হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – ৩০

॥ ৩০ ॥ ‘পো-লো-য়ে-কিয়া’ বা প্রয়াগ

হয়মুখ থেকে গঙ্গা নদী পার হয়ে, নদীর দক্ষিণ কূল ধরে দক্ষিণ-পূর্বদিকে এগিয়ে গেলাম। প্রায় ৭০০ লি মতো পথ চলার পর ‘পো-লো-য়ে-কিয়া’ বা প্রয়াগ রাজ্যের দেখা পেলাম।

এ দেশটির পরিধি ৫০০০ লির কাছাকাছি। গঙ্গা নদীর দুটি শাখানদীর মাঝে ২০ লি মতো অঞ্চল জুড়ে এর রাজধানী গড়ে উঠেছে।

এখানে প্রচুর খাদ্যশস্যের ফলন হয়। ফল গাছেরও ছড়াছড়ি। আবহাওয়া উষ্ণ ও মনোরম। লোকজনের আচার-ব্যবহার ভদ্র ও মার্জিত। জ্ঞানচর্চ্চা করতে ভালবাসে। বিপরীত ধর্মের দিকে এদের প্রবল অনুরাগ।

এ রাজ্যে দুটি মাত্র সংঘারাম। সেখানে অল্পকতক ভিক্ষু রয়েছেন। সকলেই হীনযানের উপাসক

বেশ কয়েকটি দেবমন্দির আছে। বিধর্মীদের সংখ্যা সেখানে খুবই বেশি।

রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে এবং চাঁপাবনের মধ্যে রাজা অশোকের গড়া একটি স্তূপ দেখলাম। এর ভিত দেবে গেছে। তবু এর দেয়ালগুলি এখনো একশো ফুটের বেশি খাড়া। এর পাশে একটি স্তূপে বুদ্ধদেবের চুল ও নখকণা রাখা হয়েছে।

শেষে যে স্তূপটির কথা বললাম তার পাশে একটি পুরোনো সংঘারাম আছে। দেব বোধিসত্ত্ব এখানে থেকে ‘কোয়াঙ পিহ’ বা শতশাস্ত্ৰ বৈপুল্যম বইটি লেখেন। এ বইতে তিনি হীনযান শাখার মূলতত্ত্বকে খণ্ডন করার সঙ্গে সঙ্গে বিধর্মীদের মতবাদের অসারত্বও প্রমাণ করেন। তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে প্রথমে এখানে আসেন।

নগরীর মধ্যে একটি দেবমন্দির রয়েছে। এটি অতি সুন্দরভাবে কারুকার্য করা। এর খুব নামডাক। বিধর্মীদের পুঁথিপত্তর অনুসারে এটি সকল জীবের পুণ্য সঞ্চয়ের একটি প্রধান পীঠ।

অন্য কোন মন্দিরে ৫০০ স্বর্ণমুদ্রা দান করলে যে পুণ্য সঞ্চয় হয় এই মন্দিরে একটি কড়ি দান করলে তার চেয়ে নাকি বেশি পুণ্য হয়। যদি কোন লোক এখানে প্রাণবিসর্জন দেয় তবে সে নাকি স্বর্গে গিয়ে অনন্ত সুখভোগ করে।

মন্দিরের মূল দেব-কক্ষের বাইরে অনেক ঝুড়ি ও ডালপালামেলা বিরাট একটি গাছ আছে (অক্ষয় বট)। গাছটির নিচে বেশ ঘন ছায়া। অনেক লোক আত্মবিসর্জন করার দরুণ প্রচুর নরমাংস মেলে বলে এখানে এক নরমাংস ভোজী রাক্ষস থাকে। এ জন্য গাছটির ডাইনে বাঁয়ে তাকালে যে কেউ বিরাট হাড়ের স্তূপ দেখতে পারে। কেউ মন্দিরে এলে তার মনে নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মিয়ে আত্মবিসর্জনে উদ্দীপ্ত করার জন্য এখানে সব রকম ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু বিধর্মীরাই নয়, অশুভ আত্মারাও এ ব্যাপারে তাকে প্ররোচিত করে। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে এই অপরীতি এখানে চলে আসছে।

রাজধানীর পূর্বদিকে দুই নদীর সঙ্গমস্থলের কাছে দশ লি মতো অঞ্চল বেশ উঁচু ও মনোরম। পুরো জায়গাটি মিহি বালির আস্তরণে ঢাকা। রাজা-রাজড়া ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কেউ কোন কিছু দান করতে চাইলে এই জায়গাটিতে এসে তা করে থাকেন। প্রাচীনকাল থেকেই এই রীতি চলে আসছে। এজন্য এ জায়গাটি ‘মহাদানক্ষেত্র’ নামে খ্যাতি লাভ করেছে। পূর্ব-পুরুষের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অধুনা রাজা শিলাদিত্য এখানে এসে তাঁর পাঁচ বছরের সঞ্চয় একদিনে দান করে যান। এই ক্ষেত্রটিতে এসে সব ধনরত্ন স্তূপ সাজিয়ে প্রথমদিন তিনি খুব সমারোহের সঙ্গে বুদ্ধের পূজাঅর্চ্চনা করে তাকে অতি মূল্যবান রত্নাদি নিবেদন করলেন। তারপর দান করা শুরু হল। প্রথমে স্থানীয় ভিক্ষুরা দান পেলেন। তারপর দূর থেকে আসা ভিক্ষুরা। এরপর রাজ্যের বিশিষ্ট সব গুণীজনদের দেওয়া হল। এরপর এল স্থানীয় ভিন্নধর্মীদের পালা। সবার শেষে বিধবা, অসহায়, অনাথ, পরিত্যক্ত, গরিব আর ভিখারিরা দান পেলো।

এ ভাবে দান করে ধনাগার ও খাদ্যশস্যাদি শেষ করার পর তিনি তাঁর রাজমুকুট, ইত্যাদি সব খুলে নিয়ে তাও বিলিয়ে দিলেন। প্রথম থেকে শেষ অবধি এজন্য তাঁর কোন রকম দুঃখ বা কাতরতা দেখা গেল না। বরং সব শেষ হয়ে যাবার পর আনন্দে উচ্ছলভাবে চেঁচিয়ে উঠে বললেন ‘চমৎকার! আমার সব কিছু এখন অজয় অক্ষয় ধনাগারে জমা পড়ল।

এ রকম দানের পর বিভিন্ন দেশের রাজারা তাঁর রত্ন ও পরিচ্ছদাদি রাজাকে দিতেন। উদ্দেশ্য, যাতে আবার তাঁর কোষাগার ভরে উঠতে পারে।

দানক্ষেত্রের পূর্বদিকে, দুই শাখানদীর সঙ্গমস্থলে প্রত্যেকদিন শত শত লোক স্নান করে বা জীবন বিসর্জন দেয়। এ দেশের লোকেরা মনে করে স্বর্গবাসী হবার জন্য পুরো উপোস থেকে এখানে প্রাণ বিসর্জন করা উচিত। এখানকার জলে স্নান করলে জীবনের যতো পাপ ধুয়ে মুছে যায়। এজন্য বিভিন্ন দেশের নানা সুদূর অঞ্চল থেকে লোকেরা দল বেঁধে এখানে আসে ও বিশ্রাম নেয়। সাতদিন ধরে কোন খাবার না খেয়ে, উপোস থেকে, প্রাণ বিসর্জন দেয়। এমন কি বানর ও পাহাড়ী হরিণরাও এই নদীর কাছে এসে জমা হয়! তাদের কতক স্নান করে ফিরে যায়, কতক আবার উপোস করে প্রাণত্যাগ করে।

এখানকার নদীর ধারে এক গাছের নিচে একটি বানর থাকত। একবার শীলাদিত্য রাজা যখন এখানে দান ধ্যানের জন্য এলেন ওই সময়ে এই বানরটি না খেয়ে উপোস করে রইলো ও কিছুদিনের মধ্যেই এ জন্য মারা পড়লো।

যেসব ভিন্ন ধর্মীরা সন্ন্যাসজীবন যাপন করে তারা নদীর মধ্যে একটি উঁচু স্তম্ভ তুলেছে। সূর্য অস্ত যাবার আগে তারা এতে চড়ে। তারপর এক হাত ও এক পা দিয়ে স্তম্ভটিকে আঁকড়ে থেকে বিস্ময়করভাবে বাকি দেহটা বাইরের দিকে বার করে দেয়। এ ভাবে দেহকে শূন্যে প্রসারিত করে তারা সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে। সূর্যের গতির সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাথাটিও ধীরে ধীরে ডানদিকে হেলে চলে। আঁধার ঘনিয়ে এলে তারা সেখান থেকে নেমে আসে। প্রচুর সন্ন্যাসী এরূপ অভ্যাস করে। তারা আশা করে যে এর ফলে তারা জন্ম-মৃত্যুর বাঁধন কাটতে পারবেন। অনেক সন্ন্যাসী কয়েক দশক ধরে এ অভ্যাস পালন করে চলেছে।

॥ ৩১ ॥ কিয়াউ-শাঙ-মি বা কৌশম্বী

প্রয়াগ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গেলে এক বিশাল অরণ্যের দেখা পাওয়া যাবে। এটি নানারকম হিংস্র জন্তু-জানোয়ার ও বুনো হাতিতে ভরাট। এরা দল বেঁধে চলাফেরা করে, যাত্রীদের নানা বিপদ ঘটায়। এজন্য বিরাট দল বেঁধে এ পথে যাওয়া আসা না করলে পদে পদে বিপদের আশঙ্কা। এই পথ ধরেই আমাদের এগোতে হলো। ৫৩০ লির মতো পথ চলে আমরা কিয়াউ-শাঙ-মি বা কৌশম্বী এলাম।

এ দেশটির আয়তন ৬০০০ লির মতন। রাজধানী তিরিশ লির কাছাকাছি। উর্বরা শক্তির জন্য এখানকার মাটির সুনাম রয়েছে। শাক-সবজী ও ফসল ক্ষেতে গাছের বাড় অবাক হয়ে চেয়ে দেখার মতো। চালার আখের ফলন খুবই ভালো। গরম একটু বেশিই পড়ে। লোকদের আচার-ব্যবহার কঠোর ও রুক্ষ। জ্ঞানচর্চ্চার দিকে ঝোঁক রয়েছে। অসংখ্য ভিন্ন ধর্মীর বাস সেখানে।

নগরে, একটি পুরোনো রাজপ্রাসাদের মধ্যে ৬০ ফুটের মতো উঁচু একটি বড়ো বিহার আছে। এটি রাজা উদয়নের বানানো। এখন পর্যন্ত অনেক দেশের রাজাই এ মূর্তিটিকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও এখান থেকে একে নড়াতে পারেনি। তাই তারা এর অনুকৃতি পূজা করে। এ রকম মিথ্যা প্রচারও অনেকে করে যে তাদেরটিই হল আসল মূর্তি, অন্য সব তারই নকল।

তথাগত প্ৰথম বুদ্ধত্ব লাভের পর মায়ের কাছে ধর্ম-ব্যাখ্যানের জন্য তিনমাস কাল স্বর্গে গিয়ে থাকেন। তাঁর অদর্শনে আকুল হয়ে রাজা একটি মূর্তি বানানোর মন করেন। মুদগলায়ন-পুত্রকে এজন্য তিনি আধ্যাত্মিক শক্তি বলে একজন শিল্পীকে স্বর্গে পাঠাতে অনুরোধ জানান। শিল্পী যাতে বুদ্ধের বিশেষ শরীরলক্ষণগুলি দেখে নিয়ে চন্দন কাঠে তার একটি সঠিক প্রতিমূর্তি করতে পারেন সে জন্যই এ অনুরোধ করা হয়। স্বর্গলোক থেকে বুদ্ধ যখন ফিরে এলেন তখন কাঠের মূর্তিটি উঠে দাঁড়িয়ে জগৎপতিকে প্রণাম করলো। জগৎপতি বুদ্ধ তখন তাকে লক্ষ্য করে করুণামাখা কণ্ঠে বললেন—”বিধর্মীদের মত পরিবর্তন করিয়ে ভবিষ্যৎকালে তাদের ধর্মের পথে চালিত করাই হবে তোমার একমাত্র কাজ। শুধু এই আশাই আমি তোমার কাছ থেকে করি।’

এই বিহারের পূর্বদিকে ১০০ পায়ের মতো গেলে বিগত চার বুদ্ধের বসা ও চলাফেরার পদচিহ্ন দেখা যাবে। এর পাশে, অল্প খানিকটা এগিয়ে তথাগতের ব্যবহৃত একটি কুয়া ও স্নানের ঘর আছে কুয়াটিতে এখনো জল আছে, কিন্তু স্নানের ঘরটি অনেককাল আগেই নষ্ট হয়ে গেছে।

নগরের ভিতরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি পুরোনো বসতবাড়ির অবশেষ আছে। এটিই অভিজাত ঘোশিরের বসত ভিটে। এর মাঝে একটি বুদ্ধ-বিহার রয়েছে। চুল ও নখকণার একটি স্তূপও আছে। এখানেও বুদ্ধের স্নানঘরের অবশেষ রয়েছে।

নগরের উত্তর-পূর্বে অল্প খানিকটা গেলে একটি পুরোনো সংঘারাম চোখে পড়বে। এখানে আগে ঘোশিরের বাগান ছিল। এখানে রাজা অশোকের গড়া একটি স্তূপ দেখলাম। এটি ২০০ ফুটের মতো উঁচু। বুদ্ধের চুল ও নখকণার একটি স্তূপও আছে।

সংঘারামের দক্ষিণ-পূর্বদিকে একটি দোতালা বুরুজের উপরে একটি ইটের তৈরী পুরোনো ঘর আছে। এখানে বসুবন্ধু বোধিসত্ত্ব বাস করতেন। এই ঘরে বসে তিনি বিদ্যামাত্র সিদ্ধি শাস্ত্রবইটি রচনা করেন। এ বইতে তিনি হীনযান ও ভিন্ন ধর্মীদের মতবাদ খণ্ডন করেছেন।

সংঘারামটির পূর্বদিকে, আমবনানীর মধ্যে একটি পুরোনো ভিটে দেখা যায়। এখানে অসঙ্গ বোধিসত্ত্ব ‘হিন-যাঙ-শিঙ-কিয়াউ’ শাস্ত্রবইটি লেখেন।

নগরীর দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ৮-৯ লি মতো যাবার পর এক বিষধর নাগের আবাস দেখা যাবে। এই নাগরাজকে বশ করে তথাগত এখানে তার ছায়া রেখে যান। স্থানটি সম্পর্কে এরকম প্রবাদ চালু থাকলেও এখানে ছায়ার কোন চিহ্নবর্ণ দেখলাম না।

এর পাশে রাজা অশোকের গড়া দুশো ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ চোখে পড়লো। কাছে বুদ্ধদেবের চলাফেরার চরণ-চিহ্ন রয়েছে। চুল ও নখকণার স্তূপও একটি রয়েছে।

শাক্যের ধর্ম যখন লোপ পাবে তখন এই একটিমাত্র দেশেই তা টিকে থাকবে। এজন্য শাক্য বুদ্ধের অনুগামী ছোট বা বড়ো যে-ই এ দেশে আসে তার হৃদয় গভীর আবেগে উতল হয়ে ওঠে, চোখ জলে ভরে আসে, তাড়াতাড়ি ফিরে চলে যায়।

নাগ-আবাসের উত্তর-পূর্বে একটি বিরাগ অরণ্য রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ৭০০ লি মতো পথ চলার পর আমরা গঙ্গা পার হলাম। তারপর উত্তরমুখো গিয়ে ‘কিয়া- শি-পো-লো’ বা কশপুর শহর পেলাম। এটির আয়তন দশ লি মতন। অধিবাসীরা ধনী ও সচ্ছল।

শহরটির কাছে একটি সংঘারাম ছিল। এখন তার বনিয়াদটুকুই মাত্র টিকে আছে। ধর্মপাল বোধিসত্ত্ব এখানে বিধর্মীদের মতবাদ খণ্ডন করেছিলেন।

এর পাশে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ আছে। এর দেয়ালগুলিতে ভাঙন ধরেছে। তবু এখনো এটি ২০০ ফুটের মতো উঁচু। চুল ও নখকণার একটি স্তূপও রয়েছে।

॥ ৩২ ॥ ‘পি-সো-কিয়’ বা বিশাখা

এবার উত্তর দিকে পথ চলা শুরু করলাম। ১৭০ থেকে ১৮০ লি পার হবার পর ‘পি-সো-কিয়’ বা বিশাখা রাজ্যে এলাম।

বিশাখা রাজ্যটির বিস্তার প্রায় চার হাজার লি মতো। রাজধানীর ঘের ১৬ লির কাছাকাছি। এখানে খাদ্যশস্যের প্রচুর ফলন হয়। ফুল আর ফলেরও ছড়াছড়ি। লোকেরা সাধু ও সৎ। জ্ঞানচর্চ্চার দিকে বেশ উৎসাহ ও যত্ন রয়েছে। পুণ্য অর্জনের দিকেও অশেষ চেষ্টা রয়েছে।

এখানে কুড়িটির মতো সংঘারাম আছে। সেখানে তিন হাজারের মতো ভিক্ষু থাকেন। তারা সম্মতীয় শাখানুসারে হীনযানের অনুগামী। দেবমন্দির পঞ্চাশটির কাছাকাছি। সেখানে অসংখ্য বিধর্মীর বাস।

শহরের দক্ষিণ দিকে, রাস্তার বাঁ পাশে একটি বড়ো সংঘারাম আছে। অহৎ দেবশর্মা এখানে বসে বিজ্ঞানকায় শাস্ত্রবইটি লেখেন। এই বইতে তিনি দেখান যে ব্যক্তিরূপে ‘আমি’র অস্তিত্ব নেই।

অর্হৎ গোপ এখানে থেকে ‘শিঙ-কিয়াউ-ইউ-শিহ-লুন’ বইটি লেখেন। সে বইতে তিনি দেখান যে ব্যক্তি হিসাবে ‘আমি’র অস্তিত্ব রয়েছে।

এই মতবাদ বিরাট তর্ক-বির্তকের ঝড় তোলে। আবার, ধর্মপাল বোধিসত্ত্ব এখানেই সাতদিনকাল থেকে হীনযানের শত (১০০) আচার্যকে পরাজিত করেন।

সংঘারামটির পাশে দু’শো ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ চোখে পড়লো। এটি রাজা অশোকের তৈরী। এই স্তূপটির পাশে একটি আশ্চর্য গাছ আছে। এটি মাত্র ৬ বা ৭ ফুট উঁচু। বহু বছর ধরে এটি ওই এক অবস্থায় আছে- একটুও বাড়েনি বা কমেনি। অতীতে, দাঁত পরিষ্কার করে তথাগত একবার তাঁর দাঁতনের টুকরোটি ফেলে দেন। সেটি শিকড় ছড়িয়ে ডালপালা মেলে। এটিই সেই গাছ। অন্যধর্মী ও ব্রাহ্মণরা মিলে এটিকে প্রায়ই কেটে ফেলে। কিন্তু আবার এটি আগের মতো গজায়।

এই জায়গাটি থেকে অল্প একটুখানি গেলেই একটি জায়গায় বিগত চার বুদ্ধের বসা ও চলাফেরার নিদর্শন রয়েছে। চুল ও নখকণার একটি স্তূপও আছে।

এখানে একের পর এক সার সার স্মারক মন্দির রয়েছে। যেদিকে যাও, যেখানে যাও এই একই দৃশ্য চোখে পড়বে। হ্রদের বুকে তাদের ছায়া ঝিলমিল করে, ঘন বনানীর মধ্যেও তারা তাদের ছায়া ফেলে খাড়া হয়ে আছে।

॥ ৩৩ ॥ শি-লো-ফু-শি-তি বা শ্রাবস্তী

বিশাখা থেকে এবার উত্তর-পূর্বদিকে যাত্রা করলাম। ৫০০ লির কাছাকাছি পথ ভাঙার পর “শি-লো-ফু-শি-তি’ বা শ্রাবস্তীতে এসে হাজির হলাম।

শ্রাবস্তী রাজ্যটির আয়তন ৬০০০ লির কাছাকাছি। প্রধান শহরটি জনমানব বর্জিত। এটির আয়তন যে কত সে বিষয়ে তথ্য না থাকায় তা আর জানা গেল না। শহরের রাজপুরী অঞ্চলটির ঘের দেয়ালের যে ভাঙা চিহ্ন রয়েছে তার মাপ প্রায় ২০ লি হবে। এই অঞ্চলটির পুরোটাই বলতে গেলে তখন ভগ্নস্তূপ। সামান্য কিছু বাসিন্দা এখনো সেখানে রয়েছে।

এ দেশটিতে খাদ্যশস্যের অঢেল ফলন। আবহাওয়া স্নিগ্ধ ও মনোরম। লোকজনের হাবভাব, স্বভাব-চরিত্র সৎ ও নির্মল। জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা রয়েছে। ধর্ম-কর্মের দিকে অনুরাগ আছে।

কয়েকশো সংঘারাম আছে এ রাজ্যটিতে। তবে বেশির ভাগই এখন ভাঙাচোরা। নামমাত্র কিছু অনুগামী আছে। তারাও আবার হীনযানের সম্মতীয় শাখার উপাসক। দেব মন্দির ১০০টি। অনুগামীদের সংখ্যাও অতি বিরাট।

তথাগত বুদ্ধের সময়ে এ রাজ্যের রাজা ছিলেন প্রসেনজিত। রাজকীয় শহরের পুরোনো বসতির মধ্যে কিছু পুরোনো ভিতের অবশেষ দেখলাম। এগুলিই রাজা প্রসেনজিতের রাজপ্রাসাদের শেষ নিদর্শন।

এখান থেকে অল্প কিছুটা দূরে পূর্বদিকে একটি ভাঙাচোরা ভিত দেখা গেল। এর উপরে একটি ছোট স্তূপ তোলা হয়েছে। এই ভাঙা ভিতটিই এককালে সদ্ধর্ম মহাকক্ষ (সদ্ধর্ম মহাশালা) ছিল। বুদ্ধদেবের জন্য রাজা প্রসেনজিত এটি তৈরী করে দিয়েছিলেন।

সদ্ধর্ম মহাকক্ষ থেকে একটুখানি এগিয়ে গেলে একটি ধ্বংসাবশেষ। তার উপরেও একটি স্তূপ বানানো হয়েছে পরে। বুদ্ধদেবের মাসী প্রজাপতি ভিক্ষুণীর জন্য রাজা প্রসেনজিত যে বিহারটি বানিয়ে দিয়েছিলেন সেটি এখানেই ছিল।

আরো পূর্বে এগিয়ে গেলে একটি স্তূপ চোখে পড়বে। এখানে সুদত্তের আবাস ছিল। স্তূপটি এখন তারই স্মারক।

সুদত্তের ভিটের পাশে একটি বড় স্তূপ আছে। অঙ্গুলিমাল্য এখানেই তাঁর অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপ ছেড়ে বৌদ্ধ ধর্মের শরণ নেন। অঙ্গুলিমাল্য সম্প্রদায় শ্রাবস্তীর এক নিন্দিত অপরাধী গোষ্ঠী ছিল।

শহরের দক্ষিণে ৫ বা ৬ লি মতো গেলে জেতবনের দর্শন পাওয়া যাবে। এখানেই রাজা প্রসেনজিতের প্রধান মন্ত্রী অনাথপিণ্ডদ, যাঁর মূল নাম সুদত্ত, বুদ্ধদেবের জন্য একটি বিহার বানিয়ে দেন। আগে এখানে একটি সংঘারাম ছিল। এখন শুধু তার ভাঙাচোরা কাঠামোটাই পড়ে আছে।

পূর্ব ফটকের ডাইনে-বাঁয়ে দু’দিকে দু’টি ৭০ ফুট খাড়া স্তম্ভ বানানো হয়েছে। বাঁদিকের স্তম্ভের নিচে একটি চক্র খোদাই করা। ডানদিকের স্তম্ভের মাথায় একটি ষাঁড়ের মূর্তি। দু’টিই রাজা অশোকের তৈরী। ভিক্ষুদের আবাস পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কেবল ভিতটুকুই যা পড়ে আছে। ব্যতিক্রম বলতে শুধু একটি ইটে গাঁথা বাড়ি। পুরো ভাঙাচোরা পরিবেশের মধ্যে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে বুদ্ধদেবের একটি মূর্তি বুকে নিয়ে।

পুরাকালে তথাগত যখন মায়ের কাছে ধর্ম ব্যাখ্যানের জন্য তেত্রিশতম স্বর্গে যান তখন রাজা উদয়ন যে চন্দন কাঠ দিয়ে বুদ্ধদেবের একটি মূর্তি বানান একথা আগেই বলেছি। রাজা প্রসেনজিতের কানে সে খবর এলে তিনিও একটি মূর্তি গড়েন। প্রসেনজিতের গড়া সেই মূর্তিটিই এই।

অভিজাত সুদত্ত একজন মানবিক হৃদয়সম্পন্ন প্রতিভাবান লোক ছিলেন। তিনি প্রচুর ধন-সম্পদ রোজগার করেন। আবার উদারভাবে দানও করতেন। তিনি গরীব ও সহায়-সম্বলহীন লোকদের সাহায্য দিতেন। অনাথ ও অথর্বদের প্রতিও তাঁর গভীর মমতা ছিল। তাঁর এই সব মহৎ গুণের জন্য তাঁর গুণমুগ্ধরা তাঁকে অনাথপিণ্ডদ নাম দেয়। বুদ্ধদেবের ধর্ম-প্রতিভার জন্য তিনি তাঁকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন ও একটি বিহার বানিয়ে দেবেন বলে সংকল্প করেন। এ দান গ্রহণের জন্য বুদ্ধকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন। সারিপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধ শ্রাবস্তী এলেন। বিহারের জন্য নানা জায়গা দেখার পর জেত রাজার এই উদ্যানটি তাঁদের পছন্দ হলো। বিহার গড়ার জন্য রাজা যাতে জমিটি দেন সেজন্য তাঁকে অনুরোধ জানাতেও তাঁরা রাজি হলেন। রাজা শুনে ব্যঙ্গ করে বললেন যদি ভূমির আয়তনের সমান স্বর্ণখণ্ড দেন তবে আমি এটি বেচতে রাজী।

সুদত্ত সে কথা শুনে সানন্দে রাজী হলেন। সর্ত পূরণের জন্য কোষাগার থেকে স্বর্ণখণ্ড এনে ভূমির উপর বিছিয়ে দিলেন। এ সত্ত্বেও অল্প একটুখানি জায়গা ফাঁকা থাকল। রাজা বললেন, এটুকু কম হলেও চলবে। কিন্তু সুদত্ত বললেন ‘বুদ্ধের ধর্ম সঠিক, আমিও এখানে সঠিক বীজ রোপণ করতে চাই।’ শেষে সেই ফাঁকা জায়গাটিতেই তিনি বিহার গড়েন।

বুদ্ধদেব আনন্দকে বললেন-এখানকার গাছপালা ‘জেত’ রাজার দেয়া। আর জমি দিয়েছে সুদত্ত। দুজনেই মহান, দুজনেই সমান ধার্মিক। সেই থেকে একে জেতবন ও অনাথপিণ্ডদের বাগান দুই-ই বলা হতো।

এ বাগানের উত্ত-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম দিকে দু’টি স্তূপ আছে। খানিক দূরে একটি কুয়া।

তথাগত এই কুয়াটির জল ব্যবহার করতেন। এর পাশে রাজা অশোকের গড়া একটি স্তূপ। এতে বুদ্ধদেবের দেহাস্থি রাখা আছে। এখানে অনেকগুলি জায়গা রয়েছে-যেখানে তথাগতের চলাফেরা ও ধর্ম ব্যাখ্যানের স্মৃতি চিহ্ন বৰ্তমান। এ দুই স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য রাজা (অশোক) একটি স্তম্ভ ও এই স্তূপটি গড়ে গেছেন। এই স্থানটিকে ঘিরে যেন এক বিস্ময় ও রহস্য-মহান পরিবেশ বিরাজমান

অনাথপিণ্ডদের বিহারটির পিছন দিকে একটুখানি এগিয়ে গেলে একটি জায়গা চোখে পড়বে। বুদ্ধের উপর নারী হত্যার কলঙ্ক চাপাবার জন্য ব্রাহ্মণরা ষড়যন্ত্র ক’রে এখানে একজন বারবনিতাকে হত্যা ক’রে মাটির নিচে পুঁতে রাখে।

সংঘারামটির (=বিহারটির) পূর্বদিকে একশো পা মত এগিয়ে গেলে একটি গভীর খাত দেখা যায়। বুদ্ধদেবকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করার দরুন দেবদত্ত এখান থেকে নরকগামী হন। ইনি ছিলেন দ্রোণোদন রাজার ছেলে।

এর দক্ষিণদিকে আরো একটি বিরাট খাত রয়েছে। এখানে কুলাকী ভিক্ষুণী, বুদ্ধদেবকে অপবাদ দেবার পাপে জীবন্ত নরকগামী হয়।

কুলাকী খাতের দক্ষিণে ৮০০ পায়ের মত যাবার পর আর একটি বেশ বড়ো আর গভীর খাতের দেখা পাওয়া যাবে। ব্রাহ্মণ কন্যা চনশ্চা পেটে কাঠ বেঁধে নকল গর্ভবতী সেজে তথাগতের উপর কলঙ্ক আরোপ করতে গিয়ে এখান থেকে জীবন্ত নরকে যায়।

এই তিনটি খাত ভয়ানক গভীর। গ্রীষ্ম ও শরৎকালের বন্যায় সব হ্রদ ও পুকুর যখন কানায় কানায় ভরে ওঠে তখনো এই খাত-তিনটিতে জল জমার কোন লক্ষণ দেখা যায় না।

জেতবনের অনাথপিণ্ডদ সংঘারামটি থেকে ৬০-৭০ পা হেঁটে গেলে ৬০ ফুটের মতো উঁচু একটি বিহার দেখা যাবে। এখানে পূর্বমুখী হয়ে বসে থাকা ভঙ্গিমায় বুদ্ধদেবের একটি মূর্তি রয়েছে। বুদ্ধদেব তাঁর জীবদ্দশাকালে এখানে বিধর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এটি থেকে আরো পূর্বে এই বিহারটির সমান আকারের একটি দেবমন্দির আছে। সূর্য ওঠার আগে এ মন্দিরের ছায়া বিহারের গায়ে পড়ে না, অথচ অস্তকালে বিহারটির ছায়া দেবমন্দিরটিকে ঢেকে ফেলে।

এই বিহারটি থেকে পূর্বদিকে তিন-চার লি মতো গেলে একটি স্তূপ দেখা যাবে। এখানে সারিপুত্র বিধর্মীদের সঙ্গে বসেছিলেন। রাজা জেত-এর বাগানটি সুদত্ত যখন বুদ্ধদেবকে বিহার করে দেবার জন্য প্রথম কেনেন, তখন সারিপুত্র তাঁর পরিকল্পনা পরিদর্শন ও রূপায়ণে সাহায্য করার জন্য তাঁর (সুদত্ত) সঙ্গে এখানে আসেন। এ সময়ে ৬ জন বিধর্মী আচার্য তাঁকে আধ্যাত্মিক ক্ষমতাচ্যুত করতে উদ্যোগী হয়। সারিপুত্র যুক্তির দ্বারা তাদের বশ করেন। এই স্তূপের পাশে বিহার আছে। বিহারটির ঠিক সামনেই একটি স্তূপ তোলা হয়েছে। এখানে তথাগত বুদ্ধ বিধর্মীদের (ধর্ম-বিতর্কে) পরাস্ত করেন ও (একটি বিহার বানিয়ে দেয়া নিয়ে) বিশাখার প্রস্তাবে মত দেন।

ওই বিহার ও স্তূপের দক্ষিণ দিকে গেলে বিরুধক রাজা শাক্যদের হত্যা করার জন্য যেখানে সৈন্য সমাবেশ করেন সেই জায়গাটির দেখা পাওয়া যাবে। পরে বুদ্ধদেবকে দেখে তিনি তাঁর সব সৈন্য সরিয়ে নেন।

সৈন্য সমাবেশের জায়গাটির পাশেই একটি স্তূপ আছে। এখানেই শাক্য মেয়েদের মেরে ফেলা হয়েছিল। বিরুধক রাজা শাক্যদের পতন ঘটিয়ে তার জয়ের নিদর্শনরূপে ৫০০ শাক্য মেয়েকে নিজের মহলে নিয়ে আসেন। রাগে ও ঘৃণায় মেয়েরা জানাল যে তারা রাজাকে মোটেও মানবে না। তারা রাজাকে গালাগালি করে মহলের মধ্যে বিশৃঙ্খলার ঝড় তোলে। রাজা রেগে গিয়ে সকলকে মেরে ফেলার আদেশ দেন। আদেশ মতো এই শাক্য মেয়েদের সবাইকে হাত-পা কেটে খাতের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়।

শাক্য মেয়েদের হত্যার স্মারক স্তূপটির পাশে একটি বড় হ্রদ আছে। এটি এখন পুরোপুরি শুকনো। এখানেই বিরুধক রাজা সশরীরে নরকগামী হন।

সংঘারামটি থেকে তিন-চার লি উত্তর-পশ্চিম দিকে গেলে আমরা আগুনে বনে এসে পৌঁছাই। তথাগতের নিয়মিত ভ্রমণ ও চলাফেরার নিদর্শনাদি এখানে রয়েছে। এছাড়া আরো অনেক পবিত্র পুরুষ এখানে গভীর সাধনা করে গেছেন। এই সব স্থানে কোথাও বা বিবরণ খোদাই করা স্তম্ভ, কোথাও বা স্তূপ গড়ে তোলা হয়েছে।

রাজধানী থেকে ১৬ লির মতো উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি পুরোনো শহর রয়েছে। যে কালে প্রত্যেক মানুষ ২০,০০০ বছর বেঁচে থাকতো, ভদ্রকল্পের সেই যুগে কাশ্যপ বুদ্ধ এই শহরে জন্মেছিলেন। শহরের দক্ষিণ ভাগে একটি স্তূপ আছে। এখানেই বুদ্ধত্ব লাভের পর প্রথম কাশ্যপ বুদ্ধর সঙ্গে তাঁর পিতার দেখা হয়।

এই শহরের উত্তর ভাগে একটি স্তূপ চোখে পড়বে। এটিতে কাশ্যপ বুদ্ধের পুরো দেহাবশেষ রাখা হয়েছে। এ দু’টি স্তূপই রাজা অশোক বানিয়ে গেছেন।

॥ ৩৪ ॥ ‘কিএ-পি-লো-ফ-সে-তি’ বা কপিলাবস্ত

কাশ্যপ বুদ্ধের জন্মস্থান থেকে এবার দক্ষিণ-পূর্বদিকে যাত্রা করা হলো। ৫০০ লির মতো পথ ভাঙবার পর ‘কিএ-পি-লো-ফ-সে-তি’ বা কপিলাবস্তু এসে পৌঁছলাম।

এদেশটির বিস্তার চার হাজার লির কাছাকাছি। এখানে দশটি জন-মানবহীন শহর চোখে পড়লো। এগুলি পুরোপুরি জন-বসতি শূন্য ও ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। রাজধানীটিও তার রাজধানীর গৌরব খুইয়ে ভেঙেপড়া চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আয়তন কত তা সঠিকভাবে মাপার উপায় নেই। শহরের মধ্যে থাকা রাজপুরীর ঘের ১৪ থেকে ১৫ লি হবে। সেটি পুরোপুরি ইট দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। দালানগুলির ভিত এখনো বেশ মজবুত আর উঁচু। অনেক কাল ধরে এখানে কোন মানুষজন বাস করে না। বসতি থাকা গ্রাম মাত্র গুটিকয়েক। তাও হতশ্রী চেহারা।

এ রাজ্যে কোন সর্বোচ্চ শাসক নেই। প্রত্যেকটি শহরেই আলাদাভাবে নিজ নিজ শাসনকর্তা রয়েছে। জমি সরস ও উর্বরা। ঋতু অনুসারে নিয়মমাফিক চাষ- আবাদের কাজ হয়। আবহাওয়ার মধ্যে সমতার ভাব রয়েছে। মানুষজনের স্বভাব- চরিত্র, চালচলন বেশ বিনীত ও ভদ্র।

সারা দেশ জুড়ে এক হাজার কি তারো বেশি সংঘারাম আছে। প্রায় সবগুলিই ভাঙাচোরা বা ভাঙো-ভাঙো অবস্থায় এসে ঠেকেছে। রাজ বসতির পাশে এখনো একটি সংঘারাম টিকে আছে জনতিরিশেক ভিক্ষু নিয়ে। এরা সকলেই হীনযানের সম্মতীয় শাখার উপাসক।

দু’টি দেবমন্দির আছে। সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুগামীরা বসবাস ও সাধন-ভজন করেন। রাজবসতির মধ্যে কয়েকটি ভাঙাচোরা দালানের ভিত আছে। এগুলি রাজা শুদ্ধোদনের মূল রাজপ্রাসাদের অবশেষ। এই ভিতের ওপর একটি বিহার গড়ে তোলা হয়েছে। তাতে রাজা শুদ্ধোদনের মূর্তি আছে। এর অদূরে একটি দালানের ধ্বসে পড়া ভিত। এইটাই এককালে রাণী মহামায়ার শোবার মহল ছিল। এখানেও একটি বিহার গড়া হয়েছে। তাতে রাণীর প্রতিমূর্তি রাখা আছে।

পাশে আর একটি বিহার। এখানেই বোধিসত্ত্ব আধ্যাত্মিক ভাবে মাতৃগর্ভে প্রবেশের জন্য অবতরণ করেন। বিহার মধ্যে তারই দৃশ্য আঁকা রয়েছে। মহাস্থবির শাখার অনুগামীরা বলেন, বোধিসত্ত্ব উত্তরাষাঢ়া মাসের তিরিশ তারিখের রাতে গর্ভে সঞ্চারিত হয়েছিলেন। আমাদের চীনা পঞ্জিকা অনুসারে এ ঘটনাকাল পঞ্চম মাসের পনেরো তারিখ। অন্যান্য শাখার অনুগামীরা এই ঘটনার কাল এই একই মাসের ২৩ তারিখ বলে ধরে। আমাদের পঞ্জিকা অনুসারে পঞ্চম মাসের ৮ তারিখ।

গর্ভাধান মহল থেকে উত্তর-পূর্বদিকে একটি স্তূপ আছে। অসিত ঋষি এখানে এসেই রাজকুমার সম্পর্কে ভবিষ্যবাণী করেন।

শহরের দক্ষিণ ফটকে একটি স্তূপ দেখলাম। এখানেই রাজকুমার অন্য শাক্য কুমারদের সঙ্গে শিল্পকলা প্রতিযোগিতা থেকে ফেরার পথে দেবদত্তের মারা হাতিটিকে দেখেন। হাতিটির মৃতদেহ সরিয়ে সকলের যাতায়াতের পথ করে দেবার জন্য সেটিকে তুলে ওই সময়ে তিনি শহরের পরিখা মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেন। হাতিটির দেহ মাটিতে সজোরে পড়ার জন্য যে গভীর ও বড়ো গর্তটি সৃষ্টি হয় তাকে সেকাল থেকেই লোকেরা ‘হাতিখাত’ (হস্তীগৰ্ত্ত) বলে আসছে।

এর পাশেই একটি বিহার আছে। এটিতে রাজকুমারের মূর্তি রয়েছে। পাশে আবার আরেকটি বিহার। এখানে রাজবধূ ও রাজকুমারের শোবার মহল ছিল। এই বিহারে যশোধরা ও রাহুলের প্রতিকৃতি রয়েছে। রাজবধূ মহলের পাশে একটি বিহার আছে। তাতে পাঠরত একটি ছাত্রের মূর্তি রয়েছে। এটি রাজকুমারের বিদ্যালয় গৃহের অবস্থান ক্ষেত্রের স্মারক।

শহরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি বিহার দেখলাম। এখানে উঁচু লাফ দেয়া একটি সাদা ঘোড়ার পিঠে বসা অবস্থায় রাজকুমারের মূর্তি রয়েছে। এখান থেকেই তিনি শহর ছেড়ে চলে যান। শহরের চার ফটকের বাইরে একটি ক’রে বিহার রয়েছে। তাতে যথাক্রমে একজন জরাগ্রস্ত, একজন মৃত ও একজন সন্ন্যাসীর মূর্তি আছে। পার্থিব ভোগ-বাসনার দিকে তার মনে বিরাগ দেখা দেয় ও সত্য- অন্বেষণের গভীর বাসনা জাগে।

শহর থেকে পঞ্চাশ লি মতো দক্ষিণ দিকে পথ চলার পর একটি পুরোনো শহরের দেখা পেলাম। এখানেও একটি স্তূপ আছে। ক্রকুচ্ছন্দ বুদ্ধ এই স্থানটিতেই জন্ম নিয়েছিলেন। সে হলো ভদ্রকল্পের কথা। সে যুগে লোকেরা ৬০,০০০ বছর বাঁচতেন।

শহর থেকে একটুখানি এগিয়ে দক্ষিণে একটি স্তূপ আছে। বুদ্ধত্ব লাভের পর প্রথম এখানেই ক্রকুচ্ছন্দ বুদ্ধের সঙ্গে তাঁর পিতার দেখা হয়।

শহরের দক্ষিণ-পূর্বদিকে একটি স্তূপ দেখা যাবে। এখানে তথাগত বুদ্ধের দেহাবশেষ রাখা হয়েছে। স্তূপটির সামনে ৩০ ফুটের মতো খাড়া একটি স্তম্ভ। তার মাথায় একটি সিংহমূর্তি খোদাই করা। এর পাশে বুদ্ধের নির্বাণ লাভ বিবরণ লেখা একটি খোদাই লিপি রয়েছে। এটি রাজা অশোকের কীর্তি।

শহরের উত্তর-পূর্বে ৩০ লি মতো যাবার পর আমরা আর একটি পুরোনো রাজধানী শহরে পৌঁছলাম। এখানে ভদ্রকল্পে কনকমুনি বুদ্ধ জন্ম নিয়েছিলেন। সে সময়ে লোকেরা ৪০,০০০ বছর বাঁচতেন। তাঁর জন্মস্থানটিকে চির-স্মরণীয় করে রাখার জন্য সেখানে একটি স্তূপ গড়া হয়েছে।

এই শহরের উত্তর-পূর্বদিকেও একটি স্তূপ আছে। বুদ্ধত্ব লাভের পর কনকমুনির সঙ্গে এখানে প্রথম তাঁর পিতার দেখা হয়।

আরো উত্তর দিকে এগিয়ে গেলে একটি স্তূপের দেখা মিলবে। এই স্তূপটিতে কনকমুনির দেহাবশেষ রাখা আছে। সামনেই কুড়ি ফুট খানেক উঁচু একটি স্তম্ভ। স্ত ম্ভের মাথায় সিংহের মূর্তি খোদাই করা। স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা রয়েছে তাঁর নির্বাণ বিবরণ। এটি রাজা অশোকের তৈরী।

শহরটির উত্তর-পূর্বদিকে ৪০ লি মতো যাবার পর একটি স্তূপ চোখে পড়বে। হলকর্ষণ উৎসব দেখার জন্য রাজকুমার এখানে একটি গাছের নিচে বসেছিলেন। এখানে গভীর ভাবমগ্ন অবস্থায় বসে থাকার সময়েই তাঁর মধ্যে কামনার নিবৃত্তি ঘটে।

রাজধানীর উত্তর-পশ্চিম দিকে হাজার হাজার স্তূপের দেখা মিলবে। বিরুধক রাজা শাক্যদের জয় করার পর তাদের গোষ্ঠীর ৯৯৯ লক্ষ লোককে বন্দী করে তাদের কেটে মেরে ফেলার আদেশ দেন। এখানেই তাদের ওই ভাবে মেরে ফেলা হয়। স্তূপগুলি তারই স্মারক চিহ্ন।

এই নরমেধের জায়গাটি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে চারটি স্তূপ রয়েছে। এই জায়গাটিতে চারজন শাক্যবংশীয় বিরুধকের এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। প্রসেনজিত যখন প্রথম সিংহাসনে বসেন তখন তিনি শাক্যদের সঙ্গে বিবাহের বাঁধন দিয়ে মিতালি গড়ে তুলতে চান। অন্য বংশীয় হবার জন্য শাক্যরা তাঁকে ঘৃণার চোখে দেখতো। তাই এক দাস কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে তাঁকে তারা ঠকায় I এই কন্যা রাজা প্রসেনজিতের প্রধানা মহিষী হলেন। তার গর্ভে রাজার একটি পুত্র হলো। ছেলের নাম রাখা হলো বিরুধক। সে এক সময়ে মামার বাড়ি এসে রথে চড়ে বেড়াবার সময়ে দক্ষিণ দিকে একটি নতুন তৈরী প্রচার মহাকক্ষ দেখতে পেয়ে কৌতূহলী হয়ে সেখানে এলো। শাক্যরা সে খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে এসে বললো-”নিচজন্মা হয়ে তোমার এতো সাহস যে বুদ্ধের জন্য শাক্যদের তৈরী এই আবাসে তুমি এসেছ?’

বিরুধক রাজা হবার পর এই অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য সৈন্যবাহিনী নিয়ে এখানে এলেন। চারজন শাক্য এই সময়ে গিয়ে তাদের বাধা দিল এবং তাদের পরাস্ত ও ছত্রভঙ্গ করে শহরে ফিরে এলো। কিন্তু শাক্যরা তাদের বীরের সম্মান দিল না। যে বংশে দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীপতি (বুদ্ধ)-রা জন্ম নিয়েছেন সেই বংশের লোক হয়ে তারা এরূপ ক্রূর ও হিংসাত্মক কাজ করে শাক্যবংশের মুখে কালি মাখিয়েছে, এই মত প্রকাশ করে তারা তাদের শহর থেকে তাড়িয়ে দিল

বিতাড়িত হয়ে এই চার শাক্য তুষারাচ্ছন্ন পর্বতমালা ঘেরা উত্তরাঞ্চলে চলে গেল। প্রত্যেকেই সেখানে এক একটি দেশের রাজা হবার সৌভাগ্য লাভ করে। একজন বমিয়ান দেশের, আর একজন উদ্যান দেশের, তৃতীয় জন হিমতাল দেশের ও চতুর্থ জন শাম্বি (কৌশম্বী?) দেশের। তাদের বংশধরেরা সেখানে পুরুষানুক্রমে রাজত্ব করে চলেছে।

শহরের দক্ষিণ দিকে ৩ বা ৪ লি দূরে একটি বটকুঞ্জ মধ্যে রাজা অশোকের বানানো একটি স্তূপে আছে। বুদ্ধত্ব লাভের পর তথাগত প্রথম যখন জন্মস্থানে ফিরে এলেন তখন সেখানে পিতার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় ও সেখানেই তিনি ধর্ম ব্যাখ্যান করেন।

সংঘারামটি থেকে অল্প কিছু দূরে একটি স্তূপ আছে। এখানেই বুদ্ধ বিরাট একটি গাছের নিচে পূর্বমুখী হয়ে বসে তাঁর মাসী প্রজাপতির কাছ থেকে সোনার সূতো দিয়ে তৈরী কষায় পরিচ্ছদ গ্রহণ করেছিলেন। সেখান থেকে একটুখানি এগিয়ে গেলে আরেকটি স্তূপ। সেখানে বসে তথাগত আট রাজকুমার ও ৫০০ জন শাক্যকে আপন ধর্মে দীক্ষিত করেন।

শহরের পূর্ব ফটকের ভেতর দিকে, রাস্তার বাঁ পাশে একটি স্তূপ রয়েছে। এই জায়গাটিতে সিদ্ধার্থ খেলাধুলা করতেন।

ফটকের বাইরের দিকে ঈশ্বর দেবের (মহেশ্বর?) মন্দির। দেব বিগ্রহটি পাথর দিয়ে তৈরী। মূর্তিটি নিচ থেকে উঠে দাঁড়াবার ভঙ্গীতে গড়া। রাজকুমার যখন শিশু তখন তিনি এই মন্দিরটিতে আসেন। রাজকুমারকে দেখে শুদ্ধোধন তখন লুম্বিনী উদ্যান থেকে ফিরে আসছিলেন। মন্দিরটির পাশ দিয়ে যেতে যেতে তিনি বললেন, “এই মন্দিরটি নানা অলৌকিকতার জন্য বিখ্যাত। শাক্য শিশুরা এখানে এসে কোনরকম দৈবানুকূল্য প্রার্থনা করলে সব সময় তা পূরণ হতে দেখা যায়। রাজকুমারকে নিয়ে একদিন এসে পুজো দিতে হবে।” এই সময়ে কুমারের ধাই-মা তাঁকে নিয়ে মন্দির মধ্যে গিয়ে ঢুকলো। পাথরের মূর্তিটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে রাজকুমারকে প্রণাম জানালো। রাজকুমার চলে গেলে মূর্তিটি আবার বসে পড়লো।

শহরের দক্ষিণ দিকে রাস্তার বাঁদিকে একটি স্তূপ আছে। রাজকুমার অন্যান্য শাক্য কুমারদের সঙ্গে এখানে খেলাধুলা ও অস্ত্রশিক্ষা করতেন। এখানেই তিনি একদিন তাঁর ধনুঃশর দিয়ে লোহার তৈরী লক্ষ্য বস্তুটিকে ভেদ করেন।

এখান থেকে ৩০ লি মতো দক্ষিণ-পূর্বদিকে গেলে একটি ছোট স্তূপ নজরে পড়বে। এখানে একটি ঝরণা আছে। তার নির্মল জল আয়নার মতো স্বচ্ছ। ধনুক নিয়ে প্রতিযোগিতাকালে কুমার যে তীর ছোঁড়েন সে তীরটি লোহার লক্ষ্যবস্তু ভেদ করে এখানে এসে মাটিতে পালক পর্যন্ত বিঁধে যায়। আর তার ফলে মাটি ফুঁড়ে একটি ঝরণাধারা বইতে শুরু করে। এজন্য লোকেরা এটিকে ‘শরকূপ’ বলে। অসুস্থ লোকেরা এই ঝরণার জল পান করলে স্বাস্থ্য ফিরে পায়। বহু দূর থেকে লোকেরা এসে এখানকার কাদামাটি নিয়ে যায়। শরীরের কোথাও বেদনা বোধ করলে সেখানে এই মাটির প্রলেপ দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সেরে ওঠে।

শরকূপের উত্তর-পূর্বে আশি-নব্বই লির মতো যাবার পর লুম্বিনী-উদ্যানের দর্শন মেলে। এখানেই শাক্যদের স্নানের পুকুরটি রয়েছে। তার জল টলটলে ও আয়নার মতো স্বচ্ছ। পুকুরের বুক নানারকম ফুলে ঢাকা

এর উত্তরে ২৪-২৫ পা গেলে অশোক ফুল গাছ। এটি এখন আর নেই। এখানেই বোধিসত্ত্ব জন্মগ্রহণ করেন। বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় পক্ষের ৮ তারিখ ছিল সেদিন। আমাদের চীনা পঞ্জিকা মতে বছরের তৃতীয় মাসের ৮ তারিখ। স্থবির শাখার অনুগামীদের মতে সে দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় পক্ষের পনেরো তারিখ। আমাদের পঞ্জিকা অনুসারে তৃতীয় মাসের পনেরো তারিখ।

এর পূর্ব দিকে, যেখানে দু’জন নাগ রাজকুমারকে স্নান করিয়ে দিয়েছিল সেখানে অশোক রাজা একটি স্তূপ বানিয়ে গেছেন।

এই স্তূপের পূর্বদিকে দু’টি স্বচ্ছ স্রোত বয়ে চলা প্রস্রবণ রয়েছে। তার পাশে দু’টি স্তূপ বানানো হয়েছে। এখানেই নাগ দু’টি মাটির নিচ থেকে উঠে এসেছিল। বোধিসত্ত্ব যখন জন্ম নেন তখন নবজাতকের জন্য জলের খোঁজে পরিচারিকা ও আত্মীয়-স্বজনেরা চারিদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। এই সময় রাণীর ঠিক পাশে মাটি ফুঁড়ে প্রস্রবণ দুটি দেখা দেয়। একটি ঠাণ্ডা জলের, আর একটি গরম জলের। এই জল দিয়ে নাগেরা নবজাতককে স্নান করিয়ে দিল।

প্রস্রবণ দু’টির দক্ষিণ দিকে গেলে একটি স্তূপ দেখা যাবে। এখানেই দেবরাজ ইন্দ্র বোধিসত্ত্ব জন্মাবার পর তাকে কোলে তুলে নিয়ে স্বর্গের তৈরী মনোরম পোষাক পরিয়ে দেন।

এর কাছেই চারিটি স্তূপ আছে। স্বর্গলোকের চার জন রাজা এখানে বোধিসত্ত্বকে কোলে নিয়েছিলেন।

এই স্তূপগুলির পর খানিকটা এগিয়ে একটি বড় পাথরের স্তম্ভ দেখা যাবে। তার ওপরে একটি ঘোড়ার মূর্তি রয়েছে এটি অশোক রাজার বানানো। পরবর্তীকালে একটি দুষ্ট নাগের দুরন্তপনায় এটি মাঝখান থেকে ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়। এর পাশ দিয়ে একটি ছোট নদী দক্ষিণ-পূর্বদিকে বয়ে গেছে। স্থানীয় লোকেরা একে তেল নদী বলে। পুত্রের জন্মের পর রাণীর স্নানের জন্য দেবতারা এটিকে স্বচ্ছ ও (তেল) ঝলমলে জলে ভরা পুষ্করিণী রূপে গড়ে দিয়েছিলেন। বর্তমানে এটি একটি নদীর রূপ নিয়েছে। এর জল এখনো আগের মতো তেলতেলে।

॥ ৩৫ ॥ লান-মো: রাম বা রামগ্রাম

লুম্বিনী থেকে এবার পূর্বদিকে চললাম। হিংস্র জন্তু জানোয়ার থাকা ঘন বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে এবার আমাদের পথ চলতে হলো। প্রায় তিনশো লি যাবার পর আমরা ‘লোন-মো’ বা রামরাজ্যে এসে পৌঁছলাম।

এই রাজ্যটি বহুকাল চাষ-আবাদহীন ও জনমানব শূন্য অবস্থায় পড়ে ছিল। রাজ্যটির আয়তন ঠিক কিরূপ তার কোন হিসাব নেই। শহরগুলির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা। অধিবাসীর সংখ্যা সামান্য।

পুরোনো রাজধানী থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ইট দিয়ে বানানো একটি স্তূপের দেখা পেলাম। এটি একশো ফুটের মতো উঁচু। পুরাকালে বুদ্ধদেবের নির্বাণ লাভের পর, এখানকার রাজা তার দেহাবশেষের ভাগ পান। তা সসম্মানে নিজ রাজ্যে নিয়ে এসে এই স্তূপটি বানিয়ে এর মধ্যে রেখে দেন।

এই স্মারকটির পাশেই একটি স্বচ্ছ জলাধার রয়েছে। কাছেই একটি খোদাই লিপি।

এই স্তূপটির পরিবেশ থেকে অল্প দূরে একটি সংঘারাম দেখতে পেলাম। নামমাত্র কয়েকজন ভিক্ষু সেখানে। তাদের আচার-আচরণ মনে সম্ভ্রম জাগায়। প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয়ে তারা নিখুঁত। মাত্র একজন শ্রমণের’ সংঘের সমস্ত কাজ একা দেখাশোনা করেন। দূর দেশ থেকে কোন ভিক্ষু এলে তাকে পরম সৌজন্য ও উদারতার সঙ্গে আদর আপ্যায়ণ করা হয়। তিনদিনকাল তারা তাকে সংঘের অতিথিরূপে রাখে ও প্রয়োজনীয় চতুর্বিধ জিনিসই জোগায়।

এই সংঘারামটি থেকে পূর্বদিকে ১০০ লি মতো গেলে একটি বিরাট অরণ্য মধ্যে রাজা অশোকের বানানো একটি স্তূপ দেখা যাবে। সারথিকে বিদায় দিয়ে এখান থেকেই যুবরাজ (সিদ্ধার্থ) অনিত্যতার হাত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে যাত্রা করেন।

স্তূপের পূর্বদিকে, যেখান থেকে সারথি চণ্ডক ফিরে গিয়েছিল সেখানে একটি জাম গাছ আছে। এটির পাতা, ডালপালা সব নিশ্চিহ্ন হয়েছে। কিন্তু গুঁড়িটি এখনো খাড়া দাঁড়িয়ে। এর পাশে একটি ছোট স্তূপ আছে। এখানে যুবরাজা তাঁর মূল্যবান রাজ পোষাক ও আবরণ ছেড়ে মৃগচর্ম পরিধান করেন।

এই স্তূপটি থেকে অল্প একটুখানি দূরে রাজা অশোকের গড়া আরেকটি স্তূপ দেখা যাবে। এখানে রাজপুত্র তাঁর মাথার চুল কামিয়ে ফেলেন।

রাজকুমার কোন বয়সে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস নেন তা ঠিক ভাবে জানা যায় না। কেউ বলে তখন তাঁর বয়স ১৯ বছর ছিল। কেউ বলে ২৯ বছর। দিনটি বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় পক্ষের ৮ তারিখ। আমাদের চীনা পঞ্জিকা মতে তৃতীয় মাসের ১৫ তারিখ।

মাথা কামানোর স্মারক স্তূপটি থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ১৮০ থেকে ১৯০ লি মতো পথ ভাঙার পর একটি মরুভূমির মাঝে আমরা একটি বটকুঞ্জে এসে হাজির হলাম। এখানে তিরিশ ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ রয়েছে দেখলাম। পুরাকালে বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর যখন তাঁর দেহাবশেষ ভাগবাটোয়ারা হলো তখন ব্রাহ্মণেরা তার কোন ভাগ পেল না। তাই তারা দাহস্থলে এসে চিতার কাঠ কয়লা ও ছাই তাদের দেশে নিয়ে গেল। তার ওপরেই তারা এই স্তূপটি গড়ে পূজা অর্চ্চনা করে চলেছে।

চিতাভস্ম-স্তূপটির কাছে একটি পুরোনো সংঘারাম আছে।

তার ডাইনে বাঁয়ে কয়েকশো স্তূপ দেখা যাবে। এর মধ্যে একটি বড়ো স্তূপ। সেটি রাজা অশোকের বানানো। যদিও সেটির ভাঙা অবস্থা, তবু একশো ফুটের মতো উঁচু এখনো।

॥ ৩৬ ॥ ‘কিউ-শি-ন-কি’য়ে-লো’ বা কুশীনগর

এখান থেকে উত্তর-পূর্বদিকে এবার চলতে থাকলাম। বিরাট এক বনের মধ্য দিয়ে পুরোটা পথ যেতে হলো। এ পথ যে রীতিমত কষ্টকর আর বিপদজনক তা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলার দরকার করে না। কোথাও বুনো ষাঁড়, কোথাও বা হাতির পাল। এর ওপর আবার ডাকাত আর শিকারীর দলও রয়েছে। এদের সকলের কাছ থেকেই যে কোন মুহূর্তে সমান বিপদের সম্ভাবনা। এই দুর্গম অরণ্য পার হবার পর আমরা ‘কিউ শি-ন-কি’য়ে-লো’ বা কুশীনগর পৌঁছলাম।

এদেশের রাজধানীটি বর্তমানে চাকচিক্যহীন ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। সব শহর আর গ্রামগুলিও প্রায় চাষ-আবাদ শূন্য ও জন-মানব বর্জিত। পুরোনো রাজধানীর ইটের ঘের-দেয়ালের মাপ ১০ লি মতন হবে। সামান্য কিছু জনবসতি রয়েছে। শহরের রাস্তাঘাট জনশূন্য, ভাঙাচোরা ও আবর্জনায় ভরা।

শহরের ফটকের উত্তর-পূর্ব কোণে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ চোখে পড়লো। এটি চন্দের পুরোনো আবাস। এর মাঝখানে একটি কুয়া আছে। বুদ্ধকে খেতে দেবার সময় এটি সে খুঁড়েছিল। যদিও অনেক অনেক কাল পার হয়েছে তবু এখনো এর জল পরিষ্কার ও মিষ্ট।

শহরের উত্তর-পশ্চিমদিকে ৩ বা ৪ লি মতো গিয়ে অজিতবতী নদী পার হয়ে, নদীর পশ্চিম তীরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই আমরা শালবনের দর্শন পেলাম। শাল গাছ দেখতে অনেকটা আমাদের হু গাছের মতোই। সবুজাভ সাদা বাকল। পাতা তেল-তেলে মসৃণ। বনের মধ্যে চারিটি অসম্ভব উঁচু শাল গাছ আছে। তথাগত কোথায় মারা গেছেন এরাই সে কথা জানিয়ে দিচ্ছে।

এখানে ইটে গড়া একটি বিরাট বিহার রয়েছে। তার মধ্যে বুদ্ধের নির্বাণ অবস্থার মূর্তি আছে। উত্তরদিকে মাথা রেখে তিনি শুয়ে আছেন-বুঝি বা ঘুমিয়ে আছেন। বিহারের কাছাকাছি অশোক রাজার তৈরী একটি স্তূপ। এটির এখন ভাঙা দশা। তবু এর উচ্চতা এখনো ২০০ ফুটের মতো। সামনে বুদ্ধের নির্বাণ বিবরণ লেখার জন্য গড়া পাথরের স্তম্ভ। তাতে বিবরণ খোদাই করা থাকলেও তার মধ্যে ঘটনার বছর মাস দিনের কোন উল্লেখ নেই।

চলতি মত অনুসারে বুদ্ধদেবের বয়স হয়েছিল তখন আশি বছর। বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় পক্ষের ১৫ তারিখ তিনি নির্বাণ লাভ করেন। চীনা পঞ্জিকা অনুসারে বছরের তৃতীয় মাসের ১৫ তারিখ। কিন্তু সর্বাস্তিবাদীরা বলেন যে এ দিনটি কার্তিক মাসের দ্বিতীয় পক্ষের ৮ তারিখ। চীনা পঞ্জিকা অনুসারে তাহলে বছরের নবম মাসের ৮ তারিখ। বুদ্ধের মৃত্যু কতো বছর আগে হয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠী সে কথা বিভিন্ন রকম বলে। কেউ বলে তাঁর মৃত্যুর পর ১২০০ বছরেরও বেশি পার হয়ে গেছে। কেউ বলে, ১৩০০ বছরেরও বেশি। আবার কেউ বলে, ১৫০০ বছরেরও বেশি। কেউ কেউ আবার বলে যে ৯০০ পার হয়ে গেছে কিন্তু ১০০০ বছর ডিঙোয়নি।

বিহারটির কাছাকাছি দু’টি স্তূপ। তার পশ্চিম দিকে একটুখানি গেলেই আবার একটি স্তূপ দেখা যাবে। এখানে সুভদ্র মারা যান। তিনি মূলতঃ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর তখন ১২০ বছর বয়স হয়েছিল। এরূপ দীর্ঘকাল বাঁচার দরুন তিনি অনেক জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ পান। বুদ্ধ মৃত্যুমুখে— এ সংবাদ পেয়ে তিনি শালবৃক্ষ দু’টির কাছে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এই সময়ে তিনি বুদ্ধের অনুগামী হন। আবার বুদ্ধের মৃত্যুর আগেই অহতত্ব লাভ করে মারা যান। তাই তিনিই বুদ্ধের দ্বারা শেষ দীক্ষিত অথচ প্রথম নির্বাণ প্রাপ্ত শিষ্য।

সুভদ্রের নির্বাণ স্তূপের পাশে আর একটি স্তূপ আছে। এখানে বজ্রপাণি মূৰ্চ্ছা গিয়েছিলেন। পরম করুণাময় জগৎপিতা বুদ্ধ, পৃথিবীর বুকে মানুষের মতি পরিবর্তনের কাজ শেষ করে দু’টি শাল গাছের মাঝে নির্বাণের আনন্দলোকে প্রয়াণ করলেন। উত্তর দিকে মাথা রেখে তিনি সেখানে শেষ শয়ানে শায়িত হলেন।

বুদ্ধদেবকে মারা যেতে দেখে দেবোপম অথচ রহস্যভরা চরিত্রের মল্লরা হীরকদণ্ড হাতে নিয়ে কান্নার আবেগে ভেঙে পড়লেন। তাঁরা বলতে থাকলেন— “তথাগত চির-কালের মতো আমাদের ছেড়ে মহানির্বাণ-লোকে চলে যাচ্ছেন। আমাদের পরম আশ্রয় আমরা হারাতে বসেছি। আমাদের বুক খানখান হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যথার আগুন কিছুতে নেভার নয়।” হীরকদণ্ড ফেলে দিয়ে তাঁরা অনেকক্ষণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রইলেন। পরে উঠে বসে গভীর ব্যথা ও ভালবাসার আবেগ মাখা সুরে বলাবলি করতে থাকলেন— “জন্মমৃত্যুর অথৈ পারাবার কে এখন আমাদের তার নৌকা নিয়ে পার করবে। কে এবার আমাদের অজ্ঞানতার অপার তিমির মধ্যে আলোকশিখা দেখাবে।”

হীরকদণ্ডগুলি মাটিতে যে জায়গায় ফেলা হয়েছিল সেখানে একটি স্তূপ গড়া হয়েছে। বুদ্ধ মারা যাবার পর সাতদিন ধরে মল্লরা এখানে তাঁর মরদেহ পূজা- অর্চ্চনা করেন।

তথাগতের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে চারিদিক এক পরম জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মানুষ ও দেবতা সবাই এসে তাঁকে ঘিরে দাঁড়ালেন। নিজেদের মধ্যে তাঁরা বলাবলি করতে থাকলেন— “জগৎ পিতা মহান বুদ্ধ এবার মহাপ্রয়াণে চলেছেন। মানুষের সুখ শান্তি এবার গেল। নির্ভর করার মতো জগতে কেউ আর রইলো না।” একথা শুনে তথাগত তাঁর বিছানায় ডান পাশ ফিরে বিরাট সমাবেশের দিকে তাকিয়ে বললেন— “মারা যাচ্ছি বলে একথা বলোনা যে তথাগত চিরকালের জন্য চলে যাচ্ছে। ধর্ম-শরীর অমর! অপরিবর্তনীয়! সব আলস্য ত্যাগ করে বন্ধন মোচনের সাধনা কর।”

তথাগত বুদ্ধ মারা গেলে ভিক্ষুরা গভীর শোকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চললেন। তাই দেখে দেবতারাও পাছে ভেঙে পড়ে সেই ভয়ে অনিরুদ্ধ ভিক্ষুদের শোক করতে বারণ করলেন।

মল্লরা তাদের পূজা-অর্চনা শেষ করে সোনার কফিনটিকে শ্মশান ঘাটে বয়ে নিয়ে যাবার আয়োজন করলো। অনিরুদ্ধ তাদের থামিয়ে দিয়ে জানালেন যে দেবতারাও সাত দিন ধরে বুদ্ধের মরদেহ পূজা-অর্চ্চনা করতে চান

দেবতাগণ নানারকম স্বর্গীয় ফুল আঁজলে নিয়ে স্বর্গ থেকে বুদ্ধের মহিমা কীর্তন করে চললেন। সকলে অন্তর দিয়ে পূজার্ঘ্য নিবেদন করলেন।

যেখানে শবাধারটি আটকে দেয়া হয়েছিল সেখানে একটি স্তূপ বানানো হয়েছে। এখানেই (স্বর্গ থেকে নেমে এসে বুদ্ধের মা) রাণী মহামায়া বুদ্ধের (মৃত্যু শোকে তাঁর) জন্য কেঁদেছিলেন।

শহরটির উত্তর দিকে নদী পার হয়ে তিনশো পা মতো গেলে একটি স্তূপ চোখে পড়বে। এই জায়গাটিতেই বুদ্ধের মরদেহ দাহ করা হয়। এখানকার মাটি এখন কালচিটে হলদে ধরনের। মাটি আর কাঠকয়লা মিশে এই রকমটি হয়েছে। কোন লোক সত্যিকারের বিশ্বাস নিয়ে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা জানিয়ে খুঁজলে এখনো এখানে অবশ্যই বুদ্ধের কোন না কোন পূতাস্থি পাবে।

বুদ্ধের দাহ স্থানটির কাছে একটি স্তূপ আছে। এখানে তথাগত কাশ্যপের জন্য নিজের চরণ প্রকটিত করেন। দাহ করার জন্য তথাগতের মরদেহ থাকা সোনার শবাধারটির উপরে তেল ঢালা হলো। কাঠ স্তূপ করা হলো। কিন্তু শত চেষ্টা করেও আগুন জ্বালানো গেল না। সকল দর্শকের মন ভয় ও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লো। অনিরুদ্ধ তাই দেখে বললেন–কাশ্যপের জন্য একটু অপেক্ষা করা যাক্।

এমন সময়ে ৫০০ অনুগামী নিয়ে কাশ্যপ বনের ভেতর দিয়ে কুশীনগর এসে হাজির হলেন। আনন্দকে তিনি বললেন— “তথাগতকে একবার শেষ দেখা দেখতে পারি কি?” আনন্দ বললেন— “হাজার টুকরো কাপড় দিয়ে জড়ানো হয়ে তাঁর দেহ এখন একটি ভারী শবাধারের মধ্যে বন্ধ। ওপরে চন্দন কাঠ স্তূপ করা হয়েছে। তাতে আগুন লাগানোর আয়োজন চলেছে!”

এই সময়ে শবাধারের ভেতর থেকে বুদ্ধ তাঁর পা দু’টি বাইরে বাড়িয়ে দিলেন। যেখানে বুদ্ধ তাঁর পা প্রকটিত করেন তার কাছেই রাজা অশোকের বানানো একটি স্তূপ আছে। আট রাজা এখানেই বুদ্ধের দেহাবশেষ ভাগ করে নেন। সামনেই একটি পাথরের স্তম্ভ। তাতে এই ঘটনার বিবরণ খোদাই করা রয়েছে।

দেহাবশেষ বাটোয়ারার স্তূপটি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ২০০ লির কাছাকাছি পথ চলার পর একটি বেশ বড়োসড় গ্রামের দেখা পেলাম। এ গ্রামে এক ব্রাহ্মণ থাকতেন। তিনি বেশ ধনী ও নাম করা লোক ছিলেন। সকল ধর্ম শাস্ত্রের উপর তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল। ত্রিপিটকের উপরেও। পঞ্চ বিদ্যাতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। তিনি তাঁর বাড়ীর পাশে ভিক্ষুদের জন্য একটি আবাস গড়েন। আবাসটিকে সুন্দর করে গড়ার জন্য তিনি তাঁর সব ধন-সম্পদ খরচ করেন। যদি কোন ভিক্ষু ঘুরতে ঘুরতে এ গ্রামে এসে হাজির হতেন তিনি তাকে তাঁর সেই আবাসে আতিথ্য গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাতেন। তাকে আদর আপ্যায়নের জন্য সব রকম চেষ্টা করতেন। তা তিনি এক রাতই থাকুন আর সাত দিন সাত রাতই থাকুন।

তারপর, শশাঙ্ক রাজা বৌদ্ধ ধর্ম উৎখাত শুরু করলেন। ভিক্ষুরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো ও অনেক বছর ধরে পালিয়ে বেড়াল। তা সত্ত্বেও তাদের প্রতি ব্রাহ্মণের শ্রদ্ধার এতটুকু চিড় ধরলো না। একদিন ভোরবেলা বেড়াতে বেড়াতে তিনি হঠাৎ এক শ্রমণকে দেখতে পেলেন। দুটি ভুরু মোটা, কামানো মাথা, হাতে যষ্ঠি বা হিক্কাল নিয়ে এদিকেই আসছিলেন। ব্রাহ্মণ তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে তাঁকে তাঁর ভিক্ষু আবাসে আতিথ্য গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানালেন। শ্রমণ তাঁর অনুরোধ রাখল। ব্রাহ্মণ সকালের দিকে তাঁকে খানিক পায়স খেতে দিলেন। শ্রমণ তা থেকে একটুখানি খেয়ে, একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাকি পায়স সহ ভিক্ষা পাত্ৰ নামিয়ে রাখলেন। তাই দেখে ব্রাহ্মণ বিনীতভাবে বললেন “ভদন্ত! এমন কিছু কারণ ঘটেছে কি যে জন্য আপনি একটি রাতও আমার এখানে থাকতে চাইছেন না? যে খাবার দিয়েছি তা কি আপনার ভালো লাগে নি?” শ্রমণ করুণাঝরা কণ্ঠে উত্তর দিলেন—”পুণ্য দিন দিন ক্ষীণ হয়ে চলেছে দেখে আমি মর্মাহত। যাই হোক, আমার আগে খাওয়া শেষ করতে দাও তারপর তোমাকে সব বলব।” খাওয়া শেষ হলে তিনি তাঁর পোষাক পত্তর গুছিয়ে নিলেন—যেন এখুনি চলে যাবেন আর কি। ব্রাহ্মণ তা দেখে বললেন—”আপনি আমায় সব কথা বলবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তবে চুপ করে রইলেন কেন?” শ্রমণ উত্তরে বললেন—”আমি ভুলিনি। তবে তোমাকে সে কথা বোঝানো কঠিন। তবুও তোমাকে অল্প কথায় বলছি। তুমি আমায় যে অন্ন দিয়েছ সেজন্য আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলিনি। সত্যি বলতে কি কয়েকশো বছরের মধ্যে এমন সুস্বাদু অন্ন আমি খাইনি। তথাগত যখন বেঁচে ছিলেন ও রাজগৃহের কাছে বেণুবন বিহারে থাকতেন তখন আমি তাঁর শিষ্যত্ব নেই। সেখানে একদিন আমি নদীর নির্মল জলে তাঁর পাত্রটি ধুয়ে, তাঁর কুঁজায় জল ভরে, তাকে মুখ ধোবার জন্য, জল দেই। কিন্তু হায়! তুমি আমায় আজ যে পায়স খেতে দিলে তার স্বাদ, পুরানো দিনের সেই মিষ্টি জলের কাছাকাছিও নয়। এর কারণ আর কিছুই নয়। দেবতা ও মানুষের পুণ্যবল, আগের চেয়ে ক্ষীণ হয়ে গেছে।” ব্রাহ্মণ তখন বললেন—”আপনি নিজের চোখে বুদ্ধদেবকে জীবিত দেখেছেন এ কী করে সম্ভব?” শ্রমণ উত্তর দিলেন—”তুমি কি কখনো বুদ্ধের আপন ছেলে রাহুলের নাম শোনোনি? আমিই সে। সত্য ধর্মকে রক্ষার বাসনায় আমি এখনো পর্যন্ত নির্বাণ যাই নি।” এ কথা বলে সহসা তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

ব্রাহ্মণ তখন সে ঘরটিকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে সেখানে রাহুলের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। সে মূর্তিটিকে তিনি এরূপ সম্মান জানাতেন যেন ঠিক রাহুল-ই তাঁর চোখের সামনে।

॥ ৩৭ ॥ ‘পো-লো-নি-সি’ বা বারাণসী

বিরাট অরণ্যের মধ্য দিয়ে এবার আমরা একটানা পথ ভেঙে চলেছি। ৫০০ লির মতো পেরিয়ে আসার পর পো-লো-নি-স্সি বা বারাণসী পৌঁছলাম।

দেশটি আয়তনে চার হাজার লি মতো হবে। রাজধানীটি গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে। শহরটি লম্বায় ১৮ থেকে ১৯ লি, চওড়ায় ৫ থেকে ৬ লি। এর ভিতরের ফটকগুলি ছোট দাঁতওয়ালা চিরুনীর মতো। জনবসতি বেশ কম। পরিবারগুলি বেশ ধনী বলে মনে হলো। বসতবাড়িগুলি চোখ ঝলসানো রীতিমতো ও পয়সা খরচ ক’রে তৈরী। লোকজনের আচার-আচরণ কোমল ও মানবিক বোধ সম্পন্ন। জ্ঞানচর্চার দিকে প্রবল স্পৃহা। তাদের বেশীর ভাগই বিধর্মী, নামমাত্র কিছু বুদ্ধের অনুগামী।

এ রাজ্যের আবহাওয়া স্নিগ্ধ। ফসল অফুরান। ফল ফলাদির গাছপালায় চারিদিক ভরাট। যে-দিকে তাকানো যায় মাটির বুক খাটো ঝোপঝাড় লতাগুল্মে সবুজ।

এখানে তিরিশটির মতো সংঘারাম আছে। সেখানে তিন হাজারের কাছাকাছি ভিক্ষু থাকেন। তাঁরা হীনযানের সম্মতীয় শাখার উপাসক।

প্রায় একশোটির মতো দেবমন্দির রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দশ হাজারের মতো অনুগামী থাকেন। তাঁরা প্রধানভাবে শিব ভক্ত। কতক অনুগামী তাদের চুল কেটে ফেলে। কতক আবার তাকে জটা বেঁধে রাখে ও পুরো নগ্ন থাকে। সারা গায়ে তারা ছাই মাখে ও সবরকম কঠোর সাধনা ক’রে জন্ম ও মৃত্যুর বাঁধন থেকে মুক্তিলাভের উপায় খোঁজে।

রাজধানীর মধ্যে কুড়িটি দেবমন্দির দেখলাম। তার চূড়া ও মণ্ডপগুলি কারুকাজ করা কাঠ ও ভাস্কর্য খোদাই করা পাথর দিয়ে বানানো। সার সার গাছের ঘন পাতায় চারিদিকে ছায়া-ঘেরা। নদীতে বয়ে চলা বিমল জলধারা যেন গাছের সারিগুলিকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। দেশী তামা দিয়ে তৈরী শিব মূর্তিটি ১০০ ফুটের চেয়ে কিছুটা কম উঁচু। চেহারা ভাবগম্ভীর ও মহিমাব্যঞ্জক। দেখে মনে হলো যেন সত্যিই জীবিত।

রাজধানীর উত্তর-পূর্বে বরণা নদীর পশ্চিম পাড়ে একটি স্তূপ দেখলাম। একশো ফুটের মতো উঁচু। এটি রাজা অশোকের বানানো। সামনে একটি পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। এটি বেশ চকচকে ও আয়নার মতো ঝলমলে। এর সারা গা তেলতেলে ও বরফের মতো মসৃণ। স্তম্ভটির গায়ে সব সময় ছায়ার মতো বুদ্ধের মূর্তি দেখা যায়।

উত্তর-পূর্বদিকে বরণা নদী পেরিয়ে ১০ লি মতো গেলে ‘লু ঈ’ বা মৃগদাব সংঘারামের দেখা পাওয়া যায়। এর সীমানা আট ভাগে বিভক্ত, একটি ঘের-দেয়াল দিয়ে সবগুলি যোগ করা। তল বিশিষ্ট বুরুজগুলি থেকে বেরিয়ে আসা ঝুল বারান্দা ও ছাঁচগুলি অতি নিপুণ হাতের কাজ। এই সংঘারামটিতে ১৫০০ মতো ভিক্ষু আছেন। তাঁরা হীনযানের সম্মতীয় শাখার উপাসক। বিরাট সীমানার ভিতরে দুশো ফুটের মতো উঁচু একটি বিহার দেখলাম। ছাতের শীর্ষে একটি সোনায় মোড়া আমের প্রতিকৃতি রয়েছে। দালানের ভিত পাথরের। সিঁড়িও পাথরের। কিন্তু বুরুজ ও কুলুঙ্গিগুলি ইটের তৈরী। কুলুঙ্গিগুলি চারিদিকে একশোটি সারিতে সাজানো ও তার প্রত্যেকটিতে একটি করে সোনার বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। বিহারের মধ্যে দেশী তামা দিয়ে তৈরী একটি বুদ্ধমূর্তি। ধর্ম-ব্যাখ্যানে রত এই মূর্তিটির আকার স্বাভাবিক মানুষের সমান।

বিহারটির কাছাকাছি গুটিসাতেক স্তূপ দেখা গেল।

এখান থেকে একটুখানি দক্ষিণে গেলে বিগত চার বুদ্ধ যেখানে স্বাস্থ্যের জন্য নিয়মিত পায়চারি করতেন সে জায়গাটি দেখা যাবে। এটি প্রায় ৫০ পায়ের মতো লম্বা ও ৭ ফুটের মতো উঁচু। নীল রঙা পাথর গাদা ক’রে এটি বানানো হয়েছে। এর উপর হেঁটে যাবার ভঙ্গিমায় তথাগতের একটি মূর্তি আছে। মূর্তিটি মহান করুণা ভাব ও সৌন্দর্য ব্যঞ্জক। নাভি থেকে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত একটি বিনুনীর মতো পাকানো তন্ত্রী বিস্ময়কর ভাবে প্রবাহিত। মূর্তিটিতে তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতাকে অতি সহজভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দৈব প্রতিভা ও সাধন ক্ষমতার পরিপাটি সমন্বয় দেখানো হয়েছে।

সংঘারামটির পরিসরের পশ্চিম দিকে তিনটি সরোবর রয়েছে। শেষ সরোবরটি থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলে একে একে তিনটি স্তূপের দেখা পাওয়া যাবে।

সংঘারামটির দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ২ বা ৩ লি এগিয়ে গেলে তিনশো ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ চোখে পড়বে। এর নিচের ভিত বেশ চওড়া ও দালানগুলি উঁচু। এটি বিভিন্ন ধারার কারু ও শিল্পকাজ করা এবং দামী দামী বস্তু দিয়ে সুন্দর ক’রে সাজানো। এটিকে কুলুঙ্গিসহ স্তরে স্তরে সাজিয়ে গড়া হয়নি। গম্বুজের উপরে শীর্ষদণ্ড থাকলেও তার ঘণ্টার ঘেরগুলো নেই। এর পাশে আরেকটি ছোট স্তূপ।

মৃগবনের পূর্বদিকে দু-তিন লি মতো গেলে আমরা একটি স্তূপের দেখা পাই। এর পাশেই একটি শুকনো পুকুর রয়েছে। এটির আয়তন ৮০ পায়ের মতো হবে। তার পশ্চিমে আর একটি স্তূপ।

॥ ৩৮ ॥ ‘চেন-চু’-গর্জপুর বা ঘাজিপুর

এদেশ ছেড়ে গঙ্গা নদীর প্রবাহ ধরে পূর্বদিকে এগিয়ে চললাম। প্রায় ৩০০ লি পথ চলার পর ‘চেন চু’ অর্থাৎ গর্জপুর বা ঘাজিপুর এলাম।

এ রাজ্যটির আয়তন ২০০০ লির কাছাকাছি হবে। রাজধানীটি গঙ্গা নদীর কূলে ১০ লি মতো পরিধি জুড়ে গড়ে উঠেছে। লোকেরা ধনবান ও সমৃদ্ধ। শহর ও গ্রামগুলির গা ঘেঁষাঘেষি হয়ে রয়েছে। জমি সরস ও উর্বর। নিয়মিতভাবে চাষবাসের কাজ চলে। আবহাওয়া স্নিগ্ধ ও নাতিশীতোষ্ণ। লোকজনেরা আচার- আচরণের দিক থেকে সৎ ও নিষ্ঠাবান। মূল প্রকৃতি সহজাতভাবেই উগ্র। একটুতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে অন্যধর্মী ও সত্যধর্মী গোষ্ঠীর লোকই রয়েছে।

এখানে দশটির মতো সংঘারাম আছে। সেখানে ভিক্ষুর সংখ্যা হাজারের কিছু কম হবে। সকলেই হীনযানের অনুগামী। দেবমন্দির কুড়িটি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুগামীরা সেখানে থাকে।

রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমে একটি সংঘারাম আছে। সেখানে রাজা অশোকের গড়া একটি স্তূপ আছে দেখলাম।

এর কাছেই একটি জায়গায় বিগত চার বুদ্ধের ওঠা-বসা, চলাফেরার স্মারক বর্তমান। কাছেই মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বের একটি মূর্তি রয়েছে। মূর্তিটি ছোটখাট।

প্রধান শহরটি থেকে পূর্বদিকে ২০০ লি মতো যাবার পর একটি সংঘারামের দর্শন পেলাম। এটির নাম ‘অবিদ্ধ কর্ণ’। এর পরিসর বিরাট না হলেও দালানের কারুকাজগুলি উচ্চাঙ্গের শিল্প নিদর্শন। চারিদিকে ফুটে থাকা ফুল, গম্বুজ শিখর ও কুলুঙ্গির পর পর লেগে থাকা ছবি, হ্রদগুলির জলে প্রতিফলিত হয়ে এক অপূর্ব পরিবেশ গড়ে তোলে। ভিক্ষুরা ভাবগম্ভীর ও রুচিবোধ সম্পন্ন। প্রতিটি করণীয় কাজ ঠিক ঠিক মতো ক’রে চলে।

অবিদ্ধকর্ণ থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ১০০ লি মতো এগিয়ে গঙ্গা নদী পার হয়ে দক্ষিণ দিকে গেলে মো-হো-শ-লো-বা মহাসার শহরের দেখা পেলাম। এখানকার অধিবাসীরা সকলেই ব্রাহ্মণ (হিন্দু ধর্মী)। বুদ্ধের ধর্মকে তারা ভাল চোখে দেখে না। আমাকে দেখতে পেয়ে প্রথমেই তারা আমার বিদ্যা বুদ্ধির খোঁজ খবর নিল। যখন মেপেঝুপে বুঝতে পারল যে এ লোকটির সত্যই বেশ পাণ্ডিত্য রয়েছে তখন খুব আদর অভ্যর্থনা, সম্মান দেখাল।

গঙ্গার উত্তর কূলে একটি বিষ্ণু মূর্তি রয়েছে। মন্দিরটির ঝুলবারান্দা ও তলবিশিষ্ট গম্বুজগুলি চমৎকারভাবে নানারকম ভাস্কর্য ও কারুকার্য করা। যতগুলি দেব বিগ্রহ সেখানে দেখলাম সবগুলিই পাথরের তৈরী। সেগুলি শিল্পকর্মের সেরা নিদর্শন সব।

এই মন্দিরটি থেকে পূর্বদিকে তিরিশ লি কাছাকাছি গেলে রাজা অশোকের বানানো একটি স্তূপ চোখে পড়বে। এর অর্ধেকেরও বেশি মাটির মধ্যে বসে গেছে। সামনে ২০ ফুট খানেক একটি পাথর স্তম্ভ। তার মাথায় সিংহমূর্তি। বুদ্ধ এখানে কতক মরুদানবকে বশ করেন। স্তম্ভের গায়ে তারই খোদাই করা বিবরণ রয়েছে।

মরুদানবদের হৃদয় পরিবর্তনের স্থানটি থেকে একটুখানি এগিয়ে অনেকগুলি সংঘারাম দেখতে পেলাম। বেশিরভাগই ভাঙাচোরা অবস্থায় পৌঁছেছে। তবু সেখানে কিছু ভিক্ষু রয়েছেন দেখলাম। তারা সকলেই মহাযানের উপাসক।

এখান থেকে একশো লি মতো দক্ষিণ-পূর্বে পথ চলার পর আমরা একটি ভেঙে পড়া স্তূপের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ভগ্নদশা হলেও এখনো এটি বেশ উঁচু (কয়েক দশ ফুট)। তথাগত নির্বাণলোকে চলে যাবার পর, আটটি বড়ো বড়ো দেশের রাজা তাঁর দেহাবশেষ ভাগ ক’রে নেন। যে ব্রাহ্মণ তাদের দেহাবশেষ ভাগ করে দেন, তিনি তার মধ্য থেকে কিছুটা সরিয়ে নিয়ে মধু মাখা কলসে ভরে রাখেন ও তা নিজের দেশে নিয়ে আসেন। তারপর সেই পূতাস্থির উপর এখানে একটি স্তূপ গড়েন। কলসটির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য তিনি সেটিকেও স্তূপের মধ্যে রাখেন। এজন্য স্তূপটির নাম দ্রোণ (কলস) স্তূপ দেয়া হয়। পরে অশোক রাজা সে স্তূপটি খুঁড়ে দেহাবশেষ বার করে নেন। কলসটিকেও নিয়ে যান। পুরানো স্তূপটির জায়গায় একটি বড়ো স্তূপ গড়েন।

॥ ৩৯ ॥ ‘ফেই-শে-লি’ বা বৈশালী

গর্জপুর থেকে উত্তর-পূর্বদিকে যাত্রা করলাম। এজন্য (আবার) গঙ্গা নদী পার হলাম। প্রায় ১৪০ থেকে ১৫০ লি পথ চলার পর ফেই-শে-লি বা বৈশালী রাজ্যে এসে পৌঁছলাম।

এ রাজ্যটির আয়তন প্রায় ৫০০০ লি হবে। জমি সরস ও উর্বরা। ফুল আর ফল গাছের ছড়াছড়ি। ‘আম্র’ (আম) ও ‘মোচা’র (কলা) ফলন খুবই বেশি। এদু’টি ফলের প্রচুর আদর। আবহাওয়া মোটামুটি ভালই, না বেশি শীত না বেশি গরম। আচার ব্যবহারের দিক থেকে লোকেরা সৎ ও নিষ্ঠাবান প্রকৃতির। ধর্মকর্মের দিকে অনুরাগ রয়েছে, জ্ঞানচর্চ্চার প্রতিও পরম শ্রদ্ধা রয়েছে। বৌদ্ধধর্মী ও অন্যান্য ধর্মীরা মিলেমিশে বাস করছে।

এখানে কয়েকশোর মতো সংঘারাম আছে। বেশিরভাগই ভাঙা বা ভাঙো ভাঙো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। গুটি তিন পাঁচ যা এখনো খাড়া আছে তাতে সামান্য কিছু ভিক্ষু বাস করেন। বেশ কিছু (কয়েক দশ) দেবমন্দির রয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্য ধর্মীরা সেখানে বসবাস করেন। নির্গ্রন্থ অনুগামীদের সংখ্যাই এখানে সব থেকে বেশি।

এ রাজ্যের রাজধানী শহর বৈশালীর এখন প্রায় ভাঙাচোরা দীন দরিদ্র অবস্থা। এর পুরানো পরিসরের ঘের ৬০ থেকে ৭০ লি হবে। রাজপুরীর ঘের চার থেকে ৫ লি। এখন সেখানে সামান্য কিছু লোক বাস করে। রাজপুরী থেকে ৫ বা ৬ লি উত্তর-পশ্চিমে একটি সংঘারাম দেখলাম। এটিতে সামান্য কয়েকজন ভিক্ষু থাকেন। তারা হীনযানের সম্মতীয় শাখা মাৰ্গী।

এর কাছে একটি স্তূপ রয়েছে। এখানে তথাগত বিমলকীর্তি সূত্র ব্যাখ্যান করেন। এ ছাড়া এখানকার এক গৃহস্থ পরিবারের ছেলে রত্নাকর ও আরো কতকে মিলে এখানে বুদ্ধদেবকে কয়েকটি মূল্যবান রোদ নিবারণী ছাতা উপহার দেন। এর পূর্বদিকে আর একটি স্তূপ আছে। এখানে সারিপুত্র ও আরো অনেকে অহতত্ব লাভ করেন।

শেষ জায়গাটির দক্ষিণ-পূর্বদিকে একটি স্তূপ দেখা যায়। এটি বৈশালীর এক রাজা তৈরী করেন। বুদ্ধের নির্বাণ লাভের পরে তাঁর দেহাবশেষের একটি ভাগ এখানকার এক রাজা পেয়েছিলেন। সেই দেহাবশেষকে পরম সম্মান সহকারে নিয়ে এসে এখানে তিনি এই স্তূপটি তোলেন।

ভারতীয় ইতিহাস পুঁথি থেকে জানা যায় যে, আদিতে এই স্তূপটির মধ্যে দশ পেক (১ হোহ) এর সমান দেহাবশেষ ছিল। অশোক রাজা এটিকে খুঁড়ে তা থেকে নয়-দশমাংশ নিয়ে নেন। এরপর এ দেশের আর একজন রাজা আবার এটিকে খুঁড়তে মন করেন। কিন্তু খোঁড়া শুরু হবার মুহূর্তে ভূমিকম্প দেখা দিল। তাই তিনি আর সে কাজ করতে সাহসী হলেন না।

উত্তর-পশ্চিমদিকে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ দেখলাম। তার পাশে ৫০ থেকে ৬০ ফুট খাড়া একটি পাথর স্তম্ভ। তার মাথায় একটি সিংহমূর্তি রয়েছে। পাথর স্তম্ভের দক্ষিণদিকে একটি পুকুর। তার দক্ষিণদিকে দুটি স্তূপ।

সংঘারামটি থেকে ৩ বা ৪ লি উত্তর-পূর্বে গেলে একটি স্তূপ দেখা যাবে। ওখানেই এককালে বিমলকীর্তির ভিটে ছিল।

এর অদূরে একটি যক্ষনিবাস রয়েছে। এটির আকার গাদা করা ইটের পাঁজার মত। চলিত মতে, গৃহস্থ বিমলকীর্তি অসুস্থ থাকাকালে যেখানে ধর্মের ব্যাখ্যান করেছিলেন সেখানেই এই পাথর গাদা বৰ্তমান।

এখান থেকে একটুখানি এগিয়ে গেলে আর একটি স্তূপ দেখা যাবে। এখানে এককালে রত্নাকরের ভিটে ছিল।

এই জায়গাটি থেকে আবার একটু এগোলে একটি স্তূপ। এখানে এককালে আম্রপালীর আবাস ছিল। বুদ্ধদেবের মাসী অন্যান্য ভিক্ষুণীরা এখানেই নিৰ্বাণগত হন।

সংঘারামটি থেকে তিন-চার লি উত্তরে একটি স্তূপ রয়েছে। মরণের জন্য কুশীনগর যাবার আগে বুদ্ধদেব এখানে থেমেছিলেন। এই সময় নর ও কিন্নরেরা তার সঙ্গ নেয়। এখান থেকে একটুখানি উত্তর-পশ্চিমে একটি স্তূপ আছে। এখানে দাঁড়িয়েই তথাগত শেষবারের মতো বৈশালী শহরের দিকে ফিরে তাকান। এর অল্প কিছু দক্ষিণে একটি বিহার দেখা যাবে। তার সামনে একটি স্তূপ রয়েছে। এটি এককালে আম্রপালীর বাগান ছিল। বুদ্ধদেবকে এটি তিনি দান করেন।

বাগানটির কাছাকাছি আরো গুটি চারেক স্তূপ। তারপর খানিকটা এগিয়ে গেলেই বুদ্ধ যেখানে বসে ‘সমন্তমুখ ধরণি’ ও অন্যান্য সূত্রাবলী প্রকাশ করেছিলেন। সেই গম্বুজবিশিষ্ট প্রচার মহাকক্ষটির ভাঙা অবশেষের দেখা মেলে।

প্রচার মহাকক্ষের পাশে, কিছুটা এগিয়ে গেলে একটি স্তূপে চোখে পড়বে। এটিতে আনন্দের দেহাবশেষ অর্ধেক রাখা আছে।

এখান থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলে অনেক স্তূপ দেখা যাবে। এর প্রকৃত সংখ্যা কতো তার হিসাব নেই। বৈশালী নগরীর ভিতরে ও বাইরে এবং এর সব দিক ঘিরে এতো পবিত্র স্মারক রয়েছে যে তা বর্ণনা করা অসম্ভব ব্যাপার। এক পা এগোলেই একটি ক’রে বিশেষ স্মরণীয় জায়গা এবং পুরানো এক একটি স্মারক চোখে পড়বে। এই সব পুরোনো স্মারকের বেশির ভাগই কালের সুদীর্ঘ প্রভাবে ও ঝড় বাতাসের দাপটে পুরোপুরি নষ্ট হয় গেছে। বন-বনানী নির্মূল, অগভীর হ্রদগুলি মজে ওঠা, দুর্গন্ধে ভরা। শুধু মন খারাপ ক’রে তোলা ভাঙাচোরা অবশেষে আখ্যান ছাড়া আর কিছুই শোনানোর মতো নেই।

প্রধান নগরটি থেকে ৫০ বা ৬০ লি উত্তর-পশ্চিমে গিয়ে আমরা একটি বড় স্তূপের দেখা পাই। এখান থেকেই লিচ্ছবিরা বুদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নেয়। ঐ সময়ে বুদ্ধ তার স্মৃতির নিদর্শনরূপে নিজের ভিক্ষা পাত্রটি তাদের দেন।

বৈশালী নগরী থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ২০০ লির কাছাকাছি পথ চলে আমরা একটি পুরানো শহরে এসে পড়লাম। বহুকাল হলো লোকজন ও শহরটি ছেড়ে চলে গেছে। সামান্য কিছু মানুষ যা বাস করছে। এই শহরের মধ্যে একটি স্তূপ আছে।

শহরটি থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ১৪-১৫ লি এগিয়ে গেলে একটি বড় স্তূপ দেখা যাবে। এখানেই সাত শত বৌদ্ধ মুনি-ঋষিদের সম্মেলন হয়েছিল (দ্বিতীয় মহাসম্মেলন)। বুদ্ধদেবের নির্বাণ লাভের ১১০ বছর পর বৈশালীর কতক ভিক্ষু বুদ্ধের নীতিসমূহ ভাঙেন ও শৃঙ্খলার বিধিনিয়ম বিকৃত ক’রে তোলেন। আয়ুষ্মত যশদা এই সময়ে কোশলে থাকতেন। আয়ুষ্মত সমবোধ মথুরায়। আয়ুষ্মত রেবত হানজো (কান্যকুব্জ্য)তে। আয়ুষ্মত সাল বৈশালীতে। আয়ুষ্মত পূজসুমির (?) শ- লো-লি-ফো (শলঋভু?)তে। এরা সকলেই নামকরা অর্থৎ ছিলেন। প্রত্যেকের স্বাধীন স্বকীয় ক্ষমতা ছিল। সকলেই ত্রি-পিটকের একান্ত অনুগামী। প্রত্যেকেই ত্রি-বিদ্যায় পারদর্শী ও অতি বিখ্যাত ছিলেন। যা যা জানা উচিত সবই তারা জানতেন। আবার সকলেই ছিলেন আনন্দের শিষ্য।

এই সময়ে যশদা বৈশালী নগরীতে মহাসম্মেলনের আয়োজন করলেন। যে সব ভিক্ষু বিনয় পিটকের নীতি-নিয়ম ভঙ্গ করেছেন, তাদের এই সম্মেলন দোষী সাব্যস্ত করলেন। যে-সব বিধি-নিয়ম ভাঙা হয়েছে সেগুলিকে নতুন ক’রে বাঁধলেন। বুদ্ধের পবিত্র ধর্ম-মতবাদের প্রতি সমর্থন জানালেন।

এই জায়গাটি থেকে ৮০-৯০ লি মতো দক্ষিণদিকে যাবার পর আমরা শ্বেতপুর সংঘারামে এসে পৌঁছলাম। এর গোলাকার ও দ্বিতল বুরুজগুলি যেন আকাশ ছুঁয়েছে। ভিক্ষুরা শান্তশিষ্ট ও ভদ্র। সকলেই মহাযানের উপাসক। এই দালানের পাশেই এক জায়গায় বিগত চার বুদ্ধের বসা ও চলাফেরার নিদর্শন রয়েছে।

এগুলির পাশে রাজা অশোকের গড়া একটি স্তূপ আছে। বুদ্ধ তাঁর জীবিত কালে মগধদেশ থেকে দক্ষিণদিকে এসে এই জায়গাটিতে উত্তরমুখী হয়ে বৈশালীর দিকে তাকান। ঠিক যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে এখনো তার নিদর্শন রয়েছে।

শ্বেতপুর সংঘারাম থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ৩০ লি খানেক যাবার পর গঙ্গার দক্ষিণ ও উত্তর দুই কূলেই দু’টি স্তূপ দেখা যাবে। শ্রদ্ধেয় আনন্দ এখানেই দুই রাজ্যের মধ্যে আপনার দেহ ভাগ করে দেন। (মগধ ও বৈশালীর মধ্যে ভাগ করেছেন) আনন্দ তথাগতের ভাইপো ছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *