॥ ৪০ ॥ ‘ফো-লি-শি
এবার উত্তর-পূর্বদিকে রওনা হওয়া গেল। ৫০০ লি মতো পথ ভাঙবার পর আমরা ‘ফো-লি-শি’ বা বৃজি রাজ্যে এসে গেলাম।
এ রাজ্যটির আয়তন ৪০০০০ হাজার লির কাছাকাছি। পূর্ব-পশ্চিমদিকে লম্বা, উত্তর-দক্ষিণে সরু। জমি সরস ও উর্বরা। ফল ও ফুল প্রচুর। আবহাওয়া একটু যেন ঠাণ্ডা। লোকেরা চটপটে ও ব্যস্তবাগীশ। এদের বেশির ভাগই অন্য ধর্মী। বুদ্ধের অনুগামী খুবই কম এখানে।
এখানে দশটির মতো সংঘারাম আছে শুনলাম। সেখানে হাজার খানেকের মতো ভিক্ষু আছেন। তাঁরা বেশ উৎসাহের সঙ্গে হীনযান ও মহাযান ও দুয়েরই চর্চ্চা করেন। বেশ কিছু (কয়েক দশ) দেবমন্দির রয়েছে। অন্য ধর্মী উপাসকদের সংখ্যাও বিপুল। রাজ্যের রাজধানীর নাম ‘চেন-শু-নো’ (জনকপুর?)। এটির এখন প্রায় ভাঙা দশা। পুরানো রাজপুরীর সীমানা মধ্যে তবু এখনো প্রায় তিন হাজারের মতো বাড়ী ঘর আছে। এটিকে গ্রামও বলা যেতে পারে; আবার ইচ্ছে করলে
শহরও বলা যেতে পারে।
বড়ো নদীর উত্তর-পূর্বে একটি সংঘারামের দেখা পেলাম। ভিক্ষুর সংখ্যা রীতিমতো অল্প। তারা বেশ অধ্যবসায়ী, নিষ্ঠাবান ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন চরিত্রের
এখান থেকে নদীর কূল বরাবর পশ্চিমদিকে গেলে তিরিশ ফুট খানেক খাড়া একটি স্তূপ দেখা যাবে। এর দক্ষিণদিকে গভীর জলের খাড়ি। করুণাময় ভগবান বুদ্ধ এখানে কতক জেলেকে ধর্মের অনুগামী করেন।
এখান থেকে উত্তরদিকে ১৪০ বা ১৫০ পা মতো এগিয়ে যেতে একটি ছোট স্তূপের দেখা পাওয়া গেল। বুদ্ধদেব এখানে বসে ভিক্ষুদের জন্য কতক শৃঙ্খলাবিধি রচনা ও প্রচলন করেন। এরপর একটুখানি গেলেই চুল ও নখকণার একটি স্তূপ আছে।
॥ ৪১ ॥ ‘নি-পো-লো’
এখান থেকে উত্তর-পশ্চিমদিকে এবার পথ চলা শুরু করলাম। বেশ কয়েকটা পাহাড় ডিঙোবার পর উপত্যকার দেখা পেলাম। এভাবে ১৪০০ থেকে ১৫০০ লি পথ চলার পর নেপাল পৌঁছানো গেল।
নেপাল রাজ্যটির আয়তন ৪০০০ লি মতন হবে। তুষারাবৃত পর্বতমালার মধ্যে দেশটি অবস্থিত। রাজধানীর ঘের মোটামুটি ২০ লি খানেক হবে। পাহাড় আর উপত্যকা একটানা পর পর ছড়িয়ে আছে। দেশটি খাদ্য শস্যের চাষ-আবাদে অভ্যস্ত। ফুল আর ফলও যথেষ্ট পরিমাণে ফলে। এখানে দেশী তামা পাওয়া যায়। এছাড়া চমরী গাই ও জীবঞ্জীব পাখিও রয়েছে।
লেন দেন ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তারা দেশী তামার মুদ্রা ব্যবহার করে। আবহাওয়া একেবারে হিমেল। লোকের আচার-আচরণ মিথ্যাচার ও বিশ্বাস- ঘাতকতা প্রবণ। মেজাজ রুক্ষ ও উগ্র। সত্য কথা বা শ্রদ্ধা-সম্মানের ধার ধারে না। এরা অশিক্ষিত হলেও নানা শিল্পকর্মে পটু। তাদের চেহারা বিশ্রী, দেখলেই মন বিগড়ে ওঠে।
সত্য ধর্মের অনুগামী ও অন্য ধর্মী দুইই আছে এখানে। সংঘারাম আর দেবমন্দির দুইই একেবারে পাশাপাশি। এখানকার সংঘারামগুলিতে দু’হাজারের মতন ভিক্ষু থাকেন। হীনযান ও মহাযান দুয়েরই চর্চ্চা করেন তারা। অন্য ধর্মী ও তাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর উপাসকদের সংখ্যা ঠিক বলতে পারলাম না।
রাজা ক্ষত্রিয় বর্ণের লোক। তিনি লিচ্ছবী বংশে জন্মেছেন। বেশ লেখাপড়া জানেন, ভাল খবরাখবর রাখেন। নিষ্ঠাবান ও মর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ। বৌদ্ধধর্মের প্রতি তার গভীর অনুরাগ রয়েছে।
আগে এখানে অংশুবর্মণ নামে এক রাজা ছিলেন। বিদ্বান ও চতুর হিসাবে তাঁর বেশ নাম ডাক ছিল। শব্দ বিদ্যার উপর তিনি একখানি বই লিখে গেছেন। জ্ঞান ও সদ্গুণকে তিনি বিশেষ চোখে দেখতেন। তার খ্যাতি ও সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
রাজধানীর দক্ষিণ-পূর্বে একটি ছোট নদী আছে। একটি হ্রদও রয়েছে। এগুলিতে যদি আগুন ছুঁয়ে দেয়া যায় তবে সঙ্গে সঙ্গে তা জ্বলে ওঠে। অন্যান্য জিনিষ এর মধ্যে ছুঁড়ে দিলে তাতেও আগুন ধরে যায় ও তার গুণ পালটে যায়। *
[* হিউয়েন সাঙ নেপাল গিয়েছিলেন বলে মনে হয় না।]
॥ ৪২ ॥ মগধ
নেপাল থেকে বৈশালী ফিরে গেলাম। গঙ্গা নদী পেরিয়ে তার দক্ষিণ তীরের দিকে চলে এলাম। তারপর সেখান থেকে মগধে এসে হাজির হলাম।
মগধ দেশটির আয়তন ৫০০০ লির কাছাকাছি হবে। দেয়াল ঘেরা নগরগুলিতে অল্প লোকের বাস। কিন্তু শহরগুলিতে বেশ ঘন বসতি। জমি সরস ও উর্বরা। ফসলের ফলন প্রচুর। এখানে এক বিশেষ ধরনের চাল জন্মায়। এগুলির আকার বেশ বড়ো, সুগন্ধি আর খেতেও চমৎকার। চিকচিকে রঙের জন্য এই চাল মন কাড়ে। একে সাধারণতঃ ‘বড়ো লোকদের খাবার চাল’ বলা হয় (নহাশলী বা সুগন্ধিকা)। জমি নিচু আর স্যাঁতসেঁতে বলে শহরগুলি উঁচু জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে। গ্রীষ্ম ঋতুর প্রথম মাসের পর থেকে, শরৎ ঋতুর দ্বিতীয় মাসের আগ পর্যন্ত সমতল ভূমি বন্যার জলে ডুবে থাকে। নৌকার সাহায্যে যাতায়াত, ও যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। লোকজনের আচার-আচরণ সরল ও সৎ। আবহাওয়া বেশ গরম। জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টাকে তারা বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অগাধ ভক্তি।
এখানে পঞ্চাশটির মতো সংঘারাম রয়েছে। সেখানে প্রায় দশ হাজারের কাছাকাছি ভিক্ষু থাকেন। বেশির ভাগই মহাযানের অনুগামী।
দশটি দেবমন্দির আছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর উপাসকেরা সেখানে থাকেন। তাদের সংখ্যা বেশ নজরে পড়ার মতো।
গঙ্গা নদীর দক্ষিণ কূলে একটি পুরানো শহর আছে। এর আয়তন ৭০ লি মতন হবে। যদিও বহুকাল ধরে এখানে আর লোকজন বসবাস করে না তবুও এর ভিতদেয়ালগুলো এখনো খাড়া রয়েছে। যে যুগে মানুষ অনেক অনেক কাল বেঁচে থাকতো, সে যুগে এই শহরটিকে কুসুমপুর বলা হতো। রাজপুরী অসংখ্য ফুলে ভরা ছিল বলেই শহরের এ নাম। যখন মানুষের আয়ু মাত্র কয়েক হাজার বছরে নেমে এল সে সময় এর নাম বদলে রাখা হলো পাটলীপুত্র।
.
যখন কুসুমপুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনা হল তখন এই শহরটিকে রাজধানী করা হলো।*
[* অর্থাৎ মূল পাটলিপুত্র কুসুমপুর থেকে একটু দূরে গড়ে ওঠে। পরে সম্ভবতঃ দু’টি শহর একাকার হয়ে যায় ও পাটলিপুত্র নামে পরিচিত হয়।
পুরানো রাজপ্রাসাদের উত্তরদিকে বেশ কিছুটা (কয়েক দশ ফুট) উঁচু একটি স্তম্ভ আছে। এই জায়গাটিতেই রাজা অশোকের ‘নরক পুরী’টি গড়া হয়েছিল। তথাগতের মৃত্যুর ১০০ বছর পরে অশোক নামে এক রাজা রাজত্ব করেন। তিনি বিম্বিসার রাজার প্রপৌত্র ছিলেন। তিনি তার রাজধানী রাজগৃহ থেকে পাটলিপুত্র সরিয়ে আনেন। পুরানো শহরকে তিনি দেয়াল তুলে ঘিরে দেন। তারপর অনেক পুরুষ কেটে গেছে। এখন শহরটির পুরানো ভিতদেয়ালই শুধু যা টিকে আছে। শয়ে শয়ে সংঘারাম, দেবমন্দির ও স্তূপের ধ্বংসাবশেষ চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। দু’তিনটি মাত্র পুরোপুরি খাড়া আছে। পুরানো রাজপ্রাসাদের উত্তরে, গঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে একটি ছোট শহর রয়েছে। সেখানে হাজারখানেক বাড়ি ঘর দেখা যায়।
অশোকের গড়া নরক থেকে একটুখানি দক্ষিণে একটি স্তূপ আছে। এর ভিত বসে গিয়ে পুরো স্তূপটি হেলে পড়েছে ও ভেঙে চলেছে। তার গম্বুজের শীর্ষচূড়াটি কিন্তু এখনো টিকে আছে। এটি খোদাই করা পাথরের তৈরী ও পিলপে দিয়ে ঘেরা। এটি ৮৪০০০টি স্তূপের মধ্যে প্রথম (বা একটি)। অশোক রাজা তার রাজপুরী মধ্যে মানব শিল্পীদের দিয়ে এটি গড়েন। এতে এক চিং ching পরিমাণ বুদ্ধদেবের দেহাবশেষ রয়েছে।
স্তূপটির অদূরে একটি বিহার মধ্যে একটি বড়ো পাথর আছে। এর উপর বুদ্ধ চলাফেরা করেছেন। এখনো তাতে তার দু’ পায়ের ছাপ রয়েছে। এই ছাপ ১৮ ইঞ্চি লম্বা ও ৬ ইঞ্চি চওড়া। দুটি ছাপেই চক্র চিহ্ন আছে। দশটি আঙ্গুলের প্রান্তে পুষ্প ও মৎস্য চিহ্ন বর্তমান। এগুলি আলোয় ঝিক্মিক্ করছে।
অতীতকালে বুদ্ধের নির্বাণ লাভ কাল ঘনিয়ে এলে তিনি উত্তরদিকে কুশীনগর যাত্রা করেন। তখন দক্ষিণদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, মগধের দিকে চেয়ে এই পাথরটির উপর তিনি উঠে দাঁড়ান। তারপর আনন্দকে বলেন-’আমি আমার শেষ চরণচিহ্ন এখানে রেখে গেলাম’। মগধের দিকে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন-’এখন থেকে ১০০ বছর পরে অশোক নামে এক রাজা জন্ম নেবে। সে এখানে তার রাজধানী গড়বে ও রাজসভা বসাবে। সে ধর্মীয় ত্রি-রত্নের পৃষ্ঠপোষক হবে’।
রাজা অশোক সিংহাসনে আরোহণের পর রাজধানী পরিবর্তন করলেন ও এই শহরটি গড়লেন। বুদ্ধের চরণচিহ্ন আঁকা এই পাথরটিকে ঘিরেও তিনি এক বিহার গড়লেন। এটি রাজপুরীর কাছে থাকার দরুন তিনি নিয়মিত এখানে এসে পূজা দিতেন। পরে প্রতিবেশী রাজ্যের রাজারা এটিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। পাথরটি অতি বড়ো না হওয়া সত্ত্বেও তারা এটিকে এখান থেকে এক পা-ও নড়াতে পারলেন না।
সবশেষে রাজা শশাঙ্কের দৃষ্টি পড়লো এদিকে। তিনি তখন বৌদ্ধধর্মের উৎখাত ক’রে চলেছেন। সমস্ত পবিত্র স্মারক নষ্ট ক’রে তিনি এটিকে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। কিন্তু এটি আবার জুড়ে গিয়ে এক হয়ে গেল। ছাপ একেবারে আগের মতোই থাকল। তখন তিনি গঙ্গা নদীর মধ্যে এটিকে ফেলে দিলেন। কিন্তু এটি আবার তার পুরানো জায়গায় ফিরে এলো।
এই পাথরটির পাশেই একটি স্তূপ আছে। বিগত চার বুদ্ধ যেখানে ওঠাবসা ও চলাফেরা করতেন সেখানে এটি গড়া হয়েছে। তাদের সে-সব চিহ্ন এখনো আছে।
বুদ্ধের পদচিহ্ন থাকা বিহারটি থেকে একটুখানি গেলেই ৩০ ফুট মতো উঁচু একটি বড়ো পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। এটিতে এক খোদাই বিবরণ আছে। বিবরণটিকে ক্ষত-বিক্ষত ক’রে ফেলা হয়েছে। এর মূল বক্তব্য মোটামুটি এই— “অশোক রাজা বুদ্ধের মতবাদের প্রতি গভীর অনুরক্ত হয়ে তাকে এই জম্বুদ্বীপ তিনবার ধর্মার্ঘ নিবেদন করেন ও ধনরত্ন দিয়ে তিনবার তাকে আবার কিনে নেন।”
পুরানো রাজপ্রাসাদের উত্তরদিকে একটি বিশাল পাথরের বাড়ি আছে। বাইরে থেকে এটিকে একটি বড়ো পাহাড়ের মতো দেখায়। এর ভিতরটা খুব লম্বা চওড়া (কয়েক দশ ফুট প্রশস্ত)। রাজা অশোক তার ভাইয়ের জন্য দানোদের দিয়ে এটি বানিয়ে দেন। তার এই ভাইয়ের নাম মহেন্দ্র। ইনি অশোকের সৎভাই ছিলেন। প্রথম জীবনে ইনি অতি বিলাসী ও উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন। এজন্য প্রজারা পর্যন্ত রাজার কাছে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করেন। পরে ইনি সম্পূর্ণ পালটে যান। সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ ক’রে উচ্চ সাধনার দ্বারা অহতত্ত্ব লাভ করেন। তার বসবাসের জন্য এরপর রাজা অশোক এটি তৈরী করেন।
পুরানো রাজপ্রাসাদের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি ছোট পাহাড় আছে। পাহাড়ের চূড়াগুলিতে ও চারিদিককার উপত্যকায় অনেকগুলি (কয়েক দশ) পাথরের কক্ষ রয়েছে। উপগুপ্ত ও অন্যান্য অহৎদের থাকার জন্য রাজা অশোক দানোদের দিয়ে এগুলি বানিয়ে দেন।
পাশেই একটি বুরুজ দেখলাম। অনেক পুরানো। এখন এটি ভেঙে গিয়ে পাথরগাদা হয়ে পড়ে রয়েছে। পাশে একটি পুকুর। আয়নার মতো টলটলে জলের বুকে মাঝে মাঝে বুদবুদের ধীর আলোড়ন। লোকেরা একে একটি পবিত্র জলাধার বলে মনে করে। যদি কেউ এর জল পান করে বা এখানে স্নান করে তার সব পাপ-তাপ ধুয়ে মুছে যায়।
পাহাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে একটি জায়গায় পাঁচটি স্তূপ রয়েছে। এগুলি অনেক উঁচু ক’রে গড়া হয়ে থাকলেও এখন ভাঙা দশা। এ সত্ত্বেও এখনো এগুলি বেশ উঁচু। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন ছোট ছোট পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটিই সামনের দিকে অনেকখানি ক’রে জায়গা জুড়ে রয়েছে। পরের যুগে এর মাথায় ছোট ছোট স্তূপ বানাবার চেষ্টা করা হয়েছে। ভারতের ইতিহাস মধ্যে এ সম্পর্কে এরকম এক বিবরণ রয়েছে : আগের কালে রাজা অশোক ৮৪০০০ স্তূপ বানান। এগুলি শেষ হবার পর তিনি দেখলেন যে, আরো পাঁচ কুনকে দেহাবশেষ এখনো রয়ে গেছে। তখন তিনি বিশেষভাবে দেখার মতো ক’রে ভিন্ন শৈলীর আরো পাঁচটি স্তূপ বানান। এগুলি বুদ্ধদেবের পঞ্চবিধ আধ্যাত্মিক প্রতীক (রূপ, বেদনা, সজ্ঞান, সংস্কার, বিজ্ঞান)। কিছু সন্ধিগ্ধমনা ব্যক্তি পরবর্তীকালে এইরকম কানাঘুষা শুরু করেছিল যে, পুরাকালে নন্দ রাজা তার ধনরত্ন রাখার জন্য এগুলি তৈরী করেছিলেন। এই কানাঘুষার ফলে একজন অধার্মিক রাজা ধনলোভে সসৈন্যে এখানে এলেন ও এগুলি খনন করতে শুরু করলেন। এর ফলে ভূমিকম্প দেখা দিল, পাহাড় টলোমলো হলো, কালো মেঘে সূর্য ঢেকে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। স্তূপের মধ্য থেকে বজ্রধ্বনির মতো গভীর নাদ ভেসে এলো। সৈন্যসামন্ত ও তাদের নায়কেরা সব চিৎপাত হয়ে উল্টে পড়লো। হাতি- ঘোড়ার দল প্রাণ ভয়ে এদিক ওদিক ছুটে পালালো। এরকম দুর্দশা হবার পর রাজার ধনলোভ ছুটে গেল। তিনি আর এগুলি খুঁড়তে সাহস করলেন না।
বিবরণে আরো বলা হয়েছে যে, “এই কাহিনীকে ভিক্ষুদের গালগল্প বলে উড়িয়ে দেয়া হয়, কিন্তু পুরানো প্রবাদ থেকে সত্য বলেই মনে হয়।”
পুরানো শহরের দক্ষিণ-পূর্বে কুক্কুটরাম নামে একটি সংঘারাম আছে। রাজা অশোক বুদ্ধের অনুরাগী হবার পর প্রথম এটি গড়েন। এটি তার প্রথম পুণ্য বৃক্ষ রোপণ ও মহান স্থাপত্য নিদর্শন রচনার প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করা যেতে পারে। তিনি সেখানে ১০০০ ভিক্ষুর থাকার ব্যবস্থা করেন। এদের প্রয়োজনের সব জিনিসই উদারভাবে জুগিয়ে দেয়া হতো। এই দালানটি অনেক কাল হলো ভেঙেচুরে গেছে। তবে ভিতগুলি এখনো টিকে আছে।
সংঘারামের পাশেই একটি বড়ো স্তূপ। এটির নাম আমলক স্তূপ। আমলক ফলটি ভারতে ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। রাজা অশোক একবার খুব অসুখে পড়েন। অনেককাল রোগে ভোগার পর ধরে নিলেন যে তিনি আর বাঁচবেন না। তাই তার যা কিছু সম্পদ বন পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য দান করবেন বলে ঠিক করলেন। রাজার এ ইচ্ছা মন্ত্রীর মনপুতঃ হলোনা বলে তিনি তা কার্যকর করতে চাইলেন না। একদিন তিনি উদ্দেশ্যমূলক ভাবে একটি আমলক ফলের আধখানা নিজে খেয়ে বাকি আধখানা দান করার জন্য রাজার হাতে দিলেন। ফলটি নিজের হাতে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজা মন্ত্রীকে শুধালেন— ‘জম্বু দ্বীপের রাজা এখন কে? মন্ত্রী উত্তরে বললেন— ‘একা আপনি’। রাজা বললেন— ‘না, এ সাম্রাজ্য এখন আর আমার নয়। আমি শেষ বয়সে একজন মন্ত্রীর হাতের পুতুল। এখন আমার বলতে শুধু এই আধখানা আমলক ফল।’
এরপর রাজা একজন পার্শ্বচরের হাতে ওই আধখানা আমলক দিয়ে বললেন যাও, কুক্কুটরামের ভিক্ষুদের এটি দিয়ে বলে এসো, এতকাল যিনি জম্বুদ্বীপের রাজা ছিলেন এখন তিনি মাত্র এই আধখানা আমলকের অধিপতি। তাই তিনি এটি পাঠিয়ে দিয়ে জানিয়েছেন, আপনারা অনুগ্রহ ক’রে, তার এই শেষ শ্ৰদ্ধাৰ্ঘ গ্ৰহণ করুন।
পার্শ্বচরের মুখে একথা শুনে ভিক্ষুদের স্থবির বললেন— ‘রাজা তার পূর্ব- পুণ্যফলে ভাল হয়ে উঠবেন। তিনি অসুস্থ বলে, লোভী মন্ত্রীরা তার ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে ও ধনসম্পদ আত্মসাৎ করতে চাইছে। কিন্তু এই আধখানা আমলক ফলদান থেকেই রাজা আরো আয়ু পাবেন।
রাজা সেরে উঠে ভিক্ষুদের নানা উপহার নিবেদন করলেন। সংঘারামের পরিচালক (কর্মদান)-কে উপযুক্ত পাত্রে ওই ফলের বীজ সংরক্ষণ করার আদেশ দিলেন। এছাড়া আয়ুলাভের জন্য কৃতজ্ঞতার নিদর্শনরূপে এই স্তূপটিও এখানে গড়লেন।
আমলক স্তূপের উত্তর-পশ্চিমে একটি পুরানো সংঘারামের মধ্যে একটি স্তূপ দেখা যাবে। এটির নাম ‘ঘণ্টাধ্বনি প্রবর্তন’। প্রথমদিকে এ শহরটিতে একশোটির মতো সংঘারাম ছিল। ভিক্ষুরা জ্ঞানী ও মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। নৈতিক চরিত্রও উঁচু মানের ছিল। অন্যধর্মী পণ্ডিতদের তাঁরা চুপচাপ বোবা ক’রে রেখেছিলেন। সে পুরুষ কাল গত হবার পর যাঁরা এলেন, তাঁরা তাঁদের মতো হলেন না। এই সুযোগে অন্যধর্মীরা সংঘারামগুলির মধ্যে প্রবেশ ক’রে ঘণ্টাধ্বনি দিয়ে তাদের বিতর্ক যুদ্ধে আহ্বান করলো। তাঁরা রাজাকে বিচারক মানলেন। মূর্খ ভিক্ষুরা অন্যধর্মীদের কাছে পরাস্ত হলো। তখন বিজয় পুরস্কার রূপে তারা রাজার কাছে দাবী করলো যে, ভবিষ্যতে কোন সংঘারাম আর ঘণ্টা বাজিয়ে বিতর্ক সমাবেশ আহ্বান করতে পারবে না। রাজা তাদের সে দাবী মেনে নিয়ে ভিক্ষুদের উপর সেইরূপ শাস্তি আরোপ করলেন। ফলে ১২ বছর ধরে ঘণ্টা নীরব হয়ে থাকলো।
এই সময়ে দক্ষিণ ভারতে নাগার্জুন বোধিসত্ত্ব থাকতেন। তিনি তখন যুবক। পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁর তখন বিরাট খ্যাতি। উচ্চ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ভোগ বিলাস ও সংসার ত্যাগ ক’রে জ্ঞানের পরম সাধনা শুরু করেন ও তার শীর্ষ চূড়ায় ওঠেন। দেব নামে তার একজন শিষ্য ছিল। তিনিও জ্ঞান বুদ্ধির দিক থেকে বিরাট ছিলেন। আধ্যাত্মিক শক্তিও প্রবল ছিল। তিনি অধীর হয়ে বললেন— বৈশালীতে বুদ্ধের অনুগামীরা বিধর্মীদের কাছে হেরে গিয়ে বারো বছর ধরে কোন ঘণ্টাধ্বনি করেনি। বিধর্মীদের হার মানিয়ে আবার সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের আলোক শিখা জ্বালাবো।’
একথা শুনে নাগার্জুন বললেন—বৈশালীর বিধর্মীরা অনন্য পণ্ডিত। তাদের সঙ্গে এঁটে ওঠার মতো যোগ্যতা তোমার এখনো হয়নি। চলো, আমি নিজেই যাবো।’
দেব উত্তর দিলেন-কতকগুলি আগাছাকে দ’লে দেবার জন্য কেন আমরা পাহাড় ছুঁড়তে যাবো। আমি যতটুকু শিক্ষা পেয়েছি তা-ই তাদের চুপ করিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। অন্তত আমার নিজের সেই রকমই ধারণা। আচার্য বরং বিধর্মীদের পক্ষ নিয়ে যুক্তি করুন। আমি আপনার সব যুক্তি তাত্ত্বিকভাবে খণ্ডন করাবার চেষ্টা করবো। এর ফলাফল কি হয় দেখুন। তারপর না হয় ঠিক করবেন আমি যাবো কি যাবো না।’
নাগার্জুন তখন বিধর্মীদের পক্ষ নিয়ে যুক্তি শুরু করলেন ও দেব তা একে একে কেটে চললেন। এভাবে সাতদিন তর্ক চলার পর নাগার্জুন দেবের কাছে হার মানলেন। তিনি তখন দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন— মিথ্যা বুনিয়াদের উপর কোন কিছু বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। তাই ভুল মতবাদের পক্ষ নিয়ে লড়াই করা শক্ত। দেব, তুমিই তাদের হারাতে পারবে।’
দেব তখন বৈশালী যাত্রা করলেন।
দেব আসছেন খবর পেয়ে বৈশালীর বিধর্মীরা রাজাকে প্রভাবিত ক’রে এরূপ আদেশ জারী করলেন যে, অন্য রাজ্যের কোন বৌদ্ধ শ্রমণ এরাজ্যে আসতে পারবে না।
দেব তখন বৌদ্ধ ভিক্ষুবেশ ত্যাগ ক’রে অন্য বেশে শহরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু সংঘারামে কেউ তাঁর পরিচিত না থাকায় সেখানে রাতের আশ্রয় জুটলো না। বাধ্য হয়ে ঘণ্টা স্তূপে তিনি রাত কাটালেন ও পরদিন খুব ভোরে উঠে প্রাণপণ ঘণ্টা বাজিয়ে চললেন। চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। ভিক্ষুরা যখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, আগন্তুক একজন বিদেশাগত ভিক্ষু, তখন তাঁরা উৎসাহের সঙ্গে সমস্ত সংঘারাম থেকে ঘণ্টাধ্বনি শুরু করলেন।
রাজার লোকেরা যখন এজন্য জবাবদিহি চাইলেন, দেব উত্তর দিলেন— সমাবেশের জন্য ঘণ্টাধ্বনি করা হয়েছে। এছাড়া আর কিসের জন্য ঘণ্টাধ্বনি করা হয়?’
রাজ-কর্মচারীরা বললেন— ‘আগের কালে তর্কযুদ্ধে হেরে যাবার দরুন ঘণ্টাধ্বনি করা বারণ হয়ে গেছে। ১২ বছর সেই মতোই কেটেছে।’
দেব বললেন— “তাই নাকি! তবে আমি নতুন করে ধর্মভেরী বাজালাম।’ দূত গিয়ে রাজার কাছে একথা নিবেদন করলো।
রাজা সমাবেশের আয়োজন করলেন। সর্ত দিলেন যে পক্ষ পরাজিত হবে তাকে মেরে ফেলা হবে।
এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে দেব অন্য ধর্মীদের পরাস্ত করলেন।
রাজা ও তাঁর মন্ত্রীবর্গেরা খুশী হয়ে দেবের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য এই স্মারকটি গড়েন।
যেখানে ঘণ্টাধ্বনি করা হয়েছিল সেখানে তৈরী স্তূপটির উত্তরদিকে একটি পুরানো ভিত রয়েছে। এখানে এক প্রেতসিদ্ধ ব্রাহ্মণের বাস ছিল। প্রেতসিদ্ধ বলে সে সবাইকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে খ্যাতি লাভ করে। কিন্তু অশ্বঘোষ বোধিসত্ত্ব তাকে শেষ পর্যন্ত পরাজিত করেন।
পুরানো সংঘারামের দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ১০০ লি মতো গেলে তিলডক সংঘারামের দেখা পাওয়া যাবে। এখানে চারিটি মহাকক্ষ, ত্রিতল দর্শন মঞ্চ ও বুরুজ সব রয়েছে। বুরুজগুলি কিছুটা অন্তর অন্তর জোড়া-দরজা দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে যোগ করা; এই দরজাগুলি ভিতরের দিকে খোলে। বিম্বিসার রাজার শেষ বংশধর এটি গড়েন। ধর্ম ও সদগুণ বিস্তারে উচ্চ প্রতিভা বিকশিত করার জন্য তিনি অনেক কিছু করেন। কাছের ও দূরের বিভিন্ন শহর থেকে জ্ঞানীগুণীরা দল বেঁধে এখানে আসতেন ও এই সংঘারামে বাস করতেন।
এখন এই সংঘারামটিতে হাজারজন ভিক্ষু থাকেন। সকলেই মহাযানের অনুগামী। এর মাঝের ফটকটির সামনের রাস্তায় তিনটি বিহার আছে। এগুলির শীর্ষে পর পর যুক্ত থাকা ধাতুবলয়ের ঘের রয়েছে। বলয়গুলি যেন শূন্যে ঝোলানো। সেগুলিতে আবার ঘণ্টা আটকানো রয়েছে। বিহার তিনটিকে আগাগোড়া ধাপ ধাপ সাজিয়ে বসানো হয়েছে। তাদের চারিদিকে লোহার বেষ্টনী রয়েছে। দরজা, জানালা, থাম, কড়িকাঠ ও সিঁড়ি সব জায়গায় গিলটি করা, তামা দিয়ে উচল ভাস্কর্য করা ও ফাঁকগুলি অতি সুন্দর কারুকাজে ভরা। মাঝের বিহারটিতে তিরিশ ফুট মতো উঁচু একটি দাঁড়ানো বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। বাঁদিকের বিহারে তারা বোধিসত্ত্বের মূর্তি, ডাইনের বিহারে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের মূর্তি। এ মূর্তি দুটি ধাতু পাথর দিয়ে তৈরী। তাদের আধ্যাত্মিক ভাবব্যঞ্জক চেহারা এক অদ্ভুত ও বিস্ময় মেশানো ভাব জাগায় ও তা মনে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি বিহারে এক কুনক করে দেহাবশেষ রয়েছে।
তিলডক সংঘারামের দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে প্রায় ৯০ লির কাছাকাছি যাবার পর আমরা একটি বিরাট পাহাড়ের দেখা পাই। এর চূড়াগুলি নীল মেঘে ঘেরা ও বুক জুড়ে ছায়া-আঁধার জাগানো ঘন বন জঙ্গলের সমারোহ। এটি দেবর্ষিদের এক বিচরণ কেন্দ্র। দুর্দান্ত প্রকৃতির নাগেরা ও বিষাক্ত সাপ এখানকার গুহা মধ্যে বাস করে। অসংখ্য পশু ও শিকারযোগ্য পাখি এই অরণ্য মধ্যে থাকে। পাহাড় চূড়ায় একটি বিশেষ উল্লেখ করার মতো বড় পাথর আছে। এর উপর দশ ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ রয়েছে। বুদ্ধদেব এখানে সমাধিগ্রস্ত হন। পুরাকালে তথাগত যখন বায়ুদেহে বা সূক্ষ্ম শরীরে জন্ম গ্রহণের জন্য অবতরণ করেন তখন তিনি এই পাথরের উপর বিশ্রাম নেন। ঐ সময়ে তিনি এখানে ‘পূৰ্ণলীন’ সমাধিগ্রস্ত হয়ে সারারাত কাটান। দেবতা ও মুনি-ঋষিরা তখন তথাগতকে পূজার্ঘ নিবেদন করেন। স্বর্গ থেকে সুমধুর সঙ্গীত ও তালে তালে বাজনার ধ্বনি ভেসে আসতে থাকে ও সাথে সাথে পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। তথাগত চলে যাবার পর দেবতারা তাকে পূজার্থ নিবেদনের জন্য সোনা রূপা ও দামী দামী রত্ন পাথর দিয়ে একটি স্তূপ তৈরী করলেন। তারপর অনেক কাল পার হয়ে যাবার দরুন স্তূপটি এখন পাথরে পালটে গেছে।
পাহাড়টির পূর্বদিকের চূড়ায় একটি স্তূপ আছে। একসময়ে তথাগত এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মগধদেশ অবলোকন করেন।
পর্বতটি থেকে উত্তর-পশ্চিমে ৩০ লির কাছাকাছি গেলে একটি পাহাড়ের ঢালের দিকে একটি সংঘারাম রয়েছে। এটি একটি ছোট খাড়া পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এর উঁচু দেয়াল ও বুরুজগুলি পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। পঞ্চাশজনের মত ভিক্ষু এখানে থাকেন দেখলাম। সকলেই মহাযানের অনুগামী। গুণমতি বোধিসত্ত্ব এখানেই বিধর্মীদের পরাজিত করেন।
এখান থেকে ২০ লি মতো দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে গেলে আমরা একটি নিরালা পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়াই। এখানে শীলভদ্র নামে একটি সংঘারাম আছে। শাস্ত্রাচার্য শীলভদ্র তর্কযুদ্ধে বিজয় লাভ করে যে শহরটি দান হিসেবে পান তার অর্থ দিয়ে এটি তৈরী করা হয়েছে। এখানে বুদ্ধের কিছু পূতাস্থি আছে। শাস্ত্রাচার্য সমতট রাজপরিবারের বংশধর। জাতিতে ব্রাহ্মণ। তিনি জ্ঞানপ্রিয় ছিলেন ও ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ধর্মীয় সত্যের সন্ধানে ভারত ভ্রমণ শুরু করেন ও এরাজ্যে এসে পড়েন। নালন্দা সংঘারামে এসে হঠাৎ তিনি ধর্মপাল বোধিসত্ত্বের দেখা পান। তাঁর ধর্ম ব্যাখ্যা শুনে শীলভদ্রের উপলব্ধি জন্মাল ও তাঁকে শিষ্য করে নিলেন। এরপর শীলভদ্র অতি সূক্ষ্ম প্রশ্ন সমূহের সমাধান খোঁজেন ও এ সম্পর্কে সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পদ্ধতি নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। এভাবে তিনি জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার চরম শিখরে পৌঁছান ও সমকালীন দেশ-বিদেশের লোকদের মধ্যে খ্যাতি লাভ করেন।
দক্ষিণ দেশে একজন বিধর্মী পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ধর্মপালের খ্যাতি শুনে তাঁকে হারিয়ে দেবার জন্য আসেন। ধর্মপাল তাঁর সঙ্গে তর্কের লড়াইয়ে নামতে গেলে শিষ্য শীলভদ্র তাঁকে বাধা দিলেন ও তাঁর মুখোমুখি হবার জন্য গুরুর কাছে অনুমতি চাইলেন। ধর্মপাল রাজি হলেন। শীলভদ্র তর্কযুদ্ধে বিধর্মী পণ্ডিতকে হারিয়ে দিলেন। রাজা মুগ্ধ হয়ে তাঁকে এই শহরের রাজস্ব দান করলেন। শীলভদ্র প্রথমে এ দান নিতে ঘোর আপত্তি জানান। কিন্তু পরে রাজার একান্ত আগ্রহের দরুন তা গ্রহণ করেন। সেই রাজস্ব দিয়ে এই বিরাট ও চমৎকার সংঘারামটি বানান।
শীলভদ্র সংঘারামটি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লি পথ হাঁটার পর নৈরঞ্জনা নদী (বর্তমান ফল্গু নদী) পার হয়ে গয়া শহরে এসে পৌঁছলাম। এই শহরটি পাহাড় ঘেরা বলে প্রাকৃতিক ভাবেই সুরক্ষিত। জনবসতি খুবই কম। কেবল হাজার খানেক মতো ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করেন। তাঁরা একজন ঋষির বংশধর। রাজা তাঁদের নিজের অধীন প্রজা বলে মনে করেন না ও প্রত্যেক রাজ্যের লোকেরা তাঁদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন।
এ শহরটির উত্তরদিকে ৩০ লি মতো গিয়ে একটি নির্মল জলের প্রস্রবণ দেখতে পেলাম। ভারতীয় পরম্পরা অনুসারে এটি একটি পবিত্র জলাধার। যাঁরা এর জল পান করেন বা এখানে স্নান করেন তাঁদের সব পাপ ধুয়ে মুছে যায়।
শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমদিক ৫ থেকে ৬ লি মতো দূরে গয়া পর্বত তার ছায়া আঁধার মাখা উপত্যকা, খর বয়ে চলা একাধিক নদী আর খাড়াই ও বিপদসঙ্কুল চূড়াগুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতে এই পাহাড়টির চালু নাম হলো ধর্মপাহাড়। এ দেশের রাজা প্রজাদের আনুগত্য ও শ্রদ্ধা লাভ এবং বিগত রাজাদের চেয়ে বেশি খ্যাতি লাভের জন্য এই পাহাড়ে এসে ধর্মানুষ্ঠানসহ সিংহাসনে অভিষিক্ত হন। এখানকার রাজবংশ মধ্যে এই প্রথা বহুকাল ধরে চলে আসছে। এই পর্বতের শীর্ষে একশো ফুট উঁচু একটা স্তূপ আছে। রাজা অশোক এটিকে গড়েন।
গয়া পর্বতের দক্ষিণ-পূর্বে একটি স্তূপ রয়েছে। কাশ্যপ এখানে জন্ম নেন। এর দক্ষিণে আরো দুটি স্তূপ আছে। এখানে গয়া কাশ্যপ ও নান্দী কাশ্যপ অগ্নি উপাসক রূপে যাগযজ্ঞ করতেন।
গয়া কাশ্যপ যেখানে যাগযজ্ঞ করতেন সেখান থেকে পূর্বদিকে একটি বড়ো নদী পার হয়ে প্রাগ্বোধি পাহাড়ে এলাম। তথাগত ছ’বছর কৃচ্ছ সাধনা করে সেপথে পরম জ্ঞানের আলোক না পেয়ে তা ছেড়ে দিয়ে সুজাতার দেয়া পায়সান্ন খেলেন। তারপর উত্তরদিকে যেতে যেতে এই পাহাড়টি চোখে পড়লো। তিনি দেখলেন পাহাড়টি একেবারে নিরালা, নির্জন ও ছায়া-আঁধার ঘেরা। তাই তিনি এখানে বসে জ্ঞানের আলোক সন্ধানের মন করলেন। উত্তর-পূর্বদিকের ঢাল বেয়ে তিনি উপরে উঠে এলেন। সহসা পৃথিবী দুলে উঠলো, পাহাড়টি থর থর করে কেঁপে চললো। তখন ভয় পেয়ে পর্বতদেব তাঁকে বললেন—’এ পর্বত পরম জ্ঞান লাভের পক্ষে উপযুক্ত জায়গা নয়। যদি তুমি এখানে থেকে বজ্র সমাধি আরম্ভ করো তবে ভূমিকম্প হয়ে চলবে, পৃথিবী বিদীর্ণ হবে ও পর্বত তোমার উপর ভেঙে পড়বে।’
বোধিসত্ত্ব তখন নেমে আসতে শুরু করলেন। দক্ষিণ-পূর্বদিকের ঢাল বেয়ে আধা আধি নেমে দাঁড়িয়ে গেলেন। পিছনে পাহাড় ও সামনে খর বেগে বয়ে চলা নদীর পরিবেশ মধ্যে একটি পাহাড়ী গুহা দেখতে পেলেন। এখানে তিনি আসন করে বসলেন। পৃথিবী ও পর্বত আবার থরথর কেঁপে উঠলো। তখন শুদ্ধ বস্ত্ৰ পরিহিত এক দেবতা আকাশবাণী শোনালেন— ‘এ জায়গাটি একজন তথাগতের পরম জ্ঞান লাভের সহায়ক নয়। এখান থেকে ১৪-১৫ লি মতো দূরে তোমার কৃচ্ছ্র সাধনা পীঠের কাছে একটি অশ্বত্থ গাছ দেখতে পাবে। এর নীচে বজ্রাসন রয়েছে। অতীতের সব বুদ্ধ সেখানেই সেই বজ্রাসনের উপর বসে পরম জ্ঞান লাভ করেছেন। যাঁরা ভবিষ্যতে বুদ্ধ হবেন তাঁরাও সেখানে বসেই পরম জ্ঞান লাভ করবেন। তুমি সেই জায়গাটিতে চলে যাও।
বোধিসত্ত্ব তখন যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন তাই দেখে ওই গুহানিবাসী নাগ তাঁকে বললো—’এই গুহাটি এক মনোরম ও পবিত্র জায়গা। এখানে বসেই তোমার অভীষ্ট পূরণ হবে। তুমি করুণা করে আমায় ছেড়ে চলে যেও না।’
আপন অভীষ্ট সিদ্ধির পক্ষে এ স্থান অনুকূল নয় বুঝতে পেরে বোধিসত্ত্ব এখান থেকে চলে যাওয়াই সঙ্গত মনে করলেন। তবে যাবার সময় নাগকে সন্তুষ্ট করার জন্য আপন ছায়া রেখে গেলেন। দেবতারা আগে আগে পথ দেখিয়ে তাঁকে বোধিবৃক্ষের কাছে নিয়ে চললেন।
অশোক রাজা হবার পর এ পর্বতের যে সব জায়গায় বোধিসত্ত্ব এসেছিলেন সে সমস্ত জায়গায় স্তম্ভ ও স্তূপ গড়ার আদেশ দেন। প্রত্যেক বছর বর্ষাবাস সমাপ্তি দিনে সাধারণ উপাসকেরা বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে এসে জড়ো হয়। পাহাড়ের উপর চড়ে বুদ্ধদেবকে পূজা দেয়। একরাত এখানে কাটিয়ে তারা চলে যায়।
প্রাগ্বোধি পর্বত দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ১৪-১৫ লি মতন গেলে আমরা বোধিবৃক্ষের দর্শন পাই। অনেক উঁচু, খাড়া আর মজবুত ইটের দেয়াল দিয়ে এটিকে ঘিরে রাখা হয়েছে। জায়গাটির পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা আর উত্তর-দক্ষিণে সরু। প্রায় ৫০০ পা মতো গোলাকার ধরনের। নানা বিরল জাতের নাম করা ফুল গাছের ফুল ও ছায়া জায়গাটিকে স্নিগ্ধ করে রেখেছে। কচি দূর্বাঘাস ও আরো নানারকম গুল্ম-লতা জমির বুকে সবুজ গালিচা বানিয়ে দিয়েছে। ভিতরে যাবার মূল ফটকটি নৈরঞ্জনা নদীর বিপরীত দিকে, পূর্বে। দক্ষিণের ফটকটির দিকে নদীর উপকূলটি ফুলে ভরা। পশ্চিমদিকে পুরোপুরি বন্ধ, পাঁচিল এত উঁচু যে তা ডিঙোনো অসম্ভব।
উত্তরের ফটকটি একটি বিরাট সংঘারামের মধ্যে। ঘের দেয়াল পরিসর মধ্যে নানা পবিত্র স্মৃতি-স্মারক একের পর এক গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে স্তূপের সারি, ওখানে বিহারের সমরোহ। সারা জম্বুদ্বীপের বিভিন্ন রাজা, মহারাজা ও নামকরা লোকেরা এখানে এগুলি গড়ে গেছেন।
দেয়াল দিয়ে ঘেরা বোধিবৃক্ষের পরিসরের মাঝখানে বজ্ৰাসন।
বুদ্ধের নির্বাণ পরে বিভিন্ন দেশের রাজারা চলিত পরম্পরা থেকে বজ্রাসনের প্রকৃত মাপ জানতে পেরে উত্তর ও দক্ষিণদিকের সীমানা নির্ধারণ ক’রে তার নিশানা রূপে দুদিকে অবলোকিতেশ্বরের দুটি মূর্তি বসিয়েছেন। দুটি মূর্তিই পূর্বমুখী হয়ে বসে আছে।
প্রাচীন লোকেরা বলে থাকেন যে অবলোকিতেশ্বরের এই মূর্তি দুটি যখন পুরোপুরি মাটিতে বসে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে তখন বৌদ্ধ ধর্ম লোপ পাবে। দক্ষিণের মূর্তিটি এখন বুক পর্যন্ত বসে গেছে। বজ্রাসনের উপরের বোধিবৃক্ষটি একটি অশ্বত্থ গাছ (পিপল)। পুরাকালে বুদ্ধের সময়ে গাছটি কয়েকশো ফুট উঁচু ছিল। তারপর একে প্রায়ই কেটে ফেলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনো এটি ৪০ থেকে ৫০ ফুট উঁচু। বুদ্ধ এর নিচে বসে সম্যক সম্বোধি বা যথার্থ জ্ঞান লাভ করেন বলে একে জ্ঞানের বৃক্ষ বা বোধিবৃক্ষ বলা হয়। এ গাছের বাকল হলদেটে-সাদা, পাতা গাঢ় সবুজ রঙের। কি শীত কি গ্রীষ্ম কোন ঋতুতেই এর পাতা ঝরে পড়ে না। সবসময় সেগুলি তেলতেলে চিকণ, কখনও কোন হেরফের নেই। কিন্তু প্রত্যেক বছর বুদ্ধের নির্বাণ তারিখটি এলে পাতাগুলি হলদে হয়ে ঝরে পড়ে ও মুহূর্তের মধ্যে আবার নতুন পাতা গজিয়ে ওঠে ও আগের চেহারা ফিরে পায়। এই দিনটিতে বিভিন্ন দেশের রাজারা ও অসংখ্য ধর্মানুরাগী চার দিক থেকে কাতারে কাতারে এসে এখানে জমা হন। বোধিবৃক্ষের পাদদেশে সুগন্ধি জল ও সুরভিত দুধ দিয়ে ধুইয়ে দেয়া হয়। সবাই স্তবগান করে ফুল ছড়ায়, সুগন্ধি ধূপধূনা জ্বালায়। রাতে মশালের আলোয় জায়গাটি আলোকিত হয়ে ওঠে। নানা ধৰ্মীয় অনুষ্ঠান সহ পূজা ও উপহার নিবেদন করা হয়।
তথাগতের নির্বাণ লাভের পরেরকার কথা। অশোক রাজা হলেন। এই সময়ে তিনি বিধর্মী ছিলেন। তাই বোধিবৃক্ষটিকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য মন করলেন। সসৈন্য এখানে এসে এটিকে কেটে একেবারে কুঁচি কুঁচি করে এ জায়গাটি থেকে দশ পা পশ্চিমে তাকে গাদা করলেন। তারপর এক ব্রাহ্মণকে ডেকে সেগুলি যজ্ঞে আহুতি দেবার আদেশ দিলেন। কিন্তু যজ্ঞাগ্নির ধোঁয়া মিলিয়ে যেতে না যেতে আগুনের শিখা থেকে একটি জোড়া গাছের আবির্ভাব হলো। গাছটির পাতা ও ডালপাতা পালকের মতো ঝলমল করছিল বলে এর নাম দেয়া হলো— ‘ভষ্ম বোধিবৃক্ষ’। রাজা অশোক এ অলৌকিক কাণ্ড দেখে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হলেন। তখন তিনি পুরানো বোধিবৃক্ষের শিকড়গুলিতে সুরভিত দুধ ঢালার ব্যবস্থা করলেন যাতে গাছটি আবার গজিয়ে উঠতে পারে। অবাক কাণ্ড পরের দিনই দেখা গেল যে, গাছটি ঠিক আগের মতই তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। রাজা সে দৃশ্য দেখে এতো অভিভূত হয়ে পড়লেন যে, নিজেই তাকে পূজার্ঘ নিবেদন ক’রে চললেন। এনিয়ে এরূপ আনন্দবিহ্বল হয়ে রইলেন যে রাজপ্রাসাদে ফিরে যাবার কথাই তিনি ভুলে গেলেন।
রাজা অশোকের মহিষীও একজন গোড়া বিধর্মী ছিলেন। তিনি গোপনে একজন লোক পাঠিয়ে এক মধ্য রাতে আবার গাছটিকে কেটে ফেললেন। পরদিন সকালে রাজা অশোক পূজা দিতে এসে গাছটির ওই অবস্থা দেখে খুব মর্মাহত হলেন। তিনি কায়মনোবক্যে প্রার্থনা জানিয়ে তার গোড়ায় সুরভিত দুধ ঢাললেন। একদিন পার হতে হতেই গাছটি আবার গজিয়ে উঠলো। রাজা এই অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন গাছটির প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় অভিভূত হয়ে তার চারদিক ১০ ফুটের বেশি উঁচু পাথরের (ইটের) দেয়াল দিয়ে ঘিরে দিলেন। এ দেয়াল আজও দেখা যায়।
এরপর বিধর্মী শশাঙ্ক রাজা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিপত্তি নাশ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। তিনি সংঘারামগুলি ভেঙে ফেললেন ও বৌদ্ধবৃক্ষটিকে কেটে তার গোড়া খুঁড়ে পৃথিবীর উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত চলে গেলেন। তবু তিনি এর শিকড়ের শেষ মাথা পর্যন্ত পৌছতে পারলেন না। তখন তিনি এটিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে তার উপর আখের রস (গুড়) ঢেলে দিলেন যাতে গাছটি পুরোপুরি চিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
রাজা অশোকের শেষ বংশধর মগধরাজ পূণবর্মা এ খবর শুনে দুঃখ পেলেন। কয়েক মাস পরে তিনি গাছের শিকড়গুলিতে এক হাজার গরুর দুধ ঢাললেন। এক রাতের মধ্যে গাছটি আবার গজিয়ে ১০ ফুটের মতো লম্বা হয়ে গেল। পাছে আবার কেটে ফেলা হয় সেই ভয়ে তিনি তার চারদিকে ২৪ ফুট উঁচু পাথরের দেয়াল তুলে দিলেন। গাছটি এখন ২০ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা।
বোধিবৃক্ষের পূর্বদিকে ১৬০ থেকে ১৭০ ফুট একটি বিহার আছে। এতে ভিত সামনের দিকে ২০ পায়েরও বেশি। নীল রঙা টালি (ইট) ও চূন দিয়ে এটিকে তৈরী করা হয়েছে। এর বিভিন্ন থাকগুলির কুলুঙ্গীতে সোনার মূর্তি রয়েছে। সৌধের চারিদিকে অবাক করে দেবার মতো নানা কারুকাজে ভরা। কোথাও মুক্তার মালা কোথাও বা দেবর্ষিদের মূর্তি। বিহারটি গিলটি করা তামা দিয়ে বানানো একটি আমলক ফল দিয়ে পুরোটা ঘেরা।
বিহারটির অংশ রূপে তার পূর্বদিকে একটি বহুতল মণ্ডপ রয়েছে। তার গায়ে থাকা কুলুঙ্গীগুলি একের উপর এক তিন তলা সমান পর্যন্ত উপরে উঠে গেছে। কুলুঙ্গী, থাম, কড়িকাঠ, দরজা ও জানালাগুলি সব সোনা ও রূপার কারুকাজ করা, জোড়ের মুখগুলিতে মুক্তা ও রত্ন বসানো। এর আবছা আঁধার ভরা কক্ষগুলি ও রহস্যময় মহাকক্ষগুলিতে তিনটি তলাতেই দরজা রয়েছে। বাইরের ফটকের ডাইনে ও বাঁয়ে ঘরের মতো বড়ো বড়ো কুলুঙ্গী। বাঁদিকে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের ও ডানদিকে মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বের মূর্তি। সেগুলি সীসা দিয়ে তৈরী ও দশ ফুট মতো উঁচু। বর্তমান বিহার যেখানে রয়েছে সেখানে অশোক রাজা প্রথম একটি ছোট বিহার বানিয়েছিলেন। তারপর একজন ব্রাহ্মণ বিরাট ভাবে এটিকে তৈরী করেন। এই ব্রাহ্মণ প্রথমে বুদ্ধের অনুগামী ছিলেন না, তিনি মহেশ্বরের পূজা করতেন। মহেশ্বর তুষারবৃত পর্বতমালা উপরে থাকেন শুনে তাঁরা দুভাই তাঁর সঙ্গে দেখা করে মনোবাঞ্ছা পূরণের প্রার্থনা জানাতে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। মহেশ্বর বললেন-’যে লোকের কোন পূণ্য কর্ম সেই, তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করা সম্ভব নয়। তোমরা আগে কিছু পূণ্য কর্ম করে এসো।’ ব্রাহ্মণ যখন জানতে চাইলেন কী রূপে পূণ্য কর্ম করলে তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে। মহেশ্বর তাঁদের বোধিবৃক্ষের কাছে একটি বড়ো বিহার ও বড়ো পুকুর বানাতে বললেন।
দেব আদেশে বড়ো ভাই বিহারটি গড়লেন ও ছোট ভাই পুকুরটি খুঁড়লেন। পূণ্য কর্মের ফল হাতে হাতে ফললো। ব্রাহ্মণ রাজার মন্ত্রীপদ পেয়ে গেলেন। তিনি তার সব বেতন দান ধ্যানে ব্যয় করতে থাকলেন।
বিহারটি তৈরী শেষ হলে ব্রাহ্মণ সেখানে তথাগত বুদ্ধের বুদ্ধত্বলাভ মুহূর্তের মূর্তি বসাবেন ঠিক করলেন। এ মূর্তি গড়ার জন্য দেশ বিদেশের সেরা শিল্পীদের ডাক দিলেন। কিন্তু কেউই সাহস ক’রে এগিয়ে এলো না। ব্রাহ্মণ যখন নিরাশ হতে বসেছেন এমত সময় সহসা একজন ব্রাহ্মণ এসে সেই মূর্তি গড়তে চাইলেন। তিনি বললেন-”বিহার মধ্যে এক স্তূপ সুরভিত মাটি রাখো ও একটি প্রদীপ জ্বেলে দাও। আমি ভিতরে ঢোকার পর বিহারের দরজা বন্ধ করে দেবে। ছ’মাস পার হয়ে গেলে তবে দরজা খুলবে।’
ব্রাহ্মণের নির্দেশ মতো সব কিছু করা হলো। কিন্তু চার মাস পার হয়ে যাবার পর হঠাৎ এক আশ্চর্য ঘটনায় বিস্মিত হয়ে সবাই মিলে মন্দিরের দরজা খুলে ফেললো। খুলে বিহারের মধ্যে তারা বুদ্ধের একটি অপরূপ মূর্তি দেখতে পেল। মূর্তিটি বসে থাকা ভঙ্গিমার। পায়ের ডান পাতাটির উপরে বাঁ হাতটি ভর দেয়া, ডান হাতটি নিচের দিকে ঝুলছে। পূর্বমুখী হয়ে বসে থাকা এই মূর্তিটি তাঁর জীবন্ত কালের মতোই করুণাকর চেহারার। যে সিংহাসনে তিনি বসে আছেন সেটি ৪’- ২” উঁচু ও ১২’-৫” চওড়া। মূর্তি ১১’-৫” উঁচু দুটি হাঁটুর একপাশ থেকে অন্য পাশ ৮’-৮” ও দুই কাঁধ ৬’-২”। বুদ্ধের বিশেষ লক্ষণগুলি সব ঠিক ঠিক বর্তমান। মুখের করুণাময় অভিব্যক্তি জীবন্তকালের মতো। দক্ষিণ বুকের দিকটি পুরোপুরি শেষ করা হয়নি। মন্দির মধ্যে ব্রাহ্মণকে আর খুঁজে না পেয়ে সবাই -বুঝলেন— এ পুরোপুরি অলৌকিক ঘটনা। একজন শ্রমণ এরই কাছেপিঠে সেদিন রাত কাটিয়েছেন। মৈত্রেয় বোধিসত্ত্ব তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানালেন যে এ মূর্তি মানুষের গড়া অসম্ভব বলে তিনিই ব্রাহ্মণবেশে সেখানে গিয়ে এটি বানিয়ে দিয়েছেন। সকলে সে কথা শুনে অভিভূত হয়ে গেল।
এরপর বুকের উপরে যে অংশটুকু অসমাপ্ত থেকে গেছে, সেখানটা নানা দামী পাথর ও রত্ন খচিত একটি হার দিয়ে ঢেকে, মাথায় অতি মূল্যবান রত্নমালা ছড়িয়ে দেয়া হলো।
রাজা শশাঙ্ক যখন বোধিবৃক্ষ কেটে ফেলেন তখন এই মূর্তিটিকেও নষ্ট করে ফেলার মন করেন। কিন্তু মূর্তিটির অপরূপ সুষমা দেখে তাঁর মন টলে উঠলো ও সংকল্পচ্যুত হয়ে দেশাভিমুখে ফিরে গেলেন। পথে এক আমাত্যকে তিনি বললেন— বুদ্ধের ওই মূর্তিটি সরিয়ে নিয়ে একটি মহেশ্বর মূর্তি বসাতে হবে।
আমাত্য এ আদেশ পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়লেন। বুদ্ধের মূর্তি নষ্ট করলে কল্পকাল ধরে দুর্ভোগ ভুগতে হবে। আবার রাজার আদেশ না মানলে এ জন্মেই সে তাকে মেরে ফেলবে ও সারা পরিবার নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তিনি তখন একজন বুদ্ধ অনুরক্তকে ডেকে বুদ্ধমূর্তি থাকা কক্ষের মধ্যে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে সামনের দিকটা একটি ইটের দেয়াল গেঁথে দিলেন ও সেখানে মহেশ্বরের মূর্তি এঁকে দিলেন (অথবা একটি মূর্তি গড়লেন)।
কাজ শেষ করে তিনি গিয়ে মহারাজকে খবর দিলেন। রাজা শশাঙ্ক সে কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তারা সারা শরীরে ঘা দেখা দিল। মাংস পচে পচে খসে পড়তে লাগলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন।
এরপর সামনের দেয়াল ভেঙে ফেলা হলো। যদিও কয়েকদিন এর মধ্যে পার হয়ে গেছে তবু দেখা গেল যে প্রদীপটি তখনো অম্লান জ্বলে চলেছে।
মূর্তিটি দেব-শিল্পমতে তৈরী হয়েছে বলে এখনো নিখুঁত অবস্থায় আছে। একটি অন্ধকার কক্ষের মধ্যে মূর্তিটি বসানো। তার মধ্যে সব সময় প্রদীপ ও মশাল জ্বলে চলেছে। মূর্তিটিকে ভালভাবে দেখার জন্য কক্ষের মধ্যে ঢোকার নিয়ম নেই। একটি বড়ো আয়না নিয়ে সকালবেলা সূর্যালোক প্রতিফলিত করে তার সাহায্যে দেখতে হয়। যারাই সে মূর্তি দর্শন করে তাদের ধর্মানুরাগ বহু পরিমাণে বেড়ে যায়।
তথাগত সম্যক সম্বোধি লাভ করেন বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় পক্ষের অষ্টম দিনে। আমাদের চীনা পঞ্জিকা মতে বছরের তৃতীয় মাসের অষ্টম দিন। কিন্তু স্থবির শাখানুবর্তীদের মতে দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় পক্ষের ১৫ তারিখ। চীনা পঞ্জিকা মতে দাঁড়ায় বছরের তৃতীয় মাসের ১৫ তারিখ। তথাগতের বয়স তখন তিরিশ বছর। মতান্তরে ৩৫ বছর।
বোধিবৃক্ষের উত্তরদিকে একটি জায়গা আছে যেখানে বুদ্ধ চলাফেরা করে বেড়িয়েছেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর তথাগত আসন থেকে উঠে আসেননি। তিনি পুরো সাতদিন সেখানে মৌন ভাবাবেশে সমাধিমগ্ন থাকেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গাছটির উত্তরদিকে পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী দশ পা মতো জায়গায় ৭ দিন ধরে পায়চারি করে চলেন। তাঁর পদচিহ্নের নিচ থেকে ১৮টি অলৌকিক ফুল দেখা দেয়। পরে এই জায়গাটি তিন ফুট উঁচু ইটের দেয়াল দিয়ে ঢাকা দেয়া হয়। অনেককাল থেকে চলে আসা ধরণা অনুসারে এই ঢাকা দেয়া জায়গাটি যে কোন লোকের আয়ু নির্দেশ করে। তা জানার জন্য আন্তরিক প্রার্থনা নিবেদন ক’রে জায়গাটি মাপতে হয়। আয়ুর কমবেশী অনুসারে মাপ কমবেশি হবে।
বুদ্ধ যেখানে পায়চারি করেন সেখান থেকে উত্তরে রাস্তার বাঁদিকে একটি বড়ো পাথর আছে। এর উপরে একটি বুদ্ধের মূর্তি আছে। মূর্তিটি উপরের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে রয়েছে। তথাগত বুদ্ধত্ব লাভের পর ৭ দিন ধরে বোধিবৃক্ষের দিকে ওইভাবে চেয়ে থাকেন। এই সময় মধ্যে তিনি ক্ষণেকের জন্যও বোধিবৃক্ষ থেকে তাঁর দৃষ্টি সরিয়ে নেন নি। এভাবে চেয়ে থেকে তিনি বোধিবৃক্ষকে তাঁর অন্ত রের কৃতজ্ঞতা জানান।
বোধিবৃক্ষ থেকে অল্প একটুখানি গেলে পশ্চিমদিকে একটি বড়ো বিহার দেখা যাবে। তার মধ্যে পিতলের তৈরী বুদ্ধমূর্তি আছে। মূর্তিটি দুর্লভ রত্ন খচিত ও পূর্বমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। এর সামনে অদ্ভুত আকৃতিতে কাটা ও নানা চিহ্ন আঁকা একটি নীলরঙা পাথর আছে। বুদ্ধ ‘সম্যক সম্বোধি’ লাভের পর ব্রহ্মা এখানে বহুমূল্য সপ্তবস্তু দিয়ে একটি মহাকক্ষ গড়িয়ে দেন ও সেখানে ইন্দ্রের তৈরী সপ্তরত্ন নির্মিত সিংহাসনে বুদ্ধ বসেন। এখানে তিনি ‘সম্যক সম্বোধি’ লাভের প্রতিক্রিয়ায় ৭ দিন আচ্ছন্নের মতো কাটান। তখন তাঁর শরীর থেকে এক বিচিত্র আভা ফুটে বেরোয় ও তা বোধিবৃক্ষটিকে ঝলমলে করে তোলে। পরম জ্ঞানীর পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পর অতি দীর্ঘকাল পার হয়ে গেছে, আর তার ফলে রত্নগুলি সব পাথর পালটে গেছে।
বোধিবৃক্ষ থেকে একটুখানি দক্ষিণে গেলে ১০০ ফুট মতো খাড়া একটি স্তূপ চোখে পড়বে। অশোক রাজা এটিকে গড়েন। বোধিসত্ত্ব নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান ক’রে বোধিবৃক্ষের দিকে এগিয়ে চলেন। তখন তাঁর মনে ভাবনা এলো কিসের উপর তিনি বসবেন। ঠিক করলেন সকাল হলে তিনি ঘাসের (কুশ তৃণ?) খোঁজ করবেন। তখন ইন্দ্র রাজা ঘাস কাটালির ছদ্মবেশে একবোঝা ঘাস নিয়ে হাজির হলেন। বোধিসত্ত্ব তার কাছে ঘাসের বোঝাটি চাইলেন। ছদ্মবেশী ইন্দ্র তাঁকে দিয়ে দিলেন। বোধিসত্ত্ব তা নিয়ে বোধিবৃক্ষের দিকে এগিয়ে চললেন।
এ রাজ্যটি থেকে একটুখানি উত্তরদিকে একটি স্তূপ আছে। বোধিসত্ত্ব সম্যক জ্ঞান লাভের আগে এখানে একদল নীল (রোহিন?) পাখিকে উপরে উঠে শুভ নির্দেশ সূচক-ভাবে উড়তে দেখেন। ভারতে যেসব সংকেতকে শুভ মনে করা হয় এটি তার মধ্যে সেরা। বোধিবৃক্ষের পূর্বদিকে বড়ো রাস্তার ডাইনে বাঁয়ে দুটি স্তূপ আছে। এখানে মার রাজা বোধিসত্ত্বকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে। সে প্রথমে তাকে রাজচক্রবর্তী করে দেবার লোভ দেখায়। সে বিফল হয়ে ফিরে গেলে তার কন্যারা প্রলুব্ধ করতে আসে। বোধিসত্ত্ব তখন তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তিবলে তাদের রূপ পালটে বৃদ্ধা রমণী করে দিলেন। তারা তখন লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হল।
বোধিবৃক্ষের উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি বিহার মধ্যে কাশ্যপ বুদ্ধের মূর্তি রয়েছে। এই বিহারটির উত্তর-পশ্চিমে দুটি ইটের তৈরী ঘর আছে। তার প্রত্যেকটিতে পৃথিবীদেবের মূর্তি রয়েছে। পুরাকালে সত্য জ্ঞান লাভের আগে ‘মার’ যখন বুদ্ধকে প্রলুব্ধ করার অপচেষ্টা করে, তখন তিনি বুদ্ধের হয়ে সাক্ষী থাকেন। লোকে এজন্য পরে তাঁর অপরূপ মূর্তি বানিয়ে এখানে স্থাপনা করে (মূর্তি বা চিত্র)।
বোধিবৃক্ষের দেয়ালের উত্তর-পশ্চিমদিকে কুমকুম স্তূপ। এটি ৪০ ফুটের মতো উঁচু। ‘সাও-কিউ-চু’ (সৌকুট) দেশের একজন শ্রেষ্ঠী এটি গড়েন।
বোধিবৃক্ষের দেয়ালের দক্ষিণ-পূর্বদিকে একটি বটগাছের পাশে একটি স্তূপ আছে। পাশে একটি বিহার মধ্যে বুদ্ধদেবের বসে থাকা ভঙ্গিমায় মূর্তি রয়েছে। সম্যক সম্বোধি লাভের পর বুদ্ধদেবকে ব্রহ্মা এখানে ধর্ম ব্যাখ্যানের জন্য প্রথম অনুপ্রাণিত করেন।
বোধিবৃক্ষের ঘের-দেয়ালের মধ্যে চারকোণে চারটি বড় স্তূপ রয়েছে। শুভ সূচক ঘাস (কুশ তৃণ) পেয়ে তথাগত যখন বোধিবৃক্ষের চারিদিকে বর্গাকারে প্রদক্ষিণ করলেন তখন বিশাল পৃথিবী থর থর কেঁপে চললো। যেই তিনি বজ্রাসনের কাছে এলেন, অমনি মাটির কাঁপন থেমে গিয়ে চুপচাপ
ঘের-দেয়ালের মধ্যে এত বেশি পবিত্র স্মারক রয়েছে ও সেগুলি এত বেশি গা ঘেঁষাঘেঁষি ক’রে দাঁড়িয়ে আছে যে, প্রত্যেকটির কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলা দুঃসাধ্য।
বোধিবৃক্ষের দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে দেয়ালের বাইরে একটি স্তূপ চোখে পড়বে। বুদ্ধদেবকে যে দুই গোপকন্যা পায়সান্ন খেতে দিয়েছিল, এটি তাদের পুরানো ভিটে। এর পাশে আরেকটি স্তূপ আছে। সেখানে গোপকন্যারা পায়েস রান্না করে। এর পাশে একটি জায়গায় তথাগত সেই পায়সান্ন গ্রহণ করেন।
বোধিবৃক্ষের দক্ষিণ ফটকের বাইরে ৭০০ পা মতন গোলাকার একটি দীঘি রয়েছে। এর জল বেশ টলমলে ও আয়নার মতো স্বচ্ছ। দীঘিটিতে অনেক নাগ ও মাছ রয়েছে। মহেশ্বরের আদেশে সেই ব্রাহ্মণ দুভাই এটি তৈরী করেন।
আরো একটু দক্ষিণে গেলে একটি পুকুর দেখা যাবে। সম্যক জ্ঞানলাভের পর, তথাগতের স্নান করার ইচ্ছা হলো। তখন দেবরাজ অলৌকিক শক্তিবলে বুদ্ধের জন্য এ পুকুরটি করে দিলেন।
পুকুরের পশ্চিমদিকে একটি বড়ো পাথর আছে। বুদ্ধ স্নান সেরে কাপড় ধুলেন। ভাবছেন, কোথায় শুকোতে দেবেন। অমনি পাথরটি এখানে দেখা দিল। তুষারঘেরা পর্বতমালা থেকে ইন্দ্র সেটিকে বুদ্ধদেবের জন্য নিমেষে এনে দিলেন।
পাশেই একটি স্তূপ। স্নানের পরে এক বৃদ্ধার দেয়া কাপড়খানি বুদ্ধদেব এখানে পরেন। আরো দক্ষিণে বনের মধ্যে একটি স্তূপ রয়েছে। বৃদ্ধা রমণী এখানেই বুদ্ধদেবকে ঐ পুরানো কাপড়খানি দেন।
পুকুরটির পূর্বদিকে বনের মাঝে মুচিলিন্দ নাগরাজের সরোবর রয়েছে। জল ঘন নীল রঙের। স্বাদ বেশ মধুর ও তৃপ্তিকর। পশ্চিম তীরে একটি ছোট বিহার রয়েছে। ভিতরে একটি বুদ্ধ মূর্তি দেখা যাবে। বুদ্ধত্ব লাভের পর তথাগত এখানে সম্পূর্ণ শান্ত ও সমাহিত ভাবে সাতদিন ধরে ভাবসাধনা ক’রে কাটান। তখন মুচিলিন্দ নাগরাজ তাকে সতর্কভাবে পাহারা দেয়। নিজের দেহকে সাতপাক কুণ্ডলী ক’রে বুদ্ধের শরীর ঘিরে রাখে ও বহু ফণা বিস্তার ক’রে ছাতার মতো তাকে ছায়া দেয়। সরোবরের পূর্বদিকে এই নাগরাজের আবাস।
মুচিলিন্দ সরোবরের পূর্বদিকে বনের মধ্যে একটি বিহারে বুদ্ধদেবের একটি মূর্তি আছে। এতে তাকে বেশ দুর্বল ও কংকালসার দেখানো হয়েছে।
পাশেই একটি জায়গা আছে, সেখানে বুদ্ধ পায়চারি করেন। জায়গাটি ৭০ পা মতন লম্বা, দু’পাশে দু’টি অশ্বত্থ গাছ রয়েছে।
প্রাচীনকাল থেকেই ধনী গরিব নির্বিশেষে যে কোনো লোক অসুখে পড়লে এই মূর্তিটিতে সুগন্ধি মাটি লেপন করে। এর ফলে অনেকেই ভালো হয়ে যায়। এই জায়গাটিতেই বোধিসত্ত্ব কৃচ্ছ্র সাধনায় রত ছিলেন। এখানেই তিনি বিধর্মীদের বশ করেন, মায়ের অনুরোধ শোনেন, তারপর ছ’ বছরব্যাপী অনশন আরম্ভ করেন। ওই সময়ে তিনি শুধু একটি করে জোয়ার-দানা ও একটি ক’রে গমের দানা খেতেন। ফলে তাঁর শরীর ক্ষীণ ও দুর্বল হয়ে পড়ে, চোখ মুখ বসে যায়। যে জায়গাটিতে তিনি পায়চারি করতেন সেখান থেকেই অনশন ভঙ্গের পর গাছের ডালটি নেন।
যে অশ্বত্থ গাছটির কাছে বুদ্ধ অনশন করেন তার কাছাকাছি একটি স্তূপ দেখা যাবে। এখানেই অজ্ঞাত কৌণ্ডিন্য প্রভৃতি পাঁচজন বাস করতেন। রাজকুমার গৃহত্যাগ করার পর প্রথম কিছুকাল পর্বত ও উপত্যকা মধ্যে ঘুরে বেড়ান। তখন তিনি কখনো বা বনের মধ্যে কখনো বা কুয়ার পাশে বিশ্রাম নিতেন। তখন শুদ্ধোধন রাজা ওই পাঁচজনকে সব সময় রাজকুমারকে ছায়ার মতো অনুসরণ ও দেখাশোনা করার ভার দেন। রাজকুমার যখন অনশন-সহ কঠোর তপস্যা সুরু করলেন তখন তার দেখাদেখি অজ্ঞাত কৌণ্ডিন্য ও অন্য চারজনও ওই রকম কষ্টকর তপস্যা সুরু করে।
এ জায়গাটি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে একটি স্তূপ দেখা যাবে। এখান থেকেই বোধিসত্ত্ব নৈরঞ্জনা নদীতে স্নান করতে যান। আর এরই কাছাকাছি একটি জায়গাতে বসে তিনি পায়সান্ন খান।
এর পাশে যে জায়গাটিতে দুজন শ্রেষ্ঠী তাকে আটা ও মধু দান করে, সেখানেও একটি স্তূপ গড়া হয়েছে।
যখন বণিক দুজন বুদ্ধকে আটা ও মধু দিলেন তখন তিনি চিন্তায় পড়লেন যে, কিসে ক’রে তা নেবেন। তখন চারিদিক থেকে চার দেবলোক রাজ এসে তাঁকে একখানি করে সোনার পাত্র যাচলেন। এ রকম দামী পাত্র নেয়া সন্ন্যাসীর মানায় না বলে তিনি তা নিলেন না। তখন তারা একটি ক’রে রুপার পাত্র যাচলেন। তারপর স্পটিকের পাত্র, তারপর গাঢ় নীল, হালকা লাল, হলুদ এবং রক্ত-গোলাপ রঙের দামী রত্ন দিয়ে তৈরী পাত্র একে একে যাচলেন। কিন্তু ভগবন তার কোনোটিই নিলেন না। তখন চার রাজা প্রাসাদে গিয়ে গাঢ় নীল রঙের পরিচ্ছন্ন পাথরের পাত্র নিয়ে এলেন। কারটি নেবেন তা নিয়ে বিরোধ এড়াবার জন্য তিনি তখন চারিটি পাত্র নিয়ে একের উপর আরেকটি বসিয়ে একটি পাত্র ক’রে নিলেন। এজন্য তাঁর পাত্রটির চারিটি কানা দেখা যায়।
এখান থেকে মুচিলিন্দ সরোবরের দক্ষিণদিক পর্যন্ত এলাকার মধ্যে আরো গুটিকয়েক স্তূপ চোখে পড়বে।
বোধিবৃক্ষ দেয়ালের পূর্বদিকে ফটকের বাইরে দু’তিন লি মতো গেলে অন্ধ নাগের আবাস। ফটকের কাছাকাছি এলাকায় তিনটি স্তূপ।
বোধিবৃক্ষ ঘের দেয়ালের উত্তর ফটকের বাইরে মহাবোধি সংঘারামটি। সিংহলের এক প্রাচীন রাজা এটি গড়েন। এই সংঘটিতে ৬টি মহাকক্ষ ও তেতলা বুরুজ রয়েছে। এটি তিরিশ থেকে চল্লিশ ফুট উঁচু প্রতিরোধ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এই বিহারটি তৈরী করার জন্য শিল্পীরা তাদের সব শিল্পনৈপুণ্য কাজে লাগিয়েছেন। অতি উজ্জ্বল রঙ দিয়ে এটিকে অলংকৃত করা হয়েছে। বুদ্ধদেবের মূর্তিটি সোনা ও রূপা দিয়ে বানানো ও নানা রত্ন ও দামী পাথর বসানো। এগুলির মধ্যে বুদ্ধের দেহাবশেষ রাখা হয়েছে। অস্থিগুলি এক একটি হাতের আঙ্গুলের মতো লম্বা, চিকন, চকচকে ও ধবধবে সাদা আর পরিষ্কার। চর্মাবশেষ সত্যিকারের বড়ো মুক্তার মতো হালকা নীলাভ লাল রঙের। প্রত্যেক বছর বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনটিতে এগুলি সকলের দর্শনের জন্য রাখা হয়।
এখানে হাজার জনেরও বেশি ভিক্ষু আছেন। তাঁরা মহাযানের চর্চ্চা করেন ও স্থবির শাখার অনুগামী। তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে ‘ধর্ম বিনয়’-এর অনুসরণ করেন। তাঁদের আচরণ খাঁটি ও নির্ভুল।
সিংহল নামে দক্ষিণ সাগরের একটি দেশে আগের কালে একজন ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ রাজা ছিলেন। তাঁর ভাইও সংসার ছেড়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু হন। তিনি বৌদ্ধ তীর্থগুলি দেখার জন্য ভারতে এলেন। কিন্তু কোন ভারতীয় সংঘারামে তিনি ভাল ব্যবহার পেলেন না। প্রান্তিক দেশবাসী বলে ভারতীয় ভিক্ষুরা তাঁকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেন। অশেষ দুঃখ কষ্ট সয়ে সারা ভারত ঘুরে তীর্থ দর্শন শেষ ক’রে তিনি কোনমতে প্রাণটুকু নিয়ে দেশে ফিরে গেলেন। তারপর রাজাকে সব কথা জানিয়ে সিংহলীয় বৌদ্ধদের ক্লেশ নিবারণের জন্য যাতে তিনি ভারতে একাধিক সংঘারাম স্থাপন করেন সেজন্য উদ্বুদ্ধ করলেন।
সিংহল অধিপতি তখন ভারত-নৃপতির কাছে সংঘারাম স্থাপনার জন্য অনুমতি চাইলেন। ভারতপতি বোধিবৃক্ষের কাছে একটি সংঘারাম গড়ার সম্মতি দেন। সিংহল রাজ তখন বহু ধন-সম্পদ খরচ করে এই সংঘারামটি গড়েন ও সেখানে তামার পাতের উপর এই ঘোষণাপত্রটি খোদাই ক’রে দেন—
“কোন রকম বৈষম্য না দেখিয়ে সাহায্য করার পরম শিক্ষাই সকল বুদ্ধ আমাদের দিয়ে গেছেন। পরিস্থিতি অনুসারে যথাসম্ভব সবাইকে করুণা দেখানোর মহৎ শিক্ষাই বিগত মুনিঋষিদের কাছে আমরা পেয়েছি। সে কারণে আমি এক রাজবংশের দীন সন্তান হয়েও এই সংঘারামটি গড়েছি। বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র নিদর্শনগুলি যাতে সকলে সহজে দেখার সুবিধা পায়, তাদের মহত্ত্ব পরপুরুষ মধ্যে সঞ্চারিত হয় ও তার ফলে লোকেরা যাতে উপকৃত হয় এই বাসনা থেকে এটি গড়া হয়েছে। আমার রাজ্যের ভিক্ষুরা এর ফলে স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে ও এদেশের সংঘের সভ্যরূপে ব্যবহার লাভের অধিকারী হবে। এ সুযোগ সুবিধা যেন পুরুষানুক্রমে নিরবচ্ছিন্নভাবে বজায় থাকে।
এজন্য এই সংঘারামটি সিংহলের বহু ভিক্ষুর সেবাযত্ন করে। বোধিবৃক্ষের দক্ষিণ দিকে দশ লি মতো অঞ্চল জুড়ে এত অসংখ্য পবিত্র স্মারক রয়েছে যে তাদের প্রত্যেকটির নাম করা অসম্ভব। প্রত্যেক বছর ভিক্ষুদের বর্ষা-উদ্যাপন শেষ হলে ধর্মপ্রাণ লোকেরা কাতারে কাতারে চারিদিক থেকে এখানে এসে ভিড় করে। সাতদিন সাতরাত ধরে তারা এই জেলাটি ঘুরে বেড়িয়ে বিভিন্ন স্তূপ ও বিহারে ফুল ছড়ায়, ধূপধূনা জ্বালায় ও গানবাজনা করে তাদের পূজা ও উপহার নিবেদন করে। ভারতের ভিক্ষুরা বুদ্ধের পবিত্র নির্দেশ মতো শ্রাবণ মাসের প্রথম পক্ষের প্রথম দিন থেকে বর্ষা উদযাপন আরম্ভ করে। আমাদের দেশে তা সুরু হয় পঞ্চম মাসের ষোড়শ দিন থেকে। এখানে বর্ষা উদ্যাপন শেষ হয় আশ্বিন মাসের দ্বিতীয় পক্ষের পঞ্চদশ দিনে। আমাদের ওখানে অষ্টম মাসের পঞ্চদশ দিনে।
ভারতে মাসের নাম নক্ষত্রের নামানুসারে দেয়া হয়। এ বিষয়ে প্রাচীন বেঁধে দেয়া নিয়ম এখনো অপরিবর্তিতভাবে চালু রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন স্থানীয় ভাষায় মূল নির্দেশ ও বিবরণ ভাষান্তরকালে বিভিন্ন শাখাগুলি যে সব ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটিয়েছে তার ফলে বর্ষা উদ্যাপনকাল নিয়ে কিছু মতান্তর দেখা দিয়েছে। এজন্য কোথাও কোথাও তারা চতুর্থ মাসের ষোড়শ দিন থেকে বর্ষা উদ্যাপন আরম্ভ করে ও শেষ করে সপ্তম মাসের পঞ্চদশ দিন।
বোধিবৃক্ষের পূর্বদিকে নিরঞ্জনা নদী পার হয়ে আমরা এক বনের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এসে একটি স্তূপের দেখা পেলাম। এর উত্তরদিকে একটি জলাশয়।
জলাশয়ের পাশেও একটি স্তূপ দেখা যাবে। স্তূপটির সামনে একটি পাথর স্ত ম্ভ। অতি পুরাকালে কাশ্যপ বুদ্ধ এখানে সাধনা করেন। এর পাশে একটি জায়গায় বিগত চার বুদ্ধের বসা ও চলাফেরার চিহ্ন রয়েছে।
এই স্থানটির পূর্বদিকে মহীনদী পার হয়ে আমরা একটি বিরাট বনে এসে হাজির হলাম। এখানে একটি পাথর স্তম্ভ রয়েছে।
বুদ্ধের সমকালীন বিখ্যাত সন্ন্যাসী উড্র রামপুত্র এখানে চরম সিদ্ধি লাভ করেন। আবার পরবর্তীকালে এখানেই তিনি এক কু-বাসনা প্রকাশ করেন।
মহীনদীর পূর্বদিক গেলে আমরা বন্য প্রাণীসংকুল একটি বিরাট অরণ্যের দেখা পাই। ১০০ লি মতো পথ চলার পর কুক্কুটপাদগিরিতে এসে পৌঁছাই। এর আরেক নাম গুরু পাদ্যঃ কন্যা। এ পর্বতের ধারগুলি বেশ খাড়া ও এবড়ো থেবড়ো। উপত্যকা ও গিরি খাতগুলির মধ্যে যাতায়াত অসম্ভব। এর চারপাশ দিয়ে তীব্রগতিতে জলধারা নেমে আসে। উপত্যকাগুলি ঘন জঙ্গলে ভরা। গুহা- গহ্বর ছড়িয়ে থাকা পর্বতের ধারগুলি লতিয়ে ওঠা নানারকম বুনো লতাপাতায় ঢাকা। পর্বতটির তিনটি সংকীর্ণ চূড়া আকাশ ফুঁড়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। চূড়ার উপরের দিক মেঘ ও বাষ্পাচ্ছন্ন। এই পর্বতমালায় পিছন দিকে সম্মানাস্পদ মহাকাশ্যপ নির্বাণাচ্ছন্ন হয়ে শায়িত রয়েছেন। লোকে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে স্পর্দ্ধা করে না বলে ‘গুরু-পাদাঃ’ বলে। মহাকাশ্যপ একজন স্রাবক ছিলেন। তিনি আধ্যাত্মিক ষড়ৈশ্বর্য ও অষ্ট বিমোক্ষ লাভ করেন। তথাগত নির্বাণ লাভের আগে তার উপর ধর্ম-পিটক রক্ষার ও মাসীর দেয়া সোনার সূতায় বোনা কষায়টি ভাবী বুদ্ধ নৈত্রেয়কে দেবার ভার দিয়ে যান।
ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব লাভ করে কাশ্যপ প্রথম মহাসম্মেলন আহ্বান করলেন। তারপর তিনি কুড়ি বছর কাল তাঁর দায়িত্ব পালন করে চলেন। পরে এই অনিত্য জগতের প্রতি অনীহা থেকে মৃত্যুর ইচ্ছা প্রকাশ করেন ও সেজন্য এই পাহাড় শীর্ষে ওঠেন। তাই এই পাহাড়ের চূড়ায় একটি স্তূপ গড়া হয়েছে। নির্জন সন্ধ্যাবেলায় দূর থেকে স্তূপটির দিকে তাকালে অনেক সময় মশালের আলোর মত এক উজ্জ্বল আলোক শিখা দেখা যায় কিন্তু পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে সেরকম কিছুই চোখে পড়বে না।
কুক্কুটপাদ পর্বতের উত্তর-পূর্বদিকে প্রায় ১০০ লি কাছাকাছি যাবার পর আমরা বুদ্ধবন পর্বতমালার দেখা পাই। এর চূড়াগুলি বেশ উঁচু, ছোট বড় পাহাড়গুলি রীতি-মতো খাড়া। এই খাড়া পাহাড়ের মধ্যে পাথর গুহা রয়েছে। বুদ্ধ কোন এক সময় এই পর্বতে নেমে এসে (আকাশ পথে) এই গুহাটিতে থাকেন। এর পাশে একটি বড়ো পাথর আছে। এটিতে গোশীর্ষ চন্দন গুঁড়ো করে ব্রহ্মা ও দেবরাজ ইন্দ্র তা তথাগতের দেহে ওই সময়ে লেপন করে দেন। সেই চন্দনের সুগন্ধ এখনো পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে।
বুদ্ধবন পর্বতের বন্য উপত্যকার মধ্য দিয়ে পথ ভেঙে ৩০ লি মতো পূর্বদিকে চলার পর আমরা যষ্ঠিবন অরণ্যে এসে পড়লাম। এখানে বড়ো আকারের বাঁশ জন্মায়। পাহাড় ও উপত্যকা এই বাঁশের বনে ছেয়ে আছে।
এই বনের মাঝে একটি স্তূপ চোখে পড়লো। রাজা অশোক এটিকে গড়ে গেছেন।
এই বনে কিছুকাল আগে জয়সেন নামে একজন উপাসক বাস করতেন। তিনি পশ্চিম ভারতীয় ক্ষত্রিয় ছিলেন। অতি সাধাসিধে ধরনের এই মানুষটি বন পাহাড় ভালবাসতেন ও সবসময় সত্যের সন্ধানে ডুবে থাকতেন। তিনি ধর্ম ও ধর্ম-বহির্ভূত সব রকম শাস্ত্র পাঠ করে সেদিকে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। শ্রমণ, ব্রাহ্মণ বিভিন্ন বিধর্মী গোষ্ঠীর লোক রাজা মন্ত্রী সকলেই তাঁকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করতো। তারা সকলেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ও জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে আসতো। তাঁর শিষ্যরা চারিদিক ছড়িয়ে পড়ে। সত্তর বছর বয়সেও তিনি অবিরাম পড়ে চলতেন।
ভারতে একরকমের সুগন্ধি গুঁড়োকে মাটির তালের মতো করে তা দিয়ে স্তূপ বানানোর প্রথা চলিত আছে। এগুলি ৬-৭ ইঞ্চি লম্বা ক’রে বানানো হয় ও কোন একটি সূত্র থেকে কিছুটা লিখে এর মধ্যে ভরে দেয়া হয়। এগুলির নাম দিয়েছে তারা ‘ধর্ম্ম-শরীর’। এগুলি যখন অনেক জমা হয়ে যায় তখন একটি বড়ো স্তূপ বানিয়ে তার মধ্যে এগুলি তারা জমা করে ও সর্বদা পূজা অর্চ্চনা করে চলে। জয়সেন সর্বদা মুখে শাস্ত্র পাঠ ও ছাত্রদের নির্দেশাদি দিয়ে চললেও তাঁর হাত দু’টি সব সময় কিন্তু এই স্তূপ বানাতে ব্যস্ত থাকতো। একশো বছর পার হবার পরেও তিনি সম্পূর্ণ সক্রিয় ছিলেন। তিরিশ বছর মধ্যে তিনি সাত কোটি স্তূপ বানান ও এক এক কোটির জন্য এক একটি বড় স্তূপ বানিয়ে তার মধ্যে তা রেখে দেন। সাত কোটি পূর্ণ হয়ে যাবার পর তিনি পূজা দিলেন ও ভিক্ষুদের সেই উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করলেন। তারা তাঁকে অভিনন্দন জানালো। এই সময়ে চারিদিকে এক দিব্য জ্যোতি খেলে গেল ও নানা অলৌকিক কাণ্ড ঘটলো। আর তারপর থেকে প্রায়ই এখানে দিব্য জ্যোতির দেখা পাওয়া যেতে লাগলো।
যষ্ঠিবনের দক্ষিণ-পশ্চিমে ১০ লি মতো গেলে একটি বড়ো পাহাড়ের দক্ষিণ পাশে দুটি উষ্ণ প্রস্রবণ দেখা যাবে। এর জল বেশ গরম। পুরাকালে তথাগত এদু’টি সৃষ্টি করেন ও নিজে তাতে স্নান করেন। এখনো এদু’টি অফুরন্ত বয়ে চলেছে। কাছে ও দূরের লোক এখানে স্নান করতে আসে। তাদের মধ্যে কারো কোন পুরানো বা কঠিন অসুখ থাকলে এখানে স্নানের ফলে প্রায়ই সে সেরে ওঠে প্রস্রবণ দু’টির পাশে যেখানে তথাগত স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য নিয়মিত পায়চারি ক’রে বেড়াতেন সেখানে একটি স্তূপ গড়া হয়েছে।
যষ্ঠিবনের দক্ষিণ-পূর্বে ৬-৭ লি মতো গেলে একটি বড়ো পাহাড়ের দেখা পাওয়া যাবে। এই পাহাড়ের একটি গিরিপথের সামনে একটি স্তূপ আছে। মানুষ ও দেবতাদের শুভার্থে তথাগত বর্ষা উদ্যাপনের তিনমাস কাল এখানে থেকে ধর্ম ব্যাখ্যান করেন। এই সময়ে বিম্বিসার রাজা তা শোনার জন্য আসতে চান। তিনি পাহাড়টির গা কেটে, পাথর গাদা ক’রে তার উপরে ওঠা নামা করার পথ ক’রে দেন। এটি চওড়ায় প্রায় ২০ পা আর লম্বায় ৩ থেকে ৪ লি।
এই বড়ো পাহাড়ের উত্তর দিকে ৩-৪ লি গেলে একটি নির্জন পাহাড় চোখে পড়বে। আগের কালে ঋষি ব্যাস এখানে নিরালায় বাস করতেন। পাহাড়ের দেহ খুঁড়ে তিনি একটি ঘর বানান। তার কতকাংশ এখনো দেখা যায়। শিষ্যেরা তাঁর রেখে যাওয়া জ্ঞানের পরম্পরা বয়ে নিয়ে চলেছে ও এখনো তাঁর জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে।
এই নির্জন পাহাড়টির উত্তর-পূর্বে চার পাঁচ লি গেলে একটি ছোট পাহাড় পড়বে। এটিও একলা দাঁড়িয়ে আছে। এই পাহাড়ের একপাশে একটি পাথরের কক্ষ আছে। লম্বা ও চওড়ায় এটি ১০০০ জন লোক বসার পক্ষে যথেষ্ট। তথাগত এখানে তিন মাস ধর্ম ব্যাখ্যান করেন। এই পাথর মহাকক্ষের উপরে একটি বড়ো পাথর আছে। দেবরাজ ইন্দ্র ও ব্রহ্মা এখানে গোশীর্ষ চন্দন গুঁড়া ক’রে তা বুদ্ধের দেহে ছড়িয়ে দেন। পাথরের গায়ে সে গন্ধ এখনো পাওয়া যায়।
এই পাথর মহাকক্ষ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বিরাট সুড়ঙ্গ আছে। ভারতীয়রা একে অসুরপুরী বলে। একবার এক যাদুকর ও তার ১৪ জন সঙ্গী এর মধ্যে প্রবেশ করে ৩০-৪০ লি মতো যাবার পর এক বিরাট রাজনগরী দেখতে পায়।
পাথর কক্ষটির পাশ দিয়ে প্রায় দশ পা মতো চওড়া ও ৪-৫ লি লম্বা একটি কাঠের পথ রয়েছে। আগের কালে বিম্বিসার রাজা বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে যাবার জন্য বন পাহাড় কেটে এটি তৈরী করেন।
এখান থেকে পাহাড়ের মধ্যে পূর্বদিকে প্রায় ৬০ লি মতো পথ চলার পর আমরা কুশাগারপুর (রাজগৃহ) পৌঁছাই। মগধ রাজ্যের মধ্যবিন্দুতে এ শহরটি অবস্থিত। এটি এখানকার পুরানো রাজাদের রাজধানী ছিল। এখানে প্রচুর পরিমাণে সুগন্ধি কুশ তৃণ জন্মায় ও এজন্য একে কুশাগার বলে। এর চারিদিকে উঁচু পাহাড় দিয়ে এমনভাবে ঘেরা যে সেগুলিকে এর বাইরের দেয়াল বলে মনে হবে। পশ্চিম দিকের একটি সরু গিরিপথ দিয়ে শহরের মধ্যে ঢুকতে হয়। উত্তরদিকেও পর্বতমালার মধ্য দিয়ে একটি পথ আছে। শহরটি পূর্ব পশ্চিমে লম্বা ও উত্তর-দক্ষিণে সরু। প্রায় ১৫০ লি মতো এর ঘের। মাঝখানে থাকা মূল শহরের অবশেষ চিহ্ন প্রায় ৬০ লি মতো পরিসর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটি রাস্তার দু’পাশে কনকচাঁপা গাছের সারি। তার ফুল থেকে ভেসে আসা এক মধুর গন্ধে চারিদিক ভরপুর। এই ফুলগুলি উজ্জ্বল সোনালী রঙের। বসন্তকালে এখানকার সমস্ত বন-বনানী এই ফুলের সোনালী রঙে ভরে ওঠে।
রাজপুরীর উত্তর ফটকের বাইরে একটি স্তূপ চোখে পড়বে। দেবদত্ত ও রাজা অজাতশত্রু দু’জনে এক হয়ে তথাগতকে বধ করার জন্য এখানে এক মাতাল হাতিকে তার দিকে লেলিয়ে দেন।
এর উত্তর-পূর্বে একটি স্তূপ রয়েছে। এখানে সারিপুত্র ভিক্ষু অশ্বজিতের কাছে ধর্ম-ব্যাখ্যান শোনেন ও তার ফলে অহতত্ব লাভ করেন।
এই জায়গাটি থেকে একটুখানি উত্তরদিকে গেলে একটি গভীর খাদের দেখা পাওয়া যাবে। তার পাশে একটি স্তূপ গড়া হয়েছে। খাদের মধ্যে আগুন লুকিয়ে রেখে ও ভাতে বিষ মিশিয়ে শ্রীগুপ্ত এখানে বুদ্ধদেবকে মারার ফন্দি করেন।
শ্রীগুপ্তের আগুনের খাদ থেকে উত্তর-পূর্বদিকে শহরের এক বাঁকে একটি স্তূপ রয়েছে। মহাচিকিৎসক জীবক এখানে বুদ্ধের জন্য একটি প্রচার মহাশালা বানিয়ে দেন। দালানটির চারিদিকে তিনি ফুল ও ফলগাছ লাগান। ভিতের নিদর্শন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া গাছের শিকড়গুলি এখনো দেখা যায়। তথাগত প্রায়ই এখানে আসতেন। প্রচার মহাশালার কাছে জীবকের বসত ভিটের শেষ নিদর্শন ও একটি পুরানো কুয়ার গর্ত এখনো চোখে পড়ে।
রাজপুরীর উত্তর-পূর্বদিকে ১৪/১৫ লি মতন পথ চলার পর গৃধ্রকূট পাহাড়ের দর্শন পাওয়া যাবে। উত্তরের পাহাড়ের দক্ষিণদিকের ঢাল ছুঁয়ে এই পাহাড়ের একমাত্র চূড়াটি অনেক উঁচু পর্যন্ত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এর উপর শকুনদের বাস। এটি অনেকটা উঁচু বুরুজের মতো দেখায়। শিখর ঘিরে আকাশের হালকা নীল রঙের প্রতিফলন। পাহাড় ও আকাশের রঙ মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেছে।
তথাগত তাঁর পঞ্চাশ বছর ধর্ম-প্রচারকের জীবন মধ্যে অনেককাল এই পর্বতে কাটান। তাঁর ধর্ম-মতবাদের অনেক তত্ত্বের বিকশিত রূপ তিনি এখানে বসে দিয়ে যান। তাঁর ধর্ম-ব্যাখ্যান শোনার জন্য রাজা বিম্বিসার বহু লোক সঙ্গে নিয়ে এর চূড়ায় উঠে ছিলেন। তাঁরা এর উপত্যকাগুলিকে সমান ক’রে খাড়া পর্বতের গা ছেঁটে রাস্তা বের করেন, খাড়া পর্বতাংশের ফাঁক মধ্যে সেতু বানান ও পাহাড়ের বুক কেটে পাথরের সিঁড়ি তৈরী করেন। এ সিঁড়িটি দশ পা চওড়া ৫ থেকে ৬ লি লম্বা। রাস্তার মাঝে দুটি ছোট স্তূপ দেখা যাবে। একটির নাম ‘রথাবরোহণ’। কারণ, রাজা এখানে রথ থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যান। অন্যটির নাম ‘জন- আবর্তন’। কারণ, রাজা সাধারণ মানুষদের তাঁর সাথে আর না নিয়ে এখান থেকে ফিরিয়ে দেন। পর্বত শীর্ষটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ও উত্তর-দক্ষিণে সরু। তার পশ্চিম সীমান্তে খাড়া ও উঁচু পাথর ঘেরের মাঝে একটি ইটে বানানো বিহার আছে। এটি বেশ লম্বা চাওড়া। গঠন শৈলীও খুব চমৎকার। ফটক পূর্বদিকে। তথাগত প্রায়ই এখানে এসে ধর্ম-ব্যাখ্যান করতেন। ধর্ম-ব্যাখ্যানরত অবস্থার তাঁর একটি স্বাভাবিক আকারের মূর্তি এখন এখানে রয়েছে।
বিহারের পূর্বদিকে একটি খুব লম্বাটে পাথর দেখা যাবে। তথাগত নিয়মিত এটির উপর পায়চারি করে বেড়াতেন। এটির পাশে ১৪-১৫ ফুট উঁচু ও ৩০ পা মতো ঘোরের একটি বিরাট পাথর রয়েছে। দেবদত্ত বুদ্ধদেবকে মারার জন্য দূর থেকে ওই পাথর এই জায়গায় গড়িয়ে ফেলেন।
এর দক্ষিণে পাহাড়ের খাড়াইয়ের নিচে একটি স্তূপ আছে। পুরাকালে তথাগত এখানে সদ্ধর্ম পুণ্ডরীক সূত্র প্রকাশ করেন।
বিহারটির দক্ষিণদিকে খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়ের এককোণে একটি বড় পাথরের গুহা-ঘর রয়েছে। তথাগত এখানে একবার সমাধিমগ্ন হন।
পাথরের ঘরটির সামনে উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রকাণ্ড একটি পাথর রয়েছে। পূজনীয় আনন্দ যখন সমাধিমগ্ন হন, তখন মার রাজা এখানে তাঁকে ভয়ভীত করার জন্য শকুনের রূপ ধরে আসেন। মারের কার্যকলাপে আনন্দ ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লে বুদ্ধদেব তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে সে কথা জানতে পারলেন। তখন তিনি পাথরের দেয়াল ফুঁড়ে নিজের হাত বাড়িয়ে আনন্দের পিঠ থাবড়ে তাঁকে আশ্বাস ও সাহস দেন।
বহুকাল পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখনো পাথরের উপর পাখির নখের চিহ্ন দেখা যাবে। পাহাড় ফুঁড়ে হাত বের করার ফলে যে গর্তটি হয়, আজও সেটি বৰ্তমান।
বিহারটির পাশে কয়েকটি পাথরের ঘর রয়েছে। এখানে সারিপুত্র ও অন্যান্য বড়ো বড়ো অর্হৎ সমাধিমগ্ন হতেন। সারিপুত্রের পাথরের ঘরের সামনে একটি বড়ো কুয়া আছে। এখন এটি জলশূন্য। শুধু গর্তটিই যা দেখা যাবে।
বিহারের উত্তর-পূর্বে একটি পাহাড়ী নদীর মাঝে একটি বড়ো ও সমতল পাথর দেখা যাবে। এখানে তথাগত তার ‘কাষায়’ বস্ত্র শুকোতে দিতেন। আজো তাতে কাপড়ের সুতোর দাগ দেখা যায়—ঠিক যেন সেগুলো পাথরের গায়ে খোদাই ক’রে রাখা হয়েছে।
এর পাশে একটি পাথর টিলার উপর বুদ্ধদেবের পায়ের ছাপ আছে। ছাপের গায়ে থাকা চক্ৰচিহ্নগুলো বেশ কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে উঠলেও এখনো তার অস্তিত্ব ধরা যায়।
পর্বতের উত্তর চূড়ায় একটি স্তূপ চোখে পড়বে। সেখানে দাঁড়িয়ে বুদ্ধ মগধ শহর দেখেন ও সাতদিন কাল ধর্ম-ব্যাখ্যান করেন।
এই পাহাড়ী শহরের উত্তর ফটকের পশ্চিমে বিপুলগিরি। চলতি মতানুসারে এই পাহাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোলের উত্তরদিকে আগে নাকি পাঁচশো উষ্ণ প্রস্রবণ ছিল। এখন মাত্র গুটিদশেক চোখে পড়ে। তার মধ্যেও আবার কতক ঠাণ্ডা আর কতক গরম। এগুলির উৎপত্তি হয়েছে তুষার ঘেরা পর্বতমালার দক্ষিণে থাকা অনবতপ্ত সরোবর থেকে (রাবণ হ্রদ)। মাটির তল দিয়ে বয়ে চলে এগুলি হঠাৎ এখানে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে। এদের জল সরোবরটির জলের মতই বেশ মিষ্টি আর টলটলে। সরোবর থেকে ৫০০টি প্রবাহ ধারায় পাতালঅগ্নির ধার দিয়ে বয়ে আসার দরুন সেই অগ্নিশিখার উত্তাপ প্রস্রবণগুলির জলকে গরম করে তুলছে। কতক উষ্ণ প্রস্রবণের মুখে পাথর কেটে নানা আকৃতি করে বসানো হয়েছে। কোনটার চেহারা সিংহের, কোনটার বা ধবল হাতির মুখ। কোথাও কোথাও পাথরের নালী বানানো হয়েছে যার মধ্য দিয়ে জল গড়িয়ে উঁচু পুকুরে বা জলাধারে গিয়ে পড়ে। আবার নিচেও পাথর বাঁধান জলাধার। সেখানে জল গিয়ে পুকুরের মতো জমা হয়। প্রত্যেক শহর ও গ্রাম থেকে নানা দেশের লোকেরা এখানে স্নান করতে আসেন। অসুস্থ লোক এর ফলে প্রায়ই ভাল হয়ে ওঠে। এই উষ্ণ প্রস্রবণগুলির ডাইনে বাঁয়ে অনেক স্তূপ আছে। অনেক বিহারেরও অবশেষ রয়েছে। এগুলি একেবারে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। এর সবকটি জায়গাতেই বিগত চার বুদ্ধ ওঠা-বসা চলা-ফেরা করে গেছেন এবং এখনো সে সবের চিহ্ন রয়ে গেছে। এ স্থানটি পর্বত ঘেরা ও যথেষ্ট জল থাকার দরুণ বিশেষ গুণবান ও জ্ঞানবান ব্যক্তিরা এখানে বাস করেন। অনেক মুনি ঋষিও এখানে শান্তিতে ও নিরালায় বাস করেন।
উষ্ণ প্রস্রবণের পশ্চিমে ‘পপ্পল’ নামের পাথরের বাড়িটি দেখা যাবে। ভগবান বুদ্ধ প্রায়ই এখানে বাস করতেন। এই বাড়িটির পিছনে যে গভীর গুহাটি রয়েছে সেটি এক অসুরপুরী। সমাধি অভ্যাস রত বহু ভিক্ষু তার মধ্যে বাস করেন। প্রায়ই এই গুহা থেকে নাগ, সাপ, সিংহ ও নানা আকৃতির আশ্চর্যকর জীবজন্তুকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। এ ধরনের দৃশ্য দেখে অনেকেই হতবাক হয়ে যুক্তিবোধ হারিয়ে ফেলেন। যাই হোক, মুনি ঋষিরা যেসব জায়গায় বাস করেন এই অঞ্চলটি তার মধ্যে একটি। এখানে বহু পুণ্য-স্মারক আছে বলে তাঁরা সব বিপদ-আপদ তুচ্ছ করেও এখানে থাকেন।
বিপুলগিরির শিখরে একটি স্তূপ চোখে পড়বে। এক সময় বুদ্ধদেব সেখানে ধর্ম-ব্যাখ্যান করেন। এখন সেখানে অসংখ্য নগ্ন সন্ন্যাসীর (নির্গ্রন্থ) বাস। তাঁরা দিন ও রাত অবিরামভাবে কৃচ্ছ্র সাধনা ক’রে চলেছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত স্তূপটিকে প্রদক্ষিণ ক’রে শ্রদ্ধা ও ভক্তি জানিয়ে চলেছেন।
এই পাহাড়ী শহরটির (গিরিরাজ) উত্তর ফটকের বাঁদিক ধরে পূর্বমুখী ২/৩ লি মতো গেলে, দক্ষিণ পাহাড়ের উত্তর কোলে একটি বড়ো পাহড়ের ঘর দেখা যাবে। এটিতে দেবদত্ত সমাধি সাধনা করতেন।
এই পাথরের ঘরটি থেকে সামান্য একটুখানি পূর্বদিকে একটি সমতল পাথরের বুকে রক্তের দাগের মতো ছোপ ছোপ দাগ রয়েছে। পাশেই একটি স্তূপ। এখানে একজন ভিক্ষু সমাধি সাধনা করতেন। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে না পারায় তিনি প্রাণত্যাগ করার জন্য নিজের গলা ক্ষতবিক্ষত করেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অহতত্ব লাভ হলো। তারপর তাঁকে দাহ করা হয় ও তিনি নির্বাণ লাভ করেন। তাঁর এই মহৎ সিদ্ধান্তের জন্য তাঁর নামে এই স্মৃতি স্তূপটি গড়া হয়।
এখান থেকে পূর্বে একটি পাহাড়ী অঞ্চলে একটি পাথরে বানানো স্তূপ দেখা যাবে। এখানে বাস করা এক সমাধি সাধারণত ভিক্ষু আকাংখিত ফল না পেয়ে এখান থেকে নিচে ঝাঁপ দেন ও সিদ্ধিলাভ করেন। তাঁর অচল বিশ্বাসের দৃষ্টান্ত টিকে চিরন্তন ক’রে রাখার জন্য স্তূপটি বানানো হয়েছে।
পাহাড়ী শহরটির উত্তর ফটক থেকে এক লি মতো এগিয়ে যাবার পর করণ্ড বেণু বনের দেখা পাই। এখানে এখন শুধু একটি বিহারের পাথরে তোলা বুনিয়াদ ও ইটের বুনিয়াদ ও ইটের দেয়ালগুলিই যা দেখা যাবে। এর দরজা পূর্বমুখী। তথাগত এখানে প্রায়ই এসে বাস করতেন। লোকেদের পথনির্দেশ করার জন্য ধর্মের ব্যাখ্যান শোনাতেন। মতির পরিবর্তন ঘটিয়ে সত্যধর্মের অনুরাগী ক’রে তুলতেন। এখানে এখন বুদ্ধদেবের স্বাভাবিক আকারের একটি মূর্তি বানানো হয়েছে। এই শহরের এক নামকরা গৃহপতি করণ্ড এই বিহারটি বুদ্ধদেবকে ক’রে দেন।
করও বেণুবনের পূর্বদিকে রাজা অজাতশত্রুর তৈরী একটি স্তূপ দেখা যাবে। বুদ্ধের পবিত্র দেহাবশেষ যে ক’জন রাজার মধ্যে ভাগ হয়, অজাতশত্রু তাদের একজন। তিনি তার উপর এই স্তূপটি গড়ে বুদ্ধের প্রতি পূজা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর রাজা অশোক এটিকে খুঁড়ে দেহাবশেষ বের করে নেন ও নিজে অন্য একটি স্তূপ তোলেন।
রাজা অজাতশত্রুর স্তূপটির পাশে আরেকটি স্তূপ আছে। এটিতে আনন্দের আধা দেহাবশেষ রাখা হয়েছে। এই সৌধটির পাশে একটি জায়গা আছে যেখানে বুদ্ধদেব পায়চারি করতেন।
এখান থেকে অল্প একটুখানি এগিয়ে গেলে একটি স্তূপের দেখা পাওয়া যাবে। বর্ষা উদ্যাপনকালে সারিপুত্র ও মুদগলপুত্র এখানে বাস করতেন।
বেণুবনের দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ৫ থেকে ৬ লি মতন যাবার পর দক্ষিণ পর্বতের উত্তরভাগে একটি বিরাট বাঁশবন দেখা যাবে। এর মাঝে একটি বিশাল পাথরের বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বুদ্ধদেবের নির্বাণ পরে পূজনীয় কাশ্যপ এখানেই তিন পিটক সংকলনের জন্য ৯৯৯ জন মহান অহতের সঙ্গে মিলিতভাবে মহাসম্মেলন ডাকেন। এর সামনে একটি পুরানো ভিত দেখা যাবে। ধর্ম পিটক সংকলনের জন্য সমবেত অঙ্গণের থাকার জায়গা ক’রে দেবার জন্য রাজা অজাতশত্রু এটি তৈরী করিয়েছিলেন।
এই সম্মেলনে আনন্দ সূত্র-পিটক, উপালি বিনয়-পিটক ও কাশ্যপ অভিধর্ম- পিটক সংকলনের ভার নেন। পূজনীয় কাশ্যপ ও সম্মেলনের সভাপতি বা স্থবির ছিলেন বলে একে স্থবির সম্মেলন বলা হয়।
মহান কাশ্যপ যেখানে সম্মেলন করেন সে জায়গাটি থেকে উত্তর-পশ্চিমদিকে একটি স্তূপ আছে। উপরোক্ত সম্মেলনে যোগদানে প্রথমে বাধা পেয়ে আনন্দ এখানে এসে নীরবে বসে থাকেন ও সেই অবস্থায় অহতত্ব লাভ করেন। অহতত্ব লাভের পর তিনি সম্মেলনে যোগ দেবার সুযোগ পান।
এই জায়গাটি থেকে ২০ লি মতো পশ্চিমদিকে হাঁটলে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপের দেখা পাওয়া যাবে। এখানেই ‘মহাসংঘ’ তাদের অধিবেশন করেন। কাশ্যপের সম্মেলনে যারা যোগ দেবার অনুমতি পাননি এ রকম একলক্ষ লোক একত্রিত হয়ে এখানে আলাদা এক সম্মেলন করেন। এই সম্মেলনে ভিক্ষু ও গৃহী উপাসক উভয়ে একত্রিত হয় ও শেষ পর্যন্ত ৫টি পিটক সংকলিত হয়। এই পাঁচটি পিটক যথাক্রমে-সূত্র, বিনয়, অভিধর্ম, বিবিধ (ক্ষুদ্র নিকায় বা সন্নিপাত নিকায়) ও ধারণী পিটক। যেহেতু এখানে ভিক্ষু ও গৃহী উভয়ে একত্র হয়েছিলেন এজন্য এ সম্মেলনকে ‘মহাসংঘ’ বলা হয়।
বেণুবন বিহারের উত্তরদিকে ২০০ পা মতো গেলে করণ্ড সরোবর। জীবিতকালে তথাগত এখানে প্রায়ই ধর্ম-ব্যাখ্যান ক’রে গেছেন। এর জল স্বচ্ছ ও নির্মল এবং অষ্টগুণ সমন্বিত। বুদ্ধের নির্বাণের পর সরোবরের জল শুকিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
করণ্ড সরোবরের উত্তর-পশ্চিমে ২/৩ লি মতো গেলে একটি স্তূপ দেখা যাবে। রাজা অশোক এটিকে বানান। ৬০ ফুটের মতো উঁচু এই স্তূপটির পাশে একটি পাথর স্তম্ভ আছে। এতে এই স্তূপ গড়ার কারণ খোদাই করা রয়েছে। স্তম্ভটি পঞ্চাশ ফুটের মতো উঁচু ও তার উপরে একটি হাতির মূর্তি রয়েছে।
পাথর স্তম্ভটি থেকে উত্তর-পূর্বদিকে একটুখানি গেলে আমরা রাজগৃহ শহরে এসে পৌছাই। শহরের বাইরের দেয়াল নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তার চিহ্নবর্ণ ও নেই। ভিতরের দেয়াল (অর্থাৎ রাজপুরীর দেয়াল) শেষ দশায় পৌঁছালেও এখনো মাটির উপর কিছুটা উঁচু পর্যন্ত টিকে আছে। এর ঘের প্রায় ২০ লির কাছাকাছি। রাজা বিম্বিসার প্রথমে কুশীনগর বাস করতেন। কিন্তু সেখানে লোকের বাড়িঘর একেবারে গা ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে থাকার দরুন ঘন ঘন আগুন লেগে ক্ষতি হতো। একটি বাড়িতে আগুন লাগলে পাশের বাড়িও তা থেকে রেহাই পেত না ও এভাবে এক একটি পল্লী পুড়ে ছাই হয়ে যেত। মুখ বুজে ক্ষতি সয়ে চলা অসম্ভব হয়ে উঠতে লোকেরা জোর নালিশ জানাতে শুরু করলো। রাজা বললেন-’আমার পাপের ফলেই গরিব মানুষেরা ভুগছে। কোন্ পুণ্যকর্ম করলে এ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচা যায়?’ মন্ত্রীরা বললেন-মহারাজ, আপনার সুশাসনে চারদিকে শান্তি ও ঐক্য বজায় রয়েছে। আপনার ন্যায়নিষ্ঠ নীতিবিধির জন্য (ধর্ম ও জ্ঞানের) আলোক ও অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। শুধু লোকের অমনোযোগিতার ফলেই আগুনে পুড়ে এসব ক্ষতিকর ঘটনা ঘটছে। এরকম ঘটনা রুখতে হলে কঠোর নিয়ম চালু করা দরকার। এখন থেকে যদি কোথাও আগুন লাগে তবে তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে পেতে তার উৎস বার করা হোক। মূল দোষীকে সাজা দেয়া হোক, তাকে ‘শীত বনে’ নির্বাসিত করা হোক। শীত বনে সাধারণতঃ মৃতদেহ ফেলা হয়। সকলেই একে ভয়ংকর জায়গা বলে মনে করে। কেউই তার মধ্য দিয়ে চলা ফেরা তো দূরের কথা তার ধারও মাড়াতে চায় না। অপরাধীকে সেখানে তাড়িয়ে দেয়ার নিয়ম চালু করলে, লোকে আপনা থেকেই সতর্ক ও মনোযোগী হয়ে উঠবে। রাজা বললেন- “ভাল কথা বলেছ। রাজ্যে সেই রকম ঘোষণা ক’রে দাও। প্রত্যেক লোকের কানে একথা যেন পৌঁছায়।
এরকম ঘোষণার পর সবার আগে রাজপ্রাসাদেই একদিন আগুন লাগল। রাজা তখন মন্ত্রীদের বললেন—’আমাকেই নির্বাসিত করা দরকার।’ তিনি ছেলের হাতে রাজ্যভার দিয়ে নির্বাসনে গেলেন।
রাজা বিম্বিসার শীত বনে একা বাস করছেন শুনে, বৈশালীরাজ তাঁকে আচমকা আক্রমণ করার জন্য সসৈন্যে এগোতে থাকলেন। খবর পেয়ে সীমান্ত রক্ষী সেনাপতিরা বনের মধ্যে একটি শহর গড়ে তুললেন। রাজা নিজে যেহেতু সেখানে প্রথম বনবাস আরম্ভ করেন সেজন্য তার নাম দেয়া হলো রাজগৃহ। তারপর মন্ত্রী ও অন্যান্য লোকেরা সেখানে বসবাস শুরু করলো।
আবার এরকম কথাও শোনা যায় যে রাজা অজাতশত্রুই নাকি প্রথম এ শহরটি গড়েন। তারপর তাঁর উত্তরাধিকারীও একেই রাজধানী করেন ও রাজা অশোকের সময় পর্যন্ত তা চালু থাকে। এরপর রাজা অশোক প্রথম পাটলীপুত্রে রাজধানী সরিয়ে আনেন ও রাজগৃহ শহরটি ব্রাহ্মণদের দান ক’রে দেন। এজন্য আজকাল সে শহরে সাধারণ মানুষদের দেখা যায় না। হাজার খানেক ব্ৰাহ্মণ পরিবারই থাকেন শুধু
রাজপুরীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দু’টি ছোট সংঘারাম রয়েছে। যে সব ভিক্ষু এখানে আসা যাওয়া করে বা একেবারে নতুন তারা এ’টিতে রাত কাটায়। বুদ্ধদেব দু’টি জায়গাতেই তাঁর জীবিতকালে এসে ধর্ম-ব্যাখ্যান ক’রে গেছেন। এর উত্তর- পশ্চিমে একটি স্তূপ আছে। গৃহপতি জ্যোতিষ্ক যে গ্রামটিতে জন্মান সেটি এককালে এখানেই ছিল।
শহরের দক্ষিণ ফটকের বাইরে, রাস্তার বাঁদিকে একটি স্তূপ আছে। এখানে তথাগত ধর্ম-ব্যাখ্যান করেন। এছাড়া রাহুলকেও তিনি এখানেই আপন ধর্মমতে দীক্ষিত করেন।
এখান থেকে তিরিশ লি মতো উত্তরদিকে গেলে নালন্দা সংঘারামের দর্শন পাই। দেশের পুরানো ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এই সংঘারামের দিকে এক আম বনানীর মাঝে একটি পুকুর আছে। এই পুকুর নিবাসী নাগের নাম নালন্দা। এর পাশেই সংঘারামটি গড়া হয়েছে বলে এটির এরকম নাম। কিন্তু আসল কথা অন্য রকম। পুরাকালে তথাগত একবার বোধিসত্ত্ব হয়ে এখানে জন্মেছিলেন। ওই সময়ে তিনি একটি বিশাল রাজ্যের রাজা হন। সে রাজ্যের রাজধানী এখানেই ছিল। জীবের প্রতি অপার করুণা থেকে তিনি সর্বদা তাদের দুঃখ দূর করার চেষ্টা করতেন। এই সদ্গুণের জন্য তাঁকে ‘অবিরামদাতা’ বলা হতো। আর এই নামটিকে চিরন্তন ক’রে রাখার জন্য সংঘারামটির এই নামকরণ করা হয়। এ জায়গাটি আগে একটি আম বাগান ছিল। ১০ কোটি স্বর্ণ খণ্ড দিয়ে ৫০০ জন শ্রেষ্ঠী এটিকে কিনে বুদ্ধদেবকে দান করেন। বুদ্ধদেব এখানে তিন মাস কাল থেকে ধর্ম-ব্যাখ্যান করেন ও সেই বণিক ও অন্যান্যরা এর ফলে সদ্গতি লাভ করেন।
বুদ্ধের নির্বাণ লাভের কিছুকাল পরে এদেশের এক পূর্বতন রাজা শক্রাদিত্য বুদ্ধের ধর্মমতের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ত্রি-রত্নের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠেন। তিনি এই আমবাগানে একটি শুভস্থান গণ কার দিয়ে বাছাই ক’রে সেখানেই নালন্দা সংঘারামটি গড়লেন। যখন এটি বানানোর কাজ শুরু করলেন তখন খোঁড়াখুঁড়ির বেলায় আঘাত পেয়ে নাগটি আহত হলো। এই সময়ে বিধর্মীদের মধ্যে একজন নামকরা গণ কার ছিলেন। তিনি নির্গ্রন্থ সম্প্রদায়ের লোক। ঘটনাটি দেখে তিনি এইরকম ভবিষ্যৎবাণী লিখে রেখে গেছেন: ‘মনোনীত জায়গাটি অতি সুলক্ষণযুক্ত। এখানে একটি সংঘারাম তৈরী করা হলে সেটি বিখ্যাত হয়ে উঠবে। পঞ্চসিন্ধু মধ্যে আদর্শ স্থানীয় রূপে গণ্য হবে। এক হাজার বছর তার ক্রমোন্নতি বজায় থাকবে। সকল স্তরের শিক্ষার্থীরাই এখানে সহজে সুশিক্ষা লাভ করবে। কিন্তু নাগের দেহ থেকে রক্ত ঝরানোর জন্য এখানে অনেক রক্তপাত ঘটবে।’
শক্রাদিত্যের পর তাঁর পুত্র বুধগুপ্ত রাজা হলেন। পিতা যে মহৎ কাজ আরম্ভ করেন তিনি তা বজায় রাখেন। এই সংঘারামটির দক্ষিণদিকে তিনি আরো একটি সংঘারাম বানিয়ে দেন। রাজা তথাগত গুপ্তও উদ্দীপনার সঙ্গে তাঁর পূর্ব-পুরুষদের ধারা অনুসরণ ক’রে যান। তিনি (মূল) সংঘারামটির পূর্বদিকে আরো একটি সংঘারাম গড়ে তোলেন।
এরপর রাজা বালাদিত্য সাম্রাজ্য লাভ করলেন। তিনি উত্তর-পূর্বদিকে একটি সংঘারাম বানিয়ে দেন। সংঘারামটি তৈরী সম্পূর্ণ হলে তিনি এক আনন্দ সম্মেলন ডাকলেন। খ্যাত অখ্যাত সবাইকে তিনি সমানভাবে সম্মান দিতেন। তাই সাধারণ মানুষ ও ধর্মানুগামী সবাইকে তিনি নির্বিচারে আমন্ত্রণ জানালেন। ভারতের সকল ভিক্ষু এসে জমায়েত হলো, এমনকি দশ হাজার লি দূর থেকে পর্যন্ত। সকলের আসা যখন শেষ হয়ে গেছে তার অনেক পর দুজন ভিক্ষু এসে হাজির হলেন। তাঁদেরও অভ্যর্থনা ক’রে তেতলা মণ্ডপের উপর নিয়ে যাওয়া হলো। অভ্যর্থনাকারীরা তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন— ‘আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? এত দেরীতে কেন এলেন?’ তাঁরা উত্তর দিলেন— ‘আমরা চীন দেশ থেকে এসেছি। আমাদের আচার্যের অসুখ হয়েছিল, তাই তাঁর সেবা সুশ্রূষা ক’রে সুস্থ ক’রে তুলে তারপর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বের হয়েছি। এজন্যই আমাদের এখানে আসতে এতো দেরী হয়ে গেল।’
সমবেত সকলে সেকথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। রাজাকে খবর দেয়া হলো। তাঁরা যে উঁচুদরের সাধু একথা বুঝতে পেরে তিনি নিজেই তাঁদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করার জন্য এলেন। মণ্ডপে এসে কিন্তু তাঁদের খোঁজ আর পেলেন না। তাঁরা যে এর মধ্যে কোথায় গেলেন তা কেউ বলতে পারলো না। এই (অলৌকিক) ঘটনায় রাজার মনে ধর্ম বিশ্বা। আরো গভীর হলো। তিনি রাজ্য ত্যাগ ক’রে সন্ন্যাস নিলেন। রাজা থেকে তিনি একেবারে নিম্ন পর্যায়ের ভিক্ষু হয়ে গেলেন। ফলে তিনি এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়লেন। তাই তিনি ভিক্ষুসংঘকে বললেন-’আগে আমি রাজা ছিলাম, সম্মানীয়দের মধ্যে আমার স্থান ছিল সবার উপরে। কিন্তু ভিক্ষু হবার পর আমাকে ভিক্ষু কুলের একেবারে তলে স্থান দেয়া হয়েছে।’ তখন সংঘ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে যারা পূর্ণসম্পদা লাভ করেননি এমন ভিক্ষুদের শ্রেণী বিভাগ সংঘে প্রবেশকাল অনুসারে করা হবে। একমাত্র এই সংঘারামটিতেই এ নিয়ম চালু রয়েছে।
এই রাজার পুত্র বজ্র তারপর সিংহাসন লাভ করলেন। তিনিও এই ধর্মের প্রতি গভীর অনুরক্ত ছিলেন। এই সংঘারামের পশ্চিমদিকে তিনিও একটি সংঘারাম স্থাপন করেন।
এরপর মধ্য ভারতের এক রাজা উত্তরদিকে একটি বিশাল সংঘারাম গড়লেন। এছাড়াও তিনি এই সংঘারামগুলির পুরো পরিসর উঁচু ঘের দেয়াল দিয়ে ঘিরে এক ফটকের মধ্যে সব সংঘারামগুলিকে রাখলেন। পর পর আরো অনেক রাজা নানা সৌধ তুললেন। ভাস্কর্য শিল্পীরা প্রাণ ঢেলে তাদের নৈপুণ্য খাটিয়ে সেগুলিকে শিল্পমণ্ডিত ক’রে তুলেছে। এভাবে পুরো জায়গাটি ধীরে ধীরে এক অপরূপ দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে। রাজা বললেন-’যে সম্রাট প্রথম এখানে সংঘারাম গড়েছেন তাঁর গড়া সংঘারামের মহাকক্ষ মধ্যে আমি একটি বুদ্ধ মূর্তি বসাব। প্রতিষ্ঠাতা সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন রূপে সংঘের চল্লিশ জন ভিক্ষুকে প্রত্যেকদিন খাওয়াবো।
এখানে বেশ কয়েক হাজার ভিক্ষু আছেন। যোগ্যতা ও প্রতিভার দিক থেকে তাঁরা সবার সেবা। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকশো ভিক্ষুর নাম ও খ্যাতি দূর দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। চাল-চলন আচার-ব্যবহারের দিক থেকে তাঁরা নিষ্ঠাবান ও ত্রুটিশূন্য। আন্তরিকতার সঙ্গে নৈতিক নীতি-দর্শনের মূল আদর্শ ও লক্ষ্যকে মেনে চলেন। এই সংঘারামের নীতি-নিয়মগুলি বেশ কঠোর। প্রতিটি ভিক্ষু তা মেনে চলতে বাধ্য। ভারতের সব দেশ তাঁদের শ্রদ্ধা করে, অনুসরণ করে। প্রতিদিন বহু তাত্ত্বিক প্রশ্ন এখানে তোলা হয়, তার উত্তর দেয়া হয়। প্রশ্ন আর উত্তরের ভিড়ের মধ্যে দিন যে কখন শেষ হয়ে যায় টের পাওয়া যায় না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সকলে নানা আলোচনায় নিমগ্ন। শিক্ষানবীশ ও অভিজ্ঞরা একে অপরকে সাহায্য ক’রে চলেছে। যাঁরা ত্রিপিটকের উপর কোন জিজ্ঞাসা বা প্রশ্নের উত্তর বা আলোচনা করার ক্ষমতা ধরেন না তাঁদের পণ্ডিত বলে গণ্য করা হয় না। এজন্য যেসব লোক তাড়াতাড়ি জ্ঞান ও খ্যাতির শিখরে উঠতে চান তাঁরা বিভিন্ন দেশ থেকে দলে দলে এখানে আসেন। এখান থেকে মনের জিজ্ঞাসা ও সংশয় দূর ক’রে নিয়ে তাঁরা ফিরে যান। এভাবে জ্ঞানের স্রোতধারা দিকে দিকে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সহজে নাম কেনার জন্য অনেকেই মিথ্যা করে নিজেকে এখানকার ছাত্র বলে পরিচয় দেয় ও সম্মান কুড়োয়। যদি বাইরের কোন লোক এখানে ছাত্র হিসাবে স্থান পেতে চায় বা আলোচনায় ভাগ নিতে চায় তবে দ্বারপাল তার কাছে কতকগুলি শক্ত প্রশ্ন তোলেন। অনেকেই তার উত্তর দিতে না পেরে এখান থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পুরানো ও নতুন বিভিন্ন শাস্ত্র বইয়ের উপর আগে থেকে গভীর দখল না থাকলে এখানে ছাত্র হিসাবে স্থান পাওয়া দুষ্কর। এজন্য, যেসব ছাত্র এখানে নতুন আসে তাদের গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ক্ষমতা দেখাতে হয়। সাধারণতঃ দশ জনের মধ্যে ৭ থেকে ৮ জনই এই পরীক্ষায় অসফল হয়। সেই সফল দুই বা তিনজন যখন এখানকার (পণ্ডিত) সমাবেশে আলোচনা করতে সুযোগ পায় তখন তাদের হার একেবারে নিশ্চিত। কিন্তু যারা অসাধারণ প্রতিভাধর তাদের নাম এখানকার বিরাট কৃতীদের নামের তালিকায় যুক্ত হয়ে যায়। যেমন ধর্মপাল ও চন্দ্রপাল : এঁরা এঁদের রেখে যাওয়া অনন্য জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞান ও পার্থিব লোকদেরও উদ্দীপিত করেছেন। গুণমতি আর স্থিরমতি : এঁদের উন্নতমানের শিক্ষাধারা এখনো বিদেশে পর্যন্ত প্রবাহিত। প্রভামিত্র : ইনি তাঁর সুস্পষ্ট আলোচনা ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত। জিনমিত্র : তাঁর উন্নত ধারার বাগ্মীতার জন্য নাম কিনেছেন। জ্ঞানচন্দ্রের রীতি ও খ্যাতিই তাঁর বিশিষ্ট কার্যকলাপের স্বাক্ষর। আছেন শীঘ্রবুদ্ধ ও শীলভদ্র। আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি আছেন যাঁদের নাম কালক্রমে লোকে এখন ভুলে গেছে। এই সব বিখ্যাত লোকেরা সকলের কাছে পরিচিত। তাঁরা সদগুণ ও প্রতিভায় পূর্ববর্তীদেরও ছাড়িয়ে যান, প্রাচীনদের জ্ঞানের সীমানাকেও অতিক্রম করেন। এদের প্রত্যেকেই অনেকগুলি করে (কয়েক দশ) ধর্মপ্রবন্ধ ও টীকা গ্রন্থ লিখে গেছেন ও সেগুলি ব্যাপকভাবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাঞ্জলতার জন্য সেগুলি এখনো সুপ্রচলিত।
এই সংঘারামের চারিদিকে শয়ে শয়ে পুণ্য স্মারক ছড়িয়ে আছে। বইয়ের আয়তন সংক্ষিপ্ত করার জন্য এ থেকে মাত্র গুটি কয়েকের কথা বলবো।
সংঘারামের পশ্চিমদিকে একটি বিহার আছে। এটি দেখার জন্য বেশি দূর হাঁটতে হবে না। পুরাকালে তথাগত এই জায়গাটিতে তিন মাস থাকেন ও দেবতাদের মঙ্গল বিধানের জন্য পরম ধর্মকে বিশেষভাবে ব্যাখ্যান করেন।
দক্ষিণ দিকে ১০০ পা মতো গেলে একটি ছোট স্তূপের দিকে নজর পড়বে। বহু দূর দেশ থেকে আসা এক ভিক্ষুকে বুদ্ধদেব এখানে দর্শন দেন।
এই দক্ষিণ দিকেই অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের একটি দাঁড়ানো মূর্তি আছে। কখনো কখনো তাকে এক সুরভি পাত্র নিয়ে বুদ্ধের বিহারের দিকে যেতে দেখা যায় কখনো বা ডানদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
এই মূর্তিটির দক্ষিণে একটি স্তূপ আছে। বুদ্ধদেব তিন মাস মধ্যে যত নখ ও চুল কাটেন তা এখানে রাখা আছে। যে সব লোক কঠিন রোগে ভোগেন তাঁরা এখানে এসে স্তূপটিকে প্রদক্ষিণ করলে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ভাল হয়ে যান।
এর পশ্চিমে, দেয়ালের বাইরের দিকে পুকুরের পাশে একটি স্তূপ আছে। এখানে চড়াই পাখি হাতে ক’রে এক বিধর্মী বুদ্ধদেবকে জন্ম ও মৃত্যু নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করেন।
দেয়ালের সীমানা মধ্যে, দক্ষিণ-পূর্বে ৫০ পা মতো গেলে একটি অসামান্য গাছ দেখা যাবে। এ গাছটি ৮ থেকে ৯ ফুট উঁচু, কিন্তু গাছটির দুটি গুঁড়ি। জীবিতকালে তথাগত একদিন তাঁর দাঁত ঘষে দাঁতনটি এখানে ছুঁড়ে ফেলেন। সেই দাঁতনটি থেকেই এ গাছটি গজিয়েছে। বহুকাল পার হয়ে গেলেও গাছটি বাড়েনি বা কমেনি।
তারপর পূর্বদিকে একটি বড়ো বিহার রয়েছে। এটি প্রায় দুশো ফুটের কাছাকাছি উঁচু। তথাগত এখানে চার মাস থেকে ধর্মের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা ক’রে যান।
এরপর উত্তরদিকে ১০০ পা মতো গেলে একটি বিহার দেখা যাবে। এখানে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের মূর্তি আছে। যে সব নিষ্ঠাবান ভক্তরা অপার ভক্তি নিয়ে তাঁকে পূজা অর্চ্চনা করেন, তাঁরা তাঁকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে দেখতে পান। তিনি একই স্থানে অনড় থাকেন না। কখনো তাঁকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, কখনো বা কুলুঙ্গীর বাইরে চলে আসেন। সাধারণ অনুগামী ও ভিক্ষু উভয় স্তরের ধর্মপ্রাণ লোকই চারিদিক থেকে দলে দলে তাঁকে পূজা দিতে আসে।
এই বিহারটির উত্তরদিকে এর চেয়েও বড়ো একটি বিহার আছে। এটি খাড়ায় তিনশো ফুটের কাছাকাছি। রাজা বালাদিত্য এই বিহারটি তৈরী ক’রে গেছেন। এর গঠন সৌন্দর্য, আকার ও বুদ্ধ মূর্তিটি বোধিবৃক্ষের কাছে থাকা বড়ো বিহারটির মতন।
এর উত্তর-পূর্বদিকে একটি স্তূপ দেখা যাবে। তথাগত এখানে সাতদিন ধরে পরম ধর্মের ব্যাখ্যান করেন।
উত্তর-পশ্চিমদিকে একটি জায়গা আছে সেখানে বিগত চার বুদ্ধ ওঠা-বসা চলাফেরা করেন।
এর দক্ষিণদিকে রাজা শীলাদিত্যের তৈরী বিহারটি দেখা যাবে। এটি পিতল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। বানানো এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। পরিকল্পনা মতো গড়ে শেষ হলে এর খাড়াই ১০০ ফুট হবে।
তারপর পূর্বদিকে দু’শো পা মতো গেলে, দেয়ালের বাইরের দিকে বুদ্ধের একটি দাঁড়ানো মূর্তি চোখে পড়বে। এটি তামার তৈরী, উঁচু প্রায় ৮০ ফুটের মতো। এটিকে আচ্ছাদন করতে হলে ছ’তলা মণ্ডপের দরকার। রাজা পূর্ণবর্মা এটি তৈরী করে গেছেন।
এই মূর্তিটির উত্তরদিকে ২-৩ লি মতন যাবার পর ইটে গাঁথা একটি বিহার চোখে পড়বে। তার মধ্যে ‘তারা’ বোধিসত্ত্বের মূর্তি রয়েছে। মূর্তিটি খুব উঁচু। এর অলৌকিক ক্ষমতাও বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। প্রত্যেক উপবাসের দিনে এখানে বেশ বড়ো আকারে পূজা হয়। প্রতিবেশী দেশগুলির রাজা, মন্ত্রী ও বড়ো বড়ো লোকেরা অতি মনোহর সব সুগন্ধি, নানারকম ফুল, রত্নখচিত পতাকা, ছত্র প্রভৃতি দিয়ে পূজা নিবেদন করেন। এই সময় বীণা, বাঁশী আরো নানারকম পাথর ও ধাতুর তৈরী বাজনা-যন্ত্র সহ সঙ্গীত পরিবেশন ক’রে চলে। এরূপ অনুষ্ঠান ৭ দিন ধরে চলে।
দক্ষিণ ফটকের দিকে, সীমানার মধ্যে একটি বড়ো কুয়া আছে। একদিন একজন বণিক পিপাসার্ত হয়ে জায়গাটিতে বুদ্ধের কাছে আসেন। ভগবান আঙুল দিয়ে এই বিশেষ জায়গাটি দেখিয়ে বলেন-’ওখানে জল রয়েছে’। বণিকদের দলপতি একথা শুনে তাঁর শকটের অক্ষদণ্ডের ডগা দিয়ে এ জায়গাটি বিঁধতেই নিচ থেকে ফোয়ারার মতো জল বেরিয়ে এলো। জল খেয়ে তাঁরা তৃপ্ত হলেন। এরপর বুদ্ধদেবের ধর্ম ব্যাখ্যান শুনলেন। সকলেই এর ফলস্বরূপ মোক্ষ লাভ করলেন।
এই সংঘারামটি থেকে ৮/৯ লি মতো দক্ষিণ-পশ্চিমে গেলে আমরা কূলিক নামে একটি গ্রামে এসে পৌঁছাই। এই গ্রামের মধ্যে রাজা অশোকের গড়া একটি স্তূপ দেখলাম। পূজনীয় মুদগলপুত্র এখানে জন্ম নেন। গ্রামের পাশে আরো একটি স্তূপ দেখা যাবে। এখানেই তিনি পরম-নির্বাণ লাভ করেন। এই স্তূপটিতে তাঁর মরদেহের অবশেষ রয়েছে। পূজনীয় মুদগলপুত্র এক নামকরা ব্রাহ্মণ বংশের সন্ত ান। ছোটকাল থেকেই তিনি ও সারিপুত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সব কথা প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে বলার ক্ষমতার জন্য সারিপুত্রের বিরাট খ্যাতি ছিল। অপরজনের খ্যাতি ছিল ধারণ ক্ষমতা ও জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ প্রতিভার জন্য। তাঁদের জ্ঞান ও প্রতিভা ছিল সমান স্তরের। তাঁরা সব সময় একই সঙ্গে থাকতেন। তাঁদের লক্ষ্য এবং বাসনাও প্রথম থেকে পর্যন্ত অভিন্ন ছিল।
মুদগলপুত্রের জন্ম-গ্রাম থেকে ৩/৪ লি পূর্বদিকে গেলে একটি স্তূপ। বুদ্ধদেবের সাথে দেখা করতে রাজা বিম্বিসার এখানে আসেন।
এই জায়গাটি থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রায় ২০ লি পথ চলার পর আমরা কালপিনাক শহরের দেখা পাই। এই শহরটিতে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ আছে। পূজনীয় সারিপুত্র এখানে জন্ম নেন। এখানকার কুয়াটি এখনো বর্তমান এর পাশেই একটি স্তূপ আছে। এখানে সারিপুত্র নির্বাণ লাভ করেন। এই স্তূপে তাঁর দেহাবশেষ রাখা আছে। তিনিও বড়ো ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান। তাঁর পিতা বিখ্যাত পণ্ডিত ও গুণীব্যক্তি ছিলেন। সারিপুত্র বুদ্ধের আগেই মারা যান।
কালপিনাক শহর থেকে ৪-৫ দক্ষিণ পূর্বদিকে একটি স্তূপ দেখা যাবে।
সেখান থেকে পূর্বদিকে ৩০ লি মতো যাবার পর আমরা ইন্দ্রশৈল গুহা পর্বতে পৌছাই। খাড়া পাহাড়ী অঞ্চল ও উপত্যকাগুলি বেশ থমথমে ও ছায়ান্ধকার। বন জঙ্গলের মতো গাদা গাদা ফুলের গাছ। পাহাড়টির দুটি চূড়া। বেশ খাড়া, আকাশ ছোঁয়া। পশ্চিম চূড়ার ডাইনে নিচু পাহাড়মালার মাঝে একটি বড়ো গুহা আছে। এটি বেশ চওড়া হলেও তেমন উঁচু নয়। বুদ্ধ এখানে থাকাকালে দেবরাজ ইন্দ্র পাথরের উপর ৪২টি কূটচিত্র আঁকেন ও বুদ্ধের কাছে তার ব্যাখ্যা চান।
বুদ্ধ সেগুলির ব্যাখ্যা দেন। এই কূটচিত্রগুলি এখনো বর্তমান। বর্তমানকালের লোকেরা এই পবিত্র চিত্রগুলি দেখে নকল করার চেষ্টা করে। যারা এখানে পূজা দিতে আসে তাদের মধ্যে এক ধর্মীয় ভাবান্তর দেখা দেয়।
পাহাড়ের গায়ে বিগত চার বুদ্ধের ওঠা-বসা, চলা-ফেরার চিহ্ন আজো বর্তমান। পূর্বদিকের চূড়ার উপরে একটি সংঘারাম রয়েছে। আর তার সামনে একটি স্তূপ। নাম হংস-স্তূপ।
ইন্দ্ৰশৈল গুহা পর্বতমালা থেকে ১৫০ বা ১৬০ লি মতো উত্তর-পূর্বদিকে গেলে কপোতক সংঘারামের দেখা পাওয়া যাবে। এখানে ২০০ জনের মতো ভিক্ষু বাস করেন। এঁরা সর্বাস্তিবাদ শাখার অনুগামী। সংঘারামের পূর্বদিকে রাজা অশোকের গড়া একটি স্তূপ।
এখান থেকে ২/৩ লি দক্ষিণদিকে গেলে একটি নিরালা পাহাড় দেখা যাবে। পাহাড়টি বিরাট উঁচু ও ঘন বন-জঙ্গলে পুরোটা ঢাকা। নানারকমের নামকরা ফুল ও ঝরনার নির্মল জলধারায় এর চারদিক ঘেরা। এই জলধারা এর খাদের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে। এই পর্বতটিতে অনেকগুলি বিহার ও পুণ্য মন্দির রয়েছে। এগুলি অতি উঁচুদরের শিল্পভাস্কর্য মণ্ডিত। বিহারের ঠিক মধ্যস্থলে অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি রয়েছে। হাতে পদ্মফুল ও মাথার উপর একটি বুদ্ধ মূর্তি।
এখানে সবসময়ই কিছু লোকে বোধিসত্ত্বের দেখা পাওয়ার জন্য উপোস করে হত্যা দিয়ে পড়ে থাকে। ৭ দিন, ১৪ দিন এমনকি পুরো একমাসও তারা এরকম হত্যা দিয়ে পড়ে থাকে। যারা প্রকৃত অনুরাগী তারা দেখা পায়।
পুরাকালে সিংহলের রাজা সকালবেলা আয়নায় নিজের মুখ দেখতে গিয়ে নিজের মুখের বদলে জম্বুদ্বীপের মগধ দেশের একটি পর্বত উপরে তালবনের মধ্যে বোধিসত্ত্বের এই মূর্তিটি দেখতে পান। রাজা মূর্তিটির সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে অনুসন্ধান শুরু করলেন। তারপর এই পাহাড়ে এসে তার সন্ধান পেলেন। তখন তিনি এখানে একটি বিহার বানিয়ে দিলেন ও নিয়মিত পূজার্চ্চনার ব্যবস্থা করলেন। পরবর্তী রাজারা তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এখানে আরো বিহার ও স্ত পাদি গড়েন। এখানে গান বাজনাসহ সব সময়ে ফুল ধূপ ও ধুনা জ্বালানো হয়।
এই বিহারটি থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে ৪০ লি মতো পথ এগিয়ে যাবার পর একটি সংঘারাম দেখা যাবে। এখানে ৫০ জনের মতো ভিক্ষু থাকেন। এরা সকলেই হীনযানের উপাসক। সংঘারামটির সামনে একটি স্তূপ আছে। এর পাশেই বিগত তিন বুদ্ধের বসা ও চলাফেরার চিহ্ন রয়েছে।
সংঘারামটি থেকে উত্তর-পূর্বদিকে ৭০ লি যাবার পর গঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে একটি বড়ো গ্রামে এসে হাজির হলাম। গ্রামটিতে অনেক লোকের বাস। এখানে অনেক দেবমন্দির আছে। প্রত্যেকটিই সুন্দরভাবে নানা কারুকাজ করা।
এখান থেকে অল্প কিছুটা দক্ষিণ-পূর্বদিকে একটি বড় স্তূপ চোখে পড়লো।
আরো পূর্বদিকে এগিয়ে আমরা এক নির্জন পর্বতমালার মধ্যে এসে ঢুকলাম। এই পাহাড়মালা ভেঙে প্রায় ১০ লি পথ চলার পর ‘লো-ইন-নি-লো’ গ্রামের সংঘার মটিতে এসে উপস্থিত হলাম।
এই সংঘারামটির সামনে অশোক রাজার তৈরি একটি বড়ো স্তূপ আছে। এর উত্তর দিকে ২ বা ৩ লি মতো গেলে একটি বিরাট হ্রদের দেখা পাওয়া যাবে। এটির ঘের প্রায় ৩০ লির মতো। সব ঋতুতেই এখানে চার রকম রঙের পদ্মফুল ফোটে।
॥ ৪৩ ॥ ‘ই-লান-ন-পো-ফো-তো’ বা হিরণ্য পর্বত
এবার আরো পূর্বদিকে এগিয়ে চললাম। এক বিরাট নিবিড় অরণ্যের মধ্য দিয়ে পথ চলেছি। এ অরণ্য যেন আর শেষ হয় না। ২০০ লি মতো যাবার পর এলাম ই-লোন-ন-পো-ফো-তো বা হিরণ্য পর্বত রাজ্যে।
তিন হাজার লি মতন পরিসর এ রাজ্যটির। রাজধানীর আয়তন মোটামুটি ২০ লি। তার উত্তরদিক দিয়ে গঙ্গা নদী বয়ে চলেছে। এখানে নিয়মিত চাষ-আবাদের কাজ হয়। ফসলের প্রচুর ফলন। ফুল ফলও অফুরান। আবহাওয়া বেশ ভালই, গরমের দাপট তেমন জোরালো নয়। মানুষজন সৎ ও সরল।
দশটি সংঘারাম আছে। সেখানে চার হাজারের মতো ভিক্ষু। বেশির ভাগই হীনযানের সম্মতীয় শাখার অনুগামী। ১২টির মতো দেবমন্দির। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্যধর্মীরা সেখানে থাকে।
সম্প্রতি পাশের কোন এক রাজ্যের রাজা এ রাজ্যটি দখল করে নিয়েছেন। তিনি বৌদ্ধদের প্রতি উদার। এ শহরে তিনি দু’টি সংঘারাম তৈরি করে দিয়েছেন। প্রত্যকটিতে হাজারের চেয়ে কিছু কম ভিক্ষু থাকার ব্যবস্থা আছে, দুটি সংঘারামই হীনযানের সর্বাস্তিবাদ শাখার অনুগামী।
রাজধানীর পাশে গঙ্গা নদীর কোল ঘেঁষে হিরণ্য পর্বত। ধোঁয়া আর বাষ্প উগরে পর্বতটি সূর্য ও চাঁদের আলো তার আস্তরণে ঢেকে চলেছে। সুদূর অতীত থেকে অধুনা পর্যন্ত এটি মুনি-ঋষিদের বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে আছে। এখন এখানে একটি দেবমন্দির রয়েছে। প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিরা যে সব বিধি-বিধান দিয়ে গেছেন, মন্দিরটিতে এখনও সে সব মেনে চলা হয়। তথাগতও অতীতে এখানে বাস করে গেছেন, ব্যাখ্যান করে গেছেন পরম ধর্মের।
রাজধানীর দক্ষিণ দিকে একটি ও তার পশ্চিমে আরেকটি স্তূপ।
দেশের পশ্চিম সীমানার দিকে গঙ্গা নদীর দক্ষিণ বরাবর একটি নির্জন পাহাড় রয়েছে। এটির দুটি চূড়া। অনেক উঁচু পর্যন্ত উঠে গেছে চূড়া দুটি।
পর্বতটির দক্ষিণ-পূর্বে একটি পাথরের উপর বুদ্ধের উপবেশন চিহ্ন রয়েছে। এর উপর একটি স্তূপ গড়া হয়েছে।
তার দক্ষিণ-পূর্বে একটি জায়গায় যক্ষ বকুলের পদচিহ্ন রয়েছে। পর্বত চূড়ায়ও বুদ্ধদেবের পদচিহ্নের উপর একটি স্তূপ বানানো হয়েছে।
এর পশ্চিমদিকে ছয় সাতটি উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে। তার জল খুবই গরম।
দেশটির দক্ষিণ সীমানা ঘিরে বিরাট পাহাড়ী বনাঞ্চল। সেখানে বড়ো বড়ো বুনো হাতির বাস।
॥ ৪৪ ॥ ‘চেনা-পো’ বা চম্পা
হিরণ্য পর্বত রাজ্য পিছনে রেখে, গঙ্গা পার হয়ে, তার দক্ষিণ তীর বরাবর পূর্বদিকে চলতে থাকলাম। প্রায় তিনশো লি পথ পার হবার পর চেন-পো বা চম্পা
রাজ্যের দেখা পেলাম।
চম্পা রাজ্যটির আয়তন চার হাজার লির মতো। রাজধানীর উত্তর সীমানা দিয়ে গঙ্গা নদী বয়ে চলেছে। শহরটি আকারে ৪০ লির মতো। ভূমি সমতল ও উর্বরা। নিয়মিত চাষ আবাদের কাজ হয়, ফসলের ফলনও পর্যাপ্ত। আবহাওয়া মোলায়েম ধরনের, গরমের দাপট রয়েছে কিছুটা। লোকজন সৎ ও সরল স্বভাবের। অনেকগুলি কয়েক দশ) সংঘারাম আছে। বেশির ভাগেরই ভাঙাদশা। মাত্র শ’ছয়েক ভিক্ষুর দেখা পাওয়া গেলো সেগুলিতে। তাদের সকলেই দেখলাম হীনযানের অনুগামী।
কুড়িটির মতো দেব মন্দির। সেখানে সব সম্প্রদায়ের বিধর্মীরাই থাকে। রাজধানীর আরক্ষা-প্রাকার ইট দিয়ে গড়া ও রীতিমতো উঁচু (কয়েক দশ ফুট)। খুব উঁচু বাঁধের উপর এই সব দেয়ালের ভিতের পত্তন করা হয়েছে। ফলে, এই দেয়াল পাহাড়ের মতো খাড়া। শত্রুর আক্রমণ সহজেই ব্যর্থ করে দিতে পারে।
শহর থেকে ১৪০/১৫০ লি মতো পূর্বে, গঙ্গা নদীর দক্ষিণদিকে, একটি নির্জন ও বিচ্ছিন্ন পর্বত রয়েছে। পাহাড়টি বেশ খাড়া ও এবড়ো খেবড়ো, চারিদিক জলে ঘেরা। পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে একটি দেব মন্দির। পাহাড় কুরে কুরে কতক ঘর বানানো হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘরের মধ্য দিয়ে নদীর ধারা অবিরাম বয়ে চলেছে। নানা বিচিত্র ফুলগাছে জায়গাটি নয়ন জুড়ানো ফুলের অরণ্য হয়ে উঠেছে। এখানকার পাহাড়ে বন্দরে অনেক সাধু-সন্ত-জ্ঞানীর আবাস। যারা একবার এখানে আসে তাদের আর ফিরে যেতে মন চায় না।
দেশটির দক্ষিণ সীমানা ঘিরে বুনো জন্তু-জানোয়ার ভরা গভীর অরণ্য। বুনো হাতি, নানা রকম হিংস্র পশুরা দল বেঁধে ঘোরাফেরা করে সেখানে।
॥ ৪৫ ॥ “কিএ-চু-হোহ-খি-লো’ বা কঘীর (বা কজিঙ্ঘরা )
চম্পা থেকে পূর্বদিকে গেলাম এবার। চারশো লি মতো পথ চলার পর দর্শন পেলাম ‘কিএ-চু-হো-হ-খি-লো’ বা কঘীর-এর।
এই রাজ্যটির পরিসর ২০০০ লির মতো হবে। জমি সমতল ও মাটি দো- আঁশ। চাষ আবাদ করে ফসলের ফলনও প্রায় অঢেল। গরমের দেশ। অধিবাসীদের চাল-চলনের মধ্যে সরলতার ভাব রয়েছে। উঁচু প্রতিভাবান লোকেদের বিশেষ শ্রদ্ধা সম্মান দেখায়। লেখাপড়া ও শিল্পকলাকে যথেষ্ট সমাদর করে।
ছ’টি সাতটি সংঘারাম আছে এখানে। ভিক্ষু আছেন সেখানে তিনশো জনের মতো। দশটির কাছাকাছি দেব মন্দির। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্যধর্মীরা সেখানে থাকে।
কয়েক শতাব্দী হলো এখানকার রাজবংশ লোপ পেয়ে গেছে। একটি পড়শী রাজ্য এখন একে শাসন করছে। এর শহরগুলোতে মানুষজন একরকম নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ লোকই গ্রামে ও আশ্রমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এজন্য পূর্ব-ভারতে ঘুরে বেড়ানোর কালে শীলাদিত্য রাজা এখানে একটি প্রাসাদ গড়েন ও সেখান থেকে তাঁর বিভিন্ন রাজ্যের কাজকর্ম চালানোর ব্যবস্থা করেন। গাছের ডালপালা ও খড় দিয়ে অস্থায়ীভাবে এটি হয়েছিল। তিনি চলে যাবার পর সেটি পুড়িয়ে ফেলা হয়। দেশটির দক্ষিণ সীমানায় অনেক বুনো হাতির আবাস।
উত্তর সীমানায় গঙ্গা নদীর কাছেই একটি বেশ বড়ো ও উঁচু স্তূপ রয়েছে। এটি ইট ও পাথর দিয়ে তৈরী। এর ভিত বেশ প্রশস্ত ও উঁচু। নানারকম দুর্লভ ভাস্কর্যকলা এর গায়ে খোদাই করা। স্তূপের চারিদিকে মুনিঋষি, দেবতা ও বুদ্ধদেবের মূর্তি আলাদা আলাদা খোপের মধ্যে খোদাই করা হয়েছে।
॥ ৪৬ ॥ ‘পুন-ন-ফ-তন-ন’ বা পুণ্ড্রবর্ধন
পূর্বদিকে এগিয়ে চললাম। গঙ্গা নদীও পার হলাম। প্রায় ৬০০ লি মতন পথ ভাঙার পর এলাম ‘পুন-ন-ফ-তন-ন’ বা পুণ্ড্রবর্ধন।
এ রাজ্যটি আকারে ৪০০ লি প্রায়। রাজধানী ৩০ লির কাছাকাছি। বেশ ঘন বসতির দেশ। পুকুর, সরকারী দপ্তর আর পুষ্পকুঞ্জ পর পর চোখে পড়বে। জমি সমতল। মাটি দো-আঁশ। সবরকম শস্যের অপর্যাপ্ত ফলন। পণস ফল প্রচুর পরিমাণে ফলে ও এখানে তার বেশ আদর রয়েছে। এর ফল এক একটি কুমড়োর মতো বিরাট। পাকলে হলুদাভ-লাল রঙের চেহারা নেয়। ভাঙলে তার ভেতর পায়রার ডিমের মতো অগুণতি ছোট ছোট ফল দেখা যাবে। এই ফলগুলি হলুদাভ-লাল রঙের ও রসে ভর্তি। গন্ধও অতি মধুর। এ ফল কখনো অন্যান্য ফলের মতন গাছের ডালে হয়, কখনো বা গাছের গুঁড়িতে। আবহাওয়া না বেশি গরম না বেশি ঠাণ্ডা। জ্ঞানচর্চাকে লোকেরা বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
এখানে কুড়িটির মতন সংঘারাম আছে। ভিক্ষু আছেন তিন হাজার প্রায়। হীনযান ও মহাযান দু’য়েরই চর্চা করেন তাঁরা।
শ’খানেকের মতো দেবমন্দির রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্য-ধর্মীরা সেখানে বসবাস করেন। নগ্ন নির্গ্রন্থ উপসাকদের সংখ্যা সব থেকে বেশি।
রাজধানী থেকে ২০ লি মতন গেলে পো-চি-পো সংঘারামটি দেখা যাবে। এর আঙিনাগুলি বড়ো ও আলোক ভরা। গম্বুজ ও মণ্ডপগুলি খুব উঁচু। ৭০০ জনের মতো ভিক্ষু রয়েছেন। মহাযান শাখার চর্চা করেন। ভারতের পূর্ব অঞ্চলের অনেক নামকরা ভিক্ষু এখানে থাকেন।
এর কাছেই রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ রয়েছে। অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের মূর্তি থাকা একটি বিহারও দেখলাম।
॥ ৪৭ ॥ ‘কিআ-মো-লু-পো’ বা কামরূপ
পুণ্ড্রবর্ধনকে পেছনে ফেলে আরো পূর্বদিকে চলেছি। ৯০০ লি মতো পথ ভেঙে একটি নদী পেরিয়ে কিআ-মো-লু-পো বা কামরূপ রাজ্যে এলাম। (আসলে তিনি মগধ থেকে কামরূপ আসেন।)
এ রাজ্যটির আয়তন দশ হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানীর পরিধি হবে প্রায় ৩০ লি। এখানকার জমি নিচু। কিন্তু বেশ সরস ও উর্বরা, নিয়মিতভাবে চাষ আবাদ হয়ে থাকে। এখানে পণস (কাঁঠাল) ও নারিকেল চাষ হয়। ফল দু’টির গাছ এখানে অগুণতি হলেও বিশেষ মূল্য বা মর্যাদা পায় না। নদী বা বাঁধানো সরোবর থেকে খাল কেটে নিয়ে আসা জল শহরগুলিকে ঘিরে বয়ে চলেছে। আবহাওয়া কোমল ধরনের, শীত ও গরম কোনটাই বেশি গায়ে বেঁধে না। লোকজনের চালচলন সাদামাটা। সৎ প্রকৃতির। এদের চেহারা ছোটোখাটো, গায়ের রঙ ঘন-হলুদ ঘেঁষা। ভাষা তাদের মধ্য ভারতের ভাষার চেয়ে একটু অন্যরকম। স্বভাব অতি একগুঁয়ে ও বুনো ধরনের। স্মরণশক্তি বেশ প্রখর। জ্ঞানচর্চ্চার দিকে বেশ আগ্রহী।
তারা দেবতাদের পূজা করে ও তাদের কাছে বলি দেয়। বৌদ্ধধর্মের প্রতি কোন অনুরাগ নেই। এ জন্য বুদ্ধের জন্ম থেকে এ যাবৎ একটিও সংঘারাম তৈরি হয়নি।
একশোটির মতো দেবমন্দির আছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কয়েক অযুত অনুগামী আছেন সেখানে। বর্তমান রাজা প্রাচীন বিষ্ণুদেব পন্থী। জাতিতে তিনি ব্রাহ্মণ। তাঁর নাম ভাস্কর বর্মণ, উপাধি-কুমার। এ বংশ এ রাজ্যের রাজা হবার পর থেকে বর্তমান রাজা পর্যন্ত এক হাজার প্রজন্ম পার হয়েছে। রাজা জ্ঞানচর্চ্চায় বিশেষ অনুরাগী। তাঁর দেখাদেখি তাঁর প্রজারাও এদিকে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রতিভাবান লোকেরা কাজের আশায় তাঁর কাছে আসেন। তিনি বুদ্ধদেবের অনুগামী না হলেও বিদ্বান শ্রমণদের খুব শ্রদ্ধা করেন। বুদ্ধের মহান ধর্মমত অধ্যয়ন করার জন্য চীনের মতো এক দূরদেশ থেকেও একজন শ্রমণ মগধের নালন্দা বিহারে এসেছেন ও কঠোর শ্রম ক’রে অধ্যয়ন করে চলেছেন এ খবর তাঁর কানে যেতেই তিনি এর মধ্যেই তিন তিন বার আমাকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমি যাইনি। তখন আচার্য শীলভদ্র আমায় বললেন : ‘বুদ্ধদেবের প্রতি অন্তরের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ইচ্ছা থাকলে তাঁর সত্য-ধর্ম প্রচারের দিকে তোমার মন দেয়া উচিত, এ তোমার এক কর্তব্য। দূর পথকে তোমার ভয় করা উচিত নয়। কুমার রাজা ও তাঁর পরিবারের লোকেরা অন্যধর্মীদের অনুগামী। অথচ তিনি একজন শ্রমণকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। এ এক শুভ লক্ষণ। এ থেকে মনে হচ্ছে তাঁর মনের ও মতের পরিবর্তন ঘটছে। তিনি সত্যিকারের পুণ্যকর্ম করে অপরের মঙ্গল করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সকলের উপকারের জন্য তুমি এর আগে জীবনের পরোয়া না করেও একা একা এখানে আশার শপথ নিয়েছিলে।’ এভাবে তিনি আমায় উদ্বুদ্ধ করতে আমি আর কোনরকম ছলছুতো বা বিলম্ব না করে তাঁর দূতের সঙ্গে সোজা তাঁর রাজ্যে যাত্রা করলাম।
আমি আসতে কুমার রাজা বললেন : ‘আমার যদিও কোনরকম প্ৰতিভা নেই তাহলেও আমি সব সময়ে বিশেষ জ্ঞানী লোকেদের ভাল চাই। আপনার খ্যাতি ও গুণের কথা শোনার পর থেকে তাই আমি আপনাকে নিমন্ত্রণ জানাবার সাহস করেছি।’
আমি উত্তর দিলাম : ‘আমার বিদ্যাবুদ্ধি অতি সামান্য। আমার তো মনে হয় আপনি আমার অখ্যাতির কথাই শুনে থাকবেন।’
এভাবে নানা কথা বিনিময়ের পর তিনি আমার কাছ থেকে চীন রাজার বিরাট সাম্রাজ্যের কথা শুনে, সেখানে যাবার গভীর বাসনার কথা প্রকাশ করলেন। শেষে বললেন : রাজা শীলাদিত্য এখন কজুঘীর রয়েছেন। জ্ঞান ও পুণ্যের শিকড় গভীরে ছড়িয়ে দেবার জন্য তিনি কিছুদিনের মধ্যেই বিরাট দানধ্যান করবেন। পঞ্চ ভারতের সকল শ্রমণ ও ব্রাহ্মণদের সেখানে সমবেত হওয়া বিশেষ জরুরী। তিনি আমায় নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। আমার অনুরোধ আপনিও আমার সঙ্গে চলুন।
এর পর আমরা একসঙ্গে যাত্রা করলাম।
এ রাজ্যটির পূর্বদিকটি সার সার পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এজন্য সেদিকে কোন বড়ো শহর নেই। রাজ্যের সীমান্ত দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের অসভ্য উপজাতি এলাকার সংলগ্ন। এইসব উপজাতির লোকেরা রীতিনীতি চালচলনের দিক থেকে আসলে ‘মন’ গোষ্ঠীর লোকেদের সমগোত্রীয়। খোঁজ খবর নিয়ে যা জানলাম তা থেকে আমার ধারণা হলো যে, এদিক দিয়ে দু’মাস ধরে হাঁটলে আমরা ঝে’চুয়েন (শুহ্ ) প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানায় গিয়ে পৌছাবো। কিন্তু পর্বত ও নদী এই যাবার ব্যাপারে বিশেষ প্রতিবন্ধক। দূষিত বাতাস, বিষ বাষ্প, ভয়ংকর সব সাপ ও বিষাক্ত গাছ-পালার দরুন পদে পদে মরণের ভয় রয়েছে।
রাজ্যটির দক্ষিণ-পূর্বে পালে পালে বুনো হাতিরা ঘুরে বেড়ায়। এজন্য, এখানে এদের বিশেষভাবে যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়।
॥ ৪৮ ॥ ‘সন-মো-ত-চ’ বা সমতট
এখান থেকে ১২০০-১৩০০ লি দক্ষিণ দিকে পথ চলে সন-মো-ত-চ বা সমতটে উপস্থিত হওয়া যায়। [পুণ্ড্রবর্ধন-কর্ণসুবর্ণ-সমতট এই পথে আসেন]
সাগরকূলে থাকা এ রাজ্যটির আয়তন তিন হাজার লি মতো। জমি নিচু ও সরস। রাজধানীর পরিধি ২০ লি খানেক হবে। শস্যের প্রচুর ফলন দেখে বোঝা যায় চাষ আবাদের কাজ নিয়মিত বেশ আগ্রহের সঙ্গেই করা হয়ে থাকে এখানে। যেদিকে চোখ ফেরাও শুধু ফুল আর ফল। আবহাওয়া স্নিগ্ধ। লোকের আচার ব্যবহার বেশ মোলায়েম। অধিবাসীরা সহজাত ভাবেই পরিশ্রমী। ছোটখাটো গড়নের শরীর, গায়ের রঙ কালচে ধরনের। জ্ঞানচর্চ্চা করতে বেশ ভালো পারে, তাকে আয়ত্ত করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে। সত্যধর্ম ও অন্য ধর্ম দু’য়েরই অনুগামী আছেন এখানে। তিরিশটি বা তার কাছাকাছি সংঘারাম আছে, প্রায় দু’হাজার ভিক্ষু থাকেন। সকলেই স্থবির শাখার অনুগামী। শ’খানেক দেবমন্দির রয়েছে। সেখানে সবরকম অনুগামীই থাকেন। নগ্ন নির্গ্রন্থ সন্ন্যাসীরাই সব থেকে বেশি।
শহরের বাইরে একটুখানি গেলেই অশোক রাজার তৈরী একটি স্তূপ দেখা যাবে।
এর কাছাকাছি একটি সংঘারাম আছে। সেখানে সবুজ পাথরে (Jade) গড়া একটি বুদ্ধিমূর্তি দেখতে পেলাম। মূর্তিটি আট ফুট উঁচু।
এখান থেকে উত্তর-পূর্বদিকে সাগরকূল ধরে এগিয়ে গেলে শ্রীক্ষেত্র রাজ্যে আসা যায় (Shi-li-cha-to-lo=Burma)।
এরপর দক্ষিণ-পূর্বদিকে গেলে সাগরকূলে কামলঙ্কা (Kia-mo-long-kia Pegu)। আরো পূর্বদিকে গেলে দ্বারপতি (To-Lo-Pa-ti = Probably Shyam)। তারপর আরো পূর্বদিকে এগোলে দেখা মিলবে ঈশানপুরের (I-Shang-na-pu- lo)। আরো পূর্বে গেলে মহাচম্পা (Mo-ho-chem-po)। এর পর দক্ষিণ-পশ্চিমে চললে যমনদ্বীপ। এ ছ’টি দেশ এতো পাহাড়-পর্বত নদীতে ভরা যে সেখানে যাওয়া অসম্ভব।
॥ ৪৯ ॥ তান-মো-লি-তি বা তাম্রলিপ্তি
সমতট থেকে পশ্চিমদিকে ৯০০ লির মতো পথ ভাঙার পর তান-মো-লি-তি বা তাম্রলিপ্তি রাজ্যের দেখা পাওয়া যাবে।
রাজ্যটি আকারে ১৪০০ থেকে ১৫০০ লি মতো। রাজধানীর আয়তন দশ লি খানেক। এ রাজ্যটিও সাগরকূলে। ভূমি নিচু ও সরস। নিয়মিতভাবে চাষবাসের কাজ হয়। দেদার ফুল ও ফলের ছড়াছড়ি। আবহাওয়া গরম ধাঁচের। লোকজনেরা চটপটে ও ব্যস্তবাগীশ। বেশ পরিশ্রমী ও সাহসী। সত্যধর্মানুরাগী ও অন্য-ধর্মী দুই-ই আছে।
এখানে দশটির মতো সংঘারাম। সেখানে হাজার জনের কাছাকাছি ভিক্ষু থাকেন। দেবমন্দির প্রায় পঞ্চাশটি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্য-ধর্মীরা সেখানে মিলেমিশে বাস করছেন। দেশটির উপকূল একটি সমুদ্র খাড়ি দিয়ে ঘেরা (উপসাগর)। জল ও ভূমি যেন একে অপরকে আলিঙ্গন ক’রে রয়েছে। প্রচুর পরিমাণে নানারকম দামী দামী পণ্যসামগ্রী ও রত্নাদি এখান থেকে সংগ্রহ করা হয়। এজন্য এখানকার লোকেরা সাধারণভাবে বেশ ধনী।
শহরের কাছ ঘেঁষে অশোক রাজার গড়া একটি স্তূপ রয়েছে।