রাজার বাড়ি

রাজার বাড়ি

পাখিটা উড়তে উড়তে এল রাজার বাড়ি। নীল রঙের লেজ, হলুদ রঙের পিঠ, লাল রঙের পেট আর আর মাথাটি হলুদ পালকে ভর্তি। পাখির নাম, রঙভরা। নামটি রাজার বাড়ি থেকে পাওয়া। সে হলো খবরিয়া পঙ্খী।খবর নিয়ে আসে রাজার বাড়ি। সে উড়তে পারে অনেক উঁচু দিয়ে। ফলে পাহাড়তলীর মানুষ তাকে তীর দিয়ে ছুঁতে পারে না।বন্দুকের গুলিতে বিদ্ধ করতে পারে না। তার চোখের খুব জোর। কত উঁচু থেকে সে সব দেখতে পায়। কী দেখতে পায়, না গারো রাজার দেশে হচ্ছে কী। অত্যাচারী সেনাবাহিনী আসছে কি আসছে না, খারাপ মানুষ ভালো মানুষের উপর অত্যাচার করছে কি করছে না, সিমসাং নদীতে বান এল কি এল না, নদীর ভিতরে হয়েছে নৌকো ডুবি হলো কি হলো না, এই সব খবর নিয়ে খবরিয়া পাখি উড়ে আসে পাহাড়ে। এই সিমসাং নদীর রাজার রাজধানীতে যেমন কিছু হয় না প্রায়, রাজার বাড়িতে রাজা আর রানি থাকেন,আর কেউ না। না মন্ত্রী, না কোটাল কিংবা সেনাপতি। রাজা রানি দুজনেই বুড়ো। হাজার বারোশো বয়স হয়েছে। রাজা আর রানি কথা বলে আর নিজ মনে মাথা নাড়ে। রাজার রাজ্য নিয়ে নিয়েছে সোমেশ্বর পাঠক নামে আর এক রাজা। রাজা ছিল না সে। ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিল এদিকে বাণিজ্য করতে। তারপর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ যে হবে তা রাজার বাড়ির কেউ জানত না। রাজা না, সেনাপতি না। যুদ্ধ হয়নি কোনো কালেই। কে আসবে যুদ্ধ করতে? যুদ্ধ মানে হিংসা। হিংসা মানে রক্তপাত, মৃত্যু। তাতে খুব ভয় গারো রাজার, তাই যুদ্ধ হয়নি। আর সোমেশ্বর পাঠক বিনা যুদ্ধে রাজ্য জয় করে পাহাড়তলীতে রাজধানী নির্মাণ করল। কত দিনের কথা তা! কিন্তু গারো রাজা আছেন। তাঁকে ছুঁতে পারেনি সোমেশ্বর পাঠক। যে কিনা পরে হয় সোমেশ্বর সিংহ। রাজা হয় সিংহ। বনের রাজা সিংহ, তাই দেশের রাজাও সিংহ। কী হয়েছিল সেই সময়? সিমসাং নদীর দেশের রাজা বলেন, কিছুই হয়নি, সোমেশ্বর পাঠক আসতেই পারেনি রাজার বাড়ি দখল করতে। এলে ভয়ানক কিছু হতো। রাজার বাড়িতে আগুন লাগত। রক্তপাত হতো। তখনও এক পাখি এসে খবর দিয়েছিল। রংভরা খবরিয়া পাখি। আসছে। রাজা মশায় তারা আসছে দামামা বাজিয়ে। যুদ্ধ করবে। যুদ্ধ! নাকে তেল দিয়ে ১৮ ঘন্টা ঘুমোনো সেনাপতি পালিয়ে বনে চলে গেল। মন্ত্রী আর দেওয়ান মনে মনে ভেবে নিল ভিনদেশিরা এলেই তাদের দলে চলে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। রাজা এসে দাঁড়ালেন বনের ধারে খোলা আকাশের নিচে। যুদ্ধের ভেরি বাজাতে বাজাতে আসছে ভিনদেশিরা। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাক দিলেন আয়। এল। কে এল? যোদ্ধারা না হস্তিযূথ? হস্তিযূথকে দিয়ে প্রতিরোধ করলে ভিনদেশিরা মরত সব। কিন্তু হস্তিযূথ প্রস্তুত নেই বলেছিল সেনাপতি। বলে বনপথ দিয়ে সোমেশ্বর পাঠকের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। রাজা কিছুই না করে কুয়াশা ডাকলেন। কুয়াশা নেমে এল আচমকা। আকাশ থেকে ঝরে পড়তে লাগল যেন। কুয়াশায় ছেয়ে গেল বন-পাহাড়। কুয়াশার দেওয়াল উঠে গেল রাজবাড়ির সব দিকে। সোমেশ্বর পাঠকের সৈন্য আর ভেরিবাদকরা কুয়াশায় পথ হারিয়ে সাতদিন ঘুরেছিল পাহাড়ে আর বনে। তারপর নামতে পেরেছিল নিচে। আর সেনাপতি পথ হারিয়ে এখনো বনে ঘুরছে। মন্ত্রী আর চিনতেই পারেনি রাজার বাড়ি। ব্রহ্ম দেশের পথে চলে গিয়েছিল শোনা যায়। মানে রংভরা পাখির খবর তেমন। রাজার বাড়ি তাই রাজা একা। মন্ত্রী নেই, সেনাপতি নেই। রানি আর রাজা আছে আর আছে হস্তিসেনা। আর আছে রংভরা খবরিয়া, লাল নীল হলদে সবুজ মোহন পাখি।

 মোহনরে মোহন, কী খবর?

 মোহন পঙ্খী খবর দেয়, সেই কতদূর থেকে মিলিটারি আসছে ট্যাঙ্ক, কামান, বন্দুক, রাইফেল নিয়ে পাহাড়তলীর রাজার দেশে।

 পাহাড়তলীর রাজা সোমেশ্বরের কোনো রাজ্য নেই, আমার রাজ্য সে নিয়েছে,আমি দিয়েছি তাই নিয়েছে, প্রজারা সব আমার। সিমসাং নদীর রাজা বলল।

 কেউ বাঁচবে না কামানের হাত থেকে, পাকিস্তানি সেনা নেমেছে যুদ্ধ করতে, যুদ্ধে কোনো বিপক্ষ নেই, আছে প্রজারা, তাদের কোনো বন্দুক নেই, তারা চাষবাস করে খায়। রংভরা পাখি বলল।

 যা বলেছিল রংভরা খবরিয়া সব সত্যি। সেই যে অনেক বছর আগে সে দেশে মুক্তিযুদ্ধ লাগে।পাকিস্তানি মিলিটারির কামান বন্দুকের বিরুদ্ধে দা কুড়ুল নিয়ে যুদ্ধে নামে সে দেশের মানুষ। সেই তখনকার কথা হচ্ছিল রাজা আর খবরিয়ার। রাজা বলল, আমার প্রজা, রক্ষা করব আমি।

 পাহাড়তলীতে পাকিস্তানি সেনা আসতে না আসতে কুয়াশা নামল দশদিক জুড়ে। আর সেই কুয়াশার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল হাতির পাল। পাকিস্তানিরা পালিয়েছিল। পালাতে গিয়ে নদীর জলে ডুবে মরেছিল। হাতির পায়ের তলায় পিষে মরেছিল।

 সে কতকাল আগের কথা। তারপরও কত খবর এসেছে। রাজা শুনেছে আর চুপ করে থেকেছে।বন্যায় ফসল নষ্ট, চাষীদের খুব কষ্ট। রাজা বললেন, পরের সনে বানা হবে না, চাষ হবে ভালো, আমার প্রজাদের কষ্ট হবে না।

 কত খবর আসে।একটা শয়তান লোক দলবল নিয়ে খুব ঝামেলা করছে। চাষীদের ঘরে আগুন দিচ্ছে,চাষীদের ফসল লুট করছে।রাজা হাতি পাঠালেন। অন্ধকার রাতে হাতি নেমে গিয়ে লোকটাকে শুঁড়ে করে তুলে এনে বনের ভিতরে ছেড়ে দিল, কুয়াশায় ঘিরে দিল তার চারদিক। সেই কুয়াশা থেকে লোকটা বেরতে পারেনি। খারাপ লোককে কুয়াশার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে শাস্তি। রাজার বাড়ি অভিযান করতে এসে ফিরে গেছে ব্রহ্মদেশের রাজা। কুয়াশায় দিকভ্রান্ত হয়েছিল তারা। তো এতদিন বাদে রংভরা খবরিয়া খবর আনল একটা লোক আসছে। সে দেখেছে একটা লোক আসছে। রাজার বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে একটা লোক আসছে। কেমন মানুষ সে?

 খবরিয়া বলল, এমনি মানুষ।

 এমনি মানুষ! রাজার বাড়ি আসছে কেন?

 রংভরা খবরিয়া বলল, এমনি আসছে।

 এমনি মানে কী? সিমসাং রানি জিজ্ঞেস করল।

 এমনি মানে এমনি, লোকটা আসছে রাজার বাড়ি দেখতে।

 রাজা বলল, গারো পাহাড়ে রাজার বাড়ি আছে তা কে বলল?

 শুনেছে সে। পঙ্খী বলল।

 কে শুনালো? রাজা জিজ্ঞেস করল।

 কেউ না রাজামশায়, এমনি শুনেছে।

 এমনি শুনা যায়? রানি জিজ্ঞেস করল।

 যায় মশায় যায়, না গেলে সে আসে কী করে?

 তার হাতে অস্ত্র আছে? রাজা জিজ্ঞেস করে।

 না মশায়, সে শান্ত মানুষ।

 শান্ত মানুষ এতদূর আসে কেন?

খবরিয়া পঙ্খী বলল,এমনি আসে মহারাজ, কুয়াশা হয় না যেন মশায়।

 মশায় মহারাজ বলল, রাজার বাড়ির পথ কেউ জানবে না, কুয়াশা হবে তবুও সে আসবে এখানে, আসুক সে, কিন্তু এসে করবে কী?

 রাজা রানি আর রাজবাড়ি দেখবে। খবরিয়া পঙ্খী বলল।

 দেখে করবে কী? রানি জিজ্ঞেস করল।

 এমনি দেখবে মশায়া। খবরিয়া পঙ্খী বলল।

এমনি এমনি আর এমনি, এমনির বাইরে হয় না কিছু? রাজা অধৈর্য হয়ে বলল।

 সে জানে মশায়, সে এক ভালোমানুষ। খবরিয়া বলল।

 ভালোমানুষ তো আসা কেন?

 পাখি শিস দিয়ে উঠল, পাখি গান গেয়ে উঠল,

 সিমসাং নদী, তুমার রাজায় কত না কথা কয়।

 সিমসাং নদী আজও দেখি এমনি এমনি বয়।।

 এমনি আলো এমনি কুয়া, এমনি মানুষ ভালো।

 এমনি জগত এমনি পাহাড় এমনি এত আলো।।

 রাজা বলল,আমার প্রাসাদে ভালোমানুষ আসবে,তাকে কী দিয়ে আপ্যায়ণ করব?

 রানি বলল, আমাদের খেজুর রস আর পিঠাপুলি, আর হরিণের দুধ।

 তারে আমরা কী দেব, কোন মণি রত্ন? রাজা জিজ্ঞেস করল।

 রানি বলল, বাঁশের ঝুড় আর বেতের ধামাভরা আপেল আর কমলা লেবু সবুজ লেবু দেব।

 মোহন পঙ্খী খবরিয়া বলল,তাহলে আমি দেখে আসি, কেমনে সে আসে, ঠিক পথে আসে না ভুল পথে যায়?

 যাওরে মোহন পঙ্খী খবরিয়া,

 আসো তারে নিয়া।

 কুয়াশায় কুয়াশা নামে

 আসে কোন পথ দিয়া।।

***

লোকটা পাহাড়ের পথে কিছুটা চলে আচমকা দেখল কুয়াশা নেমে এল। দুর্ভেদ্য কুয়াশা। এক হাত দূরের কিছু দেখা যায় না। কিন্তু সে জানত এমনি হবে। কুয়াশার ভিতরেই আত্মরক্ষা করে সিমসাং রাজা। কুয়াশার প্রাচীরের ভিতরই রয়েছে রাজার বাড়ি। রাজা রানি। সে অন্ধের মতো চলতে লাগল। গারো পাহাড়ে এক রাজার প্রাসাদ আছে, রাজা রানি আছে, সে তাদের দেখতে এসেছে। দেখে ফিরে যাবে, আর কিছু না। মানুষ এমনি কত কিছু দেখে ফিরে যায়, সমুদ্র, হ্রদ, নদী, পাহাড়, জঙ্গল, সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়, কত কিছু। এমনিই দেখে ফিরে যায়। সেও এমনি দেখে ফিরে যাবে কি যাবে না, তা পরের সিদ্ধান্ত। আর কিছু না। এই যে এত কুয়াশা, এমনি কুয়াশা এল কোথা থেকে, সে শুনেছিল, কুয়াশা পেরিয়ে যেতে হবে রাজার বাড়ি। কত পথ যেতে হবে, কত দূর তা জানে না লোকটি। সে নিজের মতোই চলছিল। ভুল না ঠিক পথ জানে না। কিন্তু যেতে যেতে তার মনে হলো কুয়াশার ভিতরে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে। সে ডাক দিল, কেউ আছ, আমি রাজার বাড়ি যাব, কোন পথে যাব?

মোহন পাখি খবরিয়া ছিল এক শাল গাছের ডালে,বলল, যে পথে যাও, রাজার বাড়ি পৌঁছবে।

কোন পথে তাড়াতাড়ি পৌঁছব?

মোহন পাখি খবরিয়া বলল, যে পথে যাও, একই দূর।

রাজার বাড়ি উত্তরে না দক্ষিণে, পুবে না পশ্চিমে?

উত্তর দিক দিয়ে যাওয়া যায়, পুব দিক দিয়েও যেতে পার, পশ্চিমে রাজার বাড়ি আবার দক্ষিণেও সেই একই বাড়ি, সিমসাং রাজা আর সিমসাং রানি তোমার জন্য বসে আছে ধামা ভরা ফল-পাকুড় আর গজা কদমা নিয়ে। পঙ্খী বলল।

লোকটা নিশ্চিন্ত হয়। এমনিই শুনেছিল বটে। সে জিজ্ঞেস করল, আর কত সময় লাগবে?

মোহন পঙ্খী বলল,সময় কী তা তো জানি না, তুমি ঠিক পৌঁছে যাবে।

লোকটি অনেক লম্বা, স্বাস্থ্যবান, গৌরবর্ণ, সে চলল কুয়াশার ভিতরে। চলতে চলতে চলতে, আচমকা দেখল কুয়াশা নেই। বিকেলের আলো যেন মুছে যেতে যেতেও রয়ে গেছে। রোদ নেই। আলোর ভিতরে সূর্যাস্তের লালচে ভাব। কুয়াশার দরজা ভেদ করে লোকটা পৌঁছে গেল। রাজা রানির ঘরে তাঁরা আছেন। অতিথির জন্য একটি আসন। আসনের সামনে পানীয় জল, মিষ্টান্ন। রাজা তাকিয়ে আছেন অতিথির মুখের দিকে। অতিথিও রাজার দিকে চেয়ে আছেন।

রাজা বিস্মিত গলায় বললেন, তুমি?

হ্যাঁ আমি। লোকটি বলল।

তুমি কি এই প্রাসাদ অধিকার করবে? রাজা অকম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

লোকটা মাথা নিচু করল, বলল, আমি সব ফেরত দিতে এসেছি রাজা।

তুমি সোমেশ্বর পাঠক!

হ্যাঁ মশায়, রাজা।

রানি জিজ্ঞেস করলেন, কী ফেরত দেবে?

যে রাজ্য জয় করেছিলাম, সেই রাজ্য। বলে দীর্ঘদেহী সেই রাজপুরুষ দুহাত বাড়িয়ে দিলেন।

রাজা বললেন, আমাকে কোন রাজ্য ফেরত দেবে, রাজ্য তো আমার আছে।

আছে! বিস্মিত হলেন রাজা সোমেশ্বর পাঠক।

আছে, আমার রাজ্য তো আমারই আছে, কিছুই তুমি নিতে পারো নি।

সোমেশ্বর পাঠকের চোখে জল এসে গেল, বললেন, তাই বলছ রাজা?

হ্যাঁ, আমার কিছুই যায়নি রাজা, তুমি কী দেবে?

সোমেশ্বর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলেন গারো রাজার দিকে। গারো রাজা, সিমসাং নদীর রাজা উঠে এগিয়ে এলেন। আলিঙ্গন করলেন তাঁরা পরস্পরে। আর তখনই অন্ধকার নেমে এল। সূর্যাস্ত হলো। প্রাসাদ আর রাজা রানি সব মুছে গেল জগত থেকে। দেখল সব সেই খবরিয়া পাখি। লাল নীল হলুদ সবুজ মোহন পঙ্খী খবরিয়া। সে উড়ে গেল এই কাহিনি নিয়ে। রাজার বাড়ি নেই। দুই রাজা আর নেই। কুয়াশা আর নেই। তার কাছেই সবটা আমার শোনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *