হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – ১

॥১॥ লম্পক

কপিশা থেকে পথ চলার পর লম্পকে এসে পৌঁছনো গেল। এ রাজ্যটি আয়তনে এক হাজার লির মতো। উত্তর দিকে তাকালে চোখে পড়বে শুধু তুষার মুকুট পরা বিরাট বিরাট পর্বতের পাঁচিল। অন্য তিন দিকও কালোরঙের পাহাড় দিয়ে ঘেরা। রাজধানীর আয়তন দেখা গেল দশ লির মতো। এখানকার সর্বশেষ রাজবংশ কয়েক শতাব্দী আগে লোপ হয়ে গেছে। তারপর থেকে চলেছে গোষ্ঠী প্রধানদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। সকলেরই নজর কী করে নিজে সকলের উপর উঠবেন। ফলে যা হয় তাই হয়েছে। রাজ্যটি শেষ পর্যন্ত কপিশার অধীনে চলে গেছে।

এ দেশের লোকেরা ধানের চাষে বেশি অভ্যস্ত। আখের বনও দেখলাম প্রচুর আছে। গাছেও প্রচুর ফল হয়, তবে খুব কম ফলই পাকে। আবহাওয়া তেমন ভাল নয়। প্রায়ই জমাট তুষার কণা চারিদিকে অন্ধকার করে ফেলে। তবে, তুষারপাত তেমন বেশি নয়।

সাধারণ লোক প্রাচুর্য্যের মধ্যে রয়েছে। চোখে মুখে তৃপ্তির আভাস। সঙ্গীত চর্চ্চার দিকে প্রবল ঝোঁক দেখলাম। কিন্তু স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে সুবিধের নয়। বিশ্বাসের অযোগ্য। চুরির স্বভাবও রয়েছে। কী করে অন্যের কাছ থেকে কিছু হাতড়ে নেবে সব সময় সেদিকে নজর। নিজের স্বার্থ সবার আগে, অন্যেরটা বুঝতে রাজী নয়। চেহারার দিক থেকে বেঁটে-খাটো হলে কি হবে, কর্মঠ ও আবেগ প্রবণ। পোষাক-পরিচ্ছদের বেশীর ভাগ দেখলাম সাদা কাপড়ে তৈরী। সেগুলি বেশ মানানসই।

দশটির মতো সংঘারাম রয়েছে। কিন্তু সেখানে ভিক্ষুর সংখ্যা কম। বেশীর ভাগই মহাযানের অনুগামী। কয়েক কুড়ি দেব-মন্দিরে বিধর্মীদের সংখ্যাও নিতান্ত কম।

॥২॥ নগরহার

লম্পক থেকে রওনা হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়ে চললাম। এক বিরাট পাহাড় শ্রেণী ডিঙোতে হলো। একটা চওড়া নদীও পার হলাম। এভাবে ১০০ লির মতো পথ চলার পর না-কিত্র-লো-হো বা নগরহার পৌছলাম; কিংবা বলতে পার উত্তর ভারত-সীমানায় পা রাখলাম।

এ দেশটি কপিশার অধীন। কোন রাজা বা রাজ্যপাল নেই। সামরিক শাসনকর্তা ও কর্মচারীরা সব কপিশা থেকে আসেন।

পূর্ব-পশ্চিমে নগরহার প্রায় ৬০০ লি লম্বা। উত্তর-দক্ষিণে ২৫০ থেকে ২৬০ লির মতো। হঠাৎ মাথাচাড়া দেয়া খাড়া পাহাড় ও প্রাকৃতিক সব প্রতিবন্ধ দিয়ে চারিদিকে ঘেরা। রাজধানীর আয়তন ২০ লির মতো হবে।

খাদ্যশস্যের বেশ প্রাচুর্য রয়েছে দেখলাম। ফুল আর ফলেও ভরা। আবহাওয়া ভিজে ও উষ্ণ। লোকেরা স্বভাব চরিত্রের দিক থেকে সরল ও সৎ। বেশ উদ্দীপনা আর সাহসে ভরা। ধন-সম্পদকে তুচ্ছ চোখে দেখে। জ্ঞানের চর্চ্চা করতে ভালবাসে। সবাই বৌদ্ধ ধর্মের অনুগামী। অন্য ধর্মমতে অনুরাগীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। অনেকগুলি সংঘারাম রয়েছে। তবে ভিক্ষুদের সংখ্যা সেখানে কম। স্তূপগুলিও দেখলাম পরিত্যক্ত ও ধ্বংসাবশেষে পরিণত। পাঁচটি দেব-মন্দির আছে। সেখানে প্রায় শ’ খানেক অনুগামীও চোখে পড়লো।

শহর থেকে তিন লির মতো পূর্বে যেতে একটি বিরাট স্তূপ দেখতে পেলাম। প্রায় তিনশো ফুট উঁচু। রাজা অশোক এটিকে তৈরি করিয়েছিলেন। অতি সুন্দর করে খোদাই করা ও নানা কারুকার্য করা পাথর দিয়ে এটি চমৎকার ভাবে তৈরী।

এর পশ্চিম দিকে একটি সংঘারাম। কয়েকজন মাত্র ভিক্ষু সেখানে বাস করেন। তার দক্ষিণে একটি ছোট স্তূপ। এ স্তূপটিও রাজা অশোকের তৈরী।

শহরের মধ্যে একটি বিশাল স্তূপের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ল। প্রবাদ অনুসারে এখানে নাকি ভগবান বুদ্ধের দন্ত রাখা হয়েছিল। স্তূপটিও নাকি খুব উঁচু আর অতি চমৎকার ছিল। এখন অবশ্য প্রাচীন ভিতটুকুই যা আছে, দন্তও নেই।

এর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ৩০০ ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ। পুরোনো কাহিনী থেকে এর জন্মবৃত্তান্ত কিছু জানা যায় না। তবে, লোকে বলে যে এটি নাকি আকাশ থেকে নেমে এসেছে। কোনরকম মানবিক শিল্পকর্মের চিহ্নবর্ণ এতে না থাকার দরুন এটি স্পষ্টতঃই স্বর্গীয় রচনার নিদর্শন।

নগরের দক্ষিণ পশ্চিমে ১০ লির মতো হাঁটার পর একটি স্তূপ নজরে এলো। ২০ লির মতো যেতে দেখা পেলাম একটি ছোট পর্বত টিলার। এখানে বিরাট মহাকক্ষ-যুক্ত একটি সংঘারাম দেখলাম। পাথরের পর পাথর সাজিয়ে এর বহুতল তোরণ-দ্বারটি তৈরী। এককালে জন-মুখরিত এই সংঘারামটি এখন নির্জন ও পরিত্যক্ত। এর মাঝখানে ২০০ ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ। রাজা অশোক এটি তৈরী করিয়েছিলেন।

এই সংঘারামের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি প্রপাত। পাহাড়ের উঁচু মাথা থেকে প্রবল বেগে জল নিচে আছড়ে পড়ছে। পাহাড়ের ধারগুলি যেন দেয়ালের মত তাকে ঘিরে রেখেছে। এরই পূর্ব দিকের একটি দেয়ালে বিরাট এক গুহা রয়েছে। গুহাটি বেশ গভীর আর চওড়া। এটি গোপাল নাগের আবাস। এর প্রবেশপথ সরু, ভিতর অন্ধকার। খাড়া পাহাড়ের বিভিন্ন দিক থেকে সরু জলস্রোত এই গুহায় নেমে এসেছে। আগের কালে এখানে ভগবান বুদ্ধের শরীর-ছায়া দেখা যেত। একেবারে প্রকৃত চেহারার মতো দীপ্ত ও সকল বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন। আজকাল আর বিশেষ দেখা যায় না। যা দেখা যায় তা হল চেহারার ক্ষীণ-সাদৃশ্য। তবে, যে লোক গভীর প্রত্যয় নিয়ে আন্তরিক প্রার্থনা জানায়, সে দিব্যদৃষ্টি লাভ ক’রে একে স্পষ্টভাবে দেখতে পায়-কিন্তু তাও বেশীক্ষণ নয়। গুহার দরজার কাছে দুটি চৌকা পাথর আছে। এর একটিতে সুন্দর ও সুস্পষ্ট চক্ৰচিহ্ন সহ বুদ্ধদেবের পদচিহ্ন পাথর আছে। এটি থেকে থেকে আলোর বিকিরণ ক’রে ঝলসিত হয়ে ওঠে।

গুহাটির দুদিকে কয়েকটি পাথরের কক্ষ রয়েছে। বুদ্ধদেবের পবিত্র শিষ্যেরা এখানে ধ্যানে বসতেন।

গুহার উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি স্তূপ। এতে বুদ্ধের চুল ও নখ রাখা আছে। এর অনতিদূরে আরো একটি স্তূপ। এই স্থানটিতেই বুদ্ধ তথাগত তাঁর সত্যধর্মের গূঢ় নীতিগুলি তৈরি করে স্কদ্ধ-ধাতু-আয়তন ঘোষণা করেছিলেন।

গুহাটির পশ্চিমে একটি বড় পাথর রয়েছে। বুদ্ধ তাঁর বস্ত্র ধুয়ে এটির উপর মেলে দিয়েছিলেন।

রাজধানী-শহর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে ৩০ লির মতো যেতে দেখা পেলাম হিড্ড বা হি-লো শহরের। এর আয়তন ৪ থেকে ৫ লি। শহরটি বেশ উঁচুতে গড়ে উঠেছে ও স্বাভাবিক ঢালু অঞ্চলের দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত। এখানে নানা রকমের ফুল ও বন সম্পদ রয়েছে। একাধিক হ্রদও আছে। জল আয়নার মতো স্বচ্ছ। বাড়িগুলি চিত্রিত। স্তম্ভগুলি লাল রঙ করা। দোতলায় একটি ছোট স্তূপ রয়েছে। সাতটি মূল্যবান বস্তু দিয়ে এটি তৈরী। এতে বুদ্ধদেবের করোটি রক্ষিত হয়েছে। করোটিটি ১৪ ইঞ্চির মতো গোল। সাদাটে-হলুদ বর্ণ। চুলের ছিদ্রগুলি স্পষ্ট। একটি বহুমূল্য আধারে ক’রে এটিকে স্তূপের মধ্যে রাখা হয়েছে। যে সব লোক ভাগ্য সম্পর্কে পূর্ব-সংকেত লাভে আগ্রহী তারা সুগন্ধি মৃত্তিকার তালের উপর এই করোটির ছাপ নেন। পুণ্যফল অনুসারে ছাপ ওঠে।

এটি ছাড়া আরো একটি স্তূপ আছে। এ স্তূপটিও সাত মূল্যবান বস্তুতে তৈরী। এটিতে বুদ্ধের করোটি আটকে বন্ধ ক’রে রাখা হয়। এটির আকৃতি পদ্মপাতার মতো। অন্যটির মতোই এর রঙ। এটিও একটি সীলকরা ও বাঁধা মূল্যবান আধারে ভরে রাখা হয়েছে।

এছাড়া আরো একটি স্তূপ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তথাগতের চোখের মণি। এটি একটি আমের মত বড়, উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ। অন্য দুটির মতো একেও একটি মূল্যবান আধারে রাখা হয়েছে।

তথাগতের গেরুয়া রঙ করা সুতি কাপড়ের সংঘটি পোষাকও এখানে একটি মূল্যবান পেটিকায় রাখা হয়েছে। অনেক পুরানো হয়ে যাওয়ার দরুন এর কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। সাদা লোহার আংটা-ওয়ালা চন্দন কাঠের যষ্টিটিও তাঁর একটি মূল্যবান আধারে রাখা আছে।

কপিশার রাজা পাঁচজন ব্রাহ্মণের উপর এ-সবের পূজা-অর্চনার ভার দিয়েছেন। নির্জন সাধনার জন্য অবসর ক’রে নেয়ার উদ্দেশ্যে তারা এ-সব বস্তু দর্শনের জন্য বিশেষ দর্শনী ধার্য করেছেন। যিনি বুদ্ধদেবের করোটি দেখতে চাইবেন তাকে দিতে হবে এক স্বর্ণমুদ্রা। ছাপ নিতে চাইলে দিতে হবে পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা। অন্য সবের জন্যও এরকম বাঁধা দর রয়েছে। যদিও এই দর্শনীর হার খুব বেশি তা সত্ত্বেও দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক।

এই দোতলা তোরণের উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি স্তূপ আছে। এটি তেমন উঁচু বা বড় নয়। তবু এর অনেক অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। যদি লোকে একে কেবল একটুখানি আঙুল দিয়ে ছোঁয় এটি ওঠে ও ভিত পর্যন্ত কাঁপতে থাকে এবং ঘণ্টা ও কাঁসর এক লয়ে দুলে উঠে মধুর শব্দ তরঙ্গের সৃষ্টি হয়।

॥৩॥ গান্ধার

হিড্ড থেকে ক্রমশঃ আরো দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়ে চললাম। শুধু পাহাড় আর উপত্যকার চড়াই আর উৎরাই। ৫০০ লির মতো পথ পেরিয়ে আসার পর দেখা পেলাম গান্ধার রাজ্যের।

এ দেশটি পূর্ব-পশ্চিমে ১০০০ লির ও উত্তর-দক্ষিণে ৮০০ লির মতো। এর পূর্ব সীমানা ছুঁয়ে সিন (সিন্ধু) নদী বয়ে চলেছে। রাজধানীর নাম পো-লু-শো-পু- লো বা পুরুষপুর। আয়তন ৪০ লির মতো। এখানকার রাজবংশও লোপ পেয়েছে। এখন কপিশার অধীন। শহর ও গ্রামগুলি প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায়। খুব অল্প লোক এখন বাস করে। শহরের দেয়ালঘেরা অংশটিতে প্রায় এক হাজার পরিবারের বাস। রাজপ্রাসাদও এখানেই অবস্থিত।

দেশটিতে প্রচুর খাদ্যশস্য জন্মায়। নানারকম ফুল আর ফলের দেখা পেলাম। আখও প্রচুর। এ দিয়ে তারা চিনি তৈরি করে। আবহাওয়া উষ্ণ ও ভিজে। বরফ বা তুষারপাত সাধারণতঃ হয় না। লোকেরা কোমল ও ভীরু চরিত্রের। জ্ঞানের চর্চ্চা করতে ভালোবাসে। এদের অধিকাংশই বিধর্মী। বৌদ্ধ অল্প কিছু।

প্রাচীন কাল থেকে এ-পর্যন্ত ভারতের এই প্রান্তিক দেশটি বহু শাস্ত্রকারের জন্ম দিয়েছে। নারায়ণ দেব, অসংগ বোধিসত্ত্ব, বসুবন্ধু, বোধিসত্ত্ব ধর্মতাত, মনোর্হিত, মহানুভব পার্শ্ব সকলেরই জন্ম এখানে। প্রায় এক হাজারের মতো সংঘারাম ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু সবগুলিই এখন জনশূন্য অবস্থায় ধ্বংসের মুখে। জঙ্গল আর আগাছায় ভরা। স্তূপগুলির বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। বিধর্মী মন্দিরের সংখ্যাও একশোর মতো। আর সবগুলিতেই তাদের নানান সম্প্রদায় বিশৃঙ্খলভাবে বাস করছে।

পুরোনো শহরের মধ্যে উত্তর-পূর্ব দিকে একটি পুরোনো ভিত দেখা যায়। এখানে আগে বুদ্ধের ‘পাত্রের’ অমূল্য স্তূপটি ছিল। বুদ্ধের নির্বাণ লাভের পর পাত্রটি এদেশে আসে। অনেক শতাব্দী ধরে এখানে সেটি পূজা পায়। তারপর নানা দেশের হাতবদল হয়ে এখন সেটি পারস্যে আছে।

শহরের বাইরে, প্রায় ৮ বা ৯ লি দক্ষিণ-পূর্বে একশো ফুটের মতো উঁচু একটি অশ্বত্থ গাছ আছে। এর ডালগুলি মোটা, নিচের ছায়া ঘন ও অন্ধকার। আগের চার বুদ্ধ এর নিচে বসে গেছেন। এখন সেখানে সেই চার বুদ্ধের উপবিষ্ট মূর্তি রয়েছে। এর নিচে দক্ষিণমুখী হয়ে বসে শাক্য তথাগত আনন্দকে বলেছিলেন— “পৃথিবী থেকে আমি বিদায় নেবার চারশো বছর পর কণিষ্ক নামে এক রাজা রাজত্ব করবে। সে এর কাছে, দক্ষিণ দিকে একটি স্তূপ বানাবে ও তাতে আমার অস্থি ও দেহভষ্ম রাখবে।”

কণিষ্ক তদনুসারে দক্ষিণদিকে একটি জোড়া-স্তূপ তৈরী করান ও সেখানে বুদ্ধের অস্থি ও দেহভস্ম রাখেন। এই দুটি স্তূপের একটিকে ঘিরে অন্যটি তৈরী। মাঝের স্তূপটি অন্যটি থেকে উঁচু। এই স্তূপ দুটি এখনো বর্তমান।

এই জোড়া-স্তূপের পূর্বদিকে, সোপান শ্রেণীর দক্ষিণ পাশে দুটি স্তূপ রয়েছে। একটি তিন ফুট, অন্যটি পঁচিশ ফুট উঁচু। এদুটি বড় স্তূপ দুটির (জোড়া-স্তূপ সমানুপাতিক। বুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি রয়েছে এখানে; একটি চার ফুট ও অন্যটি ছয় ফুট উঁচু। বোধিবৃক্ষের নিচে বুদ্ধ আসন করে বসে আছেন এভাবে মূর্তি দুইটি তৈরী।

সোপানশ্রেণীর দক্ষিণ দিকে বুদ্ধের একটি ১৬ ফুট উঁচু ছবি আঁকা রয়েছে। ছবিটির উপরের ভাগ দুটি দেহ, নিচের ভাগ একটি দেহ।

বড় স্তূপটির দক্ষিণ-পশ্চিমে ১০০ পায়ের মত এগিয়ে গেলে বুদ্ধের একটি মূর্তি দেখা যাবে। এটি শ্বেত পাথরে তৈরী ও ১৮ ফুট উঁচু। এটি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থার মূর্তি। উত্তরমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

স্তূপটির ডাইনে-বাঁয়ে ১০০টির মত ছোট স্তূপ পাশাপাশি একটানা ভাবে রয়েছে এবং এগুলি শিল্প নৈপুণ্যের চূড়ান্ত নিদর্শন।

তথাগতের ভবিষ্যৎ বাণী অনুসারে এই স্তূপটি সাতবার পুড়ে যাবার ও পুনর্নির্মিত হবার পর বৌদ্ধ ধর্ম লোপ পাবে। পুরোনো নথি থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত এটি তিনবার পুড়েছে ও তিনবার পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। আমি যখন প্রথম এদেশে এলাম ঠিক সে সময়ে একটি অগ্নিকাণ্ডে এর ক্ষতি হয়। পুনরুদ্ধারের কাজ চলেছে, এখনো শেষ হয়নি।

স্তূপটির পশ্চিমে একটি প্রাচীন সংঘারাম আছে। এটিও রাজা কণিষ্কের তৈরী। এর দুটি তোরণ, সংলগ্ন ছাদ, তলাবিশিষ্ট স্তূপ ও ভিতর কক্ষ-সব কিছুই বলে দেয়, এককালে এখানকার বিরাট বিরাট জ্ঞানী পুরুষেরা খ্যাতির উঁচু সোপানে আরোহণ ক’রে ধর্মের রূপ বিন্যাস করেন ও এই সংঘারামটিকে বিখ্যাত করে তুলেন। বর্তমানে এর কিছুটা ভগ্নদশা হলেও স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন বহন করে এটি। অল্প কয়েকজন ভিক্ষু তখন এখানে বাস করছেন। এটির জন্মকাল থেকে এযাবৎ অনেক শাস্ত্রকার এখানে জীবন কাটিয়েছেন, পরম সম্পদ লাভ করে গেছেন। তাদের পবিত্র খ্যাতি এখনো ব্যাপক, তাদের আদর্শ ধর্মপ্রাণ চরিত্র এখনো জীবন্ত।

তৃতীয় মিনারে শ্রদ্ধেয় পার্শ্বিকের কক্ষ। কিন্তু এটি অনেক কাল আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে এখানে তার একটি স্মৃতিফলক বসানো হয়েছে। তিনি প্রথমে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন। আশি বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্মানুগামী হন।

পার্শ্বিক যেখানে থাকতেন তার পূর্বদিকে একটি পুরানো দালান আছে। এখানে বোধিসত্ত্ব বসুবন্ধু ‘অভিধর্মকোষ’ শাস্ত্র রচনা করেন। শ্রদ্ধার নিদর্শনরূপে লোকেরা এখানে এ সম্পর্কে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছেন।

বসুবন্ধুর আবাসের দক্ষিণদিকে পঞ্চাশ পায়ের মতো গেলে একটি দোতালা আবাস রয়েছে। এখানে থেকে শাস্ত্রবিশারদ মনোর্হিত বিভাগ শাস্ত্র রচনা করেন। তিনি বুদ্ধ থেকে দশম শতকের মধ্যকালে জীবিত ছিলেন। যুবাকালে গভীর জ্ঞানচর্চ্চা করে ধর্মানুরাগীদের মধ্যে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি বিশেষ প্রতিভাবান ছিলেন। সাধারণ মানুষও এজন্য তাঁকে সম্মান করতেন। এ সময়ে শ্রাবস্তীর রাজা ছিলেন প্রসিদ্ধ বিক্রমাদিত্য। মনোর্হিত তাঁর কোপে পড়ে অন্যায়ভাবে তর্কযুদ্ধে লাঞ্ছিত হন। লজ্জায় অপমানে তিনি নিজের জিভ কেটে ফেলেন ও এভাবে মারা যান। বসুবন্ধু তাঁর শিষ্য ছিলেন।

কিছুকাল পরে বিক্রমাদিত্য রাজ্য হারালেন। যিনি নতুন সম্রাট হলেন তিনি বিশেষভাবে গুণীদের সমাদর করতেন। তিনি জানতেন মনোর্হিত প্রকৃতই একজন জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। শিষ্য বসুবন্ধু তার সহায়তায় মনোহিতের সুনাম পুনরুদ্ধার করেন।

কণিষ্ক রাজার তৈরী সংঘারামটি থেকে উত্তর-পূর্বে পঞ্চাশ লি-র মতো গেলে একটি বড় নদী পড়ে। এই নদী পার হয়ে পো-শি-কিএ-লো-ফা-তি বা পুষ্কলাবতী। এর আয়তন ১৪ বা ১৫ লির মতো। অনেক লোক বাস করে এখানে। এক পরিখা দিয়ে এর তোরণ-দ্বারগুলির একের সঙ্গে অন্যের যোগ রয়েছে।

পশ্চিম তোরণের বাইরে একটি দেবমন্দির আছে। দেবতার বিগ্রহটি বেশ আকর্ষণীয়, প্রায়ই নানা অলৌকিক কাণ্ড ঘটায়।

নগরীর পূর্বদিকে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ। আগের চার বুদ্ধ এখানে ধর্মপ্রচার করেন। প্রাচীন (বৌদ্ধ) সাধু সন্তদের মধ্যে অনেকে মধ্যভারত থেকে এখানে জ্ঞান প্রচারের জন্য এসেছিলেন। তাদের মধ্যে শাস্ত্রবিশারদ বসুমিত্রের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি অভিধর্ম প্রকরণপাদ গ্রন্থখানি এখানে বসে রচনা করেন।

নগরীর উত্তরে ৪ বা ৫ লি গেলে আরেকটি পুরোনো সংঘারাম দেখা যায়। এর মহা কক্ষগুলি এখন নিস্তব্ধ নির্জন হয়ে পড়ে রয়েছে। মাত্র সামান্য কয়েকজন ভিক্ষু এখানে থাকেন। সকলেই হীনযান পন্থী। শাস্ত্রজ্ঞ ধর্মতাত এখানে তার সংযুক্তাভি-ধর্ম শাস্ত্রগ্রন্থখানি রচনা করেন।

সংঘারামটির পাশে কয়েকশো ফুট উঁচু একটি স্তূপ আছে। রাজা অশোক এটিকে তৈরী করান। কাঠ ও পাথর দিয়ে একে বানানো হয়েছে। কাঠের উপর নানা কারুকাজ, পাথরে নানারকম চিত্র খোদাই। নানান শ্রেণীর শিল্পীরা মিলে এটি বানিয়েছেন।

এখান থেকে পূর্ব দিকে সামান্য একটুখানি যেতে দুটি পাথরের স্তূপ চোখে পড়বে। দুটিই প্রায় ১০০ ফুট উঁচু। একটি ব্রহ্মা ও দ্বিতীয়টি শত্রু (ইন্দ্র) দেবের তৈরী। এ দুটি আগে দামী দামী পাথর ও মণি-রত্নভূষিত ছিল। বুদ্ধের মৃত্যুর পর সে সব সাধারণ পাথরে পালটে যায়। এ দুটি এখন ভগ্নদশায় পৌঁছেছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও এ দুটি এখনো যথেষ্ট উঁচু ও জমকালো।

এই স্তূপ দুটি থেকে ৫০ লি মতো উত্তর-পশ্চিমে গেলে আরেকটি স্তূপ। শাক্য তথাগত এখানে যক্ষমাতার হৃদয় পরিবর্তন করে অপরের শিশু বধ করা থেকে তাকে নিবৃত্ত করেন। এই কারণে সাধারণ লোকেরা এখানে সন্তান লাভের জন্য মানত করে।

এখান থেকে পঞ্চাশ লি মতো উত্তর দিকে গেলে আরো একটি স্তূপ। এখানেই সামক বোধিসত্ত্ব বালক কালে অন্ধ পিতামাতাকে লালন-পালন করতেন।

এবার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ২০০ লি মতো পথ চলার পর আমরা পো-লু-শ শহরে পৌঁছলাম। এই শহরের উত্তরে একটি স্তূপ আছে। কতক ব্রাহ্মণকে পিতার অতিকায় হাতিটি দান করে দেবার অপরাধে রাজকুমার সুদানকে এখানে দোষী সাব্যস্ত করে নির্বাসন দণ্ড দেয়া হয়েছিল। নগর থেকে বেরিয়ে এই স্থানটিতে এসেই তিনি তার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নেন। এই স্তূপটি একটি সংঘারাম। পঞ্চাশ জনের মতো ভিক্ষু এখানে থাকেন। সকলেই হীনযানে অনুরক্ত। শাস্ত্রবেত্তা ঈশ্বর এখানে পুরাকালে ও-পি-তো-মো-সিঙ-চিঙ-লুন রচনা করেন।

শহরটির পূর্ব-দিককার ফটকের বাইরে একটি সংঘারাম আছে। এখানেও ৫০ জনের মতো ভিক্ষু থাকেন। এরা সবাই মহাযানপন্থী। রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ আছে এখানে।

পো-লু-শ শহর ছেড়ে ২০ লি মতো উত্তর-পূর্বে যেতে দন্তলোক পাহাড়ের দেখা পাওয়া গেল। এই পাহাড়টির একটি চূড়ায় রাজা অশোকের তৈরী একটি স্ত প আছে। রাজপুত্র সুদান এখানে তাঁর নির্বাসিত জীবন যাপন করে গেছেন। এর কাছে আরেকটি স্তূপ আছে। এখানে সুদান তাঁর পুত্র-কন্যাকে ব্রাহ্মণের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন। প্রহার করে ব্রাহ্মণ এখানেই তাদের রক্ত ঝরিয়েছিলেন। এখানকার গাছপালা, ঝোপ জঙ্গল এখনো এজন্য গাঢ় লাল রঙের। দুই পাহাড়ের চূড়ার মাঝে একটি পাথরের কক্ষ আছে। ওই রাজপুত্র ও তার স্ত্রী এখানে সাধনা করতেন।

এই বনের পাশে একটি পাহাড়ী গুহা আছে। এখান থেকে তা বেশি দূরে নয়। আগে এক বৃদ্ধ ঋষি সেখানে বাস করতেন।

পাহাড়ী গুহাটি থেকে একশ লির মতো পথ চলে উত্তর-পশ্চিম দিকে গেলে প্রথমে একটি ছোট পাহাড় পড়বে। সেটি পার হয়ে গেলে একটি বড় পর্বত। এই পর্বতের দক্ষিণে একটি সংঘারাম আছে। এখানে অল্প কয়েকজন ভিক্ষু থাকেন। সকলেই মহাযানের উপাসক। এর পাশে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ। পুরাকালে এখানে একশৃঙ্গ ঋষি বাস করতেন। বারবণিতার ছলনায় ভুলে তিনি তাঁর ঋষিত্ব হারান। সেই রমণীটি তাঁর কাঁধে চেপে নগরে ঘোরে।

পো-লু-শ নগরী থেকে ৫০ লি মতো উত্তর-পূর্বে গেলে উঁচু পর্বত। এখানে সবুজ (নীলাভ) পাথরে কাটা ঈশ্বর দেবের স্ত্রীর বিগ্রহ রয়েছে। ইনি ভীমা দেবী (দুর্গার অপর রূপ)। ব্রাহ্মণরা ও অপরাপর নিচ ধর্মের লোকেরা বলে যে এই মূর্তিটি আপনা থেকে এখানে আবির্ভূত হয়েছে। এর নানারকম অলৌকিক ঘটনা ঘটানোর খ্যাতি রয়েছে। এ জন্য সকলের কাছে সে পূজা পায়। ভারতের প্রত্যেক অঞ্চল থেকে লোকে এখানে পূজা দিতে ও সমৃদ্ধি কামনা করতে আসে। গরিব ধনী সকলেই এখানে ভিড় করে। যারা তাঁর দিব্য দর্শন পেতে চায় তারা পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে সাত দিন উপবাসে কাটালে তিনি তাদের দেখা দেন ও অধিকাংশ মনস্কামনা পূরণ করেন। পর্বতের নিচে মহেশ্বর দেবের মন্দির। যে সব বিধর্মীরা সারাদেহে ভষ্ম মাখে, এখানে তারা পূজা দেয়।

ভীমা দেবীর মন্দির থেকে দক্ষিণ-পূর্বে ১৫০ লি মতো গিয়ে আমরা ‘উ-তো- ফিয়-হন-ছ’ শহর পাই। এ শহরটির আয়তন ২০ লি মতো। এর দক্ষিণ সীমানা দিয়ে সিন্ধু নদ বয়ে চলেছে। অধিবাসীরা বিত্তবান, সমৃদ্ধ। নানা দিক থেকে দামী দামী সব পণ্য সামগ্রী ও নানা জিনিসপত্র এখানে এসে জমা হয়।

এ শহর থেকে ২০ লি মতো উত্তর-পশ্চিমে গেরে আমরা ‘পো-তো-তু-লো’ বা শলাতুরা শহরে এসে হাজির হই। ব্যাকরণ রচয়িতা পাণিনি ঋষির জন্মস্থান এটি। অসংখ্য শব্দ সংগ্রহ করে বর্ণের উপর তিনি একখানি বই লেখেন। এতে ৩২ মাত্রার ১০০০টি শ্লোক রয়েছে। অক্ষর ও শব্দ সম্বন্ধে তাঁর সময় পর্যন্ত জানা সবকিছু এতে আছে, কোন কিছুই বাদ পড়েনি। রচনা শেষ হলে বইখানি তিনি রাজার কাছে পাঠিয়ে দেন। রাজা বইখানিকে অতি সমাদর করেন। রাজ্যময় এর ব্যবহার ও শিক্ষাদানের নির্দেশ দেন। তিনি এ কথাও ঘোষণা করেন যে যিনি এ বইখানি সুরু থেকে শেষ অবধি পুরো আয়ত্ত করতে পারবেন তাঁকে এক হাজার স্বর্ণখণ্ড দেবেন। সেই থেকে পণ্ডিতরা সারা বিশ্বে মঙ্গলের জন্য গুরু শিষ্য পরম্পরায় নির্ভুলভাবে একে হস্তান্তর করে চলেছেন। এই শহরটির ব্রাহ্মণরা এই কারণে তাদের ব্যাকরণ ও দক্ষতা, প্রতিভা ও স্মরণশক্তির জন্য বিখ্যাত।

শলাতুরা শহরে একটি স্তূপ আছে। একজন অর্থৎ পাণিনির এক শিষ্যকে এখানে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করেন।

তথাগত নির্বাণ লাভের ৫০০ বছর পর কাশ্মীরে একজন অর্হৎ আসেন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য। ক্রমে সেখান থেকে এখানে এসে তিনি এক ব্রহ্মচারীকে দেখলেন। সে অক্ষর বিষয়ে নির্দেশ দিতে দিতে একটি বালককে পেটাচ্ছিল। অর্হৎ তাই দেখে ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করলেন-ছেলেটিকে তুমি মারছ কেন? ব্রাহ্মণ উত্তর দিল-”আমি ওকে শব্দবিদ্যা শেখাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই ও ঠিকমতো এগোতে পারছে না।” অর্হৎ ঈষৎ হাসলেন। ব্রাহ্মণ তা দেখে বললেন, “শ্রমণেরা করুণা ও ভালবাসার অনুগামী, মানুষ ও সকল প্রাণীর প্রতি সাধারণতঃ দয়ালু, তা জানি। কিন্তু আপনি হাসছেন কেন? দয়া করে বলুন।” অর্হৎ উত্তর দিলেন, “সহজ কথাটাও যখন তুমি বুঝলে না তখন সেকথা শুনলে তুমি সহজে বিশ্বাস করতে পারবে না। সকলের শেখার সুবিধার জন্য যিনি শব্দবিদ্যা শাস্ত্র লিখে গেছেন সেই ঋষি পাণিনির নাম শুনেছ নিশ্চয়ই?” ব্রাহ্মণ বললেন-”এ শহরের অধিবাসীরা সবাই তাঁর শিষ্য, সবাই তাঁর গুণমুগ্ধ। তাঁর স্মৃতি রক্ষার জন্য একটি মূর্তিও স্থাপিত হয়েছে এবং তা এখনো বর্তমান আছে।” অর্হৎ বললেন-”এই যে ছেলেটিকে তুমি পড়াচ্ছ সে-ই পাণিনি ঋষি। তিনি তাঁর মানসিক উদ্যম যেহেতু শুধু পার্থিব শাস্ত্র আয়ত্তের জন্য ব্যয় করেছেন তাই সত্য কারণহীণ অপর-ধর্মী শাস্ত্র রচনা করেছেন। তাই তাঁর আত্মা ও জ্ঞান চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তিনি তখন থেকে এখন পর্যন্ত জন্মের আবর্তন চক্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু সত্য-ধর্মের প্রভাবে তিনি এবার তোমার পুত্র হয়ে জন্মেছেন। এই কারণেই পার্থিব জ্ঞানের দিকে তাঁর কোন আকর্ষণ নেই। তুমি তাঁকে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে গৃহত্যাগের অনুমতি দাও।

অর্হৎ এই কথা বলে তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এ দেখে ব্রাহ্মণ গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়লো ও তার মনে বিশ্বাস জন্মালো। শহরে ও তার আশেপাশে সে এ ঘটনা রটনা করলো ও ছেলেকে বুদ্ধের অনুগামী হবার অনুমতি দিল। সে নিজের ধর্মমতের পরিবর্তন করলো। গ্রামের লোকেরাও তার আদর্শ অনুসরণ করে বুদ্ধের উপাসক হলো। এখনও পর্যন্ত তারা তাদের সেই পুরানো জীবিকায় একাগ্র রয়েছে।

॥৪॥ উ-চাঙ-নঃ উদ্যান

‘উ-তো-কিয়-হন-ছ’ থেকে উত্তর দিকে পথ চলে ৬০০ লির মতো যাবার পর আমরা ‘উ-চাঙ-ন’ বা উদ্যান রাজ্যে উপস্থিত হলাম। পথে আমাদের কয়েকটি পর্বত অতিক্রম করতে হলো, নদী পার হতে হলো।

উদ্যান রাজ্য আয়তনে ৫০০ লির মতো। পর পর পর্বত আর উপত্যকা যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেছে। উপত্যকা আর জলাভূমি একের পর আর পাল্লা দিয়ে উঁচু মালভূমির সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েছে। এ রাজ্যে অনেক রকম শস্য বোনা হয়। কিন্তু ফসল তেমন ভাল হয় না। আঙুর প্রচুর, আখ অল্পস্বল্প। মাটির নিচ থেকে সোনা ও লোহা মেলে। ‘য়ো-কিন’ বা হলুদ নামে এক প্রকার গন্ধসার গাছ চাষের পক্ষে এ অঞ্চলটি খুব উপযোগী। বনাঞ্চল বেশ ঘন, আলো ঢুকতে পায় না। ফল ফলাদি ও ফুল অজস্র। ঠাণ্ডা আর গরম দুটোই মানানসই, ঝড় ও বৃষ্টি তাদের ঋতু অনুসারে।

এখানকার অধিবাসীরা কোমল ও মেয়েলী ভাবাপন্ন। স্বভাবের দিক থেকে কিছুটা ধূর্ত ও কপট। জ্ঞানের আদর করলেও তা অর্জনের দিকে কোন মনোযোগ নেই। ভোজবাজী, তন্ত্রমন্ত্রের প্রয়োগের দিকে তাঁদের বিশেষ ঝোঁক রয়েছে। তাঁরা সাদা সুতীর কাপড় পরেন-এছাড়া আর কিছু বড়ো পরেন না। ভারতের ভাষা থেকে এঁদের ভাষা কোন দিকে পৃথক হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার সঙ্গে মিল রয়েছে। লেখার বর্ণমালা ও সামাজিক ভদ্রতা প্রকাশের রীতিনীতিও ওই রকম কিছুটা মিশেল ধরনের। এঁরা বুদ্ধের প্রতি বিশেষ ভক্তিপরায়ণ ও মহাযানপন্থী।

শুভবাস্তু (বর্তমান স্বাত) নদীর দুপারে ১৪০০ মতো পুরোনো সংঘারাম রয়েছে। এখন এগুলি বলতে গেলে প্রায় ধ্বংসের মুখে ও মানব-বর্জিত। আগে এখানে আঠারো হাজারের মতো ভিক্ষু বাস করতেন। তারপর কমতে কমতে এখন নামমাত্র সংখ্যায় ঠেকেছে। সবাই মহাযানের উপাসক। সবাই নির্জন সাধনার বিধি পালন করেন, এ নিয়ে শাস্ত্রবাক্য আওড়াতে ভালোবাসেন, কিন্তু এ সম্পর্কে গভীর কোন অনুভব অনুভূতি নেই। যাঁরা নৈতিক নীতিগুলো মেনে চলেন তাঁরা পবিত্র জীবন যাপন করেন, ভোজবাজী-তন্ত্রমন্ত্র এসব থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকেন। বিনয় পিটকের যে সব শাখার সঙ্গে তারা পরিচিত সেগুলি হলো-সর্বাস্তবাদ, ধর্মগুপ্ত, মহীশাসক, কাশ্যপীয়, মহাসংঘিকা—এই পাঁচটি।

এখানে দশটির মতো দেবমন্দির আছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দুরা সেখানে থাকে। ভাল শহরের সংখ্যা চার থেকে পাঁচ। রাজারা প্রধানতঃ মুঙ্গলী থেকে রাজ্য শাসন করেন। এ শহরটির আয়তন ১৬ বা ১৭ লির মতো। জনসংখ্যা আয়তনের তুলনায় ঢের বেশি। মুঙ্গলী থেকে ৪-৫ লি পূর্বে একটি স্তূপ আছে।

মুঙ্গলী শহর থেকে ২৫০ বা ২৬০ লির মতো উত্তর-পূর্বে গেলে একটি বিরাট পর্বতের চূড়ায় নাগ অপলাল-এর প্রস্রবণে হাজির হই। এটি শুভবাস্তু নদীর উৎস। নদীটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে। গ্রীষ্ম ও বসন্ত দুটি ঋতুতেই এটি জমে যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি তুষার-বাষ্প ভেসে চ’লে মেঘের বুকে মিলিয়ে চলেছে। যেদিকে তাকানো যায় শুধু রঙিন ছটার সূক্ষ্ম প্রতিফলন।

নাগ অপলালের প্রস্রবণ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বা নদী থেকে ৩০ লি মতো উত্তর দিকে একটি বড় পাথরের উপর ভগবান বুদ্ধের পদচিহ্ন রয়েছে। পরবর্তীকালে লোকেরা এখানে একটি পাথরের ঘর তুলেছে। বহুদূর থেকে লোকে এখানে পূজা দিতে আসে।

নদীর স্রোত যে পথ ধরে তলমুখী বয়ে গেছে সেই পথে ৩০ লির মতো এগোলে আমরা সেই পাথরটির কাছে পৌঁছাই যেখানে তথাগত তাঁর বসন ধুয়েছিলেন। তাঁর কাষায় বস্ত্রের সূতা এখনো সেখানে প্রত্যক্ষ করা যায়। পাথরের উপর ঠিক যেন খোদাই হয়ে রয়েছে।

মুঙ্গলী শহর থেকে দক্ষিণ দিকে ৪০০ লির মতো চললে হিল পর্বতের দেখা পাওয়া যায়। উপত্যকার মধ্য দিয়ে নদীটি বয়ে এসে এখানে পশ্চিমে বাঁক নিয়েছে ও তারপর আবার পূর্বমুখী বাঁক নিয়ে উপরের দিকে (উৎস অভিমুখে) এগিয়ে গেছে। নদীর দুপারে পাহাড়ের দিক মুখ করে নানারকম ফল ও ফুলের গাছ ছড়িয়ে আছে। যে দিকে চোখ ফেরানো যায় বড়ো বড়ো পাহাড়ের চূড়া আর গভীর গুহা। আর বয়ে চলেছে নদীর স্বচ্ছ স্রোত উপত্যকার বুক চিরে। কানে ভেসে আসে কখনো মানুষের কণ্ঠস্বর, কখনো বা গানের কলি। কোথাও কোথাও লম্বাটে সরু চৌকো বিছানার মতো পাথর নজরে পড়ে। দেখলে মনে হবে যেন মানুষের হাতের কাজ। এগুলি সারি সারি পাহাড়ের উপর থেকে উপত্যকা পর্যন্ত নেমে এসেছে। প্রাচীনকালে তথাগত বুদ্ধ এখানে বাস করেন। এখানেই নীতি বিষয়ক অর্ধ-গাথাটি শুনে তাঁর মনে প্রাণ ত্যাগ করার ইচ্ছা দেখা দেয়।

মুঙ্গলী থেকে ২০০ লির মতো দক্ষিণ দিকে গেলে একটি পর্বতের কাছে এসে আমরা পৌছাই। এখানেই মহাবন সংঘারাম। তথাগত পুরাকালে এখানেই সৰ্বদত্ত রাজা হয়ে জন্মে বোধিসত্ত্বের জীবন কাটান। শত্রুর কাছ থেকে পালিয়ে নিজের দেশ ছেড়ে তিনি গোপনে এখানে চলে আসেন। এক গরিব ব্রাহ্মণের সঙ্গে এখানে তাঁর দেখা হয়। ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে ভিক্ষা চায়। রাজ্য হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ায় কিছুই তাঁর কাছে দেবার মত ছিল না। তিনি তখন তাঁকে বেঁধে বন্দী করে শত্রু রাজার কাছে নিয়ে যাবার জন্য ব্রাহ্মণকে বললেন। শত্রু রাজা ব্রাহ্মণকে এজন্য নিশ্চয় পুরস্কার দেবেন। সেই পুরস্কারই হবে ব্রাহ্মণের প্রতি তাঁর নিজস্ব দান।

মহাবন সংঘারাম থেকে উত্তর-পশ্চিম ধরে পাহাড়ের নিচের দিকে ৩০-৪০ লির মতো চললে মো-সু বা মসুর সংঘারাম। এখানে ১০০ ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ আছে। এর একপাশে বিরাট এক চতুষ্কোণ পাথরের উপর বুদ্ধদেবের পদচিহ্ন রয়েছে। আর গোড়ায় একটি হলদেটে-সাদা পাথর আছে যা সব সময় তেলতেলে পদার্থে ভেজা। এই সংঘারাম থেকে ৬০ বা ৭০ লি পশ্চিমে গেলে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ দেখা যাবে।

এ জায়গাটি থেকে উত্তর-পশ্চিমে ২০০ লির মতো গেলে আমরা শন-নি-লো- শি বা শনি রাজার উপত্যকায় পৌঁছাই। এখানে স-পও-শ-তি বা সপৌষধি সংঘারাম বর্তমান। এখানে ৮০ ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ আছে।

এই স্তূপের বেশ কাছাকাছি সুমা নামে একটি স্তূপ আছে।

এই শনি রাজার উপত্যকার উত্তরে একটি খাড়া পাহাড়ের পাশে একটি স্তূপ রয়েছে। অসুখে পড়ে যারা এখানে পূজা দেয় তাদের অনেকেই নিরাময় লাভ করে।

পুরাকালে তথাগত যখন ময়ূরদের রাজা হয়ে জন্ম নেন তখন একবার অনুচরদের নিয়ে তিনি এখানে আসেন। ওই সময়ে তাদের দারুণ জলপিপাসা পায়। সবাই জলের খোঁজ শুরু করে। কিন্তু কোথাও জলের দেখা পাওয়া গেল না। ময়ূর-রাজ তখন নিজের ঠোঁট দিয়ে পাহাড়ের গা ঠোকরালেন। সঙ্গে সঙ্গে জলের ধারা বইতে সুরু করলো। সেই জলধারায় অনুচরদের পিপাসা দূর হলো। এই জলধারা থেকেই এখানে একটি হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে। অসুখ হলে কেউ যদি এই জল পান করে বা এখানে স্নান করে তবে সে ভালো হয়ে যায়। পাহাড়ের উপরে ময়ূরের পায়ের ছাপ এখনো দেখা যায়।

মুঙ্গলী শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ৬০ থেকে ৭০ লির মতো গেলে একটি বড় নদী। এর পূর্বদিকে ৬০ ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ। রাজা উত্তর সেন এটি তৈরী করান। পুরাকালে তথাগত যখন মৃত্যুমুখে তখন তিনি সমবেত সবাইকে বলে যান “আমার নির্বাণের পর উদ্যানের রাজা উত্তর সেন আমার দেহাবশেষের একটি ভাগ পাবে।” যখন অন্য রাজারা সকলে তা ভাগ করে নিচ্ছেন এমন সময়ে রাজা উত্তর সেন এসে হাজির হলেন। প্রান্তিক দেশ থেকে এসেছেন বলে কেউ তাঁর দিকে নজর দিল না। তখন দেবতারা বুদ্ধদেবের কথাগুলি ঘোষণা করলেন। রাজাকে দেহাবশেষের ভাগ দেয়া হলো। রাজা তা নিয়ে দেশে ফিরলেন ও তার প্রতি সম্মান দেখাবার জন্য একটি স্তূপ বানালেন। এই স্তূপের পাশে, নদীর পারে হাতির মতো আকৃতির একটি বিরাট পাথর আছে। রাজা উত্তর সেন একটি বিরাট সাদা হাতির পিঠে করে দেহাবশেষ এনেছিলেন। এই জায়গাটিতে পৌঁছে হাতিটি মারা যায় ও সঙ্গে সঙ্গে পাথরে পরিণত হয়ে যায়।

মুঙ্গলী থেকে ৫০ লি মতো পশ্চিমে গিয়ে বড় নদীটি পার হলে এই স্তূপটি দেখা যায়। এটির নাম রোহিতক। স্তূপটি ৫০ ফুটের মতো উঁচু। রাজা অশোকের বানানো।

মুঙ্গলী শহর থেকে ৩০ লির মতো গেলে হো-পু-তো-শি বা অদ্ভুত স্তূপ। এটি ৪০ ফুটের মতো উঁচু।

এর পশ্চিম দিকে বড় নদীটি পার হয়ে ৩০ বা ৪০ লির মতো গেলে আমরা একটি বিহারের দেখা পাই। এখানে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের মূর্তি রয়েছে।

অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি থেকে ১৪০ বা ১৫০ লির মতো গেলে লন-পো-লু পর্বত। এই পর্বতে ৩০ লি মতো আয়তনের নাগ-হ্রদ বর্তমান। স্বচ্ছ ঢেউ অপরূপ ব্যঞ্জনায় বয়ে চলেছে। জল আয়নার মতো পরিষ্কার। এই নাগ রাজার মেয়ে এক শাক্য যুবকের প্রেমে পড়েন ও তাদের বিবাহ হয়। নাগ রাজা প্রদত্ত তরবারি দিয়ে এই শাক্য যুবক উদ্যানের রাজাকে হত্যা করে সেখানে রাজা হন। তারপর তাঁর পুত্র উত্তর সেন সেখানকার রাজা হন। বুদ্ধ এই উত্তর সেনের রাজ্যে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর দেখা না পেয়ে তাঁর মায়ের কাছে বলে যান যে তিনি অল্পকাল মধ্যে কুশীনগরে, শাল বনে দেহত্যাগ করবেন। উত্তর সেন যেন সেখানে গিয়ে তার দেহাবশেষ নিয়ে আসেন।

মুঙ্গলী শহর থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে যাত্রা করলাম। প্রথমে একটি পাহাড় ডিঙোতে হলো। তারপর এক উপত্যকার মধ্য দিয়ে পথ চলে আমরা আবার সিন্ধু নদের পারে এসে হাজির হলাম। এ পথও রীতিমতো পাহাড়ী-রাস্তা, যথেষ্ট খাড়া। চারদিকের পাহাড়-পর্বত ও উপত্যকা কেমন যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন, থমথমে। কখনো আমাদের দড়ির সাহায্যে খাত পার হতে হলো, কখনো বা লটকানো শিকড়ের সাহায্যে। কোথাও আবার মাথা ঢাকা ঝুলন্ত কাঠের সেতু, কোথাও উড়ন্ত। কাঠের সিঁড়িও রয়েছে নীচ থেকে খাড়া বাঁধের উপর ওঠার জন্য। এ ভাবে ১০০ লি পথ ভাঙবার পর হাজির হলাম দরিল নদীর উপত্যকায়। উদ্যানের রাজধানী এক সময়ে এখানে ছিল। প্রচুর সোনা ও সুগন্ধি হলুদ এই অঞ্চলে। এখানে একটি বিরাট সংঘারাম আছে। তার পাশে ভাবী বুদ্ধ মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বের একটি মূর্তি। এটি কাঠের তৈরী। রঙ-সোনালী,−বেশ ঝকমকে। রীতিমতো অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন। মূর্তিটি একশো ফুটের কাছাকাছি উঁচু হবে। অর্থৎ মধ্যান্তিকের কীর্তি এটি (ইনি আনন্দের শিষ্য)। এই অর্হৎ এক শিল্পীকে তুষিত স্বর্গে জীবন্ত পাঠান যাতে সে মৈত্রেয়কে আপন চোখে দেখে তার সঠিক মূর্তি গড়তে পারেন। এজন্য শিল্পী মোট তিনবার তুষিত স্বর্গে যান। এই মূর্তিটি বানানোর পর থেকে পূর্বদিকে বৌদ্ধ ধর্মের হাওয়া বইতে শুরু করে।

॥৫॥ পো-লু-লো: বোলর

দরিল থেকে বেরিয়ে, আবার খাড়াই পাহাড় আর উপত্যকা পেরিয়ে এবার আমরা সিন্ধু নদের কূলে এসে পৌঁছলাম। সেখান থেকে উড়াল সেতু আর কাঠ দিয়ে বানানো হাঁটাপথের সাহায্যে নদী ও খাত পেরিয়ে, খাড়াই পাহাড় ভেঙে ৫০০ লির মতো পথ পার হলাম। এরপর দর্শন পেলাম বোলর রাজ্যের।

বোলর রাজ্যটির আয়তন চার হাজার লির কাছাকাছি। তুষার মুকুট পরা বিরাট বিরাট পর্বতের মাঝখানে এই দেশটি। পূর্ব-পশ্চিম দিকে লম্বা, উত্তর-দক্ষিণ দিকে সরু। এখানে গম ও ডালের চাষ হয়। সোনা ও রূপার খনি আছে। যথেষ্ট সোনা থাকার দরুন দেশটি ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে সমৃদ্ধ। আবহাওয়া সব সময় ঠাণ্ডা। মানুষ জন কড়া ও রুক্ষ মেজাজের। মানবিকতা বা ন্যায়বোধের বেশ অভাব দেখলাম তাদের মধ্যে। ভদ্রতা কাকে বলে জানে না, কখনো তার নাম শুনেছে বলেও যেন মনে হয় না। চেহারাও বেজায় কর্কশ, দেখলে ঘৃণার ভাব জাগে। পরণে সবার পশমের তৈরী পোষাক।

এদের লিপিমালা প্রায় ভারতের মতোই। ভাষা কিছুটা ভিন্ন ধরনের। এ অঞ্চলে ১০০টির কাছাকাছি সংঘারাম। ভিক্ষু সেখানে হাজার খানেকের মতো। জ্ঞান-চর্চ্চার দিকে তাদের তেমন কোন উৎসাহ নেই। নৈতিক চরিত্রের দিকে ও ভ্রুক্ষেপ নেই।

এ দেশ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম ‘উ-তো-কিয়া-হন-চ’ বা উদখাণ্ড (ওহিন্দ)। দক্ষিণ-দিক দিয়ে সিন্ধু নদ পার হলাম। নদটি এখানে তিন থেকে চার লির মতো চওড়া হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বয়ে চলেছে। জল বেশ পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন। খরবেগে বয়ে চলেছে বলে আয়নার মতো সুস্বচ্ছ। পাশে থাকা গুহা- গহ্বর, ফাঁক-ফোকরের মধ্যে নানা রকমের বিষাক্ত সাপ ও হিংস্র জন্তু-জানোয়ার রয়েছে। কেউ যদি মূল্যবান জিনিষপত্র বা ধন-রত্নাদি বা দুর্লভ জাতের ফুল বা ফলাদি এবং বিশেষ করে বুদ্ধের দেহাবশেষ নিয়ে এই নদ নৌকায় পার হবার চেষ্টা করে তবে প্রায়ই তার নৌকা ডুবে যায়।

॥ ৬ ॥ ত-ছ-শি-লো: তক্ষশীলা

সিন্ধুনদ পার হয়ে আমরা তক্ষশীলায় এলাম। এ রাজ্যটি আয়তনে দু’হাজার লির মতো। রাজধানীর আয়তন প্রায় দশ লি। মূল রাজবংশের চিহ্নবর্ণও নেই। অভিজাতরা এর অধিকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে চলেছে। আগে এটি কপিশার অধীন হয়ে ছিল। পরে কাশ্মীরের অধীনে এসেছে।

উর্বরাশক্তির জন্য দেশটি বিখ্যাত। প্রচুর ফসল ফলে। নদী আর ঝরণায় দেশটি ভরা। ফুল আর ফলের ফলনও প্রচুর। আবহাওয়া অতি মনোরম। অধিবাসীরা বেশ সজীব ও সাহসী। ত্রিরত্নকে শ্রদ্ধা করে। অনেক সংঘারাম আছে। তবে সেগুলির এখন ভাঙন-দশা, জন-শূন্য অবস্থা। খুব অল্প কতক ভিক্ষু আছেন। সকলেই মহাযান উপাসক।

নাগরাজ এলাপাত্রের সরোবরটি রাজধানী থেকে প্রায় ৭০ লি উত্তর-পশ্চিমে। এটি প্রায় ১০০ পায়ের মতো গোলাকার। জল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, মিঠা। নানা রঙের পদ্ম ফুল ফুটে সরোবরটিকে নয়নহরা করে তুলেছে। বিভিন্ন রঙের হালকা আভা বিকীর্ণ করে প্রাকৃতিক শোভায় মনোমুগ্ধকর পরিবেশ গড়ে তুলেছে। এই নাগ একজন ভিক্ষু ছিলেন। কাশ্যপ বুদ্ধের সময়ে তিনি একটি ইলাপাত্র গাছ ধ্বংস করেন। এই কারণে এখনো এখানকার লোকেরা বর্ষা বা ভাল আওহাওয়ার জন্য প্রার্থনা জানাতে হলে শ্রমণদের নিয়ে এখানে আসে। অল্পকালের মধ্যেই তাদের অভীষ্ট পূরণ হয়।

নাগহ্রদের দক্ষিণ-পূর্বদিকে ৩০ লি মতো হাঁটলে দুটি পর্বতের মাঝে থাকা একটি গিরিখাতে এসে হাজির হই। এখানে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ আছে। উঁচু ১০০ ফুটের কাছাকাছি।

স্তূপটির পাশে একটি সংঘারাম ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। অনেক কাল থেকে এটি মানব-বর্জিত, ভিক্ষু-শূন্য।

নগরের উত্তরদিকে ১২ বা ১৩ লি দূরে রাজা অশোকের তৈরী আর একটি স্তূপ আছে।

কাছেই একটি সংঘারাম। এর বাগান ও উঠান জঙ্গলে ভরপুর, কেউ এদিকে যাওয়া-আসা করে না। মাত্র জনকয়েক ভিক্ষু থাকেন। শাস্ত্রবেত্তা কুমারলব্ধ অতীতকালে এখানে থেকে কয়েকখানি শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করে গেছেন। ইনি সৌত্রান্তি ক শাখার অনুগামী ছিলেন।

নগরের বাইরে, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পাহাড়ের ছায়ায় একটি স্তূপ আছে। উঁচু একশো ফুটের কাছাকাছি। বিমাতার মিথ্যা অভিযোগে এখানে (অশোকের পুত্র) কুণালের চোখ উপড়ে নেয়া হয়েছিল। এ স্তূপটিও রাজা অশোকের বানানো।

॥ ৭ ॥ সঙ-হো-পু-লো: সিংহপুর

তক্ষশীলা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পর্বতশ্রেণী ও উপত্যকা ভেঙে ৭০০ লির মতো এগিয়ে যাবার পর সিংহপুর রাজ্যের দেখা পেলাম। আয়তনে রাজ্যটি প্রায় ৩৫০০ থেকে ৩৬০০ লি। পশ্চিম সীমানা দিয়ে সিন্ধু নদ বয়ে চলেছে। রাজধানীর আয়তন ১৪ থেকে ১৫ লি। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বর্তমান! ছোট-বড় খাড়া পাহাড়-পর্বতে ঘেরা বলে প্রাকৃতিক ভাবে রাজ্যটি সুরক্ষিত। জমিজমা খুব বেশি চাষ-আবাদ হয় না, কিন্তু ফলন যথেষ্ট। আবহাওয়া শীতল। লোকদের প্রকৃতি উগ্র ধরনের, শৌর্য-বীর্যের উপরেই বেশি জোর দেয়। প্রতারণা করার প্রবণতাও খুব। এ রাজ্যের আলাদা কোন রাজা বা শাসক নেই। কাশ্মীরের অধীন রাজ্য। রাজধানীর কাছেই দক্ষিণ দিকে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ আছে। এর কারুকার্য বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাছেই একটি সংঘারাম। এখন আর কোন ভিক্ষু নেই, জনমানব শূন্য।

শহরের দক্ষিণ-পূর্বে ৪০ বা ৫০ লি দূরে একটি স্তূপ আছে। এটিও রাজা অশোকের বানানো। প্রায় ২০০ ফুট উঁচু। এখানে দশটি পুকুর রয়েছে। গোপনভাবে পরস্পরের সঙ্গে এগুলি যুক্ত। ডান ও বাঁয়ের গোপন সংযোগ-পথগুলি পাথর দিয়ে ঢাকা। পাথরগুলি বিভিন্ন আকারের ও অদ্ভুত ধরনের। পুকুরের জল পরিষ্কার, বুদবুদগুলি সময়ে সময়ে শব্দ তোলে ও আলোড়ন জাগায়। সাপ ও নানারকম মাছ পুকুরের চারপাশে খানা ও ফোকরের মধ্যে বাসা বেঁধেছে ও জলে খেলা করে বেড়ায়। নির্মল জলের বুকে চার রঙের পদ্মফুল উঁকি দিচ্ছে। প্রায় একশো রকমের ফলগাছ পুকুরগুলিকে ঘিরে রয়েছে। জলের বুকে তাদের ছোট বড়ো ছায়া ঝিলমিল করছে। গাছের নিচেও চমৎকার ছায়া। সব মিলিয়ে, ঘুরে বেড়ানোর পক্ষে চমৎকার একটি জায়গা।

এর পাশে একটি সংঘারাম আছে। এখানে অনেককাল ধরে কোন ভিক্ষু নেই। স্তূপের ধার ঘেঁষে জায়গাটি রয়েছে সেখানে বিধর্মীদের মূল প্রবক্তা (মহাবীর) তাঁর ধর্মতত্ত্ব লাভ করেন ও প্রথম প্রচার করেন। এ সম্পর্কে এখানে একটি খোদাই লিপি রয়েছে। এই জায়গাটির পাশে একটি দেব মন্দির আছে। এখানে যাঁরা থাকেন তাঁরা কঠোর জীবন যাপন করেন। দিবারাত্রি অবিরাম তাঁরা কঠোর সাধনা করে চলেছেন। তাঁদের প্রবর্তক যে সব অনুশাসন দিয়ে গেছেন তার বেশিরভাগই বুদ্ধদেবের ধর্ম-নীতির বই থেকে নেয়া। এরা একটি ভিন্ন গোষ্ঠীর ও তদনুসারে তাদের নীতিসূত্রাদি ধার্য হয়েছে। যারা উঁচু পর্যায়ের তাদের ভিক্ষু বলা হয়, নবীনদের বলা হয় শ্রমণ। জীবন-ধারা ও ক্রিয়া-অনুষ্ঠানাদির দিক থেকে তাদের সঙ্গে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের যথেষ্ট সাম্য রয়েছে। কেবল তাদের একটি করে টিকি আছে ও উলঙ্গ থাকে। তাছাড়া যে কাপড় তারা কখনো সখনো পরে তার রঙ সাদা। এই সামান্য পার্থক্য অন্যদের সঙ্গে তাদের ভিন্নতা প্রকাশ করে। তাদের পবিত্র প্রবর্তকের আকৃতিকে তারা নিঃশব্দে তথাগতের সঙ্গে সমান করে থাকে। একমাত্র কাপড়ের দিক থেকেই যা একটু পৃথক। কিন্তু সৌন্দর্যের দিক থেকে পুরোপুরি এক।

এখান থেকে তক্ষশীলার উত্তর সীমান্তের দিকে ফেরা গেল। সিন্ধু নদ পার হয়ে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ২০০ লির মতো যাবার পর একটি বিরাট পাথরের ফটকের কাছে হাজির হলাম। আগের কালে রাজা মহাসত্ত্ব এখানে এক ক্ষুধার্ত বিড়ালকে খাইয়েছিলেন। ফটকের দক্ষিণে ৪০ বা ৫০ পা এগোলে একটি পাথরের স্তূপ নজরে পড়বে। এখানেই মহাসত্ত্ব ওই পশুটিকে মৃতপ্রায় দেখতে পেয়ে করুণাবিষ্ট হয়ে একটি বাঁশের ফলাকা দিয়ে নিজেকে বিদ্ধ করে তাকে আপন রক্ত পান করান। এর ফলে প্রাণীটি তার জীবন ফিরে পেল। এজন্য আজও এখানকার মাটি ও গাছপালা রক্ত-বর্ণে রঞ্জিত। মাটি খুঁড়লে বিদ্ধ করবার ফলাকার মতো জিনিস সব পাওয়া যায়। এসব গল্প আমরা বিশ্বাস করি কি করি না এ প্রশ্ন না তুলেও বলা যেতে পারে যে ঘটনাটি করুণাকর মনের পরিচায়ক।

এই দেহ-উৎসর্গের স্থানটি থেকে উত্তর দিকে ২০০ ফুটের মতো উঁচু একটি পাথরের স্তূপ আছে। রাজা অশোক এটি বানান। এটি উচ্চ সৌন্দর্যবোধের পরিচয় বহন করে ও নানা ভাস্কর্যমণ্ডিত। এখানে প্রায় একশোটির মতো ছোট স্তূপ আছে। সেখানকার মূর্তিগুলি বেদীসহ অপসারণযোগ্য ভাবে তৈরী।

এই স্তূপটির পূর্বে একটি সংঘারাম আছে! এখানে প্রায় ১০০ জন ভিক্ষু থাকেন। সকলেই মহাযানের চর্চ্চা করে চলেছেন।

এখান থেকে পূর্বে পঞ্চাশ লি মতো গেলে আমরা একটি নির্জন পাহাড়ে এসে পৌঁছাই। এখানেও একটি সংঘারাম আছে। একশোজনের মতো ভিক্ষু সেখানে থাকেন। তাঁরাও সবাই মহাযানের উপাসক। এখানে একাধিক প্রস্রবণ ও পুকুর রয়েছে, জল আয়নার মতো স্বচ্ছ। ফল ও ফুল প্রচুর। এই সংঘারামটির পাশে ৩০০ ফুটের কাছাকাছি উঁচু একটি স্তূপ আছে।

॥ ৮ ॥ উ-ল-শিঃ উরস

সিংহপুর থেকে এবার আমরা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাত্রা করলাম। পাহাড়মালা ডিঙিয়ে চড়াই ও উৎরাই ভেঙে ঊ-ল-শি বা উরস রাজ্যে উপস্থিত হলাম।

উরস রাজ্যটি আয়তনে দুহাজার লির কাছাকাছি। পাহাড় ও উপত্যকা যেন একের পর অন্য পর পর সাজানো। চাষ করার মতো জমির পরিমাণ বেশ কম; রাজধানীর আয়তন ৭ থেকে ৮ লি। এখানকার কোন স্থানীয় রাজা নেই। কাশ্মীরের শাসনাধীন। চাষের জমি কম হলেও ফসল ফলানোর উপযোগী। তবে ফল আর ফুল কম জন্মায়। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ ও মনোরম। বরফ বা তুষারপাত খুব কম। লোকদের মধ্যে মার্জিত রুচির অভাব বেশ প্রকট। স্বভাবের দিক থেকে কঠোর ও রুক্ষ। পরকে ঠকানোর অভ্যাস বেশ প্রবল। এরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নয়।

রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চার থেকে পাঁচ লি মতো গেলে একটি স্তূপের দেখা পাওয়া যায়। উঁচু ২০০ ফুটের মতো। এটি রাজা অশোকের তৈরী। পাশেই একটি সংঘারাম আছে। কিন্তু সেখানে ভিক্ষুর সংখ্যা বেশ কম। তারা সকলেই মহাযানের উপাসক।

॥ ৯ ॥ কিয়-শি-মি-লো: কাশ্মীর

উরস থেকে, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলে অনেক পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে, নানা চড়াই ভেঙে শিকলের সেতু পেরিয়ে একহাজার লির মতো এগিয়ে গেলাম। পৌঁছলাম কাশ্মীর এসে।

রাজ্যটির আয়তন সাত হাজার লির মতো। সবদিক পর্বত দিয়ে ঘেরা। এই পর্বতগুলি খুবই উঁচু। পর্বতগুলির মধ্য দিয়ে যদিও যাবার পথ রয়েছে কিন্তু সেসব পথ যেমন সরু তেমন আঁকাবাঁকা। এ জন্য যেসব প্রতিবেশী রাজ্য এ দেশ আক্রমণ করে পদানত করার চেষ্টা করেছে তারা কেউ এ যাবৎ সফল হয়নি। রাজ্যের রাজধানী পশ্চিম দিকে গড়ে তোলা হয়েছে ও একটি বড় নদী পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। নগরীটি উত্তর-দক্ষিণে ১২ বা ১৩ লি, পূর্ব-পশ্চিমে ৪ বা ৫ লি।

খাদ্যশস্য ফলানোর দিক থেকে এখানকার জমি বেশ উপযোগী। ফল ও ফুলে দেশটি ভরা। ড্রাগন-হর্স (dragon-horses), সুগন্ধি হলুদ (জাফরান?), ফো- চী (Fo-Chi) ও নানারকম ওষধি গাছ-গাছড়াও এখানে জন্মায়।

আবহাওয়া শীতল ও রুক্ষ। তুষারপাতের মাত্রা বেশি। বাতাস বা ঝড়ও খুব কম। লোকেরা চামড়ার আঁটোসাঁটো জামা ও সাদা কাপড়ে তৈরী পোষাক পরে। তাদের চেহারা পাতলা, স্বভাবের দিক থেকে লঘুচিত্ত, দুর্বল ও ভীরু প্রকৃতির। দেশটি যেহেতু একটি নাগের দ্বারা রক্ষিত তাই এরা এই অঞ্চলের রাজ্যগুলির মধ্যে সব থেকে বেশি প্রাধান্যের পরিচয় দিয়ে এসেছে। লোকদের দেখতে বেশ সদাশয় হলেও ধূর্তামির দিকে বিশেষ প্রবণতা রয়েছে। জ্ঞানচর্চার দিকে তাদের বেশ আগ্রহ রয়েছে। ভালো শিক্ষাও লাভ করে। তাদের মধ্যে অন্য-ধর্মী ও বৌদ্ধধর্মী দুই-ই ছড়িয়ে আছে।

এখানে ১০০টির মতো সংঘারাম ও পাঁচ হাজারের মতো ভিক্ষু আছেন। অশোক রাজার তৈরী চারটি স্তূপ আছে এখানে। এর প্রত্যেকটিতে ২০ আউন্সের মতো তথাগতের দেহাবশেষ রক্ষিত আছে। দেশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজ্যটি আগে একটি বিশাল নাগ-হ্রদ ছিল। পুরাকালে বুদ্ধ যখন এক দুষ্ট প্রকৃতির দানবকে বশ করে মধ্য-ভারতে ফিরছিলেন তখন এই দেশের উপর দিয়ে আকাশ পথে যাবার সময়ে আনন্দকে বলেন— “আমার নির্বাণ লাভের পর অর্হৎ মধ্যান্তিক এখানে একটি দেশের দেখা পাবে, তাদের সংযত করবে ও নিজের চেষ্টায় আমার ধর্মবাণী প্রচার করবে।”

বুদ্ধের নির্বাণ লাভের পঞ্চাশ বছর পর আনন্দের শিষ্য অর্থৎ মধ্যান্তিক ষড় ঐশ্বর্য ও অষ্ট-বিমোক্ষ লাভের পর এই ভবিষ্যৎবাণীর কথা শোনেন। তিনি তখন এই রাজ্যের দিকে আসেন ও একটি উঁচু পাহাড়ে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে তিনি তাঁর পরমার্থিক শক্তিবলে হ্রদস্থ নাগকে বিমোহিত করেন। নগরাজ জানতে চাইলো তিনি এখানে কী চান। অর্থৎ তাঁর কাছে হ্রদে পা রাখার মতো একটুখানি জায়গা চাইলেন। নাগরাজ জল সরিয়ে নিয়ে তাঁর জন্য একটু জায়গা করে দিল। অর্হৎ তাঁর দৈব ক্ষমতা বলে বিরাট শরীর ধারণ করলেন। তাঁর পা রাখার মত জায়গা করে দিতে গিয়ে নাগরাজকে হ্রদের সব জল সরিয়ে নিতে হলো। নাগরাজ তখন নিজের জন্য অহতের কাছে আশ্রয়স্থান প্রার্থনা করলো। অর্থৎ ১০০ লি মতো দূরে একটি ছোট হ্রদে তাকে ও তার বংশধরদের বাস করতে বললেন। নাগরাজ তারপর তার পূজা করতে চাইলেন। কিন্তু নির্বাণ লাভের পূর্বে এরূপ অনুমতি দেয়া সম্ভব নয় বলে মধ্যান্তিক নিজের অক্ষমতার কথা জানালেন। নাগরাজ তখন প্রার্থনা জানাল “তাহলে আমি যেন এই ধর্মমত যতদিন লোপ না পায় ততদিন ৫০০ অর্থৎকে পূজা করতে পারি ও এই ধর্ম লোপ পাবার পর আবার এই হ্রদে ফিরে আসতে পারি।” মধ্যান্তিক তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন।

আপনার দৈবক্ষমতা বলে এই জমি লাভ করে অর্হৎ মধ্যান্তিক সেখানে পাঁচশটি সংঘারাম স্থাপন করেন। তারপর যাতে ভিক্ষুকের সেবাযত্ন করতে পারে সেজন্য চারপাশের দেশ থেকে কিছু গরীব লোক কিনে আনার ব্যবস্থা করলেন। মধ্যান্তিক মারা যাবার পর এই গরীব লোকেরা প্রতিবেশী দেশগুলির উপর নিজেরা রাজা হয়ে বসলো। চারিদিকের অন্য সব রাজ্যের লোকেরা এদের নিচজাতীয় লোক বলে, ঘৃণা করে, এদের সঙ্গে মেলামেশা করে না ও এদের কৃতীয় বলে ডাকে। এই হ্রদটি আবার প্রকটিত হতে আরম্ভ করেছে।

তথাগত নির্বাণ লাভ করার একশো বছর পরে অশোক মগধের রাজা হয়ে পৃথিবীময় তাঁর আধিপত্য বিস্তার করলেন। এমনকি অতি দূরান্তের লোকও তাঁকে শ্রদ্ধা করতো। তিনি ত্রি-রত্নকে গভীর ভাবে সম্মান করতেন। এছাড়া সকল জীবন্ত প্রাণীর প্রতি তাঁর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। তিনি এখানে অহৎদের জন্য ৫০০টি সংঘারাম বানান ও এদেশটি ভিক্ষুদের জন্য দান করেন।

তথাগত নির্বাণ লাভের চারশো বছর পর গান্ধাররাজ কণিষ্ক অতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। একেবারে প্রান্তিক প্রদেশগুলিকেও তিনি তাঁর অধীনে আনেন। রাজকার্যের ফাঁকে তিনি প্রায়ই বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থাদি নিয়ে আলোচনা করতেন। ধর্ম ব্যাখ্যানের জন্য ভিক্ষুদের নিজ প্রাসাদে ডাকতেন। কিন্তু (বৌদ্ধ ধর্মানুগামীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মতবাদ মধ্যে বিরোধিতা লক্ষ্য করে তাঁর মনে সংশয় দেখা দেয়। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন পথও ছিল না। এই সময়ে শ্রদ্ধেয় পার্শ্বিক তাঁকে বললেন— “বুদ্ধদেব পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পর বহুকাল অতীত হয়েছে। প্রত্যেক গোষ্ঠীই তাদের একাধিক আচার্যের নীতি-নির্দেশের অনুগামী। প্রত্যেকে শুধু নিজ নিজ মতবাদকে আঁকড়ে পড়ে রয়েছে আর এর ফলে ঐক্য বিনষ্ট হয়ে সকলে বহু-বিভক্ত হয়ে পড়েছে।”

রাজা একথা শুনে খুব ব্যথিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন। তারপর পার্শ্বিকের কাছে বুদ্ধদেবের মতবাদকে অবিকৃতভাবে পরপুরুষের জন্য রেখে যাবার বাসনা থেকে ত্রিপিটককে বিভিন্ন শাখানুসারে সংকলন ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। পার্শ্বিক রাজার ইচ্ছাকে আগ্রহের সঙ্গে সমর্থন জানালেন।

রাজা কণিষ্ক তখন কাছের ও দূরের সমস্ত দেশ থেকে (জ্ঞানী ও আচার্যদের) এক পবিত্র সম্মেলন আহ্বান করলেন।

সম্মিলিত ব্যক্তিদের মধ্যে বাছাই করে যারা ত্রি-পিটক ও পঞ্চবিদ্যায় সুপটু এরকম ৪০০ জনকে নির্বাচিত করা হল। এর পর এ দেশের হিমেল ও রুক্ষ আবহাওয়ার দরুণ কষ্টভোগ হেতু রাজা নিজের দেশে ফিরে যেতে চাইলেন। তাছাড়া, কাশ্যপ যেখানে ধর্ম-সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন রাজগৃহের সেই পর্বত গুহাটিও তাঁর দেখার ইচ্ছা দেখা দিল। শ্রদ্ধেয় পার্শ্ব ও অন্য সকলে তখন তাঁকে বললেন— “আমাদের সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। সেখানে অনেক বিধর্মী পণ্ডিত রয়েছে। বিভিন্ন শাস্ত্র পর্যালোচনা করতে গেলে শুধু বাদ-বিবাদ ও বৃথা তর্ক দেখা দেবে। যথেষ্ট সময় নিয়ে সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে নতুন গ্রন্থ সংকলিত না হলে তা থেকে কোন সুফল বা পাওয়া যাবে? সম্মেলনের সকলেরই এ দেশ পছন্দ। পর্বতমালা দ্বারা দেশটি ভালভাবে সুরক্ষিত। যক্ষেরা এর সীমান্ত রক্ষা করে চলেছে। জমি উর্বরা ও সুফলা আর খাদ্যও বেশ প্রয়োজন মতো রয়েছে। সাধু ও ঋষিরা এখানে সমবেত হন, বাস করেন। দেবর্ষিরাও এখানে বিচরণ ও বিশ্রাম করেন। রাজা তখন তাঁর মত পরিবর্তন করলেন।

সম্মেলনের সকলে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত প্রকাশ করলেন যে তারা রাজার অভিলাষকে বাস্তবে রূপায়িত করতে প্রস্তত। রাজা তখন সম্মেলনের স্থান থেকে অহগণকে নিয়ে আর এক স্থানে গেলেন। সেখানে একটি বিহার স্থাপন করলেন। যাতে সবাই সেখানে সম্মিলিত হয়ে (আলাপ আলোচনা করে) শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করতে পারেন ও বিভাষা শাস্ত্র রচনা করতে পারেন সে জন্যই এই ব্যবস্থা।

বসুমিত্রকে সভাপতি করে এই পাঁচশত সাধু ও ঋষি প্রথমে সূত্র পিটক ব্যাখ্যার জন্য এক লক্ষ শ্লোক দিয়ে উপদেশ শাস্ত্র রচনা করলেন। তারপর বিনয় পিটক ব্যাখ্যার জন্য এক লক্ষ শ্লোকে বিনয় বিভাষা শাস্ত্র রচনা করা হলো। পরে অভিধর্ম পিটক ব্যাখ্যার জন্য এক লক্ষ শ্লোকে অভিধর্ম-বিভাষা শাস্ত্র সংকলিত হলো।

কণিষ্ক রাজা এগুলিকে লাল তামার পাতে খোদাই করালেন। তারপর একটি পাথরের কুঠুরীতে সেগুলি রেখে দিয়ে তাকে ঘিরে একটি স্তূপ বানালেন।

এই মহৎ কাজ শেষ হবার পর সৈন্যসহ তিনি রাজধানীতে ফিরে যাবার উদ্যোগ করলেন। পশ্চিমের ফটক দিয়ে এ দেশের বাইরে বেরিয়ে পূর্বমুখী হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আবার এই পুরো দেশটিকে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দান করলেন।

কণিষ্কের মৃত্যুর পর কৃতীয় জাতীর লোকেরা আবার রাজ্য দখল করলো। ভিক্ষুদের তাড়িয়ে বৌদ্ধধর্মকে উৎখাত করলো।

তুষার দেশের হিমতাল রাজ্যের রাজা শাক্য-বংশীয় ছিলেন। বুদ্ধের নির্বাণের পর ষষ্ঠ শতাব্দীতে তিনি তার পূর্ব-পুরুষদের রাজ্য লাভ করেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের গভীর অনুরাগী ছিলেন। কৃতীয়গণ এদেশ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের উচ্ছেদ করেছে শুনে তিনি ৩০০০ বাছাই যোদ্ধাকে নিয়ে বণিকের ছদ্মবেশে কাশ্মীরে প্রবেশ করেন ও কৃতীয় রাজাকে হত্যা করে এ দেশ অধিকার করেন। তারপর একটি সংঘারাম তৈরী করে তিনি ভিক্ষুদের ফিরিয়ে আনলেন। আবার আগের মতো তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন। তিনিও পশ্চিমের দ্বার দিয়ে এ রাজ্য ত্যাগ করেন ও বাইরে এসে পূর্বমুখী হয়ে রাজ্যটিকে পুনরায় ভিক্ষুদের জন্য দান করেন।

বার বার ভিক্ষুদের দ্বারা তাদের অধিকার ধর্মমত প্রতিহত হবার দরুণ কৃতীয়রা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ ঘৃণা ও বিরূপতা পোষণ করতে শুরু করে। কিছুকাল পরে আবার তারা ক্ষমতায় এলো। এই কারণে এ রাজ্যের লোকেরা বর্তমানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তেমন অনুরক্ত নয়। বিধর্মী মন্দিরগুলিই তাদের চিন্ত াধারাকে অবিষ্ট করে রেখেছে।

নতুন শহর থেকে দশ লি দক্ষিণ-পূর্বে, আর পুরানো শহর থেকে উত্তরে, একটি বড় পর্বতের দক্ষিণভাগে একটি সংঘারাম রয়েছে। এখানে তিনশো জনের মতো ভিক্ষু থাকেন। এ স্তূপটিতে বুদ্ধের একটি দাঁত রক্ষিত আছে। এটি লম্বায় প্রায় দেড় ইঞ্চি, রঙ হলদেটে সাদা।

এ সংঘারামটি থেকে ১৪ বা ১৫ লি দূরে, দক্ষিণ দিকে, আরেকটি ছোট সংঘারাম আছে। এখানে অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের একটি দাঁড়ানো মূৰ্তি আছে।

ছোট সংঘারামটি ছাড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্বে ৩০ লি মতো এলে একটি বড় পর্বতের দেখা মেলে। এখানে একটি পুরানো সংঘারাম আছে। এটির গঠন-শৈলী দেখার মতো। বেশ মজবুত করে তৈরী। এখন অবশ্য এটি ভাঙনের মুখে। মাত্র একটি দিক টিকে আছে। এই দিকটিতে একটি ছোট যমজ-তোরণ রয়েছে। এই সংঘারামে ৩০ জনের মতো ভিক্ষু আছেন। সকলেই মহাযানের অনুগামী। প্রাচীনকালে এখানে বসেই শাস্ত্রকার সংঘভদ্র ন্যায়ানুসার শাস্ত্র রচনা করেন। সংঘারামের ডাইনে ও বাঁয়ে অনেকগুলি স্তূপ দেখা গেল। এখানে মহান অর্থদের দেহাবশেষ রাখা আছে।

যে সংঘারামটিতে বুদ্ধের দাঁত রয়েছে সেখান থেকে ১০ লি মতো পূর্বদিকে গেলে উত্তর দিককার একটি গিরিপথের মাঝে একটি ছোট সংঘারাম দেখা যাবে। পুরাকালে বিরাশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত স্কন্ধিল এখানে বিভাষা-প্রকরণপাদ শাস্ত্ৰ লেখেন।

এই সংঘারামটিতে একটি স্তূপ রয়েছে। পঞ্চাশ ফুটের কাছাকাছি উঁচু। এখানে একজন অহতের দেহাবশেষ রাখা আছে।

রাজধানী থেকে দুশো লি মতো গেলে মাই-লিন (বিকৃত বন?) নামে একটি সংঘারামে এসে পৌঁছাই। শাস্ত্রবেত্তা পূর্ণ এখানে থেকে তার বিভাষা সূত্র-টীকা লেখেন।

শহরের পশ্চিমে ১৪০-৫০ লির মতো গেলে একটি বড় নদী পড়বে তার তীরে উত্তর দিকে, একটি পর্বতের ঢালু জায়গায় একটি সংঘারাম আছে। এটি মহা-সংঘিকা গোষ্ঠীর। প্রায় একশো জন ভিক্ষু থাকেন। আগের কালে শাস্ত্রবেত্তা বোধিল এখানে বসে তার ‘ৎসিহ-চিন-লুন’ (তত্ত্ব-সঞ্চয়-শাস্ত্র?) রচনা করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *