বনে বনে অষ্টাঙ্গ যোগসাধনা

চতুর্থ অধ্যায় – বনে বনে অষ্টাঙ্গ যোগসাধনা

অরণ্যপথে ক্ষুধাতৃষ্ণা জয়

যোগসাধনা কল্পে কালীঘাটের থেকে এগিয়ে গঙ্গা পেরিয়ে পশ্চিমদিকে বর্তমান হাওড়া জেলার তৎকালীন অরণ্যপথে এগিয়ে যেতে লাগলেন আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি, লোকনাথ ও বেণীমাধব। পথে কোনো বসতি নেই, দেখা গেল না কোনো লোকালয়, যেখান থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে। অবিরাম পথ চলা। চারিদিকে জঙ্গল আর জঙ্গল। কেবল শোনা যায় কখনো কখনো পশুর ডাক। পথশ্রমে ক্লান্ত দুই বালক সন্ন্যাসী ক্রমেই ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লেন। এই গহন বনে খাদ্য ও পানীয় জল পাবার কোনো সম্ভাবনা নজরে এলো না। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি বালক শিষ্যদের কাতর অবস্থা দেখে ঈশ্বরের কাছে আকুল প্রার্থনা জানাতে লাগলেন বালকদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর করার জন্য। বনে চলতে চলতে হঠাৎ এক সন্ন্যাসী আবির্ভূত হয়ে আচার্যদেবকে বললেন, তোমরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর। আমি তোমাদের এই দানা দিচ্ছি। এই দানা গ্রহণ করলে তোমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর হয়ে যাবে। আচার্যদেব ওই গহন বনে আকস্মিক সন্ন্যাসী দর্শনে ও তাঁর দানা প্রদানে হতচকিত হয়ে গেলেন। সন্ন্যাসী দানা প্রদান করেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আচার্যদেব তাঁর বালক শিষ্যদের নিয়ে দুটি করে দানা মুখে দিলেন। কি আশ্চর্য! দানা মুখে দিতেই মুহূর্ত মধ্যে তাদের ক্লান্তি-ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব দূর হয়ে গেল। কি আশ্চর্য ক্ষমতা সেই দানার! বলাবাহুল্য যে সন্ন্যাসী এই দানা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি নিশ্চয়ই কোনো উচ্চমার্গের যোগী অথবা দিব্যপুরুষ। এই দানা নিশ্চিতভাবে কোনো দিব্যবস্তু যার সেবনে মুহূর্ত মধ্যে ক্ষুধা-তৃষ্ণা-পথশ্রম সব দূর হয়ে গিয়ে শরীরে নতুন উদ্যমের সৃষ্টি করে। দানা সেবনঅন্তে তিনজন নতুন করে শক্তি পায় এবং আবার এগিয়ে যেতে থাকে গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে সাধনার অনুকূল কোনো স্থানের সন্ধানে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটে গেলেই তাদের কার্যসিদ্ধি হল না, কেননা তারা বেরিয়েছেন ঈশ্বরের সন্ধানে। কিন্তু ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে জয় করা নিশ্চয়ই সাধনার পথে এক বড় পদক্ষেপ। এখন তাদের আকুলতা কেবলই ঈশ্বরের জন্য, দেহের প্রয়োজন মেটাবার জন্য নয়।

.

আচার্য কর্তৃক ঈশ্বরকে খোঁজার ব্যাকুলতার পরামর্শ

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি অরণ্যপথে চলতে চলতে শিষ্যদের বোঝালেন যে, তারা ঈশ্বর দর্শনের অভিযানে বেরিয়েছেন। সাধনার মাধ্যমেই ঈশ্বর দর্শন হতে পারে। আর সাধনা তখনই সফল হয় যখন সাধকের ঈশ্বর দর্শনের জন্য ব্যাকুলতা বৃদ্ধি পায়। দেহের প্রয়োজনের থেকে মন যখন ঈশ্বর প্রয়োজনের দিকে ধাবিত হয়, তখনই ঈশ্বর দর্শনের জন্য ব্যাকুলতা বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বরকে দর্শন করতে গেলে আগে নিজেকে দর্শন করতে শিখতে হবে। গুরুদেব শিষ্যদের বললেন, যে দেহটা নিয়ে তোমরা চলছে, সেটা তোমাদের আসল পরিচয় নয়। তোমাদের এই দেহের ভিতরে যে আত্মা বিরাজ করছে, সেটাই তোমাদের সত্য রূপ। যতক্ষণ সেই আত্মার দর্শন না হয়, পরমাত্মার দর্শন হয় না। সেই জন্য সাধনার মাধ্যমে তোমাদের আগে আত্মদর্শন করতে হবে। আত্মদর্শন হলে অর্থাৎ নিজের আত্মাকে চিনতে পারলে, তবেই তোমরা পরমাত্মার দর্শন পাবে এবং তাকে চিনতে পারবে। কিন্তু নিজের আত্মাকে চেনার জন্য দরকার আত্মজ্ঞান। প্রকৃত আমি কে’–এই তত্ত্ব জানাকে বলে আত্মজ্ঞান। ‘আমি’ বলতে আমরা আমাদের এই স্থূল দেহ এবং মন ও বুদ্ধির মিলিত রূপ বা সূক্ষ্ম দেহকে বুঝি। এই দুই রূপ দেহের মধ্যেই আছে ব্রহ্মের অংশ, যখন কোনো সাধকের এই জ্ঞান হয় যে এই স্থূল ও সূক্ষ্মদেহ প্রকৃত ‘আমি’ নই, আমি এই দুইরূপ দেহের কারণ বিশেষ, তখনই তার আত্মজ্ঞান হয়। সাধকের মধ্যে আত্মজ্ঞান সাধনার মাধ্যমে হয়। সেইজন্য এখন তোমাদের যোগসাধনায় ব্রতী হতে হবে।

যোগসাধনার তিনটি পথ আছে–জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগ। এর মধ্যে যে কোনো একটি পথ অবলম্বন করেই সাধনা করতে হবে। এখন আচার্যদেবকেই ঠিক করতে হবে কোন্ পথে তিনি শিষ্যদের সাধনপথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আচার্য গাঙ্গুলি নিজেই এবার আত্মপর্যালোচনা করতে থাকেন যে, তার নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে কোন্ পথ এই বালক শিষ্যদের জন্য সঠিক পথ হবে।

.

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির আত্মপর্যালোচনা

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি ছিলেন একজন মহাপণ্ডিত ও মহাজ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি ছিলেন একাধারে এক মহান দার্শনিক এবং একজন মহান শাস্ত্রজ্ঞ। বেদ-প্রাণ এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। তিনি ছিলেন জ্ঞানমার্গের সাধক। কিন্তু এত গভীর শাস্ত্র ও দার্শনিক জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও তখনও তিনি সাধনমার্গে সিদ্ধিলাভ করতে পারেননি। শিষ্যদের সাধনমার্গ দর্শনের ভার নিয়ে তিনি এটা। বুঝতে পেরেছিলেন যে, জটিল দার্শনিক যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিপন্ন করা যায় বটে, কিন্তু তাতে ঈশ্বর দর্শন হয় না। ঈশ্বর দর্শনের জন্য যে ব্যাকুলতা প্রয়োজন, প্রেম-ভক্তি হল তার প্রধান ভিত্তি। প্রেম-ভক্তিবিহীন জ্ঞানযোগ নিরস এবং তা সাধকের আত্মাকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে না। ঈশ্বর প্রেম-ভক্তি বিহীন যোগসমাধি ক্ষণস্থায়ী। সমাধি থেকে বিচ্যুত হলেই সাধকের চিত্ত বৈকল্য হতে পারে ও তার পতন হতে পারে। ভক্তিমার্গে যোগসাধনা সাধককে মোক্ষপথে নিয়ে যায়। কিন্তু ভক্তিযোগ সহজ পন্থা নয়। সাধকের ঈশ্বরের প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভগবানকৃপা ভিন্ন ঈশ্বরশক্তি লাভ হয় না। ভক্তিমার্গের সাধক প্রবল ঈশ্বরানুরাগী না হলে ভক্তিমার্গে সিদ্ধিলাভ সহজ নয়। অনেক যোগী যোগাভ্যাসে পটুতা লাভ করেন কিন্তু ঈশ্বর দর্শনের বা তাকে পাবার জন্য যে প্রবল ব্যাকুলতা, নিজের হৃদয়ে সেই অবস্থার সৃষ্টি না করতে পারাতে ভগবৎকৃপা থেকে বঞ্চিত হন। আচার্যদেব অনুভব করেন যে, তিনি জ্ঞানযোগের উচ্চমার্গে বিচরণ করলেও হৃদয়ে ভক্তির অপ্রতুলতায় এখনও সিদ্ধিলাভ করতে পারেন নি।

আচার্য গাঙ্গুলি এও অনুভব করেন যে, কেবল প্রেম-ভক্তি থাকলেও ভক্তিমার্গে সাধক সফল নাও হতে পারেন। ভক্তিযোগ সমৃদ্ধ কর্মর্মার্গ তাঁর শিষ্যদের জন্য সঠিক হতে পারে। বালকদ্বয়ের মধ্যে ঈশ্বর দর্শনের প্রবল ব্যাকুলতা আছে। লোকনাথের মধ্যে তিনি পূর্বেই দিব্যলক্ষণের সন্ধান পেয়েছিলেন। তারা যদি ভক্তিযুক্ত মনে কর্মযোগের সাধনায় ব্রতী হন, তবে সফলতা আসবেই। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে স্থিরমতি হন যে, বিশুদ্ধ ভক্তি সহকারে ঈশ্বর দর্শনের প্রবল ব্যাকুলতা নিয়ে যদি তার এই দুই বালক শিষ্য কর্মযোগ সাধনা করে, তবে এই পথেই তারা একদিন সিদ্ধিলাভ করবে। এই পথই তিনি তার শিষ্যদের সাধনপন্থার জন্য নিশ্চিত করলেন। তিনি শিষ্যদ্বয়কে বললেন, এবার আমি তোমাদের যোগ সাধনার বিভিন্ন মার্গের শিক্ষা দান করবো।

.

যোগসাধনার তিন প্রধান মার্গের ব্যাখ্যা

আচার্য নিজে যখন স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন যোগ সাধনার এই পথেই তার দুই শিষ্যকে প্রাথমিক স্তরে শুরু করাবেন, তখন তিনি তাদের নিয়ে বসে শুরু করলেন তার জ্ঞানগর্ভ পাঠ। তিনি শুরু করলেন যোগ সাধনার তিনটি প্রধান মার্গ নিয়ে আলোচনা। এই তিনটি মার্গ হলো–জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও কর্মযোগ

জ্ঞান যোগ : জ্ঞানযোগ শিখতে হলে আগে জ্ঞানের অর্থ জানা প্রয়োজন। কোনো সাধকের কাছে যার দ্বারা সবর্ভূত এবং স্বীয় আত্মাকে অভিন্ন বোধ হয় এবং স্বীয় আত্মা ও পরমাত্মাও অভিন্ন বোধ হয়–অর্থাৎ যাতে জীব, জগৎ ও ব্রহ্মের একাত্ম দর্শন হয়, তাই জ্ঞান। যে যোগ সাধনার মাধ্যমে সাধক এই জ্ঞান লাভ করেন তাকে জ্ঞানযোগ বলে। কিন্তু জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয় বিনা জ্ঞানযোগ সম্পূর্ণ হয় না। জ্ঞানের সঙ্গে কর্মের সমন্বয় প্রয়োজন। জ্ঞানীর কর্মের বন্ধন হয় না। জ্ঞানী যখন প্রকৃত জ্ঞান আহরণ করেন, তখন তার সব কর্মই নিষ্কাম কর্ম হয়। নিষ্কাম কর্মের অর্থ হল ফলকামনা ত্যাগ করে সমত্ব বুদ্ধিযুক্ত হয়ে কর্ম করা। তাহলে দেখা যায় যে, যদিও সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন, কিন্তু কেবল জ্ঞান ও যুক্তি-তর্ক দ্বারা ঈশ্বরের সাযুজ্য লাভ করা যায় না।

ভক্তিযোগ : শ্রীগীতায় উল্লেখ আছে যে ভক্তিমার্গেই প্রত্যক্ষ ও ব্যক্ত ঈশ্বরের উপাসনা হয় এবং সেটাই অপেক্ষাকৃত সুখসাধ্য। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং অর্জুনকে বলেছিলেন–ভক্তিমার্গে নিত্যযুক্ত হয়ে যাঁহারা আমার সগুণ স্বরূপের উপাসনা করেন, তাহারাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু কেবল ভক্তিমার্গেও ব্রহ্মদর্শন দুর্লভ।

কর্মযোগ : তপস্যা, ওঁকার মন্ত্র জপ ও ঈশ্বরে সব কিছু অর্পন করে কর্ম করাই কর্মযোগ। কর্মযোগীর তিনটে প্রধান লক্ষণ দেখা যায়?

(১) কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ (2) ফলাকাঙ্খ বর্জন এবং (৩) সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ। কর্মযোগীর মধ্যে এই তিন লক্ষণ থাকতে হবে। যেমন–যিনি ‘আমি’ করছি, এই বুদ্ধি ত্যাগ করতে পেরেছেন, তিনি পরম ভক্ত। সেই সাধকের ভক্তিযোগ হয়েছে। ভাবতে হবে। যিনি সর্বকর্মের ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করে কর্ম করেন, তিনি পরম জ্ঞানী–সেই সাধকের মধ্যে জ্ঞানযোগের গুণ যুক্ত হয়েছে বলে মনে করতে হবে। যিনি সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমর্পণ করে মনে করেন আমি ঈশ্বরেরই কর্ম করছি, তিনিই প্রকৃত কর্মী। এই তিন লক্ষণ যার মধ্যে থাকে, তিনিই প্রকৃত কর্মযোগী। অর্থাৎ, কর্মযোগে ভক্তি, জ্ঞান ও কর্ম–এই তিনেরই সমন্বয় থাকে। এই কর্মযোগ পথে সাধনায় ব্রতী হলে সাধক যেমন প্রকৃত জ্ঞানলাভ করেন, তেমনি শুদ্ধভক্তিতে ঈশ্বরের প্রতি ব্যাকুল হতে পারেন এবং কর্মের মাধ্যমে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে পারেন। সেইজন্য এই তিন সাধনার যোগপন্থার মধ্যে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ। আচার্য বালকশিষ্যদ্বয়কে বলেন, তোমাদের আমি ঈশ্বরের প্রতি প্রেমভক্তি সমৃদ্ধ কর্মযোগেরই শিক্ষা দান করবো।

.

লোকনাথের বিদ্যাশিক্ষার আগ্রহ প্রকাশ

গুরুর কথা শুনে লোকনাথ বললেন, গুরুদেব, আমি নিরক্ষর মূর্খ। আমার কোনো অক্ষর জ্ঞানই হয়নি। কোনো শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থ সম্বন্ধে আমার কোনো জ্ঞান নেই। এমতাবস্থায় যে কর্মযোগের কথা আপনি বললেন, সেটা শুরু করার আগে বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তখন বললেন, বাবা লোকনাথ, বিদ্যাশিক্ষার জন্য তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। তোমরা গুরুর কাছে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেছে। আমি তোমাদের সাধনমার্গে এগিয়ে নিয়ে যাবার ভার নিয়েছি। আমার প্রতি তোমাদের যে অপরিসীম ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে, তাতে বিনা অধ্যয়নেই আমার মধ্যে সঞ্চিত বিদ্যা আমি তোমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেবো। তোমরা হবে অনন্ত জ্ঞানের অধিকারী।

শ্রীগীতায় আছে–শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ। (৪/৩৯)

অর্থাৎ জিতেন্দ্রিয়, সাধনপরায়ণ, শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি জ্ঞানলাভ করেন। লোকনাথ ও বেণীমাধবের গুরুভক্তি ছিল প্রশ্নাতীত। গুরুচরণে সমর্পিত মন ছিল তাদের। এই দুজনের সদ্গুরু আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি ছিলেন একজন শ্রোত্রিয় এবং ব্রহ্মনিষ্ঠ উপাসক। যে উপাসক সমস্ত বেদ, শাস্ত্র ও সমগ্র পুরাণ বিশারদ হন, তাকে শ্রোত্রিয় বলা হয়। এবং যে উপাসক সদ্গুরু ব্রহ্মকে জানেন, তাকে বলা হয় ব্রহ্মনিষ্ঠ। যে সদ্গুরুর মধ্যে এই দুই গুণ বর্তমান, তাঁর মধ্যে এক ভগবৎশক্তি বিরাজ করে। সদ্গুরুর সেই শক্তিই শিষ্যে সঞ্চারিত হয়ে তার অন্তরের মায়ার গ্রন্থি শিথিল করে দিয়ে প্রকৃত দিব্যজ্ঞানের সঞ্চার করে। সদ্গুরুর থেকে শিষ্যের মধ্যে এই শক্তি সঞ্চারের ক্রিয়া নিয়ত অবাধে চলতে থাকে এবং একসময়ে তা প্রবল আকার ধারণ করে শিষ্যের মধ্যে মহাজ্ঞান ও মহাশক্তির সৃষ্টি করে। সদ্গুরুর শিষ্যের মধ্যে এই শক্তি সঞ্চারের প্রক্রিয়া সাধারণতঃ তিন প্রকারে সাধিত হয়।

(১) শিষ্যের অন্তরে সদ্গুরুর মহাশক্তি তার দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সঞ্চারিত হয়।

(২) শিষ্যের মধ্যে সদ্গুরু-স্মরণ-মননের মধ্য দিয়ে শক্তি সঞ্চার করেন।

(৩) শিষ্যের হৃদয়ে সদ্গুরুর যোগস্পর্শের মধ্য দিয়ে শক্তি ও জ্ঞানের সঞ্চার হয়।

সদ্গুরু থেকে শিষ্যের মধ্যে এই শক্তি সঞ্চারের লীলা এক সদগুরুর শক্তির অলৌকিক লীলা। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি পূর্ব থেকেই অবগত ছিলেন যে, তার জ্ঞানমার্গের সঞ্চিত জ্ঞান তাঁকে এই দুই শিষ্যের মধ্যে সঞ্চারিত করে এদের জ্ঞানের অপ্রতুলতা দূর করতে হবে। তারপর সেই সঞ্চারিত জ্ঞানের সঙ্গে লোকনাথ ও বেণীমাধবের অদম্য ঈশ্বর দর্শনের ইচ্ছা ও কর্মযোগের সাধনের সমন্বয় ঘটিয়ে পোঁছে দিতে হবে সাধনমার্গের অত্যুচ্চ শিখরে। সেই লক্ষ্যেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এখন একাধারে তিনি তার দুই শিষ্যের মধ্যে ধীরে ধীরে জ্ঞান সঞ্চারিত করবেন এবং কর্মমার্গের যোগসাধনার শিক্ষা দান করবেন। ঈশ্বর দর্শনের যে প্রবল ইচ্ছা ও ব্যাকুলতা আছে এই দুজনের মধ্যে, কর্মযোগের পথে তা প্রবলতর হবে এবং একদিন তারা সফল হবেই।

.

ঋষি পতঞ্জলের কর্মযোগ শিক্ষা

এরপর একদিন আচার্যদেব তাঁর দুই শিষ্যকে বললেন, আজ আমি তোমাদের ঋষি পতঞ্জলের কর্মযোগ শিক্ষা দেবো–সাধকের কাছে ঋষি পতঞ্জল প্রদর্শিত কর্মযোগ প্রক্রিয়াই সাধনায় সিদ্ধিলাভের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি রূপে গণ্য হয়। ঋষি পতঞ্জলের মতে তপস্যা, ওঁকার মন্ত্র জপ ও ঈশ্বরে সমস্ত সত্তা অর্পণ করাকেই কর্মযোগ বলে।

এক্ষেত্রে সুখ-দুঃখ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, শীত-গ্রীষ্মজনিত দ্বন্দ্ব সহ্য করার প্রক্রিয়ার নাম তপস্যা। কর্মযোগীকে তপস্যার মাধ্যমেই সাধনপথে এগিয়ে যেতে হয়।

ওঁকার তিন অক্ষরের মিলিত এক মহামন্ত্র।–অ, উ, ম। ওঁ মন্ত্রে ‘অ’-কারের অর্থ জগৎপিতা বা জগতের পালনকর্তা। উ’ কারের অর্থ জগতের সংহারকর্তা। ‘ম’ কারের অর্থ জগতের সৃষ্টি কর্তা। ওঁকার মন্ত্র জপ করার অর্থ জগতের পালনকর্তা, সংহারকর্তা ও সৃষ্টি কর্তার ধ্যান করা। এই সম্বন্ধে আমি তোমাদের পরে আরও বিস্তারিত জ্ঞান দান করবো।

ধ্যান করার অর্থ হল ভ্রূমধ্যে ধ্যেয়রূপ পরমেশ্বরের আনন্দময় ও জ্যোতির্ময় স্বরূপে মগ্ন হয়ে যাওয়া। এই ধ্যানই হচ্ছে প্রধান যৌগিক প্রক্রিয়া। ধ্যান করার সময় সাধকের মন ও ইন্দ্রিয়কে অন্তর্মুখী করে তার সমস্ত সত্তা ঈশ্বরে সমর্পণ করতে হয় এবং মনে করতে হয় আমি এই শরীরের পঞ্চক্লেশ রহিত আনন্দময় অমৃতপুত্র ব্রহ্মের অংশ। কর্মযোগীর এই মনোভাব তার শরীরের পঞ্চক্লেশকে শক্তিহীন করে তাকে সমাধির পথে নিয়ে যায়।

.

মানব শরীরের পঞ্চক্লেশ তত্ত্ব

লোকনাথ তাঁর গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করেন–শরীরের পঞ্চক্লেশ কি?

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তখন শিষ্যদের মানব শরীরের পঞ্চক্লেশ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। মানব শরীরের পঞ্চক্লেশ হল–অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশ। এই পঞ্চক্লেশের মধ্যে অবিদ্যাই প্রধান। যার শরীরে অবিদ্যা ক্লেশ বিদ্যমান, অন্য চারটি ক্লেশ সেখানে অবস্থান করবেই। সাধক যদি অবিদ্যা ক্লেশকে ক্ষয় করতে পারেন তবে অন্য ক্লেশগুলি সহজেই ক্ষয় হয়। সেজন্য সাধকের প্রয়োজন প্রথমে শরীরের অবিদ্যাজনিত ক্লেশকে ক্ষয় করা।

লোকনাথ গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করেন–অবিদ্যা কি?

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তখন শিষ্যদের বলেন–অনিত্যবস্তুতে নিত্যজ্ঞান, অশুচিতে শুচিজ্ঞান, দুঃখে সুখজ্ঞান আর অনাত্মায় আত্মজ্ঞানকে অবিদ্যা বলে। আত্মজ্ঞান দ্বারা অবিদ্যার বিনাশ হলে চিত্ত বিমুক্ত হয় এবং যোগী তখন আত্ম চৈতন্যরূপে নির্মলভাবে অবস্থান করেন এবং তার ব্রাহ্মীস্থিতি লাভ হয়।

মানবশরীরের দ্বিতীয় ক্লেশের নাম অস্মিতা। পুরুষচেতন ভোজা আর বুদ্ধি অচেতন ভোগ্য, এই উভয়ের অভেদ জ্ঞানকে অস্মিতা ক্লেশ বলে। বুদ্ধিই প্রকৃতি। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনকেই জীবভাব বলা হয়। জীবের সকল কর্তৃত্বই প্রকৃতির, পুরুষ অকর্তা। প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতই জীবের পুনঃ পুনঃ যোনীতে জন্ম ও সংসার সুখ-দুঃখ ভোগ।

তৃতীয় ক্লেশের নাম রাগ। সুখ ও সুখের জন্য উপায়সাধনে আসক্তি বা কামনাকে রাগ বলে। সাধককে সর্বদা সুখ বা সুখজনিত উপায়সাধন ত্যাগ করে চলতে হয়। তবেই এই ক্লেশের ক্ষয় হয়।

চতুর্থ ক্লেশের নাম দ্বেষ। দুঃখ বা দুঃখের কারণে শরীরে যে ক্রোধ উৎপন্ন হয়, তাকে দ্বেষ বলে। সুখ-দুঃখের ভিন্ন জ্ঞান অবিদ্যাজনিত ক্লেশ। এই ক্লেশ থেকেই দ্বেষের উৎপত্তি। সুখ-দুঃখকে অভিন্ন জ্ঞান করলে যেমন অবিদ্যাজনিত ক্লেশ ক্ষয় হয়, তেমনই দ্বেষজনিত ক্লেশও ক্ষয় হয়।

মানব শরীরের পঞ্চম ক্লেশটি হল অভিনিবেশ। পূর্বজন্মের মরণদুঃখ অনুভব করে লোকের মনে যে মৃত্যুভয় আসে, তাকে বলা হয় অভিনিবেশ। এটি হল জন্মান্তরের সংস্কার। সাধক যখন তপস্যাবলে আত্মজ্ঞানের পথে অগ্রসর হন, তখন তার মধ্যে জন্মান্তরবাদের উদয় হয়। তিনি তখন পূর্বজন্মকে স্মরণ করতে পারেন। সেই স্থিতিতে তিনি যদি পূর্বজন্মের মরণদুঃখে দুঃখিত হয়ে পড়েন, তবে এই ক্লেশ সাধককে সাধনার পথে বিচ্যুত করবে। সেজন্য জন্মান্তরবাদজনিত এই অভিনিবেশ ক্লেশকে ক্ষয় করেই সাধককে অগ্রসর হতে হয়।

লোকনাথ একদিন গুরুদেবকে প্রশ্ন করলেন–সংস্কাররূপ ক্লেশগুলিকে কি উচ্ছেদ করা যায়?

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তখন বললেন, পঞ্চক্লেশের সুখ-দুঃখ, মোহ ইত্যাদি স্থূলরূপ বৃত্তিগুলি সংসারীদের ভোগ করতে হয়। কর্মযোগী তপস্যার দ্বারা এইসব বৃত্তিগুলি ক্ষয় করতে সমর্থ হয় এবং এই বৃত্তিগুলিকে তখন সাধক ত্যাগ করেন। যতদিন এই ত্যাগ সব সাধকের মধ্যে না আসে, ততদিন তাকে সাধনা করে যেতে হয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ বৃত্তিগুলি থেকেই পুণ্যকর্মাশয় এবং অপুণ্যকর্মাশয় উৎপন্ন হয়। এই কর্মাশয়গুলির মধ্যে কতকগুলি বর্তমান জন্মেই অনুষ্ঠিত হয় এবং এই জন্মেই ভোগ সম্পন্ন করতে হয়। একে ক্রিয়াকরণ কর্ম বলে। কতকগুলি বৃত্তি আবার মরণের পরে জন্মান্তর ফল উৎপন্ন করে। একে মানব সঞ্চিতকর্ম বলে। পরবর্তীকালে জন্মান্তরবাদ অনুযায়ী সেই আত্মার পুনর্জন্ম হলে তখন এই সঞ্চিত কর্ম প্রারব্ধকৰ্ম রূপে তাকে সেই জন্মে ভোগ করতে হয়। পঞ্চক্লেশ থাকলেই পুণ্য ও অপুণ্য কৰ্মাশয়ের বিপাক হয়। ক্লেশরূপ মূলের উচ্ছেদ হলে আর তা হয় না। আত্মজ্ঞান দ্বারা সাধকের অবিদ্যার নাশ হলে কর্মাশয়ের নাশ হয় অর্থাৎ কার্যবিমুক্তি হয়। এই বিমুক্তি হলে সাধকের চিত্ত বিমুক্তি হয়। তখন সাধক সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিনের গুণাতীত হয়ে চৈতন্যরূপে নির্মলভাবে অবস্থান করে।

এক্ষেত্রে তোমাদের জীবদেহে তিন গুণের অস্তিত্বের কথা বলা প্রয়োজন। শ্রীগীতায় বলা আছে–সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃজাত প্রবৃত্তিগুলি প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন এবং এই তিনগুণ অবিনাশী জীবাত্মাকে শরীরে আবদ্ধ করে। এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বঃগুণ নির্মল হওয়ায় প্রকাশশীল এবং বিকাররহিত। সত্ত্বঃগুণ নির্মল হওয়ায় জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এই জ্ঞান কিন্তু আত্মজ্ঞান নয়। সত্ত্বঃগুণের অধিকারীর মধ্যে আমি সুখী, আমি জ্ঞানী, আমি ভক্ত এইরূপ অভিমানের ভাব থাকে। যতক্ষণ সত্ত্বগুণাধিকারীর মনে এই অভিমান ভাব বিরাজ করে, ততক্ষণ তিনি বন্ধনমুক্ত হতে পারেন না। এই সাত্ত্বিক অভিমান বা আসক্তি সাধনার প্রাথমিক স্তরে সাধকের মুক্তিপথের সহায়ক হয়। সাধক যখন মনে করেন আমি দীন-হীন নই, আমি পরমাত্মারই অংশ, আমি জ্ঞানী ও ভক্ত, তখন এই ভাব তাঁকে আত্মোন্নতির পক্ষে সহায়তা করে। তবে সাধনার উচ্চতম স্তরে এই সাত্ত্বিক অভিমান ত্যাগ করতে হয়। জীবাত্মার সত্ত্বঃগুণকে এইজন্য বলা হয় একাধারে বন্ধনের কারণ ও মুক্তির সহায়ক। সাধক যখন দেখেন দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ দ্বারা উদ্ভাসিত হচ্ছে, তখন বুঝতে হবে সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি পেলেই সাধকের মনে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। সত্ত্বগুণের কাজ হল চিত্ত ও ইন্দ্রিয়াদিতে আলস্য দূরীভূত করে একপ্রকার চেতনার উন্মেষ ঘটানো। সাধকের মধ্যে যখন এই চেতনার বিকাশ ঘটে, তখন তিনি ধীরে ধীরে সাত্ত্বিক অভিমান ত্যাগ করে স্বত্তগুণাতীত হবার পথে অগ্রসর হন।

রজঃগুণের ধর্ম রাগাত্মক। এই গুণ জীবাত্মার মধ্যে কামনা এবং আসক্তি উৎপন্ন করে। রজঃগুণ কর্মকে আচ্ছাদিত করে রাখে। রজঃগুণ সমন্বিত ব্যক্তি ভোগপ্রবণ হয় এবং কদাচ স্বল্পে সন্তুষ্ট হয় না। ভোগপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য এই গুণ সমন্বিত ব্যক্তি গর্হিত আচরণশীল হয়। এইজন্য এইরূপ জীবাত্মা বিবিধ কর্মে আবদ্ধ হয়ে দুঃখ ভোগ করে।

তমোগুণ সমন্বিত জীবাত্মার অন্তঃকরণে মোহিনীবৃত্তি, কর্তব্যকর্মে অপ্রবৃত্তি ও ব্যর্থ চেষ্টার উৎপন্ন হয়। তমোঃগুণ জীবাত্মার অধোগতি উৎপন্ন করে। তমোঃগুণ সমন্বিত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়। তামসিক গুণ সমন্বিত ব্যক্তি পশু, নীচযযানি বা নরকপ্রাপ্ত হয়।

জন্মলগ্নে কোনো জীবাত্মার মধ্যে এই তিন সত্ত্বগুণ স্বতন্ত্র বা অবিমিশ্রতভাবে অবস্থান করে না। প্রতি জীবাত্মাতেই এই তিন গুণের সমন্বয় থাকে। কারও মধ্যে সত্বগুণ প্রবল থাকে, কারও মধ্যে রজঃগুণ প্রবল থাকে বা কারও মধ্যে তমঃগুণ প্রবল থাকে। যে মানবের মধ্যে যে গুণ প্রবল থাকে, সে সেই গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তদনুরূপ কার্য করে। মোক্ষার্থী সাধকের এই গুণত্রয়ের সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা প্রয়োজন। কেননা, এই গুণগুলিকে জয় করতে না পারলে সাধকের পঞ্চক্লেশের ক্ষয় হয় না এবং চিত্ত কদাপি শুদ্ধ, সংস্কারমুক্ত ও মোক্ষমুখী হয় না। যে সাধক ভক্তিযোগ সহকারে এই গুণত্রয় অতিক্রম করে ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন, তিনিই মোক্ষলাভের অধিকারী হন। যে সাধক দেহের গুণত্রয় ধর্ম অনুযায়ী কার্য চলতে থাকলেও উদাসীনের ন্যায় অবস্থান করেন, সত্ত্বাদি গুণকর্ম কর্তৃক বিচলিত হন না, যাঁহার সর্ববিষয়ে সমত্ত্ব বুদ্ধি জন্মায়, যাঁহার নিকট সুখ-দুঃখ, মান-অপমান, স্তুতি-নিন্দা, শত্রু-মিত্র সকলই সমান তিনিই ত্রিগুণাতীত হন। আর এইরূপ ত্রিগুণাতীত সাধকই ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হয়। সাধক স্বীয় জীবাত্মাকে সাধনার মাধ্যমেই ত্রিগুণাতীত অবস্থায় নিতে পারেন। আজ তোমাদের এই পর্যন্তই শিক্ষা দিলাম।

আচার্যের কাছ থেকে লোকনাথ সাধনমার্গের গুহ্যতম বিদ্যাগুলি শিক্ষালাভ করছেন। সেদিনের শিক্ষা সারারাত তার মনকে আলোড়িত করে। তিনি চিন্তা করতে থাকেন, সাধনাই মোক্ষলাভের একমাত্র পথ কি না? পরদিন আবার গুরুদেব আলোচনা শুরু করলেন।

প্রথমেই লোকনাথ আচার্যকে জিজ্ঞাসা করেন–সাধনা ছাড়া কি মোক্ষলাভের অন্য কোনো উপায় নেই? আচার্য বলেন, না, সাধনা ছাড়া সিদ্ধিলাভ হয় না। আর সিদ্ধিলাভ ভিন্ন মোক্ষলাভও হয় না। মোক্ষলাভের জন্য এই সাধনা হল অষ্টাঙ্গ যোগের অনুষ্ঠান। আমি আজ তোমাদের সাধনার অষ্টাঙ্গযোগ সম্বন্ধে শিক্ষাদান করবো।

.

লোকনাথের অষ্টাঙ্গ যোগশিক্ষা

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি এরপর অষ্টাঙ্গ সাধনা সম্পর্কে তার শিষ্যদ্বয়কে বিস্তারিত জ্ঞানদান করেন। অষ্টাঙ্গযোগ যোগীর কাছে এক প্রকৃষ্ট সাধনমার্গ। এই সাধনমার্গে অগ্রসর হয়েই একজন যোগী সিদ্ধিলাভ করেন। কিন্তু সাধনা আর সিদ্ধিলাভের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। সব যোগীই সাধনমার্গে সিদ্ধিলাভ করতে পারেন না। একজন প্রকৃত সাধকই কেবলমাত্র এই সাধনমার্গে সিদ্ধিলাভ করতে পারেন। সব যোগী অবিদ্যা আদিজনিত কারণে প্রকৃত সাধক হতে পারেন না।

প্রকৃত সাধক কে? : প্রকৃত সাধক হল একজন যোগীর ভাবশরীর। মানুষের এই স্থূলশরীর প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তিত হয়। পরমাত্মার দুটি প্রকৃতি–অপরা এবং পরা। স্থূলশরীর হল অপরা প্রকৃতি এবং জীব হল পরা প্রকৃতি। এই স্থূলশরীর হল প্রথমে অব্যক্ত পরে ব্যক্ত ও পরিশেষে অব্যক্ত। যে প্রকৃতি সর্বদাই পরিবর্তনশীল, সে সাধক কি করে হতে পারে? পরা প্রকৃতি অর্থাৎ জীবাত্মা সর্বদাই অব্যক্ত। এই অব্যক্তই সাধক, কেননা এটা পরিবর্তনশীল নয়। মানব শরীরের ব্যক্তরূপ সাধক হয় না। সাধন মার্গে সাধকের যখন সিদ্ধিলাভ হয়, তার স্কুলশরীরের সিদ্ধিলাভ হয় না। প্রকৃত সাধক সাধন প্রক্রিয়ার দ্বারা তার সমস্ত সত্তাকে অব্যক্তে লীণ করে দেন অর্থাৎ জীবভাবে পরিণত করেন এবং সিদ্ধিলাভ করেন। সাধনার এই প্রক্রিয়ার জন্য ঋষি পতঞ্জল কথিত অষ্টাঙ্গ যোগসাধনাই সর্বশ্রেষ্ঠরূপে গণ্য হয়।

এরপর আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে অষ্টাঙ্গ যোগের বিভিন্ন অঙ্গগুলি ব্যাখ্যা করেন। অষ্টাঙ্গ যোগের আটটি অঙ্গ হল–যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি।

.

অষ্টাঙ্গ যোগের প্রথম অঙ্গ যম

অষ্টাঙ্গ যোগসাধনের প্রথম অঙ্গ হচ্ছে যম। যে অনুষ্ঠান দ্বারা দেহের ইন্দ্রিয়গুলিকে এবং মনকে হিংসা ইত্যাদি অশুভ ভাব থেকে সরিয়ে আত্মকেন্দ্রিক করা যায়, তাকে যম বলে। ঋষি পতঞ্জল যমের পাঁচটি অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল–অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ। এরপর আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে এই পাঁচটি অনুষ্ঠান সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বলেন।

অহিংসা : অহিংসার অনুষ্ঠানের অর্থ হচ্ছে কোনো প্রাণীকে কথা, মন অথবা কর্মদ্বারা কোনো কষ্ট না দেওয়া। মনে মনেও কারও অনিষ্ট চিন্তা না করা, কটু বাক্য দ্বারা কাউকে কষ্ট না দেওয়া এবং কর্ম দ্বারা কোনোস্থানে, কোনো অবস্থাতে কোনোদিন কোনো প্রাণীর প্রতি হিংসাভাব প্রদর্শন না করা–এই অভ্যাসগুলিই হচ্ছে অহিংসা। মানুষের দ্বারা তিন প্রকারের হিংসা অনুষ্ঠিত হতে পারে–

(১) নিজের মন, বাক্য বা কর্মদ্বারা হিংসা করা;

(২) নিজে প্রত্যক্ষরূপে হিংসা না করে, অন্যদের দিয়ে হিংসা কার্য করানো; এবং

(৩) হিংসা কার্য সমাধা করার জন্য অন্য কাউকে পাঠানোর অনুমোদন করা।

যমের অহিংসা অনুষ্ঠানে সাধককে এইসব কার্য থেকে বিরত থাকা উচিত। সাধকের মনে দৃঢ় নিশ্চয় থাকা উচিত যে, হিংসাজনিত কোনো কার্যই আমি কোনোদিন, কোনো অবস্থাতে, কোনোভাবে গ্রহণ করবো না। হিংসাজনিত দোষগুলিকে আমি সদাই পরিত্যাগ করে চলবো। তবেই অহিংসা অনুষ্ঠান পালিত হবে।

সাধকের ভিতর অহিংসা প্রতিষ্ঠা হলে, সে তখন সব জীবের প্রতি নিজের হৃদয়ে নিঃস্বার্থ স্নেহ-প্রেম বৃদ্ধি ও ধারণ করতে পারে এবং তা তার কর্মের মধ্য দিয়ে প্রদর্শন করতে পারে। সাধকের মধ্যে যখন অহিংসাভাব প্রবল হয়, তখন হিংস্র জীবজন্তুও সেই সাধকের প্রতি হিংসাভাব ত্যাগ করে।

সত্যঃ সত্য অনুষ্ঠানের অর্থ হল যা দেখেছি, যা শুনেছি, যা জেনেছি, তেমনটাই শুদ্ধভাবে মনে ধারণ করা এবং সেইভাবে কাজ করা। সাধকের কথার মধ্যে ছল-কপটতা, ভ্রান্তি, মিথ্যা থাকা উচিত নয়। সাধকের যা সত্য নয়, সেই কথা বা সেই ভাবকে মনে স্থান দেওয়া উচিত নয়।

কোনো সাধক যখন এই সত্য অনুষ্ঠান সফলভাবে করেন, তখন সেই সাধকের মুখনিঃসৃত বাক্য সত্য ও অমোঘ হয়ে ওঠে। মহাযোগীদের জীবনী অনুধাবন করলে দেখা যায় যে, সেই মহাযোগিরা মুখে যে কথা বলেছেন, সে কথা অবশ্যই সত্য হয়েছে। প্রকৃত যোগীপুরুষ সর্বদা সত্য আচরণ করে থাকেন। সত্যবাদী মহাযোগিদের মধ্যে এক মহাশক্তির জন্ম নেয় যা তাদের বাক্যকে অমোঘ করে।

অস্তেয়ঃ অস্তেয় শব্দের অর্থ হচ্ছে চুরি না করা। কোনো শাস্ত্রবিরুদ্ধ পদ্ধতিতে সাধক কোনো দ্রব্য গ্রহণ করলে, তাকে চুরি অর্থাৎ স্তেয় বলা হয়। সাধকের মনে অপরের বস্তু প্রাপ্ত করার বাসনা বা লালসাকেও চুরি করা বলে। একজন সাধকের না অপরের দ্রব্য চুরি করা বা দ্রব্য প্রাপ্তির উপর লালসা করা উচিত, না অন্যের দ্বারা সেই দ্রব্য প্রাপ্তির চেষ্টা করা উচিত।

সাধকের মনে সবসময় এই ভাব বিরাজ করা উচিত যে, আমার এই স্থূলশরীরের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, ভগবান স্বয়ং আমায় সেইসব প্রদান করেন, তাহলে আমার অন্যের দ্রব্য প্রাপ্তির কি প্রয়োজন। এই ভাবের সাধক কখনো অন্যের নিকট হতে কোনো দ্রব্য গ্রহণ করেন না। যদি কেউ তাকে কোনো দ্রব্য দেন, তবে সাধক সেই দ্রব্য মানব কল্যাণে দান করে দেন। অস্তেয় ব্রত সিদ্ধি হলে যোগীর সংকল্প মাত্রই তার হাতের কাছে সমস্ত রত্ন উপস্থিত হয়।

এই বিষয়ে আচার্যদেব শিষ্যদের একটি চমৎকার ঘটনার কথা বলেন। একবার গুরু মীননাথ শিষ্য গোরক্ষনাথকে নিয়ে পদব্রজে চলেছেন। গুরু মীননাথের মধ্যে বিষয়াসক্তি ছিল। তাঁর সঙ্গে বহু ধনরত্ন ছিল। কিছুদূর চলার পর গোরক্ষনাথ বললেন, প্রভু, আপনার ওই ধনরত্নের বোঝাটি আমায় দিন, আমি এটা বহন করে নিয়ে যাবো। মীননাথ বোঝাটি গোরক্ষনাথের হাতে দিলে তিনি সেটাকে বনের মধ্যে নিক্ষেপ করলেন। মীননাথ তা দেখে রোষাবিষ্ট হয়ে শিষ্যকে তিরস্কার করতে লাগলেন। গোরক্ষনাথ তখন গুরুকে বললেন, গুরুদেব এই সামান্য ধনরত্নের জন্য আপনি বিচলিত হচ্ছেন কেন? এইসব রত্নের এমন কি মূল্য? প্রস্রাব করলেও তার থেকে এমন রত্ন পাওয়া যায়। এ কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য মীননাথ শিষ্য গোরক্ষনাথকে তাই করে দেখাতে আদেশ করলেন। গেরাক্ষনাথ তৎক্ষণাত সেখানে প্রসাব করলেন এবং গুরু দেখলেন, আশ্চর্যজনকভাবে সেই প্রস্রব থেকে ভুরি ভুরি রত্ন উৎপন্ন হল। এই দৃশ্য দেখে মীননাথ নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং শিষ্যকে বললেন, আমি বুঝলাম, বিষয়-বৈভবই অনর্থের মূল। একজন যোগীর কাছে তার কোনো প্রকৃত মূল্য নেই। বলাবাহুল্য, গোরক্ষনাথ ছিলেন এক উচ্চকোটির মহাযোগী।

আমি যখন নর্মদা পরিক্রমা করি, তখন হোসেঙ্গাবাদের এক পূর্বতন মহাযোগী ও মা নর্মদার বরপুত্র মহাযোগী গৌরীশঙ্কর মহারাজের সম্বন্ধে অনুরূপ একটি ঘটনার কথা জেনেছিলাম। এই ঘটনা পাঠককে জানতে সাহায্য করবে যে, ভারতের সাধকদের কি উচ্চ আধ্যাত্ম ক্ষমতা ছিল!

গৌরীশঙ্কর মহারাজ হাজার হাজার সাধু-সন্ন্যাসীর জমায়েত নিয়ে নর্মদা পরিক্রমা করতেন। ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের হাতে ঝাঁসির রানী, বাদশা জাফর, তাতিয়া তোপির মতো ব্যক্তিরা পরাজিত হবার পর, ইংরেজরা ভারতের সাধুদের জমায়েতের উপর অত্যাচার শুরু করে। সেইসময় গৌরীশঙ্কর মহারাজ নর্মদা তটে ৬-৭ হাজার সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গে পরিক্রমা করছিলেন। ইংরেজ অফিসাররা গৌরীশঙ্কর মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেন, এত সাধুদের রোজ ভোজন খরচ কোথা থেকে পাও? এই কথার উত্তরে গৌরীশঙ্কর মহারাজ ‘হর নর্মদে’ ধ্বনি দিয়ে যেই নর্মদার জলে হাত ডুবিয়েছেন অমনি তার হাতে উঠে আসে স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটি থলি। উনি ইংরেজদের বলেন, এটা মা নর্মদার কৃপা।

একচ্ছত্র শাসন ক্ষমতার অধিকারী দাম্ভিক ইংরেজরা তাঁর এই মহামানবীয় কাণ্ডকে সহজে মেনে নেয়নি। তাদের সন্দেহ হয় অন্য কেউ নর্মদার জলে হাত ডোবালে কোনো স্বর্ণমুদ্রার থলি উঠে আসে না কেন? নিশ্চয় এই সাধুরা কোনো ডাকাতির ধনরত্ন নর্মদার কূলবর্তী জলে লুকিয়ে রেখেছে। মহারাজকে তারা মাঝনদী থেকে রত্ন তোলার আদেশ করে। নৌকা করে মহারাজকে মাঝনদীতে নিয়ে গেলে তিনি সেই একই কাণ্ড করে দেখালেন। ইংরেজ অফিসারেরা মোহিত হয়ে পড়ে।

এরপর তারা মহারাজের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এক আদেশনামা জারী করে যে, গৌরীশঙ্কর মহারাজ একজন সত্যই সিদ্ধ পুরুষ।

গুরু ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদ্বয়ের কাছে গোরক্ষনাথের ঘটনার উল্লেখ করে এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে, একজন সিদ্ধপুরুষের যোগৈশ্বর্য পৃথিবীর ধনরত্নের থেকে বেশি মূল্যবান।

ব্রহ্মচর্যঃ ব্রহ্মচর্য কথার প্রকৃত অর্থ হল ব্রহ্মে বিচরণ অর্থাৎ ভগবানে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। মানবশরীর সপ্তধাতুতে গঠিত–যেমন, রস, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মজ্জা ও শুক্র। এই সপ্তধাতুর মধ্যে শুক্রকে বীর্য বলে। তপস্যার দ্বারা এই বীর্যকে পতন না ঘটিয়ে শরীরের মধ্যে রক্ষা করাই হল ব্রহ্মচর্যের উদ্দেশ্য। বীর্যের প্রতি বিন্দুতে কোটি বজ্রের শক্তি নিহিত আছে। ব্রহ্মচর্য ব্রত ও তপস্যার মাধ্যমে বীর্য রক্ষা করলে সাধকের দেহে ওজঃ অর্থাৎ ব্রহ্মতেজ উৎপন্ন হয়। এই ওজঃ সাধকের মস্তিষ্কে অবস্থান করে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে। স্বয়ং মহাদেব বলেছেন, যে ব্যক্তি ধৃত বীর্য, উৰ্দ্ধরেতাঃ, সে মানুষ নয়, সে দেবতা। এই অনুষ্ঠান পালন করলে, যোগী পুরুষের তেজ, কান্তি, শক্তি ও পরাক্রম বেড়ে ওঠে।

অপরিগ্রহ : অপরিগ্রহের প্রকৃত অর্থ হল বৈরাগ্যসিদ্ধি। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনে সন্তুষ্ট হয়ে ঈশ্বর আরাধনা করাই হচ্ছে অপরিগ্রহ। ঐশ্বরীয় প্রনিধান অনুযায়ী জীবনে যে বাহ্যসাধন প্রাপ্ত হয়, তাতে অহঙ্কারের বশীভূত না হয়ে সেই জাগতিক বা বাহ্যসুখের সাধনগুলি পরিত্যাগ করাই প্রকৃত যোগীর কর্তব্য। যোগীর বিষয়ের প্রতি অনাসক্ত থেকে বৈরাগ্যভাব নিয়ে অপরিগ্রহের পালন করা উচিত। কোনো সাধক যখন বৈরাগ্য ভাব নিয়ে বিষয়াসক্তি থেকে সম্পূর্ণ রহিত হয়ে সাধনা করেন, তখন তিনি জিতেন্দ্রিয় হন। সাধক যখন এইরূপ জিতেন্দ্রিয় হন, তখন তার কাছে জন্ম-মৃত্যুর স্বরূপ উদ্বাটন হয় এবং তিনি আত্মদর্শনের পথে এগিয়ে যান। অর্থাৎ নিজের মধ্যে আত্মাকে অন্তদৃষ্টিতে দর্শন করেন। এই স্থিতিতে সাধকের মনে আপনা থেকেই জ্ঞানলাভ করে। যমের সমস্ত পরিগণনাগুলি শিষ্যদ্বয়ের কাছে ব্যাখ্যা করে গুরুদেব বললেন, এরপর আমি তোমাদের অষ্টাঙ্গযোগের দ্বিতীয় অঙ্গ নিয়মের কথা বলবো। নির্জন ঘন। বনের মধ্যে দিয়ে নিরন্তর পথচলা এবং কোথাও কোথাও লতাপাতার কুটির বানিয়ে রাত্রিবাস এবং গুরুদেবের থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে লোকনাথ কিন্তু থেমে থাকেন না। গুরুদেবের থেকে যে শিক্ষা পেয়েছেন, নিয়ত তার অভ্যাস করে চলেন।

কোনো প্রশ্ন তার মনে জাগলে, পরদিন সেই প্রশ্নের উত্তর চেয়ে নেন গুরুদেবের কাছে। অষ্টাঙ্গ যোগের একটি অঙ্গের শিক্ষা পেয়েছেন, দ্বিতীয় অঙ্গশিক্ষা শুরুর পূর্বে লোকনাথ তার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করে নেন। পরদিন আবার শুরু হয় দ্বিতীয় অঙ্গ ‘নিয়মের শিক্ষা।

.

অষ্টাঙ্গযোগের দ্বিতীয় অঙ্গ নিয়ম’

অষ্টাঙ্গযোগের দ্বিতীয় আধার নিয়ম। মহর্ষি পতঞ্জল পাঁচটি নিয়মের উল্লেখ করেছেন। যেগুলি পালনের মাধ্যমে যোগী নিজের স্থূলশরীর ও লিঙ্গশরীরকে যোগক্ষম করতে পারেন। এই নিয়মগুলি হলো–শৌচ, সন্তুষ্টি, তপঃ, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বর প্রণিধান।

এই নিয়মগুলি হল–

শৌচ : শৌচ সাধারণভাবে দুই প্রকার–বাহ্যশৌচ ও অন্তঃশৌচ। পবিত্র সলিলে স্থলশরীরকে ধৌত করার নাম বাহ্যশৌচ। চিত্ত থেকে রাগ-দ্বেষ ক্লেশাদি দূর করার নাম অন্তঃশৌচ। কিন্তু একজন সাধকের কাছে শৌচের অর্থ আরও বড়। প্রকৃত সাধককে প্রতিদিন পবিত্র সলিলে অবগাহন করে স্থূলশরীরের শুদ্ধি, সত্যাচরণ দ্বারা মনের শুদ্ধি, বিদ্যা আর তপদ্বারা আত্মার শুদ্ধি এবং জ্ঞানদ্বারা বুদ্ধির শুদ্ধি করতে হয়।

একজন সাধক যখন শৌচের অনুষ্ঠানে সিদ্ধ হন, তখন তাঁর বাহ্যশরীরের প্রতি নিরাসক্তি দেখা দেয়। সাধকের তখন তার স্কুলশরীরের প্রতি কোনো মোহ থাকে না। তিনি তখন জীবপ্রেম স্থূলশরীর দিয়ে নয়, আত্মা দিয়ে করেন। আর সাধক যখন আভ্যন্তরীণ শৌচ অনুষ্ঠানের দ্বারা অন্তঃকরণ শুদ্ধি করেন, তখন তার মনে একাগ্রতা বৃদ্ধি হয় এবং তিনি ইন্দ্রিয়গুলির উপর বিজয়প্রাপ্ত হন। তখনই তিনি তাঁর আত্মাকে জানার যোগ্যতা অর্জন করেন। বাহ্য ও আভ্যন্তরীণ শৌচসিদ্ধ সাধকই নিজ আত্মাকে আপনাতে অন্তদৃষ্টিতে দেখার জন্য সক্ষম হন। এই সক্ষমতার ফল আত্মদর্শন।

সন্তুষ্টিঃ বিষয়ভোগ থেকে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিবৃত্ত রাখার নামই হল সন্তুষ্টি। সাধকের মধ্যে কোনো অপ্রাপ্তের তৃষ্ণা রাখতে নেই। ঈশ্বর কৃপায় যা প্রাপ্ত হয়েছে তাতেই মনকে সন্তোষ রাখার নামই হল সন্তুষ্টি। বৈভবের পিছনে না ছুটে সন্তুষ্টি অনুষ্ঠান সিদ্ধ হলে সাধক আত্মিক ও আন্তরিক সুখ লাভ করেন। সাধকের মনে রাখা উচিত যে, সন্তুষ্টি অনুষ্ঠানের ফলে প্রাপ্ত সুখ সর্বোত্তম সুখ।

সংসারে কামরূপ এবং দিব্যস্বর্গের কল্পনাযুক্ত যে মহান সুখ আছে, এই দুই প্রকারের জাগতিক সুখ-তৃষ্ণা নাশ হলে প্রাপ্ত হওয়া সুখের বোল ভাগের এক ভাগের সমানও জাগতিক সুখ হতে পারে না। সন্তুষ্টি অনুষ্ঠান সাধককে স্বর্গীয় সুখ এনে দেয়।

সেই জন্য সাধককে সন্তুষ্টি অনুষ্ঠান সাধনের দ্বারা স্বর্গীয় সুখের সন্ধান করতে হয় এবং তার জন্য তাঁর দৃঢ়ভাবে জাগতিক সুখকে ত্যাগ করতে হয়। সত্ত্বগুণ প্রবল হলে সাধক এইরূপ করতে পারেন।

তপ : যোগীর সাধনকর্মে যা কিছু বাধা-বিঘ্ন ও দ্বন্দ্ব আসবে, সেগুলিকে সহ্য ও অতিক্রম করে নিরন্তর সাধনা করে যাওয়াই হচ্ছে তপ। সাধকের সাধনকালে ক্ষুধা-তৃষ্ণা, শীত-গ্রীষ্ম, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান, স্তুতি-নিন্দা ইত্যাদি দ্বন্দ্ব ও প্রতিকূলতায় সম থাকার অর্থই হচ্ছে তপ। তপের অনুষ্ঠান দ্বারা সাধকের শরীর, মন শুদ্ধ হয় এবং তিনি তখন ত্রিগুণাতীত হয়ে ধর্মপথে শুভকর্মের আচরণ করেন।

স্বাধ্যায় : মহর্ষি ব্যাসদেব বলেছেন, সাধককে মোক্ষের পথে এগিয়ে নিয়ে চলা বেদ-উপনিষদ, যোগদর্শন, গীতা ইত্যাদি শাস্ত্রের শ্রদ্ধাপূর্বক অধ্যয়ন ও ওঁ-কার মন্ত্র জপ করাকে স্বাধ্যায় বলে। যে সাধক স্বাধ্যায়ের অনুষ্ঠান করেন, তিনি সিদ্ধ পুরুষ, মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি, দেব বা বিদ্বান যোগীর দর্শন পান-যাঁরা সাধককে সাধনায় সহায়তা করেন। ওঁকার মন্ত্র সঠিক জ্ঞানে জপ করলে, সাধক সাধন পথে যখনই কোনো বাধার সম্মুখীন হন, তখনই কোনো যোগসিদ্ধ পুরুষ তার পথ প্রদর্শন করেন।

স্বাধ্যায় অনুষ্ঠান সাধকের ভিতরে আলোকের সন্ধান দেয়। সাধক স্বাধ্যায় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও চর্চা পাণ্ডিত্য অর্জনের জন্য করেন না। সাধকের ততটাই স্বাধ্যায় অনুষ্ঠান করা উচিত, যতটা করলে তার মধ্যে পাণ্ডিত্যাভিমান জন্মায় না। যে মুহূর্তে সাধকের মনে পাণ্ডিত্যের অভিমান জন্ম নেয়, তখন তিনি যোগ বিভূতির দিকে ধাবিত হন এবং সাধনার থেকে দূরে সরে যান। স্বাধ্যায় অনুষ্ঠানের লক্ষ্য হল সাধকের মধ্যে জ্ঞানালোকের বিকাশ ঘটিয়ে তাকে ঈশ্বর প্রণিধানে সহায়তা করা ও জপের মাধ্যমে সাধনার উচ্চস্তরে পৌঁছানো। স্বাধ্যায় হচ্ছে সাধনার এমন একটি অনুষ্ঠান যা সাধকের কাছে সাধনাকে সহজ করে তোলে। স্বাধ্যায় দ্বারা সাধক তার সাধনার মূল লক্ষ্যকে স্থির করতে পারেন।

ঈশ্বর প্রণিধানঃ পরমাত্মার নিকট নিজের সমস্ত কর্ম অর্পণ করার নাম ঈশ্বর প্রণিধান। পরমাত্মা বা পরমেশ্বরকে সাধক সেই জিনিসই অর্পণ করতে পারে যেটা পবিত্র ও দিব্য। সেইজন্য সাধক অন্যান্য নিয়মানুষ্ঠানগুলি দ্বারা নিজেকে সম্পূর্ণ দিব্যভাবে উন্নীত করে নিজের অস্তিত্ব ও সমস্ত সত্তা ঈশ্বরকে অর্পণ করেন। সাধক যখন এই অনুষ্ঠানে সফল হন, তখন তাঁর সমাধি ও সিদ্ধি প্রাপ্তির সময় হয়। সমাধিকালে সাধক নিজের মধ্যে ও সর্বত্র পরমেশ্বরকেই দর্শন করেন এবং এই বোধ প্রাপ্ত হন যে পরমেশ্বর ও তার আত্মার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই।

লোকনাথ ও বেণীমাধব গুরুদেবের কাছ থেকে অষ্টাঙ্গযোগের নিয়মানুষ্ঠানগুলি তন্ময় হয়ে শুনতে থাকেন। গুরুদেব তাঁদের কাছে নিজজ্ঞান উজার করে দিচ্ছেন। এখন তাঁদের এই নিয়মানুষ্ঠানগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে প্রকৃত সাধক হবার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। লোকনাথ নিরলসভাবে যোগের বিভিন্ন অঙ্গের অনুষ্ঠান নিয়ত দৃঢ়ভাবে অভ্যাস করতে থাকেন।

.

অষ্টাঙ্গযোগের তৃতীয় অঙ্গ আসন

যোগী যে প্রকারে স্থিরভাবে বিনা কষ্টে দীর্ঘক্ষণ একভাবে বসে যোগসাধনা করেন, তাকে আসন বলে। যোগীর সাধনার জন্য কোনো একান্ত স্থানে সমতল ভূমিতে কুশ অথবা কম্বলের উপর মেরুদণ্ড সোজা রেখে আসনে বসা উচিত। এই আসন নানাপ্রকার হয়–যেমন, পদ্মাসন, ভদ্রাসন, বীরাসন, গোমুখাসন, স্বস্তিকাসন, দণ্ডাসন, পর্যাসন ইত্যাদি। যোগী তার সুবিধা অনুযায়ী যে কোনো আসন গ্রহণ করতে পারেন। এরপর আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে সবগুলি আসনের বিধি প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়ে দেন এবং বলেন যে, যোগী যখন আসনে সিদ্ধি লাভ করেন, তখন তার শীত-গ্রীষ্ম, ঠাণ্ডা-গরমজনিত কষ্ট থাকে না।

গুরুদেবের থেকে আসন বিধির শিক্ষা পেয়ে দুই শিষ্য বিভিন্ন আসন অভ্যাস শুরু করেন এবং বুঝতে চেষ্টা করেন, কোন্ আসনে তাদের মনোযোগ বেশি দৃঢ় হচ্ছে এবং কোন্ আসনে তারা বেশিক্ষণ ধ্যানে থাকতে সক্ষম হচ্ছেন। গুরুদেব তাদের প্রচেষ্টা দেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন।

.

অষ্টাঙ্গযোগের চতুর্থ অঙ্গ প্রাণায়াম

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদ্বয়কে বলেন, আজ আমি তোমাদের প্রাণায়াম শেখাব। তোমাদের আগে আসনসিদ্ধি লাভ করার জন্য যে আসনগুলি শিখিয়েছি, সেই আসনসিদ্ধ হলেই তবে প্রাণায়াম করতে তোমরা সক্ষম হবে। প্রাণায়াম হচ্ছে প্রাণের সাধনা। আসনসিদ্ধ হয়ে দেহের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে পরমেশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকার প্রক্রিয়ার নাম প্রাণায়াম। প্রাণায়ামের তিনটি স্তর আছে–যথা, পূরক, কুম্ভক এবং রেচক। গুরুদেব লোকনাথ ও বেণীমাধবকে প্রাণায়মের পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন–ডানহাতের অঙ্গুষ্ঠ দিয়ে দক্ষিণ নাসা ধারণ করে বায়ু রোধ করে ওঁ মন্ত্র জপ করতে করতে বাম নাসা দিয়ে যতটা সম্ভব বায়ু গ্রহণ করতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে বলে পূরক।

তারপর কনিষ্ঠা ও অনামিকা অঙ্গুলিদ্বয় দিয়ে উভয় নাসা ধারণ করে বায়ুরোধ করে ওঁ মন্ত্র জপ করতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে কুম্ভক বলে। তৎপর অঙ্গুষ্ঠ ডান নাসা থেকে তুলে নিয়ে ওঁ মন্ত্র জপ করতে করতে দক্ষিণ নাসা দিয়ে ভিতরের বায়ু বাইরে ত্যাগ করতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে বলে রেচক।

এইভাবে পুনশ্চ বিপরীত ক্রমে প্রথমে ডান নাসা দিয়ে পূরক, তৎপর উভয় নাসা বন্ধ করে কুম্ভক এবং অন্তে বাম নাসা দিয়ে রেচক করতে হবে। পূরক, কুম্ভক ও রেচক করবার সময় ওঁ মন্ত্র নিরন্তর জপ করে যেতে হবে।

সাধারণতঃ পূরকের সময় যতবার:ওঁ মন্ত্র জপ করবে, কুম্ভকের সময় তার চতুগুণ জপ করবে এবং রেচকের সময় পুরকের দ্বিগুণ জপ করবে। প্রাণায়ামের সময় একবার বামহাতের কর রেখায় এবং আরেকবার দক্ষিণহাতের কর রেখায় জপসংখ্যা রাখতে হয়।

লোকনাথ গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, যোগ সাধনায় প্রাণায়মের গুরুত্ব কি? আচার্যদেব তখন শিষ্যদ্বয়কে যোগসাধনায় প্রাণায়ামের বিশেষ গুরুত্বের ব্যাখ্যা করেন।

গুরুদেব শিষ্যদের বলেন, প্রাণায়াম যোগ সাধনার একটি প্রধান অঙ্গ। প্রাণায়ামের সঠিক অভ্যাসে দেহের পঞ্চক্লেশগুলি শিথিল হয়ে সাধকের মনে একাগ্রতা বৃদ্ধি করে এবং তার ধ্যানাবস্থার উন্নতি সাধন করে তাকে সমাধির পথে নিয়ে যায়। প্রাণায়ামের অভ্যাসে যোগী তার দেহে স্থিত পঞ্চপ্রাণকে দৃঢ় করতে সক্ষম হন এবং তার ফল হিসেবে যোগীপুরুষ দীর্ঘ আয়ু প্রাপ্ত হন। আচার্য তাদের আরও বলেন, এই পঞ্চপ্রাণ সম্বন্ধে আমি তোমাদের আরও কথা বলব। এখন তোমরা নিজ নিজ আসনে প্রাণায়াম অভ্যাসে রত হও।

লোকনাথ ও বেণীমাধব বনমধ্যে পথ চলতে চলতে যেখানেই অবস্থান করেন, যম-নিয়মের অনুষ্ঠানগুলি করতে থাকেন এবং আসন অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণায়ামের অভ্যাস নিরলসভাবে করতে থাকেন। লোকনাথ পর্যঙ্কাসন এবং গোমুখাসন বেশি করে অভ্যাস করেন কেননা তিনি এই দুই আসনেই চিত্তের একাগ্রতা বেশি করে বৃদ্ধি করতে পারেন, বেণীমাধব পদ্মাসনে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।

.

অষ্টাঙ্গযোগের পঞ্চম অঙ্গ প্রত্যাহার

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি এই দেখে তৃপ্ত হন যে, তার শিষ্যদ্বয় অক্লান্ত পরিশ্রম করে দ্রুত তার দেওয়া শিক্ষা আয়ত্ত করছেন। লোকনাথের যোগাসন অভ্যাসে তার মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় হয় যে, যোগের পরবর্তী ধাপগুলি গ্রহণ করতে এখন তাঁর শিষ্যদ্বয় সক্ষম হয়েছেন। সেইজন্য একদিন তিনি শিষ্যদ্বয়কে অষ্টাঙ্গ যোগের পঞ্চম অঙ্গ প্রত্যাহার সম্বন্ধে শিক্ষাদান করার জন্য ডাকেন।

গুরুদেব শিষ্যদের বলেন, আসনে বসে যোগাভ্যাস করার সময় প্রধান বাধারূপে দেহের ইন্দ্রিয়গুলি উপস্থিত হয়। দেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয় যোগীর চিত্তকে একাগ্রতা থেকে সরিয়ে বৈকল্যের পথে টেনে নিয়ে যায়। যোগীকে দেহের এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের উপর বিজয় প্রাপ্ত হতে হয়। দেহের এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের চালক হচ্ছে মন। সাধক যখন বৈরাগ্য ও প্রাণায়াম দ্বারা নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন, তখন তিনি দেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে জয় করতে সক্ষম হন। প্রাণায়াম ও বৈরাগ্যের দ্বারা দেহের ইন্দ্রিয়গুলিকে অন্তর্মুখী করার প্রক্রিয়ার নাম প্রত্যাহার। মহর্ষি পতঞ্জল বলেছেন, প্রত্যাহার অনুষ্ঠান দ্বারা সাধক তার ইন্দ্রিয়ের উপর পূর্ণ অধিকার কায়েম করতে পারে। দেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয় হল–শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ। এর প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের প্রতি আসক্তি মনকে বিচলিত করে তোলে। সাধক প্রত্যাহার সিদ্ধ হলে এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে জয় করতে সমর্থ হন এবং তিনি পরম ভগবতসুখের সন্ধান পান।

প্রত্যাহারের ব্যাখ্যা দিয়ে আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে বলেন, এতদিন পর্যন্ত আমি তোমাদের অষ্টাঙ্গ যোগের যে পাঁচটি অঙ্গ অর্থাৎ–যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম ও প্রত্যাহারের শিক্ষাদান করলাম, এগুলি হল অষ্টাঙ্গযোগের বহিরঙ্গ সাধন। অষ্টাঙ্গযোগের আর তিনটি অঙ্গ, অর্থাৎ–ধ্যান, ধারণা ও সমাধি হল অন্তরঙ্গ সাধন। তোমাদের বহিরঙ্গ সাধন সিদ্ধ হলে তবেই তোমরা অন্তরঙ্গ যোগসাধনে সক্ষম হবে। সুতরাং এইগুলি সম্বন্ধে আমি তোমাদের পরে শিক্ষাদান করবো। এখন আমি তোমাদের এই বহিরঙ্গ সাধনে সিদ্ধিলাভ করার উপায় ও পথ নির্দেশ করবো। তোমাদের দৃঢ় মনে আমার নির্দেশিত পথে এই বহিরঙ্গ যোগসাধনা করতে হবে। এরপর তারা আবার দুর্গম বনপথে এগিয়ে যেতে থাকেন ও প্রতি রাত্রিবাসে লোকনাথ ও বেণীমাধব বহিরঙ্গ যোগাভ্যাসে ডুবে যান। এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে তাদের যোগশিক্ষা ও সাধনা যার দৃষ্টান্ত মেলা ভার।

.

গুরুতত্ত্ব আলোচনা

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি নিজে চিন্তা করতে থাকেন যে, তাঁর শিষ্যদ্বয় নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলতে প্রস্তুত হচ্ছে, কিন্তু অষ্টাঙ্গ যোগে। নিয়মের অন্তর্গত স্বাধ্যায় অনুষ্ঠান করার মতো অক্ষর বা শাস্ত্রজ্ঞান এদের নেই। স্বাধ্যায়ের যথোচিত অনুষ্ঠান করলেই একজন সাধক উপলব্ধি করতে পারেন–সে কে? কে তার সৃষ্টিকর্তা? কেন তার সৃষ্টি হয়েছে? তার জীবনের লক্ষ্য কি? এই উপলব্ধির দ্বারাই সাধক পরমেশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং সিদ্ধিলাভের পথে এগিয়ে যান। লোকনাথ ও বেণীমাধবের মধ্যে এই উপলব্ধির সঞ্চার করতে হবে। তারা এখন মায়ার অন্ধকারে ডুবে আছেন। গুরুরূপে তাকে এখন শিষ্যদ্বয়ের এই মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে জ্ঞানের আলোর সন্ধান দিতে হবে।

শাস্ত্রে আছে–গুকারঃ প্রথমো বর্ণো মায়াদি গুণভাসক। রুকার্যোস্ত পরং– ব্রহ্ম মায়াভ্রান্তিবিমোচকম্।। অর্থাৎ, গুরু শব্দের ‘গু’ অক্ষরটি মায়ান্ধকারের প্রতীক। এবং রু অক্ষরটি সেই পরব্রহ্মের প্রতীক যে সেই মায়ার অন্ধকার থেকে শিষ্যকে মুক্ত করতে পারেন।

কিন্তু গুরু তখনই শিষ্যের মধ্যে জ্ঞানের সঞ্চার করতে সক্ষম হন যখন শিষ্য গুরুতত্ত্ব সম্বন্ধে অবহিত হয়ে সেই তত্ত্বসাগরে ডুব দিতে পারেন। সেইজন্য এখন প্রথমে তাকে শিষ্যদের গুরুতত্ত্ব সম্বন্ধে অবহিত করতে হবে।

তিনি শিষ্যদের বলেন, দেখো, তোমরা নিষ্ঠা ও ভক্তি সহকারে আমার থেকে যোগদর্শনের শিক্ষা গ্রহণ করছো। তোমরা আমার নিকট সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছে। সেজন্য এখন আমি গুরুরূপে তোমাদের স্বাধ্যায় অনুষ্ঠানের উপযুক্ত করে তুলবো। আমার মধ্যে সঞ্চিত জ্ঞান তোমাদের মধ্যে সঞ্চারের দ্বারা আমি তোমাদের মধ্যে মায়ার অন্ধকারকে ছিন্ন করে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে দেবো। লোকনাথ জিজ্ঞাসা করেন, গুরুদেব মায়া কি? আমাদের মধ্যে মায়া কোথা থেকে এলো? গুরুদেব বললেন, মায়া শব্দ মী ধাতু থেকে বুৎপন্ন হয়েছে। মী ধাতুর অর্থ হল বোধ করা। যে শক্তির দ্বারা ঈশ্বরের সৃজন, পালন হরণাদি বোধ হয় তাকে মায়া বলে। দেহতত্ত্বের নিয়মানুযায়ী ঈশ্বর যখন এই দেহ সৃষ্টি করেন, তখন এই দেহস্থিত আত্মার নিজ স্বরূপকে এক মায়ার আবরণ দ্বারা ঢেকে রাখেন। এই মায়ার জাল ছিন্ন না হলে আত্মার স্বরূপ জানা যায় না এবং তপস্যায়ও সফল হওয়া যায় না। গুরুর কৃপাই তোমাদের এই মায়াজাল ছিন্ন করে সত্যের সন্ধান দেবে। কিন্তু গুরুর সেই কৃপা একমাত্র একজন উপযুক্ত শিষ্যই পেতে পারেন। এই উপযুক্ত শিষ্য হবার জন্য তোমাদের গুরুতত্ত্ব সম্বন্ধে কিছু অবহিত হতে হবে। এই প্রকারে তিনি প্রথমে শিষ্যদের গুরু শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করেন। তারপর বলেন, শাস্ত্রে আছে

গুরুবক্রে স্থিতা বিদ্যা গুরুভক্ত্যা চ লভ্যতে।।

অর্থাৎ জগতের প্রকৃত বিদ্যা অর্থাৎ জ্ঞান একজন সদ্গুরুর মুখে অবস্থান করে এবং তা একজন প্রকৃত গুরুভক্তই লাভ করতে পারেন। শাস্ত্রে এও বলেছে

গুরুবক্রে স্থিতং ব্রহ্ম প্রাপ্যতে তৎপ্রসাদতঃ।

অর্থাৎ গুরুর বচনে স্বয়ং ব্রহ্মা অধিষ্ঠান করেন। পরমেশ্বরই স্বয়ং সদ্গুরুর মাধ্যমে সাধকের ভিতরের সব অন্ধকারের নিরসন করে তাকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলেন। যোগ্যশিষ্য সদ্গুরুর থেকে সত্যতত্ত্বের জ্ঞান লাভ করেন। সদগুরু কেবল একজন শিষ্য তৈরি করেন না, তিনি শিষ্যকে একজন তত্ত্বজ্ঞ জীবন্মুক্ত পুরুষে পরিণত করেন, যিনি মানব উদ্ধারকর্তা রূপে পৃথিবীর ক্লেশ লাঘব করেন। তোমরা এই গুরুতত্ত্ব সর্বদা মনে রাখবে। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাবান শিষ্য সদাই জ্ঞানলাভ করে। শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞান। আমি তোমাদের মধ্যে স্বাধ্যায়ের অনুষ্ঠান নিমিত্ত সেই জ্ঞানের সঞ্চার করবো যার দ্বারা তোমরা তোমাদের মধ্যের মায়ার আবরণকে ছিন্ন করে জ্ঞানের আলোর সন্ধান পাবে এবং একদিন সেই আলোয় জগৎকে আলোকিত করবে।

আচার্যদেব শিষ্যদের গুরুতত্ত্ব ব্যাখ্যা করে গহন বনের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে এক নির্জন পাহাড়ের গুপ্ত মুখ দেখতে পেলেন। সেই গুহার পাশেই ছিল এক গভীর খাদ। তার মধ্যে দিয়ে বহমানা এক খরস্রোতা নদী। আচার্যদেব ভাবলেন যমের অনুষ্ঠানে ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের জন্য এটাই উপযুক্ত স্থান। শিষ্যদের নিয়ে তিনি ওই গুহাতেই প্রবেশ করলেন এবং বললেন ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের জন্য এটাই উত্তম স্থান। কাল থেকে আমি তোমাদের এই গুহাতে ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের শিক্ষা দান করব।

.

ব্রহ্মচর্য ব্ৰতানুষ্ঠান পর্ব

আচার্যদেব সকালে শিষ্যদের নিয়ে নদীতে স্নান করে এসে বললেন, আজ আমি তোমাদের ব্রহ্মচর্য ব্রত আচরণ সম্বন্ধে বলবো। আজ থেকে শুরু হবে তোমাদের কঠোর কৃচ্ছুব্রত। ব্রহ্মচর্য পালন সাধনায় মোক্ষলাভের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান আছে। ধূমের দ্বারা যেমন অগ্নি, ময়লার দ্বারা দর্পণ এবং জরায়ুর দ্বারা গর্ভ আবৃত থাকে, তেমন কাম দ্বারা জ্ঞান আবৃত থাকে। ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি এইগুলি কামের বাসস্থান। ইন্দ্রিয়াদিকে বশীভূত করতে ব্রহ্মচর্য পালন করা কর্তব্য। ইন্দ্রিয়াদিকে জয় করতে হলে মনে করতে হবে ইন্দ্রিয় থেকে মন শ্রেষ্ঠ, মন · থেকে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ এবং বুদ্ধি থেকে অতিশয় শ্রেষ্ঠ হল আত্মা। ব্রহ্মচর্য পালন করলে যোগী সেই আত্মাকে দর্শন করতে সমর্থ হয়। ব্রহ্মচর্য পালনের জন্য তোমাদের নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী হতে হবে। একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী কঠোর যোগসাধনার সঙ্গে ব্রহ্মচর্যের ব্রতগুলি পালন করে। যোগীকে ব্রহ্মচর্যে সফলতা লাভ করার জন্য ৮টি ব্ৰতানুষ্ঠান করতে হয়। সেগুলি হল-নক্তব্ৰত, একান্তরা, ত্রিরাত্র, পঞ্চাহ, নবরাত্র, দ্বাদশাহ পক্ষাহ ও মাসাহ। এখন আমি তোমাদের এই ব্রতগুলি পালনের নিয়মগুলি বলবো।

নক্তব্ৰত : নক্ততে সারাদিন উপবাসে থেকে যোগানুশীলন করতে হয়। সূৰ্য্য অস্ত গেলে নক্ষত্র দর্শন করে হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যে উপযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।

একান্তরা ব্রত : একান্তরা ব্রত পালনের সময় একদিন ও একরাত্রি উপবাস করে কঠোর যোগ সাধনা করতে হয়। তারপরদিন স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।

ত্রিরাত্র ব্রত : ত্রিরাত্র ব্রতে যোগীকে ক্রমান্বয়ে তিনদিন-তিনরাত্রি উপবাস করে কঠোর যোগসাধনা করতে হয়। তারপর চতুর্থদিন স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের অনুকূল খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।

পঞ্চাহ ব্রত : পঞ্চাহ ব্রত পালনে যোগীকে ক্রমান্বয়ে পাঁচ দিন পাঁচ রাত্রি উপবাস করে যোগানুশীলনের পর ষষ্ঠ দিবসে স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্ৰহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।

নবরাত্র ব্রত : নবরাত্র ব্রত পালনে যোগীকে ক্রমান্বয়ে নয় দিন নয় রাত্রি উপবাস করে যোগানুশীলন করতে হয়। তারপর দশম দিনে স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।

নবরাত্রির ব্রত লোকনাথ ও বেণীমাধবের কাছে খুব কঠিন ছিল। ব্রহ্মচর্যাবস্থায় এত দীর্ঘদিন উপবাস থেকে যোগসাধনা করা বেশ কঠিন কাজ। লোকনাথ বাবা এই নবরাত্রিব্রত কিরূপে সমাধা করেছিলেন, সেই কথা ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন–উপবাসের কালে যাতে আমাদের কোনোরূপ অঙ্গ সঞ্চালন করতে না হয়, সেদিকে গুরুদেব সদা সতর্ক থাকতেন। এমনকি মল, মূত্র ত্যাগের জন্যও শরীর নড়াচড়া করতে গুরুদেবের নিষেধ ছিল। মল, মূত্র ত্যাগ করতে হলে গুরুদেব এসে জলশৌচাদি সমাধা করিয়ে দিতেন এবং আমাদের ধরে তুলে পরিষ্কার স্থানে বসিয়ে দিতেন। তৎপর বিষ্ঠা দূরে ফেলে দিয়ে স্থান পরিষ্কার করতেন। এইসব কথা যখন তিনি বলেছিলেন, সেইসময় লোকনাথ বাবার নয়ন হতে অশ্রু বিগলিত হয়ে তার বক্ষ ভেসে যেত। এমন গুরু না পেলে কি এমন লোকনাথ ব্রহ্মচারী হওয়া সম্ভব হতো! একবার হিতলাল মিশ্র লোকনাথ ও বেণীমাধবকে বলেছিলেন–আমরা জীবনে এমন গুরু পাই নাই।

দ্বাদশাহ ব্রত : দ্বাদশাহ ব্রত পালনে যোগীকে ক্রমান্বয়ে বারো দিন বারো রাত্রি উপবাস করে কঠোর যোগানুশীলন করতে হয়। তারপর ত্রয়োদশ দিনে স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্যগ্রহণ করতে হয়।

পক্ষাহ ব্রত : পক্ষাহ ব্রত পালনে যোগীকে ক্রমান্বয়ে এক পক্ষ অর্থাৎ পনেরো দিন পনেরো রাত্রি উপবাস করে কঠোর যোগানুশীলন করতে হয়। তারপর ষোড়শ দিনে স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।

মাসাহ ব্রত : মাসাহ ব্রত পালনে যোগীকে ক্রমান্বয়ে এক মাস দিবারাত্রি উপবাস করে একনিষ্ঠভাবে কঠোর যোগানুশীলন করতে হয়। তারপর একমাস কাল অতিক্রান্তের পরদিন স্নানান্তে একবার হবিষ্যান্ন অথবা ব্রহ্মচর্যের উপযোগী খাদ্য গ্রহণ করতে হয়।

আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়কে আরও উপদেশ দিলেন যে, তোমাদের ক্রমান্বয়ে এই ব্ৰতগুলি পালন করতে হবে। এই ব্রতানুষ্ঠানের নামই সাধনায় কৃচ্ছ্বসাধন। তোমরা ব্রতানুষ্ঠানকালে অষ্টাঙ্গ যোগের যে পাঁচটি অঙ্গ আমি তোমাদের শিখিয়েছি, সেগুলির পালন করবে। পূর্ণ একনিষ্ঠতার সঙ্গে অষ্টাঙ্গ যোগের অনুষ্ঠান এবং এই আটটি ব্রতের পালন করতে পারলে, তোমরা সাধনার পথে অনেক দূর অগ্রসর হতে পারবে। নক্তব্ৰত দিয়ে শুরু করে এক একটি ব্রত পালনে সিদ্ধ হয়ে, তবেই পরের ব্রত পালনে অগ্রসর হবে। আগামীকাল থেকেই শুরু হবে তোমাদের এই কৃছুব্রত। তোমরা তার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করো।

লোকনাথ ও বেণীমাধব নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রত উদ্যাপন শুরু করলেন। যোগানুশীলনের প্রতি পদে গুরু ভগবান গাঙ্গুলি তাদের পথ নির্দেশ করতেন। শিষ্যদের প্রতি কাজে তাঁর ছিল সজাগ দৃষ্টি। শিষ্যদের ব্রতানুষ্ঠানের পর খাদ্যগ্রহণ ও বিশ্রামের প্রতিও তিনি ছিলেন সর্বদাই সজাগ। ব্রত পালনের পর তাঁদের খাদ্য ছিল তিল ও দুধ দিয়ে তৈরি এক প্রকার অন্ন। পরবর্তীকালে লোকনাথ বাবা বলেছিলেন যে, এই খাদ্য খেতে তার বড়ই কষ্ট হতো।

এইভাবে তিন দশকের অধিক কাল ধরে চললো লোকনাথ ও বেণীমাধবের কঠোর কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে যোগসাধনা। লোকনাথ নক্তব্রত থেকে মাসাহ পর্যন্ত সব পর্যায়ের ব্রত পালনের পর আবার দ্বিতীয়বার মাসাহ করলেন। কিন্তু বেণীমাধব একবারই মাসাহ ব্রত পালন করেছিলেন। কঠোর তপস্যা আর কৃচ্ছ্বসাধনের মাধ্যমে ব্রহ্মচর্য ব্রতানুষ্ঠানের পর লোকনাথের শরীরে এক আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল। যোগলীণ লোকনাথের শরীর স্থির নিস্পন্দ এবং তার চক্ষু দুটি স্থির উজ্জ্বল রক্তবর্ণ। শরীর থেকে বের হচ্ছে এক উজ্জ্বল আভা। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথের এই তপোদীপ্ত শরীর দর্শন করে বুঝলেন, লোকনাথ তার স্থির লক্ষ্যের প্রতি এগিয়ে চলেছে।

একদিন লোকনাথ গুরুকে বললেন, গুরুদেব, দ্বিতীয়বার মাসাহ ব্রত করার সময় একদিন আমার মানসনেত্রে পূর্বজন্মের এক অদ্ভুত ছবি ভেসে উঠেছিল। আচার্যদেব জানতে চাইলেন, কি সেই ছবি?

লোকনাথ তখন বললেন, আমি যোগে লীণ ছিলাম। স্বপ্নের মতো দেখতে পেলাম, বর্ধমান জেলার পাশ দিয়ে দামোদর নদ বয়ে চলেছে। ওই নদের তীরে বেড়ুগাঁ নামে এক গ্রাম। সেই গ্রামে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে আমি সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে বিচরণ করছি। পরিবারে আমি সব থেকে ছোট ছেলে। অবিবাহিত। আমি কারও সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা বা কারও সঙ্গে বেশি কথা বলি না। কারও সঙ্গে কোথাও যাইও না। একা একা নির্জনে থাকতে ভালোবাসি। আমি গতজন্মে এই প্রকৃতির একজন মানুষ ছিলাম।

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি কাগজ এনে লোকনাথের বর্ণিত বৃত্তান্ত লিখে রাখলেন। তিনি বুঝলেন, লোকনাথের অভিনিবেশ অনুষ্ঠানকালে পূর্বজন্মের স্মৃতি তার মানসচক্ষে জাগরিত করতে পেরেছিল। একেই সাধনার ভাষায় বলে, জাতিস্মরতা লাভ।

গুরুদেব বুঝলেন, এই স্থানে সাধনার কাজ শেষ হয়েছে। এখন তাদের আবার এগিয়ে যেতে হবে। তাদের গন্তব্যস্থল এখনও অনেক দূর। সাধনপথে অগ্রগতির মধ্য দিয়েই সেই পথ অতিক্রম করতে হবে। তিনি লোকনাথকে বললেন, বাবা লোকনাথ, আমরা আগামীকাল এই স্থান ত্যাগ করবো। আবার শুরু হয় পথচলা এবং পথে পথে যোগসাধনা। এরপর থেকে তপস্যায় লোকনাথ তার মধ্যে দর্শন করেন তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। চলমান ছবির মতো সেই দৃশ্য তার মানসচক্ষে ফুটে ওঠে। এইভাবে যম, নিয়ম, অনুষ্ঠানের বিভিন্ন অঙ্গে তিনি সিদ্ধ হতে থাকেন।

.

যোগী লোকনাথের প্রতি হিংস্র জন্তুর অহিংসা প্রদর্শন

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথ ও বেণীমাধবকে নিয়ে এরপর এক বন। থেকে অন্য বনে ঘুরে যোগসাধনার উপযুক্ত একটি আস্তানার খোঁজ করতে থাকেন। একসময় তারা গভীর বনের মধ্যে একটি পরিত্যক্ত কুটির দেখতে পান। আচার্যদেব ভাবলেন গভীর নির্জন বনের মধ্যে এই কুটিরে কিছুদিন অবস্থান। করে শিষ্যদের যোগসাধনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তারা কুটিরকে অবস্থানের উপযুক্ত করে কিছু ফলমূল আহার করে শয়নের ব্যবস্থা করলেন। লোকনাথ গুরুদেবকে বললেন, আপনি বেণীমাধবকে নিয়ে কুটিরের ভিতরে শয়ন করুন। আমি আজকের রাতে কুটিরের বারান্দায় শয়ন করি। আচার্যদেব লোকনাথের কথায় সম্মতি প্রদান করলেন। তিনি কুটিরের বারান্দায় একা শয়ন করলেন। গভীর রাতে সহসা কোথা থেকে একদল ডাকাত কুটিরের সামনে এসে উপস্থিত হল। তারা কুটিরের বারান্দায় লোকনাথকে অন্ধকারে দেখতে পায়নি। ডাকাতরা এই পরিত্যক্ত কুটিরটি ব্যবহার করতে নিজেদের ডাকাতি করা সম্পত্তি ভাগ করার জন্য। কুটিরের ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে তারা দেখতে পায় গৈরিকবসন পরিহিত এক সন্ন্যাসী দরজার সামনে শুয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন চিৎকার করে বলে ওঠে, এখানে আবার কে শুয়ে আছে? ভাগ এখান থেকে। কিন্তু তাদের কথার কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। তখন ডাকাতেরা লোকনাথের খুব নিকটে এসে দেখতে পেল, এক তরুণ সন্ন্যাসী হাঁটুর উপর দুই বাহু প্রসারিত করে (পর্যঙ্কাসনে) শুয়ে আছে। সন্ন্যাসীর শরীর থেকে এক জ্যোতি বের হচ্ছে। তখন তারা যুক্তি করলো যে, এই তরুণ সন্ন্যাসীকে তারা হত্যা করবে। কিন্তু ডাকাত সর্দার সন্ন্যাসীকে দেখে তার সঙ্গীদের সেই ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত করলো। সে সঙ্গীদের বললো যে, এই সন্ন্যাসীকে হত্যা করলে আমাদের বিপদ হতে পারে। এ কোনো সাধারণ সন্ন্যাসী নয়। অন্য ডাকাতরা সর্দারের কথা না মেনে বললো, যদি আমরা এই সন্ন্যাসীকে ছেড়ে দিই, তবে সে অন্যদের আমাদের কথা বলে দিতে পারে। তাতে আমাদের বিপদ বাড়বে। সেজন্য একে শেষ করে দেওয়াই ভালো। এই কথা বলে একজন ডাকাত খোলা তরোয়াল নিয়ে যেই লোকনাথকে হত্যা করতে যাবে, তার হাত আর উপরে উঠলো না। সে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো এবং অন্যরা সেই দৃশ্য দেখে হতচকিত হয়ে গেল। এই সময় হঠাৎ কোথা থেকে দুটো বাঘ গর্জন করতে করতে ছুটে এলো। সর্ব ডাকাতরা ভয়ে মালপত্র ফেলে রেখে পালিয়ে গেল। কেবল ডাকাত সর্দার উঠানের একপাশে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সে দেখলো, বাঘ দুটি লোকনাথের কাছে এসে তাকে দেখে আবার বনের মধ্যে চলে গেল। ডাকাত সর্দার এই দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। যোগাসনে লোকনাথ এই ঘটনার কথা জানতে পারলেন না এবং কুটিরের অভ্যন্তরে নিদ্রামগ্ন আচার্যদেব ও বেণীমাধবও এই ঘটনার কথা কিছু টের পেলেন না।

পরদিন সকালে তারা একটি লোককে কুটিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। সেই লোকটি হল ডাকাত সর্দার। লোকনাথের চরণে মাথা রেখে বললো, তুমি মানুষ নও, দেবতা। আমি ডাকাত সর্দার। গতরাতে আমার সঙ্গীদের। নিয়ে যখন এই কুটিরে আসি, তখন তোমাকে দ্বারে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আমার সঙ্গীরা তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। আমার এক সঙ্গী যেইমাত্র তার তরোয়াল দিয়ে তোমাকে হত্যা করতে যাবে, তার হাত আটকে গেল। আমরা সকলে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তখন কোথা থেকে দুটো বাঘ গর্জন করতে করতে এখানে এলো। আমার সঙ্গীরা মালপত্র ফেলে বনে পালিয়ে গেল। আমি উঠানের পাশে একটি গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বাঘ দুটো তোমার কাছে এসে, তোমাকে দেখে চারিদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বনে চলে গেল। তোমার শরীর থেকে তখন এক অপূর্ব জ্যোতি বেরোচ্ছিল। তুমি সাধারণ সন্ন্যাসী নও বাবা। তুমি নিশ্চয়ই কোনো মহাযোগী। তোমার অলৌকিক শক্তির জন্যই বাঘ দুটো তোমার রক্ষায় এসেছিল।

লোকনাথ গতরাতের সব ঘটনা শুনে বিনীতভাবে আচার্যদেবকে দেখিয়ে বললেন, আমার কোনো শক্তি নেই। আমার এই গুরুদেবই আমার সকল শক্তির উৎস। তিনি যা শিখিয়েছেন, আমি তাই শিখেছি। ডাকাত সর্দার তখন আচার্যদেবকে বলল, আমার অনেক ভাগ্যে আমি আপনাদের মতো পুণ্যবান লোকেদের দেখা পেলাম। আমি আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। আচার্যদেব তাকে আশীর্বাদ করে বললেন, আর কখনও ডাকাতি কোরো না। সত্তাবে সংসার প্রতিপালন করো। আচার্যদেব এই ঘটনায় বুঝতে পারলেন যে, লোকনাথ বহিরঙ্গ যোগে সিদ্ধিপ্রাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। হিংস্র বাঘের তাঁর প্রতি অহিংস আচরণ করা লোকনাথের যোগবিভূতির পরিচয়।

এরপর একদিন লোকনাথ আচার্যদেবকে বললেন, গুরুদেব, আজ আমি সারারাত যোগাসনে থাকবো। আপনি ও বেণীমাধব আমার পাশে শুয়ে ঘুমোবেন। রাতে গহন বনে হিংস্র জীবজন্তুর নানাবিধ আওয়াজ কুটিরের পরিবেশকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। চারিদিকে অন্ধকার। লোকনাথ কুটিরের ভিতর যোগাসনে ধ্যানমগ্ন। আচার্যদেব ও বেণীমাধব তার পাশে শুয়ে গভীর নিদ্রামগ্ন। ব্রাহ্মমুহূর্তে আচার্যদেব গাত্রোত্থান করলেন ও বেণীমাধবকে জাগ্রত করলেন। ঘুম থেকে উঠে তারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন একটা প্রকাণ্ড বিষধর সাপ লোকনাথের গলা জড়িয়ে আছে। লোকনাথ নিশ্চলভাবে গভীর ধ্যানে মগ্ন। তাদের বাক্যস্ফুট হল না। কিছুক্ষণ এই দৃশ্য অবলোকন করার পর সাপটি ধীরে ধীরে লোকনাথের কণ্ঠ থেকে নেমে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। এর কিছুক্ষণ পরে লোকনাথের বুক্ষণ হল এবং তিনি এই ঘটনার কথা গুরুদেবের কাছে শুনলেন। আচার্যদেব বুঝতে পারেন যে, লোকনাথ অষ্টাঙ্গ যোগের যম-এর অনুষ্ঠান সফলভাবে করতে পারার জন্য অষ্টাদশ সিদ্ধির এক সিদ্ধি, যথা প্রাপ্তিসিদ্ধি লাভ করেছেন। সিদ্ধিলাভের পথে তাঁকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। যোগের অষ্টাদশ সিদ্ধিই প্রাপ্ত হতে হবে লোকনাথকে। আচার্যদেব মনে করলেন, গভীর বনে হিংস্র জন্তুর মাঝে যোগাসনে সফল হয়েছেন লোকনাথ। এখন আবার এগিয়ে যেতে হবে। তার পরবর্তী লক্ষ্য এটা পরীক্ষা করে দেখা যে, মাসাহ ব্রতের সময় লোকনাথ তাঁর পূর্বজন্মের যে কথা স্মরণ করতে পেরেছিলেন, সেটা সত্য কিনা। যদি সত্য হয়, তবে বোঝা যাবে, সে দেহের পঞ্চক্লেশকে ক্ষয় করতে সমর্থ হয়েছে।

.

লোকনাথের পূর্বজন্মের সত্যতা যাচাই

বনের কুটির ছেড়ে আবার শিষ্যদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি। বেশ কিছুদূর চলার পর তাদের সামনে একটি নদী দৃশ্যমান হল। আচার্যদেব লোকনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, কখনও যোগাসনে তুমি এইরকম কোনো জায়গা দেখেছ কি? লোকনাথ ভালো করে চারিদিক অবলোকন করে গুরুদেবকে বললেন, মনে হয় দ্বিতীয় মাসাহব্রতের সময় তিনি এইরকম জায়গাই দেখেছিলেন। তার মনে হয়, যোগাসনে দেখা সেই নদীই এই দামোদর নদ। এরপর তারা তিনজন লোকালয়ে প্রবেশ করে বেড়ুগাঁর সন্ধান করতে লাগলেন। কিছুদূর লোকালয়ে এগিয়ে লোকনাথ নিজেই বেডুগাঁ চিনতে পারলেন। আচার্যদেব সেই গ্রামের কতিপয় বৃদ্ধদের জিজ্ঞাসা করতে তারা সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতে পারলেন। সেই বৃদ্ধেরা সীতানাথের পরিবারের সম্বন্ধে যখন বলতে লাগলেন, তখন লোকনাথের তাঁর পূর্বজন্মের সব কথা মনে পড়তে লাগলো। এই গ্রামে জন্মের পর থেকে দেহপাত পর্যন্ত তিনি যা যা করেছিলেন, সব তার স্মরণ হতে লাগলো। এই ঘটনা থেকে আচার্যদেব নিশ্চিত হলেন যে, লোকনাথ দ্বিতীয় মাসাহ ব্রতের সময় তাঁর পূর্বজন্মের যে কথা স্মরণ করতে পেরেছিলেন, সে কোনো স্বপ্ন নয়, সেটা হল তার অভিনিবেশ ক্লেশকে ক্ষয় করার উদাহরণ। দেহের পঞ্চক্লেশ যতক্ষণ ক্ষয় না হয়, সাধক সাধনার উচ্চমার্গে প্রবেশ করতে পারে না। এই পঞ্চক্লেশের মধ্যে অভিনিবেশ ক্লেশ ক্ষয় হলেই সাধক তাঁর পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পারেন। বেডুগার ঘটনা প্রমাণ করে যে, লোকনাথ পঞ্চক্লেশকে ক্ষয় করতে পারায় তার মধ্যে পূর্বজন্মের স্মৃতি উন্মোচিত হয়েছে। এখন অষ্টাঙ্গ যোগের বহিরঙ্গ যোগসাধনের অন্য অনুষ্ঠান গুলিতে সফল হলে তবেই সে অষ্টাদশ সিদ্ধির পথে এগোতে পারবে। তাদের যোগসাধনার যাত্রা যে সঠিক পথে হচ্ছে, বেডুগাঁয়ে আচার্যদেব সেই সম্বন্ধে নিশ্চিত হলেন।

.

বনের মন্দিরে কালীসাধকের সঙ্গে সাক্ষাৎ

আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির আবার শুরু হয় পথ চলা। লোকালয় ছেড়ে শিষ্যদের নিয়ে আবার তিনি বনপথ ধরেন। গহন অরণ্যে পথ চলতে চলতে একটি আশ্রমের সন্ধান পাওয়া যায়। আচার্যদেব সেই আশ্রমেই কিছুদিন থাকার সংকল্প করেন। জনকোলাহলশূন্য বনের মধ্যেই এখন যোগসাধনার উপযুক্ত স্থান বলে গুরুদেব মনে করেন। চতুর্দিকে হিংস্র জন্তু জানোয়ারের মাঝে নানারকম কীটপতঙ্গের শব্দের মধ্যে বসে একনিষ্ঠ যোগসাধনায় শিষ্যদের তিনি মগ্ন হতে বলেন।

এইসময় একদিন বনের মধ্যে বিচরণ করতে করতে লোকনাথ একটি কালীমন্দিরের দর্শন পান। তিনি জানতে পারেন যে, সেই মন্দিরের সেবক একজন কালীসাধক। ওই সাধক কালীসাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছেন। তিনি কোনো আচার মানেন না। মা কালী তার সঙ্গে কথা বলেন। একদিন তিনি সেই কালীসাধককে দেখতে পান। তিনি সেই সাধককে জিজ্ঞাসা করেন, মা কি তোমার সঙ্গে কথা বলেন? সেই সাধক লোকনাথের কথা শুনে পাগলবৎ উচ্চহাস্য করে বলেন, মা আমার সঙ্গে কথা বলে বৈকি! মা তার ছেলের সঙ্গে কথা কইবে না? লোকনাথ তখন তার কাছে আবদার করেন, তার হয়ে একটি কথা মাকে জিজ্ঞাসা করতে। সেই সাধক লোকনাথকে দেখে বুঝতে পারেন যে সেও একজন যোগী। সাধক রাজি হন। লোকনাথ বলেন, তুমি মার কাছে জিজ্ঞাসা কোরো আমি হিমালয়ে গিয়ে তপস্যা করতে পারবো কি না? সেখানকার দারুণ শীত আমার সহ্য হবে কি না? সাধক মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন। লোকনাথ শুনতে পান, মা বলছেন, তুমি হিমালয়ে গিয়ে তপস্যা করতে পারবে। শীত সহ্য হবে। লোকনাথ অবাক হয়ে সাধককে বলেন, আমি মাকে একটা প্রশ্ন করবো? সাধক বলেন, করে দেখ। লোকনাথ এইবার নিজে প্রশ্ন করেন, আমি কি হিমালয়ে তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করতে পারবো? মার কাছ থেকে কোনো উত্তর আসে না। লোকনাথ ভাবতে থাকেন, সাধক যখন জিজ্ঞাসা করলেন, তখন মা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, কিন্তু মা তার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি বুঝলেন, এই সাধক সিদ্ধিপ্রাপ্ত। তিনি নিজে এখনও সেই স্তরে উন্নীত হতে পারেন নি। তিনি তখন সেই সাধককেই অনুরোধ করেন, তার হয়ে প্রশ্নটা মাকে করতে। সাধক হেসে লোকনাথের প্রশ্নটা মাকে নিবেদন করেন। এবার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসে, হ্যাঁ, হিমালয়ে সিদ্ধিলাভ ঘটবে। এই ঘটনা লোকনাথের মনে প্রবল বল সঞ্চার করে। তিনি পূর্ণ উদ্যমে গভীর সাধনায় মগ্ন হন। তাঁর সাধনার প্রতি সদা জাগ্রত দৃষ্টি রাখেন আচার্যদেব।

.

প্রণবরূপী শব্দব্রহ্ম সাধনা

একদিন লোকনাথ গুরুদেবের কাছে প্রণবরূপী শব্দব্রহ্ম সাধনা সম্বন্ধে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আচার্যদেব তাকে বলেন, মানুষ জন্মসময়ে শুদ্ৰজাতি থাকে, উপনয়ন সংস্কারান্তে দ্বিজ হয় এবং যখন সে বেদপাঠ করে তখন তাকে বিপ্ৰ বলে। বিপ্র যখন ব্রহ্ম অর্থাৎ প্রণবকে জানতে পারে, তখন তাকে ব্রাহ্মণ বলে। একজন বিপ্র তখনই ব্রাহ্মণ হন, যখন তিনি প্রণবরূপী ওঁকারকে জানতে সমর্থ হন। এই প্রণবরূপী ওঁকারই ব্রহ্ম। ওঁকার ব্রহ্মের শব্দপ্রতীক। ব্রহ্মের ধ্যেয়মূর্তি। ওঁকার সহায়ে ব্রহ্মের ধ্যান করলে জীবের ক্রমমুক্তি হয় এবং ব্রহ্মলোক প্রাপ্তি হয়।

ব্ৰহ্ম দুই প্রকার–পরব্রহ্ম ও অপরব্রহ্ম।

 ব্ৰহ্ম যখন নিষ্ক্রিয় থাকেন অর্থাৎ যখন তিনি প্রকৃতিতে আরোপিত হন না, তখন তাকে পরব্রহ্ম বলা হয়। ব্ৰহ্ম যখন প্রকৃতি স্বরূপ হয়ে সৃষ্টি করতে থাকেন, তখন তাকে অপরব্রহ্ম বলা হয়। এই পরব্রহ্ম ও অপর ব্রহ্মের সমষ্টিকে মহাপ্রণব বলা হয়। তোমাদের এই মহাপ্রণবের জ্ঞান আত্মস্থ করে প্রণব জপের মাধ্যমে ব্রহ্মের ধ্যান করতে হবে।

আচার্যদেব শিষ্যদের বলেন, এতদিন তোমরা প্রাণায়ামকালে প্রণবের প্রকৃত অর্থ না জেনে প্রণবমন্ত্র জপ করেছ। প্রাণায়াম অভ্যাসের প্রাথমিক অবস্থায় এইরূপ করে তোমরা প্রাণায়াম পদ্ধতিতে উৎকর্ষ লাভ করেছ। আমি তোমাদের পূর্বে কেবলওঁকার মন্ত্রের তিন বর্ণের অর্থ বলেছিলাম। কিন্তু ওঁকারের প্রকৃত অর্থ আরও ব্যাপক। আমি তোমাদের এখন ‘ওঁ’ কার মন্ত্রের সেই প্রকৃত অর্থ বলবো।

তোমরা জেনেছ ‘ওঁ মন্ত্র তিনটি বর্ণ দ্বারা গঠিত-অ-উ-ম। এই মন্ত্রে অ-কারের অর্থ জগতের পালনকর্তা, উ-কারের অর্থ জগতের সংহারকর্তা এবং ম-কারের অর্থ জগতের সৃষ্টিকর্তা। এই তিনবর্ণের মিলিত শব্দ ওঁ-কে মহাপ্রণব বলা হয়। সুতরাং ওঁ শব্দ হল পরব্রহ্ম ও অপরব্রহ্মের সমষ্টি।

এই ওঁ-কারের সাতটি অঙ্গ, চতুষ্পদ, ত্রিস্থান এবং পঞ্চদেবতা আছে। ওঁ-কারের সাতটি অঙ্গ হলো–অ-কার, উ-কার, ম-কার, নাদ, বিন্ত, মূল, প্রকৃতি এবং কলাতীত। ওঁ-কারের চতুস্পদ হলোস্থূল, সূক্ষ্ম, বীজ এবং সাক্ষী। ওঁ-কারের ত্রিস্থান হলো-জাগ্রত অবস্থা, স্বপ্নাবস্থা এবং সুষুপ্তি অবস্থা। ওঁ-কারের পঞ্চদেবতা হলন–ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, ঈশ্বর ও মহেশ্বর।

ওঁকারের এই প্রকৃত ও বহু ব্যাপক অর্থ জেনে যিনি ওঁকারের অর্থাৎ প্রণবের ধ্যান করেন, তিনিই ব্রহ্মকে জানতে পারেন। এই প্রণব ধ্যান বা জপ কেবল ওঁ শব্দ উচ্চারণ নয়। ওঁ মন্ত্র যখন সাধকের যচক্র ভেদ করে দেহের সত্যলোকে পৌঁছায়, তখন তার ব্রহ্মদর্শন হয়। মানবদেহের মস্তকে সত্যলোক অবস্থিত।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মানবদেহের বিভিন্ন অংশে পরলোকের বিভিন্ন ভাগের অবস্থান আছে। ব্রহ্মাণ্ডের চতুর্দশভূবন এই মানবদেহে অবস্থান করে। তার মধ্যে নাভিদেশে ভূলোক, হৃদয়ে ভূবলোক, কণ্ঠদেশে স্বর্গলোক, চক্ষুদ্বয়ে মহর্লোক, চক্ষুদ্বয় ও ললাটের মাঝে জনলোক, ললাটে তপলোক এবং মস্তকে সত্যলোকের অবস্থান। কোনো সাধক যখন ওঁ মন্ত্রের অর্থাৎ প্রণবের উপাসনা করেন তখন তার উচ্চারিত ওঁ মন্ত্রের ধ্বনি দেহস্থিত ব্রহ্মাণ্ডের এই সকল ভবনে ধ্বনিত হয়ে ষট্‌চক্র ভেদ করে সত্যলোকে পৌঁছায় এবং সেখানে ব্রহ্মলোক স্ফুটিত হয়। সেইজন্য সাধকের দেহতত্ত্ব জ্ঞান বিনা মহাপ্রণবের উপাসনা সফল হয় না।

লোকনাথ ও বেণীমাধব গুরুদেবের এই ওঁ-কারতত্ত্ব আলোচনায় খুবই উৎসাহিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে এই সম্বন্ধে আরও জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ বেড়েছে। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, মানবদেহ সৃষ্টির গুঢ় তত্ত্ব না জেনে ব্রহ্মের সাধনায় সফল হওয়া যায় না। সাধনার গুঢ়তম তত্ত্ব এই মানবদেহের মধ্যেই নিহিত আছে। তারা ঠিক করলেন, পরের দিন গুরুদেবের কাছে ষট্‌চক্রতত্ত্ব রহস্য সম্বন্ধে আরও জানতে চাইবেন।

.

মানবদেহের ষটচক্র তত্ত্বশিক্ষা

পরদিন আচার্যদেব শিষ্যদের নিয়ে আলোচনায় বসতেই লোকনাথ ও বেণীমাধব তার কাছে মানবদেহের ষট্‌চক্রতত্ত্ব ও ষট্‌চক্র ভেদের প্রক্রিয়া জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আচার্যদেব শিষ্যদ্বয়ের আগ্রহে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কাছে মানবদেহের ষট্‌চক্রতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন।

মানবদেহের মেরুদণ্ডের মধ্যস্থলে একটি সুষুম্ননাড়ী আছে। এই নাড়ী দেহের গুহ্যমূল থেকে মস্তকের ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত প্রসারিত। মেরুদণ্ডের মজ্জার সঙ্গে যে স্থানে মস্তিষ্কের মজ্জার সংযোগ ঘটেছে, সেই স্থানের নাম আজ্ঞাচক্র। সুষুম্না নাড়ী এই স্থান থেকে দুভাগে বিভক্ত হয়ে ব্রহ্মরন্ধ্রে গিয়েছে। আজ্ঞাচক্র থেকে ললাটের সম্মুখদিকের অভ্যন্তরপথে অর্ধবৃত্তাকারে ব্রহ্মরন্ধের কাছে নাড়ীর একটি মুখ এবং আজ্ঞাচক্রের পিছন দিয়ে অর্ধবৃত্তাকারে অপর পাশে গিয়েছে নাড়ীর আর একটি মুখ। ব্রহ্মতালুদেশে এই দুই মুখের মধ্যস্থলে ব্রহ্মরন্ধ্র অবস্থিত। ব্রহ্মর কথার অর্থ যে রন্ধ্র অর্থাৎ ছিদ্রপথে পরমাত্মা শরীরের মধ্যে জীবাত্মারূপে প্রকট হন বা যেখান দিয়ে জীবাত্মার উক্ৰমণ ঘটে। সুষুম্না নাড়ীর এই দুই ভাগের নাম উত্তরা সুষুম্না ও অপরা সুষুম্না। আজ্ঞাচক্রের নিচের যে ষট্‌চক্রের অংশগুলি অবস্থিত, সেগুলি দক্ষিণায়নের পর্ব। এইজন্য ষট্‌চক্রের পঞ্চচক্র পর্যন্ত ভেদ করে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত যোগী উঠতে পারলেও যোগীকে দক্ষিণায়নের পথে এই মরদেহ ত্যাগ করতে হয় এবং সেক্ষেত্রে যতই সিদ্ধি সে আয়ত্তে আনতে পারুক না কেন, তাকে আবার কিছুকাল পরে পুনর্জন্ম লাভ করতে হয়। যোগী যদি আজ্ঞাচক্রের উপরে উঠতে সমর্থ হয় অর্থাৎ উত্তরা সুষুম্না পথে সহস্ররে উঠতে সমর্থ হয়, তবে সে উত্তরায়ণের পথে তার জীবাত্মাকে ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে উক্ৰমণ করতে সমর্থ হয় এবং সেই পথে সে ব্রহ্মলোকে পৌঁছতে সমর্থ হয়। উত্তরা সুষুম্না হল ব্রহ্মমার্গ। নর্মদা পরিক্রমাকালে গুজরাটের নর্মদাতটে উত্তরেশ্বর লিঙ্গের কাহিনী যখন জেনেছিলাম, তখন বুঝেছিলাম উত্তরেশ্বর লিঙ্গের উৎপত্তি হয়েছিল ব্রহ্মবিদ্যার মূর্ত বিগ্রহ ভগবান সনকুমারের তপস্যাবলে এবং নর্মদা পরিক্রমাকারী উত্তরেশ্বরের তপস্যা করলে ব্রহ্মবিদ্যার এই পথের সন্ধান পাওয়া যায় এবং সাধক উত্তর সুষুম্না পথেরও সন্ধান পান। বাবা লোকনাথ এই উত্তর সুষুম্না পথেই উক্রমণ করেছিলেন।

যোগীকে নিজের শরীরাভ্যন্তরের ব্রহ্মমার্গের সন্ধান পেতে গেলে এই সুষুম্ন নাড়ীর মাধ্যমে কিভাবে ষট্‌চক্র ভেদ করে ব্রহ্মজ্যোতি আজ্ঞাচক্রে ভোলা যায়, সেই প্রক্রিয়া শিখতে হয়।

সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে একটি নাড়ী আছে যার নাম চিত্ৰাণী এবং সেই চিত্রাণী নাড়ীর অভ্যন্তরে আর একটি সুক্ষ্ম নাড়ী আছে যার নাম ব্রহ্মনাড়ী। এই সুষুম্ন নাড়ী একটি শুক্লবর্ণ নাড়ী যার ছয়টি গ্রন্থি আছে। এই ছয়টি গ্রন্থিকে ছয়টি চক্র বা ষট্‌চক্র বলে। মেরুদণ্ডের নিচে গুহ্যমূল থেকে মস্তক পর্যন্ত বিস্তৃত সুষুম্না। নাড়ীর ক্রমান্বয়ে গ্রন্থিগুলি হল—

(১) মূলাধার–এখানে দেহের ক্ষিতিতত্ত্ব নিহিত আছে। এই মূলাধার চক্রে কুলকুণ্ডলিনী নিদ্রিত অবস্থায় বা সুপ্তাবস্থায় চতুর্দল পদ্মমধ্যে থাকে।

 (২) স্বাধিষ্ঠান–এখানে দেহের জলতত্ত্ব নিহিত আছে। মানবের যৌনসম্ভোগজনিত বৃত্তিগুলি এখানে ষড়দল পদ্মমধ্যে অবস্থিত।

(৩) মণিপুর–এখানে দেহের তেজতত্ত্ব নিহিত আছে। এটি মানবদেহের নাভীমূল। এখানে খাদ্য ও পানীয়জনিত বৃত্তিগুলি দশদল পদ্মমধ্যে নিহিত আছে।

(৪) অনাহত–এখানে দেহের বায়ুজনিত তত্ত্বগুলি নিহিত আছে। এখানে মানবের দর্প, দম্ভ, অহঙ্কার, সন্দিগ্ধতা, মান-অভিমানজনিত বৃত্তিগুলি দ্বাদশদল পদ্মমধ্যে নিহিত আছে।

(৫) বিশুদ্ধ–এখানে দেহের আকাশতত্ত্ব নিহিত আছে। এটি মানবদেহের ঘাড়ের কাছে অবস্থিত। এখানে মানবের পূজা-পাঠ, তীর্থভ্রমণ, তীর্থস্থান, উপবাসাদি জনিত বৃত্তিগুলি সোড়শদল পদ্মমধ্যে নিহিত আছে।

(৬) আজ্ঞাচক্র–ইহা ভগবদ্ভুমি। ললাটে দ্বিদল পদ্মমধ্যে অবস্থিত।

 (৭) মস্তক–যচক্রের উপরে মস্তকে ব্রহ্মাণ্ডের সত্যলোক অবস্থিত। এখানে অধোমুখ সহস্রদল পদ্মকর্ণিকা মধ্যে পরমাত্মার নিবাস। ঈশ্বর যখন দেহসৃষ্টি করেন, তখন এই সহস্রদল পদ্মকর্ণিকা মধ্যে নিজের অর্থাৎ নিজ অংশের প্রবেশ ঘটান।

কোনো আত্মা যখন পরলোক থেকে ইহলোকে একটি শরীরকে আধার করে অবতীর্ণ হয়, তখন সেই আত্মার মধ্যে যে জীবাত্মা থাকে তাকে নিবাত দ্বীপশিখার মতো চিন্তা করে সুষুম্না পথে হৃদয় থেকে এনে মূলাধারে কুলকুন্তলিনীর সঙ্গে একীভূত করতে হয়। যোগীগণ গুরুর নিকট যোগশিক্ষা করে এই কাজে সমর্থ হয়। তারপর যোগবলে সেই কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে এক একটি চক্রে নিহিত প্রবৃত্তি গুলিকে জয় করে চক্র ভেদ করে উপরে উঠতে হয়। এইভাবে ছয়টি চক্র ভেদ করে যখন কুলকুণ্ডলিনী আজ্ঞাচক্রে পৌঁছায়, তখন ভগবৎদর্শন লাভ হয়। আজ্ঞাচক্রে পৌঁছবার আগে বিশুদ্ধচক্রে মানবকে ধর্মের মায়ার আবরণে এমন ভাবে ভুলিয়ে রাখে যে সে কেবল পূজা-পাঠ ও তীর্থভ্রমণ করে সন্তুষ্টিতে ভোগে। যোগীরা অনেক সময় এইভাবে স্বাধ্যায় অনুষ্ঠানেই আটকে যান। তাহলে আর আজ্ঞাচক্রে পৌঁছে ভগবৎ দর্শন লাভ হয় না। যিনি নিজের সাধনার দ্বারা এই মায়ার বন্ধন ত্যাগ করে বিশুদ্ধচক্র ভেদ করে আজ্ঞাচক্রে পৌঁছতে পারেন, তিনিই ভগবৎ দর্শনের অধিকারী হন।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মানন্দ ভারতীর কাছে যোগশিক্ষা প্রদানকালে প্রকাশ করেছিলেন যে, কুলকুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে মেরুদণ্ডের অভ্যন্তরদেশে ক্রমে ক্রমে ছয়চক্র ভেদ করে অতিক্রম করে সহস্রাধারে অর্থাৎ মস্তিষ্কমধ্যে প্রবেশ করালে যোগী বিশেষ আনন্দ অর্থাৎ পরমানন্দ অনুভব করতে পারেন। এই প্রক্রিয়ায় যোগী তাঁর আত্মাকে সুষুম্না নাড়ীর মস্তিষ্কস্থিত মুখ থেকে অর্থাৎ ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে দেহ থেকে সূক্ষ্মভাবে বর্হিবিশ্বে নিয়ে যেতে পারেন আবার সেই পথে তার নিজের দেহে ফিরিয়ে আনতে পারেন। বাবা লোকনাথ অন্তদৃষ্টির মাধ্যমে এই কাজ সুচারুরূপে করতে সক্ষম হতেন। অনেক যোগী হয়তো ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে আত্মাকে বহির্গত করতে সক্ষম হন কিন্তু আবার সেটা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন না। তখন সেই আত্মা ব্রহ্মলীণ হয়।

যোগী যখন ষট্‌চক্র ভেদ করতে করতে উপরের দিকে উঠতে থাকেন তখন সুষুম্না নাড়ীর অভ্যন্তরে ব্রহ্মনাড়ীর মধ্যে এক প্রকার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হতে থাকে। একে আধ্যাত্মিক ভাষায় ব্রহ্মতেজের জাগরণ বলে। যখন ষট্‌চক্র ভেদ প্রক্রিয়ায় যোগী আজ্ঞাচক্রে পৌঁছতে সমর্থ হন, তখন ব্রহ্মনাড়ীর সেই স্ফুলিঙ্গ দুই ভ্রু-র মধ্যস্থলে আজ্ঞাচক্রে দিব্যজ্যোতির আকারে দর্শন হয়। এরপর যোগীর জীবাত্মা মস্তকস্থিত সহস্ৰারে পরমাত্মাকে দর্শন করে পরম আনন্দ অনুভব করেন।

তপস্যারূপ নর্মদা পরিক্রমাকালে সহস্রধারে পরমাত্মা দর্শনের জন্য আর একটি বিদ্যার কথা জেনেছিলাম। তার নাম শাম্ভবী বিদ্যা বা শাম্ভবী মূদ্রা। শাম্ভবী মূদ্রা প্রকৃতপক্ষে শিব সাধনা। এই বিদ্যায় চিন্তা করা হয় যে সদাশিব সকল মানবের ইষ্টদাতা এবং মুক্তির জনক। তিনিই একমাত্র মানবের মুক্তিদাতা। কোনো মানব যদি ইহজীবনে পরমেশ্বরের পরমতত্ত্বের অনুভূতি পেতে চান বা নিজের মধ্যে পরমাত্মাকে দর্শন করতে চান বা দর্শনের পরম আনন্দসাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চান, তবে তাকে জন্মমল, কর্মর্মল ও আণবমলের করালগ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করে অমৃতপদে স্থান পাবার জন্য শাম্ভবী বিদ্যার প্রয়োগ করতে হবে। এই শাম্ভবী মুদ্রার প্রয়োগে সকলের অধিকার জন্মায় না। যে যোগীর খেচরী মুদ্রা আয়ত্তে আছে, সেই কেবল শাম্ভবী মুদ্রা প্রয়োগের অধিকারী। খেচরী মুদ্রা সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য যে, নর্মদা পরিক্রমাকালে জানা যায় যে খেচরী মুদ্রা হল এক বিশেষ প্রকার যৌগিক ক্রিয়া যার প্রয়োগে শিবদর্শন হয়। প্রক্রিয়াটি হল জিহ্বাকে লম্বা করে উল্টোদিকে আলজিহ্বার উপর দিয়ে তালুমধ্যে প্রবেশ করিয়ে সহস্রাধার মণ্ডলের দিকে ঊর্ধদিকে রেখে অবস্থান করা। এই ক্রিয়ায় সাধকের শিবদর্শন হয়। নর্মদাতটে যোগীগণ এই ক্রিয়ার প্রয়োগ করে থাকেন।

শাম্ভবী মুদ্রায় জিহ্বাকে অবলীলাক্রমে দুই ভ্র-মধ্যস্থ স্থানে স্পর্শ করাতে হয়। যোগাসনে বসে যোগী জিহ্বাকে তালুর অভ্যন্তর দিয়ে উপরদিকে কপালের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়ে স্থির দৃষ্টিতে অবস্থান করবেন। তারপর দুই ভ্র-মধ্যস্থ স্থান পলকহীন ভাবে স্থির দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে একাগ্রভাবে নিজ জীবাত্মাতে এক জ্যোতি অবলোকন করবে। এর নাম শাম্ভবী মুদ্রা। এটা জানা যায় যে, এই মুদ্রা প্রয়োগের সময় যোগীর দুই চোখের মণিদ্বয় একপাশে এনে ঊর্ধ্বনেত্রে জ্ব-দ্বয়ের মধ্যবিন্দুকে লক্ষ্য করতে হয় (আজ্ঞাচক্র)। যোগী প্রথমে বাঁ চোখের মণি ডানপাশে এবং ডান চোখের মণি বাঁ পাশে এনে মধ্যস্থ স্থলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। তারপর প্রাণায়ামের নিয়ম অনুযায়ী শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যোগী তাঁর আজ্ঞাচক্রে জ্যোতির প্রকাশ ঘটান। একজন সিদ্ধ যোগী এই জ্যোতির মধ্যে পরমেশ্বরের চিদানন্দরূপ দর্শনে সমর্থ হন এবং তার চৈতন্য সত্তায় মন ডুবে গিয়ে সমস্ত জগৎ একাকার হয়ে যায়। তখন তার হৃদয়ে কেবলই পরমানন্দ। সাধক এই অবস্থায় নিজ জীবাত্মাকে এক জ্যোতিস্বরূপ দেখতে সমর্থ হন এবং সেই জ্যোতির মধ্যে পরমাত্মা দর্শন করে সদানন্দভাবে বিভোর হয়ে থাকেন।

এই বিদ্যা জেনেছি, কিন্তু নিজে প্রয়োগ করার চেষ্টা করিনি। শাম্ভবী বিদ্যার উল্লেখ এইখানে এইজন্য করলাম যে, যারা বাবা লোকনাথের ছবিকে অন্তর দিয়ে দেখবেন, তারা লক্ষ্য করবেন বাবার চোখের মণি প্রায়শই শাম্ভবী মুদ্রায় অবস্থান করতো এবং তার চক্ষু পলকহীন স্থির থাকতো। মনে হতো যেন তিনি কোনো দূরঅন্তে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন। তিনি অনেক সময় শাম্ভবী মুদ্রায় পরমেশ্বরের সঙ্গে ব্রহ্মজ্যোতিতে পরমানন্দে অবস্থান করতেন। যা সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না। বাবা লোকনাথ ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে যোগশিক্ষা দেবার কালে এই শাম্ভবী মুদ্রার উল্লেখ করেছিলেন। নিজ পঞ্চভূত দেহ মধ্যে ব্রহ্মজ্যোতি দর্শন করার এটিও একটি পথ।

যচক্র ভেদ ক্রিয়া মানবদেহের ভূতশুদ্ধির একটি অঙ্গ বচ্চক্রভেদক্রিয়ার জ্ঞান লাভ করে লোকনাথ আচার্যদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, গুরুদেব, ভূতশুদ্ধি কি?

.

ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা

আচার্যদেব বললেন, আমাদের শরীরের ভিতর পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চপ্রাণ, মন ও বুদ্ধি দ্বারা গঠিত আর একটি শরীর আছে যাকে সূক্ষ্মশরীর বা লিঙ্গশরীর বলা হয়। চক্ষুদ্বারা একে দেখা যায় না। যোগীরা যোগবলে এই লিঙ্গশরীর দর্শন করতে সমর্থ হন। এই লিঙ্গশরীরকে শোধন করার প্রক্রিয়ার নাম ভূতশুদ্ধি। আমি প্রথমে তোমাদের মানবদেহস্থিত পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চপ্রাণের পরিচয় দিচ্ছি।

লিঙ্গশরীর গঠন উপাদানের পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় হল–চক্ষু, কর্ণ, নাসিক, জিহ্বা ও ত্বক। এগুলির দ্বারা আমরা পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ ভোগ ও অনুভব করি।

পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় হল–বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ। এই পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় সংযত করে যোগীরা কর্মযোগে রত হন।

মানব শরীরে পঞ্চপ্রাণ অবস্থিত। এই পঞ্চপ্রাণগুলি কি এবং মানব শরীরে এরা কি কি কাজ করে, আমি তোমাদের সে কথা বলছি।

(১) প্রাণ–শরীরের কণ্ঠ থেকে হৃদয় পর্যন্ত যে বায়ু কাজ করে তাকে প্রথম প্রাণ বলা হয়। এই প্রাণ নাসিকাপথ, স্বরযন্ত্র, বাক-ইন্দ্রিয়, অন্ননালী, শ্বাস-তন্ত্র, ফুসফুস এবং হৃদয়কে ক্রিয়াশীল রাখে এবং শক্তি প্রদান করে।

(২) অপান–নাভির নিচ থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত যে বায়ু কাজ করে, তাকে অপান বলে। এই অপান বায়ু তলপেট থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ক্রিয়াশীল রাখে।

(৩) উদানকণ্ঠের উপর থেকে মস্তক পর্যন্ত যে বায়ু কাজ করে, তাকে উদান বলে।

কণ্ঠের উপরের অঙ্গ যথা-নেত্র, নাসিকা এবং মুখমণ্ডলকে তেজ ও আভা প্রদান করা এই বায়ুর কাজ। এছাড়া উদান বায়ু মস্তিষ্ককে ক্রিয়াশীলতা প্রদান করে।

(৪) সমান-হৃদয়ের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত শরীরে যে বায়ু কাজ করে, তাকে সমান বলে। হৃদয়ের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত যকৃৎ, অন্ত্র, প্লীহা এবং অগ্নাশয় সমেত সম্পূর্ণ পাঁচন তন্ত্রের আভ্যন্তরীণ কার্যপ্রণালীকে এই বায়ু নিয়ন্ত্রণ করে।

(৫) ব্যান–ব্যান প্রাণ সমস্ত শরীরে ব্যাপ্ত থেকে শরীরের সব গতিবিধিকে নিয়মিত এবং নিয়ন্ত্রিত করে। শরীরের সব অঙ্গ, মাংসপেশী, তন্তু, সন্ধি এবং নাড়ীর ক্রিয়াশীলতা রক্ষা করা এবং শক্তি প্রদান করাই ব্যান বায়ুর কাজ।

এই পঞ্চপ্রাণের অতিরিক্ত শরীরে পঞ্চউপপ্রাণও থাকে। যেমন–দেবদত্ত, নাগ, কৃংকল, কৃর্ম এবং ধনঞ্জয়। এই উপপ্রাণগুলি যথাক্রমে হাঁচি, চোখের পলক ফেলা, হাই তোলা, চুলকানো, হেঁচকি তোলা ইত্যাদি ক্রিয়াগুলিকে সঞ্চালিত করে।

যে পঞ্চপ্রাণ ও উপপ্রাণের কথা বলা হল, এদের কাজগুলি শরীরের কোষের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রাণায়াম অভ্যাস এইসব প্রাণেদের এবং প্রাণময় কোষগুলির শুদ্ধতা, সুস্থতা এবং নীরোগ রাখার কাজ করে। যে যোগী প্রাণের এই কাজগুলি সম্বন্ধে সম্যক অবহিত হয়ে প্রাণায়ামাভ্যাস করে, সে দেহের সমস্ত কোষগুলিকে সাধনার উপযুক্ত শুদ্ধ ও সুস্থ রাখতে সমর্থ হয়। যোগীগণ ভূতশুদ্ধি যোগের দ্বারা লিঙ্গশরীর শোধন করে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বাবা লোকনাথ নাগ উপপ্রাণ নিয়ন্ত্রণে উৎকর্ষতা লাভ করে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতে পারতেন।

ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগী তার দেহের লিঙ্গশরীর এবং নিজ পঞ্চভূত দ্বারা নির্মিত দেহকে শুদ্ধ করে থাকেন। এটি একটি অনন্য যৌগিক ক্রিয়া। মানবদেহ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চভূতের দ্বারা নির্মিত হয়েছে। এখানে

ক্ষিতি অর্থ–মাটি, পৃথিবী।

অপ অর্থ–জল

তেজ অর্থ-শক্তি, আলোক, শুক্র, রেতঃ

মরুৎ অর্থ–দেবতা,

বায়ু ব্যোম অর্থ–আকাশ, জল, নভোমণ্ডল

ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ায় মানবদেহের উপাদান এই পঞ্চভূতকে মস্তকস্থিত পরমাত্মার সঙ্গে সংযোগ করা হয়।

.

শাস্ত্রসম্মত ভূতশুদ্ধি পদ্ধতি

যোগী প্রথমে রং মন্ত্র উচ্চারণের দ্বারা তার চারিদিকে জলের ধারা দিয়ে এক বহ্নি প্রকার তৈরি করবে যেন মনে হয় সে চতুর্দিকে বহ্নিদ্বারা বেষ্টিত হয়ে বসে আছে। তারপর সে দুই হাত চিৎ করে উপর্যুপরি কোলের উপর রেখে সোহহং মন্ত্রে হৃৎপ্রদেশস্থ জীবাত্মাকে মূলাধারস্থিত কুলকুণ্ডলিনীর সঙ্গে সুষুম্নাপথে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ এবং আজ্ঞা নামক ষট্‌চক্র ভেদ করে শিরোস্থিত অধোমুখ সহস্রদল কমলের কর্ণিকামধ্যস্থ পরমাত্মাতে সংযোগ করবে। অতঃপর সেখানে দৈহিক পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, গন্ধ, রূপ, রস, স্পর্শ, শব্দ, নাসিকা, জিহ্বা, চক্ষু, ত্বক, কর্ণ, বাক্, হস্ত, পদ, পায়ু, উপস্থ, প্রকৃতি, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার–এই চতুর্বিংশতিতত্ত্বকে বিলীন ভাবনা করে অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা বাম নাসা রোধ করে যং নামক বীজ চিন্তা করে ১৬ বার বাম নাসা দিয়ে বায়ু গ্রহণ করে সমস্ত দেহ আপূরণ করতে হবে। তৎপর উভয় নাসা বন্ধ করে কুম্ভক অবস্থায় ওই যং মন্ত্রটি ৬৪বার জপ করতে করতে পাপ পুরুষের সঙ্গে নিজদেহ শোষণ হচ্ছে চিন্তা করতে হবে। তারপর ওই যং মন্ত্র ৩২ বার জপ করতে করতে দক্ষিণ নাসা দিয়ে বায়ু ত্যাগ করতে হবে। পরে রং বীজ মন্ত্র। চিন্তা করে ১১ বার জপের সঙ্গে বায়ু গ্রহণ করে দেহ আপূরণ করতে হবে এবং ৬৪ বার জপের সঙ্গে কুম্ভক মূলাধারোথিত বহ্নিদ্বারা পাপপুরুষ দগ্ধ হচ্ছে চিন্তা করে ৩২ বার জপের সঙ্গে বাম নাসা দিয়ে দগ্ধীভূত পাপপুরুষের ভস্মের সঙ্গে বায়ু পরিত্যাগ করতে হবে। এরপর ঠং চন্দ্ৰবীজ মন্ত্র চিন্তা করে ১৬ বার জপ করতে করতে বায়ুতে দেহ আপূরণ করতে এবং বং বীজমন্ত্র ৬৪ বার জপ করতে করতে কুম্ভকাবস্থায় ললাটে চন্দ্রানয়ন করতে হবে।

এরপর লং পৃথ্বীবীজ চিন্তা করে ৩২ বার জপের মাধ্যমে দেহকে সুদৃঢ় করে দক্ষিণ নাসা দিয়ে বায়ু ত্যাগ করতে হবে। অনন্তর হংসঃ এই মন্ত্রে জীবাত্মাকে বিলীন কুলকুণ্ডলিনী সহ চতুর্বিংশতি তত্ত্বকে সস্থানে স্থাপন করে নিজ শরীরকে অভীষ্ঠ দেবের সদৃশ চিন্তা করতে হবে। এই হল ভূতশুদ্ধি পদ্ধতি।

আচার্যদেব বলেন, ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ায় সফল হলে যোগীর দেহ দেবসদৃশ হয়। ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগী মন্ত্রসিদ্ধ হয় ও বিভিন্ন প্রকার বিভূতি ও যোগৈশ্বর্য লাভ করে। এই ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ার সঙ্গে কিছু অন্য ক্রিয়াকরণের মাধ্যমে যোগী ব্রহ্মদর্শনের উপযুক্ত হয়।

.

ব্ৰহ্মদর্শনের উপায় বর্ণন

গুরু ভগবান গাঙ্গুলির কাছে ষটচক্র ভেদ ও ভূতশুদ্ধি প্রক্রিয়ার কথা জেনে লোকনাথ ও বেণীমাধব চমৎকৃত হন। তারা বুঝতে পারেন মানব দেহের এই গুঢ় তত্ত্ব না জেনে প্রণবমন্ত্রে সিদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। তাদের এখন ষট্‌চক্র ভেদ করে মহাপ্রণবমন্ত্রে সিদ্ধ হতে হবে। কিন্তু ষট্‌চক্র ভেদ করতে হলে নিজের লিঙ্গশরীর ও তার পঞ্চভূত শরীরাধারকে শুদ্ধ করার জন্য ভূতশুদ্ধি যৌগিক ক্রিয়ার উৎকর্ষতা লাভ করতে হবে। এর জন্য এখানে তাদের আরো কঠোর যোগাভ্যাস করতে হবে। গুরুদেবের থেকে জেনে নিতে হবে যোগাভ্যাসের আরো কিছু গূঢ় তত্ত্ব যার দ্বারা তারা মহাপ্রণব মন্ত্রে সিদ্ধ হতে পারেন। লোকনাথ গুরুদেবের কাছে যৌগিক ক্রিয়ার আরও কিছু গূঢ় তত্ত্ব জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন যাতে তারা মহাপ্রণব মন্ত্রে সিদ্ধ হয়ে আত্মদর্শনে তথা ব্রহ্মদর্শনে সমর্থ হন।

আচার্যদেব তখন তাদের মহাপ্রণব মন্ত্রে সিদ্ধ হবার জন্য যোগাভ্যাসের কিছু প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন।

আচার্যদেব বলেন, তোমরা যোগাসনে বসে দুই অঙ্গুষ্ঠ দিয়ে দুটি কান, দুই তর্জনী দিয়ে দুই চোখ, দুই মধ্যমা দিয়ে দুই নাসারন্ধ্র আর বাকি আঙ্গুলগুলি দিয়ে মুখদ্বার দৃঢ়ভাবে রুদ্ধ করবে। তারপর আত্মা, প্রাণ ও মন এক এই চিন্তা করতে করতে একাগ্র মনে ওঁ মন্ত্র জপ করতে করতে নাসিকাদ্বয় দিয়ে বায়ুধারণ করবে এবং পরে নাসিকাদ্বয় বন্ধ করবে। তখন দেখবে তোমাদের মুখবিবর থেকে ক্রমে প্রথমে ভ্রমরের গুঞ্জনধ্বনি, পরে বংশীধ্বনি, তারপর ক্রমে বীণার ঝঙ্কার ধ্বনি, ঘন্টার ধ্বনি এবং সবশেষে জলপূর্ণ ঘন মেঘের গর্জন ধ্বনি বের হবে। অতঃপর দেহস্থিত বায়ু বার করে পুনরায় পূর্বরূপ অভ্যাস করবে। ভূতশুদ্ধির সঙ্গে এইরূপ যোগাভ্যাস করবে। তোমাদের আত্মদর্শন লাভ হবে এবং সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শন হবে। যোগের এই অবস্থায় যোগী ঈশ্বরের স্বারূপ্য লাভ করে, তখন পরমেশ্বর ও সাধকের মধ্যে নিত্যমধুর সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং সে দেবতাগণের সঙ্গে ক্রীড়া করতে সমর্থ হয়। তোমাদের নিষ্ঠার সঙ্গে যোগাভ্যাস করে এই অবস্থায় পৌঁছতে হবে। এটাই এখন তোমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। এই আলোচনা ও শিক্ষাদানের পর, শুরুদেব তার দুই শিষ্যকে নিয়ে বনমধ্যে আবার পথ চলা শুরু করেন। এরইসঙ্গে স্থলে স্থলে বিশ্রাম ও নিরন্তর যোগসাধনা চলতে থাকে।

একদিন লোকনাথ গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, গুরুদেব যোগীরা কত প্রকার সিদ্ধি লাভ করতে পারে?

আচার্যদেব লোকনাথের প্রশ্নের উদ্দেশ্য অনুধাবন করে বলেন, যোগীরা মুখ্য ও গৌণভেদে অষ্টাদশসিদ্ধি লাভ করতে পারেন।

.

অষ্টাদশসিদ্ধির ব্যাখ্যা

আচার্যদেব বললেন, যোগের অষ্টাদশসিদ্ধির মধ্যে আট প্রকার সিদ্ধি মুখ্য সিদ্ধি এবং দশ প্রকার সিদ্ধি গৌণ সিদ্ধি। মুখ্য আটপ্রকার সিদ্ধি লাভ করলে যোগী সিদ্ধ হন কিন্তু দেবস্বারূপ্য বা দেবসাযুজ্য লাভ করেন না। অষ্টাদশ সিদ্ধিলাভ করলে তবেই যোগী দেবসাযুজ্য লাভ করেন।

.

অষ্ট মুখ্য সিদ্ধি

(১) অনিমাসিদ্ধি–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগী পঞ্চভূত দেহকে অতিমাত্রায় সূক্ষ্ম করে বিচরণ করতে পারেন, তাকে অনিমাসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধিবলে যোগী নিজেকে সূক্ষ্মাবস্থায় নিয়ে যে কোনো দেবস্থানে বা যে কোনো কাজে যেতে সমর্থ হন।

আমি যখন নর্মদা পরিক্রমা করেছি, তখন জেনেছিলাম যে ওঁকারেশ্বর মন্দিরে এবং অমরকন্টকের পাতালেশ্বর মন্দিরে অনেক সিদ্ধ যোগী ও দেবতাগণ ওঁকারেশ্বর-এর আরতী দর্শন করতে সূক্ষ্মরূপে আসেন এবং পাতালেশ্বরেও সূক্ষ্ম রূপে এসে পাতালেশ্বরের পূজা করে যান। আমি উভয় জায়গায় এইরূপ সূক্ষ্ম রূপে যোগীদের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছিলাম।

(২) লঘিমাসিদ্ধি–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগী নিজের পঞ্চভূত দেহকে অতিমাত্রায় লঘু করে বিচরণ করতে পারেন, তাকে লঘিমাসিদ্ধি বলে।

(৩) মহিমাসিদ্ধি–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগী নিজের দেহকে অতিমাত্রায় বৃহৎ করতে পারেন, তাকে মহিমাসিদ্ধি বলে।

শ্রীহনুমান লঙ্কা দহনকালে রাবনের সামনে এই সিদ্ধিবলে নিজেকে অতিবৃহৎ করেছিলেন।

 (৪) প্রাপ্তিসিদ্ধি–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগী নিজের ইন্দ্রিয় শক্তির সঙ্গে সমস্ত প্রাণীদের ইন্দ্রিয় শক্তির সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারেন, তাকে প্রাপ্তিসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধিবলে যোগীরা যে কোনো হিংস্র জন্তুকে বশীভূত করতে পারেন এবং যে কোনো কীটপতঙ্গের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারেন।

 (৫) প্রাকামসিদ্ধি–যে সিদ্ধি দ্বারা যোগী ঐহিক ও পারত্রিক সকল তত্ত্ব অবগত হতে পারেন, তাকে প্রাকামসিদ্ধি বলে।

(৬) ঈশিতাসিদ্ধি–যে সিদ্ধির দ্বারা ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য ও মায়ার তত্ত্ব জানা যায়, তাকে ঈশিতাসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধির বলে যোগী ঈশ্বরের সৃষ্টির সকল গূঢ় তত্ত্ব অবগত হন।

(৭) বশিসিদ্ধি–যে সিদ্ধিদ্বারা যোগী সত্ত্বাদি গুণযুক্ত সকল প্রকার বিষয়ভোগকে বশীভূত করে তাকে জয় করতে পারেন, তাকে বশিসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধি প্রাপ্ত হলে যোগী কোনো ভোগে লিপ্ত হন না।

(৮) কামবসায়িত্বসিদ্ধি–যোগী যে সিদ্ধিবলে সকল প্রকার সুখ ও কামনা পূরণ করতে পারেন তাকে কামবসায়িত্ব সিদ্ধি বলে। এই অষ্টমুখ্য সিদ্ধিপ্রাপ্ত হলে যোগী কিছু বিশেষ গুণের অধিকারী হন এবং কিছু বিভূতি লাভ করেন। কিন্তু তার ব্রহ্মদর্শন হয় না। এই সিদ্ধিগুলির বলে যোগী কখনও দেবস্বারূপ্য লাভ করতে পারেন না। তার জন্য যোগীকে গৌণদশটি সিদ্ধিও প্রাপ্ত হতে হয়।

.

দশ প্রকার গৌণসিদ্ধি

(১) অনুৰ্মিমত্ত্বা–যোগীর দেহের যে ছয়টি দেহতরঙ্গ আছে, যথা ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শোক, মোহ, জরা ও মৃত্যু এই তরঙ্গগুলিকে জয় করাকে অনুমিত্ত্বা সিদ্ধি বলে। এর মধ্যে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা প্রাণের তরঙ্গ, শোক ও মোহ মনের তরঙ্গ এবং জরা ও মৃত্যু বাহ্যদেহের তরঙ্গ। এই তরঙ্গগুলিই যোগীর দেহকে ক্ষীণ করে।

(২) দূরশ্রবণ ও দর্শন–যে সিদ্ধির বলে যোগীর ত্রিভূবনের সকল শব্দ শ্রবণ এবং অদৃশ্যকেও দর্শন হয়, তাকে দূরশ্রবণ ও দর্শনসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধির বলে যোগী বহুদূরের যে কোনো শব্দ ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুও দর্শন করতে পারেন।

(৩) মনোজবসিদ্ধি–যে সিদ্ধির বলে যোগী মন দ্বারা কামনামাত্র যেখানে খুশি গমন করতে সমর্থ হন, তাকে মনোজবসিদ্ধি বলে।

নর্মদা পরিক্রমাকালে আমি শাণ্ডিল্যমুনির তপস্থলী গুহায় এমন একজন মুনির সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, যিনি রাত্রিকালে বিভিন্ন দেবস্থানে ভ্রমণ করতেন যদিও তার দেহ গুহাতেই অবস্থান করতো।

(৪) কামরূপসিদ্ধি–যে সিদ্ধির বলে যোগী যে কোন প্রাণী বা দেবমূর্তি ধারণ করতে পারেন, তাকে কামরূপ সিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধিবলে যোগী যে দেবতার ধ্যান অন্তরে করেন, তারই স্বারূপ্য লাভ করতে পারেন।

(৫) পরকায় প্রবেশন–যে সিদ্ধির বলে যোগী নিজ ইচ্ছামতো অন্যের দেহে সূক্ষ্মরূপে প্রবেশ করতে পারেন, তাকে পরকায় প্রবেশন বলে। এই সিদ্ধির বলে যোগী নিজ ভক্তের মধ্যে প্রবেশ করে তাকে চালনা করতে পারেন।

(৬) ইচ্ছামৃত্যু–যে সিদ্ধির বলে যোগী নিজের ইচ্ছায় ব্রহ্মলীণ হতে পারেন বা নিজের মৃত্যুর সময় নিজেই ঠিক করতে পারেন, তাকেই ইচ্ছামৃত্যুসিদ্ধি বলে।

নর্মদা পরিক্রমাকালে নর্মদার দক্ষিণ তটে ব্রহ্মাণ ঘাট তীর্থস্থানে আমি বিমলা বাঈ নামক এক মহাযোগিনীর সমাধিস্থলে যাই, যিনি ৭ এপ্রিল ২০০৬ সালে কালেক্টর এবং সকল ভক্তের সামনে মা নর্মদা মন্দিরে ব্রহ্মলীণ হয়েছিলেন। তাঁর এই ইচ্ছামৃত্যুর কথা তিনি সবাইকে অনেক আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন।

(৭) যথাসংকল্পসিদ্ধি-যে সিদ্ধির বলে যোগী কিছু সংকল্প করা মাত্রই তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়, তাকে যথাসংকল্পসিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধিবলে যোগী মনে যা কিছু সংকল্প করেন, তাই ঘটে।

 (৮) দেবগণের সঙ্গে ক্রীড়াকরণ সিদ্ধি–এই সিদ্ধির বলে যোগী নিত্য নিজ ইচ্ছানুযায়ী দেবগণের সঙ্গে ক্রীড়া করতে সমর্থ হন। এই সিদ্ধি প্রাপ্ত হলে যোগী দেবসাযুজ্য লাভ করেন।

(৯) অপ্রতিহতা আজ্ঞা–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগীর কোনো আজ্ঞাকে কারও, এমনকি প্রকৃতিরও লঙ্ঘন করার ক্ষমতা থাকে না, তাকে অপ্রতিহতা আজ্ঞা সিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধির বলে যোগী প্রকৃতিকে বশ করতে সমর্থ হন।

(১০) অপ্রতিহতা গতি–যে সিদ্ধির দ্বারা যোগী এমন গতি প্রাপ্ত হন, যা কেউ রোধ করতে পারে না, তাকে অপ্রতিহতা গতি সিদ্ধি বলে।

এই অষ্টাদশ সিদ্ধি যোগীর অন্তরঙ্গ সাধনের ধারণা স্তরে বা অবস্থাতে উদয় হয় ও সিদ্ধি প্রাপ্তি হয়। যোগী সাধনার বিভিন্ন স্তরে ও অবস্থায় প্রথমে আটটি মুখ্য সিদ্ধি প্রাপ্ত হন এবং পরে সাধনার অত্যুচ্চ স্তরে ক্রমে ক্রমে দশটি গৌণসিদ্ধি প্রাপ্ত হন। যোগীগণ সাধনার উচ্চমার্গে যখন ঈশ্বরকে অন্তরে ধারণ করেন, তখন এই অষ্টাদশ সিদ্ধি ভিন্ন আরও পাঁচটি অনন্য সিদ্ধি লাভ করে থাকেন। সেগুলি হল

(১) ত্রিকালজ্ঞতা–যে সিদ্ধিবলে যোগী নিজের ও যে কোনো ব্যক্তির ভূত বর্তমান-ভবিষ্যৎ –এই তিনকাল সম্বন্ধে অবহিত হতে পারেন, তাঁকে ত্রিকালজ্ঞতা বলে।

(২) অদ্বন্দ্বত্ব–যে সিদ্ধিবলে যোগী শীত-গ্রীষ্ম আদি ঋতুজনিত সব অবস্থা সহ্য করতে সক্ষম হন, তাকে অদ্বন্দ্বত্ব বলে।

(৩) পরচিত্তাভিজ্ঞতা–যে সিদ্ধিবলে যোগী অন্যের মনের কথা জানতে পারেন, তাকে পরচিত্তাভিজ্ঞতা সিদ্ধি বলে।

(৪) স্তম্ভনকরণ–যে সিদ্ধিবলে যোগী অগ্নি, জল, সূর্য ও বিষাদিকে নিষ্ক্রিয় বা শক্তিহীন করে দিতে পারেন, তাকে স্তম্ভনকরণ সিদ্ধি বলে।

(৫) অপরাজেয়–যে সিদ্ধির বলে যোগীকে কেউ অভীভূত করতে সমর্থ হয় না, তাকে অপরাজেয় সিদ্ধি বলে।

যে যোগী এই অষ্টাদশ এবং বিশেষ অন্য পাঁচটি সিদ্ধি সাধনায় লাভ করেন, তার বহ্মদর্শন হয় এবং তিনি দেবস্বারূপ্য লাভ করেন।

আচার্যদেব বলেন, লোকনাথ ও বেণীমাধব তোমরা ৪০ বৎসর ধরে তপস্যা করে যোগসাধনার অনেক গূঢ় রহস্য করায়ত্ত করেছ। নিজেদের ইন্দ্রিয়সকল জয় করতে পেরেছ, আসক্তি ও ভোগ বাসনাকে জয় করেছ এবং নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের বায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছ। এখন তোমাদের অষ্টাঙ্গ যোগের অন্তরঙ্গ সাধন প্রক্রিয়াগুলি শিখতে হবে। আমি তোমাদের যে ২৩টি সিদ্ধির কথা বললাম, তা একমাত্র অন্তরঙ্গ সাধনস্তরেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। তোমরা বহিরঙ্গ সাধন প্রক্রিয়ায় উৎকর্ষ লাভ করে এখন অন্তরঙ্গ সাধন প্রক্রিয়ার অভ্যাস করবে। হিমালয়ে পৌঁছে তোমাদের অন্তরঙ্গ সাধনে ডুবে যেতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই ২৩টি সিদ্ধি দুর্লভ হলেও, তোমরা তা প্রাপ্ত করতে পারবে। এইভাবে বনপথে এগোতে এগোতে চলতে থাকে যোগশিক্ষা এবং যোগাভ্যাস। বনের মধ্যে কোনো কোনো জায়গায় কিছুদিন অবস্থান করেন, কঠোর যোগ সাধনায় শিষ্যদের নিয়োজিত করেন, আবার এগিয়ে চলেন হিমালয়ের পথে। আচার্যদেব মনে করেন, এখন শিষ্যদের অন্তরঙ্গ যোগানুষ্ঠানের তিনটি অঙ্গ শেখানো প্রয়োজন। কেননা অন্তরঙ্গ যোগ সাধনাই তাদের সাধনার আরও উচ্চমার্গে নিয়ে যাবে। সেজন্য তিনি শিষ্যদের কাছে অন্তরঙ্গ যোগানুষ্ঠান প্রক্রিয়াগুলি ব্যাখ্যা করেন।

.

অষ্টাঙ্গ যোগের অন্তরঙ্গ যোগসাধনা

আচার্যদেব বলেন, অষ্টাঙ্গ যোগের পাঁচটি অঙ্গের কথা তোমাদের আগে বলেছি। এখন তোমাদের শিখতে হবে অষ্টাঙ্গ যোগের তিনটি অন্তরঙ্গ যোগানুষ্ঠান যা তোমাদের পৌঁছে দেবে সাধনার আরও উচ্চস্তরে। এই তিনটি যোগানুষ্ঠান হল -ধারণা, ধ্যান ও সমাধি।

ধারণা–দেহের নাভিচক্র, হৃদয়পুণ্ডরীক, মূর্ধা, মধ্য, নাসিকা, ব্রহ্মরন্ধ্র ইত্যাদির মধ্যে যে কোনো একস্থানে মনকে একাগ্র করাকে ধারণা বলে। প্রত্যাহার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যখন যোগীর ইন্দ্রিয়সকল ও মন দেহের এইসকল স্থানের কোনো এক স্থানে স্থির হয়, তখন যোগীর সেই অবস্থার নাম ধারণা। এইসময় যোগী মনকে স্থূল বিষয় থেকে সরিয়ে আত্মা বা পরমাত্মাতে কেন্দ্রীভূত করেন। যোগীর মধ্যে যখন ধারণার উদয় হয়, তখনই যোগী ধ্যানাবস্থা প্রাপ্ত হন। সেজন্য ধারণাকে ধ্যানের প্রথমাবস্থা বলা হয়।

ধ্যান-ধ্যান অর্থ হল ধারণাবস্থা প্রাপ্ত হয়ে নাভিচক্র, হৃদয়পুণ্ডরীক, নাসিকাগ্র, মধ্য, মূর্ধা অথবা ব্ৰহ্মরন্ধ্রে পরমেশ্বরের ধ্যেয়রূপে মগ্ন হয়ে থাকা। প্রথমে ভ্রমধ্য এবং পরে ব্রহ্মরন্ধ্রে ধ্যেয় রূপে মগ্ন থাকাই শ্রেয়। এই ধ্যানাভ্যাসের সময় দেহের সকল ইন্দ্রিয় ও মনকে অবশ্যই অন্তর্মুখী করতে হবে এবং বহিরঙ্গ যোগানুষ্ঠানের পালনপূর্বক ওঁ-কার মন্ত্র জপ করতে হবে।

সমাধি-সমাধি হল সাধকের সেই অবস্থা যখন সাধক ধ্যানাবস্থায় পরমেশ্বরের ধ্যেয় রূপের সঙ্গে নিজের স্বরূপকে একাত্ম করে নিজেকে তার মধ্যে লীন করে দিতে পারেন। এই অবস্থায় সাধক নিজের অস্তিত্ব ভুলে যান এবং এক দিব্য আনন্দে ভাসতে থাকেন।

সমাধিবস্থায় সাধকের জীবাত্মার সঙ্গে মস্তকস্থিত পরমাত্মার মিলন ঘটে এবং তাঁর আজ্ঞাচক্র হতে সহস্রার পর্যন্ত এক ব্রহ্মতেজরাশি বিরাজ করে। সেই অবস্থায় সাধকের দিন-রাত্রি কিছুরই জ্ঞান থাকে না কেননা তিনি বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েন। সমাধিবস্থায় সাধকের দেহ এইসব জগতে থাকলেও তার আত্মা ঈশ্বর জগতে ভ্রমণ করে। তাকে ঘিরে রাখে এক পরম আনন্দবিভূতি।

অন্তরঙ্গ সাধনের অঙ্গগুলি ও সাধন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে আচার্যদেব শিষ্যদের বললেন, তোমরা এখন থেকে বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ সাধন পদ্ধতিগুলি কঠোরভাবে অভ্যাস করো। আমরা এখন বিন্ধ্যপর্বত হয়ে হিমালয়ের পথে যাত্রা করবো।

বিন্ধ্যপর্বত হয়ে হিমালয়ে যাবার পথে মেকল পর্বতশ্রেণীর নিচে ছিল সিদ্ধিদাত্রী নর্মদা। এই নর্মদার জন্মস্থল অমরকন্টক সমস্ত ঋষি ও দেবতাদের প্রিয় তপস্যাস্থল। অমরকন্টকে নর্মদা তটেই আবার কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হলেন লোকনাথ।

.

সিদ্ধিদাত্রী নর্মদা তটে তপস্যা

গহন বনের মধ্য দিয়ে পথ চলতে চলতে কত পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে লোকনাথ এসে পৌঁছোন অমরকন্টকের উপকণ্ঠে নর্মদার দক্ষিণতটে। এই পর্বতকে বলা হতো মেকল পর্বতশ্রেণী। অমরকন্টক পরিবেষ্টিত হয়ে আছে সবুজ ঘন বন ও হিংস্র জন্তু জানোয়ার দ্বারা, তথাপি এই পর্বত ঋষি সংঘ সেবিত। অমরকন্টক মা নর্মদার জন্মস্থান। অমরকন্টকের রেবাকুণ্ড তার উৎসস্থল। হরপার্বতী সমেত সমস্ত দেবতাদের প্রিয় তপস্থলী এই অমরকন্টক। মহামুনি মার্কন্ডেয় এইখানে তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করে শিবের থেকে সপ্তকল্পান্ত জীবী থাকার বর পেয়েছিলেন। ভৃগু আদি সব ঋষি এবং তৈলঙ্গস্বামীও এখানে তপস্যা করেছেন।

পুরাণে কথিত আছে মাতা নর্মদা পিতা দেবাদিদেব মহাদেবের থেকে এই বর প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, নর্মদার উভয়তটে যে সকল মুনি-ঋষি তপস্যা করবেন, তারা অবশ্যই সিদ্ধিপ্রাপ্ত হবেন। পুরাণে বর্ণিত সমস্ত মুনি-ঋষিরা এমনকি দেবতারা পর্যন্ত কোনো না কোনো সময় নর্মদার কোনো তটে তপস্যা করেছেন। বাবা লোকনাথ নর্মদার দক্ষিণ তটে পাহাড়ের উত্রাইয়ে এসে পৌঁছেছেন। চারিদিকে পাহাড়, সবুজ বনানীতে ঘেরা। সামনে মাতা নর্মদা বহমান। তিনি এখানে একটি শিবলিঙ্গ দেখে সেখানেই তপস্যায় বসলেন। একদিন তিনি দেখেন, একটি কালো গাভী নর্মদার জলে নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন সেই গাভীটি জল থেকে উঠে এল, তার গায়ের রং সাদা। তাঁর কাছে এটি বেশ রহস্যজনক মনে হল। তিনি ধ্যানে বসে জানতে পারলেন যে, মা গঙ্গা রোজ এখানে এসে কালো গাভীর রূপ নিয়ে নমর্দায় স্নান করে যান। যে পথে ওই গাভীটি নর্মদায় নামে, সেখানে একটি জলধারা বয়ে গিয়ে নর্মদায় মিশেছে। এই জলধারাকে গঙ্গা বলে। যে স্থানে সেই গাভীটি স্নান করে, তাকে কপিলা সঙ্গম বলা হয়।

আমি তপস্যারূপে যখন নর্মদা পরিক্রমা করি, কপিলা সঙ্গমে পৌঁছে এই স্থানটি দর্শন করি ও এই কথা লোকমুখে শুনতে পাই। বাবা লোকনাথ পূজিত সেই শিবলিঙ্গ এখনও জঙ্গলের মধ্যে আছে। সেই জঙ্গলে এখন আদিবাসীদের বাস। তারাই এই স্থানকে পরিষ্কার করে রাখে ও শিবলিঙ্গের পূজা করে। স্থানটি বন আধিকারিকের আওতায় থাকায় এখানে কোনো মন্দির গড়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু বাবা লোকনাথের তপস্যাস্থলের চিহ্নরূপে আদিবাসীরা সেটি সংরক্ষণ করে রেখেছে। সেই স্থল থেকে এখনও একটি স্থূল জলধারা নমর্দায় এসে নিয়ত মিশছে। আমি ও আমার স্ত্রীর সৌভাগ্য হয়েছিল এই কপিলা সঙ্গম স্পর্শ করার।

নর্মদা পরিক্রমার সময় উত্তর তটে ডিনডোরির কাছে আর একটি ঘাটের সন্ধান পেয়েছিলাম যেখানে বাবা লোকনাথ তপস্যা করেছিলেন। তার নাম গঙ্গাবাহ ঘাট। পুরাণে রেবাখণ্ডে মার্কন্ডেয় মুনির কথা থেকে জানা যায় যে, আদিকালে মহাপুণ্যা গঙ্গাদেবী নর্মদার উত্তর তটে এইস্থানে নারায়ণের উদ্দেশ্যে কঠিন তপস্যা করেছিলেন। তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে নারায়ণ গঙ্গাদেবীকে দর্শন দিয়ে বলেছিলেন, তুমি আমার পাদপদ্ম হতে উদ্ভূতা। তোমার তপস্যায় আমি তুষ্ট। বলল, তোমার জন্য আমি কি করতে পারি? গঙ্গাদেবী তার উত্তরে বলেন–ভগীরথের তপস্যার প্রভাবে আমি আপনার এবং গঙ্গাধরের কথায় এই মর্ত্যলোকে অবতীর্ণ হয়েছি, আমাকে আপনার পাদোদ্ভূতা জেনে আমার জলে ব্রহ্মঘাতী, গুরু নিন্দুক, পিতৃমাতৃত্যাগী, অগম্যাগামী, মিথ্যাচারী, বিশ্বাসঘাতক, কৃতঘ্ন, ব্যাভিচারী প্রভৃতি সকল রকমের পাপিষ্ঠগণ নিত্য অবগাহন করে পাপমুক্ত হচ্ছে। আমি তাদের পাপরূপ ক্ষারে নিত্য দগ্ধ হচ্ছি। যাতে আমি তাদের পাপের জ্বালা এবং স্পর্শ থেকে রক্ষা পাই তার উপায় বলুন। নারায়ণ তখন বললেন–তুমি এই স্থানে নিত্য নর্মদা জলে প্রবেশ করবে। আমি এবং মহেশ্বর সতত এখানে বিরাজ করবো। লোককৃত দুঃসহ পাপের জ্বালা এইখানে স্নান করলে দূর হবে। আজ হতে এই তীর্থ গঙ্গাবাহ তীর্থ নামে প্রসিদ্ধ হল। ব্রহ্মাদি দেবগণ এবং ঋষিগণ এই তীর্থের সেবা করবেন। তদবধি নর্মদার উত্তর তটের এই ঘাট গঙ্গাবাহ ঘাট নামে পরিচিত।

বাবা লোকনাথ নর্মদার দক্ষিণতট থেকে উত্তরতটে এসে এই গঙ্গাবাহ ঘাটে তপস্যা করেছিলেন। একদিন ধ্যানদৃষ্টিতে তিনি দেখেছিলেন, মা গঙ্গা এই ঘাটে এসে এক কৃষ্ণগাভীর রূপ ধারণ করে নর্মদার জলে স্নান করলেন এবং অতঃপর শ্বেতবর্ণ ধারণ করে জল হতে নির্গত হয়ে মহারণ্যের মধ্যে অন্তর্হিত হলেন। এই ঘাট সংলগ্ন বনে বাবা লোকনাথ কিছুদিন তপস্যা করেছিলেন।

কপিলা সঙ্গম স্থানে নর্মদা তটে তপস্যা করার পর গঙ্গাবাহ তীর্থে যাবার পূর্বে মেকল পর্বতশ্রেণী দিয়ে বাবা লোকনাথ নর্মদা তটের দুধধারায় পৌঁছান। দুধধারার জলপ্রপাতের পাশে দুর্বাসা মুনির গুহা অবস্থিত, যেখানে দুর্বাসা মুনি দীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন। নর্মদা পরিক্রমার সময় জানতে পেরেছিলাম এই গুহায় সাধারণ ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারে না। এখনও এই গুহায় সূক্ষ্মরূপে এসে মুনি-ঋষিরা তপস্যা করেন। জনশ্রুতি এই যে বাবা লোকনাথ এই গুহায় এসে দুর্বাসা মুনি পূজিত শিবলিঙ্গের সামনে বসে তপস্যা করেছিলেন। এই গুহাকে অতি পবিত্র তপোস্থলী বলে মানা হয়। জনশ্রুতি আছে যে কোনো পরিক্রমাকারী এই দুধধারায় স্নান করে দুর্বাসা মুনির গুহায় ধ্যান জপ করে আবার দুধধারার জলে মা নর্মদার স্মরণ করলে, জলে শিবলিঙ্গ ভেসে আসে। কোনো কোনো পরিক্রমাকারী এইরূপ শিবলিঙ্গ প্রাপ্ত হয়েছেন এবং কোনো কোনো যোগী এই দুর্বাসা মুনির গুহায় ধ্যান করতে যেয়ে সূক্ষ্ম আত্মার উপস্থিতি টের পেয়েছেন। এই স্থান এক অতি জাগ্রত তপোস্থলী। দুধধারা স্থানটি কপিলধারা থেকে ১ কিঃমিঃ বনপথে এগিয়ে গেলে বাঁ হাতে পড়ে। ডানদিকে ও বাঁদিকে সবুজ মেকল পর্বতশ্রেণী এবং তার মধ্য দিয়ে নর্মদা প্রবাহিত।

এইভাবে সিদ্ধিদাত্রী নর্মদার উভয় তটে তপস্যা করে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি শিষ্যদের নিয়ে এগিয়ে চলেন হিমালয়ের পথে। এই দীর্ঘ পথে চলতে থাকে শিষ্যদের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ যোগসাধনায় উৎকর্ষ বৃদ্ধির প্রয়াস, যে প্রয়াসে তারা সফল হয়েছিলেন। আচার্যদেব জানতেন যে হঠযোগের সাধনায় পূর্ণ উৎকর্ষ লাভ না করতে পারলে ব্রহ্মদর্শনের জন্য সাধনার অন্তিম চরণে পৌঁছানো যাবে না। হিমালয়ে পৌঁছবার পূর্বেই শিষ্যদের হঠযোগের উৎকর্ষতায় পূর্ণ হতে হবে।

একদিন লোকনাথ গুরু ভগবান গাঙ্গুলিকে বলেন, গুরুদেব আমি হঠযোগের সাধনায় কি এখনও সফল হইনি? গুরুদেব তখন বলেন, তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে। লোকনাথ রাজি হয়ে যান।

আচার্যদেব তখন লোকনাথ ও বেণীমাধবকে বলেন জঙ্গল থেকে কিছু শুকনো কাঠ নিয়ে আসতে। দুই শিষ্য বনের থেকে শুকনো ডালপালা নিয়ে এসে গুরুদেবের সামনে বসেন। গুরুদেব তখন লোকনাথকে বলেন হাঁটুদ্বয় সোজা করে সামনের দিকে রেখে তার নিচে কাঠগুলি রাখতে। তারপর তিনি লোকনাথের দুই হাঁটুর মধ্যখানে একটি মাটির হাঁড়িতে দুধ ও চাল দিয়ে বসিয়ে দেন। তারপর বলেন, তুমি যদি হঠযোগসিদ্ধ হয়ে থাক, তবে এই কাঠে আগুন জ্বেলে হাঁড়িতে মিষ্টান্ন রান্না করে আমাকে খাওয়াও। একজন হটযোগসিদ্ধ যোগীকে অগ্নি স্পর্শ বা দহন করতে পারে না। লোকনাথ গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে একমনে ধ্যানাবিষ্ট হলেন এবং তার দুই হাঁটুর মাঝের পাত্রে মিষ্টান্ন রান্না হতে থাকল। তার হাঁটুর নিচে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত থাকা সত্ত্বেও সেই অগ্নি তার দেহকে দহন করতে পারল না। লোকনাথের এই সিদ্ধি অবস্থায় আচার্যদেব অতিশয় প্রীত হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর শিষ্যদ্বয় হিমালয়ে গিয়ে ব্রহ্মেপসনায় নিজেদের নিয়োগ করতে সক্ষম হবে। তিনি তো শিষ্যদের যোগবিভূতি অর্জন করার জন্য এই পথে আসেন নি। পরমেশ্বরের নির্দেশে তাকে এই দুই শিষ্যকে যোগের এমন স্তরে উন্নীত করতে হবে যাতে তারা দেসাজুয্য লাভ করে মানব কল্যাণে ব্রতী হতে পারেন। তাঁর শিষ্যদের ঈশ্বরকোটির যযাগী হতে হবে। লোকনাথ ও বেণীমাধবের যোগারাধনার প্রগতিতে আচার্যদেব তুষ্ট। তার অভিষ্ট সফলের জন্য এখন বনপথে পাড়ি দিয়ে তাকে হিমালয়ের উচ্চশিখরে পৌঁছতে হবে। যেখানে পার হতে হবে তাঁর শিষ্যদের সাধনার চরম ও অন্তিম লগ্ন। সাধনার চরম লক্ষ্য ব্রহ্মদর্শন ও ব্রহ্মজ্ঞান লাভ। নিরন্তর যোগসাধনা করতে করতে গুরু-শিষ্য দীর্ঘ বনপথ অতিক্রম করেন সেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছবার আশায়।