আল্লাহর বিশেষ রক্ষা ব্যবস্থার কারণে আপন চাচা বনু আবদুল মুত্তালিব ও বনু হাশিম গোত্রের কার্যকর প্রতিরোধের মুখে শারীরিক কোন আক্রমন চালাতে পারেনি। তাই তারা অনন্যোপায় হয়ে তাঁকে নিন্দা, কটাক্ষ, উপহাস বিদ্রƒপ করা এবং তাঁর সএথ ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়ার পথ বেছে নেয়। কুরআন কুরাইশদের এ জাতীয় ক্রিয়াকলাপ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে তাদের শত্রুতামূলক আচরণ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা ও বিশ্লেষণসহ নাযিল হতে থাকে। এ জাতীয় আচরণকারীদের কারো কারো নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদের নাম উল্লেখ না করে কাফিরদের সম্পর্কিত সাধারণ বর্ণনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কুরাইশদের মধ্য থেকে এ জাতীয় যেসব লোকের নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আবু লাহাব ইবনে আবদুল মুত্তালিব অন্যতম। তার স্ত্রী উম্মে জামীল বিনতে হারব ইবনে ইমাইয়কে “হাম্মালাতার হাতাব” অর্থাৎ কাঠ বহনকারিণী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা সে কাঁটা সংগ্রহ করে এনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাতায়াতের পথে ছড়িয়ে রাখতো। এজন্যই আল্লাহ তাদের উভয়ের সম্পর্কে এই সূরা নাযিল করেন :
[আরবী *************]
“ভেঙ্গে গিয়েছে আবু লাহাবের দুই হাত, আর সে ব্যর্থ হয়েছে। তার সম্পদ ও অর্জিত কোন কিছুই তার কাজে আসেনি। অবশ্যই সে শিখাবিশিষ্ট আগুনে নিক্ষিপ্ত এবং তার সাথে তার স্ত্রীও- যে কাষ্ঠ বহনকারিনী। তার গলায় থাকবে খেজুর ছালের রশি।”
ইবনে ইসহাক বলেন, আমি শুনেছি, উম্মে জামীল যখন তার ও তার স্বামীর ব্যাপারে নাযিল হওয়া কুরআনের এই সূরার কথা শনলো, তখন হাতে একটা পাথর মুষ্টিবদ্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নিকট উপস্থিত হলো। এই সময় তিনি আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়ারøাহ তা’য়ালা আনহুর সঙ্গে কা’বা শরীফের পাশে মসজিদে হারামে বসে ছিলেন। সে সেখানে তাঁদের দু’জনের কাছে এসে দাঁড়াতেই আল্লাহ তা’য়ালা তার চোখ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অদৃশ্য করে দিলেন। ফলে সে আবু বাক্র ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলো না। সে বললো, “হে আবু বাক্র, তোমার সঙ্গী কোথায়? আমি শুনেছি, সে আমার নিন্দা করে। আল্লাহর শপথ, তাকে পেলে আমি এই পাথর তার মুখের উপর ছুড়ে মারতাম।” এ কথা বলে সে চলে গেল। আবু বাক্র (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি মনে করেন যে, সে আপনাকে দেখতে পেয়েছে?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সে আমাকে দেখতে পায়নি। আল্লাহ আমাকে দেখবার শক্তি তার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।”
আর উমাইয়া ইবনে খালাফ ইবনে ওয়াহাব ইবনে হুযাফা ইবনে জুমাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলেই উচ্চস্বরে গালাগালি ও অস্ফুট স্বরে নিন্দা করতো। আল্লাহ তার সম্পর্কে সুরা হুমাযা নাযিল করেন :
[আরবী *************]
‘সামনাসামনি কটু কথা বলতে, অসাক্ষাতে নিন্দা করতে এবং ধনসম্পদ উপার্জন করে তা গুনে গুনে রাখতে অভ্যস্ত এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য অনিবার্য ধ্বংস। সে মনে করে, তার সম্পদ তাকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে। কক্ষণো নয়, সে অবশ্যই চূর্ণবিচুর্ণকারী স্থানে নিক্ষিপ্ত হবে। আর সেই চুর্ণ বিচূর্ণকারী স্থানটা কি, তাকি তুমি জান? সেটা আল্লাহর আগুন, যাকে উত্তপ্ত করা হয়েছে, যা অন্তর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। নিশ্চয় তা তাদের ওপর ঢেকে বন্ধ করে দেয়া হবে, তা উঁচু উঁচু স্তম্ভে পরিবেষ্টিত থাকবে।”
আর একজন ছিল ’আস ইবনে ওয়ায়েল সাহামী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম সাহাবী খাব্বাব ইবনুল আরাত একজন কর্মকার ছিলেন। তিনি তরবারী বিক্রি করেছিলেন। এই সুবাদে ’আসের নিকট তার বেশ কিছু টাকা পাওনা ছিল। তিনি সেই টাকার তাগাদা দিতে গেলে ’আস বললো, “হে খাব্বাব, তোমাদের লোক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বাস করে যে, জান্নাতে যারা যাবে তারা যত খুশী সোনা, রূপা, পোশাক ও চাকর নফর পাবে, তাই না?” খাব্বাব বললেন, ‘হ্যাঁ।’ ’আস বললো, “তাহলে হে খব্বাব, আমাকে কিয়ামাত পর্যস্ত সময় দাও। আমি জান্নাতে গিয়ে তোমার পাওনা পরিশোধ করে দেবো। হে খাব্বাব, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তুমি ও তোমার সাথী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে আমার চেয়ে অগ্রগন্য হবে না এবং আমার চেয়ে এবং আমার চেয়ে বেশী সৌভাগ্যশালীও হবে না।” এ প্রেক্ষিতে ’আস সম্পের্কে আল্লাহ নাযিল করেন-
[আরবী *************]
“তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখেছো যে আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করে এবং বলে যে, আমাকে তো ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি দিয়ে সমৃদ্ধ করা হতেই থাকবে। সে কি গায়েব জেনে ফেলেছে, কিংবা করুণাময় আল্লাহর কাছ থেকে কোন প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে? কক্ষণো নয়! সে যা বলে আমি লিখে রাখবো এবং তাঁর শাস্তি আরো বাড়িয়ে দেবো? যে সন্তান ও ধন সম্পদের কথা সে বলে, তা শেষ পর্যন্ত আমারই অধিকারভুক্ত হবে এবং সে একাকীই আমার কাছে হাজির হবে।” (সূরা মারিয়াম)
অপর এক রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, আবু জাহল ইবন হিশাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করে বলে, “হে মুহাম্মাদ, আমাদের দেবদেবীকে গালাগালি করা তোমাকে বন্ধ করতে হবে। নচেত তোমার খোদাকে গাল দেবো।” এ প্রসঙ্গে আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন :
[আরবী *************]
“ওদের দেবদেবীকে তোমরা গাল দিও না। তাহলে ওরা শত্রুতা ও অজ্ঞতার কারণে আল্লাহকে গাল দেবে।” (আল আনয়াম)
নাদার ইবনে হারেস ইবনে কালাদা ইবনে আবদে মানাফ ইবনে আবদুদ্ দার ইবনে কুসাই ছিল এমনি আর একজন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন বৈঠকে আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতেন, কুরাইন তিলাওয়াত করতেন এবং কুরাইশদেরকে অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ইতিহাস বর্ণনা করে তাদের অনুরূপ পরিণতির শিকার হওয়া সম্পর্কে সাবধান করে দিতেন এবং ঐ বৈঠকের শ্রোতদের কাছে পারস্যের বীর রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের কাহিনী বলতো। তারপর সে বলতো, “মুহাম্মাদ আমার চেয়ে ভাল কাহিনী শোনাতে পারে না। মুহাম্মাদের কাহিনীগুলো তো প্রচীন যুগের কিচ্ছা কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। ওগুলো মুহাম্মাদ যেমন লিখে রেখেছে, তেমনি আমিও লিখে রেখেছি।” তার সম্পর্কে আল্লাহ নযিল করেন,
[আরবী *************]
“তারা বলেছে : এসব প্রচীন যুগের কিচ্ছা কাহিনী যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখিয়ে নিয়েছে। এগুলো তাকে প্রতিদিন সকালে ও বিকালে শেখানো হয়। হে নবী, তুমি বল : এ বাণী তিনিই নাযিল করেছেন যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সকল গুপ্ত রহস্য জানেন। বস্তÍতঃ তিনি ক্ষমাশীল করুণাময়।” (আল কুরআন)
[আরবী *************]
“অবিশ্বাসীকে যখনই আমার আয়াত পড়ে শোনানো হয় অমনি সে বলেঃ এসব তো প্রাচীন কালের কিচ্ছা কাহিনী মাত্র।” (আল কালাম)
আরো নাযিল হয়,
[আরবী *************]
“এমন প্রত্যেক মিথ্যাবাদী পাপিষ্ঠের জন্যে ধ্বংস যার সামনে পঠিত আল্লাহর আয়াতগুলো শুনেও সে দাম্ভিকতার ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়ায় এবং এমন ভান করে যেন শুনেনি। সুতরাং তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ জানিয়ে দাও।” (আল জাসিয়া)
আর এক ব্যক্তি হলো আখনাস ইবনে শুরাইক ইবনে আমর ইবনে ওয়াহাব সাকাফী। সে ছিল একজন গণ্যমান্য লোক। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নানা উপায়ে লাঞ্ছনা দিত এবং অকথ্য কথা বলতো। আল্লাহ তার সম্পর্কে সূরা আলা কালামে বলেন,
[আরবী *************]
“এমন ব্যক্তির আনুগত্য করো না যে অত্যধিক কসম খায়, যার কোন গুরুত্ব নেই, যে অতিমাত্রায় গালাগাল করে ও চোগলখুরী করে বেড়ায়, যে ভাল কাজে বাধা দেয়, সীমালংঘন করে, পাপ কাজে লিপ্ত থাকে, যে অতিমাত্রায় দুষ্কৃতিকারী, অত্যাচারী এবং সর্বোপরি যে পরিচয়হীন।”
ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা বলেছিল, “কুরাইশ গোত্রে আমার মত সরদার এবং সাকীফ গোত্রে আবু মাস’উদ আমর ইবনে উমাইর সাকাফী থাকতে ওহী নাযিল হলো কিনা মুহাম্মাদের ওপর আমরা দুই শহরের দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব কিনা বাদ পড়ে গেলাম।”
এর জবাবে আল্লাহ নাযিল করেন সূরা যুখরুফের আয়াত,
[আরবী *************]
“তারা বলেছে : দুই শহরের[৩২. অর্থাৎ মক্কা ও তায়েফ] কোন একজন প্রধান ব্যক্তির ওপর কুরআন নাযিল হলেই ভাল হতো। তোমার প্রভুর অনুগ্রহ ওরাই বণ্টন করে থাকে? পার্থিব জীবনে তাদের জীবিকা আমিই তাদের মধ্যে বণ্টন করেছি এবং তাদের কিছু সংখ্যক লোককে অপর কিছুসংখ্যক লোকের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি, যার ফলে একে অপরকে কাজে লাগাতে পারে। আসলে তারা যা সংগ্রহ করছে তার চেয়ে তোমার প্রভুর অনুগ্রহই উৎকৃষ্ট।”
উকবা ইবনে আবু মুয়াইত ও উবাই খালফ উভয়ে পরস্পরের অন্তরঙ্গ সহচর ছিল। একবার উকবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে বসেছিল এবং তাঁর কথা শুনেছিল। উবাই এখবর জানতে পেরে উকবার কাছে এসে বললো, “তুমি মুহাম্মাদের মজলিসে বসেছো এবং তার কথা শুনেছো তা কি আমি শুনিনি মনে করেছো?” অতঃপর সে কঠিন শপথ বাক্য উচ্চারণ করে বললো, “তুমি যদি মুহাম্মাদের মজলিসে বসে থাক এবং তার কথা শুনে থাক আর তার মুুখে থু থু নিক্ষেপ না করো তবে তোমার মুখ দেখা আমার জন্য হারাম হয়ে যাবে।” আল্লাহর অভিসম্পাত উকবার উপর! হতভাগা সত্যি সত্যি আল্লাহর দুশমন উবাইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করলো।
এ সম্পর্কে আল্লাহ নাযিল করলেন,
[আরবী *************]
“যেদিন যালিম নিজের আঙ্গুল কামড়ে অনুশোনা করবে এবং ভাববে, হায়! আমি যদি রাসূলের সহযোগিতা করতাম। হায়! আমি যদি অমুককে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। সে তো আমাকে বিপথগামী করে দিয়েছে আমার কাছে পথনির্দেশ আসার পর। বস্তুতঃ শয়তান মানুষকে হেয় করতে খুবই সিদ্ধহস্ত।”
একদিন উবাই ইবনে খাল্ফ একখানা জীর্ণপ্রায় পুরনো হাড় নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেল এবং সে বললো, “হে মুহাম্মাদ, তুমি কি বিশ্বাস কর যে, আল্লাহ এই ধ্বংসপ্রায় হাড়কে পুনর্জীবিত করবেন? অতঃপর সে ওটা নিজের হাতের ওপর গুড়ো করে বাতাসে ফুঁক দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে উড়িয়ে দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ হ্যাঁ, আমি বলি আল্লাহ এ হাড়কে এবং তোমাকে জীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর পুনর্জীবিত করবেন। অতঃপর তোমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” এ প্রসঙ্গে আল্লাহ আয়াত নযিল করেন করলেন,
[আরবী *************]
“সে আমাকে দিয়ে দৃষ্টান্ত দেয় আর নিজের সৃষ্টির ব্যাপারটা ভুলে যায়। সে বলে, ‘এই অস্থিগুলো যখন জরাজীর্ণ হয়ে গেছে, তখন কে এগুলোকে আবার জীবিত করবে?’ তুমি তাকে বল, ‘এগুলিকে তিনি পুনর্জীবিত কবেন যিনি প্রথমবার এগুলিকে সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি সৃষ্টির সব কাজই জানেন। তিনিই সেই আল্লাহ যিনি তোমাদের জন্য শ্যামল সবুজ গাছ হতে আগুন উৎপন্ন করেছেন আর তা দিয়ে তোমরা নিজেদের চুলো জ্বালাও।” (ইয়াসীন)
আর একদিন যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বার তাওয়াফ করছিলেন, তখন আসওয়াদ ইবনুল মুত্তালিব ইবনে খালফ ও ’আস ইবনে ওয়ায়েল সাহামী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে ধরলো। তারা সবাই ছিল নিজ নিজ গোত্রের প্রবীণ ব্যক্তি। তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ. এসো আমরা তোমার আল্লাহর পূজা করি আর তুমি আমাদের দেব-দেবীর পূজা কর। এভাবে আমরা পরস্পরের কাজে শরীক হয়ে যাই। যদি তোমার মাবুদ আমাদের দেব-দেবীর চেয়ে ভাল হয়ে থাকে তা হলে আমরা তার পুজার অংশ হয়ে গেলাম। আর যদি আমাদের দেবতা তোমার খোদার চেয়ে ভাল হয়ে থাকে তাহলে তুমিও তার অংশ পেয়ে গেলে।”এর জবাবে আল্লাহ নযিল করলেন,
[আরবী *************]
“হে নবী, তুমি বল : হে কাফিরগণ, তোমরা যার ইবাদাত কর আমি তার ইবাদাত করি না। আর আমি যাঁর ইবাদাত করি তোমরা তাঁর ইবাদাত কর না। আমি তার ইবাদাত করবো না যার ইবাদাত তোমারা করছো, আর আমি যাঁর ইবাদাত করি তোমরাও তার ইবাদাত করবে না। তোমাদের জন্য তোমাদের দীন আর আমার জন্য আমার দীন।” (আল কাফিরুন)
আল্লাহ্ কাফিরদেকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য যাক্কুম বৃক্ষের উল্লেখ করলে আবু জাহল ইবনে হিশাম বললো, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মাদ যে যাক্কুম বৃক্ষের ভয় দেখাচ্ছে, সেটা কি জান?” তারা বললো, ‘না’ তখন সে বললো, “মদীনার খেজুর যা মাখন সহকারে রাখা হয়। আল্লাহর শপথ করে বলছি, মদীনায় যদি বসবাস করার সুযোগ পাই তাহলে তৃপ্তি সহকারে ওটা খাবো।” এই প্রসঙ্গে আল্লাহ নাযিল করলেন,
[আরবী *************]
“যাক্কুম গাছ গুনাহগারের খাদ্য হবে, তেলের গাদের মত পেটের ভেতরে এমনভাবে উথলে উঠবে যেমন ফুটন্ত পানি টগবগ করে উথলে ওঠে।” (আদদুখান)
অর্থাৎ যাক্কুম সম্পর্কে আবু জাহল যা বলে আসলে তা নয়।
একবার ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে কথা বলতে আরম্ভ করেন। তিনি ওয়ালীদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠছিলেন। এই সময় অন্ধ সাহাবী ইবনে উম্মে মাকতুম সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলাপ শুরু করে দিলেন এবং তাঁকে এ কুরআন পড়ে শোনাতে বললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাঁর এ আগমন ও কথাবার্তা বিরক্তিকর বলে মনে হলো। কারণ তিনি ওয়ালীদের সাথে কথাবার্তায় তেমন মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। ফলে তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তিনি যে আশা পোষণ করছিলেন সেটা প- হয়ে যাবার উপক্রম হলো। আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের কথাবার্তা অতিমাত্রায় বেড়ে যেতে আরম্ভ করেছে দেখে তিনি বিরক্তিভরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং তাঁকে কোন গুরুত্ব দিলেন না। তাই আল্লাহ তা’আলা তাঁর সম্পর্কে নাযিল করলেন,
[আরবী *************]
“সে (রাসূল) ভ্রূ কুঁচকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল এ কারণে যে, তার কাছে অন্ধ লোকটি এসছিল। তুমি জান, সে হয়তো শুধরে যেত কিংবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশ তার জন্য কল্যানকর হতো। পক্ষান্তরে যে লোক অনাগ্রহী তার প্রতি তুমি বেশ মনোযোগ দিচ্ছ। অথচ সে শুধরে না গেলেই বা তোমার কি আসে যায় আসে? আর যে লোক তোমার নিকট দৌড়ে এলো এবং যে পরিণাম সম্পর্কে ভয় করছিলো তুমি যে লোক তোমার নিকট দৌড়ে এলো এবং যে পরিণাম সম্পর্কে ভয় করছিলো তুমি তার প্রতি অনীহা দেখাচ্ছ। কক্ষণো নয়, এটা একটা উপদেশ-যার ইচ্ছা গ্রহণ করবে। সম্মানিত গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ, যা উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ও পবিত্র।” (সুরা ’আবাসা)
অর্থাৎ আল্লাহ বলেন : আমি তোমাকে সকলের জন্য সুসংবাদ দানকারী ও সতর্ককারী করে পঠিয়েছি এবং তোমাকে নির্দিষ্ট কারো জন্য পাঠাইনি। অতএব যে যা চেয়েছে তা থেকে তাকে বঞ্চিত করো না। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছুক নয় তাঁর জন্য লালায়িত হয়ো না।
যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর বাড়ীর চৌহদ্দিতেই কষ্ট দিত তারা হলো আবু লাহাব, হাকাম ইবনে আবুল ’আস, উকবা ইবনে আবু মুয়াইত, আদী ইবনে হামরা আস্ সাকাফী ও ইবসুল আসদা আল-হাযালী। এরা সবাই ছিল তাঁর প্রতিবেশী। হাকাম ইবনে আবুল ’আস ছাড়া এদের মধ্যে কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি। বর্ণিত আছে, এসব লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামায পড়তেন তখন তাঁর ওপর ছাগলের নাড়ীভুড়ি ছুড়ে মারতো। কেউ কেউ তাঁর বাড়ীতে রান্নার জন্য চড়ানো হাড়িতেও ঐ নাড়ীভুড়ি নিক্ষেপ করতো। শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাধ্য হয়ে একটা দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে নামায পড়তে লাগলেন। তারা তাঁর শরীরে নাড়িভুড়ি নিক্ষেপ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা তা একটা লাঠির মাথায় উঠিয়ে বাড়ীর বাইরে যেতেন এবং সংশ্লিষ্ঠ লোকের ঘরের দরজায় গিয়ে বলতেন, “হে আবদে মানাফের জাতিগোষ্ঠি, এটা তোমাদের কোন ধরনের প্রতিবেশীসুলভ আচরণ? তারপর তিনি সেই নাড়ীভুড়ি রাস্তায় ফেলে দিতেন।”