বাবা লোকনাথের বারদী আগমন

ষষ্ঠ অধ্যায় – বাবা লোকনাথের বারদী আগমন

ভারত-চীনব্ৰহ্মদেশ বর্ডারে কারাবাস

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও বেণীমাধব যোগীবর তৈলঙ্গস্বামীর থেকে বিদায় নিয়ে হিমালয়ের তিব্বত অভিমুখে যাত্রা করলেন। বাবা লোকনাথ স্মরণ করলেন যে, তাকে সেই পথেই যেতে হবে যেখানে আবির্ভূত হবেন তার গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলি। তাকে পরজন্মে কর্মযোগে প্রবৃত্ত করে মুক্ত করার ভার তিনি নিয়েছেন। আবার উপনয়নে দণ্ডীঘরে মা কমলা দেবীকে কথা দিয়েছিলেন, তার পরজন্মে পুত্ররূপেই দেখা দেবেন। এই দুই অঙ্গীকার রক্ষার্থে এবং গুরুদেব নির্দেশিত লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজে ব্রতী হতে তাকে এমন স্থানে যেতে হবে যেখানে তিনি তার কার্য সমাধা করতে পারবেন। এই দায়িত্ব স্মরণ করে তিনি অভিন্ন হৃদয়সঙ্গী বেণীমাধবকে নিয়ে চীন-তিব্বত সীমান্ত অতিক্রম করে নিম্নভূমিতে প্রবেশ করেন।

এইভাবে যখন তারা ভারতের নিম্নভূমিতে প্রবেশ করেন, তাঁদের এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। দুই ভারতীয় মহাযোগী তখন ছিলেন নগ্নদেহ, দীর্ঘজটাজুটো শত্রুধারী, বড় বড় নখযুক্ত এবং বাক্যরহিত। দীর্ঘদিন তরল পদার্থ ও কন্দমূল ভক্ষণে তারা বাশক্তি রহিত ছিলেন। বাবা লোকনাথের ছিল পলকহীন চক্ষুদ্বয়। সেইসময় চীন-ব্রহ্মদেশ-ভারত বর্ডারে ইংরেজ আধিকারিকরা ছিলেন। তারা এই ভারতীয় মহাযোগীদের পরিচয় জানতেন না, এমনকি, তখন ভারতীয়রাও তাদের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতো না। ইংরেজ আধিকারিকেরা তাঁদের চোরাকারবারী সন্দেহে আটক করলেন। চীন-ভারত পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়ে তখন চোরাকারবারী সাধু-সন্ত সেজে জটার মধ্যে ও থলিতে সোনা-মোহর, গাঁজা-আফিম ইত্যাদি পাচার করতো। শুল্ক বিভাগের লোক মহাযোগীদের সেইরকম কোনো চোরাকারবারী ভেবেছিলেন। তারা যোগীদের জটা-শ্মশ্রু ধরে অনেক টানাটানি করে কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য পেলো না এবং জটা ও শ্মশ্রু আসল বলে বুঝতে পারলেন। তা সত্তেও তারা তাদের আটক করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চালান করলেন। এই যোগীদ্বয় বাকশক্তি রহিত হবার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কোনো কথা ব্যক্ত করতে সমর্থ হলেন না। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বাবা লোকনাথ স্থির, অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন। তাঁর চোখ থেকে এক দিব্যজ্যোতি ঠিকরে বের হচ্ছিল। ম্যাজিস্ট্রেট তার চোখের দিকে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে গেলেন। বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব মুখে কোনো কথা ব্যক্ত করতে না পারলেও, তাঁদের চোখের দৃষ্টি যেন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সব ব্যক্ত করলো। ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট বুঝতে পারলেন, এই দুই ভারতীয় সাধু সাধারণ যোগী নন। এঁদের মধ্যে উচ্চ অলৌকিক ক্ষমতা আছে। তিনি দুই মহাযোগীকে তৎক্ষণাৎ সসম্মানে মুক্তির আদেশ দিলেন। বাবা লোকনাথ তখন ইঙ্গিতে অন্য সকল সাধুদেরও মুক্তি প্রার্থনা করলেন। ম্যাজিস্ট্রেট বাবা লোকনাথের তুষ্টির জন্য আটক অন্যান্য সাধুদেরও মুক্তির আদেশ দিলেন। এরপর বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব নিম্নভূমিতে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠলেন।

.

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে বাবা লোকনাথ

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উঠে বাবা লোকনাথ ও বেণীমাধব একটু বিশ্রামের জন্য জায়গা খুঁজতে শুরু করলেন। শুল্ক বিভাগের আধিকারিকদের হয়রানি, হাজতবাস এবং দীর্ঘ পার্বত্যপথ অতিক্রমের ধাক্কায় তারা তখন খুবই ক্লান্ত। অবশেষে ওই পাহাড়ের উপরে বনাঞ্চল বেষ্টিত নির্জন একটি গুহার খোঁজ পান। সেখানেই তারা বিশ্রাম নেবার মনস্থ করলেন।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গুহায় প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরেই ঘটে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড। যে গুহায় তারা অবস্থান করছিলেন, তার অল্পদূরে এক বাঘিনী হঠাৎ তীব্র গর্জন করতে শুরু করে। অনেকক্ষণ ধরে বাঘিনী গর্জন করতে থাকলে বাবা লোকনাথ ধ্যানস্থ হয়ে জানতে পারলেন যে, একটি বাঘিনী কিছু সময় পূর্বে জঙ্গলের মধ্যে সন্তান প্রসব করেছে। সামনে দুজন মনুষ্য দেখতে পেয়ে ভীত হয়ে সে সন্তানদের আগলে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করছে। ধ্যানে বাঘিনীর মনোভাব জানতে পেরে বাবা লোকনাথ বাঘিনীকে বলেন, তোমার কোনো ভয় নেই মা। তুমি শিশুসন্তান নিয়ে সুখে নিদ্রা যাও। আমরা ব্রহ্মচারী, আমাদের কাছ থেকে তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি আর চিৎকার কোরো না, শান্ত হও। এই কথা শুনে বাঘিনী আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে যায় ও তার সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরের দিন সকালবেলায় বাঘিনী আবার গর্জন শুরু করে। বাবা লোকনাথ আবার ধ্যানস্থ হয়ে জানতে পারেন যে, নবপ্রসূত বাঘিনী সন্তানদের একা রেখে কিভাবে শিকারে যাবে বুঝতে না পেরে গর্জন করছে। বাঘিনীর মনের ভাব বুঝতে পেরে বাবা লোকনাথ তাকে বললেন, তুমি সন্তানদের এখানে রেখে শিকার করতে যাও, তাদের জন্য চিন্তা কোরো না। আমি এদের রক্ষা করবো। বাবার এই কথা শুনে বাঘিনী নিশ্চিন্ত মনে একা শিকারে বের হয়। শিকারে গেলে বাবা বাঘিনীর সন্তানদের রক্ষা করতেন। বাঘিনী শিকার থেকে ফিরে দু-তিনবার আওয়াজ করে বলে দিত যে সে ফিরে এসেছে। এরপর বাঘিনী যখনই শিকারে যেত, বাবাকে তার মনোভাবে জানিয়ে যেত। আবার যখন ফিরে আসতো, তখনও আওয়াজ করে জানিয়ে দিত। এইভাবে কিছুদিন অবস্থান করার পর বাবা লোকনাথ ও বেনীমাধব ওই স্থান ত্যাগ করে কিছুদূর এগিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল সেই বাঘিনীর প্রচণ্ড গর্জন। তারা যত এগোতে লাগলেন, গর্জন বাড়তে লাগলো। তখন বাবা লোকনাথ বেণীমাধবকে বললেন, বেণী, আজ আর যাওয়া হল না, বাঘিনীর বড় কষ্ট হচ্ছে। আর কয়েকদিন এখানে থেকে যেতে হবে। দুজনে ফিরে এসে বাঘিনীকে বললেন–যতদিন তোমার ছেলেরা তোমার সঙ্গে যেতে না পারবে, ততদিন আমরা এখানে থেকে গেলাম। আর দুঃখ কোরো না। এখন চুপ করো। বাবার এই কথা শুনে বাঘিনী চুপ করে গেল। এরপর মাসখানেক সময় অতিবাহিত হবার পর বাঘিনী তার সন্তানদের নিয়ে শিকারে চলে যায়। এই ঘটনার কথা বাবা লোকনাথ তাঁর প্রিয় শিষ্য শ্রীযুক্ত যামিনীকুমার মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে বলেছিলেন। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওই স্থানে বাবা লোকনাথের ভব্য মন্দির বর্তমানে তীর্থযাত্রীদের চিত্ত আকর্ষণ করে। বারদী থেকে চট্টগ্রাম হয়ে এই মন্দিরে যেতে হয়।

যখন দুই ব্ৰহ্মজ্ঞানী মহাযোগী চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থান করছেন, তখন সেই পাহাড়ের কোলে বনের মধ্যে সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী তপস্যারত ছিলেন। সাধক বিজয়কৃষ্ণ প্রথম জীবনে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করে নিরাকার ব্রহ্মোপসনায় লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু তাতে তার মন ভরছিল না। এরপর তিনি সাকার দেব-দেবীর উপাসনায় আকর্ষণ অনুভব করলেন। একবার সাকার, একবার নিরাকার–এইরূপ দুই সাধনার দোলাচলে তিনি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না। অশান্ত মনে সাধনায় তার তখনও ঈশ্বর দর্শন সম্ভব হয়নি। হতাশায় জর্জরিত হয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গলে সাধনা করতে করতে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে পাহাড়ের নিচে তিনি ঈশ্বর দর্শন উদ্দেশ্যে ধ্যানমগ্ন।

একদিন সেই বনাঞ্চলে দাবানলের সৃষ্টি হল। চোখের পলকে সেই দাবানল বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। যে জায়গায় বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ধ্যানরত, সেই জায়গার চারিদিক দাবানল বেষ্টিত। পাহাড়ের উপরে গুহায় বাবা লোকনাথ তখন যোগ সাধনায় মগ্ন। তিনি যোগবলে জানতে পারলেন যে, নিচে পাহাড়ে গায়ে সাধক বিজয়কৃষ্ণ দাবানল বেষ্টিত হয়ে আছেন। তিনি যোগবলে সেখানে পৌঁছে দাবানলের ভিতর থেকে বিজয়কৃষ্ণকে উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় একটি পাথরের উপর বসিয়ে নিজের গুহায় প্রত্যাবর্তন করেন। সাধুক বিজয়কৃষ্ণের যখন বুত্থান হল তিনি চারিদিকে তাকিয়ে সেই দাবানলের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করলেন। কিন্তু তিনি কি করে সেই দাবানল থেকে রক্ষা পেয়ে এই পাথরের উপর এলেন, তা বুঝতে পারলেন না। চতুর্দিক অবলোকন করেও তিনি কারো সন্ধান পেলেন না। তার চোখের সমানে দাবানল তখনও জ্বলছে; তার ধ্যানস্থান তখনও দাবানল বেষ্টিত। কিন্তু তিনি কিভাবে এখানে এলেন, তা কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। জানতে পারলেন না, এক ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগী তাকে উদ্ধার করে এখানে রেখে গেছেন। তিনি বিমূঢ়ভাবে চতুর্দিকেতার উদ্ধারকর্তাকে অনুসন্ধান করতে থাকলেন।

এই ঘটনার পর আরও কিছুদিন বাবা লোকনাথ চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ধ্যানযোগে অতিবাহিত করলেন। তারপর তার স্মরণ হল যোগীবর তৈলঙ্গস্বামী ও গুরু ভগবান গাঙ্গুলির কথা। কেবল পাহাড়-পর্বতে যোগানুষ্ঠান করলেই হবে না, তাদের এখন নিম্নভূমিতে গিয়ে নিষ্কাম কর্মের মধ্য দিয়ে লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজ করতে হবে। তাই বাবা লোকনাথ বেণীমাধবকে সেই কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং দুজনে চন্দ্রনাথ পাহাড় ত্যাগ করতে মনস্থ করলেন।

চন্দ্রনাথ পাহাড় ত্যাগ করা দুই মহাযোগীর কাছে কেবল স্থান ত্যাগ করা নয়। নিম্নভূমিতে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দুজনের নিষ্কামকর্মে ব্ৰতী হতে হবে। তার জন্য এই দুই মহাযোগীর দীর্ঘজীবনের অভিন্নসঙ্গও ত্যাগ করতে হবে। জন্মের পর থেকেই দুজন অভিন্ন সঙ্গী হয়েছিলেন। একইদিনে উপনয়ন হয়ে এগারো বছর বয়সে দুজনে একসঙ্গে গুরুর হাত ধরে সন্ন্যাসী হবার বাসনায় ঘর ছেড়েছিলেন। দুজনে একসঙ্গে সাধনযাত্রার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে সিদ্ধিলাভ করেছেন, বিশ্বপর্যটন করেছেন। দীর্ঘ প্রায় ১০০ বছরের সঙ্গ চিরদিনের মতো ত্যাগ করে এখন তাদের ভিন্ন স্থানে নিষ্কাম কর্মে ব্রতী হতে হবে। এ বড় কঠিন কাজ। কিন্তু এই দুই মহাযোগী জীবনে অনেক কঠিন, অসম্ভব কাজকে সম্ভব করেছেন। আজও তারা এই কঠিন কাজকে সহজ করে নিয়ে নিজ নিজ বাসনা ব্যক্ত করলেন। ব্রহ্মচারী বেণীমাধব তার হৃদয়ের অভিন্ন সঙ্গী বাবা লোকনাথকে বললেন, তিনি দেবীর একান্নপীঠের অন্যতম কামরূপ তীর্থে গিয়ে কামাখ্যাধামে কর্মে রত হবেন। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী তার জীবনের সর্বক্ষণের সঙ্গী বেণীমাধব ব্রহ্মচারীকে বললেন, তিনি তার নিম্নভূমির কর্মস্থলের পথে ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। দুই মহাযোগীর এই কথোপকথন কোনো বাক্য বিনিময়ের মাধ্যমে হল না, কারণ, দুজনেই বাকরহিত। উচ্চমার্গের যোগীগণ যোগের মাধ্যমেই তাদের ভাবের আদানপ্রদান করেন। একজনের ইচ্ছা অন্যজন বুঝতে পারেন। মহাযোগীদের এই এক অপূর্ব যোগলীলা। নর্মদা পরিক্রমাকালে উচ্চমার্গের মুনিদের এইরূপ যোগলীলার কথা আমি শুনেছি। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যে স্থানে দাঁড়িয়ে দুই মহাযোগী তারা তাদের বাসনা প্রকাশ করলেন, সেখান থেকে এই দুই যোগীর যাত্রাপথ ভিন্ন হল বেণীমাধব এগিয়ে চলেন কামাখ্যা ধামের পথে আর বাবা লোকনাথ এগিয়ে চলেন ত্রিপুরার পথে। চন্দ্রনাথ পাহাড় হয়ে ওঠে এক প্রসিদ্ধ শিবতীর্থ (বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থিত)।

.

ত্রিপুরার দাউদকান্তি (কাঁদি) গ্রামে বাবা লোকনাথ

অনেক পথ ঘুরতে ঘুরতে বাবা লোকনাথ ত্রিপুরার দাউদকান্তি গ্রামে পৌঁছে একটি বৃক্ষের নিচে বিশ্রামের জন্য বসলেন। এই গ্রামটিতে হিন্দু-মুসলমান চাষীদের বাস ছিল। বাবা লোকনাথ এইখানেই নগ্নদেহে অনাহারে কিছুদিন অতিবাহিত করলেন। মুখ দিয়ে তাঁর কোনো বাক্য বের হয় না, সেজন্য তিনি কারও সঙ্গে কোনো কথাও বলতে পারেন না। একদিন একটি দশ-বারো বছরের মেয়ে চাষের ক্ষেতে আব্বার জন্য খাবার নিয়ে যাবার সময় লক্ষ্য করলো, গাছতলায় একটি সন্ন্যাসী বসে আছেন। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না এবং কিছু খানও না। সন্ন্যাসীকে দেখে মেয়েটির মনে দয়া হল এবং সে তার কাছে গিয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। বাবা লোকনাথ কেবল তারদিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো বাক্য বের হল না। মেয়েটি তখন বাড়ি থেকে কিছু খাবার এনে তাকে খেতে দিলেন। কিন্তু দীর্ঘসময় কোনো শক্ত খাবার গ্রহণ না করার জন্য তিনি জিহ্বাতে কোনো খাবার নিতে পারলেন না। তার খাদ্য গ্রহণের অক্ষমতা দেখে মেয়েটির মনে করুণা হল। সে তখনই বাড়ি গিয়ে গরম দুধ এনে চামচে করে নিজেই বাবা লোকনাথকে খাইয়ে দিলো। এইভাবে মেয়েটি রোজ বাবার কাছে এসে তাকে সযত্নে দুধ খাইয়ে যায়। একদিন সে সুজির পায়েস (মোহন ভোগের মতো) এনে বাবাকে খাইয়ে দিলো। এইভাবে কয়েকদিন খাওয়াবার পর তিনি একটু করে খাদ্যগ্রহণে সমর্থ হলেন এবং দুই-একটি কথা উচ্চারণ করতে সমর্থ হলেন। মেয়েটি তখন বুঝলো যে সন্ন্যাসী বাবা অনেকদিন অনাহারে থাকার জন্যই কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। সে রোজ খাবার এনে বাবাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। এইভাবে বাবা শরীরে কিছু শক্তি সঞ্চয় করলেন এবং বাকশক্তি ফিরে পেলেন। কিছুদিন খাদ্যগ্রহণ করার পর তিনি দেখলেন, তার রক্তের রঙ, যা সাধনার সময় রসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার লাল হচ্ছে। তিনি সেই মেয়েটিকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। সেই নিম্নভূমিতে প্রথম ব্যক্তি যে বাবার কৃপালাভ করেছিল।

কিছুদিন একই স্থানে কাটাবার পর বাবা লোকনাথ স্মরণ করলেন যে, তাঁকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। সেই গ্রাম ছেড়ে তিনি আবার পথ চলা শুরু করলেন। একদিন তিনি পথে একটি গাছের নিচে আশ্রয় নিলেন। এই জায়গাটি অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার কাছাকাছি ছিল। কুমিল্লা জেলা ত্রিপুরার লাগোয়া। তিনি যখন বৃক্ষের নিচে ধ্যানমগ্ন, সেইসময় ডেঙ্গু কর্মকার নামক এক ব্যক্তি তাকে দেখতে পান। ডেঙ্গু কর্মকার একজন উলঙ্গ জটাজুটধারী সন্ন্যাসীকে বৃক্ষের নিচে বসে থাকতে দেখে তাঁর কাছে যান। ডেঙ্গু কর্মকার ছিলেন এক ফৌজদারী মামলার আসামী। প্রতিদিন ওই পথে তিনি উকিলের কাছে যাতায়াত করতেন। বাবা লোকনাথের উজ্জ্বল অঙ্গকান্তি ও অপলক চক্ষু দেখে তার মনে ভক্তিভাব হয় এবং তিনি তার আশীর্বাদ নেবার জন্য তার কাছে যান। তিনি বলেন আমি ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বারদী গ্রাম নিবাসী। দাউদকান্তি গ্রামে বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য আমাকে প্রায়শঃই আসতে হয়। আমি বর্তমানে একজন ফৌজদারী মামলার আসামী। কিছু ব্যক্তি শত্রুতা করে আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে। আপনি আমায় আশীর্বাদ করুন যেন আমি এই মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি পাই। বাবা ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে, ওই ব্যক্তি নির্দোষ। তিনি তাকে অভয় দিয়ে বললেন, তুই বাড়ি যা। তোর কোনো ভয় নেই। আদালতে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তুই দেখবি, তুই খালাস পেয়েছিস। এই অভয়বাণী শুনে ডেঙ্গু কর্মকার সেদিন বাড়ি ফিরে গেলো। এরপর আদালতে রায়দানের নির্দিষ্ট দিনে অত্যন্ত আশঙ্কা নিয়ে ডেঙ্গু কর্মকার এজলাসে উপস্থিত হন। তাঁর আশঙ্কা ছিল যে শেষপর্যন্ত তিনি বুঝি হেরেই যাবেন এবং তার ফল নিশ্চিত জেল। কিন্তু প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বিচার শেষে বিচারক ডেঙ্গু কর্মকারকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে রায় দেওয়ায় তিনি বেকসুর খালাস পেয়ে যান।

ডেঙ্গু কর্মকার আনন্দে আত্মহারা হলেও তার মনে পড়ে যায় গাছতলায় বসে থাকা সেই নাগাসন্ন্যাসীর কথা। তিনি আদালত থেকে বেরিয়েই দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করেন ওই গাছতলার দিকে। বাবা লোকনাথ তখন ধ্যানস্থ। তাঁর পা জড়িয়ে ধরে ডেঙ্গু কর্মকার হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। বাবাকে কিছু জানাতে হয় না, কারণ তিনি নিজেই তো সূক্ষ্মরূপ নিয়ে আদালতে তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করেছেন। ডেঙ্গু বলেন, এই খোলা আকাশের নিচে গাছতলায় আপনাকে রেখে আমি যাবো না। আপনি দেবতা, মহাপুরুষ। আপনি বারদীতে আমার বাড়িতে চলুন। সেখানে আমার সেবায় আপনি থাকবেন। তা না হলে আমি আপনার এই শ্রীচরণেই পড়ে থাকবো।

বাবা লোকনাথ তাঁকে পা ছাড়তে বলে ধ্যানাবিষ্ট হলেন। ধ্যানযোগেই তিনি জানতে পারলেন, যে কর্মের জন্য তিনি পাহাড় থেকে নিম্নভূমিতে এসেছেন, সেই কর্মস্থল বারদী। সেখানেই তিনি দেখা পাবেন তার পরমগুরু আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির বর্তমান জন্মের শরীর। মা কমলাদেবীও বর্তমান জন্মে সেখানে আছেন। আজ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার সময় এসেছে। গুরু নির্দেশিত লোকশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কাজও সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। এইসব ভেবে ঈশ্বরের ঐকান্তিক ইচ্ছায় তিনি ডেঙ্গু কর্মকারের প্রস্তাবে সম্মত হলেন।

.

বাবা লোকনাথের বারদী আগমন

ঢাকা জেলার মেঘনা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জ মহকুমায় বারদী ছিল এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এই অঞ্চলটি ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বতীরে অবস্থিত। ব্রহ্মপুত্র নদের এই পূর্বতীর সোনারগাঁ নামে প্রসিদ্ধ। সেইসময় সোনারগাঁ হিন্দু রাজাদের রাজধানী ছিল। জলযান এই অঞ্চলের মুখ্য যাতায়াতের মাধ্যম ছিল।

আনুমানিক বাংলা ১২৭০ সনে বাবা লোকনাথ বারদী গ্রামে পদার্পণ করেছিলেন। ওইসময় তার বয়স ছিল আনুমানিক ১৩৩ বছর। প্রথম যখন বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বারদী পদার্পণ করেছিলেন, তখন বারদীবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল এক দীর্ঘদেহী, আজানুলম্বিত বাহু, ভূতলস্পর্শী বিশাল জটা ও শ্বেত-শুভ্র শ্মশ্রু সমন্বিত এক মহাপুরুষকে। যার দুই হাত ও পায়ে বড় বড় নখ। যাঁর দৃষ্টি ছিল পলকহীন। দীর্ঘ কয়েক দশক বরফের দেশে অবস্থানের জন্য তার গাত্রচর্ম ছিল শ্বেতশুভ্র। তখনকার দিনে গ্রামে হিন্দু-মুসলমান সমাজ ছিল ভীষণরকম রক্ষণশীল। ডেঙ্গু কর্মকার এই মহাপুরুষের অলৌকিক শক্তির পরিচয় পেলেও গোঁড়া রক্ষণশীল হিন্দু-মুসলমান সমাজ নগ্নদেহী সাধুকে প্রথমে সুনজরে দেখেনি। ডেঙ্গু কর্মকারের পরিবারের লোকেরাও এই নগ্ন সন্ন্যাসী দর্শনে খুশি হয়নি। সেজন্য প্রথমে বাবা লোকনাথ ডেঙ্গু কর্মকারের বাড়িতে রক্ষিত একটি জীর্ণ নৌকার ছৈয়ের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ব্রহ্মজ্ঞানী বাবা লোকনাথের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ জ্ঞান ছিল না। তার কাছে বস্ত্র ও বিবস্ত্রর মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। কিন্তু ডেঙ্গু কর্মকারের বাড়ির লোকেরা ও গ্রামের লোকেরা এই উলঙ্গ সাধু দেখে খুব বিরক্ত হতেন। গ্রামের রাস্তায় দেখতে পেলে তার প্রতি সকলে কটুক্তি করতে এবং ছোটো ছেলেমেয়েরা তাকে পাগল মনে করে ঢিল ছুঁড়তো। বাবা কেবল তাদের প্রতি নীরবে করুণা দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন। যখন গ্রামের ছেলেরা তাকে পাগল বলে তাড়া করতে তিনি স্মিত হাস্যে তাদের প্রতি করুণাদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ডেঙ্গু কর্মকারের সন্তানরা বাবা লোকনাথের আগমনে খুশি হতে পারেননি। ডেঙ্গু কর্মকার একজন নগ্ন পাগলপ্রায় সাধুকে বাড়িতে এনেছেন দেখে তার পরিবারও আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ডেঙ্গু কর্মকার যখন তাঁর স্ত্রীর কাছে মামলায় খালাস পাওয়ার কথা বলেন, তখন তিনি আর আপত্তি করেননি। তিনি বুঝেছিলেন, নিশ্চয়ই এই সাধুর কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু গ্রামবাসী ও গ্রামের অন্য ব্রাহ্মণদের মনে এই সাধুকে নিয়ে ছিল অনেক প্রশ্ন। তারা প্রশ্ন করলো, যদি এই সাধু ব্রাহ্মণ হবেন, তবে তার যজ্ঞোপবীত নেই কেন? তিনি যে সত্যই ব্রাহ্মণ, তার প্রমাণ কি? একরাশ জটাজুট ও দাড়ি নিয়ে বিবস্ত্র হয়ে যোগাসনে বসে থাকলেই তো আর সাধু হওয়া যায় না! এই লোকটি কোনো ভণ্ড তপস্বীও হতে পারে। অনেকে তাকে বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ বলে মনে করলো। গ্রামবাসী ও ব্রাহ্মণদের এইরূপ অসন্তোষ প্রকাশ করা সত্তেও ডেঙ্গু কর্মকার নির্বিকার এবং বাবা লোকনাথকে গৃহে স্থান দেবার ব্যাপারে অটল রইলেন। গ্রামবাসীরা বাবা লোকনাথকে পাগল বলে উপেক্ষা করতে লাগলো।

এরপর একদিন ঘটলো এক চমৎকার ব্যাপার। একটি বাড়ির বাইরের বারান্দায় বসে তিনজন প্রবীণ ব্রাহ্মণ সকালে স্নানান্তে পৈতা গ্রন্থি দিচ্ছিলেন। কিন্তু পৈতার সুতো এমনভাবে জট পাকিয়ে গিয়েছিল যে, তারা কিছুতেই তা খুলতে পারছিলেন না। বাবা লোকনাথ সেইসময় ব্রহ্মপুত্র নদীতে স্নান সেরে সেই পথে ফিরছিলেন। তিন ব্রাহ্মণের গলদঘর্ম অবস্থা দেখে তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর ধীর পায়ে তাদের কাছে গিয়ে বললেন, কি, খুব সমস্যায় পড়েছে, তাই না? প্রবীণ ব্রাহ্মণত্রয় হৈ হৈ করে বললেন, তোর এখানে কি চাই? দূরে সরে দাঁড়া। আমরা স্নান সেরে এসেছি। তুই ছুঁয়ে দিলে আবার ডুব দিতে হবে। যা, নিজের কাজে যা। বাবা লোকনাথ স্মিত হেসে বললেন, কেন? ছুঁয়ে দিলে কি হবে? আমি ছুঁলে তোমাদের কি জাত যাবে? ব্রাহ্মণদের মধ্যে থেকে একজন তখন খেঁকিয়ে বলে উঠলেন, জাত তো যাবেই; জাত যাবে কিনা নিজে বুঝিস না হতচ্ছারা! তোর কি জাতের ঠিক আছে? মাথায় জটা রেখে গায়ে ভষ্ম মাখলেই যদি সাধু হওয়া যেত, তবে সাধু সন্ন্যাসীতে দেশ ছেয়ে যেত! বাবা লোকনাথ ব্রাহ্মণের কথায় বিন্দুমাত্র উম্মা প্রকাশ না করে স্মিত হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি গোত্র গা? প্রবীণ ব্রাহ্মণটি বললেন, কাশ্যপ গোত্র। বাবা লোকনাথ উচ্চারণ করলেন-কাশ্যপ গোত্র? ‘কাশ্যপ–অবসর-নৈ ধ্রুব প্রবর’ বাবা লোকনাথের মুখে এই কথা শুনে তিন অহঙ্কারী ব্রাহ্মণ কেবল হতচকিতই হলেন না, বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে মহাযোগী বাবা লোকনাথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কয়েক মুহূর্ত আগে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বলে যাদের মধ্যে আত্মম্ভরী ভাব প্রকট হয়েছিল, তারা এক পাগলপ্রায় বিবস্ত্র সাধুর মুখে কাশ্যপ গোত্রের গোত্ৰপবিতের কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। মহাযোগী বাবা লোকনাথ তাদের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার ডান হাতটি বাড়িয়ে দিলেন। প্রবীণ ব্রাহ্মণটি বিস্ময়াবিষ্ট থেকেই নীরবে হাতের জট পাকানো পৈতেটি যন্ত্রের মতো বাবা লোকনাথের হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু তিনি বাবা লোকনাথকে স্পর্শ করলেন না। বাবা লোকনাথ মুচকি হেসে বললেন, পাক লেগে যাওয়া পৈতে খুলতে হলে গায়ত্রী জপ করতে হয় গা। তবে গায়ত্রী জপে উচ্চারণ পরিষ্কার হওয়া দরকার। তারপর তিনি অস্ফুট স্বরে গায়ত্রী জপ করতে করতে জট পাকানো পৈতেটির দুই প্রান্ত ধরে সজোরে টান দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পৈতের পাঁচ খুলে গেল। ব্রাহ্মণত্রয় একে অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। তাদের চোখের ভাষা প্রকাশ করছিল–এ কোনো ছদ্মবেশী মহাপুরুষ নয় তো? মহাযোগী বাবা লোকনাথ পৈতের জট খুলে দিয়ে কাঠের খরম পায়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলেন। অহঙ্কারী ব্রাহ্মণত্রয় সেই পথের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকলেন। এই ঘটনা মুখে মুখে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। গ্রামের সমাজপতিগণ ও ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় যারা এতদিন সেই মহাযোগীর অপযশ কীর্তন করে বেড়াতেন তারা এখন তাকে ছদ্মবেশী কোনো মহাপুরুষ মনে করলেন এবং তাঁর চরণে আশ্রয় নিলেন। গ্রামবাসীরাও তাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতে আরম্ভ করলেন।

এদিকে মহাযোগেশ্বর বাবা লোকনাথ বারদী গ্রামে আগমনের পর গ্রামের প্রভুত উন্নতি হতে থাকে। তার আগমনের পূর্বে এই গ্রামে বসন্ত, কলেরা মহামারীতে প্রতি বছর অনেক লোক মারা যেত। কিন্তু এই মহাপুরুষের আগমনে সেই মড়ক বন্ধ হয়ে যায়। চাষীরা ক্ষেতে ভালো ফসল পেতে আরম্ভ করে। অনাবৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। মৎসজীবীরা নদীতে প্রচুর মাছ পেতে থাকে। গ্রামের সর্বদিক থেকে উন্নতি লক্ষিত হয়। গ্রামের লোকেরা তাকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করে এবং তার কাছে যা মানত করে, তা সিদ্ধ হয়। সমস্ত গ্রামবাসীরা এই মহাযোগীর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে।

এইসময় ইংরেজ নীলকর ওয়াইজ সাহেবের সঙ্গে নীলের কুঠি নিয়ে জমিদার নাগবাবুদের সঙ্গে জোর দাঙ্গা বাঁধে। ইংরেজদের অস্ত্রবলে জমিদার ভীত হয়ে পড়েন। তখন তার কানে তারই গ্রামের বসবাসকারী এক মহাযোগীর কথা যায়। তিনি জানতে পারেন, এই যোগী একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষ। জমিদার নাগবাবু তখন সেই মহাপুরুষের শরণাপন্ন হলেন। মহাযোগেশ্বর তাকে অভয় দেন। বাবা লোকনাথের আশীর্বাদে জমিদারের জয় হয় এবং ওয়াইজ সাহেবের নীলকুঠি উঠে যায়। এই ঘটনার পর বারদীর জমিদার নাগবাবুদের বাবা লোকনাথের উপর ভক্তিশ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়। তারা নিয়মিত বাবার কাছে যাতায়াত শুরু করেন।

এ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে ডেঙ্গু কর্মকারের মৃত্যু হয়। তার ছেলেরা কোনোদিনই বাবা লোকনাথের বাড়িতে অবস্থান ভালো চোখে দেখেনি। কিন্তু বাবার ভয়ে কিছু বলতেও পারেনি। তাদের আশঙ্কা ছিল যে যদি এই সন্ন্যাসী এখানে কোনো আশ্রম গড়ে তোলে তবে তাদের ভাগের অনেকটা জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে, তাই তারা বাবার অনুপস্থিতিতে বাড়ির মেয়েদের অসুবিধার কারণ জানিয়ে তাকে অন্যত্র চলে যেতে বলে। বাবা তাদের বলেন, আমি সন্ন্যাসী। এ বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে তোমাদের কিসে ভালো হয়, কিসে মঙ্গল হয়, তোমরা বোঝ নি।

বাবা লোকনাথ কর্মকার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন, এই কথা গ্রামে প্রচার হয়ে যায়। সে কথা ক্রমে জমিদার নাগবাবুর কানে যায়। তিনি তৎক্ষণাৎ মহাযোগীর দর্শনে এসে তার কাছে নিবেদন করেন যে, তাদের জায়গায় বাবার জন্য তিনি একটি আশ্রম গড়ে দিতে আগ্রহী। তিনি বাবার কাছে প্রার্থনা করেন তাঁর এই প্রস্তাবে রাজি হবার জন্য। কিন্তু বাবা বলেন, আমি সন্ন্যাসী। তোমাকে খাজনা কোথা থেকে দেবো? যদি তোমরা আমাকে এমন কোনো জায়গা দিতে পারো, যেখানে কোনো খাজনা দিতে হবে না, তবে আমি সেখানে আশ্রম করতে পারি। তখন জমিদার নাগবাবু বললেন, গ্রামের পূর্বদিকে শ্মশানের কাছে একটি পতিত জমি আছে। সেখানে শবদাহ হয় বলে কোনো খাজনা দিতে হয় না। আমি সে জায়গায় আপনাকে আশ্রম বানিয়ে দেবো। বাবা লোকনাথ জমিদারের এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। বারদীর নাগবাবু শ্মশান সংলগ্ন জমিতে বাবা লোকনাথের জন্য আশ্রম বানিয়ে বাবার আসনঘর তিনি নিজের হাতে ছনের চাল দিয়ে তৈরি করেন।

এই আশ্রমে বাবার আসন ঘরের বাইরে বড় উঠান ছিল এবং সোজাসুজি একটি বেলগাছ ছিল। বাবা লোকনাথ ডেঙ্গু কর্মকারের বাড়ি ত্যাগ করে এই আশ্রমেই তার বারদী লীলা করেছিলেন। ঈশ্বরকোটির মহাপুরুষ বলেই মহাযোগী বাবা লোকনাথ লোকালয়ে আবির্ভূত হয়ে লোকশিক্ষার ও সমাজ সংস্কারের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। জীবকোটির সিদ্ধ মহাপুরুষগণ ব্রহ্মদর্শনের পর ব্রহ্মলীন থাকেন, তারা নিম্নভূমিতে প্রবেশ করেন না। ঈশ্বরকোটির মহাপুরুষরূপে মহাযোগী বাবা লোকনাথের প্রকৃত আত্মপ্রকাশ ঘটে বারদীর এই আশ্রমে। এইরূপ মহাপুরুষ নিজেরা স্বয়ংই আত্মপ্রকাশ ঘটান। তারা স্বেচ্ছায় প্রকাশ না করলে, কেউ তাঁদের নাগাল পায় না। বাবা নিজেও বলেছেন, আমি ধরা না দিলে, আমায় ধরতে পারে কার বাপের সাধ্যি! এতদিনে বাবা কোটিতে বস্ত্র ধারণ শুরু করেছেন। একই বস্ত্রে শরীর আবৃত থাকত।

বারদীর এই আশ্রম যেদিন প্রতিষ্ঠা হল সেদিন উঠানে উপস্থিত গ্রামবাসীদের বাবা সেবা করিয়েছিলেন। সেদিন জমিদার নাগবাবুদের পরিবারবর্গও উপস্থিত ছিল। উঠানে যখন কলাপাতায় ভোগ পরিবেশন হচ্ছে, তখন বাবা দেখতে পেলেন এক কোণে একজন সাদা থান পরিহিতা মহিলা বসেছেন। তাকে খাদ্য পরিবেশন করা হয়েছে। বাবা স্মিতহাস্যে তাঁর সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মা তুমি কোথা থেকে এসেছো? সেই মহিলা বললেন, আমি গোয়ালিনী, আমার গরু আছে, কাছেই থাকি। দুধ বিক্রি করেই আমার দিন চলে। বাবা দিব্যদৃষ্টিতে এই গোয়ালিনী মায়ের মধ্যে তাঁর মা কমলাদেবীকে চিনতে পারলেন। পূর্বজন্মে এই গোয়ালিনী ছিলেন তাঁর জন্মদাত্রী। উপনয়নের সময় দণ্ডীঘরে তিনি মাকে কথা দিয়েছিলেন, পরজন্মে আবার তাকে পুত্ররূপে দেখা দেবেন। এখন সেই সময় সমাগত। তিনি গোয়ালিনী মাকে বললেন, রোজ তাকে দুধ খাওয়াতে। বারদীর এই আশ্রম থেকেই মহাযোগী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ধরাধামের লীলা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই আশ্রমের ঠিকানা–শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, বারদী, সোনারগাঁ, মহকুমা? নারায়ণগঞ্জ, জেলা-ঢাকা, বাংলাদেশ।

ডেঙ্গু কর্মকারের পরিবারের যারা একদিন বাবাকে চরম অসম্মান ও অবজ্ঞা করে বিতাড়িত করেছিল, অল্প কিছুকালের মধ্যেই সেই পরিবারে চরম সংকট ও বিপর্যয় নেমে আসে। গোটা সংসারটাই ধনেমানে বিনষ্ট হয়ে যায়। অবশেষে মাত্র দু’জন মানুষ জীবিত থাকে। যে বাড়ি থেকে একজন ঈশ্বরকোটি ব্রহ্মজ্ঞ মহাযোগীকে বিতাড়িত হতে হয় সেখানে কি ঈশ্বর অবস্থান করতে পারেন! অবশেষে যখন বাকি দুজন তাদের ভুল বুঝতে পারে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

কিন্তু এই বারদী আগমনও তার কাছে নিষ্কন্টক হল না। বারদী জমিদারদের অনেক শরিক ছিল। কোনো কোনো শরিক বলতে লাগলো, পৈতে নেই একজন ল্যাংটা সাধু আবার মহাপুরুষ হয় কি করে? একজন ল্যাংটা সাধুকে এখানে ঠাই দিলে মেয়েরা কি মনে করবে। সেই জন্য বাবা যখন বারদী আশ্রমে পদার্পণ করেন, তিনি নাগবাবুদের কাছ থেকে একটি পৈতা ও একটি শ্বেতবস্ত্র গ্রহণ করেন। তাও কোনো কোনো শরিকদের বৈরী ভাব যায় না। একজন শরিক বলেন, বাবা যদি এতই বড় মহাপুরুষ, এক সের দুধের মিষ্টান্ন রান্না কইরা সারা বারদী গ্রামের লোকরে খাওয়াউক তো দেখি! সেই কথা বাবা জানতে পারলেন। বাবা আশ্রমের ভোগশালায় এক সের দুধের পায়েস বানাতে বললেন। পায়েসকে বাংলাদেশে মিষ্টান্ন বলা হয়। সেই পায়েস তৈরি হলে বাবা সেই হাঁড়ি স্পর্শ করে সারা বারদী গ্রামের লোককে প্রসাদ দিতে বলেন। সেদিন সেই এক সের দুধের পায়েস প্রসাদ একহাতা করে সারা বারদী গ্রামের লোক পেয়ে ধন্য হয়েছিল। যতক্ষণ একজন লোকও বাকি ছিল, হাঁড়ির পায়েস শেষ হয়নি। এমনকি জমিদারদের বৈরী শরিকও সেই প্রসাদ পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন এবং বাবার কৃপা ভিক্ষা করেছিলেন।

বারদী গ্রামে এইভাবেই বাবা নিজের লীলা শুরু করেন।