কালীঘাটে দ্বিজ লোকনাথ

তৃতীয় অধ্যায় – কালীঘাটে দ্বিজ লোকনাথ

কালীঘাটের পথে বনে অবস্থান

কচুয়া গ্রাম ছেড়ে ধীরে ধীরে দুই বালক সন্ন্যাসী ও আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি এগিয়ে চলেছেন জঙ্গলের পথ ধরে কালীঘাটের দিকে। কচুয়ার পরে বসিরহাট, বারাসতের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তবে কলকাতায় কালীঘাট। ওই সময় এই বিস্তীর্ণ পথ ছিল ঘন জঙ্গল ও জলাশয়ে আবৃত। সাধারণ পথচারীদের জন্য কোনো পথের ব্যবস্থা ছিল না। নিতান্ত প্রয়োজনে যারা চলাচল করতো, তারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে পথ করে পদব্রজে কিংবা গোরুর গাড়িতে করে যাতায়াত করতো। বালক দুজনের বয়স সবে দশ অতিক্রম করে এগারোয় এবং তাদের গুরুর বয়স তখন ৭০ পার হয়ে ৭১-এ পড়েছে। এই প্রথম এত দীর্ঘ পদযাত্রা করছে দুই বালক। পথ চলতে চলতে সন্ধ্যা আগত। কিন্তু কোথাও জনবসতি দেখা যায় না। কেবল জঙ্গল আর জঙ্গল। আচার্যদেব বোঝেন যে এখন রাত্রি কাটাবার জন্য একটি আশ্রয়স্থল প্রয়োজন। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পান না। তিনি নিজে এবং বালকেরাও সারাদিন পদযাত্রায় ক্লান্ত। আরও কিছুদূর এগিয়ে বনের ধারে এক পর্ণকুটির দেখা গেল, আচার্যদেব এগিয়ে দেখলেন, কুটির শূন্য। কুটিরের অবস্থা দেখে সহজেই অনুমান করলেন যে, এই কুটিরে অবশ্যই কোনো সাধু বা সন্ত বাস করেন অথবা কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিলেন। এই পর্ণকুটিরেই আচার্যদেব রাত্রিবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। সন্ন্যাস আশ্রমে প্রবেশ করে এই প্রথম দুই বালক সন্ন্যাসীর বনাঞ্চলে পর্ণকুটিরে বাস। পথশ্রমে ক্লান্ত হলেও তাদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনা কাজ করছিল। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে স্বায়ংকালীন সন্ধ্যাকাজ সম্পন্ন করে বসলেন গায়ত্রী আলোচনা করতে। বালক শিষ্যদের সন্ন্যাস আশ্রমের শিক্ষা তিনি গায়ত্রীর অর্থ দিয়েই শুরু করতে চান। আরম্ভ হল দ্বিজ লোকনাথ ও বেণীমাধবের শিক্ষা।

গায়ত্রীর অর্থ দিয়ে কেন আচার্যদেব তাঁর শিক্ষা শুরু করেছিলেন, সেটা জানতে হলে আমাদের একবার সৃষ্টির আদি তত্ত্বে ভ্রমণে যেতে হবে। একবার বিশ্বেশ্বর স্বয়ং পার্বতী দেবীকে সেই তত্ত্ব সম্বন্ধে যা বলেছিলেন, এখানে তার উল্লেখ করছি। বিশ্বেশ্বর মাতা পার্বতাঁকে বলছেন

আমি পূর্বে প্রাকৃত কল্পে মুখ হতে এক কপিলাকৃতি পুরুষ সৃষ্টি করি। তাকে বলি–তুমি নিজের আত্মাকে বিভক্ত কর। কিভাবে আত্মাকে বিভক্ত করি–সেই চিন্তায় যখন আমি ধ্যানাবিষ্ট, সেই সময় আমার প্রসাদে তার দেহ ভেদ করে ত্রিবর্ণস্তররূপী চতুর্বর্গ ফলপ্রদ ঋক্‌-যজুঃ-সাম নামক ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবাত্মক ওঁকার স্বীয় প্রভাবে অখিললোক পরিব্যাপ্ত করে আবির্ভূত হলেন। ওই সময় আমার উদার বাণী দ্বারা সমলস্কৃত হয়ে ওঁকারের হৃদয় হতে ধটুকার ধ্বনি উত্থিত হল। আর ছন্দঃশ্রেষ্ঠা চতুর্বিংশতি অক্ষরবিশিষ্ট পঞ্চশীর্ষা মধুরভাষিণী দেবী গায়ত্রীও তাঁর পাশে প্রকট হলেন। হে পার্বতী! আমি গায়ত্রী ও ওঁকারকে বললাম–তোমরা উভয়ে বিচিত্র সৃষ্টির প্রবর্তন কর। আমার কথা শুনে হিরন্ময় ত্ৰিশিখ ওঁকার স্বীয় জ্যোতি থেকে বিবিধ সৃষ্টি প্রকাশ করতে লাগলেন। সর্বপ্রথমে বেদ প্রকট হলেন। ক্রমে ক্রমে তেত্রিশ জন বৈদিক দেবতা, কয়েকজন ঋষি ও মানুষ সৃষ্টি হল সেই ওঁকার থেকে। গায়ত্রী সহ এই ওঁকারই সর্বজগতের স্রষ্টা। স্কন্দপুরাণে এই তত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং অথর্ব বেদেও এই তেত্রিশ বৈদিক দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। আমি নর্মদা পরিক্রমার সময় কারেশ্বরের মন্দিরে এই তত্ত্বকথা অবগত হই। সৃষ্টির আদি এই তেত্রিশ বৈদিক দেবতা ও গায়ত্রী সহ ওঁকার সৃষ্টি প্রারম্ভ করে ওঁকারেশ্বরের ওঁকারে লীণ হয়ে যায়।

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তার শিষ্যদের শিক্ষার একেবারে প্রাথমিক স্তরে মানবের সৃষ্টিতত্ত্ব থেকেই শুরু করেছিলেন। কেননা যে সাধন অভিযানে তিনি বেরিয়েছেন তার মূল লক্ষ্য আত্মদর্শনের মাধ্যমে ব্রহ্মদর্শন। এবং সেই লক্ষ্যে। পৌঁছোতে হলে, এই মানব সৃষ্টির বীজ কোথায় তা জানা দরকার। গায়ত্রীর মধ্যেই সকল বৈদিক দেবতার বাস। এই সকল বৈদিক দেবতারাই মানব শরীরে বাস করেন। গায়ত্রী মন্ত্র দেহের মধ্যের সকল দেব দেবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই মন্ত্রের দ্বারাই সাধক সেই ধী শক্তিকে আহ্বান করেন, যিনি তাকে সর্বত্র রক্ষা করে প্রাপ্য পদে পৌঁছে দেবেন।

গায়ত্রী মন্ত্র : তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি।
ধ্যেয় যো নঃ প্রচোদ্দয়াৎ।।

 অর্থ : যিনি আমাদের ধী শক্তি প্রেরণ করেন, আমরা সেই সবিতাদেবের সে বরণীয় তেজ ধ্যান করি। ঋগ্বেদে সবিতাদেব বলতে সূর্যকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রথম রাতেই আচার্যদেব তার দুই বালক শিষ্যকে সেই জ্ঞান প্রদান করেন, যার দ্বারা তারা সবিতাদেবের ধীশক্তির অধিকারী হতে পারেন এবং তাঁর তেজকে ধারণ করার শক্তির অধিকারী হন। এই প্রথম শিক্ষাই ছিল এক অনন্য শিক্ষা। যখন আচার্যদেব তার শিষ্যদের সঙ্গে গায়ত্রীর আলোচনা করছিলেন, সেই সময় এক বিরাট সৰ্প এসে বিশাল ফনা বিস্তার করে প্রথমে স্থির হয়ে রইল। তারপর একদৃষ্টে অনেকক্ষণ ধরে দুই বালক ব্রহ্মচারীকে নিরীক্ষণ করে তাদের তিনবার প্রদক্ষিণ করে কুটির থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আচার্য বুঝতে পারলেন যে, এই নাগরাজ কোনো সর্পদেহধারী দিব্যপুরুষ। নাগরাজের আকস্মিক আবির্ভাব, আচরণ ও অন্তর্ধানের ঘটনায় তিনজনের দেহ রোমাঞ্চিত এবং অন্তর পুলকিত হয়ে উঠল।

নর্মদা পরিক্রমার শেষ পর্যায়ে আমি যখন ওঁকারেশ্বরের পরিক্রমা সমাপন পূজা করতে গিয়েছিলাম, তখন আমিও অনুরূপ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আমি ওঁকারেশ্বরের উত্তর তটে পাহাড়ের গায়ে এক কুটিরে অবস্থিত শুকদেব মুনিকে দর্শন করতে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের খাঁজের শেষ ধাপে পৌঁছতেই একজন আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। আমি বললাম আমি একজন নর্মদা পরিক্রমাকারী। পরিক্রমা সমাপন পূজা করতে এসেছি। শুকদেব মুনির দর্শনপ্রার্থী। তিনি তখন আমাকে সামনে পাহাড়ের খাঁজ দেখিয়ে বলেন–আপনি আগে এই নাগরাজকে দর্শন করুন। এই নাগরাজকে সবসময় দেখা যায় না। কোনো পরিক্রমাকারী বা মুনি এলে তখনই তিনি আবির্ভূত হন। আপনি অতীব ভাগ্যবান। আমি নাগরাজের থেকে ৫ ফুট দূরত্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে। হাত জোড় করে তাঁকে প্রণাম করে আশীর্বাদ চাইলাম। নাগরাজ প্রথমে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর একবার আমার বাঁদিকে, আবার ডানদিকে এইভাবে কয়েকবার মস্তক আন্দোলন করে তাকালেন। তারপর আমার শুকদেব মুনির দর্শন হল। ওঁকারেশ্বরেই শুনেছিলাম, অনেক সময় সিদ্ধযোগী পুরুষরাও নাগরূপে দর্শন দেন।

এখানে পর্ণকুটিরে নাগরাজের দর্শন নিশ্চিতভাবে একটি শুভলক্ষণ। আর এইজন্যই আচার্যদেব ঠিক করলেন এই স্থানেই বারোদিন অবস্থান করে ব্রহ্মচর্য শিক্ষা শুরু করবেন। এই বারোদিনে যখনই আচার্যদেব গায়ত্ৰীমন্ত্র আলোচনা করেছেন, তখনই প্রত্যহ সেই নাগরাজ তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করে আবার বনে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। বারোদিন পর আচার্যদেব মনস্থ করলেন আরও এগিয়ে যাওয়ার। যেদিন সকলে কুটির ছেড়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, তখন এক সাধু এসে সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, এই পর্ণকুটির তার। তখন আচার্যদেব তাকে তাদের বারোদিন বসবাসের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করলেন।

তিনি আচার্যদেব ও দুই বালকের পরিচয় বৃত্তান্ত শুনে বললেন যে, শুধুমাত্র ওই নাগরাজ দর্শনের আশায় তিনি বিগত বারো বছর ওইখানে কুটির বেঁধে বসবাস করছেন। কিন্তু ওই নাগরাজের দর্শন পাননি। তিনি বলেন, আপনার বালক শিষ্যরা খুবই ভাগ্যবান যে প্রথম দিনেই তাঁর দর্শন পেয়েছেন এবং প্রত্যহ তার দর্শন পেয়েছেন। ওই নাগরাজ একজন দিব্যজ্ঞানী মহাপুরুষ। স্বেচ্ছায় সর্পদেহ ধারণ করে সাধকদের কৃপা করেন। আপনাদের অনেক সুকৃতি আছে।

সাধু মহারাজের কাছে বিদায় নিয়ে আবার শুরু হল পথচলা। এবার বনাঞ্চল পেরিয়ে তারা গঙ্গার তীর ধরে হাঁটতে লাগলেন। গন্তব্যস্থল মহাতীর্থ কালীঘাট। অক্লান্তভাবে পথ চলে একদিন তারা পৌঁছলেন কালীঘাট।

কালীঘাট সেই সময় ছিল এক মহাজাগ্রত সাধনপীঠ। এই পীঠস্থান একটি প্রধান শক্তিপীঠ নামে কথিত ছিল। দেবীর ৫১ পীঠের এক পীঠ। এইখানে সতীর ডান পায়ের চারটি আঙ্গুল পতিত হয়েছিল। দেবী সতীর অঙ্গ যেখানেই পতিত হয়েছে সেখানেই মহাপীঠের সৃষ্টি হয়েছে। কালীঘাট মহাপীঠে দেবী বিরাজ করছেন দক্ষিণা কালিকা ও শিব নকুলেশ্বর ভৈরব রূপে। এই দক্ষিণা কালিকা সর্বসিদ্ধিদাত্রী। ইংরেজ ভূতত্ত্ববিদ এসমা সাহেবের বাংলার নক্সা থেকে জানতে পারা যায় যে দক্ষিণ বাংলার সমুদ্রতীর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল জঙ্গলময় ভূভাগের সমতটের মধ্যেই কালীঘাট অবস্থিত ছিল। ওই জঙ্গলের মধ্যে একটি কালীকুণ্ড নামে হ্রদ ছিল। এই হ্রদের পাশে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের মধ্যে পর্ণকুটিরে দক্ষিণা কালিকা ও নকুলেশ্বর শিব বিরাজমান ছিলেন। জনৈক কালীসাধক এই দেবদেবীর সেবায়েত ছিলেন। পরবর্তীকালে যশোরের জমিদার বসন্তরায় মহাশয় সেই পর্ণকুটিরের জায়গায় একটি ছোট মন্দির তৈরি করে দেন। এরপরে কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ১৮০৯ সালে বড়িশার জমিদার সন্তোষ রায়চৌধুরি ও তার পুত্র রামলোচন রায়চৌধুরি এবং ভাইপো রাজীবলোচন রায়চৌধুরি বর্তমান মন্দির নির্মাণ করান। ১৯৮২ সালে শিল্পপতি বিড়লা ট্রাষ্ট কালীকুণ্ডের সংস্কার করিয়ে বর্তমান রূপ দেয়।

বাবা লোকনাথ যে সময় এসেছিলেন, সেই সময় এই অঞ্চল ঘন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। অনেক সাধুসন্ন্যাসী এখানে আসতেন শক্তির আরাধনা করার জন্য। মন্দিরের অদূরে ছিল কালীঘাটের বিখ্যাত মহাশ্মশান। ওই নির্জন শ্মশান তান্ত্রিকদের সাধনক্ষেত্র ছিল। তন্ত্র সাধনার জন্য সেইসময় কালীঘাট বিখ্যাত ছিল। তখন নিবিড় জঙ্গলে বন্যকুকুর ও শেয়াল ঘুরে বেড়াত। আস্তানা ছিল কিছু ডাকাতেরও। প্রতি অমাবস্যার রাতের অন্ধকারে তান্ত্রিকেরা উন্মাদের মতো সাধনা করতেন। তাদের ঘিরে থাকতো জঙ্গলের পশুরা। আচার্যদেব এই মহাতীর্থে পদার্পণ করে বালক সন্ন্যাসীদের নিয়ে মন্দিরের সন্নিকটে জঙ্গল পরিস্কার করে একটি পর্ণকুটির নির্মাণ করলেন। সেটাই তাদের বাসস্থান হল। বাবা লোকনাথ তাঁর কালীঘাট অবস্থান সম্বন্ধে ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বেশ মজা করে যা বলেছিলেন, সে কথার এখানে উল্লেখ করছি।

তৎকালে কলিকাতা জঙ্গলময়, কালীঘাটও নিবিড় বনে আচ্ছাদিত ছিল। ইংরেজরা কালীঘাটের নিকট সওদাগিরি ব্যবসা করছিলেন। আমরা যখন কালীঘাটে এসেছিলাম, তখন বহু সংখ্যক দীর্ঘ জটাজুটধারী সাধুসন্ন্যাসী তথায় অবস্থান করছিলেন। আমি ও বেণী এই অভিনব জীবদের পেয়ে বিলক্ষণ তুষ্ট হলাম। কয়েকদিন থেকে আমরা কালীঘাটকে বাড়িঘরের মতো বানিয়ে নিলাম। সাধুরা যখন চুপ করে স্থিরভাবে উপবিষ্ট থাকতেন, তখন বালক স্বভাবসুলভ চপলতাবশতঃ আমরা কাহারও জটায় হস্তাপণ, কাহারও বা লেংটি স্পর্শ করতাম। তাহারা কিছু বলতেন না। আমরা প্রশ্রয় পেয়ে তাদের জটা ও লেংটি ধরে টান দিয়ে পালিয়ে যেতাম। সাধুরা আমাদের উপদ্রব কয়েকদিন সহ্য করে অবশেষে গুরুদেবকে জানালেন। গুরুদেব উত্তর করলেন–আমাকে বলেন কেন? আমি তো গৃহী। এরা আপনাদের লোক। আপনারা এদেরকে প্রস্তুত করে নিন। আমি গৃহ থেকে দুইটি বালককে সঙ্গে করে এনে আপনাদের নিকট উপস্থিত করেছি। এই উত্তর শুনে সাধুরা আর গুরুদেবকে অনুযোগ করতে পারলেন না। তারপরে গুরুদেব আমাদের একান্তে ডেকে বললেন–তোমরা যে তাদের জটা খসিয়ে ফেল ও লেংটি ধরে টানো, বড় হলে যখন অন্যেরা তোমাদের জটা ও লেংটি ধরে টানাটানি করবে, তখন কি করবে? আমি তখন বললাম, সে কি! আমরা তো পৈতার দিনের চেলি কাপড় পড়েছি। আমাদের জটা ও লেংটি হবে কেন? গুরু বললেন–তোমরা এই সংসার ছেড়ে আসলে ওদের মতোই জীবনযাপন করতে এসেছ। তখন আমি বললাম–আমরা যদি ওঁদের মতো হতে এসে থাকি, তবে ওরা ভিক্ষা করে খান, আর আমাদের ঘর থেকে খরচ আসে কেন? গুরু বললেন–তাও আমাদের ভিক্ষা স্বরূপ। সেই সময় লোকনাথের গ্রাম থেকে তাদের জন্য সিধে আসতো। তাদের ভিক্ষা করতে হতো না।

সাধুদের এই ঘটনা তাদের অন্তরে এক পরিবর্তন এনে দিল। তারা এরপর থেকে তান্ত্রিকদের সেবা করতে লাগলো। তাদের মধ্যে কৌতূহল হল তান্ত্রিকদের সাধন রহস্য জানার। এক-একদিন সারারাত তাদের সঙ্গে থেকে দুই বালক তান্ত্রিকদের সাধন প্রক্রিয়া দেখতো ও তাদের ধর্মালোচনা শুনতো। বুঝতে চেষ্টা করতো সাধন জগতের রহস্য। কোনো নতুন সন্ন্যাসী এলে দুই বালক সন্ন্যাসী তাদের সেবায় লেগে যেতেন। সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি তাদের অনুরাগ বাড়ে। লোকনাথ ও বেণীমাধবের মধ্যে এই ভাবান্তর দেখে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি খুশি হন। তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর দুই বালক শিষ্য বালকসুলভ চপলতা ত্যাগ করে ধীরে ধীরে সন্ন্যাস জীবনের প্রতি আসক্ত হচ্ছেন। আর যত তাড়াতাড়ি তাদের সন্ন্যাস জীবনের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি পায়, তত তাদের মধ্যে বৈরাগ্য আসবে। মহাতীর্থে এসে বালকেরা সন্ন্যাসে আসক্তি বাড়িয়েছে। এবার আবার এগিয়ে যেতে হবে। পথে পথে শিষ্যদের শিক্ষা দিতে হবে সাধনার গুহ্য পথের।

একদিন আচার্যদেব দুই শিষ্যকে ডেকে বললেন, এই মহাতীর্থে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে। এবার আবার পথে বেরোতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে উচ্চতম সাধনপীঠের দিকে আর পথে পথে তোমাদের শিখতে হবে সাধন জগতের সব গুহ্য রহস্য। চলো, আবার আমরা পথ চলা শুরু করি। দুই বালক শিষ্য তখনই তৈরি গুরু নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলার জন্য। কালীঘাটের জঙ্গলের লতাপাতা নির্মিত কুটির ত্যাগ করে তিন সাধনপথের যাত্রী আবার আপন করে নিলেন অজানা অরণ্যপথকে।