প্রথমে গুজবটা ছড়িয়েছিল অনেকটা নিরীহভাবে। কিন্তু কোনো কোনো গুজব হঠাৎ জীবন্ত প্রাণীর মতন হয়ে ওঠে। তারপর থেকে সে চলাফেরা করতে থাকে তার নিজস্ব নিয়মে।
গত দু-দিন কেউ আর সন্ধ্যের পর বেরোয়নি বাড়ি থেকে। বাজারের দোকানগুলো সাধারণত খোলা থাকে রাত ন-টা-দশটা পর্যন্ত, সেগুলোও অন্ধকার হতে-না-হতেই ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। কেউ তাদের বন্ধ করে দিতে বলেনি, কেউ তাদের ভয় দেখায়নি। দিনের বেলা গ্রামের রাস্তায় ছোটো জটলায় সকলেই বলে, দুর, এ কখনো আজকালকার দিনে সম্ভব! লোকেরও কাজ নেই, একটা উড়োকথার পেছনে…
কে প্রথমে ছড়িয়েছিল কথাটা, কেউ জানে না। অথচ গ্রামসুদ্ধ সবাই শুনেছে। এখন তো খবরই ছাপা হয়ে গেছে জেলাবার্তায়। ছাপার অক্ষরে আতঙ্ক শব্দটা দেখে সকলেই আতঙ্কিত হওয়ার ন্যায্য অধিকার বোধ করে। যদিও অনেকেই জানে যে, পরিমল মাস্টারের ভাগনে আজকাল জেলাবার্তায় খবর লেখে, তবু সাতখানি গ্রামজুড়ে আতঙ্ক—বড়ো কাঠের হরফে ছাপা দেখে যেন গা ছমছম করে।
পুলিশ আসার কথাও শোনা যাচ্ছে রোজই। মাত্র সাত মাইল দূরে ফাঁড়ি। অথচ সাতদিনের মধ্যেও এইটুকু রাস্তা পেরিয়ে আসতে পারলেন না বাবুরা। জল-কাদা নেই, শীতের শেষের শুকনো খটখটে রাস্তা, কোনোই অসুবিধে নেই যাতায়াতের। ছাপার অক্ষরে খবর বেরিয়ে গেছে, তবু পুলিশ আসছে না দেখে সত্যি রাগ ধরে যায়।
সেই সত্তর-বাহাত্তর সালে পুলিশ এই গ্রামে আসত খুব ঘন ঘন। একবার গুলি চালিয়েছিল পর্যন্ত। তখন বোঝা যেত, দেশে থানা-পুলিশ আছে। গত ক-বছর ধরে পুলিশ যেন ভুলেই গেছে এ গ্রামটার কথা।
কোনো কারণ নেই, তবু মনে হয়, পুলিশ এলে আসবে সন্ধ্যের পরই। মিশমিশে অন্ধকারের মধ্যে পুলিশের হাতের জোরালো টর্চ আর জিপগাড়ির হেডলাইটে তাদের উপস্থিতিটা বেশ সম্রান্ত হয়ে ওঠে। দিনের বেলা অতটা না। সত্তর-বাহাত্তর সালের সময় পুলিশ আসত ভোর রাত্রে, চুপেচাপে। এখন তো আর সেরকমভাবে আসবার ঠেকা নেই।
পুলিশ এলে প্রথমেই যে খোঁজ করে দ্বারিকের, তা সবাই জানে। লোকে প্রথমে চেনালোকের কাছেই যায়। দ্বারিকের বাড়িতে এর আগে অন্তত দশবার পুলিশ এসেছে। দ্বারিক ছাড়া আর যে দু-জনকে চিনত পুলিশ, তারা এখন আর নেই।
দ্বারিকের বাড়ির ঠিক সামনে দিয়েই টানা রাস্তা। জানলা দিয়ে তাকালেই সোজা সেই তেঁতুলিয়ার মোড় পর্যন্ত দেখা যায়। সন্ধ্যের পর পথ একেবারে শুনশান। একটা গোরুর গাড়ি পর্যন্ত চলে না। ঘুমে চোখ টেনে এলেও দ্বারিক চট করে শুতে যায় না, জানলা খুলে চেয়ে বসে থাকে। পুলিশের জন্য প্রতীক্ষা। পুলিশের হাঁকডাকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে লাফিয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা আর দ্বারিক চায় না। সেসব যথেষ্ট হয়েছে।
এবাড়ির পাশেই একটা বেশ বড়ো পুকুর। কচুরিপানায় একেবারে ঠাসা। তার ওপাশে তিন শরিকের আমবাগান। সেই বাগান পেরিয়ে পুরোনো ইটের একতলা বাড়ি। সেখানে এখনও আলো জ্বলছে। মাঝে মাঝে সেই বাড়ি থেকে গ্রাম্য রাত্রির স্তব্ধতা ভেঙে উঠে আসছে একটা কান্নার আওয়াজ। বিটুর মা। ওই কান্নাটা শুনলেই দ্বারিকের ভুরু কুঁচকে যায়। কান্না সে একেবারে সহ্য করতে পারে না।
দ্বারিকের টেবিলের ওপর ঘড়িটা থেমে আছে সাড়ে সাতটায়। সকালে দম দেওয়া হয়েছিল ঠিকই, দ্বারিক নিজেই দিয়েছে। তাহলে কিছু রোগ হয়েছে ঘড়িটার। এখন ক-টা বাজে বোঝবার উপায় নেই। যদি রেডিয়োটা চালু থাকে তাহলে অবশ্য সময়টা মিলিয়ে নেওয়া যায়।
ঘড়িটায় দম দিতে দিতে দ্বারিক জানলার ধার ছেড়ে উঠে এল। ঘড়িটা আবার টিকটিক করছে। রেডিয়োটা এ ঘরেই থাকত আগে, দ্বারিক সেটা দিয়েছে বীথিকে। কিন্তু বীথিও সেটা নিজের ঘরে রাখেনি। দ্বারিকের বাবাই সেটা শোনেন আজকাল। তিনি এখন প্রায় অথর্ব, চোখে কম দেখেন, কানে প্রায় শুনতেই পান না, তবু এই বয়সে হিন্দি গান শোনার এক দুর্দান্ত নেশায় পেয়ে বসেছে তাঁকে। শিশুর খেলনার মতন তিনি রেডিয়োটা আঁকড়ে ধরে থাকেন সর্বক্ষণ।
ঘুমন্ত বাবার শিয়রের কাছ থেকে রেডিয়োটা তুলে নিয়ে এল দ্বারিক। সেটাকে চালিয়ে দিয়ে এদিক-ওদিক কাঁটা ঘোরালো। গান-বাজনা শুনে সময় বোঝা যাবে না। ওটা চালানোই রইল, খবর হবে নিশ্চয়ই কখনো-না-কখনো।
আপনি খাবেন এখন?
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বীথি। সরু লাল পাড়ের শাড়ি পরা, সাদা রঙের ব্লাউজ, সিথিতে স্পষ্ট করে দেওয়া সিঁদুর। রেডিয়োটা আনতে যাওয়ার সময় দ্বারিক দেখেছিল, বীথি তার নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে হ্যারিকেনের আলোয় বই পড়ছে। হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশুনো করার অভ্যেস নেই যাদের, তাদের নিশ্চয়ই নতুন করে মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধে হয়। বীথি অবশ্য সে-কথা স্বীকার করে না।
হ্যাঁ, খেয়ে নিতে পারি। আজও পুলিশ আসবে না বোধ হয়।
আসুন, জায়গা করাই আছে। খেতে বসতে হবে দ্বারিককে একাই। মেঝেতে আসন পাতা, পাশে কাঁসার গেলাসে জল। অনেক বলে বলেও দ্বারিক ব্যবস্থা পালটাতে পারেনি। বাবা রাত্তিরে কিছু খান না, সন্ধ্যের সময়ই খানিকটা মুড়ি আর বাতাসা খেয়ে নেন পেটভরে, আর এক কাপ চা। বাকি থাকে আর তিনজন, মা, বীথি আর দ্বারিক। মা বাবর ছেলেদের খাবার আগে পরিবেশন করেছেন, নিজে খেতে বসেছেন পরে। বীথিও মার সঙ্গে পরে খায়। তিনজনে একসঙ্গে বসে খেয়ে নিলে যে আলোর খরচটা কম হয়, সেটা কিছুতেই বুঝবেন না মা।
পরিবেশন করারও কিছু নেই। রুটি, ডাল আর আলু-পেঁয়াজের তরকারি। প্রত্যেকদিন রাত্রে এই একই খাবার। খেতে বসে দ্বারিকের প্রত্যেকদিনই অস্বস্তি হয়। তার অভ্যেস আছে, কিন্তু বীথি কী করে দিনের পর দিন এই খাবার খেয়ে যাচ্ছে? অথচ অন্য কোনো ব্যবস্থাও তো করবার উপায় নেই। টাকাপয়সার প্রশ্ন ছাড়াও, পাওয়াও তো যায় না কিছু। এ গ্রামের বাজারে মাসে একদিন-দু-দিন মাত্র মাংস ওঠে। আগে থেকে খবর পাওয়া যায় যে, রবিবার খাসি কাটা হবে। এমনি কোনো দিন হঠাৎ একটা খাসি কাটা হলে পুরো মাংস বিক্রি হওয়ার মতন খদ্দের জোটে না। মাছ এদিকে মেলেই না প্রায়। ধারে-কাছে নদী নেই। দু চারটে মজা-হাজা পুকুরে সারাদিন জাল ফেললেও মাছের সন্ধান পাওয়া যায় না। যেদিন বাজারে বড়োমাছ ওঠে, সেদিন শহরের চেয়েও বেশি দাম হাঁকে। যারা টাকার অভাবের জন্য মাংস কেনে না, তারাও ধারধোর করে সেই মাছ কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
স্কুল থেকে ফেরার পথে দ্বারিককে রণকালীপুর পেরিয়ে আসতে হয়। গ্রামটি মুসলমানপ্রধান। ওর আসল নাম রওনাক আলিপুর। কিন্তু লোকের মুখে মুখে রণকালীপুর হয়ে গেছে, অনেক মুসলমানও ওই নামই বলে। সে-গ্রামের বাজারে দ্বারিক গোরুর মাংস ঝুলতে দেখে রোজই। তিন টাকা কিলো।
দ্বারিক একদিন বীথিকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি গোরুর মাংস খাও? বীথি উত্তর দিয়েছিল, খাইনি কখনো, …তবে খেতে পারি। দ্বারিক বলেছিল, আমি যদি মাঝে মাঝে গোরুর মাংস কিনে আনি, তাতে তোমার আপত্তি আছে? মাকে অবশ্য জানানো হবে না–
বীথি বলেছিল, মাকে জানানো হবে না?
না, মা মেনে নিতে পারবেন না কিছুতেই। সে চেষ্টা করে আর লাভ নেই। ওঁকে বলতে হবে পাঁঠার মাংস, এমনিতে তো দেখে কিছু তফাত বোঝা যাবে না।
তারপর উনি যদি একদিন জেনে যান।
বীথির দৃষ্টিতে এমন একটা সারল্যের জোর আছে যে দ্বারিক আর কোনো কথা খুঁজে পায়। মায়ের পক্ষে জেনে যাওয়া খুবই সম্ভব। ভুবন হালদারের ছেলে দ্বারিক গোরুর মাংস কিনছে, এ খবর গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চালাচালি হয়ে যাবে দু-চারদিনের মধ্যেই। কথাটা কোনোক্রমে কানে এলে মা প্রথমে জিজ্ঞেস করবেন বীথিকেই। আর বীথি তো মিথ্যে কথা বলবে না।
আপনি ডিম কিনে আনেন না কেন? আপনার নিশ্চয়ই অসুবিধে হয়—
না, না, আমার জন্য নয়, তোমার জন্যই।
আমার তো কোনো অসুবিধে হয় না।
অসুবিধে হয় কিনা হয়, তা তো বীথি বলবে না মুখ ফুটে। হাঁস-মুরগির ডিম অবশ্য পাওয়া যায়। কিন্তু বীথি ডিম খায় না, তার অ্যালার্জির ধাত আছে। দ্বারিক নিজে ডিম ভালোবাসে, কিন্তু আজকাল পারতপক্ষে বাজার থেকে ডিম আনে না। বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে বীথি, সে কোনো প্রোটিন খাবে না, আর দ্বারিক কি একলা ডিম খেতে পারে?
মোট ঠিক চারখানা রুটি খায় দ্বারিক। দু-খানা ডালে ডুবিয়ে। দু-খানা আলু-পেঁয়াজের তরকারি দিয়ে। তবু প্রত্যেকদিনই মা জিজ্ঞেস করবেন, আর রুটি নিবি না? নে, আরও আছে কিন্তু।
দ্বারিক দু-দিকে মাথা নাড়ায়।
একসময় সে দশ-বারো খানা রুটি খেত। স্কুলজীবনের শেষ থেকেই। এক ডেলা গুড় দিয়েই রুটি উড়িয়ে দিত পাঁচ ছ-খানা। জেলে থাকার সময় থেকেই তার খিদে মরে গেছে।
খাওয়া শেষ করে কাঁসার গেলাসের জলে চুমুক দিতেই আবার শোনা গেল বিটুর মায়ের কান্না। দ্বারিক ভুরু কোঁচকালো এবং বিষম খেল। মা বললেন, ষাট, ষাট।
মা বসে আছেন পাড় সেলাই করা আসনে। বীথি দাঁড়িয়ে আছে দেওয়ালে হেলান দিয়ে। গেলাসটা নামিয়ে রেখে দ্বারিক বলল, আজও বিটুর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি?
মা একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আর খোঁজ পাওয়া যাবে কী করে? শুনছি নাকি মাটির নীচে পুঁতে রেখেছে।
কে পুঁতে রেখেছে?
তা কী জানি। বলাবলি তো করছে লোকে।
একটা নিরীহ ছেলেকে কে মাটির নীচে পুঁতে রাখতে যাবে?
মা চুপ করে গেলেন। কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা। এরমধ্যে মনে মনে কিছু কথা বলাবলি হল। এমন দিন গেছে, যখন জোয়ান জোয়ান ছেলেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি করে মরেছে। বন্ধুকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মেরেছে অন্য বন্ধুরা। কিংবা পুলিশ এসে শেয়াল-কুকুরের মতন পিটিয়ে বা গুলি চালিয়ে মেরেছে। অথবা থানায় নিয়ে যাওয়ার নাম করে পাঠিয়ে দিয়েছে নিরুদ্দেশে।
সেরকম দিন আর এখন নেই। এখন মারদাঙ্গার কথা কেউ বলে না। এমনকী পুলিশকে নিজে থেকে গিয়ে খবর দিয়ে এলেও পুলিশ সময় পায় না এদিকে আসবার।
দ্বারিক নিস্তব্ধতা ভেঙে আবার বলল, স্কুলের ছেলেরা বলে, তাদের কেউ কেউ নাকি দেখেছিল বিটুকে রাধিকাপুরের বাসে চাপতে।
মা বললেন, রাধিকাপুরে ওদের মামার বাড়ি। তারা ও-তল্লাট তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে। যাবে কোথায় ছেলেটা? সঙ্গে পয়সাকড়িও কিছু ছিল না নাকি?
দেখো, কয়েকদিনের মধ্যেই ও ঠিক চিঠি লিখবে।
কথাটা বলেই দ্বারিক ভুল বুঝতে পারল। কিন্তু আর ফেরাবার উপায় নেই।
মা সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ অভিমানের সঙ্গে বললেন, তাহলে আমাদের ভুত কেন চিঠি লেখে না?
আহা ওর ব্যাপারটা তো আলাদা।
হোক আলাদা। এখন তো আর কোনো ভয় নেই।
দ্বারিক চট করে আবার বীথির মুখটা দেখে নিল। বীথি শান্তভাবে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। যেন সে নিঃশব্দে বলতে চায়, তার জন্য চিন্তা করার কিছু দরকার নেই, দ্বারিক শুধু তার মায়ের কথাই চিন্তা করুক।
মা বললেন, তুই কলকাতায় যে খবর নিবি বলেছিলি?
দ্বারিক তাড়াতাড়ি হাত উঁচু করে বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও, একটু চুপ করো—
রেডিয়োতে গান থেমে ইংরেজি খবর শুরু হয়েছে। দ্বারিক বলল, দাঁড়াও, খবরটা শুনে নিই, যদি এখানকার কথা কিছু বলে।
খবর পাঁচ মিনিটে শেষ হয়ে যায়। তাতে ফিলিপিনস, অষ্ট্রেলিয়া এমনকী বেইরুটের সংবাদও আছে। কোনো গ্রামের কথা কিছুই নেই, কোনোদিনই প্রায় থাকে না, তবু দ্বারিক পাঁচ মিনিট মাকে চুপ করিয়ে রাখে। কান্নার আওয়াজ পেলে দ্বারিক চটে যাবে বলে মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিলেন এরমধ্যে। তারপর বললেন, তুই ওঠ, হাত ধুয়ে নে।
দ্বারিক এসে আবার জানলার ধারে বসল। রাস্তার ওপরে খুব নরমভাবে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে। অনেক দূরে কয়েকটা কুকুর ডাকছে একটানা, আর কোনো শব্দ নেই। বিটুর মা বোধ হয় এবার ঘুমিয়ে পড়েছে। ওঁর গলায় যে এত জোর, দ্বারিক জানত না এতদিন। বিটুর মাকে দ্বারিক লীলাবউদি বলে ডাকে। তার মনে আছে, লীলাবউদি যেদিন বিয়ের পর প্রথম নতুন বউ হয়ে এলেন এ গ্রামে, তখন দ্বারিকের বয়েস দশ-এগারো, সেদিন খুব ঝড়-বৃষ্টি ছিল। গোরুর গাড়ি থেকে ধীরেনদা টোপর হাতে নিয়ে নেমে দাঁড়াবার পরও নতুন বউ নামতে খুব দেরি করছিল। কলাবউ-এর মতন একগলা ঘোমটা দিয়ে জড়সড় হয়ে বসেছিলেন লীলাবউদি। পাড়ার মেয়েরা শাঁখ বাজিয়েই চলেছে, গুরুজনরা প্রণাম নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে লাইন বেঁধে, তবু বউ আর নামেই না। শেষপর্যন্ত ধীরেনদাই তাড়া দিয়ে বললেন, কই, নামো, নিজেই তিনি বউয়ের হাত ধরে নামালেন। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল দ্বারিক। বউয়ের মুখ দেখে পাড়ার মেয়েরা জোরে নিশ্বাস টানার শব্দ করেছিল, হেসেছিল ঠোঁট টিপে। দ্বারিকও হেসেছিল। বউকে দেখতে সুন্দরী নয়, রং তো কালো বটেই, মুখখানাও কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের। সকলেই আশা করে, নতুন বউমাত্রই সুন্দরী হবে। কিন্তু বাংলা দেশের অধিকাংশ মেয়েই তো সুন্দরী নয়, তাদের কি বিয়ে হয় না? অনেকে সেদিনই বলেছিল, এ যে ঘোড়ামুখো বউ!
লীলাবউদি নিজের রূপ সম্পর্কে বড়ো বেশি সচেতন। লজ্জায় কোনোদিন কারোর সঙ্গে ভালো করে মুখ তুলে কথা বলেন না। কিন্তু মানুষটা বড়োই ভালো, মনটা খুব সাদা। কিছুদিন মেলামেশার পর দ্বারিকের আর মনেই পড়েনি যে লীলাবউদি রূপসী নন। ওঁর শান্ত, সুমিষ্ট কথা শুনতে খুব ভালো লাগে।
বীথি এ গ্রামে নতুন বউয়ের বেশে কখনো আসেনি। সে এসেছিল একলা। মল্লিকপুরে বাস থেকে নেমে লোকের কাছ থেকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করে করে সে এসে দাঁড়িয়েছিল এ বাড়ির দরজার সামনে।
রেডিয়োটা থামেনি এখনও, অর্থাৎ এগারোটা বাজেনি। আর একটু অপেক্ষা করেই শুয়ে পড়বে দ্বারিক। খাওয়া শেষ হলেও মা আর বীথি অনেকক্ষণ বসে বসে গল্প করে। এইবার বোধ হয় ওরা দু-জনে আঁচাতে গেল। বীথি রাত্তির বেলা পর্যন্ত জেগে থাকতে ভালোবাসে। শহরের মেয়েদের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। এখানে ন-টা-দশটার মধ্যে সব বাড়ি নিঝুম হয়ে যায়।
রান্নাঘর ছাড়া এ বাড়িতে আর মাত্র দু-খানি ঘর ছিল। সবচেয়ে বড়োঘরখানা মা আর বাবার। তা ছাড়া কাঠের সিন্দুক থেকে শুরু করে গুচ্ছের পুরোনো জিনিসপত্র সবই সেই ঘরে জড়ো করা। বাকি ঘরখানা দ্বারিক আর ভুতো দু-জনের, ভুতো এখন নেই। বীথি আসবার পর তার শোবার জায়গা নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। প্রথম কিছুদিন বীথিকে এই ঘরখানাই ছেড়ে দিয়ে দ্বারিক শুত বড়োঘরটার মেঝেতে। এ ব্যবস্থায় বীথি আপত্তি করেছিল, দ্বারিকেরও অসুবিধে হচ্ছিল যথেষ্ট। এখন সামনের বারান্দাটার মাঝখানে দেওয়াল তুলে একটা আলাদা ছোটোঘর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে বীথির জন্য। ওই ঘরটায় বাতাস ঢোকে না বেশি। এখন শীতের সময় তেমন বোঝা যাচ্ছে না, গরম পড়লে কষ্ট হবে খুব। ঘরের ভিত আর দেওয়াল পাকা হলেও টিনের ছাদ। গরমকালে ঘরের ভেতর মানুষদের একেবারে ঝলসানো অবস্থা হয়।
আপনার জল।
রাখো টেবিলের ওপর। তুমি কী খাচ্ছ? পান?
না, আমলকী। আপনি খাবেন?
খেতে পারি।
বাঁ-হাতের মুঠো খুলে হাতটা এগিয়ে দিল বীথি। দ্বারিক আলগোছে তুলে নিল দুটো টুকরো। মনে মনে একটু হাসল। মা দেখলে রাগ করতেন। বাঁ-হাতে করে কারোকে যে কোনো জিনিস দিতে নেই, বীথি সেটা খেয়াল করেনি। অবশ্য কোনো মানে হয় না এসবের, দ্বারিক জানে, তবু চোখে লাগে। গ্রামের কোনো মেয়ে এভাবে বাঁ-হাত এগিয়ে দিত না। অবশ্য, বীথির ডান হাতে জলের গেলাস ছিল।
এই যে রাত্তিরের জন্য এক গেলাস জল দিয়ে যাওয়া, এটাও নতুন। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে কদাচিৎ তেষ্টা পায়। সেরকম তেষ্টা পেলেও একটু বিছানা ছেড়ে উঠে রান্নাঘরের কলশি থেকেও তো গড়িয়ে নিয়ে খাওয়া যায়। ছেলেবেলায় ঘুমচোখে এ-রকম কয়েকবার গেছে দ্বারিক। পেতলের কলশির শব্দ শুনেই মা জিজ্ঞেস করতেন, কে রে?
এখন বীথি রোজ রাত্তিরে দ্বারিকের শিয়রের পাশের টেবিলে এক গেলাস জল রেখে যায়। দ্বারিকের প্রয়োজন হয় না, তবু বীথিকে নিষেধ করেনি। সকালে উঠে অকারণেই খালিপেটে জলটা খেয়ে নেয়।
আপনার ঘর থেকে আর একটা বই নেব?
নাও। স্নো-র বইটা পড়া হয়ে গেছে?
সবটা পড়িনি। আপনার কাছে আর কোনো বাংলা বই নেই?
নেই বোধ হয়, আচ্ছা দেখি, কাল-পরশু যদি দু-একখানা আনতে পারি…আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিতে হয়তো…
দ্বারিকের বইয়ের সংগ্রহ খুব কম। সব মিলিয়ে কুড়ি-পঁচিশখানা মাত্র। জেলে থাকার সময় পয়সা জমিয়ে কিনেছিল কিছু। আবার অনেক বই হারিয়ে গেছে। একসময় ইচ্ছে করেই বিলিয়ে দিয়েছিল অন্যদের। গল্প-উপন্যাস নেই একখানাও।
বীথি ঠিক কী ধরনের বই পড়তে ভালোবাসে, তা এখনও জানে না দ্বারিক। খুব কম কথা বলে বীথি। দ্বারিকও আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু বীথির খুব পড়ার নেশা। হ্যারিকেনের আলোতেও কষ্ট করে সে অনেক রাত জেগে পড়ে। এ-রকমভাবে পড়লে চোখ খারাপ হয়ে যেতে পারে, দ্বারিক একবার বারন করবে ভেবেছিল। কিন্তু বীথি যদি ভাবে যে দ্বারিক কেরোসিন তেলের খরচ বাঁচাবার জন্য বলছে!
বীথি চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল দ্বারিক। আজকাল সবচেয়ে ভালো লাগে ঘুমের সময়টা। ঘুমের মতন উপভোগ্য আর কিছু নেই। শরীর এখন ঘুম চায়।
বিছানায় শোয়ার পরই কিছুক্ষণ খুব কাশি হয়। বসে থাকলে বা দাঁড়িয়ে থাকলে হয় না, কিন্তু শরীরটা হরাইজনটাল হলেই শুরু হয় কাশির দমক, খুবই বিশ্রী ব্যাপার। দু-বার তিনবার সিরাপ খেলে খানিকটা কমে। ব্রঙ্কাইটিস বা টি বি নেই, শুধু এই এক অদ্ভুত কাশি। শুকনো।
কাশির জন্য তার ঘোর ভেঙে যায় মাঝে মাঝে। এক-একবার উঠে বসে। আবার অগভীর ঘুমের মধ্যে মনে হয়, সে যেন পুলিশের জিপের শব্দ শুনতে পাচ্ছে, থেমে পড়ার পরও জিপের ইঞ্জিনের আওয়াজ, ভারী ভারী বুট-পরা পুলিশের পা।
একবার দ্বারিক সেই ভ্রমকে সত্যি মনে করে, ধড়মড়িয়ে উঠে জানলার কাছে এল। না, কিছু নেই। সেইরকমই ফাঁকা রাস্তা। নরম জ্যোৎস্নায় চুপচাপ শুয়ে আছে। এমন নির্জন নিস্তব্ধ পথ দেখলে বড়ো মায়া হয়।
হ্যারিকেনের লালচে আলোর একটা শিখা গিয়ে পড়েছে বাড়ির সামনের উঠোনে। অর্থাৎ বীথি এখন জেগে আছে, পড়ছে। পড়ুক।
আবার এসে শুয়ে পড়ল দ্বারিক। বেশ কিছুক্ষণ আর কাশি হল না। আস্তে আস্তে চোখের পাতায় নেমে এল ঘুম। একেবারে তলিয়ে যাওয়ার আগে দ্বারিকের মনে হল, দূরে কুকুরগুলো বড়ো বেশি জোরে ডাকাডাকি করছে। দুটো-চারটে নয়, একসঙ্গে বহু কুকুর। পৃথিবীতে এখন কুকুরের চিৎকার ছাড়া আর কিছু নেই।
কুকুরগুলোর প্রচন্ড দাপাদাপিতে গ্রামের আরও অনেকেরই ঘুম ভেঙেছিল। কেউই রাত্তিরে উঠে কারণ অনুসন্ধান করতে যায়নি। ভোর বেলা কয়েকজন তেঁতুলিয়ার মোড়ে গিয়ে দেখতে পায় এক চমকপ্রদ দৃশ্য। তারপরই হুলুস্থুলু পড়ে যায় গোটা গ্রামজুড়ে।