এক সিং ডাকাতের গল্প

এক সিং ডাকাতের গল্প

আবার এক ডাকাতের কথা। রোগা লিকলিকে, সিড়িঙ্গে, হুমদো কত ডাকাতের কথা শুনেছি আগে। হুকুম সিং, গরম সিং, তেজা সিং, লাখমন সিং…কত সব ডাকাত।এইয়া গোঁফ, এইয়া চোখ, মুখে হিন্দি বোলি। এখন বলছি আর এক ডাকাতের কথা। সবার চেয়ে বড় ডাকাত। ডাকাত বলে ডাকাত। চরকির মতো ঘুরছে সে। এটা ভাঙছে, ওটা ভাঙছে, হি হি করে হাসছে, হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতে হাসছে, হাসতে হাসতে কাঁদছে। তার নাম ডাকু জঙ্গল সিং দিয়েছে ছোট পিসি। ছোট পিসি আর মেজকাকার আদরে আদরে তার এই অবস্থা।মস্তবাড়ি একতলা দোতলা। তার অনেক ঘর।অনেক ঘরের দরজা খোলা। কোনোটা পিসির ঘর, কোনোটা কাকুর ঘর, কোনোটা গণেশদাদার ঘর, কোনোটা তার মা-বাবার, দাদার ঘর, দিদির ঘর। শুধু তার নিজের কোনো ঘর নেই। তার বয়স পাঁচ, একদিন সে বায়না করেছিল ঘর চাই তার ঘর চাই, তা শুনে মেজকাকুর ঘরে দুদিন থাকতে বলল তাকে মা, থাকতে পারলে ঘর পাবি তুই, একটা ঘর তালা দেওয়া আছে, খুলে দেওয়া হবে তোকে।

তার নাম গুগুল। এই নামটা দিয়েছে তার ছোট পিসি মিলি। সে যে একটা ডাকাত,এ বিষয়ে বাড়ির সবাই একমত। এমন কি ঠাকুমাও। ঠাকুমার ঘরে হরেক জিনিশ। বুড়ির ঘরে গান বাজে সব হরেক রকম। আর আছে অনেক বই। ঠাকুমা লেখেন। গল্প লেখেন। সেই গল্প গুগুল শোনে। মাঝে মাঝে তাঁর ফোন আসে। ফোনে তিনি গম্ভীর হয়ে কতরকম কথা বলেন। গুগুল ঠাকমার ঘরে গিয়ে তেমন ডাকাতি করতে পারে না। শুধু বই আর বই। আর ম্যাগাজিন। এই বাড়িতে কোন ঘরে বই নেই ? তার নিজেরও বই আছে। ছবির বই, আঁকার বই, ছড়ার বই, গল্পের বই। এখন তার ছয়। ক্লাস ওয়ান। ঠাকমা অনেক গল্প জানে। ডাকাতি করলে সেই সব গল্প বন্ধ হয়ে যাবে, সেই ভয়ে সে নিরস্ত হয়েছে। না হলে কী আর ছাড়ত, ঠাকুমার চশমা, বাঁধানো দাঁত, মোবাইল ফোন, কোনটাতে তার নজর নেই? আর বইয়েও যে নজর নেই তা নয়। বইয়ে হিজিবিজি দাগ টেনে দিল পেন্সিল দিয়ে। তার অনেক রঙের পেন্সিল আছে। কোনোটা ঘষলে লাল, কোনোটায় সবুজ, কোনোটায় নীল কিংবা হলুদ। শ্রীমান গুগুলের শুধু শাদা কাগজ দরকার। ঠাকুমার ঘরে আছে। কিন্তু তাতে হাত দেওয়া বারণ। কম্পিউটার থেকে লেখা ছেপে বের হয় ওই কাগজে। ঠাকুমা কম্পিউটারও নিয়েও বসেন। গুগুলের খুব ইচ্ছে কম্পিউটারের সামনে সেও বসে। যা ইচ্ছে বোতাম টিপে নানা রকম ছবি বের করে।উপায় নেই। ঠাকুমা ঘর থেকে বের হয় না। এমন ঠাকুমা ভূভারতে আছে?কোথায় রান্না ঘরে গিয়ে রান্না করবে, পিঠেপুলি করবে, তা না শুধু ঘরে বসে পড়া আর লেখা। কম্পিউটারেও হাত দেওয়ার উপায় নেই। খবরের কাগজ ছিঁড়তে তার খুব ভাল লাগে। উপায় নেই। তাও কি করে না? করে। না করলে সে করবে কী? ডাকাতের মান তো রাখতে হবে। ছোট পিসি মিলি তাকে বোঝায়, খবদ্দার ঠাম্মার ঘরে নো ডাকাতি, ঠাম্মা ডাকাতের গল্প লিখছে।

কী লিখছে? গুগুল জিজ্ঞেস করে।

 এক যে ছিল ডাকাত, এই গল্প।

 কই বলে না তো। গুগুল বলে।

 বলবে বলবে, লেখা হোক। ছোট পিসি বলে।

 গুগুল এরপর ঠাকমার ঘরে ঢুকে দেখে তিনি মন দিয়ে কম্পিউটারে কী লিখছেন। গুগুল নিঃশব্দ পায়ে ঢুকতে পারে। আর নিঃশব্দ পায়ে ঢোকা মানে, কিছু একটা করবে। কী করবে? ডাকাতের গল্প মানে কি তার গল্প? তার কথা লিখছে ঠাকমা? সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। ঠাকমা ডাকাতের গল্প লিখেই যাচ্ছে। কী লিখছে ধরতে পারছে। কিন্তু ভাল ভাবে ধরা তার পক্ষে সহজ নয়। লেখাটা পড়তে পড়তে উঠে যাচ্ছে। তার মনে হল হুম করে কম্পিউটারের কি বোর্ডে হাত দিয়ে এ, বি, সি, ডি, আঙুল দিয়ে পর পর টিপে দেয়। একদিন দিয়েছিল। ঠাকমা তাকে কোলের কাছে টেনে বলেছিল, অমন করতে নেই, গুগুল সোনা।

সে ঠাম্মাকে ডাকে, কী করছ?

 লিখছি তো দেখছ।

 গুগুল বলে, এর ভিতরে গুগুল আছে না?

 আছে।

 গুগুল সব জানে?

 ঠাম্মা অবাক হয়ে তার দিকে ফিরল, কে বলল?

 পিসি।

 ঠাম্মা মুখ টিপে হাসলেন, বললেন, তোমার কি তাই মনে হয়?

 গুগুল বলল, হম।

 হম মানে?

 গুগুল বলে, হ্যাঁ।

 আচ্ছা, তুমি সব জানো? ঠাম্মা জিজ্ঞেস করল।

 গুগুল বলল, হম।

 ঠাম্মা তখন বলল, গল্পটা আটকে গেছে।

 তার মানে? গুগুল জিজ্ঞেস করে।

 ঠাম্মা কম্পিউটার বন্ধ করে গুগুলকে বলল,আয় দুজনে শুয়ে গল্প করি।

 অদ্ভুত ব্যাপার। ঠাম্মা লেখা থামিয়ে গুগুলকে নিয়ে শুলো, গুগুল ঠাম্মার গলা জড়িয়ে বলল, তোমার ডাকাতের গল্পটা শোনাও দেখি।

 ঠাম্মা বলল, ওই গল্পই তো আর মনে পড়ছে না রে সোনা।

 ভুলে গেছ?

 ঠাম্মা বলল, কী জানি ভুলে গেছি কি না কে জানে।

 গুগুল জিজ্ঞেস করে, ডাকাতটা কেমন দেখতে বল।

 ঠাম্মা হেসে বলে, এক রত্তি ছেলে আর এক রত্তি ডাকাত।

 তার মানে? গুগুল জিজ্ঞেস করে।

 ঠাম্মা তার গাল টিপে দিয়ে বলল, তোর মতো।

 ওম্মা, তা কী করে হবে?

তাই তো রে সোনা। ঠাম্মা বলে।

 তাহলে আর গল্প কেমন হবে? গুগুল হতাশ হয়।

 তখন ঠাম্মা বলে,শোনরে গুগুল গুগুল শোন, সেই ডাকাতের বয়স পাঁচ, ক্লাস ওয়ান, এটা ভাঙে ওটা ভাঙে, একটুও স্থির হয় না, সব সময় মনে মনে ছক করছে, হারে রে রে রে, করে ঝাঁপিয়ে পড়বে কার উপর।

 গুগুল বলে, হম, বুঝেছি, আমাকে নিয়ে লিখছ।

 কী করে বুঝলি তুই?

 গুগুল বলে, খুব বুজতে পারা যায়, কিন্তু গল্প তোমার হবে না।

 কেন রে সোনা হবে না কেন?

 গুগুল বলে, আমাকে নিয়ে লিখছ, তুমি কি আমার মতো জান আমার কথা?

 কেন জানব না? ঠাম্মা বলল।

 উঁহু, কিছুই জান না।

 ঠাম্মা বলে, জানি জানি জানি।

 গুগুল বলে, মোটেই না, যা জান না, গুগুল তোমাকে বলে দেয়।

 উফ! ঠাম্মা তখন বলে, তুই তাহলে বলে দে।

 তখন এই যে ডাকাত, ডাকু গুগুল সিং বলতে লাগল ডাকাতের গল্প। কী আশ্চয ব্যাপার, সে নাকি গল্প বলবে আর সেই গল্প লিখবে ঠাকুমা। গুগুল বলে, একদিন রাত্তিরে সেই ডাকাত,আর পাঁচটা চেলা নিয়ে…ও ঠাকমা চেলা মানে কী গো?

 ঠাকমা হেসে বলে, সাগরেদ।

 তার মানে?

 না জানিস তো বললি কেন? ঠাকমা বলে।

গুগুল বলে,তুমিই তো লিখেছ ডাকাতেরা চেলা নিয়ে ঘোরে, হুকুম সিং-এর চেলা ভোলা আর কোলা, তাদের মাথায় তখন সিং হয়নি।

 ঠাকমা বলে, হুম, কবে লিখেছিলাম?

 তা তো জানি না, তবে মনে হয় তোমার গল্পে আছে।

 ঠাকমা মুখ টিপে হাসে। এই কথাটা গুগুল থেকে জানা গেল। গুগুল বলে, ভোলা আর কোলা দুই চেলা একদিন রাগ করে বলে, ভাত খাব না।

 ও ছেলেরা ভাত খাবি নে কেন, নেহি খায়েগা? হুকুম বলে।

 ভোলা বলে, আমরা কি চিরকাল তোমার চেলা হয়ে থাকব?

কোলা বলে, তুমি হলে ডাকু হুকুম সিং, আমি কেন ডাকু কোলা সিং হব না?

ভোলা বলে, আমি কেন ডাকু ভোলা সিং নই বল।

 তখন হুকুম সিং বলে, তোদের মাথায় সিং গজাক।

 ভোলার খুব বুদ্ধি, বলে, তোমার মাথায় সিং কই হুকুম সিং?

 হুকুম সিং বলে, নাপিতের কাছে জমা রেখেছি।

 তখন ভোলা কোলা দুই চেলা চলল নাপিতের বাড়ি। নাপিতের মাথা নেড়া। গোঁফ নেই। নাপিত তখন এইটুকুনি আয়নায় নিজের হুমদো মুখ দেখছে। নেড়া হওয়ার পর নিজেকে চিনতে পারছে না, কী হবে এবার?

ভোলা এসে বলল, পেন্নাম হই পরামানিক, সোনামানিক, আমাদের সিং চাই।

 হুকুম সিঙের চেলা?

 কোলা বলল, ইয়াস।

 বাপরে, ইংলিশ বলছে। নাপিত একটু সতর্ক হলো। ডাকাত এখন হিন্দি ছেড়ে ইংলিশ ধরছে? সে বলল, হুকুম চাই।

 হুকুম সিং হুকুম যদি না দেয়?

 ভোলার কথায় নাপিত বলে, হবে না হবে না।

 তখন ভোলা আর কোলা রেগে গেল খুব। নাপিত যদি না দেয় সিং পাবে না কোনদিন। সিং না পেলে ডাকু হবে না। ডাকু ভোলা আর কোলা সিং বলে কেউ খাতির করবে না। রাগের চোটে তারা নাপিতকে তুলে নিয়ে চলল বনের ভিতর।

 তারপর? ঠাকুমা জিজ্ঞেস করে। ইস ঠাকুমার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে গুগুলের গল্প শুনে। কী কাণ্ড! এতদিন ঠাকুমার কাছে গল্প শুনত গুগুল, এখন গুগুলের কাছে ঠাকুমা। বনের ভিতরে নাপিতকে নিয়ে গিয়ে ভোলা, বলল, সিং দো।

 কোলা বলল, মুঝে দো, সিং দো পরামানিক ভাইয়া।

 ভোলা বলল, সিং দো, সিং দো, পরামানিকজি।

 নাপিত বসে থাকে। ভোলা কোলা তার উপরে গরম দেখায়। কিন্তু নাপিত করবে কী? সিং গজাবে কী করে? সিং ছাড়া কেউ ডাকাত হয় না, এমন আজব কথা কে শুনেছে কবে? কিন্তু বলেছে যে হুকুম সিং। সে যে তার সিং জমা রেখেছে পরামানিকের কাছে।

 তারপর? উত্তেজনায় ঠাকুমা উঠে বসে।

গুগুল বলল, গুগুলে আছে।

কী আছে?

 তারপর নাপিত কী করল। গুগুল বলে।

 ঠাকমা মাথা নাড়ে, মোটেই নেই।

 হি হি করে হাসে গুগুল। বলল, আছে আছে আছে, তুমি ঘুমোও আমি এখন আসি।

 ঠাকুমা বলে, তুই আমার কাছে ঘুমো।

 না, মার কাছে।

 মার কাছে কেন আমার কাছে।

 না মার কাছে। বলে খাট থেকে লাফ দিয়ে পড়ে গুগুল উধাও। ঠাকুমা কী আর করেন, মনে মনে গল্প নিয়ে অথৈ জলে পড়েন যেন। হুকুম সিঙের জমা রাখা সিং দেবে কী করে নাপিত। তখন বাইরে ঝিমঝিম ঝিম বৃষ্টি নামে।ঠাকমা ঘুমিয়ে পড়েন। গুগুলের আর পাত্তা নেই দুদিন। ঠাকুমার গল্পও আর এগোয় না। গুগুল জানে। কম্পিউটারের গুগুল নয়। এই বাড়ির ডাকাত গুগুল। তো ঠাকুমা যখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন, আর গল্প হবে না। পত্রিকার লোক ফোন করছে বারেবারে। তখন গুগুল একদিন এল পা টিপে টিপে। মাথায় দুটো সিং। কালো কালো, মোষের সিঙের মতো বাঁকানো। হে হে হে হে, এই তো নাপিত দিয়েছে সিং। দুটো মাত্তর সিং ছিল হুকুম সিং ডাকুর। ভাগ করে নাও তোমরা ভোলা কোলা। এক সিং ডাকাত তোমরা। বুঝলে ঠাম্মা? সমঝা, মেরা নাম হুকুম সিং, মেরা পাশ দো সিং, আর ভোলা কোলা দুই চেলা, তারা পেল এক সিং আর এক সিং।

ঠাকুমা তো অবাক। তাই তো রে তাই তো। নাপিত কোথায় পেল দুই সিং, ও গুগুল সোনা?

গুগুল বলে, বনের কাঠকুটো দিয়ে বসে বসে বানালো নাপিত, ভোলা কোলা তো শুধু ভোঁস ভোঁস করে ঘুমালো তখন।

তাতেই ওরা খুশি?

গুগুল নাচতে লাগল। বহুত খুশি আচ্ছা খুশি। বোকারাম ভোলা কোলা এক সিং ডাকাত হয়ে কী নাচ না নাচতে লাগল। কী গান না গাইতে লাগল। কেমন হয়েছে ঠাম্মা আমার দুই সিং?

ঠাকুমা বলেন, এক্কেবারে হুকুম সিং, তার চেলা এক সিং দুই ডাকাত ভোলা কোলা, উফ, গুগুল আমার কত জানে, ঠাম্মা তার কাছে গল্প শোনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *