স্টিফেন হকিং এর চিঠি

স্টিফেন হকিং এর চিঠি

শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মহাশয়,

আমার নাম নীলাভ। ডাক নাম নীল। আমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে আপনার কাছে। হ্যাঁ, আগে বলে নিই, আমার বয়স চোদ্দো। ক্লাস এইট। আমার দাদার কুড়ি। ফিজিক্স পড়ে। দাদার জন্মদিনে দাদাকে একটি বই দিয়েছিল বাবা – এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম-সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। দাদার কাছ থেকে নিয়ে বইটা আমিও পড়েছি। সবটা ধরতে পারিনি, কিন্তু পড়তে খুব ভাল লেগেছে। বুঝিনি সবটা বলেই কিছু কিছু প্রশ্ন জেগেছে আপনার লেখা ওই বইটি নিয়ে, বলা যায় সময় নিয়ে। তা রাখছি।

১) বড় হতে কত সময় লাগে স্যার?

২) আমার কাছে সময় সবসময় কম মনে হয় কেন? কারোর কারোর কাছে যে সময় আর ফুরোয় না, যেমন অভিরূপ। তার কথা পরে বলছি।

৩) স্যার অনেকের কাছে সময় অঢেল। আমি যখন সময়ের অভাবে হলদে পাখির পালক বইটা পড়তে বেশি সময় নিই। অনেকে সময় নেই, সময় বাড়ন্ত বলে ঘুমিয়ে কাটায়। ঘুমোতে গিয়ে সময় নষ্ট করে ফেলে। স্যার অনেক লোকের যেমন টাকা থাকে না, সময়ও থাকে না। আমাদের ক্লাসের শুভময়রা হঠাৎ গরিব হয়ে গেছে। টাকা নেই ওর বাবার। এই যে ইস্কুল থেকে নিয়ে গেল হলদিয়া বন্দর দেখাতে, শুভময় যেতে পারল না। টাকা দিতে পারেনি তো। আমরা ফিরে এসে ওকে গল্প করেছি কী রকম টিফিন হলো, কী রকম লাঞ্চ হলো, বাস কোথায় কোথায় দাঁড়াল, কেমন দেখলাম ডক এই সব নিয়ে। কেমন দেখলাম বিদেশি জাহাজ, সেই সব নিয়ে। শুনতে শুনতে শুভময় যেন আমাদের কথা মুখস্থ করে ফেলল। পরে আমাকে বলল,দ্যাখ তোরা কেমন গেছিস কী দেখেছিস,সব আমি বলতে পারি, শুনবি।

আমার অবাক লাগে। সময় এক একজনের কাছে এক এক রকম। আমরা যে সময়ে হলদিয়া বন্দরে ছিলাম, শুভময় ঠিক সেই সময়ে ছিল বাড়িতে। ও খুব চেষ্টা করেছিল টাকা জোগাড় করতে। শেষ পর্যন্ত ওর বাবা দিতে পারেনি। বাবা যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করত তা বন্ধ হয়ে গেছে আচমকা। স্যার স্টিফেন হকিং আমরা সবাই মিলে যখন খুব আনন্দ করছি, ও তখন চুপচাপ বাড়িতে একা একা বসে। একই সময়, কিন্তু দুজনের ক্ষেত্রে তা দু’রকম কেন?

৪) স্যার স্টিফেন হকিং আর একটি ছেলের কথা বলি। তার নাম অভিরূপ। সেও হলদিয়া বন্দরে যায়নি। যেতে পারেনি, দুর্বল কি না। অভিরূপ প্রায়ই ইস্কুলে আসে না। ওর নাকি জ্বর হয়। আমরা যখন ইন্টার ক্লাস ফুটবল ম্যাচ খেলি, আমি লাল জার্সি গায়ে, শুভময় নীল জার্সি গায়ে, অরিত্র সবুজ জার্সি গায়ে, তখন অভিরূপ বসে থাকে মাঠের বাইরে। ওরও একটা টিম আছে। ক্লাস এইট। লাল জার্সি আছে। লাল জার্সি পরেই মাঠের ধারে বসে হাত নাড়ে। আমার ইস্কুলে যখন শীতের সময় স্পোর্টস হয়, একশো মিটার দুশো মিটার দৌড়, লং জাম্প, হাই জাম্প – অভিরূপ কোনোটাতে নাম দেয় না। ওর না অসুখ। আমি যখন ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁডিয়ে গোল্ড মেডেল নিই, অভিরূপ ক্ষীণ গলায় চিৎকার করে ওঠে, হিপ হিপ হুররে। একই তো সময়, তা দুজনের ক্ষেত্রে দুরকম হবে কেন?

স্টিফেন হকিং স্যার, আপনি হইল চেয়ারে বসে থাকেন। কথা বলতে পারেন না। আপনার মনের ভাষা যন্ত্র লিখে দেয়। যন্ত্র প্রকাশ করে দেয়। আপনি মহাকাশ সৌরমন্ডলের কথা ভাবেন। এই সৌরলোকের বাইরে যে অন্য সৌরলোক আছে তার কথা ভাবেন। তাদের চেনেন। আপনি কৃষ্ণগহ্বর চেনেন। মহাব্রহ্মাণ্ডে ওই বিন্দুই সব কিছু গ্রাস করে নেয় চারপাশ থেকে। ওই গহ্বরে প্রবেশ করলে সময় নাকি থেমে থাকে। ভাবতে অবাক লাগে। সব কিছু বুঝতে না পেরেও শিহরণ লাগে হে মহাবিজ্ঞানী, আপনি আমার সামান্য প্রশ্ন কটির উত্তর দিলে বাধিত হবো। প্রণাম নেবেন।

প্রিয় নীলাভ,

নীলাভ শব্দটির অর্থ কী? আমি জেনেছি। আমার কম্পিউটার আমাকে সব জানিয়ে দেয়। নামটি ভারি সুন্দর। তোমার নামের সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশ হাজার হাজার নক্ষত্র নিয়ে জেগে ওঠে চোখের সামনে। কত নতুন তারার জন্ম হয়। কত তারার মৃত্যু হয় – এ সব আমরা চোখে দেখে ধরতে পারি না। সময় এক অপূর্ব ধারণা। শোনো যে নক্ষত্রটির আলো আজ রাত্রে পৃথিবীতে এসে পৌঁছল, সেই নক্ষত্রটির হয়ত বহু শত বৎসর আগে মৃত্যু হয়েছে। লক্ষ আলোকবর্ষ পার হয়ে আসা তার আলো আজই দেখতে পেলাম আমরা। আমাদের কাছে সে জীবিত। তার মৃত্যুর আগেই ওই আলো যাত্রা করেছিল পৃথিবীর উদ্দেশে।

শোনো নীলাভ, সময়কে বুঝতে হবে নিজে নিজে। সময়ের আরম্ভ আছে, সময়ের শেষ নেই। প্রবাহিত হয়েই চলেছে তোমাদের পবিত্র নদী গঙ্গা, গোদাবরী, কাবেরী, নর্মদার মতো। নদী তো সমুদ্রে মিশে যায়। সময়ও আর এক সমুদ্রে লীন হয়। সেই সমুদ্রটি খোঁজা এখনও বাকি। খুঁজছি। যদি অ্যান্টনি থাকত সে ঠিক খোঁজার পথটি বলে দিত। আন্টনির কথা পরে শুনবে।

তুমি এক চোদ্দ বছরের বালক। তুমি যে আমার বইটি পড়তে চেষ্টা করেছ, সময়কে বুঝতে চেয়েছে, তারপর কিছু প্রশ্ন জেগেছে তোমার ভিতরে তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। যে মানুষ প্রশ্ন করতে করতে বড় হয়, সে জানতে পারে অনেক কিছু।

প্রতিদিনই পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে অসংখ্য চিঠি আসে আমার কাছে। সবই প্রায় ই-মেল-এ। সেই সব ই-মেল-এর জবাব আমার সহকারীই দিয়ে দেন। একই প্রশ্নই তো সবাই করে। তোমার প্রশ্নগুলি একটু আলাদা। তাই আমিই জবাব দিলাম।

সময়কে বুঝতেও চাও বালক। বুঝতে পারবে, বড় হও। কেন একই সময়ে দু’জন দুরকম থাকে? বুঝতে পারবে, বড় হও। সময় আপেক্ষিক। সবার কাছে সমান হতে পারে না। তুমি তো প্রণম্য বিজ্ঞানী স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের নাম শুনেছ। বড় হও। তাঁর কথা জানবে। তিনিও বুঝিয়ে দেবেন। আপেক্ষিকতাবাদ তো তাঁরই খুঁজে বের করা।

প্রিয় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং,

আপনার উত্তর আমি পেয়েছি। আমার বাবা বললেন, এ আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আপনি প্রশ্নগুলি নিয়ে ভেবেছেন। আপনি সৃষ্টিরহস্যের মুলে পৌঁছতে চাইছেন। রাতের আকাশের মতো বিপুল আপনার জ্ঞানের পরিধি, তবু আপনার জিজ্ঞাসা কিন্তু শেষ হবে না। আমার প্রশ্নও শেষ হয় নি। আপনি উত্তরগুলি দিলে বাধিত হবো।

১) অভিরূপ ইস্কুলে একদিন আসে, সাতদিন আবার আসে না। পড়াশুনোয় পিছিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। যেদিন আসে খুব গল্প করে। দক্ষিণ ভারত গিয়েছিল ডাক্তার দেখাতে। ভারত মহাসাগর দেখে এসেছে। শুভময় কোনদিন সমুদ্র দ্যাখেনি। বার বার জিজ্ঞেস করে সমুদ্র কত বড়? অভিরূপ বলে, আকাশ যত বড়, হয়তো তেমন, অসীম।

অভিরূপ বলে, বাড়িতে তার সময় আর কাটে না। সকাল থেকে সন্ধে হতে যেন বছর ঘুরে যায়। সময় অফুরন্ত। সে সারাদিন শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। ওদের ফ্ল্যাটটি সাততলায়। জানালা দিয়ে শুধু আকাশ দেখা যায়,আর দেখা যায় দুরের গাছপালা, বাড়ি। রাতে দেখা যায় আকাশের তারা, ছায়াপথ,দিনে দেখা যায় পাখির উড়াল আর ঘুড়ি। অভিরূপ খুব ঘুড়ির কথা বলে। তার খুব ইচ্ছে ঘুড়ি উড়ায়। লাল নীল সবুজ হলুদ রঙের ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে লাটাই-এর সুতো ছেড়েই যায়।ঘুড়ি একটু একটু করে মহাকাশে পৌঁছে যাবে। পার হয়ে যাবে মহাকাশও।

স্যার কত লোক ঘুড়ি উড়ায়। কত ছেলেরা উড়ায়। আমাদের শুভময়ও উড়ায়। কিন্তু অভিরূপ উড়াতে পারে না। তার মা বলে, এখনো সময় হয়নি সোনা। কবে সময় হবে? সময় এত নিষ্ঠুর কেন? ঘুড়ি উড়ানোর সেই সময় লাল হলুদ সবুজ নীল রং মেখে কেন অভিরূপের কাছে আসে না?

আমাদের ওই বন্ধু শুভময় কত রকম ঘুড়ির নাম জানে।ঘুড়িতে ঘুড়িতে যুদ্ধের কথা বলে। আকাশে প্যাঁচ খেলা হয়। একটা ঘুড়ি কেটে যায়। শুভময় যখন ভো-মারা বলে চাপা চিৎকার করে ওঠে, তখন উত্তেজনায় অভিরূপের চোখে জল এসে যায়। সেও ক্ষীণ কণ্ঠে বলে ওঠে, ভো-মারা।

স্যার অভিরূপ সেদিন এক আশ্চর্য কথা শোনাল। বলল, ঘুড়িরা কেটে গেলে আকাশ দিয়ে ভাসতে ভাসতে কোথায় যায় জানো – ৫৮১ সি গ্রহে। সেই গ্রহ কোথায় জানো? এই সৌরজগতের বাইরে আর এক জগতে, এই গ্যালাক্সির বাইরে অন্য এক গ্যালাক্সিতে। গ্রহটি নাকি একেবারে পৃথিবীর মতো। তাপমাত্রা পৃথিবীর মতো হওয়ায় সেখানে মানুষ থাকলেও থাকতে পারে। অভিরূপ বলতে বলতে আচমকা হেসে উঠল, আরে শুনবি তোরা, সেখানে তেরো দিনে এক বছর। মানে তেরো দিনে গ্রহটি তার সূর্যকে পাক দেওয়া শেষ করে। বছর গিয়েই বছর আসে। হ্যাঁ, সেই পৃথিবীর যে সূর্য তার নাম গ্লিসে-৫৮১। আসলে সে একটি বামন নক্ষত্র, ডোয়ারফ স্টার। তার আলো লালচে। তাই নতুন পৃথিবীতে সেই লালচে আলোই এসে পড়ে। মনে হয় সব সময় বিকেল।

স্যার, অনেকদিন বাদে অভিরূপ এই নতুন গ্রহের কথা বলতে বলতে খুব হাসছিল। বলছিল, তার সময় কাটে না বাড়িতে শুয়ে থেকে থেকে, নতুন পৃথিবীতে তেরো দিনে যখন বছর, সময় ধরাই যাবে না। দুগগা পুজো কবে এল ধরাই যাবে না।অভিরূপ বলে, যদি ভবিষ্যতে এমন কিছু হয় যে মানুষ ওই গ্রহে বাস করতে গেল সেও চলে যাবে। ওখানে সময় তাড়াতাড়ি ফুরোয় তাড়াতাড়ি এসেও যায়, কম কথা!

এইসব কথা শুনতে শুনতে শুভময় একদিন আমার কাছে চাইল তোমার ওই বইটা।

বইটা যে আমি দেব, কী করে দেব? দাদার বই দাদা দিল না। বলল, দামি বই তো, না দিলেই ভালো।

‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ না পেয়ে শুভময়ের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সে খুব আশা করেছিল বইটা পাবে। আমি তখন বললাম, বাবাকে বল কিনে দেবে।

বাবা এখন পারবে না।

কেন পারবে না, বাবারা ওই রকম বলে!

না রে, বাবার ফ্যাক্টরি নাকি আর খুলবে না, আমার মা সেদিন কাঁদছিল আমাকে বুকে চেপে ধরে, আমাদের সময়টা এখন খুব খারাপ যাচ্ছে।

স্যার, একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারি না। সময়েরও ভালো মন্দ হয় কী করে? সময় কেন সবার কাছে সমান ভাবে আসে না। ভাল সময় মন্দ সময় – কী ভাবে সময় ভাগ হয়ে গেল ভালোমানুষ মন্দ মানুষের মতো?

২) স্যার, ওই যে অভিরূপ বলে সেই একটা ঘুড়ির কথা – মাঝ-আকাশে বাঁধন ছাড়া হয়ে এই পৃথিবী ছাড়িয়ে এই মহাকাশ ছাড়িয়ে উড়তে উরতে অন্য সৌরমণ্ডলে গিয়ে পড়ল। তারপর খুঁজে পেল নতুন পৃথিবী ৫৮১-সি কে। ঢুকে পড়ল সেই পৃথিবীর আকাশে। তারপর নেমে পড়ল একটা মাঠের ভিতর। ঘুড়িও তো ক্লান্ত হয়। অভিরূপ বলে, মানুষের চেয়ে ঘুড়ি স্বাধীন, যখন সে কেটে যায়, বাঁধনহারা হয়ে যায়। মানুষের সময় কাটেই না, শুধু বিছানায় শুয়ে থাকো, ওষুধ খাও, ঘুম আসবে না তবু ঘুমোও। খোলা জানালা দিয়ে আকাশটা দেখা যায়। এক একদিন মেঘ হয়। ঘন মেঘ আকাশ ঢেকে ফেলে। সে যখন মেঘের দিকে চেয়ে ভাবে, আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, তখন মা এসে জানালা বন্ধ করে দেন। জোলো বাতাসে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। এখন এ সব দেখার সময় আসেনি।

স্যার কবে সময় আসবে? আমরা তো মেঘ দেখি, বারান্দায় বৃষ্টি এলে ভিজি। অভিরূপ তা পারে না। একদিন ইস্কুলে কী হলো, টিফিনের সময় কী মেঘ না করল, কী বাতাস বইল, তারপর বৃষ্টি ধেয়ে এল সৈন্যদলের মতো। শুভময় হো হো করতে করতে বৃষ্টির দিকে ছুটে গেল। জলে ভিজে ক্লাসে ফিরতে ওর শাস্তি হলো। একটা পিরিয়ড ক্লাসের বাইরে। ও পরে বলল, বৃষ্টির ভিতরে ছুটে যেতে কী ভালোই না লেগেছিল। তার জন্য একটু শাস্তি হলোই না হয়। অমন সময় তো সব সময় আসে না।

স্যার পৃথিবীতে যে যে সময় সুন্দর, সেই সেই সময় সবার কাছে থেকে যায় না কেন? ভাল সময় খারাপ সময় – সময় আলাদা হলো কী করে? স্যার আপনিই সব জানেন। সময়ের সব ইতিহাস। তাহলে বলুন স্যার, এসব কথার উত্তর দেওয়া আপনার কাছে কত সহজ।

প্রিয় বন্ধু নীলাভ,

আমার বালক বন্ধু, তোমার ই-মেল আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমার ওই বয়সে। মনে পড়ে যাচ্ছে কত কথা। মনে পড়ে যাচ্ছে আমার সহপাঠী অ্যান্টনির কথা। তার মা-বাবাও খুব গরীব ছিল। ওই বয়সেই তার পড়া বন্ধ হয়ে গেল। সে জাহাজে খালাসির কাজ নিয়ে পূর্বদেশে যাত্রা করল। যে বন্দরে জাহাজ থামত সেখান থেকে আমাকে চিঠি লিখত। পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্যে তার মনে খুব কষ্ট ছিল। জাহাজে গিয়ে খুব মনমরা হয়ে ছিল ক’দিন। মা-বাবার জন্য, ইস্কুলের জন্য। গোপনে সে ক’দিন ধরে জাহাজের খোলে বসে কাঁদছিল। তখন এক বুড়ো নাবিকের চোখে পড়ল তা। সে তার হাত ধরে তুলে নিয়ে এল ডেকে। রাতের আকাশ দেখাল সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে। তারা চেনাতে লাগল। বলল, এর চেয়ে বড় ইস্কুল আর নেই। সেই বৃদ্ধ নাবিক সমস্ত জীবন সমুদ্রে ভেসে ভেসে আকাশের যত তারা, নক্ষত্রপুঞ্জ চিনেছিল একটু একটু করে। আকাশ দেখে, গ্রহ-তারা দেখে বিভোর হয়ে গেল অ্যান্টনি।

বালক বন্ধু নীলাভ, সময় যেমনই আসুক, তাঁকে নিজের কাছে টেনে নিতে হবে। মনে করবে সমস্ত সময় রয়েছে মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। আমার সেই সহপাঠী অ্যান্টনি যদি মন খারাপ করে জাহাজের খোলে বসে থাকত, তাহলে আকাশ চেনা হতো? বন্দর থেকে যে চিঠি লিখত অ্যান্টনি,মনে আছে,তার ভিতরে থাকত সমুদ্রের ভিতর থেকে রাতের আকাশ দেখার অপূর্ব বর্ণনা। আকাশ সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে কীভাবে নেমে এসেছে সমুদ্রের জলে, তা লিখেছিল অ্যান্টনি, মনে আছে। সে ছবি এঁকে এঁকে বছরের কোন সময়ে গ্রহগুলির কী অবস্থান তা বুঝিয়ে দিত আমাকে। কোন সময় কোন নক্ষত্র দেখা যায়, কোন সময় তারা অদৃশ্য হয়ে যায়, তা লিখে দিত। তার চিঠি পড়েই আকাশকে চিনলাম আমি, আকাশকে দেখতে আরম্ভ করলাম। আকাশ আর সময়কে চিনতে চাইলাম।

আমার সেই বালক বন্ধু অ্যান্টনি জাহাজডুবিতে পূর্বসমুদ্রে মারা যায়। পূর্বসমুদ্র, বে-অফ-বেঙ্গল তো তোমার দেশে। অ্যান্টনিকে স্মরণ করো, সময়ের ভালোমন্দ,সময়ের বিপুলতা, সময়ের ক্ষুদ্রতা সব জেনে নিতে নিতে বড় হও। কবে যে বড় হয়ে যাবে তা তুমিও টের পাবে না, সময়ের এমনই খেলা।

প্রিয় বন্ধু, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং,

আজ আপনাকে দুটি কথা বলব। অনেক দিন কেটে গেছে এর ভিতরে। বর্ষা শেষ হয়ে শরৎকালও চলে গেছে। এখন আমাদের দেশে হেমন্তকাল এসেছে। বেলা ছোট হয়ে গেছে, রাত্রিকাল হয়ে গেছে দীর্ঘ। আমার সহপাঠী, বন্ধু শুভময় ইস্কুল ছেড়ে চলে গেছে। তারা এখন দূর পশ্চিমে, নাগপুরে। সেখান থেকে সে চিঠি লেখে আমাকে। তার বাবা নতুন একটি চাকরী পেয়েছেন ওই দেশে। হ্যাঁ, সে কিনতে পেরেছে আপনার সেই বই, ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’। সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। সব আমাকে চিঠিতে লিখেছে সে। লিখেছে সময় এখন আনন্দের। ভালো সময় এসেছে। তবে কষ্টের দিনগুলোর কথা সে ভুলবে না কোনোদিন। সময় চিনতে পারছে সে। আকাশে বাতাসে দিনে রাত্রে শীতে গ্রীষ্মে সময় বয়ে যায় বহমান এক নদীর মতো। তার উৎসে যেতে চায় সে।

প্রিয় বন্ধু, শেষ কথাটি বলি, অভিরূপ ৫৮১-সি গ্রহে বিকেলের লালচে রোদের পৃথিবীতে চলে গেছে। সে আর নেই। তার যে অত কঠিন অসুখ ছিল তা আমরা অতটা বুঝিনি। প্রিয় স্টিফেন হকিং, তুমি তো এই গ্যালাক্সি, এর বাইরের গ্যালাক্সি- অন্য ব্রহ্মাণ্ডের সব কথা জানো। আমাকে বলো দেখি নতুন পৃথিবীতে অভিরূপ কেমন আছে। তার অসুখ সেরে গেছে তো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *