1 of 3

০৪৭. দুর্বল মুসলমানদের ওপর মুশরিকদের অত্যাচার

যারা ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করেছিলো সেসব সাহাবার ওপর মুশরিকরা ভীষণ অত্যাচার চালাতে লাগলো। প্রত্যেক গোত্র তার মধ্যকার মুসলমানদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কোথাও বা তাদেরকে অন্তরীণ রেখে মারপিট করে, ক্ষুৎপিপাসায় অবর্ণনীয় কষ্ট দিয়ে, কোথাও বা দ্বি-প্রহরে প্রচ- গরমের সময় মক্কার রৌদ্রতপ্ত মরুপ্রন্তরে শুইয়ে দিয়ে নির্যাতন চালাতে থাকলো। যারা দুর্বল এভাবে নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য করা হতো। কেউ কেউ অসহ্য নির্যতনের চাপে ইসলাম ত্যাগ করতো। আবার কেউ কেউ সাহায্য সমর্থন পেত এবং এভাবে আল্লাহ তাদেরকে রক্ষা করতেন। আবু বাকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ক্রীতদাস বিলাল এক সময় বনু জুমাহ গোত্রের এক ব্যক্তির ক্রীতদাস ছিলেন। তাঁর নাম ছিল বিলাল ইবনে রাবাহ। তাঁর মার নাম ছিল হামামাহ। তিনি তাদের মধ্যেই আশৈশব লালিত পালিত হয়েছিলেন। তিনি একজন নিষ্ঠাবান ও পবিত্রাত্মা মুসলিম ছিলেন। উমাইয়া ইবনে খালাফ ইবনে ওয়াহাব ইবনে হুযাফা ইবনে জুমাহ রৌদ্রতপ্ত দুপুরে তাঁকে মক্কার সমভূমিতে নিয়ে চিৎ করে শুইয়ে দিতো। অতঃপর তাঁর বুকের ওপর একটা প্রকা- পাথর চাপা দিয়ে রাখার নির্দেশ দিত। তারপর তাকে বলতো, “মুহাম্মাদকে অস্বীকার করে লাত ও উয্যার পূজা করতে রাজী না হলে আমৃত্যু এভাবেই থাকতে হবে।” এহেন কঠিন যন্ত্রণা ভোগের মুহূর্তেও তিনি কলতেন, “আহাদ” অর্থৎ আল্লাহ এক, আল্লাহ এক। তিনি এভাবে নিযৃাতন ভোগের সময় যখন ‘আহাদ’, ‘আহাদ’ উচ্চারণ করতেন, তখন মাঝে মাঝে ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল তাঁর কাছ দিয়ে যেতেন। বিলালের ঐ কথা শুনে ওয়ারাকা ইবনে নাওফেলও সাথে সাথে বলতেন, “আল্লাহর শপথ, হে বিলাল, সত্যই আল্লাহ এক, আল্লাহ এক, আল্লাহ এক।“ এরপর ওয়ারাকা উমাইয়া ইবনে খালাফের কাছে এবং বিলালকে নির্যাতনকারী বরী জুমাহ গোত্রের অন্যান্যদের কাছে যেয়ে বলতেন, “আল্লাহর শপথ, এই কারণে তোমরা যদি তাকে মেরে ফেল, তাহলে আমি তাকে অবশ্যই মহাপুণ্যবান মনে করবো এবং তার পদধূলি নেবো।” একদিন সেখান দিয়ে আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহু যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন বিলালকে সেই একই পন্থায় নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি উমাইয়া ইবনে খালাফকে বললেন, “এই অসহায় মানুষটাকে নির্যাতন করতে তোমার কি একটুও আল্লাহর ভয় হয় না? আর কত দিন এটা চালাবে?”

সে বললো, “তুমিই তো ওকে খারাপ করেছো। এখন তুমিই ওকে এ অবস্থা থেকে রেহাই দাও।”

আবু বাকর বললেন, “আমি তাই করবো। আমার কাছে ওর চেয়েও তাগড়া ও শক্তিশালী একটা ছেলে আছে সে তোমার ধর্মের অনুসারী। এর বদলে আমি তাকে দিয়ে দেবো।” সে বললো, “আমি রাজী।” আবু বাক্র বললেন, “আমি রাজী। সেটা তোমাকে দিলাম।” অতঃপর তিনি সেটা দিলেন উমাইয়াকে এবং উমাইয়ার কাছ থেকে বেলালকে নিয়ে মুক্ত করে দিলেন। হিজরাতের আগে আবু বাক্র বিলালসহ মোট সাতজন নওমুসলিম গোলামকে স্বাধীন করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আমের ইবনে ফুহাইরা, উম্মে উবাইস ্এবং যিননীরা। যিননীরাকে মুক্ত করার সময় তাঁর চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কুরাইশরা তা দেখে বললো, “ওর চোখ নষ্ট হয়েছে লাত ও উয্যার অভিশাপেই।” যিননীরা বললেন, “আল্লাহর শপথ, তোদের আমি কখনো মুক্ত করবো না”, তখন আবু বাক্র সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি কথাটা শোনামাত্রই বললেন, “হে অমুকের মা, তুমি শপথ ভঙ্গ কর।” সে বললো, “কী বলছো! শপথ ভঙ্গ করবো? তুমিই তো ওদেরকে খারাপ করেছো। এখন তুমিই মুক্ত কর।” আবু বাক্র বরলেন, “আমি ওদেরকে নিয়ে নিলাম! ওরা মুক্ত ও স্বাধীন। মেয়ে দুটিকে বললেন, “তোমরা মহিলার আটা ফিরিয়ে দাও।” মেয়েদ্বয় বললো, “হে আবু বাক্র, আগে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেব এবং পরে আটা ফিরিয়ে দেব কি?” আবু বাক্ র বললেন, “সে তোমাদের ইচ্ছা।”

আর একবার তিনি বনী মুয়াম্মালের একজন নও মুসলিম বাঁদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। উমার ইবনুল খাত্তাব তাঁর উপর নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে ইসলাম ত্যাগের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। উমার তখনো মুশরিক। তিনি মারতে মারতে যথন ক্লান্ত হযে গেলেন তখন তাকে বললেন, “তোর কাছে আমি ওজর জানাচ্ছি যে, শুধু ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কারণেই তোকে আর মারতে পাররম না।” মেয়েটি বললো, “আল্লাহ তোমার সাথে যেন এরূপ আচরণই করেন।” এই দৃশ্য দেখে আবু বাক্র তৎক্ষণাৎ বাঁদীটি কিনে নিয়ে মুক্ত করে দিলেন।

আবু বাক্রের (রা) পিতা আবু কুহাফা একদিন তাঁকে বললেন, “বেটা, আমি দেখছি তুমি শুধু দুর্বল দাস দাসীদেরকে মুক্ত করছো। যদি তুমি শক্তিশালী জোয়ান পুরুষ দাসদের মুক্ত করতে তাহলে প্রয়োজনের সময় তারা তোমার পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারতো।” একথা শুনে আবু বাক্র বললেন, “হে পিতা, আমি যা করছি তা একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যেই করছি।”

বনু মাখযূম গোত্রের লোকেরা আম্মার ইবনে ইয়াসার ও তাঁর পিতামাতাকে তপ্ত দুপুরের সময় মক্কার উতপ্ত মরুভূডমিতে নিয়ে নির্যাতন করতো। তাঁদের গোটা পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের ওপর নির্যাতন চলাকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের কাছে উপস্থিত হতেন এবং সান্তনা দিয়ে বলতেন, হে ইয়াসারের পরিবার, ধৈর্য ধারণ কর। তোমাদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।” আম্মারের মাতাকে (সুমাইয়া) তারা মারতে মারতে মেরেই ফেললো। তথাপি তিনি ইসলাম ত্যাগ করেননি।

আর পাপিষ্ঠ আবু জাহল যখনই শুনতো যে অমুক ইসলাম গ্রহণ করেছে, অমনি তার বিরুদ্ধে কুরাইশদেরকে উস্কিয়ে দিত। ইসলাম গ্রহণকারী যদি ভালো পদমর্যাদাধারী ব্যক্তি হতো তাহলেও তাঁকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতো এবং বলতো, “তুমি তোমার বাপের ধর্ম ত্যাগ করেছ। অথচ তোমার বাপ তোমার চেয়েও উত্তম। কাজেই আমরা তোমাকে বেকুফ প্রতিপন্ন করবো, তোমার মতামত যে খারাপ ও ভুল, তা আমরা প্রমাণ করে ছাড়বো, তোমার মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত করে তবে ক্ষান্ত হবো।” আর যদি তিনি ব্যবসায়ী হতেন তবে তাকে বলতো, “আমরা তোমার ব্যবসায়ের সর্বনাশ ঘটাবো এবং তোমার মালপত্র নষ্ট করে দেবো।” আর যদি দুর্বল কেউ হতো তাহলে মারপিট করতো ও তার বিরুদ্ধে লোকজনকে লেলিয়ে দিত।

সাঈদ ইবনে যুবাইর বলেন, “আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বসকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের ওপর কি এতদূর অত্যাচার চালাতো যার ফলে তারা ইসলাম ত্যাগ করলেও তাদের ওপর দোষারোপ করা চলতো না?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ। তারা তাঁদেরকে প্রহার করত এবং অনাহার ও পিপাসায় কষ্ট দিত। তাঁদের এক একজন এ ধরনের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এতদূর হীনবল হয়ে পড়তেন যে, সোজা হয়ে বসে থাকতেও পারতেন না।

এহেন নির্যাতন চালানোর পর তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করতো, ‘স্বীকার কর আল্লাহর ছাড়া লাত-উয্যাও তোমার মাবুদ?’ কেউ কেউ বলতো, হাঁ।’ এমনকি একটা তুচ্ছ পোকামকড়ও দেখিয়ে বলতো, ‘আল্লাহ্ ছাড়া একেও মাবুদ বলে মান তো?’ কেউ কেউ অসহ্য নির্যাতন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনন্যোপায় হয়ে বলতো, ‘হাঁ’।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *