হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – ১০

॥ ১০ ॥ পুন-নু-ৎসো: পুনাচ বা পুন্‌চ

এবার কাশ্মীর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রওনা হলাম। কয়েকটি পর্বত ডিঙিয়ে, অনেক খাড়া চড়াই আর ছোট ছোট খাড়া পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে ৭০০ লির মতো পথ চলার পর পুন্চ রাজ্যের দেখা পেলাম।

রাজ্যটি দু-হাজার লির মতো আয়তনের। অনেক পাহাড় আর নদী আছে দেখলাম। তার ফলে চাষ-আবাদ করার মতো জমি খুবই কম। তবে নিয়মিতভাবে এখানে ফসল বোনার কাজ হয়। ফুল আর ফলের পরিমাণ যথেষ্ট। প্রচুর আখ জন্মে। কিন্তু আঙুরের ফলন নেই। অমল, উদুম্বর, মোচ এসব প্রচুর। একেবারে অঢেলভাবে ফলানো হয়। খেতে সুস্বাদু বলে এসব ফলের আবাদ বেশ লাভজনক।

আবহাওয়া উষ্ণ ও ভিজালো। লোকেরা সাহসী। সাধারণতঃ সূতীর পোষাক পরে। স্বভাব-চরিত্রের দিক থেকে সবাই সত্যানুরাগী, ন্যায়বান। তারা বৌদ্ধ ধর্মের অনুগামী। এখানে পাঁচটি সংঘারাম চোখে পড়লো। তবে বলতে গেলে, সবগুলিই প্রায় জনশূন্য। এখানকার কোন স্বাধীন রাজা নেই, এরা কাশ্মীরের অধীন।

প্রধান শহরের উত্তরদিকে একটি সংঘারাম চোখে পড়লো। সামান্য কয়েকজন ভিক্ষু রয়েছেন দেখলাম। একটি স্তূপও আছে এখানে।

॥ ১১ ॥ হো-লো-শি-পু-লো: রাজপুরী

পুন্‌চ থেকে এবার দক্ষিণ-পূর্বদিকে পথ ভাঙতে সুরু করলাম। চারশো লির মতো হাঁটার পর রাজপুরীতে এসে পৌঁছলাম।

‘হো-লো-শি-পু-লো’ বা রাজপুরী রাজ্যটি আয়তনে চার হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানীটি দশ লির মতো গোলাকার। অনেক পাহাড়-পর্বত ও নদীর জন্য রাজ্যটি প্রাকৃতিক ভাবেই সুরক্ষিত। কিন্তু পাহাড়ী অঞ্চল বেশি হবার দরুণ আবাদী জমি খুব কম। ফসলের পরিমাণও এই কারণে কম। আবহাওয়া পুন্‌চ রাজ্যের মতোই। ফল ফলাদিও সব সেখানকার মতো। লোকজন বেশ চটপটে ও ব্যস্তবাগীশ। এ রাজ্যেও কোন স্বাধীন রাজা নেই, রাজ্যটি কাশ্মীরের অধীন।

এখানে দশটির মতো সংঘারাম আচে। ভিক্ষুর সংখ্যা দেখলাম খুব কম। একটি দেবমন্দির রয়েছে। বিপুল সংখ্যক বিধর্মী তার উপাসক।

‘লান-পো’ বা লমঘান থেকে ‘হো-লো-শি-পু-লো’ বা রাজপুরী পর্যন্ত লোকজনের চেহারা রুক্ষ, স্বভাব উগ্র এবং কাম ও উত্তেজনা প্রবণ। ভাষা স্থূলরুচির পরিচায়ক, অমার্জিত, অনুন্নত। ভদ্রতা বা সুরুচি প্রায় দুর্লভ। এরা সঠিকভাবে ভারতবর্ষীয় নয়। ভারতের প্রান্তিক সীমানার অধিবাসী ও বর্বর ভাব-অভ্যাস প্রবণ।

॥ ১২ ॥ ৎসেহ-কিয়া: টক্ক

রাজপুরী থেকে আরো দক্ষিণ-পূর্বদিকে এবার এগিয়ে চলা সুরু করলাম। পাহাড়ী অঞ্চলের খাড়াই ভাঙা শেষ হলো। এবার উৎরাইয়ের দিকে নামতে সুরু করলাম। তারপর নদী পার হলাম। এখাবে ৭০০ লির মতো পথ ভাঙবার পর ‘ৎসেহ কিয়া’ বা টক্ক রাজ্যে এসে পৌঁছলাম।

দশ হাজার লি মতন আয়তনের এই রাজ্যটির পূর্ব সীমানার গা ছুঁয়ে বিপাশা নদী বয়ে গেছে। পশ্চিম সীমানা ধরে বয়ে গেছে সিন্ধু নদ। এ রাজ্যের রাজধানীর আয়তন প্রায় ২০ লির মতো। জমি ধান চাষের উপযোগী। দেরিতে বোনা ফসল যথেষ্ট জন্মায়। এ অঞ্চলে সোনা, রূপা, তিওউ পাথর (teoushih), তামা ও লোহা প্রভৃতি পাওয়া যায়। আবহাওয়া খুব উষ্ণ। ঝড়-ঝঞ্ঝা হয়। লোকেরা চটপটে ও উগ্র। ভাষা কর্কশ ও অমার্জিত। এরা কৌষেয় (silk) নামে এক ধরনের ঝিলমিলে সাদা রঙের কাপড় পরে। এছাড়া প্রভাতী-লাল ও অন্যান্য রঙের কাপড়ও ব্যবহার করে। খুব কম লোকই বুদ্ধের অনুগামী। দেবতা ও পুণ্যাত্মাদের উদ্দেশে অনেক পূজা, যজ্ঞ ও বলিদানাদি হয়ে থাকে। দশটির মতো সংঘারাম ও কয়েকশো মন্দির আছে। আগে এদেশে গরিব ও অনাথদের থাকার জন্য অনেক পুণ্যাশ্রম ছিল। তারা তাদের ওষুধপত্র, খাদ্য, কাপড় চোপড়, ও অন্য সব জিনিষপত্র যোগাতো; ফলে ভ্রমণকারী বা পথচারীদের যথাসর্বস্ব কেড়ে নেয়ার ঘটনা খুব কম হতো।

রাজধানীর দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ১৪-১৫ লি মতন গেলে আমরা পুরোনো শহর শাকল পৌছাই। এর সীমানা দেয়ালগুলি ভেঙে পড়লেও ভিত এখনো বেশ শক্ত আর মজবুত রয়েছে। আয়তনে শহরটি ২০ লির কাছাকাছি হবে। এ শহরের মধ্যেই তারা একটি ছোট শহর গড়ে তুলেছে। এটির আয়তন ছয় কি সাত লি হবে। এর বাসিন্দারা বেশ সমৃদ্ধিশালী ও ধনী। এই শাকলই ছিল আগে এ রাজ্যের রাজধানী। কয়েক শতাব্দী পূর্বে মিহিরকুল নামে এক রাজা ছিল। সে এই শহরের উপর তার আধিপত্য বিস্তার করে ও সারা ভারত শাসন করে। সে ছিল খুব উপস্থিত-মনা প্রতিভাবান লোক। খুব সাহসীও ছিল। প্রতিবেশী সব রাজ্যকেই সে তার অধীনে আনে। সমগ্র ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম লোপ করার জন্য সে আদেশ জারী করে।

মগধ-রাজ বালাদিত্য বৌদ্ধধর্মের পরম অনুরাগী ছিলেন। প্রজাদের তিনি সন্ত ানের মতো পালন করতেন। মিহিরকুলের নিষ্ঠুর কার্যকলাপ ও অত্যাচারের কথা শুনে তিনি তাঁর রাজ্যের সীমানায় কঠোর প্রহরা বসালেন। অস্বীকার করলেন মিহিরকুলের বশ্যতা মেনে নিতে। বালাদিত্যের এ হেন স্পর্দ্ধার শাস্তি দেবার জন্য মিহিরকুল সসৈন্যে অগ্রসর হলেন। খবর পেয়ে বালাদিত্য রাজধানী থেকে পালিয়ে সাগর মধ্যে একটি দ্বীপে আশ্রয় নিলেন। অনেক প্রজাও প্রিয় রাজার অনুগমন করলো। মিহিরকুল তখন তার ভাইয়ের উপর সেনাবাহিনীর ভার দিয়ে বালাদিত্যকে আক্রমণ করার জন্য (অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে) সাগর অভিমুখে এগোলে বালাদিত্যের সৈন্যরা সেখানে মিহিরকুলকে বন্দী করলো। কিন্তু পরে মায়ের আদেশে বালাদিত্য ছেড়ে দিলেন তাকে। শুধু উত্তরের কয়েকটি ছোট রাজ্যের উপর তাকে রাজত্ব করার সুযোগ দিলেন। কিন্তু মিহিরকুলের ভাই সৈন্যবাহিনী নিয়ে ফিরে গিয়ে সে রাজ্যগুলি দখল করে নিল। রাজ্যহারা মিহিরকুল শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরে পালিয়ে গিয়ে কাশ্মীর-রাজের কাছে আশ্রয় নিল। কাশ্মীর-রাজ তার দুর্দশায় করুণাপরবশ হয়ে তাকে একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল ও একটি শহর রাজ্যরূপে দিলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই মিহিরকুল সমস্ত শহরের লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলে বিদ্রোহ করে কাশ্মীররাজকে হত্যা করল ও নিজে সিংহাসন দখল করে বসলো। কাশ্মীরের পর সে গান্ধারের উপর নজর দিল। ছদ্মবেশে কিছু সৈন্য পাঠিয়ে সেখানকার রাজাকে হত্যা করলো। রাজ পরিবার এবং প্রধান-মন্ত্রীকেও নিশ্চিহ্ন করলো। ১৬০০ মতো স্তূপ ও সংঘারাম ভেঙে ফেললো। তার সেনাবাহিনী যে সব লোক হত্যা করেছে তা ছাড়া আরও নয় লক্ষ লোককে সে মেরে ফেলতে মনস্থ করলো। তখন সেখানকার সকল মন্ত্রীরা একত্র হয়ে নিজেদের প্রাণের পরিবর্তে তাদের প্রাণ- বাঁচানোর আবেদন জানালেন। মিহিরকুল কিন্তু তাদের কথায় কর্ণপাত করলো না।

সে তিন লক্ষ প্রথম শ্রেণির লোককে সিন্ধুনদের তীরে বধ করলো। এই একই সংখ্যার মধ্যম শ্রেণীর লোককে নদীর জলে ডুবিয়ে মারলো। আর এই একই সংখ্যার তৃতীয় শ্রেণীর লোককে সৈন্যদের মধ্যে বেঁটে দিল। তারপর দেশের সমস্ত ধন-সম্পদ লুঠ করে সৈন্যদের নিয়ে ফিরে গেল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে মারা পড়লো। তার মৃত্যুকালে বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি সুরু হলো, ঘন অন্ধকারে চারিদিক ঢেকে গেল। ভূমিকম্পে পৃথিবী দুলে উঠে প্রবল ঝঞ্ঝা বইয়ে দিল। তার জন্য করুণা প্রকাশ করে পবিত্র ঋষিরা বললেন, অসংখ্য মানুষকে হত্যা ও বুদ্ধের ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সে এবার গভীর নরকগামী হলো, এবার সেখানে তাকে জন্মের অনন্ত পাকচক্রে পাক খেয়ে ফিরতে হবে।

শাকলের পুরানো নগরীতে একটি সংঘারাম আছে। এটিতে একশো জনের মতো ভিক্ষু থাকেন। এরা হীনযানের উপাসক। পুরাকালে বসুবন্ধু বোধিসত্ত্ব এখানে বাস করে ‘পরমার্থ শাস্ত্র’ রচনা করেন।

এর কাছে দুশো ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ রয়েছে।

সংঘারামটি থেকে ৫ বা ৬ লি উত্তর-পশ্চিমে আর একটি স্তূপ। এটি রাজা অশোকের বানানো। দুশো ফুটের কাছাকাছি উঁচু স্তূপটি।

নতুন রাজধানীর উত্তর-পূর্ব দিকে দশ লি মতো গিয়ে আমরা আরো একটি স্তূপের দেখা পেলাম। এটিও দুশো ফুটের কাছাকাছি উঁচু। রাজা অশোকের-ই বানানো।

॥ ১৩ ॥ চি-নো-পো-তি: চীনাপতি

শাকল থেকে পাঁচশো লি মতো চলে আমরা চীনাপতি রাজ্যে এলাম।

এ দেশটি আয়তনে দু’হাজার লির মতো। রাজধানীর ঘের ১৪ বা ১৫ লি। এখানে প্রচুর ফসল ফলে। চারিদিকে অল্পস্বল্প ফলের গাছ ছড়িয়ে আছে। লোকেরা সন্তোষ-চিত্ত ও শান্তিপ্রিয়। দেশটি নানা প্রকার সম্পদে পরিপূর্ণ। আবহাওয়া উষ্ণ ও ভিজালো। স্বভাবের দিক থেকে লোকেরা ভীতু ও উদাসীন চরিত্রের। তন্ত্রমন্ত্র চর্চ্চার দিকে বিশেষ ঝোঁক পড়লো। তাদের মধ্যে বুদ্ধের অনুগামী ও বিধর্মী দু- রকম লোকই রয়েছে। এখানে দশটি সংঘারাম ও আটটি দেব মন্দির আছে।

রাজা কণিষ্কের রাজত্বকালে তার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার সৈন্যক্ষমতা ও পরাক্রম সকলে স্বীকার করে নেন। পীত নদীর পশ্চিম দিকের দেশগুলির রাজারা তার অধীনতা মেনে নেন ও তার নিদর্শনরূপে তার সভায় তাদের প্রতিনিধি পাঠান। রাজা কণিষ্ক এই সব প্রতিনিধিদের প্রতি বিশেষ আদর যত্ন দেখান। বছরের ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর জন্য তাদের ভিন্ন ভিন্ন (অঞ্চলে) আবাস দেন। নিরাপত্তার জন্য বিশেষ রক্ষী নিয়োগ করেন। এ দেশটি তাদের শীতকালীন আবাস ছিল। এই কারণে এর নাম হয় চীনাপতি।

ভারতের কোন অঞ্চলে আগে নাশপাতি ও পীচফল ছিল না। এই প্রতিনিধিরাই প্রথম সেগুলি এখানে লাগান। এই জন্যই পীচকে এখানে চীনানী ও নাশপাতিকে চীনারাজপুত্র বলা হয়। পূর্ব দেশের (চীনের) প্রতি এখানকার লোকের খুব শ্রদ্ধা রয়েছে। এমন কি আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি পর্যন্ত করছে “এ লোকটি আমাদের আগের সেই শাসকের দেশের লোক”।

রাজধানী থেকে পঞ্চাশ লি মতো দক্ষিণ পূর্ব দিকে যেতে আমরা একটি সংঘারামের দেখা পেলাম। এটির নাম তামসবন (তমসা বন?) এখানে ৩০০ জনের মতো ভিক্ষু থাকেন। এরা সর্বাস্তিবাদ ধারার অনুগামী। তাদের চালচলন মনে সম্ভ্রম জাগায়, সদগুণাবলী সহজে চোখে পড়ার মতো, জীবনধারা পবিত্রতার বাহক। হীনযানের ধর্মীয় মতধারা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান বেশ সুগভীর।

বুদ্ধের নির্বাণলাভের তিনশো বছর পর শাস্ত্রজ্ঞ কাত্যায়ন এখানে অভিধর্মজ্ঞান- প্রস্থান শাস্ত্র রচনা করেন।

তামসবন সংঘারামে দুশো ফুটের মতো উঁচু একটি স্তূপ আছে। রাজা অশোক এটি তৈরী করেন। এখানে সারিবদ্ধভাবে অসংখ্য ছোট ছোট স্তূপ ও বড় বড় পাথরের বাড়ি মুখোমুখিভাবে রয়েছে। কল্পের আরম্ভ থেকে এখন পর্যন্ত যে সব ভিক্ষু অহতত্ত্ব অর্জন করে নির্বাণ লাভ করেছেন এগুলি তাদেরই স্মারক। এদের সকলের বর্ণনা দেয়া অসম্ভব। তাদের দাঁত ও অস্থি এখনো বর্তমান। পর্বতকে ঘিরে ২০ লি মতো আয়তনের এলাকা জুড়ে এই সংঘারাম ও স্তূপগুলি ছড়িয়ে রয়েছে। বুদ্ধের দেহাবশেষ রয়েছে এমন স্তূপের সংখ্যাও অগণিত। এগুলি এমনভাবে ভীড় করে রয়েছে যে একটি অন্যটিকে ঢেকে ফেলেছে।

॥ ১৪ ॥ চে-লন-তো-লো: জালন্ধর

চীনাপতি থেকে উত্তর-পূর্বে ১৪০ বা ১৫০ লির কাছাকাছি পথ চলার পর জালন্ধর রাজ্যের দেখা পেলাম।

এ রাজ্যটি পূর্ব-পশ্চিমে ১০০০ লি উত্তর-দক্ষিণে ৮০০ লির মতো। রাজধানীর আয়তন ১২ বা ১৩ লি। খাদ্যশস্য আবাদের পক্ষে জমি বেশ উপযোগী। প্রচুর ধান হয়। অরণ্যগুলি ঘন ও ছায়া-অন্ধকার। ফুল ও ফল অফুরান। আবহাওয়া উষ্ণ ও ভিজেটে।

লোকেরা সাহসী ও আবেগ প্রবণ। কিন্তু তাদের চেহারা সাধারণ ও গেঁয়ো ধরনের। প্রত্যেকটি পরিবারই ধনী ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা। এখানে পঞ্চাশটির মতো সংঘারাম আছে। সেখানে দু-হাজারের কাছাকাছি ভিক্ষু থাকেন। মহাযান ও হীনযান দুটি শাখারই উপাসক রয়েছেন তাদের মধ্যে। তিনটি দেব মন্দির আছে। সেখানে বিধর্মীদের সংখ্যা পাঁচশো মতো। তারা সকলেই পাশুপত।

॥ ১৫ ॥ কিউ-লু-তো: কুলূত

এখান থেকে এবার আরো উত্তর-পূর্বে এগিয়ে চললাম। কতক প্রকাণ্ড পর্বতের গা- ঘেঁষে সঙ্কীর্ণ গিরিপথ ধরে হেঁটে, কয়েকটি গভীর উপত্যকা পার হয়ে এক দুর্গম পথ পিছনে ফেলে এলাম। অনেক গিরিখাতও পার হতে হলো। এভাবে কম বেশি ৭০০ লি পথ ভাঙবার পর কুলূত রাজ্যে এসে উপস্থিত হলাম।

এ দেশটি আয়তনে ৩০০০ লির কাছাকাছি। চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা। প্রধান শহরটির ঘের চৌদ্দ থেকে পনের লির মধ্যে। জমি খুব সরস ও উর্বরা। ঠিকমতো চাষ-বাস করে যথেষ্ট ফসল ফলানো হয়। ফুল আর ফল অফুরন্ত। প্রচুর শাক- সবজি গাছপালা। তুষারাচ্ছন্ন পর্বত-সঙ্কুল হবার জন্য বহু রকমের অতি মূল্যবান ওষধি গাছ ও মূল পাওয়া যায়। সোনা, রূপা, তামা, এসবও রয়েছে। স্ফটিক ও দেশি বা লাল তামাও আছে। আবহাওয়া অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। অনবরত শিলাবৃষ্টি ও তুষারপাত লেগে রয়েছে। অধিবাসীরা অমার্জিত ও সাধারণ চেহারার। তাদের মধ্যেও গলগণ্ড ও আব রোগের বেশ প্রকোপ। মেজাজ কঠোর ও উগ্র ধরনের। ন্যায় ও শৌর্যকে বিশেষ মর্যাদা দেয়।

এখানে কুড়িটির মতো সংঘারাম আছে। সেখানে এক হাজারের কাছাকাছি ভিক্ষু থাকেন। তাদের বেশিরভাগই মহাযানের উপাসক। অল্প কিছু অন্যান্য নিকায় বা শাখার অনুগামী। পনেরটি দেবমন্দির রয়েছে। কোনরকম বিচারভেদ না করে সব সম্প্রদায়ই সেখানে বাস করে।

পর্বতের খাড়াই অঞ্চলে পাহাড়ের মধ্যের একটি খাতে মুখোমুখিভাবে তৈরী অনেকগুলি পাথরের কক্ষ চোখে পড়লো। এখানে অর্হত্রা বাস করেন, মুনি ঋষিরা বিশ্রাম নেন।

দেশটির মাঝামাঝি অঞ্চলে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ দেখলাম।

এখন থেকে উত্তর দিকে গেলে লাহুল দেশ। সেখানে যেতে হলে এখান থেকে প্রায় ১৮০০ থেকে ১৯০০ লি পথ হাঁটতে হবে। পথটি বেশ বিপদসঙ্কুল। বার বার খাড়া নিচে নেমে গেছে। তাছাড়া পুরো পথটাই যেতে হবে পর্বতমালা ও উপত্যকার বুক ভেঙে।

দু-হাজার লির মতো উত্তর দিকে গেলে পাওয়া যাবে মো-লো-সো বা সান- পো-হো দেশ। কিন্তু সেজন্যও নানা জায়গায় খাড়া উত্রাই আর বিপদভরা পথ পার হতে হবে। তার উপর আছে হিমেল বায়ু-প্রবাহ ও তুষার প্রবাহ।

॥ ১৬ ॥ শে-তো-তু-লো: শতদ্রু

কুলূত দেশ থেকে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করলাম। প্রায় ৭০০ লি পথ পার হয়ে শতদ্রু দেশে এসে পৌঁছলাম। এ পথেও একটি বিরাট পর্বত ডিঙাতে হলো। একটি চওড়া নদীও পার হলাম।

এ দেশটি পূর্ব-পশ্চিমে ২০০০ লির মতো। একটি বিরাট নদীর উপকূল জুড়ে অবস্থিত। রাজধানীর আয়তন ১৭ বা ১৮ লি। প্রচুর খাদ্যশস্যের ফলন হয়। অফুরন্ত ফল রয়েছে। সোনা ও রূপা যথেষ্ট পরিমাণ মেলে। মূল্যবান সব পাথরও রয়েছে। আবহাওয়া উষ্ণ ও ভিজালো। এক ধরনের খুব ঝলমলে কৌষেয় (silk) কাপড় পরে এরা। পোষাক-আশাক খুব সুন্দর ও দামী। লোকজনের আচার- ব্যবহার রুচিপূর্ণ ও অমায়িক। এরা বেশ ভদ্র আর ধার্মিক। নিচু-উঁচু, ছোট-বড় সকলে নিজ নিজ ভূমিকা যথাযথ পালন করে চলেছে। অতি নিষ্ঠার সঙ্গে তারা বুদ্ধের অনুশাসন মেনে চলে, তাকে গভীর সম্মান করে।

রাজধানী ও তার বাইরে দশটি সংঘারাম রয়েছে। তার মহাকক্ষগুলি এখন শূন্যে, নিস্তব্ধ। মাত্র সামান্য কিছু ভিক্ষু সেখানে থাকেন। শহরের দক্ষিণ-পূর্বদিকে তিন বা চার লি হাঁটলে একটি স্তূপ চোখে পড়বে। দুশো ফুটের মতো উঁচু এই স্তূপটি রাজা অশোকের তৈরী। এখানে বিগত চার বুদ্ধের ওঠা-বসা, চলা-ফেরার চিহ্ন বর্তমান।

॥ ১৭ ॥ পো-লি-যে-তো-লো: পারিষাত্ৰ

কুলূত থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ৮০০ লির কাছাকাছি পথ চলার পর আমরা পারিষাত্র দেশে এসে পৌঁছলাম।

এ দেশটি আয়তনে ৩০০০ লির মতো। রাজধানী প্রায় ১৪ বা ১৫ লি। এখানে শস্যের ফলন প্রচুর, বিশেষ করে দেরীতে বোনা গম। এ দেশে আশ্চর্য ধরনের এক জাতের ধান বোনা হয়—এগুলি মাত্র ৬০ দিনে পাকে। গরু ও ভেড়ার সংখ্যা প্রচুর। ফল ও ফুলের ফলন কম। আবহাওয়া গরম ও ঝলসানো। লোকেরা একরোখা ও উগ্র ধরনের। জ্ঞান-চর্চ্চার দিকে বিশেষ ঝোঁক নেই। অন্য ধর্মের অনুরাগী।

রাজা জাতিতে বৈশ্য। স্বভাবের দিক থেকে তিনি সাহসী ও একরোখা ধরনের এবং খুব যুদ্ধবাজ।

এখানে আটটি সংঘারাম আছে। সব কটিই প্রায় ভাঙনের মুখে। খুব সামান্য কিছু ভিক্ষু আছেন। সকলেই হীনযানের অনুগামী। দশটি দেবমন্দির রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত প্রায় এক হাজারের মতো অনুগামী সেখানে থাকেন।

॥ ১৮ ॥ মো-তু-লো: মথুরা

পারিষাত্র থেকে এবার পূর্বদিকে রওনা হলাম। ৫০০ লির মত পথ চলার পর মথুরায় এসে পৌঁছলাম।

মথুরা রাজ্যটির আয়তন ৫০০০ লির কাছাকাছি হবে। রাজধানীর পরিধি ২০ লির মতো। জমি সরস ও উর্বরা, খাদ্য-শস্য ফলনের উপযোগী। এরা সব থেকে বেশি মনোযোগ দেয় ‘অন-য়ো-লো’ বা আমলক গাছ চাষের উপর। এগুলি ঝাঁক বেঁধে জন্মায় ও রীতিমত অরণ্য সৃষ্টি করে। এর গাছগুলির যদিও একটি মাত্র নাম তা হলেও এরা আসলে দুটি জাতের। যেটি ছোট প্রজাতির তার ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ, কিন্তু পাকার পর হলদে হয়ে যায়। যেটি বড়ো প্রজাতির তার ফল সব অবস্থাতেই সবুজ থাকে।

এ রাজ্যে এক রকম মিহি সূতার কাপড় বোনা হয়। হলদে সোনাও এখানে পাওয়া যায়। আবহাওয়া বেশ কিছুটা গরম। লোকদের আচার-ব্যবহার কোমল ও হাসিখুশী। পুণ্যফল সঞ্চয়ের দিকে তাদের ঝোঁক রয়েছে। তারা সদ্‌গুণের আদর করে, জ্ঞানচর্চ্চাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে।

এখানে প্রায় কুড়িটির মতো সংঘারাম আছে। সেখানে প্রায় দু’হাজারের মতো ভিক্ষু থাকেন। মহাযান ও হীনযান দুয়েরই চর্চ্চা রয়েছে তাদের মধ্যে। পাঁচটি দেবমন্দির আছে। সেখানে সব সম্প্রদায়ের অনুগামীরা থাকেন।

রাজা অশোকের বানানো তিনটি স্তূপ আছে এখানে। বিগত চার বুদ্ধের স্মারক চিহ্ন রয়েছে সেখানে। শাক্য তথাগতের মহান অনুগামীদের দেহাবশেষ সম্বলিত অনেক স্মৃতি-স্তূপও রয়েছে। যথা-সারিপুত্র, মুদগলপুত্র, পূর্ণ-মৈত্রায়ণিপুত্র, উপালি, আনন্দ, রাহুল, মঞ্জুশ্রী এবং আরো অনেক বোধিসত্ত্বের স্তূপ

শহরের পূর্বদিকে ৫ বা ৬ গেলে একটি পর্বত কেটে তৈরী সংঘারাম দেখা যায়। পাহাড়ের গা কেটে ভিক্ষুদের থাকার জন্য কুঠুরী তৈরী হয়েছে। আমরা একটি উপত্যকা দিয়ে ফটক পার হয়ে এর মধ্যে প্রবেশ করলাম। সম্মানাষ্পদ উপগুপ্ত এটিকে তৈরী করিয়েছিলেন। এখানে একটি স্তূপ আছে। তাতে বুদ্ধের নখকণা রয়েছে।

সংঘারামের উত্তরদিকে একটি পাহাড়-খাতে কুড়ি ফুট উঁচু ও তিরিশ ফুট চওড়া পাথরের বাড়ি আছে। এটি চার ইঞ্চি লম্বা ছোট ছোট কাঠের স্মারকে বোঝাই। এখানে উপগুপ্ত ধর্মপ্রচার করতেন। যখনই তিনি কোন লোককে সস্ত্রীক বৌদ্ধের অনুগামী করতেন ও এর ফলে তারা অহতত্ত্ব লাভ করতো, তিনি এখানে একখানি করে এই কাঠের স্মারক রাখতেন। অপর কোন শাখার অনুগামী অহতত্ত্ব লাভ করে থাকলে তা তিনি এই হিসাবের মধ্যে আনেননি।

এই পাথরের বাড়িটির দক্ষিণ-পূর্বে চব্বিশ-পঁচিশ লি মতো গেলে একটি বিরাট শুকনো জলাভূমি রয়েছে। এর পাশে একটি স্তূপ আছে।

হ্রদের কাছাকাছি উত্তরদিকে একটি বনের মধ্যে বিগত চার বুদ্ধের পদচারণার চিহ্ন বর্তমান। পাশে অনেকগুলি স্তূপ আছে। এগুলি সারিপুত্র, মুদগলপুত্ৰ প্ৰভৃতি ১২৫০ জন মহান অর্হৎ যে জায়গায় তাদের সমাধি অভ্যাস করেছিলেন ও তার স্মারক চিহ্ন রেখে গেছেন তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তোলা হয়েছে।

তথাগত তাঁর জীবদ্দশা কালে প্রায়ই এ দেশে ধর্ম-প্রচার করে বেড়িয়েছেন। যে সব জায়গায় তিনি থেমেছিলেন সেখানে তার উল্লেখসহ স্মারকস্তম্ভ রয়েছে।

॥ ১৯ ॥ স-ত-নি-শি-ফ-লো: স্থানেশ্বর

মথুরা থেকে ৫০০ লির মতো উত্তর-পূর্বে পথ চলে অবশেষে আমরা স্থানেশ্বরে এলাম।

এই রাজ্যটি আয়তনে ৭০০০ লির মতন। জমি সরস ও উর্বরা, শস্য- শ্যামল। আবহাওয়া যদিও গরম তবু বেশ আরামপ্রদ। লোকদের আচার-ব্যবহার শীতল ও আন্তরিকতা-শূন্য। পরিবারগুলি ধনী, বেশি মাত্রায় বিলাস-ব্যসনের দিকে আকৃষ্ট। ভোজবাজী ও জাদুকলার প্রয়োগের দিকে এদের প্রচণ্ড ঝোঁক রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও যারা বিশিষ্টতা অর্জন করে তাদের খুব সম্মান দেখায়। অধিকাংশ লোকই পার্থিব সম্পদের পিছনে ছোটে। সামান্য কিছু লোক চাষ-আবাদের দিকে মনোযোগী। নানা দুর্লভ ও মূল্যবান পণ্য চারিদিক থেকে এসে এখানে স্তূপ স্তূপ জমা হয়।

এ দেশটিতে তিনটি সংঘারাম আছে। সেখানে সাতশোর কাছাকাছি ভিক্ষু থাকেন। তারা সকলেই হীনযানের উপাসক। কয়েকশো দেবমন্দির আছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অসংখ্য অনুগামী সেখানে থাকে।

রাজধানীকে ঘিরে ২০০ লির মতো একটি অঞ্চলকে এখানকার লোক পুণ্যভূমি বলে (ধর্মক্ষেত্র বা কুরুক্ষেত্র নামেও অভিহিত হয়)।

শহরের উত্তর-পশ্চিমদিকে চার কি পাঁচ লি দূরে একটি স্তূপ আছে, তিনশো ফুটের মতো উঁচু এই স্তূপটি রাজা অশোকের বানানো। এর ইটগুলি সব হলদেটে লাল রঙের, বেশ উজ্জ্বল ও চক্‌চকে। এর মধ্যে এক পেকের সমান (দুই গ্যালন) বুদ্ধের দেহাবশেষ রক্ষিত আছে।

শহরের দক্ষিণ দিকে একশো লির মতো গেলে আমরা গোকণ্ঠ (?) নামে একটি সংঘারামে এসে হাজির হই। সামনে পর পর সারি বেঁধে অনেকগুলি বুরুজ আছে। একটি বুরুজ থেকে আরেকটিতে যাতায়াতের জন্য প্রত্যেক তলায় সংযোগ পথ রয়েছে। এখানকার ভিক্ষুরা ধর্মপ্রাণ, ভদ্র ও শান্ত-সুন্দর গাম্ভীর্য সম্পন্ন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *