5 of 8

ব্যাঙ্ক

ব্যাঙ্ক

এক সময়ে ব্যাঙ্কে টাকা জমানো খুব মজা ছিল। টাকা ক্রমাগতই জমে যেত। যদিও সুদের হার বেশ কম ছিল, আসল টাকাটাই জমে জমে বেড়ে যেত। টাকা যত ইচ্ছে জমিয়ে যাও, কোনও অসুবিধে বা বাধা নেই। ব্যাঙ্কের কাউন্টারে ফর্ম পূরণ করে টাকা জমা দিলেই হল।

কিন্তু টাকা তোলা যেত না। উইথড্রয়াল ফর্ম কিংবা চেকের সই কিছুতেই মিলত না। টাকা তোলার জন্যে ব্যাঙ্কে চেক জমা দেওয়া মাত্র ওপাশের কেরানিবাবু একবার চেকের সইয়ের দিকে তাকিয়ে তারপর চেকধারীর মুখের দিকে তাকাতেন। তারপর কিছুক্ষণ কী যেন খুব চিন্তা করতেন, বোধ হয় প্রাপকের মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করতেন, সইটা ঠিক কি না। এই ব্যক্তি এই টাকা পাওয়ার যোগ্য কি না।

এরপর তিনি চেকের ওপরে একটা নম্বর লিখে ঠিক সেই নম্বরের একটা পেতলের চাকতি চেকওলার হাতে তুলে দিতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা লম্বা লাল খাতার মধ্যে চেকটিকে সেই কেরানিবাবু লুকিয়ে ফেলতেন।

ব্যস, এর পর দু’ঘণ্টা বিরতি। তবে বুদ্ধিমান লোকেরা এই বিরতির সুযোগ খুব একটা গ্রহণ করতেন না। ব্যাঙ্কের মধ্যে অপেক্ষা করতেন। কারণ এক ঘণ্টার মাথায় একটা শোরগোল উঠবে। ব্যাঙ্কের ভেতর থেকে তারস্বরে চিৎকার উঠবে, ‘সতেরো নম্বর চেক, সতেরো নম্বর।’

টোকেন অর্থাৎ সেই পেতলের চাকতির ওপরে দৃষ্টিপাত করে অবধারিতভাবে দেখতে পেতাম আমারই সতেরো নম্বর। দুরুদুরু হৃদয়ে চুরির মামলার আসামির মতো ব্যাঙ্কের মধ্যে প্রবেশ করতাম। কোনও একটা টেবিলে পৌঁছে জানতে পারতাম, সই মেলেনি। বিজয়ীর উল্লসিত হাসি হাসতে হাসতে সেই টেবিলের ভদ্রলোক জানাতেন, সইয়ের টির মাথা ছোট এবং ওয়াইয়ের লেজ লম্বা হয়েছে। নিজের চেক হলে হয়তো বলতাম, ‘দিন এখনই আর একটা সই করে দিচ্ছি।’ কিন্তু তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘আজ আর হবে না। চেক নেওয়ার সময় শেষ। আর একদিন আসুন।’

শিবরাম চক্রবর্তী অবশ্য এর চেয়েও জটিল সমস্যার কথা লিখেছিলেন। তাঁর গল্পের এক চরিত্র পোস্টাফিসে টাকা রাখতেন। টাকা তোলার ব্যাপারে ব্যাঙ্কের থেকে পোস্টাফিস ছিল দশ কাঠি ওপরে, কস্মিনকালেই সই মিলত না।

শিবরামের গল্পের সেই দেহাতি চরিত্র ছিলেন অতিশয় কৃপণ। তিনি তাঁর ভাষায় ‘পুস্টাফিসে’ টাকা জমাতেন, টাকা কখনওই তোলা যাবে না, ঘোরতর প্রয়োজনের মুহূর্তেও পোস্টাফিসে সই কিছুতেই মিলবে না। টাকা তোলা যাবে না। তদুপরি সেই ভদ্রলোক বুদ্ধি খাটিয়ে হিন্দিতে সই করতেন। বাংলা সই যদিও বা কালেভদ্রে মিলে যায়, ‘হিন্দি সহি’ কখনওই মেলার কোনও সম্ভাবনা নেই।

আজকাল তো পোস্টাফিসেও চেকবই চালু হয়েছে। আর ব্যাঙ্কে সইয়ের ব্যাপার, সরাসরি নিজের টাকা তোলবার ব্যাপারে, অনেক জায়গাতেই উঠে যেতে বসেছে। কোনও সইসাবুদ নয়, দিনে রাতে যে কোনও সময় ‘এনি টাইম মানি’, একটা বাক্সে প্ল্যাস্টিকের কার্ড গলিয়ে দিলেই ঈপ্সিত অর্থ বেরিয়ে আসবে। এ ছাড়া প্রায় সর্বত্র এখন টেলার সিস্টেম, কাউন্টারের এ পাশ থেকে চেক গলিয়ে দিলে দু’-এক মিনিটের মধ্যে ওপাশ থেকে টাকা উঠে আসে।

প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি সদ্য উপার্জন করা আরম্ভ করে একটা ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম। সেই সময়ে বাড়ি থেকেও অল্প কিছু টাকা আমি পেয়েছিলাম।

পুরো টাকাটা আমি ব্যাঙ্কে জমা দিই। কিন্তু টাকা তুলতে গিয়ে দেখি বিশাল ঝামেলা, আমার চেকে কোনও না কোনও খুঁত বেরতই। সেই সময়ে একদিন অফিস কামাই করে প্রচুর ধ্বস্তাধ্বস্তি করে সঞ্চিত অর্থের প্রায় নব্বই ভাগ তুলে ফেলি। এবং তারপরে দীর্ঘদিন আর ব্যাঙ্কমুখী হইনি।

তখন ব্যাঙ্কের নিয়মকানুন আমি একদম জানতাম না। বছর দু’-এক পরে ব্যাঙ্ক থেকে পাঠানে একটা রেজেষ্ট্রি চিঠি থেকে আমি জানতে পারি, আমার অ্যাকাউন্ট অবলুপ্ত হয়ে গেছে। একশো টাকার কম জমা থাকায় প্রতি মাসে দশ টাকা করে কাটতে কাটতে আমার জমা শূন্য হয়ে গেছে।

এর পরে ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে আমি একটা চিঠি দিয়েছিলাম।

প্রিয় ম্যানেজার সাহেব,

আপনাদের হিসেবমতো যে তারিখে আমার জমা শূন্য বলে জানিয়েছেন আমি অঙ্ক কষে দেখলাম সেই তারিখে শূন্য নয় আমার জমা মাইনাস তিরিশ। শূন্য হত আরও চার-পাঁচ মাস আগে।

সে যা হোক, এই হিসাব অনুযায়ী আমার কাছে আপনার ব্যাঙ্কের তিরিশ টাকা জমা আছে। যদিও আপনাদের চেক বই দেওয়া যায়নি আপনাদের জমা একশো টাকার কম, সুতরাং এখন থেকে প্রতি মাসে আপনাদের পাঁচ টাকা করে দিতে হবে। এইভাবে আগামী ছাব্বিশ মাস বাদে আপনাদের কাছে আমার একশো তিরিশ (৫ × ২৬) টাকা পাওনা হবে।

এর মধ্যে আপনাদের জমা তিরিশ টাকা বাদ দিয়ে বাকি একশো টাকা আপনারা আমাকে দেবেন।

শোধবোধ হয়ে যাবে। ইতি।

বলাবাহুল্য ব্যাঙ্ক এ পত্রের কোনও উত্তর দেয়নি, আমিও আর খোঁজ নিইনি।

এখন অবশ্য দিনকাল অনেক বদলেছে। ব্যাঙ্ক থেকে নিজের সঞ্চিত বা চেকবাবদ প্রাপ্য অর্থই শুধু তোলা যায়, তা নয়, ঋণও পাওয়া যায়।

কিছুকাল আগে আমি যখন বাড়ি তৈরি করার জন্যে ঋণ চাইতে ব্যাঙ্কে যাচ্ছিলাম, পুরনো ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড় পরে যাচ্ছিলাম। যাতে অধমর্ণের মতো চেহারা দেখায়। ব্যাঙ্কের লোকদের মায়া হয়।

আমার স্ত্রী কিন্তু বাধা দিলেন, বললেন, ‘ভাল, দামি জামাকাপড় পরে যাও। যাতে ব্যাঙ্কের লোকেরা বুঝতে পারে তুমি সচ্ছল লোক, ঋণ শোধ দিতে পারবে।’

স্ত্রীর কথাই শুনেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *