মহাপ্রয়াণ

নবম অধ্যায় মহাপ্রয়াণ

১১৩৭ সনের পুণ্যলগ্নে বাবা লোকনাথ এই জগতে আগমন করেছিলেন। ১১৪৭ সনে গৃহত্যাগ করে গুরু ভগবান গাঙ্গুলির সঙ্গে সাধন পথের যাত্রা শুরু করেছিলেন। তারপর দীর্ঘ ১২৩ বছর বহু পাহাড়-পর্বত-জঙ্গল ও হিমালয়ে তপস্যা করে সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে ১২৭০ সনে লোককল্যাণহেতু নিম্নভূমিতে অবতরণ করে বারদী আশ্রমে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর গুরুদেবের আদেশ ছিল নিম্নভূমিতে অবস্থান করে লোকশিক্ষাহেতু তাকে কিছুদিন কর্ম করতে হবে। সিদ্ধিতে প্রাপ্ত ব্রহ্মজ্ঞানের আলোকে জগতের মানুষকে জীবন্মুক্তির আলোর সন্ধান দিতে হবে। তার সঙ্গে তার দুটি আরও কাজ ছিল। প্রথম কাজ উপনয়নের দিন গর্ভধারিণী মা কমলার কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা পালন করা ও দ্বিতীয় কাজ গুরু ভগবান গাঙ্গুলিকে পরজন্মে ভক্তি ও কর্মযোগের শিক্ষার মাধ্যমে মোক্ষ প্রাপ্তিতে উপযুক্ত করা। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে তিনি গুরুর আদেশ পালন করছেন। মা কমলা পরজন্মে গোয়ালিনী রূপে বারদীতে লোকনাথ বাবাকে কাছে পেয়েছেন। রামকুমাররূপী ভগবান গাঙ্গুলিকে গোপনে তিনি ভক্তি ও কর্মযোগের শিক্ষার মাধ্যমে ও তার ব্রহ্মশক্তি রামকুমারের মধ্যে সঞ্চারের মাধ্যমে তাকে তিনি মোক্ষলাভের উপযুক্ত স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর ধরে তিনি নানাবিধ লোককল্যাণ কার্যে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এবং লোকশিক্ষা হেতু আরও কিছু যোগীপুরুষ তৈরি করেছেন। যখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে তার গুরুদেবের সাধনা মোক্ষলাভের স্তরে পৌঁছে গেছে, তখন তার মন আর এই জগতে থাকতে চাইছিল না। তার পঞ্চভূত দেহ থেকে তার পূর্ণব্রহ্ম রূপ ঘনঘন তখন বেরিয়ে যেত। প্রতিদিন রাতে তাঁর কাছে হিমালয় থেকে মহাযোগীরা সূক্ষ্ম দেহে আসতেন যোগ সাধনার বিভিন্ন গুহ্য প্রক্রিয়ার শিক্ষা লাভের জন্য। তার যোগজীবনী ছিল যোগ শিক্ষা বা যোগ সাধনার এক প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত যা সেইসময় বা আজও অতি বিরল। বারদীতে এই কথা শোনা যায় যে একদিন রাতে চতুর্যগ অমর অশ্বত্থামা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। ঋষি অরবিন্দের অবনী নামে এক ভক্ত তাঁকে বলেছিলেন যে বারদীতে ব্রহ্মচারী বাবার কাছে গভীর রাতে হিমালয়ের অনেক মহান যোগীগণ যোগসাধনার গুহ্যতত্ত্ব আলোচনা করতে আসেন। একজন পূর্ণব্রহ্ম মহাপুরুষরূপে তার অবস্থানের যথার্থতা তিনি সেই সময় উপভোগ করতেন। কিন্তু বারদী আশ্রমে সারাদিন অগণিত ভক্ত আসত কেবল সংসারের দুঃখ কষ্ট, রোগ নিবারণের আর্জি নিয়ে। জীবন্মুক্তির সন্ধান পেতে খুব কম লোকই তার কাছে আসত। এই সমস্ত স্বার্থান্বেষী ভক্তের আর্জি শুনতে শুনতে তিনি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং তার মন আর এই জগতে থাকতে চাইছিল না। তিনি এই সময় কোনো কোনো ভক্তকে বলতেন, আমি ইচ্ছা করলে আমার এই দেহে অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু দেহটি জীর্ণ হয়ে পড়েছে, এ দেহ এখন ত্যাগ করতে হবে। একদিন তিনি সমবেত ভক্তগণকে বলেন, আমি যোগবলে দেহত্যাগ করব। সেই সময় গ্রামের এক ব্যক্তি তার পুত্রকে কোলে নিয়ে বাবা লোকনাথ বলে চিৎকার করতে করতে আশ্রমে ঢোকে। সেই আশ্রমের উঠানে পুত্রকে কোলে নিয়ে বসে কাঁদতে থাকে। বাবা তার আসন ঘর থেকে বাইরে এসে তাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। সেই ব্যক্তি বলে তার পুত্র যক্ষারোগে আক্রান্ত এবং তার শেষ সময় উপস্থিত। সে বাবার কাছে মিনতি করে পুত্রের প্রাণ রক্ষার জন্য। বাবা সেখানে দাঁড়িয়েই ধ্যানস্থ হয়ে যান। যে-কোনো মরদেহ ত্যাগ করতে হলে একটি হেতুর প্রয়োজন। হয়। বাবা মনে করেন এই পুত্রটির জীবনদানের মাধ্যমে তিনি মরদেহ ত্যাগ করার হেতু পাবেন। সেজন্য তিনি বলেন, তোমার পুত্রকে মাটিতে শুইয়ে দাও। আমি ওকে জীবনদান করব। এরপর বাবা সেই ছেলেটির কপালে বাঁ হাত ও বুকে ডান হাত রাখেন। তার শরীর থেকে এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ বের হয়ে সেই ছেলেটির শরীরে প্রবেশ করে। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হয়ে যায়। বাবা নিজে তার রোগ গ্রহণ করে ছেলেটিকে সুস্থ করে দেন। এরপর বাবার শরীরে যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। ভক্তদের অনেক অনুনয় সত্ত্বেও তিনি নিজে রোগমুক্ত হতে চান না। তিনি তো স্ব-ইচ্ছাতেই এই রোগ গ্রহণ করেছেন।

এরপর বাবা একদিন সমবেত ভক্তগণকে বলেন, আমার দেহত্যাগের সময় যদি আকাশ মেঘমুক্ত হয় ও সূর্য উজ্জ্বল কিরণ দান করতে থাকে, তবে বুঝতে হবে আমি সূর্যরশ্মি ভেদ করে ব্রহ্মলোকে গিয়ে জ্যোতির্ময়ে প্রবেশ করছি, আমার আর পৃথিবীতে পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। আমি উত্তরায়ণে দিনের বেলায়ই দেহত্যাগ করবো। বাবার এই কথা শুনে উপস্থিত ভক্তগণ ও গোয়ালিনী এবং আপামর আশ্রমবাসীগণ চোখের জলে ভাসতে থাকেন। তারা বাবার চরণে অশ্রুজলে আকুতি জানাতে থাকেন যেন বাবা তাঁদের ছেড়ে না যান। কিন্তু বাবা তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

বাবা লোকনাথ উত্তরায়ণের সময় কেন দেহত্যাগ করার জন্য বেছেছিলেন, সেই সম্বন্ধে কিছু কথা বলার দরকার।

মনুসংহিতা অনুযায়ী পৃথিবীর ৬ মাসে দেবতাদের একদিন এবং ৬ মাসে এক রাত্রি। দেবতাদের দিনকে বলা হয় উত্তরায়ণ এবং রাত্রিকে বলা হয় দক্ষিণায়ন। দেবতাদের একটি দিন হয় তিনটি ঋতুকে নিয়ে বর্ষা, শরৎ ও হেমন্ত। অর্থাৎ এই তিন ঋতু উত্তরায়ণ। দেবতাদের একটি রাত্রি হয় বাকি তিনটি ঋতুকে নিয়ে গ্রীষ্ম, শীত ও বসন্ত অর্থাৎ এই তিন ঋতু দক্ষিণায়ন। আমাদের যেমন ১২ মাসে এক বছর হয়, দেবতাদের তেমন একদিন ও এক রাতকে সৌরবর্ষ বলে। দেবতাদের এক বছর মানে ৩৬০ সৌরবর্ষ। এইরকম ৬৩০ সৌরবর্ষে এক দিব্যবৰ্ষ হয়, আর ১২ হাজার দিব্যবর্ষে চতুর্যুগ।

বাবা লোকনাথ উত্তরায়ণে দেহত্যাগ করতে চেয়েছিলেন অর্থ এই যে, তিনি দেবতাদের দিনের বেলায় ব্রহ্মলোকে পদার্পণ করতে চেয়েছিলেন। যেহেতু জ্যৈষ্ঠ মাসে বর্ষা ঋতুর আগমন ঘটে, সেইজন্য তিনি উত্তরায়ণের প্রথম ঋতুতেই এই ধরাধাম ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন।

বাবা লোকনাথ যে সূর্যরশ্মি ভেদ করে ব্রহ্মলোকে চলে যাবেন বলে ভক্তদের জানিয়েছিলেন, সেই কথারও বিশেষ অর্থ আছে। সূর্যরশ্মি ভেদ করে কোনো পুণ্যাত্মার ব্রহ্মলোকে যাবার প্রক্রিয়াকে আত্মার উক্ৰমণ বলা হয়।

কোনো পুণ্যাত্মা যখন ব্রহ্মলীণ হন, তখন তার আত্মা যে পথে ব্রহ্মলোকে গমন করে তার একটি রূপরেখা এখানে উল্লেখ করছি।

প্রথম ধাপ : ব্ৰহ্মবিদদের ইহলোক ত্যাগ করার পর তাদের পুণ্যাত্মা প্রথমে অর্চি অর্থাৎ জ্যোতিতে গমন করে। মরদেহের অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার আগেই এই আত্মার গমন হয়। যখন কোনো ব্রহ্মবি যোগবলে তার আত্মার উক্রমণ ঘটান, তখন তার ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে একটি অগ্নিশিখারূপ আত্মা জ্যোতিতে গমন করে।

দ্বিতীয় ধাপ : দ্বিতীয় ধাপে সেই আত্মা অর্চি থেকে দিবসে গমন করে।

তৃতীয় ধাপ : তৃতীয় ধাপে আত্মারূপ জ্যোতি দিবস থেকে শুক্লপক্ষে গমন করে।

চতুর্থ ধাপ : চতুর্থ ধাপে সেই আত্মারূপ জ্যোতি শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের পথে ৬ মাস থাকে।

পঞ্চম ধাপ : পঞ্চম ধাপে সেই আত্মারূপ জ্যোতি উত্তরায়ণ থেকে সম্বৎসরে গমন করে।

ষষ্ঠ ধাপ : ষষ্ঠধাপে সেই আত্মারূপ জ্যোতি সম্বৎসর থেকে আদিত্যে গমন করে।

সপ্তম ধাপ : সপ্তম ধাপে সেই আত্মারূপ জ্যোতি আদিত্য থেকে চন্দ্রমাতে গমন করে।

অষ্টম ধাপ : অষ্টম ধাপে সেই জ্যোতি চন্দ্রমা থেকে বিদ্যুল্লোকে গমন করে। বিদ্যুল্লোকে এক দিব্যপুরুষ এসে সেই জ্যোতিকে ব্রহ্মলোকে নিয়ে যান। এই হল দেবপথ। কোনো পুণ্যাত্মার এই দেবপথ গমনের নাম উক্রান্তি। যাঁরা ব্রহ্মজ্ঞানী, তাদের প্রাণ অর্থাৎ আত্মা ব্রহ্মলোকে উক্রান্তি হয়। অর্থাৎ ব্রহ্মেতে লয় হয়। এই হল আত্মার চরম মুক্তি বা নির্বাণ। যিনি ব্রহ্মচর্যে সিদ্ধ হয়ে স্বল্পদ্মস্থিত ব্রহ্মের উপাসনা করেন, তিনি মরদেহ ত্যাগ করলে মূর্ধাভিমুখে প্রসারিত সুষুম্না নাড়ি অবলম্বন করে উৰ্দ্ধদিকে গমন করেন। মহাযোগীগণ যোগবলে ব্রহ্মরস্থিত সুষুম্না নাড়ির দ্বারা উক্ৰমণ পদ্ধতি অবলম্বন করে সূর্যরশ্মি ভেদ করে সূর্যমণ্ডলে প্রবেশ করেন। তারপর ক্রমে ব্রহ্মলোকে গমন করে ভগবৎসাযুজ্য লাভ করেন।

তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমাকালে আমি নর্মদা তটে এমনভাবে যোগীদের ব্ৰহ্মলীণ হবার ঘটনা শুনেছি। নর্মদার দক্ষিণ তটে ব্রহ্মাণ ঘাটে মা নর্মদার কৃপাধন্যা এমন এক যযাগিনীর সমাধিস্থলে বসেছিলাম যিনি মাত্র কয়েক বছর আগে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এবং অগণিত ভক্তদের চোখের সামনে এইভাবে ব্রহ্মলীণ হয়েছিলেন। তাঁর আত্মস্বরূপ জ্যোতি ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে সকলের সামনে উপরে আকাশে সূর্যরশ্মির সঙ্গে মিলে যায়।

বাবা লোকনাথও উত্তরায়ণে দিনের বেলায় সকলের সামনে সূর্যরশ্মি অবলম্বন করে ব্রহ্মলোকে উক্রমণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসার আগে একদিন বাবা তার ভক্তদের বলেন, আমার মৃত্যুর পর এই দেহটি আগুনে পোড়ায়ে দিস। যখন তিনি দেহত্যাগের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেন, তখনই পরিব্রাজনে থাকা রামকুমার চক্রবর্তী বাবার সূক্ষ্ম নির্দেশ পান অবিলম্বে বারদীতে বাবার কাছে আসার জন্য। দেহত্যাগের সমস্ত আয়োজন সারা হয়ে গেছে।

তারপর এলো সেই দিন। ১২৯৭ সনের ১৯শে জ্যৈষ্ঠ। খুব সকালে উঠে বাবা আদেশ করলেন সমস্ত আশ্রমবাসীদের ভোজন বেলা ৯ টার মধ্যে শেষ করতে হবে। বাবা তার আসন ঘরে সকাল থেকে রয়েছেন। বেলা ১০টার সময় তিনি নিজে খোঁজ নিয়ে জানলেন সকল আশ্রমবাসীর ভোজন সমাধা হয়েছে কি না। তারপর তিনি আত্মস্থ হলেন। পরিষ্কার উজ্জ্বল দিন। সূর্য অতি উজ্জ্বলভাবে তার কিরণ জাল বিস্তৃত করেছেন। ব্রহ্মচারী বাবা সকল ভক্তের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্থির হয়ে গোমুখাসনে বসলেন। তাঁর পিঠ পিছনে একটি কাঠের তক্তায় ঠেস দেওয়া ছিল। যোগবলে তাঁর আত্মা আলাদা হয়ে গেল। দেহ স্থির। চক্ষু পলকহীন। সকল ভক্তের উৎকণ্ঠিত চক্ষু বাবার দিকে প্রসারিত। যখন তিনি সমাধি অবস্থায় থাকেন, তখনও তার দেহ এইপ্রকার স্থির থাকে, চক্ষু পলকহীন থাকে, কিন্তু কিছু সময় পরে আবার সেই দেহ নড়ে ওঠে, বাবা কথা বলেন। কিন্তু আজ প্রায় ২ ঘন্টা হতে চললো সেই দেহ নড়ে উঠলো না। কেউ সাহস পাননা সেই দেহকে স্পর্শ করতে পাছে বাবার ধ্যানভঙ্গ হয়। ভক্তদের মধ্যে কেউ কেউ ডুকরে কেঁদে ওঠেন এই বলে যে বাবা বোধহয় আর নাই। কেউ কেউ অধীর আগ্রহে দেহের দিকে তাকিয়ে থাকেন যদি অন্যদিনের মতো এই দেহটি আবার নড়ে ওঠে। বাবা বুঝি এইবার কথা বলবেন।

কিন্তু না, ওই দেহ নড়ে ওঠার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। অবশেষে সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটের সময় ভক্তগণ মিলে পরামর্শ করলেন যে একবার দেহটি স্পর্শ করে দেখলে হয়। তখন জানকী ব্রহ্মচারী (যিনি বাবার নিত্য সেবায় নিয়োজিত ছিলেন এবং বাবার পরে তাঁকেই আশ্রমের গুরুরূপে চিহ্নিত করে গিয়েছিলেন। বাবার দেহ স্পর্শ করতেই বুঝলেন যে এই পুণ্যদেহ থেকে বাবার পুণ্যাত্মা চিরদিনের মতো বিদায় নিয়ে দেবলোকের পথে উক্রমণ করেছে। এই কথা প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গে বারদী আশ্রম জনারণ্যে পরিণত হলো। বাবার অগণিত ভক্ত সেই পুণ্য দেহটি একবার শেষ দর্শনের জন্য আশ্রমে এসে উপস্থিত হতে লাগলেন। প্রত্যেকেরই চোখে জল। প্রত্যেক ভক্তের মনই আজ বাবার বিরহ ব্যথায় কাতর, বিষণ্ণ।

এরপর শুরু হল অন্ত্যষ্টিক্রিয়া। বাবার পুণ্যদেহকে ধৃত ও চন্দনে চর্চিত করা হলো। অনেক ভক্ত সেই কার্যে অংশগ্রহণ করে পুণ্য অর্জন করলেন। তারপর আশ্রমেই এক চন্দন কাঠের মহাচিতা সজ্জিত হলো। কয়েকজন ভক্ত মিলে বাবার পুণ্যদেহকে শেষবারের মতো স্পর্শ করে চিতায় স্থাপন করলেন। তারপর বাবার নির্দেশ অনুযায়ী রামকুমার চক্রবর্তী বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা বাবার মুখাগ্নি করে চিতায় অগ্নি সংযোগ করলেন। যে দেহে নিত্য অগ্নি বাস করতেন সেই দেহকে তিনিই গ্রহণ করলেন। বাবার দাহক্রিয়া সকল ভক্তের সামনে সমাধা হল। বাবার মরদেহকে অগ্নিদেব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে যোগসাধনার এক জীবন্ত অনন্য মূর্তি এই জগৎ সংসার থেকে বিলীন হয়ে গেল। রয়ে গেল কেবল তার কীর্তিকথা। বাবার নির্দেশ পালনের পর রামকুমার কাশী গিয়ে মণিকর্ণিকার ঘাটে ধ্যানাবিষ্ট হয়ে মরদেহ ত্যাগ করলেন এবং তিনিও উত্তরায়ণের পথে দেবলোকে যাত্রা করলেন।

বাবা লোকনাথ ইচ্ছামৃত্যুসিদ্ধি লাভ করেছিলেন যা ছিল তার অষ্টাদশসিদ্ধির অন্তর্গত। যখন ইচ্ছা তখনই তিনি দেহত্যাগ করার অধিকারী ছিলেন। তাঁর স্তরের ঈশ্বরকোটির যোগী নিম্নভূমিতে সাধারণতঃ দৃশ্যমান হননা। কেবল গুরুর আজ্ঞায় ও গুরুকার্যে লোকশিক্ষা ও লোককল্যাণ হেতু তিনি প্রায় ২৭ বছর নিম্নভূমিতে ছিলেন। ইচ্ছা হলে তিনি হয়তো আরও অনেক বছর থাকতে পারতেন। তার সমসাময়িক ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ তৈলঙ্গস্বামী, আব্দুল গফুর আরও অনেক বেশিদিনই এই ধরাধামে অবস্থান করেছিলেন। নর্মদা তটে একজন ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের কথা জানি যিনি প্রায় ৪৫০ বছর দেহধারণ করে ছিলেন। কিন্তু বাবা লোকনাথের অগণিত ভক্তদের মিলিত ইচ্ছাশক্তি তাকে এই ধরাধামে আটকে রাখতে পারেনি। বাবা ছিলেন প্রেমভক্তির কাঙাল। ভক্তিরসে সিঞ্চিত হয়ে শিশুর মতো বাবা ডাক তিনি কখনও উপেক্ষা করতে পারতেন না।

 এই কথার সব থেকে বড়ো প্রমাণ ছিল, যখন বাবা নিম্নভূমিতে অবতরণ করে ত্রিপুরার দাউদকান্তি গ্রামে এসে একটি গাছের নিচে অবস্থান করছিলেন, সেইসময় একটি চাষীর মেয়ে তাঁকে দেখতে পেয়ে প্রথম বাবা সম্বোধন করে। সে রোজ বাবার জন্য খাবার বানিয়ে তার কাছে নিবেদন করে যেত। কিন্তু বাবা তখন না কথা বলতে পারতেন, না কোনো শক্ত খাবার খেতে পারতেন। মেয়েটি বাবার এই অবস্থা অবগত হয়ে নিজের হাতে সুজির পায়েস বানিয়ে এনে বাবাকে পিতৃস্নেহে খাইয়ে দিতেন। এই মেয়ের সেবায়েই বাবা নিম্নভূমিতে এসে প্রথমে খাদ্যগ্রহণ ও কথা বলার শক্তি পান। সেজন্য বাবা বারদী চলে গেলেও এই মেয়েটি যেখান থেকে বাবাকে বাবা বলে ডাকতেন, তিনি সূক্ষ্ম রূপে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে আশীর্বাদ করতেন। মেয়েটির মমতা ভরা বাবা ডাক তিনি উপেক্ষা করতে পারতেন না।

বাবা লোকনাথ অনেক সময় বলতেন–একবার বাবা বলে ডেকে দেখ না–বাবা বলে সন্তান যেভাবে বাবার কাছে আসে, সেভাবে আমার কাছে এসে দেখ না। কিন্তু অন্তরে শিশুর আবেদন নিয়ে ভক্তি ও পিতৃস্নেহরসে পূর্ণ বাবা ডাক, যা তিনি সেই চাষীর মেয়ের ডাকে পেতেন, সেই মধুর অন্তরের ডাক তিনি ইদানিং কমই শুনতে পাচ্ছিলেন। বাবা বলে ডেকে যারা তাঁর কাছে আসতেন, সেটা তাঁর কাছে আনুষ্ঠানিক সম্বোধন ঠেকতো আবার অনেকের ডাকে ছিল স্বার্থসিদ্ধির প্রলেপ। পূর্ণব্রহ্ম বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সামনে সেইসব সম্বোধনকারীর মনের প্রতিটি ভাজ খুলে যেত। তিনি তাদের মনের অবস্থা বুঝতে পারতেন এবং একথা তিনি কিছু ভক্তকে জানিয়েও ছিলেন। তিনি মনে অনেক বেদনা নিয়ে ভাবতেন, সন্তান কি বাবার কাছে কেবল স্বার্থের জন্য আসে! তিনি কি এই দেহ কেবল জগতের লোকের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধারণ করে আছেন? যদি এই দেহ জগতের লোককে মুক্তির আলো না দেখাতে পারে, তবে এই দেহ থেকে কি লাভ? এই ভাবনা থেকেই তিনি তার মরদেহ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে সন্তানদের প্রতি যে অকৃত্রিম স্নেহ ও করুণা তার হৃদয়ে সঞ্চিত আছে, তিনি এই মরদেহে না থেকেও সেই স্নেহ ও করুণার ধারা তাঁর সন্তানদের উপর বর্ষণ করতে পারেন। তবে কেন এই পঞ্চভূত জরাজীর্ণ দেহটিকে কষ্ট দেওয়া! সেইজন্য তাঁর পূর্ণব্রহ্ম রূপের প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি লোকনাথ রূপের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন।

মহাপ্রয়াণের পরেও তিনি সূক্ষ্মরূপে দর্শন দিয়ে অথবা তার সূক্ষ্ম প্রকাশের মাধ্যমে ভক্তের ডাকে প্রতিনিয়ত সাড়া দিয়ে চলেছেন। তিনি যে ভক্তের কাছে, তার সন্তানদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

রণে বনে জলে জঙ্গলে, যেখানেই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও। আমিই রক্ষা করিব।

এত বড়ো প্রতিজ্ঞা আজ পর্যন্ত কোনো মহাপুরুষের থেকে এই জগতের মানুষ শোনেনি। আজও বাবা লোকনাথ দেবলোকে থেকে সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেছেন। আর আজও তিনি অধীর আগ্রহে তার অগণিত ভক্তদের দিকে তাকিয়ে আছেন কেবল একটিবার সেই শিশুসুলভ বাবা ডাক শোনার জন্য। যে ডাকে থাকবে না কোন স্বার্থ, থাকবে না কিছু পাবার আশা। বাবার কাছে যে অগাধ অমূল্যধন সঞ্চিত আছে, তা তো তিনি ভক্তদের দেবার জন্য ভাণ্ডার খুলেই রেখেছেন, তবে সন্তানদের চাইবার দরকার কি! সন্তানের কী দরকার, পিতার থেকে ভালো আর কে জানে? কেবল বাবা বলে তার চরণে স্মরণ নিলে আর ভয় কি? আমাদের বাবা যে স্বয়ং ব্রহ্ম। তিনিই সৃষ্টিকর্তা, তিনিই সংহারকর্তা, তিনিই পালনকর্তা। কেবল একটি শিশুসুলভ নিঃস্বার্থ বাবা ডাক পেলেই তিনি কোলে তুলে নেবেন। আসুন আমরা সকলে সেই পূর্ণব্রহ্মস্বরূপ বাবাকে স্মরণ করি।

বাবা গো, আমি পরমব্রহ্মস্বরূপ শ্রীগুরুর কথা কীর্তন করি, পরমব্রহ্মস্বরূপ শ্রী গুরুর ভজনা করি, পরমব্রহ্মস্বরূপ শ্রীগুরুকে স্মরণ করি, পরমব্রহ্মস্বরূপ শ্রী গুরুকে নমস্কার করি।

আমি নিত্য, শুদ্ধ, নিরাভাস, নির্বিকার, নিরঞ্জন, নিত্যবোধস্বরূপ চিদানন্দময় গুরুব্রহ্ম শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে নমস্কার করি। একাধারে পিতা ও মাতা স্বরূপ বাবা লোকনাথ অখণ্ড মণ্ডলাকারে এই বিশ্বচরাচরের সর্বত্র ব্যাপ্ত থেকে তার যে স্বরূপ আমাকে দর্শন করিয়েছেন, আমি তাঁর সেই পুণ্যপদে আমার বিনম্র প্রণাম নিবেদন করি।

হে বাবা লোকনাথ, তুমি পূর্ণব্রহ্মরূপে ওঁকারে বিরাজ করছে। তুমি দেবাদিদেব মহাদেব, তুমি চতুর্ভূজ নারায়ণ, তুমি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, আবার তুমিই ব্রহ্মময়ী আদ্যাশক্তি স্বরূপিনী মাতা কালিকা। যে ওঁকারের মধ্যে তোমার এই অত্যুজ্জ্বল ব্রহ্মরূপ বিরাজ করছে, আমি সেই ওঁকার চরণে কোটি কোটি প্রণাম নিবেদন করি। তোমার ব্রহ্মজ্ঞানের আঁধারে আমায় অমরত্ব প্রদান কর–আমার দেহ যেন সুকর্মে উপযুক্তভাবে নিয়োজিত হয়, আমার জিহ্বা যেন অতিশয় মধুরভাষী হয়ে তোমার জয়গান করতে পারে, আমার কর্ণদ্বয় যেন সর্বদা তোমারই নাম শুনতে পায়, আমার চক্ষুদ্বয় যেন পরমেশ্বরকে দর্শনের জন্য উজ্জ্বল অন্তদৃষ্টি লাভ করে, আমার মন যেন সর্বদা ঈশ্বরাভিমুখী হয়ে তোমার নাম জপ করে। তুমি ব্রহ্মের কোষস্বরূপ বিরাজিত এবং প্রজ্ঞা দ্বারা আবৃত আছো। তুমি কৃপা করে আমার সমস্ত শরীর কোষ ও দিব্যনাড়ীকে জাগ্রত করে অজ্ঞানতা নাশ করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে ঈশ্বর সাধনার উপযুক্ত করে দাও এবং তোমার দ্বারা প্রদত্ত জ্ঞানকে রক্ষা করো।

অজ্ঞানতায় পাশবদ্ধ এই মন যদি কোনো অন্যায় করে থাকে, তুমি তোমার শিশুসন্তানকে নিজগুণে ক্ষমা করে তোমার চরণে ঠাই দিও।

হে সচ্চিদানন্দস্বরূপ বাবা লোকনাথ, আমার প্রতি প্রসন্ন হও। তোমাকে ভালোবেসে, তোমার চরণে যে পূজা নিবেদন করছি, তা গ্রহণ করে তোমার ওই রাঙা চরণে, তোমার ওই অভয় চরণে, তোমার ওই যুগল চরণে তোমার সন্তানকে স্থান দাও। তুমি আমার কাছে সঙ্গোপনে রয়েছ, সেই গোপনের আস্তরণে থেকেও তুমি আমার রক্ষাকর্তা। হে পিতা, তোমার স্নেহের সন্তানের কাতর ডাক শোন, আকুল প্রার্থনা শোন। তোমার স্নেহের সন্তানের সশ্রদ্ধ প্রণাম গ্রহণ করো।

তুমি আমায় দেখ বাবা, আমি দেখি তোমায়
পিতা-পুত্রের এই আলাপন রেখ তুমি সঙ্গোপন।

.

প্রার্থনা

ও দয়াল প্রভু হে, আমি যেন তোমায় আপন করতে পারি। (৩)
আমি সাধনশূন্য, ভজনশূন্য, শক্তিশূন্য ভক্তিও শূন্য
কোন গুণে বল আমি তোমায় পাব হে (২)
 তুমি নিজ গুণে দয়া করে দেখা দিও গো মোরে।
ও দয়াল প্রভু হে ….।
ওই রাঙাচরণ দাও গো আমায় (২)
ওই যুগলচরণ দাও গো আমায় (২)
ওই অভয় চরণ দাও গো আমায় (২)
প্রভু আমি যখন যেভাবে থাকি
 দয়া করে দেখা দিও গো মোরে (২)
ও দয়াল প্রভু হে, আমি যেন তোমায়
আপন করতে পারি
 আমি সাধনশূন্য, ভজনশূন্য, আমি শক্তিশূন্য, ভক্তিশূন্য
 কোন গুণে বলল আমি তোমায় পাব হে
 তুমি নিজ গুণে দয়া করে দেখা দিও গো মোরে।
 ও দয়াল প্রভু হে…।

ভিড় সাধন পথের অন্তরায়–বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী।