ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশ, হিউয়েন সাঙ ও তার ভ্রমণ পথ

ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশ, হিউয়েন সাঙ ও তার ভ্রমণ পথ

মানুষ শান্তি ও শৃঙ্খলার মধ্যে তৃপ্ত ও সুখী জীবন যাপন করছে, নির্ভয়ে যখন যেখানে খুশি যেতে পারছে, বসবাস করতে পারছে-ভারতে এসে পরিব্রাজক ফা- হিয়েন এ দৃশ্যই দেখে গেছেন। তিনি এদেশে আসেন হিউয়েন সাঙ থেকে প্রায় ২৩০ বছর আগে, খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর একেবারে আরম্ভে। গুপ্তবংশীয় সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বের শেষ ভাগ তখন। পুরো দেশ রাজনৈতিক দিক থেকে সুসংহত, বিদেশী শত্রুর ভয়মুক্ত।

হিউয়েন সাঙও তৃপ্ত ও সুখী মানুষ দেখেছেন, মানুষের সম্পদ ও ঐশ্বর্য দেখেছেন, বিলাসিতা প্রত্যক্ষ করেছেন। পাশাপাশি আবার দেখেছেন দারিদ্র্য চোর-লুটেরা-ডাকাতের উপদ্রব, নিয়ম-শৃঙ্খলার তুলনামূলক অভাব বা অবনতি।

দরিদ্র ও ভিখারি অবশ্য ‘রাম-রাজত্বে’ও ছিল। ইতিহাস লিখতে বা পড়তে গিয়ে সেদিকে আমরা দৃষ্টি দিই না। জাঁকজমক, আড়ম্বর, ধন-সম্পদ, দান-ধ্যান ইত্যাদি দেশ ও সমাজের আলোর জৌলুষের দিকেই তাকাই, রাতের অন্ধকার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকি।

হিউয়েন সাঙ এদেশের মাটির উর্বরতা দেখে, প্রচুর শস্য, ফুল, ফলের ফলন দেখে অভিভূত হয়েছেন। প্রাকৃতিক শোভা, শিল্পকলা, ভাস্কর্য দেখে হয়েছেন মুগ্ধ ঐশ্বর্যের পরিচয় লেখা বাড়ি ঘর, বিলাসিতা, আড়ম্বর, প্রাচুর্য, দান-ধ্যান তাঁকে অবাক করে দিয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি অন্য চিত্রটিও তাঁর নজর এড়ায়নি। পাঞ্জাবের টক্ক রাজ্য ঘুরে বেড়াবার সময় তিনি লক্ষ্য করেছেন ও বলেছেন ‘আগে এ দেশটিতে গরিব ও অনাথদের থাকার জন্য অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ছিল। তারা এদের ওষুধপত্তর, খাদ্য, কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য জিনিষপত্র বিতরণ করতো। এর ফলে ভ্রমণকারী বা পথচারীদের যথাসর্বস্ব, তেমন কেড়ে নেওয়া হতো না’। এই মন্তব্যে হিউয়েন শুধু চোর-লুটেরার কথাই বলেননি, তাদের উপদ্রব বৃদ্ধির কারণের আভাসও কিছুটা দিয়েছেন।

দক্ষিণ ভারতের চোল রাজ্যের কথা বলতে গিয়ে হিউয়েন জানিয়েছেন ‘লুটেরা-ডাকাতের দল এখানে সবার চোখের সামনে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ এই উপদ্রব শুধু যে টক্ক আর চোল রাজ্যেই ছিল তা নয়। পথে লুটেরা-ডাকাতদের উপদ্রবের কথা তিনি অনেক জায়গাতেই উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজেও বার চারেক এদের কবলে পড়েন বলে তার জীবনীতে বলা হয়েছে। এমনকি খোদ হর্ষবর্ধন শিলাদিত্যের রাজ্য মধ্যে অযোধ্যা ও প্রয়াগের মধ্যবর্তী হয়মুখ রাজ্য দিয়ে প্রয়াগ আসার পথে তিনি জলদস্যুদের হাতে পড়েন।

জীবনী মধ্যে ওই সব ঘটনার যে রকম অলৌকিক পরিসমাপ্তি দেখানো হয়েছে তাতে এরকম ধারণা স্বাভাবিক যে বৌদ্ধ ধর্ম ও বিশেষভাবে হিউয়েন— সাঙ-এর মহিমা বাড়ানোর জন্যই বোধহয় ওই ঘটনাগুলি কল্পনা করা হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলেও তা যে বাস্তব পরিস্থিতির ভিতের উপর গড়া কল্পনা-হিউয়েনের বিবরণই সেকথা বলে দেয়। সুতরাং অতিরঞ্জিত হলেও ওই সব ঘটনা নিছক কল্পিত কাহিনী বলে মনে করা চলে না।

সারা ভারত ঘুরে বেড়ানোর কালে হিউয়েন অনেক শহর, পুরানো রাজধানী, অনেক গ্রাম, এমনকি এক একটি রাজ্যকেও ক্ষয়িষ্ণু ও জন-বিরল অবস্থায় দেখেছেন। গান্ধারের কথা বলেছেন ‘এর শহর ও গ্রামগুলি প্রায়-পরিত্যক্ত, খুব অল্প লোকই এখন এখানে বাস করে।’ উত্তর ভারতে কপিলাবস্তুর কাছে থাকা ‘লান-ম’ বা ‘রাম’ রাজ্যটি সম্পর্কে বলেছেন ‘এ রাজ্যটি বহুকাল চাষ-আবাদহীন জন-মানব শূন্য হয়ে পড়ে ছিল। …শহরগুলির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা। অধিবাসীর সংখ্যা সামান্য।’ উত্তর-পশ্চিম বাঙলায় গঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা কজুঘীরা বা কজঙ্গল রাজ্যের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন ‘একটি পড়শী রাজ্য এখন একে শাসন করছে। এজন্য এর শহরগুলোতে মানুষজন একরকম নেই বললেই চলে। বেশীর ভাগ লোকই গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।’ কলিঙ্গ রাজ্যের বেলায় বলেছেন ‘আগে এখানে খুব ঘনবসতি ছিল। এক ঋষির ক্রোধে পরে জনশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর বাইরের লোক এসে ধীরে ধীরে এখানে বসবাস শুরু করে। তবু এখনো যথেষ্ট জনবসতি গড়ে ওঠেনি।

এ নিশ্চয়ই দেশের সর্বত্র সব স্তরের মানুষের মধ্যে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির মনোরম ছবি নয়। যুদ্ধ বিগ্রহে নড়বড়ে, অর্থনীতি ও আইন-শৃঙ্খলায় ভাঁটা দেখা দেয়া এক জনসমাজের ছবি।

ষষ্ঠ শতাব্দীর আরম্ভে গুপ্ত সাম্রাজ্যে ভাঙন শুরু হয়। এর ফলে যে রাজনৈতিক একাত্মতার অভাব ও শক্তি-শূন্যতা দেখা দিতে আরম্ভ করে তা বিদেশী শক্তিকে আবার ভারতের দিকে লোভের থাবা বাড়াতে উৎসাহিত করে তোলে। তোরমান ও তার ছেলে মিহিরকুলের নেতৃত্বে হুণরা আগের চেয়েও প্রবল বেগে হানা দিতে থাকে ভারতের জনজীবন ও রাজনৈতিক স্থিতি টলোমলো করে তোলে। মালবের যশোধর্মণ ও মগধের গুপ্ত রাজা বালাদিত্যের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত তাদের থাবা ভেঙে গেলেও তাদের দুজনের কারো পক্ষেই দেখা দেওয়া একাত্মতার অভাব ও শক্তি-শূন্যতা দূর করা সম্ভব হয়নি। যশোধর্মণ উল্কার মতোই দেখা দেন ও মিলিয়ে যান।

সপ্তম শতাব্দীর আরম্ভে গৌড় বা কর্ণ-সুবর্ণের রাজা শশাঙ্কও সম্ভবতঃ ওই অভাব ও শূন্যতা দূর করতে চেয়েছিলেন। তার সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আসেন স্থানেশ্বরের পুষ্পভূতি রাজবংশের হর্ষবর্ধন শিলাদিত্য। শশাঙ্ককে তিনি পরাস্ত করতে না পারলেও তার অগ্রগতি যে রোধ করে দিয়েছিলেন এতে সন্দেহ নেই। মৃত্যুর পর শশাঙ্কের গড়া রাজ্য হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

হর্ষবর্ধনের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দেখা দেন মহারাষ্ট্রের চালুক্যবংশীয় রাজা দ্বিতীয় পুলকেশী। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে তিনি হর্ষবর্ধনের অগ্রগতি স্তব্ধ করে দেন। পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমে বিপাশা নদী পার হওয়াও হর্ষবর্ধনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সে অঞ্চলে তখন কপিশা, উদ্যান, কাশ্মীর ও টক্কের শাসনাধীন একটি রাজ্য (লঙলা) পারস্যের অধিকারে। নেপাল ও কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষপুরও হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বাইরে ছিল।

বিপাশা নদীর এপারে অবশিষ্ট উত্তরাপথে হর্ষবর্ধন কতখানি সাফল্য অর্জন করেছিলেন তা এখনো গবেষণার বিষয়। হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ধনের আমলে এদেশে আসেন। তিনি তাঁর অবারিত প্রশংসা প্রশস্তি করেছেন। তাঁকে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সমগ্র ভারত (উত্তরাপথ)-এর একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাঁর বিবরণ ভুলত্রুটি ও অতিরঞ্জন বৰ্জিত নয়।

হিউয়েনের জীবনী বইটিতে তাঁর নিজের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব বাড়ানোর জন্য, তিনি নিজেই হোন অথবা তাঁর শিষ্যরা হোন, বেশ কিছুটা অতিরঞ্জনের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এর ফলে মূল বইয়ে থাকা হর্ষবর্ধন, শীলাদিত্য ও কামরূপের ভাস্করবর্মণ এবং এদের সঙ্গে হিউয়েনের সম্পর্ক গড়ে ওঠার বর্ণনার সঙ্গে জীবনী বইয়ে থাকা বর্ণনার কিছুটা গরমিল দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়। যেমন মূল বইতে হিউয়েন জানিয়েছেন— কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মণ তিন তিনবার নিমন্ত্রণ পাঠালেও তিনি যাননি। তখন নালন্দার আচার্য শীলভদ্র তাঁকে যাবার জন্য উপদেশ দেন। এরপর তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য দূতের সঙ্গে কামরূপ যাত্রা করেন। কিন্তু জীবনী বইতে বলা হয়েছে, ভাস্করবর্মণ হিউয়েনকে পাঠাবার জন্য দু’ দুবার শীলভদ্রের কাছে দূত মারফত পত্র পাঠান। কিন্তু ‘সে যে শীঘ্রই দেশে চলে যাবে’ এই অজুহাত দেখিয়ে না করে পাঠান। শেষে ভাস্করবর্মণ ক্ষেপে গিয়ে হুমকি দিয়ে পত্র দেন যে যদি হিউয়েনকে না পাঠানো হয় তবে শশাঙ্ক রাজা যেভাবে বৌদ্ধ-ধর্মের নাশ করেন ও বোধিবৃক্ষ ধ্বংস করেন তিনিও ঐভাবে সেনা ও হাতি পাঠিয়ে নালন্দা মহাবিহার গুঁড়িয়ে দেবেন। তখন শীলভদ্র তাঁকে যাবার উপদেশ দেন। ভাস্করবর্মণ কি এতই আহাম্মক ছিলেন যে একজন বৌদ্ধ শ্রমণের জন্য তিনি নালন্দা মহাবিহার গুঁড়িয়ে দিতে চাইবেন। বিশেষ করে যে মহাবিহার আবার তাঁর নিজের রাজ্যে নয়, সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজ্যে। ভাস্করবর্মণ বৌদ্ধও ছিলেন না। হিউয়েনের বিবরণ মতো তিনি ছিলেন বিষ্ণু উপাসক ও ব্রাহ্মণ। শীলাদিত্যকে কেন্দ্র করেও এই একই ধরনের অবিশ্বাস্য ঘটনার আমদানি হয়েছে সেখানে।

জীবনী বইটিতে যেরকম অলৌকিকত্বের ছোঁয়াচ লেগেছে সে তুলনায় মূল বইটি কিন্তু খুব স্বাভাবিক। ধর্মীয় প্রসঙ্গ ও উপাখ্যানগুলিকে বাদ দিলে বাকি অংশ সহজ, সরল, স্বাভাবিক। হিউয়েন সরলভাবে নিষ্ঠার সঙ্গেই সব তুলে ধরতে চেয়েছেন। এমনকি বৌদ্ধ হয়ে অন্য ধর্মীদের মন্দির কিংবা বিগ্রহের বর্ণনা ও তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে তার আটকায়নি। আটকায়নি অন্যধর্মী পণ্ডিতদের ও প্রশংসা করতে, শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখাতে। এসব ক্ষেত্রেও তার মনের স্বাভাবিক মানবিক সৌন্দর্য, তার ভেতরের জ্ঞান-শিল্পকলা-সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষটি চমৎকারভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

ধর্মীয় অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী এই মানুষটি অলৌকিকতার ক্ষেত্রেও কিন্তু বৈষম্য করেন নি। যেমন তিনি বৌদ্ধ বোধিসত্ত্ব মূর্তি, বুদ্ধমূর্তি, স্তূপ, দেহাবশেষের অলৌকিকত্ব বর্ণনা করেছেন, তেমন হিন্দু দেব-দেবী বিগ্রহ বা মন্দিরের অলৌকিকত্ব ও মহিমা ব্যক্ত করতে কুণ্ঠিত হননি, বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি। যখন তিনি স্তূপ, মূর্তি বা দেহাবশেষ থেকে জ্যোতি বিকীর্ণ হওয়ার কথা বলেন তা পড়ে অবশ্য আমাদের হাসি পায়। কিন্তু তিনি যে মিথ্যে কথা বলেন নি তার পরিচয় পাওয়া যায় জীবনীতে বিবৃত একটি ঘটনা থেকে।

বৌদ্ধ পূর্ণিমায় হিউয়েন সাঙ একবার অপর এক বিখ্যাত পণ্ডিত জয়সেনকে নিয়ে বুদ্ধ-গয়ায় উৎসব দেখতে যান। এই উৎসবের সময় সেখানকার বোধিবিহার- এ বুদ্ধের দেহাস্থি দেখানো হয়ে থাকে। হিউয়েনও জয়সেনকে সঙ্গে নিয়ে তা দেখতে গেলেন। এর মধ্যে ছোট ও বড়ো দু রকম দেহাস্থিই ছিলো। বড়োগুলি গোল মুক্তার মতো। চক্‌চকে উজ্জ্বল। রক্তাভ হলদে রঙের। চামড়ার নিদর্শনও রয়েছে। বরবটীর বিচির মতো আকারের, দেখতে উজ্জ্বল লাল। দেখে ফিরে এসে রাতে জয়সেন দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অস্থির আকারের সঙ্গে তার অসাম্য নিয়ে আলোচনা করতে করতে হিউয়েনকে বললেন— ‘আপনি তো অনেক জায়গাতেই দেহাস্থি অবশেষ দেখেছেন। সবগুলিই চালের দানার মতো ছোট ছোট। তাহলে এখানকার এগুলো এতো বড়ো বড়ো হলো কী করে? এ ব্যাপারে আপনার মনে কি সন্দেহ দেখা দিচ্ছে না?’

হিউয়েন উত্তর দিলেন—’হ্যাঁ, আপনার মতো আমার মনেও এ ব্যাপারে সন্দেহ জাগছে।’

এর কিছুক্ষণ পরেই বিহারটিতে থাকা সবগুলি বাতি হঠাৎ নিভে গেল। আচমকা এক অলৌকিক আলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। তাঁরা তাকিয়ে দেখলেন, অস্থি থাকা সেই স্তূপটি থেকে সূর্যের মতো আলো ও জ্যোতি বিকীর্ণ হচ্ছে। স্ত পটির চূড়া থেকে পাঁচরঙা চঞ্চল আলোকশিখা আকাশ ছুঁয়েছে। চারিদিক আলোয় আলোময়। সে আলোয় চাঁদ আর তারা ম্লান হয়ে গেছে। এক মৃদু সুরভিতে বিহারের পরিমণ্ডল ভরে উঠেছে।

চারিদিকে জোর হৈ হৈ উঠলো, ‘শরীর (দেহাস্থি বা দেহাবশেষ) তার অলৌকিক ক্ষমতা দেখাচ্ছে।’ সকলে সেখানে ছুটে গেলো। এ দৃশ্য দেখে গদগদ হয়ে উঠলো প্রশংসায়। আলো ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে যেতে থাকলো, বার কয়েক স্তূপের চূড়ায় পাক খেয়ে স্তূপের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ফিরে এলো চারিদিকে আগের সেই অন্ধকার। আকাশের তারাগুলিকে চোখে দেখা সম্ভব হলো আবার। এই অলৌকিক ঘটনা চোখে দেখে সবাই তাদের মধ্যে থাকা সবরকম সন্দেহ ও সংশয় মুক্ত হলো।

যে সব বৌদ্ধ স্তূপ, দেহাস্থি বা মূর্তি থেকে জ্যোতি বিকিরণের কথা হিউয়েন জানিয়েছেন সে সব স্থানে এভাবেই জ্যোতি বিকীর্ণ করানো হতো। সব থেকে বেশি জ্যোতি বিচ্ছুরিত হবার কথা হিউয়েন বলেছেন রাজা অশোকের গড়া স্তূপগুলি প্রসঙ্গে। বইটিকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য সে বিবরণ অবশ্য এখানে বাদ দেওয়া হয়েছে।

বাদ দেওয়া হয়েছে প্রাচীন আখ্যায়িকা ও গাল-গল্পগুলোও। পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ধর্ম কোন অতলে খসে গিয়েছিল, কীরূপ মিথ্যার পসরা তৈরী করেছিল, এগুলি তারই উদাহরণ। সব ধর্মেই এগুলি সমান রয়েছে। আগেও ছিল, এখনো আছে। অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী ও তার বাস্তব মহিমায় (অজ্ঞ সাধারণ মানুষের উপর তার প্রভাব দেখে) অভিভূত হিউয়েন এখানে এসে যা দেখেছেন ও শুনেছেন তাকেই সাংবাদিকের মতো লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর মূল বইটিতে। এসব তৎকালীন তথাকথিত ধর্মীয় পরিবেশ। ধর্মের মহিমা বাড়াতে গিয়ে তাঁরা নানা গালগল্প অতিরঞ্জনের দ্বারা ইতিহাসকে বিকৃতির অতলে তলিয়ে দিতেও পিছপা হননি। তাই পঁচিশ, পঞ্চাশ বা একশো বছর আগেকার ঘটনাও অবিকৃতভাবে পাওয়া যায় না। তাই হিউয়েন রাজা শশাঙ্ক বা হুণ রাজা মিহিরকুলের বিবরণ অবিকৃতভাবে আমাদের দিয়ে যেতে পারেননি। বৌদ্ধ ধর্মের শত্রু হিসাবে দুজনকেই সমানভাবে দুর্জন সাজিয়েছেন। আর এই ভারতীয় বিকৃতির ছোঁয়াচ হিউয়েনের গায়েও যে শেষ পর্যন্ত লেগেছিল তার পরিচয় তাঁর জীবনী বইটি ও রাজা হর্ষবর্ধন শীলাদিত্যের বিবরণ। বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করার দরুন হর্ষবর্ধন নিশ্চয়ই একজন সুজন। রাজা অশোক ও কণিষ্কের মতোই তাঁর কীর্তি ও মহিমার অতিরঞ্জন আবশ্যক। অতএব অবলোকিতেশ্বর আবির্ভাব ও কর্ণসুবর্ণের রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধ ধর্মের যে ক্ষতিসাধন করেছে তার ক্ষত মুছে দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের জন্য হর্ষবর্ধনের প্রতি তার আদেশ-এসব গালগল্প শোনাতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। বলতে বাধেনি ‘তাঁর সৈন্যরা অবিরাম গতিতে এগিয়ে চললো। পূর্ব থেকে পশ্চিমে সবাইকে তিনি অধীনে আনলেন। দখল করলেন ছয় বছরের মধ্যে পুরো পঞ্চসিন্ধু।’ হর্ষবর্ধন ও তার ভাই-বাবা-পূর্বপুরুষরা যে মূলতঃ কনৌজের রাজবংশ নন, থানেশ্বরের রাজবংশ এই সাধারণ সংবাদটি যিনি জানেন না, তিনি শীলাদিত্যের সঙ্গে অবলোকিতেশ্বর বোধি-সত্ত্বের দেখাসাক্ষাতের ঘটনাটি কী করে জানলেন এ প্রশ্ন অবশ্যাই আমরা করতে পারি। মনে হয়, তার সম্পর্কে তিনি বিশদভাবে কোন খোঁজ খবর নেন নি। যা নিজের চোখে দেখেছেন, যা বৌদ্ধ মহলের পরিচিত পাঁচজনের কাছ থেকে শুনেছেন তার উপরেই লিখেছেন। কোন লোক বড়ো হলে তাকে নিয়ে আমাদের দেশে দেখতে দেখতে নানা স্বাদু গল্প, কিংবদন্তী গড়ে ওঠে। অবলোকিতেশ্বরের সঙ্গে শীলাদিত্যের দেখাসাক্ষাৎ সম্ভবতঃ বৌদ্ধ মহল থেকে ছড়ানো সেই ধরনেরই এক স্বাদু গল্প।

রাজা শশাঙ্ক সম্পর্কে যে সব বিবরণ এখানে রয়েছে তা কতদূর সত্য তা নিয়ে স্বতঃই সন্দেহ জাগে। যিনি নিজের মূল রাজ্য কর্ণসুবর্ণের সংঘারাম ও স্ত পগুলি অক্ষত রাখলেন তিনি কেন মগধে গিয়ে সেখানকার সংঘারাম ভাঙতে গেলেন, বোধিবৃক্ষ কাটতে গেলেন, বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত পাথর গঙ্গায় ফেলে দিতে গেলেন? কেনই বা সেখানকার বৌদ্ধ বিহার থেকে বুদ্ধের মূর্তি সরিয়ে মহেশ্বর মূর্তি স্থাপনের আদেশ করলেন? সমস্ত ব্যাপারটাই গালগল্প বলে মনে হয়। অধিকার বিস্তার করতে গিয়ে শশাঙ্ক যেসব রাজাকে উচ্ছেদ ও পদানত করেন তাদের অনেকেই বোধ হয় বৌদ্ধধর্মী বা তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এর ফলে বৌদ্ধধর্ম তাদের পৃষ্ঠপোষণা থেকে বঞ্চিত হয়ে সম্ভবতঃ সামগ্রিকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও শশাঙ্ককে বৌদ্ধ-ধর্মের শত্রুরূপে মনে করতে শুরু করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে হর্ষবর্ধনের বড়ো ভাই রাজ্যবর্ধন, যাকে শশাঙ্ক হত্যা করেন বলে জানা যায়, বৌদ্ধ ছিলেন। বরঞ্চ হর্ষবর্ধনই পুরোপুরি বৌদ্ধধর্মানুরাগী ছিলেন কিনা এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। তার রাজকীয় মোহর ও অন্য দুটি লেখা থেকে মনে হয় যে তিনি শৈব ধর্মানুরাগী ছিলেন। বোধিবৃক্ষের কাছে থাকা বৌদ্ধ বিহারটি সম্পর্কে যে কিংবদন্তী হিউয়েন সাঙ শুনিয়েছেন তা থেকে সন্দেহ উঁকি দেয় যে সেটি সম্ভবতঃ আগে একটি শিব বা মহেশ্বর মন্দির ছিল ও পরে তাকে বৌদ্ধ বিহারে পরিণত করা হয়। হয়তো বা সেই কারণেই শশাঙ্ক তাকে আবার মহেশ্বর মন্দিরে রূপায়িত করার আদেশ দেন। যাই হোক, এ সম্পূর্ণই অনুমান। রাজা শশাঙ্ক সম্পর্কে সত্য ঘটনা জানার জন্য আমাদের তথ্যের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

হিউয়েন সাঙ তাঁর বিবরণে সিংহল নিয়ে মোট ৮২টি রাজ্যের কথা বলেছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করা যেতে পারে। কেননা, উত্তর ভারত তিনি যতোটা ব্যাপকভাবে ঘুরেছেন, দক্ষিণ ভারতে ততো ব্যাপক ঘোরেননি। ফলে সেখানকার কিছু রাজ্যের কথা স্বভাবতাই তার বিবরণ মধ্যে বাদ পড়েছে। কিন্তু ভারতের কথা সামগ্রিকভাবে বলার বেলায় বলেছেন ‘সমগ্র ভূ-ভাগ সত্তরটি বা কিছু কম-বেশী দেশে বিভক্ত।’ এই ব্যতিক্রমের দুরকম কারণ হতে পারে। (১) তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন সমগ্র দেশটি ৭০-এর কাছাকাছি রাজা-শাসিত অঞ্চলে বিভক্ত। (২) অথবা তিনি যে ১১টি রাজ্যকে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য বলেছেন তাকে এই হিসাব থেকে বাদ দিয়েছেন।

হিউয়েন কপিশা থেকে পূর্বদিকে এগিয়ে প্রায় ৬০০ লি পথ পার হবার পর ভারতের উত্তর সীমান্তে পা রাখেন। যে জায়গাটিতে তিনি আসেন সেটি হলো লম্পক বা লামঘান রাজ্য। সেখান থেকে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য বলে অভিহিত ২১টি দেশ তিনি এভাবে ঘুরে দেখেন—(১) লম্পক-(২) নগরহার-(৩) গান্ধার- (৪) উদ্যান-(৫) বোলর-গান্ধার-(৬) তক্ষশীলা-(৭) সিংহপুর-(৮) উরস-(৯) কাশ্মীর-(১০) পুনচ-(১১) রাজপূরী।

জীবনীতে ৫-বোলর-কে এই ভ্রমণ পথ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তার বদলে, ভারত থেকে ফিরে যাবার বেলায় পামির উপত্যকা অতিক্রম করার সময়ে পামিরের দক্ষিণে এক পর্বতমালার ওপারে এ দেশটি অবস্থিত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বোধ হয়, এটি ভারতের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে পড়ে না বলে এই পরিবর্তন করা হয়েছে।

রাজপুরী থেকে হিউয়েন একের পর এক যান (১২) টক্ক (১৩) চীনাপতি (১৪) জালন্ধর (১৫) কুলুত (১৬) শতদ্রু (১৭) পারিযাত্র (১৮) মথুরা (১৯) স্থানেশ্বর (২০) শ্রুঘ্ন (২১) মতিপুর (২২) ব্রহ্মপুর।

ব্রহ্মপুরের পর হিউয়েন পর্বতমালার মধ্যে প্রমীলারাজ্য (২৩) হিরণ্যগোত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু সেখানে যাননি।

এরপর (২২) ব্রহ্মপুর থেকে নিচের দিকে নেমে, আসেন (২৪) গোবিসান ও সেখান থেকে (২৫) অহিক্ষেত্র বা অহিচ্ছত্র। জীবনীতে কিন্তু গোবিসান বাদ গেছে। (২৫) অহিক্ষেত্র থেকে এবার তিনি একের পর এক ঘুরলেন (২৬) বীরসান (২৭) কপিত্থ (২৮) কনৌজ (২৯) অযোধ্যা (৩০) হয়মুখ (৩১) প্রয়াগ (৩২) কৌশাম্বী (৩৩) বিশাখা (বিশোক)? (৩৪) শ্রাবস্তী (৩৫) কপিলাবস্তু (৩৬) রাম বা রাম গ্রাম (৩৭) কুশীনগর (৩৮) বারানসী (৩৯) গর্জপুর বা ঘাজিপুর (৪০) বৈশালী।

মূল বইয়ের বিবরণ অনুসারে এরপর হিউয়েন (৪১) বৃজি ও (৪২) নেপাল গিয়ে আবার (৪০) বৈশালী ফিরে আসেন ও সেখান থেকে (৪৩) মগধ উপস্থিত হন।

কিন্তু জীবনীতে বৃজি ও নেপালকে বাদ দেয়া হয়েছে। এজন্য তিনি ওই দুটি রাজ্যে প্রকৃতই গিয়েছিলেন কিনা এ নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়।

৬২৯ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে হিউয়েন সাঙ চীন থেকে যাত্রা শুরু করেন। ৬৩০-এর সেপ্টেম্বরে ভারত সীমানায় পদার্পণ করেন। ৬৩১-এর মে মাসে তিনি কাশ্মীর আসেন ও ৬৩৩ এপ্রিল পর্যন্ত পুরো দুবছর সেখানে অধ্যয়ন করে কাটান। এরপর আবার যাত্রা শুরু করেন। চীনাপতিতে পৌঁছে বিশিষ্ট পণ্ডিত বিনীতপ্রভের কাছে ১৪ মাস থেকে অধ্যয়ন করেন। তারপর জালম্বরে আচার্য চন্দ্রবর্মার কাছে চার মাস অধ্যয়নের জন্য থাকেন। এরপর শ্রুঘ্ন রাজ্যেও তিনি আচার্য জয়গুপ্তের কাছে ছয় মাস কাটান। তারপর মতিপুর এসেও তিনি গুণপ্রভের শিষ্য মিত্রসেনের কাছে ছয় মাস অধ্যয়নের জন্য থাকেন। ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কনৌজ আসেন। ৬৩৬-এ মগধে ও নালন্দা মহাবিহারে।

৬৩৯-এ তিনি আবার ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। এবার যান একে একে (৪৪) হিরণ্য পর্বত (৪৫) চম্পা (৪৬) পুণ্ড্রবর্ধন।

এর মধ্যে হিরণ্য পর্বত রাজ্যে তথাগত গুপ্ত ও ক্ষান্তি সিংহের কাছে এক বছর অধ্যয়ন করে কাটান।

মূল বইতে (৪৭) পুণ্ড্রবর্ধনের পর (৪৮) কামরূপ (৪৯) সমতট (৫০) তাম্রলিপ্ত (৫১) কর্ণসুবর্ণ-এর বিবরণ রয়েছে। কিন্তু জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি কামরূপ অনেক পরে গিয়েছিলেন। সেখানে এই সময়কার ভ্রমণ পথ রয়েছে।

(৪৭) পুণ্ড্রবর্ধন-(৫১) কর্ণসুবর্ণ-(৪৯) সমতট-(৫০) তাম্রলিপ্ত। এই পথই ঠিক বলে মনে হয়।

এরপর তিনি যান (৫২) উড্র (৫৩) কঙ্গোদ (৫৪) কলিঙ্গ (৫৫) কোশল (৫৬) অন্ধ্র (৫৭) ধনকণ্টক (৫৮) চোল (৫৯) দ্রাবিড়।

হিউয়েন (৬১) সিংহলে যাবার জন্য এপথ ধরে এগিয়ে চলছিলেন। কিন্তু দ্রাবিড়ের রাজধানী কাঞ্চীপুরে দুজন সিংহলীয় শ্রমণের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। তাদের কাছে জানতে পেলেন যে সিংহলের রাজা মারা গেছেন, রাজ্যে দুর্ভিক্ষ ও বিশৃঙ্খলা চলছে। এজন্য তারা ৩০০ জনের মতো ভিক্ষু এদেশে চলে এসেছেন। শুনে তিনি সেখানে যাবার বাসনা ত্যাগ করলেন। (৬০) মালকূট বা মহীশূর অঞ্চল দেখে ফিরে এলেন দ্রাবিড়ে। সেখান থেকে সিংহলী শ্রমণদের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লেন। গেলেন একে একে (৬২) কঙ্কণপুর (৬৩) মহারাষ্ট্র (৬৪) ভরুকচ্ছ (৬৫) মালব (৬৬) অটলি (৬৭) কচ্ছ (৬৮) বল্লভী (৬৯) আনন্দপুর (৭০) সুরাষ্ট্র (৭১) গুর্জর (৭২) উজ্জয়নী। (৭৩) চি-কি তো (৭৪) মহেশ্বরপুর।

এর পরের ভ্রমণ পথটি মূল বইতে এক রকম পাওয়া যায়, জীবনীতে অন্যরকম।

মূল বই মতে হিউয়েন (৭৪) মহেশ্বরপুর থেকে (৭১) গুর্জর ফিরে আসেন। সেখান থেকে (৭৫) সিন্ধু (৭৬) মূলস্তান (৭৭) পর্বত (৭৮) অন্তনবকেল (৭৯) লঙলা (৮০) হয়ে পারস্য যান। পারস্য থেকে আবার ফিরে আসেন (৭৮) অন্ত নবকেল, সেখান থেকে যান (৮০) পীতশিলা ও (৮১) অবণ্ড।

জীবনী অনুসারে তিনি (৭৪) মহেশ্বরপুর থেকে (৭০) সুরাষ্ট্র ফিরে আসেন। সেখান থেকে (৭৮) অন্তনবকেল ও (৭৯) লঙলা হয়ে পারস্য যান। পারস্য থেকে ফিরে আসেন আবার (৭৯) লঙলা। সেখান থেকে যান একে একে (৮০) পীতশিলা (৮১) অবণ্ড (৭৫) সিন্ধু (৭৬) মূলস্থান (৭৭) পর্বত।

জীবনী মতো এরপর হিউয়েন দক্ষিণ-পশ্চিমের পথ ধরে (জুলিয়েনের পাঠ মতো উত্তর পূর্ব) মগধ ফিরে আসেন।

আগেও এ সময় মগধ থাকা কালে তিনি দু-দুবার ষষ্ঠীবনের বিশিষ্ট পণ্ডিত জয়সেনের কাছেও অধ্যায়ন করেন। এছাড়া অধ্যয়ন করেন নালন্দায় আচার্য শীলভদ্রের কাছে।

এরপর ৬৪৩ খ্রী. আরম্ভে কুমার রাজা বা কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মণের আমন্ত্রণে (৪৮) কামরূপ যান। সেখান থেকে ভাস্করবর্মণের সঙ্গে (৪৬) কজুঘীরা যান রাজা হর্ষবর্ধন শিলাদিত্যের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সেখান থেকে তাদের সঙ্গে এলেন (২৮) কনৌজ, ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিতে। পরপর শীলাদিত্যের অনুরোধে তিনি (৩১) প্রয়াগ যান তার মহামোক্ষ পরিষদে যোগ দিতে। এখান থেকে তিনি স্বদেশের দিকে যাত্রা করলেন। যাত্রাপথে (৩১) প্রয়াগ থেকে এলেন (৩২) কৌশাম্বী। সেখান থেকে নানা রাজ্য (২৬) বীরসান এলেন। সেখান থেকে রাজা উধীতের রাজ্যে (১৪) জালন্ধরে। এলেন সেখান থেকে (৭) সিংহপুর। সিংহপুর থেকে গেলেন (৬) তক্ষশিলা। সেখান থেকে (৯) গান্ধার ও (৪) লম্পক। তারপর লম্পক থেকে গেলেন (৮২) ফ-ল-ন বা বরণ। এখান থেকে তিনি ভারত সীমানা ত্যাগ করলেন। ৬৪৫ খ্রী. চীনের পশ্চিম রাজধানী শিঙ-ফুতে এসে পৌঁছলেন।

এক

ইতিহাস পড়লে জানা যায়, তিয়েন-চু বা ভারতের অনেক নাম। এসব নাম কোথা থেকে কীভাবে এসেছে তা নিয়েও মাথা গুলিয়ে দেবার মত নানা মুনির নানা মত রয়েছে। পুরাকাল থেকেই একে সিন-তু (সিন্ধু) ও হিয়েন-তু (হিন্দু) বলা হত। ঠিক উচ্চারণ মতো এখন একে ইন-তু (ইন্দু) বলা হয়। চীনা ভাষায় এর অর্থ হল-চাঁদ। চাঁদের অনেক নামের মধ্যে ‘ইন-তু’ (বা ইন্দু) একটি। ইন-তুর বিভিন্ন অঞ্চলকে তার লোকেরা রাজ্য-অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়েছে। এই সব (রাজ্য বা) দেশের আচার-প্রথার মধ্যে নানান বৈচিত্র্য রয়েছে। ঠিক ঠিক উচ্চারণ মেনে নিয়ে আমরা পুরো দেশটিকে ইন-তু বলব।

ইন-তুর পরিবারেরা বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত। ব্রাহ্মণেরা তাদের শুদ্ধতা ও মহত্ত্বের জন্য বিদিত। পরম্পরা এদের যে রকম পবিত্ররূপে চিত্রিত করেছে তাতে আমরা যে ভুল করে অন্য দেশে এসে পড়েছি এরকম মনে করার কোন কারণই নেই। (বিদেশী) লোকেরা ই-তু-কে সাধারণতঃ ব্রাহ্মণদের দেশ বলে।

দুই

যে দেশগুচ্ছকে ইন-তু বা ভারত বলা হয় তাদের সাধারণত পঞ্চ-সিন্ধু (Five Indies) নামে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এর আয়তন প্রায় নব্বুই হাজার লি। তিনটি দিকই সাগরে ঘেরা। উত্তর বা পিছনের দিকটিতে তুষারের টোপর পরা পর্বতমালার পাঁচিল। উত্তর দিকটি চওড়া আর দক্ষিণ দিকটি সরু হবার দরুণ আকৃতি আধফালি চাঁদের মতো। পুরো ভূ-ভাগ কিছু কম-বেশী সত্তরটি দেশে বিভক্ত। আবহাওয়া উষ্ণ, ভূমি সুজলা ও ভিজেল। উত্তর ভাগে সারি সারি পাহাড়ের পর পাহাড়, পর্বতের পর পর্বত। জমি শুকনো ও নোনা। পূর্বদিকে রয়েছে উপত্যকা আর সমতলভূমি। অজস্র নদীনালার জন্য সুজলা-সুফলা। দক্ষিণ অঞ্চল অরণ্য আর ওষধি গাছে ভরা। পশ্চিম ভাগ পাথুরে ও ঊষর।

তিন

পরিমাপের কথা তুললে সবার আগে মনে জাগে যোজনের কথা। অতি পুরাকালের রাজা-রাজড়াদের আমলে সৈন্যবাহিনীর একদিনের পথকে যোজন বলা হত। পুরোনো নথিতে একে ৪০ লি-র সমান বলা হয়েছে। ভারতের চলতি গণনা মতো ৩০ লি-র সমান। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম বইয়ে এর দৈর্ঘ্য মাত্র ১৬ লি-র সমান বলা হয়েছে।

ছোট বিভাগের বেলা এক যোজন আট ক্রোশের সমান। গরুর ডাক যতখানি দূর পর্যন্ত শোনা যায় সেই দূরত্বকে সাধারণতঃ ক্রোশ বলা হয়। ক্রোশ আবার ৫০০ ধনুতে বিভক্ত। এক ধনু চার হাতের সমান। হাতকে ভাগ করা হয়েছে চব্বিশ আঙুলে। এক আঙুল ৭ যবের সমান। যবকে আবার উকা বা উকুনে, উকুনকে লিখ্যাতে, লিখ্যাকে রজ, গরুর লোম, ভেড়ার লোম, ঘোটকীর কেশ, তাম্রপাত্রের ছিদ্র। আর এই ভাবে করতে করতে সপ্তম ধাপে এসে পৌঁছেছে ধূলিকণায়। ধূলিকণাকে আবার ভাগ করতে করতে সপ্তম ধাপে নিয়ে আসা হয়েছে অণুতে। অণুকে আর ভাগ করা সাধ্যের বাইরে। ভাগ করতে গেলেই শূন্যতায় মিলিয়ে যাবে। তাই অণুর ছোটকে পরমাণু আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

চার

আহ্নিক ও বার্ষিক গতির নিয়ম, রবি ও চন্দ্রের বিভিন্ন নক্ষত্রে অবস্থানকে যদিও ভারতে অন্য সব নাম দেওয়া হয়েছে তাহলেও তাদের ঋতুগুলি আমাদের সঙ্গে এক। ভিন্ন ভিন্ন নক্ষত্রে চন্দ্রের অবস্থান অনুসারে মাসগুলির নামকরণ করা হয়েছে। সময়ের সব থেকে ছোট বিভাগকে ক্ষণ বলা হয়। ১২০ ক্ষণ এক তৎক্ষণের সমান। ৬০ তৎক্ষণে এক লব। ৩০ লবে এক মুহূর্ত। ৫ মুহূর্তে এক কাল। ৬ কাল (প্রহর) এক অহোরাত্রের সমান। তবে, চলতি হিসাবে অহোরাত্রকে সাধারণতঃ ৮ কালের (প্রহর) সমান ধরা হয়।

অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত কালকে শুক্লপক্ষ আর পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা কালকে কৃষ্ণপক্ষ ধরা হয়। কৃষ্ণপক্ষে কখনো ১৪, কখনো ১৫ দিন ধরা হয়। কেননা, মাস কখনো বা বড়ো কখনো বা ছোট। প্রথমে কৃষ্ণ, পরে শুক্ল-এভাবে দুই পক্ষকে নিয়ে এক মাস ধরা হয়। ছয় মাসে এক অয়ন। সূর্য যখন (কর্কট ক্রান্তির) ভিতর-বৃত্তার্ধে গতি বারে তখন উত্তরায়ণ। যখন বাইরের বৃত্তার্ধে গতি বারে তখন দক্ষিণায়ণ। এ দুই অয়নকাল মিলিয়ে এক বছর।

প্রথম মাসের ১৬ তারিখ থেকে তৃতীয় মাসের ১৫ তারিখ অবধি —ক্রমগ্রীষ্ম

তৃতীয় মাসের ১৬ তারিখ থেকে পঞ্চম মাসের ১৫ তারিখ অবধি —গ্রীষ্ম

পঞ্চম মাসের ১৬ তারিখ থেকে সপ্তম মাসের ১৫ তারিখ অবধি —ক্রমগ্রীষ্ম

সপ্তম মাসের ১৬ তারিখ থেকে নবম মাসের ১৫ তারিখ অবধি —বর্ষা

নবম মাসের ১৬ তারিখ থেকে একাদশ মাসের ১৫ তারিখ অবধি —ক্রমশীত

একাদশ মাসের ১৬ তারিখ থেকে প্রথম মাসের ১৫ তারিখ অবধি —শীত

বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থানুসারে বছর তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম মাসের ১৬ তারিখ থেকে পঞ্চম মাসের ১৫ তারিখ গ্রীষ্মকাল। পঞ্চম মাসের ১৬ তারিখ থেকে নবম মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত বর্ষা। নবম মাসের ১৬ তারিখ থেকে প্রথম মাসের ১৫ তারিখ শীতকাল।

আবার চার ঋতুর বিভাগও আছে। বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। বসন্ত ঋতুর তিন মাসকে বলা হয়-চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ। এরা প্রথম মাসের ১৬ তারিখ থেকে চতুর্থ মাসের ১৫ তারিখ অবধি। গ্রীষ্ম ঋতুর তিন মাসকে বলা হয়-আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র পাদ। এরা চতুর্থ মাসের ১৬ তারিখ থেকে সপ্তম মাসের ১৫ তারিখ অবধি। শরৎ ঋতুর তিন মাসকে বলা হয়-অশ্বফুজ, কার্তিক ও মার্গশীর মাস। এরা সপ্তম মাসের ১৫ তারিখ থেকে দশম মাসের ১৫ তারিখ অবধি। শীত ঋতুর তিন মাসের নাম-পুষ্য, মঘা ও ফাল্গুন। এরা চীনের দশম মাসের ১৬ তারিখ থেকে প্রথম মাসের ১৫ তারিখ অবধি।

পাঁচ

শহর ও গ্রামগুলির প্রবেশ দ্বার রয়েছে। যে দেয়াল দিয়ে সেগুলি ঘেরা তা বেশ চওড়া ও উঁচু। পথ ও অলিগলি এদিক ওদিক পাক খেয়ে এগিয়ে গেছে। বড় রাস্তা আঁকাবাঁকা মোচড় খাওয়া। পথ জুড়ে নোঙরা। দু’ধারে থাকা দোকানপাটগুলিতে নামের ফলক। কসাই, জেলে, নর্তকী, জুহ্লাদ, ঝাড়ুদার প্রভৃতির বাস শহরের বাইরে। পথ চলার সময় এদের রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে হাঁটতে হয়। তাদের বাড়িঘর নিচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা ও শহরতলী অঞ্চলে। মাটি নরম ও কাদাটে হওয়ার দরুণ শহরতলির দেয়াল অধিকাংশই ইট বা টালি দিয়ে তৈরি। দেয়ালের লাগোয়া ফটকস্তম্ভ কাঠ বা বাঁশের তৈরী। ঝোলা-বারান্দা ও অলিন্দগুলি কাঠের তৈরী। চূণকাম বা চূণ-বালির প্রলেপ দেওয়া। ছাদ টালি দিয়ে ছাওয়া। এখানকার বিভিন্ন বাড়িঘরের আকৃতি চীনে তৈরি ঘর-বাড়ির মতোই। খড়, গাছের শুকনো পাতা, চালি বা ফলক দিয়ে আচ্ছাদন করা। চূণ অথবা মিশেল-মাটি দিয়ে দেয়ালগুলো ঢাকা। শুদ্ধতার জন্য এর সঙ্গে গোবরও মেশানো হয়। ঋতু অনুসারে আঙিনায় ফুলগাছ লাগায়।

সংঘারামগুলি বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে তৈরী। চারকোণে তেতালা মিনার তোলা হয়। কড়ি ও খিলানগুলিকে অতি অটুতার সঙ্গে বিভিন্ন আকারে তৈরী ও খোদাই করা হয়ে থাকে। দরজা, জানালা, নিচু দেয়ালগুলি নানারকম ভাবে চিত্রিত করা হয়। ভিক্ষুদের থাকার ঘরগুলো ভিতরের দিক অলঙ্কার করা আর বাইরের দিকটা সাধাসিধা। দালানের ঠিক মাঝখানে এক মহাকক্ষ (hall)-বেশ উঁচু আর লম্বা- চওড়া। বাড়িগুলি বিভিন্ন তলবিশিষ্ট, চূড়াগুলি নানান আকারের ও উচ্চতার-এ নিয়ে ধরাবাঁধা কোন নিয়ন নেই। দরজা পূর্বদিকে। রাজসিংহাসনও পূর্বমুখী।

ছয়

বসা ও বিশ্রামের জন্য তারা সকলেই মাদুর ব্যবহার করে। রাজ-পরিবার নামকরা নামকরা লোকেরা ও সহকারী কর্মধ্যক্ষরা নানারকম নক্সাকরা মাদুর ব্যবহার করেন। মাপে সবগুলিই সমান। রাজার আসন বেশ বড় ও উঁচু। মূল্যবান রত্নাদি দিয়ে সাজানো। একে সিংহ-আসন বা সিংহাসন বলা হয়। এটি অতি চমৎকার ভাবে ঝালর দিয়ে ঘেরা। পা রাখার চৌকিও রত্নখচিত। অভিজাতরা চিত্রিত করা জাঁকালো আসনে বসে নিজেদের অভিরুচি মতো।

সাত

পরণের পোষাক কেটে ছেঁটে, বিশেষ কোন শ্রী ছাঁদ মতো তৈরী করা হয় না। বেশীর ভাগ মানুষই ধবধবে সাদা পোষাক পছন্দ করে। রঙমিশালী বা অলংকার করা পোষাক তেমন পছন্দ করে না। পুরুষেরা তার কোমর ঘিরে কাপড় পরে ও তাকে বগলের নিচ দিয়ে ঘুরিয়ে শরীরকে বেড় দিয়ে ডাইনে তলের দিকে ঝুলিয়ে দেয়।

মেয়েদের পোষাক মাটি পর্যন্ত নেমে আসে। তারা তাদের কাঁধ পুরোপুরি ঢাকা দেয়। মাথার উপর চূড়োর মত করে খোঁপা বাঁধে ও বাকি চুল আলতো ভাবে ঝুলতে থাকে।

কতক লোক তাদের গোঁফ কামিয়ে ফেলে। আরো নানা অদ্ভুত অদ্ভুত প্ৰথা রয়েছে। তারা মাথায় উষ্ণীষ পরে থাকে। তাতে ফুলের গুচ্ছ ও রত্নাভরণ থাকে।

তাদের পোষাক আশাক কৌষেয় ও তুলার তৈরী। কৌষেয় বন্য গুটিপোকা থেকে মেলা সূতায় তৈরী। ক্ষৌম বস্ত্রও রয়েছে তাদের। এগুলি এক ধরণের খড় (মসিনার ছাল) দিয়ে তৈরী। কম্বল দিয়ে তৈরী কাপড়ও আছে। এগুলি ছাগলের মিহি লোম দিয়ে তৈরী। কয়াল দিয়ে তৈরী পরিচ্ছদও আছে। বন্য প্রাণীর লোম দিয়ে এগুলো বানানো। এগুলি বুনোট করতে বেশ পরিশ্রম ও কুশলতার দরকার। এজন্য এ ধরনের বস্ত্র অতি দামী ও উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত।

উত্তর ভারতের আবহাওয়া হিমেল। এই কারণে তারা ‘হু’ (hu) -দের মতো ছোট ও আঁটোসাঁটো পোষাক পরে। তা যেমন বিভিন্ন রকমের, তেমনি আবার মিশেল। কেউ কেউ ময়ূরের পালক পরে। কাউকে কাউকে বা নরমুণ্ডের মালা পরতে দেখা যায়। কেউ কেউ কিছুই একেবারে পরে না, পুরো নগ্ন থাকে (নির্গ্রন্থ)। কেউ আবার পাতা বা বল্কল পরে। অনেকে চুল তুলে ফেলে গোঁফ কামায়। অন্যেরা ঝোপের মত গোঁফদাড়ি রাখে, চুল জট পাকিয়ে মাথার উপর বেঁধে রাখে। পোষাক-পরিচ্ছদও এক রকমের নয়। আর তার রঙ-তা লালই হোক আর সাদাই হোক—সব সময়ে এক প্রকার নয়।

শ্রমণদের তিন রকমের পোষাক। সংঘটি, সংকক্ষিকা ও নিবাসন। এর ছাঁদ সব জায়গায় এক রকমের নয়। শাখাভেদ অনুসারে ছাঁদের ভেদ দেখা যায়। কারো যদি পট্টি চওড়া, কারো তবে সরু। কেউ যদি খোল চিপা করে তৈরী করছে তবে অন্যে করছে ঢিলা। সংকক্ষিকায় বাঁ-কাঁধ ঢাকা, দু’ বগল ঘেরা। বাঁদিক খোলা আর ডানদিক আটকানো ভাবে এটি পরা হয়। ঝুলকোমর ছাড়িয়ে আরো নিচ পর্যন্ত নামানো। নিবাসনে কটিবন্ধ কিংবা রেশমের ঝাপপা ব্যবহারের চল নেই। পরার সময় একে চুনটের মতো ভেঙ্গে ভাঁজ করে কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। পোষাকের রঙ নিয়েও ভেদ রয়েছে। হলদে ও লাল দুই রঙ-ই চালু।

ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরা পোষাক-আশাকের ব্যাপারে বেশ ছিমছাম পরিষ্কার। বেশ ঘরোয়া চালে অনাড়ম্বর ভাবে জীবন কাটায়। রাজা-রাজড়া ও বড় বড় মন্ত্রীরা নানা রকমের ভিন্ন ভিন্ন পোষাক ও আভরণ পরে। সুন্দর ভাবে সাজার জন্য রত্নখচিত পাগড়ী বা মুকুটে ফুল গোঁজে; হার অঙ্গদ এইসব পরে। ধনী বণিকদের মধ্যেও অঙ্গদের চল রয়েছে। বেশীর ভাগ লোক খালি পায়ে চলে। অল্পকতক চটি ব্যবহার করে। তারা তাদের দাঁত লাল ও কালো রঙে রাঙায়। চুল উপরের দিকে তুলে বাঁধে। কানে ছেঁদা করে। তাদের নাক বেশ টিকালো, চোখ বড় বড়।

আট

শারীরিক পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তারা বিশেষ সতর্ক। খেতে বসার আগে প্রত্যেকে হাত মুখ ধুয়ে নেয়, কখনো উচ্ছিষ্ট খায় না, নিজের থালার খাবার অন্যকে খেতে দেয় না। কাঠ ও পাথরের (পাতা ও মাটির?) পাত্র ব্যবহার করলে [একবার ব্যবহারের পর] তা ফেলে দেওয়া হয়। সোনা, রূপা, তামা বা লোহার বাসন-পত্র প্রত্যেকবারের পর ঘষে মেজে ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। খাবার পর একটি দাঁতন দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করে মুখ হাত ধোয়।

তারা খাবার পর মুখ হাত ধোয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে ছোঁয় না। প্রত্যেকবার মলত্যাগের পর জল দিয়ে শরীর পরিষ্কার করে এবং চন্দন অথবা হলুদ মাখে।

রাজা যে সময় স্নান করেন তখন ঢাক বাজানো হয়, বিভিন্ন সঙ্গীত যন্ত্রাদিতে স্তুতি গান করা হয়। পূজা-অর্চ্চনা প্রভৃতি ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের আগে স্নান ও আচমন করে নেয়।

নয়

তাদের বর্ণমালার অক্ষরগুলি ব্রহ্মদেব কল্পিত। আদি থেকে সেই অক্ষরই পুরুষানুক্রমে চলে আসছে। [স্বর ও ব্যঞ্জন] মিলিয়ে মোট ৪৭টি অক্ষর। উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন মত এগুলিকে সাজিয়ে শব্দ গঠন করা হয়, [বিভক্তি, প্রত্যয় প্রভৃতি জুড়ে তার বিভিন্ন রূপান্তর ঘটানো হয়। এই বর্ণমালা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ও পরিবেশ অনুযায়ী বিভিন্ন শাখা বিস্তার করেছে। এর ফলে উচ্চারণের কিছু পরিবর্তন ও ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। তবে মূল চরিত্রের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। মধ্য-ভারতে এর মূল চরিত্র অবিকৃত থেকে গেছে। এখানে এর উচ্চারণ কোমল ও মার্জিত-ঠিক যেন দেবতার ভাষা। শব্দের উচ্চারণ স্পষ্ট ও নির্ভুল, সব লোকের কাছে আদর্শস্থানীয়। সীমান্তের লোকদের উচ্চারণের মধ্যে কতক বিকৃতি লক্ষ্য করা যায়।

ধারাবাহিকভাবে ঘটনাধারা নথিভুক্ত করে রাখার জন্য প্রত্যেক রাজ্যের নিজস্ব লোক রয়েছে। এই নথিকে Ni-lo-pi-ch’a বলা হয়। এই নথিতে ভাল-মন্দ সব ঘটনা, দৈব-দুর্বিপাক ও শুভসূচক স্মরণীয় বিবরণ লেখা রয়েছে।

ছোটদের লেখাপড়া শেখানোর প্রথম ধাপ হিসাবে (সিদ্ধবস্তু নামে) ১২ অধ্যায়ের একখানি বই পড়ানো হয়। সাত বছরে পা দিলে তারপর অতি দরকারী শাস্ত্র হিসাবে পঞ্চ বিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলার পাঠ আরম্ভ হয়।

এই পঞ্চবিদ্যার প্রথমটি হলো শব্দ বিদ্যা। এই শাস্ত্র ভাষা ও ব্যাকরণ আয়ত্ত করতে শেখায়।

দ্বিতীয় হলো শিল্পস্থান বিদ্যা। এতে কলা, শিল্প ও জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখান হয়।

তৃতীয়টি চিকিৎসা বিদ্যা। —এতে শরীর রক্ষার বিধি-নিয়ম, তন্ত্র-মন্ত্র, ওষধি গুণ সম্পন্ন পাথর, শল্যবিদ্যা (acupunture) ও ওষধি গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ বিষয়ে শেখানো হয়।

চতুর্থ হলো হেতুবিদ্যা। এতে সত্য-মিথ্যা, ভুল-ঠিক ইত্যাদি যুক্তিসম্মতভাবে নির্ধারণের পদ্ধতি শেখানো হয়।

পঞ্চম হলো অধ্যাত্মবিদ্যা। এতে পঞ্চায়ন, তাদের কারণ ও পরিণাম এবং তার সূক্ষ্ম প্রভাব বিষয়ে শেখানো হয়।

ব্রাহ্মণরা চারি বেদ অধ্যয়ন করে। এর প্রথমটি আয়ুর্বেদ। এই বাক্যটি সংকলকের বক্তব্য। এতে জীবন রক্ষা ও প্রাকৃতিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বিষয় রয়েছে। দ্বিতীয়টি যজুঃর্বেদ। এতে যজ্ঞ ও পূজা-স্তুতির বিষয় রয়েছে। তৃতীয়টি সামবেদ। রীতি-পদ্ধতি, জ্যোতিষ ও রণনীতি বিষয় রয়েছে। চতুর্থটি অথর্ববেদ। এতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, তন্ত্রমন্ত্র ও ওষধি বিষয়ে পাঠ রয়েছে।

বেদ শিক্ষকদের এগুলি গভীরভাবে অধ্যয়ন করে এসবের গূঢ়তত্ত্ব ও সঠিক অর্থ আয়ত্ত করতে হয়। তারপর তারা শিক্ষার্থীদের এসব ব্যাখ্যা করে বোঝান, কঠিন শব্দগুলির প্রকৃত অর্থ বুঝতে তাদের সাহায্য করেন। যতদিনে না তাদের শিক্ষা ঠিকভাবে সম্পূর্ণ হয় ততদিনে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে নিজেদের কাছে আটকে রাখেন। অনেক লোক আছেন যাঁরা প্রাচীন সভ্যতায় গভীরভাবে অভিজ্ঞ। তাঁরা সংসার-বন্ধন ছিন্ন করে, সরল জীবন ধারার অনুবর্তী হয়ে উন্নত কৃষ্টির সাধনায় মগ্ন থাকেন। এভাবে তারা পার্থিব পরিসরের ঊর্দ্ধে আরোহণ করেন ও জাগতিক ভোগবিলাস তাঁদের কাছে তুচ্ছ বিষয়ে পরিণত হয়। তাঁদের প্রজ্ঞার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। রাজারা তাঁদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন। রাজসভায় টেনে আনতে চাইলেও আনতে পারেন না। তাঁদের মনীষার নিকট দেশের প্রধানকেও নতি স্বীকার করতে হয়। জনসাধারণের মুখে মুখে তাঁদের গুণ- গান শোনা যায়, তাঁদের প্রতি অন্তরের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নিবেদিত হতে দেখা যায়।

এরূপ খ্যাতি ও সম্মানের প্রেরণা থেকেই এখানকার জ্ঞানীগুণীরা অক্লান্তভাবে কঠোর শ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে জ্ঞানের সাধনা করে চলেন। যদি তাঁদের প্রচুর ধনসম্পদ থাকে তবু তাঁরা জীবন-নির্বাহের জন্য বিভিন্ন দিকে ঘুরে বেড়ান। তবে এমন লোকও আছেন, যাঁরা জ্ঞানচর্চার মহত্ত্ব মুখে আওড়ালেও সেদিক অবহেলা করে নির্লজ্জের মতো আমোদ-প্রমোদ করে পয়সা ওড়ান। নিজেদের অর্থ ও সামর্থ্য দামী দামী খাবার আর পোষাক-পরিচ্ছদে নিঃশেষ করেন। কোনরকম মহান আদর্শ, ও জ্ঞানের সাধনা না থাকার ফলে শেষপর্যন্ত তাঁরা নিন্দার পাত্র হয়ে পড়েন, দিকে দিকে তাঁদের অখ্যাতি ছড়ায়।

ভগবান বুদ্ধের অনুগামীরা নিজ নিজ স্তর অনুসারে প্রত্যেকেই তাঁর মতবাদ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন। সেই পরম-পুরুষ থেকে বিদায় নেবার পর বহুকাল অতীত হয়ে গেছে। বর্তমানে তাঁর মতবাদকে অনেক পরিবর্তিত আকারে তুলে ধরা হয় ও বোঝা হয়। ঠিক হোক ভুল হোক, যার যেমন প্রতিভা সেই মতো সে একে বোঝে।

দশ

তথাগতের অনুগামীদের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সব সময় মতবিরোধ লেগে রয়েছে। তাদের বাদ-প্রতিবাদের ঝড় যেন সর্বদা সাগরবুকে উত্তাল তরঙ্গ তুলে চলেছে। প্রত্যেক শাখারই ভিন্ন ভিন্ন প্রবক্তা রয়েছেন এবং নানা পৃথক পৃথক পথ ধরে এক অভিমুখের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে চলেছেন।

বৌদ্ধধর্মীরা মোট ১৩টি শাখায় বিভক্ত। এদের প্রত্যেকেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে। মহাযান ও হীনযানের প্রবক্তারা আলাদা আলাদা থাকেন। কিছু কিছু আছেন যাঁরা নীরবে ধ্যান ও অনুশীলন করে চলেছেন। যখন যে অবস্থাতে থাকুন না কেন সব সময় তাঁরা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাধনায় নিমগ্ন। কতক আবার ঠিক তাদের বিপরীত ভাবে নিজেদের ধ্যানধারণা নিয়ে আকাশ পাতাল তোলপাড় করে ফেরেন।

এদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ সংঘ অনুসারে বিশেষ কতকগুলি নিয়ম-কানুনের অধীন। সে সবের উল্লেখ করে বিবরণকে আর ভারি করব না।

বিনয়-অভিধর্ম ও সূত্র-পিটক তিনটিই সমানভাবে বৌদ্ধ-গ্রন্থ। যিনি এর মধ্যে যেকোন একটি বর্গের বইগুলিকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করার দক্ষতা দেখাতে সমর্থ হন তাকে ‘কর্মদান’-এর বিধি থেকে রেহাই দেয়া হয়। যিনি দুই বর্গের বই ব্যাখ্যায় সক্ষম তাঁকে এর সঙ্গে উচ্চতর আসনের সামগ্রী দেয়া হয়। যিনি তিন বর্গের বই ব্যাখ্যায় সমর্থ তাঁকে তাঁর দেখাশোনা ও কাজকর্ম করে দেবার জন্য ভৃত্য দেয়া হয়। যিনি চার বর্গের বই ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা দেখাতে পারেন তাঁর পরিচর্যার জন্য একজন ‘উপাসক’কে দেয়া হয়। যিনি পাঁচ বর্গের বই ব্যাখ্যা করতে পারেন তিনি হাতিতে চড়ে চলাফেরার সুবিধা লাভ করেন। যিনি ছয় বর্গের এই ব্যাখ্যায় পারদর্শী তিনি ওইসঙ্গে দেহরক্ষীও পান।

যখন কোন ব্যক্তি বিদ্যাবত্তার খ্যাতিতে খুব উচ্চসীমায় পৌঁছান তখন তিনি মাঝে মাঝে আলোচনাসভা ডাকেন। যারা এতে ভাগ নেয় তিনি তাদের প্রতিভা বিচার করেন, ভুলত্রুটি দেখিয়ে দেন, যোগ্যকে প্রশংসা করেন, অযোগ্যকে তিরস্কার করেন। যদি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কেউ মার্জিত ভাষা, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, গভীর প্রবেশ ক্ষমতা ও তীব্র যুক্তি তর্কের দ্বারা নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করতে পারেন তবে তাঁকে মূল্যবান আভরণে সুসজ্জিত হাতির পিঠে চাপিয়ে শোভাযাত্রা করে সংঘারামের তোরণদ্বারগুলিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

যদি কেউ বলতে বলতে যুক্তির খেই হারিয়ে ফেলেন, দুর্বল, যুক্তিহীন ভাষা প্রয়োগ করেন, তর্কশাস্ত্রের নিয়ম ভঙ্গ করেন ও সেই রকম শব্দ প্রয়োগ করেন তবে তার মুখে সাদা রঙ লেপে, গায়ে ধুলো ও ময়লা মাখিয়ে তাকে কোন নির্জন জায়গায় বা কোন খানার মধ্যে ফেলে দিয়ে আসে। এইভাবে সেখানে প্রতিভাবান ও অপদার্থ জ্ঞানী ও মূর্খের মধ্যে পার্থক্য করা হয়।

আমোদ-প্রমোদ, ভোগ-বিলাসকে তারা পার্থিব-জীবন ও জ্ঞান-অন্বেষাকে ধর্মজীবন বলে মনে করে। ধর্মজীবন থেকে পার্থিব জীবনের দিকে ঢলে পড়াকে দোষাবহ বিচার করা হয়। যদি কেউ নিয়ম শৃঙ্খলা ভাঙে, তাকে সকলের সামনে তিরস্কার করে। সামান্য ত্রুটির জন্যও তিরস্কার করা হয় বা সাময়িকভাবে বের করে দেয়া হয়। বড় ত্রুটির জন্য পাকাপাকি ভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

যাদের এভাবে তাড়িয়ে দেয়া হয় তারা অন্য কোথাও গিয়ে থাকার আশ্রয় খোঁজে। অনেক সময় মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে পথে ফেরে। কোন কোন সময়ে তারা পুরোনো বৃত্তি, পূর্ব জীবনে ফিরে যায়।

এগারো

বর্ণ বিভাগে পরিবারগুলিকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম হলো ব্রাহ্মণ বা বিশুদ্ধ আচারের লোক। তারা ধর্ম-আচরণের ব্যাপারে সদা-সতর্ক। শুদ্ধ জীবন যাপন করে ও ত্রুটিহীনভাবে নীতি নিয়ম মেনে চলে।

দ্বিতীয় হলো ক্ষত্রিয় বা শাসক জাতি। যুগ যুগ ধরে তারা শাসকের ভূমিকা পালন করে এসেছে। মানবিকতা ও করুণার নীতি তারা মেনে চলে।

তৃতীয় হলো বৈশ্য। এরা বণিক জাতি। ব্যবসা বাণিজ্য এদের প্রধান কাজ। দেশ ও বিদেশ দুদিক থেকেই তারা লাভ করে।

চতুর্থ হলো শূদ্র। এরা কৃষক শ্রেণী। জমি চাষ-আবাদ করে ফসল ফলানোই এদের প্রধান কাজ।

পবিত্র-অপবিত্র অনুসারে সমাজে প্রত্যেকের স্থান সুনির্দিষ্ট। বিবাহকালে সেই নতুন গড়া সম্পর্ক অনুসারে তাদের মর্যাদার পতন-অভ্যুদয় ঘটে। জ্ঞাতি মধ্যে বিবাহ নিষেধ। কোন স্ত্রীলোক জীবনে একবারের বেশি বিবাহ করতে পারে না।

এছাড়া আরো নানান শ্রেণীর লোক রয়েছে। তারা তাদের নিজ নিজ প্ৰথা অনুসারে পরস্পরের মধ্যে বিবাহ করে। এদের সম্পর্কে বিশদভাবে কিছু বলা বেশ কষ্টকর।

বারো

রাজ-ধারাবাহিকতা ক্ষত্রিয় বর্ণের মধ্যেই সীমিত। অন্যায়ভাবে ও রক্তপাতের দ্বারা এরা নানা সময়ে ক্ষমতা করায়ত্ত করেছে। তবু একটি বিশেষ শ্রেণী বা জাতি হিসাবে তাদের মর্যাদা আছে।

প্রধান যোদ্ধাদের দেশের সব থেকে সাহসী লোকদের মধ্য থেকে বাছা হয়। সন্তানেরা যেহেতু পিতার বৃত্তি অনুসরণ করে তাই তারা খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। তারা বাহিনীবদ্ধ হয়ে রাজপ্রাসাদ ঘিরে বাস করে। কোনরকম অভিযানের বেলা সম্মুখ-বাহিনীরূপে সবার আগে যায়। সেনাদের মধ্যে চারটি বিভাগ রয়েছে: পদাতিক, অশ্বারোহী, রথী ও হস্তী। হাতিদের মজবুত বর্ম দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। তাদের শুঁড়ে তীক্ষ্ণ ফলাকা আটকে দেয়া হয়। সেনানায়ক একটি রথে চড়ে সৈন্য পরিচালনা করে। দুজন সারথী ডান ও বাঁ দুদিক থেকে রথ চালায়। চারটি ঘোড়া রথ টানে। সেনাপতি রথের মধ্যখানে থাকে। একদল রক্ষক তাকে ঘিরে থাকে। তারা তার রথের চাকার পাশে পাশে চলে।

প্রতিরোধ করার জন্য অশ্বারোহীর দল সামনের দিকে ছড়িয়ে থাকে। পরাজয় ঘটলে বিভিন্ন আদেশ পালনের জন্য তারা নানা জায়গায় ঘোড়া ছুটিয়ে যায়। পদাতিকেরা তাদের ক্ষিপ্র গতিবেগের দ্বারা প্রতিরোধকে মজবুত করে তুলতে সাহায্য করে। সাহস ও পরাক্রমের জন্যেই তাদের এ কাজে বাছাই করা হয়েছে। সাধারণতঃ তারা একটি বড় ঢাল ও একটি লম্বা বর্শা নেয়। কখনো কখনো তলোয়ার বা খড়্গগ নিয়ে প্রচণ্ড বেগে সামনের দিকে ছুটে চলে। যুদ্ধের সব অস্ত্রই খুব ধারালো ও তীক্ষ্ণ। এদের মধ্যে কয়েকটির নাম-বর্শা ও ঢাল, ধনুক ও তীর, তলোয়ার, খড়্গগ, রণ-কুঠার, বল্লম, পরশু, দীর্ঘ-বল্লম ও বিভিন্ন প্রকারের প্রস্তর- নিক্ষেপ যন্ত্র বা ফিঙা। এগুলি তারা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে।

তেরো

সাধারণ লোকদের সম্পর্কে এবার কিছু বলা যাক। স্বভাবতঃই এরা হালকা চিত্তের মানুষ। তা হলেও ন্যায়-পরায়ণ ও সম্মানবোধসম্পন্ন। টাকা পয়সার ব্যাপারে ছল- চাতুরীর ধার ধারে না। বিচারের বেলাও বিবেচক। পরলোকের শাস্তিকে তারা ভয় করে ও ইহলোককে লঘু করে দেখে! স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে প্রতারক বা বিশ্বাস-ভঙ্গকারী নয়, কথা দিলে কথা রাখে, কোন রকম শপথ কি অঙ্গীকার করলে তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। সরকারী প্রশাসনও যথেষ্ট ন্যায়-পরায়ণ, ব্যবহার যথেষ্ট ভদ্র ও মিষ্টি। অপরাধ ও বিদ্রোহ খুব কম, কখনো-কখনো বিপদজনক হয়ে ওঠে। কেউ আইন ভাঙলে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে বিষয়টিকে খুঁটিয়ে বিচার করে তবে অপরাধীকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। কোনরূপ দৈহিক শাস্তি দেয়া হয় না। অপরাধীকে সোজাসুজি বাঁচতে বা মরতে ছেড়ে দেয়া হয় ও মানুষের মধ্যে ধরা হয় না। যদি নীতি-নিয়ম ভাঙা হয়, যদি কোন লোক স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ করে বা জনক-জননীর প্রতি কর্তব্য উপেক্ষা করে তবে তার নাক বা কান বা হাত- পা কেটে দেয়া হয় অথবা দেশ থেকে বার করে দেয়া হয় বা তাকে জনহীন অরণ্যে তাড়িয়ে দেয়া হয়। অন্যান্য ত্রুটির জন্য অল্পসল্প জরিমানা করা হয়। অপরাধমূলক তদন্তের প্রমাণ সংগ্রহের জন্য লাঠির ব্যবহার করা হয় না। কোন দোষী লোককে প্রশ্ন করার বেলা যদি সে খোলা মনে সব কথার উত্তর দেয় তবে তদনুযায়ী দণ্ড লঘু করা হয়। যদি অপরাধী একগুঁয়ের মতো অপরাধ অস্বীকার করে চলে বা দোষ-স্খালনের চেষ্টা করে, তবে সত্য খুঁজে বার করে বিচার নিষ্পত্তির জন্য চার রকমের পরীক্ষার আশ্রয় নেয়। (১) জলের দ্বারা (২) শক্তি প্রয়োগের দ্বারা (৩) পরিমাপের দ্বারা (৪) বিষের দ্বারা।

যখন জলের দ্বারা পরখ হয় তখন অভিযুক্তকে একটি বস্তার মধ্যে ভরা হয়। বস্তাটি একটি পাথরের পাত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তারপর ওই অবস্থায় তাকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। যদি সে ডুবে যায় ও পাথরটি ভাসে তবে সাব্যস্ত হয়— সে দোষী। যদি লোকটি ভাসে ও পাথরটি ডুবে যায় তবে সাব্যস্ত হয়— সে নির্দোষ।

যখন শক্তি প্রয়োগের দ্বারা পরখ করা হয় তখন সাহায্য নেয়া হয় আগুনের তারা একটি লোহার পাত গরম করে ও অভিযুক্তকে তার উপর বসতে বাধ্য করে। তারপর তার পা দুটি তার উপর রাখা হয়। পরে তার হাতের পাতায় এটি রাখা হয়। আবার জিভ দিয়েও তাকে এটি চাটতে বাধ্য করে। যদি এর ফলে কোথাও কোন পোড়াদাগের সৃষ্টি না হয় তবে প্রমাণ হয়- সে নির্দোষ। যদি পোড়াদাগের সৃষ্টি হয় তাহলে প্রমাণ হয় সে দোষী। যারা দুর্বল ও ভীতু লোক, যাদের সহন ক্ষমতা এ-ধরনের পরখের অন্তরায় তাদের বেলা একটি ফুলের কুঁড়ি নিয়ে তাকে আগুনে ছুঁড়ে দেয়া হয়। যদি আগুনের তাপে এটি ফুলের মতো ফোটে তবে প্রমাণ হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ। যদি কুঁড়িটি পুড়ে যায় তবে সাব্যস্ত হয় যে সে দোষী।

পরিমাপ বা ওজনের দ্বারা পরখ এই রকমের: একজন মানুষ ও একটি পাথরকে সমানভাবে পাল্লায় রাখা হয়। তারপর তুলনামূলক ভাবে কে ভারি আর কে হালকা তাই দেখে দোষী নির্দোষী স্থির হয়। যদি অভিযুক্ত লোকটি নির্দোষ হয় তাহলে তার ওজন পাথরের চেয়ে বেশি হবে। যদি দোষী হয় তবে পাথরটির তুলনায় তার ওজন কম হবে।

বিষের দ্বারা পরখ করা হয় এইভাবে: একটি ভেড়া নিয়ে এসে তার দক্ষিণ উরুতে একটি ক্ষত করা হয়। তারপর অভিযুক্তের খাবার থেকে খানিকটা নিয়ে তাতে সব রকমের বিষ মিশিয়ে তা সেই ক্ষতের মধ্যে ভরে দেয়া হয়। যদি সেই বিষের ক্রিয়ায় প্রাণীটি মারা পড়ে তাহলে প্রমাণ হয় যে মানুষটি দোষী। যদি প্রাণীটি বেঁচে থাকে তবে সাব্যস্ত হয়—মানুষটি নির্দোষ।

চার রকমের এই পরখ-প্রথার দরুণ অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।

চৌদ্দ

প্রকাশ্যভাবে সৌজন্য জানানোর নয়টি রীতি চলিত আছে। (১) নম্রতাসূচক শব্দের ব্যবহার করে অনুরোধ জানানো (২) সম্মান দেখানোর জন্য মাথা নত করা। (৩) দু’হাত তুলে মাথা নত করা। (৪) দু’হাত যুক্ত করে মাথা নত করা। (৫) হাঁটুমুড়ে ঝুঁকে পড়ে। (৬) ভূমিতে সম্পূর্ণ দেহ প্রসারিত করে। (৭) হাত ও হাঁটু মুড়ে প্রসারিত হয়ে। (৮) পাঁচটি গোলকের দ্বারা ভূমি স্পর্শ করে। (৯) দেহের পাঁচটি ভাগ ভূমিতে প্রসারিত করে।

এই নটি রীতির মধ্যে সব থেকে বেশি সম্মান প্রকাশক হলো ভূমিতে দেহ প্রসারিত করা ও তারপর হাঁটু মুড়ে সেই ব্যক্তির স্তুতি-গান করা। যখন দূর থেকে সম্মান জানানো হয় তখন মাথা নত করাই সাধারণ রীতি। কাছ থেকে জানানোর বেলা পায়ের পাতা চুম্বন ও পায়ের গোছ ঘষে দেয়া।

যখন কোন উচ্চপদস্থ বা বয়স্ক লোকের কাছ থেকে কোন আদেশ গ্রহণ করা হয় তখন আদেশ-গ্রহণকারী পোষাকের প্রান্ত তুলে ও নত হয়ে তা গ্রহণ করে। যাকে এরূপ সম্মান দেখানো হয়েছে তার উচিত ওই লোকটির মাথায় ও পিঠে হাত বুলিয়ে স্নেহের নমুনা স্বরূপ কিছু মিষ্ট উপদেশ দিয়ে ভদ্রভাবে কথা বলা।

যখন কোন শমণ বা ধর্মীয় জীবন গ্রহণ করেছেন এমন কোন লোককে এরূপ সম্মান দেখানো হয় তখন সে শুধু মৌখিকভাবে তার শুভ কামনা করে।

তারা শুধু নত হয়েই সম্মান দেখিয়ে থাকে। কখনো শুধু একবার প্রদক্ষিণ করে, কখনো বা তিন বার। যদি দীর্ঘ প্রতীক্ষা বা অনেক কাল পুষে রাখা আকাঙ্ক্ষার পর দর্শন পায় ও বিশেষ সম্মান দেখানোর ইচ্ছা বা উচ্ছ্বাস দেখা দেয় তবে মনের সাধ অনুসারে যতবার খুশী প্রদক্ষিণ করে।

পনেরো

অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা সাধারণতঃ ৭ দিন উপবাস করে। এ সময়ের মধ্যে অনেকেই ভাল হয়ে যায়। না হলে তখন ওষুধ খায়। এইসব ওষুধের চরিত্র বিভিন্ন। নামও বিভিন্ন। রোগীর পরীক্ষা এবং তার পদ্ধতি নিয়ে ডাক্তারের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

কোন লোক যখন মারা যায় তখন যারা তার শব-সৎকারের জন্য একত্র হয় তারা চীৎকার ক’রে ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে শোক প্রকাশ করে। কান্নার সময় অনেকে কাপড় ছিঁড়ে ফেলে, চুল এলোমেলো করে, কপাল চাপড়ায়, বুক চাপড়ায়। শোকের পোষাক সম্পর্কে কোন নিয়মকানুন নেই। শোক পালনের সময় সম্বন্ধেও কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই।

মৃতকে অন্তিম-সম্মান প্রদর্শনের তিনটি বিধি চালু রয়েছে। (১) সৎকার করা। অর্থাৎ কাঠের চিতা সাজিয়ে তার উপর দেহ রেখে তাকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা। (২) জলে ছুঁড়ে ফেলে ভাসিয়ে দেয়া (৩) নির্জনে ফেলে দেয়া। দেহটিকে বন্য জন্তু জানোয়ার থাকা অরণ্য মধ্যে ফেলে দেয়া-পশুদের খাবার জন্য।

রাজা মারা গেলে সবার আগে তার উত্তরাধিকারী নির্বাচন করা হয়, যাতে সে রাজার সৎকার-কার্য পরিচালনা করতে পারে, কোন কাজের পর কোন কাজ করতে হবে তা যাতে ঠিক করে দিতে পারে। জীবিতকালে তারা তাদের শাসককে তার চরিত্রের গুণাবলী অনুসারে উপাধি দেয়। যখন মারা যায় তখন মরণোত্তর কোন উপাধি দেয় না।

কোন বাড়িতে লোক মারা গেলে সেখানে কোনরূপ খাওয়া নিষিদ্ধ। তবে সৎকারের পর তারা পুনরায় যথারীতি খায়। কারো মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয় না। যারা শবানুগমন করে তাদের তারা অশুদ্ধ মনে করে। শবানুগমনকারীরা শহরের বাইরে স্নান করে তবে শহরে প্রবেশ করে।

মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে এমন বৃদ্ধ ও অশক্ত লোক এবং দুরারোগ্য রোগীরা, মৃত্যুর প্রতীক্ষ থেকে মুক্তি পেতে, কিংবা জীবনের দুর্বিপাক বা সাংসারিক ঝঞ্ঝাট থেকে রেহাই পেতে অনেক সময় মৃত্যু বরণ করে। সে তখন বিদায় ভোজ খেয়ে আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বিদায় নেয়। তারা গানবাজনা সহ তাকে গঙ্গার তীরে এনে একটি নৌকার উপর বসিয়ে মাঝ-গঙ্গার বুকে ঠেলে দেয়। সেখানে সে নিজে ডুবে মরে। এভাবে তারা দেবতাদের মধ্যে জন্ম নিতে চায় (অর্থাৎ, স্বর্গে যেতে চায়)। কখনো কখনো এরকম লোককে নদীর কূলে তখনো না-মরা অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।

ভিক্ষুদের মধ্যে মৃতের জন্য কান্না বা শোক করার নিয়ম নেই। কোন ভিক্ষুর বাবা বা মা মারা গেলে তিনি প্রার্থনা জানান। ওই সময়ে তিনি তাঁর নিকট নিজের ঋণের কথা স্মরণ করেন। অতীতে যেরূপ মমতাভরে তাকে লালন পালন করেছেন সে সব স্মৃতি স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এর ফলে স্বর্গতঃ ব্যক্তির পুণ্যফল বৃদ্ধি পাবে বলে তাঁরা আশা করে থাকেন।

ষোলো

সরকার পরিচালনা হিতকর নীতি-নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। এজন্য এর কাজকর্ম সরল, সাদাসিধে। পরিবারের নাম-পরিচয় নথিভুক্ত করা হয় না। লোকদের বেগার খাটানোর বা বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদলে নাম লেখানোর বিধি নেই। রাজ্যের নিজস্ব আয়কে প্রধানতঃ চারভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম ভাগ ব্যয় হয় রাজ্যের শাসন পরিচালনা ও যজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপের জন্য। দ্বিতীয় ভাগ ব্যয় হয় রাজ্যের কর্মচারী ও মন্ত্রীদের দেয় ভাতা মেটাবার জন্য। তৃতীয় ভাগ খরচ হয় রাজ্যের বিশিষ্ট প্রতিভাধর লোকদের পুরস্কারাদি দেবার জন্য। চতুর্থ ভাগ খরচ করা হয় ধর্মীয় সংস্থা সমূহকে দান ও পুণ্যকর্মের জন্য। এর ফলে করের বোঝা খুব অল্প, লোকজনের প্রয়োজনও অল্প। প্রত্যেকের পার্থিব সম্পত্তি নিরাপদ। ভরণ-পোষণের জন্য প্রত্যেকেই চাষ-আবাদ করে। যারা রাজার খাস জমিতে চাষ করে তাদের এক-ষষ্ঠাংশ কর দিতে হয়। বণিকেরা অবাধে জিনিসপত্র নিয়ে আসে ও বিনিময় করে চলে যায়। নদীপথ ও রাস্তার চৌকি সামান্য পথশুল্ক দিলেই খুলে দেয়া হয়। জনহিতকর কাজের জন্য শ্রমের দরকার পড়লে তার জন্য পারিশ্রমিক দেয়া হয়। কাজের অনুপাত অনুসারে পারিশ্রমিক দেয়া হয়ে থাকে।

সৈন্যেরা সীমান্ত পাহারা দেয়, কোথাও বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তা দমন করতে যায়। রাতে রাজপ্রাসাদ পাহারা দেয়। কাজের গুরুত্ব অনুসারে তাদের ভাতা দেয়া হয়। কিছু নির্দিষ্ট ভাতা বা মাইনে দেবার সর্তে তাদের সাধারণের মধ্য থেকে বেছে নেয়া হয়। শাসনকর্তা, মন্ত্রী, অমাত্য ও কর্মাধ্যক্ষগণকে ভরণপোষণের জন্য জমি দেওয়া হয়।

সতেরো

মাটি ও জলবায়ুর প্রভেদের জন্য এদেশে উৎপন্ন দ্রব্যাদিও বহু প্রকারের। ফুল, ফল, গাছপালা, লতাপাতা, শাকসবজী বিভিন্ন রকমের; এবং প্রত্যেকের বিশেষ বিশেষ নাম রয়েছে। যেমন-অমল ফল, আম্ল ফল, মধুক ফল, ভদ্র ফল, কফিখ ফল, অমলা ফল, তিন্দুক ফল, উদুম্বর ফল, মোচ ফল, নারিকেল ফল, পনস ফল। সবরকম ফলের নাম করা অসাধ্য, যেগুলি লোকে বেশি পছন্দ করে সেগুলিই শুধু বলা হলো। খেজুর, বাদাম, লকেট ও পার্সিমন অজানা। নাশপাতি, বুনো কুল, পীচ, খোবানি, আঙুর এসব কাশ্মীর থেকে আনা হয় ও অন্যান্য প্রত্যেক জায়গাতেই জন্মাতে দেখা যায়। ডালিম ও মিষ্টি কমলা সবখানেই জন্মায়।

যারা চাষ-আবাদের কাজ করে তারা ঋতু অনুসারে তা করে থাকে। অন্য সময় চুপচাপ বিশ্রাম করে কাটায়। উৎপন্ন ফসলের মধ্যে ধান ও শস্য জাতীয় ফসলই বেশি। খাবার যোগ্য ওষধি ফল ও তরি-তরকারীর মধ্যে আদা, সরিষা, তরমুজ, কুমড়ো, হিউয়েন-তো ইত্যাদি। পিঁয়াজ রসুন অল্প হয় ও খুব অল্প লোক এসব খায়। যারা এসব খায় তাদের শহরের সীমানার বাইরে তাড়িয়ে দেয়া হয়। সব থেকে বেশি প্রচলিত খাদ্য হলো দুধ, ঘি, ননী, গুড়, মিছরি, সরিষার তেল এবং শস্য দিয়ে বানানো নানা রকমের পিঠে। মাছ, ভেড়ার মাংস ও নানা জাতের হরিণের মাংস তারা টাটকা অবস্থায় খেয়ে থাকে। কখনো কখনো শুকনো করেও খায়। গরু, গাধা, হাতি, ঘোড়া, শুয়োর, কুকুর, শেয়াল, নেকড়ে, সিংহ, বানর ও অন্য রকম লোমশ জন্তু খাওয়া বারণ। যারা এসব খায় তাদের ঘৃণা ও তিরস্কার করা হয়, সমাজচ্যুত করা হয়। তারা জনবসতির বাইরে বাস করতে বাধ্য হয় ও কদাচিৎ তাদের লোক-সমাজে দেখা যায়।

মদ ও মাদক-জাতীয় পানীয় অনেক রকমের রয়েছে। আঙুরের রস, আখের রস ইত্যাদি ক্ষত্রিয়েরা পানীয় রূপে খেয়ে থাকে। বৈশ্যেরা কড়া মাদক-পানীয় খেতে অভ্যস্ত। শ্রমণ ও ব্রাহ্মণরা আঙুর ও আখ থেকে তৈরী এক রকমের সরবৎ পান করেন। এটি মাতানো মদের মতো নয়।

বর্ণ-সঙ্কর ও নিচ-জন্মের লোকেরাও খাদ্য-পানীয়ের ক্ষেত্রে ও থেকে আলাদা নয়। একমাত্র বাসন-পত্র ব্যবহারের দিকেই যা অন্য। উপাদান ও দাম দুদিক থেকেই এক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। গৃহস্থালীর জন্য প্রয়োজনীয় উন্নত মানের জিনিসপত্রের কোন অভাব নেই। চাটু ও কড়াই থাকলেও, জলের ভাপে ভাত রান্নার পাত্রের ব্যবহার জানে না তারা। মাটির তৈরি নানারকম পাত্র আছে তাদের। দেশী তামায় তৈরী পাত্র কদাচিৎ ব্যবহার করে। নানারকম খাদ্য এক সঙ্গে মেখে একটি পাত্র থেকে তারা তাদের আঙুল দিয়ে খায়। চামচ নেই, কাপও নেই। কোনরকম খাবার কাঠিও নেই। যখন অসুস্থ হয় তখন অবশ্য তারা তামার তৈরী পানীয় পাত্র ব্যবহার করে।

আঠারো

সোনা, রূপা, দেশী তামা, সাদা জেড, আগ্নেয়-মুক্তা এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। এছাড়া বিরল রত্নাদি এবং বিভিন্ন নামের মূল্যবান পাথরও প্রচুর আছে। সাগর বুকের দ্বীপগুলি থেকে এসব সংগ্রহ করা হয়। অন্য পণ্যের সঙ্গে এগুলি তারা বিনিময় করে। সত্যি কথা বলতে কি তারা সবসময়ে ব্যবসায়িক পণ্যের বিনিময় করে থাকে। কারণ তাদের সোনা বা রূপোর মুদ্রা নেই। মুক্তা-ঝিনুক কিংবা ক্ষুদে মুক্তাও নেই।

[ভারত ও তার অধিবাসীদের সম্পর্কে পাঠকের মনে একটি সামগ্রিক ছবি ফুটিয়ে তুলে এবার রাজ্যভিত্তিক বিশদ বর্ণনার দিকে হিউয়েন সাঙ মন দিয়েছেন। বর্ণনা সুরু করেছেন লান-পো বা লামঘান থেকে। একে ভারতের লোকেরা সেকালে ‘লম্পক’ বলতেন। এখানে তিনি এসেছিলেন বাল্‌খ-জুমধ-তালিকান- গচি-বামিয়ান-কপিশার পথ ধরে। চীন থেকে পুরো যাত্রাপথটি জানার আগ্রহ থাকলে যে অধ্যায়ে তাঁর জীবনকথা বলা হয়েছে সেই অধ্যায়টি দেখুন। তারপর তাঁর বিবরণের দিকে মন দিন।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *