পটকথা

প্রথম অধ্যায় – পটকথা

ব্রহ্মচারী বাবার কৃপায় দ্বিতীয় জন্মলাভ

ঈশ্বর হি কেবলম–শ্রীশ্রী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর অপার করুণার কথা নানাভাবে আমরা নানাজনের কাছে শুনে এসেছি। তার অপার মহিমা ইতিমধ্যে বিভিন্ন গল্প-কথা, চলচ্চিত্র এমনকি টি.ভি. সিরিয়ালের মাধ্যমে আমরা জ্ঞাত হয়েছি। কিন্তু আমার এই নিবন্ধে আমি আমার নিজের জীবনে তার অপার করুণাময় কৃপার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তার জীবনবৃত্তান্ত শুরু করছি।

২০০০ সালের ২৮ নভেম্বরের সকাল। আমি ঢাকুরিয়া বাসস্টপে অফিস যাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। একটি বাস ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার ব্যস্ত চোখ খুঁজছে ওই বাসের পিছনের দিকের মিনিবাস। হঠাৎ বাঁদিক থেকে একটা সাইকেল তীব্র গতিতে এসে আমাকে ধাক্কা মারলো। আমি বাঁদিকে কাৎ হয়ে দুই পা সহ ঢুকে গেলাম বাসের তলায়। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে সামনে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম—’বাবা লোকনাথ বাঁচাও’। বাবা লোকনাথ আমার প্রথম দিব্যগুরু। আমার চিৎকারে বাসযাত্রীরা ও ব্যস্ত পথচারীরা সচকিত হয়ে চিৎকার করতে লাগলো। বাসের কন্ডাক্টর ততক্ষণে বাস ছাড়ার ঘন্টা বাজিয়েছে। বাসের পিছনের দুটি চাকা ধীরে ধীরে আমার পায়ের উপর উঠে আবার পিছনে নেমে গেল। সকলেই ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছে। কিছু পথচারী আমার দেহটা টেনে বাসের নিচ থেকে বার করলো। আমাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোমর থেকে সম্পূর্ণ নিচে আমার কোনো জোড় নেই। আমাকে সোজা করে তারা ধরে রেখেছে। আমি বাবা লোকনাথের নাম নিয়ে কেঁদে চলেছি। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার তোড়জোড় শুরু করতেই আমি বললাম–

আমার বাড়ি খুব কাছেই। আমাকে আগে বাড়ি নিয়ে চলুন। তারপর বাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ততক্ষণে আমার পা-দুটি ফুলে কলাগাছ। আমাকে তারা বাড়িতে ঢোকালেন। আমার ওই অবস্থা দেখে বাড়ির সকলের কান্নার রোল পড়ে গেল। আমার নিম্নাঙ্গে কোনো বোধশক্তি নেই। একজন ডাক্তারকে সঙ্গে সঙ্গে আনা হল। তিনি সব দেখেশুনে অবাক। Pain killer ওষুধ দিলেন এবং বললেন আমাকে কোনো অস্থিবিশারদের কাছে তখনই নিয়ে যেতে। আমার শরীর ক্রমশঃ নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগলো। কলকাতার একজন বিশিষ্ট অস্থিবিশারদ আমার পরিচিত ছিলেন। তাকে ফোন করে সব জানানো হল। তিনি তৎক্ষণাৎ আমার বাড়িতে এসে আমাকে দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তক্ষুনি কোনো ভালো নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

তিনি এও জানালেন যে, যদি আমাকে কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো তবে তক্ষুনি আমার পা দুটো কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু তার এখুনি কোনো প্রয়োজন নেই। উনি আমার পা বাদ দিয়ে চিকিৎসা করতে পারবেন না। ওনার প্রথম লক্ষ্য হল আমার জীবন বাঁচানো। উনি কিছু injection আমাকে দিলেন এবং বললেন, তখনও আমার জীবন সংশয় আছে। সেজন্য উনি আমাকে কয়েকদিনের জন্য একটি নার্সিংহোমে দিতে চান। আমার নিশ্চল দেহ নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হল। তিনদিন পর্যন্ত চললো যমে-মানুষে টানাটানি। বাড়ির লোক সারাদিন নার্সিংহোমে বসে থাকতো। কখন খারাপ খবর হয়! এইভাবে বেশ কয়েকদিন যাবার পর আমার স্ত্রী অস্থিবিশারদকে অনুরোধ করলো যে, আমাকে যদি বাড়িতে রেখে উনি চিকিৎসা করেন, তবে খুব ভালো হয়। বাড়িতে বাবা লোকনাথ আছেন। তার উপর আমাদের বিশ্বাসের কথা ওনাকে জানানো হল। ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের মর্যাদা দিয়ে অস্থিবিশারদ আমাকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করতে রাজি হলেন। আমার নিশ্চল দেহ আবার বাড়িতে ফিরে এলো। আমার শোবার ঘর ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নার্সিংহোমের মতো তৈরি রাখা হলো। ডাক্তারবাবু প্রতিদিন আমার বাড়ি এসে চিকিৎসা করতে লাগলেন। ১৮দিন পর্যন্ত চললো জীবন ও মরণের সঙ্গে প্রবল যুদ্ধ। প্রতিদিন রাতে মেয়েরা ও স্ত্রী এসে দেখতে আমি বেঁচে আছি কিনা। আর বাবা লোকনাথের কাছে চোখের জল ফেলতো। অমায়িক ডাক্তারের অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং বাবা লোকনাথের দয়ায় ১৮ দিন পর আমার জীবন বিপদমুক্ত হল। তখন ডাক্তার বললেন, এখন আমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেবার জন্য আমার পা দুটিকে সচল করতে হবে। আমার দু-পায়ের সমস্ত Soft-tissue গুলি smashed হয়ে গিয়েছিল। কলাগাছের মতো ফোলা এক-একটি পা। কোনো sense নেই। একজন দেবদূত অস্থিবিশারদ ও আমার স্ত্রী ও কন্যাদের অক্লান্ত সেবায় এবং বাবা লোকনাথের অসীম কৃপায় দীর্ঘ চিকিৎসার পর আমি হাঁটতে সক্ষম হলাম। যদিও আমার বাঁ পায়ে এখনও দুটি fracture আছে। ডাক্তার বললেন, ওই fracture দুটি সারাতে অপারেশন করলে ভবিষ্যতে আমার পা দুর্বল হয়ে যাবে। আমি যখন হাঁটতে পারছি, তখন আর অপারেশনের দরকার নেই। আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলাম। পরবর্তী সময়ে এই পা নিয়ে আমি সারা ভারতবর্ষের তীর্থক্ষেত্র ভ্রমণ করেছি। এমনকি নর্মদা পরিক্রমাও করেছি।

ডাক্তার যখন আমার পায়ের scan report দেখলেন, বললেন এই scan report অনুযায়ী এইভাবে আপনার হাঁটতে পারার কথা নয়, কিন্তু আপনি আমার সামনে হাঁটছেন। আপনার মাটিতে বসতে পারার কথা নয়, কিন্তু আপনি বসছেন। আপনার এত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কথা নয়, কিন্তু আপনি ফিরেছেন। আমি কোষ্টাকে বিশ্বাস করবো! scan report যা দেখছি সেটা, না আমার চোখে যা দেখছি, সেটা! আমি নিজেই জানি না আপনি কীভাবে এত তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠলেন। It’s a miracle. আমি জানি, আমার এই দ্বিতীয় জীবনদাতার নাম মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। বিশিষ্ট অস্থিবিশারদের কৃতিত্ব বিন্দুমাত্র ছোট না করে বলছি, বাবা লোকনাথের অসীম কৃপায় আজ আমি জীবিত। অস্থিবিশারদ তার দূত রূপে আমার চিকিৎসা করে গেছেন।

পরবর্তীকালে একজন অন্য বিশিষ্ট অস্থিবিশারদ আমাকে ও আমার চিকিৎসাপত্র দেখে বলেছিলেন যে, আমি জানিনা কিভাবে আপনি এইরকম হাঁটতে পারছেন। আপনাকে এই অবস্থায় দাঁড় করাতে কেবল সেই চিকিৎসকই পারেন যে ভগবান। আমি তখন তাকে বলেছিলাম, আমি বাবা লোকনাথের চরণাশ্রিত। তিনি শুনে বলেছিলেন, তার কৃপা যেখানে থাকে, সেখানে সবই সম্ভব। আমার কিছু বলার নেই।

আমি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি ১৯৯৫ সালে। তখন জীবনের এক কঠিনতম বিপদের মধ্যে আমি বাবা লোকনাথের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। সেই বছরই ১৯শে জৈষ্ঠ্য বাবা লোকনাথের ফটো আমার ঘরের ঠাকুরের আসনে প্রতিষ্ঠা করে তাকে আমার প্রথম দিব্যগুরুরূপে বরণ করি এবং এখনও নিত্য তার পূজারাধনা করে আসছি। এবং তার কৃপাধন্য হয়ে বেঁচে আছি।

.

ব্রহ্মচারী বাবার দিব্যশক্তির মূল্যায়ণ প্রেক্ষাপট

সেই ১৯৯৫ সাল থেকে আমি একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা করছি যে, বাবা লোকনাথ ইহলোকে নিজ শরীরে না থেকেও কিভাবে আমাদের এইভাবে রক্ষা করেন! নর্মদা পরিক্রমা করার সময় আমি সেইসব স্থান দর্শন করেছি যেখানে বাবা লোকনাথ তপস্যা করেছিলেন। এবং নর্মদা তটে তার তপস্যার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি। হিমালয়ের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্র দর্শন করে তার তপোজীবন সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার ও তার স্বরূপ জানার প্রয়াস করেছি। বদ্রীনাথ মন্দিরে তাঁর প্রতিকৃতি সামনে রেখে পূজা করে তার কাছে আকুল প্রার্থনা জানিয়েছি আমাকে তাঁর দিব্য স্বরূপের সন্ধান দেবার জন্য। সেখানে এক জ্যোতিরাশির মধ্যে অজস্র ওঁকার আমার মুখমণ্ডলকে ঘিরে রেখেছিল।

এইভাবে মহাযোগী বাবা লোকনাথ সম্বন্ধে বিভিন্ন তীর্থে যেসব তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে যে, আমরা তার ভক্তরা বোধহয় সেই মহাযোগীর যোগপ্রভাবের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। আজ ঘরে ঘরে বাবা লোকনাথ পূজিত। যখন কাউকে জিজ্ঞাসা করি কেন তারা বাবা লোকনাথকে পূজা করেন? তখন নিম্নরূপ উত্তর পাই :

(ক) যে কোনো বিপদে বাবাকে ডাকলে, বাবা রক্ষা করেন।

(খ) বিপদের সময় বাবাকে স্মরণ করলে মনে জোর পাই।

(গ) বাবা অনেকের ব্যাধি সারিয়ে দিয়েছেন।

(ঘ) কোনো মামলা-মোকদ্দমায় বাবাকে স্মরণ করে সাহায্য চাইলে, বাবা রক্ষা করেন।

(ঙ) বাবার আশীর্বাদ থাকলে, কোনো বিপদ হয় না। ইত্যাদি।

এই উত্তরগুলি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় যে, আমরা বাবাকে পূজা করি তার যোগ-বিভূতির জন্য। অর্থাৎ আমরা বাবা লোকনাথের যোগ-বিভূতিকে পূজা করি।

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান বলে যে, কোনো সাধক যোগ-বিভূতি প্রাপ্ত হন অষ্টাঙ্গ অথবা অষ্টাদশ যোগসিদ্ধ হলে। এই যোগ-বিভূতি তার একটি লীলাখেলা’–এটা কোনো সাধকের আসল পরিচয় নয়। বাবা লোকনাথ যে যোগ-বিভূতির দ্বারা নানা মানবকল্যাণ ও সমাজকল্যাণের কাজ করতেন, সেটা তার কাছে অতি সামান্য কাজ ছিল। তাঁর যোগৈশ্চর্য ছিল অতি উচ্চ মার্গের। এইসব বিভূতি প্রদর্শন ছিল তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ ব্যাপার। তিনি ব্রহ্মজ্ঞ হয়ে যোগের যে স্তরে উপনীত হয়েছিলেন, সেখানে তিনি দেব স্বারূপ্য লাভ করেছিলেন। তাঁর আত্মা-পরমাত্মার সঙ্গে লীন হয়ে দেহাভ্যন্তরে বিরাজ করতো। যাঁর সর্বদেহের লোমকূপে দেবতারা বিরাজ করতেন, তার কাছে কি এই যোগ-বিভূতি প্রদর্শন করা অতি সামান্য ব্যাপার নয়! আসলে আমরা এই সামান্য বিভূতি পেয়েই সন্তুষ্ট থেকেছি এবং যে মহা ঐশ্বর্য তার কাছে ছিল, তার আর সন্ধান করিনি। যখন কোনো ভক্ত আরাধ্যের যোগ-বিভূতি পাবার জন্য তার পূজা করে, তখন তার মধ্যে একটি স্বার্থ নিহিত থাকে। স্বার্থযুক্ত পূজা দেবতার চরণে পৌঁছয় না। দেবতা তার কৃপা-বিভূতি প্রদানেই সীমাবদ্ধ রাখেন। যেমন কথিত আছে, একজন পরম দেবভক্ত ইহলোকে অবস্থানকালে অনেক মন্দির নির্মাণ করেছেন, যজ্ঞানুষ্ঠান ও দান করেছেন। পরলোকে তার স্থান হয়েছিল তৃতীয় নরকে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এত ভালো ভালো কাজ করে তিনি নিশ্চয়ই স্বর্গে দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন। তৃতীয় নরকে পড়ে তিনি চেঁচামেচি করতে লাগলেন। উচ্চস্বরে সেখানে সকলকে বলতে লাগলেন যে, তিনি ইহলোকে কি কি দেবকার্য করেছেন। এত দেবকার্য করার পর কারও যদি নরকে স্থান হয়, তবে আর কেউ দেবকার্য করবে না। তার চেঁচামেচিতে নরকে শান্তি ভঙ্গ হওয়ায় স্বর্গ থেকে একজন দেবদূত তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন সে এখানে অশান্তির সৃষ্টি করছে। সে দেবদূতকে গালাগালি দিয়ে বলতে লাগলো যে, ভগবান তার প্রতি অবিচার করেছেন। তখন দেবদূত তাকে বললেন, আপনি ইহলোকে অনেক দেবকার্য করেছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু সব দেবকার্যের পিছনেই আপনার নিজের স্বার্থ ছিল। স্বার্থ সম্বলিত দেবপূজা বা ফল কামনা করে যে পূজা, সেই পূজা ইহালোকের ফল প্রদানেই সমাপ্ত হয়ে যায়। কেবলমাত্র নিঃস্বার্থ দেবপূজা বা ফল কামনা রহিত দেবকার্যই দেবতার চরণে পৌঁছয়। আপনার স্বার্থ সম্বলিত পূজার ফল আপনি ইহলোকেই প্রাপ্ত হয়েছেন; পরলোকের জন্য আপনার কোনো সুফল সঞ্চিত নেই। সেইজন্য আপনার নরক প্রাপ্তি।

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, আমার উপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল হও। আমাতে মনপ্রাণ সমর্পণ করে ভক্তি ভরে ভজনা করে যাও। তুমি যখন কোনো কর্মের অনুষ্ঠান করবে, আমিই তার উপলক্ষ এই জ্ঞানে আমাতে সমস্ত কর্ম সমর্পণ করো। তাতে যেন কোনো ফলাকাঙ্ক্ষা না থাকে। এইরূপ কর্মের জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি, আমিই তোমাকে রক্ষা করবো। তুমি আমার শরণাগত হও, আমার উপর নির্ভরশীল হও। আমি তোমাদের সমস্ত পাপ হতে রক্ষা করবো।

বাবা লোকনাথও তেমনি ভক্তদের বলতেন, আমি সচ্চিদানন্দ পুরুষ, আমি সেই পরমাত্মা। তোরা তোদের সব কিছু আমাকে সমর্পণ করে নিষ্কামভাবে কাজ করে যাবি। মনে ভাববি, তোদের সব কিছু আমার। কোনো ফলের প্রত্যাশা করবি না। বিপদে পড়লে আমাকে স্মরণ করবি। আমি তোদের রক্ষা করবো। ব্রহ্মজ্ঞ বাবা লোকনাথের কাছে আমরা কেবল যোগ-বিভূতিই চেয়ে এসেছি। কিন্তু তিনি তো আমাদের ভবরোগ থেকেই মুক্ত করে দিতে সক্ষম ছিলেন! এইজন্য মহাপ্রয়াণের আগে বারদীতে বাবা দর্শনার্থী এক পরমভক্ত বিধবা মহিলাকে বলেছিলেন–এ দেহটা একটা পাখির খাঁচা। জানিস মা, ওরা আমাকে মানুষ ভাবে। কোনো ভবরোগী পেলাম না।–এই কথার গূঢ় অর্থ তখন কেউ বিশ্লেষণ করেনি।

সাধারণ মানুষ কোনো মহাপুরুষের জীবন আলোচনাকালে তাঁর অলৌকিক বিভূতির মানদণ্ডে আধ্যাত্মিক সিদ্ধির মূল্যায়ণ করে থাকে। বলা বাহুল্য, আমাদের এই মূল্যায়ণ পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত। একজন প্রকৃত মহাপুরুষের বা মহাযোগীর কাছে অষ্টসিদ্ধি বা অষ্টাদশসিদ্ধির মূল্য কম। এগুলি মূল সিদ্ধিপ্রাপ্তির সোপান স্বরূপ। সিদ্ধ যোগীর কাছে যোগের ফল জ্যোতিস্মতী ও মধুমতী প্রজ্ঞা, ব্রহ্মলোকের সন্ধান। মহাযোগী যে ব্রহ্মজ্ঞানের ও ব্রহ্মলোকের অধিকারী হন, তা যোগ্যশিষ্য বা ভক্তের মধ্যে সঞ্চারিত করে তার আত্মা বা লিঙ্গ-শরীরকে ব্রহ্মজ্ঞানের ও ব্রহ্মলোকে বিচ্ছুরিত করে দেন। অষ্ট বা অষ্টাদশসিদ্ধির অলৌকিক শক্তি থেকে এই ব্রহ্মজ্ঞ শক্তি অনেক অনেক উচ্চস্তরের। আমরা যদি এই ব্রহ্মজ্ঞানের মানদণ্ডে বাবা লোকনাথকে দেখি বা ব্রহ্মবিদ্ ঋষিরূপে তার যোগেশ্বর্যের মূল্যায়ণ করি, তবে দেখতে পাবো যে, তিনি স্বয়ং ভগবানরূপে সর্বদা আমাদের মধ্যেই বিরাজ করছেন এবং তাকে একবার মাত্র ভক্তিভরে স্মরণ করলেই তিনি তার জ্যোতি বিচ্ছুরণের মাধ্যমে আমাদের মঙ্গল বিধান করতে পারেন।

আমি নর্মদা পরিক্রমা করে মা নর্মদার দৈবীশক্তির পরিচয় জনসমক্ষে প্রকাশ করার পরে অন্তরে এক তীব্র আকুলতা অনুভব করেছি মহাযোগী বাবা লোকনাথের অপার যোগৈশ্বর্যের স্বরূপ জনসমক্ষে উন্মোচন করতে। এগারো বছরের বালক লোকনাথ কিভাবে ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগী লোকনাথে পরিণত হয়ে দেবসাযুজ্য লাভ করেছিলেন, সেই বিস্তৃত যোগ-সিদ্ধির কাহিনী এখনও অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে। বাবার যোগবিভূতির মায়ায় সেই অত্যাশ্চর্য অদ্ভুত যোগসিদ্ধির কাহিনী আবৃত হয়ে আছে। এই কাহিনী উন্মোচিত হলে যেমন ভারতের যোগসাধনার এক অত্যুচ্চ দিক আলোকিত হবে, তেমনই বাবার ভক্তগণ তার সত্যস্বরূপ জেনে তাঁকে পূজা করতে সমর্থ হবেন ও ভবরোগ থেকে স্বীয় আত্মাকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হতে পারবেন।

কিন্তু আমার মতো ক্ষুদ্র যোগশক্তিবিহীন ব্যক্তির পক্ষে মহাযোগী বাবা লোকনাথের যোগজীবন আলোচনা করা কি সম্ভব! বারদীতে বাবা লোকনাথ নিজ মুখে বলেছিলেন–আমি ধরা না দিলে, কার বাপের সাধ্য আমাকে ধরতে পারে! সত্যিই তো। তিনি নিজে না বলে দিলে, তার কঠোর ও মহাযোগশক্তির সন্ধান কে পেতে পারে। তাই আমি বাবার পুণ্যচরণ কমলে কোটি কোটি প্রণাম। নিবেদন করে বলছি, বাবা, আমি জ্ঞানহীন, শক্তিহীন, সাধনহীন, ভক্তিহীন। আমি তোমার সত্যস্বরূপ জগতের সামনে উন্মোচন করতে ব্ৰতী হয়েছি। তুমি নিজে কৃপা করে আমার কলমে অধিষ্ঠান করে তোমার পরিচয় ব্যক্ত করো। তুমি নিত্য আমার আত্মায় বিরাজ করো। আমি তোমারই চরণাশ্রিত। হে পরম করুণাময়, তোমার অত্যাশ্চর্য কঠোর তপোময় জীবনচরিত অধিকাংশ জনমানসের দৃশ্যপট বহির্ভূত। সেই অলৌকিক গাথা যেমন লোকাতীত তেমন কল্পনাতীত। আমি সমগ্র নর্মদা তট ও হিমালয়ের বদরিকা আশ্রম পরিভ্রমণ করে তোমার মতো এমন ত্রিকালদর্শী এবং এত যোগৈশ্বর্যপূর্ণ ব্যক্তির সন্ধান পাইনি। তোমার উপমা, তুমি নিজেই। কেবল নর্মদা উত্তরতটের ওঁকারেশ্বরে প্রলয়দাসজি নামে এমন একজন ব্রহ্মজ্ঞের সন্ধান পেয়েছিলাম যিনি এখন দেহে নেই, যে অলৌকিক তপোবলে তিনি সর্ববিদ্যা বিশারদ হয়েছিলেন ও ব্রহ্মদর্শন করেছিলেন, তা আপামর জনমানসের নয়নের অগোচরে রয়ে গেছে। তুমি যেমন অনধিগম্য, তোমার অলৌকিক জীবনলীলাও তেমনি দুয়ে ও জনমানসের জ্ঞানাতীত। তোমার অমৃতময় ও সুমধুর জীবনকথা লোকসমাজের মঙ্গলকার্যে প্রচারে আমি ব্রতী হয়েছি। আমি তোমার, আমার আত্মায় তুমি অধিষ্ঠিত। সে জন্য আমার এ কাজও তোমার। আমাকে নিমিত্ত করে তুমি নিজেই এ কাজ সম্পাদিত করো। তুমি আমাকে যেমন লেখাবে আমি তেমনই লিখব। এ যেন এক অমর কথা হয়ে থাকে।

জয় বাবা লোকনাথ। জয় শিব লোকনাথ।
 জয় গুরু লোকনাথ। জয় ব্রহ্ম লোকনাথ।।

গুরুপ্রণাম

যোগীন্দ্রায় নমস্তুভ্যাং ত্যাগীশ্বরায় বৈ নমঃ।
ভূমানন্দ স্বরূপায় লোকনাথায় নমো নমঃ।।
 শ্রীমৎ পরং ব্রহ্ম গুরুং বদামি
 শ্রীমৎ পরং ব্রহ্ম গুরুং ভজামি।
শ্রীমৎ পরং ব্রহ্ম গুরুং স্মরামি
শ্রীমৎ পরং ব্রহ্ম গুরুং নমামি।।
নিত্যং শুদ্ধং নিরাভাসং নির্বিকারং নিরঞ্জন।
নিত্য বোধং চিদানন্দং গুরুং ব্রহ্ম নমাম্যহম্।
অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্।
তৎপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।
গুরুব্রহ্মা গুরুবিষ্ণু গুরুদেবো মহেশ্বরঃ।
গুরুরেব পরংব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ।
চিন্ময়ং ব্যাপিতং সৰ্ব্বং ত্রৈলোক্যং সচরাচরম্।
তৎপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।
 চৈতন্যং শাশ্বতং শান্তং ব্যোমাতীতং নিরঞ্জন।
 বিন্দুনাদ কলাতীতং তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।
যস্যস্মরণ মাত্রেণ জ্ঞানমুৎপদ্যতে স্বয়ম্।।
 স এব সর্বসম্পন্নঃ তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ।।
 ত্বমেব মাতা চ পিতা ত্বমেব, ত্বমেব বন্ধুশ্চ সখা ত্বমেব।
 ত্বমবে বিদ্যা দ্রবিণং ত্বমেব, ত্বমেব সর্বং মম দেবদেব।।
ওঁ নমঃ শ্রী গুরবে বাবা লোকনাথায় নমো নমঃ।।