5 of 8

যদিদং হৃদয়ং

যদিদং হৃদয়ং

ঘটনাটা সব খবরের কাগজে অল্প বিস্তর প্রকাশিত হয়েছে। এ বছরের সাগরমেলার প্রতিবেদকেরা সকলেই বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। দু’-একটি দৈনিক কাগজে ছবিও ছাপা হয়েছে।

পৌষ মাসের শেষ দিন মকর সংক্রান্তি। দিনটা ছিল মেঘলা, ঝিরঝিরে বৃষ্টি। লক্ষাধিক পুণ্যার্থী সাগরসঙ্গমে উপস্থিত হয়েছিল, শীত বৃষ্টি, আহার-নিদ্রা উপেক্ষা করে পুণ্য মূহূর্তে পুণ্যস্নানের উদ্দেশ্যে।

সমুদ্রের দিক থেকে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। সমুদ্রের তীরে এক জায়গায় বেশ ভিড়। সেখানে একটা বিয়ে হচ্ছে। একটু আগেই রাত বারোটা বেজে গেছে।

দুটি খবরের কাগজে সে বিয়ের ছবি আমি খুঁটিয়ে দেখেছি। কোনওটাতেই পাত্রীর মুখ ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না। তবে একটি ছবিতে পাত্রের মুখ বেশ স্পষ্ট। দেখে মনে হয় পাত্র বছর পনেরো-ষোলোর বালক।

পাত্রের নাম শ্রীযুক্ত ভবানী দেবনাথ, সাকিন নামখানা। পাত্রী হলেন শ্রীমতী দুর্গা পাণ্ডা, তাঁর বাড়ি ওই সাগরদ্বীপেই।

পাত্রীর বাবা স্থানীয় দরজি। পাত্র ভ্যান রিকশা চালান নামখানা বন্দরে।

মধ্যরাতের লোকজনভরা তীর্থমেলায় এ রকম একটি বিবাহবাসরে কৌতুহলী দর্শকের অভাব হয়নি। নিতান্ত বালক-বালিকার বিয়ে দেখে অনেকেই প্রশ্ন করে, ‘পাত্রের বয়স কত? পাত্রীর বয়স কত?’

আইন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে পাত্র নিজেই শিখিয়ে দেওয়া উত্তর দিয়েছিল যে তার বয়স আঠারো। কিন্তু আঠারো বছর বয়সে ভোট দেওয়া যায় বটে, পুরুষেরা বিয়ে করতে পারে না। আঠারো বছর বয়সের মেয়েদের বিয়ে সিদ্ধ, কিন্তু ছেলেদের বিয়ে আইনত নিষিদ্ধ।

পাত্র শ্রীযুক্ত ভবানী দেবনাথ, আর যা হোক দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অধিবাসী, যেখানকার লোকেরা আইনি চতুরতার জন্যে বঙ্গবিখ্যাত। কোনও কাজ না থাকলে তারা নাকি সদরে আদালতে যায় প্রতিবেশী, বন্ধু বা জ্ঞাতির নামে মামলা দায়ের করতে।

সতরাং শ্রীযুক্ত ভবানীই বা কম কীসে। তিনি যে মুহূর্তে বুঝতে পারলেন আঠারো বছর বয়েস বলাটা ভুল হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংশোধন করে নিজের বয়েস এক ধাপে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে পঁচিশে তুলে দিলেন।

উৎসাহী জনতার কৌতূহলী দৃষ্টি ও জিজ্ঞাসা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যে বিয়ে আরম্ভ হওয়ার একটু পরেই মালা বদল করে পাত্র-পাত্রী একটি হোগলার কুঠিতে আশ্রয় নিলেন। বাকি মন্ত্র-তন্ত্রের কাজ যজ্ঞাগ্নি জ্বালিয়ে পুরোহিত শ্রীদিলীপ পাণ্ডাই চালিয়ে গেলেন।

হঠাৎ এমন দিনে এমন জায়গায় এই বিয়ে কেন, এই প্রশ্নের জবাবে দিলীপবাবু বললেন, ‘মকর সংক্রান্তির মতো এমন পুণ্য তিথি বিরল। পৌষ মাসে বিয়ে অশুভ। রাত বারোটায় পৌষ মাস শেষ হয়ে গেলে মাঘের পুণ্যলগ্নে উপযুক্ত পাত্রীকে যোগ্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হল।’

পুরোহিতমশায়কে বলা যেত, রাত বারোটায় দিন শেষ হয় বিলিতি মতে। হিন্দু মতে নতুন দিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের সঙ্গে, মধ্যযামে নয়।

কিন্তু একথা পুরোহিতকে বলা হয়নি। তবে যে শতশত জনতা সেই বিবাহ বাসরে ভিড় করেছিল তাদের কেউ কেউ পাত্রপাত্রীর অভিভাবকদের বলেছিল। ‘ছেলের বয়স তো একুশ হয়নি দেখা যাচ্ছে। এভাবে বিয়ে হচ্ছে, কিন্তু আইনে এ বিয়ে টিকবে না।’

কিন্তু একথা শুনে বরকর্তা বলেছিলেন, ‘এই মকর সংক্রান্তি সাক্ষী, কপিল মুনি সাক্ষী, আকাশ সাক্ষী, গঙ্গা সাক্ষী, ভগবান সাক্ষী। কী বলছেন, এ বিয়ে আইনে টিকবে না! আইন কি ভগবানের চেয়ে বড়?’

গঙ্গাসাগরের শীতার্ত মধ্য রাতে, বিভ্রান্ত সমুদ্র এবং আকুল বাতাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেনি। আমলা, পুলিশ, শহুরে শিক্ষিত নাগরিক অনেকেই সেই ভিড়ের মধ্যে ছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *