5 of 8

চার্চিল

চার্চিল

এই ধুরন্ধর রাজনীতিবিদের জন্ম, মৃত্যু বা অভিষেকের শতবার্ষিকী, রজত বা হীরকজয়ন্তী কিছু নয়। বড় জোর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসপঞ্জি খুলে বলা যেতে পারে, মিত্রপক্ষের অন্যতম প্রধান স্থপতি, চার্চিলের প্রতি যুদ্ধলক্ষ্মী প্রসন্ন হওয়ার এটা সুবর্ণজয়ন্তী বৎসর।

আশ্চর্য কাণ্ড! স্মৃতি-বিস্মৃতির গলিখুঁজিগুলি বড় আলোছায়া-ঘেরা, বড়ই রহস্যময়।

বঙ্গীয় সংবাদ-বিদ্যার মহাগুরু বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে মনে পড়ল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথা, আর সেই সূত্রে উইনস্টন চার্চিল।

চার্চিল মানে স্যার উইনস্টন লিওনার্ড স্পেন্সার চার্চিল। আমাদের অল্প বয়েসে, চার্চিল সাহেব তখন মধ্যগগনের সূর্য, একটি ছেঁদো রসিকতা ছিল তাঁর নাম নিয়ে। এটি একটি ধাঁধামূলক রসিকতা। প্রশ্ন করা হত, বলো তো চার্চিলের কয় পা? চার্চিল মানে চারটি চিলপাখি হলে উত্তর হল: পায়ের সংখ্যা চার দু’গুণে আট। আবার চার্চিল যদি গোটা মানুষ হন, যে-ব্যক্তি বিলেতের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর তো দুটো পা। জানি না এই রসিকতা তর্জমা করে চার্চিল সাহেবের কাছে পৌঁছেছিল কি না! নিশ্চয়ই পৌঁছয়নি। কোনও বঙ্গভাষী তাঁর কাছাকাছি ছিলেন বলে শুনিনি। তা ছাড়া এই নাক-উঁচু, নীল-রক্ত ইংরেজের সঙ্গে আমাদের ছিল রাজা-প্রজা সম্পর্ক; তিনিই তো ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পাততাড়ি গোটানোর অনুষ্ঠানে আমি সভাপতিত্ব করতে চাই না।’ সেসব যাই হোক, এতদিন পরে আর রাগ পুষে লাভ নেই। তা ছাড়া উইনস্টন চার্চিলের কাছে আজকের সভ্য পৃথিবীর একটা বড় ঋণ রয়েছে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অক্লান্ত যোদ্ধা।

চার্চিল ছিলেন সুরসিক, তর্কবীর। তাঁর বিখ্যাত উক্তিগুলি বাদ দিয়ে দুয়েকটি কম-পরিচিত রসিকতার উল্লেখ করা যেতে পারে।

একদা বিরোধীপক্ষের এক মহিলা এম পি চার্চিলকে বলেছিলেন ‘মি. চার্চিল, আপনার ওই খোঁচা গোঁফ আর ওঁছা যুক্তি— এ-দুটোর কোনওটাই আমার পছন্দ নয়।’

তিক্ত হাসি হেসে চার্চিল বলেছিলেন, ‘এ-দুটোর কোনওটার সংস্পর্শেই আসার সুযোগ আপনার হবে না, মহোদয়া, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’

এই হল চার্চিলের বিরোধীর সঙ্গে বাক্যালাপ। অনুগামীর সঙ্গে কথাও কম চিত্তগ্রাহী নয়। একদিন এক অনুগামী উচ্ছ্বাসভরে চার্চিলকে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা স্যার, এই যে এত লোক সব সময়ে আপনার বক্তৃতা শুনতে ভিড় করে আসে, এতে আপনি গৌরব বোধ করেন না। এতে আপনার রোমাঞ্চ হয় না ?’

চার্চিল জবাব দিয়েছিলেন, ‘গৌরব বোধ করি বইকী। রোমাঞ্চ হয় বইকী। কিন্তু তুমি একবার ভেবে দ্যাখো তো যে যদি আমার বক্তৃতার বদলে আমাকে আজ ফাঁসি দেওয়া হত, তা হলে লোক আরও কত বেশি হত।’

চার্চিলের অন্য একটি কাহিনী, সেই যাকে বলে সেয়ানে-সেয়ানে। জর্জ বার্নার্ড শ বনাম উইনস্টন চার্চিল। বলা বাহুল্য, এঁরা দু’জন সমসাময়িক। তখন বার্নার্ড শ-এর বিখ্যাত নাটক ‘পিগম্যালিয়ন লন্ডনের মঞ্চে অভিনীত হচ্ছে। অভিনয়ের প্রথম দিনের শো-এর দুটি পাশ চার্চিলকে পাঠিয়ে দিয়ে বার্নার্ড শ চার্চিলকে লিখেছিলেন, ‘একটি পাশ আপনার জন্যে আর দ্বিতীয়টি আপনার কোনও বন্ধুর জন্যে অবশ্য যদি আপনার কোনও বন্ধু থাকে।’ এর উত্তরে পাশ দুটি ফেরত পাঠিয়ে চার্চিল জানালেন, ‘দুঃখিত, আমি আজ যেতে পারছি না। তবে কাল আপনার শো-তে যেতে পারি। অবশ্য কাল কিংবা আর-কখনও যদি আপনার শো হয়।’

এর চেয়ে তির্যক মন্তব্য চার্চিলের রাজনীতি বিষয়ে। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, ভাল রাজনীতিবিদের যোগ্যতা কী হওয়া উচিত। চার্চিল বলেছিলেন, ‘বিশেষ কিছু নয়। শুধু তাকে দূরদর্শী হতে হবে; সে যেন ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেটা ঠিকমতো বলতে পারে। আর যখন সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিলবে না, তখন যেন ব্যাখ্যা দিতে পারে, কেন মিলল না।’ এবার চার্চিল সম্পর্কে একটি পরিচিত গল্প বলি। চার্চিলের আশি বছরের জন্মদিনে এক তরুণ ফটোগ্রাফার তাঁর ফটো তুলতে গিয়েছিল। সে মাতব্বরি করে বলেছিল, ‘আমি আশা করি আপনার জন্মশতবর্ষেও এসে এমনিভাবে ছবি তুলে নিয়ে যেতে পারব।’ তরুণ ফটোগ্রাফারের উৎসাহে এক কলসি ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে চার্চিল তার পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, ‘কেন নয় ছোকরা? তোমার স্বাস্থ্য তো বেশ ভালই দেখছি। নিশ্চয়ই ততদিন বেঁচে থাকবে।’

পুনশ্চ: অবশেষে চার্চিল-সূত্রে একটি অ-চার্চিল গল্প।

বাংলায় যাকে ডালকুত্তা বলে, ইংরেজিতে তা-ই বুলডগ। আবার ওই থ্যাবড়া মুখের জন্যে চার্চিল-যুগে ওর নাম হয় চার্চিল ডগ। এই বুলডগ তথা চার্চিল ডগের থেকে কিঞ্চিৎ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটি বাচ্চা ছেলে কুকুরটিকে মুখ ভ্যাংচাচ্ছিল। তাকে যখন বলা হল, ‘তুমি কুকুরটাকে মুখ ভ্যাংচাচ্ছ কেন?’ সে নির্বিকারভাবে জবাব দিল, ‘ও অনেক আগে থেকে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *