॥ ৬০ ॥ সিংহল
সিংহল রাজ্যটি সাত হাজার লি আয়তনের। রাজধানীর পরিধি ৪০ লি মত হবে। আবহাওয়া গরম। মাটি উর্বর ও সরস থাকায় চাষ আবাদও ঠিক মতো হয়ে চলেছে। ফুল আর ফলও অপর্যাপ্ত হয়। জনসংখ্যাও অনেক। প্রত্যেকটি পরিবারই তার বিষয় সম্পত্তি থেকে ভালো রোজগার করে।
এখানকার লোকেরা ছোটখাটো চেহারার। গায়ের রঙ কালো। স্বভাবে উগ্রতার পরিচয় পাওয়া যায়। জ্ঞানচর্চার দিকে এদের আকর্ষণ রয়েছে, সদগুণাবলীকে সম্মান করে। ধর্মীয় ঐশ্বর্যকে তারা গভীর শ্রদ্ধা করে; ধর্মাচরণ ও পুণ্য অর্জনের দিকে যথেষ্ট চেষ্টা রয়েছে।
এ দেশকে আদিতে রত্নদীপ বলা হতো। এখানে দামী দামী রত্ন পাওয়া যায় বলেই এ নাম। পুরাকালে এটি রাক্ষসের আবাস ছিল।
এ রাজ্যের লোকেরা আগে নীতিশূন্য ধর্মীয় পূজা অর্চনার প্রতি আসক্ত ছিল। বুদ্ধের মৃত্যুর একশো বছর পর রাজা অশোকের ছোট ভাই মহেন্দ্র এখানে বুদ্ধের বাণী প্রচার করেন। সেই থেকে এখানকার লোক বুদ্ধের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। এখানে প্রায় একশোটির মতো সংঘারাম গড়ে ওঠে ও সেখানে কুড়ি হাজারের কাছাকাছি ভিক্ষু বসবাস করতে থাকেন। এঁরা প্রধানতঃ মহাযান শাখার স্থবির মতবাদের অনুগামী। এর দু’শো বছর পর তাঁরা দু’টি শাখায় ভাগ হয়ে যান। একদল ‘মহাবিহার বাসী’-যাঁরা মহাযানের বিরোধী ও হীনযানের অনুগামী। অন্যদল-’অভয় গিরি বাসী’-যাঁরা উভয় যানেরই চর্চ্চা করে থাকেন। এঁরা বিভিন্ন মতবাদের ত্রি-পিটকের নির্দেশগুলিকে একাকার করে ফেলেছেন। এই মতবাদপন্থী ভিক্ষুরা নৈতিক নিয়মগুলিকে বিশেষভাবে মেনে চলতেন। উপলব্ধি ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার জন্য তাঁরা বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলেন। তাঁদের নির্ভুল আচরণ ও চালচলন পরবর্তী কালের কাছে আদর্শ স্বরূপ হয়ে উঠেছিল।
রাজার প্রাসাদের কাছেই বুদ্ধদেবের দন্ত বিহার। এটি কয়েকশো ফুট উঁচু নানা রকম দুর্লভ রত্ন দিয়ে অলংকৃত। বিহারের উপরে একটি খাড়া দণ্ড রয়েছে। তার মাথায় একটি পদ্মরাগ মণি বসানো আছে। এ থেকে সব সময়ে উজ্জ্বল জ্যোতি খেলে চলেছে। কি দিন কি রাত সব সময়েই সে আলো দূরে থেকে চোখে পড়ে, তখন একে একটি নক্ষত্রের আলো বলে মনে হয়। রাজা প্রতিদিন বুদ্ধের তিনবার দাঁতটিকে সুগন্ধি জল দিয়ে ধোয়া মোছা করেন, কখনো বা সুগন্ধি চূর্ণ দিয়ে মাজেন।
একে বর্তমানে সি-লন-শান বা সিলনগিরি বলা হয়। কিন্তু আগে সিংহল বলা হতো।
এখানকার বর্তমান রাজ্য অ-লি-ফুন-নই-’রহ (অলিবুনর?) সোলি (চোল) দেশের লোক। সে গভীরভাবে ভিন্ন ধর্মের অনুরাগী, বুদ্ধের ধর্মের প্রতি তার কোন রকম অনুরাগ নেই। সে যেমন ক্রূর তেমনি স্বেচ্ছাচারী। যা কিছু ভালো মহৎ, সে তারই বিরোধী। দেশের লোকেরা এ সত্ত্বেও এখনো বুদ্ধের দাঁতের প্রতি সম্মান দেখায়।
দন্ত বিহারের কাছেই একটি ছোট বিহার আছে। এটিও নানারকম মূল্যবান রত্ন দিয়ে অলংকৃত। এখানে বুদ্ধের একটি সোনার প্রতিমা রয়েছে। মূর্তিটি স্বাভাবিক মানুষের আকারের। এ দেশের একজন পুরানো রাজা এটি গড়ে গেছেন। পরে তিনি শিরোভূষণটিকে রত্ন খচিত করেন।
রাজপ্রাসাদের পাশেই একটি রন্ধনশালা রয়েছে। রোজ এখান থেকে আগে আট হাজার ভিক্ষুকে খাদ্য দেয়া হতো। ইদানীং দশ বছর খানেক ধরে এ দেশে বিশেষ বিশৃঙ্খলা চলেছে, কোন সুপ্রতিষ্ঠিত রাজা নেই এদিকে দৃষ্টি দেবার জন্য।
দেশের উপকূলে একটি উপসাগরের দরুন এই রাজ্যটি দামী রত্নাদি ও মূল্যবান পাথরের দিক থেকে ধনী। রাজা নিজে সেখানে ধর্মানুষ্ঠান করেন, এর ফলে আত্মীয়রা তাঁকে নানারকম দুর্লভ ও মূল্যবান বস্তু উপহার দেয়। দেশের অধিবাসীরাও এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। যে যার ধর্মীয় সুকৃতি অনুসারে ফল লাভ করে। যে যা পায় তার নির্দিষ্ট এক ভাগ রাজাকে কর দেয়।
রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বদিকে লংকা পর্বত।
এখান থেকে সমুদ্র পার হয়ে আরো দক্ষিণে গেলে কয়েক হাজার লি পর ন- লো-কি-লো বা নরকির দ্বীপ পড়বে। সেখানকার লোকেরা ছোটখাটো মাত্র তিন ফুট লম্বা। তাদের দেহ মানুষের মতো হলেও পাখির মতো চঞ্চু রয়েছে। তারা কোন শস্য ফলায় না, কেবল নারিকেলের উপর বেঁচে থাকে।
॥ ৬১ ॥ কঙ-কিন-নো-পু-লো বা কঙ্কনাপুর
দ্রাবিড় রাজ্য পেছনে ফেলে উত্তরদিকে এগিয়ে চলে আমরা এক জন্তু জানোয়ার ভরা অরণ্যের দেখা পাই। এখানে পর পর মানব বর্জিত কতক শহর রয়েছে, বরং এদের শহর না বলে গ্রাম বলাই ঠিক হবে। ডাকাত লুটেরার দল এখানে দল বেঁধে পর্যটকদের উপর হামলা চালায়। জখম করে, অনেক সময় বন্দীও করে রাখে। এই পথ ধরে দু’হাজার লি মতো যাবার পর আমরা কঙ-কিন-নো-পু-লো বা কঙ্কনাপুরের দেখা পেলাম।
এ দেশটি আয়তনে পাঁচ হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানী তিরিশ লি মতো জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে। মাটি রসালো ও উর্বরা। নিয়মিত চাষের কাজ চালিয়ে যথেষ্ট ফসল ফলাচ্ছে। আবহাওয়া খর, গরমের বেশ দাপট।
এখানকার লোকজনেরা বেশ উৎসাহী ও চটপটে স্বভাবের। রঙ তাদের কালো। মেজাজ উগ্র, চালচলন অমার্জিত। জ্ঞানচর্চ্চার দিকে ঝোঁক রয়েছে, সদগুণাবলী ও প্রতিভার কদর করে।
একশোটির মতো সংঘারাম আছে। দশ হাজার খানেক ভিক্ষু সেখানে থাকেন। মহাযান ও হীনযান দু’য়েরই চর্চ্চা করেন। দেবতাদের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। কয়েকশো দেবমন্দির বর্তমান। নানা সম্প্রদায়ের বিধর্মীদের পীঠস্থান এগুলি।
রাজপ্রাসাদের পাশেই একটি বড়ো সংঘারাম দেখলাম। শ’তিনেক ভিক্ষু থাকেন। প্রত্যেকেই বিশিষ্ট লোক। একশো ফুটের বেশি উঁচু বিরাট একটি বিহার রয়েছে। রাজকুমার স্বার্থসিদ্ধের (সিদ্ধার্থ) একটি মূল্যবান উষ্ণীষ বা মুকুট আছে এখানে। এটি উচ্চতায় দু’ফুটের কিছু কম, নানা দামী রত্ন পাথর দিয়ে অলংকৃত করা। একটি রত্ন খচিত আধারে একে রাখা হয়। এটি অর্হৎ শ্রুতবিংশতি কোটির শিল্পকর্ম।
নগরীর উত্তরদিকে একটুখানি গেলেই ৩০ লি এলাকা জুড়ে একটি তালবন। গাছের পাতাগুলি লম্বা ও চওড়া। রঙ চকচকে উজ্জ্বল। ভারতের সব রাজ্যেই লেখার জন্য এই পাতা ব্যবহার করা হয়। এই বনের মধ্যেই একটি স্তূপ দেখলাম।
শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে কিছুটা গেলেই একশো ফুট মতো উঁচু একটি স্তূপ দেখা যাবে। এটি অশোক রাজার গড়া। এর পাশেই একটি সংঘারামের ভগ্নাবশেষ রয়েছে। শুধু ভিতটুকুই যা বর্তমান।
শহরের পূর্বদিকেও একটি স্তূপ আছে। ফুট তিরিশেক ছাড়া বাকী অংশ মাটিতে বসে আছে।
॥ ৬২ ॥ ‘মো-হো-লো-চ’ বা মহারাষ্ট্র
কঙ্কনাপুরের সীমানা ছেড়ে উত্তর-পশ্চিমদিকে এগিয়ে চললাম। এক বিরাট অরণ্যের মধ্য দিয়ে চলেছি। হিংস্র জন্তু জানোয়ার, ডাকাত ও লুটেরার দল সুযোগ পেলেই পর্যটকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পদে পদে জখম হবার, প্রাণ খোয়াবার ভয়। এ পথ ধরে ২৪০০ থেকে ২৫০০ লি যাবার পর দেখা পেলাম মো-হো-লো- চ বা মহারাষ্ট্র রাজ্যের।
রাজ্যটির আয়তন পাঁচ হাজার লি মতন। এক বড়ো নদীর পশ্চিম পাড়ে ৩০ লি খানেক এলাকা জুড়ে রাজধানী শহরটি গড়ে উঠেছে।
এখানকার মাটি সরস ও উর্বরা। নিয়মিত চাষ আবাদ চলছে। ফসলের ফলন খুবই ভালো। আবহাওয়ায় গরমের দাপট। লোকজন সৎ ও সরল স্বভাবের। শরীরের গড়ন বেশ লম্বা চওড়া। একগুঁয়ে ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। কেউ কোন উপকার করলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা পোষণ করে। শত্রুদের উপর কোনরকম মায়া-মমতা দেখায় না। কেউ অপমান করলে, তার শোধ তুলবার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হয় না। যদি কেউ দুর্দশা, দুর্বিপাকে পড়ে কোন সাহায্য চায়, নিজেদের ব্যস্ততার ঠেলায় তাকে সাহায্য করতেই ভুলে যাবে। কারো উপরে প্রতিশোধ নেবার আগে তারা শত্রুপক্ষকে হুঁশিয়ার করে দেবে, তারপর উভয়ে বর্শা হাতে নিয়ে একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। যখন কেউ পালাবার চেষ্টা করে অন্যজন পিছু পিছু ধাওয়া করে, তবে যে লোক নতিস্বীকার করে আত্মসমর্পণ করে তাকে কখনো তারা হত্যা করে না।
কোন সেনাপতি যুদ্ধে হেরে গেলে তারা তাকে কোন শাস্তি দেয় না। পরিবর্তে, তাকে মেয়েদের কাপড় উপহার পাঠায়। এর ফলে, (অপমানিত হয়ে) সে নিজেই মৃত্যুবরণ করে নেয়। এ রাজ্যে কয়েকশো লোক নিয়ে গড়া একটি সংসপ্তক সেনাবাহিনী রয়েছে। প্রত্যেকবার যুদ্ধযাত্রার আগে তারা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নেয়। তারপর বর্শা হাতে একদল লোক দশ হাজারের মুখোমুখি হয় ও যুদ্ধের আহ্বান জানায়। যদি এই ‘সংসপ্তক’ সেনারা কোন লোককে অকারণেও মেরে ফেলে, দেশের আইন তাদের কোন শাস্তি দেয় না। যখনই তারা বাইরে বের হয়, তারা তাদের আগে আগে ভেরী বাজিয়ে চলে। এছাড়া তারা শয়ে শয়ে হাতিকে মাতাল করে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যায়। নিজেরাও মদ খেয়ে নেয়। তারপর একত্র হয়ে হাতি ও মানুষে মিলে সামনে যা কিছু পায় দলিয়ে মাড়িয়ে ধ্বংস করে চলে। ফলে কোন শত্রুদলই এদের সামনে তিষ্ঠোতে পারে না।
এই সব লোক ও হাতি নিজের মুঠোয় থাকার জন্য রাজা তার পড়শীদের সঙ্গে তাচ্ছিল্যকর ব্যবহার করেন। তিনি ক্ষত্রিয় বর্ণের লোক। নাম তাঁর পুলকেশি। তাঁর কল্যাণকর কাজসমূহের সুফল ও প্রভাব বিরাট এলাকা জুড়ে অনুভূত হয়। তাঁর প্রজারা তাঁকে গভীরভাবে মেনে চলে। অধুনা শীলাদিত্য মহারাজ পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সব জাতিকে জয় করে নিয়েছেন। দেশের অতিসুদূর প্রান্তেও তাঁর প্রতিপত্তি রয়েছে। কিন্তু একমাত্র এই রাজ্যের লোকেরাই তাঁর অধীনতা মেনে নেয়নি। তিনি পঞ্চ-সিন্ধুর সব অঞ্চল থেকে সৈন্য সমবেত করে, সব দেশ থেকে সেরা নায়কদের বেছে নিয়ে, নিজেই তাঁদের নিয়ে এদের জয় করার জন্য এসেছিলেন। তবুও তিনি এদের সৈন্যদের জয় করতে পারেননি।
স্বভাবের দিক থেকে এরা বিদ্যানুরাগী। বৌদ্ধ ও অন্য ধর্ম দু’য়েরই চর্চ্চা করে। একশোটির মতো সংঘারাম আছে এখানে। পাঁচ হাজারের মতো ভিক্ষুও আছেন। মহাযান ও হীনযান উভয়কেই অনুসরণ করেন তাঁরা। দেবমন্দির একশোর কাছাকাছি। সেখানে সব সম্প্রদায়ের বিধর্মীরাই থাকেন।
রাজধানীর ভিতরে ও বাইরে বুদ্ধদেবের স্মৃতি বিজড়িত ৫টি স্থানে পাঁচটি স্তূপ আছে। সব ক’টিই রাজা অশোক গড়েছেন। এছাড়া ইট ও পাথরের গড়া আরো এতো স্তূপ রয়েছে যে সবগুলির বিবরণ দেয়া অসম্ভব।
শহরের দক্ষিণে অল্প খানিকটা গেলেই একটি সংঘারাম চোখে পড়বে। এখানে চাওয়ান-ঝে-ৎসই বোধিসত্ত্বের একটি পাথরমূর্তি আছে।
রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে একটি দুরারোহ পর্বতমালা আছে। এর মাঝে, এক অন্ধকার উপত্যকায় একটি সংঘারাম গড়া হয়েছে। এর বিশাল মহাকক্ষগুলি ও তার বারান্দাগুলি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রতিটি তলের পিছন দিকে বন্ধুর পর্বত, সামনে উপত্যকা।
সেই সংঘারামটি অর্হৎ আচার (O-che-1o) বানিয়েছেন, ইনি পশ্চিম ভারতীয় ছিলেন।
এর বিহারটি একশো ফুটের মতো উঁচু। মাঝে ৭০ ফুট খানেক লম্বা একটি বুদ্ধ-মূর্তি রয়েছে। তার ওপর সাত ধাপ যুক্ত পাথরের ছত্র। কোন রকম অবলম্বন ছাড়াই সেগুলি উপরে উঠে গেছে। প্রত্যেকটি ছত্রের মধ্যে তিন ফুটের মতো ব্যবধান।
বিহারের চারপাশেই পাথরের দেয়ালগুলিতে বুদ্ধের বোধিসত্ত্ব জীবনের নানা ঘটনা চিত্রিত রয়েছে। বুদ্ধত্ব অর্জনের আগে তিনি যেসব শুভসংকেত দর্শন করেন তার চিত্র ও তাঁর নির্বাণ ঘটনাসহ তাঁর জীবনের বিভিন্ন আধ্যাত্মিক ঘটনাবলীর চিত্রও এখানে রয়েছে।
এই দৃশ্যগুলি অতি নিপুণ ও নিখুঁত ভাবে রূপায়িত করা হয়েছে। সংঘারামের বাইরের ফটকে, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে, ডাইনে ও বাঁয়ে দুটি পাথরের হাতি আছে। প্রাচীনকালে জিন বোধিসত্ত্ব প্রায়ই এই সংঘারামটিতে আসতেন।
॥ ৬৩ ॥ ‘পো-লু-কিএ-চে-পো’ বা ভরুকচ্ছে
এবার আমরা পশ্চিম দিকে এগিয়ে চললাম। প্রায় হাজার লি পথ চলার পর নর্মদা নদী পার হয়ে পৌঁছালাম এসে পো-লু-কিএ-চে-পো বা ভরুকচ্ছেব (ভরুকচ্ছ)।
রাজ্যটি ২৪ শত থেকে ২৫ শত লি এলাকা জুড়ে। রাজধানী ২০ লি মতন। এখানকার মাটি নোনা। গাছপালা লতাগুল্ম অন্যান্য অঞ্চলের মতো অত বেশি নজরে পড়ে না। অল্প স্বল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এরা সাগরের জল জ্বাল দিয়ে নুন বানায়। সমুদ্রই এদের একমাত্র অবলম্বন, যা কিছু সম্পদ আর রোজগারের পথ। আবহাওয়া গরম। সব সময়েই ঘূর্ণি ঝড় আর বাতাসের দাপট।
লোকজনের ধরন ধারণ কেমন যেন হিম আর নির্বিকার। স্বভাব-চরিত্র কুটিল ও বিকৃত। এদের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চ্চা নেই। সত্যমার্গী ও বিপথমার্গী দুই মতের লোকই রয়েছে।
রাজ্যটিতে দশটির মতো সংঘারাম আছে। শ’তিনেক ভিক্ষু সেখানে। এরা মহাযানের উপাসক। স্থবির শাখার অনুগামী। দেবমন্দির গুটি দশেক। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিপথ মার্গীরা সেখানে থাকে।
॥ ৬৪ ॥ ‘মো-ল-প’ বা মালব
ভরুকচ্ছেব পিছনে ফেলে উত্তর-পশ্চিমে এগিয়ে চলতে থাকলাম। প্রায় দু’হাজার লি পথ ভাঙার পর মো-ল-প বা মালব দেশের দেখা মিললো।
দেশটি দু’হাজার লি এলাকা জুড়ে। তিরিশ লি রাজধানীর আয়তন। এর দক্ষিণ ও পূর্ব সীমা দিয়ে মহানদী বয়ে চলেছে। জমি সরস ও উর্বরা, এজন্য ফসলের ফলন অপর্যাপ্ত। লতাগুল্ম গাছপালার সীমা সংখ্যা নেই, ফল ও ফুল অফুরান। শীতে গম বোনার পক্ষে এ জমি বিশেষ উপযোগী। এরা বেশির ভাগই মচমচে রুটি ও ভাজা শস্য চূর্ণ বা তা দিয়ে তৈরী খাবার খায়।
লোকজন বেশ সদগুণ সম্পন্ন নরম স্বভাবের। বুদ্ধির প্রখরতা বিশেষ লক্ষ্য করার মতো। এদের ভাষা বেশ প্রাঞ্জল ও পরিষ্কার। বিদ্যাবত্তা বেশ গভীর ও ব্যাপক।
বিদ্যা ও জ্ঞানের পীঠরূপে ভারতের দুই প্রান্তের দু’টি দেশের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে মালব আর উত্তর-পূর্বে মগধ। এরা সদগুণাবলীর কদর করে, সভ্য-ভব্য আচরণের সম্মান করতে জানে। মন বুদ্ধিদীপ্ত, আর অপার প্রচেষ্টাশীল। এ সব সত্ত্বেও এরা মিথ্যা ধর্মে বিশ্বাসী। বৌদ্ধ ধর্মীও রয়েছে। দুই সম্প্রদায় মিলেমিশে বাস করে।
একশোটির মতো সংঘারাম আছে এখানে। দু’হাজারের কাছাকাছি ভিক্ষু সেখানে। হীনযানের সম্মতীয় শাখার উপাসক সবাই। নানাধরনের দেবমন্দির শ’খানেক রয়েছে। অসংখ্য বিধর্মী উপাসক সেখানে। তবে, পাশুপতদের সংখ্যাই বেশি।
এরাজ্যের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে এখন থেকে ৬০ বছর আগে এখানে শীলাদিত্য নামে এক রাজা ছিলেন। জ্ঞানী ও বিদ্বানরূপে তাঁর খুব খ্যাতি ছিল। ছিল উঁচুদরের সাহিত্য প্রতিভাও। চতুর্বিধ প্রাণীকে সযত্নে লালনপালন করতেন, গভীর শ্রদ্ধা করতেন ত্রিরত্নকে। সারা জীবনে কেউ তাঁকে কখনো এতটুকু রাগ করতে দেখেনি, কোন প্রাণীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি বা আঘাত করতে দেখেনি কখনো। যাতে কোন প্রাণী হত্যা না হয় এ জন্য তিনি তাঁর হাতি ও ঘোড়াদের ছাঁকনী দিয়ে ছেঁকে তারপর জল খেতে দিতেন। তাঁর পঞ্চাশ বছর রাজত্বকালে বন্য পশুদের সঙ্গেও মানুষের প্রীতির সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল। কোন লোক তাদের কোন ক্ষতি করতো না, তাদের হত্যা করতো না।
শীলাদিত্য তাঁর প্রাসাদের পাশেই একটি বিহার তৈরী করান। এটিকে সবরকম শিল্পকলায় সুষমামণ্ডিত করা হয়েছে। এখানে তিনি সপ্ত বুদ্ধের প্রতিমা গড়ে বসিয়েছেন। প্রতি বছর তিনি দেশের চারিদিক থেকে ভিক্ষুদের আমন্ত্রণ করে এনে ‘মোক্ষ মহাপরিষদ’ সম্মেলন বসাতেন। তাদের দানধ্যান করতেন। এ প্ৰথা এখনো এখানে চলিত রয়েছে।
রাজধানী থেকে উত্তর-পশ্চিমে ২০০ লি মতো গেলে ব্রাহ্মণদের একটি শহর (বা ব্রহ্মাণপুর-এর) দেখা পাওয়া যাবে। এর কাছে একটি গভীর খাদ আছে। তার পাশেই রয়েছে ছোট্ট একটি স্তূপ।
॥ ৬৫ ॥ ‘ও-চ-লি’ বা অটলি
দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যেতে যেতে এক উপসাগর কূলের দেখা পেলাম। সেখান থেকে উত্তর-পশ্চিমে চললাম এবার। ২৪০০ থেকে ২৫০০ লি পথ পেরিয়ে এসে পড়লাম ‘ও-চ-লি’ বা অটলি রাজ্যে।
রাজ্যটির পরিসর ছয় হাজার লির কাছাকাছি। কুড়ি লি খানেক এলাকা নিয়ে এর রাজধানীটি গড়ে উঠেছে। ঘন-জন বসতি ভরা। ভালো জাতের রত্ন পাথর ও মূল্যবান সামগ্রীর এক বিপুল ভাণ্ডার এ রাজ্যটি। ভূমিজাত ফসলাদির কোন রকম কিছু অভাব নেই। তাহলেও ব্যবসাই এদের প্রধান জীবিকা। জমি লবণাক্ত ও বালিভরা। ফুল ও ফল তাই অপর্যাপ্ত নয়।
এ অঞ্চলে হাটসিয়ান (hutsian) গাছ প্রচুর জন্মে। এ গাছের পাতাগুলি ঝে- চুয়েন গোলমরিচ গাছের (sz’chuen pepper) পাতার মতো দেখতে। হিয়ুন-লু (hiun-lu) সুগন্ধি গাছও এখানে জন্মে। এর পাতা থঙ-লি (thang-li) গাছের পাতার মতো।
এলাকাটির জল বাতাস গরম। বাতাস আর ধুলোর দাপটও রয়েছে। লোকজনের ধরন-ধারণ কেমন যেন নিস্পৃহ-নির্বিকার, ঠাণ্ডা। ধন-সম্পদই এদের কাছে সবকিছু, সদগুণাবলী দুচোখে বিষ। এখানকার বর্ণমালা, ভাষা, রীতিনীতি, আচার ব্যবহার, লোকদের শরীরের গড়ন-সবকিছুই মালব দেশের মতো। অটলির বেশির ভাগ লোকেরই পুণ্যকর্মের প্রতি কোন রকম আকর্ষণ বা বিশ্বাস নেই। যারা একটু বিশ্বাস করে তারা সকলেই দেব-ভক্ত। তাদের মন্দির রয়েছে এখানে হাজারখানেক। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিধর্মীরা সেখানে সমবেত হয়, বাস করে।
॥ ৬৬ ॥ ‘কিএ-চ’ বা কচ্ছ
মালব থেকে উত্তর-পশ্চিমদিকে পথ চলে ৩০০ লি খানেক পার হবার পর ‘কিএ-চ’ বা কচ্ছে যাওয়া যায়।
দেশটি আয়তনে তিন হাজার লির কাছাকাছি। কুড়ি লি রাজধানীর পরিধি। বেশ ঘন বসতি ভরা অঞ্চল। পরিবারগুলি বেশ সমৃদ্ধ ও ধনী। কোন স্থানীয় শাসক নেই। মালব রাজ্যের অধীন।
জলবায়ু, জমির ফসল, ফুলফলাদি, গাছপালা, লোকজনের আচার ব্যবহার ইত্যাদিতে দুদেশের মধ্যে গভীর সাম্য রয়েছে।
দশটির মতো সংঘারাম আছে। হাজারখানেক ভিক্ষুর বাস সেখানে। হীনযান ও মহাযান দুয়েরই চর্চ্চা করে তারা। বেশ কিছু (কয়েক দশ) দেবমন্দির রয়েছে। সেখানে অগুণতি বিধর্মী অনুগামী।
॥ ৬৭ ॥ ‘ফ-ল-পি’ বা বল্লভী
কচ্ছকে পিছনে ফেলে এবার উত্তরমুখো চলতে থাকলাম। লক্ষ্য হলো ‘ফ-ল-পি’ বা বল্লভী রাজ্য। প্রায় হাজার লি মতন পথ হাঁটার পর সেখানে পৌঁছলাম।
ছয় হাজার লি মতন অঞ্চল জুড়ে এ রাজ্যটি। রাজধানীর পরিসর ৩০ লির কাছাকাছি। মাটির রকম, জলবায়ু, মানুষজনের চালচলন আচার ব্যবহার সবকিছুই মালব রাজ্যের মতো।
বেশ ঘন বসতি ভরা জায়গাটি। পরিবারগুলি ধনী ও সচ্ছল। কয়েকশো পরিবার আছে যারা রীতিমতো কোটিপতি। দূর অঞ্চল থেকে নানারকম মূল্যবান পণ্যসম্ভার এসে এখানে পাহাড় হয়।
একশোর মতো সংঘারাম হবে এখানে। ভিক্ষুর সংখ্যা হাজার ছয়েক। বেশির ভাগই সম্মতীয় শাখানুগামী হীনযানপন্থী। দেব মন্দিরও শ’খানেক। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রচুর বিধর্মীর বাস সেখানে।
বুদ্ধদেব প্রায়ই এদেশে আসতেন। এজন্য রাজা অশোক বুদ্ধের বিশ্রাম স্থানগুলিতে স্মারক বা স্তূপ বানিয়েছেন। এগুলির মধ্যে অপর তিন বুদ্ধের ভ্রমণ স্থানগুলিও আছে।
বর্তমান রাজা ক্ষত্রিয় বর্ণের লোক। তিনি মালবের শীলাদিত্য রাজার ভাইপো। কন্যাকুজের (কান্যকুব্জ) বর্তমান রাজা শিলাদিত্যের জামাই। তাঁর নাম ধ্রুবপট (বা ধ্রুব ভট্ট)। তিনি বেশ সজীব ও ব্যস্তবাগীশ স্বভাবের। প্রজ্ঞা ও শাসন দক্ষতা অগভীর। অতি সম্প্রতি তিনি বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী হয়েছেন। প্রতিবছর তিনি এক মহাসম্মেলন ডাকেন। সাতদিন ধরে সেখানে নানা মূল্যবান ধনরত্ন, সুস্বাদু সব মিষ্টান্ন দান করেন। ভিক্ষুদের ত্রিবিধ পোষাক, ওষুধ বা তার দাম ও মূল্যবান সপ্তরত্নে তৈরী নানা রকম বস্তু বিতরণ করে থাকেন। এসব দান করে আবার দ্বিগুণ মূল্যে নিয়ে নেন। তিনি সদগুণাবলীর কদর করেন। ভালো কাজকে সম্মান দেখান। যাঁরা প্রজ্ঞার জন্য খ্যাতিবান তাঁদের বিশেষভাবে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন। যেসব বড়ো বড়ো ভিক্ষু দূর দূর অঞ্চল থেকে আসেন তাঁদের তিনি বিশেষ করে শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখান।
শহর থেকে একটুখানি দূরে একটি বড়ো সংঘারাম আছে। এটি অর্থৎ আচার- এর গড়া। গুণমতি ও স্থিরমতি বোধিসত্ত্ব ভ্রমণ পথে এখানে কিছুকাল থেকে প্রবন্ধ গ্রন্থাদি রচনা করেন। এই রচনাগুলি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে।
॥ ৬৮ ‘ও-নন-তো-পু-লো’ বা আনন্দপুর
এবার উত্তর-পশ্চিমদিকে রওনা হওয়া গেল। যাবো ও-নন-তো-পু-লো বা আনন্দপুর। সাতশো লি মতন পথ ভাঙতে হলো সেজন্য।
রাজ্যটি দুই হাজার লি আয়তনের। রাজধানী গড়ে উঠেছে ২০ লি মতো এলাকা জুড়ে। ঘন বসতি ভরা। পরিবারগুলি বেশ ধনী। কোন স্থানীয় রাজা নেই। মালব রাজ্যের অধীন।
এখানকার কৃষিজাত দ্রব্যাদি, জল বাতাস, সাহিত্য, আইন-কানুন সব কিছুই মালব দেশের মতো।
সংঘারাম আছে প্রায় দশটি। হাজারের কিছু কম ভিক্ষু আছেন। তারা হীনযানের সম্মতীয় শাখার অনুগামী। বেশ কিছু দেবমন্দির রয়েছে (কয়েক দশ)। এগুলি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিধর্মীয়দের বিচরণ ক্ষেত্র।
॥ ৬৯ ॥ ‘সু-লো-চ’ বা সুরাষ্ট্র
বল্লভী থেকে পশ্চিমে গেলাম এবার। ৫০০ লি যাবার পর দেখা পেলাম ‘সু-লো-চ’ বা সুরাষ্ট্র রাজ্যের।
দেশটির আয়তন চার হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানীর পরিধি তিরিশ লি। রাজধানীর পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে মাহী নদী চলে গেছে। বেশ ঘন বসতি ভরা অঞ্চলটি। বাসিন্দারা সচ্ছল ও ধনী। রাজ্যটি বল্লভীদের অধীন।
এ অঞ্চলের মাটি নোনা। ফল ও ফুলের ছড়াছড়ি তাই বেশ কম। আবহাওয়া গা-সওয়া গোছের হলেও ঝড় ঝঞ্ঝার বিরাম নেই। লোকজন যত্নহীন, নির্বিকার নিস্পৃহ ধরনের। লঘু ও অস্থির-মতি স্বভাব। লেখাপড়া, জ্ঞানচর্চ্চার দিকে কোন শ্রদ্ধা বা আগ্রহ নেই। সত্যধর্মী ও অন্যধর্মী দু-ই রয়েছে।
পঞ্চাশটি মতো সংঘারাম আছে। সেখানে হাজার তিনেক ভিক্ষুর বসবাস। তাদের বেশীর ভাগই মহাযানের স্থবির শাখার অনুগামী। শ’খানেক দেবমন্দির রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিধর্মীতে সেগুলি ভরা।
এ রাজ্যটি পশ্চিম সাগর পথে অবস্থিত। এজন্য সাগর-নির্ভর জীবিকাগুলি ও ব্যবসা বাণিজ্য এদের আয়ের প্রধান পথ।
এই শহর থেকে খানিকটা গেলেই উদুন্ত পাহাড়। এর উপর একটি সংঘারাম আছে। পাহাড়ের গা কেটে বেশীর ভাগ কক্ষ ও বারান্দাগুলি বানানো হয়েছে। পাহাড়টি ঘন বন জঙ্গল ও গাছগাছালিতে ভরা। কয়েকটি ঝরনা একে ঘিরে বয়ে চলেছে। মুনি-ঋষিদের বিচরণ ও বাসের জায়গা এটি।