1 of 3

০৫০. উমার ইবনুল খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ

আমর ইবনুল ’আস ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবী’আ যখন মক্কায় কুরাইশদের কাছে ফিরে আসলো তখন কুরাইশরা জানতে পারলো যে, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদেরকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছেই, অধিকন্তু নাজাশী তাদেরকে অপ্রীতিকর কথাবার্তা বলেও বিদায় দিয়েছেন। এই সময় হযরত উমারও ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একরোখা ও দুঃসাহসী। তাঁর অসাক্ষাতেও কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলতে বা করতে সাহস করতো না। হামযা ও উমারের মত দুই বীরকে কিছু বলতে বা করতে সাহস করতো না। হামযা ও উমারের মত দুই বীরকে সাথী হিসেবে পেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ কাফিরদের যুলুম থেকে অনেকটা নিরাপত্তা লাভ করেন। বলতে গেলে তাঁরা শক্তি মত্তায় কুরাইশদেরকেও ছাড়িয়ে গেলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রা) বলতেন, “খাত্তাবের পুত্র উমার ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত আমরা কা’বা ঘরে গিযে নামায পড়তে পারতাম না। উমার ইসলাম গ্রহণ করার পর কুরাইশদেরকে চ্যালেঞ্জ করে কা’বার সামনে গিয়ে নামায আদায় করেন এবং আমরাও তাঁর সাথে নামায পড়ি। কিছুসংখ্যক সাহাবা হিজরাত করে হাবশায় [আবিসিনিয়া] যাওয়ার পর উমার (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন।”

উমারের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটা এইরূপ : তাঁর বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব ও তার স্বামী সাঈদ ইবনে যায়িদ তখন ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ব্যাপারটা তাঁরা উভয়েই উমারের কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন। বনী আদী ইবনে কা’ব গোত্রের নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ নাহহামও গোত্রের লোকদের ভয়ে নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রাখেন। তিনি ছিলেন হযরত উমারেরই জাতিগোষ্ঠীভুক্ত। আরেকজন সাহাবী খাব্বাব ইবনুল আরাত ফাতিমা বিনতে খাত্তাবের কাছে মাঝে মাঝে তাঁকে কুরআন শরীফ পড়াতে আসতেন। একদিন উমার তলোয়ার হাতে নিয়ে বেরিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর গুটিকয়েক সাহাবীর সন্ধানে। তিনি পূর্বাহ্নে জানতে পেরেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চল্লিশজন নারাী পুরুষ সহচরকে নিযে সাফা পর্বতের নিকট একটি বাড়ীতে সমবেত হয়েছেন। সেখানে তাঁর সাথে হামযো ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা), আবু বাক্র সিদ্দক (রা) ও আলী ইবনে আবু তালিব (রা) সহ সেইসব মুসলমান ছিলেন যারা আবিসিনিয়া না গিয়ে মক্কাতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়েছিলেন। নাঈম উমারের (রা) মুখোমুখী দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাচ্ছ উমার?”

উমার বললো, “আমি ঐ বিধর্মী মুহাম্মাদের সন্ধানে যাচ্ছি, যে কুরাইশদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, তাদেরকে বেকুফ সাব্যস্ত করেছে, তাদের ধর্মের নিন্দা করেছে এবং তাদের দেবদেবীকে গালি দিয়েছে। আমি তাকে হত্যা করবো।”

নাঈম তাঁকে বললেন, “উমার, তুমি নিশ্চয়ই আত্মপ্রবঞ্চিত হয়েছো। তুমি কি মনে কর যে, মুহাম্মাদকে হত্যা করার পর বনু আবদে মানাফ তোমাকে ছেড়ে দেবে এবং তুমি অবাধে বিচরণ করতে পারবে? তুমি বরং নিজের ঘর সামলাও।

উমার বললেন, “কেন, আমার গোষ্ঠীর কে কি করেছে?”

নাঈম বললেন, “তোমার ভগ্নিপতি ও চাচাতো ভাই সাঈদ ইবনে যায়িদ ইবনে আমর এবং তোমার বোন ফাতিমা। আল্লাহর শপথ, ওরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তারা মুহাম্মাদের ধর্মের অনুসরণ করে চলেছে। কাজেই পারলে আগে তাদেরকে সামলাও।”[২৮. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন বিপন্ন হবার আশংকা বোধ করে উমারের মনযোগ অন্যদিকে চালিত করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এতে করে ফাতিমা ও তাঁর স্বামীর নির্যাতিত হবার সম্ভাবনা থাকলেও সেটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাশংকার তুলনায় অনেক হালকা ব্যাপার।]

এ কথা শোনামাত্রই উমার বোন ও ভগ্নিপতির গৃহ অভিমুখে ছুটলেন। তখন সেখানে খাব্বাব ইবনুল আরাতও উপস্থিত। তাঁর কাছে পবিত্র কুরআনের অংশবিশেষ ছিল যা তিনি সাঈদ দম্পতিকে পড়াচ্ছিলেন। ঐ অংশে সূরা ত্বাহা লেখা ছিল। তাঁরা উমারের আগমন টের পেলেন। খাব্বাব তৎক্ষন্ৎ একটি ক্ষুদ্র কক্ষে আত্মগোপন করলেন। ফাতিমা কুরআন শরীফের অংশটুকু লুকিয়ে ফেললেন। উমার গৃহে প্রবেশের প্রক্কালে শুনছিলেন যে, খাব্বাব কুরআন পড়ে তাঁদের দু’জনকে শোনাচ্ছেন। তিনি প্রবেশ করেই বললেন, “তোমরা কি যেন পড়ছিলে শুনলাম।” সাঈদ ও ফাতিমা উভয়ে বললেন, “তুমি কিছুই শোননি।” উমার বরলেন, “আল্লাহর শপথ, আমি শুনেছি, তোমরা মুহাম্মাদের ধর্ম গ্রহণ করেছো এবং সেটাই অনুসরণ করে চলছো।” এ কথা বলেই ভগ্নিপতি সাঈদকে একটা চড় দিলেন। ফাতিমা উঠে এসে স্বামীকে তার প্রহার থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে লাগলেন। উমার ফাতিমাকে এমন জোরে আঘাত করলেন যে, তিনি আহত হলেন।

উমারের এই বেপরোয়া আচরণ দেখে তারা উভয়ে বললেন,“হ্যাঁ, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং আল্লাহ ও তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি। এখন আপনি যা খুশী করতে পারেন।” উমার তাঁর বোনের দেহে রক্ত দেখে নিজের এহেন আচরণে অনুতপ্ত হলেন।

তারপর অনুশোচনার সুরে বোনকে বললেন, আচ্ছা, তোমরা যে বইটা পড়ছিলে, সেটা আমাকে দাও তো। আমি একটু পড়ে দেখি মুহাম্মাদ কি বাণী প্রচার করে?” এখানে উল্লেখ্য যে, উমার লেখাপড়া জানতেন।

তাঁর বোন বললেন, “আমাদের আশংকা হয়, বইটা দিলে তুমি নষ্ট করে ফেলবে।”

উমার দেবদেবীর শপথ করে বললেন, “তুমি ভয় পেও না। আমি ওটা পড়ে অবশ্যই ফিরিয়ে দেব।” একথা শুনে বোনের মনে এই মর্মে আশার সঞ্চার হলো যে, তিনি হয়তো ইসলাম গ্রহণ করবেন। তাই তিনি বললেন, “ভাইজান, আপনি মুশরিক হওয়ার কারনে অপবিত্র। অথচ এই বই স্পর্শ করতে হলে পবিত্রতা অর্জন করা প্রয়োজন।”[২৯.কুরআন শরীফ স্পর্শ করার জন্য পবিত্রতার শর্ত সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, ফরয। আবার কারো কারো মতে ফরয নয়-মুস্তাহাব।]

উমার তৎক্ষনাৎ গিয়ে গোসল করে পবিত্র হয়ে আসলেন। ফাতিমা এবার কুরআন শরীফ দিলেন। খুলেই যে অংশটি তিনি দেখলেন তাতে ছিল সূরা ত্বাহা। এথম থেকে কিছুটা পড়েই বললেন, “কি সুন্দর কথা! কি মহান বানী!” আড়াল থেকে এ কথা শুনে খাব্বাব বেরিয়ে এসে বললেন, “ উমার মনে হয়, ্আল্লাহ তার নবীর দোয়া কবুল করে তোমাকে ইসলামের জন্য মনোনীত করেছেন। গতকাল তিনি দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আবুল হাকাম ইবনে হিশাম অথবা ইমার ইবনুল খাত্তাবের দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি কর।’ হে উমার, তুমি আল্লাহর ডাকে সাড়া দাও, তুমি আল্লাহর ডাকে সাড়া দাও!”

উমার তখন বললেন, “হে খাব্বাব, আমাকে মুহাম্মাদের সন্ধান দাও। আমি তাঁর কছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করি।” খাব্বাব বললেন, “তিনি সাখা পর্বতের নিকট একটা বাড়ীতে কিছুসংখ্যক সাহাবার সাথে অবস্থান করছেন।”

উমার তাঁর তলোয়ার কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের সন্ধানে চললেন। যথাস্থানে গিয়ে দরজায় করাঘাত করলেন। আওয়াজ শুনে একজন সাহাবা উঠে এসে জানালা দিয়ে তাঁকে দেখলেন। সেখলেন উমার তরবারী হাতে দাঁড়িয়ে। তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ফিরে গেলেন এবং বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, উমার দরজায় তরবারী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।” হামযা রাদিয়ল্লাহু তা’য়ালা আনহু বললেন, “তাঁকে আসতে দাও। যদি ভালো উদ্দেশ্যে এসে থাকে আমরা তাকে সহযোগিতা করবো আর যদি খারাপ উদ্দেশ্যে এসে থাকে তবে তাঁর তরবারী দিয়েই তাকে হত্যা করবো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাকে আসতে দাও।” তিনি উমারকে ভেতরে যেতে অনুমতি দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে উমারের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং কক্ষের ভেতরে তাকে সাক্ষাত দান করলেন। তিনি উমারের পাজামার বাঁধনের জায়গা অথবা গলায় চাদরের দুই প্রান্ত যেখানে একত্রিত হয় সেখানে শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলেন। তারপর করলেন, “হে খাত্তাবের পুত্র, কি উদ্দেশ্যে এসছো? আল্লাহর শপথ, আল্লাহর তরফ থেকে তোমার উপর কোন কঠিন মুসিবত না আসা পর্যন্ত তুমি সংযত হবে বলে আমার হয় না।”

উমার বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের প্রতি ঈমান আনার জন্যই এসছি।”

একথা শোনামাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন জোরে ‘আল্লাহু আকবার’ বললেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের সবাই বুঝতে পারলো যে, উমার ইসলাম গ্রহণ করেছে। হামযার পরে উমারের ইসলাম গ্রহণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণের মনোবল বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেল। তাঁরা নিশ্চিত হলেন যে, এই দু’জন এখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মুশরিকদের যুলুম-নির্যাতন প্রতিরোধ করতে পারবেন এবং তারা সবাই ওদের দু’জনের সহযোগিতায় মুসলমানদের শত্রুদের মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন। এরপর সাহাবাগণ সেই স্থান থেকে নিজ নিজ অবস্থানে চলে গেলেন।

উমার রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু বলেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর সেই রাতেই চিন্তা করতে লাগলাম যে, মক্কাবাসীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে কট্রর দুশমন কে আছে। আমি তার কাছে যাবো এবং আমার ইসলাম গ্রহণের কথা তাকে জানাবো। আমি স্থির করলাম যে, আবু জাহলই বড় দুশমন। অতঃপর সকল হতেই আমি তার বাড়ীতে গিয়ে দরজায় করাঘাত করলাম। আবু জাহল বেরিয়ে আমার সামনে আসলো। সে বললে, “ভাগ্নে, তোমাকে খোশ আমদেদ জানাচ্ছি। [৩০.উমারের (রা) মাতা হানতামা বিনতে হিশাম আবু জাহলের বোন ছিলেন।]

কি মনে করে এসছো?” আমি বললাম, “আপনাকে জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল মুহাম্মাদের প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর আনীত বিধান ও বাণীকে মেনে নিয়েছি।” এ কথা শোনামাত্র সে আমার মুখের ওপর এই বলে দরজা বন্ধ করে দিল, “আল্লাহ তোকে কলংকিত করুক, যে খবর তুই এনছিস তাকেও কলংকিত করুক।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *