রঙের বাহার

রঙের বাহার

এই একটা ছেলে। খুব বেখেয়াল। আর বলা যায় দুষ্টুও। দুষ্টুর শিরোমণি। এর সব উলটো।খাওয়ার সময় ঘুমোয় ঘুমোনর সময় খায়। পড়ার সময় গান শোনে, ঘুমের সময় পড়ে। এর সব উলটো।যখন সবাই টিফিন খায়, এ তখন খায় ভাত। ভাতের সময় রুটি। রুটির সময় ভাত। এর নাম লবন। লবন কারো নাম হয়? হয় হয়, না হলে এর নাম হবে কেন তা?

এর বোন আছে ঝাঁকড়া চুলের ছোট।গোল গোল চোখ।হাত নেড়ে কথা বলে আর গিন্নিগিরি করে।বোনের নাম চিনি।তারা ভাই বোন হলো নুন চিনি। লবন আর চিনি। তারা কিন্তু তোমার বয়সী। তোমার যদি বারো হয়, লবন তখন বারো। তোমার যদি সাত হয় লবন তখন সাত। তোমার বোন যদি চার হয়, চিনি তখন চার। নাহলে সে পাঁচ হতে পারে, ছয় সাত, নয় দশও হতে পারে।

সেই যে লবন সে এখন অঙ্ক কষতে বসেছে। অঙ্ক মানে যোগ। যোগ বিয়োগ। গুন ভাগ। যোগের উলটো বিয়োগ। গুনের উলটো ভাগ।

 ৫+৫= ১০ না হয় শূন্য।

 ৫-৫=০ না হয়ে দশ।

লবন সব সময় উলটো উত্তর করে। স্যার গোল্লা দেবেন। একটায় গোল্লা দিলে অন্যটায়ও গোল্লা। কিন্তু বলে, স্যারের ভুল। আমি তো উলটো কষেছি। স্যার উলটো করে উত্তর দেখলে ঠিক নম্বর পেয়ে যেতাম। দশে দশ। প্রথমটায় দ্বিতীয় উত্তর লিখে দিলে আর দ্বিতীয়টায় প্রথম উত্তর ভেবে নিলে সে দশে দশ পেয়ে যেত। স্যারের ভুল। তার ভুল নয়। কিন্তু স্যারের কি ভুল হয়? হয় না। তুমি যদি উলটো করো, পাল্টা করো, স্যার কেন উলটো করবেন, পাল্টা করবেন ? লবন একটা বিচ্চু ছেলে। তবু অঙ্কের স্যার তাকে ভালবাসেন খুব। বিজ্ঞানের স্যারও। ভুগোলের স্যার জানেন লবন সব জানে, কিন্তু ইছে করে ভুল বলে।

কী বলছ, এই করে সে নম্বর পায় না? পায় না,পায় না।নম্বর দিয়ে কি ধুয়ে খাবো? লবন হাসতে হাসতে বলে। ক্লাসে উঠতে পারবে না যে। তাই নাকি?অ্যানুয়াল পরীক্ষায় সে অমনি করে না। তখন খাতা ভরা নম্বর। পারলে একশোয় তার বেশি পেয়ে যায়। স্যারের ভুল। কিন্তু সারা বছর তার ভুল তার ভাল। লবন হলো এমনি। ইস্কুল যায় না? যায় আবার না। কিন্তু সব গোল পাকিয়ে দেয় ভাই বোনে। নুন চিনিতে। হ্যাঁ, চিনি কিন্তু অতটা অমনি না। সে যেমন শান্ত তেমন কটকটি। সে পড়ে ক্লাস থ্রি। থিরি না মিছিরি। এই চিনি শোন।

চিনি বলে, কী হয়েছে বল।

এই চিনি, ওই দ্যাখ পিঁপড়ে। ক্লাস ফ্রেণ্ড খোকা বলে।

চিনি একটুও রাগে না, বলে, এই খোকা শোন।

খোকা বলল, কী বলছিস বল।

খোকা তোর মাথায় দেবে টোকা।

খোকা বলল, এই চিনি, জলে ডুবলে আর দেখা যাবেনি।

চিনি শান্ত হয়ে বলে, এই খোকা তুই কেনরে এত বোকা।

খোকাও কম যায় না, চিনিরে চিনি, পয়সা দিয়ে কিনি।

চিনি বলে, খোকারে খোক…, মেলাতে না পেরে, চিনি হেসে বলে, খোকা গেছে মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর কুলে, ছিপ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে মাছ নিয়ে গেল চিলে, ওরে খোকা বাড়ি আয়, দুধ মাখা ভাত কাগে খায়…। ইস খোকা কিচ্ছু পারে না, দুধ ভাত খেয়ে ঘুমায়।

খোকা আর চিনি এক ক্লাসে পড়ে কি না, তাই খুব ভাব। ক্লাস থিরি… উঠতে গেলে একটা দুটো তিনটে সিঁড়ি। তারা তিন সিঁড়ি উঠতে উঠতে এই সব গল্প করে। তখন চিনির দাদা লবন ক্লাস এইট। শ্রেণী তার অষ্টম। ছেলে বড় দুষ্টম। চিনি বসে বাইরের আকাশে তাকিয়ে। বিজ্ঞানের স্যার বিজ্ঞান পড়াচ্ছে। তার কান স্যারের দিকে, তার চোখ জানালার বাইরে। এখন ভাদ্র মাস। ইস্কুলে আসার সময় দেখেছে, আকাশে নীল শাদা মেঘ। মেঘের দল ভেসে ভেসে কত দূর চলেছে! আহা মেঘেদের কত মজা, যতদূর ইচ্ছে যাই, কিন্তু সেই আকাশে কোথা থেকে উড়ে এসেছে এক কিম্ভুত-কিমাকার মেঘ। যেন দত্যি দানবের ভাই। ঘন ঘন গর্জন করছে। যেন নাক ডাকছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, তার বাবা ডাকে অমনি। হেঁইও রে হেঁই নাসিকা, দিচ্ছি এক ঝটিকা। ঝটিকা মানে ঝড়। কিন্তু কুজ্ঝটিকা মানে কুয়াশা। কী করে হলো? বড় হয়ে বোঝা যাবে।

চিনি দেখেছে আকাশ কালো। শাদা মেঘ খেয়ে নিয়েছে কালো মেঘ। চিনির মনে হচ্ছে, যা না, এই ভুতের মতো অদ্ভুত মেঘ চলে যা, এই বিষ্টি থেমে যা, মিষ্টি আমড়া খেয়ে যা। কালো মেঘ কালো মেঘ, আর কতদিন? ডেকে ডেকে চমকাবি, তা ধিন ধিন। কালোমেঘ কালোমেঘ এইবার তুই যা, আলুকাবলি খেতে দেব, যেতে যেতে খা। সে একটু গেয়ে ওঠে এই সব, বিষ্টি তার একটুও ভালো লাগেনা। লেবুর পাতায় করমচা, এই বিষ্টি থেমে যা। দিদি দিদি ও অঙ্ক দিদি।

অঙ্ক দিদি বললেন, কী হয়েছে চিনিমিনি?

চিনি বলল, আমার না, আমার না, আমার না…।

 তোমার না তোমার না তোমার না, চিনিমিনি কী বলছ, অঙ্ক খাতা কই? অঙ্ক দিদি বললেন।

 খোকা আর চিনি খুব পরামর্শ করে। চিনি যখন না না করে, খোকা তখন হ্যাঁ হ্যাঁ করে। কিন্তু চিনি যে খোকার সঙ্গে আড়ি করবে, তা হয় না, তা হয় না। খোকা বলল, চুপ করে বস না চিনি।

 চিনি বলছে, ধুর চুপ করতে ইচ্ছে করছে না।

 ইস, কেলাসে কেউ কথা বলে?

 চিনি যে কটকটি, বলল, কথা না কী বলে ?

 খোকা বলে, পড়া বলে।

 অঙ্ক দিদি ডাকলেন, এই চিনি, এই ভাগটা কষে দাও বোর্ডে এসে।

 কথা যে অমান্য করবে, তা হবে না। চিনির বুক করে দুরু দুরু, ভাগাভাগি হয় শুরু। বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে খড়ি দিয়ে ভাগ কষতে লাগল সে। ইস, ভাগ মিলল না। ১ রইল অবশিষ্ট। চিনি চুপ করে তাকিয়ে থাকে দিদির দিকে। কিছুতেই এক বাদ দেওয়া গেল না। ভাগশেষ নিয়ে করবে কী চিনি? দিদি বলল, রাইট, চিনিমিনি ঠিক করেছে। আর তাই শুনে চিনি বলল, ও দিদি, দিদি,আমি আর কিছু করি?

 কী করবি তুই ?

 চিনি ভাবল কী করে। নেচে নেচে লেবুর পাতায় করমচা। ও দিদি, বিষ্টি যে থেমে গেল। সত্যি তো শাদা মেঘ আবার ফুটেছে আকাশে। কালো মেঘ, হুতুম মেঘ নেই আর। রোদ উঠছে গো। চিনিমিনি হাত নাড়িয়ে গেয়ে উঠল, মেঘের কোলে রোদ উঠেছে বাদল গেছে টুটি…।

 আরে কী করিস কী করিস চিনিমিনি! অঙ্ক দিদি বলে উঠলেন।

 মেঘের কোলে,ওই দ্যাখো দিদি মেঘের কোলে…রোদ উঠেছে বাদল গেছে টুটি।

এই রে কী হলো, ক্লাসসুদ্ধ সবাই গাইতে লাগল, মেঘের কোলে রোদ উঠেছে বাদল গেছে টুটি…।

 অঙ্ক দিদি বাইরে তাকালেন, শরতের আকাশ থেকে এক পশলা নামছিল যে গুরু গুরু গরজে গরজে, তা কখন গিয়েছে থেমে, নীল আকাশে ভেসেছে শাদা মেঘের ভেলা। আহা কী সুন্দর আকাশ আর পৃথিবী!

 ক্লাসের সবাই গাইছে মেঘের কোলে রোদ উঠেছে। চিনিমিনি নাচছে তার সঙ্গে। আর তখনই না কয়েক মিনিট বাদে বাজল ঢং ঢং ঢং…। ইস্কুলের ছুটির ঘন্টা ঠিক দুপুরেই বাজিয়ে দিল কে। ঢং ঢং ঢং। ছুটি ছুটি ছুটি। ক্লাসঘর থেকে আনন্দের ফোয়ারা বেরিয়ে এল যেন। আর কি উপায় আছে ইস্কুল বসানোর? দুষ্টু থেকে শান্তশিষ্ট ছেলে মেয়েরা সবাই সব ক্লাস থেকে ছুটিই বলতে বলতে বেরিয়ে এল। তাই শুনে হেড স্যার, বিজ্ঞান স্যার, অঙ্ক দিদি, ভুগোল স্যার, বাংলা ইংলিশ সব স্যার আর দিদিরা জিজ্ঞেস করতে লাগল, কে ঘন্টা বাজাল, কে কে কে। সব স্যারেরা বেরিয়ে এল বাইরে। হুম কে বাজাল ছুটির ঘন্টা? কার আদেশে ছুটির ঘন্টা? অষ্টম শ্রেণীর দুষ্টম ছেলে লবন হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল। ঘন্টা হাতে ছুটির ঘন্টা সে বাজিয়ে সবাইকে বের করে এনেছে ক্লাস থেকে। ঘন্টা বাজিয়েই চলেছে।

এই তুই কী করলিরে? হেড স্যার বেত হাতে মারবেন কি মারবেন না ঠিক করতে পারছেন না।

লবন বলল, মেঘের কোলে রোদ উঠেছে স্যার,আজ রবি ঠাকুরের ছুটি।

হেড স্যার খুব রাগী। রাগী না হলে হেড স্যার হয়ই না। হেড স্যারকে হাসতে নেই। বেশি কথা কইতে নেই। লবনকে দাঁড় করিয়ে দিলেন ইস্কুলের মাঠে, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক। লবন দাঁড়াল। কান ধরলও। তারপর চোখটা আকাশে তুলে দিল। এই যে দ্যাখো। সবাই দ্যাখো। কী দেখবে? রাম ধনু। সাত রঙের রাম ধনু দ্যাখো সবাই, চিনি তার মিঠে গলায় বলে উঠল। আহা তাই তো। এখন আশ্বিন মাস। এই কিছু আগে এক পশলা হয়ে গেছে। রোদ উঠছে বৃষ্টি ভেজা। লবন যেন জানত এই সময়ে রামধনু উঠতে পারে। তাই ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দিয়ে কান ধরে মাঠের ভিতরে দাঁড়িয়ে। ইস্কুলের দাদারা, ভাইয়েরা, দিদিরা, বোনেরা, বন্ধুরা সবাই ইস্কুলের বই খাতা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে মাঠের ভিতর দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। মেঘের কোলে রোদ উঠেছে বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটিরে ভাই আজ আমাদের ছুটি…।

লবন বলল, আমি যেই শুনেছি চিনির গান, তেমনি ঘন্টা বাজল মনের ভিতর।

হেড স্যার আর সব স্যাররা করবেন কী? লবনকে ঘিরে আর সবাই যে নেচে নেচে গাইছে,মেঘের কোলে রোদ উঠেছে বাদল গেছে টুটি…, আকাশ সেজেছে রঙের বাহারে। রঙের ধনু এক দিক থেকে উঠে অন্য দিকে নেমেছে। স্যারেরা হাসছেন লবনের কাণ্ডে। ওরে লবন, কানের থেকে হাত নামা, রঙের থেকে একটু নামিয়ে নে। সেই রঙেতে রাঙিয়ে দে। ছুটি ছুটি ছুটি। আজ আমাদের ছুটি রে ভাই আজ আমাদের ছুটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *