বাবার কৃপাধন্য কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির কথা

অষ্টম অধ্যায় বাবার কৃপাধন্য কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির কথা

গোয়ালিনী মা

বারদী আশ্রম থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে একটি মাটির ঘরে গোয়ালিনী মা-র নিবাস ছিল। তিনি ছিলেন বাল্যবিধবা এবং নিঃসন্তান। তিন কুলে তাঁর কেউ ছিল না। তার নিজের বলতে ছিল একটি ছোট মাটির কুটির এবং একটি গরু। এই গরুটিকেই তিনি সন্তান স্নেহে লালন-পালন করতেন এবং দুধ বিক্রি করে তার গ্রাসাচ্ছাদন চলতো। গোয়ালিনী মা নামেই তিনি গ্রামে পরিচিতা ছিলেন।

গোয়ালিনী একদিন লোকমুখে শুনতে পেলেন বারদী গ্রামে শ্মশানের কাছে এক মহাপুরুষ আসছেন। শ্মশান সংলগ্ন জমিতে তার কুটির তৈরি হয়েছে। মহাপুরুষের কথা শুনেই তার মনটা কেমন বিচলিত হয়ে ওঠে। মনটা ছুটে চলে যেতে চায় সেই মহাপুরুষকে দেখতে। বারদী আশ্রমে যেদিন প্রথম ভক্তদের সেবা করানো হয়, সেদিন তিনিও আশ্রমে যান খিচুরি প্রসাদ নিতে ও মহাপুরুষকে দেখতে। আশ্রমে এসে তিনি এককোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে মহাপুরুষকে দেখতে থাকেন। আশ্রমের আঙিনায় যখন সব ভক্তদের খিচুড়ি প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা হয়, তখন তিনি এক কোণে প্রসাদ নিতে বসে পড়েন। তার সামনে শালপাতায় খিচুড়ি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রসাদ গ্রহণে তার মন নেই। তিনি আশ্রমের বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী জটাজুটমণ্ডিত মহাপুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার অন্তর ও চোখ যেন কিছু খুঁজে বেড়ায়।

বাবা লোকনাথের নিম্নভূমিতে অবতরণের পর বারদীতে আসার একটি বড়ো কারণ হল তার জন্মদাত্রীকে তিনি যে কথা দিয়ে সন্ন্যাসাশ্রমে বেরিয়েছিলেন, সেই কথা রাখতে। উপনয়নের পর দণ্ডী ঘরে লোকনাথকে ভিক্ষা দেবার পর মা কমলা স্বয়ং লোকনাথের কাছে ভিক্ষা চান যেন পরজন্মে তাকেই পুত্ররূপে পান। বাবা লোকনাথ মা-কে কথা দিয়েছিলেন যে, মা-র পরজন্মে তার সঙ্গে আবার পুত্ররূপে দেখা হবে। ত্রিকালজ্ঞ বাবা লোকনাথ জানতেন যে তার গর্ভধারিণী মা সেইসময় বারদী গ্রামেই অবস্থান করছেন। সেইজন্য তিনি নিম্নভূমিতে অবতরণের সময় বেণীমাধবকে বলেন যে, তিনি বারদী যাবেন। বারদী এসে তার চোখও গর্ভধারিণী মাকে খুঁজতে থাকে। আসন ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ভক্তদের প্রসাদ গ্রহণ দেখতে দেখতে তার চোখ পড়ে এক কোণায় বসে থাকা ওই গোয়ালিনী মার দিকে। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলেন, মা, তুমি প্রসাদ গ্রহণ করো। তার কথা যেন গোয়ালিনী মা-র অন্তরে পৌঁছায়। ভেতর থেকে উঠে আসতে থাকে কান্নার রোল। তিনি কেবল দুচোখ ভরে মহাপুরুষকে দেখতে থাকেন। বাবা লোকনাথ চিনতে পারেন তার জন্মদাত্রী মা-কে। তিনি গোয়ালিনী মা-র থেকে তার নিবাস জেনে নেন।

পরদিন বাবা গোয়ালিনী মা-র নিবাসে উপস্থিত হয়ে তার বর্তমান অবস্থা জানতে পারেন। তিনি গিয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে গোয়ালিনী মা-র সঙ্গে কথা বলেন। তিনি গোয়ালিনী–কে বলেন আশ্রমের সব ভার নিতে আর তার গরুর দুধ আশ্রমে দিতে। তিনি গোয়ালিনী মা-কে বলেন যে তিনি যেন বাবাকে পুত্রবৎ দেখেন। মহাপুরুষ না ভাবেন। সেই থেকে আশ্রমের ভক্তদের সেবা, রুগীদের শুশ্রূষা ও আশ্রমের সব দেখাশোনার ভার বর্তায় গোয়ালিনী মা-র উপর। বাবার কৃপায় গোয়ালিনী মা-র অন্তরে এক বাৎসল্যভাবের উদয় হয় এবং তিনি পুত্রবৎ বাবা লোকনাথের সেবা করতে থাকেন। বিশেষ করে আহারকালে তিনি বাবার আহার তার সামনে নিজে এনে দিতেন। বাবার কৃপায় তিনি এক আশ্চর্য কর্মশক্তির অধিকারিণী হলেন যার বলে সারাদিন তিনি আশ্রমের সেবা করতে পারতেন।

বারদী আশ্রমে যখন শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী প্রথম বাবা লোকনাথের দর্শনে আসেন, তখন বাবা গোয়ালিনী–কে বলেন, এটি তোমার আর এক ছেলে বিজয়কৃষ্ণ। গোয়ালিনী তখন বাবার সামনে বসে বিজয়কৃষ্ণের বিশাল বপুকে নিজের কোলে শুইয়ে স্তন্যপান করান। তিনি নিজে নিঃসন্তান। কোনোদিন তার বুকে দুধ আসেনি। কিন্তু বাবার কৃপায় ও গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর যোগবলে সেই বিশাল বপুলঘু হয়ে গোয়ালিনী মার কোলে শুয়ে মাতৃদুগ্ধ পান করেছিলেন। এই ঘটনা উপস্থিত সমস্ত ভক্ত প্রত্যক্ষ করে ধন্য হয়েছিল। সবার মনে এই প্রশ্ন জেগে উঠেছিল যে গোঁসাইয়ের এত বিশাল বপু অশীতিপর বৃদ্ধা কী করে কোলে নিলেন এবং যার কোন সন্তানই কোনোদিন হয়নি, এই বয়সে তাঁর স্তনে মাতৃদুগ্ধ কি করে এলো। গোয়ালিনী নিঃস্বার্থভাবে অন্তর থেকে বাবা লোকনাথের সেবা করতেন। তাঁর কোনো ধর্মবিষয়ে জ্ঞান ছিলনা এবং সাধন জ্ঞানও ছিলনা। তিনি নিজেকে বাবার চরণে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে বাবার সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। সেইজন্য বাবাই তাকে এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিণী করেছেন। বাবা ভক্তদের কাছে বলতেন যে, গোয়ালিনী–ই পূর্বজন্মে তার জন্মদাত্রী মাতা ছিলেন। বাবা লোকনাথের অনেক অলৌকিক লীলা গোয়ালিনী দেখেছেন। বাবার সামনে যে কোনো সময়ে উপস্থিত হবার অধিকার একমাত্র তাঁরই ছিল। গোয়ালিনী–ই হচ্ছেন সেই বিশিষ্ট ব্যক্তি যিনি বাবা লোকনাথকে কালীরূপে দর্শন করেছিলেন। বাবা লোকনাথের কামরূপসিদ্ধির এই প্রকাশ কেবলমাত্র গোয়ালিনী–ই প্রত্যক্ষ করেছেন। গোয়ালিনী তার জন্মদাত্রী মা জেনেই বাবা তাঁর সমক্ষে দক্ষিণাকালীকা রূপে প্রকট হয়েছিলেন। গোয়ালিনী মা-র চক্ষু সেদিন সার্থক হয়েছিল তাঁর পূর্বজন্মের লোকনাথের সাধন ক্ষমতা দেখে। দণ্ডীঘরে তার চোখের জল বৃথা যায়নি।

বারদী আশ্রমের অনতিদূরে গোয়ালিনী মার সেই মাটিরবাড়ি আজও রক্ষিত আছে। বারদী আশ্রম থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারা গেল যে একজন গোয়ালিনী মা-র ভিটা জোর করে দখল করে নিয়েছিলেন। তখন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাঁকে এই কাজ করতে নিষেধ করে। কিন্তু তিনি গায়ের জোরে সেই ভিটা দখল করে বসবাস করতে শুরু করেন। এরপর তাঁর একটি সন্তান মারা যায় এবং সংসারে ভীষণ অশান্তি ও উপদ্রব নেমে আসে। তারপর তিনি সেই ভিটা ত্যাগ করেন। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সকলেই বলে যে এই ভিটায় বাবা লোকনাথ নিজে এসে বসেছেন। সেই ভিটাকে আমরা রক্ষা করবো। বাবা লোকনাথের কৃপা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পেয়েছিলেন। বারদী গ্রামেরতো কথাই নেই, সারা বাংলা থেকে লোক তার কৃপা পাবার জন্য বারদী যায়। বর্তমানে গোয়ালিনী মা ও বাবা লোকনাথের স্মৃতি রক্ষার্থে এই ভিটার রক্ষণাবেক্ষণে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে।

যেসব ভক্ত বারদী আশ্রম পরিদর্শন করেন, তারা গোয়ালিন মা-র ভিটাও দর্শন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

.

নারিশা বাবা

নারিশা নিজের জীবনধারণের কোনো সদুপায় করতে না পেরে প্রথম জীবনে মাকে ছেড়ে এক অসৎ সাধুর চেলা হয়েছিলেন। জীবনধারণের কোনো নিজস্ব উপায় না থাকলেও সঙ্গদোষে সে গাঁজা খাওয়া, নারী ভোগকরা ইত্যাদি কাজে বেশ হাত পাকিয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে এক সাধুর চেলা হয়ে বিনামূল্যে গাঁজা সেবন করার সুযোগ পেল এবং সাধুগিরি কী করে করতে হয় তাও শিখলো। সন্ত সাধুরা কিভাবে লোক ঠকিয়ে পয়সা উপার্জন করে এবং রাতের অন্ধকারে সুখী জীবন ভোগ করে সেগুলি সে সাধুবাবার চেলাগিরি করে বেশ ভালোভাবে রপ্ত করে নিল। যখন তাঁর সাধু ব্যবসাটা বেশ বোঝা হয়ে গেছে এবং নিজেরও বেশ বড় জটা হয়ে গেছে, তখন সে ভাবল সে নিজেই সাধু হয়ে যাবে। এখন চেলাগিরী করে যা উপার্জন করে, তার বেশিরভাগই সাধুকে দিয়ে দিতে হয়। আর রাতের সুখীজীবন ভোগ থেকেও বঞ্চিত হতে হয়। এইসব ভেবে সে চেলাগিরী ছেড়ে অন্যগ্রামে গিয়ে নিজেই সাধুরূপে আত্মপ্রকাশ করলো। সঙ্গে কয়েকজন চেলাও রাখলো। গেরুয়াবসনে ও লম্বা জটায় তাকে সাধুর মতো দেখায় বটে। গ্রামের গাছতলায় একটি ধূনী জ্বালিয়ে ত্রিশূল পুঁতে সে ব্যোম ভোলানাথ ধ্বনি দিতে থাকে। ধর্মভীরু গ্রামের সাধারণ মানুষ ক্রমেই আকৃষ্ট হয় ওই সাধুর প্রতি। তারা দেখে যে এক জটাধারী সাধু চোখ বুজে ধ্যানাবিষ্ট হয়ে মাঝে মাঝেই ‘ব্যোম ভোলানাথ’ ধ্বনি দিচ্ছে। গ্রামের অসহায় দুঃখী মানুষেরা তাদের সংসার জীবনের হাজারো সমস্যা সেই সাধুর কাছে ব্যক্ত করতে থাকে। সাধুও তাদের অভয় আশীর্বাদ দিয়ে আশ্বস্ত করতে থাকে এই বলে যে সব সমস্যা সে দূর করে দেবে।

তার চেলারা মানুষজনকে বোঝাতে থাকে যে শুধু অর্থপ্রণামী দিয়ে ‘সিধা দিলেই হবে না। বাবার চরণে গাঁজাও নিবেদন করতে হবে। সকলে তাদের অর্পিত ‘সিধায় গাঁজাও দিতে শুরু করে। অতিরিক্ত গাঁজা সে এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে অর্থ উপার্জনও শুরু করে। কোনো মহিলার সমস্যা হলে তার সমাধানের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণ হতো রাতে, যাতে নারীভোগের বিলাসিতাটুকুও নির্বিঘ্নে মেটানো যেত।

কিন্তু চতুর এই নারিশা বাবা এক গ্রামে বেশিদিন অবস্থান করতো না। কারণ সে জানতো অচিরেই স্থানীয় মানুষরা তার ভণ্ডামী ধরে ফেলবে। ক্রমেই তার পসার এমনই জমে উঠেছিল যে নিজস্ব বড়ো তাবু, তিনটি ঘোড়া ও ব্যাপক পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ও গাঁজা-আফিমের ভাণ্ডার নিয়ে সে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে ঘুরে বেড়াত। এভাবেই একবার ত্রিপুরার একটি গ্রামে গিয়ে গোল বাঁধলো নারিশার সাজানো সংসারে।

প্রতিদিনের অভ্যাসমতো গ্রামের একটি গাছতলায় ধূনী জ্বালিয়ে ব্যোম ভোলানাথ শব্দে সবে সে আসর জমাবার চেষ্টা করছে আর ফাঁকে ফাঁকে মিটমিট করে দেখছে কতজন ভক্ত আকৃষ্ট হলো। ঠিক সেই সময় একটি পদধ্বনি তার সামনে এসে থামলো এবং তার সংসার জীবনের নাম ধরে ডাকলো। নারিশাবাবা সেই নাম প্রায় ভুলেই গিয়েছে। এতদিনপর এই নামে তাকে কে ডাকলো! সেই আগন্তুক তারপর বললেন–কিরে বেশ তো ব্যবসা কেঁদে জমিয়ে বসেছিস দেখছি। এইজন্যই বুঝি বাবা-মাকে কাঁদিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিলি? বাবা মরে বেঁচেছে আর বুড়ি মা অন্ধ হয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। মানুষের চামড়া যে তোর গায়ে আছে তাও তত মনে হয়না। এত বয়সে তুই নির্লজ্জের মতো কী করে বেড়াচ্ছিস, তা আর কেউ না জানুক, আমি ভালো করেই জানি। বেশ করে ভেবে বলতো দেখি, কি শাস্তি হলে তোর ঠিক উপযুক্ত হয়। গুরুগম্ভীর শব্দে এই কথা শুনে নারিশাবাবা চোখ খুলে আগন্তুকের দিকে তাকালো। তার সামনে দণ্ডায়মান দীর্ঘদেহী জটাজুটধারী দেহে দীপ্ত আভা সমন্বিত এক যোগীপুরুষ। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আর নিজেকে সামলাতে পারলো না নারিশাবাবা। তার দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগলো। বুকের গভীর থেকে এক উদত্ত কান্নার রোল এসে তার চক্ষুকে প্লাবিত করতে লাগলো। তার মনে হল সেই আগন্তুকের সামনে যেন সে নিজের সব সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। সে সেই যোগীপুরুষের চরণে লুটিয়ে পড়ে নিজেকে আত্মসমর্পণ করলো। সেদিনের সেই আগন্তুক যোগীপুরুষ ছিলেন মহাযোগী ব্রহ্মজ্ঞ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী।

বাবা লোকনাথ নারিশাবাবার প্রায় অবসন্ন দেহটিকে তুলে পরম স্নেহে তার বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, তোর কোনো ভাবনা নেই। এখন থেকে তোর সব ভার আমার। এখান থেকে আমি বারদী গ্রামে যাব। ছাগলবাঘিনী ঘাটের কাছে মেঘনা নদীর তীরে শ্মশানভূমিতে আমার স্থান নির্দিষ্ট আছে। সেইখানে সন্ধান করলে আমাকে পাবি। আগে জননীর প্রতি তোর শেষ কর্তব্যটা করে আয়। আগামী পূর্ণিমার দিন তোর মা দেহ রাখবেন। তার সেবা করার জন্য আর দিন দশেক সময় পাবি। নানাভাবে এতদিন ধরে যা জমিয়েছিস, এই সুযোগে তা সমস্ত ব্যয় করে হালকা হয়ে তুই আমার কাছে ফিরে যাবি। এই কথাগুলি বলে বাবা লোকনাথ অন্তর্হিত হলেন।

সেইদিনই বাবা লোকনাথের উপদেশ শিরোধার্য করে নারিশাবাবা সাধুব্যবসা গুটিয়ে ফেলে ট্রেনে চেপে তার নিজের গ্রামে রওনা হলেন। গ্রামে পৌঁছে মাকে খুঁজে বার করে অক্লান্ত পরিশ্রমে তার সেবা করলেন। তারপর তার মা দেহত্যাগ করলে মায়ের শ্রাদ্ধ করে তার পাপপথে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করলেন। তার কাছে সম্বল রইল কেবল বারদী পৌঁছবার পথের খরচ।

নারিশাবাবা বারদী পৌঁছলে বাবা লোকনাথ তাঁকে সত্যকারের সাধুরূপে নিজের হাতে গড়ে তোলেন। নারিশা বাবা তার পূর্বের সাধুজীবনের সব অসৎ কাজ পরিত্যাগ করেছিলেন, কেবল গাঁজা সেবন ছাড়া। আশ্রমে তিনি লুকিয়ে গাঁজা সেবন করতেন। বাবা লোকনাথ সেই কথা জানতেন। একদিন বাবা নারিশাবাবাকে ডেকে বলেন, হারে নারিশা, গাঁজার নেশাটাও তুই ছেড়ে দিলি! বাবার এই কথায় হতচকিত হয়ে নারিশাবাব বলেন, বাবা অপরাধ নিবেন না। আপনার কৃপায় গাঁজা সেবন ছাড়া বাকি সবই আমি ছেড়ে দিয়েছি। এখন যদি বলেন তো গাঁজা খাওয়াও ছেড়ে দেবো। বাবা তখন স্মিত হেসে বলেন, তোর মতো অনেকেরই সবকিছু আমি গ্রহণ করেছি। কোনো চিন্তার কারণ নেই। তোকে গাঁজা খাওয়া ছাড়তে হবে না। যত খুশি গাঁজা খা। তবে তা লক্ষ্য করার জন্য আমি সর্বদা পাহাড়ায় থাকব। গাঁজা যেন তোকে না খায় তা দেখার দায়দায়িত্ব আমারই থাকবে।

এই নারিশাবাবা বারদী আশ্রমের এক প্রধান সেবক ছিলেন যাকে বাবা লোকনাথ নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন। যতদিন বাবা ধরাধামে ছিলেন, একদিনের জন্যেও নারিশাবাবা তার কাছ ছাড়া হননি এবং তাঁর দেহত্যাগের পরও তার সুখস্পর্শ স্মৃতিকে বুকে নিয়েই তিনি আশ্রমের সেবা করে গেছেন। বাবা যে তার সমস্ত পাপকার্য নিজে গ্রহণ করে তাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। তার মতো ভাগ্যবান কজন আছে?

.

চন্দ্রকিশোর চক্রবর্তী

ঢাকা, বিক্রমপুর নিবাসী চন্দ্রকিশোর চক্রবর্তীর ইচ্ছা ছিল তিনি সিদ্ধিলাভ করে একজন মহাপুরুষ হবেন। তার মনের ঐকান্তিক বাসনা ছিল যে তিনি লোকসমাজে একজন মহাপুরুষ রূপে আদৃত হবেন। সেই ইচ্ছা পূরণের আশায় তিনি অনেক সাধুসন্ন্যাসীর সঙ্গে সঙ্গত করেছেন। কিন্তু তার আকাঙ্খিত সিদ্ধি হস্তগত হয়নি। মনে গভীর অতৃপ্তি নিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। একদিন লোকমুখে তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার অমিত যোগশক্তির কথা শুনতে পান। তিনি বিভিন্ন লোকের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে ওই ব্রহ্মচারীর যোগবিভূতির কোনো সীমা নেই। লোকমুখে বারদী ব্রহ্মচারীর কথা শুনে তিনি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন এবং মনে বল পেলেন যে, এই মহাযোগীর কৃপা লাভ করতে পারলেই তিনি যোগসাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারবেন। তাই কালবিলম্ব না করে তিনি বাবা লোকনাথের কৃপালাভের জন্য বারদীর আশ্রমে উপস্থিত হলেন। আশ্রমে এসে তিনি বাবাকে দর্শন করে প্রণাম করলেন। তারপর কোনো কথা না বলে আসন ঘরের বারান্দার এক কোণে উপবাস করে নীরবে হত্যে দিয়ে পড়ে রইলেন। তিনি কেন এসেছেন সে কথা বাবাকে বললেন না এবং তিনি যে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন সে সম্বন্ধে বাবাও কারোকে কিছু বললেন না। উভয়েই নীরব রইলেন। এইভাবে আটদিন উপবাসে কাটলো। চন্দ্রকিশোর জলও স্পর্শ করলেন না। বাবাও তাকে কিছু বললেন না। তিনি কেবল নীরবে চন্দ্রকিশোরের ভক্তি, সংযম ও তিতিক্ষার পরীক্ষা করতে লাগলেন। নয়দিনের দিন চন্দ্রকিশোর পিপাশায় যন্ত্রণাকাতর হলেন কিন্তু জল গ্রহণ করলেন না। চন্দ্রকিশোরের যন্ত্রণা বাবা অনুভব করলেন এবং ভক্তের যন্ত্রণায় তিনি অতিশয় কাতর হয়ে এক ভক্তকে ডেকে তার খাবারের ব্যবস্থা করলেন।

চন্দ্রকিশোর খাদ্য-পাণীয় গ্রহণ করে বাবার সম্মুখে গেলে বাবা তাকে বসতে বললেন। চন্দ্রকিশোর বাবার চরণবন্দনা করে বসলেন। বাবা তাঁর মধ্যে আশীর্বাদ সঞ্চারিত করলেন। সেই আশীর্বাদের সঙ্গে বাবা কিছু যোগশক্তি চন্দ্রকিশোরের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন। বিনা আয়াসে একজন ব্রহ্মজ্ঞানী মহাযোগীর থেকে চন্দ্রকিশোরের মধ্যে কিছু যোগশক্তি সঞ্চারিত হলো। সবই হল নীরবে। কেউ কোনো কথা বললেন না। এরপর চন্দ্রকিশোর বাবাকে প্রণাম করে তার অনুমতি নিয়ে বিক্রমপুর ফিরে গেলেন।

বিক্রমপুরে ফিরে গিয়ে চন্দ্রকিশোর প্রচার করলেন যে, তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার যোগশক্তির অধিকারী হয়েছেন। বাবা লোকনাথের নাম করে তিনি বহু লোকের দূরারোগ্য ব্যাধি সারাতে থাকেন। সেইসব রোগমুক্ত ব্যক্তিরাই চন্দ্রকিশোরের নাম সারা ঢাকায় প্রচার করে। চন্দ্রকিশোরের যশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

এই যশ ও প্রচার চন্দ্রকিশোরের মধ্যে অহংভাবের সৃষ্টি করে। তিনি ভুলে যান যে বাবা লোকনাথ তাঁর মধ্যে সামান্য যোগশক্তি সঞ্চারিত করেছেন। মূল শক্তির অধিকারী মহাযোগী বাবা লোকনাথ। তিনি নিজেকে একজন বড়ো যোগীপুরুষরূপে ভাবতে থাকেন এবং সেইভাবে প্রচারে উৎসাহ দিতে থাকেন। এই অহঙ্কার বোধ ও যশের মোহই তার কাল হয়। অল্পদিনের মধ্যেই বারদীর ব্রহ্মচারীর দেওয়া যোগশক্তির ক্ষয় হতে থাকে এবং একদিন তা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। চন্দ্রকিশোর ভুলে গিয়েছিলেন যে, তিনি বিধিবদ্ধ কোনও তপস্যার দ্বারা এই যোগসিদ্ধি অর্জন করেননি। বাবা লোকনাথ লোককল্যাণ হেতু তার মধ্যে কিছু যোগশক্তি সঞ্চারিত করেছিলেন। কিন্তু চন্দ্রকিশোর সেই যোগশক্তিকে নিজের যশলাভ হেতু ব্যবহার করেছেন এবং সেই শক্তিদাতাকেই অবজ্ঞা করেছেন। যখন তার মধ্যে সমস্ত শক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল, তখন তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চন্দ্রকিশোরের কীর্তি লোকমুখে বারদীতে পৌঁছেছিল। বাবা লোকনাথ তখন বুঝলেন যে চন্দ্রকিশোর তার কাছে যোগশক্তি সঞ্চয়ের জন্য এসেছিলেন কেবল নিজের নাম-যশ অর্জন করার জন্য, মানবকল্যাণের জন্য নয়। চন্দ্রকিশোরের সিদ্ধিলাভের বাসনার পিছনে আধ্যাত্মিক গভীরতা ছিল না। ছিল কেবল নাম-যশ লাভের উচ্চাকাঙ্খা। তিনি চন্দ্রকিশোরের মনের এই অবস্থা সম্বন্ধে অবগত ছিলেন। এবং সেইজন্যই তাকে আটদিন উপবাসে রেখে তার শরীরকে ক্লীষ্ট করে মনকে সিদ্ধিলাভের উপযোগী করার চেষ্টা করেছিলেন। বাবা লোকনাথ চন্দ্রকিশোরকে যৎসামান্য যোগশক্তি দান করেছিলেন। কিন্তু এই যৎসামান্য শক্তির প্রভাবেই চন্দ্রকিশোর নিজেকে একজন বড়ড়া যোগী ভাবতে থাকেন ও যশলাভের জন্য প্রচার করতে থাকেন। তার মধ্যে এই যৎসামান্য শক্তি ধারণ করার ও রক্ষা করার শক্তি ছিল না। আসলে তার মধ্যে সাধনার জমিই প্রস্তুত ছিল না। কঠোর তপস্যা ও যোগসাধনা ভিন্ন যোগশক্তি ধারণ করা যায় না। যৎসামান্য শক্তি সঞ্চারিত করে চন্দ্রকিশোরকে বাবা লোকনাথ সেই শিক্ষাই দান করেছিলেন।

আজকের ভঙ্গুর সমাজে আমরা এইরূপ ঘটনার অজস্র উদাহরণ দেখতে পাই। যদি কেউ সামান্য সাধনায় সামান্য কিছু সিদ্ধি অর্জন করে থাকেন, তবে তিনি নিজেকে একজন মহাশক্তিধর সিদ্ধযোগী বলে প্রচার করতে থাকেন। যিনি কঠোর তপস্যা ও যোগসাধনার মাধ্যমে যোগসিদ্ধি লাভ করেছেন, তিনি সর্বদা প্রচার বিমুখ হবেন। তপস্যার শিক্ষাই হল যোগী কখনও তার সিদ্ধির প্রচার প্রকাশ্যে করবেন না। বাবা লোকনাথের মতো উচ্চকোটির অমিত যোগশক্তির অধিকারী কোনো যোগী আমি সমগ্র নর্মদা পরিক্রমা করে এবং হিমালয় ভ্রমণ করে মাত্র দুজনকে জেনেছিলাম। যাঁদের আসন-গুহায় প্রবেশ করে তাদের শ্রদ্ধা জানাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় নর্মদা তটের একটি ঘটনার। মায়ুর কল্পে অমরকন্টকের নর্মদা তটে মহামুণি মার্কণ্ডেয় বাল্যাবস্থা থেকে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত মহাদেবের সাধনায় রত ছিলেন। তার সাধনায় তুষ্ট হয়ে শিব-পার্বতী যখন তাকে দর্শন দিয়ে বর প্রার্থনা করতে বলেন, তখন মুণি মার্কণ্ডেয় বলেন, প্রভু যদি আপনি আমার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে থাকেন, তবে আমাকে অমর করে দিন। যাতে আমি যুগ যুগ ধরে মানবকল্যাণতরে যোগসাধনা করে যেতে পারি। তার আকাঙ্ক্ষায় তুষ্ট হয়ে শিব মহামুনিকে সপ্তকল্প অমর থাকার বরদান করেন। মহামুনি সপ্তকল্প জীবিত থেকে মানবকল্যাণের জন্য যোগসাধনা করেন।

যোগসাধনা এবং তার ফলশ্রুতি রূপে প্রাপ্য যোগবিভূতি মানবকল্যাণের জন্য হয়। ব্যক্তিগত নাম-যশ-মুনাফা অর্জনের জন্য নয়। যারা যোগসাধনালব্ধ ফল ব্যবসায়িক কারণে অথবা ব্যক্তিগত হিতে ব্যবহার করেন, যোগশক্তি বা ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তি সে স্থানে বাস করে না। বাবা লোকনাথ তাঁর অমিত যোগশক্তি কেবল মানবকল্যাণের জন্যই ব্যবহার করেছেন। কখনও সেই যোগশক্তি ব্যবহার করার জন্য কোনো মূল্য গ্রহণ করেননি। বা নিজের নাম-যশ প্রচারও করেননি। তার কাছে ধনী-দরিদ্র-জমিদার-রাজা সব সমান ছিল। আর্থিক মাপকাঠিতে তিনি ভক্তদের বিচার করতেন না। ভক্তদের তিনি সর্বদা সদুপদেশ দিতেন যাতে তাদের কল্যাণ হয়। এরূপ দৃষ্টান্ত বর্তমান সমাজে মেলা কঠিন। এখন প্রচারের যুগ। সবাই কেবল প্রচার চায় আর যোগবিভূতিকে অর্থের তরাজুতে মূল্যায়ণ করে। এরূপ ব্যক্তিদের মধ্যে তো ব্রহ্মজ্ঞান আশা করা যায় না। ব্রহ্মজ্ঞানী বাবা লোকনাথ তো তার ভক্তদের জন্য হৃদয়াসন পেতেই বসে আছেন। তবে কেন আমরা মেকিদের পিছনে ঘুরি!

.

কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন

তৎকালীন পূর্ববাংলার একজন সুপণ্ডিতরূপে পরিচিত ছিলেন কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন মহাশয়। তিনি ছিলেন একজন উচ্চ ব্রাহ্মণ বংশীয় এবং তপস্বী। গুরুকূলে বাস করে বিধিবদ্ধভাবে ব্রহ্মচর্যানুষ্ঠান করে তিনি বেদ ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র বিশারদ হয়েছিলেন। তিনি গুরুকুলে নিত্যব্রত অনুষ্ঠান দ্বারা তপস্যা ও যোগসাধনায় ব্রতী হয়ে একজন জিতেন্দ্রিয় পুরুষ হয়েছিলেন। যোগসাধনার মাধ্যমে তিনি তাঁর পঞ্চভূত দেহের সব রিপুগুলিকে জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তার মধ্যে কোনো বিষয়ভোগের’ বাসনা ছিল না। গুরুকুলে শিক্ষান্তে তিনি গৃহাশ্রম ধর্মে প্রবৃত্ত হয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। কারও থেকে কখনও তিনি দান বা প্রতিগ্রহ গ্রহণ করতেন না। তাঁর মনে বিষয় ভাবনার পরিবর্তে ছিল আধ্যাত্মিক বাসনা। তার মধ্যে আধ্যাত্মিক পিপাসা প্রবল ছিল। পূর্ববাংলায় তার অনেক শিষ্য ছিল।

বিদ্যারত্ন মহাশয় বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার নাম শুনে দর্শন করতে আসেন এবং প্রথম দর্শনেই তার নজরে পড়েন। তিনি এরপর প্রায়ই তার আধ্যাত্ম পিপাসা নিবারণার্থে বাবা লোকনাথের কাছে আসতেন এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিষয়ে আলোচনা করতেন।

একদিন বিদ্যারত্ন মহাশয় আশ্রমে এসে আসন-ঘরের বাইরে থেকে বাবাকে প্রণাম নিবেদন করতেই ভিতর থেকে বাবা পরম স্নেহে বলে ওঠেন কালীপ্রসন্ন, নিদারুণ অর্থাভাবে তোর এখন দিন কাটছে, না রে? হাতে টাকা পয়সা কিছু নেই। তুই ভাবিস না। আমার কাছে অনেক টাকা রয়েছে। তুই সেগুলো নিয়ে যা।

বিদ্যারত্ন মহাশয় আসন-ঘরে ঢুকে বাবার চরণ স্পর্শ করে বললেন, ব্রহ্মচারী ঠাকুর আপনি অষ্টাদশসিদ্ধি এবং পাঁচটি সামান্য সিদ্ধি লাভ করেছেন। তাই আপনার তো টাকা পয়সার অভাব থাকতে পারে না। কিন্তু আমি এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। দারিদ্র্য আমার সহচর। তবু আমার টাকা পয়সার দরকার নেই।

এই কথা শুনে বাবা অত্যন্ত খুশি হলেন। তবু নিজের কম্বলাসন উঠিয়ে তাকে দেখালেন। বিদ্যারত্ন মহাশয় দেখেন আসনের নিচে অনেক টাকা। তিনি বুঝলেন, যিনি আজন্ম ব্রহ্মচারী, টাকা পয়সায় কোনোদিন হাত দেননি, তাঁর আসনের নিচে এত টাকা কোথা থেকে আসবে। এটা বাবার এক অলৌকিক লীলাখেলা। তিনি বললেন, ব্রহ্মচারী ঠাকুর, আপনার যোগৈশ্বর্য আপনারই থাকুক। ওতে আমার দরকার নেই। আশীর্বাদ করুন যেন আমার ভগবৎ ঐশ্বর্য লাভ হয়।

বাবা বিদ্যারত্ন মহাশয়কে পরীক্ষা করছিলেন। তার মুখে এই কথা শুনে তিনি খুব খুশি ও তৃপ্ত হলেন। তাঁর কাছে ভক্তরা কেবল বিষয়ভোগ বাসনার আর্জি নিয়ে আসে। কেউ ভগবৎ-ঐশ্বর্য পাবার বাসনায় আসে না। কিন্তু কালীপ্রসন্ন ভগবৎ-ঐশ্বর্য পেতে এসেছেন। তিনি এতে খুব খুশি। যার অন্তর তপস্যাবলে শুদ্ধ হয়, তার বাসনাও ক্রিয়াহীন হয়। যার মধ্যে ঈশ্বরবাসনা থাকে, তার মধ্যে যোগ বাসনা থাকে না। তিনি আসনের নিচে অনেক অর্থ দেখিয়ে তা দান করতে চাইলেও কালীপ্রসন্ন কোনো আগ্রহ দেখালেন না, বরং বললেন, আপনার যোগৈশ্বর্য আপনারই থাক। অর্থাৎ অর্থ দেখেও কালীপ্রসন্ন বুঝতে পেরেছে যে সেটা বাবার যোগৈশ্বর্য। সাধারণ লোক এইরকম দেখলে মনে করবে বাবা লোকনাথ ভক্তদের কৃপা বিতরণ করে অনেক অর্থ উপার্জন করেছেন। তারা বাবার যোগৈশ্বর্যের নাগাল পাবে না। সেজন্য বাবা লোকনাথের মতো এমন উচ্চ ঈশ্বরকোটির ব্রহ্মচারীর কৃপালাভ করার জন্য ভক্তের অন্তরের জমি তৈরি করা প্রয়োজন। কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্নের ওইদিনের ঘটনার মাধ্যমে বাবা এই লোকশিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। ভক্তগণ তা বুঝতে পেরেছে কি?

নর্মদা পরিক্রমার সময় আমি দুটি জায়গায় দুজন সিদ্ধ যোগীর সম্মুখীন হয়েছিলাম। যাঁরা আমাদের মনের ইচ্ছামতো বর প্রার্থনা করতে বলেন। কিন্তু আমরা কেবল মা নর্মদা ও শিবশঙ্করের আশীর্বাদ ভিন্ন অন্য কোনো বর কারও কাছে চাইনি। যদিও আমাদের বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। গুরুদেবের থেকে যে সামান্য জ্ঞান সঞ্চয় করে পরিক্রমায় বেরিয়েছিলাম, তাতে মনে দৃঢ় সঙ্কল্প ছিল যে ঈশ্বরের কৃপা ভিন্ন অন্য কোনোকিছু আমরা গ্রহণ করবো না। তপস্যার এটি মূল মন্ত্র। কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন মহাশয় যেহেতু একজন জিতেন্দ্রিয় পুরুষ ছিলেন, সেইজন্য তিনি তপস্যার মূল মন্ত্রটি ভালোভাবে জানতেন এবং বাবা লোকনাথের কাছে কেবল ভগবৎ ঐশ্বর্য প্রার্থনা করেছিলেন। বাবার এমন ভক্ত খুব কমই ছিল।

এরপরে আর একদিনের কথা। বিদ্যারত্ন মহাশয় বারদীর আশ্রমে এসেছেন বাবার কাছে বিদায় নিয়ে কাশী চলে যাবেন বলে। তিনি যখনই বাবার ঘরের দরজায় পৌঁছলেন, ভিতর থেকে বাবা বলে উঠলেন, কীরে কালীপ্রসন্ন, শেষে মনের দুঃখে কাশীবাসী হতে চলেছিস?

বিদ্যারত্ন মহাশয় আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, এই অন্তর্যামী মহাপুরুষের অজ্ঞাত কিছুই নেই। যে কথা তিনি বলবার জন্য এসেছেন, কিন্তু এখনও কারোকে বলেননি, সে কথা বাবা তাকে দেখা মাত্রই কী করে জেনে গেলেন? বিদ্যারত্ন মহাশয় বাবাকে বললেন, আগামী মাসেই চলে যাব ঠিক করেছি। আপনার কি অভিমতো তাই জানতে এসেছি।

বাবা লোকনাথ তখন বললেন, এ মাসে তোর মেয়ের বিয়ে দিয়ে আসছে মাসে চলে যাবি–এই তত তোর ইচ্ছে? হারে তোর পুত্র সন্তান নেই বলেই কি এই অভিলাষ? তোর মনে দুঃখ, তাই বৈরাগ্য। তোর কাশী যাওয়া হবে না। তুই যেখানে আছিস সেখানেই থাকবি। আমি তোর ঘরে ছেলে হয়ে জন্মাব। বাবার কথা শুনে বিদ্যারত্ন মহাশয় যারপরনাই বিস্মিত হলেন। তার মনের গভীরে যে দুঃখ-ব্যথা লুকিয়ে আছে, বাবা সেকথা জানতে পেরেছেন। পরম করুণাময় বাবা তাঁর অলৌকিক শক্তির দ্বারা সেই দুঃখের অবসান করবেন বলেছেন। এজন্যই বলে ভক্তের জন্যই ভগবান। ভক্তের দুঃখে ভগবানের প্রাণ কাঁদে। বাবার এই অযাচিত কৃপালাভ করে বিদ্যারত্ন মহাশয় কাশী যাবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করলেন। কিন্তু তারপরও বাবাকে বললেন, ব্রহ্মচারী ঠাকুর, আপনি আমায় আবার কেন সংসারে আবদ্ধ করছেন?

 বাবা লোকনাথ তখন বললেন, কালীপ্রসন্ন, তুই তো ব্রহ্মনিষ্ঠ। ব্রহ্মচর্য ব্রতানুষ্ঠানের পর গৃহাশ্রমী হয়েছিস। ব্রহ্মচর্য ও ধর্মজ্ঞান শিক্ষা করলে চিত্ত বিশুদ্ধ হয়। চিত্ত বিশুদ্ধ হলে যদি কেউ সংসার ধর্ম পালন করে, তাহলে সংসার বন্ধন হয় না। আমি জানি তোর গৃহে ভোগাসক্তি নেই। মনে রাখিস, কর্তব্যের খাতিরে সংসারধর্ম প্রতিপালন ও সন্তান প্রজনন করেও সেই পরম পদে ভক্তি স্থির রাখলে ভোগের মধ্যে গৃহীর চিত্ত আকৃষ্ট বা আবদ্ধ হয় না। আমি শুনেছি তোর স্ত্রীও ভক্তি পরায়ণা। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভক্ত হলে তাতে কখনও বিষয়াশক্তি পাপ উপস্থিত হতে পারে না।

বাবা লোকনাথের বিদ্যারত্ন মহাশয়কে এই কথা বলার এক নিগূঢ় অর্থ আছে। পরমাত্মা ও জীবাত্মা একই বস্তু। ব্রহ্মচর্য অনুষ্ঠানের দ্বারা বিশুদ্ধ চিত্ত হলে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার সাক্ষাৎ হয়। কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন ব্রহ্মচর্য পালন করে গুরুগৃহে ব্রতানুষ্ঠানের দ্বারা নিজের চিত্তকে বিশুদ্ধ করেছেন। তিনি অবিদ্যাজনিত ক্লেশগুলিকে বিনাশ করে নিজের জীবাত্মায় পরমাত্মাকে সাক্ষাৎ করতে সমর্থ হয়েছেন। সেইজন্য তিনি ব্রহ্মজ্ঞ যোগীশ্বর বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর এই পরমতত্ত্ব বুঝতে পারলেন। বুঝলেন, বাবা লোকনাথ কিভাবে তাকে সংসারী করেও মনে অনন্ত সুখের সন্ধান দিলেন। কৃতজ্ঞতায় তার মস্তক অবনত হলো। তিনি বাবার আশীর্বাদ নিয়ে বাড়ির পথে অগ্রসর হলেন।

বাড়ি যেতে যেতে তিনি ভাবলেন, যতক্ষণ জীবাত্মা মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, ততক্ষণ সে জীবনের আসল সত্যটি উপলব্ধি করতে পারে না। সংসারের মায়ার বন্ধনেই সে আবদ্ধ থাকে। যখন ঈশ্বরের করুণাময় জীবাত্মা সেই মায়ার বন্ধন হতে মুক্ত হয়, তখন সংসারে থেকেও সে বন্ধনহীন থাকে। ঈশ্বর দ্বারা সৃষ্ট মহামায়ার এই বন্ধন কেবল একজন পরমব্রহ্ম মহাপুরুষই ছিন্ন করতে বা করাতে পারেন। আজ বাবা লোকনাথকে তিনি সেই পরমব্রহ্ম মহাপুরুষরূপেই দর্শন করলেন। বাবার কৃপায় আজ তাঁর জীবাত্মার সংসারের মায়ার বন্ধন ছিন্ন হলো। কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন মহাশয়ের ব্যক্তিগত জীবনে তপশ্চারণ ও ব্রতানুষ্ঠানের মাধ্যমে যে জমি প্রস্তুত করেছিলেন, আজ বাবা তাতে সুরভিত ফুলের বীজ বপন করে দিলেন। তার মধ্যে এই জমি প্রস্তুত ছিল বলেই তিনি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে একজন ব্রহ্মজ্ঞানী পরমপুরুষরূপে দেখতে সমর্থ হলেন। এ তার অতীব সৌভাগ্য। তাঁর মন আজ আনন্দময় হয়ে উঠেছে এই ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের কৃপায়। তিনি পুনঃ পুনঃ প্রণাম জানাতে থাকেন তার পরমপুরুষকে।

.

অভয় ব্রহ্মচারী

অভয়াচরণ চক্রবর্তী তৎকালীন বাংলার ময়মনসিংহ জেলার সদর রেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করতেন। তার নিবাস ছিল ওই শহর সংলগ্ন হরিশচন্দ্রপট্টি গ্রামে।

স্ত্রী-পুত্র ও এক বড়ো ভাই নিয়ে তার পরিবার। ধর্মে মতি ছিল। ঈশ্বর দর্শনের বাসনা তার মধ্যে ক্রমে ক্রমে তীব্র হচ্ছিল। হঠাৎ একদিন তিনি কারোকে কিছু না বলে গৃহত্যাগ করলেন। তারপর থেকে দীর্ঘদিন তার কোনো খবরই ছিল না।

১৭ বছর পরে অনেক পাহাড়-পর্বত ভ্রমণ করে একদিন তিনি ব্রহ্মচারীরূপে ঘরে ফিরে এলেন। সংসারে তার মন ছিল না। সর্বদাই তিনি যেন কীসের চিন্তায় মগ্ন থাকেন। শিব চতুর্দশীর কয়েকদিন আগে তিনি ময়মনসিংহ জজকোর্টের এক পরিচিত উকিলের বাড়িতে এসে বলেন যে, তাঁর শিবরাত্রির দিন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে তীর্থে যাবার খুব বাসনা হয়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে যেতে পারছে না। চন্দ্রনাথ তীর্থ (বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে পড়ে)। সেখানে শিবরাত্রিতে বহুভক্তের সমাগম হয়। অভয়াচরণের মনের বাসনা ছিল সেখানে শিবদর্শনে যাবার। তাঁর কথা শুনে উকিলবাবু তাঁকে বললেন, অভয়াচরণ, আপনি তো চন্দ্রনাথ পাহাড়ে পাষাণ শিবের পূজা করতে যেতে চাইছেন। এক কাজ করুন না। ঢাকা জেলায় বারদী গ্রামে এক অলৌকিক যোগশক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষ এসেছেন, যাঁকে সকলে সচল শিব বলেন। তাকে দর্শন করে আসুন। আপনার চিত্ত আনন্দিত হবে। তিনি অভয়চরণকে পাথেয় হিসাবে কিছু অর্থও প্রদান করলেন। উকিলবাবুর কথামতো অভয়াচরণ পথে বেরিয়ে পড়লেন এবং শিব চতুর্দশীর দিন সচল শিব দর্শনের জন্য নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে বারদী গ্রামের পথে অগ্রসর হলেন। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছতে তাঁর অনেক ধকল গেছে। গঞ্জিকা সেবন করা তাঁর একটি অভ্যাস ছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ উপবাসে থেকে সচল শিবের পূজা করবেন বলে তিনি পথে একবারও গাঁজা সেবন করেননি। বারদী গ্রামে যাবার পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়েও তার গাঁজা সেবন করার প্রবল ইচ্ছা জাগলেও তিনি মনের দৃঢ়তায় সেই ইচ্ছাকে দমন করে রাখেন। অবশেষে তিনি বারদী আশ্রমদ্বার দেখতে পান।

বাবা লোকনাথ তখন ভক্তপরিবৃত হয়ে আসন ঘরে বসেছিলেন। হঠাৎ তিনি ভক্তদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়েন। ভক্তেরা এর কোনো কারণ অনুধাবণ করতে পারলেন না। একটু পরে আবার বাবা হাত নেড়ে ভক্তদের ঘরের প্রবেশ দ্বার থেকে সরে যেতে ঈশারা করেন। ভক্তরা তখন বুঝতে পারেন, বোধহয় বাইরে থেকে কোনো সাধুজন বাবার সাক্ষাতের জন্য আসছেন। তারা প্রবেশদ্বার থেকে সরে বসেন। এরপর বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখেন একজন সাধু দ্রুতগতিতে বাবার ঘরের দিকে আসছেন। তখন তারা বুঝতে পারেন যে অন্তর্যামী বাবা এই সাধুর প্রবেশের পথের জন্য তাদের দ্বারের প্রবেশপথ থেকে সরে বসতে ইশারা করছিলেন।

অভয়াচরণ ঘরে প্রবেশ করে বাবার সম্মুখে গিয়ে প্রণাম নিবেদন করে আসন গ্রহণ করতে যাবেন, এমন সময় ব্রহ্মচারী বাবা বললেন, হ্যাঁরে অভয়াচরণ, আজ তোর এখানে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে তো?

অভয়াচরণ মনে করলেন, ব্রহ্মচারী বাবা বোধহয় তার পথশ্রমের কথা বলছেন। কিন্তু পরক্ষণেই বাবা বললেন, অভয়াচরণ একটু গাঁজা সেজে নিয়ে আয় তো। এবার তার মনের ভুল ভাঙ্গলো। অবাক হয়ে তিনি ভাবতে থাকেন যে, ব্রহ্মচারী বাবা তার নাম কি করে জানলেন? তিনি তো আগে কখনও এখানে আসেননি বা তার পরিচিত কেউও এখানে নেই। তাছাড়া তিনি যে গাঁজা সেবন না করে এতটা পথ এত কষ্ট করে এসেছেন, সে কথাই বা বাবা কি করে জানলেন? বাবা কি করে জানলেন যে তিনি গাঁজা সেবন না করে থাকতে পারেন না? বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গাঁজা নিয়ে আসতে যান। বাবা লোকনাথ তখন গীতা নিয়ে বারান্দার এক কোণায় এসে বসেন।

ব্রহ্মচারী বাবার আদেশ পেয়ে অভয়াচরণ ভালো করে গাঁজা সেজে নিয়ে এসে দেখেন যে বাবা বারান্দায় বসে গীতাপাঠ করছেন। তিনি বাবার সামনে এসে বসেন। সেইসময় এক দমকা হাওয়ায় গাঁজার কলকের ধোঁয়া গিয়ে বাবার নাকে প্রবেশ করে। বাবা তখন অভয়াচরণকে বলেন, নে তুই এবার গাঁজা সেবন কর। অভয়াচরণ অবাক বিস্ময়ে দেখেন হাওয়ায় গাঁজার ধোঁয়া কেবল বাবার নাকেই প্রবেশ করছে, অন্য কোনোদিকে যাচ্ছে না। তিনি বাবাকে বলেন, বাবা, আপনি প্রসাদ করে দেবেন না? বাবা বললেন, প্রসাদ করা হয়েছে। অভয়াচরণ তখন বুঝলেন, বাবার ইচ্ছাশক্তিতে গাঁজার কলকের ধোঁয়া হাওয়ায় বাবার নাকে প্রবেশ করে প্রসাদহয়েছে। তিনি বুঝতে পারলেন, বাবা লোকনাথ কে কেন লোকে সচল শিব বলেন। বাবার আজ্ঞায় তিনি আনন্দিত হয়ে গাঁজা সেবন করতে থাকেন। গাঁজা সেবন করতে করতে অভয়াচরণ ভাবতে থাকেন, তার চন্দ্রনাথ তীর্থে শিবচতুর্দশীর দিন যাবার বাসনা ছিল। অর্থভাবে যাওয়া হল না। যদি তিনি চন্দ্রনাথ তীর্থে যেতেন, তবে এমন শিবযোগী মহাপুরুষ দর্শন করতে পারতেন না। বারদী আশ্রমে এসে যেন তার সাক্ষাৎ ব্রহ্মদর্শন হলো। এত বছর পাহাড়-পর্বতে ভ্রমণ করে যে শক্তির সন্ধান করেছেন, আজ বারদী গ্রামে এসে তার সাক্ষাৎ হলো। আর তার পাহাড়-পর্বতে যাবার প্রয়োজন নেই। তার মনে হল এখানে আসার পর যা ঘটছে, তাতে মনে হয় তিনি এই ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের শরণ পথেই আছেন। তিনি নিজে এক আত্মতৃপ্তি লাভ করলেন এবং আশ্রমে রাত্রিবাস করলেন। রাতে তিনি মনে মনে ভাবলেন, কাল প্রত্যূষে এই সচল শিবের কৃপা ভিক্ষা করবেন।

পরদিন সকালে বাবাকে দর্শন করে, প্রণাম করে তিনি বাবার কৃপা ভিক্ষা করলেন। বাবা লোকনাথ তাকে বললেন, তুই নিজেই তো একজন ব্রহ্মচারী, তুই আবার আমার কাছে কৃপা ভিক্ষা করছিস কেন? অভয়াচরণ নিজেকে অভয় ব্রহ্মচারী রূপে পরিচয় দেন। ব্রহ্মজ্ঞ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী’ শব্দের প্রকৃত অর্থ অবহিত আছেন। বেদ অর্থে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী সারা জগৎকে ধারণ করেন। একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী যে পথে চলেন, স্বয়ং দেবতারাও তাকে পথ করে দেন। কেবলমাত্র গেরুয়া বসন ধারণ করে সন্ন্যাসী হলে ব্রহ্মচারী হওয়া যায় না। জগৎ ধারণ ও পালন করার কর্তব্যও তাকে পালন করতে হয়। সেইজন্যই বাবা অনেককে বলতেন, আমি যেদিকে তাকাই কেবল আমাকেই দেখি। একজন ব্রহ্মচারী সারা জগৎ পরিব্যাপ্ত করে থাকেন। অভয় ব্রহ্মচারী সেই অর্থে এখনও ব্রহ্মচারী হননি। পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়ালেও তিনি কর্মযোগে প্রবৃত্ত নন। তাই বাবা তাকে বলেছেন, তুই তো নিজেই ব্রহ্মচারী, তবে আমার কৃপা চাইছিস কেন? একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী নিজেই ব্রহ্ম। তিনি অন্যদের কৃপা করেন, কিন্তু তার কারও কৃপার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অভয় ব্রহ্মচারী কি বাবার কথার এই গূঢ় অর্থ বুঝতে সক্ষম হবেন! অভয় ব্রহ্মচারী মনে মনে ভাবলেন, বুঝেছি ঠাকুর, আপনি ধরা দিতে চান না। তা তো হবে না। যাঁকে দেখবার জন্য আহার, নিদ্রা, পিপাসা সব ত্যাগ করে ছুটে এসেছি, মহাতীর্থ চন্দ্রনাথে না গিয়ে সচল শিবের দর্শন ও কৃপালাভের আশায় উন্মত্ত হয়েছি, সেই পরম শিবময় পুরুষ আমায় প্রত্যাখ্যান করবেন, এটা হতে পারে না। যে জীবন্ত শিবের কৃপালাভের আশায় আমি ক-দিন ধরে উপবাস করে আছি, আজ দেখি কি করে তিনি আমায় প্রত্যাখ্যান করেন। যদি আমার ভক্তি একনিষ্ঠ হয়, তবে তার সাধ্য কি ধরা না দিয়ে যান।

অভয়াচরণের কৃপা ভিক্ষার আর্জিতে বাবা আর কোনো সাড়া দিলেন না। অভয়াচরণ তখন বাবার দুয়ারে তিনবার মাথা ঠুকে আশ্রম ত্যাগ করতে উদ্যত হলেন। মনে গভীর বেদনা নিয়ে তিনি ধীরে ধীরে আশ্রমের দ্বারের দিকে চলেছেন। এমন সময় উপস্থিত ভক্তগণের মধ্যে একজন উকিল বাবাকে বললেন, বাবা উনি তো গতকাল থেকে এখানে উপোস করে আছেন। শিবচতুর্দশীর উপোস করে প্রসাদ না খেয়ে উনি আশ্রম ছেড়ে যাচ্ছেন কেন? তখন বাবা লোকনাথ বললেন, ওকে বসতে বল। ওর আহারের জন্য এখনি আহার মিলবে।

বাবার এই কথা অভয়াচরণকে বললে তিনি ব্যথিত হয়ে চড়া গলায় বাবাকে শুনিয়ে বলেন, আমি বামুনের ছেলে। দু-একদিন না খেলে মরবো না। খুব ক্ষিদে পেলে তিন বাড়ি ঘুরে তিন মুঠো চাল পেলে নিজে রান্না করে খাব। আমি এখানে খেতে আসিনি। যে জন্যে আমার এখানে আসা, তাই যদি না পেলাম, তবে কি জন্যে এখানে থাকবো? অভয়াচরণ প্রচণ্ড গাঁজাসক্ত ছিলেন। গাঁজা সেবন না করে থাকতে পারতেন না। তবুও তিনি বাবার আজ্ঞায় একবার ভিন্ন সেই ঘর হতে বার হওয়া থেকে এখন অবধি আর গাঁজা সেবন করেননি। শরীরের সব কষ্ট সহ্য করেছেন কেবল এই ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের কৃপা লাভের আশায়। বাবা যখন তাঁকে নিজে গাঁজা সেজে আনতে বলেছিলেন, তখন তিনি ভেবেছিলেন, এখানে তার অভিষ্ট অবশ্যই পূরণ হবে। কিন্তু পরদিনই কেন তিনি কৃপাভিক্ষা মঞ্জুর করলেন না, সেটাই অভয়াচরণ বুঝতে পারছেন না। তাঁর মনের মধ্যে সব গণ্ডগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে বাবা অভয়াচরণকে কঠিন পরীক্ষা করছেন। ১৭ বছর পাহাড়-পর্বতে সে যে ব্রহ্মচর্য পালন করে এসেছেন, তা কতটা খাঁটি তিনি পরখ করে দেখতে চাইছেন। অভয়াচরণ যখন বলেন, তিনি ভিক্ষান্নে জীবনধারণ করতে পারেন, বাবা তাতে খুশি হন। বুঝতে পারেন যে অভয়াচরণের ব্রহ্মচর্য পালনে নিষ্ঠা ছিল। কিন্তু কর্মযোগে প্রবৃত্ত হবার মতো গুরুর অভাব ছিল। ভক্তকে ভগবান সর্বদা পরীক্ষার মধ্যে ফেলেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে পারলে তবেই তার কৃপা পাওয়া যায়।

বাবার মনের ভাব বুঝতে না পেরে অভয়াচরণ আবার আশ্রমদ্বারের দিকে পা বাড়ায়। ঠিক সেই সময় একজন রমণী নানাবিধ অন্নব্যঞ্জন ও মিষ্টান্ন ভোগ সাজিয়ে উপবাসের পর বাবা লোকনাথকে নিবেদন করার জন্য নিয়ে আশ্রমে প্রবেশ করলেন। সারারাত্রি উপবাস করে বাবার কাছে নিবেদন করে উপবাস ভঙ্গ করার জন্য সে নানাবিধ উপচারে ভোগ নিয়ে এসেছে। বাবা লোকনাথ তার সিদ্ধিবলে জানতেন যে তার জন্য ভোগ আগতপ্রায়। সেইজন্যই তিনি অভয়চরণকে এতক্ষণ পরীক্ষা করছিলেন। এবার ভোগের থালা দেখে স্নেহভরা কণ্ঠে তাকে ডেকে বললেন, অভয়াচরণ, তোর খাবার এসেছে। এবার খেয়ে উদরপূর্তি কর।

সেই স্নেহভরা কণ্ঠস্বরকে আর উপেক্ষা করতে পারলেন না অভয়াচরণ। তিনি অশ্রুপূর্ণ নয়নে উপবাস ভঙ্গ করার জন্য বাবার সামনে এসে বসতেই, বাবা সেই রমণীকে বললেন, তুই সরে যা এখান থেকে। রমণী বাবাকে প্রণাম করে শশব্যস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেই অভয়াচরণ সেই প্রসাদ খেতে আরম্ভ করলেন।

রমণী বাইরে বেরিয়ে এসে ভাবলেন, তিনি বাবার উপবাস ভঙ্গের জন্য সারারাত্রি একনিষ্ঠভাবে এই ভোগ রান্না করে এনেছেন। বাবা তার ভোগ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অন্য একজন সাধুকে তা খাইয়ে দিলেন। তিনি এর কোনো কারণ খুঁজে পেলেন না।

ভগবান কোনো কাজ কেন করেন, তা ভক্তের বোধগম্য হয় না। কিন্তু তাঁর কাজ সর্বদা ভক্তের মঙ্গলের জন্যই হয়। নর্মদা পরিক্রমার সময় উপবাসে থেকে মামলেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গের অভিষেক পূজা করে সস্ত্রীক যেই আমরা গর্ভগৃহ থেকে নাটমন্দিরে বেরিয়েছি, একটি হনুমান এসে অনেক দ্রব্যের মধ্যে কেবল প্রসাদটি নিয়ে চলে গেল। আমি তার দিকে তাকাতেই, মহন্তজি বলেছিলেন, এ অতি শুভ লক্ষণ। মামলেশ্বরের প্রসাদ হনুমানজিকেই খেতে দিন। এতে ভক্তের মঙ্গল হয়। রমণীর অনেক আকাঙ্ক্ষা করে বাবার জন্য নিয়ে আসা ভোগ বাবা অভয়াচরণকে খাইয়ে দিলেন, তাতে রমণীর কল্যাণই সাধিত হবে।

এদিকে অভয়াচরণ পরমতৃপ্তি সহকারে বাবার সামনে বসে প্রসাদ খেতে থাকলেন। প্রায় অর্ধেক খাওয়া হয়ে যাবার পর বাবা তাকে বললেন, এ যে কায়েতের মেয়ের হাতের রান্না খাচ্ছিস, অভয়চরণ।

এ কথা শুনে অভয়াচরণ বললেন, আমি তো ঠাকুরের প্রসাদ খাচ্ছি। চণ্ডালের মেয়ের হাতের রান্না হলেই বা দোষ কি?

বাবা লোকনাথ অভয়াচরণের এই উক্তিতে অতিশয় আনন্দিত হলেন এবং তার সত্য জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে খুশি হলেন। অভয়াচরণ ভোগ খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে সেদিন আশ্রমেই থেকে গেলেন। তার মনের মধ্যে আলোড়ন চলতে থাকল যে বাবা তাকে অভিষ্ট কৃপা দিচ্ছেন না, অথচ তার প্রতি স্নেহপূর্ণ মনোভাবও দেখাচ্ছেন। তাকে নিবেদন করা ভোগ তিনি অভয়চরণকে সামনে বসিয়ে খাওয়ালেন। তিনি বুঝতে পারেন, বাবা নিশ্চয়ই তাকে পরীক্ষা করছেন। একজন ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষের কৃপা পেতে গেলে তাকে পরীক্ষা তো দিতেই হবে। তিনি মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন যে বাবার যে কোনো পরীক্ষাতে তাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে এবং এজন্য তিনি কিছুদিন আশ্রমেই অবস্থান করলেন। তারপর একদিন সকালে বাবার দর্শন করে অভয়াচরণ বিদায় চাইলেন। বাবা তখন তাকে বললেন, হারে অভয়াচরণ, যার জন্য তুই ১৭ বছর পাহাড়-পর্বত ঘুরে বেড়িয়েছিস, তা কি তুই পেয়েছিস? অভয়াচরণ বাবাকে বললেন, না পাইনি।

বাবা তখন অভয়াচরণের ডান হাতের কব্জিটা নিজের ডান হাতে ধরে বললেন, যার জন্য ঘুরেছিস, তা তোর ডান হাতে বেঁধে দিলাম। আর তোকে ঘুরতে হবে। না! শুধু ঘুরে বেড়ালে কি হবে রে? জানবি কর্মই ব্ৰহ্ম। কর্মের মধ্যে দিয়েই ব্রহ্মকে জানতে হবে, তাকে পেতে হবে। এরপর তিনি রজনী ব্রহ্মচারীকে ডেকে বললেন, রজনী তুই অভয়াচরণকে সঙ্গে নিয়ে যা। বুঝিয়ে দে, তুই এখন কি কর্ম করছিস। আর ওকে বেশ করে খাইয়ে দিস। তারপর অভয়াচরণকে বললেন, শোন অভয়াচরণ, রজনী যা, আমিও তা। রজনী আমার সীলমোহর।

ওদিকে বাবা লোকনাথ যখন অভয়াচরণের ডানহাত স্পর্শ করলেন, তিনি সর্বাঙ্গে এক অপূর্ব শিহরণ অনুভব করলেন। তাঁর সমস্ত শরীরে যেন কোনো বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবেশ করল। তিনি কয়েক মুহূর্তের জন্য মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। তার মুখ দিয়ে কেবল অস্ফুট শব্দ বেরোতে লাগলো’কর্মই ব্রহ্ম’! কর্মই ব্ৰহ্ম! আজ থেকে আমি কর্মযোগী। এখন থেকে আমাকে কর্মযোগে নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। বাবা লোকনাথ তাঁর হাত ছেড়ে নাম দিলেন অভয় ব্রহ্মচারী। এবার ব্রহ্মশক্তির অংশ পেয়ে অভয় ব্রহ্মচারী নামে সে পরিচিত হবে। প্রবৃত্ত হবে বাবা লোকনাথ প্রদর্শিত পথে। তার মনের ঐকান্তিক কামনা এতদিনে পূর্ণ হলো। সচল শিব দর্শন তার সফল হলো।

বাবা লোকনাথ অভয়াচরণকে কৃপা করলেন, কিন্তু তার কর্মগুরু ও পথপ্রদর্শক করলেন রজনী ব্রহ্মচারীকে। বাবা বুঝেছিলেন যে, অভয়াচরণের মধ্যে ব্রহ্মচর্যের শক্তি আছে, কিন্তু কর্মযোগ ভিন্ন তার প্রকাশ সম্ভব নয়। তিনি তার মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত করে দিলেন যাতে অভয়াচরণ কর্মযোগে সফল হতে পারেন। এ তার অহৈতুকি কৃপা। একজন ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের থেকে যখন যোগশক্তি কোনো ভক্তের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, তখন তার মনের জমি সহজে উর্বর হয় এবং তার অন্তরস্থিত জীবাত্মা সহজে মহামায়া সৃষ্ট মায়ার বন্ধন কাটিয়ে মস্তকে স্থিত পরমাত্মাকে দর্শন করতে সমর্থ হয়। বাবার এই কৃপা অভয়াচরণকে সাধনপথে একধাক্কায় অনেকখানি এগিয়ে দিলো। বাবার থেকে যে কতিপয় ভাগ্যবান ব্যক্তি এইভাবে বাবার যোগশক্তির কিছু কণা পেয়েছিলেন, অভয়াচরণ তাদের মধ্যে একজন।

রজনী ব্রহ্মচারী বাবা লোকনাথের আদেশানুসারে অভয়াচরণকে সঙ্গে নিয়ে তার ঢাকা আশ্রমে এলেন। অভয়াচরণ সেখানে তিনদিন বাস করার পর আবার অজানা পথে বেরিয়ে পড়লেন। বাবা লোকনাথ তাঁকে রজনী ব্রহ্মচারী নির্দেশিত কর্মযোগের পথে অগ্রসর হতে উপদেশ দিয়েছিলেন। জানা যায় যে অভয় ব্রহ্মচারী তার নিজ গ্রামে এসে একটি আশ্রম স্থাপন করেন। ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরপট্টি গ্রাম ছিল একটি অখ্যাত পল্লী। যেখানে প্রচুর গরীব মানুষের বাস। অভয় ব্রহ্মচারী এই দরিদ্র মানুষের মধ্যে থেকে তাঁর কর্মযোগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মনস্থ করেছিলেন। তিনি তার গ্রামে এতদিন এক ভবঘুরে সন্ন্যাসীরূপেই পরিচিত ছিলেন। তার উপর তার নিত্য গাঁজা সেবন করার অভ্যাসকে নাগরিক সমাজ খুব ভালো চোখে দেখতো না। কিন্তু তাদের সেই অভয়াচরণ যখন অভয় ব্রহ্মচারী হয়ে গ্রামে ফিরলেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। বাবা লোকনাথ তাকে যে কর্মযোগের পথে এগোতে বলেছিলেন, তিনি গ্রামে আশ্রম স্থাপন করে সেই কাজেই বেশ কিছুদিন প্রবৃত্ত রইলেন। তারপর বাবা ধরাধামে থাকাকালীন তিনি একবার মাত্র বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বারদী আশ্রমে এসেছিলেন। তখন বাবার সঙ্গে তার কি কথোপকথন হয় সেটা জানা যায়নি। তবে এরপর আর তার কোনো খবর পাওয়া যায় না। ব্রহ্মচারী বাবার ব্রহ্মশক্তির সামান্য অংশ নিয়ে তিনি সাধনমার্গের কোন স্তরে উন্নীত হতে পেরেছিলেন, বাবার ভক্তগণ তা জানতে সক্ষম হল না। বাবার উপদেশ মতো আশ্রম স্থাপন করে তিনি কর্মযোগে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু পরবর্তীকালে হয়তো বাবার দ্বারা সঞ্চারিত ব্রহ্মশক্তির বলে তিনি নিজ মুক্তির পথের সন্ধান পেয়ে যান। তাই সাধক সমাজ আর তার সন্ধান পান না। ব্রহ্মশক্তির বলে জীবাত্মায় যে জ্ঞানের আলোয় উদ্দীপিত হয় তাতে সাধক নিজমুক্তি কামনায় প্রবুদ্ধ হতেই পারেন। সেই জ্ঞানের আলোয় যে-সব সাধক সমাজকে আলোকিত করতে চান, মানবকল্যাণ সাধন করতে চান, তারাই ঈশ্বরকোটির সাধক হন। এমন উচ্চমার্গের সাধক জগতে কমই এসেছেন।

.

রজনী ব্রহ্মচারী

রজনীকান্ত চক্রবর্তী ঢাকা সাব জজ আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। ঢাকা শহরে তাঁর বেশ পরিচিতি ছিল। সুখী স্বচ্ছল সংসার। রজনীবাবু ও তার স্ত্রী উভয়েরই আধ্যাত্মিক বিষয়ের প্রতি অনুরাগ ছিল। সংসারধর্ম পালন করতে থাকলেও তাদের উভয়ের মধ্যেই এক বিষয় বৈরাগ্যের সঞ্চার ঘটে। নিত্য সংসারধর্ম পালনে ক্রমে তাদের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক অতৃপ্তি জেগে ওঠে এবং মন অশান্ত হয়ে ওঠে। উভয়ের উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধায় কোনো রকমে সংসার বন্ধন টিকে থাকে। রজনীবাবুর বুদ্ধিমতি স্ত্রী বুঝতে পারেন যে তার স্বামীর ধর্মপথে অগ্রগতির প্রধান প্রতিবন্ধক সংসারবন্ধন। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই স্বামীকে সংসার ত্যাগ করতে দিতে চান না। সংসারে থেকেই সংসারবন্ধনকে কাটাবার জন্য রজনীবাবুর ভক্তিমতি স্ত্রী একটি উপায় বার করেন। একসময় তিনি এক ব্রত পালন উপলক্ষে তার স্বামীকে কর্মস্থল থেকে বাড়িতে আসার অনুরোধ জানান। রজনীবাবু আদালত থেকে বাড়ি এলে সারাদিন স্ত্রীর ব্রতপালন অনুষ্ঠান চলে। রাত্রিতে শয়নকালে রজনীবাবুর স্ত্রী তাঁর কাছে একটি বর প্রার্থনা করেন। রজনীবাবু খুবই আশ্চর্য হয়ে বর দিতে রাজি হলে তাঁর স্ত্রী বলেন, আজ হতে তোমার আমার মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক অর্থাৎ সহবাসের সম্পর্ক থাকবে না। রজনীবাবু তখন তাঁর স্ত্রীকে বলেন, বেশ তাই হবে। আজ থেকে তুমি আমার মা হলে। তোমার উপর আমার মাতৃভাব থাকবে। রজনীবাবুর স্ত্রী তখন বললেন–হ্যাঁ, আমি তাই হলাম।

রজনীবাবু ও তার স্ত্রী উভয়েরই ধর্মপথে যে সংসারবন্ধন কাঁটাস্বরূপ ছিল, তা দূরীভূত হলো। ধর্মপথে উভয়ের অগ্রসর হওয়া নিষ্কন্টক হলো। এরপর উভয়েই নিজ নিজ মতে আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অগ্রসর হতে থাকেন। রজনীবাবুর স্ত্রী ব্রহ্মচারিণী রূপে জীবনযাপন করতে থাকেন এবং একদিন ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে দেবলোকের পথে যাত্রা করেন।

স্ত্রী গত হবার পর রজনীবাবু ইতস্ততঃ বিভিন্ন জায়গায় সাধুদর্শনে যেতে থাকেন মনের শান্তি ও আধ্যাত্মিক পথ নির্দেশের আশায়। কিন্তু কোথাও তার অশান্ত মন শান্তি খুঁজে পায় না। মাঝে মাঝে তিনি ঢাকার গেন্ডারিয়ায় গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আশ্রমে যেতেন। মনে কিছুতেই শান্তি আসে না। এক আধ্যাত্মিক অতৃপ্তি তার সারা মন জুড়ে বিরাজ করতে থাকে। একদিন গোঁসাইজি তাকে বলেন, শোন রজনী, তুমি একবার বারদীর ব্রহ্মচারীকে দর্শন করে এসো। এমন উঁচুদরের মহাপুরুষ আমি কোথাও দেখিনি। রজনীবাবু গোঁসাইজির কথা শোনেন, কিন্তু তার অশান্ত মনে সে কথা কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। তিনি অনেক সাধু-সন্ন্যাসীর আখড়া ঘুরেছেন, কিন্তু এমন কাউকে খুঁজে পাননি যাঁকে দর্শন করে তাঁর অশান্ত মন তৃপ্ত হয়ে ওঠে। এইভাবে স্ত্রী বিয়োগের ব্যথা নিয়ে অতৃপ্ত মনে তিনি জীবনযাপন করতে থাকেন।

এরপর একদিন সাব জজ কোর্টের এক উকিল মহাশয় রজনীবাবুর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করার পরামর্শ দেন। যে উপদেশ গোঁসাইজি দিয়েছিলেন সেই একই পরামর্শ উকিলবাবুর কাছে শুনে রজনীবাবুর মনে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শনের ইচ্ছা হয়। তিনি তখন আর দেরি না করে তার আদালতের বৃন্দাবন নামক একজন পিওন ও ঢাকা মুন্সেফ আদালতের উকিল বিষ্ণুচরণ চক্রবর্তীকে নিয়ে বারদী আশ্রমে যাওয়া ঠিক করেন।

সেই সময়টা ছিল ১২৯৪ সালের শ্রাবণ মাস। যাবার দিন নদীর ঘাটে বৃন্দাবন ও রজনীবাবু এসে পৌঁছেছেন। কিন্তু বিষ্ণুবাবুর দেখা নেই। তারপর হঠাৎ বিষ্ণুবাবু হন্তদন্ত হয়ে এসে খবর দিলেন যে একটি বিশেষ পারিবারিক কারণে তিনি সেদিন যেতে সমর্থ হচ্ছেন না। অতঃপর রজনীবাবু বৃন্দাবনকে সঙ্গে নিয়েই নৌকাযোগে বারদীর পথে পাড়ি দিলেন।

রজনীবাবুর নৌকা সূর্যোদয়ের কিছু পূর্বে যখন বারদী বাজারের পশ্চিমদিকের আখড়ার কাছে পৌঁছলো, তখন পাড়ে দাঁড়ানো একটা নৌকা থেকে একজন জিজ্ঞাসা করলো, এই নৌকা কোথা থেকে আসছে? বৃন্দাবন তখন নৌকা থেকে উত্তর দিলো, ঢাকা থেকে। পাড়ের নৌকা থেকে আবার প্রশ্ন হলো, এই নৌকায় রজনীবাবু এসেছেন নাকি? তখন বৃন্দাবন পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনি জানলেন কি করে? এবার পাড়ের নৌকা থেকে উত্তর এলো, ঢাকা থেকে বিষ্ণুবাবু এসে বলে গেছেন।

এই কথা শুনে রজনীবাবু ও বৃন্দাবন দুজনেই যারপরনাই বিস্মিত ও হতবাক হলেন। তারা ভাবতে লাগলেন, এ কি করে সম্ভব? বিষ্ণুবাবু তো নিজেই তাদের রওনা হবার সময় নদীর ঘাটে এসে জানিয়ে গেলেন যে কিছু পারিবারিক কাজের জন্য তিনি তাদের সঙ্গে বারদী আসতে পারবেন না। তাই তো তারা দুজনে রওনা হয়ে এলেন। এখন তাদের নৌকা সবে ঘাটে এসেছে। এর মধ্যে বিষ্ণুবাবু তাঁদের আগে পৌঁছে কি করে তাদের আগমন সংবাদ দিয়ে গেলেন। রজনীবাবু চমৎকৃত হলেন এই ভেবে যে, এটা নিশ্চয়ই সেই বারদী ব্রহ্মচারী বাবার এক লীলা। বৃন্দাবনের কাছে গোটা ব্যাপারটা বোধগম্য হল না। সে নিঃশব্দে রজনীবাবুকে অনুসরণ করে বারদী আশ্রমের পথে এগুতে থাকলো।

বারদীর আশ্রমে প্রবেশ করেই রজনীবাবুর মনে হল তিনি যেন কোন পুরাকালের মুনি-ঋষির আশ্রমে এলেন। আশ্রমের ভূমিতে পা রেখেই তিনি এক পবিত্রতার স্পর্শ পান। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আশ্রম। চারিদিকে নানা সুরভিত ফুল ও ফলের গাছ শোভিত। উঠোনের মাঝে একটি বেলগাছ। চারহাত উঁচু। গাছটি উপরে উঠে তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। শাখাগুলি উপরে উঠে এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যেন তার ছায়ায় আশ্রমে আগমনকারীরা সুশীতল হন। সেই বৃক্ষের নিচে কিছু ভক্ত উপবেশন করেছিলেন। আশ্রমের ডানদিকে লোকনাথ বাবার আসন-ঘর। ঘরের বাইরে একটি বিস্তৃত বারান্দা। রজনীবাবু আশ্রমে আসার সময় একটি মিছরির পুঁটলি সঙ্গে করে এনেছিলেন। তিনি বৃন্দাবনকে সঙ্গে নিয়ে লোকনাথ বাবার ঘরে প্রবেশ করে মিছরির পুঁটলিটা তার পায়ের সামনে রেখে তাঁর চরণে মাথা ঠেকিয়ে যেই প্রণাম করেছেন, অমনি তার নাকে এক অতি সুমিষ্ট দিব্য গন্ধ প্রবেশ করলো এবং বাবার চরণ স্পর্শে তার সমস্ত শরীর শিহরিত হলো। তিনি পাগলপ্রায় হয়ে দুহাত তুলে লাফাতে লাগলেন। এ গন্ধ তো যে সে গন্ধ নয়! এ যে এক অপার্থিব দিব্য গন্ধ, যা কেবল দেবতাদের শরীর থেকেই নির্গত হতে পারে। বাবা লোকনাথ স্থির হয়ে আসনে উপবিষ্ট। রজনীবাবু পাগল হয়ে আবার বাবার চরণে মাথা স্পর্শ করলেন এবং প্রায় ১৫ মিনিট সেইভাবে বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় রইলেন। ১৫ মিনিট পর যখন তার বাহ্যজ্ঞান ফিরে এলে তিনি বাবার ডানদিকে মাটির উপর ধপ করে বসে পড়ে বাবার পলকহীন দুই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বাবার চোখের সঙ্গে তার যখন দৃষ্টি বিনিময় হলো, তখন তিনি কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। চলে গেছেন অন্য এক জগতে। কিছুক্ষণ এইভাবে নীরব দৃষ্টি বিনিময়ের পর বারান্দায় পাতা একটি কুশাসন দেখিয়ে বাবা তাকে সেখানে গিয়ে বসতে বললেন। রজনীবাবু বাবাকে করজোড়ে বললেন, আপনার চরণপদ্ম ছাড়া আর কোথাও বসবার বাসনা আমার নেই। রজনীবাবুর মধ্যে আধ্যাত্মিক অনুভূতি তো ছিলই। সংসারী হয়েও তিনি বৈরাগ্য জীবনযাপন করেছেন, ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। বাবার চরণস্পর্শে তিনি যে দিব্য অনুভূতি পেয়েছেন, সেটা ছেড়ে আর কোথাও তিনি যেতে চান না। বাবা তখন একটু কঠোরস্বরে রজনীবাবুকে বললেন, ওই বাসনাতেই তো সব মাটি করলি।

রজনীবাবু বাবার কথার অর্থ বুঝতে পারেন না। ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের সব কথার অর্থ বোঝা সহজ কাজ নয়। রজনীবাবু ভাবতে লাগলেন, আমি তো কোনো বিষয় বাসনা নিয়ে এখানে আসিনি। বাবার চরণদর্শনই আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল। বাবার কৃপায় সেই চরণের আত্মিক দর্শন হয়েছে। আর তার কি বাসনা থাকতে পারে। এমন ভাবতে ভাবতে দেখেন লোকনাথ বাবার দুই চোখ একেবারে স্থির। তার দৃষ্টি যেন বহুদূরে কোথাও নিক্ষেপিত হচ্ছে। তার দেহে কোনো শ্বাস প্রশ্বাসের লক্ষণ নেই। দেহ কাষ্ঠবৎ স্থির। যেন পটে আঁকা কোনও ছবি। তার দেহটি আশ্রমের এই ঘরে উপবিষ্ট থাকলেও তিনি যেন এই দেহে নেই। চলে গেছেন কোথাও কোন্ অজানা দেশে। এমনভাবে প্রায় আরও ১৫ মিনিট কাটল। তারপর তাঁর দেহে প্রাণের স্পন্দন দেখা দিল। তিনি রজনীকান্তের দিকে স্থির কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন।

রজনীকান্তের দিকে স্থিরদৃষ্টি রেখে গম্ভীরস্বরে তিনি তাকে অনেক প্রশ্ন করতে থাকলেন। রজনীকান্ত তার উত্তর দিতে থাকলেন। এরপর হঠাৎ বাবা রজনীকান্তকে বললেন, অনেকদিন হল তোর স্ত্রী গত হয়েছেন। তুই আবার বিয়ে করলি না কেন? তুই ভাবলি বিয়ে করলে তোর ব্রহ্মজ্ঞান হবে না! তুই একটা কাপুরুষ।

রজনীকান্ত নিজে থেকে তার সম্বন্ধে কোনো কথাই এ যাবৎ বাবাকে বলেননি। তিনি ভাবলেন, বাবা কি করে স্ত্রীর কথা জানলেন। তিনি বাবার কথা শুনে চমকে উঠলেন। এতদিন যে সমস্ত সাধুসন্ন্যাসী তিনি দর্শন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনি এইরূপ দিব্যপ্রকাশ ও ক্ষমতা দেখেননি। সেজন্যই তিনি বাবার কথায়, চমকে গিয়েছেন। বিস্ময় ভাঙলে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বাবাকে বললেন, কাপুরুষ না হলে এখানে আসব কেন? বাবা লোকনাথ তখন করুণামাখা স্বরে বললেন, কিরে, তুই আমার কথায় চলি না যে? রজনীকান্ত তখন বললেন, চট্র কেন? চার কি আছে? কাপুরুষকে কাপুরুষ বলেছেন। আমাকে যদি দুটো চড় কিংবা জুতোর বাড়িও দেন, তাহলেও চট্র না। আমি আপনাকে চিনেছি, বুঝেছি। আমি বুঝেছি, নিতান্ত পাষণ্ডও যদি আপনার সাক্ষাতে আসে, সেও চটতে পারে না।

একজন ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি ও তার ভক্তের মধ্যে এই আলাপন এক গভীর ইঙ্গিত বহন করে। কোনো সিদ্ধ মহাযোগী সহজে কারোকে তার কাছে ঘেঁষতে দেন না। যে তার কাছে আসার চেষ্টা করে, তার প্রতি সে এমন দুর্ব্যবহার করে, ভয় দেখায় যেন সে বিরক্ত হয়ে দূরে সরে যায়। কিন্তু আগন্তুক যদি সেই রূদ্ররূপকে সহ্য করে মহাযোগীর সান্নিধ্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে না ছাড়েন, তবে অন্তে তার কোমল হৃদয়ে জায়গা অবশ্যই পায়। আমি নর্মদা পরিক্রমা করার সময় দক্ষিণ তটে এইভাবে দুবার এইরকম পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। প্রাথমিকভাবে আমি খুবই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সেই ঋষিদের চরণ ছেড়ে বেরিয়ে আসিনি। যা থাকে কপালে মনে করে তাদের চরণ ছাড়িনি। অন্তে দুজনেই আমাকে তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন এবং আমাকে সস্ত্রীক আশীর্বাদ ও বর প্রদান করেছিলেন।

রজনীকান্ত আজ কোনভাবেই এই মহর্ষির কৃপাদৃষ্টি থেকে নড়বেন না স্থির করেছেন। তাই বাবার কোনো কথায় তার প্রতি রজনীকান্তের রাগ, বিরূপতা কিছুরই উদ্রেক হচ্ছে না।

এবার বাবা তাকে বললেন, রজনী, তুই আবার বিয়ে কর। এই আমার আদেশ। বাবা এবার আদেশ করে রজনীকান্তকে পরীক্ষা করছেন। রজনীকান্ত উত্তর দিলেন, আপনার এ আদেশ আমি পালন করতে পারবো না। একথা শুনে বাবা রাগত স্বরে বললেন, কেন পারবি না? রজনীকান্ত উত্তর করলেন, স্ত্রীলোকে আমার মাতৃভাব হয়েছে। অবশ্য এর পিছনে আমার বিগতা স্ত্রীর ভূমিকা ছিল। এরপর রজনীকান্ত তিনবছর পূর্বের সেই ব্রতের দিনের কথা বাবাকে বলেন, যেদিন সারাদিন ব্রত পালন করে তার স্ত্রী তাকে সংসার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর স্ত্রীকে মাতৃরূপে দেখার শপথ নিয়েছিলেন। এখন জগতের সব স্ত্রীলোকের প্রতিই তার মাতৃভাব।

বাবা লোকনাথ রজনীকান্তর মুখে এই কথা শুনে বললেন, সত্যযুগ ফিরে এল না কি রে? তাহলে তুই আমার কাছে এসেছিস কেন? আমারই তো উচিত ছিল তোর কাছে যাওয়া। সংসারবদ্ধ জীবের পক্ষে সহধর্মিণীর প্রতি মাতৃভাব স্থাপন করা তো সোজা কাজ নয়। এরূপ সংসার বৈরাগ্য একমাত্র তখনই হতে পারে যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়েই সংসারের মধ্যে থেকেও ব্রহ্মচর্য পালন করতে পারেন। এই ঘটনার প্রায় ১১ বছর পূর্বে এমন কাণ্ড ঘটেছিল দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সারদামাকে জগদম্বারূপে পূজা করে তাঁর প্রতি মাতৃভাব জ্ঞাপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ঈশ্বরকোটির ভগবৎ প্রেমে উন্মত্ত সাধক এবং সারদা মাতার মধ্যে ছিল মাতৃশক্তি।

বাবা লোকনাথ রজনীকান্তের ইন্দ্রিয়সংযম ক্ষমতার পরীক্ষা করছিলেন। ইন্দ্রিয়সংযম না করতে পারলে অবিদ্যাজনিত ক্লেশ দূর হয় না। সাধক পঞ্চভূতের দেহের পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়কে সংযত করে কর্মযোগে ব্রতী হন। এই পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়র মধ্যে একটি হল উপস্থ। উপস্থ সংযমের দ্বারাই ব্রহ্মচর্য পালিত হয়। যোগী পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়কে সংযত করতে পারলে পঞ্চক্লেশকে ক্ষয় করতে পারে। সেজন্য ইন্দ্রিয়সংযমবিনা অন্তরে ধর্মভাব স্থায়ী হতে পারে না। ইন্দ্রিয়সংযম যোগীকে স্থিতপ্রজ্ঞ করে। স্থিতপ্রজ্ঞ যোগীই জিতেন্দ্রিয় হতে পারেন। বাবা লোকনাথ ভাবেন, বিষয় উপভোগ না করলেই মানুষ জিতেন্দ্রিয় হতে পারে না। সেজন্য তিনি রজনীকান্তকে কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে থাকেন। অনেকে বিকলাঙ্গ হলে বা লোকনিন্দার ভয়েও বিষয় ভোগে বিরত থাকে। কিন্তু তাতে তারা জিতেন্দ্রিয় হয় না। এদের মনে বাসনা থাকে। এই বাসনার যতক্ষণ নিবৃত্তি না হয়, ততক্ষণ প্রজ্ঞা স্থির হয় না। যে মানব ইন্দ্রিয়সংযমের দ্বারা বাসনার নিবৃত্তি করতে পারেন, তাঁর মধ্যেই ঈশ্বরানুরাগ জন্ম নেয়। ঈশ্বরানুরাগ জন্মালে চিত্ত বিশুদ্ধ হয়। তখন আর কোনো সংসারের ভোগ বাসনা থাকে না। যোগীরা অষ্টাঙ্গ যোগ সাধনের মাধ্যমে এই পর্যায় পেরিয়ে আসেন, কিন্তু সংসারবদ্ধ জীবের পক্ষে এই পর্যায় পেরোনো অত্যন্ত কঠিন কাজ। সেজন্যই বাবা বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে রজনীকান্তের চিত্তশুচিতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চাইছেন।

রজনীকান্ত যখন বললেন, ‘কাপুরুষ না হলে আপনার কাছে আসব কেন? এই কথা শুনে বাবা অতীব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। যতক্ষণ মানুষের মনে অহংভাব থাকে, ততক্ষণ সে আত্মসামর্থকে বড়ো বলে মনে করে। সাধুসঙ্গের প্রতি আকুলতা তখন মনে স্থান পায় না। সাধুসঙ্গে প্রবৃত্তি দুই প্রকার ব্যক্তির হতে পারে। কেউ সাধুসঙ্গ করে ক্ষমতা-যশ লাভ করতে চায়। কেউ সাধুসঙ্গ করে ব্রহ্মলোকের সন্ধান চায়। বাবা লোকনাথ পরীক্ষা করে দেখছিলেন, রজনীকান্ত আসলে কি চায়। রজনীকান্তের অন্তরের ঈশ্বরলাভের আকুলতা ও তার পথের সন্ধানের আকুলতা বাবা লোকনাথকে চমৎকৃত করেছিল। তিনি রজনীকান্তকে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে বসতে বললেন।

রজনীকান্ত ঘর থেকে উঠে আশ্রমের উঠানে একটি আমগাছের নিচে গিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ জোড় ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। রজনীকান্ত কোনো হৃক্ষেপ না করে গাছের নিচে বৃষ্টির মধ্যে বসে রইলেন। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এতদিন জ্ঞানে অজ্ঞানে যা পাপ করেছি, তা এই মুক্ত মহাপুরুষের সামনে সব ধুয়ে যাক। আজ এই জলঝড়ে আমার দেহের যদি কোনো ক্ষতি হয় তবে এই মহাপুরুষই তার প্রতিকার করবেন। এই মনে করে যখন তিনি বৃষ্টিতে ভিজে একসা, তখন বাবা তাকে ডেকে বললেন, রজনী তুই উঠে আয়। আমার কাছে আয়। ওরে, তুই এখনও ছায়ার কচু। রোদ বৃষ্টি সইবি কি করে? একথা শুনে রজনীকান্ত বুঝলেন যে বারদী আসা তার সফল হয়েছে। তিনি গাছতলা থেকে উঠে কাকভেজা অবস্থায় বাবার সামনে এসে বসলেন।

বাবা তার সঙ্গে আবার ধর্মালোচনা করতে লাগলেন। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে সপসপে হয়ে গিয়ে তাঁর খুব তামাক খাবার ইচ্ছা হলো। রজনীবাবুর একটু তামাকে আসক্তি ছিল। অন্তর্যামী বাবা রজনীকান্তের মনের কথা জানতে পেরে তাঁকে বললেন, তুই কেমন ভক্ত রে, আমাকে একটু তামাক খাওয়াতে পারলি না? রজনীকান্ত তখন মনে মনে আনন্দিত হয়ে তামাক সাজতে গেলেন। রজনীকান্ত তামাক সেজে নিয়ে এসে বাবাকে দিলেন। বাবা তারপর নিজে প্রসাদ করে রজনীকান্তকে খেতে দিলেন। রজনীকান্ত বাবার আড়ালে নিয়ে খাবার চেষ্টা করতেই বাবা বলে উঠলেন, তা হবে না। আমার সামনে বসে খেতে হবে। রজনীবাবু তখন তামাক নিয়ে বাবার সামনে বসে টান দেন। কি আশ্চর্য! দুবার তামাকে টান দিয়ে তৃতীয়বার টান দিতে হুঁকোতে মুখ ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর চিরদিনের মতো তামাক খাবার ইচ্ছা চলে গেল। এরপর রজনীকান্ত আর কোনোদিন তামাক স্পর্শ করেননি।

তামাক খাওয়া হলে রজনীবাবু ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েন। বারদী আশ্রমে পৌঁছবার পর থেকে বাবা তাকে কত পরীক্ষা করছেন আর সঙ্গে সঙ্গে কত কৃপাও করছেন। তিনি ভাবে বিহ্বল হয়ে পড়েন। এরপর ভোগ গ্রহণ করতে যান। ভোগ গ্রহণ করে তিনি বাবার কাছে বিদায় নিয়ে ঢাকা ফিরে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বাবা তখন তাঁকে বলেন, আয়, একবার আমার বুকে আয়। রজনীবাবু বাবার কাছে যেতেই বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। সঙ্গে সঙ্গে বাবার হৃদয় থেকে রজনীকান্তের মধ্যে সঞ্চারিত হল এক অনির্বচনীয় শক্তির ধারা। রজনীকান্ত তার অন্তরে এমন এক শান্তি অনুধাবন করলেন যার প্রভাবে তাঁর চক্ষু দিয়ে অবিরল ধারায় আনন্দাশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। তিনি পেলেন এক অপার শান্তি। তার এতদিনের অশান্ত মন বাবা লোকনাথের শান্তিচ্ছায়ায় স্থান পেল। তার হৃদয়াসনে স্থান হল রজনীকান্তের।

মহাযোগী বাবা লোকনাথের স্নেহবাৎসল্য ছিল অপরিসীম। তিনি তাই তো বলতেন, সন্তানের মতো নিজের মনে করে একবার ডেকে দ্যাখ, আমি তোদের আমার বুকে রেখে দেবো। কিন্তু রজনীকান্তের মতো সবাই তা পারে কই?

এরপর থেকে রজনীকান্ত লোকনাথ বাবাকে বেশিদিন না দেখে থাকতে পারতেন না। প্রায়শঃই ব্যাকুলভাবে ছুটে আসতেন বারদীর আশ্রমে। সবসময় তার মন ছটফট করতো বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার চরণ দর্শনের জন্য। যিনি ব্রহ্মচারী বাবার হৃদয়ে আসনলাভ করেছেন, তিনি কি আর তাকে দর্শন না করে থাকতে পারেন!

একদিন বাবা লোকনাথের রজনীকান্তকে খুব দেখতে ইচ্ছা হলো। বাবা যখন কোনো বিশেষ ভক্তকে দেখতে ইচ্ছা করতেন, তখন তার কাছে তিনি সূক্ষ্ম নির্দেশ পাঠাতেন। তার নির্দেশ পেলেই সেই ভক্তের অন্তরে তাকে দর্শনের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হতো এবং সে ছুটে আসত বারদীর আশ্রমে। রজনীকান্ত বাবা লোকনাথের এক সূক্ষ্ম নির্দেশ পেলেন বিনা ছাতিতে খালি পায়ে আগামী ছুটির দিন বাবার কাছে আসতে। আদেশ পাবার সঙ্গে সঙ্গে রজনীকান্তর মনে বাবাকে দর্শনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাবা আগামী ছুটিতে যেতে বলেছেন। কোনোরকমে অনন্ত মনের কষ্টে তিনি প্রতিটি মুহূর্ত কাটান। কবে ছুটির দিন আসবে। অবশেষে ছুটির দিন বিনা ছাতিতে বিনা জুতোয় কাঠফাটা রোদ্দুরে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে বারদী আশ্রমে রজনীকান্ত এসে পৌঁছান। ঢাকা থেকে বারদীর দীর্ঘপথ প্রখর রৌদ্রতেজ মাথায় নিয়ে তপ্ত কাকুড়ে মাটিতে পা ক্ষত-বিক্ষত করে আশ্রমে এসে রজনীকান্ত বাবার চরণে মাথা রাখেন। বাবার চরণে মাথা স্পর্শ করা মাত্র এক অপার্থিব আনন্দের ধারা তার সারা শরীরে প্রবাহিত হতে লাগলো এবং তার সমস্ত পথশ্রান্তি মুহূর্তে অন্তর্হিত হলো। বাবা রজনীকান্তকে তখন আশ্রমে থাকার নির্দেশ দিলেন। রজনীকান্তের উপর আশ্রম দেখাশুনা করার ভার পড়লো। আশ্রম পরিচালনার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রজনীকান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বাবার ও ভক্তদের সেবা করতে লাগলেন। আশ্রমের সেবায় কোনো ত্রুটি হলে বাবা খুব রেগে যেতেন। আশ্রমের প্রতিটি কাজের প্রতি তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিল। আশ্রমের সেবা করা ছিল কর্মযোগের একটি অঙ্গ। রজনীকান্তকে বাবা কর্মযোগী করতে চেয়েছিলেন। কর্ম ছেড়ে কেবল সাধু-সন্ন্যাসীদের আখড়ায় ঘুরে বেড়ালে কর্ম সাধনা হয় না। কর্ম করতে হবে নিষ্কামভাবে। তবেই নৈষ্কর্মসিদ্ধি হবে। কর্মের মধ্যেই ব্রহ্মের সন্ধান করতে হবে। কর্মযোগীর কাছে কর্মই ব্রহ্ম।

রজনীকান্তের কর্মযোগের প্রতি নিষ্ঠা ও বাবা লোকনাথের প্রতি একনিষ্ঠ এবং অকৃত্রিম ভক্তি দেখে বাবা সন্তুষ্ট হন। তিনি তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে জানতে পারেন যে রজনীকান্তের পার্থিব ভোগ্যবস্তুর উপর কোনো আসক্তি নেই এবং ঈশ্বরলাভের জন্য তাঁর অন্তর হয়ে উঠেছে ব্যাকুল। এমতাবস্থায় একদিন বাবা রজনীকান্তকে ডেকে আদেশ করেন কৌপীন পরার জন্য। তিনি আরও বলেন, বাড়িতে যখন থাকবি নেংটি পরবি আর বাইরে বেরোলে শাল দোশালা করে পরবি। এখন থেকে তুই হলি রজনী ব্রহ্মচারী।

রজনী ব্রহ্মচারী এরপর ঢাকায় ফিরে গিয়ে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে আর্তের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার কর্মের উপর বাবার আশীর্বাদ আছে এবং তিনি রজনী ব্রহ্মচারীর কর্মযোগের উপর বারদী থেকে প্রখর দৃষ্টি রাখেন।

আশ্রম প্রতিষ্ঠা করার পর রজনী ব্রহ্মচারীর কাছে অনেক লোক আসে তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে। রজনী ব্রহ্মচারীর স্পর্শে অনেকের রোগ সেরে যায়। তাঁর নাম ঢাকা শহরে ছড়াতে থাকে। এতে তার মনে ধীরে ধীরে এক মোহের জন্ম নেয়। নামের মোহ। একদিন তিনি লোকনাথ বাবার কাছে বারদী আশ্রমে আসেন। তখন তিনি একান্তে কথোপকথনের সময় বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, মোহ কেন আসে?

বাবা লোকনাথ তাঁকে বলেন, মোহ কেন আসে, তা জানা আছে। আসতে না দিলেই হয়।

তখন রজনী ব্রহ্মচারী সরলভাবে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, মোহ জয়ের সহজ পন্থা কি?

বাবা তখন উত্তর দেন, বাক্যবাণ, বন্ধু-বিচ্ছেদ বাণ ও চিত্ত-বিচ্ছেদ বাণ সহ্য করতে পারলে মৃত্যুকেও জয় করা যায়। অর্থাৎ বাবা রজনী ব্রহ্মচারীকে এই শিক্ষা দিলেন যে, একজন কর্মযোগী কখনও নিজ বাক্যদ্বারা কাউকে আঘাত করেনা বা কেউ যদি তাকে বাক্যদ্বারা আঘাত করতে চায়, তবে সেই আঘাত তাকে স্পর্শ করেনা, কারণ তিনি নিত্য, তার কর্মই ব্রহ্ম, ব্রহ্মকে কেউ কখনও আঘাত করতে পারে না। একজন যোগী যখন ব্রহ্মরূপে কর্মে রত, তখন সে সর্ব কর্মে থেকেও নেই। সেজন্য বন্ধু-বিচ্ছেদ জ্বালা তাকে স্পর্শ করে না। আর ব্রহ্মের চিত্ত সর্ব চিত্তে ব্যাপৃত। সেজন্য চিত্ত-বিচ্ছেদে সে ব্যাকুল হয় না। একজন কর্মযোগীর মধ্যে যখন এই ভাব আসে, তখন সে কোনোকিছুর মোহে আবৃত হয় না। কোনো মোহই তার আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। রজনী ব্রহ্মচারীকে বাবা নিজের সীলমোহর দিয়েছিলেন। সেজন্য তিনি তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করেছেন এবং তাঁর যোগসাধনার অগ্রগতি নিজে পরীক্ষা করতেন।

বাবা লোকনাথ রজনী ব্রহ্মচারীকে যে শিক্ষা দিলেন তাতে তিনি হতে পারছেন কি না, সেটা তিনি একবার পরীক্ষা করতে চাইলেন। ঢাকা থেকে যখন রজনী ব্রহ্মচারীর কোনো ভক্ত বারদী আশ্রমে বাবাকে দর্শন করতে আসত, তখন বাবা তাদের বলতেন, রজনী একটা ভণ্ড। তোরা আর রজনীর কাছে যাস না। সে কৌপীন পড়ে ঘুরে বেড়ায় আর বলে আমি তাকে কৌপীন পড়তে বলেছি। কিন্তু আমি তাকে একথা বলিনি। (যদিও বাবা নিজেই তাঁকে কৌপীন পড়তে আদেশ দিয়েছিলেন। বাবা বলেন, ও নিজেকে জাহির করবার জন্য, লোকেদের কাছ থেকে নাম, সম্মান পাবার লোভে আমার নাম নিয়ে মিথ্যা কথা বলে।

যে-সমস্ত ভক্তগণ রজনী ব্রহ্মচারীর কাছে প্রভূত উপকার পেয়েছেন তারা বাবা লোকনাথের মুখে এইসব কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যান। তারা ভাবতে থাকেন যে মহাপুরুষের সান্নিধ্যে এসে এবং তার কৃপায় রজনী ব্রহ্মচারী এত অল্পদিনের মধ্যে, এত অল্প আয়াসে এত সিদ্ধাই অর্জন করেছেন, সেই মহাপুরুষ যখন নিজের মুখে এইসব কথা বলছেন, তখন তা মিথ্যা হতে পারে না। যে মহাপুরুষের এক কথায় কত অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়, তিনি মিথ্যা বলছেন, এ কথা ভাবাও পাপ। তাই বাবা লোকনাথের কথা রজনী ব্রহ্মচারীর ভক্তগণ ঢাকা শহরে প্রচার করতে থাকে। এই প্রচারের কিছুদিনের মধ্যেই ভক্তদের মধ্যে রজনী ব্রহ্মচারী সম্বন্ধে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয় এবং তারা রজনী ব্রহ্মচারীর আশ্রমে যাওয়া বন্ধ করে দেন।

গিরিশচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন বাবা লোকনাথের একজন অনুগত ও একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি জানতেন যে রজনী ব্রহ্মচারীকে কর্মযোগ ও সাধনপথে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাবা লোকনাথ নিজেই। এমনকি তিনি নিজে সকলকে বলতেন, রজনী হল আমার সীলমোহর। রজনী ব্রহ্মচারীর গুরুভক্তিতে তিনি কখনও কোনো খুঁত দেখেননি। রজনী ব্রহ্মচারী ছিলেন গুরু অন্ত প্রাণ। সেই রজনী সম্বন্ধে বাবা লোকনাথ কেন এসব কথা বলছেন সেই কথা জানার জন্য তিনি একদিন রজনী ব্রহ্মচারীর আশ্রমে গিয়ে বাবার সব কথা তাকে বলেন।

রজনী ব্রহ্মচারী গিরিশবাবুর মুখে সব কথা শুনে অবিচলিতভাবে বলেন, বাবা লোকনাথের মঙ্গলময় স্বরূপ তিনি দর্শন করেছেন। গুরুতর হৃদয়াসনে সুপ্রতিষ্ঠিত। ব্রহ্মচারী বাবার লীলা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাঁর প্রতিটি আচরণই আমার জন্য মঙ্গলময়। তিনি আমার সম্বন্ধে যাই বলুন, আমি জানি তিনি আমার মঙ্গলের জন্যই বলবেন।

এমন গুরু ও এমন ভক্তযোগী এ জগতে এমন সময় মেলা ভার। এখন যদি কোনো সিদ্ধ যোগী জানতে পারেন, তার কোনো ভক্ত তাকে অবজ্ঞা করেছেন, তবে তিনি সঙ্গে সঙ্গে নিজের যোগবিভূতি ব্যবহার করে সেই ভক্তের ক্ষতি সাধন করে দেবেন।

গিরিশবাবু রজনী ব্রহ্মচারীর কথায় অবাক হয়ে যান। তার প্রতি গিরিশবাবুর ভক্তিশ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। তিনি বুঝতে পারেন, গুরুর প্রতি রজনী ব্রহ্মচারীর ভক্তিশ্রদ্ধা কত গভীর ও কত অবিচল। এইরকম গুরুভক্তি আছে বলেই তো তিনি লোকনাথ বাবার দ্বারা সঞ্চারিত যোগশক্তি নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছেন।

এইভাবে এক বছর ধরে বাবা লোকনাথের লীলা চলতে থাকে। রজনী ব্রহ্মচারী বাবার উক্তিকে আশীর্বাদ মনে করে অন্তরে ধারণ করেন আর ভক্তেরা যখন এই সব কথা তাকে বলেন, তখন তিনি তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ভক্তদের কথা তার মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না বা তার গুরুর প্রতি কোনো রকম ক্ষোভের সৃষ্টি করে না। একবছর পরে একদিন রজনী ব্রহ্মচারী বারদী আশ্রমে আসেন ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনের জন্য। আশ্রমে এসে বাবাকে প্রণাম করে তিনি নির্বিকারভাবে আশ্রমের সেবায় লেগে যান। কোনো রকম মান-অপমান বোধ তার ব্যবহারে প্রকাশ পায় না। তার মনের মধ্যে কেবল একটি আগ্রহ বাবার নিজের মুখ থেকে শোনার যে, বাবার এইরূপ আচরণ করার প্রকৃত কারণ কি?

রজনী ব্রহ্মচারী যখন আশ্রমে থাকতেন, তখন গোয়ালিনী মা-র থেকে খাবার নিয়ে তিনি নিজে হাতে বাবাকে খাইয়ে দিতেন। এদিনও তেমন খাবার নিয়ে তিনি বাবাকে খাওয়াতে এলেন। তার ব্যবহারে কোনো রকম মানসিক বিরূপতা প্রকাশ পেল না। খাওয়াতে খাওয়াতে এক সময় তিনি বাবাকে প্রশ্ন করলেন, বাবা, একথা কি সত্য যে, আপনি বহু লোকের কাছে বলেছেন, রজনী নিজের ইচ্ছায় সম্মান আর যশের মোহে কৌপীন পড়েছে, আমি তাকে পড়তে বলিনি! আপনি জানেন, একথা মিথ্যা। তবুও আপনি কেন এই মিথ্যার অবতারণা করেছেন আমার জানতে ইচ্ছা হয়।

রজনীকান্তের কথা শুনে বাবা সোজা তাকে উত্তর দেন–হ্যাঁ, বলেছি তো। তোকে কৌপীন নিতে বলেছি বলে তুই আমার দুর্নাম করে বেড়াস। আর তার ফলে বহু লোক এসে আমায় বিরক্ত করে।

বাবার কথা শুনে রজনীকান্তের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। বাবা লোকনাথের মাহাত্মকীর্তন তার জীবনের ব্রত। তিনি যে কাজ করেন, সব বাবা লোকনাথের নাম নিয়েই করেন এবং তার যোগশক্তির ক্ষমতাতেই করেন। অথচ বাবা বলছেন কিনা সে বাবার দুর্নাম করে বেড়ায়! বিস্ফারিত চোখে তিনি বাবার মুখে দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বার হয় না।

বাবা লোকনাথ রজনী ব্রহ্মচারীর চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁর সপ্রশ্ন দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারেন। শিষ্যের অন্তরের বেদনা নিরসনের জন্য তিনি তখন সস্নেহে বলেন–’দূর’ শব্দের অর্থ ব্যবধান আর ‘নাম’ শব্দের অর্থ যশ। দূর থেকে যশকীর্তন করার নাম দূর্নাম। তুই দূর থেকে আমার যশকীর্তন করলে, লোকে আমার কাছে এসে ভিড় করে। যোগীর কাছে যত বেশি সংসারী লোকের ভিড় হয়, তাঁর যোগসাধনায় তত বিঘ্ন ঘটে। লোকের ভিড়, তাদের নামকীর্তন সাধকের মনে মোহ বা অহঙ্কারের সৃষ্টি করতে পারে। আর যোগী যদি একবার সেই মোহজ্বালে জড়িয়ে পড়ে, তবে আর সাধন মার্গের উচ্চস্তরে উঠতে পারে না। পরম করুণাময় বাবা তার প্রিয় শিষ্যকে আধ্যাত্ম পথের বাধাগুলি থেকে সচেতন করার জন্যই তার নিন্দার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্যকে সর্বদা মোহমুক্ত ও অহংমুক্ত রাখতে চান যাতে সে সাধন মার্গের আরও উচ্চ স্তরে উন্নীত হতে পারেন।

রজনী ব্রহ্মচারী বাবার এই উদ্দেশ্য জানতে পেরে তার চরণে লুটিয়ে পড়েন। তার প্রতি বাবার যে কি অসীম কৃপা তা অনুধাবন করে তাঁর মস্তক বাবার চরণে লুটিয়ে পড়ে। এদিকে ভক্তগণ ধীরে ধীরে বাবার উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন এবং রজনী ব্রহ্মচারীর প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব ত্যাগ করে তার প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হন।

রজনী ব্রহ্মচারী বুঝতে পারেন যে বাবার শরণপথে তিনি সর্বদা রয়েছেন এবং বাবা তাকে নিত্য পরীক্ষা করে চলেছেন। এবারের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন কেননা তার প্রতি বাবার বিরূপ মন্তব্য সকল শুনেও তাঁর মন বিচলিত হয়নি। বাবার পূণ্যচরণ থেকে তার মন সরে যায়নি বা তিনিও কোনো মন্তব্য করেন নি। বাবার সামনে এসেও তিনি বাবাকে কোনো কথা বলেন নি। কেবল এইরূপ আচরণের কারণ জানতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে লোকহিতের জন্য হলেও কোনো সাধক যখন তার যোগবিভূতি ব্যবহার করেন, তখন তার মধ্যে একটি অহংবোধ জন্ম নেবার অবকাশ থাকে। সেই অহংবোধ থেকেই মোহের সৃষ্টি হয়। আর এই মোহই আধ্যাত্মিক উন্নতির সব থেকে বড় বাধা। বাবা লোকনাথ তাঁকে এই মোহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যই ওই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর মনের জিজ্ঞাসা প্রশমিত হয়ে গেছে। তিনি ঢাকা ফিরে গিয়ে আবার তার কর্মযোগে প্রবৃত্ত হলেন। বাবার প্রতি রজনী ব্রহ্মচারীর যে অটল বিশ্বাস আর অবিচল ভক্তি ছিল তার জোরে রজনী ব্রহ্মচারী ক্রমে সাধনার উচ্চস্তরে উন্নীত হতে থাকেন।

বেশ কিছু সময় পর একদিন বাবা লোকনাথ তাঁর শিষ্যকে বারদীতে তার কাছে ডেকে পাঠান। রজনী ব্রহ্মচারী তার কাছে এলে তিনি তাকে বলেন, রজনী সংসার আশ্রমের মধ্যে থেকে কর্তব্যকর্ম করে যতটা সাধনা করার, তোর তা করা হয়েছে। এবার তোকে নিরালায় গিয়ে যোগসাধনা করতে হবে। বাবা তার স্নেহের শিষ্যকে আরও বলেন, তুই যোগী হয়েছিস ঠিক, কিন্তু আমি চাই তুই মহাযোগী হ। আর তার জন্য তোর সংসারের সমস্ত সম্বন্ধ পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ একনিষ্ঠ হয়ে যোগসাধনা করতে হবে। তা না হলে প্রকৃত জীবন্মুক্তির অবস্থা লাভ করা সম্ভব নয়। তাই আমি চাই তুই আলাদা কোথাও আমার মতো একটা ঘর করে বসে সাধনার গভীরে ডুবে যা।

মহাশক্তিধর গুরুর আদেশ মাথা পেতে নেন রজনী ব্রহ্মচারী। বাবার আদেশ তার মধ্যে জীবন্মুক্তির এক পরোক্ষ দিব্য ভাবের আবেশ জাগায়। তার অন্তর এক অজানা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। হাতে ধরে বাবা লোকনাথ তাকে যোগসাধনার উচ্চমার্গে উন্নীত করে দিচ্ছেন। জীবন্মুক্তির পথের সন্ধান দিয়ে নিজে তার পথ প্রদর্শন করছেন। কত ভাগ্যবান তিনি, যে এই ব্রহ্মজ্ঞ দেবসুলভ মহাপুরুষের কৃপা পেতে সক্ষম হয়েছেন। পরম ভক্তিতে ও শ্রদ্ধায় তার মস্তক এই দেবপুরুষের চরণে আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনি ভক্তিভাবে বিভোর হয়ে বাবার চরণে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকেন আর ব্রহ্মপুরুষ বাবার শরীর থেকে এক দিব্য জ্যোতি তার শরীরে প্রবেশ করে।

এরপর রজনী ব্রহ্মচারী যোগসাধনায় লীণ হয়ে যান। সংসার জগতের সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে গভীর যোগ সাধনায় তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দেন এবং একদিন সাধনার উচ্চস্তরে পৌঁছে বহু সিদ্ধিলাভ করেন। অতঃপর লোকনাথ বাবার নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে তার মতাদর্শ সাধারণের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন এবং নিজের যোগসাধনার সিদ্ধাই মানবহিতে ব্যবহার করতে থাকেন। তাঁর সমস্ত কর্মই তিনি লোকনাথ বাবার নামে উৎসর্গ করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

.

সুরথনাথ ব্রহ্মচারী

দীর্ঘ ৯০ বছর ধরে পাহাড়, পর্বত, বন, জঙ্গল এবং হিমালয়ের উচ্চশিখরে তপস্যা করে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। তারপর আরও ৩০ বছর কঠোরভাবে যোগসাধনার প্রয়োগ করে বিস্তীর্ণ বরফাঞ্চল ও বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আধ্যাত্মিক ভাব বিনিময় করেছেন ও নিজের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করেছেন। এরপর তিনি নিম্নভূমিতে অবতরণ করেছিলেন এবং বসবাস করেছিলেন মানবকল্যাণে তার অনন্য যোগসাধনাকে ব্যবহার করার জন্য। মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবার জন্য। এছাড়াও তার আর একটি উদ্দেশ্য ছিল তার গুরুদেব আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির আত্মার মুক্তির ব্যবস্থা করা এবং তার গর্ভধারিণী মাতাকে বর্তমান জন্মে দর্শন দেবার। সেই কার্য সম্পন্ন করার নিমিত্তই তার বারদীতে অবস্থান। কিন্তু এত উচ্চমার্গের একজন ঈশ্বরকোটির যোগীর সন্ধান পাওয়ামাত্র তখন নিপীড়িত সমাজের মানুষ সংসারের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য ও দেহের রোগ নিবারণের জন্য তার কাছে ভিড় করে। বারদীর আশ্রম হয়ে ওঠে হাসপাতাল। করুণাময় বাবা তাদের অবস্থা বুঝতে পেরে তাদের দুঃখ-দুর্দশার নিরসন করেন। কিন্তু এইটি তার আসল কাজ ছিল না। কেননা এইসব কাজের জন্য যোগীকে তাঁর যোগবিভূতির ব্যবহার করতে হয়। একজন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ হিসাবে তিনি চেয়েছিলেন মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে। কিন্তু মানুষ তার কাছে কেবল রোগমুক্তি ও সংসারের দুর্দশার থেকে মুক্তি পেতে আসে। এটা তাঁর ভালো লাগে না। এজন্য তিনি কিছু ব্যক্তির মধ্যে যোগশক্তি সঞ্চারিত করে তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কর্মযোগের মাধ্যমে সাধনা করতে। রজনী ব্রহ্মচারী ছিলেন এঁদের মধ্যে অন্যতম। সেইজন্য বাবা তাকে নিজের সীলমোহর বলতেন। কিছু কিছু সাধারণ ব্যক্তির মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে বাবা লোকনাথ তাদের কর্মযোগে নিয়োজিত করেছিলেন। একসময় সেই কর্মযোগীরাই বড়ো যোগী হয়ে মানব কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন। সেইরকম আর এক ব্যক্তিত্ব ছিল সুরথ ব্রহ্মচারী।

শ্রী অখিলচন্দ্র সেন ঢাকা জেলার অন্তর্গত সোনার গাঁ অঞ্চলে এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেইসময় ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য সোনার গাঁ’র খুব নাম ছিল এবং সেখানে অনেক ধনী পরিবারের বসতি ছিল। অখিলচন্দ্র সুদর্শন যুবক ছিলেন এবং খুব সৌখীন ছিলেন। তার জীবনযাত্রা যৌবনে ভোগবিলাসে পরিপূর্ণ ছিল। প্রতিদিন ধনী বন্ধুদের সংসর্গে মদ্যপান ও নারী বিলাসিতায় তাঁর দিন খুব ভালোই কাটছিল। একদিন সান্ধ্য আসরে একজন বারদীর বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর কথা বলে। তার সারা বঙ্গে খুব নামডাক আছে। শুনে অখিলচন্দ্রের ইচ্ছা হয় বারদীতে গিয়ে তাকে দর্শন করার।

একদিন সকালে কোঁচানো বাবু ধুতি, শার্ট, কোট, মোজা, জুতো, গলায় সোনার চেন ও রুদ্রাক্ষ মালা পড়ে তিনি বারদী আশ্রমে উপস্থিত হলেন। দেখতে তাকে তখনকার দিনের ফুলবাবুর মতো লাগছিল। আশ্রমে পৌঁছে বাবার সামনে উপস্থিত হতেই বাবা তাকে দেখে হেসে বললেন, বড়ো যে সাজ-সজ্জা করে এসেছিস দেখছি। অখিলচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে উত্তর দেন, সাজবো না কেন? এই দেহ তো দেবতার মন্দির। এ দেহকে সাজাবো না তো কাকে সাজাবো?

অখিলচন্দ্রের উত্তর শুনে বাবা প্রসন্ন হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন অখিলচন্দ্র বিলাসী ও ব্যভিচারী হলেও তাঁর অশুদ্ধ দেহের আধারে এক শুদ্ধভাব আছে। ভোগের মধ্যে সহসা তাঁর মধ্যে এক ত্যাগের ভাব জাগ্রত হওয়ায় এক অধ্যাত্ম চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। অখিলচন্দ্রের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বাবা বললেন, ঠিকই বলেছিস। এ দেহ তো দেবতারই মন্দির। বাবার এই স্নেহময় উক্তি শুনে অখিলচন্দ্রের মনে এক আলোড়ন শুরু হলো। বাবার দিকে তাকিয়ে যেন তিনি আর চোখ ফেরাতে পারছেন না। বাবা তার মস্তক স্পর্শ করে আশীর্বাদ করলেন। বাবার দর্শনে এবং তার সস্নেহ স্পর্শে অখিলচন্দ্রের মন এক দিব্য আনন্দের জোয়ারে ভেসে গেল। মনের মধ্যে তার এমন এক আনন্দের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল যে আনন্দ, যে তৃপ্তি তিনি চরম ভোগবিলাসেও পাননি; জগতে অর্থের বিনিময়ে যা কিছু কাম্যবস্তু, তিনি এই বয়সে সবই ভোগ করেছেন। কিন্তু যত ভোগ করেছেন, ভোগের বাসনা তত বেড়ে গেছে। ভোগের বাসনার নিবৃত্তি তাতে কখনই হয় নি। কিন্তু আজ এ কি হলো! এই মহাপুরুষের এক স্পর্শে এবং তাঁর প্রতি তাঁর দিব্য দৃষ্টি নিক্ষেপণে তার মনে এক তুমুল আলোড়ন এনে দিয়েছে। এই মহাপুরুষের সামনে বসে তাঁর মনে হচ্ছে ভোগবাসনায় যে পার্থিব সুখ পাওয়া যায়, তা ক্ষণস্থায়ী। সে সুখ অন্তরের এত গভীরে পৌঁছয় না। একজন মহাপুরুষের স্পর্শে যে সুখ পাওয়া যায়, যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেটা অন্তরের গভীরে স্পর্শ করে এবং অন্তরকে সেই সুখে আবৃত করে রাখে। সুরা ও নারীসঙ্গ লাভ করে তিনি যে সুখ এতদিন ভোগ করে এসেছেন, সেই সুখ তো অন্তরের এত গভীরে কখনও প্রবেশ করতে পারেনি। যে অখিলচন্দ্র ফুলবাবু সেজে বাবাকে দর্শন করতে এসেছিলেন, তিনি বাবার চরণে নিজেকে সমর্পণ করলেন। বাবার কৃপা প্রার্থনা করলেন। তারপর এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ রূপে সোনার গাঁ ফিরে এলেন।

সোনার গাঁ ফিরে এসে তার আর ভোগবিলাসের জীবন ভালো লাগে না। সুরা ও নারীসঙ্গ, যা ভিন্ন তিনি একদিনও থাকতে পারতেন না, তা তার বিষময় মনে হতে লাগলো। তার অন্তরে কেবল বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার মুখ ও স্নেহময় আশীর্বাদ ভেসে ওঠে। কিছুদিন পরপর তিনি বারদী আশ্রমে আসেন বাবাকে দর্শন করতে। বাবা লোকনাথও তাকে সন্তানবৎ স্নেহ করেন এবং তার প্রতি নিজের কৃপা বর্ষণ করতে থাকেন। প্রতি দর্শনেই বাবা তাকে আধ্যাত্মপথের বিভিন্ন শিক্ষা দান করতে থাকেন এবং কর্মের মাধ্যমে তার প্রারব্ধকে ক্ষয় করাতে থাকেন। বাবা জানতেন প্রারক্কের ভোগের জন্য অখিলচন্দ্র ওইরূপ ভোগবিলাসী স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন করছিলেন। অন্তর্যামী বাবা লোকনাথ নিজের দেবসত্তায় জানতে পেরেছিলেন অখিলচন্দ্রের প্রারব্ধ ও সঞ্চিত ভোগের কথা। তিনি নিজেই ছিলেন পূর্ণব্রহ্ম। তাঁর মধ্যে সমস্ত দেবসত্তা বিরাজমান ছিল। তিনি বলতেন কোনো ভক্তের অন্তরে যখন তার দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয়, তখন তার অন্তরের সব ভজ তার সামনে খুলে যায়। তিনি সেই ভক্তের জন্ম-জন্মান্তরের সব কর্মভোগ সম্বন্ধে অবহিত হয়ে যান। সেইজন্য তিনি যখন জানতে পারলেন যে অখিলচন্দ্র ভোগবিলাসী স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন করছেন তার প্রারব্ধ কারণে কিন্তু তার অন্তঃকরণে একটি শুদ্ধ আধার আছে, তিনি নিজে অখিলচন্দ্রের প্রারব্ধ ও সঞ্চিত ভোগকে কর্মের মাধ্যমে ক্ষয় করিয়ে তার অন্তঃকরণে স্থিত শুদ্ধ আধারকে জাগ্রত করে দিয়েছিলেন। কেমন করে গুরু তাঁর শিষ্যের প্রারব্ধকে ক্ষয় করে তার মধ্যে স্থিত শুদ্ধ আধারকে জাগ্রত করে তাকে আধ্যাত্মিক চেতনা সমৃদ্ধ করতে পারে, লোকনাথ বাবার অখিলচন্দ্রের উপর কৃপার এ এক অনন্য উদাহরণ যা আজকের যুগে অতি বিরল।

বর্তমান কালে কোনো শিষ্য ও ব্যক্তি সমস্যা জর্জরিত হয়ে গুরু বা কোনো সাধক বা জ্যোতিষের কাছে গেলে তারা বলেন, এটা আপনার প্রারন্ধের ভোগ। প্রারন্ধের ভোগ কেউ কাটাতে পারে না। ব্যক্তিকে স্বয়ং সেই ভোগ সম্পন্ন করতে হয়।

আমি হৃষিকেশে এক মহাযোগী ও শক্তিধর মহাপুরুষের দর্শন ও কৃপালাভ করেছিলাম, যিনি প্রারব্ধ ভোগ সম্পর্কে আমায় বলেছিলেন, যিনি প্রারব্ধ তোমার এই জীবনে লিখে দিয়েছেন, তার কাছেই আকূল আর্তি জানাও তাকে ক্ষয় করে দেবার। তিনিই সামান্য উপায়ে সেই প্রারক্কের ক্ষয় করে দেবেন। যেটা অনেক বড়ো কিছু হতে পারত, সেটা সামান্য কষ্ট ভোগের মাধ্যমে তিনি ক্ষয় করে দেবেন। বাবা লোকনাথ যেভাবে নিজে থেকে অখিলচন্দ্রের প্রারব্ধ ভোগ ক্ষয় করে দিয়েছিলেন, তাতে সেই মহাযোগীর কথার সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু এ কাজ একমাত্র প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষের দ্বারাই করা সম্ভব। এবং প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ তখনই এই কাজ করেন যখন যে ব্যক্তির প্রারব্ধ তিনি ক্ষয় করছেন, সে নিজেকে নিঃশর্তভাবে অবিচল ভক্তির দ্বারা সেই ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষের চরণে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করতে পারেন। অখিলচন্দ্র সেইভাবে নিজেকে বাবা লোকনাথের চরণে সমর্পণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন বলে বাবা তাঁর প্রারব্ধ ভোগগুলিকে ক্ষয় করিয়ে তাকে দেহবাদী জৈব চেতনার অন্ধকার স্তর থেকে টেনে আধ্যাত্ম চেতনার আলোকের স্তরে তুলে আনেন। এর জন্য চাই গুরুর প্রতি অবিচল ভক্তি, অকৃত্রিম বিশ্বাস এবং সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। এ কাজ সেই শিষ্যই করতে পারে, যে নিজের গুরুর বাক্যকেই ব্রহ্ম বলে মনে করে তা পালন করতে পারে। সেই শিষ্যকে গুরু ব্রহ্মজ্ঞানের আলোকে আলোকিত করে তোলেন, যে ভাগ্য অখিলচন্দ্রের হয়েছিল।

এ সম্বন্ধে আমার সাধন পথে শোনা একটি কথার উল্লেখ করা যেতে পারে। একজন গুরুর কাছে দুই শিষ্য আসে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য। গুরুগৃহে তারা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। গুরু তাদের বলেন, গুরুবাক্যই ব্রহ্ম। পঞ্চভূত দেহের মধ্যে যে মনের অবস্থান সেটা ঠিক জলের মতো। যে রঙে তুমি তাকে রাঙাতে চাও, সে সেই রঙেই রেঙে উঠবে। যে শিষ্য গুরুবাক্য শুনে সেই রঙে মনকে রাঙাতে পারে, সে-ই ব্রহ্মলোকের সন্ধান পায় এবং সে-ই আলোকে তার জীবাত্মা পরমাত্মাকে দর্শন করে।

শিষ্যরা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উপযোগী হয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্য গুরুদেব তাদের নিয়ে একটি নদীর পাড়ে আসেন। সেখানে দুই শিষ্যকে নদীর ঘাটে সিঁড়িতে নেমে দাঁড়াতে বলেন। তিনি শিষ্যদের বলেন, তোমরা জল দেখবে। তারপর এক শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি দেখছ? শিষ্য বলে, আমি জল দেখছি। গুরু আবার জিজ্ঞাসা করেন, তুমি আর কি দেখছ? শিষ্য বলে, আমি জলে নদীপাড়ের গাছের ছায়া দেখছি। গুরু বলেন, তুমি আর কি দেখছ? শিষ্য বলে, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার নিচে জলের তলায় আরও সিঁড়ি দেখছি। গুরু আবার জিজ্ঞাসা করে, ভালো করে জল দেখে বলল, তুমি আর কি দেখছ? শিষ্য বলে জলের তলায় কিছু মাছ খেলা করছে, আমি তাও দেখতে পাচ্ছি।

এবার গুরুদেব দ্বিতীয় শিষ্যকে বলেন, তুমি কি দেখছ? সে বলে, আমি জল দেখছি। গুরু আবার একই প্রশ্ন করলেন। সে বলে আমি জল দেখছি। গুরু বলেন, ভালো করে দেখে বলো তুমি আর কি দেখছ? শিষ্য বলে, আমি জল দেখছি। গুরু তখন উত্তেজিত হয়ে বলেন, তুমি ভালো করে দেখে বল তুমি কি জল ছাড়া সেখানে আর কিছু দেখতে পাচ্ছ না? শিষ্য তখন হাউহাউ করে কেঁদে বলে, গুরুদেব আমার দু-নয়নে জল ছাড়া যে আর কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে না। আমি কি করব? গুরুদেব তখন উঠে এসে শিষ্যকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুমিই ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী। আমি তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করবো।

এক্ষেত্রে দ্বিতীয় শিষ্যটি তার গুরুর বাক্যকে ব্রহ্মরূপ জ্ঞান করে তা পালন করেছিল। গুরু বলেছিলেন জল দেখতে। সেইজন্য সে তার মনে কেবল জল দেখার কথাকেই স্থান দিয়েছিল। গুরুর বাক্যকে সে ব্রহ্ম মনে করেছিল। অর্থাৎ জলে ব্রহ্মরূপ দর্শন করেছিল সে। তার মনকে সে সেই ব্রহ্মলোকের আলোয় রাঙিয়েছিল। সেজন্য জল ভিন্ন আর কিছুই তার দৃশ্যগোচর হয়নি। যে এই কাজ করতে পেরেছিল তার জীবাত্মাতো তখনই ব্রহ্মলোকে আলোকিত হয়ে পরমাত্মার দর্শন করে নিয়েছে। এ কাজ সম্ভব হয়েছিল গুরুর প্রতি অবিচল ভক্তি, অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে গুরু চরণে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের জন্য। রজনী ব্রহ্মচারী এ কাজ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অখিলচন্দ্রও এত ভোগবিলাসী হওয়া সত্ত্বেও বাবার চরণে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সেজন্যই তো তারা রজনী ব্রহ্মচারী ও সুরথ ব্রহ্মচারী হতে পেরেছিলেন। আমাদের আত্মপর্যালোচনা করে দেখা দরকার আমরা যখন বাবাকে ডাকি, সত্যিই কি সেই ডাক এই তিনগুণ সমন্বিত হয়।

আমি নিজে একবার নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, বাবা লোকনাথ আমাকে বাঁচাও। আমার অর্ধেক শরীর বাসের নিচে। আমার দুই পায়ের উপর বাসের চাকা উঠছে। আমার সামনে নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু শমন ও আমার মাঝে বাবা লোকনাথ ছিলেন। শমণকে ফিরে যেতে হয়েছিল। যে পায়ের উপর বাসের চাকা উঠে আমার সমস্ত নিম্নাঙ্গ নিশ্চল করে দিয়েছিল, আমি সেই দুই পায়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছি এবং এই দুই পা নিয়েই পূর্ণ নর্মদা পরিক্রমা করেছি। সেজন্য পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি–ডাকার মতো ডাকলে বাবা ভক্তের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেন না।

এক্ষেত্রে অখিলচন্দ্রের মধ্যে এমন পরিবর্তন বাবা এনে দিয়েছিলেন যে, তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। যখন বাবা বুঝতে পারলেন যে, অখিলচন্দ্রর ভিতরের আধার এখন আধ্যাত্ম কর্মে এগিয়ে যাবার জন্য তৈরি, তখন তিনি এক শুভলগ্নে অখিলচন্দ্রকে গৈরিক বস্ত্র দান করে দীক্ষা দিলেন এবং তার নাম হল সুরথনাথ ব্রহ্মচারী। কত ভাগ্য ছিল সেই অখিলচন্দ্রের যার সমস্ত প্রারব্ধ নিজে ক্ষয় করিয়ে দিয়ে এক চরম ভোগবিলাসী জীবন থেকে তাকে আধ্যাত্ম লোকের আলোয় আলোকিত করে নিজে দীক্ষা দান করে সুরথ ব্রহ্মচারীরূপে প্রতিষ্ঠা করলেন। দীক্ষা দান করে বাবা লোকনাথ সুরথ ব্রহ্মচারীকে যোগসাধনার কিছু তত্ত্ব শিক্ষা দিলেন এবং ব্রহ্মচর্য পালন করে গৃহে অবস্থান করে তাকে যোগসাধনায় রত হতে নির্দেশ দিলেন। এই নির্দেশের মাধ্যমে বাবা মানবসমাজের কাছে এবং তার ভক্তদের কাছে একটি বার্তা দিলেন।

সংসারী মানুষরা সাধারণতঃ মনে করেন সংসারে থেকে গৃহী জীবনযাপন করে সাধনা হয় না। সাধনা করতে হলে বনে, জঙ্গলে, পাহাড়ে বা কোনো নির্জন স্থানে যেতে হয়। সাধনার একটি স্তরে হয়তো সে রকম যেতেও হয়। যেমন যেতে হয়েছিল রজনী ব্রহ্মচারীর। বাবা নিজে সুরথ ব্রহ্মচারীকে গৃহে অবস্থান করে যোগ সাধনায় রত হতে বললেন। বাবা যখন বলেছেন তখন গৃহে যোগ সাধনা করলেও সুরথ ব্রহ্মচারী নিশ্চয়ই ঈশ্বরকৃপা লাভ করবেন।

সদ্গুরুর কৃপা থাকলে শিষ্য যেখানেই সাধনা করুন সিদ্ধিলাভ করবেন। সুরথ ব্রহ্মচারীও বাবা লোকনাথের কৃপায় যোগসাধনার উচ্চমার্গে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর যোগশক্তির পরিচয় পেয়ে অনেকে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। সুরথ ব্রহ্মচারী বাবার আদেশে নিজেকে কর্মযোগে নিয়োজিত করেন। এরপর বিবাহ করে সংসার ধর্ম পালনের মধ্যে দিয়েও তিনি কর্মযোগ থেকে বিচ্যুত হননি। অবশেষে ৪ঠা পৌষ, ১৩২৯ সনে তিনি স্ত্রী ও মাতাকে এই জগত সংসারে রেখে তার পঞ্চভূত দেহ ত্যাগ করে দেবলোকের পথে গমন করেন। তিনি ইহজগৎ ত্যাগ করলেও তার ধনী ভোগবিলাসের জীবন থেকে সুরথ ব্রহ্মচারী হয়ে আধ্যাত্ম পথের উচ্চমার্গে বাবার কৃপায় উক্রমণের কথা লোককথা হয়ে আজও প্রচলিত আছে।

.

যামিনীকুমার মুখোপাধ্যায়

ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে বেজগাঁ নামক স্থানে এক সাধক বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যামিনী মুখোপাধ্যায়। ব্রিটিশ আমলে বেজগাঁর মুনসী বাড়ির খুব নাম ও প্রতিপত্তি ছিল। সেই বাড়ির এক বংশধর ছিলেন যামিনীবাবু। বংশানুক্রমিক যামিনীবাবুর পূর্বপুরুষেরা ধর্মপরায়ণ ছিলেন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দান-ধ্যান করে তাঁরা বিক্রমপুরে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছিলেন। যামিনীবাবুর পিতা গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তার মাতা ঠাকুরানী সাধন ভজনে জীবন অতিবাহিত করতেন এবং সেই ভাবধারা যামিনীবাবুকে বাল্যবয়স থেকেই প্রভাবিত করেছিল। পিতার দেহত্যাগের পর যামিনীবাবু সাধুসঙ্গ করার দিকে ঝোঁকেন। তাঁর মনে অনেক ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যা নিরসন করার জন্য তিনি সাধুসঙ্গ করতেন। কোথাও তিনি তার মনের প্রশ্নের এমন উত্তর পেতেন না যা তাঁর মনকে শান্ত করতে পারে। যামিনীবাবু ঢাকা জেলার গেণ্ডারিয়া গ্রামে অবস্থিত শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আশ্রমে যেতেন গোঁসাইজির সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনা করতে। তার অশান্ত মন কিছুতেই শান্ত হয় না। একদিন গোঁসাইজি তার আশ্রমে রজনী ব্রহ্মচারীকে বলেন যামিনীবাবুকে একবার বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কাছে নিয়ে যেতে। যামিনীবাবু এক শুভদিনে রজনীকান্তের সঙ্গে বারদীতে ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনে আসেন। বারদী আশ্রমে এসে লোকনাথ বাবার সামনে দাঁড়াতেই তিনি বুঝতে পারেন যে যামিনীবাবুর মনে অসংখ্য আধ্যাত্মিক প্রশ্ন তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। প্রথম দর্শনেই যামিনীবাবুর মনে হয় যেন তিনি মূর্তিমান গীতার সামনে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি আর স্থির থাকতে না পেরে বাবার সঙ্গে কিছু ধর্মীয় আলোচনা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রথম দিনের ধর্মীয় আলোচনা তার মধ্যে আরও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে এবং তিনি এরপর ঘন ঘন বাবার দর্শনে এসে ধর্মীয় আলোচনা করেন। এই ধর্মীয় আলোচনার মধ্যে তার সঙ্গে বাবা লোকনাথের অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পায় এবং তিনি বাবার বিশেষ কৃপার পাত্র হয়ে ওঠেন। যামিনীকুমারের সঙ্গে বাবা লোকনাথের যে ধর্মীয় আলোচনা হয়েছিল সেগুলি আধ্যাত্ম সাধনার এক অমূল্য সম্পদ বলে পরিগণিত হয়। সেজন্য এইখানে যামিনী কুমারের আধ্যাত্ম জিজ্ঞাসা এবং বাবা লোকনাথের সেইসব জিজ্ঞাসার উত্তর উপস্থাপনা করা হল যাতে বাবার অগণিত ভক্ত সেই বার্তালাপের আধ্যাত্ম রসাস্বাদন করতে পারেন।

যামিনীকুমার : তাপ শব্দের অর্থ কি?

বাবা লোকনাথ : সুখে অথবা দুঃখে, জয় অথবা পরাজয়ে মনের যে অবস্থা হয়, তাই তাপ। যে কাজ করে তুই তাপগ্রস্ত হচ্ছিস বা সমাজকে তাপগ্রস্ত করছিস, তাই হল তাপ।

যামিনীকুমার: বাবা, তাহলে তো তাপশূন্য কোনো কাজই দেখতে পাচ্ছি না?

 বাবা লোকনাথ : ঠিকই বলেছিস। যে কোনো কাজ করতে গেলে কিছুটা তাপ তো তাতে থাকবেই। যে এই কথা জেনে কাজ করে সেই তো মুক্ত। ওরে, অজ্ঞানতা হল তাপের কারণ। ঈশ্বরের সৃষ্টির সঙ্গেই এই অজ্ঞানতা জড়িয়ে রয়েছে। এই অজ্ঞানতাই হল অবিদ্যা।

যামিনীকুমার : এই অবিদ্যা অজ্ঞানতা বলতে কি বোঝায়?

বাবা লোকনাথ : অনিত্য বস্তুতে নিত্যজ্ঞান, অশুচিতে শুচিজ্ঞান, দুঃখে সুখ জ্ঞান, আর অনাত্মায় আত্মজ্ঞানকে অবিদ্যা অর্থাৎ অজ্ঞানতা বলে।

যামিনীকুমার : তাপের কারণ কি?

 বাবা লোকনাথ : বাসনাই হল তাপের কারণ। যার বাসনা নাই, তার তাপও নাই। যে লোক গন্ধ রসাদি ভোগে অনুরাগ বা তার প্রতি রাগ-দ্বেষ প্রকাশ না করে, যার কীর্তি ও সম্মান লাভে বিন্দুমাত্র বাসনা নেই, সেই লোকই যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞ। ব্রহ্মজ্ঞ লোকের সকল কামনা-বাসনা পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। শোক-সন্তাপ ও বিষয়-বাসনা মনকে কষ্ট দেয়।

যামিনীকুমার : পাপ কাকে বলে?

বাবা লোকনাথ : যাতে তাপ লাগে, তাই পাপ। সে তাপ তোমার নিজেরও হতে পারে, সমাজেরও হতে পারে। যে কাজ দ্বারা তুমি নিজেকে ও সমাজকে তাপগ্রস্ত করো, তাই পাপ কাজ।

যামিনীকুমার : আমার মাথা ব্যথায় আমি তাপগ্রস্ত হলাম। তাহলে মাথাব্যথায়ও কি পাপ হলো?

বাবা লোকনাথ : মাথা কি? কার মাথা? বেদনা কি? কে বেদনা বোধ করে? এই সব বিষয়ে আলোচনা করলে দেখবে মনেতেই বেদনার উৎপত্তি, স্থিতি, লয় মনের এই অবস্থান হয় অবিদ্যা থেকে। তখন বুঝতে পারবে, যেখানে অবিদ্যা, সেখানেই পাপ, সেখানেই তাপ। বিদ্যায় পাপ বা তাপ কিছুই থাকে না।

যামিনীকুমার : আচ্ছা বাবা, তাহলে তাপশূন্য তো কিছুই দেখি না।

বাবা লোকনাথ : ঠিক কথা। একথা জেনে যে কাজ করে সেই ব্যক্তিই মুক্ত। কিছু পরিমাণ তাপ ছাড়া কোনো কাজই হয় না। কিছু পরিমাণ তাপ ছাড়া ঈশ্বরও সৃষ্টি করেন না।

যামিনীকুমার : ঈশ্বর তাপ ছাড়া সৃষ্টি করেন না, এই কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারলাম না।

বাবা লোকনাথ : অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাই তাপের কারণ। আবার অবিদ্যা ছাড়া কোনো কাজই হয় না। সুতরাং ঈশ্বরও অবিদ্যার সাহায্য ছাড়া কোনো সৃষ্টিকাৰ্যই করতে পারেন না। কিছু পরিমাণ তাপ সব কাজের মধ্যেই আছে।

যামিনীকুমার : গুরু কে?

বাবা লোকনাথ : মানুষ যেখানে ঠেকে, সেখানেই শেখে। যার আদর্শ অনুসরণ করে শিক্ষা পাও, তিনিই গুরু।

যামিনীকুমার : গুরুকে সর্বদা স্মরণ করবে–এর অর্থ কি? বাবা লোকনাথ ও গুরুকে সর্বদা স্মরণ করবে মানে গুরুর আদেশ স্মরণ করবে। গুরুর আদেশই গুরু।  

যামিনীকুমার : গুরুর আদেশ যদি গুরু হয়, তবে তার দেহকে অনাদর করতে পারি?

বাবা লোকনাথ : না, গঙ্গাজলের পাত্রকে লোকে আদর করে।

যামিনীকুমার : গুরুর চরণ ধরবে। এর অর্থ কি?

বাবা লোকনাথ : গুরুর আচরণ করবে। অর্থাৎ গুরু যে আচরণ দ্বারা শিবত্ব লাভ করেছেন, তার অনুরূপ আচরণ করবে।

যামিনীকুমার :গুরুকে আসন-বসন দেবে। এই কথার অর্থ কি?

বাবা লোকনাথ : গুরুকে আসন দেওয়ার অর্থ হল তার আদেশ হৃদয়ে ধারণ করবে। বসন দেওয়ার অর্থ হলো, তার আদেশকে আচ্ছাদন দান করবে। অর্থাৎ অভক্ত নাস্তিকদের কাছে তার আদেশ প্রকাশ করবে না।

যামিনীকুমার : গুরুবৎ গুরুপুত্রেযু–এই কথার অর্থ কি?

বাবা লোকনাথ : গুরুর মতো যোগ্য যে গুরুর পুত্র, পৌত্রাদি, তাদের গুরুর মতো ভক্তি করবে।

যামিনীকুমার : গুরুর পুত্র কে? গুরুপুত্র মূর্খ হলে যদি তাকে ভক্তি করতে না পারি তাহলে কি দোষ হয়?

বাবা লোকনাথ : গুরুর ঔরসজাত পুত্র অথবা গুরুর উপদেশে পরিচালিত হয়ে যার জ্ঞান জন্মেছে, সেই গুরুর পুত্র। যদি শব্দ সংশয়াত্মক। গুরু পুত্রকে তুমি ভক্তি করতে পার কি না দেখ। না পারলে লোক দেখানো ভক্তি করলে লাভ না হয়ে ক্ষতি হবে।

 যামিনীকুমার : গুরু শিষ্যের কি করেন?

বাবা লোকনাথ : গুরু জ্ঞানরূপ অঞ্জনশলাকাদ্বারা অজ্ঞানান্ধ শিষ্যের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করেন। আমি কে? আমার কর্ম কি? আমি কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাব? সৃষ্টি কৌশল কি? এই সমস্ত বুঝিয়ে দিয়ে গুরু শিষ্যের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেন।

যামিনীকুমার : গুরু গীতাতে ভিন্ন ভিন্ন ধ্যান লেখার কারণ কি?

বাবা লোকনাথ : গুরু অনন্ত, ধ্যানও অনন্ত।

যামিনীকুমার : জীবের বন্ধন এবং মুক্তির কারণ কি? বাবা লোকনাথ : একই কারণ-মায়া। যামিনীকুমার ও বাবা, আমি বদ্ধ না মুক্ত, বুঝব কি করে?

বাবা লোকনাথ : ওরে, তাপই হল পরীক্ষার মূল। যখন সুখে-দুঃখে, মান-অপমানে, শীত-গ্রীষ্মে তুই একই অবস্থায় থাকবি, তোর চিত্তের কোনো চাঞ্চল্য দেখা যাবে না, তখনই বুঝবি তুই মুক্ত।

যামিনীকুমার : তাপ লাগবার কারণ কি?

বাবা লোকনাথ : কামনাই তাপের কারণ। যার কামনা নেই, তার তাপও নেই।

যামিনীকুমার : সন্ন্যাস ভালো অবস্থা কি না?

বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ, ভালো অবস্থা।

যামিনীকুমার : সন্ন্যাস কাকে বলে?

বাবা লোকনাথ : শোন যামিনী, কর্ম পরিত্যাগ করা ও কর্ম করা এই দুইকেই যে একই অবস্থা মনে করে, সেই সন্ন্যাসী। সনাতন হিন্দু ধর্মে সন্ন্যাস অনেক রকম–বৈদিক, তান্ত্রিক, বৈষ্ণব, উদাসী ইত্যাদি। এদের মধ্যে বৈদিক সন্ন্যাসী সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ। সন্ন্যাস শব্দের অর্থ হলো-কামনা, বাসনা ও বিষয়াসক্তির ত্যাগ। বাহ্যিক ত্যাগ নয়, আন্তরিক ত্যাগই সন্ন্যাস। তাই সন্ন্যাসী কর্মত্যাগী নন, তিনি কাম্য কর্ম ত্যাগ করে নিষ্কামভাবে সমস্ত কর্ম সম্পাদন করেন। তিনি দেহত্যাগের পর ব্রহ্মভূত হয়ে অর্থাৎ ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়ে ব্রহ্মেই স্থিতি লাভ করেন। জীবস্মৃতি লাভই সন্ন্যাস আশ্রমের উদ্দেশ্য। বৈদিক সন্ন্যাসের চরম আদর্শ হল নির্বিকল্প সমাধিতে জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্নরূপে স্থিতি লাভ করানো। গীতায় বলা হয়েছে– ফলত্যাগী কর্মযোগীই নিত্যসন্ন্যাসী। কর্মযোগ ও সন্ন্যাস একই। অলসতা হেতু কার্য পরিত্যাগকে সন্ন্যাস বলে না।

যামিনীকুমার : এই সংসারে ত্রিবিধ তাপ কি?

বাবা লোকনাথ : এই সংসার ত্রিবিধ তাপে পূর্ণ। বাক্যবাণ, বিত্তবিচ্ছেদ বাণ, বন্ধুবিচ্ছেদ বাণ–এই তিনটি বাণ ত্রিবিধ তাপ। এই ত্রিবিধ তাপ যিনি সহ্য করতে পারেন, তিনি মৃত্যুকে জয় করতে পারেন।

যামিনীকুমার : তবে কি আপনি এই সমস্ত তাপের মধ্যে থাকাই শ্রেয় মনে করেন?

বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ, তাই মনে করি। কর্মত্যাগ অপেক্ষা কর্ম করাই শ্রেয়। যামিনীকুমার ও তাপের কি কোনো উপকারিতা আছে? বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ, প্রচুর উপকারিতা আছে। প্রহ্লাদ ও সীতাকে দেখ। যামিনীকুমার ও প্রহ্লাদ ও সীতার কথা কি বললেন, বুঝলাম না। বাবা লোকনাথ : অবতার কেন, কী উদ্দেশ্যে হয়, বোঝ। ভগবান ধর্ম রক্ষা করার জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হন এবং নিজে সেই ধর্ম আচরণ করে জীবকে শিক্ষা দেন।

যামিনীকুমার : প্রহ্লাদকে তো ভগবানকে পাবার জন্য কত উৎকট বিপদই না সহ্য করতে হয়েছিল।

বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ, তা সত্য। কিন্তু শত তাপের মধ্যেও তারা কখনও নষ্ট হয়নি। এত উৎকট তাপেও অগ্নি পরীক্ষার সময় অগ্নি অণুমাত্রও প্রবেশ করতে পারল না সীতার দেহে। স্বয়ং হরি এসে সীতা এবং প্রহ্লাদকে কোলে তুলে নিয়ে রক্ষা করলেন।

যামিনীকুমার : বাবা, জীবের কি কি অবস্থা হয়?

বাবা লোকনাথ : ওরে, জীবের তিন অবস্থামুক্তাবস্থা, বদ্ধাবস্থা ও তৃতীয় মুক্তাবস্থা। প্রথম মুক্তাবস্থায় জীবের সামাজিক কোনো বন্ধন থাকে না। যেমন, পশুজীবন। বদ্ধাবস্থা হল সাংসারিক বা সামাজিক জীবের অবস্থা, যেমন তোর অবস্থা যামিনী। তৃতীয় মুক্তাবস্থা হল বন্ধনের ঊর্ধ্বের অবস্থা। যেমন আমার ও হিতলাল মিশ্রের অবস্থা।

যামিনীকুমার : আচ্ছা বাবা, আপনি আমাকে দ্বিতীয় অবস্থার আর আপনাকে তৃতীয় অবস্থার জীব বললেন কেন? আপনার ও আমার কর্মের মধ্যে তফাৎ কি?

বাবা লোকনাথ: দেখ যামিনী, আমার আশ্রমে প্রতিদিনই কিছু লোক প্রসাদ পায়। তেমনি তোর বাড়িতেও তোর পরিবারের লোকেরা প্রতিদিনই আহার করে। আমার আশ্রমে যারা প্রসাদ পাবে তাদের খাদ্যবস্তু কোথা থেকে আসবে আর তারা কি প্রসাদ পাবে, সে বিষয়ে আমার কোনো চেষ্টা বা ভাবনা নাই। কিন্তু তোর? তোর পরিবারের লোকেরা কি খাবে সে বিষয়ে তোর চেষ্টা-ভাবনা দুটোই আছে। যেমন, তুই মনে করিস তুই এদের খেতে দিস। আমি মনে করি আমি কাউকে খেতে দিই না। যার এখানে আহার আছে, সে আহার করবে। যার তা নাই, সে আহার করবে না। এতে আমার কোনো তাপ নেই। আমার জ্ঞান আছে, তাই আমি এরকম মনে করি। কিন্তু তুই তো অজ্ঞান, তাই তোর মনে ভয় আছে যে তুই তোর পরিবারের লোকেদের ভালো খেতে না দিলে সমাজের লোক তোর নিন্দে করবে। পরিবারের লোকেরা চেঁচামেচি করবে। দেখ, আমার কিন্তু ওই সব ভয় নেই।

যামিনীকুমার : ধর্ম কি? বাবা লোকনাথ সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ–এই তিনগুণের যে কর্ম, তাই ধর্ম। যামিনীকুমার ও সত্ত্ব গুণের লক্ষণ কি?

বাবা লোকনাথ : প্রকৃত ব্রাহ্মণের লক্ষণই সত্ত্বগুণের লক্ষণ, অর্থাৎ সম, দম, তপঃ শৌচ ইত্যাদি। রজঃ গুণের লক্ষণ হল দান, ঐশ্বর্য, বীরত্ব ইত্যাদি। আর তমঃ গুণের লক্ষণ হল হিংসা, নিদ্রা, তন্দ্রা, দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি।

যামিনীকুমার : এইসব গুণ চিন্তা করলে আমাদের কি উপকার হবে?

বাবা লোকনাথ : সূর্যোদয়ে যেমন অন্ধকার দূর হয়ে যায়, গৃহস্থ জাগলে যেমন চোর পালায়, তেমনি এইসব গুণের চিন্তা বারবার করলে নিকৃষ্ট কর্মগুলি পালিয়ে যাবে। তখন এই দেহ দেবমন্দির হয়ে উঠবে।

যামিনীকুমার : দেহ ও মনকে পবিত্র রাখার কি কোনো উপায় আছে?

বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ আছে। সাত্ত্বিক আহারে দেহ পবিত্র হয় আর বাসনা ত্যাগে মন পবিত্র হয়। এইভাবে যখন তোমার দেহ ও মন পবিত্র হবে, তখন বুঝবে ‘হরি’ কেমন। তখন জানবে ‘হরি’ তোমার কে?

যামিনীকুমার : ব্রহ্মশক্তি অসার হৃদয় অধিকার করবে–এর অর্থ কি?

বাবা লোকনাথ : কালীই ব্রহ্মশক্তি। শবের হৃদয় অধিকার করে রয়েছেন।

যামিনীকুমার : শব কে?

বাবা লোকনাথ : তুমি যাকে শিব বলে জানো।

যামিনীকুমার : শব তো মৃতদেহকে বলে। বাবা লোকনাথ ও তাই শিবকে শব বলে। যামিনীকুমার ও শিব তো মৃত্যুঞ্জয়। তবে তাকে শব বলে কেন?

বাবা লোকনাথ : যে কারণে শিব মৃত্যুঞ্জয়, সেই কারণেই শব। যামিনীকুমার ও সেই কারণটা কি, তা তো বুঝলাম না। বাবা লোকনাথ? সেই কারণ হচ্ছে বাসনা ত্যাগ। বাসনা ত্যাগ হলেই জীবের অমরত্ব লাভ হয়। তার আর তখন মৃত্যু থাকে না। কামনা-বাসনা না থাকলে অহংবোধ থাকে না। তখন কোনো কার্য তার কর্তৃত্বে হচ্ছে বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় জীব সব কাজ করে যান, অথচ আসলে তিনি কিছুই করেন না। ভোগ বাসনার অভাবে জীব তখন মৃতবৎ সংসারে বিচরণ করেন। বাসনাশূন্য হলেই জীবের জীবত্ব শেষ হয়ে যায়, এবং জীব শিবত্ব লাভ করে। সেই অবস্থায় ইচ্ছাময়ী ব্রহ্মশক্তি কালীরূপে শবদেহ অধিকার করেন।

যামিনীকুমার : তবে কি আমার বাসনা ত্যাগ হলে হৃদয়ে কালীমূর্তির আবির্ভাব হবে?

বাবা লোকনাথ : সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মনো রূপকল্পনম অর্থাৎ সাধকের হিতের জন্যই ব্রহ্মরূপ পরিগ্রহ করেন। তোমার হিতের জন্য তোমাকে বুঝিয়ে দেবার জন্যই ওই কালীমূর্তির আবির্ভাব।

যামিনীকুমার :সাধক কয় শ্রেণিতে বিভক্ত?

বাবা লোকনাথ : সাধক চার শ্রেণিতে বিভক্ত; জ্ঞানী, যোগী, ভক্ত ও কর্মী।

যামিনীকুমার : এই চার শ্রেণির সাধকের সাধন প্রণালীর মধ্যে কি কোনো প্রভেদ আছে?

বাবা লোকনাথ : হ্যাঁ, আছে। জ্ঞানীর সাধন হল সৎসঙ্গ, দান, বিচার ও সন্তোষ। যোগীর সাধন হল জীবাত্মাকে পরমাত্মার সঙ্গে যোগ করা। ভক্তের সাধন হল সম্পূর্ণ নিষ্কামভাবে ভগবানের আত্মবৎ পূজা ও সেবা করা। কর্মী বা কর্মযোগের সাধনা হল দান, যজ্ঞ ইত্যাদি সাংসারিক কাজকর্ম অনাসক্তভাবে করা। সব সাধকই বিচার করে কর্ম করতে করতে বাসনশূন্য হয়ে মুক্ত হয়ে যায়।

যামিনীকুমার : সৎসঙ্গের ফল কি?

বাবা লোকনাথ : গঙ্গাস্নান ও বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণে যে ফল হয়, সৎসঙ্গে বা সাধুসঙ্গে সেই ফল হয়। সাধু দর্শনমাত্রেই জীবের সকল পাপ ও তাপ হরণ করেন। তাই সাধুসঙ্গের গুণ ও মহিমা অনন্ত।

যামিনীকুমার : দানের উপকারিতা কি? বাবা লোকনাথ : সাত্ত্বিক দান উদারতা ও বৈরাগ্য এনে দেয়। যামিনীকুমার ও বিচারে লাভ কি?

বাবা লোকনাথ : বিচারে আত্ম-অনাত্ম বোধ হয়, নিত্য-অনিত্য বিবেক জন্মায়। নিত্যনিত্য বিবেক জন্মালে অশুদ্ধ আরোগ্যের উৎপত্তি হয় এবং জীব শিব হয়।

যামিনীকুমার : সন্তোষ কিভাবে সাধন করতে হয়?

বাবা লোকনাথ : সংসারের বিভিন্ন অবস্থার মধ্যেও চেষ্টা করে মনকে তুষ্ট রাখাই হল সন্তোষ সাধনের উপায়।

যামিনীকুমার : ভগবান ধর্ম রক্ষার জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হন। এখানে যুগ কথার অর্থ কি?

বাবা লোকনাথ : কোনো কার্যের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক যুগ বলা হয়। বাল্য, যৌবন, বার্ধক্যও এক একটি যুগ। যুগ মানে সময় জানবে।

যামিনীকুমার : আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ভগবান ধর্ম রক্ষার জন্য রাম, কৃষ্ণ ইত্যাদি রূপে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর কলিতে জন্মগ্রহণ করেন–এটা বুঝলাম। কিন্তু কোনো মানুষের জীবনে বাল্যে, যৌবনে, বার্ধক্যে ভগবান তিন-চার রূপে অবতীর্ণ হন–এর অর্থ বুঝলাম না।

বাবা লোকনাথ : অবতারের অন্যতম উদ্দেশ্য হল অসুর নিপাত করা। তোমার হৃদয়ে জ্ঞানরূপ ভগবান অবতীর্ণ হয়ে তোমার অজ্ঞানরূপ অসুরকে যুগে যুগে বিনষ্ট করেন। যখন যে কালে তোমার মধ্যে অধর্মরূপ অসুর প্রবল হয়ে ওঠে, জ্ঞানের আবির্ভাবেই তা বিনষ্ট হয়ে যায়। তা সে বাল্যে, যৌবনে বা বার্ধক্যে, যখনই হোক না কেন। এইভাবে ভগবান তিন, চার কি পাঁচ, সাত বারও এক জীবনে অবতীর্ণ হতে পারেন। আবার একজনের পাঁচ-সাত জন্মের পরও জ্ঞানব্যাপী ভগবান অবতীর্ণ হতে পারেন।

যামিনীকুমার : একবার যার জীবনে ভগবান অবতীর্ণ হন, সে চিরকালের জন্য মুক্ত হয়ে যায় না কেন?

বাবা লোকনাথ : ভোগ পূর্ণ না হলে প্রারব্ধ কর্ম ক্ষয় হয় না। আর প্রারব্ধ ক্ষয় না হলে জীব সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয় না। তাছাড়া জীবকে একেবারেই মুক্ত করে দিলে ভগবানের সৃষ্টি কৌশলও থাকে না।

যামিনীকুমার : প্রারব্ধ কর্ম কাকে বলে?

 বাবা লোকনাথ : শাস্ত্রকারেরা বাণের সঙ্গে প্রারব্ধ কর্মের তুলনা করেছেন। বাণ যেমন একবার ধনুক থেকে ছেড়ে দিলে কর্তার আর কোনো কর্তৃত্ব থাকে না, তা আপন গতিবেগে যেখানে সেখানে গিয়ে পতিত হয়, জীবের প্রারব্ধ কর্মও তেমনি। কর্ম একবার করা হয়ে গেলে তার ফলের উপর কর্তার কোনো কর্তৃত্ব থাকে না। তার ফল ভোগ করতেই হবে। একজন্মে তা ভোগ না হলে জন্মান্তরে তা ভোগ করতে হবে। ভোগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার মুক্তি নেই।

যামিনীকুমার : বিষয়টা পরিষ্কার বুঝলাম না।

বাবা লোকনাথ : ছোট বেলায় জেনেছিস তো, জন্মকালে ষষ্ঠী যার ললাটে যা লিখে দিয়েছেন, তা হরি, হর, ব্রহ্মাণ্ড খণ্ডাতে পারেন না। অর্থাৎ যার যা কর্ম নির্দিষ্ট হয়েছে, তাকে তা করতেই হবে। একেই বলে ভাগ্য বা প্রারব্ধ। এই কারণেই কারো জীবনে ভগবান জ্ঞানরূপে কয়েকবার আবির্ভূত হলেও প্রারব্ধ ভোগ শেষ না হলে জীব মুক্ত হয় না। আবার এই ভোগ শেষ হলে জীব একবারেও মুক্ত হয়ে যেতে পারে।

এই প্রারব্ধ সম্বন্ধে আর এক ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষ স্বামী রামসুখদাসজি বলেছেন। ভগবাম জপ ও কীর্তন দ্বারা প্রারব্ধ বদলানো যায়। ভগবাম জপ ও কীর্তনে চিত্ত বিশুদ্ধ হলে অলভ্য বস্তু লভ্য হয়, অসম্ভব সম্ভব হয়। যিনি কর্মফলের বিধান করেছেন, তাকে যদি কেউ ডাকে, তার নাম জপ করে তাহলে তার নাম জপকারীর প্রারব্ধ যে বদলাবে তাতে আর আশ্চর্য কি? প্রসিদ্ধ ঈশ্বরের মায়ার সৃষ্টি। তাকে ক্ষয় করার জন্য তিনিই গুহ্য পথের সৃষ্টি করে রেখেছেন। মানবের প্রয়োজন তার সন্ধান আবার ও কর্ম ভক্তি যোগের মাধ্যমে তার নিবৃত্তি করা।

বাবা লোকনাথ নিজে সুরথ ব্রহ্মচারীর প্রারব্ধ ক্ষয় করিয়েছিলেন বিভিন্ন কর্মের দ্বারা। কিন্তু আজ সেইরূপ পথপ্রদর্শক গুরু খুবই দুর্লভ। বাবা লোকনাথ নিজে যামিনীকুমারকে বলেছিলেন, শিষ্যের অর্থনাশকারী গুরু অনেক পাওয়া যায় কিন্তু শিষ্যের ভবদুঃখ নাশকারী গুরু অতীব দুর্লভ।

ব্রহ্মচারী বাবার সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে যামিনীকুমারের মনে ধর্ম সংক্রান্ত এতদিন যে সব প্রশ্ন ছিল, সেগুলি পরিষ্কার হয়ে গেল। যে সব সংশয়ের জন্য তার মন এতদিন অশান্ত ছিল, সেই সংশয়গুলি মন থেকে দূরীভূত হয়ে মন শান্ত হলো। তার মধ্যে এক নতুন বিবেক বোধ জাগ্রত হলো। এক নতুন জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হল তার মন। যামিনীকুমার এরপর ব্রহ্মচারী বাবার চরণেই নিজেকে সমর্পণ করলেন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য। এরপর বাবা লোকনাথ যামিনীকুমারকে দীক্ষা দিলেন এবং উপদেশ দিলেন যে, মৌচাক হতে মধু সংগ্রহ করতে হলে মৌমাছি সরিয়ে মধুকুণ্ড লাভ করতে হয়। তেমনই আমার সূক্ষ্ম আদেশ গ্রহণ করতে হলে প্রথমে আসন, প্রাণায়াম, ধ্যান, ধারণা প্রভৃতির ভিতর দিয়ে হিংসা, দ্বেষ, কামনা, বাসনারূপী মৌমাছিগুলিকে সরাতে পারলেই তোমরা আমার আদেশ ধরার অধিকারী হবে।

বাবা যামিনীকুমারকে আরও উপদেশ দিলেন যে, মানুষের ধর্মপথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হল অহঙ্কার। অহঙ্কার ক্ষয় হলে মোহ নাশ হবে। মোহ নাশ হলে চিত্তশুদ্ধি হবে। চিত্তশুদ্ধি হলেই আত্মজ্ঞান লাভ হবে। আর তাহলেই ঘটবে জীবন্মুক্তি।

ব্রহ্মচারী বাবার কাছে দীক্ষিত হয়ে এবং অমূল্য উপদেশ প্রাপ্ত হয়ে শান্ত শুদ্ধ মনে যামিনীকুমার বাড়ি ফিরে গেলেন। বাড়ি ফিরে যামিনীকুমার মাকে বলেন, মূর্তিমান গীতা দেখে এলাম। সব বেদ বেদান্ত সহ সর্বভাব মূর্ত হয়ে রয়েছে এই মহাপুরুষের মধ্যে। কিন্তু তাঁর কৃপা ভিন্ন তাকে বোঝা সম্ভব নয়।

যামিনীকুমার বাবা লোকনাথের কৃপাধন্য ছিলেন। তিনি সেই কতিপয় ব্যক্তিদের মধ্যে একজন অতীব ভাগ্যবান ছিলেন যার মধ্যে ব্রহ্মচারী বাবা তার আধ্যাত্ম শক্তি সঞ্চারিত করেছিলেন। দীক্ষা দান করার পর বাবা যামিনীকুমারকে কর্মযোগে নিয়োজিত করার জন্য তাঁর মধ্যে তাঁর নিজের কৃপা ও আধ্যাত্ম শক্তি সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন। এরপর একদিন যামিনীকুমারকে বাবা তার সঙ্গে আহার করতে বললেন। এক পাত্রে গুরু-শিষ্য আহার করছেন। হঠাৎ বাবা যামিনীকুমারের মুখে গ্রাস তুলে দিলেন। যামিনীকুমার খেতে লাগলেন। বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কি করছিস? যামিনীকুমার বললেন, আপনি আমার মুখে যে অন্ন তুলে দিয়েছেন, আমি তা চিবিয়ে খাচ্ছি। তখন বাবা বলেন, গুরু শিষ্যের এতটাই করতে পারেন। গুরু শিষ্যের মুখে খাবার উঠিয়ে দেন, কিন্তু শিষ্যকে তা চিবিয়ে উদরস্থ করতে হবে। বাবার এই কথা বলার অর্থ হল যে, বাবা যামিনীকুমারকে যে ধর্মতত্ত্বের শিক্ষা দিলেন, এইগুলি তাকে অন্তঃকরণে স্থান দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। তবেই তার মধ্যে জ্ঞানের উদয় হবে। যামিনীকুমার পূর্ণব্রহ্ম ব্রহ্মচারী বাবার থেকে কেবল দীক্ষাই পেলেন না, পেলেন উচ্চ আধ্যাত্মতত্ত্ব এবং সেই আধ্যাত্মতত্ত্বকে হৃদয়ে ধারণ করার মতো যৌগিক ক্ষমতা, যা বাবা তার মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। তিনি ব্রহ্মচারী বাবার কাছে যা পেয়েছেন, সে অতি দুলর্ভ।

সাধন জগতের যারা যাত্রী, তাদের কাছে যামিনীকুমার ও বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর প্রশ্নোত্তর অধিবেশন জ্ঞানের সঞ্চার করবে এবং শিষ্যকে আধ্যাত্ম জগতে এগিয়ে দিতে গুরুর কর্তব্যেরও পথ প্রদর্শন করবে। কেবল মন্ত্র প্রদানই গুরুর কর্তব্যের শেষ নয়। বাবার প্রিয়ভক্ত যামিনী কুমারের সঙ্গে তার কথপোকথন যামিনীকুমার তার ধর্মসার সংগ্রহ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গেছেন।

.

কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী

কুলদানন্দ ছিলেন গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য। গোঁসাইজির ঢাকার আশ্রমের আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা লাভ করে তিনি সাধন জগতে প্রবেশ করেন। তারা চার ভাই। হরকান্ত, বরদাকান্ত, কুলদানন্দ (কুলদাকান্ত) ও তারাকান্ত। সকলেই গোঁসাইজির আশ্রমে যাতায়াত করতেন তাদের নিজ নিজ আধ্যাত্মিক পিপাসা নিবারণের জন্য। কুলদানন্দর তখন বোধহয় ২১/২২ বছর হবে। গোঁসাইজির পরামর্শে তিনি যতই মনকে আধ্যাত্ম পথে আনার চেষ্টা করেন, যৌবনের কামের জ্বালা তাঁর চিত্তকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। কিছুতেই তিনি তার প্রতিকারের কোনো উপায় খুঁজে পান না। তিনি গোঁসাইজির কাছে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কথা অনেকবার শুনেছেন। একদিন গোঁসাইজিকে জিজ্ঞাসা করেন, আমি কি একবার বারদীর ব্রহ্মচারীকে দর্শন করতে যাব? গোঁসাইজি তাকে তৎক্ষণাৎ অনুমতি দিলে তিনি সে-কথা তার ভাইদের বলেন। অতঃপর সব ভাই পরামর্শ করে এক রবিবার সকালে বারদীর পথে রওনা হলেন। চারভাই নৌকাযোগে সন্ধ্যাবেলা বারদী বাজারের ঘাটে এসে পৌঁছলেন। তারা নৌকায় বসে ভাবতে লাগলেন, গোঁসাইজি একবার তাদের বলেছিলেন সন্ধ্যার পর ব্রহ্মচারী বাবার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। রাতে আর খোলেন না। হিমালয় ও অন্য পাহাড়-পর্বত থেকে সূক্ষ্মরূপে যোগীগণ তাঁর কাছে সেইসময় যোগসাধনা সংক্রান্ত আধ্যাত্মিক আলোচনা করতে আসেন। সুতরাং সন্ধ্যাবেলা ঘর বন্ধ হয়ে গেলে ব্রহ্মচারী বাবার দর্শন সেইদিন হবে না। কুলদানন্দ বলেন যে, পরদিন সকালবেলা ব্রহ্মচারী বাবার সাক্ষাতে গেলেই ভালো। কিন্তু তাঁর বড় ভাই হরকান্ত সেদিনই ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠলেন। কুলদানন্দ রাজি না হওয়ায় অন্য তিন ভাই নৌকা থেকে নেমে বাজার দিয়ে আশ্রমে গিয়ে পৌঁছলেন। কিন্তু আশ্রমে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিস্ময়। আশ্রমে পৌঁছে তারা দেখেন বাবা তখনও ঘরে যাননি। তিনি তাঁর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আশ্রমে প্রবেশ করে বাবার সম্মুখে যেতেই বাবা বললেন, হরকান্ত, আমি তোমাদের জন্য এত রাত পর্যন্ত আমার ঘরের দরজা বন্ধ করিনি। এখন তোমরা যাও। নৌকায় বিশ্রাম করো গে। কাল সকালে এসো। এই কথাগুলি বলে বাবা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। হরকান্তবাবু ও তার ভাইয়েরা নৌকায় ফিরে কুলদানন্দকে সব কথা জানালেন।

পরদিন ভোরবেলা চারভাই ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে আশ্রমে উপস্থিত হলেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন উথাল-পাথাল করছে যে আগের দিন তারা কোনো পরিচয় প্রদান করার পূর্বেই বাবা কি করে হরকান্তর নাম ধরে ডাকলেন! তারা তো ব্রহ্মচারী বাবাকে কোনো খবর দিয়ে আসেননি। তারা যেই বাবার ঘরের বারান্দার সামনে হাজির হয়েছেন, অমনি ব্রহ্মচারী বাবা আসন থেকে উঠে এসে হরকান্তবাবুর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে তার পাশে বসালেন। অন্য ভাইয়েরা বারান্দায় গিয়ে বসলেন।

হরকান্তবাবুকে বাবা বললেন, তুমি তো মহাপুরুষ হে, ছদ্মবেশে কেন বাবু সেজে এসেছ?

হরকান্তবাবু উত্তর দিলেন, আমি তো সবসময়েই এই বেশে থাকি।

 এরপর হরকান্তবাবুর সঙ্গে ব্রহ্মচারী বাবা নানা আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গে আলোচনা করলেন। তারপর তাকে বললেন, হরকান্ত, তোমার কর্ম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আজ তুমি এসেছ আমায় দর্শন করতে। দশ বছর পর শত শত লোক তোমাকে দর্শন করে কৃতার্থ হবে।

পূর্ণব্রহ্ম বাবা লোকনাথ তাঁর অন্তদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে হরকান্তবাবুর মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাব জাগ্রত হলেও কর্মভোগের ফেরে অর্থাৎ প্রারন্ধের ফেরে এখনও তিনি সংসারকর্ম করে চলেছেন। তবে তার প্রারব্ধ শেষ প্রায়। এরপর তার মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তির স্ফুরণ ঘটবে এবং তিনি একজন আধ্যাত্মিক জগতের পথপ্রদর্শনকারীরূপে আত্মপ্রকাশ করবেন।

হরকান্তবাবু ব্রহ্মচারী বাবার কথা শুনে তাকে প্রশ্ন করলেন, আমার যথার্থ কল্যাণ কেমন করে হবে, তা আমায় বলে দিন।

ব্রহ্মচারী বাবা তখন বললেন, তুমি গোঁসাইজির কাছে দীক্ষা নাও। তার কাছে সত্যবস্তু আছে। তিনি তোমায় আশ্রয় দিলে তোমার কল্যাণ খুব শীঘ্রই হবে।

লোকনাথ বাবার এইরূপ বলার কারণ হল তার তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তিনি হরকান্তবাবুর মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা জানতে পেরেছিলেন। হরকান্তবাবু মনে করতেন ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য কেশব সেন গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর থেকে বড়ো। সেইজন্য গোঁসাইজির আশ্রমে গেলেও তিনি তাঁর কাছে এখনও দীক্ষা নেননি। তিনি মনে মনে এই যুক্তিও করতেন যে কেশব সেন যদি বিনা দীক্ষায় ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য হতে পারেন, তবে তিনিও তো বিনা দীক্ষায় কেবল নিজের পুরুষকার বলে ধর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারেন।

বাবা লোকনাথ তার মনের এই ভাবের কথা বুঝতে পেরে বলেন, ধর্মলাভের জন্য যা থাকা দরকার তোমার মধ্যে সবই আছে। তবে সদ্গুরুর কাছে দীক্ষিত না হলে ঈশ্বর দর্শনে অধিকার হয় না। বাবা তাকে আরও বললেন, শিশু ধ্রুব পাঁচ বছর বয়স থেকেই পদ্মপলাশলোচন হরিকে কত ডাকলো, পথে পথে কত কাদলো, তবু যতক্ষণ তার গুরুকরণ হল না, হরির দর্শন পেল না। গুরুকরণ ছাড়া ব্ৰহ্মদর্শন হয় না। মৌনী হবে, আহার-নিদ্রা ত্যাগ করবে, কত লোকে সাধু বলে ভক্তি করবে। কিন্তু তাতে প্রকৃত বস্তু লাভ হবে না। যদি ব্ৰহ্মদর্শন করতে চাও, তবে অন্তরের সমস্ত পূর্ব-সংস্কার দূর করে ফেলতে হবে। গুরুকরণে সমস্ত অন্তরের বাসনা দূরীভূত হয় এবং তখনই ব্রহ্মদর্শন সম্ভব হয়। এখন তোমার যা অবস্থা তাতে অন্তরে যে বাসনা আছে তা পাবে কিন্তু ব্রহ্মদর্শন হবে না।

বাবা লোকনাথ হরকান্তবাবুকে সঠিক আধ্যাত্ম পথের সন্ধান দিয়ে দিলেন। হরকান্তবাবু সঠিক পথের দিশা পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলেন।

কুলদানন্দর মেজদা বরদাকান্তর মন জুড়ে ছিল কি করে আরও অর্থ উপার্জন করা যায়। তার মধ্যেও বংশানুক্রমিক ধারায় ধর্মভাব আছে, কিন্তু ওই বয়সে তার নজর অর্থোপার্জনের দিকে। হরকান্তবাবুর পরে বাবা বরদাকান্তকে কাছে ডাকলেন। বাবার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে বরদাকান্তর মনের ভাজ খুলে গেল। তিনি জানতে পারলেন যে বড়দাকান্তর মনে ধর্মভাব থাকলেও তার মন অর্থোপার্জনের দিকে ঝুঁকে আছে। তিনি বরদাকান্তকে বললেন, তুই এখন অর্থ উপার্জন কর আর সেই অর্থ নির্লিপ্তভাবে লোকের সেবায় ব্যয় কর।

বাবা মনে করলেন এতে বরদাকান্তর অর্থোপার্জনের প্রতি আসক্তির নিবৃত্তি ঘটবে। আবার সেই অর্থে মানবসেবা করলে তার মনের ধর্মভাবেরও রক্ষা হবে। এখন ওঁর মধ্যে অর্থোপার্জনের বাসনা ওঁকে ধর্মকাজে প্রবৃত্ত হতে দেবে না। যেমন- রোগ, তার তেমনি দাওয়াই। বরদাকান্তবাবু বাবার এই কথায় সন্তুষ্ট হলেন এবং বাবার আশীর্বাদ নিলেন।

ব্রহ্মচারী বাবা কুলদানন্দর ভাইদের পর্যায়ক্রমে ডেকে কথা বলছেন। কুলদানন্দ ভেবেছিলেন মেজদার পরে তাঁর ডাক আসবে। কিন্তু বাবা বরদাকান্তবাবুর পর অন্য লোকদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। কুলদানন্দ বা তারাকান্ত কারোকে ডাকলেন না। যখন ঘরের অন্য লোকেদের সঙ্গে ব্রহ্মচারী বাবা কথা বলছেন, তখন কুলদানন্দ চুপ করে বারান্দায় বসে বাবাকে নিরীক্ষণ করছেন। গোঁসাইজি তাকে বলে দিয়েছেন, নিজে থেকে কোনো কথা না বলতে। বাবা সবার সঙ্গে কথা বলে কুলদানন্দকে ডেকে বললেন, তুই এখানে এসেছিস কেন? দেবতা দেখতে এসেছিস?

বাবার এই কথা বলার উদ্দেশ্য হল গোঁসাইজি কুলদানন্দকে বলেছিলেন, বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার দেহে সকল দেবদেবীর বাস তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। নিম্নভূমিতে এমন মহাপুরুষ তিনি আর দেখেননি।

কুলদানন্দ গোঁসাইজির পরামর্শ অনুযায়ী মৌন থেকে কেবল মাথা নেড়ে জানান–’না’।

বাবা তখন তাঁকে ঘুষি দেখিয়ে রাগত স্বরে বলেন, কথা না বলে শুধু মাথা নাড়ছিস কেন? কথা বল। কুলদানন্দ চুপ করে বসে থাকেন। বাবা লোকনাথ তার তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বুঝতে পারেন যে কুলদানন্দর মধ্যে যৌবনের কামের জ্বালা মনে বিক্ষোভের সৃষ্টি করছে। সে কামের নিবৃত্তি চায় না, কামভাবের প্রতিকার চায়। কিন্তু তিনি কুলদানন্দকে পরীক্ষা করার জন্য হঠাৎ বললেন, শোন কুলদা, তুই রমন করবি। আচ্ছা, তোর কি স্ত্রীলোক জোটে না? কুলদানন্দ তখন বাবাকে বলেন যে তিনি এই কামভাবের প্রতিকারের আশায় বাবার কাছে এসেছেন। ধর্মপথে থেকে এইভাবে রমন কাজ তাঁর কাছে নিন্দনীয়। বাবা তখন তাঁকে বললেন, ওরে, জ্ঞানীরা নিন্দা করবে না। মূর্খরাই করবে। মূখের নিন্দায় কি হয়?

বাবা কুলদানন্দকে বোঝালেন যে প্রত্যেকে কিছু কর্মভোগ নিয়ে এই জগতে আসে। কর্মের মাধ্যমেই সেই ভোগ ক্ষয় করতে হয়। কর্মভোগ যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ ধর্ম ধর্ম করে দৌড়লে কিছু হবে না। কর্মভোগ ক্ষয় হলে ধর্মলাভ হবে।

তারপর বাবা কুলদানন্দকে বলেন, হারে কুলদা, তুই তো রোজ ডায়েরি লিখিস। তাতে আমার দুটো কথা লিখে রাখিস। (১) বিলাসিতা ত্যাগ কর। (২) আর বিদ্যা হবে না। আচ্ছা আমার এই দুটো কথার মানে কি বুঝলি বল তো?

ব্রহ্মচারী বাবার প্রশ্নের উত্তরে কুলদানন্দ বললেন, সমস্ত রকম সুখভোগ ত্যাগ করাই বিলাসিতা ত্যাগ। বিলাসিতা ত্যাগ করলে ধর্মে মতি হবে। আর তা হলে লেখাপড়া হবে না।

কুলদানন্দের কথা শুনে বাবা রাগতস্বরে বললেন–তুই একটা গণ্ডমূর্খ। আমি কি তাই বলেছি? অবিদ্যা কাকে বলে আর বিদ্যা কাকে বলে জানিস না? তুই তো সে-কথা গোঁসাইয়ের কাছে জেনেছিস। লেখাপড়া করবি না কেন? বেশ ভালোভাবে লেখাপড়া করবি। লেখাপড়া করলেই পরীক্ষায় পাশ করবি। তবে বিলাসিতা করিস না। একখানা কাপড় আর একখানা চাদরই হবে তোর পরিচ্ছদ। নেহাৎ যদি পড়তে চাস এক জোড়া চটিজুতো পড়তে পারিস। মন যখন খারাপ হবে আমার কাছে আসবি। আমাকে চিঠি লিখবি। তোর ধর্মকর্ম সব হবে। অস্থির হোস না। কোনো ভয় নেই। তারপর বাবা বলেন, হ্যাঁরে কুলদা তুই একটা ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিস, তাই না? আমার আরও কাছে আয়। আমি বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। এখনই সেরে যাবে।

কুলদানন্দ শূল ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। কিন্তু এতবড়ো একজন মহাপুরুষের কাছ থেকে তিনি কেবল একটি ব্যথা নিরাময় করতে আসে নি। তাঁর কাছ থেকে তাকে অনেক মূল্যবান আধ্যাত্মিক সম্পদ পেতে হবে। সেইজন্য কুলদানন্দ বাবাকে বললেন, ব্যথা সারাবার জন্য আমি এখানে আসিনি। বারদী আশ্রম তখন একটা হাসপাতালের রূপ নিত, কেননা বেশিরভাগ দর্শনার্থীই বাবার কাছে আসতেন কোনো না কোনো দেহের রোগ সারাতে। কিন্তু কুলদানন্দর কথায় বাবা চমৎকৃত হলেন। কুলদানন্দ বললেন, আমি এসেছি শুধু আপনাকে দর্শন করতে। আমি দুদিন আগে স্বপ্নে আপনাকে ঠিক এমনটিই দেখেছিলাম।

কুলদানন্দর মনে সাত্ত্বিক ভাব ছিল। মাঝে মাঝে রজঃভাব তাকে তাপিত করে। তিনি সেই রজঃভাবকে কি করে প্রশমিত করতে পারেন সেই উপদেশের জন্য এসেছেন। তার মনের সাত্ত্বিক ভাব তাকে ব্রহ্মচারী বাবার থেকে কিছু চাওয়া থেকে বিরত করেছে। বাবার একস্পর্শে তার শূল রোগ চিরতরে নিরাময় হতে পারে জেনেও তিনি তা করতে রাজি হননি। বাবা বুঝতে পারেন যে কুলদানন্দ তার মনের সাত্ত্বিক ভাবের দ্বারা রজঃভাবকে দমিয়ে রাখতে সক্ষম। সে এসেছে কেবল দর্শনের জন্য। কুলদানন্দ গোঁসাইজির কাছে পূর্ণব্রহ্ম লোকনাথ ব্রহ্মচারীর দেবদেহের পরিচয় পেয়ে ভেবেছেন, যে দেহে সব দেবদেবী বাস করেন, সেই দেহের দর্শনেই তো সব দেবদেবীর দর্শন হয়ে যায়, তবেই তো কর্মক্ষয়, তবেই তো ব্রহ্মদর্শন। তবে মুখে কিছু চাইতে যাব কেন? কুলদানন্দর মতো ক’জন ভক্ত এইরকম ভাবতে পারে! ব্রহ্মদর্শনের পরে আর কি কারও কিছু চাওয়ার থাকতে পারে? কিন্তু এরূপ মনের নিয়ন্ত্রণ একমাত্র তারাই করতে পারেন যাদের মনে সাত্ত্বিক ভাবের প্রবলতা বেশি। কুলদানন্দ পেরেছিলেন। কিন্তু সব ভক্ত পারবে না। তাদের মনের রজঃ ও তমঃগুণের প্রভাবে তারা সংসারের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে ফেলতে চাইবে এক দর্শনে। এক সাত্ত্বিক দর্শনে যে রজঃ ও তমঃগুণ প্রভাবিত সব সমস্যার সমাধান নিজে থেকেই হয়ে যেতে পারে, সে কথা ভক্তের মনে উদয়ই হয় না। কুলদানন্দ তার সাত্ত্বিক গুণের প্রভাবে জীবনের এই সত্যকে বুঝতে সমর্থ হয়েছিলেন।

কুলদানন্দ যখন বাবাকে বললেন, তিনি একটি স্বপ্নে বাবাকে দেখেছেন, তখন বাবা তার কাছে সেই স্বপ্নের কথা জানতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কুলদানন্দ বলেন–

স্বপ্নে দেখলাম, গোঁসাইজি হঠাৎ আমাকে ডেকে বললেন, আর সময় নেই, চলো এখনই বেরিয়ে পড়ি। গোঁসাইজির পিছনে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। তারাকান্ত দাদাও সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তারপর আমাদের পথ চলা শুরু হলো। সকলের আগে আপনি, আপনার পিছনে গোঁসাইজি, তারপর তারাকান্ত দাদা আর সকলের পিছনে আমি। চলতে চলতে বেশ কিছুদূর গিয়ে ভীষণ ঘন একটা অরণ্য দেখতে পেলাম। দূর থেকে সেই অরণ্য দেখেই ভয় হতে লাগল। কিন্তু যতই এগোতে লাগলাম, অরণ্যের সবুজ ঘনসন্নিবিষ্ট গাছের শোভায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। অরণ্যের কাছাকাছি এসে দেখলাম তা শুধু বনভূমি নয়, সেখানে রয়েছে প্রকাণ্ড একটা পাহাড়। আমরা সেই পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। আপনি নিজের মনে পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন। গোঁসাইজি তার হাতের লাঠি দিয়ে কাটা সরিয়ে পথ পরিষ্কার করতে করতে চলেছেন। তারাকান্তদাদা এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে চলেছেন। আমি গোঁসাইজির দিকে দৃষ্টি রেখে চলেছি। ক্রমে আমরা বহু উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে সেই পর্বতের শিখরদেশে একটা সমতল জায়গায় এসে পৌঁছলাম। সেখানে গোঁসাইজি এক জায়গায় আমাকে নিয়ে গিয়ে তিনটি আসন দেখালেন। আসনগুলির চারিদিকে বহু পুরনো বড়ো বড়ো ঝাঁপড়া গাছ। জায়গাটি ছায়ায় ঢাকা। গাঢ় অন্ধকার। আসন তিনটিই গৈরিক লাল রঙের পাথর দিয়ে তৈরি। আসনগুলি চতুষ্কোণ এবং পূর্বমুখে পাতা রয়েছে। আসন তিনখানি ১, ২, ৩ সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত। ৩’ সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত আসনটি আমাকে দেখিয়ে গোঁসাইজি বললেন, এইটে তোমার আসন। এই আসনে বসে তোমাকে কিছুক্ষণ সাধনা করতে হবে। এইখানে বসো। তারপর ২’ সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত আসনটিতে গোঁসাইজি বসলেন। ১’ সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত আসনটি শূন্য রইল। গোঁসাইজির নির্দেশ মতো আমি সেই আসনে বসে কিছুক্ষণ সাধনা করলাম। পরে গোঁসাইজি তাঁর আসন থেকে উঠে বললেন, আমার পিছু পিছু চলো। তখন আমরা চারজনেই আবার পথচলা শুরু করলাম। উঁচু-নিচু কণ্টকাকীর্ণ জঙ্গলময় পথ। সেই পথ চলতে চলতে কাটায় আমার পদতল ক্ষত-বিক্ষত হলো। বার কয়েক হোঁচট খেলাম। দু-তিনবার পড়ে গেলাম। এরপর গোঁসাইজি দুর্গম সঙ্কীর্ণ গিরিপথের বিপদের কথা ঈশারা করে জানিয়ে দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে তিনি এগোতে লাগলেন। আমায় বারবার বলতে লাগলেন, খুব সাবধানে ধীরে ধীরে আমার পিছু পিছু এসো।

এইভাবে অতি কষ্ট করে অনেক দূর চলার পর শেষে এক বিশাল রাজ্যের খুব কাছে এসে পড়েছি বলে বুঝতে পারলাম। ঘন সন্নিবিষ্ট সবুজ গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মির মতো সেই রাজ্যের তেজ বেরিয়ে আসছে দেখলাম। সেই তেজরশ্মি ধরে আমরা এগোতে লাগলাম। গোঁসাইজি এক-একবার মুখ ফিরিয়ে আমার মুখপানে তাকিয়ে আমায় সাহস দিতে লাগলেন। তাতে আমার মনে হলো, সামনে কোনো বিপদ আছে। আমরা যে অরণ্যপথে চলছিলাম তা থেকে সেই জ্যোতির্ময় রাজ্যে প্রবেশ করার একটিমাত্র দ্বার ছিল। তা ছাড়া গোটা রাজ্যটাই বেড়ায় পরিবেষ্টিত। খুব উৎসুক হয়ে প্রবেশদ্বারের দিকে এগোতে লাগলাম। দ্বারের কাছে গিয়ে দেখি কৃষ্ণবর্ণ এক ভয়ঙ্কর লম্বা সাপ ফোঁস ফোঁস করছে আমাদের দেখে। সাপটি ফণা বিস্তার করে তেজের সঙ্গে আমাদের দংশন করতে এলো। প্রথমে আপনার সামনে ফণা উঁচিয়ে দাঁড়াল, কেননা আপনি সকলের সামনে ছিলেন। কিন্তু আপনি তাকে গ্রাহ্য করলেন না। এগিয়ে গেলেন। সাপটি এবার ফণা নামিয়ে গোঁসাইজির দিকে ছুটল। কিন্তু গোঁসাইজিও তাকে গ্রাহ্য করলেন না, এগিয়ে গেলেন। তিনি তখন আমার পানে তাকিয়ে ভয় নেই, ভয়, নেই বলে আমাকে আশ্বাস দিতে লাগলেন। আমিও ভয় পেলাম না। সাপটি তখন ফণা নামিয়ে তারাকান্ত দাদার দিকে এগিয়ে চললো। তারাকান্ত দাদার হাতে একটি লাঠি ছিল। সাপটি তার কাছে যেতে তিনি তার লাঠি দিয়ে সাপটিকে প্রহার করতে লাগলেন। সাপটি তখন তাঁর দু-পা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। গোঁসাইজি চিৎকার করে উঠলেন, ওকে মেরো না। মেরে ওকে ছাড়াতে পারবে না। ওকে না মারলে ও কোনো ক্ষতি করবে না। কিন্তু তারাকান্তদাদা ভয়ে ক্রমাগত লাঠি দিয়ে সাপটিকে আঘাত করতে লাগলেন। সাপটিও তার পা-দুটোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

এমন সময় সামনে তাকিয়ে দেখি উলঙ্গ, দীর্ঘাকৃতি, গৌরবর্ণ এক জটা-ব্রহ্মচারী বাবা। আপনি অবলীলাক্রমে প্রবেশদ্বার দিয়ে সেই জ্যোতির্ময় রাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করলেন। গোঁসাইজি সেই দ্বারপথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। তার দেহের অর্ধেকটা সেই জ্যোতির্ময় রাজ্যের মধ্যে আর বাকি অর্ধেকটা এদিকে। গোঁসাইজি তখন আমাকে হাত নেড়ে সঙ্কেত করে বললেন, তুমি সাপটিকে ডিঙ্গিয়ে তার উপর দিয়ে আমার দিকে লাফ দাও। সাপটি তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। আমি যেমনি একটা জোড় লাফ দিয়ে তার কাছে গিয়ে পড়লাম, আমি সেই ধাক্কায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নে আমি যেমনটি আপনাকে দেখেছি, আজ এখানে এসে আপনাকে দেখলাম সেই একই রূপ ও আকৃতিতে।

কুলদানন্দের মুখ থেকে এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত শুনে ব্রহ্মচারী বাবা বললেন, তোর ডায়েরিতে এই স্বপ্নের কথা লিখে রাখিস (কুলদানন্দ বাবার কথা শুনে তার স্বপ্নকথা ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন বলে আজ বাবার অগণিত ভক্তবৃন্দ সেই কথা জানতে পারছে)। ব্রহ্মচারী বাবা তাকে আরও বললেন, তোর পথ তো স্বপ্নেই তোকে দেখিয়েছে। আচ্ছা, তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিলি না কেন?

কুলদানন্দ তখন বললেন, গোঁসাইজি আমাকে বলে দিয়েছেন, আমার ভবিষ্যতে যা যা দরকার, সে-সব বিষয় আপনি নিজে থেকেই ডেকে বলবেন। আমাকে নিজে থেকে কোনো কথা বলতে তিনিই নিষেধ করেছিলেন।

তখন ব্রহ্মচারী বাবা বললেন, তোর সব কথার উত্তর, তোর যা যা দরকার, তা সব পেয়েছিস তো? কুলদানন্দ বললেন, হ্যাঁ পেয়েছি। এরপর ব্রহ্মচারী বাবা বললেন, তবে যা। স্বপ্নে যা দেখেছিস, তোর ডায়েরিতে লিখে রাখবি। তোর যত কিছু ব্যথা বেদনা তা সব প্রারক্কের। আমি হাত বুলিয়ে দিলে এখনকার মতো সারবে বটে, কিন্তু পরে আবার হবে। কর্মফল শেষ হলে আপনা থেকেই সেরে যাবে। অসহ্য বোধ হলে বেলগাছ তলার তাজামাটি লেপে দিস। কমে যাবে। কিন্তু তাতে তোর ভোগ শেষ হবে না। ভোগ শেষ করার জন্য আবার তোকে দেহ ধারণ করে এই পৃথিবীতে আসতে হবে। এখন ভেবে দেখ, কি করবি। তোকেই ঠিক করতে হবে, এই দেহেই ব্যথা সহ্য করে সাধনার দ্বারা মুক্ত হবি, না এ জীবনে রোগমুক্ত হয়ে ভোগ শেষ করার জন্য আবার দেহ ধারণ করে আসবি। এখান থেকে বোঝা যায় যে প্রারন্ধের ভোগ পূণ্য কর্মের মাধ্যমেই ক্ষয় করতে হয়।

ব্রহ্মচারী বাবার কথা শুনে কুলদানন্দ গম্ভীরভাবে ভাবতে লাগলেন রোগমুক্তি কী জীবন্মুক্তি–কোনটা শ্রেয়। তার মধ্যে এখন জীবন্মুক্তির বাসনাই প্রবল। সাময়িক কষ্ট থেকে মুক্ত হবার জন্য জীবন্মুক্তির পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া তার উচিত হবে না। কিন্তু তিনি ব্রহ্মচারী বাবাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না। তিনি তো বলেই দিয়েছেন রোগ থেকে মুক্তি চাস, না জীবন্মুক্তি চাস? কিন্তু তার মনে এখনও একটু দ্বন্দ্ব আছে। তিনি কিছুই বলতে পারছেন না।

কুলদানন্দকে মৌন দেখে বাবা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে, চুপ করে রইলি কেন? বল, তোর কি ইচ্ছা।

এবার কুলদানন্দ মনকে শক্ত করে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বললেন, রোগমুক্তির চেয়ে জীবন্মুক্তিই আমার বেশি কাম্য। এখন রোগমুক্ত হয়ে ভোগ শেষ করার জন্য আবার জীবনে বদ্ধ হতে চাই না। সাধনজীবনে যাতে আমি চরম উন্নতি লাভ করতে পারি, রোগ যন্ত্রণা যাতে আমার সাধনপথে বিশেষ কোনো বিঘ্ন না ঘটাতে পারে, আপনি আমাকে সেই করুণা করুন। আমি রোগমুক্তি চাই না।

কুলদানন্দের কথা শুনে বাবা খুব সন্তুষ্ট হলেন। তাঁর কাছে সবাই রোগমুক্তির জন্য আসে, সেজন্য তার মনে এক খেদ জমে আছে। তিনি হচ্ছেন জীবন্মুক্তি প্রদানকারী ব্রহ্মপুরুষ। কিন্তু সেই অমূল্য ধন কেউ তার কাছে চায় না। কুলদানন্দের অভিপ্রায় জেনে তাই বাবা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। এরপর কিছুদিন বারদী আশ্রমে বাবার স্নেহচ্ছায়ায় থেকে কুলদানন্দ বাবার থেকে অসীম, করুণা লাভ করলেন, তারপর একদিন বাবার থেকে বিদায় নিয়ে নিজ জায়গায় ফিরে গেলেন। ব্রহ্মচারী বাবা নিজের আশীর্বাদ দিয়ে তাকে গোঁসাইজির আশ্রয়েই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, কেননা গোঁসাইজি ছিলেন বাবার পরম স্নেহের ব্যক্তি। এরপর কুলদানন্দ একদিন কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।

.

ব্রহ্মানন্দ ভারতী (তারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়)

শ্রীতারাকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন নারায়ণগঞ্জের একজন প্রথিতযশা উকিল। বেদ, বেদান্ত ও দর্শনশাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল এবং সেজন্য তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। শাস্ত্রালোচনার জন্য তিনি ঢাকায় গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আশ্রমে যেতেন। তাঁরা চার ভাই ছিলেন–হরকান্ত, বরদাকান্ত, তারাকান্ত ও কুলদানন্দ। এই ভাইয়েদেরও গোঁসাইজির আশ্রমে যাতায়াত ছিল। ভাইদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কুলদানন্দ ধর্মালোচনার জন্য গোঁসাইজির কাছে নিয়মিত যেতেন কিন্তু তার মনের পিপাসা তাতে মিটছিল না। তারাকান্তের মনেও অনেক ধর্মসংক্রান্ত জিজ্ঞাসা ছিল, যার সদুত্তর তিনি কোথাও পাচ্ছিলেন না। অবশেষে এই চার ভাই একসঙ্গে গোঁসাইজির পরামর্শে ১২৯৫ সনের ১লা জ্যৈষ্ঠ বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনে আসেন। এরপরে ব্রহ্মচারী বাবা দু’বছরের কিছু বেশিদিন বেঁচে ছিলেন। কুলদানন্দ ও তারাকান্তের সঙ্গে বাবার ঘনিষ্ঠতা স্বল্পকালের হলেও তাদের সঙ্গে ব্রহ্মচারী বাবার বার্তালাপ আধ্যাত্মিক জগতের এক অমূল্য সম্পদ। কুলদাকান্ত বাবার আশীর্বাদ পেয়ে পরবর্তীকালে কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। যেদিন চারভাই একসঙ্গে বারদী আশ্রমে এসেছিলেন, সেদিন অন্য তিন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললেও বাবা তারাকান্তের সঙ্গে কথা বলেননি। হরকান্ত অন্য ভাইদের নিয়ে সেই স্থান ত্যাগ করার পর বাবা তারাকান্তর সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। তার সঙ্গে ব্রহ্মচারী বাবার যে ধর্মালোচনা হয়েছিল এবং সেই সংক্রান্ত কিছু গুহ্য আধ্যাত্মিক তত্ত্ব-কথার এখানে উল্লেখ করছি।

সবাই চলে গেলে বাবা তারাকান্তাকে জিজ্ঞাসা করেন—

 ব্রহ্মচারী বাবা : তুই কি জন্য এসেছিস?

তারাকান্ত : আজ্ঞে রামপ্রসাদ বলেছেন, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মলেম শ্যামা। আমারও হয়েছে ঠিক তাই। আমি নিজের ইচ্ছায় সংসারে এসে ঠেকে পড়েছি। সেই মায়াকে পেরোতে পারছি না। আপনি মহাযোগী, এই মায়াকে বশ করেছেন। আচ্ছা এই মায়া কি? এর থেকে উদ্ধারের উপায় কি?

ব্রহ্মচারী বাবা : ‘মায়া’ শব্দটি ‘মী’ ধাতু থেকে বুৎপন্ন হয়েছে। মী’ ধাতুর অর্থ হল বোধ করা। যে শক্তি দ্বারা ঈশ্বরের সৃজন, পালন, হরণাদি বোধ হয়, তাকে মায়া বলে। যে মায়া সমস্ত দেবতাগণকেও বিমোহিত করে, সে মায়াতে মজীবেরাও যে বিমুগ্ধ হবে, তাতে আর সন্দেহ কি? মায়া সুখ-দুঃখ, আশা-দুরাশায় জীবকে মুগ্ধ রেখেছে। কর্মফল সমূহের দ্বারা জীব জগতে সৃজন, পালন, হরণ ঘটাচ্ছে। এই মায়ার তত্ত্ব বুঝলে সংসারে আবদ্ধ জীব পরমতত্ত্ব বুঝতে পারে।

ব্রহ্মচারী বাবা! তারাকান্ত, সন্দেহ করতে পারিস, যদি মুক্তির জন্য মানুষের জন্ম হয়, তবে ভগবান মায়া দিয়ে কেন তাদের আবদ্ধ করেছেন? এর উত্তরে বলা যায়, বিষয় ভোগে আসক্ত জীবদের মোক্ষের আশা জোড়ালো করবার জন্যই ভগবান মায়ার সৃজন করেছেন। ভোগ ও মুক্তি এই উভয় অবস্থা বোঝাতেই ভগবান সমস্ত পশুজগৎকে আহার, নিদ্রা, ভয়, ক্রোধ, মৈথুনাদির দ্বারা ভারাক্রান্ত করে শুধু বিষয়ভোগেই মত্ত রেখেছেন। বিষয়ভোগে দুঃখলাভ হয় এই জ্ঞান অন্তরে অনুভব করার ক্ষমতা ভগবান মানুষকেই দিয়েছেন। এই মোহ ও জ্ঞান উভয়ই অধিকারভেদে একা মায়া থেকেই মানুষ সংসারে লাভ করে। যদি এই মোহজ্ঞানের বোধ স্বভাবতঃ না হতো, তাহলে একদিনও সংসার চলতো না। মায়াদ্বারা অবস্থা ভেদে জীব জ্ঞান ও অজ্ঞান দুই-ই লাভ করে। যে সকল জীব মায়াঘটিত বিষয়ভোগে উন্মত্ত হয়, তারাই বিষয় আসক্ত হয় এবং অজ্ঞান বা মোহ লাভ করে। আর যাঁরা মায়াঘটিত বিষয়ভোগকে চিত্তের আবরণকারী বুঝে তা থেকে চিত্তকে বিশুদ্ধ রাখতে ইচ্ছা করেন, তাঁরাই জ্ঞান লাভ করেন। এখন প্রশ্ন, যারা অকৃতাত্মা ও স্থূলবুদ্ধি, তারা ঈশ্বর মায়া থেকে কেমন করে উদ্ধারলাভ করে?

অকৃতাত্মা হল তারা, যাদের ইন্দ্রিয় ও মন বিষয়ে আসক্ত, কিছুতেই যারা জ্ঞানের বশীভূত হয় না। আর স্থূল বুদ্ধি হল তারা, যাদের দেহ, গৃহ, ধন ও মনে নিত্যবুদ্ধি। চৈতন্যস্বরূপ ভগবানে তাদের বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা জন্মায় না। এই উভয়বিধ মানুষই মানবজন্মের উপযুক্ত অবস্থা লাভ করে না। মায়া থেকে তাদের উদ্ধারের উপায় বলছি, শোন।

বৈরাগ্য বিনা ওই সব দোষ দূর হয় না। মায়ার তত্ত্ব ও আত্মতত্ত্ব এই উভয় বিষয়ই উপযুক্ত গুরুর কাছে শুনতে শুনতে যখন মায়াঘটিত ভোগকে দুঃখ বলে বোধ হবে, তখনই বৈরাগ্যের উদয় হবে। এই বৈরাগ্য যত জোরালো হবে ততই মন বিশুদ্ধ ও চিত্ত উজ্জ্বল হবে। এই তত্ত্বকথা শুনতে শুনতে মনের মালিন্য দূর হয়ে যায়। এই অবস্থায় কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় যোগে এমন কিছু কর্ম করা চাই, যে কর্মের গুণে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে মন বিশুদ্ধ হবে। ভগবৎ সেবারূপ কর্ম আর আত্মতত্ত্বের অনুভব–এই উভয় বিষয় অভ্যাসে পরিপক্ক হতে হতে অন্তর যত নির্মল হবে, ততই শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রেমের সঞ্চার হবে। আর তখনই মায়ার বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে যাবে।

তবে প্রশ্ন করতে পারিস, সু-শিক্ষার জন্য না হয় তত্ত্বজ্ঞান শুনেই অভ্যাস করলাম, তাতে আবার কর্মের দরকার কি? এর উত্তরে বলা যায়, যে উপদেশ শেখার উপযুক্ত, তার কর্তব্য ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা অনুষ্ঠিত না হলে কখনও সেই বিষয়ে অন্তরের পরিণতি ঘটতে পারে না। যেমন কেউ অহিংসা পরম ধর্ম এক মুখে বলে, উপদেশ শোনে, কিন্তু কাজে তা দেখায় না। যদি সে প্রতিদিনই নিজের হাতে জীবহত্যা করে, তার মাংস খায়, তাহলে তাতে অহিংসার জন্য চিত্তের যে বিশুদ্ধ ভাব দরকার, তা কখনও হতে পারে না। যেমন ওষুধের নাম, চিকিৎসকের নাম, রোগের নাম বারবার শুনলে বা ওষুধ শিখলে রোগ দূর হয় না। নিজে ওষুধ খেতে হবে। তেমনি মায়াভোগে ইন্দ্রিয়াদির সঙ্গে অন্তরের প্রবৃত্তি ও স্থূলদেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আসক্তিরূপ যে রোগে আক্রান্ত হয়েছে, কর্মের দ্বারা তা শোধন করতে হবে। তাতে ওষুধ ব্যবহারে রোগক্ষয়ের মতো জীবের পক্ষে মায়ারও ক্ষয় হতে পারে। যাক এসব কথা। তারাকান্ত, তুই মায়ার উপাসনা করে মায়াকে বশ করিস না কেন?

তারাকান্ত : মায়া বা প্রকৃতি জড়স্বভাবা। তাই তার উপাসনা করতে প্রবৃত্তি হয় না।

ব্রহ্মচারী বাবা : গুটিপোকা তার লালা থেকে রেশম বার করে তা দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে। তখন সেই আচ্ছাদন কেটে তার আর বার হবার সামর্থ্য থাকে না। অন্য কেউ তাকে বার করে দিলেও তাকে বাঁচাতে পারে না। কিন্তু কালক্রমে যখন সে আগের রূপ পরিবর্তন করে অর্থাৎ গুটিপোকা প্রজাপতির আকারে পরিণত হয়, তখন সে নিজেই তার সেই বাসা কেটে বার হয়ে যায়।

তারাকান্ত এই কথার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারলেন না। ব্রহ্মচারী বাবা মায়াকে বশীভূত করার যে তত্ত্বের কথা বললেন, তা তারাকান্তর বোধশক্তির আয়ত্তের বাইরে। যদিও বাবা মানবশরীরে মায়ার ক্রিয়া থেকে মানুষ নিজেকে কিভাবে মুক্ত করতে পারে, সে বিষয়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারাকান্তর ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য থাকলেও, সে অনুভব করলো যে মানুষের শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে অর্থাৎ ঈশ্বরের সৃজন রহস্য সম্বন্ধে তার জ্ঞান সীমিত। সেজন্য ব্রহ্মচারী বাবার কথার প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে তিনি সক্ষম হলেন না। এই তত্ত্ব তার কাছে খুব কঠিন কৰ্মমার্গের তত্ত্ব বলে মনে হলো। তিনি ঠিক করলেন সেইদিন তিনি ফিরে যাবেন। তারপর বাবাকে প্রণাম করে সেদিন বাড়ি ফিরে গেলেন।

তারাকান্তের কাছে বাবা লোকনাথের মায়া ক্ষয় করার প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা কঠিন ও দুর্গম মনে হয়েছিল কারণ ঈশ্বরের সৃজন রহস্য তার অজানা ছিল। সৃজন রহস্য না জানা থাকলে মানবশরীরে মায়ার ক্রিয়া বোঝা যায় না। অথর্ববেদে মানবের সৃজন ক্রিয়ার উল্লেখ আছে। অথর্ববেদের একাদশ কান্ডের তৃতীয় অনুবাকের অন্তর্গত পঞ্চম ও ষষ্ঠ সূক্ত অনুযায়ী মানবদেহের ঈশ্বরের সৃজন ক্রিয়ার উল্লেখ এখানে করা হলো। এই সৃজন ক্রিয়া ও ঈশ্বর দ্বারা মায়ার ব্যবহার জানা থাকলে, বাবা লোকনাথের উপদেশানুসারে মায়া ক্ষয় করার ক্রিয়া করতে সাধনেচ্ছু মানুষ প্রবৃত্ত হতে পারে।

ঈশ্বর সৃষ্টিকালে কেশ, অস্থি, স্নায়ু, মাংস, মজ্জা একত্র করে হস্তপাদাদি অঙ্গ উপাঙ্গের সাথে শরীর নির্মাণ করে আত্মরূপে সে শরীরে প্রবেশ করেছেন এবং তাঁরই নির্দেশে মহামায়া শরীর-মধ্যে পরমাত্মাকে ও স্বত্ত্ব গুণাবলীকে আবরণ দ্বারা বদ্ধ করে রেখেছেন। এই মানবদেহের মধ্যেই তিনি সমস্ত প্রবৃত্তিগুলি মূলাধার থেকে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত ষট্‌চক্রের প্রতিটি চক্রে স্ব-স্ব স্থানে প্রতিস্থাপিত করেছেন। এবং তিনি স্বয়ং মানবদেহের মস্তকে সহস্রাধারে অবস্থান করছেন। এইজন্য বিদ্বান ব্যক্তি মানবদেহের শরীরকে ব্রহ্মের অংশ বলে জানেন।

ঈশ্বরের ইচ্ছায় স্বত্বগুণাদির প্রকাশ করে বিদ্যার বা জ্ঞানের দ্বারা অবিদ্যাদি ক্লেশের ক্ষয় করে কর্মের দ্বারা মায়ার আবরণ থেকে মানুষ মুক্ত হয়ে নিজ দেহে পরমাত্মার দর্শন করতে পারে। প্রতি মানব শরীরে পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চবায়ু, বুদ্ধি ও মন–এই সপ্তদশ ইন্দ্রিয়যুক্ত লিঙ্গশরীর দেবতাদের অবস্থানে সমৃদ্ধ জীবাত্মারূপে কথিত হয়। এই লিঙ্গশরীর অর্থাৎ জীবাত্মাকে মায়ামুক্ত করে ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্রহ্মতেজ সম্বল করে (সুষুম্না নাড়ির মধ্যে ব্রহ্ম নাড়ি) জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হতে পারে। সেটাই হল আত্মমুক্তি।

এখন প্রশ্ন হল সুষুম্না নাড়ির অন্তর্গত ব্রহ্মনাড়ির মধ্যে সঞ্চিত ব্রহ্মতেজকে সম্বল করে এই নাড়ির ব্রহ্মরন্ধ্রস্থ মুখে নিজের অন্তদৃষ্টিকে স্থিত করতে পারলে জীবাত্মা পরমাত্মার দর্শন করতে পারে, সেই কথা বোঝা গেল (সুষুম্না নাড়ির অন্তর্গত ব্রহ্মনাড়ির অবস্থান পূর্বে বর্ণিত হয়েছে)। কিন্তু গৃহাশ্রম যোগীদের কাছে সমস্যা হল ব্রহ্মনাড়ীর মধ্যে রক্ষিত ব্রহ্মতেজ অগ্নিকে কিভাবে অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে ব্রহ্মরন্ধ্রে অর্থাৎ মেরুদণ্ড থেকে মস্তকে প্রেরণ করা যাবে?

এই ব্যাপারে নর্মদা পরিক্রমাকালে যে ক্ষুদ্র জ্ঞান আমি আহরণ করতে পেরেছি, এবং বাবা লোকনাথ ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে যে জ্ঞান সম্বন্ধে অবহিত করেছিলেন, এখানে তার উল্লেখ করছি।

সুষুম্না নাড়িকে প্রথমে দর্শন ও পরে সেই নাড়ির সাহায্যে নিজ দেহে পরমপদ দর্শন করা যায়। যোগীগণ ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহকে ও চিত্তকে বিশুদ্ধ করে ষট্‌চক্র ক্রিয়ার মাধ্যমে সুষুম্না নাড়ির অন্তর্গত ব্রহ্মনাড়ির মধ্যে যে অগ্নিরূপ ব্ৰহ্মতেজ সঞ্চিত আছে, তাকে প্রথমে আজ্ঞাচক্রে প্রেরণ করে সেখানে সেই জ্যোতির দর্শন করেন এবং তৎপর সেই জ্যোতিকে অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে মস্তকে প্রেরণ করে পরমপদ দর্শন করেন। গৃহাশ্রমের সাধকগণ অর্থাৎ যারা নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী নন, তারা বা অন্য গৃহাশ্রমী ভগবৎপ্রেমীগণ অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে সুষুম্ন থেকে অগ্নিরূপ ব্রহ্মতেজ রশ্মিকে মস্তকে প্রেরণ করে নিজের জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটাতে পারেন। এক্ষেত্রে বলে রাখা যায় যে, যখন উপনয়নের পর কোনো ব্রহ্মচারী গুরু গৃহে শাস্ত্র বা যোগ শিক্ষার্থে যান এবং গুরুগৃহ থেকে আর গৃহাশ্রমে প্রত্যাবর্তন করেন না, তাকে নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী বলে। যেমন বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব। আর যখন উপনয়নান্তে ব্রহ্মচারী গুরুগৃহে শাস্ত্র ও যোগ শিক্ষার্থে গিয়ে শিক্ষান্তে গৃহাশ্রমে ফিরে আসেন, তাকে উপকূর্বান ব্রহ্মচারী বলে। তাদের গৃহে প্রত্যাবর্তনকে সমাবর্তন বলা হয়। এখানে আমি গৃহাশমীদের উপযুক্ত পদ্ধতির কথাই উল্লেখ করছি যা আমি নর্মদা পরিক্রমাকালে ও তারপরেও শিখেছি।

গৃহাশ্রমী সাধকদের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়া আছে। সেই ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ায় নিজশরীর ও চিত্তকে বিশুদ্ধ করে নিতে হয়। তারপর রাত্রিকালে অথবা ব্রাহ্মমুহূর্তে ফুসফুসের মাধ্যমে সুষুম্না নাড়িতে অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা যোগ স্থাপন করতে হয়। ওই সময়কালে অন্তদৃষ্টি দেহাভ্যন্তরে প্রসারিত করা সহজ হয়। ওইসময় ফুসফুস কর্ম স্নায়ু বিশেষ দ্বারা মেরুদণ্ডের সঙ্গে বাহিত হয়। সেই মেরুদণ্ডের মধ্যে ব্রহ্মতেজ সম্বলিত জ্বলন্ত শক্তি নিহিত আছে। ফুসফুস ক্রিয়ার সময় বায়ু গমনকালে ওই স্নায়ুর মধ্যে যে চাপ দেয়, তার দ্বারা ফুসফুস প্রসারিত হয় এবং নাসিকা পথে বাইরের বায়ু শরীরে প্রবেশ করে। আবার ওই শক্তি ঊর্ধ্বগমনকালে কম্পনরহিত হয় এবং ফুসফুস সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। এই সময় শরীরে গৃহীত বায়ু নাসিকাপথে প্রশ্বাসক্ৰমে বাইরে বেরিয়ে যায়। মস্তক-মধ্যস্থ মস্তিষ্করাশি থেকে নির্গত কঠিন মজ্জাগুলি রজ্জ্বর ন্যায় মেরুদণ্ডের মধ্যস্থ যে ছিদ্রগুলি আছে সেগুলি পূর্ণ করে অবস্থান করে। তার মধ্য দিয়ে অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে সুষুম্না নাড়ির মধ্যস্থ অগ্নিরূপ জ্বলন্ত শক্তি সঞ্চারণ করে সেই সঞ্চারণ স্থানকে সুষুম্নার অন্তর্গত ব্রহ্মনাড়ি বলে চিহ্নিত করতে হয়। এবার সাধক দুই ভ্রুর মধ্যে ললাট মধ্যস্থলে অন্তদৃষ্টিকে ক্রমে ক্রমে মজ্জাশ্রেণির সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ডের মধ্যে সঞ্চারণ করবেন। এইরূপ অভ্যাস করলে সাধক বুঝতে পারবেন যে মজ্জাগুলি অভ্যন্তরদেশে এক অতি জীবন্ত শক্তি বিদ্যুল্লতার রূপ ধারণ করে আজ্ঞাচক্র থেকে মেরুদণ্ডের মধ্যস্থল পর্যন্ত যাতায়াত করছে। সেই সময় সাধক নিজ অন্তদৃষ্টি দ্বারা আজ্ঞাচক্রে সেই ব্ৰহ্মতেজের জ্যোতিও দর্শন করবেন। সেই জ্যোতি খুব উজ্জ্বল এক চক্রের ন্যায় দর্শিত হয়। এরপর ওই জ্যোতি অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা আজ্ঞাচক্রের ঊর্ধ্বপথে প্রবেশ করিয়ে মস্তিষ্ক মধ্যে সহস্রর দর্শন পাবেন। সেই সহস্রার মধ্যে ব্রহ্মরন্ধ্রে নিজের জীবাত্মাকে প্রেরণ করলে সেখানে পরমাত্মার অর্থাৎ পরমপদের দর্শন পাবেন। তখন সাধকের মধ্যে জ্ঞান হবে যে তাঁর জীবাত্মা বা লিঙ্গশরীর পরমাত্মারই অংশ। তিনি দেখবেন নিজেকে। এই অবস্থার নামই আত্মমুক্তি।

বাবা লোকনাথ এই আত্মমুক্তির পথই তারাকান্তকে বলেছিলেন। তিনি নিজে একজন ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ বলেই এত সহজ করে সরলভাবে মায়াক্ষয় করার প্রক্রিয়া বলতে পেরেছিলেন। গৃহাশ্রমে সাধকদের ক্ষেত্রে বাবার এই সরলীকৃত পথ খুবই কার্যকর।

তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমাকালে ঈশ্বরের এই সৃজন রহস্য সম্বন্ধে আমি যৎসামান্য জ্ঞান লাভ করি এবং সারা পরিক্রমায় এই মায়াক্ষয় করার প্রক্রিয়ায় রত থাকি। উত্তরতটে উজ্জয়িনীতে মহামায়া মন্দিরে সারাদিন উপবাসে থেকে সান্ধ্য আরতিকালে মহামায়ার কাছেই আমাদের মধ্যে তিনি যে আবরণ সৃষ্টি করেছেন, তা ক্ষয় করে দেবার আকুল প্রার্থনা জানাই এবং সারা পরিক্রমায় অজপা (এইভাগেই পূর্ণ বিশ্লেষণ করা আছে) সাধনের মাধ্যমে জীবাত্মাকে ঈশ্বরমুখী করার প্রয়াস করি। খুবই আশ্চর্যের কথা, সেদিনই মধ্যরাত্রে এক দিব্যজ্যোতি পুরুষ আমার স্ত্রীকে দর্শন দিয়ে অভয় দান করেন। বাবা লোকনাথের দর্শিত মায়াক্ষয় করার পথের কার্যকারিতা আমি ও আমার স্ত্রী নিজ জীবনে উপলব্ধি করেছি।

অন্তর দিয়ে অনুধাবন করলে বোঝা যায় যে, বাবা লোকনাথ গুটিপোকার উদাহরণ দিয়ে মায়া ক্ষয় করার যে প্রক্রিয়া বলেছেন, তা কর্মমার্গের পথ। গুটিপোকা যেমন স্বনির্মিত গুটিতে আবদ্ধ হয়ে প্রজাপতিতে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত ওই আবদ্ধ দশা থেকে মুক্তিলাভ করে না, তেমনই জীবও মায়াকে ক্ষয় না করা পর্যন্ত নিজের স্বরূপ চৈতন্যে অবস্থিত হতে পারে না। জ্ঞানমার্গে এই অবস্থায় পৌঁছানো যেতে পারে, কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু ভক্তি ও কর্মমার্গ সাধকের কাছে এই কাজ সহজ করে দিতে পারে। যারা গৃহাশ্রমে থেকে আত্মমুক্তির উপায় সন্ধান করেন, তাদের কাছে এই কর্মমার্গের পথই শ্রেষ্ঠ পথ। তবে এই পথে জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞানের নাশ করা সর্বাগ্রে কর্তব্য। বাবা তারাকান্তকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তা আত্মমুক্তির উপায় সন্ধানকারী সকল ভক্তগণের কাছেই এক অতি মূল্যবান উপদেশ। ব্রহ্মচারী বাবার কৃপাদৃষ্টি সব সময় সকল ভক্তের উপর থাকে।

তারাকান্তবাবু বাড়ি ফিরে গিয়ে ব্রহ্মচারী বাবার ‘মায়া’ শব্দের বিশ্লেষণের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য বোঝায় মনোনিবেশ করেছিলেন। ব্রহ্মচারী বাবার দৃষ্টি ও তাঁর বাৎসল্যপূর্ণ ব্যবহার তারাকান্তবাবুকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি অনেক সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গে সৎসঙ্গ করেছেন, কিন্তু এই রকম ভাব কারও মধ্যে দেখেননি। এমন যত্ন করে প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি কাউকে দেখেননি। তার মনে এক প্রশ্ন বারবার ঘুরে-ফিরে আসছিল যে ব্রহ্মচারী বাবা কে? তার মন বারবার বারদী পৌঁছে যেতে চায়, অশান্ত হয়ে ওঠে। তিনি আবার বারদী আশ্রমে ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনে আসেন। তারাকান্তবাবু বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি ব্রহ্মচারীবাবাকে পরে ‘তুমি’ সম্বোধন করতেন। ব্রহ্মচারী বাবার কাছে এসে তিনি তাঁর জ্ঞানের পিপাসার নিরসন করতে থাকেন। একদিন এসে তিনি প্রশ্ন করেন

তারাকান্ত : তুমি কে? বুঝিয়ে বলো।

বাবা লোকনাথ : আমাকে আমি জানতে পারি না, অতএব বলতেও পারি না।

ব্রহ্মানন্দ ভারতী বলেছেন যে এই কথাটি হৃদয়ঙ্গম করা তাঁর পক্ষে খুব কঠিন ছিল। এই কথার মধ্যে এক গঢ় আধ্যাত্ম বিজ্ঞান নিহিত আছে– আমি কে এই কথা চিন্তা করলে বোঝা যায় কতকগুলি অনুভূতির সমষ্টিই আমার আমিত্ব। এই আমিত্বকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, অনুভূতি বিষয়গুলি অর্থাৎ কর্ম, অনুভব ব্যাপারটি অর্থাৎ ক্রিয়া, অনুভবের সম্পাদক অর্থাৎ কর্তা। এর মধ্যে যে অনুভব করল, অর্থাৎ যার সত্তা দ্বারা অনুভব ক্রিয়া নিষ্পন্ন হলো, সেই চেতন বস্তুই যথার্থ আমি অর্থাৎ বিজ্ঞাতা। সেই আমি বা চেতন বস্তু অথবা বিজ্ঞাতা ভিন্ন যা কিছু অনুভব করা যায়, তৎসমুদয় চেতন নয়, অর্থাৎ অচেতন বা জড়। এই কথা থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে সকল দেহে এক-একটি ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞাতা নাই–একই বিজ্ঞাতা অর্থাৎ আমি। ব্রহ্মচারী বাবা আপনাকে সেই একমাত্র বিজ্ঞাতা বলে টের পেয়েছিলেন এবং সেইজন্যই বলেছিলেন–আমাকে আমিজানতে পারিনা।

ব্রহ্মানন্দ ভারতী ব্রহ্মচারী বাবার স্বরূপ জানতে ইচ্ছুক ছিলেন। সেইজন্য তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে বাবার স্বরূপ উদঘাটনে সমর্থ হন। বিভিন্ন প্রশ্নের ছোট ছোট উত্তর জেনে তিনি ব্রহ্মচারী বাবার স্বরূপ সম্বন্ধে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, এখানে তাঁর সেই উপলব্ধির কথা উল্লেখ করছি

সাধারণ জ্ঞানে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার ঐক্য করার নাম যোগ। পঞ্চভূত দেহের মালিককে চোখে দেখা যায়, এজন্য তাকে জীব বলে বুঝি কিন্তু পরমাত্মাকে চোখে দেখা যায় না, তার কথা আমরা কিছু জানি না। বাবা লোকনাথ চরম সিদ্ধি প্রাপ্তির পূর্বে যাকে জীবাত্মা বলে জানতেন, চরম সিদ্ধি প্রাপ্তির পর আর তাকে খুঁজে পেলেন না। কারণ তখন আর তিনি সেই দেহের মালিক রইলেন না, তিনি হয়ে উঠলেন সেই বিজ্ঞাতা অর্থাৎ পরমাত্মা। সেইজন্য তিনি বলেছেন, আমাকে আমি জানতে পারি না। লোকনাথ ব্রহ্মচারী যখন পরমাত্মার সাক্ষাৎ পেয়ে মুক্ত হয়ে গেলেন, তখন তাঁর জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন পরমাত্মা অর্থাৎ পূর্ণব্রহ্ম। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী নিজে ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বলেছিলেন যে, যখন আমি আমার দেহ থেকে আলগা হয়ে যাই, তখন সাধারণের অগোচর বিষয়সমূহ জানতে পাই। ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবা লোকনাথের পূর্ণব্রহ্ম স্বরূপ জানতে পেরেছিলেন বলে তিনি বাবাকে কেবল একজন মহাযোগী ভাবতেন না। তার কথার মধ্যে ঈশ্বরভাব প্রকাশ পেত। তাই তারাকান্তবাবু তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ঘন ঘন বারদী আসতে থাকেন এবং একসময় ওকালতি পেশা ছেড়ে দিয়ে বারদী আশ্রমে বসবাস করতে থাকেন। বাবা লোকনাথ তার জন্য একটি ঘর বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। তারাকান্তবাবু চাইতেন ব্রহ্মচারী বাবার সান্নিধ্যে থেকে আরও কিছু সাধনার মূল বিষয় জেনে নিতে। তিনি আশ্রমে থেকে বাবার সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আরও অনেক সাধনতত্ত্ব বিষয় জেনে নেন। তাঁর কিছু এখানে উল্লেখ করছি

তারাকান্ত : আচ্ছা, মানব জীবনের লক্ষ্য কি?

বাবা লোকনাথ : ইহজীবনে ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়ে অমৃতত্ত্ব লাভ করা। তারাকান্ত ও ওই লক্ষ্যে সকলে পৌঁছতে পারেনা কেন? বাবা লোকনাথ ও ওই লক্ষ্যে পৌঁছবার পথে যে বাধা রয়েছে তা দূর করতে পারলে অভীষ্ট লাভ করা অসম্ভব। তাই পারে না।

 তারাকান্ত : ওই বাধার স্বরূপ কি? আর কিভাবেই বা দূর করা যায়?

বাবা লোকনাথ : বিষয়ের উপর আসক্তি, আর আসক্তিজনিত কামনা বাসনাই আত্মজ্ঞান লাভের প্রধান বাধা। কেননা, ওই সব কামনাবাসনাই মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে তাকে ব্ৰহ্মবিমুখ করে তোলে। ওইসব কামনাবাসনার ফলে মানুষের মনে বিক্ষোভ ও মলিনতা জন্মায়। অমন বিক্ষিপ্ত ও মলিন মনে আত্মজ্ঞানের উদ্দীপক হয় না। সে তখন কামনা বাসনার বশ হয়ে বিষয় ভোগেই মত্ত হয়। ব্রহ্মকে-ভোগ করতে পারে না। ব্রহ্মকে ভোগ করতে হলে মন থেকে কামনা বাসনা রূপ বাধা দূর করতে হয়, তাদের উচ্ছেদ সাধন করতে হয়।

তারাকান্ত : আচ্ছা, ‘অমৃতত্ত্ব লাভ’ বলতে কি বোঝায়?

বাবা লোকনাথ : অমৃতত্ত্ব লাভ করার অর্থ হল সুখ-দুঃখ, দ্বন্দ্ব-বিরোধ, অজ্ঞান-মোহময় জীবন অতিক্রম করে আনন্দময়, অমৃতময় মুক্ত জীবন লাভ করা। জন্ম-মৃত্যুর অতীত হওয়া।

তারাকান্ত : বাবা, শাস্ত্রে পড়েছি জীবাত্মা ও পরমাত্মা মাত্রই একত্র যুক্ত হয়ে থাকেন। কেউই কাউকে ছেড়ে থাকেন না। জীব সর্বদাই ঈশ্বরের আশ্রয়ে থাকেন। ঈশ্বরও সর্বদা জীবের সাথে যুক্ত হয়ে আছেন। যদি তাই হয়, তাহলে জীব কেন সুখ-দুঃখ ভোগ করে?

বাবা লোকনাথ : শোন্ জীবের দেহ যেন একটি বৃক্ষ। বৃক্ষ যেমন অল্পদিনেই বিনষ্ট হয়, তেমনই দেহেরও অচিরেই বিনাশ ঘটে। সাধারণতঃ বৃক্ষে পাখিরাই বাস করে। জীবের দেহবৃক্ষে জীবাত্মা ও পরমাত্মা দুটি পক্ষী বাস করছেন। জীব ও ঈশ্বর দুজনেই দুজনের সখা। দুইজনেই এক দেহে বৃক্ষকে আলিঙ্গন করে বাস করছেন।

তারাকান্ত : বাবা ব্রহ্মজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যিনি তার স্বরূপ বলল।

 বাবা লোকনাথ : যিনি নীতিবাদী, আত্মক্রীড়, আত্মরতি, ক্রিয়াবান ও ব্রহ্মনিষ্ঠ, তিনিই সকল ব্রহ্মজ্ঞানীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

তারাকান্ত : বাবা, হৃদয় শ্বেতপদ্মে প্রকাশমান শুদ্ধ জ্যোতির্ময় সেই আত্মাকে কি উপায়ে লাভ করা যায়?

বাবা লোকনাথ : সেই আত্মাকে সত্যনিষ্ঠ, তপস্যা, নিত্য ব্রহ্মচর্য ও সম্যক জ্ঞান দ্বারা লাভ করা যায়।

তারাকান্ত : সত্যনিষ্ঠ বলতে কি বোঝায়?

 বাবা লোকনাথ : সত্যনিষ্ঠ কথাটির অর্থ ধরতে হবে সত্যের উপলব্ধি ও অনুষ্ঠান। মিথ্যাজ্ঞানী ও মিথ্যাচারী ব্যক্তি আত্মাকে লাভ করতে পারে না। সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যা কখনও জয়লাভ করতে পারে না।

তারাকান্ত : তপস্যা বলতে কি বোঝাচ্ছে?

বাবা লোকনাথ : এখানে তপস্যা বলতে বোঝাচ্ছে ইন্দ্রিয় সংযম করে একাগ্রমনে পরমাত্মার ধ্যান। পরমাত্মাকে মনন, চিন্তন ও আরাধনা। তপস্যাই সবকিছুর মূল। তপোনুষ্ঠান না করলে কখনও উৎকৃষ্ট ফল ভোগ করা যায় না।

প্রজাপতি ব্রহ্মা তপস্যার প্রভাবেই এইসব কিছু সৃষ্টি করেছেন। মহর্ষিগণ তপোবলে বেদ সকল অধিকার করেন। পৃথিবীর মধ্যে যে বস্তু নিতান্ত দুর্লভ, তপোবলে তাও অধিকার করা যায়। প্রাচীনকালে মহর্ষিগণ যে সকল দুর্লভ ঐশ্বর্য লাভ করেছিলেন, তপস্যাই তার কারণ। ঋষিগণ, পিতৃগণ, দেবগণ ও মানুষ তপস্যার প্রভাবেই সিদ্ধিলাভ করে থাকেন। তপস্যার প্রভাবেই দেবগণ মহত্ব লাভ করেছেন। তপস্যার প্রভাবে অন্যান্য আকাঙ্ক্ষিত ফলের কথা দূরে থাক, দেবত্ব পর্যন্ত অধিকার করা যেতে পারে। তপস্যার প্রভাবে নানা পাপ থেকে বিমুক্ত হওয়া যায়। কঠিন সাধনা দ্বারা আত্মজ্ঞান বা স্বর্গাদিলাভের প্রচেষ্টায় তপস্যা। তপস্যার মূল অর্থ হলো-ইন্দ্রিয় সংযত করে একাগ্রচিত্তে পরমাত্মার মনন, চিন্তন, ধ্যান আরাধনা করা। ইহলোকে অনশনের মতো উৎকৃষ্ট তপস্যা আর কিছু নেই। মহাত্মা ভগীরথ দেহান্তে দেবলোক, গোলক ও ঋষিলোক অতিক্রম করে ব্রহ্মলোক লাভ করেছিলেন ওই অনশন তপস্যায়। তপোনুষ্ঠানের মধ্যে অনশন অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সংযত করে উপবাসই শ্রেষ্ঠ। ব্রহ্মচর্য পালনকালে গুরুদেবের নির্দেশে আমাকে নক্তব্ৰত, একান্তরা, ত্রিরাত্র, পঞ্চাহ, নবরাত্র, দ্বাদশাহ, মাসাহ, উপবাসব্রত পালন করতে হয়েছিল। মাসাহ ব্রত পালন সাধারণ লোকের কাছে সত্যিই অবাস্তব ও কাল্পনিক কাহিনী বলেই মনে হবে। কেননা, একজন মানুষ কি করে এক বিন্দু জলগ্রহণ না করে একমাস জীবিত থাকতে পারেন! জানিস, আমি দুবার মাসাহ ব্রত পালন করে সিদ্ধ হয়েছি।

তারাকান্ত : নিত্য ব্রহ্মচর্য–এই কথার অর্থ কি?

বাবা লোকনাথ : সকল সময়ে ব্রহ্মচর্য পালন অর্থাৎ অবিচ্ছিন্ন ইন্দ্রিয় সংযমই হল নিত্য ব্রহ্মচর্য।

তারাকান্ত : সম্যক জ্ঞান কি?

বাবা লোকনাথ :সম্যক জ্ঞান হল পরমাত্মার যথার্থ জ্ঞান। সে জ্ঞান পরমাত্মার সাক্ষাৎ দর্শন থেকেই লাভ করা যায়।

তারাকান্ত : বাবা, তুমি তো ব্রহ্মভূত। তুমি তো পূর্ণব্রহ্ম। তুমি তো আপ্তকাম। তোমার এই দেহ অবসানে তুমি কি আর জগতে ফিরে আসবে না?

বাবা লোকনাথ : আমি কি, তা আমি জানি না। এই দেহ অবসানের পর তোমাদের জন্য, আমার ভক্তদের ডাকে সাড়া দিয়ে আমায় তো আসতেই হবে।

ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবা লোকনাথের স্বরূপ জানতে পেরেছিলেন বলে তিনি বাবাকে কেবল একজন মহাযোগী ভাবতেন না। তিনি তার ব্রহ্মস্বরূপ জানার পর চমৎকৃত হয়ে বাবার সামনে বসে ভাবতে থাকেন যে তার সামনে স্বয়ং পরমেশ্বর অবস্থান করছেন। ব্রহ্মচারী বাবা বুঝতে পেরেছেন যে তারাকান্ত তার স্বরূপ ধরে ফেলেছেন। দুজনে একান্তে আশ্রমে উপবিষ্ট। হঠাৎ বাবা তারাকান্তকে বলেন–দীক্ষা গ্রহণ করবি?

তারাকান্ত : একথা আমার চেয়ে তুমিই বোঝ। অতএব আমাকে জিজ্ঞাসা করা অনাবশ্যক।

বাবা লোকনাথ : গুরু-শিষ্য সম্বন্ধ স্থাপনের গুরুত্ব বোধহয় জান না; এ সম্বন্ধ চিরস্থায়ী। আমি যদি মোক্ষলাভে সম্পূর্ণ যোগ্য হই, আর তুমি যদি তখন ততদূর প্রস্তুত না থাক, তবে যতদিন না তুমি আমার মতো যোগ্য হবে, ততকাল তোমার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। এইরূপ তুমি যদি আমার আগে মোক্ষদ্বারে উপনীত হও, আর আমি অন্যদিকে নিবিষ্ট থাকি, তবে তোমাকেও আমার আগমনের অপেক্ষায় তথায় বসে থাকতে হবে।

তারাকান্ত : না, তবে আমার দীক্ষাগ্রহণ করা উচিত নয়। তুমি বাল্যকাল থেকে কঠোর ব্রহ্মচর্য করেছ, এত কষ্ট স্বীকার করে, কত শীত সহ্য করে, কত সাধন ভজন করে কামরিপুকে জয় করেছ, মহাসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছ। আর আমি কি প্রকৃতির লোক, তা বিলক্ষণ দেখছি। তোমার বিরক্তির ভয়ে জামা, জুতো ছেড়েছি। কিন্তু এখনও বাবু রয়েছি। আমার সঙ্গে সম্বন্ধ করলে ক্ষতি, তুমি প্রস্তুত হয়েও কতকাল যে আমার অপেক্ষায় থাকতে বাধ্য হবে তার ইয়ত্তা নেই।

তারাকান্তের এই সরল উক্তির পরেই ব্রহ্মচারী বাবা তাকে দীক্ষা দিলেন এবং তারাকান্তর নতুন নাম হল ব্রহ্মানন্দ ভারতী। ব্রহ্মচারী বাবার দীক্ষাপ্রদান সম্পর্কে ব্রহ্মানন্দ ভারতী বলেছেন- ব্রহ্মচারী বাবা যে আমাকে দীক্ষা দিয়েছেন তা আর কিছুই নয়, গুরুমুখ নির্গত বিশেষ প্রকারের শ্রুতিবাক্য দ্বারা আত্মাকে শ্রবণ করা। আমাকে সেই দীক্ষা দিয়ে বললেন, গুরুবাক্য পেলে, এখন বেদান্ত বাক্যের সঙ্গে মিলাও। এর দ্বারা নিদিধ্যাসন পর্যন্ত করতে পারবে।

ব্রহ্মানন্দ ভারতী দীক্ষান্তে ব্রহ্মচারী বাবাকে বলেছিলেন–তুমি যে আমাকে এই অদ্ভুত দীক্ষাতে দীক্ষিত করলে, এটা পেলে কোথায়?

তার উত্তরে ব্রহ্মচারী বাবা বলেছিলেন–গুরু আমার উপনয়ন করেই এই দীক্ষা দানের সঙ্গে সঙ্গেই মনন করতে আদেশ করেছিলেন। এবং এর বলেই আমার দীর্ঘজীবন লাভ ঘটেছে। তিনি ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকেও প্রথমে মনন ও তারপরে নিদিধ্যাসন করার উপদেশ দেন। এখানে নিদিধ্যাসন কথার অর্থ হল সমাধিস্থ অবস্থায় আত্মাভিমুখ হয়ে স্থিরচিত্ত থাকা। বাবা এইসঙ্গে তাকে বিভিন্ন সাধন ক্রিয়ারও শিক্ষা দেন।

দীক্ষান্তে ব্রহ্মচারী বাবা ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বিভিন্ন যোগক্রিয়া সম্বন্ধে অবহিত করেন যার মধ্যে ছিল হঠযোগ, ষট্‌চক্রভেদ ক্রিয়া, শাম্ভবী বিদ্যা, সুষুম্ননাড়ীতে আত্মদর্শন পদ্ধতি, অজপা বিদ্যা ইত্যাদি।

ব্রহ্মানন্দ ভারতী বলেছেন যে অজপা বিদ্যা শেখার ও অভ্যাস করার পর তিনি সুষুম্না নাড়িতে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। এর সঙ্গে তিনি এ কথাও বলেছিলেন যে, তিনি ব্রহ্মচারী বাবার থেকে পেয়েছিলেন অন্তদৃষ্টি। তিনি আরও বলেছেন, ব্রহ্মচারী বাবা যখন অন্তদৃষ্টি অবলম্বন করতেন, তখন বাইরে তার নিশ্চল ভাব দেখা যেত। তিনি যখন আলগ হতেন অর্থাৎ আপনার দেহাতীত সত্তা অনুভব করতেন তখন সাধারণের দৃষ্টির অগোচর অনেক বিষয় দর্শন করে আসতেন।

অন্তদৃষ্টি শিক্ষালাভ সম্বন্ধে তিনি বলেছেন–আমি তাহার নিকট হতে অন্তদৃষ্টিতে প্রবেশ করার বিষয় শিক্ষালাভ করেছি ও কিয়ৎ পরিমাণে কৃতকার্য হয়েছি বলতে পারি। তাঁহার অন্তদৃষ্টি যাহা আমার অন্তদৃষ্টি যে তাহাই, এমন মনে করতে হবে না। এই অন্তদৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্বন্ধে তিনি বলেছেন–হৃদয় নামক দেহমধ্যস্থিত জংশন বিশেষে একশত একটি চলন পথের সন্ধি আছে। ওই এক-একটি পথের নাম এক-একটি নাড়ি। ওই সকল নাড়ির অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নাড়ি রয়েছে। যারা উহার কোনো একটি নাড়িতে অন্তঃকরণ প্রবেশ করাতে পারেন, তাদের অন্তদৃষ্টি লাভ হয়েছে বলা যায়। যে নাড়িগুলি হৃদয়াঞ্চল থেকে মেরুদণ্ডে বাহিত হয়েছে তার মধ্যে একটি নাড়ির মাহাত্ম্য সর্বাপেক্ষা অধিক। সেই নাড়ি যোগশাস্ত্রে সুষুম্না নাড়ি নামে কীর্তিত। তা আমাদের দেহ থেকে আরম্ভ করে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে সূর্য পর্যন্ত প্রসারিত আছে। পরে উনি বলেছেন যে অজপা বিদ্যার সঙ্গে উনি অন্তদৃষ্টি প্রয়োগ করে সুষুম্না নাড়ির অন্তর্গত তেজ জ্যোতি দর্শন করেছেন। এই সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, গুরুদেব আমাকে দীক্ষা দেওয়ার সময় অজপা বিদ্যার স্বরূপ ব্যাখ্যা করে দিলেন। এরপর আমার সাধন চলতে থাকল এবং গুরুর আদেশমতো লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম। কালে আমি ওই জংশনে পৌঁছতে পারলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, বিদ্যুন্ময়ী কোনো জ্বলন্তশক্তি উদ্ধোভাবে আমার দেহাভ্যন্তরে সতত সঞ্চারমানা থেকে দেহ রক্ষা করছেন। তার যাতায়াত দ্বারা শরীরের অভ্যন্তরস্থ যন্ত্রগুলি আপনা আপনি পরিচালিত হচ্ছে। এটাকেই শ্রম আদি বায়ুকর্তৃক দেহপোষণ ব্যাপার সাধিত হচ্ছে বলা যায়। ওই শক্তির যাতায়াত রেখাপথকে আমি স্নায়ু বুঝে থাকি এবং তাই আমার অন্তদৃষ্টির স্থল। অজপা দ্বারা অন্তঃকরণকে বহিব্যাপার থেকে প্রত্যাহৃত করে কেন্দ্রীভূত করা যায়। তখন মন নিজের করায়ত্ত রয়েছে বুঝতে হয়। গুরুদেবের বিশেষ উপদেশ দ্বারা কেন্দ্রীভূত অন্তঃকরণকে এমনভাবে নিয়োগ করতে হয়েছিল যে, পরিণামে দেখলাম, আমি সেই উপদেশ পালনে বিদ্যুন্ময়ী সেই জ্বলন্তশক্তির নিকট উপস্থিত হতে পেরেছি। গুরুর এই বিশেষ উপদেশ আমার চালক না হলে আমার সেই আয়ত্ত অন্তঃকরণকে আমি কোনদিকে যে চালাতাম বলা যায় না। হৃদয়স্থ নাড়িতে প্রবেশ করা বিশেষ দৈবানুগ্রহ ভিন্ন সম্ভব হয় না। যে-সকল সাধকের হৃদয়ে এই বিদ্যা সাধনের বীজ নিহিত রয়েছে, তারা অন্যান্য সাধকের কৃতকার্যতার বিষয় অবগত হলে স্বতঃই অজপা সাধনের জন্য ব্যাকুল না হয়ে পারবেন না। সেরূপ উত্তেজনা জন্মিলে গুরুভক্তির প্রভাবে সাধকের অন্তঃকরণ বিশেষভাবে সংস্কৃত হতে থাকে এবং গুরুর কৃপায় সাধকের উপযুক্ত পথপ্রদর্শক আপনা থেকে জুটে যায়।

বাবা লোকনাথের ব্রহ্মানন্দ ভারতীর উপর কি পরিমাণ স্নেহবাৎসল্য ছিল, এই ঘটনার থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি তাঁকে কেবল দীক্ষাই দেননি, মোক্ষের এক অতি উত্তম ও গুহ্য পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে তাঁর শিষ্য অতি কম আয়াসে মোক্ষ লাভের পথে যেতে পারেন। এই বিদ্যা একটি বিরল বিদ্যা। এবং অন্তদৃষ্টি প্রদান গুরুর সর্বশ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। অন্তদৃষ্টি না থাকলে অজপা সাধনায় সফল হওয়া যায় না।

অজপা সাধনা সম্বন্ধে নমর্দা পরিক্রমাকালে আমার একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে, যা এখানে উল্লেখযোগ্য। নর্মদা পরিক্রমার আগের দিন অমরকন্টকের মার্কণ্ডেয় আশ্রমের পীঠাধীশ ব্রহ্মর্ষি শ্রীমৎ স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজি মহারাজ আমাদের দীক্ষা প্রদান করেন। খুব হঠাৎ করেই তিনি দীক্ষা দিয়ে আমাদের আশীর্বাদ করে বলেন, মহর্ষি মার্কণ্ডেয় আশ্রমের যে বৃক্ষের নিচে তপস্যা করতেন, সেখানে গিয়ে জপ করতে। আমি সেখানে গিয়ে সদ্য প্রাপ্ত ইষ্ট মন্ত্রের জপ করতে থাকি। জপে যখন আমি নিবিষ্ট, হঠাৎ আমার আজ্ঞাচক্রে এক জ্বলন্ত সূর্যের ন্যায় চক্রদর্শন করি এবং পরে ধীরে ধীরে সেই উজ্জ্বল চক্ৰমধ্যে একটি বড় চক্ষু দর্শন করি যেটা আমার দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ। আমি যখন এইরূপ স্পষ্ট দর্শন করছি, তখন কিন্তু আমার চক্ষু বন্ধ। আমি যদিও খুব আশ্চর্য হয়ে যাই কিন্তু জপ করে যেতে থাকি। চক্ষুও আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অবস্থান করে। এইভাবে কিছু সময় গত হলে আমার মনে হঠাৎ খুব ভয় হয়। আমি চক্ষু উন্মোচন করে ফেলি। তখন প্রথমে আমার সামনে কেবল অন্ধকার দৃষ্ট হয় এবং পরে স্বাভাবিক হয়ে আসে। আমি গুরুদেবের কাছে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করি। গুরুদেব বলেন, তুমি মার্কণ্ডেয় মুনির আশীর্বাদ পেয়ে গেছ, আমি তোমায় অন্তঃকরণ থেকে আশীর্বাদ করছি, তুমি এবার পরিক্রমায় বেরিয়ে যাও, তুমি সফল হবে। এখন থেকেই তোমার তপস্যা শুরু হলো।

এরপর পরিক্রমায় রাত্রিবেলা আমি একটি মন্ত্রকে, অজপা সাধনায় আমার লিঙ্গ শরীরের কাছে (জীবাত্মা) প্রেরণ করি এবং সেই মন্ত্র সারারাত্রি আমার মধ্যে হতে থাকে। আমার formally অজপা বিদ্যা সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান ছিল না। পরমেশ্বরের কৃপায় আমি রাত্রিকালে ও নর্মদা আরতীর স, দৃষ্টিকে ভিতরে প্রেরণ করে অজপা সাধনা করেছি এবং অনেক সময় আজ্ঞাচক্রে এক জ্বলন্ত চক্রের দর্শন পেয়েছি। এটা যে একটি গুহ্য সাধন প্রক্রিয়া, সেটা বুঝতে পেরেছি। দৈব অনুগ্রহ ভিন্ন যে এই সাধন প্রক্রিয়া আয়ত্ত করা যায় না এবং এর ফল পাওয়া যায় না, এ কথা ধ্রুব সত্য। নর্মদা পরিক্রমাকালে গুরুদেবের আশীর্বাদ, মহর্ষি মার্কণ্ডেয় ও বাবা লোকনাথের আশীর্বাদ এবং নর্মদা মাতা ও শিবশম্ভুর কৃপা আমি পদে পদে পেয়েছি। সেজন্য ব্রহ্মানন্দ ভারতীর এই অনুভূতি যে ঈশ্বরানুগ্রহ ব্যতীত অজপা সাধনায় সফল হওয়া যায় না, এ কথার যথার্থতা আমি স্বীকার করি। আমাকে এখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে।

ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবা লোকনাথের বিশেষ কৃপালাভে সমর্থ হয়েছিলেন কেননা তিনি তাঁর পূর্ণব্রহ্মরূপ ও সত্ত্ব জানতে পেরেছিলেন। বাবা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উপায়ও ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বলে দিয়েছিলেন এবং তিনি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ব্রহ্মজ্ঞানের নিদর্শনও পেয়েছিলেন। বাবা লোকনাথ মরদেহ ত্যাগ করার পর ব্রহ্মানন্দ ভারতী লোকনাথ মাহাত্ম্য প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। দয়াগঞ্জে লোকনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠায় তার প্রত্যক্ষ মদত ছিল। ব্রহ্মানন্দ ভারতীর সঙ্গে বাবা লোকনাথের প্রশ্নোত্তর ও ভাব বিনিময়ে সাধকদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। এমনকি গৃহাশ্রমে থেকে যারা সাধনকর্মে রত আছেন, তারাও এই কথোপকথনের দ্বারা বিশেষভাবে উপকৃত হবেন। বাবা লোকনাথের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর সাধকদের কাছে এক অমূল্য আধ্যাত্মিক সম্পদ। বাবা ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে যে সব যোগানুষ্ঠানের কথা বলেছেন, তার থেকে বোঝা যায় যে যোগসাধনার সকল গুহ্য অঙ্গগুলি অতিক্রম করেই তিনি ব্রহ্মজ্ঞ হতে পেরেছিলেন। আর একথাও বোঝা যায় যে, যারা এত দীর্ঘ যোগপথ অতিক্রম করতে পারেন, তারাও ঈশ্বরানুগ্রহে বা বাবা লোকনাথের কৃপায় সাধন পথে সফল হতে পারেন। ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবার সঙ্গে তার বার্তালাপ ডায়েরিতে সযত্নে লিখে রেখেছিলেন বলে, আজ বাবার ভক্তগণ সেইসব কথা জানতে পারছেন। অনেক কথা যা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, তা বারদী আশ্রম থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে।

.

ডাক্তার নিশিকান্ত বসু

ডাক্তার নিশিকান্ত বসুর জন্ম হয় আসামের তেজপুর শহরে ১৮৮০ সনে। তার পিতা শ্রীরজনীকান্ত বসু তেজপুরের ডেপুটি কমিশনার অফিসে চাকরি করতেন। তাঁরা আট ভাইবোন ছিলেন। তাদের পূর্বপুরুষদের আদি বসতি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। পরে তারা স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকা জেলার অন্তর্গত বারদী গ্রামে বসবাস করতে থাকেন বলে জানা যায়। নিশিকান্ত বসু ছাত্র হিসাবে খুবই মেধাবী ছিলেন। যখন তার বয়স ১৪ বছর, তখন তাঁর পিতা তেজপুর থেকে ধুবড়িতে ডেপুটি কমিশনার অফিসের সেরেস্তাদার রূপে বদলি হন। সেই অফিসের এক কর্মচারীর নাম ছিল শ্রীবসন্তকুমার মজুমদার। তাঁর স্ত্রী ছিলেন বারদীর শশীভূষণ নাগের ভগিনী। নিশিকান্তবাবু বালক বয়সে তাদের কাছে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার কথা শোনেন এবং তার মনে লোকনাথ বাবার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়। তিনি তখনও বাবাকে দর্শন করেননি।

প্রাথমিক শিক্ষার পরে নিশিকান্ত বসু ডাক্তারি পাশ করেন এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা যান। সেখানে তিনি এম.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। আমেরিকায় এম.ডি. পাশ করার পর তিনি একটি স্যানেটোরিয়ামে চাকরি জীবন শুরু করেন। একদিন সেখানে এক অলৌকিক ঘটনায় তিনি প্রথম তার উপর লোকনাথ বাবার আশীর্বাদ উপলব্ধি করেন।

স্যানেটোরিয়ামে একজন ৩০ বছর বয়স্ক মহিলা পেটের টিউমারের চিকিৎসার জন্য আসেন। সেখানে চিকিৎসায় তাঁর কোনো উন্নতি না হওয়ায় একদিন নিশিকান্ত বসুকে একা পেয়ে সেই মহিলা তার কাছে এসে বলেন, ডাক্তার বোস, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। এতদিন তোমাদের এখানে চিকিৎসা করেও আমার কোনো উপকার হল না। এখন বলো, আমি কি করবো! নিশিকান্ত বাবু রোগিনীকে কিছু বলতে যাবেন এমন সময়ে সেই রোগিনী বলে উঠলেন, ডাক্তার বোস, আমি তোমার মাথার পিছনে একজনকে দেখতে পাচ্ছি। তার চুলগুলি মাথার উপর জড়ানো, তার মুখমণ্ডল দাড়ি-গোঁফে আচ্ছাদিত। তার মুখ আমার দিকে, কিন্তু চক্ষু অন্যদিকে। তার পরনে একখানি সাদা কাপড় ডান হাতের নিচ দিয়ে শরীর আবৃত করে বাম কাঁধের উপর দেওয়া আছে। তুমি জানো ইনি কে? ইনি নিশ্চয়ই তোমার Spiritual guide. নিশিকান্তবাবু মহিলার মুখের কথা শুনে চুপ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। যে বিবরণ তিনি শুনলেন, সেই বিবরণই তিনি শুনেছিলেন বসন্তকুমার মজুমদারের স্ত্রীর কাছে। এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই বারদীর বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। সূক্ষ্মদেহে এখানে তার কাছে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি অবাক বিস্ময়ে ভাবতে লাগলেন যে যাঁকে তিনি এখনও দর্শন করেননি, কেবল তার কথা শুনে অন্তরে তার জন্য গভীর ভক্তি, শ্রদ্ধা নিয়ে অপেক্ষা করছেন কবে বারদী গিয়ে তাঁর দর্শন করবেন, তিনি এত করুণাময় যে ভক্তের অন্তরের কথা জেনে সুদূর আমেরিকাতে সূক্ষ্মদেহে উপস্থিত হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করছেন। বাবার এই অযাচিত কৃপায় তিনি নিজেকে ধন্য মনে করলেন। তিনি একটি কাগজে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর নাম লিখে সেই মহিলাকে দিয়ে বললেন, তুমি সর্বদা এই নাম স্মরণ করবে আর কোনো হাসপাতালে গিয়ে তোমার টিউমার অপারেশন করাবে। তুমি ভালো হয়ে যাবে। এই কথা বলে তিনি স্যানেটোরিয়ামের একজন নার্সকে দিয়ে রোগিনীকে অন্য একটি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে সেই রোগিনীর অপারেশন হল এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন।

এই ঘটনার কিছু পরে নিশিকান্ত বসুর শিকাগো শহরের চেম্বারে ঘটলো অনুরূপ একটি অলৌকিক ঘটনা। একদিন একজন সম্ভ্রান্ত মার্কিন মহিলা শূলরোগে আক্রান্ত হয়ে তার চেম্বারে এলেন। তিনি এসে বললেন, আমি অনেকদিন ধরে শূল রোগে আক্রান্ত। পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে এতদিন আমি অনেক চিকিৎসা করেছি, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। আমি ভারতীয় প্রাচীন পদ্ধতিতে আমার রোগের চিকিৎসা করাতে চাই। সেইজন্য আপনার কাছে এসেছি। ভারতীয় প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির উপর আমার অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আছে। ভারতবর্ষ অলৌকিক যোগশক্তির দেশ। আপনি সেই যোগশক্তি সম্বলিত চিকিৎসা আমার জন্য করুন।

নিশিকান্তবাবু মার্কিন মহিলার কথা শুনে অবাক। তিনি তাকে বললেন, আমি ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকায় এসে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেছি। আমি এখানে সেই পাশ্চাত্য চিকিৎসার পেশায় যুক্ত আছি। ভারতীয় প্রাচীন চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে আমার জ্ঞান অতি সামান্য। আর ভারতীয় যোগশক্তি সম্বন্ধে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। আমি কি করে যোগশক্তি দ্বারা আপনার চিকিৎসা করব? এইভাবে যখন নিশিকান্ত বসু ও তার রোগিণীর মধ্যে বার্তালাপ চলছে, সেই সময় হঠাৎ সেই মহিলা চিৎকার করে বলে উঠলেন, well doc tor, who is there? who is behind you? আপনার পিছনে একজন দীর্ঘকায় জটাধারী মহাযোগী দাঁড়িয়ে আছেন। তার দেহে কোনো মাংস নেই। কিন্তু তার দেহের চর্মাবৃত অস্থিরাশি অপূর্ব প্রদীপ্ত। তাঁর শরীরে লোহিতবর্ণ তিলচিহ্ন আছে। তার পলকহীন নয়নযুগল স্থির হয়ে আছে। মহিলার এই কথা শুনে নিশিকান্তবাবু বললেন, আপনি শান্ত হোন। এমন পাগলামি করছেন কেন? আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

তখন মহিলা বললেন, আমি পাগল নই। এই দেখুন আমি তার থেকে ওষুধ পেয়ে গেছি। এই যোগী আমার হাতে এই ওষুধ দিয়ে বললেন, এটা খেয়ে নে। তোর রোগ সেরে যাবে। মহিলা রোগিনী তার হাত খুলে যে ওষুধটি দেখালেন, সেটা একটি ফুলের পাপড়ি। সেই পাপড়ি এক অতীব মধুর গন্ধবিশিষ্ট। মহিলা রোগিনী সেই ওষুধ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে চলে গেলেন। তারপর বাড়ি গিয়ে অতি ভক্তির সঙ্গে সেই দিব্যগন্ধযুক্ত ফুলের পাপড়ি খেলেন ও কিছুদিনের মধ্যে চিরতরে শূলরোগ মুক্ত হয়ে গেলেন। এরপর সেই মার্কিন মহিলা ভারতবর্ষ থেকে লোকনাথ বাবার একটি ছবি সংগ্রহ করেন এবং তার ঘরে টাঙিয়ে রাখেন। নিত্য তিনি সেই চিত্রে ভক্তিশ্রদ্ধা অর্পণ করতেন। ব্রহ্মচারী বাবার এই অযাচিত কৃপা নিশিকান্ত বসুর মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করল। তার মন অশান্ত হয়ে উঠল বারদীর ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করার জন্য। তিনি আমেরিকা থেকে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে এসে বারদীর পূর্বপুরুষের ভিটায় গেলেন।

নিশিকান্ত বসু ছিলেন বারদীর অরুণকান্তি নাগ মহাশয়ের আত্মীয়। তিনি জানতেন যে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার অশেষ কৃপা আছে এই অরুণকান্তি নাগ মহাশয়ের উপর। তিনি বারদী পৌঁছে নাগবাড়িতে গিয়ে অরুণকান্তি নাগ মহাশয়ের সঙ্গে দেখা করে বারদীর ব্রহ্মচারী বাবার দর্শনের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন। জমিদার অরুণকান্তি নাগ নিশিকান্ত বসুকে নিয়ে আশ্রমে গেলেন। আশ্রমে এসে বাবার আসন ঘরে বাবাকে দর্শন করেই চমকে উঠলেন নিশিকান্তবাবু। মহিলা বর্ণিত সেই দীর্ঘদেহী জটাজুটধারী, মুখে শ্বেত শ্মশ্রু, দেহে লোহিতবর্ণ তিল, চক্ষু পলকহীন মহাযোগী এখন তার সামনে গোমুখাসনে উপবিষ্ট। তার দেহে কোনো মাংস আছে বলে বোঝা যায় না। চর্মাবৃত অস্থিরাশি উজ্জ্বল প্রদীপ্ত। এই তো সেই মহাপুরুষ যাঁকে দর্শন করে ধন্য হয়েছেন তার দুই রোগিনী সুদূর আমেরিকায়। সত্যই ধন্য সেই দুই রমণী। তারা যাঁর দর্শন সেই সুদূর আমেরিকায় পেয়েছেন, তিনি ভারতীয় হয়ে আজ তার দর্শন পেলেন। নিশিকান্ত বাবু বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করে তার আমেরিকার অভিজ্ঞতা স্মরণ করছিলেন। জমিদার মহাশয় তাঁকে ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করতে দেখে বললেন, ‘কি বলছ? কি হয়েছে?’ তখন নিশিকান্ত বাবু আমেরিকায় ঘটা ঘটনার বিবরণ তাকে শোনান। তখন জমিদার অরুণকান্তি নাগ তাঁকে বললেন, ব্রহ্মচারী বাবার মনের গতি সর্বত্র। তাঁর মন যেখানে যায়, তার সূক্ষ্মশরীরও সেখানে পৌঁছে যায়। ব্রহ্মচারী বাবা হচ্ছেন একজন মহা অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষ। নিশিকান্তবাবু বুঝতে পারলেন যে, কোনো কারণে তিনি বাবার অহৈতুকী কৃপা লাভ করছেন। তার রোগীদের চিকিৎসাক্ষেত্রে তিনি বাবার আশীর্বাদ পাচ্ছেন। কিন্তু কেন তিনি এই আশীর্বাদ বা কৃপালাভ করছেন, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

নিশিকান্ত বসুর মাতা ছিলেন বারদীর বড় জমিদার কালীকিশোর নাগ মহাশয়ের কনিষ্ঠা কন্যা। লোকনাথ বাবার পরমভক্ত জমিদার অরুণকান্তি নাগ সেই সূত্রে তার আত্মীয়। বাবা লোকনাথের এই জমিদার বাড়ির উপরে বিশেষ কৃপা আছে। নিশিকান্ত বসুর মনে ব্রহ্মচারী বাবার কথা শুনে বালক বয়সেই ভক্তিশ্রদ্ধা জাগ্রত হয়েছিল। যদিও তার দর্শন লাভের সুযোগ পূর্বে হয়নি। কিন্তু তিনি মনে মনে বাবাকে পূজা করতেন ও তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। নিশিকান্ত বসুর উপর বাবার এই অহৈতুকী কৃপা আবার প্রমাণ করে যে ভক্তিযুক্ত মনে যে বাবাকে স্মরণ করে বা মনে মনে পূজা করে, সে বাবার কৃপালাভ করে। বাবাকে দর্শন করার পর নিশিকান্ত বসুর মনে বাসনা জাগে তার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করার। কিন্তু সেদিন তিনি এই কথা বাবাকে নিজমুখে বলতে পারেননি।

এরপর আবার আমেরিকাতে ফিরে গেলেও তার মন পড়ে থাকে বারদীতে। তিন বছর আমেরিকায় ডাক্তারি পেশায় নিযুক্ত থাকার পর তিনি ভারতবর্ষে ফিরে আসেন ও তার ডাক্তারি বিদ্যার দ্বারা মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ক্রমে ক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন বাবা লোকনাথের এক পরমভক্ত এবং অতি বিশ্বস্ত কৃপাধন্য সন্তান।

ভারতবর্ষে ফিরে তিনি একবার ধানবাদে তার ভাইয়ের বাড়ি যান। সেখানে কিছুদিন বসবাসকালে তার আলাপ হয় পণ্ডিত রামচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয়ের সঙ্গে। শাস্ত্রী মহাশয় বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন। নিশিকান্ত বসু তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক আলোচনা করে তার কাছেই দীক্ষা নিতে মনস্থ করেন। রামচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় তাকে দুই অক্ষরের মন্ত্র দান করে দিনে তিনবার সেই মন্ত্র জপ করতে বলেন। নিশিকান্ত বাবু গুরুদেবের নির্দেশমতো প্রতিদিন ভোর চারটে, দুপুরে স্নানের পর এবং রাত্রে শোবার সময় জপ ধ্যান করতে থাকেন। জপ করার সময় তিনি গুরুদেব প্রদত্ত মন্ত্রের সঙ্গে লোকনাথ বাবার নাম জুড়ে দেন। এইভাবে নিরন্তর জপ করতে করতে ইষ্টদেবের সঙ্গে লোকনাথ বাবার নাম যুক্ত হয়ে তার মনে ঈষ্টদেব ও লোকনাথ বাবা অভিন্ন হয়ে যান। নিয়মিত তিনবার ভিন্নও তিনি সারাদিন শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এই জপ অভ্যাস করতে থাকেন এবং এক বছর অনুরূপ অভ্যাস করার পর তিনি তার শরীরাভ্যন্তরে এক অনাহত নাদ শুনতে পান।

আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর বারদীর জমিদার নিশিকান্ত বসুকে একটি চিকিৎসালয় করে দেন। তিনি চিকিৎসালয়ে রোগীদের চিকিৎসা করে কোনো পয়সা নিতেন না। গরিব দুঃস্থদের সেবাকাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার কাছে চিকিৎসা করে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে রোগী মুক্ত হয়ে যেত।

একবার এক রোগী তার দূষিত রোগের চিকিৎসার জন্য নিশিকান্ত বাবুর কাছে আসে। সে পুলিশে চাকরি করত। কিছুদিন চিকিৎসা করার পর সে ডাক্তারকে বলে যে তার চিকিৎসায় কিছু ভুল হচ্ছে। সে তার নামে মামলা করবে। তরে যদি তার চিকিৎসা নির্ভুল প্রমাণিত হয়, তবে সে ডাক্তারকে টাকা দেবে। মামলার কথা শুনে নিশিকান্তবাবু একটু ভীত হয়ে গেলেন। তিনি লোকনাথ বাবাকে ডাকতে লাগলেন। সারারাত্রি তিনি একনিষ্ঠ চিত্তে লোকনাথ বাবাকে স্মরণ করতে লাগলেন। একসময় এক অপার্থিব দিব্যগন্ধে তার ঘর ভরে উঠল। তিনি চমকে উঠলেন। তার মনে হল বাবা লোকনাথ সূক্ষ্মদেহে তার কাছে এসেছেন। তিনি তার উপস্থিতি সেই দিব্যগন্ধের মধ্যে দিয়ে টের পাচ্ছেন কিন্তু তাকে চোখে দেখতে পাচ্ছেন না।

পরের দিন সেই পুলিশ রোগী একজন সাহেব ডাক্তারের কাছে নিজের রোগ পরীক্ষা করে এসে জানিয়ে গেল যে নিশিকান্ত বসুর চিকিৎসা সঠিক। সে নিশিকান্ত বসুর চিকিৎসাতেই পরে আরোগ্য লাভ করেছিল। যদিও সে তাকে প্রতিশ্রুতিমতো কোনো টাকা দেয়নি।

নিশিকান্তবাবুর বড়দার জামাতা প্রফুল্লচন্দ্র দে ছিলেন একজন ইনকামট্যাক্স অফিসার। তিনি ফুসফুসের একটি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কলকাতার অনেক বড়ো ডাক্তারেরা তাকে যক্ষার চিকিৎসা করেন কিন্তু তিনি ক্রমে দুর্বল হয়ে হাড়চামড়া সার হয়ে ওঠেন। সেই সময় কলকাতার একজন ডাক্তার তাকে টিবির চিকিৎসার জন্য একটি স্যানেটোরিয়ামে পাঠিয়ে দিলেন। স্যানেটোরিয়ামের ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে বলেন যে রোগী ফুসফুসে একটি ফেঁড়ায় আক্রান্ত। সে টি.বি. রোগী নয়। তখন রোগীকে আবার কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হলো। কলকাতার ডাক্তারেরা রোগীর চিকিৎসা নতুন করে শুরু করলেন কিন্তু রোগ উপশমের কিছু লক্ষ্মণ দেখা গেল না। এমন সময় নিশিকান্ত বসু বারদী থেকে কলকাতায় এলেন এবং রোগী দেখলেন। রোগীকে দেখে তিনি একটি ওষুধের নাম লিখে দিলেন ও বাড়ির লোকদের বললেন, চিকিৎসকদের ওই ওষুধের নামটি দিয়ে দিতে। কিন্তু বাড়ির লোক ভাবলো কলকাতার এত বড়ো বড়ো ডাক্তারের ওষুধে কিছু ফল হচ্ছে না, নিশিকান্তবাবুর ওষুধে কি ফল হবে? তারা ডাক্তারকে ওষুধের নামটি ইচ্ছা করে দিলেন না। এদিকে রোগীর অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে লাগল। যখন রোগীর অন্তিম সময় উপস্থিত হলো, তখন প্রফুল্লবাবুর স্ত্রী ও তার কাকা নিশিকান্তবাবুকে অনুরোধ করলেন একবার শেষ চেষ্টা করতে। জামাতার অকালমৃত্যুর কথা চিন্তা করে নিশিকান্তবাবু লোকনাথ বাবাকে স্মরণ করে একটি ওষুধের প্রেসক্রিপশন করে দিলেন। এরপর সেইমতো ওষুধ চলতে লাগল। অচিরেই রোগী সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। তখন কলকাতার ডাক্তার বললেন, এইটিই এই রোগের সঠিক ওষুধ। রোগী কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তার কর্মস্থলে যোগ দিলেন। নিশিকান্তবাবুকে পরিবারের লোকেরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গেলে তিনি বলেন যে বাবা লোকনাথের কৃপাতেই তিনি শেষ সময়ে ওই ওষুধটি প্রয়োগ করতে পেরেছেন। এটা তাঁর কৃতিত্ব নয়, এটা লোকনাথ বাবার কৃপা। এইভাবে অনেক ক্ষেত্রে নিশিকান্তবাবু দেখেছেন যে, কোনো কঠিন রোগের চিকিৎসাকালে তিনি বাবা লোকনাথের আশীর্বাদ অযাচিতভাবে পেয়েছেন।

বারদীর চৈতন্যনাগ মহাশয়ের স্ত্রী অনেক দিন ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগছিলেন। সেইসময় ম্যালেরিয়া জ্বরকে ভয়াবহ বলে গণ্য করা হতো। নিশিকান্তবাবু অনেক চিকিৎসা করেও রোগীকে সুস্থ করতে পারছিলেন না। একদিন রাতে রোগীর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হার্টের ক্রিয়া বন্ধ হবার উপক্রম হলো। নিশিকান্তবাবু তখন অনন্যোপায় হয়ে একমনে বাবা লোকনাথকে স্মরণ করতে থাকেন। তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাতে থাকেন রোগিনীকে কৃপা করার জন্য। সেইদিন রাতে রোগিনী তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় স্বপ্ন দেখেন সহসা লোকনাথ বাবা আশ্রম থেকে নেমে এসে তার মাথার কাছে খাটের উপর বসে বলেন, এই যে আমি এসেছি। তুই ভয় করিস কেন? লোকনাথ বাবার দিব্যস্পর্শে একজন নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী রোগী সকালে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল। অবাক কাণ্ড এই যে, পরদিন সেই চলৎশক্তিহীনা রোগী বিছানা থেকে নেমে হেঁটে বাবার আশ্রমে গিয়ে বাবাকে দর্শন করে পেট ভরে খিচুড়ি প্রসাদ খেলেন।

সেই রোগী এই ঘটনার কথা নিশিকান্তবাবুকে জানান। নিশিকান্তবাবু তাঁর ঘরে বসে যখন এই ঘটনার কথা তার ডায়েরিতে লিখছিলেন, তার ঘরটি একটি মিষ্ট দিব্যগন্ধে ভরে ওঠে। নিশিকান্ত বসু তাঁর প্রতি বাবার কৃপার প্রতিটি কথা তার ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন। বাবার সঙ্গে তার বার্তালাপের অংশও তিনি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। পরবর্তীকালে তার ডায়েরি থেকে নাগ পরিবারের লোকেরা এবং বারদীর আশ্রমের অন্যেরা সেইসব কথা জানতে পারেন। বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের পর এইসব অমর কথা বারদী আশ্রম, নাগ পরিবার ও অন্য ভক্তদের মাধ্যমে আপামর মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়ে।

একদিন কয়েকমাসের একটি শিশুকে চিকিৎসার জন্য নিশিকান্তবাবুর কাছে আনা হলো। শিশুটি জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত ছিল। তাকে ওষুধ দেওয়া সত্ত্বেও সে তারস্বরে কাঁদতে লাগল। ওষুধে কোনো ফল হচ্ছে না দেখে নিশিকান্তবাবু শিশুটিকে কোলে নিয়ে লোকনাথ বাবাকে স্মরণ করে হাঁটতে লাগলেন। শিশুটিকে কোলে নিয়ে তিনি একমনে লোকনাথ বাবার নাম জপ করছেন আর শিশুটি তার কোলে তারস্বরে চিৎকার করছে। নিশিকান্তবাবু লোকনাথ বাবার কাছে শিশুটির জন্য দয়া ভিক্ষা করলেন। এভাবে অনেকক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে তিনি এক জায়গায় বসে লোকনাথ বাবাকে ডেকে যেতে লাগলেন। হঠাৎ দেখা গেল শিশুটি কান্না থামিয়ে হাসছে, তার কাশিও আর নেই। জ্বরের উপশম হয়েছে। নিশিকান্ত বাবু লোকনাথ বাবার কৃপা নিজের হৃদয়ে উপলব্ধি করতে পারলেন।

নিশিকান্ত বসু লোকনাথ বাবার এত প্রত্যক্ষ কৃপা নিরন্তর পেয়েছেন যে লোকনাথ বাবাই তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছিল। লোকনাথ বাবার সঙ্গে তিনি নিজেকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন। তাঁর মনে একবার বাসনা জাগে যে বাবার মন্দিরে (ধ্যানঘরে) তিনি একা যদি বাবার পূজা করতে পারতেন! এই বাসনা মনে নিয়ে একদিন ভোরবেলায় তিনি স্নান করে বারদী আশ্রমে গেলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন সঙ্গে পূজা করার জন্য কিছু ফুল নিয়ে যাবেন, কিন্তু যাবার সময় আর ফুল নেওয়া হল না। আশ্রমে গিয়ে তিনি দেখেন বাবার পূজা হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার সামনে অনেক ফুল এখনও আছে। বাবা তার ঘরে একা আছেন। যদিও কোনোদিন বাবাকে পূজা করার পর কোনো ফুল অবশিষ্ট থাকে না, কেননা যিনি সর্বশেষ পূজা করেন, তিনিই সব ফুল তার চরণে অর্পণ করে দেন। কিন্তু আজ অবশিষ্ট ফুল পড়ে থাকতে দেখে নিশিকান্তবাবু একটু অবাকই হলেন। তিনি মনে করলেন, এও তার উপর বাবার এক অহৈতুকী কৃপা। তিনি ঘরে ঢুকে মনের আনন্দে ফুল বেলপাতা দিয়ে ইচ্ছেমতো তাঁর পূজা করলেন ও অন্তরে এক পরম তৃপ্তি অনুভব করলেন। এরপর থেকে তিনি যখনই বারদীতে থাকতেন, প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় আশ্রমে গিয়ে বাবাকে দর্শন ও প্রণাম করে সচল শিব দর্শনের আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভব করতেন। বাবা লোকনাথ নিশিকান্তবাবুকে অনেক কথা বলতেন এবং বলতেন তার কথাগুলি সব ডায়েরিতে লিখে রাখতে। বোধহয় বাবার ইচ্ছা ছিল তার এইসব কথা ভবিষ্যতে যাতে ভক্তরা এই ডায়েরি মারফত জানতে পারেন। নিশিকান্তবাবু এই কথাও তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন যে, বাবা সচ্চিদানন্দ, সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ মহাপুরুষ। তিনি সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্ম, মহান থেকেও মহান এবং বিরাট থেকেও বিরাট। তিনি পরম মঙ্গলময়। তিনি সর্বদা ভক্তকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেন। তিনি বাবা লোকনাথের প্রচুর কৃপার নিদর্শন পেয়েছেন। অনেকগুলি ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, আবার এমন অসংখ্য কৃপাকথা লেখা হয়ে ওঠেনি। সেইসব কথা আর কোনো ভক্ত কোনোদিন জানতে পারবে না। নিশিকান্ত বসু তার সুদীর্ঘ জীবনে বাবার কৃপাকে ভগবৎ কৃপারূপেই গণ্য করেছেন। তাঁর শেষজীবনে দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি ব্যয় করতেন নিরন্তর জপ-ধ্যান ও বাবার স্মরণে মগ্ন থাকার জন্য। তিনি বৈষয়িক কর্ম ও চিন্তা ত্যাগ করে পরমেশ্বরে চিত্ত সমাহিত করে থাকতেন যাতে মৃত্যুকালে তার ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ হয়। বাবার চিন্তায় মগ্ন থাকতে থাকতে তার ভ্রুযুগলের মধ্যে উজ্জ্বল ওঁকার দৃষ্ট হতো। তিনি বারদীর ব্রহ্মচারী বাবাকে পরমেশ্বর জ্ঞানে পূজা করতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী হচ্ছেন ওঁ-কারের অংশভূত। সেই পরমপুরুষ যিনি বিশ্বের নিয়ন্তা, সৃজনকারী, পালনকারী ও সংহারকারী। অনন্য যোগ সাধনায় তিনি এই পার্থিব দেহকে ব্রহ্মচর্য পালনের দ্বারা দিব্যদেহে রূপান্তরিত করেছেন। তিনি হয়েছেন এমন একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী যাঁর দেহে সর্ব দেবদেবীর নিবাস প্রত্যক্ষ করা যায়। নিশিকান্ত বসু নিজেকে ধন্য মনে করেছেন যে তিনি এই পরমপুরুষের সান্নিধ্যে আসতে এবং তার অসীম কৃপা লাভ করতে সমর্থ হয়েছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, নিশিকান্ত বসু পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শ্রীজ্যোতি বসুর পিতা।

.

জানকী ব্রহ্মচারী

বারদীতে রামরতন চক্রবর্তী নামে একজন কবিরাজের বাস ছিল। একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ হিসাবে তিনি ওই গ্রামে সুপরিচিত ছিলেন। তাঁর একমাত্র পুত্রের নাম ছিল জানকীনাথ চক্রবর্তী। একমাত্র পুত্র হিসাবে অতিশয় স্নেহ ভালোবাসায় জানকীনাথ তার শৈশব, বাল্যকাল ও কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেন। এইসময় একবার জানকীনাথ কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়। সেইসময় বঙ্গদেশে কালাজ্বর মারাত্মক আকার নিয়েছিল। অনেক ডাক্তার-কবিরাজের চিকিৎসা সত্ত্বেও জানকীনাথের রোগের কোনো উপশম হয় না, বরং ক্রমে তা বেড়ে যায়। সে দীর্ঘদিন রোগে ভুগে শীর্ণকায় হয়ে প্রায় মৃতবৎ হয়ে যায়। রামরতন ও তার স্ত্রী একমাত্র সন্তানের এই করুণ দশায় পাগলপ্রায় হয়ে যান। হাজারো ডাক্তার ও চিকিৎসা যখন তার রোগ সারাতে ব্যর্থ, তখন রামরতন বাবা লোকনাথের কৃপার উপর ভরসা করে তাঁর কাছে ছেলেকে নিয়ে যান।

রামরতন ব্রহ্মচারী বাবার সামনে সন্তানের দেহ রেখে বলেন, বাবা, আমার একমাত্র প্রাণপ্রিয় সন্তানকে আপনিই রক্ষা করতে পারেন। আপনার কৃপা ভিন্ন আমার সন্তানের প্রাণরক্ষা সম্ভব নয়। তাই আপনার চরণে আমার সন্তানের প্রাণভিক্ষা চাই। আপনি আমার সন্তানকে রক্ষা করুন।

শরণাগত ভক্তবৎসল বাবা লোকনাথ রামরতন কবিরাজের সব কথা শুনে তাঁকে বললেন, ওকে আশ্রমে রেখে যা। রামরতন জানকীনাথকে বাবার চরণে রেখে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। তাঁর মনে এটুকু আশা হল যে ব্রহ্মচারী বাবা যখন তাঁর সন্তানকে তাঁর চরণে আশ্রয় দিয়েছেন, তখন যম তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। সেদিন জানকীনাথ আশ্রমে পড়ে রইল। বাবা তাকে কিছু বললেন না।

পরদিন সকালে বাবা জানকীনাথকে ডেকে আদেশ করলেন, আশ্রমের পূর্বদিকের পুকুরঘাট থেকে জল তুলে এনে আশ্রমের সেবায় লেগে পড়তে। কিন্তু জানকীনাথ উত্থানশক্তিরহিত। তার অস্থিচর্মসার দেহে উঠে দাঁড়াবার মতোই বল নেই, সে পুকুরঘাট থেকে কি করে জল আনবে! কিন্তু বাবার আদেশ অমোঘ। তার খণ্ডন কেউ করতে পারে না। জানকীনাথ বাবার আদেশ শুনে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই, সহজে উঠে দাঁড়াল। তারপর এক অলৌকিক শক্তিবলে পূর্বদিকের পুকুরঘাট থেকে জল এনে আশ্রমের সেবা করতে আরম্ভ করল। যে সব আশ্রমবাসীগণ জানকীনাথকে মৃতবৎ পড়ে থাকতে দেখেছিল, তারা তার হঠাৎ এইরূপ কার্যে প্রবৃত্ত হয়ে পড়াতে খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। ব্রহ্মচারী বাবা যখন জানকীনাথকে আদেশ করলেন, তখনই আশ্রমের সেবার জন্য জানকীনাথের মধ্যে এক অলৌকিক শক্তির সঞ্চার হয়ে তার মধ্যের সমস্ত অসুস্থতা ও জড়তাকে দূর করে দিয়েছে। জানকীনাথ বাবার আদেশ মত নিঃশব্দে প্রতিদিন পুকুর থেকে জল তুলে এনে আশ্রমের পরিচর্যা করতে লাগল। এই সেবার ফলে প্রতিদিনই বাবার আশীর্বাদ তার উপর বর্ষিত হতে থাকল।

বাবা লোকনাথ জানকীনাথকে আশ্রম সেবার মধ্য দিয়ে কর্মযোগে প্রবৃত্ত করেছিলেন এবং নিজে তার মধ্যে আধ্যাত্ম শক্তির সঞ্চার করেছিলেন। আশ্রমের নিত্য সেবা করাই জানকীনাথ তার একমাত্র কাজ বলে মনে করে। সে মনে করে যে এই আশ্রম সেবার মধ্য দিয়েই সে ব্রহ্মচারী বাবার সেবা করার সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগকে সে হারাতে চায় না। সেজন্য অতি নিষ্ঠার সঙ্গে মনোযোগ সহকারে সে নিজেকে আশ্রম সেবায় নিয়োজিত করে। আর সে যত নিজেকে সেবায় নিয়োজিত করে, তত সে আশীর্বাদ পায় বাবার থেকে। এইভাবে ক্রমে মৃতপ্রায় জানকীনাথ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে কেবল বাবার আশীর্বাদে কর্মযোগের মাধ্যমে। যখন সব চিকিৎসা ব্যর্থ, তখন রামরতন চক্রবর্তী বাবার কৃপার উপর ভরসা করেই সন্তানকে আশ্রমে রেখে গিয়েছিলেন। জানকীনাথ সুস্থ হয়েছে লোকমুখে শুনে তিনি সস্ত্রীক আশ্রমে ছুটে আসেন সন্তানকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। জানকীর মা তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। বাবা লোকনাথ তাকে মাতৃআদেশ পালন করতে বলেন। কিন্তু জানকীনাথ বলে যে মাতৃআদেশ পালন করতে এখন সে অক্ষম।

জানকীনাথকে বাবা লোকনাথ ভালোবেসে স্নেহের ব্লসে জানকী বলে ডাকতেন। জানকী বাবা লোকনাথকে বলেন, আমার তো বাঁচার কোনো আশাই ছিল না। আমি কেবল আপনার কৃপায় বেঁচেছি। তাই এখন এই দেহের উপর আর কারও অধিকার নেই। এই দেহ কেবল আপনার সেবা, পূজা ও সাধনভজনের জন্য উৎসর্গ করেছি। সংসারে আর আমি ফিরে যাব না।

জানকীর এই কথায় তার মা-র প্রাণ কেঁদে ওঠে। একমাত্র পুত্র সন্তানের মায়া তিনি কিছুতেই কাটাতে পারবেন না। তাকে ছেড়ে জীবনধারণ করতে পারবেন না। সেইজন্য তিনি অনেক করে জানকীকে অনুনয় করতে থাকেন তাঁর সঙ্গে গৃহে ফিরে যাবার জন্য। কিন্তু জানকী তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আশ্রমের সেবা করে ব্রহ্মচারী বাবার সেবা করে ও তার সান্নিধ্যে এসে সংসার জীবনের মায়া ত্যাগ করতে সে সমর্থ হয়েছে। আর সে সেই পথে পা বাড়াতে চায় না। ব্রহ্মচারী বাবার সান্নিধ্য ছেড়ে সে পিতামাতার সান্নিধ্যে যেতে অপারগ। অবশেষে ব্রহ্মচারী বাবার প্রতি ভক্তি ও বৈরাগ্যের কাছে হার মেনে জানকীর পিতামাতা চিরদিনের জন্য তাদের পুত্রকে ব্রহ্মচারী বাবার চরণে সমর্পণ করে চোখের জলে একাকী ঘরে ফিরে যান।

এতদিনে জানকী গৃহস্থ জীবনের বন্ধন থেকে চিরতরে মুক্ত হয়ে সন্ন্যাস জীবনে প্রবেশাধিকার লাভ করে নিজেকে ধন্য মনে করেন। জানকীকে দীক্ষা দেন বাবা লোকনাথ। করে নেন তার একান্ত মন্ত্রশিষ্য। দীক্ষান্তে লোকনাথ বাবা জানকীকে যোগসাধনের বিভিন্ন ক্রিয়া শেখাতে থাকেন। গুরুঅন্ত প্রাণ জানকী অতীব নিষ্ঠার সঙ্গে গুরুর থেকে প্রাপ্ত বিদ্যা আত্মস্থ করতে থাকেন। তার নাম হয় জানকী ব্রহ্মচারী।

লোকনাথ বাবা সাধনমার্গে জানকীর নিষ্ঠায় ও তার গুরুভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে তাঁকে অষ্টাঙ্গ যোগের প্রতিটি ক্রিয়া নিজে শিখিয়ে দেন। একজন ব্রহ্মজ্ঞানী দেবসদৃশ মহাপুরুষের কাছে জানকী ব্রহ্মচারী যোগ সাধনায় উৎকর্ষ লাভ করতে থাকেন। কত ভাগ্যবান তিনি। সাধনার প্রথম কর্তব্যরূপে জানকী ব্রহ্মচারী সর্বক্ষণ বাবা লোকনাথের দিব্যদেহ স্মরণ, মনন ও অনুধ্যানের মধ্য দিয়ে নিজের দেহকে লোকনাথ স্বরূপ করে তুলতে থাকেন। জানকী ব্রহ্মচারী ছিলেন এমন একজন অতীব সৌভাগ্যবান যে, বাবা লোকনাথ নিজে তাকে একই সঙ্গে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মমার্গের শিক্ষা দিয়ে সাধনার এক অতি উচ্চস্তরে পৌঁছে দেন। জানকীর যাতে সিদ্ধি সহজলভ্য হয়, সেজন্য বাবা লোকনাথ নিজের যোগশক্তি তার মধ্যে সঞ্চারিত করেন এবং তার নিজের যোগৈশ্বর্য তাকে দান করেন। জানকী ব্রহ্মচারী ক্রমে বাবা লোকনাথের কৃপায় সাধনার অতি উচ্চস্তরে উন্নীত হন এবং বাবা লোকনাথকে সর্বক্ষণ স্মরণ, মনন করতে করতে বাবার কৃপায় তার দেহটিও লোকনাথ সদৃশ্য হয়। সাধনস্তরে এই রূপ উক্রমণ দেখে বারদীবাসী চমৎকৃত হয়।

জানকী ব্রহ্মচারীকে এইরূপ বিশেষ কৃপা করার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল বাবা লোকনাথের। যখন বারদীর শ্মশানভূমিতে আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সেখানকার মাটি হাতে নিয়ে বাবা লোকনাথ তার ব্রহ্মরূপ প্রকাশ করে বলেছিলেন, বারদীর এই মাটি এক মহাতীর্থ স্থান হবে। এই মাটি থেকে ঘটবে মানুষের সর্বকষ্ট থেকে মুক্তি। বাবা ভাবতেন, তার ভবলীলা যখন সাঙ্গ হয়ে যাবে, তারপর এই আশ্রমের ভার তিনি কাকে দিয়ে যাবেন? তার অতি সাধের বারদী আশ্রমকে মানবমুক্তির জন্য তার পরে কে পরিচালনা করবে? কে পথ দেখাবে মুক্তিকামী মানুষকে? জানকীকে সেইজন্য বাবা নিজের হাতে নিজের মনের মতো করে তৈরি করেছিলেন। নিজের যোগৈশ্বর্য তার মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন যাতে আগামী দিনে জানকী ব্রহ্মচারী মুক্তিকামী মানুষকে পথ দেখাতে পারেন।

বাবা লোকনাথ যখন দেখলেন, জানকীর শরীরে সেই দিব্য আভা যা প্রমাণ করে যে তিনি সাধনার উচ্চস্তরে উন্নীত হয়ে সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছেন, তখন তাকে ডেকে আদেশ করলেন, জানকী, আমার নলীলা অপ্রকট হলে বারদী আশ্রমের গুরুদায়িত্ব তোকেই বহন করতে হবে।

বাবা লোকনাথের এইরূপ আদেশ শুনে জানকী ব্রহ্মচারী মহাচিন্তায় পড়লেন। এত বড় দায়িত্বভার কেমন করে তিনি বহন করবেন। গুরুদেবের এই কঠোর আজ্ঞা পালন করা কি তার পক্ষে সম্ভব? যে বারদীর মাটিতে সর্ব দেব-দেবীর বাস, যে আশ্রমের মাটি সর্বরোগ ক্ষয় করে, যে আশ্রমে প্রবেশ করলে মানুষের চিত্ত নিজে থেকে শীতল ও নির্মল হয়ে যায়, যে আশ্রমে প্রবেশ করলে মানুষ হিংসা-দ্বেষ রহিত হয়, যে আশ্রমে প্রবেশ করলে মানুষ দিব্যভাব অনুভব করে, যে আশ্রম ও তার সকল দিব্যভাবের রক্ষক স্বয়ং ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী, সেই আশ্রমের সব দায়িত্বভার তিনি কি করে নেবেন? তিনি কি সেই উপযুক্ত হয়েছেন? আবার তার মনে এও প্রশ্ন জাগে যে গুরুদেব তাঁর কাছে নরলীলা সাঙ্গ করার কথা বললেন কেন? তবে কি গুরুদেব আর বেশিদিন তার বর্তমান লীলায় থাকবেন না? এইসব কথা মনে করে তিনি অতিশয় বিচলিত হয়ে পড়েন। নানা সংশয়াত্মক প্রশ্ন তার মনকে তোলপাড় করে তোলে। নিজের যোগ সামর্থ তিনি কিছুই জানেন না। তিনি লোকনাথঅন্ত প্রাণ। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, যেই আসনে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী উপবেশন করেন, এরপরে সেই আসন তাকে রক্ষা করতে হবে। তিনি অতি বিনীতভাবে গুরুদেবের চরণে তার মনের কথা, অক্ষমতার কথা প্রতিদিন নিবেদন করতে থাকেন ও প্রতীক্ষা করেন বাবার পরবর্তী নির্দেশের।

জানকীকে চিন্তিত দেখে বাবা লোকনাথ একদিন তাকে বলেন, কিরে এত বড়ো আশ্ৰম কি করে চালাবি, তাই ভাবছিস তো? ওরে, আমার কি বিনাশ আছে? তবুও তোকে বলি, প্রত্যহ আসনঘর পরিষ্কার করার সময় আমার আসনের তলায় দুটি করে টাকা পাবি। তাতেই তোদের সব খরচ চলে যাবে। বাবার এই কথা অক্ষরে অক্ষরে পরবর্তীকালে সত্য প্রমাণিত হয়। বাবা লোকনাথের দেবলোকে উক্রমণের পর প্রতিদিন জানকী ব্রহ্মচারী বাবার আসনের তলায় দুটি করে টাকা পেতেন বাবার আশীর্বাদস্বরূপ এবং সেই আশীর্বাদকে পাথেয় করেই জানকী ব্রহ্মচারী আজীবন আশ্রমের সেবা করে গেছেন।

জানকী ব্রহ্মচারী যখন বাবার কৃপায় সাধনার অত্যুচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছেন এবং তার মধ্যে বাবার যোগেশ্বর্য সঞ্চারিত হবার ফলে বিভিন্ন সিদ্ধির স্ফুরণ হতে থাকে, বাবা লোকনাথ তখন নিশ্চিত হয়ে যান যে, তাঁর উত্তরকালে তাঁর জায়গায় জানকী মুক্তিকামী মানুষকে পথ দেখাতে প্রস্তুত। এইসময় তিনি ভবলীলা সাঙ্গ করে ইহলোক ত্যাগ করার কথা ভাবতে থাকেন। জানকী ছিলেন বাবার শেষ সময়ের নিত্য সেবক। বাবার অন্তিমকালে তাঁর প্রতি নির্দেশ ছিল যে তার যোগৈশ্বচর্য দ্বারা তিনি এই বারদী আশ্রমের পবিত্রতা রক্ষা করবেন এবং সকল মুক্তিকামী মানুষকে পথ প্রদর্শন করবেন। বাবার অন্তিম প্রণয়কালে জানকী ব্রহ্মচারী উপস্থিত ছিলেন।

বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের পর বারদী আশ্রমের সমস্ত দায়িত্বভার জানকী ব্রহ্মচারীর উপর ন্যস্ত হয়। বাবার আশীর্বাদ সর্বদা তার উপরে ছিল। জানকী ব্রহ্মচারী নিত্য নিজ হস্তে ভোগ রান্না করতেন এবং সেই ভোগ বাবাকে নিবেদন করতেন। বারদী ও সোনার গাঁ-র প্রাচীন ব্যক্তিদের বর্তমান বংশধরদের কাছে শোনা যায় যে, যখন জানকী ব্রহ্মচারী ভোগ রান্না করতেন, পাকশালাটি এক দিব্যগন্ধে ভরে উঠত এবং সেই দিব্যগন্ধ সারা আশ্রম ছেয়ে যেত। ভোগ রান্না করে প্রথমে বাবা লোকনাথকে নিবেদন করা হতো। তারপর জানকী ব্রহ্মচারী প্রসাদ নিয়ে আশ্রমের উঠানে আয় আয় বলে ডাকলে আশ্রমের পাশ থেকে দুটি শেয়াল এবং অন্যান্য প্রাণী ও পক্ষীরা এসে প্রসাদ গ্রহণ করত।

যোগসাধনার উচ্চতর অবস্থায় ক্রমাগত বাবা লোকনাথকে স্মরণ, মনন করার জন্য জানকী ব্রহ্মচারী লোকনাথসদৃশ দেখতে হয়ে গিয়েছিলেন। বাবার মহাপ্রয়াণের পর তার যোগশক্তির বহিঃপ্রকাশ হতে থাকে। তার যোগেশ্বর্যের কথা দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুক্তিকামী মানুষ তার দর্শনে ও বাবা লোকনাথের পবিত্র আশ্রম স্পর্শ করার জন্য তার কাছে আসতে থাকেন। অনেক ভক্ত তখন জানকী ব্রহ্মচারীকে গুরুরূপে বরণ করে ধন্য হন।

জানকী ব্রহ্মচারীর অন্যতম শিষ্য ছিলেন গুরুদয়াল দাস। তিনি প্রথমে নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি গুরুর কাছে একটি পুত্রসন্তানের কামনা করেন। গুরুর কৃপায় যথাসময়ে তিনি একটি পুত্রসন্তান লাভ করেন। কিন্তু সেই পুত্র ছিল জন্মান্ধ। একদিন গুরুদয়াল আশ্রমে এসে জানকী ব্রহ্মচারীর চরণে তার শীর্ণকায় জন্মান্ধ পুত্রকে রেখে তার আরোগ্য কামনা করেন।

জানকীনাথ তাকে বলেন, বাবা লোকনাথের শ্রীচরণের ধূলি সর্বরোগের মহৌষধ। সেই পুণ্যধূলি আশ্রমের মাটিতে মিশে আছে। সে যেন এই আশ্রমের মাটি শিশুটির সর্বাঙ্গে ও চোখ দুটিতে প্রত্যহ মাখিয়ে দেন আর বাবা লোকনাথকে স্মরণ করেন। তাহলে বাবার আশীর্বাদে তার পুত্র নিশ্চয়ই আরোগ্য লাভ করবে। গুরুদয়াল গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী প্রত্যহ একমনে বাবা লোকনাথকে স্মরণ করে আশ্রমের মাটি সন্তানের সর্বাঙ্গে ও দুটি চোখে মাখাতে থাকেন। তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে গুরু যখন বলেছেন, এই মাটি লেপলে তার পুত্র সুস্থ হয়ে যাবে, তখন বাবার কৃপায় নিশ্চয়ই তার পুত্র একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে। তার এই ঐকান্তিক বিশ্বাসের ফল গুরুদয়াল পেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁর পুত্র সুস্থ সবল হয়ে ওঠে এবং একদিন তার জন্মান্ধ পুত্র দৃষ্টিশক্তি পায়। একদিন সেই পবিত্র আশ্রম তার দৃশ্যগোচর হয়, তারপর ধীরে ধীরে প্রকৃতির সব সৃষ্টি ও সৌন্দর্যকে সে নয়নভরে দেখতে পারে। এই অলৌকিক কাণ্ডে আনন্দে গুরুদয়াল আত্মহারা হয়ে যান, তিনি জয়ধ্বনি করতে থাকেন বাবা লোকনাথ ও জানকী ব্রহ্মচারীর। এই শিশুর তখন নামকরণ হয় ভগবান দাস। সে পরে দীর্ঘজীবন লাভ করে।

এই ঘটনা বারদীতে ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১১৯-২০ বছর আগে বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের পর। আমি এমনও প্রমাণ পেয়েছি যে, বারদী আশ্রমে বাবার ঘরের বাইরে বারান্দার পাশে একটি জায়গায় বাবা প্রত্যহ আচমন করতেন ও হস্ত-পদ প্রক্ষালন করতেন। সেই জায়গার মাটি লেপন করে আজও অনেক রোগী সুস্থ হয়ে যায়। কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। আমি নিজে কলকাতা থেকে এক বিশেষ ব্যক্তি মারফৎ সেই জায়গার কিঞ্চিৎ মাটি সংগ্রহ করেছিলাম ও এক মারণরোগ থেকে মুক্তির জন্য ব্যবহার করেছিলাম। সেইজন্য নিজ অভিজ্ঞতার থেকে জোরের সঙ্গে এই কথা বলতে পারি। আমি এও জানি যে অনেক ভক্তই আশ্রমে গিয়ে সেই জায়গার মাটি সংগ্রহ করে নিত্য উপকার পান। বর্তমানে বাংলাদেশে যাদের বারদী যাতায়াত আছে, তারা এই মাটিকে পবিত্র জ্ঞানে পূজা করে।

গুরুদয়ালের পুত্রের এই অলৌকিক ঘটনার বার্তা দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে যে, ব্রহ্মচারী বাবার মহাপ্রয়াণের পরেও বারদীর মাটি ততটাই পবিত্র আছে, যা আগে ছিল। বারদী আশ্রমে বাবা লোকনাথের যোগ্যশিষ্য জানকী ব্রহ্মচারী একইভাবে বাবার কৃপা ভক্তের মধ্যে বিতরণ করেছেন।

বারদীর দীঘির পাড়ে হরিচরণ নামে এক মৎস্যজীবী বাস করতো। ব্রহ্মচারী বাবার প্রতি তার অগাধ ভক্তি বিশ্বাস ছিল। প্রত্যহ সূর্যোদয়ের পূর্বে সে স্নান করে শুদ্ধ মতো বাবার আসন ঘরের সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সর্বাঙ্গে সেখানকার মাটি লেপন করতো। তারপর সে তার কাজে যেত। তার মনে দীক্ষা নেবার প্রবল আগ্রহ জাগে কিন্তু সে কথা সে ব্রহ্মচারী বাবাকে কোনোদিন বলতে পারে নি। বাবা লোকনাথের মহাপ্রয়াণের পর সে জানকী ব্রহ্মচারীকে সদ্গুরু রূপে পাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বাবা লোকনাথের প্রতি হরিচরণের ভক্তি বিশ্বাসের কথা জানকী ব্রহ্মচারী অনেকদিন ধরেই জানেন। বাবার ইহলোকে অবস্থানকালে প্রত্যহ ব্রাহ্মমুহূর্তে তাঁকে প্রণাম না করে সে কোনো কাজ করতো না এবং আশ্রমের পবিত্র মাটিতে দেহ লেপন না করে সে কাজে বেরোত না। এ কথা জানকীনাথের জানা। তবুও তিনি তাকে বলেন সময় হলে দীক্ষা দেবো। অধীর আগ্রহে সেই শুভ সময়ের অপেক্ষা করতে থাকে হরিচরণ। অবশেষে একদিন তিনি হরিচরণকে দীক্ষা দিয়ে সংসারে থেকেও নিরাসক্ত নির্লিপ্ত হয়ে সাধনা করে যাবার উপদেশ দেন। গুরুর কৃপায় অতি সাধারণ হরিচরণের মধ্যে অল্পদিনেই ত্যাগ ও বৈরাগ্যের লক্ষণগুলি স্পষ্ট হতে থাকে। সে ক্রমে বারদীতে একজন আদর্শ গৃহস্থ সাধুরূপে পরিচিত হয়ে ওঠে। অবশেষে দেহত্যাগের সময় বাবা লোকনাথ ও জানকী ব্রহ্মচারীর নাম স্মরণ করতে করতে এই ধরাধাম ত্যাগ করে।

বারদী আশ্রমে সেই সময় হরিচরণের দীক্ষান্তে জীবনের পরিবর্তনের কথা লোকমুখে প্রচারিত হয়। সঠিক সদ্গুরু পেলে যে শিষ্যকে সাধন ভজনের জন্য পাহাড় জঙ্গলে যেতে হয় না, হরিচরণের জীবন তার প্রমাণ। সদ্গুরুর প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তি শ্রদ্ধা থাকলে এবং সদ্গুরু যদি শিষ্যকে সঠিক পথে পরিচালনা করেন তবে গৃহে থেকে সংসারী জীবনযাপন করেও ত্যাগ ও বৈরাগ্য মনে আনা সম্ভব এবং তার ফলশ্রুতিতে মুক্তির পথের সন্ধান পাওয়াও সম্ভব। জানকী ব্রহ্মচারী হরিচরণের মতো একজন অতি সাধারণ ভক্তকে দীক্ষা দিয়েও সঠিক পথে পরিচালনা করে তার মধ্যে সংসারের প্রতি নিরাসক্ত ভাব ও বৈরাগ্য সৃষ্টি করে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন যে, সঠিক সদ্গুরুর সন্ধান পেলে শিষ্যের মুক্তির পথের সন্ধান গৃহাশ্রমে থেকেও পাওয়া যায়। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী মরদেহে না থাকলেও, তার আশ্রমগুরু ভক্তদের সেই পথের সন্ধান দিতে পারেন।

বাবা লোকনাথ অনেক গৃহস্থ ভক্তদের দীক্ষা দিয়ে ও সাধন জীবনে শিক্ষা দিয়ে সিদ্ধযোগী করে তুলেছিলেন। তিনি জগতের কাছে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছিলেন যে, ঈশ্বরদর্শন কেবল গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীদের একচেটিয়া অধিকারের বস্তু নয়, সদ্গুরুর কৃপা হলে অতি সাধারণ গৃহী ব্যক্তিও সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর থেকে উদ্ধৃতর যোগশক্তি ও আধ্যাত্মশক্তি গৃহাশ্রমে সাধনা করেই লাভ করতে পারেন। গৃহাশ্রমে সংসারে যুক্ত কত জীব যে ব্রহ্মচারী বাবার সংস্পর্শে এসে সংসারে নিরাসক্ত হয়ে ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মধ্য দিয়ে সাধনার উচ্চমার্গে পৌঁছেছিলেন, আধ্যাত্ম সাধনার ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। আবার, তার পরবর্তীকালে যাতে বারদী আশ্রমের এই ধারা বজায় থাকে, তার জন্য তিনি সকল যোগৈশ্বর্য দিয়ে জানকী ব্রহ্মচারীকে তৈরি করে গিয়েছিলেন। জানকী ব্রহ্মচারী, রজনী ব্রহ্মচারী, ব্রহ্মানন্দ ভারতী ইত্যাদি যোগীগণ বাবার সেই ইচ্ছাপূরণে সদা সচেষ্ট ছিলেন। বাবার দিব্যলোকে উক্রমণের পর জানকী ব্রহ্মচারীর যোগশক্তি, ভক্তি, ত্যাগ ও আদর্শের কথা লোকমুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং বহু লোক বারদীর আশ্রমে এসে তার কৃপাধন্য হয়।

অবশেষে ১৩১৮ সনের ২৯শে চৈত্র জানকী ব্রহ্মচারী তার পঞ্চভূত দেহ ত্যাগ করে ব্রহ্মলীন হন। যখন জানকী ব্রহ্মচারী ব্রহ্মলীন হন, তখন বাবা লোকনাথের এক সূক্ষ্ম নির্দেশে তার সমাধির পাশেই জানকী ব্রহ্মচারীর সমাধি নির্মিত হয়। এরপর থেকে একসঙ্গেই গুরু ও শিষ্যের নিত্যসেবা বারদী আশ্রমে হতে থাকে। প্রতিবছর ১৯শে জ্যৈষ্ঠ যখন বাবা লোকনাথের তিরোধান উৎসব হয়, তখন একইসঙ্গে তার সঙ্গে জানকী ব্রহ্মচারী ও মা গোয়ালিনীরও ভোগ নিবেদন হয়। বাবা লোকনাথের মতো জানকী ব্রহ্মচারীও বারদী আশ্রমে অমর হয়ে থাকেন। তার সূক্ষ্মাত্মা নিত্য ভক্তদের আজও কৃপা করে থাকে।

.

গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী

গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সঙ্গে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সম্পর্ক নিয়ে বাবার ভক্তদের মধ্যে বিশেষ কৌতূহল আছে। বাবার বারদী অবস্থানকালে গোঁসাইজি ছিলেন বোধহয় একমাত্র অতীব সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি পূর্ণব্রহ্ম বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর দিব্যদেহের প্রতি লোমকূপে দেবদেবীর অবস্থান প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং সে কথা তিনি সারা দেশে পরিভ্রমণকালে তার ভক্তদের অবগত করিয়েছিলেন। কেন গোঁসাইজি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর দিব্যদেহ প্রত্যক্ষ করতে সমর্থ হয়েছিলেন, সেকথা প্রকৃতভাবে জানতে হলে আমাদের গোঁসাইজির জন্ম থেকে সাধনজীবন সম্পর্কে কিছু কথা জানতে হবে।

গোঁসাইজির জন্ম হয়েছিল শান্তিপুরে ১৮৪১ সনের ঝুলন পূর্ণিমার দিন। তার পিতার নাম ছিল শ্রী আনন্দচন্দ্র গোস্বামী ও মাতার নাম শ্রীমতি স্বর্ণময়ীদেবী। তাঁর পিতা ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব। তাদের কূলদেবতা ছিলেন শ্যামসুন্দর। তৎকালীন বৈষ্ণব সমাজে তার পিতার একজন ধার্মিক ও ন্যায়নিষ্ঠ গুরুরূপে যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। বাল্যকালে বিজয়কৃষ্ণ গ্রামের পাঠশালায় বিদ্যা শিক্ষার্থে ভর্তি হন। কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যার্জনে তার কোনো ঝোঁক ছিল না। পাঠশালায় গিয়ে তিনি একদিন পণ্ডিত মশাইকে জিজ্ঞাসা করেন, ঈশ্বরকে কেমন দেখতে? তিনি মাতা নাকি পিতা? পণ্ডিত মশাই বিজয়ের এইরকম প্রশ্নকে বাঁচালতা মনে করেন ও বলেন, কৌপীন পড়ে, ভস্ম মেখে হিমালয়ের গুহায় গিয়ে ভগবানের খোঁজ করতে। বিজয়কৃষ্ণ তার মনের প্রশ্নের জবাব পাননা এবং সেইজন্য পাঠশালার পুঁথিগত বিদ্যার্জনে তিনি নিরাশ হয়ে পড়েন এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে তার মনের কৌতূহল ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আনন্দচন্দ্র বুঝতে পারেন যে বিজয়ের মন ক্রমেই আধ্যাত্ম পথে ধাবিত হচ্ছে। তিনি পুত্রকে তবুও পাঠশালার পড়ায় মনোনিবেশ করতে বলেন। বিজয় তখন পিতাকে জিজ্ঞাসা করেন, ঈশ্বর সাকার না নিরাকার? পিতা তখন তাকে বলেন, বিদ্যার্জনের মধ্য দিয়েই তিনি এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন। এরপর বিজয়কৃষ্ণ পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করলে আনন্দচন্দ্র তাঁকে টোলে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু টোলে ভর্তি হবার কিছুদিন পরে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। মাতা স্বর্ণময়ীদেবী তার স্বামীর ইচ্ছানুসারে পুত্রের টোল পাঠ সমাপ্ত করাতে সচেষ্ট হন এবং বিজয়কৃষ্ণ টোল পাঠ সমাপ্ত করেন। আনন্দচন্দ্রের ইচ্ছা ছিল পুত্রকে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে পড়াবার। তার অবর্তমানে স্বর্ণময়ীদেবী কলকাতায় তাদের এক অবস্থাপন্ন শিষ্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দচন্দ্রের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। সেই শিষ্য তখন বিজয়কৃষ্ণকে শান্তিপুর থেকে এনে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে পড়ার সব ব্যবস্থা করে দেন।

সংস্কৃত কলেজে সেইসময় বিভিন্ন পণ্ডিত ও বিদ্বজনদের যোগাযোগ ছিল। সেইসময় ধর্মসংস্কার আন্দোলনে এই কলেজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অনেকে যোগ দিয়েছিলেন। বিজয়কৃষ্ণ কলেজে বিভিন্ন পণ্ডিত সমাজের ব্যক্তিদের কাছে। ঈশ্বর সম্বন্ধে বিভিন্ন আলোচনা শুনতেন। একবার তিনি শান্তিপুরে মায়ের কাছে গিয়ে বলেন, মা কেবলমাত্র আমাদের এই কৃষ্ণ বিগ্রহের মধ্যেই কি ভগবান আবদ্ধ আছেন? মা ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে যান। বিজয়কৃষ্ণ মাকে বলেন, ভগবান কোনো সম্প্রদায়ের একার সম্পত্তি নন। স্বর্ণময়ীদেবী বুঝতে চেষ্টা করেন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান হয়ে তার পুত্র এসব কি কথা বলছে। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন।

সমগ্র বাংলার বুকে তখন চলছে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ভরা জোয়ার। কলকাতার সংস্কৃত কলেজ সেই আন্দোলনের এক কেন্দ্রবিন্দু। বাঙালির ধর্ম ও সংস্কৃতিতে তখন চলছে ভাঙনের জোয়ার। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন তখন ব্রাহ্ম সমাজের প্রাণপুরুষ। তাঁরা তাঁদের অনুগামীদের নিয়ে ভারতের তথা বাংলার বুকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ধ্বজা বয়ে নিয়ে চলেছেন। তারা একটা বড়ো প্রশ্ন সকল ধর্মানুরাগীদের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছেন যে, ঈশ্বরের অনুগ্রহ সকলেই চায়, কিন্তু কোন পথে? সাকার ঈশ্বর আরাধনায় না নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনায়? যে প্রশ্ন বিজয়কৃষ্ণের মধ্যে সেই পাঠশালা জীবন থেকে তোলপাড় করছিল, সংস্কৃত কলেজে এসে তিনি সেই প্রশ্ন ব্রাহ্ম সমাজের মুখে শুনতে পেলেন। এই প্রশ্ন তাকে ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি আকৃষ্ট করল। একদিন তিনি এক সহপাঠীর সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজে গিয়ে তাদের কথা শুনলেন। নিরাকারবাদ তার ভালো লাগল। ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মসংস্কার আন্দোলনে তিনি প্রভাবিত হলেন। কিন্তু বাল্যকালের মনের সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর তিনি কোথাও পাননা। ঈশ্বর সাকার না নিরাকার, এক-একজন এক-এক ভাবে ব্যাখ্যা করেন। কেউ কেউ বলেন, ঈশ্বর সাকার আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি নিরাকার। যত তিনি তাদের কথা শোনেন, তার মনের মধ্যে প্রশ্নের জাল বিস্তৃত হতে থাকে। মন হয়ে ওঠে অশান্ত। মনে এক চরম অতৃপ্তি নিয়ে তিনি এই প্রশ্নের উত্তর সংস্কৃত কলেজে খুঁজতে থাকেন।

এই সময় তিনি কলেজে সহপাঠীদের কাছে দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা জানতে পারেন। তিনি শুনতে পান, শ্রীরামকৃষ্ণ নিত্য ঈশ্বর দর্শন করেন। তার মনে হয়, এঁর কাছে গেলে তিনি হয়তো বা তার মনের প্রশ্নের উত্তর পেতে পারেন। মনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন নিয়ে তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হন। সেখানে ঠাকুরের সামনে বসে তিনি একনিষ্ঠভাবে তার উপদেশ শোনেন। ঠাকুরের কাছে তিনি জানতে পারেন, জীবন্মুক্তির উপায়। এ আবার ঈশ্বরের এক অন্য তত্ত্ব।

ঠাকুরের উপদেশ শুনে তিনি উপলব্ধি করেন যে, জীবের দুই অবস্থা–বন্ধন ও মুক্তি। ঈশ্বর উভয়েরই কর্তা। জীব কামিনী-কাঞ্চনে বদ্ধ থাকে বলে জাগতিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। জীব যদি নিজেকে সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত করে আনন্দময় পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে পারে, তবেই দেখতে পায় মুক্তির পথ। সাধুসঙ্গ করলে সংসারে আবদ্ধ থেকেও মনকে ঈশ্বরাভিমুখী করা সম্ভব। মনকে দৃঢ় করে কেঁদে আকুল হলে সেই জীব নিজেকে বন্ধন মুক্ত করে মুক্তির আস্বাদ পেতে পারে। ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা আর ব্রাহ্ম সমাজের কথা, সব তার মনকে বিচলিত করে তোলে। কোন পথে গেলে তিনি ঈশ্বরের সন্ধান পাবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। মনের মধ্যে সবকিছু জট পাকিয়ে যায়। সংস্কৃত কলেজ থেকে তিনি কিছুদিনের ছুটিতে শান্তিপুরে বাড়িতে চলে যান।

বাড়ি গিয়ে বিজয়কৃষ্ণ দেখেন সংসারে প্রচণ্ড অর্থাভাব। মা অতি কষ্টে আছেন। মা তাকে তখন কিছু শিষ্যের বাড়ি যেতে বলেন। শিষ্যের বাড়ি গেলে অর্থাভাব কিছুটা মেটার সম্ভাবনা থাকে। বাড়িতে শ্যামসুন্দরের সেবারও ব্যবস্থা হয়। কিন্তু গুরুর কর্তব্য সম্বন্ধে বিজয়কৃষ্ণের কিছুই জানা নেই। তাও মার কথায় তিনি কিছু শিষ্যের বাড়ি যান। কিন্তু সেখানে তাঁকে লজ্জাকর পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়। তিনি নিজেই অখণ্ড মণ্ডলাকার পুরুষের মাহাত্ম্য এবং তাঁকে দর্শনের উপায় জানেন না, তবে শিষ্যদের সেই পরমপুরুষের দর্শন ও মোক্ষ লাভের উপায় বলে দেওয়া কি করে সম্ভব? তিনি নিজেই তো এই প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে শান্তিপুর এসেছেন। বাড়ি ফিরে বিজয়কৃষ্ণ ভাবলেন যে, তার দ্বারা গুরুগিরি করা হবে না। প্রথমে তাকে এখন আধ্যাত্ম জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ঈশ্বর লাভের উপায় অন্বেষণ করতে হবে এবং মোক্ষ লাভের জন্য মন প্রাণ ঈশ্বরে সমর্পণ করতে হবে।

মা স্বর্ণময়ী এবং অন্যান্য আত্মীয়গণ বিজয়কৃষ্ণের এ হেন মনের অবস্থা দেখে খুবই বিচলিত হলেন এবং তার বিবাহ দিতে মনস্থ করলেন। তার মা দেখলেন পুত্র সংসার বিদ্বেষী। সর্বদা উরু-উরু মন। একটা বিবাগী ভাগ। সংসারে আয়ের প্রধান উৎসই ছিল যজন-যাজন এবং শিষ্যদের দান। কিন্তু বিজয়কৃষ্ণ এইসব থেকে মুখ সরিয়ে নেওয়ায় মা ঠিক করলেন ছেলেকে বিবাহ দিয়ে সংসারী করবেন, তবে যদি মতি ফেরে। বিজয়কৃষ্ণের বিবাহ হয়ে গেল। কিন্তু কিছুদিন শান্তিপুরে থাকার পর তিনি আবার কলকাতায় পাড়ি দিলেন।

কলকাতায় গিয়ে তিনি আবার সংস্কৃত কলেজে যাতায়াত শুরু করলেন। কিন্তু পাঠে তার আর মন বসল না। একদিন তিনি তার মনের সকল জিজ্ঞাসা নিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র সেনের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি শুনলেন, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা। ব্রহ্মই অখণ্ড মণ্ডলাকার। বিশুদ্ধ বুদ্ধি ও জ্ঞানের দ্বারাই একমাত্র তাঁকে জানা সম্ভব। ব্ৰহ্ম সর্বভূতে বিরাজমান। এই জগৎ তারই সৃষ্টি। ব্রাহ্ম সমাজ সেই ব্রহ্মের উপাসনারই পথ প্রদর্শন করে। এই ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে তিনি সংস্কৃত কলেজ ছেড়ে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারে মনোনিবেশ করলেন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ সন্তান। গৃহে কুলদেবতা শ্যামসুন্দর। এ হেন বৈষ্ণবগৃহের সন্তান হলেন ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে তিনি তখন পাগল। কিন্তু সেই ধর্ম প্রচারে তার মনের প্রধান বাধাস্বরূপ এলো গলার উপবীত। তিনি তখন এতটাই ব্রাহ্ম ধর্মে প্রভাবিত হয়েছেন যে একদিন তিনি উপবীত ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। যেমন সিদ্ধান্ত, তেমন কাজ। হঠাৎ একদিন তিনি উপবীত ত্যাগ করে বসলেন এবং নিজের আত্মীয়স্বজনদের কাছে খুব তিরস্কৃত হলেন। এই ঘটনায় তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন হলো।

এরপর তিনি মনযোগ সহকারে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার করছিলেন। কিন্তু এক নতুন বিপত্তি সামনে এলো। ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে ফাটল ধরল। কেশবচন্দ্র সেন আদি ব্রাহ্ম সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সংস্কারমুক্ত ব্রাহ্ম সমাজ গড়ে তুললেন। ব্রাহ্ম সমাজের এই বিভাজন বিজয়কৃষ্ণের মনেও চিড় ধরাল। তিনি কলকাতা ছেড়ে কিছুদিনের জন্য শান্তিপুরে ফিরে গেলেন। বাড়ি ফিরে বিজয়কৃষ্ণ উদ্ভ্রান্তের মতো দিন কাটাতে লাগলেন। একদিন রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, গৃহদেবতা শ্যামসুন্দর হাসিমুখে তার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি দিব্যকান্তি শ্যামসুন্দরকে দর্শন করলেন। এই দর্শন তার মধ্যে এক নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করলো। ঈশ্বর যদি নিরাকার হন, তবে তিনি স্বচক্ষে কি করে দিব্যকান্তি শ্যামসুন্দরকে দর্শন করলেন! তার একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী জ্ঞানমার্গী মন আবার পৌত্তলিকতার প্রতি ধীরে ধীরে আস্থাশীল হয়ে পড়তে লাগল। এমন সময় একদিন মধ্যাহ্নভোজের পর যখন তিনি বিশ্রাম করছেন, সেইসময় তামধ্যে শ্যামসুন্দর তাঁকে দর্শন দিলেন। তিনি দেখলেন, গম্ভীর মুখে শ্যামসুন্দর তার শিয়রে দাঁড়িয়ে বলছেন, বিজয়, আমি তোর কাছে ছুটে এসেছি। বড়ো কষ্ট আমার। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে। ওরা আমায় এক মুঠো খেতে দেয় বটে, কিন্তু পানীয় জল দেয় না। তুই আমায় জল দে। আমাকে ছেড়ে তুই দূরে চলে যাস না। আমার কাছেই থাক। তামধ্যে শ্যামসুন্দরের এই বাণী শুনে বিজয়কৃষ্ণের তন্দ্রা ছুটে গেল। তিনি ছুটে গিয়ে মন্দিরে দেখেন, ভোগের থালা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জল নেই। এই ঘটনায় তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন। এরপরেও শ্যামসুন্দর তাকে কয়েকবার দর্শন দেন। একদিন মন্দিরে গিয়ে তিনি দেখলেন বিগ্রহের সর্বাঙ্গ থেকে এক অত্যুজ্জ্বল আলোচ্ছটা ঠিকরে বেরোচ্ছে। তিনি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে সেই অনন্যসুন্দর দিব্যপুরুষকে দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে যখন তিনি ভাবে তন্ময় হয়ে পড়লেন, মনে হল সেই দিব্যোজ্জ্বল মূর্তি যেন তাঁকে বলছেন, আমি ভাবের কাঙাল। ভক্তির কাঙাল। বিত্ত সম্পদের কাঙাল নই। আমার ভক্তরা যা কিছু করে তা যেন সমস্তই আমাকে অর্পন করে। ভক্তি ও নিষ্ঠা সম্বল করে অনন্যভাবে আমাতে মন-প্রাণ অর্পণ করে আমার ভজনা যে করে, সে অচিরেই ধর্মাত্মায় পরিণত হয়ে যায়। এই কথা বিজয়কৃষ্ণের মনে এক নতুন ভক্তিরসের সঞ্চার করে এবং তার থেকে জন্ম নেয় এক নতুন অস্থিরতার। ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি তিনি ক্রমে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁদের পৌত্তলিকতা বিরোধিতা তার মনকে অশান্ত করে তোলে। তিনি নিজের চক্ষুকে কি করে অবিশ্বাস করবেন যে চক্ষু সার্থক করেছে দিব্যকান্তি শ্যামসুন্দরকে দর্শন করে। তিনি আবার ছুটে গেলেন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে। শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশামৃতে তিনি এবার ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়লেন এবং সাধন পথের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন।

বর্ধমান জেলার কালনায় এসে তার সাক্ষাৎ হল ভগবানদাস বাবাজির সঙ্গে। তাঁর সান্নিধ্যে এসে ভক্তিরসের সন্ধান পেয়ে তিনি অতীব মুগ্ধ হলেন। সাধুসঙ্গ করার জন্য তার মন ব্যাকুল হলো। ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাকে বলেছিলেন সাধুসঙ্গ করলে মন ঈশ্বরাভিমুখী হয়। সেইজন্য তিনি বনজঙ্গলে ভ্রমণ করতে শুরু করেন এবং সাধু দেখলেই তার সঙ্গে আধ্যাত্মতত্ত্ব আলোচনায় বসে যান। কিন্তু তখনও তিনি দীক্ষা নিয়ে সদ্গুরুর স্থানে কাউকে বসাতে পারেননি যে তাঁকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারেন। সেজন্য উদ্ভ্রান্তের মতো তিনি যেখানে সাধু দেখেন সেখানেই ছুটে যান, গুরুর খোঁজ করেন। কিন্তু সদ্গুরু কোথাও জোটে না। এরপর তিনি গেলেন কাশীতে। সেখানে মণিকর্ণিকার ঘাটে যখন তিনি উদাস মনে বসে আছেন, তখন গঙ্গাস্নান সেরে কমণ্ডলু হাতে তৈলঙ্গস্বামী তার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, বেটা ভাবছিস কেন? আজ এখনই তোর দীক্ষা হবে। যা, গঙ্গা থেকে স্নান করে আয়। বিজয়কৃষ্ণ দেখলেন তার সামনে শীকার সচল শিব দাঁড়িয়ে আছেন। সেই মহাত্মা যার এক দর্শনে শিব দর্শন হয়। তিনি নিজে বলছেন, তাকে দীক্ষা দেবেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিজয়কৃষ্ণ ছুটে গিয়ে তার বিশাল বপু নিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। গঙ্গায় স্নান করে উপরে এলে তৈলঙ্গস্বামী তাকে দীক্ষা দিয়ে বললেন, আজ তোর অর্ধেক দীক্ষা হলো। পূর্ণদীক্ষা আমি দেবো না। আমি তোর শরীরটা কেবল শুদ্ধ করে দিলাম। তোর গুরু আপনা থেকেই আসবে। ব্রাহ্মধর্ম থেকে আবার পৌত্তলিকতায় আস্থা ফিরিয়ে এনে কাশীর সচল শিব নামে পরিচিত ব্রহ্মপুরুষ তৈলঙ্গস্বামীর কাছে তার অর্ধেক দীক্ষা হলো। তিনি বলেছেন, গুরু পূর্ণদীক্ষা দেবার জন্য নিজে থেকেই আসবেন। সেজন্য বিজয়কৃষ্ণের মন এখন আরও বেশি সাধনমুখী হয়ে উঠেছে। তিনি কাশী থেকে গয়ায় গেলেন সেই অজানা গুরুর সন্ধানে। গয়ায় আকাশগঙ্গা পাহাড়ে তিনি দর্শন পান পুণ্যাত্মা ব্রহ্মানন্দ স্বামীর। ভাবাবেশে আপ্লুত হয়ে তিনি তার পায়ে লুটিয়ে পড়েন। এবার ব্রহ্মানন্দ স্বামীর কাছে তার পূর্ণদীক্ষা লাভ হলো। সেখানে দীক্ষামন্ত্র জপ করতে করতে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। যখন তার চোখ খুললো, দেখেন তার গুরু সেই স্থান থেকে অন্তর্হিত। কেঁদে সেখানে তিনি আকুল হলেন। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি উদভ্রান্তের মতো গুরুদেবের খোঁজ করতে থাকেন। সন্ধান করতে করতে যখন তিনি গয়ার রামশীলা পাহাড়ে যান, সেখানে তাঁর দর্শন হয় গুরুদেবের। গুরুদেব তাকে বললেন, তোর মনের আকুলতাই তোর সিদ্ধিলাভের সহায়ক হবে। উতলা হোস না। তুই সিদ্ধিলাভ করবি। এরপর বিজয়কৃষ্ণ গুরুদেবের কাছে সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গুরুদেব তখন তাকে আবার কাশী যেতে বলেন। কাশীতে দশাশ্বমেধ ঘাটে তার সাক্ষাৎ হয় যোগীবর হরিহরানন্দ সরস্বতীজির সঙ্গে। তিনি তাঁকে সন্ন্যাসদীক্ষা দান করেন। সাধক সমাজে তার নাম হল স্বামী অচ্যুতানন্দ সরস্বতী। এই সময় ব্রহ্মানন্দ স্বামী তাকে দর্শন দিয়ে জীবের হিতসাধনের জন্য সংসার ত্যাগ না করতে পরামর্শ দিলেন। সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেও সন্ন্যাসী হওয়ার সাধ বিজয়কৃষ্ণের পূর্ণ হল না। গুরুর আদেশে গৃহাশ্রম ধর্মের মধ্যেই তিনি গয়ায় গিয়ে তপস্যা করতে থাকলেন। গয়ার নৃসিংহ মন্দিরে তপস্যাকালে প্রথম তার মধ্যে পূর্বজন্মের স্মৃতি উদয় হল এবং তিনি জীবের পঞ্চক্রেশ ক্ষয়ের পথে এগোতে থাকলেন। তপস্যার মাধ্যমে ঈশ্বর দর্শনের হেতু তিনি এরপর হিমালয় ও অন্যান্য স্থানে সাধনা করতে করতে কলকাতায় এসে পৌঁছান। তখনও তার ব্রহ্মদর্শন বা সিদ্ধিলাভ হয়নি।

সাধনায় তখনও ব্রহ্মদর্শন ও সিদ্ধিলাভ না হওয়ায়, বিজয়কৃষ্ণ কলকাতায় এসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বুঝতে পারেন যে, বিজয়কৃষ্ণ এখন একজন সাধনপথের যাত্রী এবং সাধনায় সিদ্ধিলাভ তিনি করতে সমর্থ। তিনি তাকে বলেন, ‘বিজয়, এবার পূর্ববঙ্গে গিয়ে তোমাকে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে মন দিতে হবে।’ বিজয়কৃষ্ণ মহর্ষির কথায় পূর্ববঙ্গে যাওয়া মনস্থ করেন। পূর্ববঙ্গে এসে আবার তার গুরু ব্রহ্মানন্দ স্বামীর কথা মনে পড়ে। তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচারকার্য শুরু করার আগে প্রসিদ্ধ শিব তীর্থ চন্দ্রনাথ পাহাড়ে তপস্যায় যেতে মনস্থ করেন।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যখন তপস্যারত, সেইসময় বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী এবং বেণীমাধব ওই পর্বত শৃঙ্গেরই একটি গুহায় সাধনারত। একদিন সেই পাহাড়ে দাবানল জ্বলে উঠে সারা অরণ্যভূমিকে গ্রাস করতে থাকে। যোগবলে বাবা লোকনাথ জানতে পারেন যে সেই দাবানলের মধ্যে একজন তপস্বী সাধনারত যাকে যে কোনো সময় দাবানল গ্রাস করতে পারে। তিনি যোগে এও জানতে পারেন যে ওই তপস্বী তার গুরু হিতলাল মিশ্র তথা তৈলঙ্গস্বামীর শিষ্য অর্থাৎ এই যোগী তার গুরুভ্রাতা এবং এই সাধকের সঙ্গে তিনি পারিবারিক সূত্রে আবদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে সেই তপস্বীর রক্ষার্থে তিনি সূক্ষ্মদেহে দাবানলে প্রবেশ করে দুই হাতে সেই বিরাট বপু তপস্বী বিজয়কৃষ্ণকে তুলে দাবানলের বাইরে এনে একটি পাথরের উপর বসিয়ে দিয়ে স্ব-স্থানে ফিরে যান। সেই তপস্বী জানতেও পারেনা যে কে তাঁকে ওই পাথরের উপর বসিয়ে দিয়ে গেলেন।

যখন বিজয়কৃষ্ণের ধ্যান ভঙ্গ হলো, তিনি দেখলেন তিনি যেখানে ধ্যানে বসেছিলেন, এটা সে জায়গা নয়। সেই জায়গা দাবানলে ভস্মীভূত, কিন্তু তিনি সুরক্ষিত। তিনি ভাবতে লাগলেন, দাবানলে যখন সমগ্র অরণ্যাঞ্চল ভস্মীভূত হয়ে গেছে, তখন তিনি দাবানল থেকে রক্ষা পেয়ে কিভাবে এখানে এলেন? সেই প্রশ্নের উত্তর তিনি তখন পেলেন না। মনে সেই প্রশ্ন নিয়েই তিনি চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান। ঢাকা শহর ছিল তখন পূর্ববাংলার প্রধান সাংস্কৃতিক শহর। বিজয়কৃষ্ণ এখানে এসে গেণ্ডারিয়া গ্রামে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন এবং সেখান থেকে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার শুরু করলেন। কিন্তু তার মন থেকে তিনি ঈশ্বর দর্শনের বাসনাকে মুছে ফেলতে পারলেন না। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারের ফাঁকে এই আশ্রমে তিনি একান্তভাবে চতুর্ভূজ নারায়ণের ধ্যানে মগ্ন হলেন। শান্তিপুরে শ্যামসুন্দরের দিব্যকান্তি দর্শনের অভিজ্ঞতাকে তিনি ভুলতে পারেন নি। শ্যামসুন্দর তাদের কুলদেবতা। সেইজন্য ব্রহ্মদর্শনের জন্য তিনি নারায়ণের ধ্যান করার পথই অবশেষে বেছে নিয়েছিলেন। যখন তিনি পরমপুরুষ স্বরূপ নারায়ণকে ধ্যান করতে লাগলেন, তখন একসময় তার মধ্যে এক অলৌকিক শক্তি সঞ্চারিত হল এবং এতদিনে তিনি দিব্যজ্যোতি সম্বলিত নারায়ণকে তার সম্মুখে দেখতে পেলেন। তার ঈশ্বর দর্শনের আশা পূর্ণ হলো। কিন্তু নারায়ণের অত্যুজ্জ্বল জ্যোতিপ্ৰভার তেজ তিনি সহ্য করতে পারলেন না। সংজ্ঞা লোপ পেয়ে তার নিঃসার দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এর থেকে বোঝা যায় যে, বিজয়কৃষ্ণের দেহকে তৈলঙ্গস্বামী শুদ্ধ করে দেবার পর ব্রহ্মানন্দ স্বামীর গুরুমন্ত্রের জোরে তার ঈশ্বরদর্শন সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তার দেহ যেহেতু যোগসাধনার মাধ্যমে দেবতেজ ধারণ করার মতো পটু তখনও হয়নি, সেজন্য তিনি সেই তেজে সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন। এরপর সেখানে তার গুরুর আবির্ভাব ঘটে এবং তাঁর পুণ্যস্পর্শে বিজয়কৃষ্ণ সংজ্ঞা ফিরে পান। এইসময় গুরুদেব তাকে বলেন, বিজয়, তুমি নিজেকে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছ। অর্জন করেছ দীক্ষাদানের ক্ষমতা। এবার থেকে তুমি ঈশ্বর সন্ধানীদের দীক্ষা দিতে পারো। এইসময় থেকেই তিনি গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নামে পরিচিত হন। এই আশ্রমে তিনি তার সহধর্মিনী যোগমায়াদেবী ও শশ্রুমাতা মুক্তকেশী দেবীর সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। গুরুদেবের কথা মতো এরপর তিনি গৃহাশ্রমে থেকেই সাধনমার্গে বিচরণ করতে থাকেন। এই আশ্রমেই তিনি অষ্টসিদ্ধি লাভ করেন।

শ্রীগীতার একাদশ অধ্যায়ে পাওয়া যায় যে অর্জুন যখন শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন, তুমি নিজ চর্মচক্ষুর দ্বারা আমার বিশ্বরূপ দেখতে সমর্থ হবে না। আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্রদান করছি। সেই চক্ষুদ্বারা তুমি আমার ঈশ্বরীয় যোগশক্তি দর্শন করো (একাদশ অধ্যায়, ৮ম শ্লোক)। অর্থাৎ ঈশ্বরের দেহে যে অমিত তেজসম্পন্ন দিব্যজ্যোতি বিরাজমান থাকে, তা মানুষের চর্মচক্ষু সহ্য করতে পারে না। সেই তেজ সহ্য করার জন্য মানব দেহকে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে যোগসাধনার দ্বারা দিব্য দেহে পরিণত করতে হয়। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বা তৈলঙ্গস্বামী এই কাজ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ধর্মপথের বহুদিনের যাত্রী হলেও, অনেকটা সময় তার ব্যয় হয়েছিল সাকার আর নিরাকার উপাসনার দোলাচলে। বাবা লোকনাথ যখন তার পঞ্চভূত দেহকে দেবদেহে পরিণত করেছিলেন তখন অষ্টাদশ সিদ্ধি তাঁর করায়ত্ত এবং তিনি নিজ দেহে জীবাত্মাকে পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলিত করে পূর্ণব্রহ্ম হয়েছেন। গোঁসাইজি যখন চতুর্ভূজ নারায়ণের দর্শন পান, তখন তিনি অষ্টসিদ্ধি প্রাপ্ত হন এবং তখনও তিনি ব্রহ্ম দর্শন করেননি। অর্থাৎ তার দেহ ব্ৰহ্মস্বরূপ হয়নি। সেইজন্য তার দেহ নিঃসার হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়েছিল। অনেক সাধক এইরূপ অবস্থায় প্রাণও ত্যাগ করতে পারেন। কেননা দিব্যতেজ পঞ্চভূত শরীরের আধার ধারণ করতে সমর্থ নয়। এক্ষেত্রে ঠিক সেই সময় গোঁসাইজির গুরুদেব উপস্থিত হয়ে তাকে রক্ষা করেন। একবার বৃন্দাবনে আমি যখন শ্রীকৃষ্ণের দর্শনাভিলাষি হয়ে তার সব লীলাক্ষেত্র বিচরণ করছিলাম, তখন জানতে পারি যে নিধুবনে একজন কৃষ্ণভক্ত রাতে লুকিয়ে রাধাকৃষ্ণের লীলা দেখতে চেষ্টা করেছিলেন। সেখানে রাতে ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ভিতরে কেউ থাকতে পারে না। পরদিন সকালে যখন নিধুবনের প্রধান ফটক খোলা হয়, ভিতর থেকে অন্ধ এক পাগল ভক্ত প্রায় চিৎকার করতে করতে বলে, ‘সব উজালা হ্যায়, সব উজালা হ্যায়’। আর রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। পরে তার বাড়ির লোক সেখানে এসে বলে যে সে কৃষ্ণকে দেখার অভিলাষে নিধুবনে আগের দিন লুকিয়ে ছিল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণলীলা দেখার সেই অভিলাষ পূর্ণ করতে গিয়েই সে চিরতরে অন্ধ ও পাগল হয়ে যায়। পথে পথে সে কেবল পাগলপ্রায় হয়ে রাধাকৃষ্ণের উজ্জ্বল আবির্ভাবকে সব উজালা হ্যায় বলেই ব্যক্ত করতে থাকে। কোনোদিন সে আর ভালো হয়নি। এই ঘটনাও প্রমাণ করে যে ঈশ্বরকে এই পঞ্চভূত দেহের চক্ষু দর্শন করতে সমর্থ নয়। একমাত্র উচ্চমার্গের যোগীরাই তার সরাসরি দর্শন করতে পারেন। ঈশ্বর সেইজন্য যখন কোনো ভক্তকে দেখা দেন, হয় তিনি রূপ পরিগ্রহ করে দেখা দেন, অথবা তন্দ্রায় বা স্বপ্নে দেখা দেন। যোগী বা সাধকরা আজ্ঞাচক্রে মানসচক্ষে উজ্জ্বল আলোয় পরমেশ্বরকে দেখতে সক্ষম হন। ধ্যানাবস্থায় বা সমাধিকালে এইরকম দর্শন হয়ে থাকে। যোগশক্তি মানবদেহের সুপ্ত অবস্থায় যে দেবতাদের বাসস্থান আছে, তাকে জাগ্রত করে তোলে এবং সুষুম্না নাড়ির অভ্যন্তরস্থ ব্রহ্মনাড়িতে সঞ্চিত ওজঃকৈ আজ্ঞাচক্রে এবং মস্তকস্থিত সহস্রাধারে প্রেরণ করে দেহকে দিব্যতেজ ধারণক্ষম করে তোলে।

অষ্টসিদ্ধি লাভ করার পরে গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ যোগবলে জানতে পারেন যে এইরূপ এক ঈশ্বরকোটির মহাযোগী বারদী গ্রামে আত্মগোপন করে আছেন। সেই যোগীর বয়স তখন ১৫১ বৎসর। গোঁসাইজির খুব সাধ হল বারদী গিয়ে সেই মহাপুরুষকে দর্শন করার।

একদিন তিনি সহধর্মিনী যোগমায়াদেবী, শশ্রুমাতা মুক্তকেশীদেবী ও কয়েকজন অন্তরঙ্গ ভক্তকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ব্ৰহ্মপুত্ৰ বেয়ে বারদীর পথে রওনা হলেন। গোঁসাইজি সাধন জীবনে বিভিন্ন মত ও পথের মধ্য দিয়ে অবশেষে সাকার-এর আরাধনা করেই মুক্তির পথের সন্ধান পেয়েছেন। জন্ম হয়েছিল তার বৈষ্ণব পরিবারে, তারপর হলেন ব্রাহ্ম, ব্রাহ্ম থেকে সন্ন্যাসী, আবার ব্রাহ্ম এবং তারপর আবার সেই জন্মকালীন বৈষ্ণব। গুরু তাঁকে জীবের কল্যাণের জন্য সংসারে থাকতে বলেছেন এবং ঈশ্বর দর্শনের পর মুক্তিকামী মানুষকে পথ দেখাবার জন্য দীক্ষা দান করবার অধিকার দিয়েছেন। তখন তিনি এক কৃষ্ণপ্রেমী বৈষ্ণবাচার্যরূপে মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলেছেন। ভক্তিরসের আধাররূপে তিনি সদাই সমাধিস্থ থাকেন। তাঁর মাথায় বিরাট জটা, হাতে কমণ্ডলু এবং পরনে গৈরিক বসন। তার গলায় সর্বদা থাকে তুলসী ও রুদ্রাক্ষের মালা এবং কপালে বৈষ্ণবধর্মী তিলক। ঢাকায় গেন্ডারিয়া আশ্রম থেকে পরিব্রাজনকালে তিনি হাজার হাজার ভক্তকে দীক্ষা দিয়েছেন এবং প্রেমভক্তির রস বিতরণ করেছেন। ভারতের উচ্চকোটির সাধক সমাজে এখন তিনি একজন শক্তিধর সাধক রূপে সমাদৃত। রামদাস কাঠিয়া বাবা তার সম্বন্ধে বলেছেন, গোঁসাইজি একজন মহাসমর্থ পুরুষ, সাক্ষাৎ মহেশ্বর। তিনি যেমন তেজস্বী, তেমনই প্রেমিক। আজ তিনি চলেছেন এক পরম পুরুষের সাক্ষাৎ করতে।

পৌষ মাস শীতের সকাল। সেদিন বাবা লোকনাথ খুব ভোরে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন। সেখানে তখন গোঁসাইজির ভক্তশিষ্য কামিনীকুমার নাগ বসেছিলেন। কামিনীবাবু ব্রহ্মচারী বাবার কৃপালাভের জন্য প্রায়ই আসেন। কিন্তু এত ভোরে বাবাকে কখনও আসন ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেননি। বাবাকে দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। কামিনীবাবুকে বারান্দায় দেখে বাবা বললেন, ওরে কামিনী আজ আমার বড়ো আনন্দের দিন। আজ আমার জীবনকৃষ্ণ আসছে। গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণকে বাবা লোকনাথ জীবনকৃষ্ণ বলে ডাকতেন। গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ ছিলেন কামিনীবাবুর গুরুদেব। গুরুদেব বারদী আশ্রমে আসছেন, এই কথা বাবার মুখে শুনে কামিনীবাবু একটু অবাক হলেন। কেননা, গুরুদেব তাকে কখনও এখানে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। কামিনীবাবু তখন বাবা লোকনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা, গুরুদেব মেঘনার পথে আসছেন না ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আসছেন? বাবা লোকনাথ তখন শিশুর মতো উল্লাসে বলে উঠলেন, ওরে ঘাটে তার নৌকা ভিড়েছে। ওর সঙ্গে আসছে আমার মা ও দিদিমা। জীবনকৃষ্ণ ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আসছে। চামার বাড়ির কাছে চড়ে তার নৌকা আটকে গেছে। এখুনি তোরা যা, তাঁকে নিয়ে আয়।

বাবার কথা শুনে কামিনীবাবু, হরিশচন্দ্র রায় এবং আরও কিছু ভক্ত ঘাটের পথে রওনা হলেন। চামার বাড়ির কাছে পৌঁছে তারা দেখেন সত্যিই একটি নৌকা চড়ায় আটকে গেছে। তারা সবাই মিলে তখন ঠেলে নৌকাটি জলে নামিয়ে দিলেন। নৌকাটি এবার ধীরে ধীরে ঘাটে এসে ভিড়ল। ইতিমধ্যে গোঁসাইজির আগমনের খবরে তার অনেক ভক্ত সেখানে পৌঁছে গেছে। কামিনীবাবু গোঁসাইজিকে পথ দেখিয়ে বারদীর আশ্রমে নিয়ে গেলেন।

লোকনাথ বাবা ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন। গোঁসাইজি ঘরের বারান্দায় উঠে বিস্ময়বাক্যে বলতে লাগলেন, ‘এ কি স্বর্গীয় দৃশ্য দেখছি কামিনী! চারিদিকেই দেবদেবী! ঘরের সব জায়গায় দেবদেবী। আমার সম্মুখে এই মহাপুরুষের দেহে ও বস্ত্রেও সব দেবদেবীর অবস্থান। আমি দেখছি, তার দেহের প্রতি রোমকূপে এবং কোষমধ্যে দেবদেবী অবস্থান করছেন, তার প্রতি রোমকূপ থেকে অগ্নিশিখা বেরোচ্ছে। এ আমি কি দেখছি!’ কামিনীবাবু গুরুদেবের এইসব কথার কোনো মর্ম বুঝতে না পেরে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মহাযোগী মহাপুরুষের যে মহিমা অচিন্ত্যনীয় ও অলৌকিক যা সাধারণ মানুষের বোধের অতীত, সেই মহিমা তাঁর গুরুদেব স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করছেন। যে মহাযোগীকে তারা নিত্য দেখে আসছেন একজন মহাযোগীরূপে, তার গুরুদেব তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করছেন সব দেবদেবীর অবস্থান, প্রত্যক্ষ করছেন তার ঘরের সর্বত্র দেবদেবীর অবস্থান, তার শরীরে প্রত্যক্ষ করছেন অগ্নিশিখা, এ-কি আশ্চর্য ব্যাপার (মানব দেহের অধিকাংশস্থান অগ্নিদেব অধিকার করে থাকেন)! আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন কামিনীবাবু ও অন্যরা। তাদের দু-চোখ অশ্রুপ্লাবিত হতে লাগল। সেইসময় কামিনীবাবু প্রত্যক্ষ করলেন, বাবা লোকনাথের নয়নযুগল হতে এক দিব্য জ্যোতিপ্রবাহ বেরিয়ে এসে গোঁসাইজির শরীরে প্রবেশ করছে এবং সেই সঞ্চারিত জ্যোতিপ্রবাহে গোঁসাইজির শরীর দীপ্ত হয়ে উঠেছে। এরপর বাবা লোকনাথ দুই বাহু প্রসারিত করে গোঁসাইজিকে তার বুকে চেপে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে গোঁসাইজি বাবার চরণতলে লুটিয়ে পড়লেন। বাবা তাকে দু-হাতে তুলে পুত্রবৎসল পিতার মতো আবার তাকে বুকে টেনে নিলেন।

এইসময় কামিনীবাবু দেখলেন, লোকনাথ বাবার দেহ থেকে নির্গত হওয়া তড়িৎশিখার দিব্যস্পর্শে গোঁসাইজির বিরাট বপু লতার মতো কাঁপছে। এক অদ্ভুত অস্পষ্ট হু-হু ধ্বনি তার মুখবিবর থেকে বার হয়ে ঘরের ভিতসুদ্ধ প্রবলভাবে কাঁপিয়ে তুলছে। এমনভাবে বজ্রপাতের মতো সমস্ত ঘর কাঁপছে, মনে হচ্ছে যেন সব এক্ষুনি ভেঙ্গে পড়বে। কিছুক্ষণ এই অবস্থায় গোঁসাইজিকে ধরে রেখে বাবা ছেড়ে দিলেন। যেই বাবা তাকে ছেড়েছেন, কাঁপতে কাঁপতে গোঁসাইজি পড়ে যাচ্ছিলেন। মহাপুরুষের দেহ থেকে নির্গত যোগশক্তি যখন গোঁসাইজির দেহে সঞ্চারিত হয়, তখন তার শরীরে যে কম্পনের সৃষ্টি হয়, গোঁসাইজি তা ধারণ করতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিলেন। গোঁসাইজিকে ভাবাবস্থায় পড়ে যেতে দেখে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভক্ত তাঁকে ধরে একটি কম্বলের আসনে বসিয়ে দিলেন। বাবা লোকনাথ গোঁসাইজির দেহে ব্রহ্মশক্তি সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। এ তার এক বিশেষ কৃপা, যে কৃপা কেবল গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণই পেয়েছিলেন। অন্যান্য ভক্তদের মধ্যে বাবা লোকনাথ যে শক্তি সঞ্চারিত করেছিলেন, এই ব্রহ্মশক্তি ছিল তার থেকে অনেক উচ্চ পর্যায়ের। ব্রহ্মশক্তির প্রবাহে গোঁসাইজির দেহে এক অনন্য দিব্যভাবের সৃষ্টি হলো।

বাবা লোকনাথ তখন কানাই কবিরাজকে ডেকে বললেন, একটা ছেলে আমার জন্য একটা পাকা বেল নিয়ে আসছে। দৌড়ে গিয়ে বেলটা নিয়ে আয়। আমি খাব।

এই কথা শুনে কানাই কবিরাজ খুব বিস্মিত হলেন কেননা লোকনাথ বাবা দিনের শেষে একবার আহার করেন। আর আজ এই সকালবেলায় বাবা বেল খেতে চাইছেন! বাবার কথামতো কানাইবাবু দৌড়ে আশ্রমের বাইরে গিয়ে দেখে একজন ছেলে একটি বেল নিয়ে আশ্রমের দিকে আসছে। তিনি দৌড়ে গিয়ে ছেলেটির হাত থেকে বেলটা নিয়ে এসে বাবাকে দিলেন। লোকনাথ বাবা বেলটা নিয়ে নিজে ভেঙ্গে কিছুটা নিজের জিভে ঠেকিয়ে গোটা বেলটা নিজের হাতে গোঁসাইজিকে খাইয়ে দিলেন। বেলটা খাবার পর গোঁসাইজির দেহ স্থির হলো।

কিছুক্ষণ পরে গোয়ালিনী স্নান সেরে এসে ব্রহ্মচারী বাবাকে প্রণাম করলেন। গোঁসাইজিকে সেখানে উপবিষ্ট দেখে তিনি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কে বাবা?

গোয়ালিনী মা-র জিজ্ঞাসা শুনে বাবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। হাসিমুখে তিনি মা-কে বললেন, এটি ঘরের ছেলে। তোমার শিশু সন্তান। আমি ওর পিতামহের খুড়ো।

গোয়ালিনী মা আশ্রম জননীরূপে বারদীতে পরিচিত। তাঁর বয়স আশির অধিক, কিন্তু বাবার কৃপায় তাকে বার্ধক্য ছুঁতে পারেনি। গোয়ালিনী মা যখন বাবার মুখে শুনলেন এটি ঘরের শিশু সন্তান, তিনি তখন বিরাট বপু গোঁসাইজিকে আপন শিশুর মতো কোলে তুলে নিয়ে স্তন্যপান করাতে লাগলেন। সিদ্ধিবলে গোঁসাইজির দেহ অত্যন্ত হাল্কা শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিল। উপস্থিত ভক্তগণ বিরাট বপু গোঁসাইজিকে দেখলো, মায়ের কোলে তিনি এমন শিশুবৎ অবস্থান করছিলেন। বাবা লোকনাথের কৃপায় ৮০ বছর উত্তীর্ণ এক বৃদ্ধার স্তনে দুধ এসেছিল, যদিও তাঁর কোনোদিন কোনো সন্তান হয়নি এবং পূর্বে কখনও তার স্তন ক্ষরণ হয়নি। শিশু বিজয়কৃষ্ণ গোয়ালিনী মা-র কোলে শুয়ে স্তনামৃত পান করছিলেন। এই দৃশ্য সেদিন সমবেত ভক্তগণ প্রত্যক্ষ করে জীবন ধন্য করেছিল। এই অলৌকিক ঘটনার কথা বারদী ছাড়িয়ে দ্রুত সারা বাংলাতে ছড়িয়ে পড়েছিল। উপস্থিত ভক্তগণ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ, বাবা লোকনাথ ও গোয়ালিনী মা-র জয়ধ্বনি করতে লাগল।

গোয়ালিনী মার স্তনামৃত পান করে গোঁসাইজি যখন মায়ের কোল থেকে উঠে বসেছেন, তিনি প্রত্যক্ষ করলেন ঘরের চারিপাশে অঙ্গজ্যোতি বিচ্ছুরিত করে হাসিমুখে বসে আছেন বাবা লোকনাথ। তাঁর অঙ্গের দিব্যজ্যোতিতে চারিদিক উদ্ভাসিত। এ তো কোনো মানবের হতে পারে না। গোঁসাইজি চেঁচিয়ে ওঠেন, এ কি দৃশ্য দেখছি আমি! ব্রহ্মজ্যোতি সমন্বিত এক দিব্যপরমপুরুষ বসে আছেন। তাঁর দিব্যদেহে অসংখ্য দেবদেবী তাদের আভা সমন্বিত হয়ে বিরাজ করছেন। ব্ৰহ্মজ্যোতি সমন্বিত পরমপুরুষ কখনও চতুর্ভুজ মূর্তি, কখনও মহেশ্বর, আবার কখনও করাল বদনা কালী। একই দেহে এত দেবদেবীর উপস্থিতি কি করে সম্ভব! ইনি কি স্বয়ং নারায়ণ, না কি স্বয়ং মহেশ্বর। অথবা ব্রহ্মময়ী আদিশক্তি মহাকালী। একই দেহে শিব ও শিবার অবস্থান কি করে সম্ভব! এই দিব্য দর্শন অর্থাৎ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর স্বরূপ দর্শন, অর্থাৎ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মধ্যেই যে সৃষ্টির পালনকারী দেবতা চতুর্ভূজ নারায়ণ, সৃষ্টি সংহারকারী দেবতা শিব এবং ব্রহ্মশক্তি আদ্যামাতার অবস্থান, সেইরূপ গুরু ভগবান গাঙ্গুলি, তৈলঙ্গ স্বামী, আব্দুল গফফর এবং গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ভিন্ন আর কেউ এমন প্রত্যক্ষ দর্শন করেননি। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর স্বরূপ কী, এই কথা জানতে গেলে ভক্তদের এই দৃশ্য স্মরণ করতে হবে এবং তা নিজের মধ্যে মনন করে নিদিধ্যাসন করতে হবে। তবেই দর্শন হবে সেই পূর্ণজ্যোতি পূর্ণব্রহ্ম বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর।

বাবা লোকনাথের এইরকম দিব্যজ্যোতিসম্পন্ন ঈশ্বরীয় রূপের কথা যখন গোঁসাইজি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ব্যক্ত করছেন, তখন বাবা তাকে বলেন, ওরে তুই চুপ কর। তুই আজ হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিলি। কিছুই গোপন থাকতে দিলিনা। সবার সামনে সব প্রকাশ করে ফেললি। এতদিন শান্তিতে ছিলাম। বারদীর মাটি বাবার এই দিব্যরূপ প্রকাশে ধন্য হয়ে গিয়েছিল। সেই মাটি ব্রহ্মপুরুষের স্পর্শে আজও পবিত্র হয়ে আছে।

গোঁসাইজি দিব্যদর্শনে একটু ধাতস্থ হয়ে কিছুটা অভিমানের সুরে বাবাকে বললেন, এতদিন আমার উপর দয়া করেননি কেন?

বাবা লোকনাথও সমান অভিমানের সুরে বললেন, তুইও তো সমান পাষাণ। বাবা লোকনাথের এইরূপ বলার তাৎপর্য ছিল যে ঈশ্বর দর্শনের জন্য পাহাড়, পর্বত, বন, জঙ্গল, বৈষ্ণব সমাজ, ব্রাহ্ম সমাজ অনেক তো ঘুরে বেরিয়েছিস, কই আমার কথা তো তোর মনে হয়নি। এরপর দুজনে অন্তরঙ্গভাবে অনেক আধ্যাত্ম আলোচনা করলেন।

গোঁসাইজির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বাবা লোকনাথ তাঁকে বললেন, জীবনকৃষ্ণ, চন্দ্রশেখর পাহাড়ের দাবানলের কথা তোর মনে পড়ে কি?

গোঁসাইজি চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কথা শুনে চমকে উঠলেন। তার স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে উঠল সেই ভয়ানক দাবানলের কথা। তিনি চন্দ্রশেখর পাহাড়ে ধ্যানাবিষ্ট। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে এক ভয়ানক দাবানলের সৃষ্টি হয়ে সমস্ত বনাঞ্চল তার গ্রাসে যেতে লাগল। চারিদিকের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে তিনি উপবিষ্ট। তার পক্ষে কোনোদিকে যাবার উপায় ছিল না। হঠাৎ কোন মহাশক্তিধর পুরুষ বায়ুর গতিতে সেই গগণভেদী অগ্নিশিখার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে তার দেহকে শূন্যে তুলে নিয়ে এক নিরাপদ স্থানে রেখে আবার অদৃশ্য হয়ে গেলেন। যখন এই ঘটনা ঘটল তখন তিনি এক মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। বাহ্যজ্ঞান ফিরলে তিনি দেখেন যে তার দেহ দাবানলের অগ্নিশিখা থেকে উদ্ধার করে কে যেন এই নিরাপদ স্থানে রেখে গেছেন। কে সেই মহাশক্তিধর পুরুষ তিনি আজও তা জানতে পারেননি। বাহ্যজ্ঞান ফিরলে চারিদিকে ধ্বংসাবশেষে তিনি চন্দ্রনাথ পাহাড়ে সেই মহাশক্তিধরের অনেক অনুসন্ধান করেছিলেন কিন্তু কারও দর্শন পাননি। তখন বাবা লোকনাথ সেই রহস্যের ভাজ তার কাছে উন্মোচন করে বললেন, সেদিন চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আমিই তোকে রক্ষা করেছিলাম। গোঁসাইজি কৃতজ্ঞনেত্রে অবাক বিস্ময়ে এই পরম পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই পূর্ণব্রহ্ম পরমপুরুষকে দেখতে দেখতে তার স্মৃতিপটে আর একটি কথা ভেসে ওঠে।

তিনি সিদ্ধিলাভের পর ঈশ্বর দর্শনাভিলাষে হিমালয়ে ভ্রমণ করতে করতে একবার প্রায় মানস সরোবরের কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি কতিপয় মহাশক্তিমান সাধককে ধ্যানস্থ অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাদের কাছে গেলেন। তিনি যখন ভক্তিযুক্ত চিত্তে তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, তখন হঠাৎ একজন সাধক চোখ খুলে গোঁসাইজিকে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করলেন, তারপর বললেন, তুই এখানে এসেছিস কেন? ঢাকায় তোর আশ্রমের কাছেই আমাদের চেয়েও বড়ো এক মহাযোগী আছেন। তুই তার কাছে যা। তাহলেই তোর অভিলাষ পূরণ হবে। গোঁসাইজি তখনও বারদীর ব্রহ্মচারীর কথা জানতেন না। সেখান থেকে ফেরার পর তিনি বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর যোগৈশ্বর্যের কথা জানতে পেরে বারদী আসার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। বারদী আশ্রমে পদার্পণ করেই তিনি যে-সব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন তাতেই তার মনে হয় যে হিমালয়ের সেই সাধক তাকে সঠিক পথই দেখিয়েছিলেন। এখানে না এলে একজন পূর্ণব্রহ্ম ব্রহ্মচারীর ব্যতিক্রমী রূপ তিনি কোনোদিনই দর্শন করতে পারতেন না। একই দেহে তার সর্ব দেবদেবীর দর্শন হয়ে গেল। এই সময়ে তার এই কথাও স্মরণ হল যে একবার দ্বারভাঙ্গায় যখন তিনি মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন তিনি শুনেছিলেন কোনো এক মহাপুরুষ এসে তার বিছানার পাশে বসে তাকে স্পর্শ করেছিলেন এবং তারপরই তার স্পন্দনহীন দেহে জীবনের স্পন্দন ফিরে আসে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে এই মৃত্যুঞ্জয়ী পুরুষ তাকে রক্ষা করেছিলেন। গোঁসাইজি এক মৌনকৃতজ্ঞ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এই মহাপুরুষের কাছে দুবার তাঁর জীবন রক্ষার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।

গোঁসাইজির সহধর্মিনী যোগমায়া দেবীও কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চিত্তে এই ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষকে দর্শন করে নিজের চোখকে সার্থক করেছিলেন। তিনি বাবাকে দেবার জন্য একখানি গরদের কাপড় সঙ্গে এনেছিলেন। সেই গরদের কাপড়খানি বাবার পায়ে রেখে প্রণাম করে তার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, যদি বাবা কৃপা করে এই কাপড়খানি পরেন।

বাবা লোকনাথ বললেন, এ কি, এটা পড়তে হবে না কি? এই কথা বলে তিনি গরদের কাপড়খানি চার টুকরো করে এক খণ্ড মাথায় বাঁধলেন, আর একখণ্ড কৌপীন করলেন। বাকি দুই খণ্ড উপস্থিত ভক্তদের দান করে দিলেন। বাবার এই আচরণ বর্তমান সাধু সমাজে এই বার্তা বহন করে যে, যিনি প্রকৃত সাধক হন, তার কোনো বস্তুর উপর মায়া বা মোহ থাকতে নেই। বাবা নিঃসঙ্কোচে মুহূর্তের মধ্যে একটি দামি গরদের কাপড়কে চারফালা করে ফেললেন। এমন দৃশ্য দেখার ভাগ্য বর্তমানে ভক্তদের খুব কমই ঘটে।

এরপর বাবা গোঁসাইজির শ্বমাতা মুক্তকেশীদেবীকে জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়ের কি নাম রেখেছ গো?

মুক্তকেশীদেবী বাবাকে বললেন, যোগমায়া।

বাবা নাম শুনে বললেন, বাঃ চমঙ্কার। যোগমায়া শব্দের অর্থ জানো? যে অপ্রাকৃত মায়াকে আশ্রয় করে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ লীলা করেছিলেন, তাই হচ্ছে যোগমায়া। ঠিক নামই রেখেছ।

এরপর হঠাৎ বাবা যোগমায়াদেবীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, মা, আজ তুই আমায় নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে পারবি?

যোগমায়া দেবী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন, কেন পারবনা? দিচ্ছি রান্না করে।

এই কথা বলে যোগমায়া দেবী পাকশালায় যান বাবার জন্য ভোগ রান্না করতে। গোয়ালিনী তাকে সেই কাজে সহায়তা করেন।

ভোগ রান্না শেষ হলে থালায় করে ভোগ নিয়ে যোগমায়াদেবী বাবা লোকনাথের সামনে নিবেদন করেন।

বাবা লোকনাথ তখন বলেন, মা, আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিবি?

একথা শুনে যোগমায়া দেবী ইতস্ততঃ করতে থাকেন। সেই দেখে গোঁসাইজি তাকে বলেন, দাও না খাইয়ে।

যোগমায়া দেবী তখন থালার পাশে বসলেন। লোকনাথ বাবা তাকে বললেন, মা বাঁ হাতে আমার ঘাড় ধরে ডান হাত দিয়ে আমায় খাইয়ে দে। যেমন ছোট ছেলেকে তার মা খাইয়ে দেয়। আর বলবি, বাছা খেয়ে নে, নইলে মারবো। তবেই তোর হাতে খাব।

লোকনাথ বাবা যেমনভাবে বললেন, যোগমায়াদেবী ঠিক তেমন করেই বাবাকে খাইয়ে দিলেন। খেতে খেতে বাবা বললেন, আমিও খাই, তুইও খা।

যোগমায়া দেবী তখন বাবার কথামতো দু-এক গ্রাস থালা থেকে নিয়ে নিজের মুখে দিলেন। এরপর বাবা বললেন, এখন আমি নিজেই খাব। এই বলে তিনি নিজে খেতে লাগলেন। খেতে খেতে তিনি যোগমায়াদেবীকে বললেন, মা তুই এবার আমার হাত চেপে ধরে বলবি, বাবা আর খাসনে, অসুখ করবে। বাবা যখন আর একটু খেয়েছেন যোগমায়া দেবী তার হাত চেপে ধরে বললেন, বাবা, আর খাস নে, অসুখ করবে। এইভাবে বাবার বিচিত্র ভোগগ্রহণ পর্ব শেষ হলো।

বাবা যদিও যোগমায়া দেবীকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁকে কি করতে ও বলতে হবে, কিন্তু যোগমায়া দেবী একেবারে অকৃত্রিমভাবে বাবার শেখানো কথা এত মধুর কণ্ঠে বললেন যে বাবার স্মৃতিপটে তার মা কমলাদেবী যেমনভাবে তাকে খাওয়াবার সময় আচরণ করতেন, সেই কথা ভেসে উঠল। তিনি মুগ্ধ হয়ে ‘অহো’ ‘অহো’, এই বলে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে সমাধিস্থ হয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর বাবার সমাধি থেকে বুত্থান হলে ভক্তদের বললেন, বলতে পারিস তোরা, যযাগমায়াকে এত ভালোবাসি কেন?

বাবার এই কথা বলার অর্থ হলো, আজ বাবার ভোগগ্রহণ পর্ব যেভাবে সমাধা হল এমনটা কখনও ভক্তরা দেখেনি। তাদের মনে জন্ম নিয়েছে অনেক প্রশ্ন। অন্তর্যামী বাবা সেই ভক্তদের মনের ভাব বুঝতে পেরে নিজেই এই প্রশ্নের অবতারণা করেছেন।

একজন ভক্ত বলে ওঠে, জগৎ শুদ্ধ লোকে যে তাকে ভালোবাসে, তাই।

তখন বাবা বললেন, ঠিক বলেছিস। সবাই যাকে ভালোবাসে, সেই তো জগতের মা। যেন রাধা ঠাকুরানী। শ্রীরাধা জগজ্জননী আহ্লাদিনী শক্তি। তিনি কৃষ্ণ কর্তৃক সংস্কৃয়মানা।

বাবা এখানে এইজন্য এই কথার অবতারণা করলেন যে, শ্রীরাধা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের শক্তির উৎস। যখন তিনি এই কথা বলছেন, তখন গোঁসাইজি দেখলেন, লোকনাথ বাবার চোখ থেকে এক দিব্যজ্যোতি বার হচ্ছে, তার মুখে মিষ্ট হাসি, তার দৃষ্টি যেন শূন্যে নিহিত রয়েছে। গোঁসাইজি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ব্রহ্মচারী বাবার সেই শাশ্বত অবস্থার রসাস্বাদন গ্রহণ করছেন।

বাবার যখন সমাধি থেকে বুত্থান হলো, তিনি গোঁসাইজির জিজ্ঞাসু নেত্রের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, তোকে দেখার জন্য বারদীর অনেক লোক উগ্রীব হয়ে আছে। তুই তো আমার একার নোস। যা, তুই তাদের কাছে যা। তখন গোঁসাইজি সেখান থেকে উঠে কামিনী নাগ মহাশয়কে সঙ্গে নিয়ে অন্য ভক্তদের বাড়ি গেলেন। পথে যেতে যেতে কামিনীবাবু গোঁসাইজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ঠাকুর, ব্রহ্মচারী বাবার মধ্যে কি দেখতে পেলেন?

গোঁসাইজি তাঁকে বললেন, আমার কথা কি তুমি বিশ্বাস করবে কামিনী?

কামিনীবাবু তার গুরুদেবকে বললেন, আপনার কথা বিশ্বাস করবো না কেন?

তখন গোঁসাইজি বললেন, দেখো কামিনী, আমি বহু সাধুসন্ন্যাসীর আশ্রমে গিয়েছি। কোনো আশ্রমে কিছুই দেখিনি। কোনো কোনো আশ্রমে কিছু কিছু দেখেছি। আবার এমনও হয়েছে যে, যতক্ষণ আমি সেই আশ্রমে থেকেছি, ততক্ষণই সেই সাধুর প্রভাব বুঝেছি। কিন্তু আশ্রম থেকে বার হয়েই সব ফাঁকা মনে হয়েছে। কিন্তু যে কথা শুনে আমি বারদীর আশ্রমে এসেছি, তার চেয়েও অনেক বেশি এখানে দেখতে পেয়েছি।

ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব জানার জন্য আমি বহু দেশে পর্যটন করেছি। বহু পাহাড় পর্বত ও তীর্থ ভ্রমণ করেছি। বহু সাধু-মহাত্মা দর্শন করেছি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অসংখ্য সাধু মহাপুরুষদের সঙ্গ ও কৃপা লাভ করেছি, কিন্তু বারদীর ব্রহ্মচারীর মতো এমন মহাশক্তিধর মহাপুরুষের দর্শন কোথাও পাইনি। সমস্ত ভারতবর্ষে এখন এমন উঁচু অবস্থার মহাপুরুষ আর নেই।

ব্রহ্মচারী বাবার সর্বাঙ্গ দেবদেবীময়। গাত্রবস্ত্র দেবময়। তার গৃহ পর্যন্ত দেবদেবীময়। তাঁর প্রতি রোমকূপেই দেবতা বিদ্যমান।

কামিনী, ব্রহ্মচারী বাবার দেহকান্তি, ললাট, ভ্রুযুগল, দৃষ্টি সবই অনন্য সাধারণ। তাঁর শরীরে মাংস নেই কিন্তু তার চর্মাবৃত অস্থিরাশি অপরূপ প্রভাদীপ্ত। তার হাত পায়ের কোমলতা ও স্নিগ্ধতা পদ্মরাগকেও হার মানায়। তার শরীরের তিলচিহ্ন গুলিও লোহিতবর্ণ। সবচেয়ে অলৌকিকত্ব তার অপার্থিব দৃষ্টিতে। তার দৃষ্টি সর্বদাই স্থির। তার ওই অপার্থিব দৃষ্টি বৈশিষ্ট্য হল সামনে শত শত ভক্ত বসে থাকলেও প্রত্যেকেরই মনে হবে তিনি যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছেন।

ব্রহ্মচারী বাবার দিব্যদেহে কোনো শারীরিক ধর্ম কিছুই দেখা যায় না। নিদ্রা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, হাই প্রভৃতি দেহধর্মগুলিকে তিনি জয় করেছেন। অগ্নিতে এই দেহ দগ্ধ হবার নয়। বরফেও এই দেহ বিকৃত হয়নি। যে সমস্ত প্রাকৃতিক কারণে আমাদের পঞ্চভৌতিক দেহ গলিত বা বিকৃত হয়, এই সিদ্ধপুরুষ মহাযোগবলে সেই সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে জয় করেছেন। তার শরীরের দিব্যভাব দেখে আমার মনে হলো, ব্রহ্মচারী বাবা ইচ্ছা করলে এখনই দেহত্যাগ করতে পারেন, আবার অনন্তকাল তিনি দেহধারণ করেও থাকতে পারেন।

তিনি আরও বললেন, ব্রহ্মচারী বাবা নিত্য যোগস্থ মহাপুরুষ। তার নয়নে কোনো লৌকিক দৃষ্টির আবির্ভাব হয় না। তার নয়নযুগল সর্বদাই সমাধিমগ্ন। তাঁর দেহ সর্বদাই অসার ও নিস্পন্দ বলে মনে হলো। কোনো কোনো সময়ে বোধ হল তার শরীর প্রাণহীন। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যাচ্ছিলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, আসনের উপর দেহটির মধ্যে মনে হচ্ছিল, তিনি তখন নেই, তখন কিন্তু তার চোখদুটি নিমীলিত হয়নি।

যিনি অখণ্ড চৈতন্যস্বরূপ, নিত্যস্বরূপ, যিনি অবিদ্যাদি সমস্ত ক্লেশ থেকে মুক্ত, যিনি জ্যোতিস্বরূপ আনন্দময় ব্রহ্ম, এমন শিবতুল্য যোগেশ্বর ব্রহ্মচারী বাবা এখন লোকাঁচারের আশ্রয় গ্রহণ করে লোকশিক্ষার জন্য ধর্মকর্ম করছেন।

ব্রহ্মচারী বাবার জ্ঞান অনন্ত, যোগবল অনন্ত এবং ভক্তি অনন্ত। এমন পূর্ণ পুরুষ আমার চোখে আগে কখনও পড়েনি। যিনি যেই মার্গের সাধক হোন না কেন, তিনি ব্রহ্মচারী বাবাকে সেই পথেরই দিশারী রূপে দেখবেন। আমি দেখেছি তার প্রতি রোমকূপে দেবতা। তাছাড়া, আমি তাকে চতুর্ভূজ, কালী, মহেশ্বর প্রভৃতি বিভিন্ন মূর্তিতে দেখেছি।

এই কথা হতে হতে গোঁসাইজি কামিনীবাবুর বাড়ি এসে গেছেন। কামিনীবাবু তাকে বললেন, ঠাকুর, আপনি যথার্থজ্ঞানী। তাই ব্রহ্মচারী বাবার ওইসব অপার্থিব অলৌকিকত্ব আপনার জ্ঞান চোখে ধরা পড়েছে। আমি যথার্থই ভাগ্যবান। এই পুণ্য মুহূর্তে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আমার কুটিরে পদার্পণ করছেন।

কামিনী নাগের বাড়িতে তখন গোঁসাইজির দর্শনের আশায় বহু লোকের সমাগম হয়েছে। গোঁসাইজি সকলকে দর্শন দিয়ে কীর্তনের আখড়ায় গিয়ে নাম সংকীর্তন করলেন, তারপর কয়েকজন শিষ্যের বাড়ি ঘুরে আখড়ার মহন্তকে সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে ফিরে এলেন। তাঁর মন ও দেহ জুড়ে যে আজ ব্রহ্মচারী বাবা বিরাজ করছেন। তারই ভাবের আবেশে তিনি আবৃত।

ব্রহ্মচারী বাবা গোঁসাইজির সঙ্গে মহন্তজিকে দেখে গৌরাঙ্গ ভজন গাইতে শুরু করলেন। আর মাঝে মাঝে জীবনকৃষ্ণ, জীবনকৃষ্ণ বলে ভাবে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। গোঁসাইজি স্থির দৃষ্টিতে দেখছেন আনন্দে আত্মহারা এই পরমপুরুষকে। তিনি দেখছেন তাঁর সামনে এক অমর্ত্য মহাপুরুষ যাঁর প্রতি রোমকূপে দেবদেবীর অত্যুজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এমন দৃশ্য না কেউ কখনও দেখেছে না শুনেছে। পূর্ণব্রহ্ম নিত্য সদানন্দ পুরুষ কেমন হয়, তা তিনি বারদী এসে প্রত্যক্ষ করে গেলেন এবং এই পূর্ণব্রহ্ম রূপের সঙ্গে জগতকে পরিচিত করিয়ে গেলেন। জগতের লোক এতদিন ব্রহ্মচারী বাবার যোগীরূপ দেখেছেন কিন্তু তার মতো সেই মহাপুরুষের পূর্ণব্রহ্ম স্বরূপ কেউ দেখতে সমর্থ হয়নি। আজও নিত্যস্বরূপ চিদানন্দময় বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর এই পূর্ণব্রহ্ম স্বরূপ তার ভক্তদের কাছে চাপা পড়ে আছে।

ব্রহ্মচারী বাবা কীর্তনের আবেশে ভাবে তন্ময় হয়ে গোঁসাইজিকে বললেন, জীবনকৃষ্ণ, তুই বারদী আশ্রমে না এলে আমাকেই তোর কাছে যেতে হতো। জানিস, আমি তোর পিতামহের আপন খুড়ো। পূর্বপুরুষের চিহ্ন হিসাবে আমি তোকে এই খড়ম জোড়া আর এই কম্বলখানা দিচ্ছি। এগুলো যত্ন করে রেখে দিস।

গোঁসাইজি শ্রদ্ধাযুক্ত মনে সেই খড়মজোড়া আর কম্বলটি গ্রহণ করলেন। তারপর আবার দুজনের মধ্যে ধর্মালোচনা শুরু হলো।

গোঁসাইজি বাবা লোকনাথকে বললেন, ভগবানের সৃষ্ট জীব হয়ে মানবদের মধ্যে কেউ তাকে ভজনা করে, আবার কেউ বা সে বিষয়ে বিমুখ হয়। এর কারণ কি? ভগবান আনন্দময়। কেউ তাকে প্রিয় ভাবে আবার কেউ তাকে স্বীকার করে না। কিন্তু সকল অবস্থার লোকেরাই আনন্দকে স্বীকার করে, আনন্দ চায়। এই আনন্দশক্তি সম্পন্ন ভগবানকে তবে কেউ কেউ অনাদর করে কেন? আর সেই অনাদরকারীদের অন্তিম গতি কি হয়?

গোঁসাইজির প্রশ্নের উত্তরে ব্রহ্মচারী বাবা বললেন, গুণভেদে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চারবর্ণ সেই আদিপুরুষ ভগবানের মুখ, বাহু, ঊরু ও পা থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তাদের মধ্যে যারা আপন আপন উৎপত্তিক্ষেত্র স্বরূপ ঈশ্বরকে লব্ধ গুণানুসারে ভজনা না করে অথবা অবজ্ঞা করে, তারা স্থানচ্যুত হয়ে অধঃপতিত হয়ে থাকে। শোন জীবনকৃষ্ণ, হরিকথা বলতে বা হরিলীলা কীর্তন করতে যাদের রুচি হয় না, তারা সাধু ব্যক্তির অনুকম্পার পাত্র। যেসব অন্ধবুদ্ধি ব্যক্তিরা বিষয়াসক্তিযুক্ত রজোগুণের প্রভাবে কাম, ক্রোধ, অহঙ্কারের বশীভূত হয়, সেই পাপিষ্ঠ ব্যক্তিরাই নিষ্ঠাবান সাধুদের পরিহাস করে ও ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করে।

ঈশ্বররূপী আত্মা যে-সকল দেহধারীর মধ্যেই অবস্থান করছেন, সকল মূর্খেরা তা বিশ্বাস করতে চায় না। বেদের তাৎপর্য না বুঝে অর্থাৎ আসল অর্থ না বুঝে ওইসব মূর্খেরা ইচ্ছানুসারে ধর্মাচরণ করে। ঈশ্বর সর্বজীবে জীবাত্মারূপে অবস্থান করেন। যে লোক অজ্ঞানবশে তা না বুঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, সে সংসারবন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। সংসারের মমতপাশে আবদ্ধ হলে কখনও বৈরাগ্য অভ্যাস করা যায় না। বৈরাগ্যে অভ্যস্ত না হলে ভগবৎ ভাব প্রকাশ হয় না।

আবার এ সংসারে এক শ্রেণির লোক আছে যারা পুরোপুরি মূর্খ নয়, আবার তত্ত্বজ্ঞানও লাভ করেনি। এমন সব মধ্যবর্তী লোক ধর্ম, অর্থ, কামকে প্রধান এবং দেহাদিকে নিত্য বলে মনে করে। আর যারা আত্মাকে অসৎ ভাবে তাদের সবাইকে আত্মঘাতী বলা হয়। এরা অজ্ঞানুকে জ্ঞান বলে বিবেচনা করে। ভবিষ্যতে এদের মনোরথ বিফল হলে এরা দারুণ দুঃখ পায়। ঈশ্বরপরান্মুখ এইসব লোকেরা ইচ্ছা না থাকলেও জীবন শেষে আত্মমায়া বিরচিত গৃহ, পুত্র, সুহৃদ্ ত্যাগ করে নরকে নিপাতিত হয়।

ব্রহ্মচারী বাবার কথা শুনে গোঁসাইজি বাবাকে বললেন, আজ্ঞে, আপনার বিশ্লেষণ শুনলাম। কিন্তু আরো সহজ করে যদি বলেন তো ভালো হয়। এখানে যে সব ভক্ত রয়েছে তাদের এ সব কথা শুনে চৈতন্যোদয় হতে পারে বলে আমার ধারণা।

ব্রহ্মচারী বাবা তখন বলেন, তুই তো বুঝেছিস। তুই-ই ওদের একটু গুছিয়ে বল না।

ব্রহ্মচারী বাবার আজ্ঞা শিরোধার্য করে গোঁসাইজি তখন উপস্থিত ভক্তদের বলতে লাগলেন, তোমরা শোন গো-শাস্ত্রে বলেছে, ভগবান জগন্ময়। বিশেষভাবে তিনি আনন্দময়। তবু লোকে তাকে ভুলে যায় কেন? ভগবান থেকেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ও অনুলোম-প্রতিলোমজাত সব মানুষই উৎপন্ন হয়েছে। সব মানুষই ভগবানের সন্তান ও শিষ্য। তাহলে সকলেরই পরম পিতা ও পরম গুরুরূপী আনন্দময় হরিকে ভজনা করা উচিত। তবে সংসারে কাউকে ভক্তিমান, কাউকে অভক্তিমান দেখার কারণ কি? ব্রাহ্মণাদির জন্ম ও কর্ম সত্ত্ব গুণময়, ক্ষত্রিয়দের সত্ত্ব রজোময়, বৈশ্যদের রজো তমোময় আর শূদ্রদের কেবলই তমোময়। ব্রাহ্মণাদি যদি নিম্নশ্রেণির ধর্ম ও কর্ম আচরণ করে, তবে তাদের অধোগতি হয়। শূদ্রাদি যদি উচ্চ অবস্থার ধর্মাচরণ করে, তবে তাদের উচ্চগতি হয়। স্থান, সহবাস, আচার-ব্যবহার যে অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হয়, মানুষ সেই অনুষ্ঠান অনুযায়ী স্বভাব পেয়ে থাকে। যেমন, কোনো সাধু লোকের হিতাহিত বিবেক উদয় হবার আগে তাকে যদি কোনো কদাচারীর সহবাসে রাখা যায়, তাহলে তার আচার-ব্যবহার ওই কদাচারীর মতোই হয়ে থাকে। আবার কোনো কদাচারীকে পবিত্রতার শিক্ষা বা অনুষ্ঠান করলে তাকে উন্নত করা যায়। এই উপায় শিক্ষার জন্যই ভগবান বর্ণাশ্রমের সৃষ্টি করেছেন। সত্ত্ব গুণাদির অনুষ্ঠানে যতদূর ভগবদ্ভক্তি ও আনন্দানুভূতি হয়, রজোঃ গুণাদির অনুষ্ঠানে ততদূর হয় না। ব্রাহ্মণাদির মনোবৃত্তি যদি জন্ম থেকে নিম্নগুণ সম্পন্ন হয়, তাহলে তাতে চিত্তের বিশুদ্ধি হ্রাস পায়। চিত্তের বিশুদ্ধতা কমে গেলে চিত্ত আপনা থেকে অজ্ঞানে আচ্ছন্ন হয়। এই অজ্ঞানতার জন্য লোকে আত্মহিতাহিতবোধ শূন্য হয়। এই ধরনের লোক ভগবানকে আদর করে না। এর মানে হল এই যে, বর্ণাশ্রমের নিয়মানুযায়ী মানুষ যদি আপন হিত চিন্তা করে উন্নতির পথে ছুটে যায়, তাহলে চিত্তের বিশুদ্ধি লাভ হয়। আর চিত্তের বিশুদ্ধি লাভ হলে ভগবদ্ভক্তি হয়। যারা শাস্ত্র মতো না চলে যথেচ্ছ আচরণ করে চিত্তকে মলিন করে, তারা অজ্ঞান আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সেই অজ্ঞান রোগে ভগবদ্ বিষয়ে তাদের অরুচি জন্মায়। এইসব অজ্ঞানী ব্যক্তি সংসারকেই সার করে আসক্তিতে ডুবে যায়। আসক্তি কেন হয় এবং অভক্তদের অধোগতিই বা কেন হয়, তাই এতক্ষণ তোমাদের বোঝালাম। বাবা লোকনাথের কথায় গোঁসাইজির উপদেশামৃত পান করে সমবেত ভক্তগণ ধন্য হলেন। তারা একদিকে যেমন ব্রহ্মজ্ঞানী বাবা লোকনাথের জ্ঞান ও অজ্ঞানের ব্যাখ্যা শুনলেন আবার গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর থেকে বর্ণাশ্রম অনুযায়ী কর্ম করে কিভাবে ভগবদ চরণাশ্রয় পাওয়া যায় তারও ব্যাখ্যা শুনলেন। এই ধর্মালোচনা করতে করতে সন্ধ্যা সমাগত, এবার গোঁসাইজির বিদায় নেবার পালা। গোঁসাইজি, যোগমায়া দেবী ও মুক্তকেশীদেবী ভূমিষ্ঠ হয়ে ব্রহ্মচারী বাবাকে প্রনাম করে বিদায় প্রার্থনা করলেন।

ব্রহ্মচারী বাবা তখন মুক্তকেশীদেবীকে বললেন, ব্রাহ্মসমাজের শুকনো বাঁশের মুড়ো আর না চিবিয়ে এবার ভক্তির আশ্রয় নাও। জ্ঞান ভক্তি ছাড়া দাঁড়াবে কোথায়? যাকে তুমি জামাই করেছ, তার কাছেই সত্যবস্তু আছে। আর সময় নষ্ট না করে, তার কাছেই দীক্ষা নাও।

এরপর ব্রহ্মচারী বাবা গোঁসাইজিকে বললেন, জীবনকৃষ্ণ, আজ তোকে পেয়ে যে আনন্দ পেলাম তা বলবার নয়। তুই যথার্থ ধর্মপিপাসু, প্রেম-ভক্তির ভাণ্ডারী ও সত্যনিষ্ঠ। এবার তুই আমার ভার নে, আমি চলে যাই।

পরক্ষণেই গোঁসাইজির শরীরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, না রে তা হবার নয়। তোর শরীর এখনও তেমন পটু নয়। আমার ভার বইতে গেলে তোকে। আরও কিছুদিন সাধনা করতে হবে।

গোঁসাইজি ব্রহ্মচারী বাবাকে বললেন, আজ্ঞে আজ আপনি আমাকে যে অনুগ্রহ করলেন তাতেই আমি ধর্মজীবনে আরও উঁচু অবস্থায় পৌঁছতে পারবো। আজ আপনার সঙ্গ ও কৃপালাভ করে ধন্য মনে করছি নিজেকে। এবার অনুমতি চাইছি বিদায় নেবার। এরপর গোঁসাইজি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ঢাকায় গেন্ডারিয়া আশ্রমের পথে পা বাড়ালেন।

ঢাকায় আশ্রমে পৌঁছে গোঁসাইজি সকল ভক্তকে ব্রহ্মচারী বাবার অলৌকিক যোগৈশ্বর্যের কথা বলতে লাগলেন। সেই সময় গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সারা দেশের ধর্মজগতে খুব নাম ডাক ছিল। গোঁসাইজির কাছে ব্রহ্মচারী বাবার কথা জানতে পেরে দলে দলে লোক বারদীতে ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করতে ও তার কৃপা লাভ করতে আসতে লাগলেন। গোঁসাইজি তার ভক্তদের বলেছেন, বারদীর ব্রহ্মচারীকে দর্শন করে আমার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত পরম সত্যের খনির সন্ধান পেয়েছি। এই ব্রহ্মচারী ঈশ্বরের স্বরূপ।

এরপর বাবা লোকনাথের সঙ্গে গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সূক্ষ্মরূপে দেখা হয়েছিল। ১২৯৭ সনের জৈষ্ঠ্য মাসে। বাবা ঠিক করে নিয়েছিলেন যে তিনি এবার ইহলোক ত্যাগ করবেন। এই দেহ ত্যাগ করার আগে ১৮ই জ্যৈষ্ঠ বাবা সূক্ষ্মরূপে শেষবারের মতো গোঁসাইজির সঙ্গে দেখা করেন।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় গোঁসাইজি বৃন্দাবনে তার আসনে উপবিষ্ট ছিলেন। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন এক পরিচিত কণ্ঠস্বর–জীবনকৃষ্ণ, আমি এসেছি তোর কাছে। একথা শুনে বিস্ময়ে চমকে উঠলেন গোঁসাইজি। একমাত্র বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা ছাড়া তাকে এই নামে তো কেউ ডাকে না। সামনে তাকিয়ে তিনি দেখলেন, তাঁর সামনে দণ্ডায়মান বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা। গোঁসাইজি বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে তার চরণ স্পর্শ করে বললেন, কোনো খবর না দিয়ে এভাবে এখানে এলেন?

বাবা লোকনাথ তাঁকে বললেন, জীবনকৃষ্ণ, আগামীকালই আমি দেহত্যাগ করব। তুই আমার বারদী আশ্রমে গিয়ে বোস। ওই আসনে বসবার মতো তোকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।

এ কথা শুনে গোঁসাইজি বললেন, আমার এখন বৃন্দাবন ছেড়ে যাবার যে নেই। এখানে একবছর থাকব বলে সঙ্কল্প করে আসন পেতেছি।

 বাবা লোকনাথ তখন বললেন, তবে আমি দেহ ছেড়ে দিই?

গোঁসাইজি তখন বললেন, আপনার যা ইচ্ছা করুন। আপনার দেহের জন্য আমার এতটুকু মায়া নেই।

বাবা লোকনাথ বললেন, একথা বলছিস কেন?

গোঁসাইজি বললেন, আপনি এর মধ্যে অনেক ক্ষতি করেছেন।

লোকনাথ বাবা তখন জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কী ক্ষতি করেছি বল।

গোঁসাইজি তখন তাকে বলতে লাগলেন, আপনি অদ্বৈতবাদ শিক্ষা দিয়ে অনেককেই অদৃষ্ট প্রারব্ধ বলে তাদের মন বিগড়ে দিয়েছেন। তারা সব সাধন ভজন ছেড়ে ভুল পথে যাচ্ছে।

একদিন বারদীর একদল লোক খোল, করতাল, বাতাসা নিয়ে আপনার কাছে। গিয়ে বলে, বাবা, আমরা আশ্রমে হরিলুট দিতে এসেছি। কিন্তু আপনি তাদের কথা শুনে বলেন, এখানে হরি নেই। যেখানে তাদের হরি আছে, সেখানে গিয়ে তোরা লুট দে। আপনার কথায় তারা অসন্তুষ্ট হলে আপনি তাদের বলেন, আমি তোদের হরির মুখে প্রস্রাব করি। এই কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা চলে যায়।

কিছুদিন আগে আমার এক শিষ্য শ্রীধরচন্দ্র ঘোষ আপনার কাছে গেলে আপনি তাকে বলেন, তুই এতদিন গোঁসাইজির কাছ থেকে কি পেয়েছিস? যে নিজে অন্ধ, সে কি করে অন্ধকে পথ দেখাবে? অন্ধ গুরুর সঙ্গ ছেড়ে দে। ছ মাস তুই আমার কাছে থাক। তোকে আমি ব্ৰহ্মজ্ঞান দিয়ে উৰ্দ্ধরেতা করে দেবো।

আর একদিন একটি লোক আপনার কাছে গিয়ে বলে, আপনি আমাকে শাস্ত্রবিধি মেনে স্ত্রীসঙ্গ করতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি তা পারবো না। আমার কাম বড় বেশি। বলুন, এখন আমি কি করবো?

সেই লোকটির কথা শুনে আপনি তাকে বলেন, বেশ তো, যদি তা নাই পারিস, বেশ্যাগমন কর। ব্যাভিচার কর গে। পরে লোকটি আমার কাছে এসে বলে, বারদীর ব্রহ্মচারী বাবা আমাকে বেশ্যাগমন করতে বলেছেন। মহাপুরুষের কথামতো তা করলে আমার কখনও পাপ হবে না।

তাহলে বলুন, এসব আপনি কি করছেন? আপনার উপদেশে যে সাধারণ লোকের সর্বনাশ হবে, সমাজ উচ্ছন্নে যাবে।

মাসকয়েক আগে এক ব্রাহ্ম যুবক আপনার কাছে গিয়ে জানতে চায়, ঈশ্বর সাকার না নিরাকার? তাকে আপনি বলেন, তোর ঈশ্বরের মুখে আমি হাগি, তার মুখে মুতি। এ কথা শুনে যুবকটি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে চলে যায় ও সবার কাছে বলতে থাকে বারদীর ব্রহ্মচারি একজন নাস্তিক।

এইরকম বহু ঘটনা আপনার আশ্রমে ঘটেছে যা সমাজের উপকার না করে, অপকার করছে, বিপন্ন করছে। যেভাবে বললে সাধারণ লোক বুঝতে পারে, তেমনটি করে আপনি বলেন না কেন?

গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণের অভিযোগ শুনে বাবা তাকে বললেন, বটে, এখন কি আমি তোদের ভাষা শিখতে যাব নাকি? ও সব লোক আমার কাছে আসে কেন? আমি তো তাদের ডেকে আনি না। ঠিক আছে, এবার তোর অভিযোগগুলি খণ্ডন করছি, শোন।

বারদীর যেসব লোক খোল করতাল নিয়ে হরির লুট দিতে এসেছিল, আমার কথা অমান্য করায় আমি তাদের বলি, তোদের হরির মুখে আমি প্রস্রাব করি। একথা শুনে তারা রেগে চলে গিয়েছিল। আমি তাদের কোনো অশাস্ত্রীয় কথা বলি নি। শাস্ত্রে আছে হরি হাঁ করে যশোদাকে নিজের মুখের মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দেখিয়েছিলেন। আমি যখন ব্রহ্মাণ্ডের একজন এবং ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেই প্রস্রাব করে থাকি, তখন হরির মুখে প্রস্রাব করি বলতে দোষের কি হয়েছে?

ব্রহ্মচারী বাবার ব্যাখ্যা শোনার পর গোঁসাইজি এই সম্বন্ধে আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। আসলে যে লোকগুলি হরির লুঠ দিতে এসেছিল, তাদের মধ্যে ভক্তিভাব ছিল না। কপট হরিভক্তি দেখাতে তারা আশ্রমে এসেছিল।

অন্তর্যামী বাবা লোকনাথ তাদের অন্তরের ভাব বুঝতে পেরে বলেছিলেন, এই আশ্রমে তোদের হরি নেই, যেখানে তোদের হরি আছে, সেখানে গিয়ে লুট দে। হরির জন্য যদি অন্তরে ব্যাকুলতা না থাকে, বিশুদ্ধ ভক্তি না থাকে, কপট ভক্তি দিয়ে হরির লুট দিলে, হরি তা গ্রহণ করেন না।

এরপর শ্রীধর সম্পর্কে বাবা বললেন, আমি শ্রীধরের গুরুভক্তি পরীক্ষা করার জন্যই ওই কথা বলেছিলাম। আমার কথা শুনে সে চেঁচামেচি করতে করতে তার লেংটিটা খুলে আমার গায়ে ছুঁড়ে মারে। আমি তখন আসন থেকে উঠে দু হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, শ্রীধর তুই ঠিক বলেছিস। তোর গুরুভক্তি দেখে আমি খুব আনন্দ পেলাম। তবে আমার দোষটা হল কোথায়?

তোকে অন্ধ বলেছি, মূর্খ বলেছি, বেশ করেছি। তুই তো দেশ-বিদেশে আমায় মহাপুরুষ বলে সর্বনাশ করেছিস। বারদীতে এসে প্রথম পাঁচ বছর বেশ ছিলাম। আর এখন রোগীদের চেঁচামেচি আর মামলা-মোকদ্দমার কথা উদয়াস্ত শুনতে হচ্ছে। এইজন্যই কি আমার বারদীতে থাকা? কচি কচি ছেলেগুলোকে যোগশিক্ষা দিচ্ছিস আর মুখে গুরু গুরু বলছিস। শালা, অন্ধ, মূর্খ।

এখানে বাবা লোকনাথের গোঁসাইজিকে অন্ধ ও মূর্খ বলার উদ্দেশ্য হল যে, গোঁসাইজি কোনো বিচার না করে যাকে-তাকে যোগশিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু যোগসাধনা সব দেহে সম্ভব নয়। যোগসাধনার জন্য দেহকে প্রস্তুত করতে হয়। আর সেই কাজের জন্য যেমন দক্ষ গুরু চাই, তেমনি সত্যনিষ্ঠ উপযুক্ত শিষ্যও চাই। যোগশিক্ষার জন্য কঠোর কৃচ্ছুব্রত অনুষ্ঠান করতে হয়। অপরিপক্ক দেহে যোগশিক্ষা করতে গেলে দেহের অনিষ্ট হয়। তাতে শিষ্যের যেমন সাধনায় সফলতা আসে না, গুরুরও বদনাম হয়।

লোকনাথ বাবা গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তিনি চাইতেন তার প্রাণের জীবনকৃষ্ণ সাধনার আরও উচ্চস্তরে উন্নীত হোক। তাঁর কাছে অনেক লোক ভিড় করলে, তার সাধনার ব্যাঘ্যাত হবে। ভিড় সাধনার অন্তরায়। সেইজন্য বাবা লোকনাথ এমন পথ অবলম্বন করলেন যেন বেশি লোক তার জীবনকৃষ্ণের কাছে ভিড় না করে। জীবনকৃষ্ণ যেন ভিড়ে মিশে না গিয়ে সাধনায় মন দেন। এমন কাজ উনি রজনী ব্রহ্মচারীর জন্যও করেছিলেন। তবে রজনী ব্রহ্মচারী বুঝেছিলেন যে বাবা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই এই কাজ করছেন এবং সেইজন্য তিনি বাবার এই কাজে বিরাগভাজন হননি। কিন্তু গোঁসাইজি সেভাবে ভাবেন নি। তিনি ভেবেছিলেন বাবা গোঁসাইজির বদনাম করছেন নিজের শ্রেষ্ঠতা জাহির করার জন্য। এটা তার ভুল মূল্যায়ণ ছিল, বিশেষ করে বাবার পূর্ণব্রহ্মরূপ দর্শন করার পর।

এরপর বাবা লোকনাথ তাকে বললেন, বিধিমতো যারা স্ত্রীসঙ্গ করতে পারে না, তাদেরই বলেছি বেশ্যাগমন করগে, ব্যাভিচার করগে। এতে দোষের কি আছে? শাস্ত্রবিরুদ্ধ আচারই তো ব্যাভিচার। শাস্ত্রবিধি না মেনে স্ত্রীগমনও তো বেশ্যাগমন। ও শালারা যখন আমার কথার মানে বোঝে না, তখন আমার কাছে আসে কেন?

গোঁসাইজি শিষ্যের কাছে শুনেই বাবার প্রতি রুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু গভীরভাবে বিষয়টি ভেবে দেখেননি। জোর করে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে রমণ করাও তো এখন অপরাধ বলে গণ্য হয়। স্ত্রীর সঙ্গে শাস্ত্রীয় মতে স্বামী তো মেলামেশা করতেই পারে। কিন্তু অশাস্ত্রীয় মতে নিজের কাম-বাসনাকে পূরণ করার জন্য স্ত্রীকে ব্যবহার করাকে অপরাধ বলে গণ্য হয়। এবং বাবা বোঝাতে চেয়েছেন যে সেইরূপ ভাবে স্ত্রীকে ব্যবহার করা আর বেশ্যাগমণ করা সমান। গোঁসাইজি আধ্যাত্মতত্ত্ব অনুসারে বিষয়টি ভেবে দেখেননি।

বাবা লোকনাথ কঠোর বাক্যদ্বারা ভক্তদের পরীক্ষা করতেন। সেইরকম পরীক্ষায় ত্যাগী ও যযাগী ভিন্ন সাধারণ মানুষের উত্তীর্ণ হওয়া খুব কঠিন। এইরকম পরীক্ষার মধ্য দিয়েই উচ্চ মার্গের যোগীগণ ভক্তের ভক্তি, নিষ্ঠা, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা ও আধ্যাত্ম সাধনায় নিবিড়তা যাচাই করতেন। এই পরীক্ষায় রজনী ব্রহ্মচারী বাবার কাছে সব থেকে বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। এখানে এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে বাবা প্রায় ১১৩ বছর মুখে কোনো কথা বলেননি, বা ভাষার ব্যবহার করেননি। নিম্নভূমিতে অবতরণের পরই তিনি নতুন করে ভাষার ব্যবহার করতে শেখেন। ১১৩ বছর তিনি সমস্ত লোকাঁচারের বাইরে ছিলেন। সেইজন্য তার ভাষার ব্যবহার অনেক সময় সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকত। বাবা নিজেই তার ভাষা সম্পর্কে বলেছেন, দেখ বাপু, ভাষায় ভাসে, ভাবে ডোবে। তাই ভাষা ও ভাব পরস্পর বিরোধী বলেই ভাবকে সকল সময় ভাষায় সম্যক প্রকাশ করা যায় না। ওই ভাবের ভাবুক না হলে ওই ভাষার অর্থ বোঝা যায় না। আধ্যাত্মিক ভাব অনেক সময় ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তা অনুভূতির দ্বারা বুঝতে হয়। যখন তোর মন ওই ভাবে পূর্ণ হবে তখন তোর মন ওই ভাষার অভিমুখী হবে। তাই মনের অনুকূল অবস্থা হেতু তুই বুঝতে পারবি যে ওই ভাব প্রকাশ করতে ওই ভাষার চেয়ে স্পষ্টতর ভাষা আর কিছুই সম্ভব নয়। তখন ওই ভাষা অসম্পূর্ণ হলে কিংবা আপাতদৃষ্টিতে অশ্লীল মনে হলেও তোর ভাবের সঙ্গে মিলে যাবে।

উচ্চমার্গের যোগীদের এইরূপ ভাব আমিও প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সেইজন্য এই ভাবের অনুধাবন করতে পারি। নর্মদা পরিক্রমার সময় দক্ষিণ তটে আমাকে দুবার এইরকম কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। দু-জায়গায় দুজন উচ্চমার্গের যোগীর সামনে তাদের কঠোর বাক্যবাণ ও রূদ্ররূপের সামনে আমি প্রথমাবস্থায় থরহরি কম্পমান ছিলাম। কিন্তু গুরুর আশীর্বাদে ও মহামুনি মার্কন্ডেয় এবং মাতা নর্মদার কৃপায় আমি সেই অবস্থায় নিজেকে সামলে সেই যোগীদের কৃপা পেতে সমর্থ হয়েছিলাম। যোগীদের এইরূপ প্রক্রিয়া থেকে আমি পরিক্রমার শিক্ষা গ্রহণ করেছিলাম যে, তারা যখন কিছু বলেন তখন সেই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে বার করতে হবে। যোগীগণ অনেক সময় গুঢ় শাস্ত্রীয় তত্ত্ব হেঁয়ালির মাধ্যমে ভক্তের সামনে পেশ করেন। সেজন্য তাদের কথার চটজলদি উত্তর দিতে নেই এবং সেই কথাতে মনে ব্যথাও পেতে নেই। এটা মনে করতে হবে যে কোনো উচ্চমার্গের যোগী কঠিন পরীক্ষা ভিন্ন তাঁর কাছে কোনো ভক্তকে আসতে দেবেন না। উচ্চমার্গী যোগীদের কৃপা পেতে হলে তাদের কঠিন বাক্য, ভৎর্সনাকে আশীর্বাদ মনে করতে হবে। এটা বুঝতে হবে যে যোগী যখন মনে মনে ঠিক করলেন কাউকে কৃপা করবেন, তখনই তাকে পরীক্ষা করেন; নতুবা তাকে এড়িয়ে যান। বাবা লোকনাথ আধ্যাত্ম দৃষ্টিভঙ্গিতে সঠিক কথাই বলেছিলেন কিন্তু সমআধ্যাত্ম দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে তার কথার সঠিক অর্থ অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে গোঁসাইজি সেটা করতে পারেননি। গোঁসাইজি যখন বারদী আশ্রমে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখনই বাবা তাকে বলেছিলেন যে, গোঁসাইজির দেহ তখনও অপটু। তাঁকে সাধনার মাধ্যমে আরও উচ্চমার্গে পৌঁছতে হবে এবং সেজন্য তিনি তাকে আশীর্বাদও করেছিলেন। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, বাবা লোকনাথ ছিলেন ২৩টি সিদ্ধি ও ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী পূর্ণব্রহ্ম এবং গোঁসাইজি ছিলেন ৮টি সিদ্ধির অধিকারী। সেজন্য সাধনমার্গের এই তফাৎ তো ছিলই। কিন্তু বাবা চেয়েছিলেন গোঁসাইজি তার উত্তরাধিকারী হয়ে আরও সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে সাধনমার্গের উচ্চতম স্তরে উন্নীত হোক। গোঁসাইজির বিগত ধর্মজীবন থেকে দেখা যায় যে তিনি বরাবরই একটা দোলাচলের মধ্যে দিয়ে ধর্মজীবনে এগিয়েছেন। বর্তমান স্তরে এসেও তিনি ব্রাহ্মসমাজ ও পৌত্তলিকতা উভয়কেই একসঙ্গে নিয়ে চলেছেন। সাধনার প্রথম জীবন থেকে যেভাবে গুরু নির্দেশিত পথে সাধক নিজেকে তৈরি করে সাধনপথে এগিয়ে যেতে থাকেন, তেমনভাবে সাধন জগতের বর্তমান স্তরে গোঁসাইজির উত্তরণ হয়নি। তার মধ্যে ঈশ্বর দর্শনের ব্যাকুলতা ছিল। এই ব্যাকুলতাই তাকে উচ্চমার্গের গুরু পেতে সাহায্য করে। তারপর গুরুর আশীর্বাদে ও কৃপায় গুরুশক্তির জোরে সেই ব্যাকুলতা আরও বৃদ্ধি পায় ও সাধনপথের দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত হয়। অষ্টসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন তিনি ঢাকার গেণ্ডারিয়া আশ্রমে তপস্যা করে। এখনও তাকে অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে। সেই উচ্চতর সাধনার উদ্দেশ্যেই তিনি বৃন্দাবনে গিয়ে আসন পেতেছিলেন। বাবা লোকনাথ যখন তাকে তার বারদীর আসন গ্রহণ করতে বললেন, তখন তিনি সেজন্য মনস্থির করতে পারেননি। বৃন্দাবনে শ্যামসুন্দরের তপস্যা করার প্রবল বাসনা সেক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার উপর উপরিউক্ত কারণে তিনি বাবার উপর রুষ্টও ছিলেন।

সেইজন্য বাবা যখন তাকে বললেন, আমি দেহ ছেড়ে যাচ্ছি, তখন তিনি তাকে কিছু বললেন না। বাবা তখন তাকে বললেন, যাঁদের জন্য থাকা, তারাই যখন আমাকে চিনলেন না, আমার দ্বারা তাদের যখন কোন উপকারই হবে না, তখন আর থেকে লাভ কি? আমি দেহ ছেড়ে যাচ্ছি।

বাবার এই কথা শুনেও গোঁসাইজি তাঁকে দেহ ছেড়ে যেতে নিষেধ করেননি। তিনি বলেছিলেন, আপনার যা ইচ্ছা হয় করুন, আমার কিছু বলার নেই।

পরমুহূর্তেই এক দমকা হাওয়া ঢুকে ঘরে সব ওলটপালট করে দিল। ব্রহ্মচারী বাবার সূক্ষ্ম দেহ সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্হিত হলো। গোঁসাইজি তখন ব্রহ্মচারী বাবা, ব্রহ্মচারী বাবা বলে ব্যাকুলভাবে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু ব্রহ্মচারী বাবার আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।

গোঁসাইজির শেষ কথাটি ব্রহ্মচারী বাবার মনে গভীর দাগ কেটেছিল। তার অন্তর সেই কথায় ব্যথিত হয়ে উঠেছিল কেননা সেই কথাটি বলেছিলেন তাঁর প্রাণের জীবনকৃষ্ণ যাঁকে তিনি অন্তর থেকে সবকিছু দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। হয়তো বা দুর্লভ ব্রহ্মবিদ্যাও তিনি গোঁসাইজিকে দান করে যেতেন যে বিদ্যা তাঁর কাছ থেকে অন্য কেউ আয়ত্ত করতে পারেনি। সেই বিদ্যা ধারণ করার আধার সেইসময় আশ্রমের অন্য কারও ছিল না। গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আধার ছিল এবং তার সঙ্গে বাবা লোকনাথের পারিবারিক সম্পর্ক থাকায় তিনি তাঁকে তার উত্তরাধিকারী রূপে চিহ্নিত করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ এক অতিদুর্লভ বিদ্যা বারদী হতে এরপর অন্তর্হিত হলো। বাবা লোকনাথ এই ঘটনার পরদিনই তার পঞ্চভূত দেহ ত্যাগ করেছিলেন।

গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী এরপর সাধনভজনে মগ্ন হয়ে পড়েন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে ধ্যানযোগে লাভ করার তাঁর অত্যুগ্র বাসনা ছিল। একদিন ধ্যানযোগে তার সামনে এক দিব্যজ্যোতি ভেসে উঠল। সেই জ্যোতির অমিত তেজ সহ্য করতে না পেরে তিনি জয় গৌর, জয় গৌর বলে সংজ্ঞা হারালেন। এরপর শিষ্যদের সেবায় তার সংজ্ঞা ফেরে। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তার ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। এ নিয়ে বৃন্দাবনে অবস্থানকালে সেখানকার অনেক সাধক মর্মাহত হন। কিন্তু রামদাস কাঠিয়াবাবা ধ্যানযোগে জানতে পারেন যে গোঁসাই বিজয়কৃষ্ণ একজন মহাসাধক এবং তিনি অন্যদের বুঝিয়ে বলেন এবং তখন তারা শান্ত হন।

১৩০২ সনের ২২শে জৈষ্ঠ্য তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। শেষ জীবনেও তিনি ভক্তদের সংসারে অবস্থান করে ঈশ্বরের নাম গানের মাধ্যমে ঈশ্বর সেবার পরামর্শ দেন।

.

শ্রীরামকুমার চক্রবর্তী

রামকুমার চক্রবর্তী বারদী গ্রামে এক অতি পরিচিত পুরোহিতের পুত্র ছিলেন। জন্ম থেকে তিনি ছিলেন ধীর, স্থির ও শান্ত স্বভাবের। বাল্যকাল থেকেই তাঁর শাস্ত্রবিষয়ে জ্ঞানার্জনের প্রতি স্পৃহা লক্ষ্য করা যায়। গৃহাশ্রমে থেকেই তিনি বাল্যকাল ও কৈশোরে বিভিন্ন শাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করেন এবং সদাচারব্রতের মধ্যে দিয়ে তার মধ্যে বিভিন্ন সত্ত্বগুণের বিকাশ ঘটতে থাকে। ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মগ্রহণ করেও প্রায় মধ্যবয়স পর্যন্ত তিনি কোনো সদ্গুরু করেননি। গুরুকরণ করার জন্য তার মধ্যে কোনো চাপও লক্ষিত হয়নি। তিনি গৃহাশ্রমে নিজের মতো করে বড়ো হতে থাকেন।

বাবা লোকনাথ যখন প্রথম বারদী গ্রামে এসে আশ্রমের সূচনা করেন, তখন রামকুমারের কৈশোর উত্তীর্ণ। সারা গ্রামের লোক সেইসময় এই ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শনার্থে গেলেও, রামকুমার সেই ভিড়ে যাননি। বারদী গ্রামে বাবার আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর একদিন একাকী তিনি বারদী আশ্রমে এসে বাবার সম্মুখে উপস্থিত হলেন। আসনঘরে রামকুমারকে সম্মুখে দেখে বাবা লোকনাথ তাঁর গুরু ভগবান গাঙ্গুলির বর্তমান দেহকে চিনতে কষ্ট হয় না। রামকুমারের মধ্যেও জেগে ওঠে জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার। রামকুমারকে দর্শন করেই ব্রহ্মচারী বাবা মনে মনে বলতে থাকেন, তিনি তো গুরু ভগবান গাঙ্গুলির আশাতেই সুদূর হিমালয় থেকে নিম্নভূমিতে এসে বারদীতে অপেক্ষা করছেন। তাঁর গুরু মণিকর্ণিকার ঘাটে শেষবার বলেছিলেন, পরজন্মে বাবা লোকনাথকেই গুরুকে কর্মমার্গের মধ্য দিয়ে ভক্তিরস সৃষ্টি করে মোক্ষলাভের পথ দেখিয়ে দিতে হবে। তিনি গুরুকে দেহত্যাগের সময় কাশীতে সেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এতদিনে সেই সময় সমাগত। রামকুমারের মধ্যেও বাবা লোকনাথকে দর্শন করে এক ত্যাগ ও বৈরাগ্যের বাসনা জেগে ওঠে। জন্মান্তরের সংস্কারের কারণে তখন তার গৃহস্থ জীবন অতি সংকীর্ণ মনে হয়। তিনি সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দেন বাবা লোকনাথের কাছে।

বাবা লোকনাথ তখন রামকুমারের মধ্যে জ্ঞান ও ভক্তিমার্গের আধ্যাত্ম শক্তি সঞ্চার করলেন। তাঁকে নির্দেশ দিলেন বারদী আশ্রমে তার কাছে আসতে। রামকুমার এরপর বাবার কাছে প্রায়শঃই আসতেন। বাবা তাকে গোপনে যোগসাধনার অনেক গুহ্য পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। পূর্বজন্মের সুকৃতির ফলে রামকুমার সেইসব যোগশিক্ষা অতি দ্রুত আয়ত্ত করতে থাকেন। তারপর একদিন গোপনে বাবা রামকুমারকে কাছে ডেকে দীক্ষা দেন। দীক্ষা দান করার পর তাকে আদেশ করেন গৃহত্যাগ করে পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করতে। দেহধারণের প্রারব্ধ সংস্কার ও পূর্বজীবনের সাধনার ভুলত্রুটিগুলিকে সংশোধন করার জন্য বাবা রামকুমারকে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে পরিব্রাজনের মাধ্যমে কর্মযোগে নিয়োজিত হতে বলেন। রামকুমার বাবার সেই আদেশ শিরোধার্য করে পরিব্রাজনে বেরিয়ে পড়েন। সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করে পরিব্রাজনে বের হবার সময় যখন রামকুমার বারদী আশ্রমে বাবা লোকনাথের কাছে বিদায় নিতে আসেন, তখন বাবা তাকে বলেন, রাম সময় হলেই আমি তোমায় কাছে ডেকে নেব। তুমি যখনই আমায় স্মরণ করবে, আমাকে কাছে পাবে। রামকুমারকে দীক্ষা দান করা, যোগসাধনার সব গুহ্য তত্ত্ব শিক্ষা দেওয়া এবং সন্ন্যাসী করার কথা বাবা তখন গোপন রেখেছিলেন। বারদী আশ্রম থেকে বিদায় নিয়ে রামকুমার কাশী চলে যান। বারদী গ্রামের সকলে জানতে পারে যে রামকুমার চক্রবর্তী হঠাৎ সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগী হয়েছেন।

এরপর রামকুমার চক্রবর্তীকে বারদী আশ্রমে দেখা যায় ১২৯৭ সনের ১৮ই জ্যৈষ্ঠ, খুব সকালে। ওই সনের জ্যৈষ্ঠ মাসেই পরিব্রাজনকালে রামকুমার বাবা লোকনাথের সূক্ষ্ম নির্দেশ পান অবিলম্বে বারদী আশ্রমে আসার জন্য। বাবার নির্দেশ পেয়ে রামকুমার বারদীর পথে রওনা হন এবং ১৮ই জ্যৈষ্ঠ ব্রাহ্ম মুহূর্তে আশ্রমে এসে বাবার সঙ্গে দেখা করেন। রামকুমারকে সামনে পেয়েই বাবা তাকে সস্নেহে বুকে টেনে নিলেন। বাবার বুকে রামকুমারের স্পর্শ হতেই বাবা তার যোগদৃষ্টিতে বুঝতে পারেন দীর্ঘ পরিব্রাজনের মধ্য দিয়ে কঠোর তপশ্চর‍্যা করে আধ্যাত্ম সাধনার অনেক উচ্চভূমিতে রামকুমারের উত্তরণ হয়েছে। রামকুমারও বুঝতে পারেন কিভাবে গুরু তাকে নিজের যোগশিক্ষা দিয়ে ও তার মধ্যে আধ্যাত্ম শক্তি সঞ্চার করে দিয়ে তাঁকে সাধনার উচ্চস্তরে পৌঁছতে সাহায্য করেছেন। জ্ঞান-ভক্তি ও কর্মযোগের পথে প্রতিনিয়ত সূক্ষ্ম নির্দেশের মাধ্যমে তাকে পরিব্রাজনের সময় সাধনপথে পরিচালিত করেছেন। বাবার অসীম করুণার কথা স্মরণ করে তার চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। এমন সময় বাবা তাকে বলেন, রাম, আমি আগামীকাল দেহত্যাগ করব। তোমার প্রতি আমার নির্দেশ আমার দেহ সংস্কারকালে তুমি আমার মুখাগ্নি ক্রিয়া সম্পন্ন করবে। বাবার এই নির্দেশ সম্বন্ধে জানকী ব্রহ্মচারী ও গোয়ালিনী অবগত ছিলেন।

১২৯৭ সনের ১৯শে জ্যৈষ্ঠ বাবা ব্রহ্মলীণ হবার পর তার নির্দেশানুযায়ী রামকুমার বাবার মুখাগ্নি ক্রিয়া সম্পাদন করেন। বাবার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদনের পর তিনি আবার কাশী চলে যান এবং সেখানে মণিকর্ণিকার ঘাটে ধ্যানাবস্থায় দেহত্যাগ করেন।

রামকুমারের জন্ম হয়েছিল বাবা লোকনাথের প্রদর্শিত আধ্যাত্ম সাধনার পথে পরিচালিত হয়ে মোক্ষ লাভ করার জন্য। বাবা লোকনাথ গুরুর কাছে তার প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্যই বারদীতে এসে আশ্রম করেছিলেন। যদি রামকুমারের জন্ম বারদীতে না হয়ে অন্য কোনো স্থানে হতো, তবে বাবা নিম্নভূমিতে অবতরণ করে সেখানেই অবস্থান করতেন। বাবা লোকনাথ তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে ব্রহ্মলীণ হবার পরই রামকুমারও তার মরদেহ ত্যাগ করে দেবলোকে যাত্রা করেন।

রামকুমারই যে বাবার সাধনপথের গুরু ভগবান গাঙ্গুলি ছিলেন এবং তার উদ্ধারকল্পেই যে তিনি বারদীতে অবস্থান করছেন সেই কথা বাবা কয়েকজন বিশেষ ভক্তকে জানিয়েছিলেন। এখানে সেইরূপ একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি।

যে ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করছি, সেটা বাবার একনিষ্ঠ বিশিষ্ট ভক্ত ডঃ নিশিকান্ত বসুর ডায়েরি থেকে পাওয়া যায়।

নিশিকান্ত বসু যখন বারদীতে ডাক্তারি করতেন, তখন তিনি নারিন্দাবাসী শীরমণী দাসের সঙ্গে পরিচিত হন। রমণীমোহন বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। একদিন তিনি বাবার এক দৈবলীলার কথা নিশিকান্ত বসুকে বলেন।

রমণীমোহনের ৯ বছরের পুত্র এক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। যখন সে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে, এমন সময় একদিন সে অচৈতন্য অবস্থায় দেখে বাবা লোকনাথ, ভগবান গাঙ্গুলি ও বেণীমাধব তার কাছে এসেছিলেন। যখন চেতনা ফিরে পেয়ে এই কথা সে সকলকে বলে, তখন সকলে বলে বাবা লোকনাথ, ভগবান গাঙ্গুলি তো দেহত্যাগ করেছেন। তিনি তোমার কাছে কি করে আসবেন? পরে বাবা লোকনাথকে এই প্রশ্ন করা হয়। সূক্ষ্মদেহে বাবা লোকনাথ উপস্থিত হয়ে বলেন, তার পূর্বজন্মের গুরু ভগবান গাঙ্গুলি এ জন্মে বারদীর রামকুমার চক্রবর্তী ছিলেন। তাঁর উদ্ধারের জন্যই তিনি বারদীতে এসেছিলেন এবং এতদিন অবস্থান করেছিলেন।

সমস্ত ঘটনাক্রম, সময় এবং তথ্যাবলী বিশ্লেষণ করে ডঃ নিশিকান্ত বসুর ডায়েরির তথ্য অনুযায়ী রামকুমার চক্রবর্তীকেই বাবা লোকনাথের সাধনগুরু ভগবান গাঙ্গুলি রূপে এখানে চিহ্নিত করা হলো। এই পুস্তক লেখার সময় বাবা লোকনাথের সূক্ষ্ম নির্দেশও সেই ইঙ্গিতই বহন করে।