হাওয়াগঞ্জের ফুলমেলা

হাওয়াগঞ্জের ফুলমেলা

লোকটার নাম, কেউ বলে সে ভবরঞ্জন। নাম তো কারো গায়ে লেখা থাকে না, তাই সে রঞ্জন না ভবরঞ্জন কিংবা সুরঞ্জন তা কেউ বলতে পারে না। আসলে সে একটা লোক। ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।এ গ্রাম সে গ্রাম। ভবঘুরে বলতে পারো তাকে। কত জায়গায় যায় সে। কত পাহাড়, নদী, বন, প্রান্তর দেখেছে সে। ঘুরতে ঘুরতে কত গ্রাম-গঞ্জ হাট-বাজার পার হয়েছে সেই একটা লোক। ভবঘুরে ভবরঞ্জন। সেই ভবর কথা বলতে বসেছি। তার কাঁধে একটা ঝুলি থাকে। সেই ঝুলির ভিতরে অনেক কিছু থাকে। লাল নীল গল্প।

হুঁ,নানা রঙের গল্প।বসন্ত দিনে যে ফুল ফোটে তার রঙ মেশানো গল্প।

 এক বসন্তের দিনে মানে ফাগুনের আরম্ভে ভবরঞ্জন অনেক দূরের এক পাহাড়তলীতে পৌঁছল। সেই পাহাড়ের দেশে তখন গাছে গাছে নতুন পাতা, হাওয়াকল ঘুরছে। হ্যাঁ, কত হাওয়াকল বাতাসে বনবন করছে। ফুল ফুটেছে গাছে গাছে। লাল নীল হলুদ সবুজ। গাছের পাতায় রঙ এসেছে। ভবরঞ্জন এসেছে এই জন্য। সে আসে। এসে একটা হৈ হৈ-এর ভিতর জুড়ে যায়।কী হৈ হৈ ? না পাতা আর ফুল ফোটার উৎসব। এই যে পাহাড়তলী, এখানে পাতা আর ফুল ফোটার উৎসব হয়। গাঁয়ের মানুষ তখন নতুন জামা পরে ফুলের মুকুট পরে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে আসে পথে। মেলা বসে যায়। জিলিপি, কদমা, মুড়কি, পাঁপর আর পান্তুয়ার দোকান বসে যায়। ভবরঞ্জন একটা বড় গাছের নিচে তখন কদিন আশ্রয় নেয়। সে হলো ভবঘুরে। ভবঘুরের ঝুলিতে অনেক গল্প থাকে। গাঁয়ের মানুষ তার কাছে গল্প শুনতে চায়, হ্যাঁ গো, কী এনেছে ঝুলি ভরে, কী শোনাবে এবার ? লাল নীল হলদে সবুজ গল্প।

 এক অনেক কালের পুরোন দোকানি তার দোকান বসাচ্ছিল প্রান্তরে, মেলার মাঠের ধারে। তার নাম রমানাথ। বলল, হ্যাঁ গো কিছু শুনেছ?

 ভবরঞ্জন বলল, কী শুনব, এই তো এলাম, বটের তলায় ঘুমোব, মুড়ি মুড়কি খাব আর গল্প শুনাব।

 দোকানি বলল, এবার নাকি শেষ মেলা?

 কেন, পরের বছর হবে না? ভবরঞ্জন জিজ্ঞেস করল।

 ফুল আর পাতা আর নিজেদের থাকবে না। দোকানি বলল।

 কেন গো কেন, আমি তো দেখলাম ফুটেছে অনেক। ভবরঞ্জন বলল।

 দোকানি যা বলল, তা অন্য রকম। ফুল ফুটেছে। ফুটবে না কেন, কিন্তু ফুল সব কিনে নিয়েছে এক বড় ব্যাপারি। ব্যাপারির নাম হুদুয়া লাখন। সে বলছে, হাওয়াগঞ্জে যত ফুল ফুটবে সব ফুল তার, সে রপ্তানি করবে শহরে। শহরে খুব ফুলের চাহিদা। গঞ্জে আর ফুল থাকবে না।

 কে বলল এই সব কথা? জিজ্ঞেস করল ভবরঞ্জন।

 ব্যাপারি বলল, গাঁ থেকে লোক এসেছিল এখেনে, বলল, এবার শেষ মেলা, এরপর এই হাওয়াগঞ্জে ফুল পাতার মেলা আর হবে না, হুদুয়া লাখন শুধু সাতটা গাছের ফুল দিয়েছে এবারের মতো ছাড়, মেলা চলবে, বাকি ফুল মেলার সময় তার লোক তুলে নেবে, দেশ-বিদেশে পাঠাবে, ফুল নষ্ট হতে দেবে না। কিন্তু সেই সাতটা গাছের ফুল হুদুয়া লাখনের লোক তুলেই নিয়েছে আগে। আবার যদি ফোটে।

ভবরঞ্জন অবাক। দোকানির চালার নিচে কত রাত অবধি সে গল্প করতে থাকে। দোকানি বেশ বুড়ো হয়েছে। সে অন্তত তিরিশ বছর ধরে আসছে হাওয়াগঞ্জে। এখানে কত হাওয়া। দুই পাহাড়ের মধ্যে গঞ্জ। গঞ্জের মানুষ তাকে খুব ভালো চেনে। দোকানি বলল, এবারই ভালো মেলা হবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু সকালে মেলার মাঠ ভরে যেতে থাকে। ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে ভবরঞ্জন ভবঘুরে দ্যাখে দোকানির কথা ঠিক। গাছে গাছে পাতা, কিন্তু ফুল নেই। দূর দিগন্ত ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে থাকে এই সময়। মেলার পর ফুল তো এমনিই ঝরে যায়। কিন্তু এবার ঝরার আগে ব্যাপারি হুদুয়া লাখন সব তুলে নিয়েছে। আছে একটা দুটো গাছে সিঁদুরে রঙের পলাশ ফুল, কিন্তু তা সংরক্ষিত। হুদুয়া লাখনের লোক তাতে হাত দিতে পারবে। সিপাই লাঠি হাতে ঘুরছে, পাহারা দিচ্ছে ফুল সমেত গাছ।

মেলা এক পক্ষের।বসন্ত পূর্ণিমায় শেষ হবে। সেদিন ফুলের মালা গলায় পরে গান হয়, নাচ হয়। এবার ফুল ছাড়া সব হবে, নাটক, বাজনা। আনন্দ কি তাতে হবে? মেলা যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চলল। ভবরঞ্জন তার ঝুলি থেকে কত গল্প বের করল। সাগরতীরে কী হয়েছিল। একটা জাহাজ হারিয়ে গিয়ে ফিরে এসেছিল। মাঝ সমুদ্রে নাকি দিক ভুল করেছিল। আহা, ফিরে তো এসেছে। ফিরে যখন এসেছে আর চিন্তা নেই। ভবরঞ্জন তখন আর এক গল্প বের করল ঝুলি থেকে, একটা ঘোড়া চুরি হয়ে গেছে কিংবা পালিয়ে গেছে একা একা।

 তারপর কী হলো? গল্প শুনতে আসা লোকে জিজ্ঞেস করল।

 ভবরঞ্জন বলল, তারপরটা জানিনে, তাকে খোঁজাই হচ্ছে, শাদা ঘোড়া, খুব ছুটতে পারে।

 কিন্তু হারিয়ে গেল কোথায়? জিজ্ঞেস করল গঞ্জের এক লোক।

 কোথায় গেল তাই তো জানা গেল না। বলল ভবরঞ্জন।

 এ কেমন গল্প হলো, এর কোনো মানে নেই। মাথা নাড়তে থাকে গঞ্জের মানুষ।

 ভবরঞ্জন বলল, এবার সে জুত পাচ্ছে না, কেন পাচ্ছে না বলতে পারবে না।

বানিয়ে বলো, গল্পটা মিঠা হোক। বলল লোকটা।

 বানাতেও পারছি না। ভবরঞ্জন বলল।

 হুঁ, জিলিপি, পান্তুয়া এবার কম মিঠা, মাদারি খেল করে যারা দড়ির উপর হাঁটে, হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে ছেলেটা। এ কেমন?এমন তো হয় না।

 ভবরঞ্জন জিজ্ঞেস করে, সেই হুদুয়া লাখনের বাড়ি কোথায়?

 পশ্চিমে হবে।

 হুদুয়ার সঙ্গে আমার দেখা হবে?

 গঞ্জের মানুষ বলল, হুদুয়াকে আমরাই দেখিইনি।

 তাহলে জানলে কী করে ফুল সব নিয়ে নেবে?

 চোঙা ফুঁকে বলে গেছে তার লোক, বসন্ত আসার আগে থেকে চোঙা ফুঁকে যাচ্ছে। লোকটা বলল।

 দোকানি বলল, মেলাতেও শুনতে পাবে।

 হ্যাঁ, শোনা গেল। মেলা বসল আর চোঙা নিয়ে একুশটা লোক গেয়ে যেতে লাগল।দয়া করে ফুলে হাত দিবে না। ফুল সব হুদুয়া লাখন মশায়ের। তিনি সব গাছের মালিক। গাছের ফুল ও ফল। যার যার নিজের বাগান আছে সে সে নিজের বাগানের ফুলে হাত দাও। বাকি ফুল হুদুয়া কুম্পানির। আর বাগানের ফুল যদি দিতে চাও, কুম্পানি ভালো টাকা দিবে। এক ফুলে এক পয়সা।

 বোঝা গেল। হুদুয়া লাখন অনেক টাকা সরকারের ঘরে জমা দিয়ে ফুল কিনে নিয়েছে। বসন্তে কি শুধু অশোক, পলাশ, শিমুল, মাদার পুষ্প হয়? নিম গাছে ফুল ফোটে, আমের মুকুল হয়। আমের মঞ্জরীও ফুল। ফুলে হুদুয়া লাখনের অধিকার। মেলার দ্বিতীয় দিন চোঙাওয়ালারা বলতে লাগল, মেলা চলুক কিন্তু ফুলে হাত দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মেলায় ঘুরতে লাগল দারোগাবাবু আর তার অনুচর পুলিশ। আর পুলিশের গুপ্তচর কেউ কেউরা। তারা নাকি ফুল পাহারা দেওয়ার আদেশ পেয়েছে সরকারের ঘর থেকে। সরকার কে, না হুদুয়া লাখন সরকার, বলল এক পুলিশ। তা শুনে দারোগা তাকে খুব কষে বকে দিল। সরকার মানে সরকার তা বোঝ না মূর্খ। মূর্খ পুলিশ বুঝল না, হুদুয়া লাখন কেন সরকার হয়েও সরকার না। যাই হোক, চালু হয়ে গেল আইন। আইন শুধু হাওয়াগঞ্জের মানুষের জন্য। দারোগার বিবি দারোগানি ফুল চেয়ে বায়না করতে তা এনে দিল দারোগা। দারোগানি ফুলের গয়না পরে মেলায় ঘুরতে লাগল।তা দেখে গাঁয়ের লোক ফুল পাড়তে গেলে, লাঠি হাতে পুলিশ হাজির। খবদ্দার না। বলল, দারোগানির অনুমতি নেওয়া আছে। ফুলে হাত দিতে অনুমতি লাগবে। হুদুয়া লাখন সরকার এক লক্ষ এক টাকা সরকারের ঘরে জমা করে ফুলের অধিকার নিয়েছে। বিনা অনুমতিতে ফুলে কেউ হাত দিলে তিন মাস জেল তিন সিজিন ফুলের মেলায় আসা বারণ আর তিন বছর কিছু একটা করতে হবে। ফুল তুলে হুদুয়ার গোলামি করতে হবে, এমন কঠিন কঠিন শাস্তি। এক অপরাধে তিন শাস্তি।

 তাহলে হলো কী ? ফুলের মেলা ঠিক হলো না। মিঠাইয়ে মিষ্টি কম, নাটকে লোক নেই, গানের সুর কেটে গেল, সার্কাসের হাতি বসেই থাকল, নড়ল না, মোটর সাইকেল গর্জন করেও নড়ল না। জোকারকে লম্বা দেখাতে লাগল। ফুলের মালা না হলে কি গান হয়, জোকারের হাসি হয়, না মেলা হয়?ভবরঞ্জন দুঃখিত হয়ে মেলা ছাড়ল। পূর্ণিমার আগেই সব গাছ পুষ্পবিহীন হয়ে গেল। হুদুয়ার লোক সব ফুল পেড়ে নিল। খা খা করতে লাগল চাদ্দিক। হাওয়াগঞ্জের ফুল-মেলা নাকি উঠেই যাবে শোনা গেল। কিন্তু ব্যাপারিরা আর ভবঘুরে ভবরঞ্জন বলল, কিছুতেই না, মেলা হবে, আমরা আসব।

মেলা না বসলেও তোমরা আসবে ?

ব্যাপারি বলল, আসব, আমি পাথরের জিনিশ নিয়ে আসি, সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি ফুল-মেলার জন্য, বন্ধ রাখলে হবে না।

 গাঁয়ের লোক বলল, ফুল ছাড়া ফুল-মেলা হয় নাকি?

 হয় হয় হয়, মেলা বসলেই হয়। বলল ভবরঞ্জন।

 গাঁয়ের লোক বলল, এবারের মেলা কি ভালো হলো, তোমার গল্প ভালো হলো না, মাদারির খেলা জমল না, সার্কাসের মোটর সাইকেল চলল না, নাটকের ডায়ালগ ভুল হয়ে গেল, আর ফুলের গয়না পরে মেয়েরা গান করল না, এসব না হলে মেলা হয়।

 হয় হয় হয়,পরের বছর হবে। বলে ভবরঞ্জন ভবঘুরে আর দোকানি চলে গেল হাওয়াগঞ্জ ছেড়ে। আরো সব দোকানদানি উঠে গেল। মেলার মাঠ ঝিমঝিম করতে লাগল। হুদুয়া লাখন কোম্পানি বাকি ফুল তুলে নিয়ে চলে গেল। আমার মুকুল ছিড়ে নিয়ে গেল। নিমের ফুল ঝরিয়ে দিয়ে গেল। ইস, হাওয়াগঞ্জের হাওয়া যেন আসা বন্ধ করে দেবে। তারা তো ফুলের গায়ে বাতাস দিয়ে ফুলের রঙে রঙিন হয়ে অনেক দূরে চলে যেত। বাতাসে কত ফুলের রঙ লেগে যেত। সব কি না বন্ধ হয়ে গেল।

বছর যায়। কালবৈশাখী হয়, মেঘ হয়, বৃষ্টি হয়, শরতকাল আসে, শীত এল। শীত এল যখন বসন্তের আর কত দেরি? গঞ্জের মানুষ মন খারাপ করে হুদুয়া লাখন সরকারের চোঙা ফোঁকা লোকজনকে আসতে দ্যাখে শীতের ভিতরেই। মানুষজনকে আগাম সতর্ক করা হচ্ছে,

ফাগুন, চৈত দুই মাস,
হুদুয়া লাখন দিইছে ফাঁস।
লাখন সরকার ফুল কিনেছে,
ফুল নিয়া সে ব্যাপারি হয়েছে।
ফুলে কেউ হাত দেবে না।
ফুলের দিকে চোখ দেবে না।
লাখন সরকার, লাখ টাকা,
জমা দিয়ে করল পাকা
ফুল ফুল ফুল, ফুলটি তার।
ফুল ছুঁইলে লাঠির মার।

খুব মন খারাপ হলো হাওয়াগঞ্জের মানুষের। মন খারাপ করে হাওয়াগঞ্জের হাওয়া অন্য দিক দিয়ে বইল। হাওয়াকল ঘুরল না। হাওয়ার গায়ে রঙ লাগলো না। হায় হায়, এ কী হচ্ছে? লাখন সরকার করল কী? মানুষের চোখের জল পড়ল ভুঁয়ে। এমন করে কি মেলা হয়? ফুল না থাকলে ফুলের মেলা কেমনে হয়? হয়নি মেলা সেবার কেন পরেরবারও। কেন হয়নি?

সেই গল্প নিয়ে ভবরঞ্জন ঘুরছে। কী সব্বোনাশ, হাওয়া যেমনি বন্ধ হলো হাওয়াগঞ্জে তেমনি আর কিছু হয়েছিল। লাখন সরকারের লোক ফুল নিতে এল বড় বড় লরি নিয়ে, কিন্তু ফাগুন গেল চৈত গেল, হাওয়াগঞ্জের কোনো গাছে ফুল ফুটল না। একদম না। বছর বছর লাখ টাকা জমা করে সে ফুল তুলতে, কিন্তু ফক্কা হলো, গাছেরা মুখ ফিরিয়ে থাকল। ফুল ফুটল না তাই হতাশ লাখনের লাখ টাকা ধুলো হয়ে গেল। দোকানি জিজ্ঞেস করে তারপর কী হলো ভবঘুরে গল্পওয়ালা? হবে কি লাখন সরকার ফিরে গেল। পরের শীতে আর চোঙা ফুঁকতে কেউ এল না। এল না যখন লাখন গেছে। পুলিশের সেপাই গাছ পাহারা দিতে ঘুরল না,তার মানে হুদুয়া লাখন সরকার গেছে। বছর বছর লাখ টাকা লোকসান দেবে কেন সে।

তারপর কী হলো? সাগর পাড়ে বসে দোকানি জিজ্ঞেস করে ভবঘুরে গল্পওয়ালাকে।

ফাগুন আসছে, বসন্ত আসছে, চলো হাওয়াগঞ্জ, হাওয়াকল নাকি ঘুরছে আবার বনবনিয়ে।ফুল ফুটব ফুটব করছে। কে বলল এসব কথা। কেন ভবঘুরে ভবরঞ্জন বলল। আবার ফুল-মেলা। আবার জিলিপি পান্তুয়া। ওই যে ভবরঞ্জন চলেছে হাওয়াগঞ্জে তার গল্পের ঝুলি নিয়ে। খুললেই সব জানা যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *