5 of 8

স্বপ্ন

স্বপ্ন

‘স্বপ্নেও দিয়েছো ফাঁকি,
‘আসছি’ বলে যেইমাত্র এলে,
ঘুম ভাঙলো।’

সারা জীবন এক রহস্যময়ী রমণী স্বপ্নের মধ্যে আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে চলেছে। আমার বয়স বেড়ে বেড়ে তিনকাল গিয়ে এখন এককাল ঠেকেছে, তার কিন্তু বয়েসের কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। কখনও সে কিশোরী, কখনও পূর্ণ যুবতী, কখনও বা প্রায় প্রবীণা। কখনও তার মুখের আদল আভাসে পাওয়া যায়, কখনও তাকে চিনে ফেলি চকিতে কিন্তু অধিকাংশ সময়েই সে অধরা, অপরিচিতা। চিনেও চিনতে পারি না তাকে। আ-কৈশোর আমি ভুগে আসছি স্বপ্নদোষে। এই অসুখের কোনও চিকিৎসা নেই। যদিও রাস্তাঘাটে নিউজ প্রিন্টে ছাপা শস্তা লিফলেট, পাবলিক ইউরিনালের দেয়ালে সাঁটা বিজ্ঞাপনে হাতুড়ে ডাক্তার এবং হেকিমেরা এই রোগের ওষুধ বাতলিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এ এক দুর্জয় ব্যাধি। কখনওই সারবার নয়। স্বপ্নের সেই অমোঘ ছায়াময়ী সারাজীবন আমার সঙ্গে সহবাস করে আসছে।

একবার, অনেক দিন, তা প্রায় বছর তিন আগে ‘রঙিন ছাতা’ নামে একটি কবিতায় আমি লিখেছিলাম, ‘স্বপ্নের কোনো রঙ নেই, শস্তার সিনেমার মতো স্বপ্ন শুধু ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হতে পারে।’

একথাটা সম্ভবত আমি লিখেছিলাম কোনও বিলিতি নিবন্ধের সূত্র ধরে। কিন্তু এতকাল স্বপ্ন দেখার পরে এখন মনে হচ্ছে সবই সাদা-কালো নয়, দু’-একটা রঙিন স্বপ্নও তো কখনও কখনও দেখেছি। হয়তো দেখেছি। তবে সে সমস্তই দিবা স্বপ্ন। চাটাইয়ে শুয়ে লাখ টাকার খোয়াব দেখা। দিবা স্বপ্নের ফিরিস্তি দিতে গেলে কলমের কালি ফুরিয়ে যাবে। বরং নিশি স্বপ্নেই থাকি।

‘একদা স্বপ্নের সঙ্গে ছিল লুকোচুরি
অহরহ কবিতার
চোর চোর বুড়ি বুড়ি খেলা’…

স্বপ্নের সেই রহস্যময়ীকে ধরতে না পারার আক্ষেপে তখন লিখেছিলাম স্বপ্ন বদলের কথা—

আশেপাশে জ্ঞাতি পড়শি ঘুমানোর পরে
স্বপ্ন বদলের হাওয়া এসে ক্ষণতরে
দুপুর রাতের ঘরে
ঢুকে যায় পরীর মতন।’

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর স্বপ্ন বদল হয়নি।

স্বপ্নে সেই একই রহস্যময়ী চিরদিন ঘুরে ফিরে এসেছে, আজও আসে। বর্ষার রাতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে, আধো ঘুমে, আধো জাগরণে বৃষ্টির টিপ টিপ শব্দে পা মিলিয়ে এখনও সে আসে। সে আসে গ্রীষ্মের শেষ রাতে প্রদীপ নিভায়ে। অন্ধকার ঘরে গাঢ় ঘুমের ফাঁক ফোকর দিয়ে সে আসে। দুটি বাহুলতা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। এই স্বপ্ন জাতিস্মর। শুধু দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নয় মনে হয় জন্মের পর জন্ম, স্বপ্নের ভিতরে সে এসেছে। স্বপ্নসুন্দরীর কথায় আবার এখনই ফিরে আসব। তার আগে স্বপ্নের সওদাগর, ইংরেজিতে যাকে বলে Dream Merchant সেই জীবনানন্দ দাশের কথা একটু বলি। ব্যাপারটা প্রাসঙ্গিক। উনিশশো বাষট্টি সালে, মানে জীবনানন্দের অভাবিত মৃত্যুর আট বছর পর যখন আমার নিজের বয়েস সদ্য পঁচিশ পেরিয়েছে সেই সময়ে জীবনানন্দের উদ্দেশে একটি কবিতায় আমি যা লিখেছিলাম তা এখনও সত্যি। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে এখনও স্বপ্নের মধ্যে আমার দেখা হয়। আমার সেই কবিতাটির শেষাংশ ছিল এই রকম:

আট বছর আগেকার
লাশকাটা ঘর থেকে রক্তমাখা ঠোঁটে—
প্রত্যেক রাত্রিতে কেন, প্রত্যেক রাত্রিতে
কোনও পরিচয় নেই,
কোনও আত্মীয়তা নেই, কেন,
আমার স্বপ্নের মধ্যে কেন?

সম্পাদক মশায়, বিশ্বাস করুন, খোয়াবনামা তত নিষ্ঠুর আমি করতে চাইনি। কিন্তু জীবনানন্দের ভূত ঘাড় থেকেও নামেনি, স্বপ্ন ছেড়েও চলে যায়নি। তাই, যতই লিখি,

‘এসো স্বপ্ন, রাজহাঁস, বকুলের মালা
এতদিন পরে
একবার শেষবার এসো।’—

স্বপ্নের মধ্যে সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। লাশকাটা ঘরের রক্তমাখা ঠোঁট আর পাখির নীড়ের মতো চোখ—স্বপ্নে কোনও ব্যবধান থাকে না। ঘুমের মধ্যে পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে বীভৎস ও সুন্দর, প্রেম ও নিষ্ঠুরতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *