জন্ম ও বাল্যকাল

দ্বিতীয় অধ্যায়-  জন্ম ও বাল্যকাল

জন্মস্থান বিবাদ

বাবা লোকনাথের জন্মস্থান নিয়ে অনেকদিন থেকেই বিবাদ চলছে। চাকলার মন্দির কর্তৃপক্ষ বলেন জন্মস্থান চাকলায়। কচুয়ার মন্দির কর্তৃপক্ষ বলেন জন্মস্থান কচুয়াতে। এই বিষয়ে কোনো বিবাদে অংশগ্রহণ না করে কিছু ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে আমি বাবার জন্মস্থান চিহ্নিত করার প্রয়াস করছি।

বাবা লোকনাথের জন্ম হয়েছিল ইংরাজি ১৭৩০ সালে। ওই সময়ের নবাবী আমলে অখণ্ড বঙ্গদেশের রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য বঙ্গদেশকে ১৩টি চাকলা ও ১৬৬০টি পরগণায় বিভক্ত করা হয়েছিল। চাক’ শব্দের একটি অর্থ হল ‘বিভাগ’। তখন বারাসত নামে কোনো জেলা ছিল না। বারাসত জেলার সৃষ্টি হয় ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে। অখণ্ড বাংলাকে যে ১৩টি চাকলা ও ১৬৬০টি পরগণায় বিভক্ত করা হয়েছিল, তার মধ্যে একটি চাকলা অর্থাৎ বিভাগের নাম ছিল যশোহর। বারাসত, বসিরহাট এবং বনগ্রাম অঞ্চলগুলি এই চাকলার অন্তর্গত ছিল। বাবা লোকনাথের জন্মস্থান রূপে যে চাকলা নামের উল্লেখ করা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে কোনো গ্রামের নাম নয়। এখানে চাকলা অর্থ বিভাগ। সেই অর্থে মনে করা যেতে পারে যে, বাবার জন্ম তৎকালীন যশোহর চাকলায় হয়েছিল। সেই যশোহর চাকলারই অন্তর্গত কাকড়া কচুয়া নামে এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে লোকনাথ বাবার জন্ম হয়। বর্তমানে এই কচুয়া গ্রাম বসিরহাটের অন্তর্গত দেগঙ্গা থানার অধীন স্বরূপনগরের নিকট অবস্থিত। বর্তমান জেলা বিভাগ অনুযায়ী এই স্থান উত্তর চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত। পরবর্তীকালে দেগঙ্গা থানার কাছে চাকলা নামে একটি গ্রামেরও পত্তন হয়।

বাবার ভক্ত গবেষকদের জন্য এই সম্পর্কে আরও কিছু তথ্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। লোকনাথ বাবার জীবনী গ্রন্থের মধ্যে সর্বপ্রাচীন গ্রন্থটির নাম। সিদ্ধজীবনী। এই গ্রন্থের লেখক বাবার অতি প্রিয় শিষ্য ব্রহ্মানন্দ ভারতী। লোকনাথ বাবা নিজ মুখে ব্রহ্মানন্দ ভারতাঁকে বলেছিলেন যে, তাঁর জন্ম কচুয়া গ্রামে হয়েছে। ব্রহ্মানন্দ ভারতী বাবার কাছে জেনে নিজে কাকড়া কচুয়া গ্রাম পরিদর্শনে ১২৯৬ মতান্তরে, ১২৯৭ সালের বৈশাখ মাসে এসেছিলেন। এবং সেখানে বিস্তর খোঁজের পর রামকানাই ঘোষালের বাস্তুভিটার সন্ধান পেয়েছিলেন। সেখানে তখন লোকনাথ বাবার ভাইয়েদের বংশধরদেরও সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। যদিও তারা পরবর্তীকালে জীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। ওই সময় ব্রহ্মানন্দ ভারতী লক্ষ্য করেছিলেন যে, ওই গ্রামের লোকেরা তখন বাবা লোকনাথের বারদীতে অবস্থান সম্বন্ধে বিশেষভাবে অবগত ছিলেন না। ব্রহ্মানন্দ ভারতী এই কাঁকড়া কচুয়া গ্রামেই সন্ধান পেয়েছিলেন বাবার সতীর্থ বাল্যবন্ধু বেনীমাধবের ভাই হরিমাধব ও নীলমাধবের বংশধরদের। কথিত আছে যে বেণীমাধবের ভিটায় তাঁর ঘরখানির এখনও অস্তিত্ব আছে এবং ভক্তগণ সেখানে গেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এই গ্রামেই তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন বাবার গুরু আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির বংশধরদের, যাঁরা অনেক পরে সেখানে বসতি করেন। ভগবান গাঙ্গুলির পুত্র ও পরবর্তী বংশধরেরা জীবিকার প্রয়োজনে গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। পরে আবার সেখানে এসে কেউ কেউ বসতি করেন।

এই সমস্ত তথ্য-প্রমাণ ভক্তদের মনে এই বিশ্বাসের উদ্রেক করে যে বাবা লোকনাথের প্রকৃত জন্মস্থান ছিল কাকড়া কচুয়া গ্রাম।

বাবা লোকনাথ কোথায় জন্মেছিলেন সেটা ঐতিহাসিক ও গবেষকদের গবেষণার বিষয়। ভক্তদের কাছে জানার বিষয় হল বাবা লোকনাথ কোন্ শক্তিবলে ব্রহ্মজ্ঞানী ও ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষ হয়েছিলেন এবং কিভাবে তিনি সমস্ত ভক্তের হৃদয়ে বিরাজ করছেন। তিনি কচুয়াতে যে রকম বিরাজ করছেন, চাকলা, বারদী এবং এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র একইভাবে বিরাজ করছেন। সেজন্য জন্মস্থান বিবাদে না গিয়ে আমরা সেই মহান ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষকে আমাদের হৃদয়ে কিভাবে খুঁজবো, সেই প্রয়াসে ব্রতী হই।

.

লোকনাথের জন্ম

কাঁকড়া কচুয়া গ্রাম বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত একটি কৃষিপ্রধান গ্রাম ছিল। চাষবাস করাই ছিল এই গ্রামের প্রজাদের পেশা। এই গ্রামে রামকানাই ঘোষাল নামে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল কমলাদেবী। যে সময়ের কথা আমরা আলোচনা করছি, সেই সময়টা ছিল নবাবী আমল। সেই সময় রাজস্ব আদায়ের জন্য নবাবের লোকজন এবং জমিদারগণ প্রজাদের উপর প্রভূত অত্যাচার করতো। রামকানাই ঘোষাল ছিলেন একজন সরল প্রকৃতির ব্রাহ্মণ। যার বিষয়বুদ্ধি ছিল কাঁচা। তিনি শাস্ত্রপাঠ ও পূজার্চনাতেই দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতেন। বিষয় আলোচনার থেকে ধর্মালোচনায় তার নিষ্ঠা ছিল বেশি। বলাবাহুল্য এই জন্যই সংসারের অভাব অনটনের প্রতি তার ভ্রূক্ষেপ ছিল কম। তাঁর স্ত্রী কমলাদেবীও ছিলেন ধর্মপ্রাণা। তাঁরও বিষয় সম্পত্তির উপর টান ছিল না। এইভাবে অস্বচ্ছল সংসারে দেবার্চনাতেই স্বামী-স্ত্রী বিভোর থাকতেন। রামকানাই ঘোষালের কোনো পুত্র ছিল না। তিনি চিন্তা করতেন কিভাবে তার পিতৃকূল উদ্ধার হবে। তিনি মনে মনে ভাবতেন, যে একজন বৈদিক সন্ন্যাসী অতীত ষাটকুল ও ভবিষ্যতের ষাটকুল উদ্ধার করতে পারেন। যদি তাঁর এক পুত্র সন্তান হতো এবং সে বৈদিক সন্ন্যাসী হতো, তবে ঘোষাল পরিবারের অতীত ষাটকুল এবং ভবিষ্যৎ ষাটকুল উদ্ধার হয়ে যেত। এই চিন্তাকে তিনি মনের মধ্যে গোপনে পোষণ করতেন কেননা তখনও তার কোনো পুত্রসন্তান হয়নি।

কিছুকাল পরে কমলাদেবী প্রথম পুত্রসন্তান প্রসব করলেন। রামকানাইয়ের মন আনন্দে নেচে উঠলো। এতদিনে বোধহয় তার স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। তিনি যথাসময়ে কমলাদেবীকে তার ইচ্ছাপূরণের কথা বলতে কমলাদেবীর চোখ জলে ভরে এলো। বিষণ্ণ মুখে ছলছল চোখে তিনি স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। রামকানাই বুঝলেন, প্রথম পুত্র সন্তানের মায়া ত্যাগ করতে তাঁর স্ত্রী সমর্থ নয়। তিনি আর পীড়াপীড়ি করলেন না।

কিছুকাল পর কমলাদেবী ‘দ্বিতীয়বার গর্ভবতী হলেন। রামকানাই এবার আশান্বিত হলেন যে, এখন তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে। যথাসময়ে কমলাদেবী দ্বিতীয় পুত্র প্রসব করলেন। রামকানাই স্ত্রীর কাছে তার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতে স্ত্রী এবারও কেঁদে আকুল হলেন এবং স্বামীর প্রস্তাবে ঘোরতর আপত্তি করলেন। রামকানাই এবারও ব্যর্থ হলেন কিন্তু মন থেকে তার আকাঙ্ক্ষা মুছে ফেললেন না। দুই পুত্র নিয়ে রামকানাই সংসার জীবনে এগিয়ে চলেছেন কিন্তু তার মন অতৃপ্ত থেকে গেছে। আশায় আছেন কবে তার তৃতীয় সন্তান জন্ম নেবে। কিছু সময় গত হলে কমলাদেবী তার তৃতীয় পুত্রের জন্ম দিলেন। রামকানাই এগিয়ে এলেন তার অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে। কিন্তু মায়ের মন এবারও সায় দিল না। চোখের জলে স্বামীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি। রামকানাই আবারও আশাহত হলেন। আর বুঝি তার বংশ উদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল না। কিন্তু ধর্মনিষ্ঠ রামকানাই মন থেকে তার আকাঙ্ক্ষাকে মুছে ফেললেন না বরং নতুনভাবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন।

এরপর ঘটল এক অলৌকিক কাণ্ড। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যেই রামকানাই স্বপ্নে দেখলেন এক দিব্যকান্তি জ্যোতির্ময় পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার অঙ্গ-বিচ্ছুরিত জ্যোতিতে রামকানাইয়ের অন্ধকার ঘর আলোকিত। রামকানাই ঘুমের মধ্যে তার বন্দনা করতে লাগলেন। সেই দিব্যপুরুষ রামকানাইকে বললেন, তোমার ভক্তিতে আমি তুষ্ট। তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। আমি তোমার পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবো। এই কথা বলে সেই দিব্যপুরুষ অন্তর্হিত হয়ে গেলেন। রামকানাইয়ের নিদ্রাভঙ্গ হল। তিনি জেগে উঠে আর সেই দিব্যজ্যোতি পুরুষকে দেখতে পেলেন না। কিন্তু তার মন এক অপার আনন্দে ভরে গেল। এবার নিশ্চয়ই তার মনের বাসনা পূর্ণ হবে। এই স্বপ্নের কথা তিনি সবার কাছে গোপন রাখলেন।

এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই আর এক অলৌকিক ঘটনা ঘটলো কমলাদেবীর জীবনে। একদিন সন্ধ্যাবেলায় কমলাদেবী গৃহদেবতা শিবলিঙ্গের স্বায়ংকালীন ভোগারতির জোগাড় করছিলেন। অন্য কেউ সেখানে উপস্থিত ছিল না। হঠাৎ তার সামনে শিবলিঙ্গ থেকে এক দিব্যজ্যোতি বার হয়ে তার শরীরে প্রবেশ করলো। কমলাদেবী সেই দিব্যজ্যোতির তাপে জ্ঞান হারিয়ে শিবলিঙ্গের সামনে লুটিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলে তিনি দেখেন তিনি স্বামীর কাছে শুয়ে আছেন। তখন তিনি স্বামীকে সেই দিব্যজ্যোতির কথা বলেন। রামকানাইও তখন তার স্ত্রীকে স্বপ্নে সেই দিব্যপুরুষ দর্শনের কথা বলেন। দুজনেই এবার প্রসন্ন হন এই ভেবে যে তাদের মনোবাসনা এবার পরমেশ্বরের আশীর্বাদে পূর্ণ হতে চলেছে।

এই ঘটনার পর কমলাদেবী আবার সন্তান সম্ভবা হলেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বুঝতে পারলেন যে, এবার তাঁদের ঘরে স্বয়ং মহেশ্বর পুত্ররূপে অবতীর্ণ হচ্ছেন। তারা সব সময় এক অনাবিল আনন্দ-সাগরে ভাসতে লাগলেন। কালে কালে কমলাদেবীর শরীরে এক দিব্য দীপ্তি ফুটে উঠলো। তাঁর শরীরে দেখা যেতে লাগলো বিভিন্ন দিব্য লক্ষণ। চোখ বন্ধ করলেই কমলাদেবীর দিব্যদর্শন হয়। একদিন রাতে ঘরের মেঝেতে শুয়ে দেবাদিদেব মহাদেবকে দর্শন করলেন কমলাদেবী। তাঁর পরিধানে ছিল ব্যাঘ্রচর্ম, সর্বাঙ্গে বিভূতি, কণ্ঠে নাগরাজ, ত্রিলোচন, জটাজুটমণ্ডিত মস্তক ও পঞ্চমুখ। এই পঞ্চমুখ পঞ্চবর্ণের ছিল–ধূম্র, পীত, শ্বেত, রক্ত ও অরুণ। তার শিরে ছিল গঙ্গা আর ললাটে অর্ধচন্দ্র। দেবাদিদেব বৃষপৃষ্ঠে আরোহন করেছিলেন। এই দিব্যদর্শনের কিছুদিন পরেই এলো সেই শুভদিন। বাংলা ১১৩৭ সালের ১৮ই ভাদ্র, ইংরাজি ১৭৩০ সালের ২৯শে আগস্ট, মঙ্গলবার রোহিণী নক্ষত্রে শুভ জন্মাষ্টমীর দিন কমলাদেবী প্রসব করলেন এক দিব্যকান্তি দেবশিশু। শিশুর দেহে এক অপূর্ব দিব্যভাব। রামকানাই অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন সেই দিব্যকান্তি শিশুকে আর ভক্তিভরে স্মরণ করতে লাগলেন দেবাদিদেব মহাদেবকে। যে দিব্যজ্যোতি নিয়ে এই অনিন্দ্যসুন্দর শিশু শোভা পাচ্ছে কমলাদেবীর কোলে, তাতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বুঝলেন যে, এই সন্তান শিবঅংশ সম্ভুত। দেবাদিদেব মহাদেবের কৃপায় এই শিশু ধরায় তাদের ঘরে অবতীর্ণ হয়েছেন এই জগৎ সংসারকে আলোকিত করতে।

.

শিশু লোকনাথ

দিব্যলক্ষণ সমন্বিত শিশু লোকনাথ মাতৃক্রোড়ে বড় হতে লাগল। শিশুর যখন ৬ মাস বয়স হল তখন রামকানাই তার অন্নপ্রাশন দেবার কথা চিন্তা করলেন। তখনও শিশুর নামকরণ হয়নি। অন্নপ্রাশনে নামকরণ অনুষ্ঠান হয়। শিশুর জন্মপূর্ব অলৌকিক ঘটনাবলী এবং নিজের ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষা স্মরণ করে রামকানাই শিশুর নামকরণ অনুষ্ঠানের জন্য একজন বেদজ্ঞ পণ্ডিতের কাছে যাওয়া মনস্থ করলেন। সেই সময় ওই অঞ্চলে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি নামে এক শাস্ত্রজ্ঞ মহাপণ্ডিত বাস করতেন।

ব্রহ্মানন্দ ভারতী যে সময় কাঁকড়া কচুয়া গ্রাম দর্শনে এসেছিলেন, তার থেকে কিঞ্চিৎ সহস্র বছর পূর্বে কান্যকুজ থেকে ভট্টনারায়ণ, দক্ষ, বেদগর্ভ, ছান্দর ও শ্রীহর্ষ নামে পাঁচজন পণ্ডিত শাস্ত্রজ্ঞ বিপ্র মহারাজ আদিশূরের যজ্ঞ সম্পাদনের জন্য বাংলায় এসেছিলেন। সেই পঞ্চ বিপ্রের মধ্যে বেদগর্ভের বংশধর ছিলেন আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি। তিনি ওই অঞ্চলেই বসতি করেছিলেন। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির হিন্দুশাস্ত্রে তথা বেদ-পুরাণে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। লোকনাথের জন্মের পর তিনি দেবনির্দেশ পেয়েছিলেন যে রামকানাই-এর ঘরে যে দেবশিশুর জন্ম হয়েছে তাকে যোগসাধনার পথে পরিচালনা করে ব্রহ্মজ্ঞ করার গুরুদায়িত্ব তাকেই পালন করতে হবে।

রামকানাইয়ের সঙ্গেও তার হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল এবং রামকানাই তাকে গুরুদেব বলে সম্বোধন করতেন। একদিন রামকানাই আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির সমক্ষে উপস্থিত হয়ে তার চতুর্থ সন্তানের জন্মবৃত্তান্ত ও নিজকুল উদ্ধারের আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করলেন। তিনি পণ্ডিত মহাশয়কে এও জানালেন যে, তাঁর স্ত্রীর এই ব্যাপারে সম্মতি আছে। রামকানাইয়ের মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির ইচ্ছা হল নবজাতককে দর্শন করার। তিনি রামকানাইয়ের সঙ্গে শিশু দর্শনে এলেন। রামকানাইয়ের ঘরে সেই দিব্যশিশুকে দর্শন করেই আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি অভিভূত হয়ে গেলেন। শিশুর শরীরের কিছু দিব্যলক্ষণ তার মধ্যে বিস্ময়ের সঞ্চার করলো। তিনি নিশ্চিত হলেন যে এই শিশুর মধ্যে নানাবিধ মহাপুরুষের লক্ষণ বিদ্যমান। তিনি স্বেচ্ছায় এই শিশুর কোষ্ঠি বিচার করতে বসলেন। কোষ্ঠিবিচার করে তিনি জানতে পারলেন যে, এই শিশু ত্রিলোকের নামের অংশ হতে সমুদ্ভূত। ভবিষ্যতে এই শিশু এক মহাপুরুষরূপে আবির্ভূত হবেন। তিনি মনে করলেন লোকেশ্বরের কৃপায় যার জন্ম এবং ইহলোকের সন্তাপ দূর করার নিমিত্ত যার জন্ম হয়েছে, তার নাম লোকনাথ হওয়াই উচিত। শিশুর নামকরণ হল লোকনাথ ঘোষাল। রামকানাই মহানন্দে অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান করলেন ও সারা গ্রামের লোককে আপ্যায়িত করলেন। সারা গ্রামের লোক এই দেবশিশু দর্শন করে ধন্য হলেন।

এরপর দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, শিশু লোকনাথ হাঁটতে শেখে। অন্য ভাইদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে খেলতে শেখে। এইভাবে চার বছর পার হয়ে যায়। শিশু চার বছর অতিক্রম করলে রামকানাই শিশুর বিদ্যারম্ভের জন্য হাতেখড়ি অনুষ্ঠান করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বাংলায় এখনও এই প্রথা প্রচলিত যে, শিশুর হাতেখড়ি অনুষ্ঠান হবার পরই বিদ্যারম্ভ করা হয়। রামকানাই গেলেন শাস্ত্রবিদ পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলির কাছে একটি শুভদিন নির্ণয় করার জন্য। ভগবান গাঙ্গুলি শুভদিন নির্ণয় করে দিলেন। শিশু লোকনাথের হাতেখড়ি অনুষ্ঠান করা হল। রামকানাইয়ের মনোবাসনা এই শিশু বেদজ্ঞ মস্ত পণ্ডিত হবেন। কিন্তু শিশুর বিদ্যাশিক্ষার থেকে খেলাধূলায় মতি বেশি। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে যায়। কিন্তু লোকনাথের লেখাপড়ায় কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। রামকানাই কত চেষ্টা করেন লোকনাথের আকর্ষণ খেলাধূলা থেকে বিদ্যাভ্যাসে ফিরিয়ে আনার, কিন্তু সব বৃথা। নয় বৎসর বয়স পর্যন্ত লোকনাথের অক্ষর জ্ঞান হয় না। রামকানাই পুত্রকে নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি একদিন আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির কাছে গিয়ে সব নিবেদন করেন। তিনি বলেন যে, যখনই তিনি লোকনাথকে নিয়ে বিদ্যাভ্যাস করাতে যান, শিশুর মন কিছুতেই বিদ্যায় আকৃষ্ট হয় না। পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলি ছিলেন ভবিষ্যদ্রষ্ট। তিনি শিশুকে দর্শন করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই শিশু একদিন মহাপুরুষ হবে। তিনি রামকানাইকে বললেন, তুমি যাকে মূর্খ হবে ভাবছে, সে একদিন ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করে মহাযোগী রূপে আত্মপ্রকাশ করবে। এই জগতে একদিন সে মহাযোগী, সর্বশাস্ত্র বিশারদ, মহাজ্ঞানী রূপে পূজিত হবে। তোমরা ওকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য পীড়াপীড়ি কোরো না। সময় হলেই ওর দিব্য প্রকাশ ঘটবে এবং ওর মধ্যে দিব্যজ্ঞান স্কুরিত হবে। রামকানাইয়ের চিন্তিত মন আচার্য ভগবান গাঙ্গুলির কথায় আশ্বস্ত হল এবং তিনি গৃহে ফিরে এলেন। লোকনাথ প্রকৃতির খেয়ালে নিজের ইচ্ছায় বড় হতে লাগল।

.

বালক লোকনাথ

লোকনাথ শিশু অবস্থা থেকে বাল্যাবস্থায় পা দিয়েছেন। কিছু সঙ্গী-সাথীও হয়েছে। তাদের নিয়েই তিনি গ্রামে খেলা করে বেড়ান। তাঁদের খেলার একটি প্রিয় স্থল ছিল গ্রামের একটি প্রাচীন বটগাছতলা। সেখানে গ্রামের লোকেরা বটেশ্বর পূজা করতো। লোকনাথ ও তার সাথীরা সেই বটগাছতলায় বসে ধ্যান ধ্যান খেলা করতেন। সাথীরা লক্ষ্য করতো, যখন লোকনাথ সেই বটগাছের নিচে ধ্যান করতেন, তখন তার আর কোনোদিকে খেয়াল থাকতো না। এই ধ্যান ধ্যান খেলা তার কাছে অতি প্রিয় ছিল। লোকনাথ বাবা ব্রহ্মানন্দ ভারতীর কাছে বলেছিলেন তাঁর আর একটি প্রিয় খেলা ছিল সাথীদের নিয়ে গ্রামে ঘুরে যেখানে বৃদ্ধরা ঘন্টাকর্ণ পূজা (ঘেটুপূজা) করতো, সেখানে গিয়ে পূজা সমাধা হবার আগেই তা লাঠি দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া। এই খেলায় তিনি ও তাঁর সাথীরা খুব আনন্দ পেতেন। গ্রামের বৃদ্ধরা সেই নিয়ে বাড়িতে নালিশ জানায়। তখন বাড়ি ফিরলে মায়ের কাছে খেতে হতো বকুনি আর বাবা শোনাতেন অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরাও তাদের বাগে পেলেই জ্ঞানগর্ভ কথা শোনাতেন। তার আর একটি বাল্যকালের টান ছিল সাধু-সন্ন্যাসীদের উপর। গ্রামের প্রান্তে ছিল এক প্রাচীন শিবমন্দির। বিভিন্ন স্থান থেকে সাধু-সন্ন্যাসীরা ওই মন্দিরে এসে আশ্রয় নিত। সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি লোকনাথের ছিল এক তীব্র আকর্ষণ। তাঁর সাথীদের নিয়ে প্রায়ই ওই মন্দিরে যেতেন সাধু দর্শন করার জন্য। এই প্রবণতা তার মধ্যে ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। সাধুসন্তরা যখন ওই গ্রামে দীর্ঘদিনের জন্য উপস্থাপন করতেন, লোকনাথ প্রায় সারাদিন তাঁদের সঙ্গেই কাটাতেন। তাদের আচার-আচরণ, দিনযাপন, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি রালক লোকনাথ তীক্ষ্ণ দর্শনে অবলোকন করতেন। তিনি দেখতেন যে, সাধুরা একটি কাপড় ছিঁড়ে একখণ্ড কাপড়ে ল্যাঙ্গুটির মতো করে ব্যবহার করতেন। যাকে বলা হয় কৌপিন।

একদিন কমলাদেবী একটি নতুন বস্ত্র লোকনাথকে পড়তে দিলেন। লোকনাথ সেই বস্ত্র ছিঁড়ে একটি কৌপিন বানিয়ে পড়ে নিজের ঘরে ধ্যানে বসেন।

এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে কমলাদেবী হাসতে হাসতে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কার ধ্যান করছিস? মার কথার উত্তরে চোখ মেলে লোকনাথ গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি সন্ন্যাসী হয়েছি, শিবের ধ্যান করছি। এই কথা শুনে কমলাদেবীর হাসি আর থামে না। সে হাসতে হাসতে স্বামীর কাছে গিয়ে লোকনাথের কথা বলায় রামকানাই মনে মনে আশ্বস্ত হন যে এই লোকনাথই একদিন তার মনস্কামনা পূর্ণ করবে।

একদিন লোকনাথ গ্রামের শিবমন্দিরে গিয়ে সাধুদের সঙ্গেই ধ্যানে বসে যান। তাঁর নিষ্ঠা দেখে সাধুরা প্রীত হন। সারারাত লোকনাথ সেই সাধুদের নিয়ে নাম-গান করে ঘুমিয়ে পড়েন। এদিকে বাবা-মা রাতে লোকনাথ না ফেরায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। তারা জানতে পারেন যে, লোকনাথ শিবমন্দিরে সাধুসঙ্গ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সন্ন্যাসী দেখলেই লোকনাথ তার পিছনে ছুটে যান এবং তার সঙ্গে নানারকম বার্তালাপ জুড়ে দেন। একটি বালকের মধ্যে এত সন্ন্যাস প্রেম দেখতে পেয়ে সন্ন্যাসীরাও তাকে আপন করে নেন।

একবার চড়কের মেলায় গ্রামে অনেক সন্ন্যাসী এসেছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজনের মেলা গ্রামের একটি বড় আকর্ষণ। সেই সময় গ্রামে যেমন সন্ন্যাসী আসে তেমন গ্রামের লোকেরাও শিব-পার্বতী সঙ সেজে গ্রামে ঘোরে। অনেকে শিব সেজেছে। তাদের দেখে লোকনাথও বাঘের ছাল পড়ে, গায়ে ভস্ম মেখে, হাতে একটা ত্রিশূল নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কিন্তু গ্রামের সকলে লক্ষ্য করল যে অন্যান্য সঙের থেকে লোকনাথের শরীরে এক অন্য বিভা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক দিব্যজ্যোতিতে সে মানুষকে মুগ্ধ করে তুললো। ত্রিশূল হাতে তিনি সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অনেক দূরে চলে গেলেন। রাত হয়ে গেছে। চারিদিক অন্ধকার। এবার তিনি আর বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পান না। অন্ধকারে তাঁর সঙ্গে আর কেউ নেই। তিনি একটা বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। তারপর একমনে শিবকে স্মরণ করে বলতে থাকেন–হে বাবা ভোলানাথ, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি, আমাকে পথ দেখাও। এমন সময় কোথা থেকে এক জটাজুটধারী সাধু তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেই সাধুর শরীর থেকে এক অলৌকিক আলোর বিচ্ছুরণে চারিদিক আলোকিত হয়ে উঠেছে। মাথার পিছনে চক্রাকার দিব্যজ্যোতি। কপালে অর্ধচন্দ্রাকার। তিনি ইশারা করে লোকনাথকে চলতে বললেন। লোকনাথও বিমূঢ় চিত্তে তাকে অনুসরণ করে যখন নিজের বাড়ির সামনে পৌঁছলেন, দেখলেন, সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ আর নেই।

এরপর একদিন পাশের গ্রামে পালা গান শুনতে যাবার জন্য লোকনাথ বায়না ধরলেন। মা কিছুতেই তাকে একা যেতে দেবেন না। তার শঙ্কা লোকনাথ কোথাও হারিয়ে যেতে পারে। তিনি লোকনাথকে বলেন, তুই এতদূরে যাবি, তোর ভয় করে না? লোকনাথ মাকে বললেন ভয় করবে কেন? কোথাও রাস্তা হারালে তো তুমি আলো হাতে লোক পাঠিয়ে দাও। সেই লোকই আমায় বাড়ি পৌঁছে দেয়। সেই লোকটাকে দেখতে ঠিক শিবের মতো। ছেলের কথা শুনে মা ভয় পেয়ে গেলেন! ভাবলেন, কোনো ব্রহ্মদৈত্য ছেলের কাছে আসে না তো। তিনি আরো ভাবলেন, সাধু-সন্ন্যাসীরা ছেলের মাথা বিগড়ে দিয়েছে। মায়ের মন সবসময় সন্তানের বিপদের দিকে ধেয়ে যায়। কিন্তু এ তো যে-সে সন্তান নয়। এ যে স্বয়ং লোকের নাথ।

একবার জ্যৈষ্ঠ মাসে ভীষণ খরা। বৃষ্টির চিহ্নও নেই। কৃষিপ্রধান গ্রামে চাষীরা হাহাকার করছে। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা বৃষ্টির জন্য শুভ যজ্ঞানুষ্ঠান করছেন, কিন্তু মেঘ-বৃষ্টির দেখা নেই। দেবতারা কৃষকের ডাক শুনতে পাচ্ছেন না। গ্রামের সকলের মতো রামকানাইও চিন্তিত ছিলেন। বাবাকে চিন্তিত দেখে লোকনাথ বললেন, এতো ভাবছো কেন বাবা? আমাদের ঠাকুরঘরে যে জলেশ্বর শিবলিঙ্গ আছে, তাকে মহাস্নান করালেই বৃষ্টি হবে। খরা দূর হয়ে যাবে। লোকনাথ তখন সঙ্গীসাথী নিয়ে গ্রামের সমস্ত বাড়িতে এই খবর পৌঁছে দিতে লাগলেন যে, তাদের বাড়ির জলেশ্বর শিবলিঙ্গকে স্নান করালে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। গ্রামের মানুষ আবার কৃষিকাজ শুরু করতে পারবে।

পূর্বস্মৃতি মেনে গ্রামের সমস্ত পরিবার লোকনাথের বাড়ির শিবলিঙ্গের মাথায় পূণ্য জল ঢালতেই আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলো। লোকনাথের এই দৈববাণীতে গোটা গ্রামের মানুষ মুগ্ধ হয়ে তার নামে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। রামকানাই ও কমলাদেবীও তাদের পুত্রের দৈবসত্তার পরিচয় পেয়ে মানসিকভাবে তৃপ্ত হলেন।

এরপর একদিন লোকনাথ তার বন্ধুদের সঙ্গে গ্রামের প্রাচীন বটগাছতলায় বসে আছেন। সহসা তিনি এক বন্ধুর হাত টেনে নিয়ে ভাগ্যবিচার করতে বসেন। এক-একজনের হাত দেখে তিনি বলেন–তোর ভাগ্যে সন্ন্যাসী হওয়া নেই, তোর কপাল খারাপ। বন্ধুরা এই নতুন খেলায় মজা পায় এবং এক একজন করে সকলেই তার কাছে হাত দেখাতে থাকে। কিন্তু লোকনাথের কথা শুনে তারা বুঝতে পারে না, সন্ন্যাসী হতে না পারলে কেন কপাল খারাপ হবে? তারা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে থাকে। এমন সময় তার এক সাথী বেণীমাধব সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দেয়। লোকনাথ খুব ভাল করে তার হাত দেখে বলেন, তোর সন্ন্যাসী হবার যোগ আছে। শিবদর্শনও হতে পারে। তখন বন্ধু বেণীমাধব বলে, তুই যেদিন ঘর ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়ে বেরোবি, সেদিন আমি তোর সঙ্গী হব। সেদিন যেন তাড়িয়ে দিসনে আমায়। লোকনাথ বন্ধুকে আশ্বাস দিয়ে বললেন-ঠিক আছে, তাই হবে।

লোকনাথের মন আরও বেশি করে ধ্যানে আকৃষ্ট হয়। আগে বটগাছতলায় বা শিবমন্দিরে বসে ধ্যানাভ্যাস করতেন, এখন ঘরে বসেই ধ্যান করেন। কেউ তাকে এভাবে ধ্যান করতে শেখায়নি। ঘরে ধ্যান করলে মা যখন জিজ্ঞাসা করতেন, কি রে তুই ওভাবে বসে কি করছিস? লোকনাথ উত্তর দিতেন–দিলে তো আমার ধ্যানটা ভঙ্গ করে। চোখ বুজে এভাবে ধ্যান করলেই মাথায় জটা গজাবে। ছেলের এই কথা শুনে কমলাদেবীর হাসিও পেত আবার মন শঙ্কিতও হয়ে উঠতো এই ভেবে যে, এই বুঝি সেই সময় এগিয়ে আসছে। যখন এই পুত্রকে তিনি আর ধরে রাখতে পারবেন না। পুত্রের বাল্যকালের সংসারলীলা আর তার চক্ষুগোচর হবে না। নীরবে তিনি অশ্রু বিসর্জন করতেন।

.

দ্বিজ লোকনাথ

কোনো ব্রাহ্মণ সন্তানের উপনয়ন সংস্কার হলে তাকে ‘দ্বিজ’ বলে। বালক লোকনাথের দশ বছর বয়স পার হয়ে গেছে বাল্যলীলা করতে করতে। কমলাদেবী তার স্বামীকে বলেন লোকনাথের উপনয়ন সংস্কারের ব্যবস্থা করতে। রামকানাইও চিন্তা করেন যে, লোকনাথ এগারোয় দিয়েছে, এটাই তার উপনয়নের যথার্থ সময়। রামকানাই লোকনাথের উপনয়ন সংস্কারের ব্যবস্থা করার জন্য পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলির কাছে গেলেন। পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথের উপনয়নের কথা শুনে বুঝলেন যে এবার তাঁকেও সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে এক মহা তপস্যার অভিযানে। তিনি লোকনাথের উপনয়ন সংস্কারের দিন ঠিক করে দিলেন।

এদিকে গ্রামেরই বলরাম বাড়ুজ্যের পুত্র বেণীমাধব, যার জন্ম হয়েছিল ১১৩৭ সনের ২০শে ভাদ্র, সেও এগারোয় দিয়েছে। যখন সে জানতে পারলো লোকনাথের উপনয়ন সংস্কার হবে, সেও উপনয়নের জন্য বায়না ধরলো যে সেও লোকনাথের সঙ্গে ব্রহ্মচারী হতে চায়। লোকনাথ ও বেণীমাধবের মধ্যে একটি পূর্বনির্ধারিত আত্মিক যোগ ছিল। লোকনাথের জন্মের দুইদিন পরেই বেণীমাধবের একই গ্রামে জন্ম হয়। বেণীমাধবের লোকনাথের সঙ্গে ব্রহ্মচারী হবার বাসনায় প্রাথমিকভাবে বাড়ির লোকের আপত্তি ছিল না। সেজন্য তারও উপনয়ন সংস্কারের ব্যবস্থা করা হল।

নির্দিষ্ট দিনে পণ্ডিত ভগবান গাঙ্গুলি রামকানাইয়ের বাড়ি উপস্থিত হলেন লোকনাথের উপনয়ন সংস্কার করতে। তিনি নিজ হস্তে লোকনাথের উপনয়ন সংস্কার কার্য সমাধা করলেন। উপনয়ন সংস্কার কার্য সমাপ্ত হবার পর ভগবান গাঙ্গুলি লোকনাথকে নিয়ে দণ্ডীঘরে প্রবেশ করলেন। দণ্ডীঘরে দণ্ডীবেশী লোকনাথকে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি বললেন, লোকনাথ এবার আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। লোকনাথ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় যেতে হবে? আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তাকে বললেন, আমাদের তপস্যা করার জন্য গৃহত্যাগ করতে হবে। এখন থেকে তোমায় সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করতে হবে। ঈশ্বরের সাধনা করতে হবে। পরমেশ্বরকে লাভ করতে হবে।

আচার্যদেব এবার রামকানাই ও কমলাদেবীর কাছে ঈশ্বরের সেই অমোঘ আদেশ প্রকাশ করে বললেন, বাবা রামকানাই, মা কমলা, ঈশ্বরের যে আদেশ আমার উপর আছে, তা এবার আমায় পালন করতে হবে। এই জগতের মঙ্গলের জন্য ও ত্রিতাপজ্বালা জর্জরিত অসংখ্য মানুষকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্য এবং তোমাদের বংশের মুখ উজ্জ্বল করার নিমিত্ত লোকনাথকে সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করতে হবে। আমি এই দিনটির অপেক্ষাতেই বসে আছি।

রামকানাই বুঝলেন যে এতদিনে তার বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। তাঁর চতুর্থ পুত্র ব্রহ্মচারী হয়ে তার ষাট কুল উদ্ধার করবে। তিনি স্ত্রীকে বললেন, এবার আমাদের লোকনাথকে বিদায় দিতে হবে। মা-ও বোঝেন যে, দেবাদিদেব মহাদেবের অংশে লোকনাথের জন্ম হয়েছে জগতের মঙ্গল বিধানের জন্য। তার শক্তি নেই এর বিরুদ্ধে যাবার। কিন্তু তাও মনে মনে তিনি কেঁদে আকুল হন। রামকানাই তাকে বোঝাতে থাকেন যে, তাদের পুত্র মানবরূপে জন্মগ্রহণ করেছে কোনো দেবকার্য সাধনের জন্য। দেবতার কার্যে তাকে ছেড়ে দিতে হবে। এবার ভিক্ষা গ্রহণের পালা। উপনয়ন সংস্কারের পর শাস্ত্রানুসারে দণ্ডী সন্ন্যাসীকে ভিক্ষা দিতে হয়। মা কমলাদেবী দণ্ডীঘরে প্রবেশ করলে লোকনাথ সামনে এসে বলেন–ভগবতী ভিক্ষাং দেহী। এইভাবে তিনবার উচ্চারণ করে লোকনাথ মার কাছে ভিক্ষা চাইলেন। মা কমলাদেবী তার সন্তানকে আঁচল ভরে ভিক্ষা দিলেন ও অনেক আশীর্বাদ করলেন। এরপর মা স্বয়ং লোকনাথের কাছে ভিক্ষা চাইলেন–আগামী জন্মে আবার যেন তোমায় সন্তান রূপে পাই। লোকনাথ বললেন–তাই হবে। মা কমলাদেবী অশ্রুসজল চোখে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো দেখতে থাকেন তাঁর প্রিয় পুত্রকে। রামকানাই শোক ও আনন্দ মিশ্রিত মনে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে দু চোখ ভরে দেখতে থাকেন দ্বিজ লোকনাথকে। বিদায়ের কাল সমাগত। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি তাঁর শিষ্য লোকনাথকে নিয়ে প্রস্তুত। রামকানাই তাঁর পুত্রের সমস্ত ভার সঁপে দিলেন আচার্যদেবের হস্তে।

এদিকে গ্রামেরই অন্যপ্রান্তে ঘটছে এক অন্য ঘটনা। বেণীমাধবের ইচ্ছা অনুযায়ী তার পরিবার প্রাথমিকভাবে তাকে উপনয়ন সংস্কারের পর লোকনাথের সঙ্গে ব্রহ্মচর্য পালনে সন্ন্যাস নেবার কোনো আপত্তি না দেখালেও শেষ পর্যন্ত তারা বেঁকে বসেন। কিন্তু বেণীমাধব নাছোড়–সে প্রচণ্ড কান্নাকাটি জুড়ে দিলে সেই সময় উপস্থিত পণ্ডিতগণের সঙ্গে বাড়ির লোকেরা আলোচনা করলেন এবং বেণীমাধবের কথা শুনে পণ্ডিতবর্গ তার কথায় সায় দিলেন। লোকনাথের খেলার সাথী বেণীমাধব গৈরিক বসন পড়ে মুণ্ডিত মস্তকে কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে লোকনাথের কাছে পৌঁছল। সেখানে পৌঁছে আচার্যদেবকে দেখতে পেয়ে সে বলল, আমার নাম বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকনাথ আমার হাত দেখে বলেছিল, আমার হাতে সন্ন্যাস যোগ আছে। আমার শিবদর্শন হবে। ও যখন সন্ন্যাসী হবে, তখন ও আমাকে সঙ্গে নেবে। আমার উপনয়ন সংস্কার হয়েছে। দণ্ডীঘরে মার কাছে ভিক্ষা নিয়েই আমি লোকনাথের ডাক শুনতে পেলাম। ও বলল, বেণী, আমি তোকে কথা দিয়েছিলাম, যাবার সময় ডেকে নেব। এখনই আমি বেরিয়ে পরছি। যাবি তো এখনি আমার বাড়ি চলে আয়। সন্ন্যাসী হতে চাস তো দেরি করিসনে। দেখবি, সন্ন্যাসী হবার কি মজা! বালকের কথা শুনে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি অবাক বিস্ময়ে দুই দ্বিজ বালককে দেখতে লাগলেন। কি সরল মন ওদের। কি পবিত্র চিত্ত! কি প্রবল বাসনা সন্ন্যাসী হবার। কি ব্যাকুলতা শিব দর্শনের। দুজনেরই বয়স প্রায় এক। তিনি চোখ বুজে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন, এই জন্মে এমন শিষ্য দেবার জন্য। তিনি অন্তরে অনুভব করলেন, একদিন এই দুই বালক শিষ্যের মহিমার মাধ্যমে তাঁর জীবন সার্থক হয়ে উঠবে। এদের মাধ্যমেই হয়তো বা হতে পারে তার দেবদর্শন। আর দেরি নয়। আর কোনো মায়ার বন্ধনে জড়াতে চান না আচার্যদেব। দুই পরিবারের লোকেদের কাছে বিদায় নিয়ে এবার তাঁর এগিয়ে যেতে হবে এক মহতি অভিযানে। সেই অভিযান যেমন দুষ্কর তেমনি কঠিন। এই অভিযানের নেতৃত্ব তিনি ঈশ্বরের আদেশে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। দুই বালকের হাত ধরে নিঃশব্দে পরমেশ্বরকে স্মরণ করে আচার্য ভগবান গাঙ্গুলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে কচুয়া গ্রামের পথ ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন। একবারও পিছনে না তাকিয়ে সম্মুখে স্থির দৃষ্টি রেখে দুই দ্বিজ বালক সন্ন্যাসীর বেশে আচার্যদেবের হাত ধরে এগিয়ে চলে এক অজানার সন্ধানে। সারা গ্রামের লোক সানয়নে সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল।