আমপাতা জোড়া-জোড়া
‘আমপাতা জোড়া-জোড়া,
মারব চাবুক ছুটবে ঘোড়া…’
এ ছড়ার দিন বহুকাল আগেই শেষ হয়ে গেছে। চাবুক মেরে ঘোড়া ছুটিয়ে যাওয়ার দিন আর নেই। হয়তো গ্রামগঞ্জের দিকে গেলে ক্বচিৎ কদাচিৎ দেখা যাবে নিঃসঙ্গ কোনও অশ্বারোহীকে, ঘোড়ার খুরের ধুলো উড়িয়ে যাচ্ছেন। দু’-একটা আদ্যিকালের এক্কা কিংবা টমটম গাড়িও হয়তো চোখে পড়বে চিরকালের ভাঙা রাস্তায় সওয়ার নিয়ে চলেছে। চোখে পড়বে দু’-একটা মালবাহী ঘোড়া বা ঘোড়ার গাড়িও।
নগর ও শহরাঞ্চলে এখন ঘোড়া দেখতে গেলে রেসের মাঠে কিংবা সার্কাসের তাঁবুতে যেতে হবে। কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে গোটা তিনেক প্রাগৈতিহাসিক ফিটন গাড়িও কয়েকবছর আগে পর্যন্ত দেখা যেত, এখনও আছে কি না বলতে পারি না।
অথচ এই তো সেদিন, মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে, দেশ থেকে যেদিন কলকাতায় এলাম, শেয়ালদা স্টেশনে নেমে ঘোড়ার গাড়িতে চড়েই কলকাতার বাসায় গিয়েছি।
আমাদের বাল্যকালে রূপকথার গল্পে পড়েছি, রাজপুরীতে হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া। সেসব রাজপুরী আমরা স্বচক্ষে দেখিনি তবে ঘোড়াশালে ঘোড়া ব্যাপারটা বুঝতাম। হাতিশালে হাতি আমার বাল্য বয়েসেরও আগের ব্যাপার, হয়তো আমার শিশু প্রপিতামহই তাঁর কালে ব্যাপারটা বুঝতেন।
তবে, ঘোড়া তখনও ছিল। আমাদের মফস্বলে উকিলবাড়িতে মক্কেলরা অনেকেই আসত ঘোড়ায় চড়ে। চোখের সামনে ধীরে ধীরে দেখেছি অশ্বারোহীর সংখ্যা কমছে, সাইকেলারোহীর সংখ্যা বাড়ছে। সাইকেল বাড়তে বাড়তে শেষ পর্যন্ত সব ঘোড়াকেই আউট করে দিল। শেষ পর্যন্ত একটি মাত্র ঘোড়া সেটি ছিল গয়েশ পালের।
গয়েশ পাল ছিলেন একজন তস্কর প্রধান। এমনিতে তাঁর হাটে সোনারুপোর দোকান ছিল। সেই দোকানে বসেই তিনি স্থানীয় গৃহস্থের ধন-দৌলতের তাৎক্ষণিক আঁচ করলেন। যথাসময়ে যথাস্থানে উপযুক্ত লোক নিয়োগ করে অন্তরালে থেকে তস্করবৃত্তি পালন করতেন। বলা বাহুল্য, কাজটি বিপজ্জনক ছিল। মাঝে মধ্যেই তাঁকে পুলিশ ধরত। তাঁকেও উকিল-আদালত করতে হত।
গয়েশবাবুকেই দেখেছি শেষ পর্যন্ত ঘোড়ায় করে যাতায়াত করতে। তিনি খুব সকাল সকাল আমাদের বাড়িতে এসে ঘোড়া থেকে নেমে লাগাম খুলে একটা লম্বা দড়ি দিয়ে কাছারিঘরের পাশে একটা সুপারি গাছের সঙ্গে ঘোড়াটাকে বাঁধতেন। পরে সন্ধ্যাবেলা কাছারির কাজ শেষ হলে আমাদের বাসায় ফিরে ঘোড়ায় উঠে গ্রামে ফিরে যেতেন। অন্তর্বর্তী আট-দশ ঘণ্টা ঘোড়াটি থাকত আমার আর দাদার হেফাজতে। চাবুক হাতে আমরা তার সওয়ারি হওয়ার চেষ্টা করতাম। ঘোড়াটিকে আমরা নিশ্চয়ই খুবই নির্যাতন করতাম। কারণ একবার সেই ঘোড়া আমার ঘাড়ে কামড়ে দিয়েছিল। এখনও ঘোড়ার দাঁতের চৌকো চিহ্ন আমার ঘাড়ে স্পষ্ট দেখা যায়।
ঘোড়ার ঘটনা এতকাল পরে মনে পড়ল খবরের কাগজে একটা সংবাদ দেখে। মাননীয়া মানেকা গান্ধীর উদ্যোগে পশুক্লেশ নিবারণী বিধি সমূহে এখন থেকে একটা নতুন মাত্রা যোগ হতে যাচ্ছে। এখন থেকে ঘোড়াকে আর চাবুক মারা যাবে না। চাবুকের বদলে হালকা ধরনের কোনও কিছু প্রয়োগ করতে হবে।
খবরটি পাঠ করে গঙ্গারাম একটি বাঁকা কথা বলল, ‘এরপর হয়তো সরকারি নির্দেশ থাকবে যে গোরু দোয়া যাবে না।’
গঙ্গারামকে তেমন পাত্তা না দিয়ে বললাম, ‘ঘোড়ার গল্পে গোরু কেন?’
গঙ্গারাম বলল, ‘আপনি বুঝি গোপাল ভাঁড়ের সেই গল্পটা পড়েননি?’
আমি বললাম, ‘কোন গল্পটা?’
গঙ্গারাম বলল, ‘পুরনো গল্প। এক গৃহস্থ তীর্থে গিয়েছেন। যাওয়ার সময় তাঁর গোরু রেখে গেছেন প্রতিবেশীর কাছে। ফিরে এসে গোরু ফেরত চাইতে তিনি বললেন, ‘খুবই দুঃখের কথা, তোমার গোরু হঠাৎ মরে গেছে’। এ কথা কেউ বিশ্বাস করে? তখন সেই প্রতিবেশী ওই গৃহস্থকে গো-ভাগাড়ে নিয়ে একটি কঙ্কাল দেখালেন। কিন্তু দেখা গেল সেটি ঘোড়ার কঙ্কাল। গৃহস্থ প্রতিবেশীকে সেকথা বলতে প্রতিবেশী বললেন, ‘কী আর বলব দাদা, তোমার গোরু ওই ঘোড়ারোগেই মারা গেছে।’
এ গল্পের মানে কী ধরতে পারলাম না। তবে গঙ্গারাম তো এই রকম গল্পই বলে।