পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ

পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ

মহান চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ ৬০৩ খ্রীষ্টাব্দে হো-নান প্রদেশের চিন-লিউ-তে জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। অল্প বয়সেই তিনি মেজ ভাইয়ের সঙ্গে চীনের পূর্ব-রাজধানী লো-আঙ আসেন। ভাই ছিলেন ৎসিঙ-তু মন্দিরের ভিক্ষু। তের বছর বয়সে হিউয়েন সাঙও এই মন্দিরে উপাসক হলেন। সুই রাজবংশের পতনকালে যে পরিস্থিতি দেখা দেয় তার ফলে তিনি ও তাঁর ভাই ঝেচেওয়ান প্রদেশের রাজধানী শিঙ-তু-তে চলে আসেন। এখানে ২০ বছর বয়সে তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ ভিক্ষু রূপে উপসম্পদা লাভ করেন বা দীক্ষিত হন।

উপসম্পদা লাভের কিছুকাল পর থেকে তিনি চীনের বিভিন্ন প্রদেশে ভ্রমণ শুরু করেন। উদ্দেশ্য হলো দেশের শ্রেষ্ঠ আচার্যদের কাছে শিক্ষালাভ। ঘুরে ঘুরে শেষ অবধি চাঙ-অন এলেন। সেখানে ফা-হিয়েন ও চি-য়েন এর স্মৃতিকথা পড়ে ভারতে আসার জন্য উদীপ্ত হয়ে ওঠেন। এখানকার বৌদ্ধ ঋষিদের সংস্পর্শে এসে মনের যা কিছু প্রশ্ন ও সংশয় দূর করার গভীর বাসনা দেখা দেয়। এ সময়ে তাঁর বয়স ২৬ বছর।

৬২৯ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি চাঙ-অন থেকে ভারত অভিমুখে রওনা হলেন। সঙ্গে ছিলেন কান-সুহ প্রদেশের সিঙ-চান শহরের একজন ভিক্ষু। সেই শহরে পৌঁছে তিনি বিশ্রাম নিলেন। তারপর এগিয়ে চললেন লন-চাউ। এটি কান – সুহ প্রদেশের প্রধান শহর তখন। এখান থেকে তিনি এই প্রদেশের শাসনকর্তার একজন রক্ষীর সঙ্গে নদীর অপর পাড়ে থাকা লিয়াঙ-চাউ গেলেন। এ শহরটি তিব্বত ও সুঙ-লিঙ পর্বতমালার পূর্বদিকের দেশগুলি থেকে আসা বণিকদের মিলন কেন্দ্র ছিল। হিউয়েন এদের কাছে ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যা করলেন। জানালেন, ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ জানার জন্য তিনি ব্রাহ্মণদের দেশ ভারতবর্ষে যেতে চান। তাঁরা তাঁকে এজন্য খরচ যুগিয়ে দিলেন। শহরের শাসনকর্তা রাজনৈতিক কারণ থেকে তাঁকে যেতে বারণ করলেন। কিন্তু হিউয়েন দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ দেখে শেষ পর্যন্ত তাঁকে সরকারি অনুমতি না দিলেও পরোক্ষ সাহায্য দিলেন।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত দুজন ভিক্ষুর সহায়তায় তিনি পশ্চিম দিকে কাওয়া- চাউ এলেন। এ শহরটি সু-লু নদী থেকে প্রায় ১০ মাইল দক্ষিণে এবং সম্ভবত বুলানঘির। এখান থেকে এক যুবকের সঙ্গে তিনি উত্তর দিকে এগোতে থাকলেন। এই যুবকটি তাঁর পথ-দিশারী হবার জন্য এগিয়ে এসেছিল। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবতঃ হিউয়েনকে হত্যা করে তাঁর অর্থ লুটে নেয়া। হিউয়েন তার বিশ্বাসঘাতকতা এড়িয়ে একা একাই এখানকার সীমান্ত অঞ্চলে থাকা পাঁচটি প্রহরা ঘাঁটির প্রথমটির দিকে এগিয়ে চললেন। এখানে নানা বিপদের হাত থেকে একরকম অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়ে তিনি পাঁচটি ঘাঁটি পেরিয়ে সীমান্তের অপর দিকে ই-গু বা কামুল পৌঁছলেন। এখানে বিশ্রাম নেবার কালে স্থানীয় রাজা কাও- চাঙ (তুরফন) তাঁকে তাঁর রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলেন। তিনি হিউয়েনকে স্থায়ী ভাবে তাঁর রাজ্যে থাকার জন্য আটকে রাখতে চাইলেন। হিউয়েন রাজী হলেন না। নানাভাবে চেষ্টা করেও যখন রাজা দেখলেন, হিউয়েনকে আটকানো সম্ভব নয় তখন তিনি তাঁকে ও-কি-নি বা করসার যাবার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখান থেকে তিনি এলেন কুচে। কুচে থেকে বালুকা বা বই (অসু প্রদেশে)। এখান থেকে উত্তর দিকে তুষারাবৃত পর্বতমালা ডিঙিয়ে তিনি ৎসিঙ হ্রদের নিকটবর্তী সমতল ভূমিতে এসে হাজির হলেন (ইসাইককুল)।

এরপর ‘সু-য়েহ’ বা চু নদীর সুফলা উপত্যকা ধরে পথ হেঁটে তুরকীদের শহর ‘সু-য়েহ’তে। সেখান থেকে তরস, নুজকেন্দ ও তাসখন্দ। তারপর সুতৃষ্ণ, সমরকন্দ কেবুদ, কসনিয়া হয়ে বোখারায় এলেন।

বোখারা থেকে বেটিক, খোয়ারিজন, কেশ, তিরমেদ, চঘানিয়ান, গরসো, সুমান কুবাদিয়ান, ওয়াখশ, খোটল, কুমিধ, রোশান, বঘলান, পুই, সমনগান ও খুলম হয়ে হাজির হলেন বালখ-এ।

বালখ পিছনে রেখে তারপর তিনি এগোতে থাকলেন জুমধ, জুজগান, তালিকান, গচি, বামিয়ান ও কপিশার দিকে।

কপিশায় পৌঁছে সেখান থেকে এগিয়ে চললেন ‘লান-পো’ বা ভারতের উত্তর সীমান্তের লম্পকে। বোধ হয় ৬৩০ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সেখানে এসে প্রথম ভারতের মাটিতে পা রাখলেন।

আর তার ১৪ বছর পর ৬৪৪ খ্রীষ্টাব্দে ফ-ল-ন বা বরণ থেকে ভারতের বাইরে পা রাখেন ও এক বছর পর ৬৪৫-এ চীনের পশ্চিম রাজধানী শিঙ-ফুতে পৌঁছান।

চীনে ফিরে এসে তিনি প্রধানতঃ ভারত থেকে নিয়ে আসা বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্ৰ- বই অনুবাদের দিকে মন দেন। কম করেও ৭৫ খানি বই তিনি অনুবাদ করেন।

ভারত থেকে ফেরার পর চীনে তিনি যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা ও সম্মান লাভ করেন।

৬৬৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মারা যান। চীন সম্রাটের নির্দেশে প্রচুর জাঁকজমকের সঙ্গে তাঁকে পশ্চিম রাজধানী শিঙ-ফুতে সমাধিস্থ করা হয়। এর পাঁচ বছর পর ৬৬৯-এ তাঁর দেহাবশেষ সেখান থেকে সম্রাটের নির্দেশে ফন-চুয়েন উপত্যকার উত্তরে একটি জায়গায় সরিয়ে আনা হয় ও সেখানে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মারক-সৌধ গড়া হয়।

ভারত থেকে ফেরার সময়ে যে বিরাট পুঁথিভাণ্ডার ও মূর্তি ইত্যাদি তিনি সঙ্গে নিয়ে যান তার একটি তালিকা এখানে দেওয়া হলো—

১. বুদ্ধের দেহাস্থি-৫০০ গ্ৰেন।

২. স্বচ্ছ স্তম্ভের উপর থাকা একটি সোনার বুদ্ধমূর্তি।

৩. স্বচ্ছ স্তম্ভের উপর থাকা একটি চন্দন কাঠের বুদ্ধমূর্তি। এটি কৌশম্বীর রাজা উদয়নের তৈরী মূর্তির আদলে তৈরী।

৪. ওই ধরনের আর একটি চন্দন কাঠের বুদ্ধমূর্তি। ৩৩তম স্বর্গ বা ভূষিত স্বৰ্গ থেকে বুদ্ধের ফিরে আসার সময়কার আদলে তৈরী।

৫. স্বচ্ছ বেদীর উপর বসানো একটি রূপার তৈরী বুদ্ধমূর্তি।

৬. স্বচ্ছ বেদীর উপর বসানো একটি সোনার বুদ্ধমূর্তি।

৭. স্বচ্ছ বেদীর উপর বসানো একটি চন্দন কাঠের বুদ্ধমূর্তি।

৮. মহাযান শাখার ১২৪টি সূত্রের পুঁথি।

৯. ২২টি ঘোড়ার পিঠে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া ৫২০ বোঝা অন্যান্য শাস্ত্র বই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *