সেই বই
বইমেলায় অগ্নিকাণ্ডের পরের দিন সকালে মেলার মাঠের পাশ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একটা আধপোড়া ইংরেজি বই থেকে কয়েকটি ছত্র পেশ করেছিলাম। কারও কারও হয়তো ভাল লেগেছিল উদ্ধৃতিগুলি।
সেই পোড়া বইটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে করিয়ে দিলেন শ্রীমতী অরুণা চক্রবর্তী। শ্রীমতী চক্রবর্তী হাওড়ার বাসিন্দা, বর্ধমানের রেললাইনের আশেপাশে কোনও কলেজের ইংরেজির শিক্ষিকা। তিনি আমাকে সেই বইটির একটি অদগ্ধ কপি লোক মারফত পাঠিয়েছেন। বইটি তিনি এই বইমেলাতেই আগুন লাগার আগের দিন কিনেছিলেন। কিন্তু অক্ষত বইটি আমাকে পাঠিয়ে অরুণাদেবী আমাকে আদেশ করেছেন, ‘এই সেই বই। পোড়া বই ফেলে দিন। তারপর এই বই থেকে যত ইচ্ছে টুকুন।…
…কিন্তু কাউকে বইয়ের নাম বা লেখকের নাম বলবেন না, আপনার লেখাতেও ছাপবেন না। এত ভাল লেখা যে কেউ চুরি করুক, তা আমি চাই না।’
অরুণাদেবীর এই চিঠি পড়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। টুকে লেখায় আমার ক্লান্তি নেই, গ্লানি নেই। কিন্তু এই বইয়ের ব্যাপারটা একটু আলাদা।
আপাতত এইটুকু ভণিতাই যথেষ্ট। এখনই দেখছি এই বইটা আমার কাজে লাগছে। বুঝতে পারছি, বইটা ভবিষ্যতে আমার কাজে লাগবে।
কেন কাজে লাগবে তার দু’-একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
(এক) আদালতের বারান্দায় দুঁদে উকিলের সঙ্গে পুরনো মক্কেলের দেখা হয়েছে। উকিলবাবু বললেন, ‘আরে কী আশ্চর্য? আমি শুনেছিলাম আপনি মরে গেছেন।’
মক্কেল বললেন, ‘সে কী করে সম্ভব? আপনি তো দেখছেন আপনার সামনে আমি জলজ্যান্ত বেঁচে আছি।’
সন্দেহবোধক মুখে দুঁদে উকিল বললেন, ‘সবই তো বুঝতে পারছি। কিন্তু যে বলেছিল আপনি মরে গেছেন, সে কিন্তু আপনার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য।’
(দুই) এক পুরনো কয়েদি খুব আমুদে আর হাসিখুশি গোছের। জেলখানায় সে অনেকদিন রয়েছে। এখানকার সকলের সঙ্গেই তার চেনাজানা, গল্পগুজব।
কিন্তু জেলার সাহেব একটা জিনিস লক্ষ করেছেন, জেলখানার প্রায় প্রতিটি আসামির কাছেই লোকজন দেখা করতে আসে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কখনও বা পুরনো সাকরেদ কিংবা ফৌজদারি মামলার উকিলবাবু।
কিন্তু এই প্রৌঢ় কয়েদিটির কাছে কোনওদিন কেউ আসে না। একদিন কৌতূহলবশত জেলার সাহেব এই কয়েদিকে বললেন, ‘তোমার কি নিজের জন কেউ নেই?’
কয়েদিটি বললেন, ‘তা থাকবে না কেন?’
জেলার বললেন, ‘কেউ তো কখনও তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসে না।’
প্রৌঢ় কয়েদিটি জেলার সাহেবের এই প্রশ্নে হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, ‘কী করে আসবে? তারা তো বাইরে নেই, তারা সকলেই এই জেলের ভিতরে রয়েছে।’