ইতিহাস
আগে নাম ছিল লালদিঘি। এখনও নামটা আছে লোকমুখে, অনেকটা ডাকনামের মতো। কিন্তু ইতিমধ্যে দু’ দফায় দুটো পোশাকি নাম জুটেছে এই দিঘির।
শতাধিক বৎসর আগে ইংরেজ বড়লাট ডালহৌসির নামে লালদিঘির নামকরণ হয়েছিল ডালহৌসি স্কোয়ার। ছাত্রজীবনে কলকাতায় এসে রিকুইজিশন করা সরকারি কোয়ার্টারে বছর ছয়েক ছিলাম ওই ডালহৌসি পাড়ায়।
নাম বদলাল অনেক পরে, তখন আমি অফিসে চাকরি করি, রাইটার্স বিল্ডিংসে। হঠাৎ একটা নামবদলের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। ডালহৌসি স্কোয়ার হয়ে গেল বিবাদী বাগ। অমর শহিদ বিনয়-বাদল-দীনেশের নাম জড়িয়ে, অক্টারলোনি মনুমেন্ট হয়ে গেল শহিদ মিনার, তার মাথায় মুকুট পর্যন্ত হয়ে গেল লাল। সত্যজিৎ রায় এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।
সে যা হোক। আমি কিন্তু ভেবেছিলাম এসব নাম মোটেই টিকবে না, পাবলিক নেবে না, অতি অল্পদিনেই বরবাদ হয়ে যাবে।
এই সূত্রে ওই সময়ের অন্য একটা ঘটনার কথা বলি।
একদিন বাসায় ডাকবাক্সে একটা মুদ্রিত চিঠি পেলাম। পুনর্মিলন উৎসবের আমন্ত্রণপত্র। চিঠিটা এসেছে রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের মৌলানা আজাদ কলেজের পুনর্মিলন উৎসবের প্রস্তুতি কমিটির তরুণ সম্পাদকের কাছ থেকে।
আমি সেই সম্পাদককে চিঠি দিয়ে জানালাম, ‘আমি লেখাপড়া করেছি ওয়েলেসলি স্ট্রিটের সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে। আমি রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড চিনি না, সে রাস্তায় কস্মিনকালে যাইনি। মৌলানা আজাদ কলেজেও কখনও পড়িনি। আমি এই পুনর্মিলন উৎসবে কী সুবাদে যোগদান করব?’
উৎসাহী সম্পাদক আমার চিঠি পাওয়ার পর সদলবলে আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং আমার ভ্রম সংশোধনের চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি সংশোধিত হতে রাজি হইনি।
তবে একটা কথা অনস্বীকার্য। বিবাদী বাগ, শহিদ মিনার ইত্যাদি সম্পর্কে আমার ভবিষ্যৎ চিন্তা মোটেই মেলেনি। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই শহিদ মিনার, বিবাদী বাগ চমৎকার চালু হয়ে যায়। দূর দূর থেকে মিছিল আসে। দূর পাড়াগাঁয়ের চাষি জানে মিছিলের সঙ্গে সে যাচ্ছে শহিদ মিনারে। গোবরডাঙায় এক ঠাকুমা আমাকে বলেছিলেন যে তাঁর পৌত্র কাজ করে বিবাদী বাগের একটা অফিসে।
সেই বিবাদী বাগ এবং তার সঙ্গীরা এখন একটু বিপাকে পড়েছে। খবরের কাগজে দেখছি পুরনো সাহেবি নাম ফিরে আসছে। সাহেবি নাম মানে অবশ্য ইংরেজ আমলের নাম।
বিবাদী বাগ আবার হবে ডালহৌসি স্কোয়ার। জওহরলাল নেহরু রোড হবে চৌরঙ্গি রোড, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রোড আবার ক্লাইভ স্ট্রিট হবে।
কেউ কেউ বলছেন দিশি নামগুলো পুরোপুরি উঠে যাবে না। সাহেবি নামগুলোর পাশেই থাকবে। কেউ কেউ বলছেন, রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুরনো ঔপনিবেশিক মূর্তিগুলির পুনর্বাসন হবে।
এই জানুয়ারিতে মুক্ত অর্থনীতির মহোৎসবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর আসছেন কলকাতায়, তার আগেই নাকি এই সব পরিবর্তন হবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কলকাতায়! কম কথা নাকি, সেট ঔপনিবেশিক আমলেই মাননীয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা এদিকে পা বাড়াতে চাননি। এ বিষয়ে আমি এক সামান্য কলমকার এবং কবিযশপ্রার্থী একটু ঘুরিয়ে একটা কবিতা লিখেছি। কবিতাটি পদ্যভাষায় নয়, আমি যেমন লিখি এই ‘কি খবরে’র ভাষায় লেখা। আশা করি সকলেরই বোধগম্য হবে। কবিতাটির নাম
‘কলকাতার স্ট্রিট ডিরেক্টরি’
পলাশীর শেষ যুদ্ধে
সিরাজদৌল্লার পথে সুভাষচন্দ্র
ক্লাইভের কাছে হেরে গেলেন নেতাজি।
বিনয়-বাদল-দীনেশ পরাস্ত হলেন
ডালহৌসির সঙ্গে লড়াইয়ে।
এমনকী মহাবীর হো চি মিন
পথ ছেড়ে দিলেন হ্যারিংটনকে।
ভিক্টোরিয়ার নির্বাসন থেকে
আউটরামের, টগবগে ঘোড়া
বিজয় গৌরবে ছুটে আসছে
পার্ক স্ট্রিটের মোড়ের দিকে।
জওহরলালের লাল গোলাপ
তাকে ঠেকাতে পারবে না।
বুদ্ধিমান গান্ধী অবস্থা বুঝে
লাঠি হাতে আগেই পালিয়েছেন
ময়দানের পিছন দিকে।
চৌরঙ্গির শেষতম প্রান্তে
কমরেড লেনিনের ভ্রুকুঞ্চন তীক্ষ্ণ হচ্ছে
ঘোড়াটা এই দিকেই
আসছে নাকি?