5 of 8

হায় ভীরু প্রেম

হায় ভীরু প্রেম

ভালবাসা নাকি চাঁদের মতো। কখনও এক অবস্থায় থাকে না। হয় বাড়ে না-হয় কমে। চন্দ্রকলার মতো হয় প্রেম ক্রম বিকশিত হয় নতুবা ক্রম বিনাশিত হয়।

জানি এসৰ ছেঁদো দার্শনিক তত্ত্ব এই হালকা হাসির লঘু নিবন্ধে আর যাই হোক তারাপদ রায়ের কাছে কেউ আশা করেন না। সুতরাং আপাতত তরল কাহিনীর স্রোতে কিছুটা এগোনো যাক। ধরা যাক সেই প্রেমিক-প্রেমিকার কথা যাঁরা দীর্ঘ প্রেমলীলার পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং তারপরে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করেছিলেন তাঁদের দু’জনের মধ্যে কোথাও কোনও বিষয়ে সামান্যতম মিল নেই। শুধু একটা জায়গায় মিল ছিল দু’জনের, দু’জনারই বিয়ের তারিখ এক, তা ছাড়া দু’জনারই এক ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার।

এ-গল্পটা আসলে সেই পুরনো গল্পটার মতো যেখানে গল্পের নায়ক দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের বাড়িতে আজ পর্যন্ত কারও ভাল বিয়ে হয়নি একমাত্র আমার স্ত্রী ছাড়া।’ স্বামী-স্ত্রীর প্রসঙ্গে যথাস্থানে আসা যাবে, এখন প্রেমিক-প্রেমিকার ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা যাক।

অনেকদিন আগে একটি ছেলে আমাকে বলেছিল যে, তার যে প্রেমিকা সেই মেয়েটি যমজ সন্তানের একজন! আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দু’জনার মধ্যে ঠিক কোনজন তোমার প্রেমিকা বুঝতে তোমার কোনও অসুবিধা হয় না?

ছেলেটি ঘাড় নেড়ে আমাকে জানিয়েছিল, আরে না, না দাদা, অসুবিধে হবে কেন? ওর ভাইয়ের একটা গোঁফ আছে যে। এই রকম অন্য একটি ক্ষেত্রে আমি নিজে যে জবাবটা দিয়েছিলাম সেটাও এই সূত্রে স্মরণীয়। সে অনেককাল আগের কথা। জনৈক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার স্ত্রী এবং শ্যালিকা দু’জনেই তো একরকম দেখতে, কে আপনার স্ত্রী, কে আপনার শ্যালিকা চটপট বুঝতে অসুবিধে হয় না আপনার?

যাঁরা বিদ্যাবুদ্ধি পড়েছেন তারা জানেন আমি কী বলেছিলাম, আমি বলেছিলাম, বোঝার খুব চেষ্টা করি না।

সেই কবে পবিত্র বাইবেলে লেখা হয়েছিল ভালবাসা মৃত্যুর মতোই শক্তিশালী। এই বাইবেল-বাক্য স্মরণে রেখেই বোধহয় একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে এক আবেগবিহ্বল মুহূর্তে জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা আমি যদি হঠাৎ মরে যাই তা হলে তুমি খুব দুঃখ পাবে?

প্রেমিকের এই শিশুসুলভ প্রশ্নে খুবই কৌতুক বোধ করেছিল যুবতীটি কিন্তু মুখে বলেছিল, ‘নিশ্চয়’।

এরপর প্রেমিক জানতে চেয়েছিল, তুমি খুব কাঁদবে?

প্রেমিকা বলেছিল, কাঁদব না কেন?

তখন সেই প্রেমিক অন্যায় আবদার করে বসল, একটু কেঁদে দেখাও না।

এই অনুরোধ রক্ষা করার বদলে একটি অতি নিষ্ঠুর জবাব দিয়েছিল যুবতীটি, একটু মরে দেখাও না।

জানি না, এর পরেও ভালবাসা মৃত্যুর মতো শক্তিশালী ছিল কি না, এর পরেও টিকেছিল কিনা।

প্রেম ও মৃত্যুর ব্যাপারে সেই ঘটনাটাও মনে পড়ছে। প্রেম নিবেদন করার পরে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরে খুবই ভেঙে পড়েছিল সেই প্রেমিক। শুধু প্রণয় নিবেদন নয়, সে কিন্তু পরিণয় প্রস্তাবও দিয়েছিল। মেয়েটি রাজি না হওয়ায় সে বেচারা একেবারে মুষড়িয়ে যায়, প্রায় কান্নাকাটি করে আর কী।

মেয়েটি তখন সমবেদনার সুরে জিজ্ঞাসা করল, কী হল তোমার? এত ভেঙে পড়লে কেন, শেষে আত্মহত্যা করবে নাকি?

ছেলেটি বলল, এসব ক্ষেত্রে আমি সাধারণত আত্মহত্যাই করে থাকি।।

অন্য এক ঘটনায় এক বাক্যবাগীশ প্রেমিক তার দয়িতাকে বড় গলায় বলেছিল, আমি দরকার হলে মৃত্যুর সামনে দাঁড়াতে পারি। ভালবাসার কথা চলছিল এক পার্কের পাশের বেঞ্চিতে বসে। এমন সময় পার্কের ভিতরে ভারী একটা শোরগোল উঠল। সবাই যে যেদিকে পারে ছুটতে লাগল একটু পরেই বোঝা গেল ব্যাপারটা, দূরে দেখা গেল শিং উঁচিয়ে একটা বিরাট পাগলা যাঁড় ছুটে আসছে। প্রেমিক-প্রেমিকা যে বেঞ্চিতে বসে ছিল দেখা গেল ফোঁস ফোঁস করতে করতে সেই দিকেই ষাঁড়টা ছুটে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চের ওপরে দাঁড়িয়ে উঠে শ্রীযুক্ত প্রেমিক আর্তচিৎকার দিয়ে এক লাফে পার্কের রেলিং পার হয়ে বড় রাস্তায় পড়ে ছুট লাগাল। এদিকে প্রেমিকের এই আর্তচিৎকার শুনে এবং দীর্ঘ লক্ষ দেখেই বোধহয় ষাঁড়টি গতিপথ বদল করে অন্য দিকে ধাবমান হল।

একটু পরে ষাঁড়টি যে রকম ভীমবেগে এসেছিল ঠিক সেভাবেই পার্কের খোলা গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। নিরাপদ দূরত্ব থেকে শ্রীযুক্ত প্রেমিক এর পরে গুটিগুটি প্রেমিকার কাছে ফিরে এল।

ভালবাসার মানুষের এই কাপুরুষতা দেখে প্রেমিকাটি তখন রীতিমতো উত্তেজিতা। প্রেমিক সামনে আসতেই তাকে চেপে ধরল, এইমাত্র তুমিই না বলেছিলে আমার জন্য মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারো আর একটা ষাঁড় দেখেই আমাকে ফেলে ছুটে পালালে। শ্রীযুক্ত প্রেমিক মাথা চুলকিয়ে বলল, কী করব বলো, ষাঁড়টা যে মৃত ছিল না।

শুধু ষাঁড় দেখেই যে প্রেমিকেরা পলায়নপর হয় তা কিন্তু নয়। কমলার বাবা কমলাকে বলেছিলেন, এই যে অমিত না অসিত কী নাম যেন ছেলেটির, ওই যে ছেলেটি তোমার লাভার, ওর সঙ্গে আর কোনওদিন তোমার দেখা হবে না।

এই শুনে কমলা ডুকরে কেঁদে উঠল, কী করেছ তুমি তার, বলো কী করেছ?

কমলার বাবা বললেন, আমি তার কী করব, কিছুই করিনি। সে আমার কাছে একশো টাকা ধার চেয়েছিল, সেই টাকাটা তাকে দিয়েছি।

টাকাপয়সার ব্যাপার আরও আছে।

জয়ন্তীর সঙ্গে জয়ন্তর নতুন আলাপ।

দু’জনে গলির মোড়ে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে ফুচকা খাচ্ছিল। হঠাৎ জয়ন্তের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তাই দেখে জয়ন্তী জানতে চাইল, কী ব্যাপার জয়ন্তদা, কী হল আপনার।

জয়ন্ত বলল, ওই যে পটল না কী যেন নাম, তোমার সেই বিচ্ছু ভাইটা— আমাদের ফুচকা খেতে দেখে ফেলেছে।

এদিক ওদিক তাকিয়ে জয়ন্তী বলল, কই, কোথাও তো পটলাকে দেখতে পাচ্ছি না। আপনি নিশ্চয় ভুল দেখেছেন জয়ন্তদা।

জয়ন্ত বলল, ওই দেখো সামনের ফুটপাতের ল্যাম্পপোস্টের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

জয়ন্তী ভাল করে দেখে বলল, এ তো পটলা নয়। ও হল ছেন্টু, আমার খুড়তুতো ভাই।

জয়ন্ত বলল, তাতে কিছু সুবিধে হচ্ছে?

জয়ন্তী বলল, খুবই সুবিধে। এসব জায়গায় পটলা পঞ্চাশ টাকার কমে ছাড়ে না। ছেন্টুটা বোকাসোকা ভালমানুষ, ওকে আপনার বিশ টাকা দিলেই হবে।

এই জয়ন্ত-জয়ন্তীর বিয়েতে প্রতিবেশী হিসেবে আমি নিমন্ত্রণ খেয়েছিলাম। তারা দু’জনেই এখন সুখী দম্পতি। পটলার মাঝে মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটে, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না।

আমি নিজে এক প্রাচীন পাপী, দীর্ঘদিন আগে সেই কবে পরিণয়পাশে আবদ্ধ হয়েছিলাম। প্রেমিক-প্রেমিকার কাহিনী লিখতে গিয়ে আমি বার বার দাম্পত্য কাহিনীতে চলে যাচ্ছি। কিন্তু চৌকশ লোকেরা বলেন দাম্পত্য-প্রেম প্রেম নয়, বৈষ্ণব কবির সেই রজকিনী প্রেমের মতো নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়। এতে অবশ্য আমারই সুবিধে, সবাই জানেন, কাজকর্মে আমার তেমন ফুর্তি নেই। মদালসা নবীনা পাঠিকা হয়তো একটু দুঃখিত হবেন, কিন্তু এ বয়সে, যখন তিনকাল গিয়ে এক্কালে ঠেকার বয়সে প্রায় এসে গেছি, আমি একটু ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে চাই। প্রেমবিষয়ক দুটি অধরা, অছোঁয়া গল্প বলি।

এক নৈশ সমাহারে একটি পরমা সুন্দরী কন্যা সকলের দৃষ্টি বাঁচিয়ে ঘরের এক প্রান্তে একটা পাতাবাহারের টবের পাশে দাঁড়িয়ে। সেখানেও এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, তাঁর কৌতূহলও কম নয়, তিনি জানতে চাইলেন, তুমি ওই হলের মধ্যে হইচই হাসি-তামাশা থেকে এখানে চলে এলে কেন?

মেয়েটি বলল, আরে পুরুষমানুষগুলো, বেঁটে-লম্বা রোগা-মোটা, কালো-ফরসা, যুবক-বুড়ো সবাই আমাকে বিরক্ত করছে, খালি জানতে চাইছে, আমি থাকি কোথায়? বর্তমান ভদ্রলোক এবার সুন্দরীকে আপাদমস্তক ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, তা তুমি জবাবে কী বললে? খুব ছোট একটা হাই চাঁপার কলির মতো আঙুলের তুড়ি দিয়ে নিবৃত্ত করে সুন্দরী বলল, কী আর বলব? বললাম যে আমি শহরতলিতে থাকি।

মুখে তুড়ি দেওয়ার সময় সুন্দরী যে দেহবিভঙ্গ রচনা করেছিল বর্তমান ভদ্রলোক তার পর স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিলেন, এবার খুবই আমতা আমতা করে বললেন, কিন্তু সত্যি তুমি থাকো কোথায়?

এবার সুন্দরী নয়নধনুকে শর সংযোজন করে বলল, ওই তো বললাম না, আমি তো শহরতলিতে থাকি।

এই রকমই অধরা গল্প অন্য একটা। কোথা থেকে টুকে যেন লিখেছিলাম, এখন গ্রন্থস্থ অবস্থায় শোধবোধ-এ আছে। নিজের কাছে নিজেই অনুমতি নিয়ে গল্পটি আবার বলছি । ⋯পার্টিতে, উৎসবে, অনুষ্ঠানে, হা-প্রেম লোকেরা তাকে দেখে অভিভূত হয়ে যেত। তার ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করত।

একদা এক উদ্‌ভ্রান্ত, প্রেমপাগল যুবক সেই যুবতীকে এক আসরে পেয়ে আর কিছুতেই কাছ ছাড়া করছে না। তার চোখে গদগদ দৃষ্টি তার কণ্ঠে ভালবাসার মধু। কিন্তু মেয়েটির সে কিছুতেই পাত্তা পেল না। কতবার অনুরোধ করল, জানতে চাইল, আপনি কি একা এসেছেন, আপনি কী করে ফিরবেন, আমি আপনাকে নামিয়ে দেব, মেয়েটি হ্যাঁ, না, থ্যাঙ্ক ইউ ইত্যাদি টুকটাক সংক্ষিপ্ত জবাবে পাশ কাটিয়ে গেল।

অবশেষে ভগ্নহৃদয়ে যুবকটি বলল, আপনার ফোননম্বরটা যদি দেন, কোনওদিন যদি ফোন করি।

মেয়েটি বলল, টেলিফোন ডিরেক্টরিতে পাবেন।

অতঃপর মরিয়া হয়ে যুবকটি শেষতম মোক্ষম প্রশ্নটি করল, কিন্তু আপনার নাম।

মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, সে-ও ওই টেলিফোন ডিরেক্টরির মধ্যে পাবেন।

মেয়েরা যে সহজে পাত্তা দিতে চায় না, অনায়াসেই প্রত্যাখ্যান করে এ তো সকলেরই জানা কথা।

অল্প বয়সে আমার এক সহকর্মী আমাকে বলেছিলেন, প্রেম পারাপারে ঝাঁপিয়ে দেখুন অনেক মেয়েই আপনার সঙ্গে সাঁতরাতে রাজি হবেন, অনেকটা দূর সাঁতরাবেন, কিন্তু কিছুতেই তীরে উঠে ঘর বাঁধতে চাইবেন না।

আমি একটু বোকার মতো বলেছিলাম, মানে?

সহকর্মী করুণ হেসে বলেছিলেন, মানে আর কী? বহু মেয়ে আছে যারা বিয়ে করতে চায় না।

আমি বললাম, জানলেন কী করে?

কী করে আর, সহকর্মী বললেন, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। আমি যে অনেককেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেখেছি।

আমার এই সহকর্মী বন্ধুটির মতো অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অনেকেরই আছে। তবে আমার নেই। কোনওদিন কোনও মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার এমনকী তার প্রেমে পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। এতদিন পরে এ নিয়ে কোনও আফসোসও নেই আমার। যাক সেসব অন্য কথা। এইবার কাহিনীমালার বিরতি টানতে হয়। তবে দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, শেষ গল্পটি বড়ই মর্মান্তিক।

বলরাম বনলতাকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলল, দেখো, হয়তো আমি বলহরির মতো দেখতে সুন্দর নই; হয়তো আমরা বলহরির মতো বড়লোক নই, তার মতো আমার এয়ার কন্ডিশন বাড়ি নেই, সাজানো ফ্ল্যাট নেই কিন্তু বনলতা আমি তোমাকে ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। এক মুহূর্তও থাকতে পারব না।

কোনওরকমে আলিঙ্গন ছাড়িয়ে বনলতা বলল, সে তো আমি বুঝতে পারছি, আমিই কী তোমাকে কম ভালবাসি নাকি। কিন্তু এই যে বারবার বলহরি বলহরি বলছ, এই বলহরি লোকটা কোথায় থাকে বলো তো?

তথাপি:

তথাপি একটা এমন গল্প বাদ থেকে গেল যে সেটা না বললে অন্যায় হবে। ঠিক গল্পও নয়, একটা প্রশ্ন।

খুবই সাধারণ, সাদামাটা জিজ্ঞাসা এটা। সেই সাবেকি পুরনো একটা প্রশ্ন।

গভীর আপ্লুত কণ্ঠে প্রেমিক বেচারা প্রেমিকাকে প্রশ্ন করলেন, আনোয়ারা আমিই কি তোমার জীবনে প্রথম?

আনোয়ারা মৃদু হেসে বললেন, ছিঃ ছিঃ এসব কী প্রশ্ন করছ? তুমি ছাড়া আর কে? আর অন্য কারও কথা আসে কী করে?

আনোয়ার বলল, তবু একেক সময় কেমন যেন খটকা লাগে।

আনোয়ারা এবার বিরক্ত হয়ে বলল, এই এক সমস্যা তোমাদের এই পুরুষমানুষদের নিয়ে। সবাই জানতে চায় সেই প্রথম কিনা?

পুনশ্চ:

অবশেষে নিজের প্রেমের কথা বলি।

অনেকদিন আগে, তা প্রায় তিরিশ বছর, আমার এক বন্ধু কয়েকদিন ধরে অফিসে আসছিলেন না। আমরা দুপুরে একসঙ্গে চা খেতাম, আড্ডা দিতাম। একদিন কার কাছে শুনলাম, তাঁর জ্বর হয়েছে। ভাবলাম একদিন দেখে আসা উচিত। পরের দিন দুপুরবেলা টিফিনের সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কলেজ স্ট্রিটের মেসবাড়ি, তখন মেসবাড়ি ব্যাপারটা কলকাতায় ভালভাবেই রয়েছে। আমার বন্ধুটি থাকতেন দোতলায়। ভরদুপুরের মেসবাড়ি একেবারে ফাঁকা, একতলার খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে আমি বন্ধুর নাম ধরে ডাকতে থাকলাম। বেশ একটু পরে তাঁর সাড়া পেলাম কিন্তু তার আগে দ্রুতপদে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে একটি লাল শাড়ি-পরা মেয়ে আমার দিকে না তাকিয়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। দোতলায় আমার বন্ধুর ঘরে গিয়ে পৌঁছতে তিনি আমাকে বললেন, জ্বরটা ছেড়ে গেছে। আমি তাঁকে বললাম, হ্যাঁ, দেখলাম, এইমাত্র সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। প্রেম সম্বন্ধে আমার এই গোলমেলে মনোভাব কতটা সত্যি, এ বয়সে আর বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না। তবে আমার এই কর্কশ কণ্ঠ, গোলাকার চেহারা, তদুপরি নিয়ত প্রতিবাদ-প্রবণ মন, কোনও দিনই সফল প্রেমিক হওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না। মেয়েরা আমাকে ভয় করতে পারে, ভক্তি করতে পারে, ঘৃণাও করতে পারে, কিন্তু কখনও ভালবাসবে কিনা আমার গভীর সন্দেহ আছে।

প্রেমে বিশ্বাস করি কি না এই প্রশ্নে আমার সংক্ষিপ্ত জবাব হল, প্রেম আমার কাছে অনেকটা ভূতের মতো। ভূতে বিশ্বাস করি না কিন্তু ভয় পাই, প্রেমেও ভয় পাই। আগে হয়তো কখনও প্রেমে পড়লেও পড়তে পারতাম, কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। তার একমাত্র কারণ অবশ্য আমার বয়স নয়। এ বয়সেও ঢের ঢের লোক প্রেমে পড়ে। আমার অসুবিধে অন্যরকম। যতদূর শুনেছি এবং সেই শরৎচন্দ্রের উপন্যাস থেকে পড়ে আসছি, প্রেমিকা খুব ভালভাবে ভাল ভাল সামগ্রী বেঁধে খুব যত্ন করে খাওয়ায়। আমার পক্ষে ভাল জিনিস খাওয়া এখন বিষতুল্য। এমনিই যা খাই তাতে শরীর ফুলেফেঁপে রয়েছে। তা ছাড়া প্রেম করলে শুধু রেস্তোরাঁয় বা কফিহাউসে নয়, পার্কে, নদীর ধারে হাত-পা ছড়িয়ে প্রেমিকার পাশে অনেকক্ষণ বসে থাকার নিয়ম আছে। কিন্তু আমি মেঝেতে বা উঠোনে বসতে পারি না। ওরকমভাবে বসলে দশ মিনিটেই আমার পায়ের পাতা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ফলে ঢোল হয়ে যাবে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক গিবন সাহেবের কথা মনে পড়ে। তিনি প্রচণ্ড স্থূলাকার ছিলেন। একদা এক আসরে তিনি কায়দামাফিক হাঁটু গেড়ে বসে এক সুন্দরীকে প্রেম নিবেদন করতে যান। তারপর সুন্দরী সেই পটভূমি থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও আর গিবন সাহেব উঠে দাঁড়াতে পারলেন না। প্রায় আধঘণ্টা পরে বহুজনের সাহায্যে তিনি উঠে দাঁড়ান। মদনদেবের কাছে আমার প্রার্থনা, এই পরিণতি থেকে আমাকে রক্ষা করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *