্কুলে গেল না। বসে রইল বাড়িতেই। পুলিশের প্রতীক্ষায়। তার শরীরটা আজ আবার খারাপ লাগছে। শরীর খারাপ হলেই আজকাল মনটাও বিবশ হয়ে যায়। আজ মনে হয়, পৃথিবীতে যা ঘটে ঘটুক, আমি শুয়ে থাকি।
দু-ঘণ্টার মধ্যেও পুলিশ তার কাছে এল না দেখে দ্বারিক একটু অপমানিতই বোধ করল। শুধু ব্লক থানায় নয়, সদর পুলিশ, এমনকী কলকাতার গোয়েন্দা দফতরও দ্বারিক হালদারকে চেনে। তার নিজের পরিচয়ে তো বটেই, তা ছাড়া তার ভাই অম্বিকা হালদার। অন্তত দশবার পুলিশ এসেছে এবাড়িতে। আর আজ তাকে বাদ দিয়ে পুলিশ এ গ্রামের লোকদের সঙ্গে কথা বলবে!
আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে দ্বারিক বলল, যাই, একটু দেখে আসি।
মা অমনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, কোথায় যাচ্ছিস? না তোকে আর ওই গোলমালের মধ্যে যেতে হবে না!
দ্বারিক হাসল। মা এখনও সেই আগেকার দিনের কথা ভেবে ভয় পাচ্ছেন। যেন পুলিশ আবার দ্বারিককে দেখলেই ঝপ করে ধরে নিয়ে যাবে। মা জানেন না, গত মাসে মল্লিকপুরের হাটে যখন গোলমাল হল, পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল তিনজন ছাত্রকে, তখন দ্বারিকই থানায় গিয়ে তাদের ছাড়িয়ে এনেছিল। এ গ্রামের লোকদের যাতে পুলিশ এসে অযথা হয়রানি না করে, দ্বারিক সেটাই দেখতে যাচ্ছে।
তোমার কোনো চিন্তা নেই, মা। পুলিশরাই আজকাল আমাকে ভয় পায়।
তবু, তোর যাওয়ার দরকার কী? কে আবার নজর দিয়ে দেবে!
নজর দেবে? কে, কীসের নজর দেবে?
বলা কী যায়?
দ্বারিক দেখল, বীথি ঠোঁট টিপে হাসছে। মায়ের যত অদ্ভুত কথা। সে যেন একটা বাচ্চা ছেলে! নজর দেবে মানেটা কী?
বাড়ির বাইরে পা দিয়ে সে বলল, খানিকক্ষণের জন্যে ঘুরে আসছি!
বুক ব্যথার জন্যে যে মানসিক জড়তা এসেছিল, সেটা কাটিয়ে ফেলার জন্যই দ্বারিক জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। এবং খানিক দূরে গিয়ে ধরালো একটা সিগারেট, যা তার মতন বুক-ব্যথা ও কাশির রুগির পক্ষে এখন প্রায় বিষপানের সমান। দ্বারিকের বয়স এখন তিরিশ, কিন্তু দেখায় ছত্রিশের মতন।
তেঁতুলিয়ার মোড়ে ভিড়টা দেখে দ্বারিক অবাক হয়ে যায়। এ গ্রামে একসঙ্গে এত মানুষের সমাবেশ সে কখনো দেখেনি। দ্বারিকের দুঃখ বোধ হল। একটা যেকোনো হুজুগে এখনও এত লোক মেতে ওঠে। অথচ একটা কাজের জন্য ডাকলে আসবে না। মৃত্যু নিয়ে এত কৌতুহল, যদি এর অর্ধেকও জীবন সম্পর্কে থাকত।
চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। মাঝে মাঝে একজন সেপাই চেঁচিয়ে উঠছে, আস্তে আস্তে।
গ্রামের বুড়োরাই এখানে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। ভিড়ের কেন্দ্রস্থলে শোনা যাচ্ছে মহাদেব সাহার গলা। মনে হচ্ছে যেন পুলিশকে তিনি খুব ধমকাচ্ছেন।
দ্বারিকের প্রথমেই দৃষ্টি গেল একটা গাছের দিকে। তার রাগ হল।
এই গাছটা একটা আশ্চর্য দৃশ্য। কলকাতার ফোটোগ্রাফারদের উচিত ছিল এই গাছটার ছবি তুলে নিয়ে বড়ো করে কাগজে ছাপিয়ে দেওয়া। দেশ-বিদেশের লোক এটা দেখতে আসত তাহলে।
ওটা একটা মাঝারি আকারের অশ্বথগাছ। এমনিতে দ্রষ্টব্য কিছু ছিল না। কিন্তু গত বছর ওটা ঝড়ে উলটে পড়ে যায় পাশের ডােবাটায়। শেকড়গুলো উপড়ে গেছে, ডালপালাসুদ্ধ গুঁড়ির অর্ধেকটা পড়েছে জলে। ওইভাবেই পড়ে থেকে গাছটার একদিন পচে যাওয়ার কথা ছিল। তেঁতুলিয়ার মোড়ের অনেকটা জমি এজমালি সম্পত্তি। এখানে তেঁতুল-বটের বিয়ে হয়েছে, আর সেই দম্পতিগাছের গোড়ায় ধর্মঠাকুরের থান আছে বলে কেউ এখানকার গাছপালা কাটে না। শুধু ধর্মঠাকুর নয়, আরও নানারকম মূর্তিও ক্রমে ক্রমে বসেছে এখানে। এটাই এ গ্রামের বারোয়ারি পুজোর জায়গা, এখানে চন্ডীমন্ডপ নেই।
কিন্তু ঝড়ে উলটেপড়া অশ্বথগাছটা একটা অদ্ভুত খেলা দেখালো। কয়েকটা শেকড় বোধ। হয় হেঁড়েনি, লেগেছিল মাটির সঙ্গে, বাকি শেকড়গুলো ব্যাকুল আঙুলের মতন বাতাস আঁকড়ে ধরার ভঙ্গিতে ঝুলছিল, হঠাৎ একদিন দেখা গেল সেই অশ্বথগাছটা আবার একটু একটু করে উঁচু হচ্ছে। অলৌকিক দৃশ্যের মতন মনে হয়। একটা শুয়ে থাকা গাছ আবার উঠে দাঁড়াতে চাইছে, এ-রকম আগে কেউ কখনো দেখেনি। গাছটা তার মৃত্যুকে প্রত্যাখান করতে চায়। সামান্য যে ক-টা শেকড় লেগেছিল মাটির সঙ্গে, তারাই যেন প্রাণপণে ওকে টানছে। এখনও বেশ খানিকটা হেলে থাকলেও জল থেকে অনেকটা উঠে এসেছে উঁচুতে। দ্বারিক যাওয়া-আসার পথে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে যায় এই অশ্বত্থাগাছটার পাশে। গাছটার বেঁচে থাকার অদ্ভুত জেদ দেখতে তার ভালো লাগে। এখনও মাটির সঙ্গে তিরিশ ডিগ্রি কোণ করে ঝুঁকে আছে গাছটা, কিন্তু আর কয়েক মাসের মধ্যেই ও সোজা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে আবার।
দূর থেকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না বলে, সাত-আটটা ছেলে সেই অশ্বত্থাগাছটার গুঁড়ির ওপর গিয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাচ্ছলে দোলাচ্ছে পা দিয়ে। আর দু-একটা ছেলে উঠলেই নিশ্চয়ই গাছটার শেকড় ছিড়ে আবার জলে পড়ে যাবে।
দ্বারিক ওদিকে গিয়ে কড়া গলায় বলল, এই, মো! নামো এখান থেকে।
ছেলেগুলো দ্বারিকের মুখের দিকে তাকিয়ে পরস্পরের সঙ্গে চোখাচোখি করল। অন্য গ্রামের ছেলে হলেও ওরা দ্বারিক হালদারকে চেনে। এজমালি সম্পত্তির গাছ। তার ওপরে কেউ উঠলে দ্বারিকের চোখ রাঙানোর অধিকার নেই। কিন্তু কিছুদিন আগেও আশেপাশের সাতখানা গ্রামের কোনো ছেলের সাধ্য ছিল না দ্বারিক হালদারের কথা অমান্য করার। এখন তারা দু-একবার গা মোচড়ালো। ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করল একটুক্ষণ।
দ্বারিক আরও বেশি জোর দিয়ে বলল, মো বলছি!
ছেলেগুলো শেষপর্যন্ত প্রতিবাদ করল না, নেমে এল। তারপর তারা গাছটার গোড়ার দিকে চেয়ে হাত তুলে নমস্কার করে মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে। গাছটার অস্বাভাবিক কান্ডকারখানার জন্যে এর মধ্যেই ওর গোড়ায় সিঁদুর লেপা শুরু হয়ে গেছে, রয়েছে কয়েকটা ঘট আর ফুল বেলপাতা। ছেলেগুলো যেন বুঝিয়ে দিতে চাইল, দ্বারিকের কথায় নয়, পুজোর গাছ বলেই ওরা নেমে গেল। এজন্য আবার রাগ এসে পড়লেও সেটা হজম করতে হল দ্বারিককে।
তাদের পাড়ার ছেলে দুলালকে কাছাকাছি দেখে দ্বারিক বলল, এই, এর ওপর লোকজন উঠছে, বারন করতে পারিসনি?
দুলাল বলল, বারন করেছিলাম, দ্বারিকদা! ওরা মস্তানি করছিল।
আর একজন কে বলল, পুলিশ যেন কেসটা উড়িয়ে দিতে চাইছে। আপনি একটু কথা বলুন না, দ্বারিকদা!
আরও দু-তিনজন বলল, এই জায়গা দাও, দ্বারিকদাকে ভেতরে যেতে দাও!
এ এস আই-টি নতুন। দ্বারিক একে আগে দেখেনি। কে যেন তাকে একটা চেয়ার এনে দিয়েছে। অল্পবয়সি ছোকরা। বিভিন্ন থানার লোকজনকে পাইকারিভাবে ট্রান্সফার করা হয়েছে গত এক বছরে। জেল থেকে যারা বাড়ি ফিরেছে, তারা যাতে পুরোনো অত্যাচারী পুলিশ অফিসারদের আর দেখতে না পায়।
মহাদেব সাহা বললেন, এই যে দ্বারিক, এসো, এসো।
তারপর এ এস আই-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, এর নাম দ্বারিক হালদার, নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। পাঁচটা কেস ছিল।
এ এস আই-টি খানিকটা সম্রম দেখিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, নাম শুনেছি, নিশ্চয়ই… আমার নাম সমর দাস।
সাধারণ পুলিশ কর্মচারীরা সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসার থেকেই আসে, একথা জেনেও দ্বারিক কিছুতেই ওদের কারুকে সহ্য করতে পারে না। পুলিশ দেখলেই তার মধ্যে একটা পুরোনো ক্রোধ ফিরে আসে। ওরাই তো মেরে মেরে তার শরীরটাকে একটা ভগ্নপ করে দিয়েছে।
দ্বারিক আড়চোখে দেখে নিল যে কাটা মুণ্ডুটার ওপর কে যেন চাপা দিয়ে রেখেছে একটা চটের থলি। তাতে সে খানিকটা স্বস্তি বোধ করল।
মহাদেব সাহা বললেন, দেখো তো, কী কান্ড না কী কান্ড! যদি আবার সেই আগের মতন কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়।
সাত বছর আগে মহাদেব সাহাকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল দু-দুবার। দু-বারই উনি অতিএকটুর জন্য বেঁচে যান। মহাদেব সাহা খুন হলে দ্বারিক এখনও একটুও দুঃখিত বোধ করত না।
দ্বারিক জিজ্ঞেস করল, বডি কোথায়? বডির কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?
সমর দাস বলল, দেখুন, আমার ধারণা, এটা খুনটুনের কেস নয়, অনেক সময়…
অমনি একসঙ্গে ভিড়ের মধ্যে অনেকে চিৎকার করে উঠল। একজন সেপাই বলল, আস্তে আস্তে!
মহাদেব সাহা প্রতিবাদকারীদের নেতৃত্ব দিয়ে বললেন, মানুষের কাটা মুণ্ডু রাস্তায় গড়াচ্ছে, তবু আপনারা বলবেন, খুন নয়? ধান কাটার হাঙ্গামা নিয়ে কেস লেখাতে গেলে আপনারা আজকাল কেস লেখেন না। গত মাসে আমার বাড়িতে অতবড়ো চুরি হয়ে গেল…।
ধৈর্যচ্যুতি হলেও সমর দাস বিনীতভাবে বলল, আপনি একটু থামুন। আমি দ্বারিকবাবুকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি।
আরে মশাই, এর পর ছেলেপুলেগুলোকে কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে দিতেই সাহস পাবে। ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলে চুরি হচ্ছে।
এই তো, সেই কথাটাই বলতে দিচ্ছেন না। বুঝলেন দ্বারিকবাবু, আশেপাশে ক-খানা গাঁ ধরে ছেলে চুরির গুজব কারা ছড়াচ্ছে জানি না, কিন্তু একদম ফলস, কোনো ভিত্তিই নেই, এই একটা কেস ছাড়া আর কেউ থানায় ডায়েরি করেনি, কোনো নির্দিষ্ট বাড়ির কোনো ছেলে চুরি গেছে বা হারিয়েছে বলে জানা যায়নি…
দ্বারিক বলল, কিন্তু আমাদের পাড়ার একটি ছেলে দিন সাতেক ধরে সত্যিই নিখোঁজ।
সমর দাস সিনেমার পুলিশ অফিসারদের মতন ভুরু তুলে কথা বলে। গোঁফটা ঠোঁটের পাশে সবেমাত্র কুন্ডলী পাকাতে শুরু করেছে।
সেই তো বললাম, এই একটা কেস ছাড়া। পরীক্ষায় ফেল করে বাড়ি থেকে পালানো কি অস্বাভাবিক ঘটনা? প্রতি বছরই একটা-দুটো হয় এ-রকম, আবার ফিরেও আসে।
পুলিশের কাছে সব কিছুই ছক-বাঁধা। উঠতি বয়েসের ছেলেদের পক্ষে হঠাৎ বাড়ি থেকে পালানো সত্যিই অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরীক্ষায় ফেল করে দু-চারদিন এদিক-ওদিক লুকিয়ে থাকে মারের ভয়ে। সবই ঠিক। কিন্তু সকলের ক্ষেত্রে মেলে না। বিটুর মতন অতি নিরীহ, শান্ত, ভালো মানুষ ছেলেরা পালায় না। বিটু তার দুঃখিনী বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে, সে কেন পালাতে যাবে? অনেক ছেলেই ফেল করে সব সাবজেক্টে বিটু মাত্র অঙ্ক আর ইংরেজিতে, একটু ধরাধরি করলেই ওকে প্রোমোশন দেওয়ানো যেত।
বিটুদের মতন ছেলেরা ঝোঁকের মাথায় পালায় না। সমর দাস তো বিটুকে দেখেনি, তাই বুঝবে না।
সমর দাস পাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি, উনি আসতে পারবেন না?
বলাইকাকা বললেন, শুনছি এখনও জ্ঞান ফেরেনি। লোক পাঠানো হয়েছে।
দ্বারিক এদিক-ওদিক চেয়ে, এত মানুষের ভিড়ের মধ্যেও একজন মানুষের অনুপস্থিতি লক্ষ করল। গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই, তিনি এলে তাঁকে দেখা যেতই। শুধু যে লম্বা-চওড়া পুরুষ তাই নন, ব্যক্তিত্বেও এ গ্রামের মধ্যে তিনিই প্রধান। অবশ্য তিনি অহংকারী মানুষ, না ডাকা হলে তিনি নিজের থেকে আসবেন না।
ডিপটিউবওয়েলের পাশে রক্তের ছোপ রয়েছে। এখনও রয়েছে।
মহাদেব সাহার এই কথার সমর্থনে বলাইকাকা বললেন, হ্যাঁ, আমিও দেখেছি।
দ্বারিক বলল, রক্ত? কই, আমি তো দেখিনি। কালও গিয়েছিলাম।
মহাদেব সাহা বলল, ওটা রক্ত কিনা, বা রক্ত হলেও মানুষের রক্ত কিনা, সেটা দেখতে হবে। খানিকটা মাটি নিয়েছি।
আমরা চিফ মিনিস্টারের কাছে চিঠি লিখব।
দ্বারিক বলল, ডিপটিউবওয়েলের কাছে রক্ত, আর মুন্ডুটা এত দূরে…
কুকুরে নিয়ে এসেছে।
তাহলে বডিটা?
সমর দাস দ্বারিকের দিকে ফিরে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বলল, দেখুন, আমার প্রথম পোস্টিং হয়েছিল ঝাড়গ্রামে, ওখানে এখনও প্রায়ই নরবলির গুজব ওঠে, হয়তো কিছুটা সত্যতাও আছে…
একবার এনকোয়ারিতে গিয়ে একটা মন্দিরের সামনে শুধু একটা বডি পেয়েছিলাম, মুন্ডু ছিল না…অনেক খুঁজেও সেটা আর পাইনি, মুন্ডুটাই লুকিয়ে ফেলে, যাতে আইডেন্টিফিকেশন নাহয়…সেটাই বেশি ইয়ে, মানে, এতবড়ো একটা বডি লুকোবার চেয়ে।
এই মুখটা দেখেও তো চিনতে পারার উপায় নেই।
সেইজন্যই আমার ধারণা…অনেক সময় কবরখানা থেকে শেয়ালগুলো এ-রকম তুলে আনে…পাশেই মুসলমানদের গ্রাম…বিরাট কবরখানা…
সেখানে কোনো কবর খোঁড়া হয়েছে কিনা দেখলেই তো হয়।
তাই তো যেতে চাইছি, কিন্তু এনারা বলছেন—
মহাদেব সাহা বলল, বুঝলে দ্বারিক, এইসব বলে সব কিছু ধামাচাপা দেওয়া হবে। পুলিশ আজকাল কোনো ঝাটেই যেতে চায় না।
সমর দাস এমনভাবে দ্বারিকের মুখের দিকে চেয়ে রইল, যার অর্থ, একমাত্র দ্বারিক ছাড়া আসল কথাটা কেউ বুঝবে না। মহাদেব সাহাও দ্বারিকের পাশে এসে দাঁড়াল, যেন পুলিশের বিরুদ্ধে যেকোনো কথাবার্তায় সে দ্বারিকের সমর্থন পাবেই।
দ্বারিক বলল, ডিপটিউবওয়েলের পাশে রক্ত-ওখানেই বলি দেওয়া হয়েছে বলছেন?
দু-বার খুঁড়েও জল বেরোয়নি! ওরা রিগ ফেরত নিয়ে যাবে বলছিল।
এই সময় আবার একটা হইহই চিৎকার উঠল। ভিড় ফাঁক হয়ে গেল মাঝখানে। দ্বারিক দেখল, তাদের বাড়ির দিক থেকে আসছেন লীলাবউদি, তাঁর দু-হাত ধরে আছে সুরেন আর বিষ্ণু। লীলাবউদির আচ্ছন্নের মতন অবস্থা, তিনি চোখ বুজে প্রায় দৌড়োচ্ছেন।
অজান্তেই ঠোঁটটা বেঁকে গেল দ্বারিকের। মানুষের ভন্ডামির শেষ নেই। ওই বিষ্ণুটা অসহায় বিধবা লীলাবউদির নামে মামলা করছে। গতমাসেও একদিন লীলাবউদির উঠোনে দাঁড়িয়ে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি দিয়েছিল। আজ সেই আত্মীয় সেজে লীলাবউদির হাত ধরে আছে।
বলাইকাকা বললেন, ওই যে বউমা আসছে, একবার নিজের চোখে দেখুক।
দ্বারিক বিরক্তভাবে বলল, এর কি কোনো দরকার ছিল?
সমর দাস বলল, যদি উনি আইডেন্টিফিকেশন করতে পারেন, একবার দেখে নিন।
মহাদেব সাহা বলল, আমরা চিনতে না পারলেও মায়ের প্রাণ, ঠিকই পারবে।
দ্বারিক চঞ্চল হয়ে উঠল। এক্ষুনি এখানে বিরাট কান্নাকাটি শুরু হবে। সে শুনতে চায় না, সে এখানে থাকতে চায় না। সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল উলটো দিকে। রাস্তা ছেড়ে নেমে সে সদ্য ধানকাটা খড়খড়ে মাঠের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল মল্লিকপুরের দিকে।