॥ ২০ ॥ সু-লো-কিন-ন: শ্ৰুঘ্ন
স্থানেশ্বর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ৪০০ লির মতো পথ চলে এবার শ্রুঘ্ন রাজ্যে আসা গেল।
এ দেশটির আয়তন ছ’হাজার লির মতো। পূর্ব সীমানা বরাবর গঙ্গা নদী বয়ে চলেছে। উত্তর সীমানায় বিরাট বিরাট পাহাড়মালার পাঁচিল। যমুনা নদী দেশের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। রাজধানীর পরিধি ২০ লির কাছাকাছি। তার পূর্ব সীমানা যমুনা নদীর উপকূল। নগরটির ভিত এখনো বেশ মজবুত কিন্তু তবুও পুরোপুরি জন-মানব বর্জিত।
ফসল ও আবহাওয়ার দিক থেকে স্থানেশ্বরের সঙ্গে এখানকার মিল রয়েছে। লোকজনের ব্যবহার আন্তরিক, স্বভাব সত্যনিষ্ঠ। তারা অন্য-ধর্মের অনুরাগী। তাকে তারা গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে। জ্ঞানচর্চার উদ্যমকে বিশেষ প্রশংসার চোখে দেখে। তবে ধর্মীয় তত্ত্ব-জ্ঞানের দিকেই অনুরাগ বেশী।
এখানে পাঁচটি সংঘারাম আছে। তাতে এক হাজার জনের মতো ভিক্ষু থাকেন। তাঁদের বেশির ভাগই হীনযানের অনুগামী। সামান্য কিছু অন্য মতধারার উপাসক। তাঁরা সুষ্ঠু ভাষায় বক্তৃতা ও আলোচনা করেন। স্বচ্ছ আলোচনায় গভীর সত্যকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলেন। বিভিন্ন অঞ্চলের বিশিষ্ট জ্ঞানীগুণীরা তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে নিজেদের সন্দেহ দূর করার জন্য আসেন এখানে।
দেবমন্দিরের সংখ্যা একশোটি। সেখানে অগণিত বিধর্মী উপাসক।
রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, যমুনা নদীর পশ্চিমে একটি সংঘারাম রয়েছে। এটির পূর্বদিকের ফটকের বাইরে অশোক রাজার বানানো একটি স্তূপ দেখলাম। এর কাছে আরো অনেকগুলি স্তূপ রয়েছে। তাতে বুদ্ধদেব এবং সারিপুত্র, মৌদগলায়ন প্রভৃতি অঙ্গণের চুল ও নখকণা ইত্যাদি বর্তমান।
তথাগত নির্বাণ লাভের পর এ দেশ বিধর্মী-শিক্ষার পীঠভূমি হয়ে উঠেছিল। সত্য ধর্মের প্রতি অনুরক্তদের মিথ্যা ধর্মমতের অনুগামী করে তোলা হয়। এখানকার সংঘারামগুলিতে বিভিন্ন দেশ থেকে সে সময় (বৌদ্ধ) শাস্ত্রজ্ঞরা আসতেন। বিধর্মী ও ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তারা বিতর্কে অবতীর্ণ হতেন। এ জন্যেই এই সংঘারামগুলি এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
যমুনার পূর্বদিকে প্রায় ৮০০ লি গেলে গঙ্গা নদীর দেখা পাওয়া যাবে। নদীর প্রবাহ এখানে তিন থেকে চার লি চওড়া। দক্ষিণ-পূর্বদিকে বয়ে চলেছে। যেখানে সাগরের সঙ্গে গিয়ে মিশেছে সেখানে দশ লি বা তারও বেশি চওড়া হবে। নদীটির জল সাগরের মতো নীলাভ। তরঙ্গ প্রবাহও সাগর তরঙ্গের মতো দীঘল। জলে অগুণতি আঁশালো দৈত্য (মৎস্য-দানব) রয়েছে। কিন্তু তারা মানুষের কোন ক্ষতি করে না। জল বেশ মিষ্টি ও তৃপ্তিদায়ক। নদীর দুপার সূক্ষ্ম বালুকণায় ভরাট। এ দেশের চলিত ইতিহাসে এ নদীকে মহাভদ্রা বলা হয়-কেননা, সে অসংখ্য পাপ ধুয়ে মুছে দিতে পারে। যারা জীবনের উপর বিতৃষ্ণ তারা যদি এর কোলে জীবন বিসর্জন করে তবে স্বর্গে জন্ম নিয়ে সুখভোগ করে। লোকেরা মারা গেলে তাদের অস্থি এখানে যদি বিসর্জন দেয়া হয় তবে তারা আর নরকগামী হয় না।
॥ ২১ ॥ মতিপুর (মান্দোর)
গঙ্গানদী পার হয়ে পূর্ব মুখে চলে এবার মতিপুর এলাম।
এ রাজ্যটি আয়তনের দিক থেকে ৬০০০ লির কাছাকাছি। রাজধানী ২০ লির মতো। জমিন খাদ্য-শস্য আবাদের উপযোগী। নানা রকম ফুল, নানা জাতের ফলে ভরপুর। আবহাওয়া স্নিগ্ধ ও কোমল। অধিবাসীরা আন্তরিকতাপূর্ণ ও সত্যনিষ্ঠ। জ্ঞান চর্চ্চাকে বিশেষভাবে সম্মান দেয়। তন্ত্র-মন্ত্র ও ভোজবাজীর প্রয়োগে খুব দক্ষ। বুদ্ধের অনুরাগী ও বিপরীত মার্গীদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান।
রাজা শূদ্রবর্ণের লোক। তিনি বুদ্ধের অনুগামী নন। দেবতাদের ভক্তি ও পূজা করেন। এখানে কুড়িটির মতো সংঘারাম। ভিক্ষু সেখানে আটশোর কাছাকাছি। তাদের বেশীরভাগই হীনযানের চর্চ্চা করে ও স্থবির শাখার অনুগামী। পঞ্চাশটির মতো দেবমন্দির আছে। বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের অনুগামীরা সেখানে নির্বিচারে বাস করে।
রাজধানীর দক্ষিণ দিকে ৪ বা ৫ লি মতো গেলে একটি ছোট সংঘারাম চোখে পড়ে। এখানে পঞ্চাশ জনের কাছাকাছি ভিক্ষু থাকেন। অতীতে শাস্ত্রজ্ঞ গুণপ্রভ এখানে ‘পিনচিন’ ও আরো একশোখানির মতো গ্রন্থ রচনা করেন। অল্প বয়সেই তিনি শাস্ত্রজ্ঞরূপে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। পরিণত বয়সে বিদ্যাবত্তা ও জ্ঞানের দিক থেকে তাঁর সমকক্ষ ছিল না কেউ। মানবিক শাস্ত্রে তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন; তাঁর প্রখর উপলব্ধি ক্ষমতা ও জ্ঞান ছিল। অতি বিখ্যাত হয়েছিলেন তিনি। মহাযানের চর্চ্চা দিয়ে তিনি জীবন শুরু করেন। কিন্তু তার গভীর তত্ত্বধারার সঙ্গে পরিচিত হবার আগেই তিনি বিভাষা শাস্ত্র অধ্যয়নের সুযোগ পান। এরপর মহাযান থেকে তিনি তার মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে হীনযানের চর্চায় ডুবে যান। মহাযানকে নির্মূল করার জন্য অনেকগুলি বই লেখেন ও এভাবে হীনযানের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া, অতীতের বিভিন্ন নামকরা আচার্যদের লেখার সমালোচনা ও বিরুদ্ধতা করেও তিনি অনেকগুলি গ্রন্থ লেখেন। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থগুলি যদিও তিনি ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন তবুও হীনযান শাখার অনুগামী হওয়ার দরুন তার সবগুলি তত্ত্বকে ভেদ করতে পারেননি।
গুণপ্রভ যেখানে বাস করতেন সেই সংঘারামটির উত্তর দিকে তিন থেকে চার লি দূরে একটি বড় সংঘারাম রয়েছে। এটিতে দুশো জনের মতো ভিক্ষু থাকেন। এরা হীনযানের অনুগামী। শাস্ত্রজ্ঞ সংঘভদ্র এখানে মারা যান। তিনি কাশ্মীরের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর বিরাট যোগ্যতা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। অল্প বয়সেই তিনি অনন্য পণ্ডিত হয়ে ওঠেন এবং সর্বাস্তিবাদ শাখার সমস্ত বিভাষা শাস্ত্রের উপর দখল লাভ করেন।
এই সময় বসুবন্ধু বোধিসত্ত্ব জীবিত ছিলেন। যে সব বিষয়ের ব্যাখ্যাদান ভাষার অতীত, তাকে তিনি গভীর সাধনার সাহায্যে ব্যাখ্যার প্রচেষ্টায় মগ্ন ছিলেন। বিভাষক শাখার আচার্যদের মতবাদকে উড়িয়ে দেবার জন্য তিনি অভিধর্মকোষ শাস্ত্র রচনা করেন। তার রচনাশৈলী স্বচ্ছ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত ছিল। যুক্তিবিস্তার ছিল খুব সূক্ষ্ম ও উঁচু দরের।
সংঘভদ্র বসুবন্ধুর লেখাগুলি পড়ে, একটানা ১২ বছর ধরে অতি গভীর গবেষণা চালিয়ে তার কোষকারকা শাস্ত্র রচনা করেন। এতে আট লক্ষ শব্দের পঁচিশ হাজার শ্লোক রয়েছে। পরে বসুবন্ধু এটির নাম পরিবর্তন করে ন্যায়ানুসার শাস্ত্র রাখেন।
সংঘভদ্র মারা গেলে তাকে দাহ করা হয় ও অস্থি সংগ্রহ করে সংঘারামের একটি স্তূপে রাখা হয়। সংঘারাম থেকে ২০০ পা-এর মতো উত্তর-পশ্চিমদিকে একটি আমরনে এখনো সে স্তূপটি রয়েছে।
আমবনের পাশে একটি স্তূপে শাস্ত্রজ্ঞ বিমলমিত্রের দেহাবশেষ রাখা আছে। ইনি কাশ্মীরের লোক ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মানুগামী হয়ে তিনি সর্বাস্তিবাদী শাখার উপাসক হন।
এ দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে, গঙ্গা নদীর পূর্ব-কূলে মো-উ-লো বা মায়াপুর (বর্তমান হরিদ্বার) নামে একটি শহর আছে। এটির আয়তন ২০ লির মতো। জনসংখ্যা খুব বেশী। নদীর পবিত্র প্রবাহ এই শহরটির সব দিক দিয়ে বয়ে গেছে। এখানে দেশী তামা, নিখুঁত স্ফটিক মেলে। নানা রকম মূল্যবান পাত্র তৈরী হয়।
শহর থেকে একটুখানি দূরে গঙ্গার তীরে একটি বিরাট দেবমন্দির আছে। এটির মাঝখানে একটি জলাধার রয়েছে। অতি দক্ষভাবে পাথর জোড়া দিয়ে তার পাড়গুলি বাঁধানো। একটি কাটা খালের সাহায্যে এর মধ্য দিয়ে গঙ্গার জল প্রবাহিত করা হয়েছে। সারা ভারতের লোক একে ‘গঙ্গা নদীর দ্বার’ নাম দিয়েছে। এটি পুণ্য অর্জনের ও পাপ বিমোচনের ক্ষেত্র। নানা দূর দূরান্ত থেকে শত সহস্র লোক সব সময় এখানে আসে ও এর জলে স্নান করে। সদাশয় রাজা এখানে একটি ‘পুণ্যশালা’ বানিয়ে দিয়েছেন। বিধবা ও অসহায়, অনাথ ও পরিত্যক্তদের ভাল খাদ্য ও ওষুধপত্র দেবার জন্য এই সংস্থাকে অর্থ-বরাদ্দ করা হয়েছে।
॥ ২২ ॥ পো-লু-হিন-মো-পু-লো: ব্রহ্মপুর
এবার উত্তর দিকে যাত্রা করে তিনশো লির মতো পথ চলে ব্রহ্মপুর এসে পৌঁছলাম।
এ রাজ্যটির আয়তন ৪০০০ লির মতো। সবদিক পর্বত দিয়ে ঘেরা। প্রধান নগরীর ঘের ২০ লির কাছাকাছি। বেশ ঘন বসতিপূর্ণ শহর। পরিবারগুলিও দেখলাম ধনী।
এখানকার জমি সরস ও উর্বরা। ঋতু অনুসারে যথারীতি চাষ-আবাদ করা হয়। এখানে দেশী তামা ও স্ফটিক পাথর মেলে। আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে কিছুটা ঠাণ্ডা। লোকেরা পরিশ্রমী, কিন্তু কৃষ্টিবিহীন। খুব কম লোকই লেখাপড়া বা জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী। বেশির ভাগ মানুষই ব্যবসা-বাণিজ্য মধ্যে ডুবে রয়েছে।
লোকদের স্বভাব-চরিত্র কিছুটা বর্বর ধরনের। বুদ্ধের অনুগামী ও বিপরীতমার্গী দুই-ই এখানে রয়েছে। পাঁচটি সংঘারাম আছে। কিন্তু তাতে অল্প কতক ভিক্ষু থাকেন। দশটি দেবমন্দির। সেখানে বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোক মিলেমিশে বাস করে।
এ দেশটির উত্তর সীমা তুষারাবৃত বিরাট পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা। এই পর্বতমালার মাঝে সুবর্ণগোত্র দেশ। এদেশ থেকে উৎকৃষ্টমানের সোনা পাওয়া যায়। এজন্যই দেশটির এরকম নাম। দেশটি পূর্ব-পশ্চিমে দীঘল, উত্তর-দক্ষিণে সংকীর্ণ। এটিই হলো সেই ‘প্রাচ্য রমণীদের’ দেশ। বহুকাল ধরে রমণীই এর শাসক। এজন্য একে ‘রমণীরাজ্য’ বা ‘প্রমীলা রাজ্য’ বলা হয়। রাজত্বকারী রমণীর স্বামীকে রাজা বলা হয়। তবে রাজ্যের ব্যাপার-স্যাপার তিনি কিছুই জানেন না। পুরুষেরা যুদ্ধবিগ্রহের দায়িত্ব পালন করে, চাষ-আবাদের কাজ করে—শুধু এই যা। এরাজ্যে শীতকালীন গম হয়। প্রচুর গোরু, ভেড়া ও ঘোড়া রয়েছে। জলবায়ু অতি হিমেল। অধিবাসীরা তড়বড়ে ও একরোখা ধরনের।
এ দেশের পূর্ব সীমানা ফন রাজ্য (তিব্বত) দ্বারা ঘেরা। পশ্চিম সীমানা ‘সন- পো-হো’ (সম্পহ?) ও উত্তর সীমানা খোটান রাজ্য দ্বারা ঘেরা।
॥ ২৩ ॥ কিউ-পি-শওঙ-ন: গোবিসান
গোবিসান রাজ্যটি আয়তনের দিক থেকে দু’হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানী ১৪ থেকে ১৫ লি। এবড়ো খেবড়ো খাড়াই পাহাড় পর্বত-এর চারিদিক ঘিরে থাকার দরুন প্রাকৃতিকভাবেই রাজ্যটি বেশ সুরক্ষিত। জনসংখ্যা বিপুল। যেদিকে চোখ ফেরানো যায় শুধু ফুল আর ফুল, ফল বাগান ও হ্রদ। এরা একের পর আর যেন সার সার ছড়িয়ে আছে। এখানকার জলবায়ু ও উৎপন্ন ফসল মতিপুরের মতোই। লোকজনের আচার-ব্যবহার নিখুঁত ও স্বভাব চরিত্র সৎ। জ্ঞানের চর্চ্চা করতে তারা ভালবাসে, সৎ কাজের দিকে সব সময়ে মনোযোগী। বিধর্মীদের অনেক অনুগামী রয়েছে এখানে। তারা একমাত্র ঐহিক সুখই খোঁজে।
এরাজ্যে দুটি সংঘারাম রয়েছে। ভিক্ষু রয়েছেন সেখানে একশো জনের মতো। প্রায় সকলেই হীনযানের উপাসক। তিরিশটির মতন দেবমন্দির আছে। এগুলি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের। তারা সেখানে নির্বিচারে মেলামেশা ও বসবাস করে।
প্রধান শহরের পাশে একটি পুরানো সংঘারাম আছে। সেখানে রাজা অশোকের বানানো একটি স্তূপ দেখলাম; প্রায় দুশো ফুটের মতো উঁচু। পাশেই দুটি ছোট স্তূপ। সেখানে তথাগতের চুল ও নখকণা রয়েছে। এ দুটি দশফুটের মত উঁচু।
॥ ২৪ ॥ ও-হি-ছি-ত-লো: অহিক্ষেত্র
গোবিসান থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ৪০০ লি মতো পথ চলার পর অহিক্ষেত্র (অহিচ্ছত্র) রাজ্যে এসে উপস্থিত হলাম।
এ দেশটির আয়তন তিন হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানীর আয়তন সতেরো বা আঠারো লি। খাড়া পাহাড়শ্রেণী দিয়ে চারিদিক ঘেরা থাকার দরুন রাজ্যটি প্রাকৃতিক ভাবেই সুরক্ষিত। এখানে গমের চাষ হয়। অনেক বনানী ও হ্রদ রয়েছে। আবহাওয়া বেশ স্নিগ্ধ ও মনোরম। অধিবাসীরা আন্তরিকতায় ভরা, সত্যানুরাগী। তারা ধর্মপরায়ণ ও জ্ঞানচর্চ্চার দিকে মনোযোগী। চালাক-চতুর এবং যথেষ্ট খোঁজখবরও রাখেন।
এখানে দশটির মতো সংঘারাম আছে। সেখানে এক হাজারের কাছাকাছি ভিক্ষু থাকেন। তারা সম্মতীয় শাখার হীনযান উপাসক।
নয়টির মতো দেবমন্দির দেখা যায়। তাতে তিনশো জনের মতো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিধর্মী অনুগামীরা থাকেন। তারা ঈশ্বরের নিকট বলিদান করেন ও পাশুপতমার্গী।
প্রধান শহরের বাইরে একটি নাগ-পুষ্করিণী আছে। এর পাশে অশোক রাজার বানানো একটি স্তূপ দেখা যায়। পাশে আরো চারটি স্তূপ। এগুলিতে বিগত চার বুদ্ধের উপবেশন ও চলাফেরার চিহ্ন বৰ্তমান।
॥ ২৫ ॥ পি-লো-শান-ন: বীরসান
অহিক্ষেত্র থেকে এবার দক্ষিণ দিকে চলতে সুরু করলাম। তারপর পার হলাম গঙ্গা নদী। এপারে এসে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে ‘পি-লো-শান-ন’ বা বীরসা এসে পৌঁছলাম। এজন্য পথ ভাঙতে হলো আমাদের প্রায় ২৬০ থেকে ২৭০ লির মতন।
এ দেশটি আয়তনে দু’হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানীর পরিধি ১০ লির মতো। আবহাওয়া ও ফসলাদি অহিক্ষেত্রের মতোই। লোকজনের স্বভাব উগ্র ও রগচটা। জ্ঞান-চর্চ্চা ও শিল্পকলা চর্চ্চার প্রবণতা রয়েছে। এরা মুখ্যভাবে বিপরীত- মার্গীদের অনুগামী। বুদ্ধদেবের ধর্মমতে বিশ্বাসীদের সংখ্যা খুবই অল্প।
এখানে দুটি সংঘারাম আছে। তাতে ৩০০ জনের মতো ভিক্ষু দেখলাম। সকলেই মহাযান মতবাদের অনুগামী। পাঁচটি দেবমন্দির রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুগামীরা সেখানে থাকেন।
প্রধান নগরীর মাঝখানে যে সংঘারামটি রয়েছে সেটি বেশ পুরোনো। সেখানে অশোক রাজার তৈরী স্তূপও দেখলাম। স্তূপটির ভাঙন আরম্ভ হয়ে গেছে তবু এখনো ১০০ ফুটের বেশি উঁচু। তথাগত বুদ্ধ এখানে সাত দিন অবস্থান করেছিলেন। ওই সময়ে তিনি স্কন্দ-ধাতু উপস্থান সূত্র ব্যাখ্যা করেন। এর পাশে বিগত চার বুদ্ধের উপবেশন ও বিচরণের চিহ্ন বর্তমান।
॥ ২৬ ॥ কিএ-পি-থ: কপি
‘পি-লো-শান-ন’ থেকে এবার দক্ষিণ-পূর্বদিকে চলতে শুরু করলাম। প্রায় দুশো লি পার হয়ে ‘কিএ-পি-থ’ বা কপিত্থ রাজ্যে এসে পৌঁছলাম।
এদেশটির আয়তন দু হাজার লির মতন। রাজধানীর পরিধি প্রায় ২০ লি জলবায়ু ও চাষ আবাদের দিক থেকে ‘পি-লো-শান-ন’র মতোই। লোকদের আচার ব্যবহার কোমল ও সুন্দর। জ্ঞান-অর্জনের দিকে বিশেষ প্রবণতা রয়েছে।
চারটি সংঘারাম আছে এখানে। তাতে একশোজনের মতো ভিক্ষু থাকেন। সকলেই হীনযান শাখার সম্মতীয় উপশাখার অনুগামী। দশটি দেবমন্দির আছে। সেখানে সব রকম সম্প্রদায়ের অনুগামীরা থাকেন। তাঁরা সকলেই মহেশ্বরকে ভক্তি ও পূজা করেন।
নগরীর পূর্ব দিকে ২০ লি মতো গেলে একটি বড় সংঘারাম চোখে পড়ে। এটির গঠনশৈলী চমৎকার। শিল্পী এর সর্বত্র তাঁর সর্বোচ্চ নৈপুণ্যের নিদর্শন রেখেছেন। পরম পুরুষের পবিত্র মূর্তিটিও অভাবনীয় রকমের অনুপম। এখানে একশো জনের মতো ভিক্ষু দেখলাম। সকলেই সম্মতীয় উপশাখার উপাসক। কয়েক অযুত পবিত্র লোক (বুদ্ধের অনুগামী) এই সংঘারামের কাছে বসবাস করেন।
সংঘারামের বিরাট সীমানার মধ্যে পূর্বমুখী হয়ে তিনটি অমূল্য সিঁড়ি আছে। তিনটি সিঁড়ি পর পর উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সাজানো। তেত্রিশতম স্বর্গ থেকে ফিরে আসার সময় তথাগত বুদ্ধ এখানেই পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন। পুরাকালে বুদ্ধ জেতবন থেকে স্বর্গে আরোহণ করেন। সেখানে সদ্ধর্ম মহাকক্ষে বাস করে তিনি তাঁর মাকে ধর্ম ব্যাখ্যা করে শোনান। তিন মাস কাল সেখানে থাকার পর তিনি পৃথিবীতে ফিরে আসতে মনস্থ করলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর দৈব ক্ষমতাবলে এ তিনটি অমূল্য সিঁড়ি তৈরী করে দিলেন। মধ্যের সিঁড়িটি হলো সোনার। বাঁয়েরটি আসল স্ফটিকের। ডাইনেরটি সাদা রূপোর।
কয়েক শতাব্দী আগেও (মূল) সিঁড়ি তিনটি তাদের আসল জায়গায় খাড়া ছিল। এখন সেগুলি মাটিতে ডেবে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রতিবেশী রাজারা সিঁড়িটিকে আর দেখতে না পেয়ে দুঃখিত হয়ে তার অনুকরণে নতুন তিনটি সিঁড়ি বানিয়ে দেন। এগুলি ইট আর কারুকার্য করা পাথর দিয়ে তৈরী। রত্ন খচিত করা। মূল সিঁড়ি তিনটি যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই তৈরী করা হয়েছে। প্রত্যেকটি প্রায় ৭০ ফুট উঁচু। সিঁড়ির মাথায় একটি বিহার বানানো হয়েছে। তার মধ্যে বুদ্ধের মূর্তি রয়েছে। তার দুদিকে একটি সিঁড়িতে ব্রহ্মার ও অন্যটিতে ইন্দ্রের মূর্তি। বুদ্ধ পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় যে ভাবে তাঁরা প্রথম উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ঠিক সেইরকম মূর্তি।
সংঘারামটির বাইরে, একেবারে কাছে, ৭০ ফুট উঁচু একটি পাথরের স্তম্ভ আছে। এটি অশোক রাজার তৈরী। বেগুনীরঙা স্তম্ভটি স্যাঁতসেঁতে ভাবের দরুন চিকচিক করছে। পাথরগুলি বেশ মজবুত ও মিহি। স্তম্ভের মাথায় একটি সিংহের মূর্তি, কটিদেশে ভর দিয়ে সিঁড়িগুলির দিকে মুখ করে বসে আছে। স্তম্ভটির চারিদিকে অতি সুন্দর ভাবে সব মূর্তি খোদাই করা রয়েছে।
সিঁড়ি তিনটি থেকে একটুখানি দূরে একটি স্তূপ রয়েছে। এখানে বিগত চার বুদ্ধের উপবেশন ও বিচরণের চিহ্নাদি রয়েছে।
এর পাশে আর একটি স্তূপ আছে। তথাগত এখানে অবস্থান করেছিলেন। এর পাশে, যেখানে তথাগত সমাধিমগ্ন হতেন, সেখানে একটি বিহার তৈরী করা হয়েছে। বিহারের পাশ দিয়ে একটি লম্বা প্রাচীর চলে গেছে। এটি পঞ্চাশ পা লম্বা ও সাত ফুট উঁচু। এখানে বুদ্ধ নিয়মিত পদচারণা করতেন। তিনি যে সব স্থানে তাঁর পা রেখেছিলেন সেখানে পদ্মফুলের প্রতিকৃতি রয়েছে। দেয়ালের ডান ও বাঁ দিকে দুটি ছোট স্তূপ রয়েছে। এ দুটি ইন্দ্র ও ব্রহ্মা তৈরী করেন।
বড় স্তূপটির দক্ষিণ-পূর্বদিকে রয়েছে একটি নাগ-পুষ্করিণী।
॥ ২৭ ॥ ‘কিএ-পো-কিও-শে’ বা কন্যাকুব্জ
কপিত্থ থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে যাত্রা করা হলো। দুশো লি থেকে কিছু কম পথ পেরিয়ে (কন্যাকুব্জ বা আধুনিক কনৌজ) রাজ্যে এসে পৌঁছলাম।
আয়তনে এ রাজ্যটি চার-হাজার লির মতো। গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে এর রাজধানী। লম্বায় ২০ লির মতো। চওড়ায় ৪ বা ৫ লি। শহরটিকে ঘিরে একটি শুকনো পরিখা রয়েছে। মুখোমুখি ভাবে অনেকগুলি মজবুত আর বেশ উঁচু বুরুজ আছে। ফুলের গাছ, বন-বনানী, হ্রদ-পুকুর চারিদিকে সৌন্দর্য ছড়িয়ে চলেছে। নানা দেশ থেকে অঢেল দামী দামী পণ্য এখানে এসে জমা হয়। অধিবাসীদের অবস্থা সচ্ছল, মনে তৃপ্তির ভাব। বাড়িঘরের চেহারা সম্পন্ন, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সংকেত বহন করে। যেখানেই যাও ফুল আর ফলের প্রাচুর্য চোখে পড়বে। ঋতু অনুসারে সবখানে নিয়মমাফিক চাষ-আবাদ চলছে। আবহাওয়া মনোরম ও স্নিগ্ধ। লোকের আচার-ব্যবহার সততা ও আন্তরিকতা মাখা। চেহারার মধ্যে আভিজাত্য ও উদারতার ছাপ রয়েছে। পরনে বেশ ঝলমলে, নক্সা আঁকা পোষাক পরিচ্ছদ। জ্ঞানচর্চ্চার দিকে খুব ঝোঁক রয়েছে। কোথাও বেড়াতে গেলে আলোচনায় মেতে ওঠে। ভাষার বিশুদ্ধতার জন্য তাদের খুব খ্যাতি। বুদ্ধের অনুগামী ও অন্যধর্মীদের সংখ্যা এখানে প্রায় সমান-সমান।
এখানে কয়েকশো সংঘারাম আছে। সেখানে ভিক্ষুর সংখ্যাও হাজার দশেকের মতো। হীনযান ও মহাযান দুয়েরেই তারা চর্চা করে। মন্দিরের সংখ্যা দুশো। সেখানে কয়েক হাজার অনুগামী রয়েছে।
কন্যাকুব্জর পুরোনো রাজধানী হলো কুসুমপুর। রাজার নাম ছিল ব্ৰহ্মদত্ত। ধর্মপরায়ণতা, প্রজ্ঞা, পরাক্রম এসবের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন।
বর্তমান রাজা বৈশ্য বর্ণের। তার নাম হর্ষবর্ধন। একদল অমাত্য রাজ্যের প্রশাসনের কাজ চালান। দু’পুরুষের মধ্যে তিন জন রাজা সিংহাসনে বসেছেন। রাজার পিতার নাম প্রভাকরবর্ধন। বড় ভাইয়ের নাম রাজ্যবর্ধন।
বড় ভাই হিসাবে রাজ্যবর্ধন প্রথমে সিংহাসন লাভ করেন ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে শাসনকার্য চালাতে থাকেন। এ সময়ে পূর্ব-ভারতের কর্ণসুবর্ণ রাজ্যের রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। তিনি রাজ্যবর্ধনের উপর বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি প্রায়ই তাঁর মন্ত্রীদের কাছে বলতেন, রাজ্যের পাশে কোন ন্যায়বান রাজা থাকলে তা রাজ্যে অমঙ্গল ডেকে আনে। এজন্য মন্ত্রীরা রাজ্যবর্ধনকে একটি আলোচনা- সভায় আমন্ত্রণ জানান ও সেই সুযোগে তাঁকে হত্যা করেন।
রাজার মৃত্যুতে রাজ্যময় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মহামন্ত্রী ভণ্ডীর প্রচুর খ্যাতি ও প্রতিপত্তি ছিল। সবাই তাঁর মতামতের প্রতি মর্যাদা দিত। তিনি সব মন্ত্রীদের ডেকে বললেন—”জাতির ভাগ্য আজকের মধ্যেই ঠিক করে ফেলা দরকার। বৃদ্ধ রাজার বড় ছেলে মারা গেছেন। তাহলেও তাঁর ভাই আছেন। তিনি মানবিকতা ও মমতাপরায়ণ। স্বভাব-চরিত্রও দেবোপম। কর্তব্যনিষ্ঠা এবং আনুগত্যও রয়েছে। রাজপরিবারের সকলের প্রতি তাঁর গভীর মায়ামমতা রয়েছে। অতএব প্রজারা সকলেই তাঁকে পছন্দ করবে। আমার প্রস্তাব-তাঁকেই রাজা হিসাবে নির্বাচন করা হোক। এবার আপনাদের কার কী মত বলুন।” সমবেত মন্ত্রীরা সকলেই হর্ষবর্ধনের গুণবত্তার কথা স্বীকার করলেন ও তাঁকে রাজা রূপে নির্বাচন করা নিয়ে মহামন্ত্রীর সঙ্গে একমত হলেন।
তখন মহামন্ত্রী ও অমাত্যরা সকলে মিলে হর্ষবর্ধনের কাছে গিয়ে তাঁকে রাজ্যভার গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলেন। তাঁরা তাঁকে বললেন, “রাজকুমার, শুনুন। বৃদ্ধ রাজা তাঁর পূর্ব সুকৃতি ও এ জন্মের সদগুণাবলীর জন্য এরূপ সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন যে তিনি সেজন্য অতি সহজে তাঁর রাজ্য সুশাসনে রাখতে পেরেছিলেন। রাজ্যবর্ধন যখন রাজা হলেন আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম যে তিনিও ঐভাবে দীর্ঘকাল রাজ্যশাসন চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু তাঁর পরামর্শদাতাদের ত্রুটির জন্য তিনি নিজেকে শত্রুর হাতে সঁপে দিয়েছেন। রাজ্যের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। পরামর্শদাতা মন্ত্রীরাই এজন্য দায়ী। গানের মাধ্যমে প্রজারা আপনার সম্পর্কে যে সব অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায় যে সকলেই তারা আপনার গুণমুগ্ধ। অতএব আপনি এ রাজ্যের ভার গ্রহণ করুন, তাকে গৌরবের সঙ্গে শাসন করুন। আপনার বংশের শত্রুকে জয় করুন। রাজ্যের প্রতি, আপনার পিতার কার্যকলাপের প্রতি অপমানের প্রতিশোধ নিন। তাতে আপনার যশ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের অনুরোধ আপনি যেন প্রত্যাখ্যান করবেন না।
রাজকুমার তখন উত্তর দিলেন-”রাজ্যশাসন এক গুরু দায়িত্ব। সব সময়েই সমস্যার পর সমস্যা ভিড় করে থাকে। কর্তব্য সম্পর্কে রাজার সব সময় পূর্ব থেকে সজাগ থাকা প্রয়োজন। আমি সে দায়িত্ব পালনের মতো বিরাট লোক নই। তবে আমার পিতা ও ভাই বেঁচে নেই, এক্ষেত্রে রাজ্যের উত্তরাধিকারীত্ব অস্বীকার করা আমার পক্ষে সাজে না। তাতে প্রজাদের কোন মঙ্গলই হবে না। আমি নিজের অসম্পূর্ণতার কথা ভুলে গিয়ে এক্ষেত্রে অন্য সকলের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেব। তবে তার আগে আমাকে একবার গঙ্গার তীরে বিরাজিত অলৌকিক ক্ষমতাধারী অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের বিগ্রহের নিকটে যাবার সময় দিন। আমি এ বিষয়ে তাঁর উপদেশ চাইব।”
এরপর তিনি বোধিসত্ত্বের কাছে উপস্থিত হয়ে উপবাস করে প্রার্থনা জানাতে সুরু করলেন। বোধিসত্ত্ব তাঁর আন্তরিকতার পরিচয় পেয়ে সশরীরে দেখা দিয়ে প্রশ্ন করলেন-”এমন আকুল হয়ে কেন আমায় ডাকছ? তুমি কি চাও? তখন রাজকুমার তাঁকে সব কথা খুলে বলে তাঁর কাছে উপদেশ চাইলেন।
বোধিসত্ত্ব তখন বললেন— “পূর্বজন্মে এক সন্ন্যাসী হয়ে তুমি এই বনে কাটিয়েছিলে। সেই পুণ্যবলে এজন্মে তুমি রাজপুত্র হয়ে জন্মেছ। কর্ণসুবর্ণের রাজা বুদ্ধের ধর্মকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে চলেছে। তুমি সিংহাসনে আরোহণ করে তদনুপাতে এই ধর্মের প্রতি ভালবাসা ও করুণা দেখাও। যদি তুমি আর্তকে করুণা দেখাতে, তাদের দুঃখ দূর করতে যত্নবান হও তবে অল্পকাল মধ্যেই সারা ভারত তোমার পদানত হবে। যদি তুমি তোমার আধিপত্য বিস্তার করতে চাও তবে আমার নির্দেশ মেনে চলো। তবে, আমার আশীষবলে তুমি আরো বেশি দূরদর্শিতা লাভ করবে। তার ফলে কোন প্রতিবেশী রাজা তোমার উপর জয়ী হতে পারবে না। তুমি যেন সিংহাসনে বোসো না এবং নিজেকে যেন রাজা বলে ডোকো না।
নির্দেশ লাভ করে হর্ষবর্ধন সেইমতো রাজ্যভার গ্রহণ করলেন। নিজেকে তিনি রাজকুমার রূপে অভিহিত করলেন। তাঁর উপাধি শীলাদিত্য।
রাজ্যভার নিয়ে তিনি মন্ত্রীদের আদেশ দিলেন— “আমার ভাইয়ের হত্যাকারীরা এখনো শাস্তি পায়নি। প্রতিবেশী রাজারা এখনো অধীনে আসেনি। এ কাজ যতদিন না সম্পূর্ণ হবে ততদিন আমি দক্ষিণ হাত দিয়ে অন্ন গ্রহণ করবো না। প্রজারা ও রাজ-অমাত্যরা সকলে এক হয়ে আপ্রাণ শক্তি দিয়ে এ কাজ বাস্তবে পরিণত করার প্রয়াস করুন।’
আদেশ অনুসারে রাজ্যের সকল সৈন্যকে একত্র করা হলো। অস্ত্রগুরুদের ডাক পড়লো। রাজ্যের সমর বাহিনীতে ৫০০ রণহস্তী, ২০০০ অশ্বারোহী ও ৫০,০০০ পদাতিক ছিল। সৈন্যরা অবিরাম গতিতে এগিয়ে চললো। পুব থেকে পশ্চিমের সকলে তাঁর অধীনে এলো। ছ-বছরের মধ্যে সারা ভারতকে তিনি বশে আনলেন। নিজের রাজ্যসীমা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য বাহিনীও বেড়ে চললো। রণহস্তীর সংখ্যা ৬০,০০০ অশ্বারোহীর সংখ্যা ১০,০০,০০-তে দাঁড়াল। তিরিশ বছর পর তিনি অস্ত্র সংবরণ করলেন, সর্বত্র শান্তির পরিবেশের মধ্যে রাজ্য শাসন করে চললেন। এবার তিনি চরমভাবে মিতাচারের শাসন সুরু করলেন। চারিদিকে ধর্মের বীজ বপনের জন্য তিনি আহার নিদ্রা পর্যন্ত ভুলে গেলেন। সব রকম প্রাণী হত্যা ভারতময় নিষিদ্ধ করা হলো। এই নিষেধ অমান্যকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ রূপে ঘোষিত হলো। গঙ্গা নদীর দু-কূল জুড়ে তিনি কয়েক হাজার স্তূপ গড়লেন। প্রত্যেকটি স্তূপ দশ ফুট করে উঁচু। ভারতের প্রত্যেকটি শহর ও গ্রামের প্রধান প্রধান রাস্তায় পুণ্যশালা করে দিলেন। অন্ন ও জল বিতরণের ব্যবস্থা করলেন। চিকিৎসক নিয়োগ করলেন। স্থানীয় দুস্থ মানুষদের জন্য ও পর্যটকদের জন্য ঔষধের ব্যবস্থা করলেন। কোনরূপ কৃপণতা না করে সব কিছু বিতরণের আয়োজন করা হলো। বুদ্ধদেবের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত সকল স্থানে তিনি সংঘারাম গড়ে দিলেন।
প্রত্যেক পাঁচ বছর অন্তর তিনি বিরাট ভাবে সম্মেলনের আয়োজন করতেন। এই সম্মেলনকে মোক্ষ বলা হতো। পুরো রাজকোষ শূন্য করে ওই সময়ে তিনি দান করতেন। ভিক্ষাদানের যোগ্য নয় বলে একমাত্র সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্রই ঐ দান
থেকে বাদ পড়তো। প্রত্যেক বছর সারা দেশ জুড়ে শ্রমণদের সমবেত হবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হতো। তৃতীয় ও সপ্তম দিনে তাদের তিনি খাদ্য, পানীয়, ঔষধ ও বস্ত্র এই চতুর্বিধ দান করতেন। ধর্ম-সিংহাসনকে তিনি ব্যাপকভাবে কারুকার্য মণ্ডিত ও সুসজ্জিত করেছিলেন। ভিক্ষুদের প্রায়ই বিতর্ক সভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানাতেন ও তাঁদের যুক্তিসমূহের দোষগুণ বিচার করতেন। সৎকে পুরস্কৃত ও অসৎকে শাস্তি দিতেন। মন্দে লোকের পদাবনতি ও প্রতিভাবানদের পদোন্নতি ঘটাতেন। যে সব ভিক্ষু সদাচার ও জ্ঞান উভয়ক্ষেত্রে বিশিষ্টতা লাভ করতেন তাঁদের নিয়ে তিনি ধর্মসিংহাসনে বসাতেন ও তাঁদের কাছ থেকে ধর্মোপদেশ শুনতেন। সদাচারের জন্য খ্যাতিবান কিন্তু জ্ঞানের দিক থেকে বিশিষ্ট নন এমন ভিক্ষুকে তিনি কেবলমাত্র শ্রদ্ধা জানাতেন, বিরাটভাবে সম্মান দিতেন না।
কোন লোক নৈতিক নীতিমালা উপেক্ষা করলে, ধর্মীয় প্রাধান্য অস্বীকার করে কুখ্যাত হয়ে উঠলে তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হতো। তিনি তার মুখদর্শনও করতে চাইতেন না, কোন কথা শুনতেও চাইতেন না। কোন প্রতিবেশী রাজা বা মহামন্ত্রী ধর্মপরায়ণ ও সদগুণসম্পন্ন হলে তাঁকে তিনি হাত ধরে অতি সমাদরে পাশে টেনে একাসনে বসাতেন, মহান বন্ধু বলে সম্বোধন করতেন। যারা বিপরীত চরিত্রের তাদের মুখদর্শন করতেও তিনি চাইতেন না।
রাজকার্যের প্রয়োজনে সংবাদ আনা-নেয়ার জন্য তিনি সংবাদবাহক নিযুক্ত করেছিলেন। তারা সব সময়ে সংবাদ নিয়ে যাওয়া-আসা করতো। প্রজাদের আচরণে কোনরকম বিপরীত ভাব দেখা দিলে তিনি নিজে তাদের কাছে যেতেন। রাজ্যের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সব সময় একটি রাজনিবাস যেতো। এই নিবাসেই তখন তিনি বাস করতেন। অতি বর্ষার মাস-তিনটিতে তিনি ভ্রমণে যেতেন না। তাঁর ভ্রমণ নিবাস থেকে সর্বক্ষণ সকল সম্প্রদায়ের লোকদের সুখাদ্য বিতরণ করা হতো। এক হাজারের কাছাকাছি বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পাঁচশোর মতো ব্রাহ্মণকে এভাবে রোজ খাওয়ানো হতো।
কাজকর্মের জন্য দিনকে তিনি তিন ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। দিনের প্রথম ভাগ কাটাতেন শাসনকার্য নিয়ে। দ্বিতীয় ভাগ কাটাতেন অবিরাম ধর্মকার্য করে।
(কামরূপের) কুমার-রাজার কাছ থেকে যেবার আমি আমন্ত্রণ পেলাম ঠিক করলাম মগধ হয়ে কামরূপ যাব। শীলাদিত্য রাজা এ সময়ে তাঁর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করে চলছিলেন। কিই-মি-ওউ-কি লো’তে তাঁকে দেখার সুযোগ পেলাম। তিনি কুমার রাজাকে বললেন-”তুমি তোমার অতিথি এই বিদেশী শ্রমণকে নিয়ে এক্ষুনি নালন্দা বিহারে আসো-এই আমার ইচ্ছা। তাঁর কথায় কুমার রাজা ও আমি দুজনে গিয়ে অধিবেশনে যোগ দিলাম। যাত্রার ক্লান্তি দূর হবার পর রাজা শীলাদিত্য আমায় জিজ্ঞাসা করলেন-”আপনার দেশ কোথায়? কেন এখানে বেড়াতে এলেন?”
উত্তরে আমি বললাম-”বিশাল তাঙদেশ থেকে আমি এসেছি। বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র সংগ্রহের জন্য আপনার কাছে অনুমতি চাইছি।”
রাজা শুনে প্রশ্ন করলেন— “তাঙ নামের এই বিরাট দেশটি কোথায়? আপনারা কোন পথ দিয়ে আসেন? সে দেশ এখান থেকে কাছে না দূরে?”
আমি বললাম : “আমার দেশ উত্তর-পূর্বে। এখান থেকে কয়েক অযুত লি দূরে। ভারতের লোকেরা তাকে মহাচীন বলে।”
রাজা বললেন— “মহাচীনের ৎসিন নামে এক রাজার কথা আমি শুনেছি। আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দেখিয়ে অল্প বয়সেই তিনি ঈশ্বর-পুত্র রূপে বিখ্যাত হন। বৃদ্ধ বয়সে ‘স্বর্গীয় যোদ্ধা’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। রাজা হবার আগে পুরো সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খল ও বিভ্রান্ত অবস্থায় ছিল। প্রত্যেক জায়গায় দলাদলি, মারামারি। সৈন্যেরা বিমূঢ়। সাধারণ লোক দুর্দশার মধ্যে। তখন ঈশ্বরের পুত্র রাজা ৎসিন মহান উদ্দেশ্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আপনার ভালবাসা ও মহানুভবতা দিয়ে সকলের হৃদয় জয় করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনলেন, সবাইকে শান্ত ও সুশৃঙ্খল করলেন। তাঁর বিধান ও নির্দেশাবলী সবদিকে ছড়িয়ে পড়লো। অন্য যে সব দেশের লোকদের তিনি নিজের অধীনে এনেছিলেন তারাও তাঁর শাসন মেনে নিল। তিনি প্রজাদের মঙ্গল সাধন করেছেন বলে তারা কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁর পরাক্রম ও যশোগাথা গায়। অনেককাল আগে আমি শুনেছি তাঁর প্রশংসা নাকি গানের আকারে লোকের মুখে মুখে ফেরে।—তাঁর মহান গুণাবলীর প্রশংসাগীতি কি সত্যিই খুব প্রচলিত? যে বিরাট তাঙ দেশের কথা তুমি বলছো ইনি কি তাঁরই রাজা?”
উত্তরে আমি জানালাম— “চীন আমাদের পূর্ববর্তী রাজাদের রাজ্যের নাম। কিন্তু বিরাট তাঙ বা মহাতাঙ আমাদের বর্তমান রাজবংশের রাজ্য। এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হবার পূর্বে আমাদের রাজাকে ৎসিন-এর রাজা বলা হতো। এখন তাঁকে সম্রাট বা ‘স্বর্গের রাজা’ বলা হয়। আগেকার রাজবংশের পতন হবার পর দেশে কোন শাসক ছিল না। চারিদিকে গণ-সংগ্রাম সুরু হলো, বিশৃঙ্খলা দেখা দিল, লোকের জীবন বিপদগ্রস্ত হলো। তখন ৎসিন-এর রাজা তাঁর অলৌকিক প্রতিভাবলে আপন হৃদয়ের ভালবাসা ও মমতা সকলের উপর বিস্তার করলেন। তাঁর ক্ষমতাবলে দেশ থেকে দুষ্ট ব্যক্তিদের লোপ হলো, রাজ্যের চারিদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো। দশ হাজার রাজ্য তাঁর অধীনতা স্বীকার করে নিল। তিনি প্রত্যেক প্রাণীকে পালন করলেন। ত্রি-রত্নের প্রতি সম্মান ও আনুগত্য দেখালেন। সাধারণ মানুষের বোঝা হালকা করে দিলেন, শাস্তির কঠোরতা কমিয়ে দিলেন। রাজ্য যাতে সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠতে পারে সে ব্যবস্থা নিলেন, লোকেদের বিশ্রামের সুযোগও করে দিলেন। তিনি দেশে অনেক পরিবর্তন এনেছেন, সব কথা বিশদভাবে বলা আমার পক্ষে কষ্টকর।”
শীলাদিত্য রাজা শুনে বললেন— “খুব ভাল খবর নিঃসন্দেহে। এমন একজন মহান রাজার রাজত্বে সবাই সুখে আছে শুনে ভালো লাগল।”
কন্যাকুজ ফিরে যাবার আগে শীলাদিত্য রাজা এক ধর্ম-সম্মেলন ডাকলেন। কয়েক লক্ষ লোক সঙ্গে নিয়ে তিনি গঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে এসে ঠাঁই নিলেন। অন্যদিকে কয়েক অযুত লোক নিয়ে কুমার রাজা আস্তানা গাড়লেন উত্তর তীরে। তারপর দুজনে নদীর দু’পারে থেকে জল ও হাঁটাপথ ধরে এগিয়ে চললেন। দুই রাজার সঙ্গেই সুসজ্জিত চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনী। কতক চলেছে নৌকায়। কতক বা হাতির পিঠে। বেজে চলেছে শিঙা, দামামা, বাঁশী ও বীণাযন্ত্র। নব্বই দিন চলার পর সবাই কন্যাকুঞ্জে এসে পৌঁছলেন। সেখানে গঙ্গা নদীর পশ্চিমতীরে ফুলে ফুলে রঙীন এক বনানী মধ্যে শিবির গড়লেন।
শীলাদিত্যের আমন্ত্রণ পেয়ে কুড়িজন রাজা এই ধর্ম-সম্মেলনে যোগ দিতে এলেন। তাঁরা, শ্রমণ ও ব্রাহ্মণরা, দেশের সব গণ্যমান্য ব্যক্তিরা, সৈন্য ও অমাত্যরা সকলে এক জায়গায় সমবেত হলেন। রাজা আগে থেকেই গঙ্গার পশ্চিমতীরে একটি সংঘারাম তৈরী করিয়ে রেখেছিলেন। এটির পূর্বভাগে তৈরী করিয়েছিলেন একটি মূল্যবান স্তূপ। এটি ১০০ ফুটের মতো উঁচু। এর মাঝখানে বুদ্ধদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটি রাজার সমান উঁচু। স্তূপের দক্ষিণদিকে বুদ্ধের বিগ্রহকে স্নান করাবার জায়গায় একটি মূল্যবান বেদী তৈরী করা হয়েছে। ১৪ বা ১৫ লি উত্তর-পূর্বে তিনি আর একটি বিশ্রামাগার বানিয়েছেন। বসন্ত ঋতুর দ্বিতীয় মাস তখন। মাসের প্রথম থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত শ্রমণ ও ব্রাহ্মণদের জন্য চমৎকার ভোজন ব্যবস্থা হয়েছিল। সাময়িক রাজপ্রাসাদ থেকে সংঘারাম পর্যন্ত খুব সুন্দর করে সাজান মণ্ডপ তৈরি হয়েছে, সঙ্গীত শিল্পীদের জন্য স্থানে স্থানে আসর বানানো হয়েছে। তারা নানা রকম যন্ত্রে সঙ্গীত বাজিয়ে চলেছেন।
রাজার সাময়িক প্রাসাদ থেকে শোভাযাত্রা বার করা হলো। অতি জমকালোভাবে সাজান একটি বড় হাতির পিঠে তুলে ধরা বুদ্ধদেবের একটি তিনফুট উঁচু মূর্তি। তার বাঁদিকে ইন্দ্রের মতো সাজসজ্জায় রাজা নিজে একটি মূল্যবান ছত্র ধরে চলেছেন। ডানদিকে ব্রহ্মার মতো সাজপোষাকে কুমার রাজা একটি শ্বেত চামর হাতে চলেছেন। দুই রাজার এক একজনের দেহরক্ষী হিসাবে চলেছে ৫০০টি করে বর্ম সাজ পরা রণহাতি। বুদ্ধের মূর্তির আগে ও পিছে একশোটি বড় হাতি। তাদের পিঠে গায়ক ও বাদকের দল গান বাজনা করে চলেছে। রাজা শীলাদিত্য যাবার বেলা চারিদিকে অসংখ্য মুক্তা, নানা দামি দামি জিনিস, সোনা ও রূপো দিয়ে তৈরী ফুল ছড়িয়ে চলেছেন ত্রি-রত্নের সম্মানে। মূর্তিকে প্রথমে স্নানের বেদীতে নিয়ে সুবাসিত জলে স্নান করানো হলো। তারপর তাকে রাজা নিজের কাঁধে বসিয়ে নিয়ে চললেন পশ্চিম সংঘারামে। সেখানে মূর্তির কাছে দশ লক্ষ রেশমের পোষাক নিবেদন করা হলো। প্রত্যেকটি পোষাক দামী রত্ন খচিত। এ সময়ে ২০ জনের মতো শ্রমণ শোভাযাত্রার অনুসরণ করলেন। বিভিন্ন দেশের রাজারা দেহরক্ষীরূপে তাঁদের অনুগমন করে চললেন। উৎসবের শেষে জ্ঞানী ব্যক্তিদের সমাবেশ সুরু হলো। তাঁরা উদ্দীপ্ত ভাষায় নানা উচ্চ তত্ত্ব মূলক বিষয়ের আলোচনা করলেন। আঁধার নেমে এলে রাজা তাঁর সাময়িক প্রাসাদে ফিরে গেলেন।
প্রত্যেক দিন এভাবে তিনি সোনার মূর্তিটি বয়ে নিয়ে চললেন। শেষের দিন হঠাৎ স্তূপের মধ্যে বিরাট অগ্নিকাণ্ড হলো। এমন কি সংঘারামের ফটকের উপরকার মণ্ডপও জ্বলে উঠলো।
রাজা তা দেখে বললেন— “আগেকার রাজাদের দৃষ্টান্ত মতো আমি আমার রাজ্যের সমস্ত ধন-সম্পদ দান করেছি, এ সংঘারামটি তৈরী করে দিয়েছি ও সব রকম মহৎ কাজের দ্বারা নিজেকে আদর্শরূপে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার সে চেষ্টা সার্থক হলো না। এরকম দুর্বিপাকের পর আর আমার বেঁচে থেকে লাভ কী?”
ধূপ-ধূনা জ্বালিয়ে রাজা প্রার্থনা নিবেদন করলেন — “পূর্ব পুণ্যবলে আমি সারা ভারতের উপর আধিপত্য লাভ করেছি। আমার (এ জন্মের) ধর্মীয় সুকৃতি বলে এ আগুন নিভে যাক, নয়তো আমি মৃত্যুবরণ করবো।”
প্রার্থনা শেষ করে ফটকের দিকে ছুটে চললেন। আর ঠিক তখুনি, যেন এক ফুঁয়ে সব আগুন নিভে গেল।
এ দৃশ্য দেখে রাজার ভক্তি ও শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়ে গেল। কিন্তু মুখের ভাব অথবা বাচনভঙ্গীর কোনরূপ পরিবর্তন না করে রাজাদের দিকে চেয়ে বললেন- “ধর্মার্জিত সবটুকু পুণ্য আমার আগুনে নষ্ট হয়ে গেল। কী বলো তোমরা?”
রাজারা সকলে তাঁর পায়ে ধূলি-লুণ্ঠিত হয়ে সজল চোখে বললেন “যে কীর্তি আপনার অশেষ পুণ্য কর্মের চরম নিদর্শন হয়ে বিরাজ করছিল, যা যুগ যুগ অক্ষয় থাকবে বলে আমরা আশা করেছিলাম তা নিমিষে ভষ্ম হয়ে গেছে। এ আমরা কী করে সহ্য করি! আরো অসহ্য বোধ হয়, যখন দেখি বিধর্মীরা এতে উল্লাসে ফেটে পড়ছে, একে অন্যের সঙ্গে আনন্দে কোলাকুলি করে চলেছে।”
রাজা উত্তর দিলেন— “এ থেকে প্রমাণ হলো যে বুদ্ধের কথা কত সত্য! বিধর্মী ও অন্যান্যরা বস্তুর নিত্যতার উপর জোর দেয়। কিন্তু আমাদের মহান দ্রষ্টার মতে সব বস্তুই অনিত্য। যদি আমার কথা বলো তবে আমার ধর্মবাদ আমার অভীষ্ট মতো পূর্ণ হয়েছে। বরঞ্চ এই ধ্বংসলীলা তথাগতের মতবাদের যথার্থতার উপর আমার বিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনা এক আনন্দকর ঘটনা, দুঃখকর নয়।
এরপর রাজাদের সঙ্গে নিয়ে পূর্বদিকে গিয়ে তিনি স্তূপটিতে চড়লেন। চূড়ায় উঠে সেখান থেকে চারিদিকের দৃশ্য দেখলেন। যখন নেমে আসলেন তখন একজন বিধর্মী ছুরিকা হাতে তাঁর দিকে ধেয়ে এলো। আচমকা আক্রমণে রাজা চকিত হয়ে, পিছিয়ে, সিঁড়ির কয়েক ধাপ উপরে উঠে গেলেন। তারপর ঝুঁকে পড়ে লোকটিকে তিনি ধরে ফেললেন ও অমাত্যদের হাতে তুলে দিলেন। অমাত্যরা এতো বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে কি করবে না করবে কিছুই যেন ভেবে পাচ্ছিল না।
রাজারা সকলে লোকটিকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলতে বললেন। কিন্তু রাজা শীলাদিত্য একটুও ভয় না পেয়ে, অপরিবর্তিত মুখভাব নিয়ে তাকে হত্যা না করার আদেশ শোনালেন। তারপর তাকে প্রশ্ন করলেন— “আমি তোমার কী ক্ষতি করেছি যে এমন চেষ্টা করলে?”
অপরাধী উত্তরে বললো— “মহারাজ! আপনার ধর্মকীর্তির আলোক-দীপ্তির কোন তুলনা নেই। দেশে বিদেশে সব জায়গায় তা প্রশংসিত হয়। আমি নেহাৎই একজন মূর্খ ও অন্ধ পশু। কোনরকম মহৎ কাজের অযোগ্য। বিধর্মীদের কথায় বিপথচালিত হয়ে, তাদের প্ররোচনায় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে আপনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।”
রাজা প্রশ্ন করলেন— “বিধর্মীরা কেন এমন হীন কাজে প্ররোচিত করলো?”
সে উত্তরে বললো— “মহারাজ! আপনি বিভিন্ন দেশের লোককে এখানে সমবেত করেছেন। শ্রমণদের সেবা-আপ্যায়নের জন্য আপনার কোষাগার শূন্য করে দিয়েছেন। বুদ্ধের ধাতুমূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ যে সব বিধর্মী দূর দেশ থেকে এসেছেন তাদের প্রতি কোন মনোযোগ দেননি। এতে তারা খুব ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাই আমাকে তারা এই হীন কাজ করার জন্য যোগাড় করেছে।’
সেখানে ৫০০ জন ব্রাহ্মণ উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকেই অনন্য প্রতিভাধর। রাজার কাছে সবাইকে ডেকে আনা হলো। রাজা সোজাসুজি তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন।
জানা গেল, রাজা বিশেষভাবে শ্রমণদের শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানোর জন্য শ্রমণদের উপর ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা জ্বলন্ত তীরের সাহায্যে মহার্ঘ তোরণটিতে আগুন লাগিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, আগুনে ভয় পেয়ে জনতা বিভ্রান্তভাবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। আর সেই সুযোগে তারা রাজাকে হত্যা করবে। কিন্তু তা ভেস্তে যাওয়ায় তারা লোকটিকে অর্থ দিয়ে প্রলুব্ধ করে। রাজাকে হত্যা করার জন্য সে একটি সরু পথের মাঝে লুকিয়ে ছিল।
মন্ত্রীর দল ও রাজারা সকলে তখন বিধর্মীদের নির্মূল করার দাবী তুললেন। রাজা কেবলমাত্র তাদের প্রধানকে শাস্তি দিলেন ও বাকি সবাইকে ক্ষমা করলেন। সেই ৫০০ জন ব্রাহ্মণকে ভারতের সীমানা রাজ্যগুলিতে নির্বাসনে পাঠানো হলো। তারপর তিনি রাজধানীতে ফিরে এলেন।
রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমদিকে যেতে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ দেখতে পেলাম। তথাগত সাতদিন এখানে থেকে তাঁর মহান ধর্মের বাণী প্রচার করেন। আগের চার বুদ্ধের বসা ও চলাফেরার সব চিহ্ন এই স্তূপের পাশে বর্তমান রয়েছে। তাছাড়া আরো একটি স্তূপ আছে যেখানে বুদ্ধের চুল ও নখকণা রাখা হয়েছে। ঠিক যে জায়গাটিতে তিনি ধর্মের বাণী শুনিয়েছিলেন সেখানেও একটি স্তূপ বৰ্তমান।
দক্ষিণদিকে, গঙ্গার কাছে, তিনটি সংঘারাম আছে। সে তিনটি একটিমাত্র দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তবে প্রত্যেকটিতে যাবার জন্য আলাদা আলাদা ফটক আছে। তার প্রত্যেকটিতে অতি সুন্দর কারুকার্যময় বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। ভিক্ষুরা ভক্তি ও শ্রদ্ধাপরায়ণ। কয়েক হাজার অনুগামী তাঁদের সেবাকর্মের ভার বহন করে থাকে। একটি বিহারের মধ্যে এক মূল্যবান আধারে বুদ্ধদেবের একটি দাঁত রয়েছে। এটি দেড় ইঞ্চি মতন লম্বা, বেশ চকচকে ও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক এক সময়ে
এক এক রঙ ধারণ করে। শুধু কাছ থেকে নয়, দূর থেকেও ভক্তরা এখানে আসে। প্রচুর গণ্যমান্য ব্যক্তিও জমা হন। সকলে একাত্ম হয়ে পূজা-নিবেদন করে। প্রতিদিন শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে লোক হয়। দেহাবশেষ (দাঁতটি) রক্ষার দায়িত্ব যাদের উপর তারা প্রচণ্ড ভিড়, কোলাহল ও বিশৃঙ্খলার জন্য বাধ্য হয়ে বুদ্ধের এই দাঁত দর্শনের জন্য এক বড় স্বর্ণ-খণ্ড দর্শনী ধার্য করেছেন। এ সত্ত্বেও অতি প্রচণ্ড ভিড়। লোকে খুশীমনে এই দর্শনী দেয়। প্রত্যেক উৎসবের দিনে এটিকে এনে একটি উঁচু সিংহাসনের উপর রাখা হয়। অসংখ্য লোক এসে ধূপ জ্বালায়, ফুল ছড়ায়। কিন্তু, এই ফুল স্তূপাকার হয়ে উঠলেও দাঁতের আধারটি কখনো তাতে ঢাকা পড়ে না।
সংঘারাম-এয়ের দক্ষিণ-পূর্বে একটুখানি হাঁটতেই একটি বড় বিহারের দর্শন পাওয়া গেল। ভিত পাথরের, দেয়াল ইটের তৈরী। দুশো ফুটের মতো উঁচু। বুদ্ধের মূর্তিটি দাঁড়ানো, তিরিশ ফুটের কাছাকাছি লম্বা। দেশী তামা দিয়ে মূর্তিটি বানানো হয়েছে, দামী দামী রত্ন খচিত করা হয়েছে। বিহারের চারদিকের দেয়ালে ভাস্কর্য- চিত্র খোদাই করা। বুদ্ধ যখন বোধিসত্ত্বরূপে জন্ম নিয়ে চলছিলেন সে সময়কার নানা ঘটনা এইসব চিত্রে রূপায়িত করা হয়েছে।
এই বিহারটি থেকে দক্ষিণদিকে অল্প একটুখানি যেতে সূর্যদেবের একটি মন্দির চোখে পড়লো। এর আর একটু দক্ষিণে একটি মহেশ্বর মন্দির। দুটি মন্দিরই বেশ ঝকমকে এক ধরনের নীলরঙা পাথর দিয়ে বানানো। নানারকম উচ্চাঙ্গের ভাস্কর্য মণ্ডিত। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে এ দুটি বুদ্ধের বিহারটির সমান। প্রত্যেকটি মন্দিরে একশো জন লোক রয়েছে তাকে ধোয়ামোছা পরিষ্কার রাখার জন্য। ঢাকের বাজনা, যন্ত্রাদি সহযোগে গান কি দিন কি রাত্রি অষ্টপ্রহর ধরে চলেছে।
এই বিরাট নগরীর দক্ষিণ-পূর্বদিকে ৬ বা ৭ লি মতো গেলে গঙ্গার দক্ষিণ দিকে অশোক রাজার তৈরী ২০০ ফুটের কাছাকাছি উঁচু একটি স্তূপের দর্শন মেলে।
এর পাশে একটি জায়গায় বিগত চার বুদ্ধের বসা ও চলাফেরার চিহ্ন রয়েছে। বুদ্ধদেবের চুল ও নখকণার স্তূপও একটি আছে।
রাজধানীর দক্ষিণ-পূর্বদিকে একশো লির মতো পথ চলার পর আমরা ‘ন- পো-তি-পো-কু-লো’ বা নবদেবকুল শহরে পৌঁছলাম। গঙ্গার পূর্ব-পারে এ শহরটি গড়ে উঠেছে। আয়তন এখন কুড়ি লির কাছাকাছি। এখানে অনেক ফুলের কুঞ্জ রয়েছে। হ্রদও আছে কয়েকটি। টলটলে জলে গাছের ছায়া শিহরণ তুলে চলে।
এ শহরের উত্তর-পশ্চিমদিকে, গঙ্গা নদীর পূর্ব-পারে একটি দেবমন্দির চোখে পড়লো। এর গম্বুজগুলি, থাকথাক চূড়াগুলি নিপুণ কারুকার্যের জন্য উল্লেখ করার মতো। শহরের পূর্বদিকে ৫ লি দূরে তিনটি সংঘারাম। তিনটিই এক ঘেরদেয়ালের মধ্যে। তবে ফটক আলাদা। ৫০০ জনের কাছাকাছি ভিক্ষু থাকেন। সকলেই হীনযানের সর্বাস্তিবাদী শাখার অনুগামী।
সংঘারামের সামনের দিকে ২০০ পায়ের মতো দূরে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ দেখলাম। ভিত দেবে গেছে, তবু এখনো ১০০ ফুটের মতো উঁচু।
সংঘারামের উত্তরে তিন বা চার লি গেলে গঙ্গানদীর তীর ঘেঁষে একটি স্তূপ আছে। দুশো ফুটের মতো উঁচু এই স্তূপটি অশোক রাজার বানানো। তথাগতের চুল ও নখকণার স্তূপও একটি আছে।
॥ ২৮ ॥ ‘ও-যু-তো’ বা অযোধ্যা
নবদেবকুল থেকে প্রায় ৬০০ লি দক্ষিণ-পূর্বদিকে পথ ভাঙলাম। গঙ্গা পার হয়ে দক্ষিণ দিকে চলার পর দর্শন পেলাম ‘ও-যু-তো’ বা অযোধ্যা রাজ্যের।
দেশটি আয়তনে পাঁচ হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানী ২০ লির মতো। এখানে প্রচুর খাদ্যশস্য আবাদ হয়। অনেক ফুল আর ফলের চাষ হয়। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ ও মনোরম। লোকের স্বভাব-চরিত্র সদগুণ সম্পন্ন ও অমায়িক। ধর্মকর্মের দিকে বেশ ঝোঁক রয়েছে। জ্ঞানচর্চ্চার দিকেও অধ্যাবসায়ী।
এরাজ্যে এক কোটির মতো সংঘারাম আছে। ভিক্ষু তিন হাজারের কাছাকাছি। মহাযান ও হীনযান দুয়েরই চর্চ্চা করে থাকেন। দশটি দেবমন্দির রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিধর্মীরা সেখানে থাকে। তবে সংখ্যায় তারা খুব কম।
রাজধানীতে একটি পুরোনো সংঘারাম চোখে পড়লো। বসুবন্ধু বোধিসত্ত্ব এখানে কয়েক দশক ধরে প্রবাসজীবন কাটিয়েছেন। সে সময় তিনি মহাযান ও হীনযান দুই শাখারই নানা শাস্ত্র বই লেখেন। এর পাশে কয়েকটি ভাঙাচোরা ভিত রয়েছে। এখানে একটি মহাকক্ষ ছিল। বসুবন্ধু বোধিসত্ত্ব এখানেই বিভিন্ন দেশের রাজা, পৃথিবীর গণ্যমাণ্য লোক, শ্রমণ ও ব্রাহ্মণদের কাছে নীতি ও ধর্মের ব্যাখ্যান করেন।
শহর থেকে চল্লিশ লি উত্তরদিকে গঙ্গা নদীর কাছে একটি বিরাট সংঘারাম আছে। সেখানে অশোক রাজার বানানো ২০০ ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ দেখলাম।
সংঘারামের চার পাঁচ লি পশ্চিমে একটি স্তূপ আছে। এখানে বুদ্ধের চুল ও নখকণা রাখা হয়েছে। এর উত্তরদিকে একটি ভাঙাচোরা সংঘারামের অবশেষ দেখা যায়। সৌতান্তিক শাখার এক শাস্ত্রাচার্য শ্রীলব্ধ এখানে তাঁদের শাখার বিভাষা শাস্ত্র রচনা করেন।
শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ৫ বা ৬ লি গেলে একটি বেশ বড়োসড় আমবনের মধ্যে একটি পুরোনো সংঘারামের দেখা পাওয়া যাবে। অসঙ্গ বোধিসত্ত্ব (বসুবন্ধুর বড় ভাই) এখানে তাঁর জ্ঞানসাধনায় মগ্ন থেকে তাঁর সমকালীন লোকদের ধর্মনির্দেশ করে গেছেন।
আম-বনানীর উত্তর-পশ্চিমদিকে একশো পা খানেক এগোলে একটি স্তূপ দেখা যাবে। এটিতে বুদ্ধের চুল ও নখকণা রাখা হয়েছে। এর পাশে কতক পুরোনো ভিত রয়েছে। বসুবন্ধু বোধিসত্ত্ব তূষিত সর্গ থেকে নেমে এসে এখানে অসঙ্গ বোধিসত্ত্বকে দেখা দেন। অসঙ্গ বোধিসত্ত্ব কাশ্মীরের লোক ছিলেন। বুদ্ধদেবের নির্বাণ থেকে দশম শতাব্দীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গভীর আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ছিল। অল্পকালের মধ্যেই তিনি বুদ্ধদেবের মতধারাকে আয়ত্ত করেন। প্রবজ্যা নিয়ে প্রথমে তিনি হীনযানের মহিশাসক শাখার উপাসক হন ও পরে মতের বদল করে মহাযানের অনুরক্ত হন। তাঁর ভাই বসুবন্ধু সর্বাস্তিবাদী শাখার অনুগামী ছিলেন ও বিরাট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রগাঢ় বুদ্ধিমত্তা, গভীর জ্ঞান ও বিশেষ সূক্ষ্মদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। অসঙ্গের শিষ্য ছিলেন বুদ্ধসিংহ। তাঁর আচরণ ছিল অপার রহস্যময়। তিনিও উচ্চ প্রতিভাসম্পন্ন ও বিরাট খ্যাতিমান লোক ছিলেন।
অসঙ্গের উপদেশ-মহাকক্ষের শেষ নিদর্শন থেকে উত্তর-পশ্চিমদিকে ৪০ লি মতো যাবার পর একটি পুরোনো সংঘারামের দেখা মেলে। এটি গঙ্গার ঠিক উত্তর- কূলে। এখানে ইট দিয়ে গড়া একশো ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ আছে। এই স্থানটিতে বসেই বসুবন্ধুর মনে প্রথম মহাযান মতধারা অনুশীলনের ইচ্ছা দেখা দেয়। উত্তর ভারত থেকে তিনি এখানে আসেন। অসঙ্গ বোধিসত্ত্ব তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আসছিলেন। এখানে পৌঁছে তাঁদের মধ্যে দেখা ও আলাপ আলোচনা হয়। ওই সময়েই বসুবন্ধুর মনে এই ইচ্ছা জাগে।
॥ ২৯ ॥ ‘ও-য়ে-মো-খি’ বা হয়মুখ
অযোধ্যা থেকে গঙ্গার উত্তর তীর ধরে পূর্বদিকে কমবেশি ৩০০ লি পথ চলবার পর ‘ও-য়ে-মো-খি’ বা হয়মুখ রাজ্যে এসে পৌঁছলাম।
এ রাজ্যটির বিস্তার ২৪০০ থেকে ২৫০০ লির মতো হবে। প্রধান নগরীটি গঙ্গার একেবারে কূলে। পরিধি ২০ লির কাছাকাছি হবে। ফসল ও জলবায়ুর দিক থেকে অযোধ্যার সঙ্গে এখানকার খুব মিল রয়েছে। লোকজনের স্বভাব বেশ সরল ও সৎ গোছের। জ্ঞান ও ধর্মচর্চ্চার দিকে স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে।
এখানে পাঁচটি সংঘারাম আছে। সেখানে প্রায় হাজার খানেক ভিক্ষু থাকেন। তারা হীনযানের সম্মতীয় শাখার অনুগামী। দেবমন্দির আছে মোট দশটি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুগামীরা সেখানে থাকে।
নগরীর দক্ষিণ-পূর্বদিকে, গঙ্গার প্রায় তীর ঘেঁষে একটুখানি গেলেই রাজা অশোকের বানানো একটি স্তূপ চোখে পড়বে। এটি ২০০ ফুটের মতো উঁচু।
এছাড়া আরো একটি পাথরের স্তূপ সেখানে রয়েছে। এটিতে বুদ্ধদেবের চুল ও নখকণা রাখা আছে।
কাছেই একটি সংঘারাম দেখলাম। সেখানে ২০০ জনের মতো ভিক্ষুর বাস। নানা মূল্যবান রত্ন-শোভিত একটি বুদ্ধমূর্তি এখানে দর্শন করলাম। মূর্তিটি এমন মহান ভাব-ব্যঞ্জনাময় যে দেখলে মনে হবে যেন সত্যিই জীবন্ত। সংঘারামটির গম্বুজ ও ঝুলবারান্দাগুলি চমৎকারভাবে তৈরী ও কারুকাজ করা। এগুলি তার চেহারাকে যেন বিশেষ মর্যাদামণ্ডিত করে তুলেছে।
শাস্ত্রাচার্য বুদ্ধদাস অতীতকালে এখানে থেকে সর্বাস্তিবাদ শাখার মহাবিভাষা শাস্ত্র রচনা করেন।