হলদে গোলাপ – ৭০

৭০

আজ পনেরোই আগস্ট, এক পশলা বৃষ্টি হবার পর কি মিষ্টি এ সকাল। আকাশে জলভরা মেঘ। অনিকেতকে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছিল শুক্লা, গতকাল নিয়ে এসেছে আলপনা আঁকা পিঁড়ি, বরণডালা, শোলার মুকুট, কাজললতা, রজনীগন্ধার মালা, কলাগাছ, যুঁইফুল….

আলপনা আঁকা পিঁড়ি পায়নি, রঙিন কাগজে মোড়া পিঁড়ি পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু পিঁড়ি কী হবে? বর কনে বসবে। সম্প্রদান করবে কে? শুক্লাকে জিজ্ঞাসা করেছিল অনিকেত—কে বরপক্ষ, কে কনে পক্ষ? শুক্লা বলল দু’জনেই বরপক্ষ, দু’জনেই কনেপক্ষ

বরণ করার কুলোও কিনেছিল অনিকেত।

কুলোর গায়ে শুভবিবাহ স্টিকার মারা।

শুক্লার কিছু একটা রান্না করার ইচ্ছে হয়েছিল। মাছ ভেজেছিল বাঁ হাতেই। তারপর দই আর প্যাকেটে পাওয়া ফিশ মশলা মিশিয়ে দই রুই করল। চাটনিও। বাইরে বিরিয়ানির অর্ডার দেয়া আছে। আর সন্দেশ তো থাকবেই।

কাজের মেয়েটা সাদা ভাতও করবে। পরির বাবা বিরিয়ানি নাও খেতে পারে, শুক্লার সব দিকেই নজর আছে।

আলমারির উপরের তাকের পিছনের দিকে পড়ে থাকা বেনারসি আর সিল্কের শাড়িগুলো বের করে দিতে বলল শুক্লা। অনিকেত চার-পাঁচটা নামিয়ে দিল। চার পাঁচটা দশক নামিয়ে দিল যেন। উই লাগা ইতিহাসের চার-পাঁচটা পাতা কিম্বা রংচটা পুরনো চার-পাঁচটা ছবি যেন শাড়ির ছদ্মবেশে আলমারির ভিতর থেকে নামল। সাজোগে সাজোগে নারী হও বেশবতী, আঁখিতে কাজল দাও ওগো কেশবতী… গরদের একটা শাড়ি টেনে নিল। অনিকেতই কিনে দিয়েছিল দশ বছর আগে। শুক্লার তখন দুর্গা বরণ করার শাড়ি ছিল না।

অনিকেত বলল এটা পরবে? বরং আর একটু গর্জাস শাড়ি পরতে পারতে তো…।

শুক্লা বললনা, এটাই ঠিক আছে। আজ উৎসব করছে শুক্লা, আনন্দের বহিঃপ্রকাশ নেই কোন। যেন ব্রত করছে কোনও, কিম্বা প্রায়শ্চিত্য। নইলে দু-তিন বার দীর্ঘশ্বাস কেন? একবার বলল মন্টুটা যদি…

যদি…শব্দটার সামনে একজোড়া সমান্তরাল রেল লাইন অসীমের দিকে চলে গেছে। শুক্লা লিভিংপ্লেসে কলাগাছ বসিয়েছে জলের জারে। দু-মুঠো যুঁই ফুল রেখেছে পাথরের বাটিতে। কুলো সাজিয়েছে, কুলোতে ধান, দূর্বা, প্রদীপ…

শুভবিবাহ লেখা যে স্টিকারটা ছিল, তার উপর সাঁটিয়ে দিয়েছে সুখে থাকো। নিমন্ত্রিত তেমন কেউ নয় পরি আর চয়ন ছাড়া পরির অফিসের দু’জন। চয়নের বাবা, বাড়ির কাজের মেয়েটা। আর কেউ নয়। কল্পনা মৈত্রকে বলবে ভেবেছিল, বলেনি। কল্পনা মৈত্রর ঐ স্কুল এখন এখানে নেই আর, ওরা ফান্ডিং পেয়েছে, ওরা অন্যত্র। মন্টুর মৃত্যুসংবাদ শুনে সমাজকর্মী কল্পনা মৈত্র বলেছিল ‘আপদ গেছে’।

কলাগাছ সাজিয়ে বসে আছে শুক্লা আর অনিকেত। বাদলভরা আকাশ খান, স্তব্ধ আছে বিয়ের গান।

ওরা আসবে।

.

আজ ১৫ই আগস্ট। সাতাশে শ্রাবণ। আজ লালগড়ে মিলিটারির গুলিতে চারজন গ্রামবাসী মারা গিয়েছে। বলিভিয়ায় স্বীকার করা হয়েছে আদিবাসীদের নিজস্ব শাসন। লালকেল্লায় বক্তৃতা দিয়েছেন মনমোহন সিং, বলেছেন মানুষের সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই মূল লক্ষ্য। হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েতের নির্দেশ দুটি সমকামী তরুণকে হত্যা করা হয়েছে। ভারতের চন্দ্রযান চন্দ্রায়ণ চাঁদের দিকে ছুটেছে, পরি সাজছে। পরি জাঙ্গিয়া নয়, প্যান্টিই পরল। নতুন শায়া, বেনারসী। মায়ের হারখানি, মায়ের দুল জোড়া ছোখে কাজল, ঠোঁট রাঙানো লিপস্টিকে। পরি ব্লিড করছে।

চয়নের পোশাক পরা হয়েছে। চয়নের মেরুন পাঞ্জাবিতে ছিন্ন পালক, দুই কাঁধে অ্যাপ্লিক করা সাদা রঙের ডানা। পরির বাবাও পাজামার উপর পাঞ্জাবি পরেছে, গলায় কাজ করা।

মায়ের ছবিকে প্রণাম করল পরি। মা, মাগো, হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিয়েছি চোখের জলের বৃথা দাগ। ফাটা দাগ ঢেকে দিয়েছি, ফাউন্ডেশনে, রুজ-পাউডারে। এখন আমি ছুটে যাই, ছিলাটান, যাত্রা শুরু করি। পরি ব্লিড করছে।

বারান্দায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল শুক্লা। হাতের লাঠিটা সরিয়ে রেখেছে আজ। ট্যাক্সি থামল। শুক্লা বলল ওগো, ওরা এসেছে। নিচে যাও।

উঃ, কতদিন পর ‘ওগো’ শুনল অনিকেত। অনিকেত দেখল যেন পুষ্পক রথ থেকে চয়ন গামছে, তারপর পরি, যেন অপরূপা, হাত ধরে নামাচ্ছে ওর বাবাকে।

পৃথিবীতে দু-এক টুকরো সুন্দর এভাবেই রচিত হয় বলে পৃথিবীকে মাঝে মাঝে মায়াবী।দীর পাড়ের দেশ মনে হয়। ওরা উঠল। অনিকেত পরির বাবাকে হাত ধরে উপরে ওঠাল। নস্তব্ধ ছাদনাতলা। বাতাসে ফুলের গন্ধ আর কিসের হাহাকার।

পরির হাতে কাজললতা নেই, মোবাইল। মোবাইলে বিপ বিপ শব্দ হ’ল। মেসেজ করেছে।র্গ। উইশিং জয়ফুল এন্ড প্লেজয়রিং… পরি ব্লিড করছে। বুক থেকে সিলিকোন জেল ছড়াচ্ছে [কের বাহিরে।

মৃত্যুর অঙ্গার মথি স্তন তার ভিজেরসে উঠিয়াছে ভরি’ একটু পরই এলো পরির অফিসের দুই কলিগ।

বাপি আর নিনা। ওদের হাতে ফুলের গুচ্ছ। ওরা এলো বলে শব্দ ঝংকার হল, কুচো গগজের মত হাসি ছড়ালো বাড়িতে। নীনা বলল ওয়ান্ডারফুল। বাপি বলল হিস্টরি! হিস্টরি!

অনিকেত তসরের পাঞ্জাবি পরেছে। পাঞ্জাবিটা সুগন্ধ মাখা। হাসিও মেখেছিল মুখে। নীনা, পি এরা আসার পর ঘরেও বর্ষা এসেছে, তাই হাসিও কিছুটা বৃষ্টি। কোনও পুরোহিত নেই। কানও পুরোহিত এরকম বিবাহ দেবে না। কোনও রেজিস্ট্রারই কোনও বিবাহ আইনে এ বিয়ে ঈতে পারবে না এখনও।

শুক্লা পরির দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল একবার। বলল খুব ভালো দেখাচ্ছে। বলল, মাজ যদি তোমার মা থাকতেন…। মনে কর আমিই…। শুক্লা এই বাক্য পুরোটা শেষ করতে পারলো না। এটা শুনে পরির বুকটা টনটন করে উঠল ভীষণ। যেন আর একটা স্যাক ছিঁড়ে যাবে।

শুক্লা বলল তোমরা দু’জনে পিঁড়ির উপরে বোসো। অনিকেত বলে, তোমরা দুজনে হাত রো। অনিকেত বলে, দু’জনে একসঙ্গে বলো আমার হৃদয় তোমার হোক, তোমার হৃদয় মামার। বলো আমরা একসঙ্গে পথ চলব। আমার পায়ে কাঁটা ফুটলে তুমি উঠিয়ে দেবে, তামার পায়ের কাঁটা আমি। আমরা দু’জনে সব আনন্দ ভাগ করে নেব, সব কষ্ট ও তোমার মানন্দ আমরা হোক, আমার আনন্দ তোমার…

পরি চয়নের কাঁধের ডানার দিকে তাকিয়ে এই কথা বলে।

এবার উঠে দাঁড়াও। মালা বদল করো।

মালা বদল হয়। আকাশের মেঘে মেঘে বারতা আসে। পৃথিবীর দু-কোটি ট্রানসেকসুয়াল এস এম এস পাঠায়। আকাশ জুড়ে মেঘের গুরু গুরু।

বাপি ছবি তোলে, নিনা হাততালি দেয়।

অনিকেতের মনে হয় ওই হাততালির সঙ্গে মিশছে আরও শত সহস্র হাতের তালি। াত্তারা, ঝুমকো, ময়নারা সব ঠিকরি দিচ্ছে, ভেঁপু বাজাচ্ছে। পরির বাবার দু-চোখে বেয়ে জল াড়াচ্ছে।

পরি ব্লিড করছে।

শুক্লার কুলোয় প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয় অনিকেত। শুক্লা কুলোটা ধরে রুগ্‌ণ দু হাতে। কুলোর মধ্যে লেখা আছে সুখে থাকো। প্রদীপ জ্বলছে। শুক্লার হাত উপরের দিকে ওঠে না। শুক্লা চয়নকে বরণ করবে। চয়নের কপালে কুলো ঠেকাবে। শুক্লা ক্রেনের মতো কুলোটা উপরে ওঠাল। কী আশ্চর্য, উঠে গেল হাত। শুক্লা পারল। উলু দেবার চেষ্টা করছে এবার। অদ্ভুত একটা শব্দ বেরচ্ছে। উলু বাজছে না। বাজো বাজো বাজো। ঘৃণাকরি দূরে আছে যারা আজও… বন্ধ নাশিবে তারাও আসিবে… কিন্তু এলো ওরা। উলু দিল চাত্তারা, ফুলি, ময়নারা…দুলালীও। উলু দিল কলাগাছ, জুঁইফুল, বাঁশের কুলো, নিভন্ত প্রদীপ।

কাহিনি শেষ হল। এক সময় তো শেষ করতেই হয়। রূপকথার গল্পের মত এবার যদি বলা যেত তারপর তাহারা পরম সুখে দিনাতিপাত করিতে লাগিল….আহা। যদি বলা যেত….

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *