হিমালয়ে সিদ্ধিলাভ, ব্ৰহ্মদর্শন ও বিশ্বপর্যটন

পঞ্চম অধ্যায় হিমালয়ে সিদ্ধিলাভ, ব্ৰহ্মদর্শন ও বিশ্বপর্যটন

হিমালয়ে আগমন

বহুদিন ধরে ক্রমাগত পথ চলতে চলতে অনেক পাহাড়-পর্বত-বনাঞ্চল পেরিয়ে গুরু ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদের নিয়ে পৌঁছলেন হিমালয়ে অবস্থিত বদ্রীনাথে। এখান থেকে দেখা যায় তুষারাবৃত হিমালয়ের শিখরদেশ। তাদের পৌঁছতে হবে হিমালয়ের সেই বরফাবৃত শিখরদেশে। প্রথমে গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে বদ্রীনারায়ণ দর্শন করলেন। তারপর আবার হিমালয়ের চড়াই বেয়ে বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে উপরে উঠতে লাগলেন। যখন এই তিন সাধনত্রী হিমালয়ে আরোহণ করছেন, তখন তাদের মনে হচ্ছে তারা এখন সেই পবিত্র ভূমি অতিক্রম করছেন যেখানে পূর্বে কত যোগী সিদ্ধিলাভ করে মহর্ষি হয়েছেন। হিমালয় সিদ্ধযোগীদের পীঠস্থান। পথ চলতে চলতে সূর্যদেব যখন অস্তাচলে যাচ্ছেন, তখন তার অস্তরাগে হিমালয়ের বরফাবৃত শিখরদেশ এক অপূর্বরূপ ধারণ করেছে। অবাক বিস্ময়ে আচার্যদেব শিষ্যদের নিয়ে সেই রূপ দেখেন আর এগিয়ে চলেন। হিমালয়ের বরফাবৃত অঞ্চলে পৌঁছে লোকনাথ ও বেণীমাধব মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অপরূপ হিমালয় শৃঙ্গের দিকে। চতুর্দিকে বরফ। তার মধ্যে কোথাও কোথাও পর্বতগাত্রে গুহা দেখা যায়। নির্জন নিস্তব্ধ বরফাঞ্চল। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো–বাবা লোকনাথ, বাবা বেণীমাধব! এই নির্জন তুষারাবৃত পর্বতাঞ্চলে তাদের নাম শুনে অবাক হয়ে যান লোকনাথ ও বেণীমাধব। চারিদিকে নিরীক্ষণ করে তারা দেখতে পেলেন অদূরে এক গুহার দ্বারে দাঁড়িয়ে আছেন জটাজুটমণ্ডিত দুই যোগী। তাদের শরীর থেকে নির্গত হচ্ছে দীপ্ত আভা। সেই দীপ্তিতেই সেই গুহাদ্বার আলোকিত হয়ে আছে। আচার্যদেব বুঝলেন যে, এই দুই সিদ্ধযোগী লোকনাথ ও বেণীমাধবকে কৃপা করার জন্যই তাদের ডেকেছেন। তিনি শিষ্যদের ইঙ্গিত করলেন সেই সিদ্ধযোগীদের নিকট যেতে। লোকনাথ ও বেণীমাধব গুরুদেবকে প্রণাম করে সেই দুই সিদ্ধযোগীর কাছে এগিয়ে গিয়ে ভক্তিভরে তাঁদের প্রণাম করলেন। সেই দুই সিদ্ধযোগী ক্ষণকাল তাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলেন এবং তারপর লোকনাথ ও বেণীমাধবকে নিয়ে গুহার অভ্যন্তরে গেলেন। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলিও তাদের সঙ্গে গুহায় প্রবেশ করলেন।

.

হিমালয় গুহায় বিরামহীন যোগসাধনা ও সিদ্ধিলাভ

সেই দু’জন সিদ্ধযোগী লোকনাথ ও বেণীমাধবকে বললেন, আমরা এবার তোমাদের ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য যোগের বিভিন্ন ক্রিয়া শেখাবো। এরপর চললো বরফাবৃত হিমালয় গুহাতে বিরামহীন যোগানুষ্ঠান শিক্ষা। লোকনাথ ও বেণীমাধব সিদ্ধযোগীদের একজনকে বড়ঠাকুর এবং অন্যজনকে ছোট ঠাকুর সম্বোধন করতেন। গুরু ভগবান গাঙ্গুলির আন্তরিক শিক্ষায় লোকনাথ ও বেণীমাধব অষ্টাঙ্গ যোগসাধনে পারদর্শিতা লাভ করেছেন এবং অষ্টাদশ সিদ্ধির মধ্যে অনেকগুলি প্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান লাভ বা ব্রহ্মদর্শনের জন্য প্রয়োজন অষ্টাঙ্গ যোগ সাধনায় আরও উত্তম উৎকর্ষতা। সেই উৎকর্ষতা লাভের জন্য প্রয়োজন তুষারাবৃত হিমালয়ে বসে বিরামহীন যোগসাধনা করার শক্তি সঞ্চয়ন এবং সুকঠোর কৃচ্ছুব্রত পালন। দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয় এবং সমস্ত সত্তাকে জয় করে আত্মার মিলন ঘটাতে হবে পরমাত্মার সঙ্গে। সিদ্ধযোগীদ্বয় লোকনাথ ও বেণীমাধবকে উচ্চমার্গের সর্বযোগানুষ্ঠান শিখিয়ে দিলেন যাতে তারা সিদ্ধিলাভে সমর্থ হন। তারা এও বললেন, তোমাদের শরীরে কোনো রক্তকণিকা থাকবে না। দেহের রক্ত সাদা রসে পরিণত হবে। কিন্তু তোমরা ভয় পেও না। শরীরের পঞ্চভূতের প্রতি তোমাদের যেন কোনো আসক্তি না থাকে। ক্লান্তিহীন, বিরামহীন যোগসাধনাই তোমাদের একমাত্র অবলম্বন। যতদিন তোমাদের ব্রহ্মদর্শন না হয়, ততদিন তোমরা সুকঠোর কৃচ্ছুব্রত পালন করে যোগাসনে নিয়োজিত থাকবে। একদিন তোমরা সিদ্ধিলাভ করবে। লোকনাথ ও বেণীমাধবকে উপদেশ ও শিক্ষা দিয়ে দুই সিদ্ধযোগী বিদায় নিলেন।

যোগীদ্বয় বিদায় নিলে লোকনাথ ও বেণীমাধব কঠোর যোগসাধনা শুরু করলেন। তুষারাবৃত হিমালয়ের কোলে সম্পূর্ণ দিগম্বর রূপে চলতে থাকে যোগসাধনা। কোনোদিন একবার ফলমূল গ্রহণ করেন, কোনোদিন বা কন্দমূল আহার করেন। বেশিরভাগ দিন অনাহারেই চলতে থাকে কঠিন যোগসাধনা। দুই সাধকের শরীর হিমালয়ের মতো তুষারাবৃত হয়ে যায় আবার সেই বরফ গলে জল হয়ে যায়; কিন্তু সমাধির বুখান হয় না। গুরুদেব প্রত্যক্ষ করতে থাকেন শিষ্যদের সেই বিরামহীন যোগসাধনা। ক্রমে যোগীদ্বয়ের শরীরে দেখা যায় এক উজ্জ্বল আভা। গুরুদেব বুঝতে পারেন তার শিষ্যদ্বয় সিদ্ধিলাভের পথে এগিয়ে চলেছেন। পুলকিত হয়ে ওঠে তার মন। সর্বক্ষণ চেয়ে থাকেন তিনি তার প্রিয় শিষ্যদের দিকে। এইভাবে প্রায় ৫০ বছর কঠোর যোগ সাধনার পর লোকনাথ ও বেণীমাধব ব্রহ্মদর্শন লাভ করেন। তারা তখন নিজেদের অস্তিত্ব দেখতে পান না। নিজেদের মধ্যে ব্রহ্মদর্শন করেন অর্থাৎ নিজেতে আর পরমাত্মাতে কোনো ভেদ দেখতে পান না। নিজের ও পরমাত্মার রূপ এক বোধ হয়। তাদের অঙ্গ থেকে বের হতে থাকে এক অপূর্ব জ্যোতিরাশি। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেই জীব মুক্ত হয়। যে ব্যক্তি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন, তার মরদেহ মর্তলোক ত্যাগ করলেই নির্বাণ মুক্তি হয়ে থাকে। তার জীবাত্মা সূর্যমণ্ডল ভেদ করে ব্রহ্মলোকে স্থান পায়।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন, এই কথার অর্থ কি?–এই তত্ত্ব জানবার জন্য ব্রহ্মানন্দ ভারতী এই প্রশ্নটি বাবাকে করেছিলেন। তার উত্তরে বাবা বলেন–আমি ও আমার দেহ এবং আমার কর্ম আছে, আর কিছু চাই না। এই কর্মক্ষয় হইলেই আমি একক থাকিব-তাহাই আমি চাই। এরপর ব্রহ্মানন্দ ভারতী প্রশ্ন করেন–তোমার শরীরের সঙ্গে বাহ্যজগতের যতদূর সংশ্রব ঘটে, ততদূর পর্যন্ত জগৎকে তোমার কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে পারি, যাহা তোমার অগোচর অর্থাৎ জগতের যে ভাগের সহিত তোমার সংশ্রব আদপে ঘটে না, তাহাকে তোমার কর্ম বুঝিব কিরূপে? বাবা তার উত্তরে বলেছিলেন–যাহা আমার গোচর নহে তাহা আছে বলিয়া, তোমাদের মতো ধারণা আমার নাই। বাবা লোকনাথ প্রবৃত্তি দ্বারা আপনার কর্ম অনুভব করতেন। তিনি বলেছিলেন-যখন কোনো বিষয়েই আমাকে প্রবৃত্ত হইতে হইবে না; তখন কর্মক্ষয় হইয়াছে বুঝা যাইবে। তাহার পর হইতে আমি একক থাকিব। তাহা হইলেই আমি মুক্ত থাকিব। তাহাই একমেবাদ্বিতীয়ম।

ব্রহ্মজ্ঞান বলতে বোঝা যায় যে, যখন যোগী নিজ আত্মাকে পরমাত্মারই অংশ এইরূপ জ্ঞান লাভ করেন এবং নিজ আত্মার মধ্যে পরমাত্মার দর্শন পান, তার মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত হয় যে সে পরমাত্মার সঙ্গেই সমস্ত জগৎব্যাপী অবস্থান করছেন, তাতে ও পরমাত্মাতে কোনো প্রভেদ নেই এবং এই জ্ঞানের আলোকে যখন তার দেহ দিব্যজ্যোতি প্রাপ্ত হয়, সেই অবস্থাকে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ বলা হয়। তখনই তিনি হন একমেবাদ্বিতীয়। সেই সময় যোগীর আত্মা পরমাত্মার সঙ্গে লীণ হয়ে যায়।

বেণীমাধব ও বাবা লোকনাথের সেই অবস্থা প্রাপ্তি হয়েছিল। তাদের অঙ্গ হতে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল এক অপূর্ব জ্যোতিরাশি। আচার্যদেব শিষ্যদের এই রূপ দেখে মোহিত হয়ে যান। বুঝতে পারেন, তার এতো দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম সফল হয়েছে। লোকনাথ ও বেণীমাধব সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন। পরমেশ্বর তাঁর প্রতি যে দায়িত্ব সঁপেছিলেন ৯০ বছর আগে, এখন তিনি তা সম্পূর্ণ করতে পেরেছেন। সেই সময় লোকনাথের বয়স প্রায় ৯০ বছর এবং গুরু ভগবান গাঙ্গুলির বয়স প্রায় ১৫০ বছর। দীর্ঘ সমাধির পরে যখন লোকনাথের বুত্থান হল তখন তিনি সামনে গুরুদেবকে দেখলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে হল, যে গুরু তাকে এই সিদ্ধিলাভের জন্য তিল তিল করে তৈরি করেছেন, তিনি এখনও সিদ্ধিলাভ করতে পারেন নি। দীর্ঘ ৮০ বছর ধরে গুরুদেব নিজে কত কষ্ট সহ্য করে তাদের শিক্ষা দিয়ে তৈরি করেছেন সাধনমার্গের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিতে। গুরুর অপত্য স্নেহ এবং কৃপায় তিনি ব্রহ্মদর্শন লাভ করলেন, সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলেন, কিন্তু সর্বদা জ্ঞানমার্গে বিচরণকারী গুরু আজও সাধনমার্গে সিদ্ধিলাভ করতে পারেন নি। এই কথা ভেবে লোকনাথ গুরুর সামনে অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন ও বললেন, গুরুদেব, আপনার অক্লান্ত চেষ্টায়, শিক্ষায় আমি সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলাম। আপনি আমায় পরিত্রাণ করলেন, কিন্তু আপনি নিজে যে সাধন মার্গের একই অবস্থায় রয়ে গেলেন, তা দেখে আমি ধৈর্যধারণ করতে পারছি না। এমন কেন হল গুরুদেব!

আচার্যদেব সদ্যসিদ্ধিপ্রাপ্ত উজ্জ্বল দেহধারী তার শিষ্যের কথা শুনে বললেন, লোকনাথ আমি জ্ঞানমার্গাবলম্বী। আমি নিজে সর্বদা জ্ঞানমার্গ অবলম্বন করে চলেছি কিন্তু তোমাদের আমি কর্মমার্গের শিক্ষা দিয়ে কর্মযোগে রত করিয়েছি। আমি নিজে কর্মমার্গ অবলম্বন করে সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করিনি। কর্মমার্গের সাধনায় তুমি ও বেণীমাধব যেভাবে সিদ্ধিলাভ করেছে, আমি তা দর্শন করে পুলকিত ও বিস্মিত হচ্ছি। আমার উপর প্রদত্ত পরমেশ্বরের কাজ শেষ হয়েছে। আমি শীঘ্রই দেহত্যাগ করে আবার জন্মগ্রহণ করবো। তখন তুমি আমাকে কর্মর্মর্গে পরিচালিত করে আমার উদ্ধারের বিধান করবে। লোকনাথ গুরুদেবের এই কথা শুনে বললেন– গুরুদেব, এত বড় কঠিন কাজের ভার আমাকে দিও না। আজ পর্যন্ত তুমি আমাকে এমনভাবে প্রস্তুত করোনি যে তোমার মতো অদ্বিতীয় পণ্ডিত ব্যক্তির মত পরিবর্তন করতে আমি সমর্থ হতে পারবো। তুমি এই সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাবুদ্ধিসহ জন্মগ্রহণ করার পর যখন আমার শিষ্য হয়ে আসবে, তখন আমি কিভাবে তোমার মত ফিরিয়ে তোমাকে কর্মর্মর্গে প্রবৃত্ত করাবো?

আচার্যদেব লোকনাথকে বললেন–এ বিষয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি নিজেই এ ভার গ্রহণ করবো। লোকনাথ গুরুদেবের এই কথা শুনে বলেন, তাই হবে। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। এই কথা বলে লোকনাথ গুরুদেবকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে যুক্তকরে তার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। গুরু-শিষ্যের এই কথোপকথন থেকে বোঝা যায় যে, গুরু যদি সিদ্ধিপ্রাপ্ত নাও হয় এবং একনিষ্ঠভাবে শিষ্যের মঙ্গল চিন্তা করে তাকে সাধন মার্গের পথ প্রদর্শন করে ব্রহ্মলাভের উপযুক্ত করে তুলতে পারেন, তবে সেই শিষ্য ব্ৰহ্মদর্শন করতে পারেন। এই গুরু ঋণ অপরিশোধ্য। লোকনাথ গুরুর অসীম কৃপা স্মরণ করে তার জন্মান্তরে উদ্ধারের ভার নিয়েছেন। ভারতের অধ্যাত্ম ইতিহাসে এমন ঘটনা বোধহয় দেখা যায় না।

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি এরপর তার অবশিষ্ট কার্যগুলি শেষ করতে চান। তিনি লোকনাথকে বললেন, এবার তোমাকে সন্ন্যাস নিতে হবে। লোকনাথ গুরুদেবের এই কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তবে কি তিনি সন্ন্যাসী না হয়েই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন! কিন্তু গুরুকে এই সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে সাহস পেলেন না।

আচার্যদেব লোকনাথকে বললেন, তোমার পিতা রামকানাইয়ের ইচ্ছা ছিল, তার বংশের কেউ বৈদিক সন্ন্যাসী হলে, তার ষাটকুল উদ্ধার হবে। তিনি আমাকে সেই কথা বলেছিলেন এবং সেই উদ্দেশ্যেই তোমার উপনয়ন সংস্কারের সময় দণ্ডীঘরেই তোমায় বিদায় দিয়ে আমার হাতে সঁপেছিলেন। তুমি এতদিন যোগসাধনা করে যোগসাধনায় সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছ। এখন সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত হয়ে তোমাকে পরিভ্রমণ করে লোকশিক্ষা দিতে হবে। হিন্দুধর্মে বিভিন্ন প্রকার সন্ন্যাসের বিধান আছে–যেমন, বৈদিক, তান্ত্রিক, বৈষ্ণব, উদাসী। এর মধ্যে বৈদিক সন্ন্যাস সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ এবং তোমার পিতারও এই ইচ্ছাই ছিল। আমি আগামীকাল তোমাকে সন্ন্যাসমন্ত্রে দীক্ষা দেব। আগামীকাল দীক্ষান্তে তুমি হবে একজন সিদ্ধিপ্রাপ্ত বৈদিক সন্ন্যাসী।

.

লোকনাথের সন্ন্যাসদীক্ষা

পরদিন এক শুভমূহূর্তে আচার্য লোকনাথকে সন্ন্যাসাশ্রমে দীক্ষা দিলেন এবং তাঁর নুতন নামকরণ হল–লোকনাথ ব্রহ্মচারী। লোকনাথ নামের পরে যে ব্রহ্মচারী উপাধি যোগ করা হল সেটি কেবলমাত্র একটি উপাধি নয়। ব্রহ্মচারী শব্দের ব্যাপক অর্থকে অনুধাবন করে এবং লোকনাথের যোগৈশ্বর্যকে ভিত্তি করেই তার নাম লোকনাথ ব্রহ্মচারী রাখা হয়েছিল। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি একজন বেদজ্ঞ পুরুষ ছিলেন। অথর্ববেদে কথিত ব্রহ্মচারী কথার মাহাত্ম তিনি জানতেন এবং লোকনাথের যোগৈশ্বর্য সম্বন্ধেও তার পূর্ণ জ্ঞান ছিল। এই দুইয়ের সমন্বয়েই তিনি লোকনাথ ব্রহ্মচারী নামকরণ করেছিলেন।

অথর্ববেদে কথিত আছে যে, ব্রহ্মচারী হচ্ছেন তিনি, যিনি সর্বদা বেদাত্মক ব্রহ্মে বিচরণশীল এবং যিনি নিজ তপস্যা দ্বারা পৃথিবীব্যাপ্ত করতে করতে স্বনিয়মে প্রবর্তিত হচ্ছেন। ব্রহ্মচারীতে ইন্দ্রাদি সকল দেবগণ অনুগ্রহ বুদ্ধিযুক্ত হয়। ব্রহ্মচারী নিজ তপস্যায় পৃথিবী ও দ্যুলোক পোষণ করেন। পিতৃগণ, দেবগণ ও ইন্দ্রাদি সকল দেবতা এবং অন্তরিক্ষচারী বসুগণ ও গন্ধর্বগণ ব্রহ্মচারীর রক্ষার জন্য পৃথক পৃথকভাবে অনুগমন করে। সৃষ্টির আদি তেত্রিশ দেবতা–যথা, অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, প্রজাপতি ও বষট্‌কার–এবং তাদের বিভূতি স্বরূপ তিনশত তেত্রিশ দেবতা ও ষট্‌সহ সকল দেবতাকে অর্থাৎ দেব-মনুষ্যাদি সকল জগৎ ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচর্যের দ্বারা ধারণ করেন। ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচর্য মহিমার দ্বারা ব্রাহ্মণ জাতি, গঙ্গাদি নদী, স্বর্গাদিশোক, প্রজাপতি, সত্যলোকে অবস্থানকারী আদিব্রহ্মা পরমেষ্ঠী ও মূল প্রপঞ্চ শরীরাভিমানী বিরাট পুরুষকে ধারণ করেন। ব্রহ্মচারী তার তপোমহিমায় সূর্য ও অগ্নিযুক্ত ভূমিতে অধিষ্ঠান করেন অর্থাৎ অগ্নিরূপে তার অধিদেবতা হন।

কেলমাত্র সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করলেই ব্রহ্মচারী হয় না। ব্রহ্মচারী শব্দের এই ব্যাপক অর্থ অনুযায়ী সন্ন্যাস দীক্ষান্তে লোকনাথ ব্রহ্মচারী নাম হয়। এই নামকরণের মধ্য দিয়েই প্রতিভাত হয় যে, বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যোগৈশ্বর্য কত উচ্চ ছিল, তিনি কত বড় মহাযোগী ছিলেন এবং তার পূর্ণ প্রকাশ কি ছিল!

আচার্যদেব লোকনাথকে বললেন, তুমি একজন মহান যোগীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে কিন্তু তোমার প্রাপ্ত ব্রহ্মজ্ঞানের আলোকে তোমায় জগৎকে আলোকিত করতে হবে। লোকশিক্ষার মাধ্যমে তুমি এই কাজ করবে। যোগসাধনায় সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলে সাধকের নিজের উন্নতি হয়। কিন্তু প্রকৃত সাধক কখনও নিজের উন্নতির জন্য সাধনা করেন না। জগতের সব জীবকে মুক্তির আলো প্রদর্শনের জন্য সাধনায় সিদ্ধিলাভ। একজন কর্মযোগী সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে কর্মের মাধ্যমে সাধনায় প্রাপ্ত আলোয় জগৎকে আলোকিত করে।

সাধক দুই প্রকারের হয়–জীবকোটি ও ঈশ্বরকোটি। জীবকোটির সাধকেরা সিদ্ধি লাভের পর আর সাধারণ মানুষের মাঝে প্রকটিত হন না। ঈশ্বরকোটির সাধকেরা সিদ্ধিলাভের পর স্বেচ্ছায় অথবা ঈশ্বরের আদেশে লোকশিক্ষার জন্য সাধারণের মাঝে প্রকটিত হন। শুকদেব নির্বিকল্প সমাধিতে মগ্ন ছিলেন। ঈশ্বর শুকদেবকে দিয়ে লোকশিক্ষা দেওয়াবার জন্য দেবর্ষি নারদকে তার কাছে পাঠালেন। ঈশ্বরের ইচ্ছা ছিল শুকদেব মুনি রাজা পরীক্ষিৎকে ভাগবত শোনাবেন যার থেকে মর্ত্যে লোকশিক্ষা হবে। নারদমুনি শুকদেবের কাছে গিয়ে দেখেন, তিনি বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় সমাধি মগ্ন। তিনি তখন বীণা বাজিয়ে শ্রীহরির রূপটি চারটি শ্লোকে শুকদেবের সামনে বর্ণনা করলেন। শ্রীহরির রূপ কানে প্রবেশ করা মাত্র শুকদেবের সমাধি থেকে বুত্থান হল। তিনি হৃদয়মধ্যে শ্রীহরির মনোহর রূপ দর্শন করলেন। দেবর্ষি নারদ তার সম্মুখে পরমেশ্বরের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। শুকদেব তারপর রাজা পরীক্ষিতের সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁকে ভাগবত পাঠ করে শোনালেন। তার থেকে লোকশিক্ষার প্রসার হলো। আচার্যদেব আরও বললেন, আদি শঙ্করাচার্যও ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার পর অধ্যাত্মলোকের উচ্চমার্গ থেকে লোকশিক্ষা ও ধর্মসংস্থাপনা হেতু সাধারণের মাঝে নেমে এসেছিলেন।

বাবা লোকনাথ, তোমাকে এখন লোকশিক্ষার জন্য সাধারণের মাঝে বাস করতে হবে। নিজেকে জাতির ও সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত করতে হবে। যে ব্রহ্মজ্ঞানের সন্ধান তুমি পেয়েছ, সেই আলোয় জগৎ ও সমাজকে আলোকিত করতে হবে। পতিত মানুষকে উদ্ধার করতে হবে। এই ভারতবর্ষ হিন্দু-মুসলমানের দেশ। কেবল হিন্দুধর্ম জ্ঞানে তুমি এ দেশের আপামর জনগণের কল্যাণ সাধনে সমর্থ হবে না। তোমাকে হিন্দুধর্মের বিষয়গুলির সঙ্গে মুসলমান ধর্মের বিষয়গুলিও জানতে হবে। এইজন্য তোমাকে কোরাণ শরিফ শিখতে হবে।

.

কাবুলে কোরাণ শিক্ষা

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তার প্রিয় শিষ্যদ্বয়দের কোরাণ শরিফ শিক্ষার জন্য কাবুল যেতে মনস্থ করলেন। আফগানিস্থানের কাবুলে তৎকালীন বিখ্যাত পারসিক কবি মোল্লাসাদীর বাস। আচার্যদেব তাঁর শিষ্যদের নিয়ে হিমালয় থেকে পদব্রজে কাবুলের মিরাজনগরে মোল্লাসাদীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। মোল্লাসাদী কেবলমাত্র একজন কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন জ্ঞানমার্গের একজন সাধক। গুরু ভগবান গাঙ্গুলির সঙ্গে তাঁর দুই শিষ্যকে দর্শন করে মোল্লাসাদী অত্যন্ত প্রীত হলেন। আচার্যদেব তাকে বললেন যে, তিনি তার দুই শিষ্যকে নিয়ে এসেছেন ইসলাম ধর্ম শিক্ষার জন্য। তার এই দুই শিষ্য দীর্ঘ ৮০ বছর যোগানুষ্ঠানে ব্রতী হয়ে সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন। এখন দেশে লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজে ব্রতী হবার জন্য এদের ইসলাম ধর্ম শিক্ষারও প্রয়োজন। জীবনের প্রকৃত সত্যকে লোকসমক্ষে উদঘাটন করতে হলে সব ধর্মকে জানতে হবে। সব ধর্মের মূল সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে। তবেই প্রকৃত লোকশিক্ষা সম্ভব। লোকনাথ ও বেণীমাধব গুরুর ঐকান্তিক ইচ্ছায় মোল্লাসাদীর কাছে এক বছর অবস্থান করে ইসলাম ধর্মের মূলতত্ত্ব ও কোরাণ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করেন। মোল্লাসাদীর কাছে জ্ঞান লাভের পর আচার্যদেব আবার হিমালয়ে প্রত্যাবর্তন করেন এবং নিঃসংশয় হন যে এখন তাঁর শিষ্যদ্বয় লোকশিক্ষা দেবার উপযুক্ত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তার আগে শিষ্যদের ব্রহ্মজ্ঞ হতে হবে এবং সেই পথ উক্রমণের জন্য দরকার যোগমার্গের সর্বশেষ স্তরে পৌঁছানো। শিষ্যদের সেই মার্গে নিয়ে যাবার জন্য দরকার আরও শক্তিধর মহাযোগীর সাহচর্য। তার জন্য তাঁকে যেতে হবে কাশীধামে। তিনি একদিন লোকনাথকে বললেন, বাবা লোকনাথ এবার আমার দেহত্যাগ করার সময় হয়েছে। আমি কাশীধামে দেহত্যাগ করবো। সেখানে শুরু হবে তোমাদের আর এক মহা যোগানুষ্ঠান। সেই যোগানুষ্ঠানে সফল হলেই তোমরা হবে মহাযোগী।

.

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির কাশীধামের মাহাত্ম্য বর্ণন

আচার্যদেবের কথা শুনে লোকনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, গুরুদেব আপনি কাশীতে কেন দেহত্যাগ করবেন? আচার্যদেব লোকনাথের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ভাগীরথী তীরে এক মহাপুণ্যভূমি বারাণসী ভগবান শঙ্করের রাজধানী রূপে খ্যাত। আমি সেখানেই দেহত্যাগ করবো এবং সেখানেই মহাযোগানুষ্ঠানের পর তোমরা ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগীরূপে আত্মপ্রকাশ করবে।

ব্রহ্মচারী লোকনাথ বললেন, গুরুদেব পুণ্যভূমি বারাণসী ধাম সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলুন। বারাণসী ধাম কেনই বা শঙ্করের রাজধানী রূপে পরিচিত?

আচার্যদেব বললেন, অসি ও বরুণা নদীর সঙ্গম হওয়ায় কাশীধাম বারাণসী নামে খ্যাত। এই কাশীতে চক্রসরোবরে, মণিকর্ণিকা ও সুরধুনী মিলিত হয়েছে। অসি, বরুণা ও জাহ্নবীর মিলনে এই স্থান সর্বদুঃখবিনাশিনী মোক্ষপ্রদ এক অবিমুক্তধাম। লোকনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, গুরুদেব, কাশীধামের এত মহিমা কিসের জন্য? কেনই বা একে মোক্ষপ্রদ ও অবিমুক্ত ধাম বলা হয়?

আচার্যদেব তখন বললেন, প্রলয়কালে সমস্ত জগৎ সংসার যখন জলপ্লাবিত হয়, তখন দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিশূলের উপর কাশীধাম ছিল। মহাপ্রলয় সমাপ্ত হলে মহাদেব তার পদতল দ্বারা এই কাশীক্ষেত্রকে নির্মাণ করেন। পঞ্চক্রোশ বিস্তৃত এই কাশীধামে দেবাদিদেব মহাদেব ও মাতা পার্বতী সদা বিহার করেন। প্রলয়কালেও তারা কাশীধাম ত্যাগ করেন না। এইজন্য পণ্ডিতগণ কাশীধামকে অবিমুক্তধাম বলেছেন। এই কাশীধামে একদা বিষ্ণুদেব তাঁর চক্র দিয়ে এক পুষ্করিণী খনন করে তার তীরে বসে কঠোর তপস্যা করেন। তপস্যায় তার প্রদীপ্ত তেজ দেখে দেব মহেশ্বর বিষ্ণুকে বৰু প্রার্থনা করতে বলেন। তখন বিষ্ণুদেব বলেন, আমি ভবানীর সঙ্গে আপনাকে সর্বদা দর্শন করতে অভিলাষ করি। মহেশ্বর বিষ্ণুদেবকে এই বরদান করে বললেন, তোমার কঠোর তপস্যায় আমার দেহ কম্পিত হয়েছিল এবং সেইসময় আমার কর্ণ থেকে মণিকুণ্ডল এইস্থানে পতিত হয়। সেইজন্য এই রমণীয় স্থানের নাম দিলাম মণিকর্ণিকা। তদবধি কাশীর এই মণিকর্ণিকা ঘাট এক শ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র এবং মোক্ষপ্রদ বলে বিখ্যাত হয়েছে। এখানে বিশ্বেশ্বর নামে যে শিবলিঙ্গ আছেন, তিনিই জ্যোতির্লিঙ্গ। এই কাশীধামকে সদা রুদ্রগণ রক্ষা করেন। এই কাশীধামে আছেন এক শিবকল্প মহাযোগী। তার নাম হিতলাল মিশ্র। আমি সেই মহাযোগীর হাতে তোমাদের সমর্পণ করে মণিকর্ণিকা ঘাটে যোগাসনে দেহত্যাগ করবো। লোকনাথ তখন গুরুদেবকে বললেন, গুরুদেব, এই মহাযোগী হিতলাল মিশ্র কে? আপনি কেনই বা আমাদের তার হাতে সমর্পণ করবেন?

আচার্য তখন বললেন, এই মহাযোগী হিতলাল মিশ্র প্রায় ৮০ বছর যাবৎ কাশীধামে বাস করছেন। লোকে তাকে সচল বিশ্বনাথ বলে জানে। তিনি জগতে মানব বিগ্রহ তৈলঙ্গস্বামী নামে খ্যাত। প্রতিদিন কাশীর গঙ্গায় অজস্র ভক্ত ও তীর্থযাত্রীগণ স্নান করে ঘাটের উপর এসে শিবজ্ঞানে মহাযোগীর চরণ বন্দনা করেন। সুদীর্ঘকাল কঠোর তপস্যা করে অসামান্য যোগবিভূতির অধিকারী হয়েছেন এই পরম পূজ্য হিতলাল মিশ্র। মুক্তিকামী মানুষের কল্যাণে তিনি সর্বদা তাঁর অমূল্য যোগসম্পদ বিলিয়ে দিচ্ছেন। তার স্পর্শে কত মুমূর্য মানুষ জীবন পেয়েছেন, কত মৃত মানুষ প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। এই মহাযোগীর কাছে যোগের যে গুহ্যতত্ত্ব আছে, তা অন্য কারও কাছে নেই। তোমাদের এখন ব্রহ্মজ্ঞ হতে হবে। ব্রহ্মজ্ঞ হবার জন্য যোগের যে গুহ্যতত্ত্ব শিখতে হবে, তার জন্য হিতলাল মিশ্র ভিন্ন অন্য কেহ নাই। আমার ইচ্ছা তোমরা দুজনে এই চলমান শিবের সান্নিধ্যে থেকে যোগমার্গের সব নিগুঢ় তত্ত্বগুলি শিখে এমন এক উচ্চস্তরে পৌঁছে যাও, যেখানে যোগী সর্বদা ভগবানের নিত্যসঙ্গ লাভ করেন এবং এক পরমানন্দে অবস্থান করেন। যোগের সেই সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছলে তোমরা ভগবানের অবতারত্ব লাভ করবে এবং সর্বভূতের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হবে। তোমরা জগতে ব্রহ্মজ্ঞ বলে পরিচিত হবে। তোমাদের শরীর পূর্ণ ব্রহ্মে রূপান্তরিত হবে।

.

লোকনাথের কাশীধাম যাত্রা

লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব গুরুদেবের কাছে আশ্চর্য চলমান শিবের কথা শুনে ভাবতে থাকেন কত বড় মহাযোগী হলে তবে এই দেহকে চলমান শিবে পরিণত করা যায়! আচার্যদেব শিষ্যদের নিয়ে কাশীধামে পৌঁছে হিতলাল মিশ্রর খোঁজ করতে থাকেন। হিতলাল মিশ্র তখন মণিকর্ণিকার ঘাটে অবস্থান করছিলেন। তথায় পৌঁছে আচার্যদেব বললেন, যোগেশ্বর হিতলাল, আমার এই বালকদুটির ভার আপনার হাতে সমর্পণ করে আমি এবার দেহত্যাগ করতে চাই। আপনি এদের ভার নিন। যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী বালকদের প্রতি নিরীক্ষণ করে এঁদের ভার গ্রহণ করতে সম্মত হলেন। এবার আচার্য নিশ্চিত হলেন। দীর্ঘ আট দশকের অধিক কাল ধরে যে আশা তিনি মনে পোষণ করে এসেছেন এবং ঈশ্বরের আদেশবলে যে কার্যভার তিনি বহন করে এসেছেন, আজ তার সমাপ্তিক্ষণ এসেছে। তার প্রিয় শিষ্যদ্বয় হিমালয়ে সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন। এখন দেবতুল্য তৈলঙ্গস্বামীর তত্ত্বাবধানে তারা ব্রহ্মজ্ঞ হয়ে দেব সাযুজ্য লাভ করবে এবং জগতের কল্যাণে ব্রতী হবে। কর্মযোগী না হয়েও তিনি কর্মযোগে এইরূপ মহাসিদ্ধি লাভ প্রত্যক্ষ করেছেন। এবার তাকে এই দেহ ত্যাগ করে আবার দেহধারণ করতে হবে কর্মযোগে আত্মার মুক্তির জন্য। সেই সময় আগত। আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে বলেন, লোকনাথ, বেণীমাধব আমি এইবার মণিকর্ণিকার ঘাটে দেহত্যাগ করবো। এই কথা বলে গঙ্গায় স্নান করে মহান আচার্যদেব মণিকর্ণিকার ঘাটে যোগাসনে বসলেন। যোগাসনেই আচার্যদেব দেহত্যাগ করে নিত্যধামে গমন করলেন। লোকনাথ ও বেণীমাধব আচার্যদেবের দেহ স্পর্শ করেই বুঝলেন, তার আত্মা ইহজগতের লীলা সাঙ্গ করে পরমধামে চলে গেছে। তারা গুরুদেবের দেহের যথাবিধি সৎকার করলেন।

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির দেহত্যাগের পর লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব যোগীবর ত্রৈলঙ্গস্বামীর আশ্রমে বাস করে তার কাছে যোগমার্গের সকল গুহ্যতত্ত্বের শিক্ষা লাভ করতে লাগলেন। কিছু সময়ের মধ্যে তৈলঙ্গস্বামীর উচ্চ আধ্যাত্ম শক্তি সঞ্চারিত হল তাদের মধ্যে। ক্রমে ক্রমে তাদের যোগৈশ্বর্য অত্যুচ্চ শিখরে পৌঁছতে লাগলো। দীর্ঘ অক্লান্ত যোগ সাধনার পর লোকনাথের উপর ঐশ্বরিক করুণা বর্ষিত হল। তার মন এক অপূর্ব পরমানন্দ সাগরে ভাসতে লাগলো। তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক অপূর্ব জ্যোতিমধ্যে। তিনি দেখলেন, তিনি নিজেই ব্রহ্মের অংশ। ব্ৰহ্ম এবং তার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। তিনিই সর্ব চরাচরে বিরাজিত। সর্বপ্রাণীর মধ্যেই তিনি বিরাজমান। তিনি নিজেকে এক ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষরূপে জানতে পারলেন। তার মধ্যেই দৃষ্ট হতে লাগলো সব দেব-দেবীর বাস। তার শরীরে প্রতিভাত হল এক অপূর্ব জ্যোতি। তার চোখ পলকহীন। সেই চোখের দৃষ্টি অতি প্রখর। তৈলঙ্গস্বামী বুঝতে পারলেন, শিষ্যরা ব্ৰহ্মলাভে সমর্থ হয়েছে। এবার তাদের পরিব্রাজনে বেরোনো প্রয়োজন।

.

লোকনাথের মক্কা যাত্রা

লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব ব্রহ্মজ্ঞ হয়ে তাঁদের গুরুদেবকে স্মরণ করেন। গুরুদেবের ইচ্ছা ছিল তারা যেন ব্রহ্মজ্ঞ হতে পারেন। গুরুদেবের সেই ইচ্ছা তারা পূরণ করেছেন। মর্তলোক থেকে গুরুদেব আজ বহুদূরে। তাঁর সকল বাসনা তাদেরই পূরণ করতে হবে। কাশীধামে আসার আগে গুরুদেব বলেছিলেন, তাদের পরিব্রাজন করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বিভিন্ন দেশের ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও জীবনযাত্রা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে হবে, আর ধর্মালোচনার মাধ্যমে ব্রহ্মজ্ঞান বিতরণ করতে হবে। এখন গুরুর এই দ্বিতীয় ইচ্ছাপূরণে ব্রতী হতে হবে। লোকনাথ ও বেণীমাধব যোগীবর তৈলঙ্গস্বামীর কাছে তাদের পরিব্রাজনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যোগীবর মহানন্দে দুই ব্ৰহ্মজ্ঞানীর ইচ্ছায় সম্মতি জানান এবং তাদের সঙ্গে নিজের সঙ্গদান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যোগীবরের এই ইচ্ছায় লোকনাথ ও বেণীমাধব অত্যন্ত আনন্দিত হন। কিন্তু যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী বলেন, আমি এখন তোমাদের সঙ্গে যাব না। তোমরা যাত্রা করো। আমি সময়মতো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। যোগীবরের আদেশ পেয়ে কমণ্ডলু ও কম্বল মাত্র সম্বল করে দুই মহান ব্রহ্মজ্ঞানী যোগী আরব দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। কাশীধাম থেকে রওনা হয়ে হিমালয় হয়ে তারা প্রথমে আফগানিস্থানে এলেন। সেখানে কিছুদিন ইসলাম ধর্মচর্চা করে কঠোর পরিশ্রম শেষে মক্কায় পৌঁছলেন। মক্কা হজরত মহম্মদের জন্মস্থান হিসাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে অতি পবিত্র। সেখানে এই দুই হিন্দু মহাযোগী পৌঁছলে সেখানকার বিশিষ্ট ধর্মানুরাগীগণ তাদের সাদরে গ্রহণ করেন। লোকনাথ ও বেণীমাধব মক্কায় ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনে ব্রতী হন। মক্কায় কিছুদিন অবস্থান করে তারা মদিনায় যান। মদিনায় হজরত মহম্মদ দেহরক্ষা করেছিলেন। এখানেও দুই ভারতীয় মহাযোগী বিশিষ্ট ধর্মানুরাগীদের সঙ্গে ধর্মালোচনা করেন। এখানে তারা জানতে পারেন, মদিনা থেকে কিছুদূরে মক্কেশ্বরে আব্দুল গফুর নামে এক সাধক থাকেন। কয়েক দিনের হাঁটা পথে লোকনাথ ও বেণীমাধব মক্কেশ্বরে পৌঁছান। মক্কেশ্বরে পৌঁছে তিনি জানতে পারেন যে, আব্দুল গফুর খান মৌন ব্রত ধারণ করে গভীর সাধনায় মগ্ন। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না। লোকনাথ তার সাধনার সঙ্গী বেণীমাধব ও অন্যকিছু সাধকের সঙ্গে আব্দুল গফুর খানের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। কিন্তু আবদুল গফুর খান তাদের দিকে কোনো দৃষ্টিপাত করলেন না। লোকনাথ ভাবলেন, এত মরুপ্রান্তর পেরিয়ে আসা কি তবে বৃথা যাবে? তিনি সমাধিরত আব্দুল গফুর খানের সম্মুখে ধ্যানাবিষ্ট হলেন। সাধক জানেন সাধকের মনের কথা। বৃদ্ধ সাধক বুঝলেন, সামনের বাঙালি সাধক একজন ব্রহ্মজ্ঞ। সহজে এখান থেকে যাবেন না। তাও তিনি তার পরীক্ষা নিলেন। কয়েকদিন ধরে চললো ধৈর্য্যের পরীক্ষা। তারপর একদিন চক্ষু মেলে তাঁর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন লোকনাথের উপর। সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি বাবা লোকনাথকে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। তারপর বাবা লোকনাথ তাঁর দিকে চক্ষু মেলে তাকালে তিনি ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তুমি কয়দিনের লোক, বল তো? আচমকা এইরকম হেঁয়ালি প্রশ্ন শুনে বাবা লোকনাথ হকচকিয়ে গেলেন। তাঁর বুঝতে দেরি হল না যে, এই প্রশ্নের মধ্যে কোনো জটিল ইঙ্গিত আছে, যা একমাত্র মহাযোগিরাই বুঝতে পারেন। সাধক আব্দুল গফুর আবার প্রশ্ন করলেন–তুমি কয়দিনের লোক? অকস্মাৎ এই প্রশ্নের গূঢ় সত্যটি লোকনাথের মনে উদয় হল। তিনি বুঝতে পারলেন, সাধক জানতে চাইছেন তার গত জীবনের কথা স্মরণ আছে কি না? আর দেরি না করে বাবা লোকনাথ উত্তর দিলেন, আমি দুই দিনের নোক। আপনি কয়দিনের দয়া করে বলুন। লোকনাথের কথা শেষ হবার পূর্বেই সাধক হেসে বললেন, আমি চারিদিনের। লোকনাথ ব্রহ্মচারী আমি দুই দিনের এই কথার মধ্য দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি দুই জন্মের কথা স্মরণ করতে পারেন। সাধক আব্দুল গফুর আমি চারিদিনের এই কথা বলে বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি চারজন্মের কথা স্মরণ করতে পারেন। এই বার্তালাপের মাধ্যমেই সাধক আবদুল গফুরের সঙ্গে বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবের পরিচয় হল। এরপর এই সিদ্ধযোগী বাবা লোকনাথের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কে?’ লোকনাথ ব্রহ্মচারী খুব বিনীতভাবে উত্তর দিলেন–আমি কে তা জানার জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি। সিদ্ধ যোগীর বয়স ৪০০ বছর। লোকনাথের এই উত্তর শুনে তিনি খুশির আবেগে তাঁকে বুকে টেনে নিলেন। যোগী আবদুল গফুর খান ছিলেন অনন্ত যোগৈশ্বর্যের অধিকারী এবং সর্বজন সমাদৃত। মক্কেশ্বরের মুসলমানরা যোগীরাজের এইরূপ ব্যবহারে চমৎকৃত হলেন এবং বুঝলেন যে, এই দুই ভারতীয় যোগী অত্যন্ত উচ্চমার্গের যোগীপুরুষ। তারা বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবকে খুব আদর যত্ন করতে লাগলো। তারা দুই ভারতীয় যোগীকে বললো, বাবা, আপনারা যদি নিজের হাতে রসুই করে খেতে চান তো বলুন। আমাদের থেকে তাহলে আপনারা চাল, ডাল, সজি গ্রহণ করুন। আর যদি আপনারা আদেশ করেন তবে আমরাই রসুই করে দিচ্ছি। বাবা লোকনাথ তাদের কথার উত্তরে বলেন, তোমাদের হাতের রান্না খেতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বাবা লোকনাথের এইরূপ উত্তরে সমবেত মুসলমান ভক্তগণ বিস্মিত হলেন। তখন আবদুল গফুর তাদের বললেন, এই ভারতীয় যোগী একজন খাঁটি মুসলমান। তোমরা সকল হিন্দুকে বিধর্মী মনে করে ভুল করো। প্রকৃতপক্ষে হিন্দুদের মধ্যেও মুছলম ইমান অর্থাৎ ষোলআনা ইমান বা ধর্ম আছে এমন অনেক মহাপুরুষ আছেন। এই লোকনাথ ব্রহ্মচারী এমনই একজন মহাপুরুষ। আবদুল গফুরের কথা শুনে সমবেত মুসলমানেরা মুখে কাপড় বেঁধে অতি পবিত্র ভাবে রসুই করে বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবকে ভোজন করাতে লাগলেন। লোকনাথ ও বেণীমাধব কিছুদিন সেই মহান সিদ্ধ যোগীর সান্নিধ্যে পরমানন্দে ঐশ্বরিক আলোচনা করে কাটালেন। উভয়ের অলৌকিক যোগশক্তি উভয়কে মুগ্ধ করলো। কিছুদিন একসঙ্গে যোগানুষ্ঠানের পর বাবা লোকনাথ সতীর্থ বেণীমাধবকে নিয়ে মক্কেশ্বর ত্যাগ করার সময় বললেন, আমি এত পাহাড় পর্বত ভ্রমণ করেছি, কিন্তু মাত্র তিনজন ছাড়া ব্রাহ্মণ দেখিনি। এই তিনজন হলেন, কাশীতে তৈলঙ্গস্বামী, মক্কেশ্বরে আবদুল গফুর আর …। এই কথা শুনে উপস্থিত মুসলমানেরা বিস্মিত হলেন। তারা বললেন, আর একজন ব্রাহ্মণ কি স্বয়ং আপনি? তাই কি নাম করলেন না? তারা আরও বললেন যে, আমরা বিস্মিত হচ্ছি এই ভেবে যে, একজন মুসলমান ফকির কি ভাবে ব্রাহ্মণ হলেন? লোকনাথ তখন তাদের সন্দেহ নিরসন করে বললেন, ব্রাহ্মণ কে? ব্রাহ্মণ হলেন ব্রহ্মের অবিকৃত রূপ। দেশকালাতীত ব্রহ্মই পরমার্থিক নিত্যসত্তা। এই নিত্যসত্তাই দেশ কালে প্রকাশিত হন। যিনি ব্রহ্মজ্ঞ, তিনি নিজের আত্মাতে ব্রহ্মের উপাসনা করতে করতে ব্রহ্মরূপ হয়ে যান। তিনি তখন সর্বত্রই ব্রহ্মকে দর্শন করেন। তার মধ্যে কোনো ভেদজ্ঞান থাকে না। ব্রহ্মা ব্রাহ্মণের হৃৎপদ্মে সর্বদাই চৈতন্যরূপে অভিব্যক্ত থাকেন। মুসলমান কথার অর্থ বাবাজী তোমাদের বলেছেন–ষোলআনা ইমান। অর্থাৎ ষোলআনা ধর্ম যার মধ্যে আছে সেই মুসলমান। আমি লক্ষ্য করেছি, প্রকৃত মুসলমানের মধ্যেও ব্রাহ্মণ অর্থাৎ মহাপুরুষ আছেন। আবদুল গফুর একজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ। তার হৃদয়মধ্যে সর্বত্র ব্রহ্ম আনন্দরূপে প্রকাশ পাচ্ছেন। ব্রহ্মকে তিনি আত্মরূপে দর্শন করছেন। সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ভেদাভেদ জ্ঞান মুক্ত হয়েছেন। তাই তাঁর সাম্য প্রাপ্ত হয়েছে। ব্রহ্ম সত্যস্বরূপ। ব্রহ্মকে পেতে হলে সত্যের পথে চলতে হয়। সত্যদ্রষ্টা ঋষিগণ সত্যের পথেই সত্যস্বরূপ ব্রহ্মকে লাভ করেন। তাই তো বলা হয়, পরমাত্মাকে লাভ করার শ্রেষ্ঠ পথ সত্যের মধ্যেই নিহিত আছে। এই সত্যই হল ধর্ম। আর এই ষোলআনা ধর্ম যার মধ্যে আছে, তিনিই ব্রাহ্মণ। তিনিই মুসলমান।

বাবা লোকনাথের এই সত্য তথা ধর্ম বিশ্লেষণ আবদুল গফুর ও সমবেত মুসলমানদের চকিত করলো। লোকনাথ ব্রহ্মচারী তার ধর্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই লোকশিক্ষাই দিলেন যে, হিন্দু ও মুসলমান ধর্মে কোনো পার্থক্য নেই। দুই ধর্মই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সত্যকে জানলে আর উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। মক্কেশ্বরে দাঁড়িয়ে এই লোকশিক্ষা প্রচার করে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বেণীমাধবকে নিয়ে হিমালয়ে ফিরে আসেন। শোনা যায়, হিমালয়ের অত্যুচ্চ শিখরে কিছুদিন বসবাস করে তারা আবার মক্কায় গিয়ে আবদুল গফুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

.

লোকনাথের ইওরোপ পর্যটন

মক্কেশ্বর থেকে প্রস্থান করে দুই ভারতীয় মহাযোগী কেবলমাত্র কম্বল ও কমন্ডলু সম্বল করে তুরস্কে যান। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে তারা গ্রিস দেশে যান। গ্রিস দেশ প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র। সেখানে বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির বাস। এই দুই ভারতীয় মহাযোগীকে তারা সাদরে গ্রহণ করলেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধবের আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে বহুদূর থেকে অনেক সাধু, সন্ন্যাসী ও গুণীজনের সমাবেশ ঘটলো। আধ্যাত্মিক বিষয়ে অনেক আলোচনা হল। ভারতীয় মহাযোগিগণ তাদের অর্জিত ব্রহ্মজ্ঞানের আলোকে গ্রিস দেশের সাধু, সন্ন্যাসী ও গুণীজনদের মধ্যে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটালেন। সকলেই তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের আদান-প্রদানের জন্য সাধুবাদ জানালেন।

গ্রিস থেকে দুই মহাযোগী গেলেন ইতালি। গুরুদেবের ইচ্ছা তাদের প্রেরণা। তাদের অধ্যাত্ম জ্ঞান বিতরণ করতে হবে দেশ-বিদেশে। অর্জন করতে হবে বিভিন্ন দেশের জ্ঞান। ইতালিতে দুই মহাযোগী ধর্মানুরাগীদের থেকে পেলেন অনেক উষ্ণ সম্বর্ধনা। এখানেও ধর্মানুরাগিদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক ভাব-ভাবনার আদান-প্রদান হল। সর্বত্রই ধর্মপ্রাণ মানুষের মন জয় করে চলেছেন দুই ভারতীয় মহাযোগী।

ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড হয়ে দুই মহাযোগী চললেন ফরাসি দেশের পথে। পদব্রজে আরব দেশ থেকে এতগুলি ইওরোপ দেশ ভ্রমণ করা যে কি দুঃসাধ্য ব্যাপার, তা সকলেই অনুধাবন করতে পারেন। কিন্তু দুই ভারতীয় মহাযোগীর কাছে কোনো বাধাই বাধা নয়। যত ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছে, তত তাদের জ্ঞানপিপাসা বেড়ে চলেছে। তারা বুঝতে পারলেন, কেন গুরুদেব তাদের পরিব্রাজনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। ফরাসি দেশ পর্যটন করে লোকনাথের ইচ্ছা হল স্বদেশে ফিরে আসার। সাধনার ছায়াসঙ্গী বেণীমাধবকে নিয়ে লোকনাথ পদব্রজে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। স্বদেশে ফিরে দুজনের বাসনা হল উত্তর মেরু অভিযান করার।

.

বাবা লোকনাথের উত্তরমেরু অভিযান

 ইওরোপ পর্যটন থেকে হিমালয়ে ফিরে প্রথমে বাবা লোকনাথ মনে করলেন, গঙ্গার উৎস থেকে হিমালয়ের কোলে গঙ্গার তটে অনেক মুনি-ঋষির বাস। তারা নিরন্তর সাধনা করে চলেছেন পরমেশ্বরকে পাবার ইচ্ছায়। তিনি অভিন্নসঙ্গী বেণীমাধবকে নিয়ে গঙ্গার তটে সেইসব স্থান দর্শন করে মুনি-ঋষিদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক ভাব বিনিময় করতে মনস্থ করলেন।

প্রথমে তারা এলেন বদরিকা আশ্রম অর্থাৎ বদ্রীনাথে। বদ্রীনাথে বদ্রীনারায়ণ নামে বিষ্ণুমূর্তি স্থাপিত। হিন্দুদের এক অতি পবিত্র তীর্থস্থান। সারাদেশ থেকে পুণ্যার্থীরা অনেক দুর্গম পাহাড়িপথ অতিক্রম করে এখানে বদ্রীনারায়ণ দর্শন করতে আসেন। বিভিন্ন মুনি-ঋষি, এমনকি তোরাও সূক্ষ্মরূপে বদ্রীনারায়ণ দর্শনে আসেন। লোকনাথ ও বেণীমাধব বদ্রীনাথে এসে স্বামী বদ্রীনারায়ণ দর্শন করলেন এবং কিছুদিন সেখানে বাস করে সাধন-ভজন করলেন। সেখানকার সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাদের আধ্যাত্মিক আলোচনারও অবকাশ হল। তারপর তারা কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী ইত্যাদি ভারতের সনাতন তীর্থস্থানগুলি দর্শন করে হরিদ্বারে এসে কিছুদিন সাধুসঙ্গ করলেন। এরপর হরিদ্বার থেকে তারা আবার ফিরে গেলেন হিমালয়ের বরফাবৃত শিখরে। এরপই বাবা লোকনাথের মনে এলো পৃথিবীর উত্তরমেরুর কথা। তিনি জ্ঞানার্জনকালে জেনেছেন যে এই উত্তরমেরুই হল ‘স্বর্গদ্বার’। মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডব এই স্বর্গদ্বার দিয়েই স্বর্গে পৌঁছেছিলেন। তাই তাঁরও বাসনা জাগলো উত্তরমেরু পরিভ্রমণের। তিনি তার সঙ্গী বেণীমাধবের সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে যাওয়া স্থির করলেন।

কিন্তু বরফাবৃত উত্তরমেরুর হাড় কাঁপানো তাপাঙ্ক উপেক্ষা করা মানুষের পক্ষে অসাধ্য আর তাই নিজেদের দেহকে ওইরূপ উপযুক্ত করে তুলতে তাঁরা হিমালয়ের বরফাবৃত পর্বতে বসবাস করতে শুরু করলেন।

এইসময় বাবা লোকনাথের সিদ্ধযোগী তৈলঙ্গস্বামীর কথা মনে পড়লো। তিনি বলেছিলেন, পর্যটনের মাঝে তিনি যোগদান করবেন। মণিকর্ণিকা ঘাটে ছাড়াছাড়ি হবার পর আর দেখা হয়নি। এদিকে যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে, লোকনাথ ও বেণীমাধব উত্তরমেরু অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন এবং তাকে স্মরণ করছেন। তিনি বাবা লোকনাথের ডাক উপেক্ষা করতে পারলেন না। একদিন যোগীবর তাঁর শিষ্যদের সামনে উপস্থিত হলেন। আশ্চর্যজনকভাবে বাবা লোকনাথ দেখলেন, তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হতে সেখানে সাধক আবদুল গফুরও হাজির। অতি আনন্দে চারজন সম্পূর্ণ অনাবৃত হয়ে বরফের উপর চলা অভ্যাস করতে লাগলেন। বাবা লোকনাথ তিনবছর এই সুমেরু অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তারপর এক শুভ মুহূর্তে চার মহাপুরুষ মহাযোগী বরফাবৃত সুমেরু প্রদেশের পথে অগ্রসর হলেন।

হিমালয়ে দুর্গম পার্বতশৃঙ্গ অতিক্রম করতে করতে একসময় তারা উত্তরমেরুর সেই পথে এসে পৌঁছলেন যেখান দিয়ে পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাগণ ও দ্রৌপদীকে নিয়ে স্বর্গাভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। সেই পথ বরফাবৃত। কোথাও মানুষ জনের চিহ্ন নেই। শৈত্যের প্রভাবে নদীর জল বরফ হয়ে গেছে। তৃষ্ণা মেটাবার কোনো সংস্থান নেই। ক্ষুধা মেটাবার একমাত্র সহায়ক কন্দমূল।

তারা জানতে পারেন এই পথেই স্বর্গের খোঁজে বেরিয়ে প্রথমে দ্রৌপদীর দেহপাত হয়। পরে আরও কিছুদূর এগিয়ে সহদেবের শরীর পাত হয়। এইভাবে মহাপ্রস্থানের পথে একে একে নকুল, অর্জুন ও ভীম সহ চার পাণ্ডবের দেহ বরফের উপর পড়ে থাকে। পরে বরফগলিত জলে সেই সব দেহ ভেসে আসে কেদারতীর্থে। যে পথ দিয়ে দ্রৌপদী ও চার পাণ্ডবের দেহ কেদারতীর্থে ভেসে এসেছিল তার নাম ভৃগুপন্থা। যে পথ দিয়ে পাণ্ডবেরা মহাপ্রস্থানে এগিয়েছিলেন, ভৃগুপন্থা তার পশ্চিমদিকে অবস্থিত। এখনও কেদারতীর্থে গেলে সেখানকার পাণ্ডাগণ এই ভৃগুপন্থা তীর্থযাত্রীদের দর্শন করান। এইখানে উল্লেখযোগ্য যে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের দেহ এখানে পাওয়া যায় না। সেজন্য যুধিষ্ঠির সশরীরে স্বর্গে পৌঁছেছিলেন বলে কথিত আছে। বাবা লোকনাথসহ চারজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ এই পথে অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। কারণ তারা এরজন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, যা পাণ্ডবদের ছিল না।

এখানে জনমানসের চিহ্নও নেই। চারজন স্বর্গসন্ধানী যোগী বরফের উপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন স্বর্গদ্বারের সন্ধানে। এইসময় বরফের উপর দিয়ে চলতে চলতে তারা শ্বেতবর্ণ ধারণ করলেন। তারা একসময় উত্তরমেরুর সেই অঞ্চলে এসে পৌঁছলেন যেখানে ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত্রি হয়। দিনের আলো এখানে খুবই মৃদু। কিছু চোখে দেখা যায় না। দীর্ঘদিন এই পথে চলতে চলতে তারা অন্ধকারে দৃষ্টিশক্তি লাভ করেন। অন্ধকারের মধ্যেও তারা সব কিছু দেখতে পান। এইভাবে প্রায় দশবছর সুমেরু পর্বতের দিকে তারা অগ্রসর হতে হতে এমন এক স্থানে এসে পৌঁছলেন, যেখান থেকে আর উপরের দিকে যাবার পথ নেই। তারা উত্রাই-এ নিচের দিকে নামতে থাকলেন। কিছুদূর নিচে নেমে তাদের খেয়াল হল যে, এই পথ বোধহয় পাতালের দিকে গেছে। তাই তারা সেই পথে অগ্রসর না হয়ে আবার পিছনে এসে পথ খুঁজতে লাগলেন। সুমেরুর পথ খুঁজতে খুঁজতে তারা এক জায়গায় কয়েকটি বরফের টিলা দেখতে পেলেন। বহু কষ্টে তারা পর্বতারোহণের কোনো আধুনিক সরঞ্জাম ভিন্ন একটি বরফের টিলায় উঠতে সক্ষম হলেন। সেই টিলার উপরে কোনো বায়ুস্তরের চিহ্ন দেখতে পেলেন না। সেখানে অদ্ভুত এক নিস্তরঙ্গ ভাব তারা অনুভব করলেন। কিন্তু এটিই তাঁদের বাঞ্ছিত সুমেরু শৃঙ্গ কি না, সে সম্বন্ধে তারা নিশ্চিত হতে পারলেন না। চার ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগী পুরুষ এরপর সুমেরু অভিযান শেষ করে আবার প্রায় দশ বছর পদব্রজে হিমালয়ে ফিরে আসেন। সেখান থেকে আবদুল গফুর স্বস্থানে ফিরে যান।

.

বাবা লোকনাথের চীনদেশ যাত্রা

সুমেরু অভিযান সম্পন্ন করে যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবকে উদয়াচলের পথে যাবার কথা ব্যক্ত করলেন। উদয়াচলের কথা শুনে বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব যোগীবরের উদয়াচল অভিযানের সাথী হতে চাইলেন। এবার তিন ব্রহ্মজ্ঞানী মহাযোগী আবার পথে নামলেন। তাঁদের প্রথম গন্তব্যস্থল চীনদেশ। তারা পথে নেমে প্রথমে পৌঁছলেন সাইবেরিয়া। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করে তারা উপস্থিত হলেন মঙ্গোলিয়ায়। এখানে কিছুদিন অবস্থান করে তারা ভারতীয় আধ্যাত্মিক ভাবের আদান-প্রদান করেছিলেন। তারপর শুরু হয় আবার পথচলা। অনেক পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল অতিক্রম করে তিন মহাযোগী একদিন চীনদেশে পদার্পণ করেন। তাদের মাথায় জটাজুটো, মুখের একরাশ দাড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে, গায়ে ভস্ম মাখা। এইরূপ দেহসজ্জায় তিন যোগীকে দেখে চীনবাসীদের খুব কৌতূহল হল। তাদের উপস্থিতির কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সে দেশে এক আলোড়ন সৃষ্টি করলো। হাজার হাজার চীনবাসী তাদের দর্শন করতে এলেন। তারা চীনাভাষায় যোগীদের অনেক প্রশ্ন করেন, কিন্তু ভাষা সমস্যায় যোগীগণ তাদের কথা বুঝতে পারেন না। কেবল আকারে ইঙ্গিতে জবাব দেন। তিনজন ভারতীয় যোগীদের নিয়ে সাধারণ মানুষের উন্মাদনা রাজার গোচরে এলো। রাজার রক্ষীরা তিন যোগীকে নিয়ে রাজার সম্মুখে হাজির করলো। রাজা যা প্রশ্ন করেন, যোগীরা তা বুঝতে পারেন না। আবার যোগীরা যা বলেন, রাজা তা বুঝতে পারেন না। সে এক অদ্ভুত অবস্থা। যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী ইঙ্গিতে রাজাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, তারা ভারতীয় বোগী। আধ্যাত্মিক ভাবের আদান-প্রদান করতে এসেছেন। তাদের দ্বারা রাজার বা চীনবাসীদের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু রাজা তাঁদের কথা বুঝতে না পেরে তিন ভারতীয় যোগীকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন এবং তাদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। কিছুদিন কারাবাসের পর যোগীদের আচার-আচরণে রাজা বুঝতে পারলেন যে, এঁদের দ্বারা অহিতকর কিছু হবার সম্ভাবনা নেই। এঁরা নিছকই অধ্যাত্ম জগতের মানুষ। তারপর রাজা যযাগীদের সসম্মানে কারামুক্ত করে দিলেন এবং তখন তাদের জনসমক্ষে আসার আর কোনো বাধা রইলো না। কারাবাসের পর তিন ভারতীয় মহাযোগী যখন বাইরে এলেন, তখন চীনবাসীগণ তাদের যথেষ্ট সমাদর করলেন এবং তাদের কথা শুনলেন। এই সময় একদিন যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে, বাবা লোকনাথের নিষ্কাম কর্মে নিয়োজিত হবার সময় উপস্থিত হয়েছে। তিনি বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধবকে বললেন, তোমাদের এবার স্বদেশে ফিরে নিষ্কাম কর্মে নিয়োজিত হতে হবে। দেশে লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজ করতে হবে। তোমাদের অর্জিত অধ্যাত্ম জ্ঞানের প্রভাবে সমাজকে আলোকিত করতে হবে। তোমরা এবার সে পথে অগ্রসর হও। আমি উদয়াচলের পথে অগ্রসর হব।

বাবা লোকনাথ বুঝলেন, সাধনায় সিদ্ধিলাভের ফল দেশবাসীকে বিতরণ করার সময় আগত। এখন তাদের স্বদেশের মাটিতে ফিরে দেশ ও সমাজের কাজে ব্রতী হতে হবে। তারা যোগীবর তৈলঙ্গস্বামীর থেকে বিদায় নিয়ে দেশের পথে অগ্রসর হলেন।