বারদীতে মহাযোগেশ্বরের যোগসিদ্ধি প্রকাশ ও মানবকল্যাণ

সপ্তম অধ্যায় – বারদীতে মহাযোগেশ্বরের যোগসিদ্ধি প্রকাশ ও মানবকল্যাণ

মহাযোগী বাবালোকনাথ ব্রহ্মচারী শতাধিক বৎসর যোগসাধনা করে যে অনন্য সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং দেবস্বারূপ্য লাভ করেছিলেন, তার তুলনা কলিযুগে যোগসাধনার ইতিহাসে বিরল। পঞ্চভূতে তৈরি এক মানবদেহকে কঠোর যোগসাধনার মাধ্যমে কিরূপে দেবদেহে উন্নীত করা যায়, এই যোগেশ্বরের সিদ্ধজীবনী তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। মহাযোগেশ্বর বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী তার একনিষ্ঠ যোগসাধনার মাধ্যমে এ কথা প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন যে, মানবদেহেই বৈদিক দেবতাগণ অবস্থান করেন এবং একাগ্র যোগসাধনার মাধ্যমে তাদের জাগ্রত করে মানবদেহকে দেবদেহে রূপান্তরিত করা সম্ভব। অথর্ববেদে মানবদেহে তেত্রিশ বৈদিক দেবতার অবস্থানের কথা পাওয়া যায়। কিন্তু সেই দেবতাদের জাগ্রত করে মানবদেহকে দেবস্বারূপ্য করার প্রক্রিয়া মহাযোগী বাবালোকনাথ ব্রহ্মচারীর যোগজীবন থেকেই জানা যায়। এইরূপ ঈশ্বরকোটির যোগী তাঁর সাধনালব্ধ সিদ্ধি কেবল নিজ মুক্তির কাজে প্রয়োগ করেননা। বাবাসোকনাথ তাঁর সিদ্ধির প্রকাশ ঘটিয়ে বারদীতে প্রায় ২৬ বছর বিভিন্ন লীলার মাধ্যমে লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজ করে গেছেন এবং দেবলোক হতে এখনও তার অনন্য সিদ্ধির বলে ভক্তদের কৃপা করে চলেছেন। বারদীতে সিদ্ধির প্রকাশ ছিল যোগীদের জন্য প্রথম লোকশিক্ষা যে, মানবদেহকে সুকঠোর যোগসাধনার মাধ্যমে দেবদেহে উন্নীত করা যায়। এখন এমন অনেক সাধু-সন্ত দেখতে পাওয়া যায়, যারা একটি-দুটি সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলেই নিজেদের মহাযোগী বলে প্রচার করেন। এইরকম সাধকগণ নিজেদের যোগবিভূতিতেই আটকে রাখেন। ঈশ্বরের সান্নিধ্য তাদের লাভ হয় না। বাবালোকনাথ তার অর্জিত বিভিন্ন সিদ্ধিকে কিভাবে লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজে প্রয়োগ করেছিলেন, এই অধ্যায়ে আমরা সেই কথা জানবো।

.

প্রাপ্তি সিদ্ধিদ্বারা জীবের প্রতি অহিংসা শিক্ষা

প্রাপ্তি সিদ্ধির অধিকারী নিজের ইন্দ্রিয়শক্তির সঙ্গে সমস্ত প্রাণীদের ইন্দ্রিয়শক্তির সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। এজন্য এই সিদ্ধির অধিকারী সাধক বিনা বাক্যব্যয়ে অন্য প্রাণীদের মনের ভাব বুঝতে পারেন এবং বাক্যদ্বারা ও ব্যবহারে নিজের মনের ভাব অন্য প্রাণীদের মনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। অষ্টাঙ্গ যোগাসনে যম-এর অনুষ্ঠানে অহিংসাব্রতে সিদ্ধ হলেই যোগী এই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হন। এই সিদ্ধিবলে বাবা লোকনাথ যে কোনো কীটপতঙ্গ, হিংস্র প্রাণী অথবা সরীসৃপের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপনে সক্ষম ছিলেন। যোগসাধন কালে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে যে হিংস্ৰপ্ৰাণীগণ জঙ্গলে বাবার নিকটে এসে তার বশ্যতা স্বীকার করে চলে গেছে। তার প্রতি কোনো হিংস্রভাব প্রদর্শন করেনি। বারদীতে বিভিন্ন সময়ে এই সিদ্ধির প্রকাশ ঘটিয়ে বাবা জনমানসকে এই শিক্ষাই দিতে চেয়েছেন যে, অহিংসার মাধ্যমে যে-কোনো হিংস্র প্রাণীকে বশ করা যায়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বাঘিনীর ঘটনা এ কথা প্রমাণ করে যে, বনের হিংস্র জন্তুরাও বাবার কথা বুঝতে পারে। অর্থাৎ বাবার ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে তারা নিজেদের ইন্দ্রিয়ের যোগস্থাপনা করতে পারতো। এই সিদ্ধির প্রকাশ আবার বারদীতে দেখতে পাওয়া যায়।

লোকনাথবাবার বারদীতে আগমনে সেখানকার সমাজপতিরা অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন যে, এই অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন যোগী যদি এই গ্রামে বাস করেন, তবে উত্তরোত্তর তার ভক্তসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং গ্রামে সমাজপতি ও তথাকথিত ব্রাহ্মণদের গুরুত্ব কমবে। এজন্য তারা ভাবতেন, কিভাবে এই যোগীকে বারদী থেকে বিতাড়িত করা যায়। এই সমাজপতিদের কারও এমন সামর্থ ছিল যে তারা মুখোমুখি শাস্ত্রালোচনার মাধ্যমে তাকে পরাজিত করতে পারেন। তারপর গ্রামের জমিদার স্বয়ং যেখানে তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েছেন, তখন জমিদারের কাছে গেলেও তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হবার আশা নেই। প্রথমদিকে তারা চেষ্টা করেছিলেন গ্রামের সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে বাবার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার। কিন্তু সাধারণ মানুষ যখন বাবার দ্বারা উপকৃত হতে লাগলেন, তখন ক্রমশঃ বিভিন্ন জেলা থেকে লোক এসে বারদী আশ্রমে বাবার কৃপা লাভ করতে লাগলো। বাবার নাম বারদী থেকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। কাজেই সমাজপতিরা এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার মতলব ছেড়ে এবার বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের লোককে ক্ষেপিয়ে তোলা শুরু করলেন। ঢাকা জেলায় সেই সময় ব্রাহ্মসমাজের যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রভাব ঢাকা জেলায় যত বাড়তে থাকে, ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব তত কমতে থাকে। ব্রাহ্মসমাজের সভ্যরা ব্রহ্মের উপাসনা করলেও বাবালোকনাথের মতো কোনো ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিত্ব তাদের তৎকালীন সমাজে ছিলেন না। সেজন্য লোকনাথ বাবার ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে শক্তিহীন করার মতো কোনো শক্তি সেই সমাজের ছিল না। কিন্তু লোকনাথ বাবার প্রভাবে তাঁদের সমাজের ক্রমহ্রাসমান প্রতিপত্তিতে তারা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, অমিত যোগশক্তির অধিকারী এই ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষকে বিরুদ্ধ প্রচারের মাধ্যাম বারদী থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব হবে না। এর উপর তখন বারদী ও তার আশেপাশের সমস্ত গ্রামের সকল সম্প্রদায়ের লোকই লোকনাথ বাবার পরম ভক্ত হয়ে উঠেছে। সেজন্য তাঁরা ও বারদী সমাজপতিরা মিলে এক ষড়যন্ত্র রচনা করলেন। তাঁরা দুজন হীন প্রকৃতির ব্রাহ্ম যুবককে নিয়োগ করলেন লোকনাথ বাবাকে রাতের অন্ধকারে মেরে বারদী থেকে তাড়িয়ে ব্রহ্মপুত্র পার করে দিয়ে আসতে। ব্রাহ্ম যুবক দু’জন ঠিক করলো রাতের অন্ধকারে বারদী আশ্রমে গিয়ে তারা এই কাজ সারবে। একদিন গভীর রাতে যখন চারিদিক অন্ধকারে ডুবে আছে এবং আশ্রমের সবাই নিদ্রায় মগ্ন, সেইসময় দু’জন আশ্রমে হাজির হলো। নিশুতি রাত। আশ্রম নিস্তব্ধ। তাদের কেউ দেখতে পাচ্ছে না। যুবক দু’জন লাঠি নিয়ে আশ্রমের উঠোনে বাবার ঘরের বরাবর দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে একটি হিংস্র বাঘিনী গর্জন করতে করতে আশ্রমের দ্বারের দিকে ছুটে এলো। যুবক দুজন ভয় পেয়ে চিৎকার করে আশ্রমের একটি ঘরে ঢুকে লুকিয়ে রইলো। বাঘিনী প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে উঠোন পার হয়ে লোকনাথবাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। যুবক দুজন বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল যে, লোকনাথবাবা তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসছেন। তারা মনে মনে আনন্দিত হল যে, এবার তাদের কাজটা বাঘিনী করে দেবে। তাদের আর মারতে হবে না। বাঘিনীর সেই নরহত্যালীলা দেখবার আশায় তারা বেড়ার ফাঁকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। তারা ভাবছিল, এইবার বাঘিনী বাবার উপর লাফিয়ে পড়ে দেহটাকে ছিঁড়ে খাবে আর ঘাড়ে করে নিয়ে চলে যাবে। তাদের আর বাবার দেহ নিয়ে ব্রহ্মপুত্র পার করতে হবে না। কিন্তু এ কী! হিংস্র বাঘিনীটা গর্জন থামিয়ে চুপ করে পোষা বিড়ালের মতো বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়লো। লোকনাথবাবা তখন তার মাথায়-গলায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, মাগো, তোমার এ-সময়ে আশ্রমে আশা ঠিক হয়নি। দেখছো না, তোমার ভয়ে দুজন যুবক আমার কাছে আসতে পারছে না। তাদের ঘরে লুকিয়ে কত কষ্ট হচ্ছে। লোকনাথবাবার কথা শুনে বাঘিনী শান্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে তার মুখপানে একবার তাকিয়ে এক লাফে আশ্রম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। লোকনাথবাবা সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। বনের হিংস্র বাঘিনী যে মানুষের কথা বুঝতে পারে, এ সেই যুবকদের কল্পনার অতীত ছিল। তারা যা চোখে দেখলো তা যেন তাদের বিশ্বাসই হচ্ছে না। এইরকম বিস্ময়কর ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা তারা কল্পনায়ও ভাবতে পারে না। লাঠি থেকে তাদের হাতের মুঠি আলগা হয়ে যায়। ঘরের মধ্যে দুজন ঘামতে থাকে। তারা বুঝতে পারে, যাঁকে তারা মারতে এসেছিল, তিনি কোনো সামান্য সাধু নন, তিনি একজন অসাধারণ অলৌকিক যোগশক্তির অধিকারী। এক মহাপুরুষ, যাঁর সামনে বনের হিংস্র প্রাণীও মাথা নত করে বশ্যতা স্বীকার করে। এইরকম মহাপুরুষকে আঘাত করার জন্য তারা এসেছে, এই মনে করে তাদের মনে অনুশোচনা হলো। তারা গভীরভাবে অনুতপ্ত হয়ে ও লজ্জায় অধোবদন হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকনাথ বাবার চরণে লুটিয়ে পড়লো। বাবার কাছে তারা তাদের আশ্রমে আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলো এবং নিজেদের দোষ স্বীকার করে কৃপা ভিক্ষা করলো।

দোষী যত বড় দোষই করুক, যদি সে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে বাবার চিত্ত বিগলিত হয়ে যেত। তিনি সব সময় অপরাধীকে ক্ষমা করতেন। তিনি বলতেন, অপরাধকে ঘৃণা করো, অপরাধীকে নয়। অনুতপ্ত যুবকদের স্বীকারোক্তি ও ক্ষমা প্রার্থনায় বাবালোকনাথ তাদের ক্ষমা করে বললেন, যা তোরা বাড়ি যা, এমন কাজ আর করিসনা, তোদের চৈতন্য হোক।

এই লীলা প্রদর্শনের দ্বারা বাবা বোঝাতে চেয়েছেন যে, হিংসা থেকেই হিংসার বৃদ্ধি হয়। ব্রাহ্ম যুবকদের মনে হিংসাবৃত্তি ছিল বলেই বাঘিনী গর্জন করতে করতে তাদের দিকে ছুটে এসেছিল। কিন্তু অহিংসাসিদ্ধ বাবালোকনাথ সামনে দাঁড়াতেই সে গর্জন থামিয়ে তার পায়ে লুটিয়ে পড়েছিল। আবার বাবা চলে যেতে বলতে সে আশ্রম ছেড়ে চলেও গিয়েছিল। মহাযোগীর অহিংসাবৃত্তির প্রভাবে বনের হিংস্র বাঘিনীও হিংসাবৃত্তি ত্যাগ করেছিল। এই লীলা প্রকাশের মাধ্যমে বাবা তৎকালীন হিন্দু-মুসলমান সমাজে ক্রমবর্ধমান হিংসাবৃত্তি রোধের জন্য এই শিক্ষা প্রচার করতে চেয়েছিলেন যে, বনের এক হিংস্র প্রাণীও অহিংসাবৃত্তি অবলম্বনকারীদের সামনে হিংসাবৃত্তি পরিত্যাগ করে। সেজন্য একই সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক কেন হিংসা বৃত্তি ত্যাগ করে অহিংসভাবে সহাবস্থান করতে পারবে না! এ এক ঈশ্বরকোটি সাধক মহাপুরুষের অমিত যোগৈশ্বর্য প্রকাশের লীলা। মহাশক্তিধর যোগীদের জীবনে এইরকম লীলার বিরল প্রকাশ দেখা যায়। কলিযুগে এই প্রকাশ ছিল বিরলতম।

বাবা লোকনাথের ছিল দয়ার শরীর। কোনো প্রাণীর দুঃখ-কষ্ট দেখলেই তাঁর করুণা হতো। তার কাছের মানুষ ও অন্য জীবের মধ্যে কোনো প্রভেদ ছিল না। একদিন রাতে একজন শিষ্য বাবার ঘরের দক্ষিণদিকের বারান্দায় কম্বল বিছিয়ে জপের আসন করছেন। তিনি জপ করতে শুরু করবেন, এমন সময় একটি ঘেয়ো কুকুর এসে তার কাছে বসে গা চুলকাতে লাগলো। কুকুরটির গা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। শিষ্যটি তখন আসন তুলে নিয়ে পূর্বদিকের বারান্দায় বসলেন। সেখানে জপ শুরু করতে যাবেন এমন সময় সেই কুকুরটি আবারও তার কাছে বসে গা চুলকাতে লাগলো। শিষ্যটি কুকুরটিকে তাড়ালেও সে যায় না। তখন শিষ্যটি সেই জায়গা ছেড়ে আবার অন্য এক জায়গায় গিয়ে আসন পাতলেন। কুকুরটিও সেখানে গিয়ে তার কাছে বসলো। যেহেতু বাবা ঘরে আছেন, সেইজন্য শিষ্যটি চেঁচামেচি করতে পারছেন না, কিন্তু কুকুরের এই আগমনে যথেষ্ট বিরক্ত হচ্ছেন। সে রাগ করে মনে মনে বলছে, বাবা এভাবে আমায় একটা কুকুর দিয়ে বিরক্ত করছেন, জপ করতে দিচ্ছেন না! যেই তিনি এই কথা মনে মনে বললেন, অমনি কুকুরটা সে স্থান ছেড়ে চলে গেল। শিষ্যটি তারপর শান্ত হয়ে জপ করতে বসলেন। কিন্তু কিছুতেই জপে একাগ্র হতে পারলেন না। সারাটা রাত তার অস্থিরতার মধ্যে কাটলো।

পরদিন ভোরবেলায় বাবা দরজা খুলে শিষ্যটিকে বললেন, রাতে তোকে মশা কামড়াচ্ছিল নাকি রে? শিষ্যটি উত্তর দিলেন, না বাবা, মশা নয়। একটা ঘেয়ো কুকুর আমাকে বড় জ্বালাতন করেছে। আমি যেখানে জপ করতে বসি, সেখানেই আমার কাছে বসে গা চুলকোয়। কুকুরটার শরীরের দুর্গন্ধে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল।

একথা শুনে বাবা শিষ্যকে বললেন, তুই ওকে ঘৃণা করছিস কেন? ওকে ঘৃণা করার কোনো অধিকার তোর নেই। তোর অসুবিধা হলে, তাড়িয়ে দিবি। যদি সে না যায়, তবে তোকেই সরে যেতে হবে। আমার কথাটা মনে রাখিস।

সামান্য একটা ঘেয়ো কুকুরের প্রতি বাবার এমন অসীম করুণা দেখে শিষ্যটি হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই কথা বা লীলা থেকে বাবা দুটি শিক্ষা দিলেন—

(১) কুকুরটি আশ্রয়হীন। সে আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছে। তুমি যদি তাতে বিরক্ত হও, তবে তুমি অন্য যে-কোনো জায়গায় যেতে পারো। কিন্তু ঘেয়ো নিরাশ্রয় কুকুরটি যেখানে যাবে, সেখানেই লোকে তাকে তাড়িয়ে দেবে। আশ্রম সকল প্রাণীর। এখানে সে নিরাপদ ভেবেই আশ্রয় নিয়েছে। যদি সে অন্য জায়গায় আশ্রয় পায়, তবে সে নিজেই চলে যাবে, কিন্তু যদি না পায়, তবে তোমার উচিত তাকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া, নতুবা অন্যত্র চলে যাওয়া।

(২) জীবের সেবা করার নামই ধর্ম। জীবকে ঘৃণা করে জপ সাধনা করলে জপসিদ্ধ হওয়া যায় না। সব জীবের প্রতি সমভাবে প্রেম করলেই ঈশ্বর তুষ্ট হন।

এইভাবে বাবা বারদীতে এক একটি লীলার মাধ্যমে লোকশিক্ষার প্রবর্তন করে গেছেন। বাবা বলতেন, ঈশ্বর সর্বভূতাত্মা। ঈশ্বরকে সর্বভূতাত্মারূপে উপাসনা করলে সর্বত্র সমদর্শনরূপ আত্মজ্ঞানের উদয় হয়। সাধক সমদর্শী হয়। সমদর্শী মহাযোগেশ্বর লোকনাথের অন্তরে ছিল অসীম করুণা। এই অন্তহীণ করুণার অমৃত ধারার অধিকারী ছিল মানুষ, হিংস্র প্রাণী, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি সকলে। তিনি তার করুণার বিগলিত ধারায় সকলকে কৃতার্থ করতেন।

বারদী আশ্রমে প্রতিদিন আহারের সময় বাবা উঠোনে এসে ‘আয়, আয়’ বলে ডাক দিতেন। তখন কত পশুপাখি, কীটপতঙ্গ এসে উঠোনে হাজির হতো। আশ্রমের গাছের ডালে ডালে পাখিরা বসে কলরব করতো। কখনও কখনও পাখিরা বাবার জটায়, কাঁধে বসে বিচিত্র সুরে কলরব করতো। বাবা তাদের ভাষা বুঝতেন। আনন্দের সঙ্গে নিজের হাতে তাদের খাইয়ে দিতেন। ছোটে ছোটো পিঁপড়ের সারিতে মিছরির গুঁড়ো ছড়িয়ে দিতেন। তখন তার মুখে এক প্রশান্তি বিরাজ করতো। যতক্ষণ পর্যন্ত না পাখি, কীটপতঙ্গ খেয়ে নিরাপদে আশ্রম ছেড়ে চলে যেত, বাবা সেখানে বসে থাকতেন। তাঁর কাছে শিষ্যদের আহার ও পশুপাখি, কীটপতঙ্গের আহার সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কোনো মানুষ না খেতে পেয়ে মরে গেলেও বর্তমান সমাজপতিদের মনে দাগ কাটে না। কিন্তু একটি পাখি বা কীটও যদি আশ্রম থেকে না খেয়ে যেত, বাবার মন তার জন্য কাঁদতো। যোগসাধনায় সমদর্শী বলতে কি বোঝায়, বাবার এই আচরণ থেকে তা শিক্ষণীয়। এই সমদর্শন ভিন্ন আত্মদর্শন হয় না। আর আত্মদর্শন না হলে সিদ্ধিলাভ কি করে হবে!

একদিন জমিদারবাবু আশ্রমে এসে হাজির হলেন। সাধারণতঃ তিনি এলে সোজা বাবার ঘরে গিয়েই বসেন। তিনি বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই ভিতর থেকে অন্তর্যামী বাবা বলে উঠলেন, বাবা অরুণ, এখন ঘরে আসবি নে। আমার পরিবার খাচ্ছে। খাওয়া হয়ে গেলে ঢুকবি।

বাবার এই কথায় নাগ মহাশয় আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ভাবতে লাগলেন যে, বাবার পরিবার এখানে কোথা থেকে এলো? পরে ভাবলেন, বোধহয় কোনো কূলবধূ বাবাকে দর্শন করতে এসেছেন। এখন বাবার প্রসাদ পাচ্ছেন। তিনি বাবার আদেশমতো বারান্দায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। দেখতে দেখতে দু-ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু তখনও বাবা দরজা খুলে বাইরে এলেন না। ঘরের মধ্য থেকে কোনো কথাও শোনা যাচ্ছে না। নাগ মহাশয় ভিতর থেকে কোনো কথা শুনতে না পেয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি মেরে দেখলেন। কিন্তু ঘরে কোনো লোক তার গোচরে এলো না। এমন সময় বাবা ঘরের দরজা খুলে বললেন, বাবা অরুণ, এবার তুই ঘরের ভিতরে আসতে পারিস।

নাগবাবু ঘরে ঢুকে বাবাকে প্রণাম করলেন কিন্তু অন্য কোনো ব্যক্তি দেখতে পেলেন না। নিজের ঔৎসুক্য চেপে না রাখতে পেরে তিনি বাবার কাছে নিবেদন করলেন, ব্রহ্মচারী বাবা, আপনি তখন আমায় বললেন, আপনার পরিবার খাচ্ছে। কিন্তু কই, ঘরে তো কাউকে দেখছি না! নাগ মহাশয়ের এই কথা শুনে হাসতে হাসতে বাবা বললেন, ওই দেখ, আমার পরিবার কেমন খেয়ে খুশি মনে চলে যাচ্ছে। বাবার কথা শুনে নাগমহাশয় দেখলেন, একদল পিঁপড়ে সার বেঁধে ঘরের ভিতর থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। নাগবাবু এতক্ষণে বুঝলেন, করুণাময় বাবা নির্জনে ঘরের মধ্যে বসে নিজের হাতে পিঁপড়েদের মিছরির গুড়ো খাওয়াচ্ছিলেন এবং যতক্ষণপর্যন্ত তাদের খাওয়া শেষ না হয়, তিনি নিজে তাদের পাহারা দিচ্ছিলেন। পিঁপড়েদের খাবার সময় যদি কেউ ঘরে ঢোকে, তবে তাদের পদদলিত হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সেইজন্য বাবা সেই সময় কাউকে ঘরে ঢুকতে দেন না।

জমিদার নাগমহাশয় ভাবতে লাগলেন, পিঁপড়ের মতো এত ক্ষুদ্র জীবের প্রতিও বাবার কত ভালোবাসা, কত করুণা, কত মমতা। মানুষ পিঁপড়ে দেখলেই তাদের মেরে ফেলার ঔষধ খোঁজে। কিন্তু হিংসা ত্যাগ করে কেবল মমতা ভরা ভালোবাসা দিয়ে পিঁপড়ের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবকেও আপন করে নেওয়া যায়। তিনি আরও শিক্ষা গ্রহণ করলেন যে, পিঁপড়ের মতো এত ক্ষুদ্র প্রাণীর জন্যও বাবা জমিদারকে বাইরে বসে থাকতে আদেশ করেছিলেন। এই আচরণ দ্বারা বাবা এই শিক্ষা প্রবর্তিত করেছিলেন যে, কোনো বড় মানুষ দেখলেই, ছোটোকে দূরে সরিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। আদর্শ মানুষের কাছে বড়ো-ছোটো সমান হওয়া উচিত। বর্তমানের কর্তাভজা সমাজে বাবা লোকনাথের এই শিক্ষা কেবলমাত্র প্রাসঙ্গিকই নয়, বোধহয় দুঃস্থ ও পঙ্গু সমাজকে সবল করার জন্য অপরিহার্য্যও বটে।

নর্মদা পরিক্রমার প্রাক্কালে একজন মুনির পরামর্শে অম্বামাতার আশীর্বাদ প্রার্থনার জন্য গুজরাটের অম্বা পাহাড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে অম্বা মন্দিরে হোমযজ্ঞ করে আমি নর্মদা পরিক্রমার জন্য সফলতা প্রার্থনা করি। সেই যজ্ঞের সময় মহন্তজী একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার দ্বারা কীট-পতঙ্গাদির যে অনিচ্ছাকৃত হত্যা হয়েছে, তার পাপ স্খলনের জন্য মাতার কাছে প্রার্থনা করেন। আমি এই সময় জানতে পারি যে নর্মদা পরিক্রমা একটি তপস্যা। সাধকের মধ্যে সমদর্শন

এলে তপস্যায় সফল হওয়া যায় না। সমদর্শন থেকেই আত্মদর্শন হয়। আমার তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমা যাতে সফল হয়, সেজন্য আমার পায়ে পদদলিত হয়ে এ যাবৎ যে সব কীটপতঙ্গের মৃত্যু হয়েছে, তার পাপ থেকে আমার মুক্তি কামনাকল্পে এই প্রক্রিয়া করা হলো। তখন বিষয়টা এত গভীরে বুঝিনি। পরে পূর্ণ নর্মদা পরিক্রমাগালে এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি। অনিচ্ছাকৃত হিংসা সংঘটিত হলেও সাধকের তপস্যায় সফলতা আসেনা। সাধকের কাছে অহিংসা একটি বড়ো মন্ত্র। সিদ্ধিপ্রাপ্ত যোগী সকলের প্রতি সমান করুণা করেন।

একসময় বারদীতে ব্রহ্মচারী বাবার চাষ করার ইচ্ছা হয়। তিনি মনে করেন আশ্রমে ভক্তদের সেবা করানোর দ্রব্য যদি নিজেরা চাষ করে ফলানো যায়, তবে বাইরে থেকে কিনতে হয় না। তিনি জমিদার মহাশয়কে তার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, নাগমহাশয় চাষের ক্ষেত, চাষের দ্রব্য ও লোকজনের সব ব্যবস্থা করে দেন। এক বর্ষাকালে ধান রোপন শুরু করা হলো। শীতকালে যখন ধান পেকে উঠেছে, রোজ রাতে শুয়োরের পাল ক্ষেতে এসে ধান নষ্ট করে দিতে লাগলো। ধান কারা নষ্ট করে দিচ্ছে আশ্রমবাসীরা বুঝতে না পেরে রাতে পাহারার ব্যবস্থা করলো। পাহারাদাররা দ্যাখে রাতে শূয়োরের পাল এসে ধান নষ্ট করছে। তারা লাঠি নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছবার আগেই শূয়োরের পাল দৌড়ে পালিয়ে যায়। এইভাবে প্রতি রাতেই শুয়োরের পাল এসে ধান খেয়ে যায়, কিন্তু কোনোদিন পাহারাদাররা একটিও শূয়োরকে ধরতে পারেনা। তারা ভাবতে থাকে, শূয়োরেরা কি করে জানতে পারে যে তারা লাঠি নিয়ে আসছে, আর তারা পৌঁছনোর আগেই পালিয়ে যায়!

একদিন এক ভক্ত সেই রহস্য ভেদ করলেন। তিনি বললেন, বাবা বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে যোগবলে দেখতে পান, রাতে ক্ষেতে কে এসে ধান খাচ্ছে। একদিন আমি শুনলাম, বাবা ঘরের থেকে শূয়োরগুলোকে বলছেন, ওরে তোরা কাজ সেরে তাড়াতাড়ি সরে পড়, লাঠি নিয়ে ওরা তোদের মারতে আসছে। বাবা ঘরের থেকে বলামাত্র শূয়োরগুলো ক্ষেত থেকে দৌড়ে পালায়। বাবার অলৌকিক শক্তিতে অহিংসা সিদ্ধি দ্বারা শূয়োরগুলোর ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন, তাদের নিরাপদ করেন। সব জীবের প্রতি তার এমনই করুণা ছিল। আশ্রমবাসীরা বাবার কাছে গিয়ে এই রহস্যের কথা ব্যক্ত করেন ও তাঁর শ্রীমুখ থেকে আসল ব্যাপারটা জানতে চান। বাবা তখন সকলের কাছে স্বীকার করেন যে, তিনি প্রতি রাতে শুয়োরগুলোকে সতর্ক করে দেন, যাতে তারা নিরাপদে ক্ষেত ত্যাগ করতে পারে। ক্ষেতের যে ফসল তাতে যেমন আশ্রমিকদের অধিকার, তেমনই ক্ষুধা নিবারণের জন্য অন্য প্রাণীদেরও অধিকার। এই কথার মাধ্যমে বাবা আশ্রমিকদের এই শিক্ষা দিলেন যে, জগতের সব বস্তু ঈশ্বরের। এই জমি যেমন ঈশ্বরের সৃষ্টি, তেমন প্রাণীরাও তারই সৃষ্টি। সুতরাং ঈশ্বরের সৃষ্ট সব বস্তুতেই সব জীবের সমান অধিকার। মানুষ নিজের ক্ষুধা নিবারণের জন্য অন্য প্রাণীর অধিকার হরণ করতে পারে না।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর এই বার্তা যদি সমাজের সর্বস্তরে সমানভাবে প্রচারিত হতো, তবে দেশে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে এত ভেদাভেদ সৃষ্টি হতো না। প্রত্যেক মানুষ নিজেকে অন্যের থেকে বড় মনে করে এবং সেখান থেকেই ভেদাভেদের সৃষ্টি। আরও একটি ঘটনার মাধ্যমে বাবা ভক্তদের এই সম্বন্ধে শিক্ষা দান করেন।

একদিন বারদী স্কুলের পণ্ডিত বিপিনবিহারী সরকার মহাশয় ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনে আসেন। তিনি বাবার ঘরের বাইরে তার সঙ্গে বার্তালাপ করতে থাকেন। এমন সময় আশ্রমের এক গাছের ডালে বসে একটি কাক কর্কশ স্বরে কা-কা করে ডাকতে থাকে। কাকের কর্কশ ডাকে বার্তালাপে ব্যাঘাত ঘটায় বিপিন বিহারী বাবু একটি ঢিল ছুঁড়ে কাকটাকে তাড়িয়ে দিয়ে আবার বার্তালাপ করতে থাকেন। কিন্তু কাকটা আবার ফিরে এসে একইভাবে কর্কশ স্বরে ডাকতে থাকে। বিপিনবিহারীবাবু আবার ঢিল ছুঁড়ে কাককে তাড়িয়ে দেন। তখন বাবা লোকনাথ পণ্ডিত বিপিনবিহারীবাবুকে বললেন, কাকের ডাক তোর কাছে কর্কশ লাগছে, তাই তুই ওকে বারবার ঢিল ছুঁড়ে তাড়িয়ে দিচ্ছিস। কিন্তু দ্যাখ, তোর কথাও আমার কানে তেমন কর্কশ লাগছে, কিন্তু আমি তোকে তাড়িয়ে দিচ্ছি না। এই কথা শুনে পণ্ডিত মহাশয় খুব লজ্জিত হয়ে গেলেন। ব্রহ্মজ্ঞানী বাবা লোকনাথ এই কথার মাধ্যমে পণ্ডিত মহাশয়কে এই শিক্ষা দিলেন যে, জগৎ সংসারে সব প্রাণীই ঈশ্বরের সৃষ্টি। তাদের কাউকে ঘৃণা করার অধিকার আমাদের কারও নেই। ঈশ্বরের সৃষ্ট কোনো জীব বা বস্তু যদি কারও কাছে কুৎসিত বা অপ্রিয় মনে হয়, তাহলেও ঈশ্বরের সৃষ্টিকে অনাদর করা মহাপাপ হবে। সংসারী লোকেদের কথাবার্তায় কামনা-বাসনার প্রলেপ থাকে। যোগসিদ্ধ মহাপুরুষগণের সেইসকল কামনা-বাসনাপূর্ণ কথা ভালো লাগে না। তবুও মহাপুরুষরা তাদের তাড়িয়ে না দিয়ে কামনা-বাসনা ত্যাগ করে কি করে সংসারে সুখী হওয়া যায় তার শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কামনা, বাসনা, লোভ, মোহ ও অহঙ্কার–এই পঞ্চতত্ত্বকে যে জয় করতে পারে, সেই ঈশ্বরমুখী হতে পারে। যতক্ষণ মানুষের মধ্যে এই পঞ্চতত্ত্ব বিরাজিত থাকে, ততক্ষণ সে প্রকৃতভাবে ঈশ্বরের চরণে কিছু দিতে সমর্থ হয় না।

বারদীর আশ্রমে প্রতিদিন একটি ষাঁড় এসে বাবাকে দর্শন করে যেত। বাবা তার নাম রেখেছিলেন কালাচাঁদ। একদিন বারদীর এক ভক্ত চাষী এসে এক কাঁদি মর্তমান কলা এনে বাবার ঘরের সামনে রেখে তার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে চলে গেল। বাবার ঘর বন্ধ ছিল। ঘরের বারান্দায় আশ্রম-ভৃত্য ভজলেরাম বসেছিল। এমন সময়ে কালাচাঁদ এসে সামনে মর্তমান কলা দেখতে পেয়ে খেতে আরম্ভ করলো। ভজলেরাম এই কাণ্ড দেখে চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। তার চেঁচামেচি শুনে চাষী ভক্তটি ফিরে দ্যাখে তার দেওয়া কলার কাদি থেকে ষাঁড়টি সব কলা খেয়ে ফেলছে। সে দৌড়ে এসে ওর মুখের সামনে থেকে কিছু কলা বাঁচিয়ে সরিয়ে রাখলো। এমন সময় বাবা দরজা খুলে বেরিয়ে সেই ভক্তটিকে বললেন, তুই ওর গ্রাসের কলা সরিয়ে নিলি কেন? সেইসময় কালাচাঁদ বাবার মুখের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভক্তটি বললো, বাবা, আমি ওর গ্রাসের কলা নিইনি। কাঁদিতে যে কটা কলা পড়েছিল, সেগুলি সরিয়ে দিয়েছি। বাবা বললেন, যে কলা তুই আমাকে নিবেদন করেছিস, তাতে আর তোর কি অধিকার? কালাচাঁদ আমার কলা খেয়েছে। তুই ওর সামনে থেকে কলা নিলি কেন? ভক্তটি তখন তার ভুল বুঝতে পারলো এবং সেই কলাগুলি এনে কালাচাঁদকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো। বাবা এবার শান্ত হলেন। যখন ভক্তটি কালাৰ্চাদের সামনে থেকে কলাগুলি সরিয়ে নেয়, তখন সে করুণভাবে বাবার ঘরের দিকে তাকিয়েছিল। বাবার ইন্দ্রিয় কালাচাঁদের দুঃখ বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বেরিয়েছিলেন। আর এই ঘটনার মাধ্যমে বাবা সব ভক্তকে এই শিক্ষা দিলেন যে, আশ্রমের প্রতিটি জিনিসের উপর সবার সমান অধিকার। বাবা এখানে ভক্তদের আরও একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, দেবতার সামনে কিছু নিবেদন করে দিলে, সেটা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে দিতে হয়। নিবেদিত দ্রব্য যখন দেবতার হয়, তখন নিবেদনান্তে সেই দ্রব্য কে গ্রহণ করলো, তা নিয়ে নিবেদনকারীর মাথা ঘামানো উচিত নয়। যখন নিবেদনকারী দেবতাকে নিবেদন করার পরেও সেই দ্রব্যের প্রতি মোহ রাখে, তখন বোঝা যায় যে, সে সেই দ্রব্যের প্রতি সম্পূর্ণ স্বার্থ ত্যাগ করতে পারেনি। এমন দ্রব্য দেবতার পূজায় লাগেনা।

নর্মদা পরিক্রমার সময় ওঁকারেশ্বরের দক্ষিণতটে মামলেশ্বর মন্দিরে জ্যোতির্লিঙ্গের বিশেষ অভিষেক পূজা করে আমি যখন গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে পণ্ডিত মহাশয় ও স্ত্রীকে নিয়ে নাটমন্দিরে বসেছি, ঠিক সেই সময় একটি হনুমান এসে আমাদের সামনে থেকে কেবল প্রসাদটি নিয়ে এক লাফে চলে গেল। একদানা প্রসাদও কারও জন্য রাখলো না। পণ্ডিত মহাশয় আমাদের বললেন, ওকে নিতে দাও। এটা খুব শুভ লক্ষণ। আমরা আনন্দিত মনে সেই হনুমানকে প্রণাম করেছিলাম।

জ্যোতির্লিঙ্গকে নিবেদন করা প্রসাদ যদি হনুমান নিয়ে থাকে, তবে আমি কেন তাকে বাধা দেবো? নর্মদা পরিক্রমা একটি তপস্যা। সমদর্শী না হলে তো সেই তপস্যায় সফলতা পাওয়া যায় না। মা নর্মদা এইভাবেই পরিক্রমায় ভক্তদের পরীক্ষা করেন।

ভক্তদেরকে অহিংসার শিক্ষা দিতে ব্রহ্মচারী বাবার আর একটি ঘটনার উল্লেখ না করলে নয়। একদিন বাবা ভক্তদের বিভিন্ন উপদেশ দান করছিলেন। সেইসময় একজন গ্রামের মহিলা এক বাটি গরম দুধ বাবার সেবার জন্য এনে তার সামনে নিবেদন করে প্রণাম জানিয়ে বাইরে গেলেন। দুধ ঠাণ্ডা হয়ে গেলেও বাবার সেদিকে খেয়াল নেই। একজন ভক্ত বাবাকে দুধের কথা মনে করিয়ে দিতে তিনি আয় আয় বলে ডাকতে লাগলেন। উপস্থিত কেউ বুঝতে পারলো না যে বাবা কাকে ডাকছেন। কিছুক্ষণ পর সকলে আশ্চর্য হয়ে দেখে প্রকাণ্ড এক কেউটে সাপ বাইরে থেকে বাবার দুধের বাটির দিকে আসছে। সকলে ভীত হয়ে সরে বসলো। কয়েকজন চিৎকার করে কাষ্ঠবৎ জড়সড় হয়ে বাবার গা ঘেঁসে গিয়ে বসলেন। সাপটি ব্রহ্মচারী বাবার সামনে গিয়ে তার বিশাল ফণা বিস্তার করলো। বাবা আদর করে ফণাটি ধরে দুধের বাটির মধ্যে ডুবিয়ে দিলেন। বাটির দুধ পান করা হয়ে গেলে সে আবার বাবার সামনে ফণা বিস্তার করলো। তখন বাবা তাকে বললেন, এখন চলে যা। বাবা বলমাত্র সাপটি ফনা নামিয়ে যে পথে এসেছিল, সেইপথে চলে গেল। নিঃশব্দে এতক্ষণ উপস্থিত ভক্তগণ এই শ্বাসরুদ্ধকারী ঘটনা দেখছিলেন। সাপটি চলে গেলে বাবা দুধের বাটি থেকে একটু সর নিয়ে নিজের মুখে দিলেন। তারপর বর্ধমানের এক ভক্তকে বললেন, নে প্রসাদ নে। সেই ভক্তের নাম ছিল গৌরগোপাল রায়। গৌরগোপাল রায় মহাশয় পেশায় দারোগা ছিলেন এবং ভোলাগিরি বাবার শিষ্য ছিলেন। গৌরবাবু বিষাপ্ত সাপের মুখ দেওয়া দুধ নিতে ইতস্ততঃ করছিলেন। বাবা তখন বললেন, ইতস্ততঃ করছিস কেন? নে না, কোনো ভয় নেই। গৌরবাবু তখন মনের সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে মহাপুরুষের প্রসাদ মনে করে ভক্তিভরে তা গ্রহণ করলেন। সকল ভক্তের সামনে এইরকম বিষধর সাপের সঙ্গে অহিংসাভাব প্রদর্শন করে বাবা সকলকে এই শিক্ষা দিলেন যে, কেউটের মতো বিষধর সাপও অহিংসার ভাব প্রদর্শনে তার স্বভাবজাত হিংস্রতা ভুলে বশ্যতা স্বীকার করে। কিন্তু মানুষ হিংসার বশবর্তী হয়ে একে অপরের মধ্যে বিভেদের রেখা সৃষ্টি করে।

.

দূরশ্রবণ ও দর্শনসিদ্ধি দ্বারা লোকশিক্ষা

দূরশ্রবণ ও দর্শনসিদ্ধি দশটি গৌণসিদ্ধির অন্তর্গত। যে সিদ্ধির বলে যোগী ত্রিভূবনের সকল শব্দশ্রবণ ও সকল অদৃশ্যও দর্শন করতে পারেন, তাকে দূরশ্রবণ ও দর্শনসিদ্ধি বলে। অষ্টাঙ্গ যোগে আটটি মুখ্য সিদ্ধিপ্রাপ্ত হবার পর যোগী এই গৌণসিদ্ধি প্রাপ্ত হন। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী যে এই সিদ্ধিপ্রাপ্ত ছিলেন অর্থাৎ তিনি যে সাধারণ মানুষের কাছে অদৃশ্য জিনিসও দর্শন করতে পারতেন বা ত্রিভূবনের সকল শব্দই শ্রবণ করতে পারতেন, সেটা তিনি একটি ঘটনার মাধ্যমে জনসমক্ষে এনেছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে অষ্টাঙ্গ যোগ শিক্ষার সময় বাবা শব্দব্রহ্মের তপস্যা করেছিলেন।

একবার নারায়ণগঞ্জ যুগ্ম ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বারদীর কিছু গরীব চাষিদের নামে কিছু বিত্তবান ব্যক্তি ফৌজদারি মামলা করে। সেই গরীব চাষীরা লোকনাথ বাবার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল। তারা একদিন বাবার কাছে এসে মামলার সত্য ঘটনা নিবেদন করে তাকে চাষীদের হয়ে আদালতে সাক্ষী দিতে অনুরোধ করে। বাবা তাদের বলেন, আমি সন্ন্যাসী মানুষ, কখন কোথায় থাকি, তার ঠিক নেই। আমায় মামলা-মোকদ্দমায় জড়াচ্ছিস কেন? আমার দ্বারা ওসব হবে না। তখন ভক্তরা অনুনয় করে বলে যে, তুমি সাক্ষী না দিলে, ওরা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে সাজা দেওয়াবে। প্রকৃত সত্য আদালতের সামনে আসবে না। ভক্তদের এই একান্ত অনুরোধে আদালতে প্রকৃত সত্য প্রমাণ করার জন্য বাবা শেষপর্যন্ত সাক্ষী দিতে রাজী হলেন।

মামলার দিন আদালত কক্ষ লোকে লোকারণ্য। সবার মধ্যে প্রচার হয়ে গেছে যে, সেইদিন বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা আদালতে সাক্ষী দিতে আসছেন। নারায়ণগঞ্জে তাঁর অগণিত ভক্ত ছিল। তারা ছাড়াও অন্য অনেকে যারা কোনোদিন তাঁর দর্শন পাননি, সেইসব লোকও আদালতে কেবলমাত্র ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনাকাঙ্খায় এসেছে। আদালতের কাঠগড়ায় সাক্ষীর নাম ধরে ডাক পড়াতেই বাবা সাক্ষীর কাঠগড়ায় উপস্থিত হলেন। গুঞ্জনমুখর আদালতকক্ষ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। সকলে উগ্রীব হলেন ব্রহ্মচারী বাবা কি বলেন, সে কথা শোনার জন্য।

যুগ্ম ম্যাজিস্ট্রেট বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর দীর্ঘ জটাজুটমণ্ডিত দেহের দিকে তাকিয়ে নাম ও ঠিকানা জিজ্ঞাসা করার পর প্রশ্ন করলেন, আপনার বয়স কত?

ব্রহ্মচারী বাবা সহজভাবে উত্তর দিলেন, দেড়শো বছরের বেশি হবে।

কথা শুনে ম্যাজিস্ট্রেট আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তিনি প্রথমে ভাবলেন, কোনো মানুষ দেড়শো বছর বেঁচে থাকতে পারেনা। পরে আবার ভাবলেন, যোগী পুরুষদের পক্ষে এত দীর্ঘসময় বেঁচে থাকা সম্ভব হতেও পারে।

কিন্তু বিপক্ষের আইনজীবী বাবার কথায় বিশ্বাস করলেন না। তিনি বাবাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, আদালতে সাক্ষী দিতে এসে এইরকম অবান্তর কথা বললে, তা অপরাধ বলে গণ্য হয়।

বাবা তখন সহজ-সরলভাবে আইনজীবীকে বললেন, বেশ, আমার কথা যদি তোমাদের অবিশ্বাস্য মনে হয়, তবে তোমাদের খুশিমতো বয়সটা লিখে নাও।

বিপক্ষের উকিল তখন ম্যাজিস্ট্রেটকে বললেন, হুজুর, সাক্ষী বয়সে অতি বৃদ্ধ এবং স্বাভাবিকভাবেই তার দৃষ্টি ক্ষীণ। যে ঘটনার সাক্ষী দিতে উনি এসেছেন, তা তার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। এরপর তিনি তার বক্তব্যকে প্রমাণ করার জন্য লোকনাথ বাবাকে বিভিন্নভাবে জেরা করতে লাগলেন। ব্রহ্মচারী বাবা উকিলের জেরার সব ঠিক ঠিক উত্তর দিলেন। তাঁকে জেরায় অপ্রতিভ করা গেল না। শেষে উকিল বললেন, আপনি আপনার যে বয়সের কথা আদালতে বললেন, তাতে আপনার পক্ষে কোনো দূরের জিনিস বা ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। সুতরাং আপনি যে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছেন, এই কথা কি করে মেনে নেওয়া যায়?

ব্রহ্মচারী বাবা এই কথা শুনে উকিলবাবুকে কাছে ডাকলেন। উকিল ভাবলেন, সাক্ষী হয়তো তার কাছে কোনো গোপন কথা ফাঁস করবেন। তিনি অতি আগ্রহে তড়িৎ গতিতে সাক্ষীর সামনে গেলেন। ব্রহ্মচারী বাবা তখন আদালতকক্ষের দরজা দিয়ে দূরে একটি আমগাছ দেখিয়ে তাকে বললেন, ওই গাছটাতে কোনো প্রাণী উঠছে দেখতে পাচ্ছো?

উকিলবাবু এটিকে একটি অবান্তর প্রশ্ন মনে করে অতীব তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, না কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।

এইসময় আদালতকক্ষে উপস্থিত বাবার ভক্তগণ বুঝতে পারলেন যে, এটি বাবার একটি লীলা। বাবা যে কোনো দূরের জিনিসই দেখতে সক্ষম হন। অন্য অনেক উপস্থিত ব্যক্তিরা গাছের দিকে তাকিয়ে প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করে যে, কিছু দেখা যাচ্ছে কি না! আদালতকক্ষে অতঃপর একটি গুঞ্জন ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়, কই, কিছুই তো দেখছি না!

ব্রহ্মচারী বাবা তখন হেসে বলেন, আশ্চর্যের কথা। তোমরা সব বয়সে যুবক, তোমাদের দৃষ্টিশক্তিও প্রখর। অথচ এত কাছের জিনিসও তোমরা দেখতে পাচ্ছো না!

উকিলবাবু তখন কিছুটা ব্যঙ্গের সুরে বলেন, বেশ, আপনিই বলুন, ওই আমগাছে কোন্ প্রাণী উঠছে?

ব্রহ্মচারী বাবা সহজভাবে বললেন, ওই গাছে একদল লাল পিঁপড়ে সারি বেঁধে উপরের দিকে উঠছে।

বাবার কথা শুনে আদালত কক্ষে সকলে বিস্মিত হলো। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও বিস্মিত হলেন। তিনি উকিলবাবুকে বললেন, নিজে সেই গাছের কাছে গিয়ে দেখে আসতে যে, এই সন্ন্যাসী যা বলছেন, সেটা সত্য কি না! উকিলবাবু তখন আদালতকক্ষ থেকে দূরে অবস্থিত সেই গাছের কাছে গেলেন। কৌতূহলী কিছু লোকও উকিলবাবুর সঙ্গী হলেন। গাছের কাছে গিয়ে তারা দেখলেন যে, সত্যিই একদল লাল পিঁপড়ে সারি বেঁধে উপরের দিকে উঠছে। তারা সকলে বিস্মিত হয়ে এসে ম্যাজিস্ট্রেটকে সেই কথা জানালে তিনিও হতভম্ভ হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এই ব্রহ্মচারী একজন সাধারণ মানুষ নন। ইনি নিশ্চয়ই একজন যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ। যোগবলে সব অদৃশ্য বস্তুই ওনার দৃশ্যমান হয়। এরপর ম্যাজিস্ট্রেট লোকনাথবাবার সাক্ষী গ্রহণ করেন এবং তার সাক্ষ্যবলে বাবার ভক্তরা ফৌজদারী মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্ত হয়।

শব্দব্রহ্মের তপস্যায় সিদ্ধ হয়ে বাবা বহুদূরের কোনো মানুষ, জন্তু, কীট-পতঙ্গ ও পাখির গুঞ্জন অথবা গর্জন শব্দ শুনে তাদের ভাব বুঝতে সক্ষম ছিলেন। একজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের শরণপথে সমস্ত জগৎ সংসার থাকে। এই জগতের কে, কোথায় কি করছেন, সেটা তাঁর কাছে দৃশ্যমান হয় এবং তিনি সে কথা বলে দিতে পারেন। আদালতের এই লীলার মাধ্যমে বাবা কেবল এই প্রদর্শন করতে চাননি যে, তিনি বহুদূরের জিনিস দেখতে সক্ষম। এইভাব তর লীলার অতি সরলীকরণ। এই লীলার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, জগৎসংসারের সব কিছু তার শরণপথে থাকে। তার কাছে সারা জগৎসংসার দৃশ্যমান। এ জগতের কোনো কিছুই তার অগোচর নয়।

মহাযোগেশ্বর বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী দুর্লভ ঈশিতাসিদ্ধির দ্বারা এই মননধারণা করতে পারতেন যে, ঈশ্বর সারা আকাশব্যাপী সূক্ষ্মাত্মারূপে বিরাজমান। ঈশ্বরের সেই আকাশমূর্তির ধ্যানমন্ত্র হচ্ছে ‘ওঁ আকাশমূর্তয়ে নমঃ’। ঈশ্বরের সেই আকাশমূর্তির মধ্যে নিয়ত যে হংসশব্দ ধ্বনিত হচ্ছে, তা ব্রহ্মচারী বাবা শুনতে পেতেন। সেজন্য তিনি সমস্ত জীবের হৃদয়াকাশে হংসনাদ ও দূরবর্তী অসংখ্য প্রাণীর স্কুট-অস্ফুট সমস্ত ধ্বনি শুনে তাদের ব্যক্ত ও অব্যক্ত সব কথা বুঝতে পারতেন। এইজন্য বিপদে পড়ে কোনো লোক বাবার শরণাপন্ন হয়ে প্রার্থনা করলে, সে প্রার্থনার ধ্বনি তিনি শুনতে পেতেন ও ভক্তকে কৃপা করতেন এবং এখনও করেন। এই বিশ্লেষণ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, দূরশ্রবণ ও দর্শনসিদ্ধি কোনো সামান্য সিদ্ধি নয়। এটি একটি বিরল সিদ্ধি, যার ফল আজও তার অগণিত ভক্ত পেয়ে চলেছেন।

লোকনাথ বাবার এই বিরল সিদ্ধির অর্থ আমি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম আমার তপস্যা স্বরূপ নর্মদা পরিক্রমার সময়। নর্মদার উত্তর তটে শূলপানিঝাড়ির অদূরে এমন স্থান আছে যেখানে পরমেশ্বর শিবকে আকাশরূপে কল্পনা করে ওঁ আকাশমূর্তয়ে নমঃ মন্ত্রে ধ্যান করতে হয়। সেখানে হংসমন্ত্রে যোগীগণ আত্মশুদ্ধির জন্য তপস্যা করেন এবং হংসঋক্ মন্ত্রে পরমেশ্বরের কৃপা লাভ করেন। আত্মশুদ্ধির জন্য হংসমন্ত্র চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে।

লোকনাথবাবার এই বিরল সিদ্ধির যদি আমরা সঠিক অনুধাবন করতে পারি তবে দেখবো যে, আমাদের মনের অভ্যন্তরে কোনো বাক্য অব্যক্ত থেকেও যদি সেটা মনের মধ্যে অনুরণিত হয়, সেটাও তার দৃষ্টির বা শরণের অগোচরে থাকে না। আমাদের মধ্যে অব্যক্ত ভাব সৃষ্টি হলেও তার মধ্যে করুণার উদয় হয় এবং তাঁর বিগলিত করুণার ধারায় তিনি ভক্তকে নিত্য স্নাত করান। বারদীর আদালতে এই লীলার প্রকাশ থেকে কি আমরা বাবার এই সিদ্ধির সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছি? বা এই লীলার মাধ্যমে তিনি যে বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, সেটা কি আমরা সঠিক অনুধাবন করতে পেরেছি?

এই প্রসঙ্গে বারদী আশ্রমের আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। একদিন ঢাকার একজন পুলিশ ইনসপেক্টর কালীকান্ত নন্দী এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজের সুপারিটেডেন্ট অনাথবন্ধু মল্লিক মহাশয় বাবাকে দর্শনের জন্য বারদী আশ্রমে আসেন। তারা ঢাকায় ব্রহ্মচারী বাবা সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলেন। তাদের মনে ইচ্ছা হল একবার স্বচক্ষে দর্শন করে যাচাই করতে যে ব্রহ্মচারী বাবা কত বড়ো অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষ। যেদিন তারা বারদী আশ্রমে এলেন, তখন আশ্রম ভক্তসমাগমে পরিপূর্ণ। অনেক লোক তাদের রোগ সারাবার জন্য ব্রহ্মচারী বাবার শরণাপন্ন হয়েছেন। এই দুই ব্যক্তিও বাবাকে দূরে বসে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। তারপর যখন প্রসাদ বিতরণের সময় হলো, এই দুইজন আশ্রমের উঠানে একসঙ্গে প্রসাদ নিতে বসলেন। প্রসাদ খেতে খেতে একজন আর একজনকে বললেন, ব্রহ্মচারী বাবার যে অলৌকিক ক্ষমতা আছে, তা বোঝার জন্য একটা পরীক্ষা করে দেখলে হয়।

তারা শহরের শিক্ষিত ব্যক্তি। গ্রামের লোকেদের কথায় কাউকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী মহাপুরুষ বলে কি করে মেনে নেওয়া যায়। তাদের একজন অন্যজনকে বললেন-দেখ, এখন কঁঠালের সময় নয়। এই অকালে বাবা যদি আমাদের পাকা কাঁঠাল খাওয়াতে পারেন, তবে বুঝবো প্রকৃতই তাঁর অলৌকিক শক্তি আছে। তাদের এই কথা নিজেদের মধ্যেই হচ্ছিল, অন্য কেউ এই কথা শুনতে পায়নি বা তারাও বাবার কাছে গিয়ে এই ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। কিন্তু বাবা ঘরের ভিতর নিজ আসনে বসে আশ্রমের চারিদিকের সব কিছু দেখতে পেতেন এবং সবার ব্যক্ত ও অব্যক্ত কথাও শুনতে পেতেন। এই দুই শহুরে ব্যক্তি তাঁদের গোপন ইচ্ছা মনে নিয়ে বসেছিলেন। এই কথোপকথনের প্রায় দুই ঘন্টা বাদে দেখা গেল এক ব্যক্তি একটা বড় পাকা কাঁঠাল মাথায় নিয়ে আশ্রমে এসে বাবার ঘরের সামনে রাখলো। ওই ব্যক্তি কাঁঠালটি রেখে কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে বাবাকে প্রণাম করে চলে গেল। লোকটি চলে যাবার পর বাবা একজনকে ডেকে বললেন, এই কাঁঠালটা এখনই ভেঙ্গে ওই দুজন ভদ্রলোককে খেতে দাও। এরা যথেষ্ট খাবার পর যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবে আশ্রমের সকলকে বেঁটে দিও। আশ্রম সেবক কাঁঠালটি ভেঙ্গে ঢাকার দুই ভদ্রলোককে খেতে দিলো। সামনে পাকা কাঁঠাল দেখে ওই দুই শহুরে ভদ্রলোকের অবস্থা তখন খুবই করুণ। তারা ভাবতে লাগলেন, যে-কথা তাদের নিজেদের মধ্যে গোপনে হয়েছিল, বাবা কি করে সে কথা শুনতে পেলেন এবং এই অকালে এমন পাকা রসালো কাঁঠাল কোথা থেকে তিনি নিয়ে এলেন! বিস্ময়ে তাদের মুখে কথা ফোটে না। এতক্ষণে তারা বুঝতে পারলেন যে তাদের সামনের এই ব্যক্তি কেবল অসামান্য অলৌকিক শক্তির অধিকারীই নন, তিনি একজন অদ্বিতীয় মহাপুরুষও বটে। শ্রদ্ধায় ও সন্ত্ৰমে তাঁদের মাথা বাবার সামনে নত হল এবং তারা তখন বাবার কাছে কৃপা ভিক্ষা করলেন। বারদীতে বাবাকে নিত্য এই পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়েছে এবং হয়তো আজও ভক্তদের কাছে তার স্বরূপ চেনাবার জন্য এই পরীক্ষা দিয়ে যেতে হচ্ছে! কবে তার ভক্তরা বুঝবেন, তিনি আছেন কেবল ভক্তদের কৃপা করার জন্য।

.

ঈশিতাসিদ্ধি দ্বারা লোকশিক্ষা

যে সিদ্ধির দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য ও মায়ার তত্ত্ব জানা যায়, তাকে ঈশিতাসিদ্ধি বলে। এটি অষ্টাঙ্গ যোগের একটি মুখ্য সিদ্ধি। এই সিদ্ধিবলে যোগী ঈশ্বরের সৃষ্টিরহস্য জানতে পারেন এবং যে মায়ার বলে ঈশ্বর সেই সৃষ্টিরহস্য মানবের অগোচরে রাখেন, তার তত্ত্ব জানতে সক্ষম হন। লোকনাথবাবা বারদীতে তার কিছু লীলার মাধ্যমে এই অমূল্য ও দুর্লভ তত্ত্ব মানুষের কাছে কিঞ্চিৎ উন্মোচন করেন। তিনি জনসমক্ষে এই তত্ত্বের ততটুকুই উন্মোচন করেন, যতটুকু জানলে বা অনুধাবন করলে মানুষ মুক্তির পথ খুঁজে পায়।

শ্রীগীতার দশম অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, সর্বভূতের যাহা বীজস্বরূপ তাহাই আমি। আমি সর্বভূতের আদি, অন্ত ও মধ্য। আবার নবম অধ্যায়ে তিনি বলেছেন, আমি অব্যক্ত মূর্তিতে জগৎব্যাপিয়া আছি, আমি প্রকৃতি দ্বারাই জগৎ সৃষ্টি করি, আমি সর্বভূত মহেশ্বর, আমিই জীবের গতি, ভর্তা, প্রভু ও শরণ সুহৃৎ। কিন্তু অবিবেকী ব্যক্তিগণ আমার পরম ভাবনা না জানিতে পারিয়া আমাকে প্রাকৃত মনুষ্যবৎ মনে করেন। আমি সর্বতোমুখ, সর্বাত্মা, সর্বম্বরূপ। লোকনাথ বাবাও বলতেন, আমাকে আশ্রয় করে যারা থাকে, তাদের মধ্যেই যে আমি আছি, সেটা তারা ধারণা করতে পারে না। আমার দেহাতিরিক্ত আত্মাকে তারা পরমাত্মা বলে গ্রহণ করতে পারে না। তাই আমি তাদের মধ্যে থাকলেও তারা আমায় চিনতে পারে না।

ঈশিতাসিদ্ধি যোগীর মধ্যে আত্মদর্শন ঘটায় এবং ব্রহ্মজ্ঞানী সিদ্ধপুরুষ এই সিদ্ধির বলে নিজের পঞ্চভূত দেহের মধ্যে পরমাত্মাকে চিনতে পারেন এবং এই জ্ঞান প্রাপ্ত হন যে, তিনি পরমাত্মারূপে সর্বভূতে বিরাজ করছেন। এই আত্মোপলব্ধি যোগীর তখনই হয়, যখন যোগীর দেহ এক দেবদেহে রূপান্তরিত হয়। মহাযোগী বাবা লোকনাথ তাঁর জীবদেহকে সিদ্ধির দ্বারা দেবদেহে রূপান্তরিত করেছিলেন। কিন্তু যে সমস্ত ভক্তগণ তার সমক্ষে যেতেন, তারা তাকে একজন যোগবিভূতি সম্পন্ন মহাপুরুষ বলে ভাবতেন। তারা আন্তরিকভাবে ভাবতে পারতেন না যে, লোকনাথ বাবার আত্মা অমর, তিনি সকলের মধ্যে বিরাজ করছেন এবং পঞ্চভূতে দেহ বিলীন হয়ে গেলেও তিনি চিরকাল এই চরাচরে ব্যাপ্ত থাকবেন। তিনি পূর্ণব্রহ্ম। তিনি অনেক ভক্তকেই বলেছেন, আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো। লোকনাথবাবা যেহেতু ঈশিতাসিদ্ধি শক্তির দ্বারা ভক্তদের জন্ম-জন্মান্তরের রহস্য জানতে পারতেন, তিনি কোনো কোনো ভক্তকে তাদের পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত ও পার্থিব ভোগের কথা বলে দিতেন। তাতে ভক্তবৃন্দ কেবল এটুকু বুঝতেন যে, বাবা একজন মহাপুরুষ এবং সেজন্য ওনাদের পূর্বজন্মের কথা বলে দিচ্ছেন। বাবার বলার উদ্দেশ্য কিন্তু ভক্তদের মনে শুধুমাত্র এই ধারণা উৎপত্তির কারণই ছিল না। কথাপ্রসঙ্গে একদিন তিনি এক ভক্তকে বলেছিলেন, ইচ্ছে করেই আমি আমার অনুভূতির কথা সবাইকে শুনিয়ে দিই। আমি তো সব কিছুর মধ্যেই নিজের অস্তিত্ব দেখতে পাই। নিজের মধ্যেই বিশ্বের সবকিছু দেখতে পাই। জগৎ সংসারে যা সব কিছু যেখানে আছে, সবই আমার মধ্যে আছে। আমিই সব কিছুর মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে এক অসীম অব্যক্তরূপে বিরাজ করছি। সে এক অদ্ভুত অবর্ণনীয় ভাব। সে ভাব প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। সেই ভাবের কথা ভাবলেই আমার আত্মা দেহ থেকে আলগা হয়ে যায়। তাই আমি সময়ে চুপ করে থাকি। আমি সব সময়ে তোদের সঙ্গে থাকি, কথা বলি, তাই লোকে ভাবে আমি তাদেরই মতো একজন। তোরা আমায় চিনতে পারলি না রে!

বাবার এই ভাব প্রকাশের মাধ্যমে বাবা এটাই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে, তাদের সামনে স্বয়ং দেবতা বসে থাকলেও, ভক্তবৃন্দ তাকে একজন মনুষ্যদেহী যোগীরূপেই ভেবেছে। জন্ম-মৃত্যু রহস্যজ্ঞানী পুরুষ সমর্থ ছিলেন মানুষের জন্ম-জন্মান্তরের সঞ্চিত ভোগ থেকে মুক্তির উপায় বলে দেবার। তিনি মানুষকে মুক্তি দিতে প্রস্তুতও ছিলেন। কিন্তু মানুষ সেই দেবদেহের কাছে কেবল সংসারের দেহ ও মনোরোগের চিকিৎসার জন্য উপস্থিত হয়েছে। তাইতো তিনি প্রয়াণের পূর্বে একজনকে বলেছিলেন–অনেক সংসাররোগীর সন্ধান পেলাম, কিন্তু ভবরোগী পেলাম না। ঈশিতাসিদ্ধিপ্রাপ্ত ব্রহ্মজ্ঞ সিদ্ধ ব্রহ্মচারী যাহা বলেন, তা স্বয়ং পরমেশ্বরও খণ্ডন করতে পারেন না। জগৎসংসারে প্রারব্ধকৰ্মভোগে যারা ভুগছেন এবং অনন্ত কষ্ট ভোগ করছেন, তাদের প্রারব্ধ ক্ষয়ের উপায় তিনিই বলে দিতে পারতেন এবং ভক্তের কষ্টের লাঘব করতে পারতেন।

সর্বজ্ঞ বাবা লোকনাথ বলতেন, মানুষ ভালো-মন্দ যা কিছু করে, তা সব আমার করানো। মানুষ তার আমিত্বের বশে মনে করে, সে করছে। আমি যাকে যেমন করাই, সে তেমন করে। সে জানে না যে তার নিজের ইচ্ছায় কিছু হয় না। সবার অন্তরে বসে আমি নিত্য এই খেলা খেলে চলেছি। আমিই তাদের দিয়ে সব কিছু করাই, আমিই সেই কাজের ফল চাওয়াই, আমিই তাদের ফল দিই। যে ফল পায় সে আনন্দ করে। তার সেই আনন্দ আমি ভোগ করি। আর যে পায় না, সে বেদনা অনুভব করে। তার সেই বেদনাও আমিই ভোগ করি। যে যেমনভাবে আমার ভজনা করে, আমিও তাদের তেমনভাবে তৃপ্ত করার চেষ্টা করি।

ঈশিতাসিদ্ধির অধিকারী বাবার সামনে কেউ উপস্থিত হলেই, কেবলমাত্র দর্শনে বাবার কাছে তার জন্ম-মৃত্যু বৃত্তান্ত উন্মোচিত হতো।

এক ব্রাহ্মণ বহু গণৎকারকে কোষ্ঠী বিচার করিয়ে জানতে পারেন, তার ৬২ বছর বয়সে মৃত্যু হবে। তিনি ঠিক করেন, ৬২ বছর বয়স হলেই তিনি কোনো তীর্থে গিয়ে বাস করবেন যাতে তিনি তীর্থস্থানে মরতে পারেন। পরে ব্রহ্মচারী বাবার কথা শুনে তিনি বারদী আশ্রমে বাবাকে দর্শন করতে আসেন। তিনি বাবার সামনে গিয়ে বসলে বাবা জিজ্ঞাসা করেন–কেন এসেছো? ব্রাহ্মণ বলেন–গণকেরা বলেছে ৬২ বছর বয়সে আমার মৃত্যু হবে। কিন্তু গণকের কথায় আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস হচ্ছে না। নিশ্চিত মৃত্যু ৬২ বছর বয়সে হবে কি না তাই জানতে আপনার কাছে এসেছি।

ব্রহ্মচারী বাবা সেই ব্রাহ্মণের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে কুষ্ঠরোগে ধরেছে। বাড়ি ফিরে যাও। সম্প্রতি কোথাও যেতে হবে না। দশ-পনেরো বৎসর পরে পারলে একবার এসে সাক্ষাৎ করে যেও। তুমি ভাল হয়ে যাবে। ব্রহ্মচারী বাবা সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের শরীরের উপর যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন, তাতেই তিনি কুমুক্ত হয়ে যান এবং ৮৩ বছরের কিছু বেশি সময় পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন বলে জানা গেছে। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, তিনি তাঁর ঈশিতাসিদ্ধিবলে যে কেবল ব্রাহ্মণকে মৃত্যুভয় থেকে মুক্ত করেছিলেন তাই নয়, তার চোখ থেকে যে আলোর বিকীরণ ব্রাহ্মণের শরীরে প্রবেশ করেছিল, তাতে তার কুষ্ঠরোগ মুক্তিও ঘটে। এইভাবেই বাবার অযাচিত করুণা তাঁর ভক্তগণ পেয়ে এসেছেন।

.

যথাসংকল্প সিদ্ধি দ্বারা ভক্তদের কৃপা

যথাসংকল্প সিদ্ধি অষ্টাদশ সিদ্ধির অন্তর্গত একটি সিদ্ধি। যে সিদ্ধির বলে সিদ্ধযোগী কিছু সংকল্প করা মাত্রই তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় তাকে যথাসংকল্প সিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধির বলে যোগী ভক্তদের কোনো কৃপা করার কথা মনে মনে সংকল্প করা মাত্রই ভক্তগণ সেই কৃপা লাভ করে। মহাযোগী বাবা লোকনাথ ভক্তদের কিভাবে এই সিদ্ধিবলে কৃপা করতেন, সেই সম্বন্ধে কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হলো।

শ্রীব্রজেন্দ্রকুমার বসু বাবার একজন ভক্ত ছিলেন। তিনি উকিল। একসময় তিনি পেটে শূলরোগে আক্রান্ত হন। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও রোগের তত কোনো উপশম হলোই না, বরং পেটের ব্যথা আরও বেড়ে গেল। যখন তিনি রোগে খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন এবং কোনোভাবেই এই রোগ থেকে নিস্তার পাচ্ছিলেন না, সেইসময় বাবার অন্য এক ভক্ত তাকে বারদীতে গিয়ে লোকনাথ বাবাকে সব জানাতে বলেন। ব্রজেন্দ্রবাবু তখন মনে মনে বাবার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে রোগ নিরাময়ের আশায় আশ্রমে উপস্থিত হন। বাবা লোকনাথ তখন ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে উপদেশ প্রদান করছিলেন। ব্রজেন্দ্রবাবুও তাদের মাঝে গিয়ে বসলেন। এমন সময় তার প্রচণ্ড শূল বেদনা শুরু হলো। তিনি তখন বাবার দিব্যদেহ স্মরণ করে মনে করতে লাগলেন যে, একবার যদি বাবা তার পা আমার ব্যথার জায়গায় স্পর্শ করান, তাহলে আমার ব্যথার এখনই উপশম হতে পারে। কিন্তু কি করে তা সম্ভব! তিনি মনে মনে কাতরভাবে বাবার কাছে নির্বাক হয়ে সেই আকুতি করতে লাগলেন। আশ্চর্যভাবে সেই সময় বাবা বললেন, আমার পায়ে ঝি ঝি ধরেছে। তোদের কেউ এসে আমার পা-টা একটু টিপে দে তো। এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ব্রজেন্দ্রবাবু তাড়াতাড়ি সবাইকে ডিঙ্গিয়ে বাবার সামনে বসে তার পা-খানি ভক্তিভরে নিয়ে নিজের পেটের ব্যথার জায়গায় স্পর্শ করালেন। তারপর দু-হাতে তার পা টিপে দিতে লাগলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, মহাপুরুষের দিব্যদেহের স্পর্শে এবং তার করুণায় ব্রজেন্দ্রবাবুর শূলব্যথা কমে গেল এবং তা চিরতরে তার শরীর হতে বিদায় নিলো।

বাবা লোকনাথ ছিলেন অন্তর্যামী। তিনি ব্রজেন্দ্রবাবুর কাতর প্রার্থনা দূরশ্রবণ সিদ্ধিবলে শুনতে পেয়েছিলেন এবং তখন মনে মনে সংকল্প করেছিলেন তাঁকে কৃপা করার। তাই তিনি পা টেপানোর ছলে তাকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন তার পা-টি ব্রজেন্দ্রবাবুর ব্যথাস্থলে স্পর্শ করাবার জন্য। বাবার যথাসংকল্প সিদ্ধির বলে ব্রজেন্দ্রবাবু শূলরোগ থেকে চিরতরে অব্যাহতি পেলেন।

এরপর ব্রজেন্দ্রবাবু সবার কাছে তার রোগ নিরাময়কল্পে আশ্রমে আগমনের কথা ও তার অস্ফুট প্রার্থনার কথা বলেন। ভক্তগণ পরম বিস্ময়ে উপলব্ধি করল যে, বাবাকে মুখে কিছু না বললেও, ভক্তের মনের আকুতি ও প্রার্থনা শুনে বাবা কিভাবে এইরকম একটা রোগ থেকে একস্পর্শে ব্রজেন্দ্রবাবুকে মুক্ত করে দিলেন।

ব্রজেন্দ্রবাবু তখন ভেবেছিলেন, বাবার অহৈতুকী কৃপায় তার ব্যথা সেরে গেল। তিনি কি এটা ভাবতে পেরেছিলেন যে, বাবা তাকে ব্রহ্মপদ লাভের সুযোগটাও করে দিয়েছিলেন!

এই সম্পর্কে একদিন বাবার এক ভক্ত তাঁকে বললেন, বাবা, শুনেছি ঐশী শক্তি বলে যদি কোনো রোগীর রোগ সারিয়ে দেন, তবে সেই রোগ তাকে গ্রহণ করতে হয়। আপনি তো কত রোগীর রোগ সারিয়ে দেন, আপনি সেই রোগগুলি গ্রহণ করেন না তো?

করুণাময় বাবা লোকনাথ বলেন, কোনো রোগীর উপর আমার মনে দয়া হলেই আমার ঐশী শক্তিতে তার রোগ সেরে যায়। কোনো রোগী আমার শরণাপন্ন হলে আমি সুস্থির থাকতে পারি না। আমার থেকে দয়ার ধারা বয়ে গিয়ে রোগীকে সুস্থ করে দেয়। কোনো ভক্তের জন্য আমার হৃদয় বিগলিত হলেই সেই ভক্তের উপর আমার কৃপা বর্ষিত হয়।

ভক্তটি তখন জিজ্ঞাসা করে, বাবা, কি করলে আপনার দয়া পাওয়া যায়?

বাবা লোকনাথ বলেন, আমায় তুষ্ট করলেই আমার দয়া পাওয়া যায়।

 ভক্তটি তখন জিজ্ঞাসা করে, আপনি কিসে তুষ্ট হন বাবা?

তখন বাবা লোকনাথ বলেন, তাতে আমি জানি না। তবে কোনো ভক্ত আমাকে নিজের মনে কোরে, আপন কোরে ডাকলেই তার জন্য আমার প্রাণ কেঁদে ওঠে, আমার হৃদয় বিগলিত হয় এবং আমার করুণার ধারা তার উপর বর্ষিত হয়।

অনেক সময় বাবার এই অযাচিত করুণার অমর্যাদাও ভক্তরা করেছে। এইবার সেইরকম একটি ঘটনার উল্লেখ করবো।

একদিন বারদীর আশ্রমে কয়েকজন লোক নানাপ্রকার পূজাসামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হলো। জানকীনাথ ব্রহ্মচারী তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কীসের পূজা দিতে এসেছো? লোকগুলি বললো, আমরা মানসিক শোধ করতে এসেছি। এই মানসিক শোধ না হলে আমাদের রোগী সুস্থ হবে না। জানকীনাথ তখন জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কার মানসিক শোধ করতে এসেছো? তখন সেই লোকগুলির মধ্যে একজন বললো, বছরখানেক আগে আমাদের এক আত্মীয়কে সাপে কামড়ায়। সাপের তীব্র বিষ তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং সে মৃতবৎ হয়ে যায়। আমরা প্রথমে বৈদ্য ডাকি, কিন্তু সে কিছু করতে পারলো না। তখন আমরা ওঝা ডাকি, সে শতচেষ্টা করেও দেহ থেকে বিষ নামাতে পারলো না। অবশেষে আমাদের গাঁয়ের কিছু লোকের পরামর্শে আমরা বাবা লোকনাথের নামে মানত করলাম। সাপে কামড়ানো লোকটির মা-বাবা লোকনাথকে স্মরণ করে বললেন, হে ব্রহ্মচারী বাবা, আপনি আমাদের ছেলেকে বিষমুক্ত করে দিন। আমরা আপনার নামে পূজা মানত করছি। এই মানত করার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর শরীর থেকে বিষ নামতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো। যখন ছেলে সুস্থ হয়ে উঠলো, তখন বাড়ির কেউ কেউ বলতে লাগলো, ওঝা ও বৈদ্যের চিকিৎসাতেই ছেলে সুস্থ হয়ে উঠেছে। ব্রহ্মচারী বাবার কৃপায় কিছু হয়নি। সবাই মিলে ছেলের মাকে বোঝালেন যে, ওঝা-বৈদ্যের চিকিৎসায় যখন ছেলে ভালো হয়ে উঠেছে, তখন আবার ব্রহ্মচারী বাবার নামে পূজা দিতে যাবার দরকার কি? পাঁচজনের কথায় ছেলের মা বশীভূত হয়ে নিজের সত্যরক্ষা করলেন না। পূজা দেবার সময় চলে গেল, কেউ আর সেই আশ্রমের নামে মানসিকের কথা মনে রাখলোনা, সকলেই মন থেকে সেটা মুছে ফেললো।

এই ঘটনার ঠিক এক বছর পর এখন সেই সপর্দষ্ট লোকটি দংশনের জায়গায় বেদনা অনুভব করছে। মনে হচ্ছে যেন সেই সাপের বিষ আবার তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ছে। ছেলে বাড়িতে শুয়ে ছটফট করছে। কেউ তার যন্ত্রণার উপশম করতে পারছে না। এখন বাড়ির লোকেদের চোখ খুলেছে। তারা বুঝেছে যে ব্রহ্মচারী বাবা যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ। তিনি সাক্ষাৎ দেবতা। তার উদ্দেশ্যে করা মানত পূজা না দিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রবঞ্চনা করা হয়েছে। সেইজন্য একবছর বাদে এখন কোনো সাপ না কামড়ালেও, সেই পুরোনো বিষের জ্বালা শুরু হয়েছে। আমরা তাই বাবার শরণাপন্ন হয়েছি তার কাছে নিজেদের দোষ স্বীকার করে মানত পূজা দেবো বলে।

জানকি ব্রহ্মচারী তাদের বাবার কাছে নিয়ে গেলেন। সেই লোকেরা সবাই বাবার চরণ স্পর্শ করে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। বাবাকে কিছু বলার আগেই বাবা সব বুঝতে পারলেন। লোকগুলি অনুতপ্ত হয়ে দোষ স্বীকার করায়, বাবা পূজা গ্রহণ করলেন। তার হৃদয় করুণায় বিগলিত হলো। পূজা শেষ হলে বাবা তাদের আশীর্বাদ করলেন। লোকগুলি বাবার কাছে আর কোনো কথা বলল না, বাবাও তাদেরকে আর কোনো কথা বললেন না। তারা বাড়ি ফিরে দেখলেন ব্রহ্মচারী বাবার কৃপায় সেই ছেলেটির বিষক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। রোগীর দেহে আর কোনো বিষক্রিয়ার লক্ষণ নেই। সে সম্পূর্ণ সুস্থ।

একবছর আগে সর্পদংশন এবং বৈদ্য-ওঝার ব্যর্থতার পর প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী ওই ছেলেটির আকুল মা বাবা লোকনাথকে স্মরণ করে ছেলের প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন, বাবা তার দূরশ্রবণ সিদ্ধির বলে সেই প্রার্থনা শুনতে পেয়েছিলেন। তাঁর অন্তদৃষ্টিজনিত আশীর্বাদেই সাপের বিষ তার শরীর থেকে অন্তর্হিত হয় এবং সে সুস্থ হয়ে ওঠে।

এই ঘটনা থেকে সব সাধুসমাজ ও সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিগণ এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন যে, দোষী যদি তার দোষ স্বীকার করে, তবে তাকে ক্ষমা করে আপন করে নেওয়া উচিত।

একসময় চাঁদপুরের কয়েকজন ভক্ত উকিল বারদী আসেন বাবাকে দর্শন ও কয়েকদিন তাঁর সান্নিধ্যে কাটাবার জন্যে। কয়েকদিন আশ্রমে থেকে তারা যাবার অনুমতি চাইতে বাবার কাছে যান। বাবা তাদের বলেন, আজ তোদের না গেলে হয় না? তারা বললেন, আগামীকাল কাছারী খুলবে, না গেলে ক্ষতি হবে। তখন ব্রহ্মচারী বাবা একজনের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন–যদি তোদের যাওয়াই প্রয়োজন হয়, তবে ওকে রেখে যা। মহাপুরুষের কথা উপেক্ষা করা উচিত নয় মনে করে তাঁরা সেই ব্যক্তিকে রেখে চলে গেলেন। সঙ্গীরা চলে যাবার পর সেই লোকটি অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন এবং পরে সেইদিনই তার কলেরা দেখা দিলো। বাবা তাকে সুস্থ করে দেবার সংকল্প করলেন এবং তার মহিমায় ও সিদ্ধিবলে সেই উকিল মহাশয় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেলো। তখনকারদিনে কলেরা হলেই মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল একশোভাগ। তখন উকিলবাবু বুঝলেন, কেন বাবা তাকে থাকতে বলেছিলেন।

পণ্ডিত শ্রীহরি বিদ্যালঙ্কার মহাশয় সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি বাবার কাছে আসতেন কিন্তু পণ্ডিত বলে তার মধ্যে এক দম্ভ সবসময় বিরাজ করতো। তিনি কখনও আশ্রমের প্রসাদ গ্রহণ করতেন না। একদিন ব্রহ্মচারী বাবা পণ্ডিত বিদ্যালঙ্কার মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করেন–তোমার কোনো দ্রব্যে পিপাসা আছে? পণ্ডিত মহাশয় উত্তর দেন–পাতক্ষীর খাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। ঢাকার পাতক্ষীর বিখ্যাত। আশ্রমে পাতক্ষীর পাওয়া যাবে না মনে করেই পণ্ডিত মহাশয় তা খেতে চেয়েছেন। ব্রহ্মচারী বাবা মনে মনে পাতক্ষীরের সংকল্প করায় সেদিন বিকেলেই এক ভক্ত সের চারেক পাতক্ষীর নিয়ে আশ্রমে হাজির হয়। ব্রহ্মচারী বাবা তার থেকে দেড়সের মতো পাতক্ষীর নিজের হাতে পণ্ডিত মহাশয়কে খাইয়েছিলেন। পণ্ডিত মহাশয় বাবার এই অচিন্ত্যনীয় মহিমায় তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন এবং বাবার সামনে তার দম্ভ ত্যাগ করেছিলেন। যিনি অন্তরে সংকল্প করলে স্বয়ং দেবতার রূপ পরিগ্রহ করতে পারেন, তার কাছে পাতক্ষীর জোগার করা কী এমন কঠিন কাজ! আসলে বাবার সেই প্রকৃত রূপকে তিনি চিনতে পারেননি।

ঢাকা পশ্চিমদীর রাধিকামোহন রায় শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য ছিলেন। বাত ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে তার অর্ধাঙ্গ অবশ হয়ে গিয়েছিল। প্রভুপাদ গোস্বামী মহাশয় তাকে একটি নৌকা ভাড়া করে সপরিবারে বারদী আশ্রমে গিয়ে ব্রহ্মচারী বাবার দর্শন করতে বলেন। রাধিকামোহন রায় মহাশয় তার কথানুসারে একটি নৌকা ভাড়া করে সপরিবারে এসে বারদীর ঘাটে নৌকা বাঁধেন। প্রতিদিন সেখান থেকে তিনি বারদী আশ্রমে গিয়ে আশ্রমের মাটি সারা গায়ে মেখে ব্রহ্মচারী বাবার সামনে বসে থাকতেন। ওনার সঙ্গে কথা বলার সময়েও উনি আশ্রমঘরের মাটিতে হাত দিয়ে গায়ে ঘষতেন। কিন্তু রোগ নিরাময় করার জন্য বাবাকে কিছু বলতেন না। এইভাবে একমাসকাল চলার পরে তিনি প্রায় ভালো হয়ে যান। কেবল একটা হাত তিনি ওঠাতে পারতেন না। একদিন রাধিকাবাবুর স্ত্রী বাবার সামনে বসে আছেন আর রাধিকাবাবু নৌকাতে আছেন। রাধিকাবাবুর স্ত্রীর ম্লান মুখ দেখে বাবা জিজ্ঞাসা করলেন–এমন করে বসে আছো কেন? স্ত্রী বললেন, তার স্বামীর অসুখ প্রায় সেরে গেছে। কিন্তু হাতখানা এখনও অবশ হয়ে আছে। তখন বাবা নিজের হাতটি তিনবার উঠিয়ে বললেন-যাও, হাত উঠেছে। এই কথা শুনে রাধিকাবাবুর স্ত্রী বাবাকে প্রণাম করে তাড়াতাড়ি নৌকায় ফিরে দেখেন, রাধিকাবাবু তার হাত তুলতে পারছেন–নিজের হাত তুলে ব্রহ্মচারী বাবা যেইমাত্র সংকল্প করলেন, রাধিকাবাবুর হাত সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল। এ ছিল বাবার যথাসংকল্প সিদ্ধি প্রয়োগের এক অনন্ত উদাহরণ।

বাবা লোকনাথ যথাসংকল্প সিদ্ধি প্রয়োগ করে আর একজনকে এমন অদ্ভুতভাবে রোগমুক্ত করে দিয়েছিলেন। চিকন্দীর অধিবাসী শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী পিঠের ব্যথায় খুব কষ্ট পেতেন। তিনি আশ্রমে গিয়ে বাবাকে সেবা করে কষ্টমুক্ত হতে চেয়েছিলেন। একদিন গোয়ালিনী মায়ের কাছ থেকে বাবার জন্য খাবার এনে নিজের হাতে তাঁকে খাওয়াতে গেলেন। তিনি যখনই বাবাকে খাওয়াতে যান, বাবা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। এর আগে একবার তিনি বাবাকে নিজের হাতে খাইয়েছিলেন। সে কারণে তিনি বুঝতে পারলেননা, বাবা কেন আজ মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তিনি আবার খাবার গ্রাস নিয়ে বাবার মুখে দিতে গেলেন। বাবা আরও ঘুরে মুখ সরিয়ে নিলেন। শরৎচন্দ্রবাবু না বুঝে আবার যেই বাবার মুখে গ্রাস দিতে গেছেন, বাবা তার খড়ম নিয়ে তার পিঠে তিনবার সজোরে আঘাত করলেন। শরৎচন্দ্রবাবু তখন কেঁদে সেখান থেকে উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ কান্নার পর বাবা তাকে আবার ডাকলেন ও তাঁর হাতে খৈ-দুধ খেলেন।

শরৎচন্দ্রবাবু বুঝতে পারলেন না বাবা প্রথমে কেন তার হাতে খাবার খেলেন না, তাকে খড়ম পেটা করলেন, আবার ডেকে তার হাতেই খৈ-দুধ খেলেন। পরেরদিন তিনি আবিষ্কার করেন যে তার পিঠের ব্যথা সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে গেছে। বাবা তার প্রিয় ভক্তকে রোগমুক্ত করার সংকল্প করেই পিঠে খড়মের আঘাত করেছিলেন। এই কথা বুঝতে পেরে শরৎচন্দ্রবাবু তার পায়ে লুটিয়ে পড়েন।

.

অপ্রতিহতা আজ্ঞাসিদ্ধির দ্বারা প্রকৃতিকে বশ

অষ্টাঙ্গ যোগ সিদ্ধির দশটি গৌণসিদ্ধির মধ্যে একটি অন্যতম সিদ্ধি হল অপ্রতিহতা আজ্ঞা। যে সিদ্ধির দ্বারা যোগীর কোনো আজ্ঞা কারও, এমন কি প্রকৃতিরও লঙ্ঘন করার ক্ষমতা থাকে না, তাকে অপ্রতিহতা আজ্ঞাসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধির অধিকারী যিনি হন, দেব-দেবীকেও তার কথা মানতে হয়। বারদীতে বিভিন্ন লীলার মাধ্যমে বাবার এই অনন্য সিদ্ধি প্রকটিত হয়েছিল। এখানে তার কিছু ঘটনার উল্লেখ করছি।

একবার ঢাকার একটি কলেজের কিছু ছাত্র বাবা ব্রহ্মচারীর কথা শুনে তার মাহাত্ম্য দেখার জন্য বারদীর আশ্রমের পথে রওনা হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো বারদীর সাধুবাবা কত বড় মহাপুরুষ। তা স্বচক্ষে দেখতে হবে এবং সততা যাচাই করতে হবে।

তারা ঠিক করলো যে নারায়ণগঞ্জ হয়ে প্রথমে বারদী যাবে। তারপর তারা দয়াগঞ্জ যাবে। কিন্তু এক ছাত্র বললো যে, আশ্রমে তো নিরামিষ খাবার, বরং বাইরের হোটেলে কিছু খেয়ে নিয়ে বারদীর আশ্রমে গেলেই হবে। কিন্তু অন্য ছাত্ররা বেঁকে বসে। এই ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন রাজেন্দ্রচন্দ্র। যিনি পরবর্তীকালে বিদ্যাভূষণ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। তার অন্যতম পৌত্র বিপ্লব ভট্টাচার্য বর্তমানে সোনারপুর নিবাসী। তার মুখে শোনা ঘটনার কথাই এখানে উল্লেখ করছি।

এই ছাত্রের দল যখন বারদী আশ্রমে আসে, তার কিছুক্ষণ পর একটি লোক একটি বড় রুই মাছ নিয়ে আশ্রমে উপস্থিত হয়। ছেলেরা বাবার সামনে উপস্থিত হয়ে প্রণাম জানিয়ে নানারকম প্রশ্ন করতে থাকে। তাদের কারও কারও উদ্দেশ্য ছিল বাবাকে বিব্রত করা। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ছেলেরা বলে যে তাদের এক্ষুনি দয়াগঞ্জ হয়ে ঢাকায় তাদের হস্টেলে ফিরতে হবে। কারণ দয়াগঞ্জের হোটেলে তাদের খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। বাবা তাদের বাধা দিয়ে বলেন, এখানেই তোমরা তোমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে যাও। রুইমাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে তবে তোমরা রওনা হও। ছাত্ররা এই কথা শুনে হতবাক হয়ে যায়।

এরপর তারা ওই কাঠফাটা রোদে দীর্ঘ মাঠ পেরিয়ে যেতে হবে ভেবে বাবাকে বলতে যেতেই তিনি বলে ওঠেন, তোমরা রওনা হও। মাথায় রোদ লাগবে না। তখন একখণ্ড মেঘ হঠাৎ কোথা থেকে এসে সূর্যকে আড়াল করে দিলো। ছাত্রদের গায়ে কোনো রোদের তাপ লাগলো না। ছাত্ররা মাঠ পার হতেই সেই মেঘ আবার সূর্যের উপর থেকে সরে গেল এবং মাঠটি রৌদ্রময় হয়ে উঠলো। ছাত্রেরা এই ব্যাপার দেখে বুঝতে পারলো যে, ব্রহ্মচারী বাবা একজন সাধারণ সাধু নন। তিনি একজন মহাপুরুষ। তখন তাদের মন অনুতপ্ত হল বাবার প্রতি অবজ্ঞা ভাব দেখানো এবং এমন একজন মহাপুরুষের কথার সত্যতা যাচাই করার কথা মনে ভাবার জন্য। তারা সকলে আবার আশ্রমে ফিরে এসে বাবাকে বললো, আপনার দয়ায় মাঠ পার হতে আমাদের কোনো কষ্ট হয়নি। কিন্তু আমরা মাঠ পার হতেই আবার প্রচণ্ড রোদের তাপ আমাদের উপর এসে পড়লো। আপনি কৃপা করে আমাদের দয়াগঞ্জ পর্যন্ত ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় যাবার ব্যবস্থা করে দিন। এবার তাদের কথার মধ্যে অবজ্ঞার জায়গায় মিনতির সুর ছিল। অন্তর্যামী বাবা তাদের বললেন, দয়াগঞ্জ পর্যন্ত তোরা কোনো রোদের তাপ পাবি না। সেখান থেকে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে ঢাকায় যাবি। একথা শুনে ছাত্রের দল খুশি হয়ে বাবাকে প্রণাম করে বিদায় নিলো। যতক্ষণ ছাত্রেরা দয়াগঞ্জ না পৌঁছলো, ততক্ষণ একখণ্ড মেঘ সূর্যকে আড়াল করে রইল।

এইভাবে বাবা লোকনাথ তাঁর যোগশক্তিবলে প্রকৃতিকে যে আজ্ঞা করেছেন, প্রকৃতি তা মানতে বাধ্য হয়েছে। এক ব্রহ্মজ্ঞ সিদ্ধযোগীর আজ্ঞা অপ্রতিহত। প্রকৃতিরও সাধ্য নেই সেই আজ্ঞার অবমাননা করার।

এইরকমই একটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছিল ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে।

রাজাসাহেব একদিন পাত্র-মিত্র ও অন্যান্য লোকজন সমেত হাতির পিঠে চড়ে ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করার জন্য বারদী আশ্রমে আসেন। বাবাকে দর্শন করে চরণবন্দনার পর সকলে প্রসাদ পেলেন। তারপর রাজা বাবার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য অনুমতি চাইলেন। তিনি বাবাকে বললেন, বাবা, আজ আমাকে যাবার জন্য অনুমতি দিন। আমার বিশেষ কাজ আছে। আর থাকা চলবে না। বাবা তখন তাঁকে বললেন-না না, এখন যাসনি। যদি একান্তই যেতে হয়, কিছুক্ষণ পরে যাবি। কিন্তু ভাওয়ালের রাজা যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি আর অপেক্ষা না করে বাবাকে প্রণাম করে হাতির পিঠে চড়ে পাত্রমিত্রসহ রওনা হলেন।

আশ্রম থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তারপর শুরু হল প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। রাজা বুঝতে পারলেন যে, এমতাবস্থায় এতগুলি লোক নিয়ে ভাওয়াল যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি তখন আশ্রমে ফিরে এলেন। রাজাকে ফিরে আসতে দেখে অন্তর্যামী বাবা মনে মনে হাসলেন। কিন্তু মুখে কোনো ভাব প্রকাশ না করে বললেন-কিরে, ফিরে এলি কেন? রাজা বিনীতভাবে বললেন, ঝড়বৃষ্টির জন্য ফিরে এলাম। এই ঝড় না থামলে যাবার উপায় নেই। বাবা হেসে বললেন-’বেশ বেশ, ভালই করেছিস। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়বৃষ্টি থেমে গেল। রাজা হাতির পিঠে লোকজন নিয়ে আবার রওনা হলেন। এবারও কিছুদূর যাবার পর আবার ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। রাজা আবার আশ্রমে ফিরে এলেন। বাবা চুপচাপ বসে ছিলেন। রাজাকে কিছু বললেন না। রাজার এবার মনে হলো, যখনই রওনা হচ্ছেন, তখনই ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, আবার ফিরে এলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ তো অদ্ভুত ব্যাপার। এবার তার চৈতন্য হল যে ব্রহ্মচারী বাবা তাকে তখন যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি বাবার কথা অগ্রাহ্য করে রওনা হয়েছিলেন। লোকনাথ বাবা সাক্ষাৎ শিব। তার দেহে সব দেবতা বিরাজ করেন। তিনিই সেই পরমপুরুষ, আবার তিনিই প্রকৃতি। তাঁর ইচ্ছায় প্রকৃতির খেলা চলে। তার নিষেধ অমান্য করে রওনা হবার জন্যই প্রকৃতির রোষে বারবার পড়তে হচ্ছে। রাজা নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তিনি তখন বাবার চরণ ধরে বলেন, বাবা, আমায় ক্ষমা করুন। আপনার নিষেধ অমান্য করে যাবার জন্যই আমাকে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আপনার আদেশ না পেলে আমার কী সাধ্য যে আমি আশ্রম ত্যাগ করতে পারি? আমার খুব অপরাধ হয়েছে। আপনি কৃপা করে এবার আমায় যাবার অনুমতি দিন। বাবার ঐকান্তিক ইচ্ছা ছাড়া যে কেউ বাবার কাছে আসতে পারে না বা তার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারে না–এই কথা রাজা উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে বাবা সন্তুষ্ট হলেন। তিনি এবার বললেন–আচ্ছা যা, আর কোনো চিন্তা নেই। পথে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারবি। রাজা ও পাত্র-মিত্রগণ বাবার চরণে প্রণাম করে বাইরে এসে দেখলেন, আকাশ একেবারে পরিষ্কার। মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। আকাশ দেখে মনেই হবে না যে একটু আগে আকাশ সম্পূর্ণ মেঘাচ্ছন্ন ছিল এবং প্রবল ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। রাজা হাতিতে চড়ে পাত্রমিত্রসহ নির্বিঘ্নে ভাওয়াল গিয়ে পৌঁছলেন। এরপর থেকে ভাওয়ালের রাজা কখনও বাবার আদেশ অমান্য করেননি।

এই লীলার মাধ্যমে লোকনাথ বাবা ভাওয়ালের রাজাকে এই বার্তা স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন যে, তিনি নিজেই প্রকৃতি পুরুষ। বিশ্বচরাচরের সব কিছুই তার দ্বারা সংঘটিত হয়।

কেউ কেউ আবার তার অস্তিত্বের স্বরূপ বুঝতে না পারলেও, তার কথা অন্ধের মতো মেনে চলতেন। কিন্তু সঠিক মূল্যায়ণ করে এই ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিকে খুব অল্প ভক্তই চিনতে পেরেছিলেন।

বারদী আশ্রম ছিল পুরাকালের মুনি-ঋষিদের মতো। আশ্রমের চারিদিকে অনেক ফল-ফুলের গাছ শোভা পেত। বাবার ঘর বরাবর উঠানে একটি বেলগাছ ছিল যেটি ভূমি থেকে চার হাত পরিমাণ এক কাণ্ডে উঠে তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে এবং তার শাখা-প্রশাখাগুলি উপরে চতুর্দিকে গোলাকারে বিস্তৃত হয়েছে। ওই বেলগাছের গোড়া গোলাকারে বাঁধানো আছে। বাবার অনেক ভক্ত এই বেলগাছতলার মাটি মেখে নীরোগ হয়েছে। বাবা নিজে এই বেলগাছতলায় এসে বসতেন। অনেক সময় ঘরে লোক হয়ে গেলে, ভক্তগণ এসে এই বেলগাছতলায় বসতেন।

একদিন শ্রীযুক্ত রাধাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মদনমোহন চক্রবর্তী (বাবার একনিষ্ঠ ভক্ত) বাবার ঘরে জায়গা না পেয়ে এই বেলগাছের তলায় বসেছিলেন। দিনের বেলায় তাদের সঙ্গে আরও অনেক ভক্তও বসে আছেন। এমন সময় হঠাৎ মেঘ কালো করে ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। সকলে একমনে বাবাকে স্মরণ করতে লাগলেন। কিন্তু সেখান থেকে সরলেন না। আশ্রমের সব ঘরেই ভিড় ছিল। ভক্তের ডাক বাবার কানে পৌঁছতেই তার অসীম কৃপায় দেখা গেল বেল গাছের তলায় কোনো বৃষ্টির জলের ফোঁটা পড়ছে না, কিন্তু আশ্রমের অন্য অংশে বৃষ্টি হচ্ছে। যে ভক্তগণ বেলগাছ তলায় ছিলেন, তাদের গায়ে বৃষ্টির জল পড়লো না। তারা সকলে বাবার উদ্দেশ্যে সেখান থেকেই প্রণাম জানালেন। ভক্তের ডাক শুনে বাবা আজ্ঞা করেছিলেন, তাঁর ভক্তদের বৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে। প্রকৃতির কি সাধ্য তার আজ্ঞার অবমাননা করে? ব্রহ্মচারী বাবার আজ্ঞা যে অপ্রতিহত।

এবার একটি ঘটনার উল্লেখ করবো যার থেকে বোঝা যাবে যে, ব্রহ্মচারী বাবার আজ্ঞা যে কেবল প্রকৃতি মানতেন, তা নয়, তার আজ্ঞা অবমাননা করা দেব-দেবীর পক্ষেও সম্ভব ছিল না।

একদিন লোকনাথ বাবা তার ঘরের বাইরে আশ্রমের এক পাশে বসে আছেন। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন রক্তবস্ত্র পরিহিতা এক রমণী তার সম্মুখে দণ্ডায়মান। তাঁর মুখ বিবর আচ্ছাদিত কিন্তু তাতে বসন্তদাগ স্পষ্ট। বাবা জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কে? সেই রমণী উত্তর দিলেন–আমি মা শীতলা। আমি এই পথ দিয়ে যাব। তুমি পথ ছেড়ে বসো। লোকনাথ বাবা বললেন, তোমার এ পথ দিয়ে যাওয়া হবে না। বাবার কথা শুনে প্রথমে দেবী নীরব রইলেন। তারপর তার একটি পা এগিয়ে দিলেন। বাবা তখন হাত তুলে বললেন–আমি কি কেউ নই? আমি বারণ করা সত্তেও তুমি কি করে অগ্রসর হও? তৎক্ষণাৎ দেবী তার পা পিছনে নিয়ে নিলেন। এবার দেবী বললেন আমি কি যাবার পথ পাবো না? আমাকে কি এখানে বন্দিনী হয়ে থাকতে হবে? বাবা বললেন–তুমি বন্দিনী হবে কেন? ছাগলবাঘিনীর নদীর নিচু এলাকায় যে চর আছে, তুমি সেখান দিয়ে গমন করো। খবরদার, উঁচু ভূমিতে যেন অগ্রসর হয়ো না। এরপর মা শীতলা বাবার নির্দেশিত পথে সেই স্থান ত্যাগ করেছিলেন। আশ্রমের পিছনদিকে ছাগলবাঘিনী নদী।

এই ঘটনার কিছুদিন পর ছাগলবাঘিনীর চর এলাকায় বসন্ত দেখা দিলো। সেখানকার ভূইমালী বাড়ির বেশ কিছু লোক বসন্তে মারা গেল। পরিবারের কর্তা তখন বাবার কাছে আশ্রমে এসে তাদের দুর্দশার কথা ব্যক্ত করলেন। বাবা তাদের সেই জায়গা ছেড়ে অবিলম্বে চলে যেতে বললেন। সেই পরিবার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাড়ি ত্যাগ করলো এবং অনেকের জীবন তাতে রক্ষা পেল।

এই ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য হল যে, ব্রহ্মচারী ঋষির আজ্ঞা এতটাই অপ্রতিহত যে, তা লঙ্ন করার শক্তি কারও নেই। একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী যে পথ দিয়ে চলেন, স্বয়ং দেবতাগণ তাঁর পথ ছেড়ে দাঁড়ান। তপস্যায় সিদ্ধিপ্রাপ্ত হবার পর তাকে ব্রহ্মচারী উপাধিতে ভূষিত করার তাৎপর্য হল তিনি এক হস্তে ব্রহ্মাণ্ড ধারণ করার ক্ষমতা ধরেন। বাবা লোকনাথ সেই উচ্চতায় নিজেকে উন্নীত করেছিলেন। এই একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।

.

অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধির প্রয়োগে মানবকল্যাণ

কোনো সাধক সাধনার অতি উচ্চতম পর্যায়ে অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধিপ্রাপ্ত হন। এই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলে যোগী এমন গতিপ্রাপ্ত হন, যা কেউ রোধ করতে সমর্থ নয়। এই গতির দ্বারা যোগী ব্রহ্মাণ্ডের যে কোনো স্থানে যখন ইচ্ছা ভ্রমণ করতে পারেন। এই সিদ্ধি বাবা লোকনাথ বিভিন্ন মানবকল্যাণকার্যে প্রয়োগ করেছিলেন এবং নিজ আত্মাকে মহাপ্রয়াণের সময় উক্রমণের জন্য প্রয়োগ করেছিলেন। এখানে আমরা কিছু ঘটনার কথা আলোচনা করবো যখন বাবা মানবকল্যাণের জন্য অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধি প্রয়োগ করেছিলেন।

রজনীকান্ত ব্রহ্মচারী ছিলেন বাবা লোকনাথের একজন অতিপ্রিয় শিষ্য। তার কাছে বাবার একটি তৈলচিত্র ছিল। সেই চিত্রটি অতি প্রাচীন হয়ে যাওয়াতে এর কিছু অংশ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। রজনীকান্তের ইচ্ছা হয় চিত্রটি সংস্কার করার। তৈলচিত্রটি সংস্কার করার জন্য তিনি কেদারেশ্বর সেনের কাছে দিয়েছিলেন।

কেদারেশ্বরবাবু তখন বি.এ. ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু চিত্র অঙ্কনে তার পারদর্শিতা ছিল। তিনি রজনী ব্রহ্মচারীর একজন অনুগত শিষ্য ছিলেন। শিল্পী প্রাচীন তৈলচিত্রটি পেয়ে তার সংস্কারের কার্য করার সময় ধারণা করতে পারছিলেন না যে চিত্রটির বিকৃত জায়গায় কি হওয়া উচিত। তিনি নিজে লোকনাথবাবাকে দর্শন করেননি। সেইজন্য তার মানসপটে লোকনাথ বাবার শারীরিক ভাব বিরজিত অংশ সঠিকভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছিল না। তিনি সে কথা রজনী ব্রহ্মচারীকে জানিয়েছিলেন এবং অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সঙ্গে এমন কোনো লোকের যোগ স্থাপন করিয়ে দিতে যিনি শিল্পীকে বাবার চিত্রের বিকৃত স্থানগুলির সঠিকভাব ব্যাখ্যা করতে পারেন। রজনী ব্রহ্মচারী সেইরকম একজন লোকের খোঁজ করতে থাকেন, কিন্তু এমন কোনো লোকের সন্ধান পান না। যিনি বাবার চিত্রের সঠিক শারীরিক অবস্থান ও ভাবভঙ্গির ব্যাখ্যা দিয়ে চিত্রটি ত্রুটিমুক্তভাবে অঙ্কনে সাহায্য করতে পারেন।

এদিকে কেদারবাবু রজনীকান্তের থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে ভাবতে থাকেন কিভাবে তৈলচিত্রটি নিখুঁতভাবে গড়ে তুলবেন। এমন অবস্থায় একদিন একজন ব্রহ্মচারী তাঁর কাছে এসে, তার সামনে বসে চিত্রটির দোষ, ত্রুটি সব বলে দিলেন। চিত্রটির বিকৃত অংশ কেমন হবে তাও বলে দিলেন। তার কথানুযায়ী শিল্পী সঙ্গে সঙ্গে সেইসব জায়গা সংস্কার করলেন। তৈলচিত্রটি সম্পূর্ণ হলো। ঠিক সেইসময় কেদারবাবুকে বাইরে থেকে রজনীকান্ত ডাকলেন এবং তাঁকে বললেন যে, তিনি এমন কোনো লোক জোগাড় করতে পারেননি যিনি বাবার চিত্রটি সংস্কার করতে সাহায্য করতে পারেন। কেদারবাবু তখন তার গুরুদেবকে বলেন, একজন ব্রহ্মচারী বাবা তাঁর কাছে এসেছেন এবং চিত্রটির দোষ, ত্রুটিগুলি সংশোধন করে দিয়েছেন। চিত্রটি এখন সম্পূর্ণ। সেই ব্রহ্মচারী এখন তার ঘরেই আছেন। রজনীকান্ত তড়িৎগতিতে কেদারবাবুর সঙ্গে তার ঘরে প্রবেশ করে দেখেন সেখানে কেউ নেই। কেদারবাবু বলেন, এইমাত্র তো ব্রহ্মচারী বাবা আমার সঙ্গে বসেছিলেন, সকলের অজ্ঞাতে তিনি কোথায় গেলেন! লোকনাথবাবা স্বয়ং দেবলোক থেকে অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধির বলে কেদারবাবুর কাছে দর্শন দিয়ে তার প্রিয় শিষ্যের ইচ্ছাপূরণ করে গিয়েছিলেন। এখনও তার অপ্রতিহত গতিতে তিনি ভক্তদের কৃপা করে থাকেন। কেদারেশ্বর সেন মহাশয় লোকনাথ মাহাত্ম নামে একটি পুস্তক রচনা করে তার নানা অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন।

অন্নদাচরণ চাকলাদার লোকনাথবাবার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। তিনি একদিন বারদী আশ্রমে এসে বাবার ঘরে তার থেকে উপদেশ শুনছেন। এমন সময় তাঁর শ্যালক এসে খবর দেয়, বাড়িতে তার মায়ের বুকে-পিঠে খুব ব্যথা শুরু হয়েছে। অন্নদাচরণ বাবার কাছে বাড়ি যাবার জন্য অনুমতি চাইলেন। বাবা তাঁকে বললেন–যা, বাড়ি গিয়েই মাকে বেড়াতে দেখবি। অন্নদাচরণ অনেক চিন্তাযুক্ত মনে বাড়ির পথে রওনা হলেন। ইত্যবসরে বাবার দেহ স্থির হয়ে গেল। উপস্থিত সকলে দেখলেন, বাবা কোনো কথা বলছেন না। তার দেহ ও চক্ষু স্থির। অন্নদাচরণ বাড়ি পৌঁছে দেখলেন, তার মা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তার মা বললেন, তিনি ক্ষীর ও খৈ দিয়ে পথ্য করে রোগমুক্ত হয়ে গেছেন। এখন তাঁর কোনো রোগ নেই। মাকে এইভাবে রোগমুক্ত হতে দেখে অন্নদাচরণ আবার বারদীর পথ ধরলেন। আশ্রমে পৌঁছে ব্রহ্মচারী বাবাকে প্রণাম করতেই তিনি বললেন–আমি তোদের বাড়ি গিয়েছিলাম, তোর মাকে ক্ষীর-খৈ খাইয়ে এসেছি। তোর মা ভালো হয়েছে বটে, কিন্তু দুই বৎসরের মধ্যে বৈশাখ মাসে তাঁর মৃত্যু হবে। ব্রহ্মচারী বাবার এই কথা সত্য হয়েছিল।

এই ঘটনায় আমরা দেখতে পাই কীভাবে বাবা লোকনাথ তাঁর অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধির প্রয়োগে ভক্তের মনের ব্যথা দূর করতে তার মাকে কষ্টমুক্ত করেন। আবার ত্রিকালজ্ঞতা সিদ্ধির দ্বারা একথাও বলে দেন, কতদিন তার মা ইহজগতে থাকবেন।

কুমিল্লাবাসী নিবারণ রায় নামে এক ব্যক্তি একটি ফৌজদারী মামলার আসামী হয়ে আদালতে অভিযুক্ত হন। কুমিল্লার জেলা কোর্টে সেই মামলা চলতে থাকে। নিবারণের পক্ষে খুব ভালো উকিল নিয়োগ করা হয়। কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্তেও তার ফাঁসির হুকুম হয়।

এরপর কলকাতা হাইকোর্টে আসামীর পক্ষে আপিল করা হয়। সেখানে অনেক বড়ো আইনজীবী নিবারণের ফাঁসির হুকুম র করার জন্য অনেক পরিশ্রম করেন। কিন্তু কোনো আশার আলো দেখা যায় না। হাইকোর্টে ওই কেসের রায়দানের আগের দিন কারাকক্ষে নিবারণ অস্থির চিত্তে পায়চারি করছেন আর ভাবছেন তার ভবিতব্যের কথা। কীভাবে ওই মামলায় তার শাস্তি রদ হবে এই চিন্তায় তখন তিনি পাগল।

ইতিপূর্বে তিনি বারদীর বাবা লোকনাথের কথা শুনেছেন। কিন্তু কখনও তাকে চোখে দেখেননি। হঠাই কে যেন অন্তর থেকে ডেকে বললো, তুই বাবা লোকনাথকে স্মরণ কর। অন্তরাত্মার এই কথা শুনে নিবারণবাবু অন্তিমলগ্নে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো বাবার কৃপা প্রার্থনা করতে লাগলেন। কারাগারের অন্ধকার কুঠিতে তিনি বাবা লোকনাথের স্মরণে তন্ময় হয়ে গেলেন। হঠাৎ সেই অন্ধকার কুঠুরি এক জ্যোতির্ময় আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। নিবারণবাবু দেখলেন কারাগারের লোহার গারদ ভেদ করে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন এক জটাজুটোধারী দিব্যকান্তি মহাপুরুষ। নিবারণবাবু তার পদতলে লুটিয়ে পড়ে বললেন, আপনি কে আমি জানি না। কিন্তু আমি বড় বিপদের মধ্যে আছি। আমায় উদ্ধার করুন।

সেই জটাজুটধারী জ্যোতির্ময় পুরুষ বললেন, তুই আমাকে স্মরণ করে আমার শরণাপন্ন হয়েছিস, সেইজন্য আমি তোর মামলার রায় লিখে দিতে এখানে এসেছি। শুনে রাখ, এতক্ষণ তুই যার নাম করছিলি, আমিই সেই বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারী। এই কথা বলেই বাবা অন্তর্হিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই দিব্যজ্যোতিও কারাকক্ষ থেকে অন্তর্হিত হয়ে আবার ঘরখানি অন্ধকার করে দিল।

বিস্মিত, অভিভূত নিবারণবাবুর গোটা রাত কাটে নিদ্রাহীনভাবে। কিছুটা সংশয়, কিছুটা আশঙ্কায় গোটা রাত কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠলো। আদালতে রায়দান পর্বের সময় আগত। নির্দিষ্ট সময়ে বিচারক রায় দিয়ে ঘোষণা করলেন যে ওই মামলায় নিবারণবাবু সম্পূর্ণ নির্দোষ। তিনি বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন।

অবাক বিস্ময়ে নিবারণবাবু ভাবলেন, এত খরচ করে এত বড়ো বড়ো উকিল মোক্তার লাগিয়েও যে মামলায় তার হার প্রায় নিশ্চিত ছিল তা কেবলমাত্র বাবা লোকনাহের কৃপায় উল্টে গেল।

কারামুক্ত হয়েই নিবারণবাবু ছুটে গেলেন বারদীর আশ্রমে। আশ্রমে বাবার একটি তৈলচিত্র দেখেই তিনি চিনতে পারলেন কারাকক্ষের সেই দিব্যকান্তি পুরুষকে।

এই ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাবা কেবল তার অপ্রতিহত গতিসিদ্ধি দিয়ে কারাকক্ষে সকলের অজ্ঞাতে প্রবেশ করেছিলেন, তাই নয়, তিনি তার পরকায় প্রবেশন সিদ্ধি প্রয়োগ করে অতি সূক্ষ্মরূপে বিচারকের মধ্যে প্রবেশ করে অভিযুক্তের হয়ে রায়ও লিখে দিয়েছিলেন। অনেকে হয়তো এই ব্যাপারে আশ্চর্য হবেন, কিন্তু এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বাবা কেমন ঈশ্বরকোটির সাধক ছিলেন!

ডাঃ আশুতোষ বণিক ও তার পরিবার ব্রহ্মচারী বাবার কৃপাধন্য একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। একবার সেই পরিবারের অরবিন্দ বণিক চন্দ্রনাথ তীর্থযাত্রায় গিয়েছিলেন। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপর পৌঁছে তিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যান এবং অস্ফুটে লোকনাথ বাবাকে স্মরণ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তার শরীরের উত্তাপ বৃদ্ধি পায় এবং তিনি মৃতবৎ হয়ে পড়েন। হঠাৎ কোথা থেকে সাধু সাধু শব্দ শোনা গেল। আর তখনই কেউ যেন তার চোখে জলের ঝাঁপটা দিলেন এবং তিনি চেতনা ফিরে পেলেন। অচেতন অবস্থা থেকে চৈতন্য ফিরে পেয়ে তিনি অন্য তীর্থযাত্রীদের কাছে শুনলেন, এক সাধু আবির্ভূত হয়ে তার কমন্ডলু থেকে পবিত্র জল মন্ত্রপুত করে তীর্থযাত্রীর চোখে ঝাঁপটা দিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন। অরবিন্দ বাবু বুঝলেন যে, বারদীর ব্রহ্মচারী বাবাকে স্মরণ করেছিলেন বলে তিনি নিজে সাধুবেশে এসে মন্ত্রপুত জল সিঞ্চন করে তার প্রাণরক্ষা করে গেলেন। সার্থক করে গেলেন তার কথা–

রণে বনে জলে জঙ্গলে
যেখানে বিপদে পড়িবে
আমাকে স্মরণ করিও
আমিই রক্ষা করিবো।

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কৃপাধন্য। একবার রাজা বাবাকে ভাওয়ালে নিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি বাবাকে বলেন–ভাওয়ালে তিনি বাবার জন্য আশ্রম ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবেন। ভক্তের এই আগ্রহ দেখে বাবা তাঁকে বলেন, আমাকে ভাওয়ালে নিয়ে যাবার জন্য এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? আমাকে যেখান থেকে ডাকবি, সেখানেই পাবি।

এই কথার মাধ্যমে বাবা বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভক্ত যেখান থেকেই তাকে ডাকুক না কেন, সেই ডাক তার অন্তরে সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করে এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থানে তাকে দেখা দিয়ে কৃপা করেন। তিনি যে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডেই বিরাজ করছেন, অনেক সময় ভক্তগণ সেই কথা বুঝতেন না।

বিহারীলাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন ঢাকা জজ কোর্টের একজন আইনজীবী। ঢাকায় তার খুব প্রতিপত্তি ছিল। তিনি ছিলেন ব্রহ্মচারী বাবার চরণাশ্রিত একজন অনুগত ভক্ত। একবার তিনি ঢাকা থেকে স্টিমারযোগে মেঘনা নদীপথে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। মেঘনা নদী দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ কালো মেঘে আকাশ ঢেকে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত শুরু হয়। প্রচণ্ড ঝড়ে মেঘনা নদীর বুকে বড়ো বড়ো ঢেউ উঠতে থাকে। শুরু হয়ে যায় এক প্রলয়কাণ্ড। যাত্রীদের বুক অজানা শঙ্কায় কেঁপে ওঠে। এমনসময় যাত্রীদের বিপদ সংকেত জানাতে স্টিমারের সাইরেন বেজে ওঠে। এই সাইরেনের শব্দে স্টিমারের সব যাত্রী প্রমাদ গুণতে থাকে এবং চারিদিক থেকে আর্তনাদ ভেসে ওঠে। নিশ্চিত শমণকে সামনে দেখতে পেয়ে বিহারীলাবাবু একমনে আকূল হয়ে বাবা লোকনাথকে ডাকতে থাকেন।

সেইসময় বারদী আশ্রমে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের সুপারিনটেনডেন্ট শ্রী অনাথবন্ধু মল্লিক মহাশয়। হঠাৎ বাবা লোকনাথ সমবেত ভক্তগণকে বলেন, বিহারী এখন ভীষণ বিপদে পড়ে আমার সাহায্য প্রার্থনা করছে। আমি তার জীবনরক্ষার জন্য চললাম। এই কথা বলে বাবা গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। তার দেহ স্থির হয়ে গেল।

ওদিকে মেঘনা নদীর উপর স্টিমারে জল ঢুকতে শুরু করেছে। নাবিকরা বুঝতে পারে যে, যে-কোনো মুহূর্তেই ঢেউয়ের আঘাতে স্টিমার উল্টে সকলের সলিল সমাধি হবে। প্রাণরক্ষার আর কোনো উপায় কারও চোখে পড়ে না। সবাই যখন মেঘনার বুকে প্রকৃতির তাণ্ডবের কাছে আত্মসমর্পণ করে মৃত্যুর প্রহর গুণতে শুরু করেছে, তখনও বিহারীলালবাবু ‘হে বাবা রক্ষা কর’ বলে কাতর কণ্ঠে বাবাকে ডাকতে থাকেন। জল ঢুকে যখন স্টিমারটি ডুবতে বসেছে তখন হঠাৎ সেই তাণ্ডবলীলা স্তব্ধ হয়ে গেল। বিহারীলালবাবু ও অন্যান্য যাত্রীরা দেখলেন দুটি অলৌকিক হাত স্টিমারটিকে শক্ত করে ধরে উপরে তুলছে। বিহারীলাল বাবু সেই দুটি অলৌকিক হাত দেখতে পেয়েই বুঝলেন, এই দুই হাত স্বয়ং বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার। তার ডাক শুনে বাবা লোকনাথ তাঁকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে এসেছেন। তিনি পুনঃ পুনঃ তার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন।

এদিকে বারদী আশ্রমে সকল ভক্তগণ দেখছেন বাবার শরীর নিস্পন্দ। কিছুক্ষণ পর তার বুখান হলো। সমাধি ভঙ্গ হলে তিনি বললেন, বিহারীলাল চট্টগ্রামের পথে মেঘনা নদীতে খুব বিপদে পড়ে আমাকে স্মরণ করেছিল। ওর প্রাণ সংশয় হয়েছিল। ওকে রক্ষা করে এলাম। সঙ্গে সব যাত্রীরাও রক্ষা পেয়ে গেল। অনাথবন্ধু বাবু এবং অন্যান্য ভক্তগণ বাবার এই কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বাবা তাদের সামনে সমাধিস্থ হয়েছিলেন। তবে কি বাবা বারদী থেকে ঢাকার পথে গিয়ে মেঘনার উপর ডুবন্ত স্টিমারসহ বিহারীলালবাবুকে রক্ষা করলেন!

অপ্রতিহতাগতি এমন এক আশ্চর্য সিদ্ধি যে যোগীর আত্মা মুহূর্তের মধ্যে তাঁর অভিলষিত স্থানে পৌঁছে যেতে পারে, যদিও তার শরীর স্থির হয়ে এক জায়গায় থাকে।

এই ঘটনার কিছুদিন পরে বিহারীলাল বাবু বারদী আশ্রমে আসেন বাবার দর্শনাকাঙ্ক্ষায়। বাবা লোকনাথ তখন তাকে বলেন–তুমি কি কখনও অসহায় অবস্থায় জলপথে আমাকে স্মরণ করেছিলে? বিহারীলালবাবু তখন মেঘনা নদীর ঘটনার পূর্ণ বিবরণ সমবেত ভক্তগণের সামনে পেশ করেন এবং ব্রহ্মচারী বাবার শ্রীপাদপদ্মে তার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

যোগীর অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধির প্রয়োগ সম্বন্ধে জানতে পারা যায় যে, যোগী তার আধ্যাত্মিক শক্তিবলে আত্মাকে দেহ থেকে আলাদা করে অন্যান্য সমস্তরের যোগীদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে যান এবং আবার আত্মাকে স্বদেহে ফিরিয়ে এনে সচল করেন।

বাবা লোকনাথের অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধি প্রয়োগের আর একটি চমকপ্রদ ঘটনা সাধু সমাজে বহুল প্রচারিত।

একবার শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী উত্তর ভারত ভ্রমণের সময় ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হয়েছিলেন। এই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে বাবা একবার চন্দ্রনাথ পাহাড়ে দাবানল থেকে রক্ষা করেছিলেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে ঢাকায় গোঁসাই বলে ডাকা হতো। ঢাকায় তার আশ্রম ছিল। ঢাকার আশ্রমে একটি টেলিগ্রাম মারফৎ খবর আসে যে গোঁসাই বাবা মৃত্যুমুখে পতিত। গোঁসাই বাবার একজন প্রিয় শিষ্য ছিলেন শ্যামাচরণ। তিনি বাবা লোকনাথের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং তার বারদী আশ্রমেও যাতায়াত ছিল। শ্যামাচরণবাবু গোঁসাই বাবার খবর পেয়ে কালবিলম্ব না করে বারদী আশ্রমে গিয়ে তার গুরুদেবের প্রাণরক্ষার জন্য বাবার চরণে নিবেদন করেন। কিন্তু বাবা তাকে বলেন, তুমি আমার কাছে পূর্বে এলে না কেন?

তখন শ্যামাচরণবাবু বাবা লোকনাথের কাছে আকুল প্রার্থনা করেন যে, বাবা যেন তার আয়ু কমিয়ে গুরুর জীবনদান করেন। গুরুর প্রতি শ্যামাচরণবাবুর এমন ভক্তি শ্রদ্ধা দেখে বাবা খুশি হয়ে তাকে বলেন, তুমি ঢাকায় ফিরে যাও, আমি বিজয়কৃষ্ণের কাছে যাবো। আগামী পরশু খবর পাবে।

এরপর দেখা যায় বাবার দেহটি বারদী আশ্রমে অবস্থান করছে আবার তাকে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর রোগ শয্যাতেও দেখা যাচ্ছে। গোঁসাই বাবার সেবিকা বাবাকে রোগশয্যায় বসে রোগীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেখেছেন। গোঁসাই বাবার একজন প্রিয় শিষ্য, যিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলেছেন, গোঁসাই বাবার বাঁচার কোনো আশা ছিল না বলে ডাক্তারেরা তাকে মৃত ভেবে দেহটি বাইরে রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবা লোকনাথ সেই দেহের পাশে বসার পরেই ডাক্তাররা দেখেন যে দেহে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। এখানে বাবা তার অমিত যোগশক্তিবলে দেহের কাছে উপস্থিত হয়ে গোঁসাই বাবার জীবন দান করেছিলেন।

.

মনোজব সিদ্ধি প্রয়োগে মানবকল্যাণ

এই সিদ্ধির বলে যোগী মনের কামনামাত্র তাঁর অভিষ্ট স্থানে পৌঁছতে সমর্থ হন।

দার্জিলিং-এর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন পার্বতীচরণ রায়। তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। একদিন বারদীতে বাবার নামে পার্বতীবাবুর কাছ থেকে একটি পত্র আসে। পত্রখানি রজনী ব্রহ্মচারীর হাতে পড়ে। রজনীকান্ত খাম নিয়ে বাবাকে দিতে গেলে বাবা বলেন, দ্যাখ তো পার্বতী চরণের চিঠি কি না? রজনীকান্ত চিঠিটি বার করে বলেন, পার্বতীচরণ রায়ের চিঠি। বাবা। বললেন–পড় দেখি, কি লিখেছে? রজনীকান্ত চিঠি পড়ে বললেন, পার্বতীবাবু লিখেছেন–আমার শরীর নিতান্ত অসুস্থ হইয়াছিল গতকল্য। যেন কৃপাদৃষ্টি থাকে।

সুস্থ হয়ে পার্বতীবাবু বারদী আশ্রমে এসে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কি দার্জিলিং-এ গিয়েছিলেন? উত্তরে বাবা লোকনাথ বলেন–আমি কি বারদী ছেড়ে কোথাও যাই? তখন পার্বতীবাবু অবাক হয়ে বললেন-আমি আপনাকে। দর্শন করেছি। এই কথা শুনে বাবা বলেন–আমি তোমার বিষয়ে চিন্তা করেছিলাম।

মনোজব সিদ্ধি প্রয়োগ করে ভক্তকে কৃপা করা-শরণাগতকে কৃপা করার এটি ছিল একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

.

পরকায় প্রবেশনসিদ্ধি প্রয়োগে ভক্তকে রক্ষা

যে সিদ্ধির বলে সিদ্ধ যোগী নিজের ইচ্ছামতো অন্যের দেহে সূক্ষ্মভাবে প্রবেশ করে তার আদেশমতো কাজ করাতে পারেন, তাকে পরকায় প্রবেশন সিদ্ধি বলে। অপ্রতিহতা গতিসিদ্ধির সঙ্গে পরকায় প্রবেশনসিদ্ধি প্রয়োগ করে দেহান্তরে ব্রহ্মচারী বাবা কীভাবে এক ভক্তকে রক্ষা করেছিলেন, সেই ঘটনা আগে উল্লেখ করেছি। একবার বাবা লোকনাথ বারদীর জমিদার নাগবাবুদের রক্ষা করার জন্য কিভাবে এই সিদ্ধি প্রয়োগ করেছিলেন, এখানে সেই ঘটনার উল্লেখ করছি।

একবছর জমিদার নাগবাবুদের এজমালি মহলে প্রজারা বিদ্রোহ করেছিল। প্রজারা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিলো। তখন জমিদারির কোনো কোনো শরিক কঠোর হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করতে নির্দেশ দিলেন। তাদের মধ্যে একজন বয়ঃবৃদ্ধ শরিক বলেছিলেন, কিছু করার আগে একবার বাবা লোকনাথের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই কথা শুনে শরিকদের কেউ কেউ বললো, নিজেদের জমিদারি নিজেরা রক্ষা করবো, এ ব্যাপারে বাবার পরামর্শ নেবার দরকার কি? কিন্তু অন্য শরিকরা বাবার পরামর্শ নেবার পক্ষে মত দিলে তারা সকলে বারদী আশ্রমে বাবার কাছে গিয়ে তাঁর মত চাইলে তিনি বললেন

হ্যাঁরে, নিজেদের জমিদারি নিজেরা রক্ষা করবি, তাতে আবার বাবার পরামর্শ নেবার দরকার কি? তিনি একথা এইজন্য বলেছিলেন কেননা সর্বজ্ঞ ব্রহ্মচারী বাবা বাড়িতে তাদের কথোপকথন সব যোগবলে জানতে পেরেছিলেন। নাগবাবুরা বাবার এই কথায় বুঝতে পারলেন যে, বাবা তাঁদের কথোপকথন সব জেনে গেছেন। বাবার কথা শুনে তারা অত্যন্ত ভীত, বিস্মিত এবং লজ্জিত হলেন। তারা তখন বাবাকে বললেন, আমাদের অন্যায় হয়ে গেছে, আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা আপনার শরণাপন্ন। এরপর নাগবাবুদের কাছে কোনো ঘটনা না শুনেই বাবা নিজে থেকে বলে দিলেন, তোদের প্রজারা বিদ্রোহী হয়েছে, এই তো? ঠিক আছে, তোদের কিছু করতে হবে না। তারা এই আশ্রম থেকে বিদ্রোহী প্রজাদের খাজনা ও কবুলতি বুঝে পাবি। নাগবাবুরা ভাবলেন, বিদ্রোহী প্রজারা এসে খাজনা ও কবুলতী দিয়ে যাবে, এটা একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। বাবার কথায় তাদের বিশ্বাস হল না কিন্তু তারা কিছু না বলে বাড়ি চলে এলেন।

বাড়ি ফিরে তারা লোকনাথবাবার কথা অমান্য করে লেঠেল পাঠিয়ে খাজনা আদায় করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু লেঠেলদের হুকুম দেবার আগে তারা আবার বারদী আশ্রমে গিয়ে লোকনাথবাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাইলেন।

এবারও তারা বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার সামনে যেতেই তিনি বললেন, ‘তোরা এ কাজ করিস না। আমি তো বলছি, ভয় নেই। আশ্রম থেকেই তোরা খাজনা ও কবুলতী পাবি।

কিন্তু জমিদারপক্ষের শরিকরা তাদের জমিদারিত্বের সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে লেঠেল পাঠিয়ে অনাদায়ী খাজনা আদায়ের জন্য প্রজাদের ক্ষেত থেকে পাট কেটে আনতে হুকুম করলো। রুখে দাঁড়ালো সেইসব প্রজারা। বেঁধে গেল তুমুল সংঘর্ষ। লেঠেলদের লাঠির আঘাতে বেশ কিছু প্রজা আহত হলো। তাদের মধ্যে একজন গুরুতর জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো।

প্রজাদের পক্ষ থেকে আদালতে লেঠেলদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হলে জমিদারপক্ষ শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তারা ফের বাবার শরণাপন্ন হবার কথা ভেবে গেলেন বারদী আশ্রমে। দু’দুবার বাবার কথা অমান্য করে তখন তারা যথেষ্ট লজ্জিত। তাঁরা বাবার কাছে তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বাবার আশীর্বাদ চাইলেন। তিনি তাদের শুধু বললেন–ওরা যা করেছে করুক। তোরা দারোগা, পুলিশ, আমলা, উকিল, মোক্তার কাউকেই কোনো টাকা পয়সা দিবিনা। তোরা বাড়ি ফিরে যা। আমি দেখবো।

বাবার অভয়বাণী শুনে তারা বাড়ি ফিরে গেলেও মনে তাদের অনেক সংশয় রয়ে গেল। তারা ভাবলেন, লেঠেলদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলায় আসামীপক্ষ সমর্থন না করলে, লেঠেলরা জমিদারদের কথা বলে দিতে পারে এবং তাদের শাস্তি অনিবার্য। এছাড়াও লেঠেলদের কাছে জমিদারদের অপমানিত হতে হবে। তাদের হেয় হতে হবে। এইসব ভেবে তারা মামলা চালানোর পক্ষে যুক্তি করলেন। মামলায় লেঠেলদের শাস্তি আটকানো গেল না। আসামীদের প্রত্যেকের ছয় মাস করে জেল হয়ে গেল। নাগবাবুদের মুখ পুড়লো। লোকনাথবাবার সামনে দাঁড়ানোর আর মুখ রইলো না। তাই তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলেন। আপিল চলাকালে নাগবাবুদের বিপদ আরও বেড়ে গেল, কেননা যে বিদ্রোহী প্রজাটি গুরুতর আহত হয়েছিল, সে মারা গেল। তাই আপিল চলাকালীন ফরিয়াদি পক্ষ থেকে এটাকে খুনের মামলা হিসেবে বিচার করার জন্য প্রার্থনা জানানো হলো। এই অবস্থায় জমিদার পরিবার রীতিমতো আতান্তরে পড়ে গেল। বাবা লোকনাথের আদেশ অমান্য করেই যে আজ তাদের এই অবস্থা তা বুঝতে পেরে শেষরক্ষার জন্য তারা ফের বাবারই শরণাপন্ন হলেন।

বাবা তাদের বললেন, তোরা বারবার আমার কথা অমান্য করেছিস। তার ফলস্বরূপ এখন আগে তোদের একশত টাকা জরিমানা দিতে হবে। তোরা জানিস না, আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। তোরা নাস্তিক, তোদের তাই বিশ্বাস নেই। ত্রিকালজ্ঞ বাবা প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন যে আহত প্রজা মৃত্যুমুখে পতিত হবে, সেইজন্য তিনি নাগবাবুদের মামলায় যেতে নিষেধ করেছিলেন। ভক্তরা কীভাবে তার ত্রিকালজ্ঞতা সিদ্ধির মূল্যায়ণ করতে সমর্থ হবেন? সেইজন্যই অনেক সময় ভক্তের আন্তরিক বিশ্বাসের স্তর নিচের দিকে থাকে। যদিও বাহ্যিকভাবে তারা প্রকাশ করেন তাদের অবিচল বিশ্বাস আছে। এক্ষেত্রে নাগবাবুরা আশ্বস্ত হলেন যে, বাবা তাদের ক্ষমা করেছেন। তারা একশত টাকা জরিমানা দিতে সম্মত হলেন।

বাবা লোকনাথ তাঁদের বললেন, যেদিন তোদের মামলার শুনানি হবে, সেদিন বিকেলবেলা তোরা আমার কাছে আসবি। নাগবাবুরা আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন।

এরপর আপিলের শুনানির দিন বিকেলে নাগবাবুরা দুরুদুরু বুকে বাবার কাছে। হাজির হলেন। বাবার সামনে উপস্থিত হওয়ামাত্র তিনি বললেন, তোদের জজ অসুস্থ। আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আমি তাঁকে উঠিয়ে রায় লিখিয়ে দিয়ে এসেছি। আগামীকাল তোরা আসামীদের খালাস করার টেলিগ্রাম পাবি। আর শোন, আসামীদের তোরা আমার আশ্রমেই পাবি। যা, এখন বাড়ি যা।

করুণাময় বাবার এইরকম অভয়বাণী শুনে নাগবাবুরা নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরে এলেন। পরের দিন তারা টেলিগ্রাম পেলেন যে, আসামিরা খালাস পেয়েছে, আরও আশ্চর্যের বিষয় হল যে, আসামীরা খালাস পেয়ে জমিদারবাড়ি না গিয়ে বারদীর আশ্রমে বাবাকে দর্শন করতে এলো। নাগবাবুরা খবর পেয়ে বারদী আশ্রমে এসে তাদের সঙ্গে দেখা করলেন।

এই ঘটনাটি বড়ই অদ্ভুত। নাগবাবুরা যেভাবে বাবার আদেশ অমান্য করেছেন, কোনো দেবতাও তাদের ক্ষমা করতেন না। কিন্তু করুণাময় বাবা লোকনাথ নাগবাবুদের এই অপরাধের জন্য কেবল ক্ষমাই করেননি, তাদেরকে নিশ্চিত শাস্তির হাত থেকে রক্ষাও করেছেন। তারপর তিনি মনোজবসিদ্ধি বলে জজের কাছে পৌঁছে পরকায় প্রবেশনসিদ্ধি প্রয়োগ করে তার হাতে নাগবাবুদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় রায়ও লিখিয়ে দিয়েছেন। এইজন্যই তিনি তাঁর শাশ্বতবাণীতে বলেছেন, তিনি ইচ্ছা করলেই সব করতে পারেন। ব্রহ্মচারী বাবার পথ রোধ করে এমন ক্ষমতা কারও নেই। ভক্তের মনে কেবল অবিচল বিশ্বাস চাই।

.

পরচিত্তাভিজ্ঞতা সিদ্ধির বলে লীলা

এটি এমন এক চমকপ্রদ সিদ্ধি যার বলে যোগী পরের মনের কথা জানতে পারেন। তার সামনে কেউ কোনো কথা বা ভাবনা গোপন রাখতে পারে না। মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী এমনই এক সিদ্ধ মহাপুরুষ ছিলেন যে, তাকে কেউ স্মরণ করলে বা তার সম্বন্ধে কোনো কথা বা ভাব মনে মনে পোষণ করলে, তিনি সেটা বুঝতে পারতেন। তার হৃদয়তন্ত্রীতে সেই স্মরণকারী বা ভক্তের মনের কথা অনুরণিত হতো এবং তার মানসপটে সেই ভক্তের ছবি ভেসে উঠতো। সেই স্মরণকারী বা ভক্ত যদি বিপদগ্রস্ত হতো, তবে তিনি সূক্ষ্ম শরীরে তার কাছে পৌঁছে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতেন। তিনি অপ্রতিহতা গতি বা মনোজবসিদ্ধিবলে এই রকমভাবে ভক্তদের কাছে চোখের পলকে পৌঁছতে পারতেন। এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ আমি পূর্বেই করেছি। দেহান্তরে এখনও মহাযোগেশ্বরবাবা লোকনাথ ভক্তদের একইভাবে কৃপা করে চলেছেন। এখানে পরচিত্তাভিজ্ঞতা সিদ্ধি বলে বারদী আশ্রমে বাবার আরও কিছু লীলার উল্লেখ করছি।

একদিন আশ্রমে অনেক লোকের সমাগম হয়েছে। বাবা তাদের সঙ্গে ধর্মালোচনা করছেন। নানা বিষয়ে ভক্তদের উপদেশ দান করছেন। হঠাৎ দ্বারের দিকে চেয়ে একজনকে উদ্দেশ্য করে তিনি খুব কঠোর ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলেন। ভক্তরা বুঝতে পারলেন না যে, কাকে উদ্দেশ্য করে বাবা সহসা এত কটুক্তি করছেন। বাবা হঠাৎ বললেন–তোর সালা আজ আমি মাথা ভেঙ্গে দেবো। কিছুক্ষণ পর এক অপরিচিত ব্রাহ্মণ আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। বারদী আশ্রমে তাকে আগে কখনও দেখা যায়নি। তাঁকে দর্শন মাত্রই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বাবা। নানা কটুকথা বলে তাকে তিরস্কার করতে লাগলেন।

এই ব্রাহ্মণ অনেক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ক্লান্ত হয়ে আশ্রমে প্রবেশ করেই বাবার কাছে এইরকম কটুক্তি ও তিরস্কার পেয়ে খুবই বিস্মিত এবং দুঃখিত হলেন। তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন যে, ব্রহ্মচারী বাবা তাঁকে আগে কখনও দেখেননি, তাঁর সম্বন্ধে কিছু জানেনও না, তবে কেন তিনি এমন ভর্ৎসনা করছেন? এই ভৎর্সনার কোনো কারণ কারও জানা নেই। বাবাও কাউকে এর কোনো কারণ বলছেন না, কেবল তিরস্কার করে যাচ্ছেন। ব্রাহ্মণ এইরকম কঠোর কটুক্তি আর সহ্য করতে না পেরে অবশেষে আশ্রম ত্যাগ করলেন।

এই ঘটনায় সমবেত ভক্তগণ যথেষ্ট আশ্চর্য হলেও এটা বুঝলেন যে, এই ঘটনার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। মহাযোগী বাবা তার যোগদৃষ্টিতে ব্রাহ্মণের মধ্যে এমন কোনো অপরাধ দেখেছেন যার জন্য তিনি তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কেউ সে কথা রাগত বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস পেলো না। ব্রাহ্মণ আশ্রম ত্যাগ করলে বাবা নিজেই তার রাগের কারণ ভক্তদের বললেন। তিনি বললেন, তোরা আমার এরকম কটুক্তি শুনে নিশ্চয়ই মনে কষ্ট পেলি। কিন্তু আমার এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ওই ব্রাহ্মণ একজন নরমাংস বিক্রেতা, একটা কশাই। ওর এক বিবাহযোগ্য কন্যা আছে। বেটা বরপক্ষের কাছ থেকে মোটা পণ নিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছে। ও মেয়েকে দেবার জন্য কেবল পণের অঙ্ক বাড়িয়ে চলেছে। যে বেশি পণ দেবে, ও তাকেই মেয়ে দেবে, মেয়ে সুপাত্রে পড়লো না অপাত্রে পড়লো, সেদিকে ওর নজর নেই। তাই আমি গালি দিয়ে ওকে অমন করে তাড়িয়ে দিলুম।

একজন ভক্ত বাবার কথা শুনে কৌতূহলবশতঃ সেই ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে বাবার কথা জানালেন। তার কথা শুনে ব্রাহ্মণ মুক্তকণ্ঠে সব স্বীকার করে বললেন, তার একটি বিবাহযোগ্য কন্যা আছে। একাধিক বরপক্ষের কাছে পণের দাবি বাড়াতে বাড়াতে এখন কয়েকশো টাকায় উঠেছে। এই পণের টাকা আর বাড়বে কি না, সেই কথা জানতে তিনি আশ্রমে বাবার কাছে গিয়েছিলেন।

ব্রাহ্মণ তখন সেদিন বাবার দ্বারা তিরস্কৃত হবার কারণ বুঝতে পারলেন। করুণাময় বাবা তার মেয়ের মঙ্গল কামনা করে তাকে এমন কঠোরভাবে তিরস্কার করেছেন। পিতা হিসাবে তার মেয়ের মঙ্গল কামনা করা উচিত ছিল। কিন্তু অর্থোপার্জনের নেশায় সে মেয়ের মঙ্গল চিন্তা না করে পণের দাবি বৃদ্ধি করে গিয়েছেন। তখন তার মন অনুশোচনায় ভরে উঠলো। তিনি আশ্রমে ফিরে এসে সকলের সামনে দোষ স্বীকার করে বাবাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, যারা পণ দিতে চেয়েছে, তাদের সঙ্গে তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন না। তিনি অন্যত্র মেয়ের পাত্রের সন্ধান করবেন। বাবা তার সিদ্ধিবলে ব্রাহ্মণের মনের কথা ও ভাব বুঝতে পেরেই তাকে সঠিক রাস্তা দেখিয়েছিলেন।

একদা কলকাতার এক ধনী পরিবার থেকে এক ব্যক্তি বাবা লোকনাথকে দর্শনের জন্য বারদী আশ্রমে আসেন। তিনি প্রথমে বাবার প্রিয় শিষ্য ব্রহ্মানন্দ ভারতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর কাছে নিজেকে এক ধনী পরিবারের সন্তানরূপে পরিচয় দেন। তিনি তাকে অনুরোধ করেন বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবার জন্য। ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবার কাছে তাকে নিয়ে গিয়ে বলেন যে, ইনি কলকাতার এক প্রভূত ধনী পরিবারের ছেলে। এদের অগাধ সম্পত্তি আছে এবং এদের পরিবার কলকাতায় বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। যখন ব্রহ্মানন্দ ভারতী এই কথা বলছেন, তখন বাবা ধ্যানস্থ হয়ে পড়েন। ধ্যানাবস্থা থেকে বুত্থান হলে বাবা আগন্তুককে বলেন, তুমি এখন ভাড়া বাড়িতে থাকো। ভদ্রলোক এই কথা শুনে অবাক হয়ে যান। বাবা বলতে থাকেন, এ বড় ধনী পরিবারের সন্তান। কিন্তু পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে বাধ্য হয়ে পৈত্রিক বাড়ি ত্যাগ করে এরা এখন ভাড়াটে বাড়িতে আছেন। আগন্তুক আশ্রমে আসার সময় এই কথা ভেবে এসেছিলেন যে, তিনি নিজেকে ধনী পরিবারের সন্তান রূপে পরিচয় দেবেন এবং ভাড়া বাড়িতে থাকেন এই কথা বলবেন না। এখন তিনি না বললেও বাবা কীভাবে সেই কথা জেনে ফেললেন, তা ভেবে উনি আশ্চর্য হলেন। বাবার অলৌকিক ক্ষমতায় বিস্মিত হয়ে তিনি বললেন, হ্যাঁ, ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমরা বাধ্য হয়ে বর্তমানে ভাড়াটে বাড়িতে আছি।

যিনি নিজেকে পরমব্রহ্মে উন্নীত করেছেন, তিনি সকলের আত্মাতে বিরাজ করেন। তার কাছে কি কিছু গোপন করা সম্ভব? বরং তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিলে কৃপা পাওয়া যেতে পারে।

একদিন বাবা আশ্রমে তার আসনঘরে গোমুখাসনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। তার দেহে কোনো কম্পন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তার মুখমণ্ডলে এক উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠেছে। তার চোখের অপলক দৃষ্টি যে কোথায় কার উপর নিবদ্ধ আছে, তা কারও জানা নেই। এইসময় সমবেত ভক্তগণের মনে হচ্ছিল যে, এই দেহটা বারদীর আশ্রমে উপস্থিত থাকলেও, বাবা সূক্ষ্মরূপে ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও হয়তো বিচরণ করছেন।

সেই অবস্থা থেকে বুত্থান হয়েই তিনি আগন্তুকদের মধ্যে একজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোর অবস্থা তো বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না। সংসার ছাড়বো মনে করলেই কি আর তা করা যায়রে পাগল। কাজকর্মে ঢিলে দিয়ে আখড়ায় আখড়ায় ঘোরাফেরা করছিস। ভাবছিস বুঝি, এমনি করেই পালিয়ে যাবার পথ খুঁজে পাবি। আমার কথা যদি শুনিস, আবার একটা বিয়ে করে নতুন সংসার পাত। আর মন দিয়ে সংসারসেবায় লেগে যা। মনেও ভাবিসনি যে, সংসার ছাড়লেই সংসার তোকে ছাড়বে। সেটি হবার যো নেই। আমার কথা মেনে সংসারকে আঁকড়ে ধরলেই দেখবি তারই মাঝখান দিয়ে তোর পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে।

আগন্তুক তখন বললো, আমি তো মরেই গিয়েছিলাম। কবিরাজ আমাকে জবাব দিয়ে গিয়েছিল। তারপর এ প্রাণ তো তোমারই দেওয়া। সেজন্য তোমার আদেশ আমি মাথা পেতে নেবো। তবু তোমাকে নিবেদন করতে চাই যে, বিয়েতে আমার রুচি নেই। আর সংসারে জড়িয়ে পড়তে ভালো লাগেনা।

বাবা তখন তাকে ধমক দিয়ে বললেন, বাজে কথা রাখ। মাগ-ছেলেকে যে ভালোবাসতে পারে না, সে আমাকে ভালোবাসবে কি করে? সারা মনপ্রাণ দিয়ে সংসারকে জড়িয়ে ধরলে দেখবি আমিও ধরা পড়ে গেছি সেই ফাঁকে। ভালোবাসাও একটা শ্রেষ্ঠ সাধনা। নিজেকে ভুলে গিয়ে যতই বিলিয়ে দিবি ততই দেখবি বাঁধা পড়ে গেছি তোর কাছে। এখন যে আমাকে ভালোবাসিস, এটা মেকি ভালোবাসা। আসল বস্তু পেতে হলে ভালোবাসার তপস্যা করতে হয়। আমি বলছি আবার বিয়ে কর। তোর যা কিছু অভাব সব মিটে যাবে।

আগন্তুক মনে কি বাসনা নিয়ে এসেছিলেন, বাবা তা বুঝতে পেরে তাঁকে উপযুক্ত উপদেশ দিয়েছিলেন। এই লীলার মাধ্যমে বাবা এই কথাও বুঝিয়েছিলেন যে, কারও মনে কোনো সুপ্ত কামনা-বাসনা থাকলেও সেটা বাবার গোচরে আসে। যদিও আগন্তুক সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হবার বাসনায় এসেছিলেন, কিন্তু তার মনের গভীরে তখনও কামনা সুপ্ত অবস্থায় ছিল। সেই কামনার পূরণ না হলে সংসার ত্যাগ করে তো কোনো লাভ নেই। বাবার হৃদয়-দর্পণে সকলের মন ধরা পড়ে যায়। বাবা এই লীলার মাধ্যমে আরও একটি লোকশিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, সংসারের সকলকে ভালোবাসতে পারলে, বাবা নিজেই সেই ভালোবাসায় বাঁধা পড়ে যান। বাবার কৃপা পেতে হলে সংসার ত্যাগ করার প্রয়োজন হয় না। অনেকে সংসার ত্যাগ করে সাধু হয়েছেন, কিন্তু ঈশ্বর দর্শন হয়নি বা সিদ্ধি প্রাপ্তিও হয়নি। কারণ, তাদের মনে তখনও প্রকৃত সংসার বৈরাগ্য বাসা বাঁধেনি। সংসারধর্ম পূর্ণ পালন না করলে সংসার বৈরাগ্য সকলের আসে না।

ঢাকা বিক্রমপুরের এক নিবাসী তার দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার জন্য তিনি অনেক চিকিৎসা করেন কিন্তু সবই নিষ্ফল হয়। বাবার কথা লোকমুখে শুনে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার আশায় বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে আসেন। ঢাকা থেকে বারদী দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার সময় তিনি একমনে বাবাকে স্মরণ করতে থাকেন এবং মনে দৃঢ় ধারণা পোষণ করেন যে, অমিত যোগশক্তির অধিকারী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী নিশ্চয়ই তার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবেন। তিনি আশ্রমে পৌঁছে বাবার সামনে বসে আকুলভাবে তার প্রার্থনা নিবেদন করেন। তার কষ্ট দেখে করুণাময় বাবা তার দিকে তার শ্রীপাদপদ্ম এগিয়ে দিয়ে আদেশ করেন খুব শক্ত করে ধরে রাখতে। ব্রহ্মচারী বাবার আদেশমতো সেই ব্যক্তি তার শ্রীপাদপদ্ম খুব শক্ত করে ধরে রাখেন। বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ? উত্তরে তিনি বললেন, আমি একটু দেখতে পাচ্ছি। ঠিক সেই সময় বিক্রমপুরের কয়েলী পাড়ার এক ব্যক্তি বাবার সামনে বসে সেখানকার জমিদারের এক করুণ ইতিহাস বাবার কাছে বর্ণনা করতে শুরু করলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই দৃষ্টিহীন ব্যক্তির মনঃসংযোগে তাতে ব্যাঘাত ঘটালো এবং তিনি মনে মনে যে বাবার করুণার চিন্তা করছিলেন, সেখান থেকে মনকে সরিয়ে জমিদারের কাহিনীতে নিবিষ্ট করলেন। যেইমাত্র তিনি অমনোযোগী হয়েছেন, বাবা তাকে তার পদযুগল ত্যাগ করতে নির্দেশ দিলেন। তাঁর আর পূর্ণদৃষ্টি পাওয়া হল না। তিনি ব্রহ্মচারী বাবার যে অসীম কৃপাপ্রাপ্ত হচ্ছিলেন, তার থেকে বিচ্যুত হলেন।

এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, বাবা সেই দৃষ্টিহীন ব্যক্তির মনের আকুলতার জন্য তার কাছে ধরা দিয়ে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে সেই ব্যক্তির চিত্তবৈকল্য ঘটলো, তিনি তৎক্ষণাৎ তার চিত্তের কথা বুঝতে পারলেন এবং নিজেকে তার থেকে সরিয়ে নিলেন। ভক্তগণ অকপট অন্তর্দর্শন করলে নিজেরাই বুঝতে পারবেন যে, তারা যখন বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে স্মরণ করেন বা তার কাছে কোনো কাতর প্রার্থনা জানান, তখন সত্যই কি পূর্ণ শতাংশ মন ব্রহ্মচারী বাবার শ্রীপদযুগলে নিবিষ্ট থাকে, না তার বিভাজন হয়ে থাকে! যদি ভক্তের মন পূর্ণ শতাংশে ব্রহ্মচারী বাবার উপর নিবিষ্ট থাকে, তবে ভক্তের ডাক তৎক্ষণাৎ তার হৃদয়তন্ত্রীতে বেজে ওঠে এবং তিনি ভক্তের মনোকামনা পূর্ণ করেন। আমি নিজের জীবনে এর অনেক প্রমাণ পেয়েছি। ভক্তের ডাক যদি একনিষ্ঠ হয়, ভগবান সাড়া দেবেনই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে। ভক্তের মন কদাচিই একনিষ্ঠভাবে ঈশ্বরের চরণে নিবিষ্ট হতে পারে।

এই সম্বন্ধে দক্ষিণেশ্বরের একটি কাহিনীর এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

একদিন সকালে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরে রানী রাসমণি আহ্নিক করতে বসার সময় ঠাকুর রামকৃষ্ণকে বলেন মায়ের গান গাইতে। রানীর অনুরোধে যথারীতি ঠাকুর মায়ের নামগান শুরু করেন। বেশ কিছুক্ষণ গান গাইবার পর তিনি হঠাৎ গান থামিয়ে রানীর গালে সজোরে এক থাপ্পর মেরে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন–সর্বক্ষণ কেবল বিষয় ভাবনা! এখানে এসেও ওই এক চিন্তা! ঠাকুরের কাণ্ড দেখে মন্দিরের সেবক ও অন্যান্য কর্মচারীরা হতবাক। রানী রাসমনি কিন্তু ক্ষুব্ধ হলেন না। বিনীতভাবে বললেন, তিনি জমিদারীর একটি বিশেষ মোকদ্দমার কথা চিন্তা করছিলেন। আহিকের সময় ঈশ্বরে আত্মমগ্ন না হয়ে তিনি বিষয়। চিন্তায় আত্মস্থ ছিলেন। তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন এবং সকলকে সতর্ক করে দিলেন, যেন এই ব্যাপারে ঠাকুরকে কেউ কিছু না বলে।

এই ঘটনাও এ কথা প্রমাণ করে যে ঈশ্বরের সামনে হাতজোড় করে বসে থাকলেই ঈশ্বরের চরণে মন নিবিষ্ট থাকে না। আমি লোকনাথবাবার মন্দিরে বারংবার গিয়ে খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করেছি যে বাবার মর্মরমূর্তির সামনে উপবিষ্ট ভক্তের মনে অনেক সময়েই একটা পর্যটনের তৃপ্তি ফুটে উঠছে। লোকনাথবাবার কৃপা ভিক্ষার তৃপ্তি নয়। প্রভুর চরণে যদি এক মুহূর্তও মন একনিষ্ঠভাবে নিবিষ্ট করা যায়, মুহূর্ত মধ্যেই তার কৃপা বর্ষিত হতে পারে।

উপরিল্লিখিত অন্ধ ব্যক্তির ঘটনায় সাধারণ ভক্তগণ এই কথাই মনে করবেন যে, আহা! বাবা তাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন, কিন্তু তার মনোসংযোগ নষ্ট হওয়ায় তিনি সেই কৃপা থেকে বঞ্চিত হলেন। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে বাবা কেবল তাকে দৃষ্টিশক্তি ফেরাবার কৃপাই করছিলেন না, একজন পূর্ণব্রহ্ম রূপে ব্ৰহ্মপদ তাকে দিয়েছিলেন। এমন সুযোগ কজনের ভাগ্যে ঘটে! অন্ধ ব্যক্তি যদি সেই ব্রহ্মপদ আঁকড়ে থাকতে পারতেন তার আত্মার ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি হতো। সঙ্গতি হতো। তিনি তার মনোযোগ নষ্ট করে কেবল দৃষ্টিশক্তি থেকেই বঞ্চিত রইলেন না, যে ব্রহ্মপদ পাবার জন্য মুনি-ঋষিরা যুগ যুগ ধরে তপস্যা করেন, মানুষ কত সহস্রবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রের আবর্তনে আবর্তিত হতে থাকে, সেই অতি মূল্যবান ব্রহ্মপদ হাতে পেয়েও হেলায় হারালেন। সে জন্যই তো বাবা অতীব দুঃখের সঙ্গে বারবার বলেছেন, আমি তোদের যা দিতে চাই, যা দিতে পারি, তোরা তা নিতে পারিস কই!

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর পরচিত্তাভিজ্ঞতার সিদ্ধি প্রকাশের আর একটি মজার ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না।

সেই সময় ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায় বাহাদুরের খুব নামডাক ছিল। বংশমর্যাদায় এবং রাজরক্ত ও অর্থকৌলিন্যে সমাজে তার বিশেষ মর্যাদা ছিল। তার নামডাক সারা বাংলাদেশ জুড়ে ছিল। বারদীর আশ্রম এবং মহর্ষি লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কথা তিনি অনেক লোকমুখে শুনে তাকে একবার চাক্ষুষ দর্শন করার অভিলাষ হলো। তিনি তার মন্ত্রী ও অন্যান্য পারিষদবর্গকে নিয়ে বারদী আশ্রমে হাতির পিঠে চড়ে রওনা হলেন। পথে আসতে আসতে মন্ত্রী ও পারিষদগণ আলোচনা করতে লাগলেন যে, রাজাবাহাদুরের লোকনাথবাবাকে প্রণাম করা উচিত হবে কিনা? কোনো কোনো পারিষদ এই মতো ব্যক্ত করলেন যে, ব্রহ্মচারী বাবার জাতির কোনো ঠিক নেই। এমন লোককে উচ্চ কৌলিন্যবংশের রাজার ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করা ঠিক হবে না। পারিষদদের আলোচনার পরে রাজা বললেন–জাতির যখন কোনো নিশ্চয়তা নেই বলছে, তখন ভূমিষ্ঠ হয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করা বা পদধূলি নেওয়া ঠিক হবে না। রাজা এরপর সপারিষদ আশ্রমে প্রবেশ করলেন। কিন্তু এ কী বিস্ময়কর কাণ্ড! রাজা আশ্রমে প্রবেশ করেই সর্বাগ্রে ভূমিষ্ঠ হয়ে ব্রহ্মচারী বাবাকে প্রণাম করে পায়ের ধূলা নিলেন। বাবা তখন হেসে বললেন–কেন বাবা, প্রণাম করবেনা বলে তো মনস্থির করে এসেছিলে। কি হলো? বাবা তখন স্থির দৃষ্টিতে রাজার দিকে চেয়ে আছেন। রাজা ভাবলেন তারা তো পথে আসতে আসতে এ কথা আলোচনা করেছিলেন। ব্রহ্মচারী বাবা কি করে তাদের কথা জেনে ফেললেন? অতঃপর তিনি ও তার পারিষদগণ লজ্জায় মাথা অবনত করেন। তারা যারপর নাই অপ্রস্তুতও হন। এরপর থেকে ভাওয়ালের রাজা বাবা লোকনাথের খুব প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। শুধু তাই নয়, বাবার অগণিত ভক্তগণ আজ বাবার যে ছবি দেখতে পান, সেটা প্রকৃতপক্ষে ভাওয়ালের রাজা বারদী আশ্রমে ক্যামেরা নিয়ে তোলেন। বাবা একমাত্র ভাওয়ালের রাজাকেই তার ছবি তুলতে দিয়েছিলেন, যখন রাজা তাকে বলেছিলেন যে, এই ছবির মাধ্যমেই আগামীদিনে ভক্তগণ তার পূজা করতে পারবেন।

.

বারদী আশ্রমে লঘিমাসিদ্ধির প্রকাশ

অষ্টাঙ্গ যোগের একটি মুখ্য সিদ্ধির নাম লঘিমাসিদ্ধি। এই সিদ্ধিবলে যোগী নিজের দেহকে অতি মাত্রায় লঘু করতে পারেন। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী একবার বারদী আশ্রমে এই সিদ্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।

ঢাকার পশ্চিমদি গ্রামের বাসিন্দা অন্নদাসুন্দরী প্রায়শঃই বারদী আশ্রমে বাবার দর্শনার্থে আসতেন।

তিনি অতি ভক্তিমতি এবং বাবার প্রতি তার মনে এক বাৎসল্যভাব বিরাজ করতো। একদিন তিনি আশ্রমে এসে ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করে প্রসাদ গ্রহণ করেন। তাঁর অবিচল নিষ্ঠা ভক্তি দেখে বাবা তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন।

অন্নদাসুন্দরী বাবাকে প্রণাম করে তার পাশে আসন গ্রহণ করেন। বাবা তখন তাকে বললেন, তুই তো আমার মা হয়েছিস? তোর ছেলেকে একটিবার কোলে নিয়ে বসতে ইচ্ছা করে না?

এইকথা শুনে অন্নদাসুন্দরী বলেন, তা কেন হবে না বাবা? তবে তুমি এখন এত বড়ো হয়েছে। তাই কেমন করে আমি তোমাকে কোলে নিয়ে বসবো? তোমার যদি কৃপা হয়, তবেই আমি তোমাকে কোলে নিয়ে বসতে পারি।

বাবা তখন বললেন, আচ্ছা একবার চেষ্টা করেই দেখ না, কোলে নিতে পারো কিনা?

তখন অন্নদাসুন্দরী এগিয়ে এসে সকলের সামনে সন্তানরূপী লোকনাথকে কোলে তুলে নিলেন। কোলে নিয়েই তিনি ঘোর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কি! এ যে দেখছি শোলার চেয়েও হালকা ও নরম। লোকনাথ বাবা তখন ছোট শিশুর মতো অন্নদাসুন্দরীর কোলে শুয়ে মিটমিট করে তাকাচ্ছেন। মুখে তার স্নিগ্ধ মধুর হাসি।

অন্নদাসুন্দরী তখন মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর এই অযাচিত করুণা দেখে কৃতার্থ হয়ে করজোড়ে সজল নয়নে ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বললেন, বাবা আমি তোমার এক সামান্য মেয়ে। কোনো জ্ঞান নেই। তাই ও কথা বলেছিলাম। বুঝতে পারিনি তোমার কৃপা হলে এ জগতে সবই সম্ভব।

ঈশ্বর তার পরম ঐশী শক্তির প্রভাবে পরমাণুর মতো সূক্ষ্ম মূর্তিতে সারা জগৎব্যাপী বিরাজ করেন। তার সেই পরমাণুমূর্তিতে মনকে যুক্ত করে মহাযোগী বাবা লোকনাথ দেহকে অতি মাত্রায় লঘু করে লঘিমাসিদ্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। সেজন্যই অন্নদাসুন্দরী বাবার দেহকে শোলার মতো হালকা বলেছিলেন। অন্নদা সুন্দরীর এই মনুষ্য জনম ধন্য করে দিয়ে বাবা পূর্ণব্রহ্ম রূপে তার কোলে শুয়েছিলেন। অন্নদাসুন্দরী ব্রহ্মকে তার কোলে পেয়েছিলেন। এই কথা কি তখন অন্নদাসুন্দরী বুঝতে পেরেছিলেন? তিনি কি বুঝেছিলেন যে ভগবান স্বয়ং তার কোলে শোভা পাচ্ছেন!

তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমা অন্তে আমি যখন নর্মদার উত্তর তটে অমরকন্টকের অনতিদূরে বড়ে গণেশজির মন্দিরে গিয়ে পরিক্রমা সমাপন আরতি করছিলাম (আমার সঙ্গে সেখানকার একজন মুনি আরতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন), তখন গণেশজির পা মানবদেহের পায়ের মতো নরম হয়েছিল। স্পর্শ করে বোঝা গেছে গণেশরূপে এক সজীব দেহ আমাদের সামনে বিরাজমান। ঈশ্বরের লঘিমাশক্তির এই চমৎকার আমার নিজ চক্ষে দর্শন করার সৌভাগ্য হয়েছিল।

.

বারদীতে কামরূপসিদ্ধির প্রকাশ

অষ্টাঙ্গ যোগে সফল হয়ে যোগী যে অষ্টাদশসিদ্ধি লাভ করেন, তার মধ্যে একটি হল কামরূপসিদ্ধি। এই সিদ্ধি দশটি গৌণ সিদ্ধির অন্তর্ভুক্ত। এই সিদ্ধিবলে যোগী যোগবলে যে কোনো প্রাণী বা দেবমূর্তি ধারণ করতে পারেন। বারদীতে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী কয়েকবার এই সিদ্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।

একদা বাবার এক ভক্ত তার মেয়ের বিয়েতে বাবাকে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি বাবাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন অনুষ্ঠান দিবসে তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করতে। বাবা বলেন, তিনি আশ্রম থেকেই মেয়ে জামাইকে আশীর্বাদ করবেন। কিন্তু নাছোরবান্দা সেই ভক্ত। বারবার বাবার কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন বিবাহ দিবসে তাঁর বাড়িতে দর্শন দিয়ে মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করতে। অগত্যা বাবা রাজি হন। অনুষ্ঠান দিবসে সন্ধ্যাবেলা সেই বাড়িতে সকলেই গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন, কখন ব্রহ্মচারী বাবা আসবেন। গৃহকর্তা একবার সদর একবার ভিতর করতে থাকেন। হঠাৎ তিনি দেখেন একটি কালো কুকুর প্রবেশ করে সোজা ঘরে চলে যাচ্ছে। তিনি তখন এক লম্বা কাঠ এনে কুকুরটিকে মারতে মারতে বাইরে বার করে দেন। সেই কাঠের আঘাতে কুকুরটির দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়। সে চিৎকার করতে করতে গৃহস্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করে। সকলে বাবার জন্য অপেক্ষা করেও বাবার দর্শন না পেয়ে আশাহত হন। বিবাহকার্য সম্পূর্ণ হয়ে যায়।

কিছুদিন পর সেই ভক্ত বাবার কাছে গিয়ে ব্যক্ত করেন যে, বাবা নিজের মুখে নিমন্ত্রণ স্বীকার করে কথা দিয়েছিলেন, তাঁর মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করতে আসবেন, কিন্তু তিনি তো গেলেন না।

বাবা তখন সেই ভক্তকে বললেন, আমি তখন তোকে কত করে বললাম যে, আমি আশ্রম থেকে তোর মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করবো। সে কথা তোর মনে ধরলো না। তাই বাধ্য হয়ে কথা দিলাম, যাব। মিছে কথা আমি বলতে পারিনা। তাই আমার কথা আমি রেখেছি। তুই যদি আমাকে চিনতে না পারিস তো আমার দোষ কি? তুই বিনা কারনে কালো কুকুরটাকে অমন করে কাঠ দিয়ে মারলি কেন? শুভকর্মে তোর এমন আচরণ করা কি ভালো হয়েছে? এই দেখ, আমার ডান হাতটা এখনও ভালো করে নাড়তে পারছি না। নাই বা চিনতে পারলি। কিন্তু অমন করে মারবি কেন? এই কথা বলে বাবা তার শরীরের ক্ষত দেখায়। বাবা সেই ভক্তকে আরও বলেন, আমি ছাড়া তো আর কেউ কোথাও নেই। তারা যে ভগবানের নাম করিস, সেও তো আমি ছাড়া আর কেউ নয়। একশো বছর ধরে কত অরণ্যে পর্বতে ঘুরেছি, এ শরীরে কতবার বরফের স্তূপ জমে গেছে, আবার তা গলে জল হয়ে গেছে। কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। আমি দেখেছি কেবল আমাকে, আর বুঝেছি যেখানে যা আছে, তা সব আমারই বিভিন্ন রূপের প্রকাশ। সেই ভক্ত তখন লজ্জায় ও অনুশোচনায় অশ্রু বিসর্জন করতে করতে বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। দয়ালু বাবা নিজে তার দ্বারা প্রহৃত হয়েও তাকে ক্ষমা করলেন।

এইরকম আর একটি ঘটনা ঘটেছিল আর একজন ভক্তের সঙ্গে। একজন ভক্তের পিতৃবিয়োগ হয়। তার পিতৃশ্রাদ্ধের দিন শ্রাদ্ধবাসরে উপস্থিত থাকার জন্য সেই ভক্ত বাবাকে খুব পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। ব্রহ্মচারী বাবা সেই সময় আশ্রম ছেড়ে কোথাও যেতেন না। তিনি বলতেন, তোমরা আমায় কোথাও যাবার জন্য পীড়াপীড়ি কোর না। কিন্তু ঈশ্বরের কাছে ভক্তের জোর বেশি। কথায় বলে ভক্তের ভগবান। অনেক ভক্ত মিলে বাবাকে ধরে বসলেন যে, তাকে শ্রাদ্ধবাসরে যেতেই হবে। শেষে অনেক মিনতির পর বাবা বললেন, বেশ আমি যাব বটে, কিন্তু একলা যাব। যে কোনো সময়েই যাব, তোমরা কেউ আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবে না। ভক্তরা তাতেই রাজি।

শ্রাদ্ধের দিন সকলেই জানতে পেরেছেন বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা আসবেন। সকলে অধীর আগ্রহে তাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। যখন শ্রাদ্ধের বেদিতে শ্রাদ্ধকাৰ্য আরম্ভ হল ঠিক সেই সময় একটি কালো কুকুর দৌড়ে এসে সেখানে দাঁড়াল। সকলেই মার মার করে চেঁচিয়ে উঠল। সকলেই বলতে লাগল, কুকুর প্রবেশ করে শ্রাদ্ধবাসর অপবিত্র করে দিয়েছে। একজন একটা চ্যালা কাঠ এনে সজোরে কুকুরের গায়ে কয়েক ঘা কষিয়ে দিলো। কুকুরটা মার খেয়ে প্রথমে শ্রাদ্ধবেদিতে বসা গৃহস্বামীর দিকে করুণভাবে চাইল, তারপর ধীরে ধীরে প্রবেশদ্বার দিয়ে বেরিয়ে গেল।

এদিকে শ্রাদ্ধকাৰ্য শেষ হয়ে গেলেও সারাদিনে বাবা লোকনাথের দর্শন কেউ পেলেন না। গৃহস্বামী মনে মনে ভাবতে লাগলেন, ব্রহ্মচারী বাবা তো কখনও মিছে কথা কননা। নিশ্চয়ই বাবার শরীর খারাপ হয়ে থাকবে। তিনি চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন। রাতে সব কাজকর্ম মিটে গেলে তিনি বারদী আশ্রমে এলেন ব্রহ্মচারী বাবার খোঁজ নিতে। আশ্রমে এসে তিনি দেখেন, বাবা শুয়ে আছেন। তিনি বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, বাবা কেন তার শ্রাদ্ধবাসরে যেতে পারলেন না? বাবা তখন তাকে বললেন, এত আদর করে নিমন্ত্রণ করে শেষকালে এমন প্রহার! বাবার মুখে এই কথা শুনে ভক্ত তো আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ব্রহ্মচারী বাবা তখন বললেন, বাবা কালো কুকুরটি কি অপরাধ করেছিল যে তাকে এত কঠিন অভ্যর্থনা করে তাড়ালে? সকলে এ কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। কারও মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না। সেই ভক্তটি অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইলেন।

অন্যান্য ভক্তগণ তখন তাকে বললেন, বেলা দ্বিপ্রহরের পর ব্রহ্মচারী বাবার ঘর থেকে একটা কালো কুকুর বার হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে বাবাকে আর দেখা গেল না। কিছুক্ষণ পরে সেই কালো কুকুরটি আবার এসে বাবার ঘরে ঢুকল। তখন ঘরে এসে দেখা গেল ব্রহ্মচারী বাবা যেন বাইরে থেকে এসেছেন। দেখা হওয়ামাত্র বললেন–শ্রাদ্ধ বাড়িতে বেশ কিছু খেয়ে এলাম। এই কথা শুনে সেই ভক্তের লজ্জার সীমা রইলনা। তিনি অনুশোচনায় কেবল অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। তার পিতার শ্রাদ্ধবাসরে ব্রহ্মচারী বাবা প্রহৃত হয়েছেন জেনে দুঃখে তিনি ম্লান হলেন। বারংবার ব্রহ্মচারী বাবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেন।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী উপরিউক্ত দুটি ক্ষেত্রেই কামরূপ সিদ্ধি প্রয়োগ করে দেহান্তরে ভক্তের অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি এই পরীক্ষাও করছিলেন যে, তাঁর ভক্তগণ কত নিবিড়ভাবে তাকে ভালোবাসে। তারা কত আগ্রহে তার আদর্শ গ্রহণ করেছে। দুটি ক্ষেত্রেই ভক্তরা সেই পরীক্ষায় অসফল হয়েছে। লোকনাথ বাবা ভক্তদের বলতেন সকল জীবে সমবুদ্ধি না হলে সাধনা হয় না। সাধনজ্ঞান লাভ হলে সাধকের মনে এই বুদ্ধি আসে যে সর্বজীবে একই সত্তা রয়েছেন। তিনি সকল ভক্তকে বলতেন, সকল জীবের মধ্যে তোমার সত্তা, তোমার আত্মা, আর সকল প্রাণীর আত্মার উপাদান একই। এই ভাবটি সকলের মধ্যে তিনি বধ্যমূল করতে চেয়েছিলেন যে, ঈশ্বরকে আপন আত্মা ও এই বিশ্বচরাচর থেকে পৃথক করে দেখলে ও খুঁজলে কখনই তাঁকে পাওয়া যাবে না। ঈশ্বরকে আপন আত্মার মধ্যে এবং সেই আত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে বিচিত্ররূপে দেখাই হল প্রকৃত ঈশ্বরদর্শন। নিজের আত্মাকে যদি নিজের মধ্যে দর্শন করতে সমর্থ হও, তবে নিজের মধ্যেই ঈশ্বরকে দর্শন করতে সমর্থ হবে। বাবা লোকনাথ সকলের আত্মায় বিরাজমান। আমরা তাকে চিনতে পারিনা। তার বিভিন্ন লীলা দিয়ে তিনি এই কথাই ভক্তদের বুঝিয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা কি তা বুঝতে পেরেছি?

বাবা লোকনাথের মতো এইরূপ লীলা ও কামরূপসিদ্ধির প্রকাশ সিরডির সাঁইবাবার জীবনীতেও পাওয়া যায়। তিনিও একই প্রকারে ভক্তদের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচনের প্রয়াস করেছিলেন। নমর্দা পরিক্রমার সমাপণ পূজা দেবার সময় ওঁকারেশ্বর উত্তর তটে পাহাড়ের উপরস্থিত ভৈরব গুহা দর্শন করে ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ প্রলয়দাসজির আরাধনা করার পর আমাকে অবিশ্বাস্যরূপে দক্ষিণ তটে গজানন আশ্রমে সেই মহান ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ কালো কুকুররূপে দেখা দিয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাকে সেইরূপে দর্শন করে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাবার। মহাযোগী বাবা লোকনাথের শিক্ষা আমার তপস্যার পথ সুগম করেছিল।

নবদ্বীপের শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচলে তার ভক্তবৃন্দকে বলেছিলেন–

নন্দের নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ।
এই বাক্যে বিকাইনু তার বংশের হাত।।
তোমার কা কথা তোমার গ্রামের কুক্কুর
সে হো মোর প্রিয় অন্যজন বহু দূর।

এইবার উল্লেখ করছি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কামরূপ সিদ্ধি প্রকাশের আর এক অনন্য চমকপ্রদ ঘটনা।

একদিন বারদী আশ্রমের গোয়ালিনী ব্রহ্মচারী বাবার কাছে গিয়ে বললেন, বাবা, আমার এক আত্মীয় কালীঘাটের কালীর নামে মানত করে ফল পেয়েছে। সে এখন ওই মানতের টাকা ও পূজাসামগ্রী কালীঘাটে পাঠাতে চাইছে। আপনার কাছে তো কলকাতার কত লোক আসে। তাদের কারও সঙ্গে যদি ওই টাকা আর পূজার সামগ্রী পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন তো ভালো হয়।

গোয়ালিনী মার কাছে এই কথা শুনে বাবা বললেন, ওই টাকা ও পূজা-সামগ্রী আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমিই কালীঘাটের কালী।

বাবা লোকনাথকে ভগবান জ্ঞানে ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন গোয়ালিনী মা। বাবার কত ভগবৎ লীলা চাক্ষুষ করেছেন তিনি। বাবার কথায় তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাই তিনি তার আত্মীয়কে বললেন মানতের টাকা ও পূজা-সামগ্রী আশ্রমে বাবার কাছে দিয়ে যেতে। পরের দিন সকালবেলায় গোয়ালিনীমার আত্মীয় এসে মানতের টাকা ও পূজা-সামগ্রী আশ্রমে দিয়ে গেল। সে মনে ভাবলো ব্রহ্মচারী বাবা একজন যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ, তিনি কৃপা করলে সকল দেবদেবীরাও কৃপা করবেন। তার কাছে পূজা দেওয়া মানেই কালীঘাটের কালীর কাছে পূজা দেওয়া। তারা গোয়ালিনী মার জিম্মায় মানতের টাকা ও পূজা-সামগ্রী দিয়ে দিলেন।

বাবা লোকনাথ সেই সময় তাঁর আসন ঘরে ধ্যানাবিষ্ট। গোয়ালিনী মানতের টাকা ও পূজা-সামগ্রী নিয়ে বাবার আসন ঘরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু এ কি! সামনে উনি কী দেখছেন! বাবার আসনে বাবা নেই। তার স্থানে আসনে উপবিষ্টা করালবদনা কালীমাতা। তিনি তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি একজন নিরক্ষর মহিলা। জপ, তপ, সাধন, ভজন কিছুই তার জানা নেই। তিনি কেবল অবিচলিত ভক্তিদ্বারা একনিষ্ঠভাবে আশ্রমে বাবার সেবা করেন। বাবার অনেক ঈশ্বরীয় লীলা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। সেজন্য সামনে এমন অবিশ্বাস্য লীলা দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন, কিন্তু ভীত হননি। তার আত্মীয়ের মানতের টাকা ও পূজা-সামগ্রী সেই করালবদনা কালীমূর্তির সামনে রেখে সাষ্টাঙ্গে পরম ভক্তিভরে কালীরূপী বাবা লোকনাথকে প্রণাম করে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন। বাবা লোকনাথের এইরূপ মাতৃরূপ গ্রহণ করা প্রত্যক্ষ করেছিলেন একমাত্র তার একান্ত সেবিকা গোয়ালিনী মা। তারপর থেকেই বাবার নাম জয়গান করতে বলা হতো–জয় বাবা লোকনাথ, জয় মাতা লোকনাথ।

গোয়ালিনী যেহেতু বাবার গর্ভধারিণী মা কমলা ছিলেন, একমাত্র তাকেই বাবা কামরূপসিদ্ধির প্রকাশ দেখিয়েছেন।

একদিন গোয়ালিনী বাবার কাছে পুরীর জগন্নাথ দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তখন ব্রহ্মচারী বাবা আমিই সেই জগন্নাথ এই কথা বলে তাকে নিজ দেহে জগন্নাথমূর্তি দর্শন করিয়েছিলেন। এই কথা গোয়ালিনী পরবর্তীকালে বাবার প্রিয় শিষ্য যামিনীকুমারকে বলেছিলেন এবং তিনি এই অপূর্ব দর্শনের কথা লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। বারদীতে যামিনীকুমারের নিজ লেখা থেকে এই তথ্য জানতে পারা গেছে।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন একজন মহাযোগী। অষ্টাঙ্গ যোগশিক্ষার সময় তিনি আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির কাছে ত্রিগুণাত্মক হবার যে শিক্ষা পেয়েছিলেন এবং কঠোর যোগসাধনার দ্বারা নিজের মধ্যে সেই শিক্ষাবলে স্বত্ত্বগুণের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে তিনি যে ধারণা অনুষ্ঠানে সফল সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, তাতে কামরূপ সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে তার মনে যে ধারণার উদয় হতো, তিনি সেই রূপ পরিগ্রহ করতে পারতেন। কামরূপসিদ্ধযোগী নিজের মনে যে দেবতার ধারণা করেন, তার দেহ সেই দেবতার রূপ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে কামরূপসিদ্ধি প্রয়োগ করে বাবা গোয়ালিনী মার কথায় কালীরূপ ধারণ করেছিলেন। মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী সুদীর্ঘকাল অতি কঠোর যোগসাধনা দ্বারা যে অষ্টমুখ্য, দশটি গৌণ ও পাঁচটি অন্য সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, অতি উচ্চ ঈশ্বরকোটির যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ ভিন্ন অন্য কেউ এইরকম সিদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারেন না। অনেক সাধক হয়তো কঠোর সাধনা বা একনিষ্ঠ ভগবৎ প্রেমের দ্বারা ভগবৎ কৃপা বা ভগবৎ দর্শন লাভ করতে পারেন বা কিছু সিদ্ধি বা তার ফলস্বরূপ কিছু বিভূতি লাভ করতে পারেন, কিন্তু সেই দেহে কোনো দেবতা ধারণ করতে পারেন না। যোগসাধনায় অতি উচ্চ স্তরে কোনো ঈশ্বর কোটির যোগী যখন নিজের মধ্যে পূর্ণব্রহ্ম রূপ দর্শন করতে সমর্থ হন, তখন তার পঞ্চভূত দেহ দেবদেহে রূপান্তরিত হয়। এইরূপ অবস্থায় যোগীর দেহে সব সিদ্ধির প্রকাশ ঘটে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেই যোগীর দেহে এই দেবরূপ দর্শন করতে সমর্থ হননা যদি না যোগী স্বেচ্ছায় কারোকে তার দেবদেহ দর্শন করান। একমাত্র কোনো সিদ্ধ যোগীই ব্রহ্মাণ্ডে কোনো মহাপুরুষের দেবদেহ দর্শন করতে সমর্থ হন। শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী একজন সিদ্ধ বৈষ্ণব যোগী হিসাবে বাবা লোকনাথের দেহে সকল দেবতার অবস্থান দর্শন করেছিলেন। আর বাবা স্বেচ্ছায় তার জন্মদাত্রী মা কমলাকে (যিনি পরজন্মে গোয়ালিনী হয়ে বাবাকে পুত্রবৎ সেবা করতেন) কালীরূপে দর্শন দিয়েছিলেন।

.

ত্রিকালজ্ঞতা সিদ্ধির প্রকাশ

অষ্টাঙ্গ যোগসিদ্ধ যোগীর অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ সাধনার বিভিন্ন স্তরে প্রথম আটটি মুখ্যসিদ্ধি ও ক্রমে ক্রমে দশটি গৌণসিদ্ধির প্রকাশ ঘটে। ঈশ্বরকোটির অথবা জীবকোটির অষ্টাদশ সিদ্ধিপ্রাপ্ত যোগী এই অষ্টাদশসিদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও যখন ব্রহ্মদর্শনের পথে অগ্রসর হন, তখন যোগের বিভিন্ন স্তরে তিনি আরও যে পাঁচটি বিশেষ সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, তার মধ্যে প্রথম সিদ্ধি হল ত্রিকালজ্ঞতা। এই সিদ্ধিবলে সিদ্ধযোগী যে কোনো ব্যক্তির বা ব্রহ্মাণ্ডের ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এই তিনকাল সম্বন্ধে অবহিত হতে পারেন। ত্রিকালজ্ঞ যোগী এক অতি উচ্চস্তরের যোগী। বর্তমানে ত্রিকালজ্ঞ এই শব্দটির ব্যবহার জ্যোতিষ ও সাধারণ সাধু সমাজে যথেচ্ছভাবে হয়ে থাকে। যখন এই শব্দটি এইরূপ সাধারণ মানে ব্যবহৃত হয়, তখন তার মধ্যে ত্রিকালজ্ঞতাসিদ্ধির কোনো সম্পর্ক থাকে না। যিনি এই সিদ্ধিপ্রাপ্ত তিনি অবশ্যই অষ্টাদশ সিদ্ধিপ্রাপ্ত এবং তিনি কেবল কোনো ব্যক্তির নয়, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ব্যক্ত করতে পারেন। বাবা লোকনাথের যে বিভিন্ন লীলার উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্য সিদ্ধির সঙ্গে তার ত্রিকালজ্ঞতা সিদ্ধির প্রকাশও ঘটেছে। একবার বাবা লোকনাথ বারদীর জমিদারদের কাছে তার এক বিচিত্র লীলার মাধ্যমে এই সিদ্ধির প্রকাশ করেছিলেন, এখানে সেই ঘটনার উল্লেখ করছি।

একদিন সন্ধ্যাবেলায় বারদীর জমিদার পরিবারের অরুণকান্তি নাগ ও কুঞ্জলাল নাগ মহাশয় হঠাৎ আশ্রমে উপস্থিত হন। বাবাকে এসে যখন তারা প্রণাম করেন, তখন বাবা তাদের বলেন, তোরা না খেয়ে যাসনি। এখুনি খিচুড়ি ভোগ রান্না করে দিতে বলছি।

এই বলে বাবা গোয়ালিনী মাকে ডেকে খিচুড়ি রান্না করার জন্য বললেন ও সেই সঙ্গে নিজেই চাল ও ডালের পরিমাণও নির্দিষ্ট করে দিলেন। তিনি চাল ডালের যে পরিমাণ বললেন, তাতে অন্ততঃ পঞ্চাশজন লোক ভোগ গ্রহণ করতে পারবে। যথাসময়ে খিচুড়ি ভোগ রান্না সম্পন্ন হলো। এত ব্যাপক পরিমাণ খিচুড়ি দেখে কুঞ্জবাবু অরুণকান্তি বাবুকে বললেন, কি ব্যাপার বলতো? আমরা এখন আশ্রমে মাত্র দশজন লোক আছি অথচ বাবা পঞ্চাশজনেরও বেশি লোকের ভোগ রান্না করালেন। এত খিচুড়ি খাবে কে? কুঞ্জবাবু ও অরুণকান্তি বাবুর মধ্যে কথোপকথন অন্তর্যামী বাবা লোকনাথ সব জানতে পারলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।

রাত তখন দশটা। কুঞ্জবাবু ও অরুণকান্তি বাবু পেট ভরে ভোগ সেবা করে বাবাকে প্রণাম করে বাড়ি যাবার জন্য রওনা হলেন। তারা আশ্রমের উঠোন পার হতেই পিছন থেকে বাবা পরিহাস করে বললেন, এত খিচুড়ি খাবে কে রে? বাবার এই পরিহাস শুনে নাগবাবুরা একবার থমকে গেলেন, তারপর এর অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে না পেরে আবার এগোতে লাগলেন। যেই তারা আশ্রমের উঠোন পার করেছেন, দেখলেন হঠাৎ কোথা থেকে ৪০-৫০ জন লোক এসে হাজির। এতক্ষণে নাগবাবুরা বুঝলেন বাবা কেন তাদের পিছনে পরিহাস করেছিলেন এবং কেনই বা বাবা এত চাল-ডাল দিয়ে রাতে ভোগ রান্না করালেন। বাবার লীলা কে বুঝতে পারে!

ত্রিকালজ্ঞ বাবা লোকনাথ জানতেন যে তার ৪০-৫০ জন ভক্ত বহু পথ অতিক্রম করে আসছেন। তারা যাতে আশ্রমে এসে ভোগ সেবা করতে পারেন, সেজন্যই তিনি আগে থাকতে খিচুড়ি রান্না করতে বলেছিলেন। ভক্তের কুশল চিন্তা ভক্তের আগে বাবার মনে আসত। তিনি যে ভক্তের ভগবান ছিলেন।

যিনি ত্রিকালজ্ঞ ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষ হন, তাঁর বাক্য হয় অমোঘ। তিনি মুখে যা বলেন, সে কথা সত্য হবেই। এমন একটি ঘটনা ঘটে কেউটেখালির মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মহেন্দ্রবাবুর স্ত্রী ছিলেন মৃতবৎসা। যতবার তিনি সন্তান সম্ভবা হন, সেই সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। অনেক চিকিৎসায়ও কোনো ফল হয় না। অতঃপর রজনী ব্রহ্মচারীর পরামর্শে মহেন্দ্রবাবু স্ত্রীকে নিয়ে একদিন বারদী আশ্রমে বাবার কাছে আসেন। সেইসময় তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বাবাকে দর্শন করে প্রথমে তারা প্রসাদ গ্রহণ করেন। তারপর কিছুক্ষণ আশ্রমে বিশ্রাম করে আবার বাবার দর্শনে যান। বাবার পায়ের ধূলা মাথায় নেবার পর বাবা মহেন্দ্রবাবুর স্ত্রীকে বলেন, শোন মা, আর ভয় নেই। তোর গর্ভস্থ সন্তান আর নষ্ট হবে না। আগামীকাল থেকে তোর গর্ভস্থ সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে শয্যা ত্যাগের পর আমার আশ্রমের সেবার জন্যে একটি করে পয়সা সরিয়ে রাখবি। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর ওই পয়সা এখানে পাঠিয়ে দিবি। মহেন্দ্রবাবুর স্ত্রী যথাসময়ে একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন। প্রসবান্তে তিনি বাবার নির্দেশমতো পয়সা আশ্রমের সেবার নিমিত্ত পাঠিয়ে দেন। মহেন্দ্রবাবু স্ত্রীকে দেওয়া ত্রিকালজ্ঞ বাবা লোকনাথের বাক্য অমোঘ প্রমাণিত হয়েছিল।

.

দেবগণ সহিত ক্রিড়াকরণসিদ্ধির প্রকাশ

দেবগণ সহিত ক্রিড়াকরণসিদ্ধি সাধক তপস্যার এমন এক স্তরে প্রাপ্ত হন যখন তার দেহে অবস্থিত সমস্ত বৈদিক দেবতা জাগ্রত হয়ে সাধকের পঞ্চভূত দেহ এক দেবদেহে উন্নীত হয়। এই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলে সাধক ইচ্ছামতো দেবতাদের সঙ্গে ক্রিড়া করতে সমর্থ হন। সাধকের দেবগণের সঙ্গে এই ক্রিড়াকরণ দুইভাবে হয়ে থাকে। এক হয়, সাধকের পঞ্চভূত দেহ থেকে তার আত্মা সূক্ষ্মরূপ গ্রহণ করে দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হন। আবার দেখা যায়, পঞ্চভূত দেহের মধ্যে থেকেই সাধকের আত্মা বিভিন্ন মুদ্রার মাধ্যমে দেবগণের সঙ্গে ক্রিড়া করেন।

আমার সাধন জীবনে দু-বার এমন উচ্চমার্গের সাধকদের সামনে একান্তে বসে তাদের দেবগণের সঙ্গে ক্রিড়াকরণ প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। একজন ছিলেন হৃষিকেশের গীতা ভবনের অধ্যক্ষ স্বামী রামসুখ দাসজি। (বর্তমানে তার পুণ্যাত্মা দেবলোকে উক্রমণ করেছে)।

গীতাভবনে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই উচ্চ ঈশ্বরকোটির সাধকের সঙ্গে একান্তে মুখোমুখি বসে তার আশীর্বাদ গ্রহণ করার। তাঁকে দেখেছিলাম কথার মাঝে হঠাৎ করে প্রথমে সমাধিস্থ হয়ে যেতে, তারপর সমাধি অবস্থার মধ্যেই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হতে। সেইসময় তার ডান হাত এক বিচিত্র মুদ্রায় থাকত এবং তার মুখে এক অতি উজ্জ্বল আভা প্রকটিত হতো। কিছুক্ষণ পরে বুখান হলে তিনি আবার কথা বলতেন।

আর এক এইরকম উচ্চমার্গের সাধকের দেখা পেয়েছিলাম ওঁকারেশ্বরের উত্তর তটে। তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমার সফল পরিসমাপ্তিতে যখন আমি পরিক্রমা সমাপন পূজা করতে ওঁকারেশ্বরে গিয়েছিলাম, তখন উত্তর তটে পাহাড়ের গায়ে একটি কুঠিতে শুকদেব মুনির সন্ধান পেয়েছিলাম। পরিক্রমাকারীরূপে তার সামনে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি মুখে কোনো কথা বলতে পারেন না। তার শরীরে কোনো রক্ত চলাচল করছে কি না বোঝা দায়। সামনে থেকে দেখলে মনে হয় হাড়ের উপর চামড়া লাগানো। জটাজুটধারী মুনি বেশিরভাগ সময় শয়ন করে দুহাত দিয়ে বিচিত্র মুদ্রা করে চলেছেন। তিনি দাঁড়াতে পারেন না। কখনও তার মুখে স্মিত হাসি লক্ষ্য করা যায়। হাত কখনও থামে না। অনেক পর্যবেক্ষণ করার পর তার সেবককে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলাম, মুনিজি সবসময় দেবতাদের সঙ্গে এই মুদ্রার মাধ্যমে কথা বলেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলেন না। শুনেছি এক বিরাট সর্পরাজ সারারাত তার পাহারায় থাকেন। কেউ তখন তার কাছে থাকতে পারেন না, এমনকি সেবকও নয়। নর্মদা পরিক্রমা অন্তে তার আশীর্বাদ পাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

বাবা লোকনাথের জীবনীতেও পাওয়া যায় যে তিনি তার পঞ্চভূত দেহকে দেবদেহে উন্নীত করেছিলেন। তার পুণ্যদেহে সর্বদা দেবতাগণ বিরাজ করতেন। শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নিজ সাধন ক্ষমতায় বাবার দেহে এইরূপ দেবতাদের অবস্থান দর্শন করেছিলেন। কোনো উচ্চকোটির সাধকই একজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের দেহের এই অবস্থান বুঝতে সমর্থ হন। সাধারণ মানুষের চোখে এই দৃশ্য ধরা পড়ে না। ব্রহ্মচর্য তপস্যা দ্বারা বাবা লোকনাথ নিজ দেহে যে ওজঃ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তার তেজে তিনি ভূলোক, দ্যুলোক অনায়াসে বিচরণ করতে পারতেন। অনেক উচ্চকোটির মুনি-ঋষিরাও তার কাছে সাধন মার্গের রহস্য জানতে সূক্ষ্মদেহে বারদীতে আসতেন। একজন উর্ধরতা ব্রহ্মচারী এক স্বতন্ত্র পরম ঐশ্বর্যযুক্ত বিরাট পুরুষরূপে জগতের স্রষ্টা পরমাত্মা হন। সমস্ত দেবতারা তখন তাকে দেখার জন্য তাঁর অভিমুখে আসেন। ব্রহ্মচারী নিজ তপস্যায় পৃথিবী ও দ্যুলোক পোষণ করেন এবং তিনিই দ্যাবা পৃথিবী ব্যাপ্ত করতে করতে স্বনিয়মে প্রবর্তিত হচ্ছেন। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন ব্রহ্মে বিচরণশীল একজন প্রকৃত আচরণশীল ব্রহ্মচারী। তার দেহে সর্বদা ওজঃ নিঃসৃত ব্ৰহ্মতেজপুঞ্জ বিরাজ করতো। এইরকম আচরণশীল ব্রহ্মচারী সাধক জগতে বিরল। মুনি-ঋষিগণও এইরকম আচরণশীল ব্রহ্মচারীর পূজা করতেন। বাবা লোকনাথ নিজেই বলতেন, আমি নিত্য, আমার নাশ নেই, আমার শ্রদ্ধও নেই। বাবার যে দেহ সর্বদা দেবগণের সঙ্গে ক্রিড়ায় লিপ্ত থাকত, তা কি সাধারণ মানুষ তার চক্ষে দেখতে সক্ষম? সেই ক্রিড়া একমাত্র সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীই দেখতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি নিজে কৃপা করে যদি কাউকে তার দেবদেহ দর্শন দেন, তবেই সে দর্শন করতে পারে। সাধারণ মানুষ যে তার দেবদেহ সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না, তা কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়।

একদিন বারদী আশ্রমে পুরীর এক পাণ্ডা এসে উপস্থিত হন। তিনি বাবাকে জগন্নাথদেবের প্রসাদ দিয়ে বলেন, এটা পুরীর জগন্নাথদেবের প্রসাদ। আপনি গ্রহণ করুন। বাবা সে প্রসাদ গ্রহণ না করে পাণ্ডাকে কটু কথা বলে তাড়িয়ে দিলেন। আশ্রমভৃত্য ভজলেরাম এই ঘটনায় দুঃখ পেয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি পুরীর জগন্নাথদেবের প্রসাদ কেন নিলে না? সর্বদা ব্রহ্মে বিচরণশীল ও প্রকৃত আচরণশীল ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী যখন ঈশ্বরের সঙ্গে নিত্য যুক্ত, তার দেহেই যখন ঈশ্বর বিরাজ করছেন, তখন জগন্নাথদেবকে ভোগ নিবেদন করলে তো তাকেও সেই ভোগ নিবেদন করা হয়। তার নিজের প্রসাদ নিজে গ্রহণ করবেন কি করে?

আর একটি ঘটনার মাধ্যমেও বাবা তার স্বরূপ প্রকাশ করেছিলেন, যা কেউ ধরতে পারেনি, স্বয়ং বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীও নন।

একদিন কিছু লোক হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে আশ্রমে আসেন এবং সেখানে হরির লুট দিতে চান। বাবা তাদের বলেন, আশ্রমে হরির লুট হবে না। যখন সেই ভক্তবৃন্দ জিজ্ঞাসা করেন, কেন হরির লুট হবে না। তখন বাবা বলেন, তোদের হরির মুখে আমি হাগি, মুতি। বাবার মুখে এই প্রকার কথা শুনে ভক্তেরা খুব দুঃখিত মনে সেখান থেকে প্রস্থান করে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর কাছে এই কথা বলেছিল। বৈষ্ণব বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এই কথা শুনে খুব ব্যথিত হয়েছিলেন এবং বাবার উপর রাগ করেছিলেন। এই কথা যখন বাবার প্রয়াণপূর্বে তিনি বলেন, তখন বাবা তাঁকে বলেন–হরি তো সারা ব্রহ্মাণ্ড জুড়েই আছে। তবে আমি মল-মূত্র যখন ত্যাগ করি, সেটা কি ব্রহ্মাণ্ডের বাইরে করি? সেটা তো সকলে ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেই করি। তবে আমি এই কথা বলে কি দোষ করেছি? আসলে বাবা নিজেকে সর্বজগব্যাপী বিরাট পুরুষরূপে দেখতেন। একজন ব্রহ্মচারীরূপে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডেই তার উপস্থিতি আছে। তিনি নিজেই হরি, নিজেই শিব, নিজেই ব্রহ্মা। বাবার এই স্বরূপের প্রকাশ তো তখন হয়নি তার ভক্তদের কাছে। আজও তা হয়েছে কি না জানি না। সেজন্যই তো বাবা প্রয়াণপূর্বে বলেছেন- আমাকে তোরা চিনলি না রে। আমাকে সবাই রক্তমাংসের মানুষরূপে ভাবে।

.

সমাজসংস্কারক বাবা লোকনাথ

বাবা লোকনাথ নিম্নভূমিতে এসে তার বর্ণময় লীলা বিভূতির মাধ্যমে কেবল যে লোকশিক্ষায় ব্রতী হয়েছিলেন তা নয়। তিনি সমাজসংস্কারের কাজেও অগ্রণী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, এক সুস্থ সবল সমাজই এক শক্তিশালী জাতির গঠন করতে পারে। সেজন্য তার চেষ্টা ছিল কি করে সমাজের মঙ্গল করা যায়। এখানে বাবার বিভিন্ন সমাজমঙ্গল কার্যের উল্লেখ করছি।

একদিন বারদী গ্রামের কয়েকজন কর্মকার বাবার কাছে এসে নিবেদন করল যে তারা তাদের ছেলের বিয়ে দিতে চায়। এজন্য তারা বাবার কাছে বিবাহের একটি ফর্দ করে দেবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলো।

লোকনাথ বাবার কাছে গ্রামের সাধারণ লোকেরা অনেক রকম আবদার নিয়ে আসতো এবং বাবা কখনও তাদের নিরাশ করতেন না। এক্ষেত্রেও বাবা তাদের জন্য একটি বিবাহের ফর্দ করে দিলেন।

সেই ফর্দ পড়ে আগন্তুকদের একজন বললো, বাবা আপনি ফর্দে আতসবাজীর কথা লিখেছেন। কিন্তু আমাদের বিয়েতে বাজির দরকার নেই। একবার আমাদের শরিকের এক ছেলের বিয়েতে বাজি পোড়ানোর সময় আগুন লেগে গাঁয়ের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। তার কথা শুনে বাবা বললেন, বেশ তো, বিয়ের দিন বাজিগুলো এনে এই আশ্রমের সামনে পোড়াবি। তাহলে তো গাঁয়ের কোনো ক্ষতি হবে না। বিয়ের ফর্দতে বাজি ধরার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, গ্রামে যারা বাজি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের জন্য বাজি ব্যবহার করা দরকার। বিয়েতে কিছু লোক আনন্দ করবে আর সমাজের অন্য শ্রেণির তাতে কোনো কাজ হবে না, সেটা ঠিক নয়।

ঠিক একই কারণে বিয়েতে বাজনার ফদও তিনি করেছিলেন। এতে এক কর্মকার বাবাকে ইংরেজি বাজনা আনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু বাবার তাতে সম্মতি ছিল না। তিনি বলেন, একান্তই যদি তাই করতে হয়, তবে বারদী গ্রামে যত গরীব দুঃখী মানুষ আছে তাদের ঘরে চাল, ডাল, মাছ, দই, পান পাঠিয়ে ভোজনের ব্যবস্থা করতে হবে।

বাবা লোকনাথের এই কথা বলার অর্থ, তিনি মনে করেছিলেন ইংরাজি বাজনার জন্য খরচ না করে গ্রামের গরীব ব্রাহ্মণ-দুঃখীদের ভোজন করানো অনেক বেশি মঙ্গলজনক কাজ। গরীব ব্রাহ্মণদের ভোজন করালে স্বয়ং ভগবান দাতাকে আশীর্বাদ করবেন। তার এই কথা বলার আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল, সমাজে সকল শ্রেণির মানুষই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তাই কোনো উৎসবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির লোক যোগদান করলে শ্রেণিগত ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি পায়, সমাজ শক্তিশালী হয়।

একদিন এক ছুতোর মিস্ত্রি বাবা লোকনাথের কাছে এসে বলল, বাবা আমি বড় বিপদে পড়েছি। আপনি আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করুন।

তার কথা শুনে বাবা বললেন–তোমার বিপদটা কি, সেটা না বললে, কী করে রক্ষা করব?

তখন ছুতোর মিস্ত্রি বলল, আমি আমার ছেলেকে সার্ভে স্কুলে ভর্তি করেছি। কিন্তু এখন সেই স্কুলের খরচ চালাতে পারছি না।

লোকনাথবাবা তখন সেই ছুতোর মিস্ত্রির আর্থিক অবস্থার কথা জেনে তাকে বললেন, তোর ছেলেকে স্কুল ছাড়িয়ে কোনো জমিদারি সেরেস্তায় কাজ শেখানোর ব্যবস্থা কর। মিস্ত্রিটি সেই কথা মেনে নিয়ে বলল, বাবা তাই হবে।

লোকনাথবাবা মিস্ত্রির আর্থিক অবস্থা জেনে বুঝেছিলেন যে, তার মতো দিন আনি দিন খাই অবস্থার সংসারের ছেলেকে সার্ভে স্কুলে ভর্তি করে লেখাপড়া শেখানো সম্ভব নয়। তাতে সংসার অচল হয়ে পড়বে এবং আখেরে ছেলেরও তাতে ভালো হবে না। কিন্তু সে যদি কোনো হাতের কাজ শেখে, তবে ভবিষ্যতে সংসারের অবলম্বন হতে পারবে।

একদিন এক ব্যক্তি বারদী আশ্রমে এসে বাবাকে বলে–বাবা, আমি আপনার কৃপাপ্রার্থী। আমাকে আশ্রয় দিয়ে আমার মনের অভিলাষ পূর্ণ করুন।

অন্তর্যামী বাবা লোকনাথ খুব গম্ভীরভাবে তাকে বললেন, তুই নিজের স্ত্রীকেই ভালোবাসতে পারিস না তো আমাকে ভালোবাসবি কি করে? তুই এখান থেকে এখনি চলে যা। যেদিন তোর ওই লক্ষ্মী স্ত্রীকে ভালোবাসতে পারবি, সেদিন আমার কাছে আসবি। লোকটি আশ্রমে আশ্রয়ের জন্য অনেক অনুনয় করলো, কিন্তু বাবা তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন।

লোকটি চলে গেলে কিছু ভক্ত বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্ত্রীর সঙ্গে অসদ্ব্যবহার কি আধ্যাত্ম পথের অন্তরায়?

এই কথার উত্তরে বাবা বললেন–যে লোক তার নিজের সংসারের লোকদের ভালোবাসতে পারে না, সে কখনও ভগবানকে ভালোবাসতে পারে না। অন্তরে সত্ত্বগুণ না জন্মালে ভগবদ্ভক্তি হয় না। অর্থাৎ, যার হৃদয়ে স্বত্ত্বগুণের অভাব থাকে, সে রজঃ ও তমোঃগুণ প্রভাবে অত্যাচারী স্বভাবের হয় এবং তার মধ্যে কখনও ভগবানের প্রতি ভক্তির উদয় হয় না। সমাজে তখন স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে কপট সন্ন্যাস নেবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যেত। সেই প্রবণতা রুখতে বাবা লোকটিকে ওইরূপ আদেশ করেছিলেন।

একবার রজনীকান্তবাবু বারদী আশ্রমে এসে বাবাকে বলেন যে, তার কুলগুরুদের মধ্যে শিষ্য নিয়ে শরিকী গোলযোগ বাধায় তারা কেউ এখন দীক্ষা দিতে চাইছেন না। এখন তিনি কি করবেন?

বাবা লোকনাথ সেই কথা শুনে বললেন, তুই তোর গুরুদের বলগে যা, আপনারা শিষ্যসম্বন্ধীয় গোলমাল মীমাংসা করে আমাকে দীক্ষা দিন। যদি আপনারা গোলমাল মেটাতে না পরেন এবং আমাকে দীক্ষা দিতে না পারেন, তাহলে আমি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কাছে দীক্ষা নেব।

কুলগুরুগণ অনেক সময় মনে করেন, শিষ্যগণ তাদের পৈতৃক সম্পত্তি। তারা শিষ্যগণকে দীক্ষা দিক না দিক, শিষ্যগণ কখনও তাদের ত্যাগ করবে না। গুরুগণ যদি শিষ্যদের মঙ্গল চিন্তা না করেন, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহে লিপ্ত থাকেন, তবে তা অনেক সময় শিষ্যদের বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে। সমাজের এই কুপ্রথা দূর করার জন্য বাবা রজনীকান্তবাবুকে এইরকম উপদেশ দিয়েছিলেন। গুরু যখন শিষ্যের মঙ্গল কামনা ছেড়ে আত্মবিষয়ে মগ্ন হন, তখন গুরু শিষ্যের। বন্ধন শিথিল হয়ে যায় এবং তা সমাজের পক্ষে কল্যাণকর হয় না। বাবা লোকনাথ সমাজের এই ব্যাধির কথা চিন্তা করেই রজনীকান্তবাবুকে যথোপযুক্ত উপদেশ দিয়েছিলেন।

বাবার কাছে যখন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যধি থেকে মুক্তিলাভ হেতু আসতে থাকেন, তখন বাবা আশ্রমে এক অন্নসত্ৰ খোলেন। বাবা লোকনাথের বারদী আশ্রমের মহাপ্রসাদ খেয়ে ও বাবার অসীম করুণায় বহু মানুষ দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পায়। এইভাবে বাবা সমাজ থেকে রোগমুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন।

.

দেহরোগের ডাক্তার সিদ্ধযোগী বাবা লোকনাথ

একদিন বারদী আশ্রমে বাবা লোকনাথ সমাধিস্থ। তার দেহ নিস্পন্দ, স্থানুর মতো। চোখ পলকহীন। দেহে প্রাণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সমগ্র পঞ্চভূত দেহটিতে এক দীপ্ত আভা বিরাজ করছে। সমবেত ভক্তগণ আশ্চর্যভাবে একদৃষ্টে বাবার দেহ অবলোকন করছেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সহসা দেহটি কেঁপে উঠলো। সমবেত ভক্তগণের উৎকণ্ঠা বিজড়িত মুখগুলি দেখে স্মিত হেসে বাবা বললেন, একশো সওয়াশো বছর পরে হিমালয়ের নির্জন গুহা ছেড়ে তোদের এই হট্টগোলের মাঝে শ্মশানভূমিতে কোন্ দুঃখে আমি পড়ে আছি রে! তোদের জন্য যে আমার প্রাণটা কেমন করে ওঠে। ইচ্ছা করে তোরা যে যেখানে আছিস, সবাইকে এই বুকের মধ্যে ধরে রাখি। তোরা তো আমার অন্তরের ভাব বুঝতে পারিস না। তাই এখানে পরের মতো আসিস। বাবার কাছে ছেলে যেমন দ্বিধাহীন হয়ে আসে, তেমন করে তোরা আসতে পারিস কই?

ভক্তদের মধ্যে থেকে তখন একজন বললো, তুমি তো আমাদের তোমার মনের মতো করে নিতে পারো বাবা। বাবা বললেন, সে তোদের মনের ভুল। যা কিছু হয়, সব তোদের ইচ্ছায়। তোদের ইচ্ছা হলেই, আমার ইচ্ছা হয়। তোদের ইচ্ছা যখন আমার উপর ক্রিয়া করে, তখন আমার ভিতরে কি যেন একটা আলগা হয়ে যায় আর সঙ্গে সঙ্গে কোথাও কিছু একটা হয়ে যায়। দোষ তোদের নয়, দোষ আমার।

প্রথম প্রথম সাধ হয়েছিল, সত্যি আমি প্রকৃত ব্রাহ্মণ হয়েছি কি না পরখ করে দেখবো। ব্রহ্মকে জানলে সে নিজেই নাকি ব্রহ্ম হয়ে যায়। তার বাক্য অমোঘ হয়, তাঁর কথায় মৃতও জীবন ফিরে পায়। নিজের সম্বন্ধে সেটা যাচাই করতে গিয়ে একটা ঝোঁক পেয়ে বসেছিল। নিজেই পরখ করে দেখতে গেলাম আমি দুরারোগ্য রোগীর রোগ সারাতে পারি কি না! নিজের সেই দোষে এখন আমায় সবাই ছিঁড়ে খায়। কেউ বলে পরমায়ু দাও, সুখ দাও, ঐশ্বর্য দাও, দেহের রোগ সারিয়ে দাও, গাছে ফল ফলিয়ে দাও, এ দাও, ও দাও। কিন্তু যা পেলে সব চাওয়া মিটে যায় সেই আসল ধনটি বিলিয়ে দেবার জন্য পথ চেয়ে এত বছর বসে আছি। কেউ সেই ধনটি চায় না রে, কেউ চায় না।

মহাযোগী বাবা লোকনাথের কাছে ভক্তদের চাওয়ার কোনো শেষ ছিল না। ভক্তদের এইসব চাওয়া ছিল পার্থিব জগতের চাওয়া। তাদের দেহ সুখ, ঐশ্বর্যের জন্য চাওয়া। কেউ তার কাছে নিত্যবস্তু চাইত না, যা পেলে এই দেহটাই মুক্ত হয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ছিল। কিন্তু বারদীর আশ্ৰম ভক্ত সমাগমে মুখরিত থাকত প্রধানতঃ রোগ নিরাময়ের আশায়। বারদী আশ্রমের মাটি, পরিবেশ, প্রসাদ, বাবার স্পর্শ, বাবার কৃপাদৃষ্টির মাধ্যমে অগণিত ভক্ত দেহরোগ মুক্ত হয়েছে। এখানে সেইরকম কিছু ঘটনার উল্লেখ করা হলো–

ঢাকা, বিক্রমপুর নিবাসী শ্ৰীমদনমোহন চক্রবর্তী একদিন তার মাকে নিয়ে বারদী আশ্রমে উপস্থিত হলেন। তিনি বাবাকে দর্শন করে বললেন, বাবা, আমি প্রতিদিন ফুল, বেলপাতা ও পবিত্র জল দিয়ে আমার মায়ের চরণ পূজা করি। তার পায়ের যে জায়গায় আমি ফুল, বেলপাতা দিই সেই জায়গাটা কিছুদিন হল কালো হয়ে গেছে। সেখানে পচন ধরেছে। তাঁর জ্বরও হয়েছে। কেন তার এমন হল বুঝতে পারছি না। কিভাবে মা সেরে উঠবে তা জানতেই আপনার কাছে এসেছি।

মদনবাবুর মায়ের পায়ে চর্মরোগ দেখা দিয়েছিল। বাবা তার কথা শুনে বললেন, আশ্রমের আঙিনায় ওই যে একটা বেলগাছ আছে, তার তলায় তোর মার থাকার জন্য একটা চালা করে দে। তোর মা কে বলবি, তার যখন যা খেতে ইচ্ছা হয়, কোনো দ্বিধা না করে যেন সঙ্গে সঙ্গে আমায় জানায়। তুই তোর মার কাছে কাছে থেকে নজর রাখবি।

এই নির্দেশ মতো মদনমোহনবাবু বেলতলাতে মা’র থাকার জায়গা করে দিলেন। তার মা যখন যা খেতে চাইতেন, তিনি সে কথা বাবাকে নিবেদন করতেন এবং বাবা তার যথাযথ ব্যবস্থা করতেন। এইভাবে কিছুদিন যাবার পর দেখা গেল তার মায়ের পায়ের ঘা সম্পূর্ণ সেরে গেছে। পায়ের উপর কালো দাগ আর নেই। তার জ্বরও নেই। মদনমোহনবাবু এই দেখে বাবাকে সব জানালেন। বাবা বললেন, তোর মাকে এখন বাড়ি নিয়ে যা। যথাসাধ্য মার ইচ্ছা পূরণ করবি। তাহলেই মার পূজা করা হবে।

যে বেলগাছতলার কথা এখানে বলা হয়েছে, বাবা নিত্য এই বেলগাছতলায় এসে বসতেন। তার মতো মহাপুরুষের স্পর্শে এই স্থানে এক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন চিকণা সর্বদা বিরাজ করত। সেই চিকণার স্পর্শে ও প্রভাবে মদনমোহন বাবুর মা আরোগ্য লাভ করেছিলেন।

শ্রী সীতানাথ দাস কলকাতার হাটখোলা নিবাসী একজন ধনী ব্যক্তি ছিলেন। সংসারের সুখ, ঐশ্বর্য, অর্থ কোনোকিছুরই তার অভাব ছিল না। কিন্তু তার জীবনে এক বিরাট দুঃখ নেমে এলো। দীর্ঘকাল বাত রোগে ভুগে তিনি পঙ্গু হয়ে গেলেন। আর তার চলৎশক্তি রইল না। কলকাতায় অনেক বড়ো বড়ো ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়ে চিকিৎসা করালেন, কিন্তু কোনো ফল হল না। লোকমুখে তিনি বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নাম শুনেছিলেন। তিনি শুনেছিলেন যে, বারদীর ব্রহ্মচারী একজন যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ এবং তাঁর সংস্পর্শে এসে তার কৃপায় অনেকে রোগমুক্ত হয়েছেন। তাঁর অলৌকিক শক্তি আছে। যখন সব প্রচেষ্টায় বিফল হয়ে তিনি শয্যা নিলেন, তখন আত্মীয়স্বজন-দাসদাসী নিয়ে একটা বজরায় বারদীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

একদিন সীতানাথবাবুর বজরা বারদীর ঘাটে উপস্থিত হলেন। আত্মীয়রা তাকে ধরাধরি করে বারদীর আশ্রমে নিয়ে হাজির করলো। তাকে একটা দড়ির খাট পেতে শুইয়ে দেওয়া হলে তিনি বাকি লোকজনকে বজরায় চলে যেতে বললেন। সীতানাথবাবু মনে মনে ভাবলেন, যখন মহাপুরুষের শরণাপন্ন হয়েছি, তখন এই আশ্রমের আঙিনাতেই পড়ে থাকবো। হয় তাঁর কৃপায় রোগমুক্ত হবে নতুবা তার সামনেই মরবো।

দু-দিন দু-রাত সীতানাথবাবু এইভাবেই কাটালেন। বৃষ্টির জল, রোদের তাপ সব সহ্য করে একইভাবে পড়ে রইলেন। এই দু-দিনের মধ্যে কেউ তার কথা বাবাকে বলেনি এবং বাবাও তার সম্বন্ধে কোনো খোঁজ করেননি। কিন্তু তাতে সীতানাথ বাবুর মনোবল দুর্বল হয়নি। তিনি তার সংকল্পে দৃঢ় রইলেন।

দুদিন পর সীতানাথবাবুর আত্মীয়স্বজন ও দাসদাসীরা এসে তাকে এই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে খুব দুঃখ পেল এবং তাঁকে বজরায় ফিরে যেতে অনুরোধ করলো। সীতানাথবাবু তাদের বললেন, এখানে আশ্রমে আমার প্রাণ যায় সেও ভালো, তবু আমি বজরায় ফিরে যাব না। তার দৃঢ় সংকল্পের কথা শুনে আত্মীয়স্বজন ও অনুচরেরা বজরায় ফিরে গেল।

তৃতীয়দিন ভোরবেলায় সহসা বাবার প্রাণ সীতানাথবাবুর জন্য কেঁদে উঠলো। সূর্যোদয়ের পরে বাবা তার ঘর থেকে বেরিয়ে সীতানাথবাবুর কাছে গিয়ে বললেন, সীতানাথ তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। নে, এবার উঠে দাঁড়া। এই বলে বাবা যেমনি সীতানাথ বাবুকে স্পর্শ করলেন, অমনি তার শরীরে এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হল এবং দীর্ঘকালের বাতপঙ্গু সীতানাথবাবু শরীরে শক্তি ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। অমিত যোগশক্তির অধিকারী বাবা লোকনাথ তাঁর এক স্পর্শে চলৎশক্তিহীন এক পঙ্গুকে মুহূর্তে সব ব্যাধি মুক্ত করে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

সীতানাথবাবুর দু চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হল তার অন্তর। বাক্যরহিত হয়ে তিনি বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়লেন। বাবা তাকে বললেন, সীতানাথ, তুই তোর দেহ, মন-প্রাণ, স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়স্বজন, দাসদাসী এমনকি তোর সব বিষয়সম্পত্তি পর্যন্ত আমাকে অর্পণ করে আমারই উঠানে বৃষ্টিতে ভিজেছিস ও রোদে পুড়েছিস। তাই তোর জন্য আমার প্রাণ কেঁদেছে। এখন তুই সুস্থ সবল হয়েছিস। এবার বাড়ি ফিরে যা। (সীতানাথবাবু সর্বস্ব বাবার চরণে অর্পণ করে দিয়েছিলেন।)।

এই ঘটনা বাবা লোকনাথের ভক্তদের বিদিত করে যে, তার কেবলমাত্র একটু স্পর্শে এই পঞ্চভূত দেহের সমস্ত রোগ নিরাময় হয়ে রোগী শক্তিলাভ করতে পারে। এমন ভবরোগী তিনি পাননি যাকে এক স্পর্শে ভবরোগ মুক্ত করে ব্রহ্মলোকের সন্ধান দিতে পারেন। তিনি বলতেন, ভবরোগের বৈদ্য আমি, সে রোগ নিয়ে কেউ আসে না।

সেই সময় বিভূপদ কীর্তি নামে এক ব্যক্তি অবিভক্ত উত্তরবঙ্গের পার্বতীপুর স্টেশনে রেলকর্মচারী ছিলেন। এক দুর্যোগপূর্ণ সন্ধ্যায় তিনি রেলের বিশ্রামাগারে ঢুকতেই দেখেন একজন স্ট্রেচার বাহিত সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধের পাশে একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি চিন্তান্বিত মুখে বসে আছেন। বিভূপদবাবু ভিতরে ঢুকে বসতেই সেই ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি এইখানে থাকেন?

বিভুপদবাবু তাঁকে জানালেন যে, তিনি এই স্টেশনেরই রেলকর্মচারী। সেই ভদ্রলোক তখন তাকে বললেন, আমরা বড়ো মুশকিলে পড়েছি। আমার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্থ, অক্ষম। গরম জলের ব্যাগ ছাড়া তাঁর এক দণ্ড চলে না। হঠাৎ দেখছি, গরম জলের ব্যাগটা ফুটো হয়ে গেছে। আমরা জলপাইগুড়ি থেকে আসছি। বারদী যাব। সঙ্গে তোকজন আছে, কিন্তু তারা এখানকার কিছু চেনে না। এখানে গরম জলের ব্যাগ কোথায় পাবো?

তার কথা শুনে বিভূপদবাবু বললেন যে, তাঁর বাবা সেখানে হাসপাতালের চার্জে আছেন। স্টেশন থেকে লোক পাঠিয়ে তিনি গরম জলের ব্যাগ আনিয়ে দেবেন। তিনি একজন কর্মচারীকে হাসপাতালে ব্যাগ আনতে পাঠালেন।

পক্ষাঘাতগ্রস্থ ব্যক্তির পুত্র তখন বলেন, আমরা ঢাকা হয়ে বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে যাবো। বিভূপদবাবু বললেন, তার নাম শুনেছি, কিন্তু তিনি কি এখনও দেহে আছেন? একথা শুনে পক্ষাঘাতগ্রস্থ ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে বললেন, তিনি দেহে থাকুন বা না থাকুন, তাঁকে দেখা যায়, তার সঙ্গে কথাও বলা যায়। এইমাত্র তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। এইমাত্র তোমরা যখন কথা বলছিলে, তিনি আমাকে দেখা দিয়ে বলে গেলেন, তোমরা যাকে ব্যাগ আনতে পাঠিয়েছ, সে শূন্য হাতে ফিরে আসছে। আমি ব্যাগের ছিদ্র বন্ধ করে দিয়েছি। ঢাকা পৌঁছনো পর্যন্ত ওতেই কাজ চলে যাবে।

বৃদ্ধের কথায় বিভূপদবাবু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বৃদ্ধের পুত্র তাদের ব্যাগটি এনে দেখলেন সেখানে কোনো ছিদ্র নেই। এই অলৌকিক কাণ্ড দেখে বিভূপদবাবু বিমূঢ় হয়ে গেলেন। তাদের সামনেই ব্রহ্মচারী বাবা এসে বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে ব্যাগের ছিদ্র বন্ধ করে দিয়ে গেলেন, অথচ সেই বৃদ্ধ ভিন্ন কেউ তাকে দেখতে পেলেন না। এরপর হাসপাতাল থেকে লোকটি এসে বলল যে, হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে ব্যাগ আনতে পারেনি। তখন বিভূপদবাবু বৃদ্ধের পুত্রের কাছে জানতে চাইলেন, কি করে তার বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্থ হলেন এবং কেন তারা এই পক্ষাঘাতগ্রস্থ মুমূর্ষ ব্যক্তিকে নিয়ে এতদূর বারদী আশ্রমে যাচ্ছেন।

বৃদ্ধের পুত্র তখন বললো, আমার পিতা বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কৃপাধন্য। তিনি অনেকবার ব্রহ্মচারী বাবার কৃপালাভ করেছেন। একদিন রাতে আমাদের কাছারি ঘরে ডাকাত পড়লো। অন্ধকারের মধ্যে বাবা ঘরের দরজা খুলে যেই বেরিয়েছে, তার মাথার উপর জোর লাঠির আঘাত পড়লো। সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে তিনি নিচে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালেন। এরপর জ্ঞান ফেরার পর থেকেই তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়েন। এইভাবে উনিশ দিন উনি শয্যাশায়ী ছিলেন। এই সময় প্রতিদিন লক্ষ্য করতাম ছায়ার মতো ব্রহ্মচারী বাবা বাবার কাছে আসেন, আবার ছায়ার মতোই সরে যান। আমি তাকে দেখতে পেলেই ঘর ছেড়ে চলে যেতাম। উনিশ দিন পর হঠাৎ একদিন বাবার আচ্ছন্নভাব কেটে গেল। তার গলা দিয়ে স্বাভাবিক স্বর বেরোলো। আমি তাকে জানালাম যে, ব্রহ্মচারী বাবার কৃপায় তিনি ভালো হয়ে উঠেছেন। তাকে এও জানালাম যে, প্রতিদিন ছায়ার মতো ব্রহ্মচারী বাবা তার কাছে আসতেন। বাবা আমার কথা শুনে তখনই বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে যেতে চাইলেন। বাবার ইচ্ছানুযায়ী আমি বাবার ভগ্নদেহ নিয়ে বারদী যেতে রাজি হলাম না। তিনি তখন একজন ভৃত্যকে নিয়ে বারদী আশ্রমে চলে গেলেন।

আশ্রমে যখন বাবা পৌঁছলেন, ব্রহ্মচারী বাবা তখন ছিলেন না। তিনি আগের দিন কোথায় গেছেন, কেউ জানে না। পালকির মধ্যে শুয়ে অসহ্য গরমে বাবা দিনপাত করতে লাগলেন। আমি লোকজন, ডাক্তার, ঔষধ নিয়ে বারদী পৌঁছোলাম, তাকে বাড়ি ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি ব্রহ্মচারী বাবার দর্শন না করে বাড়ি ফিরবেন না। আশ্রমবাসীরা তাকে আশ্রমের ঘরে থাকার জন্য অনুরোধ করলেও বাবা গাছতলাতে থাকতে চাইলেন। তখন আমার লোকেরা গাছতলায় তাকে মশারি টানিয়ে বিছানা করে দিলো। বাবা আমায় লোকজন নিয়ে চলে যেতে বললেন, আমি চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরে গেলাম। তিনি আমার আনা। কোনো ঔষধ খেলেন না এবং সঙ্গেও রাখলেন না। এইভাবে তিন দিন কেটে গেল। এই তিন দিনে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগ ও ভাঙ্গা হাড়ের বেদনা সব ভুলে গেলেন। তিনি এক পরম আত্মিক তৃপ্তি লাভ করলেন। তার সমস্ত কামনা বাসনা মন থেকে অন্তর্হিত হলো।

চতুর্থদিনে ব্রহ্মচারী বাবা আশ্রমে এলেন। আমি তার কাছে সব নিবেদন করে অনুরোধ করলাম, তিনি যেন একটি বার বাবার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি না দর্শন দেওয়া পর্যন্ত বাবা জলস্পর্শও করতে রাজি নন। ব্রহ্মচারী বাবা আমার কোনো কথা গ্রাহ্য তো করলেনই না, উল্টে আমাকে কড়া ভাষায় বললেন, দেশ-দেশান্তর থেকে কত রোগী আসে, আমি কি তাদের ডেকে আনি? তোর বাবা জমিদার বলে কি তাকে খাতির করে ডেকে আনতে হবে? খাওয়া না খাওয়া, এখানে আসা না আসা তার ইচ্ছা। আমি কেন বলতে যাব? আমি এই কথা বাবাকে জানিয়ে তাকে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু বাবা বললেন, ফিরে যাব বলে তো আসিনি। সমাদর পাবার আশা নিয়েও আসিনি। যে জন্য এসেছি, তা আমি পেয়ে গেছি। প্রতি মুহূর্তে নুতন করে পাচ্ছি। গতকাল রাতে আমার মশারির গা ঘেঁষে একটা কালো ঘেয়ো কুকুর এসে শুলো। আমার তাকে তাড়িয়ে দেবার ইচ্ছা হল না। আমি মশারির বাইরে হাত বাড়িয়ে আমার কম্বল দিয়ে তাকে ঢেকে দিলাম। এক অব্যক্ত আনন্দে আমার মন ভরে উঠলো। তখন কুকুরের গা থেকে এক সুন্দর চন্দনের গন্ধ আসতে লাগলো। আমার কম্বলে এখনও সেই গন্ধ আছে। আমি সেই কুকুরটার স্পর্শে দয়াল ব্রহ্মচারী বাবার স্পর্শই পেয়েছি। তিনি বাড়ি ফিরলেন না।

এরপর একদিন আমি তাকে বললাম যে, ডাক্তার বলেছে, আর দেরি করলে তোমার বুকের হাড় জোড়া লাগবে না। মাথার ক্ষতস্থান বিষিয়ে প্রাণসংশয় হবে। ব্রহ্মচারী বাবার দর্শন পেলেই তুমি ফিরে চলো। তিনি যদি তোমার কাছে না আসতে চান, আমি লোক দিয়ে তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব। বাবা বললেন, আমাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা কোরো না। সময় হলে আমি নিজেই বাড়ি ফিরে যাব। আপাততঃ আমি এখানেই থাকব। দর্শন দেবার হয় তিনি দেবেন, না দেবার হয় দেবেন না। আমি তখন বাবাকে বললাম, তবে তোমার রোগ আর সারবে না।

ইতিমধ্যে আমার বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন আমার সমালোচনা শুরু করলেন এই বলে যে আমাদের বিপুল অর্থ থাকা সত্তেও আমি বাবার ভাল চিকিৎসা করছি না। রীতিমতো বিরক্ত হয়ে আমি আবার বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কাছে গেলাম। তাকে আমার বাবার সঙ্গে একটি বারের জন্য দর্শন দিতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা লোকনাথ বললেন–জানি এ রোগ সারবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ডাক্তার আনলেও এ রোগ সারবে না। এ রোগ সারানো শিবের অসাধ্য। এ কথা শুনে আমি বললাম, তবে আমি এখন কি করবো বলুন। তখন বাবা বললেন, তুই কিছুই করবি না। এই কথা বলে তিনি আমার সঙ্গে বাবার কাছে এলেন। তিনি যখন আসন ঘর থেকে উঠে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে আসছেন, তখন আমার মনে হচ্ছে তার পা মাটি স্পর্শ করছে না, অথচ তিনি হাঁটছেন। ব্রহ্মচারী বাবা বাবার বিছানার পাশে এসে প্রথমে নীরবে দাঁড়ালেন। তারপর তার ডান হাতটি বাড়িয়ে বাবার মাথা স্পর্শ করে বললেন, আর তোকে শুয়ে থাকতে হবে না। উঠে বস। তোর সমস্ত ব্যাধি সেরে গেছে। কোনো ওষুধপত্রের দরকার হবে না। উঠে দাঁড়াতে একটু কষ্ট হবে। আমার হাত শক্ত করে ধরে আমার সঙ্গে বেলতলা পর্যন্ত আয়। বাবা, ব্রহ্মচারী বাবার কথায় যন্ত্রচালিতের মতো উঠে বসলেন। কে বলবে, তিনি একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী, কতদিন অনাহারে এখানে পড়ে রয়েছেন। প্রথমে বাবা ব্রহ্মচারী বাবার চরণে লুটিয়ে পড়লেন। তারপর তার হাত ধরে হেঁটে বেলতলায় এলেন। এই ঘটনার পরে মাত্র কয়েকদিন ব্রহ্মচারী বাবা এ জগতে নিজ দেহে ছিলেন। এরই মধ্যে একদিন বাবাকে ডেকে বলেছিলেন, তোর প্রারব্ধ কেটে গেছে। তবে এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘদিন পরে এই রোগ আবার হবে। তখন বিচলিত না হয়ে এইখানে এসে এমনি করে দিনকতক অবস্থান করবি। তাতেই তোর সব সঞ্চিত কর্মের ভোগ কেটে যাবে। আমার দেড়শো বছরের দেহটাকে আমি এবার ত্যাগ করবো। কিন্তু আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো। যখনই ডাকবি, তখনই আমার সাড়া পাবি। আমি যে নেই, এ কথাটা মনে আমল দিবি না। আশ্রমের ভূমি শয্যায় তোকে যে ভাবটি দিয়েছিলাম, সেটি তখন স্মরণ করবি। দেহমন যখন আমাকে সমর্পণ করেছিস, তখন পাপ-পুণ্যের কোনো বোধ মনে আসতে দিবি না।

এখন বাবার আবার সেই রোগ দেখা দিয়েছে। আমরা সেজন্য বারদী যাচ্ছি ব্রহ্মচারী বাবার নির্দেশানুসারে কাজ করতে। আমাদের মনে পূর্ণ বিশ্বাস ব্রহ্মচারী বাবা বর্তমানে দেহে না থাকলেও আমার বাবা সেখানে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।

পার্বতীপুর স্টেশনে বিভূপদবাবু বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যে অপূর্ব অলৌকিক কীর্তির কথা শুনলেন, তাতে তিনি ভাবে তন্ময় হয়ে গেলেন। এই লীলার মাধ্যমে বাবা ভক্তদের অনেক বার্তা দিয়ে গেছেন।

 (১) ভক্তদের একাগ্র ডাক বাবার মনে ভক্তের জন্য কৃপাবর্ষণ করে। সেই কৃপায় ভক্ত ধন্য হয়। রোগমুক্ত হয়।

(2) বাবা নিত্য, সর্বাবস্থায়, সর্বস্থানে তিনি বিরাজিত। যে স্থান থেকেই তাকে ডাকা হোক না কেন, ভক্তের ডাকে যদি আকুলতা থাকে, তিনি সবার অলক্ষ্যে সাড়া দেবেন।

(৩) ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ যে স্থানে অবস্থান করেন, সে স্থান উচ্চ চিৎকণা সমৃদ্ধ হয় এবং তার স্পর্শে যে আসে, সেই উপকৃত হয়।

(৪) বাবার কৃপা ভক্তের প্রারব্ধভোগ ও সঞ্চিত কর্মভোগ কাটাতে সাহায্য করে। তিনি সেই পথের সন্ধান দিতে পারেন যাতে ভক্ত প্রারব্ধভোগ মুক্ত হতে পারেন।

(৫) তার স্পর্শে ভক্তের শরীরে এমন শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটে যে সেখানে কোনো রোগ আর থাকতে পারে না।

বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের ১২৭ বছর পরেও এই সব তত্ত্ব ধ্রুবসত্য। তার অগণিত ভক্ত আজও তার কৃপা লাভ করে। মহাপ্রয়াণের পরেও বাবা ভক্তকে রোগমুক্ত করেছেন, এমন একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একজন অকৃত্রিম একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন ডাঃ নিশিকান্ত বসু। তার একান্ত কাতর প্রার্থনায় তার অনেক রোগীকে বাবা সুস্থ করে দিয়েছেন।

একবার নাগ পরিবারের শ্রীচৈতন্য নাগের স্ত্রী অনেকদিন ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগতে থাকেন। তখনকার দিনে ম্যালেরিয়া ভয়ানক রোগ ছিল। নিশিকান্তবাবু অনেক চিকিৎসা করলেন, কিন্তু কোনো ফল হল না। একদিন রাতে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল, হার্টের ক্রিয়া বন্ধ হবার উপক্রম হলো। নিশিকান্তবাবু তখন একমনে লোকনাথবাবাকে স্মরণ করতে লাগলেন।

সেই রাতে রোগিনী তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় স্বপ্ন দেখলেন, লোকনাথবাবা আশ্রম থেকে এসে তার মাথার কাছে খাটে বসে বললেন, এই যে আমি এসেছি। তুই ভয় করিস কেন? এরপর রোগিনী সব রোগ সেরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। চলৎশক্তিহীনা রোগিনী বিছানায় বসে সবাইকে তার অভিজ্ঞতার কথা বললেন। এও বললেন যে, সেই সময় সারাটা ঘর এক মিষ্টি চন্দনের গন্ধে ভরপুর হয়ে উঠেছিল। পরদিন সেই রোগিনী বারদী আশ্রমে গিয়ে প্রসাদ খেয়েছিলেন।

বারদীর জমিদার আনন্দকান্তি নাগ ছিলেন বাবালোকনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত ও কৃপাধন্য। তাঁর পৌত্র প্রেমরঞ্জন নাগের স্ত্রী রেণুকণাদেবী ছিলেন লোকনাথগতপ্রাণা। বাবা লোকনাথের প্রতি তার অগাধ ভক্তি বিশ্বাস ছিল। সারাজীবন তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার সেবা, পূজা, ধ্যানে অতিবাহিত করেন। তার মনে একটি দুঃখ ছিল যে তিনি কখনও বাবার দর্শন পাননি। রেণুকণাদেবীর গুরুদেব ছিলেন ডাঃ নিশিকান্ত বসু। তার কাছ থেকেই তিনি বাবার লোকমাহাত্ম্য শুনেছেন।

১৯৮৮ সালের শেষের দিকে হঠাৎ রেণুকণাদেবী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। একদিন তিনি অচেতন হয়ে পড়লে তার শরীর নীলবর্ণ হয়ে যায়। তখন তার কন্যা ও জামাতা লোকনাথবাবা ও ডঃ নিশিকান্ত বসুর দুখানি ফটো তার মার কাছে রেখে দেন। বাড়ির সকলে লোকনাথ বাবাকে ব্যাকুলভাবে স্মরণ করে রেণুকণাদেবীর আরোগ্য কামনা করতে থাকেন। এইভাবে কয়েকদিন গত হয়।

হঠাৎ একদিন রেণুকণাদেবী চেতনা ফিরে পেয়ে বিছানায় উঠে বসে বাবা বাবা বলে কাঁদতে থাকেন। আবার পরমুহূর্তেই অচেতন হয়ে পড়েন ও তার দেহটি বিছানায় ঢলে পড়ে। বাড়ির লোকেরা ডাক্তার ডেকে আনেন।

ডাক্তার এসে রোগিণীকে পরীক্ষা করে বলেন, এ হচ্ছে ডিপ কোমা। অক্সিজেন ও প্রাণরক্ষার ঔষধ দেওয়া হলো। কিন্তু রোগিণীর চেতনা ফিরে এলো না। ডাক্তার জানালেন এই কোমা অবস্থার মধ্যেই রোগিণী প্রাণত্যাগ করতে পারেন।

ডাক্তারের এই বার্তা শুনে রেণুকণাদেবীর কন্যা প্রতিমা শোকে মূহ্যমান হয়ে লোকনাথবাবার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাকুলভাবে আর্তি জানাতে থাকেন, তাঁর মা-কে চৈতন্য ফিরিয়ে দেবার জন্য। আত্মীয়স্বজনেরা একে একে এসে অচৈতন্য রেণুকণাদেবীকে দেখে বাবা লোকনাথের কাছে তার প্রাণভিক্ষা করতে থাকেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় দিনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রেণুকণাদেবী কন্যা প্রতিমাকে ডাকতে ডাকতে সুস্থ অবস্থায় বিছানায় উঠে বসেন। কন্যাকে তার পাশে কাগজ কলম নিয়ে এসে বসতে বলেন এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের তিনি কাছে ডেকে নেন।

এরপর তিনি বলতে থাকেন, আমি দেহে এসেছি কেবল তোমাদের এই কথা বলতে যে বাবা আছেন। তিনি সর্বদাই আমাদের সাথে সাথে আছেন। মেয়েকে তিনি বলেন, জানিস আমি কেন তোদের কাছে নেমে এলাম? তুই বাবার কাছে কেঁদে বলেছিলি, আমি বিনা চিকিৎসায় মরে যাচ্ছি। বাবা তাই আমাকে একদিনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন চিকিৎসা করাবার জন্য। তবে চিকিৎসায় আমি কয়েকদিন মাত্র থাকব।

প্রতিমাদেবী মা-র কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যান। মায়ের অচেতন অবস্থায় তিনি যথার্থই বাবার ফটোর সামনে কাঁদতে কাঁদতে আকুলভাবে প্রার্থনা

জানিয়েছিলেন, মা যেন এভাবে বিনাচিকিৎসায় প্রাণ না হারান। মার অজ্ঞান অবস্থার যে কথা তিনি বাবা লোকনাথকে জানিয়েছিলেন, সে কথা মা কি করে জানলেন? এ সবই বাবা লোকনাথের অলৌকিক লীলা। এমন সময় রেণুকণাদেবীর অতি স্নেহের পৌত্র বাদশা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা দিদু, তুমি কি বাবা লোকনাথকে দর্শন করেছ? রেণুকণাদেবী তখন তাদের বলতে আরম্ভ করলেন তার পারত্রিক ভ্রমণের অলৌকিক কাহিনী। তিনি বললেন, আমি দেখলাম আমার দেহ থেকে আমি বেরিয়ে এলাম। তারপর আমার আমি ঊর্ধদিকে উঠতে লাগলাম। তখন আমার এ দেহ ভেঙ্গে দু-খণ্ড হয়ে গেছে। আমি ঊর্ধ্বে উঠতে উঠতে নীল আকাশ ভেদ করে আরও উপরে উঠলাম। যেখান থেকে এই পৃথিবীটাকে একটা ছোট বস্তুর মতো মনে হলো। নিচের পৃথিবীটাকে তখন মনে হল কি নোংরা ও দুঃখে ভরা। আমি আরও উর্ধে উঠে এক জায়গায় দেখলাম ভগবান শিব বসে আছেন ধ্যানাসনে আর তার পাশেই বসে আছেন বাবা লোকনাথ। আমাকে দেখে বাবা আসন ছেড়ে উঠে এলেন এবং অসীম করুণায় তার বক্ষের মধ্যে আমাকে টেনে নিলেন। আমার মাথা ও মুখে তার কৃপাহস্ত বুলিয়ে দিলেন। যখন রেণুকণাদেবী এই আশ্চর্য অলৌকিক কাহিনী বিবৃত করছেন, তখন তার দেহ এক অপূর্ব আভায় দীপ্তমান হয়ে উঠেছে। তিনি তার ডান হাত প্রসারিত করে তালুর মধ্যে এক গোলাপী রঙের বৃত্ত দেখালেন। এমন রক্তিম আভা কেউ কখনও তার অঙ্গে দেখেনি। তিনি বললেন, এটা আমার হাত নয়। এ হাত বাবার। এসো, এই হাত তোমরা স্পর্শ করো। তাঁর আশীর্বাদ মাথায় নাও। আমি বাবার কাছ থেকে তোমাদের সকলের জন্য এক দিব্যবাণী নিয়ে এসেছি। আমার নিম্ন অঙ্গের কোনো অনুভূতি নেই। আমার শক্তি কেবল উর্ধাঙ্গে এবং এই হাতের মধ্যে আছে। এই হাতটি বাবার কৃপাহস্ত। বাবা আমাকে তোদের কাছে পাঠিয়েছে এই অভয়বাণী শোনাবার জন্য যে, তিনি আছেন, আজও জীবন্ত হয়ে আছেন। রেণুকণাদেবীর এই কথা শোনামাত্র আশেপাশের লোকজন তাকে দর্শন করার জন্য আসতে লাগলো। তিনি সকলকে ডান হাত প্রসারিত করে আশীর্বাদ করলেন। তিনি সকলকে বলতে লাগলেন, সংসারে থেকে সংসার জীবনযাপন করেও কেমন করে ঈশ্বরলাভ করতে পারে। তার কথা শুনে সকলের মনে হচ্ছিল, এই কথা তিনি বলছেন না। তার মধ্য দিয়ে ব্রহ্মচারী বাবা বলছেন।

ডাক্তারেরা এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে খেই হারিয়ে ফেলে যে, এইরকম ডিপ কোমা অবস্থা থেকে একজন কীভাবে এই অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। বিজ্ঞানকে মিথ্যা করে দিয়ে লোকনাথবাবার মহিমা দেখে তারা অভিভূত হয়ে পড়েন। লৌকিক বস্তুজগতের উপরে যে একটা অলৌকিক আধ্যাত্ম জগৎ আছে, তার কথা অনেকেই মানেন না। কোনো বিজ্ঞান এখনও তার রহস্য ভেদ করতে সমর্থ হয়নি। ডাক্তারেরা আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে কিভাবে রেণুকণাদেবীকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়। রেণুকণাদেবী তাদের বলেন, বাবা আমাকে যতদিন এখানে রাখবেন, ততদিনই আমি থাকব। তার বেশি তোমরা আমাকে রাখতে পারবে না। মাঝে মাঝে তিনি বাবার সান্নিধ্যবিহনে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এইসব লৌকিক চিকিৎসা তার ভালো লাগেনা। এই জগৎটাকে এখন তার নোংরা মনে হয়। অবশেষে তিনি ১৯৮৮ সালের ১১ই মার্চ বাবা লোকনাথকে স্মরণ করতে করতে জ্যোতির্ময় দেবলোকের পথে গমন করেন।

পুস্তকের পটকথায় আমার উপর বাবার এইরূপ কৃপা বর্ষণের কথা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এখনও করুণাময় বাবা ও মাতা নর্মদার কৃপায় আমি জীবনধারণ করে আছি। তাদের দেওয়া জীবন এইজন্য তাদের নামেই উৎসর্গ করে দিয়েছি।

পারত্রিক জগতে এই ভ্রমণ কাহিনী সূক্ষ্মদেহে বাবা লোকনাথের ভক্তদের প্রতি কৃপার এক অমূল্য নিদর্শন। অনেক ভক্ত পূজা করেন, বাবাকে স্মরণ করেন, কিন্তু মনের গভীরে এক প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন থাকে, বাবা কি আমায় দর্শন দেবেন? কৃপা করবেন? অনেক সময় এই প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন সম্বন্ধে তারা নিজেরাও অবগত থাকেন না। পরম করুণাময় বাবা ভক্তের মনের সব ভাবের খোঁজ রাখেন। তাঁকে অটল বিশ্বাসে ভক্তি সহকারে আকুল হয়ে ডাকলে, তিনি ভক্তের ডাকে সাড়া দেবেনই। কিন্তু ভক্ত সেভাবে ডাকতে পারে কই? সেজন্যেই তিনি জীবিতকালে বলেছেন, বাবা বলে ডাকিস, কিন্তু সন্তানের মতো আসতে পারিস কই? সত্যিই তো আমরা তার কাছে কেবলই ভক্ত থাকি। কিন্তু সন্তানের আবদারে সন্তানের মতো তার সামনে যেতে পারি কি?