হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – ৫০

॥ ৫০ ॥ ‘কিএ-লো-ন-সু-ফ-ল-ন’ বা কর্ণসুবর্ণ।

এ রাজ্যটির ঘের ১৪০০ থেকে ১৫০০ লি। রাজধানীর পরিধি ২০ লির কাছাকাছি। ঘন জনবসতিতে ভরা। পরিবারগুলি বেশ ধনী ও সমৃদ্ধ। জমি নিচু ও মাটি দো-আঁশ। চাষ আবাদ বরাবর নিয়ম মতো হয়ে আসছে। অফুরান ফুলের চাষ। এ ছাড়া নানা ধরনের অসংখ্য দামী দামী সামগ্রীর চাষ। আবহাওয়া বেশ মনোরম। লোকেরা অমায়িক ও সৎ। জ্ঞানচর্চ্চাকে অত্যধিক ভালোবাসে। অতি আগ্রহের সঙ্গে এর চর্চ্চা করে। বৌদ্ধধর্মী ও অন্য-ধর্মী দুই-ই আছে এদের মধ্যে। সংঘারাম রয়েছে দশটির মতো। সেখানে দু’হাজারের মতো ভিক্ষু থাকেন। হীনযানের সম্মতীয় শাখার অনুগামী তাঁরা।

দেবমন্দির পঞ্চাশের মতো হবে। সেখানে অসংখ্য অন্য-ধর্মীর বাস।

এ ছাড়া আরো তিনটি সংঘারাম রয়েছে। এখানে দেবদত্তর নির্দেশ মেনে দই ব্যবহার করা হয় না।

রাজধানীর পাশেই একটি সংঘারাম আছে। এটির নাম রক্তবিতি। এর মহাকক্ষগুলি বেশ বড়োসড়ো ও আলো বাতাস ভরা। তলযুক্ত গম্বুজগুলি খুবই উঁচু। রাজ্যের সেরা জ্ঞানীগুণী খ্যাতিবানরা সকলেই প্রায় এখানে সমবেত হন। তাঁরা একে অপরের চরিত্র গঠনে, জ্ঞানের অগ্রসর প্রচেষ্টায় সাহায্য করেন। আগে এখানকার লোকজন বুদ্ধের মতবাদের প্রতি অনুরাগী ছিল না। এ সময়ে একজন দক্ষিণ ভারতীয় বিধর্মী পণ্ডিত ছিলেন। তিনি তাঁর পেটে তামার পাত বেঁধে রাখতেন, কপালে একটি জ্বলন্ত মশাল। সদর্পে পা ফেলে লাঠি হাতে তিনি এ দেশে এসে হাজির হলেন। বিতর্ক সভা আহ্বানের ভেরী বাজিয়ে তর্ক-যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চাইলেন। একটি লোক তখন প্রশ্ন করলো : আপনার এমন বিচিত্র সাজ কেন? তিনি জবাব দিলেন : আমার বিদ্যা এতো বেশি যে ভয় হয় তা পাছে পেট ফেটে বেরিয়ে যায়। অসংখ্য লোক নিদারুণ অজ্ঞতার আঁধারে বাস করছে দেখে আমার তাদের জন্য ভারি দুঃখ হয়, তাদের (জ্ঞানের) আলো দেখানোর জন্যই আমি কপালে মশাল জ্বালিয়েছি।

দশদিন কেটে গেল। তাঁর সঙ্গে তর্কে নামার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। একজন বললো : এখানে বনের মধ্যে একজন বিদেশী শ্রমণ আছেন। তিনি খুব পণ্ডিত। রাজা তাঁকে ডেকে আনলেন। তিনিও একজন দক্ষিণ ভারতীয়। তিনি সহজেই বিধর্মী পণ্ডিতকে তর্কে পরাস্ত করলেন।

রাজা শ্রমণের প্রতি শ্রদ্ধাপরায়ণ হয়ে এই সংঘারামটি গড়ে দিলেন। সেই থেকে এখানে বুদ্ধদেবের শিক্ষা বিস্তার করতে থাকলো।

এই সংঘারাম থেকে অল্প কিছূ দূরে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপ রয়েছে। পাশেই একটি বিহার। যে সব জায়গায় বুদ্ধদেব এসে ধর্ম প্রচার করেন সে সব জায়গায় আরো কয়েকটি স্তূপ আছে। এগুলি রাজা অশোক বানিয়ে গেছেন।

॥ ৫১ ॥ ‘উ-চ’ বা উড়

কর্ণসুবর্ণ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে এগিয়ে প্রায় ৭০০ লি মতো যাবার পর উ-চ বা উড্র দেশ। [তাম্রলিপ্তি থেকে উড্র যান]

আয়তনে এ রাজ্যটি ৭০০০ লি মতন। রাজধানীর ঘের ২০ লি খানেক। প্রচুর ফসলের ফলন দেখে বোঝা যায় মাটি বেশ সরস ও উর্বরা। অন্য যে কোন দেশের তুলনায় এখানে যে কোন ফলের ফলন বেশি। এখানে যে সব নতুন ধরনের লতাগুল্ম ও নামকরা সব ফুল ফোটে সেগুলির তালিকা দেয়া বেশ দুরূহ।

আবহাওয়া গরম। মানুষজন সুসভ্য নয়। চেহারা লম্বা-চওড়া, গায়ের রঙ হলদেটে-কালচে। তাদের কথাবার্তার ভঙ্গী ও ভাষা মধ্য ভারতের চেয়ে আলাদা। তারা জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী ও এজন্য অবিরাম চেষ্টা করে চলে। অধিকাংশই বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী।

একশোটির মতো সংঘারাম রয়েছে। দশ হাজারের মতো ভিক্ষু সেখানে থাকেন। সকলেই মহাযানের চর্চ্চা করেন।

পঞ্চাশটির মতো দেবমন্দির। সব সম্প্রদায়ের বিধর্মীরাই সেখানে থাকেন।

বুদ্ধদেব এ রাজ্যের যে সব জায়গায় ধর্মপ্রচার করে গেছেন সেখানেই একটি স্তূপে গড়া হয়েছে। এরকম স্তূপ মোট দশটি। সব ক’টিই রাজা অশোক গড়ে গেছেন।

রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের দিকে একটি বড়ো পাহাড়ের মাঝে ‘পুষ্পগিরি ‘ নামে একটি সংঘারাম আছে। এখানেও একটি স্তূপ আছে।

এর উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি পাহাড়ের উপর একটি সংঘারাম আছে। সেখানেও একটি স্তূপ দেখা যাবে।

রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে, সাগরকূলে একটি শহর চোখে পড়লো। নাম চে-লি-ত-লো বা চরিত্র। আয়তনে ২০ লির মতো। এখান থেকে সওদাগরেরা দূর দেশে যাত্রা করে, বিদেশীরাও যায় আসে, অন্য কোথাও যাবার পথে এখানে থেমে বিশ্রাম নেয়। শহরটির দেয়াল বেশ মজবুত ও উঁচু। এখানে সব ধরনের দুর্লভ ও দামী দামী জিনিষ মেলে।

শহরের বাইরে পর পর পাঁচটি বিহার রয়েছে। এদের তলবিশিষ্ট গম্বুজগুলি খুব উঁচু, চমৎকারভাবে মুনি-ঋষিদের মূর্তি খোদাই করা।

এখান থেকে কুড়ি হাজার লি মতন দক্ষিণদিকে গেলে তবে সিংহল।

॥ ৫২ ॥ ‘কঙ্গ-উ-তো’ বা কঙ্গোদ

উড্র থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে চললাম। পথে বিরাট বিরাট সব বনাঞ্চল পড়লো। তার মধ্য দিয়ে পথ চলে ১২০০ লি যাবার পর কঙ্গ-উ-তো বা কঙ্গোদ রাজ্যে প্রবেশ করলাম।

রাজ্যটির আয়তন এক হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানীর পরিধি ২০ লি মতো। একটি উপসাগর কূলে এ রাজ্যটি। এর পাহাড়মালাগুলি উঁচু আর খাড়া। জমি নিচু ও স্যাঁতসেঁতে। চাষ আবাদের কাজ লেগে আছে, ফসলও ভালো হয়। গরম আবহাওয়া। লোকজন সাহসী ও তাড়নার বশ। শরীরের গড়ন লম্বা-চওড়া, গায়ের রঙ কালো, নোঙরা থাকে। চাল-চলনের মধ্যে কিছুটা বিনয়ের ভাব দেখা যায় আর মোটামুটিভাবে সও বলা চলে। তাদের লিখিত বর্ণমালার চেহারা মধ্য ভারতের মতোই। কিন্তু ভাষা আর তার উচ্চারণ রীতি পুরোপুরি ভিন্ন। অন্য ধর্মীদের মতবাদের প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধা, বুদ্ধ ধর্মের প্রতি কোন অনুরাগ নেই।

শ’খানেকের মতো দেবমন্দির দেখা যাবে। সেখানে বোধহয় ১০ হাজারের কাছাকাছি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্যধর্মীরা থাকে।

এ রাজ্যের মধ্যে অনেকগুলি (কয়েক দশ) ছোট ছোট শহর রয়েছে। সাগরের সঙ্গে সংযোগ রেখে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এগুলি গড়ে উঠেছে। শহরগুলি স্বাভাবিকভাবেই বেশ উঁচু সুরক্ষিত। সৈন্যরাও বেশ সাহসী ও পরাক্রমী। পড়শী দেশগুলিকে তারা সৈন্যবলের সাহায্যে শাসন করে, কেউ এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না।

সাগরকূলের এই রাজ্যটিতে অনেক দুর্লভ আর দামী দামী জিনিষের প্রাচুর্য রয়েছে। কড়ি ও মুক্তা দিয়ে তারা বাণিজ্যিক আদানপ্রদান চালায়। সবজে নীলরঙা বড়ো বড়ো হাতি রয়েছে এখানে। এগুলোকে যানবাহন টানার কাজে ও অতি দূরদেশে যাত্রার সময় ব্যবহার করা হয়।

॥ ৫৩ ॥ কিও-লিঙ্গ-কিএ=কলিঙ্গ

কঙ্গোদ পিছনে ফেলে আরো দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে যাত্রা শুরু হলো। বুনো জন্তু জানোয়ারে ভরা বন আর গভীর জঙ্গল। গাছগুলো যেন একেবারে স্বর্গে মাথা উঁচিয়েছে। সূর্যের মুখ দেখার একটুও উপায় নেই। এই পথ ধরে ১৪০০ থেকে ১৫০০ লি যাবার পর আমরা পা রাখলাম কলিঙ্গ রাজ্যে।

এ দেশটির আয়তন পাঁচ হাজার লির মতো হবে। রাজধানীর পরিধিও ২০ লি খানেক। নিয়মিতভাবে চাষবাসের কাজ চলে, ফলনও ভালো। ফুল ও ফল অফুরান। বেশ কয়েকশো লি জুড়ে একটানা বন-জঙ্গল-অরণ্য। সবজে-নীল রঙের বুনো হাতি প্রচুর। পড়শী দেশগুলিতে এই হাতির বেশ কদর রয়েছে।

আবহাওয়া অঙ্গারের মতো জ্বলন্ত। মানুষজন উগ্র ও দুর্বিনীত। তাদের চাল- চলন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রুক্ষ ও অভদ্র হলেও কথা দিলে কথা রাখে ও বিশ্বাস করা চলে। তাদের ভাষা হালকা ও ছন্দোগতিময়। উচ্চারণ পরিষ্কার ও নির্ভুল। কিন্তু শব্দ ও ধ্বনির ক্ষেত্রে মধ্য ভারত থেকে তারা যথেষ্ট ভিন্ন।

এখানকার খুব কম লোকই বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী। অন্য ধর্মীরাই প্রধান। দশটির মতো সংঘারাম আছে। ভিক্ষু ৫০০ খানেক। এরা স্থবির শাখানুগামী মহাযান- পন্থী।

শ’খানেক দেবমন্দির রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিধর্মীরা অগুণতি সংখ্যায় সেখানে থাকে। সব থেকে বেশি হলো নির্গ্রন্থ সম্প্রদায়ের অনুগামী।

আগে এখানে খুব ঘন বসতি ছিল। তারপর এক ঋষির ক্রোধে রাজ্যটি প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। বাইরের লোকেরা এসে এখানে ধীরে ধীরে বসবাস শুরু করে। তবুও যথেষ্ট বসতি এখনো গড়ে ওঠেনি।

রাজধানী থেকে অল্প কিছু দূরে একশো ফুট মতো উঁচু একটি স্তূপ রয়েছে। রাজা অশোক এটি বানিয়ে গেছেন।

রাজ্যটির উত্তর সীমানায় একটি বড়ো খাড়া পাহাড়ের উপরেও (মহেন্দ্র গিরি) একশো ফুটের মতো উঁচু একটি পাথরের স্তূপ রয়েছে।

॥ ৫৪ ॥ কিও-স-লো : কোশল

কলিঙ্গ থেকে উত্তর-পশ্চিমদিকে রওনা হলাম এবার। শুধু বন আর বন, পাহাড় আর পাহাড়। এরই মধ্য দিয়ে প্রায় ১৮০০ লি পথ ভাঙবার পর এলাম কিও-স- লো বা কোশল (দক্ষিণ কোশল)।

পাঁচ হাজার লি মতো আয়তনের এ রাজ্যটির সীমা পাহাড় কন্দর দিয়ে ঘেরা। একের পর এক ঘন বন আর জঙ্গল। রাজধানী শহরটির ঘের ৪০ লি হবে। জমির সরসতা ও উর্বরতার জন্য ফসলের ফলনও অঢেল।

শহর আর গ্রামগুলি যেন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। ঘন বসতি ভরা এলাকা। মানুষজন বেশ লম্বা-চওড়া চেহারার। গায়ের রঙ কালো। মেজাজ কড়া, মার, দাঙ্গা-প্রবণ। সাহসী আর গোঁয়ার। বৌদ্ধ ও অন্য-ধর্মী দু’রকমই রয়েছে। লেখাপড়া জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী ও খুব চালাক চতুর বুদ্ধিমান।

রাজা ক্ষত্রিয় জাতির লোক। বুদ্ধের ধর্মমতের প্রতি গভীর অনুরাগী। তাঁর সদগুণাবলী ও সহৃদয়তার খ্যাতি দূর দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।

শ’খানেক সংঘারাম রয়েছে। হাজার দশেকের কিছু কম ভিক্ষু সেখানে থাকেন। সকলেই তাঁরা মহাযানের অনুগামী। দেবমন্দির সত্তরটির মতো। নানা সম্প্রদায়ের অন্য-ধর্মীদের পীঠস্থান সেগুলি।

শহর থেকে অল্প কিছু দক্ষিণে একটি সংঘারাম আছে। রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপও রয়েছে তার কাছে। নাগার্জুন বোধিসত্ত্ব এ সংঘারামে থাকতেন। সে সময়ে এখানকার রাজা ছিলেন সদবহ (সাতবাহন)। রাজা তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। দেব বোধিসত্ত্ব এ নাগার্জুনের শিষ্য। নাগার্জুন রসায়ন বিদ্যাতেও সুদক্ষ ছিলেন।

দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে তিনশো লি মতো গেলে ব্রহ্মগিরি পর্বতের দেখা মিলবে। এ পর্বতের একক চূড়াটি এ অঞ্চলের সব পাহাড়কে ছাড়িয়ে আকাশে মাথা তুলেছে। এই ভাব-গম্ভীরময় নিরেট পাহাড়টি হঠাৎ যেন এর খাড়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, মাঝে কি আশেপাশে কোন উপত্যকা নেই। নাগার্জুন বোধিসত্ত্বের জন্য রাজা সাতবাহন এই পাহাড়ের মাঝ বরাবর সুড়ঙ্গ খুঁড়ে একটি সংঘারাম বানিয়ে দিয়েছেন। প্রায় দশ লি মতন সুড়ঙ্গ খুঁড়ে সেই ঢাকা পথ দিয়ে এর মধ্যে যাতায়াতের রাস্তা বানানো হয়েছে। কোন পথ দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে তা জানা না থাকায় আমরা পাহাড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে তার সারা গায়ে খোদাই করা ভাস্কর্য দেখতে থাকলাম। ছাদে ঢাকা চলাচলের বারান্দসহ পাঁচতলা উঁচু সৌধ। উপরে উঁচু উঁচু গম্বুজ। প্রত্যেকটি তলাতেই বিহারসহ চারটি করে মহাকক্ষ। প্রত্যেকটি বিহারেই একটি করে সোনার বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। প্রত্যেকটিই স্বাভাবিক মানুষের আকারের। অপূর্ব তার শিল্প সুষমা, সোনা ও মূল্যবান রত্নাদি দিয়ে অপরূপ ভাবে সাজানো। পাহাড়ের উঁচু চূড়াটি থেকে কয়েকটি ঝরনাধারা নেমে এসেছে জলপ্রপাতের মতো হয়ে। বয়ে চলেছে তার জলধারা সৌধটির প্রত্যেকটি তলাকে ঘিরে তার ধার-বারান্দাগুলি দিয়ে। এদিক ওদিক তৈরী ফোকরগুলি দিয়ে ঢুকছে সৌধের ভেতরে আলো।

॥ ৫৫ ॥ ‘অন-ত-লো’ বা অন্ধ্র

কোশল পিছনে ফেলে এক বিরাট অরণ্যের মধ্য দিয়ে আমরা অন-ত-লো বা অন্ধ রাজ্যের দিকে এগিয়ে চললাম। প্রায় ৯০০ লি পথ চলার পর সেখানে এলাম।

তিন হাজার লি এ রাজ্যটির আয়তন। ২০ লি হলো রাজধানীর পরিধি। এ শহরটির নাম পিঙ-কি-লো (বিঙ্গিল? = সম্ভবত বেঙ্গি)।

এখানকার জমি সরস ও উর্বরা। নিয়মিতভাবে চাষ আবাদের কাজ হয়। খাদ্য-শস্যের ফলন বেশ প্রচুর। আবহাওয়া গরম, লোকজন উগ্র ও তাড়না-প্রবণ।

এ এলাকার ভাষা ও বাক্যনিবাস মধ্যভারত থেকে ভিন্ন ধরনের। বর্ণমালার চেহারা সেখানকার সঙ্গে প্রায় এক।

কুড়িটির মতন সংঘারাম আছে। ভিক্ষু থাকেন সেখানে তিন হাজারের মতো। দেবমন্দির তিরিশটি। অগুণতি বিধর্মী সেখানে বাস করে থাকেন।

শহর থেকে একটুখানি দূরে একটি বিরাট সংঘারাম রয়েছে। এর একাধিক তলবিশিষ্ট গম্বুজগুলি ও ঝুল-বারান্দাগুলি সুন্দর কারুকাজ ও অলংকার করা। এখানে অনুপম শিল্প-সুষমামণ্ডিত একটি বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে। সংঘারামের সামনে কয়েক শো ফুট উঁচু একটি পাথরের স্তূপ রয়েছে। এর সব কটিই অর্হৎ ও-চে-লো (অচল) এর তৈরী।

এখান থেকে একটুখানি দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে গেলে রাজা অশোকের তৈরী একটি স্তূপের দেখা পাওয়া যাবে।

কুড়ি লি মতো দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে গেলে একটি নির্জন পাহাড়ের উপর একটি স্তূপ চোখে পড়বে। এখানে জিন বোধিসত্ত্ব ইন-মিঙ-লুন (ন্যায়ম্বার তারক-শাস্ত্র বা হেতু বিদ্যা শাস্ত্র?) রচনা করেন।

॥ ৫৬ ॥ ‘তো-ন-কিএ-ৎসে-কিঅ’ বা ধনকণ্টক

এখান থেকে এবার নির্জন বনানীর বুক চিরে দক্ষিণদিকে ‘তো-ন-কিএ-ৎসে-কিঅ’ বা ধনকণ্টক চললাম। হাজার লির মতো পথ চলার পর সেখানে পৌঁছলাম।

এ রাজ্যটি আয়তনে ছয় হাজার লি খানেক হবে। রাজধানীর ঘেরও ৪০ লির কাছাকাছি। মাটি সরস ও উর্বরা। চাষ আবাদের কাজ নিয়মিতভাবে করা হয়। ফসলের ফলন বেশ ভালোই। দেশের বেশির ভাগ জায়গাই বসতি বৰ্জিত। শহরগুলির লোক সংখ্যাও ভয়ানক কম। আবহাওয়া গরম। লোকদের গায়ের রঙ হলদেটে-কালচে। স্বভাবের দিক থেকে উগ্র ও তাড়না-প্রবণ। জ্ঞানের প্রতি অপার শ্রদ্ধা রয়েছে।

অসংখ্য সংঘারাম এ রাজ্যটিতে। তবে সবই প্রায় জন-বর্জিত ভাঙাচোরা। যে কটিকে এখনো টিকিয়ে রাখা হয়েছে তাদের সংখ্যা কুড়িটির মতো হবে। হাজারখানেক ভিক্ষু সেখানে থাকেন। সকলেই মহাযানের অনুরক্ত। শ’খানেক দেবমন্দির আছে। নানান সম্প্রদায়ের অগুণতি বিধর্মী সেখানে থাকেন।

রাজধানী থেকে পূর্বে, পাহাড়ের গোড়ায় পূর্বশীল নামে একটি সংঘারাম আছে। পশ্চিমদিকেও পাহাড় কোলে আবরশীল নামের সংঘারামটি রয়েছে। আগেকার এক রাজা এগুলি ক’রে দিয়েছিলেন। এখন এ দু’টিতে কেউই থাকে না।

শহরের দক্ষিণে অল্প কিছুটা হাঁটলে একটি বড়ো পাহাড়ী গুহার দেখা মিলবে। মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বের অপেক্ষায় শাস্ত্রবেত্তা ভাববিবেক এখানে এক গোপন অসুরপুরীতে বাস করে চলেছেন। এই বিখ্যাত পণ্ডিত বাইরে সাংখ্যকার কপিলের অনুগামী হলেও মূলতঃ নাগার্জুনের মতবাদের অনুরক্ত।

॥ ৫৭ ॥ ‘চু-লি-য়ে’ চুল্য বা চোল দেশ

ধনকণ্টক পিছনে ফেলে এগোতে থাকলাম। এবার আমাদের লক্ষ্য চু-লি-য়ে বা চোল রাজ্য। দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে হাজারখানেক লি পথ ভাঙার পর থামলাম এসে চোলিতে।

২৪০০ থেকে ২৫০০ লি আয়তনের এ রাজ্যটির রাজধানী শহরটি মাত্র দশ লি খানেক এলাকা জুড়ে।

বেশির ভাগ অঞ্চলেই জনমানব নেই, বুনো জন্তু জানোয়ারের বাসভূমি। পরপর জলাভূমি আর ঘন বনজঙ্গল। লোকসংখ্যা খুব কম। লুটেরা-ডাকাতের দল সবার চোখের সামনে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবহাওয়া গরম ঠেকলো। লোকজনের ব্যবহারও নিষ্ঠুর, মায়া-মমতাহীন। স্বভাব সহজাতভাবেই উগ্র। বিরোধী ধর্মমতের প্রতিই এদের অনুরক্তি।

এই এলাকার সংঘারামগুলি যেমন ভাঙাচোরা আর আবর্জনায় ভরা ভিক্ষুরাও তেমনি নোংরা। বেশ কিছু (কয়েক দশ) দেবমন্দির আছে। নির্গ্রন্থ সন্ন্যাসীর সংখ্যাই সব থেকে বেশি।

শহর থেকে কিছুটা দক্ষিণ-পূর্বে গেলে রাজা অশোকের গড়া একটি স্তূপ চোখে পড়বে। শহর থেকে পশ্চিমদিকে দেখা যাবে একটি পুরানো সংঘারাম দেব বোধিসত্ত্ব এখানে অর্হৎ উত্তরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন।

॥ ৫৮ ॥ ‘ত-লো-পি-চো’ বা দ্ৰাবিড়

চোল রাজ্য থেকে এবার আমরা আরো দক্ষিণে চললাম। হিংস্র জন্তু জানোয়ার ভরা এক বিরাট অরণ্য প্রদেশের মধ্য দিয়ে পথ চলতে থাকলাম। ১৫০০ থেকে ১৬০০ লি পার হবার পর এলাম ‘ত-লো-পি-চ’ বা দ্রাবিড় রজ্যে।

দেশটির আয়তন ছয় হাজার লির বেশি হবে না। রাজধানী শহরের নাম কাঞ্চীপুর। তিরিশ লি মতন এলাকা জুড়ে শহরটি।

এখানকার মাটি উর্বরা। চাষ আবাদের কাজও ভালোই চলে। শস্যের ফলনও বেশ ভালো হয়। ফুল ফলের কোন অভাব নেই, অফুরান রয়েছে। দামী দামী রত্ন ও অন্যান্য জিনিসও এখানে পাওয়া যায়।

আবহাওয়া গরম বলেই মনে হলো। লোকজন দেখলাম সাহসী। সততা ও সত্য ভাষণের দিকে গভীর অনুরাগ রয়েছে। জ্ঞানচর্চ্চার দিকে অপার অনুরাগ ও শ্রদ্ধা। এখানকার ভাষা ও বর্ণমালা মধ্য ভারতের তুলনায় ভিন্ন হলেও এই ভিন্নতা খুবই সামান্য।

কয়েকশো সংঘারাম আছে এখানে। ভিক্ষুর সংখ্যাও দশ হাজার খানেক। সকলেই মহাযান শাখার স্থবির মতধারার অনুগামী। দেবমন্দির আশিটির মতো। নির্গ্রন্থ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীই বেশি।

তথাগত এদেশে প্রায়ই আসতেন ও ধর্মপ্রচার করে বেড়াতেন। এজন্য রাজা অশোক এখানে বুদ্ধদেবের স্মৃতি বিজড়িত জায়গাগুলিতে অনেকগুলি স্তূপ বানিয়ে গেছেন।

কাঞ্চীপুর ধর্মপাল বোধিসত্ত্বের জন্মস্থান। তিনি ছিলেন এ রাজ্যের এক মন্ত্রীর বড়ো ছেলে।

শহর ছেড়ে খানিক দূরে এগোলে দক্ষিণদিকে একটি বড়ো সংঘারাম দেখা যাবে। এখানে অশোক রাজার তৈরী একশো ফুটের মতো একটি উঁচু স্তূপ রয়েছে।

॥ ৫৯ ॥ ‘মো-লো-কিউ-চ’ বা মালকুট

এবার আরো দক্ষিণদিকে এগিয়ে চললাম। দীর্ঘ তিন হাজার লি পথ পেরিয়ে এলাম অবশেষে ‘মো-লো-কিউ-চ’ বা মালকুট।

রাজ্যটির আয়তন পাঁচ হাজার লির কাছাকাছি। রাজধানীর শহরটি গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০ লি এলাকা জুড়ে। এখানকার মাটি নোনা। শস্যের ফলন তাই ততো বেশি নয়। পড়শী দ্বীপগুলিতে যে সব মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া যায় সেগুলি এখানে আনা ও বাছাই করা হয়।

আবহাওয়া বেজায় গরম। মানুষজন বেজায় কালো। স্বভাবের দিক থেকে তারা দৃঢ়চেতা ও গোঁয়ার। বৌদ্ধধর্মী ও অন্যধর্মী দুই-ই রয়েছে তাদের মধ্যে। লেখাপড়া ও জ্ঞানচর্চ্চার দিকে তেমন কোন অনুরাগ নেই। ব্যবসায়িক লাভ লোকসান নিয়েই মেতে আছে।

অনেক পুরানো সংঘারামের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। তাদের দেয়ালগুলিই যা একটু খাড়া রয়েছে এখনো। ভিক্ষুর সংখ্যা খুবই অল্প। বেশ কয়েকশো দেবমন্দির আছে। বিধর্মী অনুগামীদের সংখ্যাও অগুণতি। বেশির ভাগই নির্গ্রন্থ সম্প্রদায়ের।

শহর থেকে খানিক দূর গেলে পূর্বদিকে একটি পুরানো সংঘারাম চোখে পড়বে। তার পথ ও প্রাঙ্গণ বুনো গাছপালার জঙ্গলে ঢাকা, শুধু যা ভিত দেয়ালগুলিই কোন মতে এখনো খাড়া রয়েছে। রাজা অশোকের ছোট ভাই মহেন্দ্র এটি বানিয়েছিলেন।

এর পূর্বে একটি স্তূপ নজরে এলো। তার প্রায় সবটাই মাটিতে বসে গেছে। কেবল চূড়ার দিকটি মাটির উপরে রয়েছে। রাজা অশোক এটি গড়েন।

রাজ্যের দক্ষিণদিকে, সাগরকূলে, মলয় পর্বতমালা। বিরাট উঁচু উঁচু চূড়া, খাড়া খাড়া পাহাড়, গভীর উপত্যকা আর গিরি ঝরনার জন্য প্রসিদ্ধ। এখানে শ্বেত চন্দন ও চন্দনিভ গাছ জন্মায়। দুটি গাছই একরকম দেখতে। প্রখর গরমকালে পাহাড়ের উপর গিয়ে এ দুটোর পার্থক্য কষা সম্ভব। তখন দূর থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে বড়ো বড়ো সাপ চন্দন গাছের পা জড়িয়ে পাক খেয়ে পড়ে আছে। এই গাছের গা খুব ঠাণ্ডা বলে সাপেরা ঐভাবে পাক খেয়ে পড়ে থাকে। এভাবে মূল চন্দন গাছ চিনবার পর দূর থেকে গাছের গায়ে তীর বিঁধিয়ে গাছটিকে চিহ্নিত ক’রে রাখা হয়। শীতকালে সাপ যখন আর থাকে না তখন গিয়ে গাছ কেটে ফেলা হয়।

এ অঞ্চলে কপূরও মেলে। কর্পূর গাছের গুঁড়ি দেখতে পাইন গাছের মতোই, তবে পাতা, ফুল ও ফল দেখতে আলাদা রকমের। যখন গাছ কেটে ফেলা হয় ও রসালো অবস্থায় থাকে তখন কোন গন্ধ পাওয়া যায় না। কাঠ শুকিয়ে গেলেই তার মধ্যে শিরার মতো দেখা দেয় ও ফেটে ফেটে যায়। তখন এর মধ্যে অভ্রের মতো স্বচ্ছ জমাট বরফ রঙের কপূরের দেখা মেলে।

মলয় পর্বতমালার পূর্বদিকে পোতলক পর্বত। এর গিরিপথগুলি ভয়ঙ্কর বিপদ-ভরা। পাহাড়ের পাশগুলি ভীষণ খাড়া, উপত্যকাগুলি দারুণ উঁচু নিচু এবড়ো খেবড়ো। পাহাড়ের উপরে একটি হ্রদ রয়েছে। জল আয়নার মতো স্বচ্ছ। একটি খাদ থেকে একটি বড়ো নদী নেমে এসেছে। নদীটি নামার পথে পাহাড়টিকে কুড়িবার পাক খেয়ে নেমে এসেছে ও শেষমেশ দক্ষিণ সাগরে গিয়ে মিশেছে। হ্রদের পাশে দেবতাদের একটি পাথর-প্রাসাদ রয়েছে।

এই পাহাড় থেকে উত্তর-পূর্ব মুখো গেলে সাগর পাড়ে একটি শহরের দেখা পাওয়া যাবে। এখান থেকেই সাধারণতঃ দক্ষিণ-সাগর ও সিংহল যাত্রা করা হয়। এখানকার লোকেরা বলে থাকে যে এই বন্দর থেকে জাহাজে চড়লে ও তিন হাজার লি মতো দক্ষিণ-পূর্বে গেলে সিংহল পৌঁছান যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *