বড়দিন
হই হই করে বড়দিন চলে গেল।
চিনে লণ্ঠন, রঙিন কাগজের শিকল, গোলাপ ফুলের তোড়া, হই হুল্লোড়, রাতজাগা পার্টি। তারই সঙ্গে ফরাসি সুরভির রমণীয় মৌতাত, বিদেশি মদিরার বিহ্বলতা। শেষ রাতে স্খলিত চরণে ফেরা।
নতুন বউ, এই অঘ্রানের শেষে বিয়ে হয়েছে। তাকে নিয়ে খোকা বড়দিনের বাসরে গিয়েছিল। খোকার চোখে মোটা কাচের চশমা, বাঁয়ে প্লাস সাত, ডাইনে প্লাস আট। বড়দিনের রাতের হুল্লোড়ে খোকাবাবু চশমাটি হারিয়ে ফেলেছে। শেষ রাতে টলতে টলতে বউয়ের হাত ধরে খোকাবাবু এসে ফ্ল্যাটের বেল বাজাতে খোকাবাবুর বুড়ো বাপ এসে দরজা খুলে দিলেন। তিনি বউমাকে দেখে দু’বার চোখ কচলালেন, তারপর বললেন, ‘খোকা, এ কী করেছিস তুই। এ তো তোর বউ নয়। তোর বউ কোথায়? এ কার বউ নিয়ে এলি বড়দিনের পাটি থেকে?’
পাঠিকা ঠাকুরানি রাগ করবেন না। এ গল্প আমার কাছেই আগে শুনেছেন। কিন্তু বড়দিনের গল্প তো এই রকমই হবে। সান্তাক্লস তাঁর ঝোলায় ভরে বড়দিনের আগের রাতে সকলের জন্যে কত কী নিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি কোনওদিন আমার জন্যে কিছু আনেননি, একটা গল্পও নয়। আমার তো ক্ষমতার সীমা আছে, আমি আর কত বানাব?
বড়দিনের সাহেবি উৎসবে সাহেবপাড়ায় যাই। উদ্ভিন্ন যৌবনে আমার কলকাতাবাসের প্রথম ছয় বছর এই এলাকায় কাটিয়েছিলাম।
এখন যে লোকেরা সাহেবপাড়ার সেকালের বড়দিন নিয়ে, এই যে এত আহা-উহু করে সেটা নিতান্ত আদিখ্যেতা। বড়দিন খ্রিস্টানদের উৎসব, সাধারণ হিন্দু বাঙালির এতে কোনও অংশ ছিল না। পার্ক স্ট্রিটে, চৌরঙ্গিতে এই যে এত মাতামাতি এটাও শুরু হয়েছে ষাটের দশকের গোড়ায়।
দু’-চারজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বাড়িতে ভেট আসত। কোনও কোনও হোটেলে বল নাচ হত। দামি রেস্তোরাঁয় চিনে লণ্ঠন জ্বলত। দু’-চারটে বড় দোকানের শো-কেসে ক্রিস্টমাস ট্রি। মেট্রো-লাইট হাউসে হলিউডের নতুন ছবি। হাওড়া ময়দানে জেমিনি সার্কাস।
এসব সত্ত্বেও পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকেও দেখেছি খ্রিস্টমাস-খ্রিস্টমাস ইভের মধ্যরাতে গির্জার হলগুলি অধিকাংশ ফাঁকা। সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে পাকিস্তান, সিংহল, বার্মা, নেপাল থেকে খ্রিস্টান প্রতিনিধি আসতেন তবুও হল ভরত না। এখন তো বড়দিনের মধ্যরাতে সেখানে গিজ গিজ করছে ভিড়। পার্টি, পার্ক স্ট্রিটের পানশালা হয়ে লোকেরা ভিড় জমাচ্ছে চার্চে, নেহাতই হুজুকবশত। এর মধ্যে ধর্মকর্মের কোনও ব্যাপার নেই।
বড়দিন কথাটা কী করে এল, এ নিয়ে আমি খুব হদিশ করেছি। কিন্তু নির্ভরযোগ্য কোনও তথ্য পাইনি। বাংলা অভিধানগুলিও এ বিষয়ে নীরব, বড়দিন মানে খ্রিস্টমাস বলে ছেড়ে দিয়েছে।
আসলে বড়দিন মোটেই বড় নয়, বছরের সবচেয়ে ছোট দিনগুলির একটা। এ বছর ২৩-২৪ ডিসেম্বর সূর্যোদয় হয়েছে সকাল ৬টা ২০ মিনিটে আর সূর্যাস্ত হয়েছে ৪টা ৫২ মিনিটে, এই দুটি দিনই উৎসবের মধ্যে হ্রস্বতম! এর চেয়ে বড়দিন মাত্র এক মিনিটের বড়, সূর্যোদয় হয় একই সময়ে, অস্ত যায় এক মিনিট দেরিতে।
এক মিনিট কোনও ব্যাপার নয়। সোজা কথা হল বড়দিন খুবই ছোট দিন। সাহেবদের খ্রিস্টমাস কী করে ভারতবর্ষে বড়দিন হয়ে গেল সে রীতিমতো গবেষণার বিষয়।
গবেষণা আমার দ্বারা হবে না। বরং একটা গল্প বলি। গল্পটা শ্রীযুক্ত হিমানীশ গোস্বামী আমাকে বলেছিলেন, পরে এটা আমি বোধহয় আনন্দবাজারে জ্ঞানগম্যিতে লিখেছিলাম।
আমি যথাসাধ্য বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। যদিও গল্পের বিষয়টি একটু ক্যাঁচালো।
এক বাড়িতে দুটো কুকুর। একটা অ্যালসেশিয়ান বিশাল বড় সাইজের। দেখলে বুক কাঁপে। অন্যটা ছোটখাটো, সাদা পমেরিয়ান। কেমন যেন লাজুক লাজুক স্বভাব।
আমি আর হিমানীশ দু’জনে কী যেন কাজে ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। কুকুর দুটোকে দেখিয়ে হিমানীশ আমাকে বললেন, ‘জানেন ওই যে বড় কুকুরটা দেখছেন ওটাই ছোট কুকুর, আর এই সাদা ছোট কুকুরটাই আসলে বড় কুকুর।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মানে?’
হিমানীশ বুঝিয়ে বললেন, ‘বড় কুকুরটার মাত্র দেড় বছর বয়েস, ওটাই ছোট কুকুর। আর ওই ছোট কুকুরটার বয়েস দশ বছর, ওটাই বড় কুকুর।’
বড়দিনের প্রসঙ্গ এলেই আমার কেমন যেন হিমানীশের ওই বড় কুকুর, ছোট কুকুরের কথাটা মনে পড়ে।