মক্কার কুরাইশ গোত্রসমূহের নারী ও পুরুষদের মধ্যে ইসলাম ক্রমান্বয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। আর কুরাইশরা মুসলমানদের যাকে পারতে আটক করে রাখতো এবং তার উপর কঠিন অত্যাচার চারাতো!
এই অবস্থায় পরিপেক্ষিতে একদিন সূর্যাস্তের পর প্রত্যেক গোত্র থেকে কুরাইশ সরদারগণ কা’বা শরীফের নিকট জমায়েত হলো। যারা জমায়েত হলো তারা হচ্ছে উতবা ইবনে রাবীয়া, শাইবা ইবনে রাবীয়া, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, নাদার ইবনে হারেস,আবুল বুখতারী ইবনে হিশাম, আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব, যামআ ইবনে আসওয়াদ, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা, আবু জাহল ইবনে হিশাম, আবদুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়া, আস ইবনে ওয়ায়েল, নুবাইহ্ ইবনে হাজ্জাজ, মুনাববিহ ইবনে হাজ্জাজ এবং উমাইয়া ইবনে খালাফ। তারা পরস্পরকে বলতে লাগলো, “মুহাম্মাদকে ডেকে পাঠাও, তার সাথে কথা বল, প্রয়োজনে ঝগড়াও কর। তাহলে জনতার কাছে তোমরা দোষ এড়িয়ে যেতে পারবে।” যথার্থই তাঁর কাছে দূত পাঠানো হলো। দূত গিয়ে বললো, “কুরাইশ নেতৃবৃন্দ তোমার সাথে কথা বলার জন্য জমায়েত হয়েছেন। তাদের কাছে একটু চলো।”
একথা শোনা মাত্রই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ত্রস্তপদে তাদের কাছে ছুটে এলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, তিনি তাদের কাছে যে দাওয়াত দিয়েছেন সে সম্পর্কেই বোধ হয় তারা নতুন কিছু চিন্তাভাবনা করেছে। বস্তুতঃ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আস্তরিকভাবে কামনা করতেন যে, তারা সঠিক পথে ফিরে আসুক। তাদের গোয়ার্তুমি ও অত্যাচারে তিনি ভীষণ দুঃখিত ছিলেন। তিনি গিয়ে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের পাশে বসলেন। তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ তোমার সাথে কিছু কথা বলার জন্য আমরা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। খোদার কসম, তুমি তোমার সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ, তেমন আর কোন আরব কখনো করেছে কলে আমাদের জানা নেই। তুমি পূর্বপুরুষদের ভর্ৎসনা করেছ, প্রচলিত ধর্মের নিন্দা করেছ, দেব-দেবীকে গালিগালাজ করেছ, বুদ্ধিমান লোকদের বোকা ঠাউরিয়েছ এবং জাতির ঐক্যে ভাঙ্গন ধরিয়েছ। মোটকথা, আমাদের ও তোমার মধ্যে কোন খারাপ জিনিসই আনতে তুমি বাকী রাখনি। এখন কথা হলো এসব কথা বলে তুমি যদি সম্পদ অর্জন করতে মনস্থ করে থাক, তাহলে আমরা তোমাকে টাকা কড়ি সংগ্রহ করে দিই, যাতে তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিত্তশালী হতে পার। আর যদি এর দ্বারা তুমি পদমর্যাদার প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে আমরা তোমাকে সরদার বানিয়ে দিই। আর যদি তুমি রাজা বাদশাহ হতে চাও তাহলে এস তোমাকে আমাদের রাজা বানিয়ে নিই। আর তোমার কাছে যে দূত আসে সে যদি কোন জ্বিন-ভূত হয়ে থাকে এবং তোমার ওপর পরাক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে আমরা যত টাকা লাগুক, তোমার চিকিৎসা করাতে প্রস্তুত যাতে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠ অথবা তোমার সম্পর্কে জনত্র কাছে আমাদের কোন জবাবদিহি করতে না হয়।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বললেন, “তোমরা যা যা বলছ তার কোনটাই আমি চাই না। আমি যে দাওয়াত তোমাদের কাছে পেশ করেছি তার উদ্দেশ্য এ নয় যে, আমি তোমাদের সম্পদ চাই কিংবা তোমাদের সম্পদ চাই কিংবা তোমাদের মধ্যে পদমর্যাদায় শ্রেষ্ঠ হতে চাই কিংবা তোমাদের রাজা হতে চাই। আমাকে আল্লাহ তোমাদের কাছে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, তিনি আমার প্রতি এক কিতাব নাযিল করেছেন এবং তোমাদের জন্য সাবধানকারী ও সুসংবাদ দানকারী হতে আমাকে আদেশ করেছেন। তাঁর আদেশ অনুসারে আমি তোমাদের কাছে আমার প্রতিপালকের বাণী পৌঁছে দিয়েছি এবং তোমাদেরকে কল্যাণের জন্য সদুপদেশ দিয়েছি। এখন তোমরা যদি আমার এই দাওয়াত গ্রহণ করে নাও, তাহলে সেটা তোমাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য বয়ে আনবে। আর যদি তা প্রত্যাখ্যান কর তাহলে তোমাদের ও আমার ব্যাপারে আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালা না আসা পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধারণ করবো।”
তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ, আমরা যে কয়টা প্রস্তাব তোমার কাছে পেশ করলাম তার কোনটাই যদি তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য না হয় তাহলে আর একটা কথা শোনো। তুমি তো জান, দুনিয়ায় আমাদের মত সংকীর্ণ আবাসভূমি আর কারো নেই, পানির অভাব ও অন্যান্য উপকরণের দৈন্যের কারণে আমরা যেরূপ দুঃসহ জীবন যাপন করি, পৃথিবীতে আর কোন জাতি এমন জীবন যাপন করে না। সুতরাং তোমার যে প্রভু তোমাকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন, তার কাছে প্রর্থনা কর যেন তিনি এই পাহাড় পর্বতগুলোকে এখান থেকে দূরে সরিয়ে নেন যাতে আমাদের আবাসভূমি আরো প্রশস্ত হয় এবং তিনি যেন ইরাক ও সিরিয়ায় নদ-নদীর ন্যায় আমাদের এ দেশেও নদ-নদী প্রবাহিত করে দেন। তাঁর কাছে আরো প্রার্থনা কর তিনি যেন আমাদের পূর্বপুরুষদের পুনর্জীবিত করেন এবং পুনর্জবীত পূর্বপুরুষদের মধ্যেই কুসাই ইবনে কিলাবও যেন অন্তর্ভুক্ত থাকেন যিনি অন্যতম সত্যবাদী ন্যায়নিষ্ঠ নেতা ছিলেন। তাদেরকে আমরা তোমার কথা সত্য না মিথ্যা জিজ্ঞেস করবো। তারা যদি বলেন তুমি সত্যবাদী এবং আমাদের দাবী অনুসারে তুমি যদি কাজ কর তাহলে আমরা তোমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবো, তোমার খোদাপ্রদত্ত মর্যাদা আমরা স্বীকার করবো এবং তোমাকে যথার্থই আল্লাহর রাসূল বলে মেনে নেব।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, “এসব ব্যাপার নিয়ে আমি তোমাদের কাছে আসিনি। আমাকে আল্লাহ যে জিনিস দিয়ে পাঠিয়েছেন, তাছাড়া আর কোন কিছু আমার ইখতিয়ারে সেই। আর যা দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে তা আমি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। এটা যদি তোমরা গ্রহণ কর তাহলে এটা দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দেবে। আর যদি অগ্রাহ্য কর তাহলে আল্লাহ তোমাদের ও আমার মধ্যে একটা চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধারণ করবো।”
তারা বললো, “এ প্রস্তাবও যদি তোমার মনঃপূত না হয়, তাহলে তুমি নিজের জন্য একটা কাজ কর। তোমার প্রতিপালককে বল তোমার সাথে একজন ফেরেশ্তা পাঠাতে। তিনি আমাদের সামনে তোমার কথা সত্য বলে সাক্ষ্য দেবেন এবং তোমার পক্ষ হয়ে আমাদের সাথে কথা বলবেন। আর আল্লাহ তোমার জন্য আনেকগুলো বাগবাগিচা ও প্রাসাদ বানিয়ে দিক এবং অনেক সোনা রূপার ধনদৌলত দান করুক। এতে করে তোমার যে অর্থলিপ্সা দেখতে পাই তা মিটবে। কেননা তুমি তো আমাদেরই মত বাজারে ঘোরাফেরা কর এবং আমাদেরই মত জীবিকা অন্বেষণ কর। তোমার এসব ধনদৌলত হলে আমরা বুঝবো, তুমি যথার্থই আমাদের চাইতে শ্রেষ্ঠ এবং তোমার প্রভুর কাছে মর্যাদাবান। তুমি নিজের ধারণা মুতাবিক সত্যিই যদি রাসূল হয়ে থাক তাহলে এসব করে দেখাও তো দেখি।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, না এটাও আমি করবো না। আমি আল্লাহর কাছে এসব জিনিস চাইতে পারবো না। আমি তোমাদের কাছে এসব জিনিস নিয়ে আাসিনি। আল্লাহ আমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে পাঠিয়েছেন। তোমরা যদি আমার আহ্বানে সাড়া দাও, তবে সেটা হবে দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের সৌভাগ্যের উৎস। আর যদি প্রত্যাখ্যান কর, তাহলে আল্লাহ যা করেন তাই হবে। তিনি যতক্ষণ আমার ও তোমাদের মধ্যে নিষ্পত্তি করে না দেন ততক্ষণ আমি ধৈর্য ধারন করবো।”
তারা বললো, “তাহলে কয়েক টুকরো মেঘ আমাদের মাথার ওপর ফেলে দাও, যেমন তুমি বিশ্বাস কর যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তা পারেন। এটা না করলে আমরা তোমার ওপর ঈমান আনবো না।”
রাসূলুল্লাহ বললেন, “এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইখতিয়ারাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে অবশ্যই তা করতে পারেন।”
তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ, তোমার প্রতিপালক কি এটা জানতেন না যে, আমরা তোমার সাথে বৈঠকে বসবো এবং যা এখন তোমার কাছে চাইলাম তা তোমার কাছে চাইবো? তিনি কি তোমার কাছে এসে আমরা যেসব কথা উত্থাপন করলাম তার জবাব তোমাকে শিখিয়ে দিতে পারলেন না এবং তোমার দাওয়াত অগ্রাহ্য করলে আমাদের তিনি কি করবেন তা জানাতে পারলেন না? আমরা জানতে পেরেছি যে, ইয়ামামায় বসবাসকারী ‘রাহমান’ নামক এক ব্যক্তি তোমাকে এসব কথা শিখিয়ে দেয়। [২৬.লোকটি হলো মুসাইলিমা ইবনে হাবিব হানফী। সে মুসাইলিমা কাযযাব (মিথ্যাবাদী) নামে প্রসিদ্ধ। সে বয়সে প্রবীণ ছিল এবং জাহিলী যুগে তাকে ‘রাহমান’ বলে ডাকা হতো। (রাউদুল আনফ)]
আল্লাহর শপথ, আমরা কথনো রাহমানকে বিশ্বাস করবো না। মুহাম্মাদ, তোমার কাছে আমরা আমাদের অক্ষমতার কথা জানাচ্ছি। তোমার আচরণ আমাদের সাথে যতদূর গড়িয়েছে তাতে আমরা তোমাকে ছাড়বো না। হয় তুমি আমাদের ধ্বংস করবে নচেৎ আমরা তোমাকে ধ্বংস করবো- তার আগে আমরা ক্ষান্ত হবো না।” সমবেত লোকদের একজন বললো, “আমরা ফেরেশতাদের পূজা করি। ফেরেশতারা হলো আল্লাহর মেয়ে।’ আর একজন বললো, “আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে হাজির কর নচেৎ আমরা তোমরা ওপর ঈমান আনবো না।”
এসব কথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে চলে এলেন। তাঁর ফুফাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়া ইবনে মুগীরাও তাঁর সাথে এলো। সে বললো, “শোনো মুহাম্মাদ তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা তোমার কাছে কতকগুলো প্রস্তাব পেশ করলো। তার একটাও তুমি গ্রহণ করলে না। তারপর তারা এমন কতকগুলো জিনিস তোমার কাছে দাবী করলো যা দ্বারা আল্লাহ তোমাকে যে পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন বলে তুমি নিজে বলে থাক তা জানতে ও বুঝতে পারে এবং তোমাকে স্বীকার করতে ও তোমার অনুসরণ করতে পারে। কিন্তু তুমি সে দাবগিুলোও পূরণ করলে না। তুমি যে তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তুমি যে আল্লাহর রাসূল তা জানার জন্যও তারা কিছু দাবী জানালো তোমার কাছে। তুমি তাও রাখলে না। আল্লাহর কসম, তুমি একটা সিঁড়ি দিয়ে আকাশে চড়বে এবং তোমাকে আকাশে উঠে যেতে আম স্বচোখে দেখবো, অতঃপর তোমার সাথে চারজন ফেরেশতা আসবেন এবং তারা তোমার দাবীর সত্যতার সাক্ষ্য দেবে- তানা হলে আমি তোমার ওপর ঈমান আনবো না। এমনকি তুমি যদি এসব করে দেখিয়ে দাও তাহলেও আমার মনে হয় না যে, আমি তোমার ওপর ঈমান আনব।”২৭.এই ব্যক্তি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে ইসলাম গ্রহণ করেন।
এরপর সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে চলে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে ত্যাগ করে অত্যন্ত ব্যাথিত ও বিষণ্ণ মনে বাড়ী চলে এলেন। কেননা তাঁকে যখন ডেকে নেয়া হয় তখন তিনি খুবই আশান্বিত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু কার্যতঃ যখন দেখলেন যে, তারা তাঁর থেকে আরো দূরে সরে গেল, তখন তাঁর দুঃখের সীমা থাকলো না।