৬৫
আজ রোববার। জানুয়ারি ১৬, ২০০৯। এখন সকাল সাড়ে ন’টা। সকাল থেকে অনিকেত কয়েকটা কথা শুক্লার উদ্দেশে বলেছে : ১) বাঃ! ডান হাতেই তো বেশ দাঁত মাজতে পারছ। ২) বাজার যাচ্ছি। ৩) পরিটা অনেকদিন আসছে না। ৪) আজ লুচি-টুচি নয়। রুটি। এর উত্তরে, শুক্লা প্রথম কথাটার পর নীরব ছিল। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কথার পরও। চার নম্বর বাক্যটির পর—’আলুচচ্চড়ি না খেজুর গুড়? খেজুর গুড় বোধহয় নেই, দেখে নিও।’ আজ যে লুচি করতে হবে না, সেটা কাজের মেয়ে কমলাকে বললেই হত, কিন্তু গৃহকর্ত্রীকেই তো বলা উচিত। আসলে অনিকেতের আজ সকালেই কম্বলের ভিতরেই ইচ্ছেটা জেগেছিল খেজুর গুড় দিয়ে রুটি খাওয়ার। শুক্লা ঠিক ধরে ফেলেছে। কী করে যে বোঝে…!
বাজারে বেশিই সময় নেয় অনিকেত, বিশেষত শীতকালে। বাজার মানে প্রকৃতি-ভ্রমণ। লতাপাতা-শস্য-সবজি, ফল-তরকারির সান্নিধ্য-সুখ। পেঁয়াজকলির সবুজ শরীরে মাথায় সাদা মুকুট, ফুলকপি শ্বেতশুভ্র, টমেটোর আশ্চর্য একটা রং, বেগুনেরও। তাজা বেগুনের গায়ে একটা ‘লাসচার’ থাকে, যেন আলো পিছলে পড়ে, ওটা হল জীবনের ঔজ্জ্বল্য। বাসি বেগুনের ওই ঔজ্জ্বল্য থাকে না, বাসি বেগুনিরও থাকে না। বাসি মানুষেরও নয়। শুক্লা বলে ‘পাপী মানুষ’ দেখলেই বোঝা যায়। কাকে উদ্দেশ করে বলে কে জানে?
সাড়ে ন’টা নাগাদ ফিরে কাগজ পড়তে থাকে অনিকেত। শুক্লা সেই নীল মলাটের ডায়েরিটা বার করেছে। ওর বিয়ের যৌতুক, মহাপুরুষের বাণী-ভর্তি ডায়েরি। অনিকেত স্বগতোক্তি করল—শুক্লাকে শোনানোর জন্যই—তপন সিংহ চলে গেলেন…।
শুক্লা মাথা তুলল।
বলল, তাই, ইস, একটু তো ভুগছিলেন, তাই না?
অনিকেত মাথা নাড়ায়।
ও বোঝে, তপন সিংহকে নিয়ে এখন শুক্লার সঙ্গে দু’চার কথা হতে পারে। এমনিতে তো কথার দুর্ভিক্ষই বলা যায়।
ইস, চলে গেলেন… শুক্লা বলে। সেই কবে বাবার সঙ্গে ‘কাবুলিওয়ালা’ দেখতে গিয়েছিলাম…। তারপর কতবার দেখেছি…। ‘গল্প হলেও সত্যি’ আমার সবচেয়ে ভাল লাগে।
শুক্লা জিগ্যেস করেনি—’তোমার?’ তা হলে তো বেশি ইন্টিমেসি দেখানো হয়ে যায়। অনিকেত নিজেই বলল, আমার ‘ক্ষুধিত পাষাণ’।
শুক্লা বলল, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ একটা স্বপ্ন, ‘গল্প হলেও সত্যি’-ও একটা স্বপ্ন। রবি ঘোষ একটা স্বপ্ন। তাই না?
এই ‘তাই না?” শব্দটা আশাতীত অনিকেতের কাছে। ‘শেয়ার’ করতে বলছে শুক্লা। কমই হয়।
অনিকেত বলল, হ্যাঁ। দু’টোই স্বপ্ন। ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমাটার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘এমন কেন সত্যি হয় না আহা’। রবি ঘোষ। আহা!
শুক্লা বলল, মন্টুকে আবার মনে পড়ছে। খুব ছেলেটা বড্ড কেয়ারিং ছিল….
ওর পড়ার জন্য তো কত কী করলাম, কিন্তু ও তো লেখাপড়ায় সিরিয়াস ছিল না, মঞ্জুর ছেলেটা কত সিরিয়াস কত উন্নতি করেছে…। মন্টুটাকে ঠিকমতো ‘মোটিভেট’ করতে পারিনি… যাক গে… ওসব ভেবে আর কী করব। শুক্লা ডায়েরি এবং অনিকেত খবর কাগজ পড়তে থাকে। খুন, অগ্নিসংযোগ, কৃষকের অধিকার… কৃষক মেরে শিল্প নয়… টাটা-রা সিঙ্গুর ছেড়ে চলে গিয়েছে। ওদের কাঠামো পড়ে আছে, সেই কাঠামো পাহারা দিচ্ছে পুলিশ…। কাগজ পড়তেও ভাল লাগে না। শুক্লা নীল ডায়েরিটা পড়ছে। শুক্লার কথা এখন অনেক পরিষ্কার, আর ততটা জড়ানো নেই। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন কথা বলতে, কথা বলা প্র্যাকটিস করতে। কিন্তু কথা কই? কথাগুলোও তো পরিত্যক্ত কাঠামোর মতোই। কথা হয় না। অনিকেত বলে যা পড়ছ জোরে পড়ো, আমিও শুনি না-হয়…। শুক্লা বলে, তুমি এসব শুনবে না কি? অনিকেত কাগজ চার ভাঁজ করে বালিশ চাপা দিয়ে বলে, পড়ো শুনি।
শুক্লা একবার তির্যক তাকায়। একে ‘অপাঙ্গে’ তাকানো বলে। এরকম ভ্রুভঙ্গি হারানো- পুরনো। অনিকেতের ভাল লাগে।
শুক্লা পড়ে—সর্বে ভবন্ত সুখিনঃ সর্বেসন্তু নিরাময়াঃ সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু মা কশ্চিদ দুঃখ ভাগ ভবৎ। শুক্লার বাবা এর বাংলা অনুবাদও করে রেখেছেন—
সকলেই যেন সুখী হয় ভবে
হোক নিরাময় বিশ্বজন
সবাই দেখুক সুখদৃশ্য
দুঃখ বেদনা হোক বারণ।
অনিকেত মনে-মনে বলে সবাই দেখুক সুখদৃশ্য? দেখলে হবে, খরচা আছে।
শুক্লা পড়ে—নাভিনন্দেত মরণং না ভিনন্দেত জীবিতম…
না করিও মরণকে অভিনন্দন
না করিও জীবনকে অভিনন্দন
কালের আদেশ লাগি প্রতীক্ষা করিও
প্রভুর আদেশ লাগি ভৃত্য যেমন
এরূপ ভাবিলে পাবে শান্তিপূর্ণ মন…
অনিকেত মনে-মনে বলে, সুখ স্বপনে, শান্তি শ্মশানে।
শুক্লা কয়েকটা ওসব শ্লোক পড়ার পর অনিকেতকে বলে, ভাল লাগছে না তো?—এবার ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়ি। আসলে ওই ডায়েরি থেকেই পড়ছিল। ওর বাবা ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ থেকে কিছু-কিছু লিখে দিয়েছিলেন।
পাপ আর পারা হজম হয় না। কেউ লুকিয়ে পারা খেলে গা ফুঁড়ে বেরবে। পাপ করলেও ফল ভোগ করতে হয়। এরপরের চার লাইন শুক্লার বাবার স্বরচিত, ছন্দোবদ্ধ মন্তব্য।
পাপ প্রশমিত হয় আত্মগ্লানি হলে
কিছু পাপ করে মাপ তীব্র অনুতাপ
লবণ যেমন গলে পরিষ্কার জলে
সুকর্ম সেরূপে হরে মানুষের পাপ।
এটুকু পড়ে চুপ করে রইল শুক্লা। বইটা বন্ধ করল। চোখ বুজল। কপালে বাম হাত স্পর্শ করে বলল, পাপ করেছি। পাপের জন্যই আমার এই অসুখ। যে-হাত দিয়ে মন্টুকে একদিন চড় মারতে গিয়েছিলাম, সে-হাতখানাই তো পড়েছে। মন্টুকে না তাড়ালে ও মরত না। বিকাশ ওর নিজের পাপের শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু মন্টুকে তো আমরাই…আমরা কেন, আমি, আমি তো… তুমি তো আমার মুখের ওপর কথা বলো, আমি যা বলি তা কি সব শুনতে? তুমি কেন বললে না—না, বিকাশের কাছে ওকে পাঠিও না, বিকাশ বয়ে গিয়েছে…।
অনিকেত তখনও বলে না যে, ও নিজেও বাড়িতে মন্টুকে রাখতে চাইছিল না। একটা অশিক্ষিত পরিবারের পড়াশোনায় তেমন ভাল নয় আনস্মার্ট ছেলের দায়িত্ব নিতে চায়নি। তেমন হলে মাঝেমধ্যে টাকাপয়সা সাহায্য করা যেত, বছরে দু’বার জামাপ্যান্ট দেওয়া যেত, বাড়িতে এনে বাৎসল্য করার পক্ষে ছিল না মোটেই। বিকাশ যখন চালচুলোহীন, নিঃসঙ্গ, তখন বিকাশের কাছে মন্টুকে পাঠানোর প্রস্তাবটা তো অনিকেতেরই ছিল। অনিকেত বলতেই পারত—তুমি কেন বললে না—তুমি কেন ভাবছ তুমিই মন্টুকে তাড়িয়েছ। আমিই তো…। বলল না।
‘কিছু পাপ করে মাপ তীব্র অনুতাপ’। অনুতাপ করুক। পাপ প্রশমিত হয় আত্মগ্লানি হলে। হোক আত্মগ্লানি। অনিকেতের কিছুই তো নেই। ও নিরালম্ব নিরাশ্রয়। ওর কোনও সমৰ্পণ নেই। ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকলে—একটা সমর্পণ থাকত। সমৰ্পণ তো একটা আশ্রয়। মঞ্জুর কাছে কি একটু আশ্রয় চেয়েছিল অনিকেত?
শুক্লা আবার বলল, মন্টুটা কী সুন্দর করে ডাকত। বাজার, হাট, মুদি দোকান… দু’টো পয়সা কখনও এধার-ওধার করেনি। ওর পারসোনাল অভ্যেস নিয়ে এতটা মাথা না ঘামালেই হত। আমাদের কারও ক্ষতি তো করছিল না, ও তো কোনও কাউকে ফুঁসলে আনত না, ও তো রেপ করত না, যা করত—নিজেরা। কাগজে তো পড়ছি এ ধরনের রিলেশন’কে স্বীকার করে নিচ্ছে কত দেশে। সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়েও স্বীকৃতি দিয়েছে নরওয়ে, সুইডেন, আরও কী সব দেশ।
অনিকেত বলে—যাক, পুরনো কথা নিয়ে ভাবতে হবে না।
শুক্লা বলে, তা হলে নতুন কথা নিয়ে ভাবি?
অনিকেত বলল, ভাবো…
শুক্লা বলে, মঞ্জুর ছেলেটাকে হেল্প কোরো, অ্যাঁ?
পরির ওপর একটা সফট কর্নার তৈরি হয়েছে, অনিকেত জানে। কয়েকবার এখানে এসেছে। শুক্লা ওর সঙ্গে গল্প করে। পরি এখন রোজগারপাতি ভালই করছে। তবে সার্জারি করে মেয়ে হতে গেলে যা-খরচ, সেটা কি পরির পক্ষে মেটানো সম্ভব? না কি আবার টাকা চেয়ে বসবে?
মঞ্জু যে-চিঠিটা লিখেছিল অনিকেতকে, সেই গোপন চিঠিটা ছাই হয়ে পঞ্চভূতে, মঞ্জুর দেহটারই মতন। মঞ্জু নেই, ওর স্মৃতি আছে। মরুপথে নদীধারা হারিয়ে গেলেও সে-নদী আসলে হারায় না। মঞ্জুর সুইসাইড নোট, যেটা শুধুমাত্র অনিকেতের কাছেই ছিল, পরে যেটা ছাই, যা পরিও জানে না, সেই চিঠিটা অনিকেতের সত্তায় পাথরের মতো। স্মৃতিভার। ‘স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি, ভার মুক্ত সে এখানে নাই’। কিন্তু সেই স্মৃতিভার শরীরের বিনাইন টিউমারের মতোই, পিঠের কুঁজের মতোই, বয়ে বেড়াচ্ছে অনিকেত। এ নিয়ে তেমন কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। স্বপ্নেও বেশি আসেনি মঞ্জু, বরং বেশি এসেছে চাত্তারা, ফুলি, হাসি, ঝুমকো, ময়না…। যাদের শরীর দিয়েছিল অনিকেত, যাদের মুখে কথা দিয়েছিল।
মঞ্জুর মৃত্যুর পর অনিকেত ভেবেছিল—যে-জীবন দোয়েলের, ফড়িং-এর তার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছে। ও আর ইন্দ্রজিৎ নয়, অমল-বিমল-কমল। এবার খুব সাধারণ। বাকি পাঁচ পাবলিকের মতোই জীবন কাটাবে। কোনও ঝুটঝামেলায় থাকবে না আর। অফিসেও কেমন মিইয়ে-যাওয়া-মুড়ি হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া চাইবাসার ঘটনাটা রটেও গিয়েছিল তো…। বাইরের মেয়েছেলেকে অনিকেতবাবু ঘরে লটকে রেখেছিল দেখে ওর স্ত্রী পটকে গিয়েছে…। কত দিন ওর কাজের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে কোনওরকম নাক গলায়নি। এমনকী, কন্যাভ্রূণ ধ্বংস নিয়ে ফিচার করার জন্য ডিরেক্টরের অনুরোধটাও এড়িয়ে গিয়েছে—এরকম বিষয় পেলে লুফে নিত একসময়। একদিন রাস্তায় আইভি-র সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল প্রায়, সেটাও এড়িয়ে গিয়েছে। ওইসব পবন, সঞ্জয়, মানবী, রঞ্জন কারও সঙ্গেই কোনও যোগাযোগ রাখেনি। মাঝেমধ্যে নিজেকে ‘নিজলিঙ্গাপ্পা’ মনে হত। ব্যাসবাক্য হল : নিজেই নিজের লিঙ্গ নিজের পায়ুতে প্রবেশ করিয়েছে। নিজেকে মনে হত হরিপদ কেরানিও নয়, হরিপদ কেরানিরাও ময়দানে বাঁদর খেলা দেখে, চুপি-চুপি জাপানি তেল-টেল কেনে। অনিকেত নিজেকে ভাবত—
টিপিকাল কেরানি
ঝামেলায় যাবনি
বসকে রাখব দূরে
বাজার করব ঘুরে
টিফিন চচ্চড়ি-রুটি
বউয়ের কথায় উঠি।
কিন্তু কবি গাহিয়াছেন ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’। এঁদো ডোবাও ভরাট হয়ে ‘সুখ নিকেতন’ বাড়ি ওঠে, গ্যাজলা স্বপনেরও মুখের ক্ষুরের ক্ষতচিহ্ন মসৃণ হয়ে যায়। কত তদন্ত কমিশন, কত সিবিআই কেস মিশে যায় হাওয়ায়। এক বছরের মধ্যে অনিকেতের মঞ্জু-কেস অফিসের লোক ভুলে যায়, কিন্তু অনিকেত পিঠের কুঁজের মতো, ক্রনিক অম্বলের মতো বয়ে বেড়ায়। কারণ হয়তো সেই গোপন চিঠিটি গিলে ফেলা, যা হজম হয়নি। মঞ্জু মরেছিল পরির কেরিয়ারের জন্যই তো, পরির কেরিয়ার তৈরি হয়েছে। এজন্য একটা প্রশান্তিও কাজ করে। মানুষ তো। সব মানুষেরই কিছু-কিছু সদ্গুণ থাকে। টুকটাক থিয়েটার নাটক দেখতে যায় আবার, মহিলা কলিগদের সঙ্গে আড্ডাও টুকটাক চলে, এক বিয়ার বিলাসিনীকে সঙ্গে নিয়ে দু’এক দিন বিয়ার সেবন, একটু-আধটু গা ঘষাঘষি, হাত ধরাধরি করে ট্রাফিকসংকুল রাস্তা পার হওয়ার পরও হাত না-ছাড়া…। কবে আপনাদের কামনা নিবৃত্তি হয় বলুন তো… বিয়ার বিলাসিনীর উত্তরে বলা—এভাবে দেশলাই মারবেন না প্লিজ, ইন বিল্ট দমকল নেই কোনও… এই সব এসে যায়। যাকে বলে ছন্দে ফেরা। সেটা মোটামুটি হয়ে যায় অনিকেতের জীবনে, তবে তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার চেষ্টাটা থাকে, তবে আগেকার মতো অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয়তা একদম নেই তার। নিজের খোঁড়া ডোবা হয়ে যাওয়া জমিতে এভাবেই সুখ নিকেতন টাইপের বাড়ি ওঠানোর চেষ্টা হয়—ফের অনিকেতের জীবনে।
একদিন মিনিবাসটা ধরবে বলে দৌঁড়চ্ছিল অনিকেত, পিছন থেকে কলার ধরেছে কেউ, নিজেকে সামলে, পিছন ফিরে দেখল আইভি।
—আইভি, তুমি?
আইভি বলল, ন্যাকাপনা রাখো তো, সেদিন তো খুব অ্যাভয়েড করলে, দেখেও দেখলে না। ফোন-টোনও করো না শালা…খুব সতী হয়েছ, না?
অনিকেতের সঙ্গে হাত মেলাল আইভি। যাকে বলে হ্যান্ডশেক। অনিকেত অনুভব করল ওর হাতের চামড়া, নরমই আছে আগেকার মতো। কিন্তু ওর হাতে একটা ট্যাটু, কাঁকড়াবিছের ছবি। আইভি হাতটা ধরে ঝাঁকানো, কাঁকড়াবিছেটাও ঝেঁকে উঠল। আইভি বলল, বলো বস কেমন আছ?
অনিকেত বলে, ভালই তো।
আইভি বলে, চলো বস, কোথাও বসি। চা খাবে, না. কি রাম!
অনিকেত বলে, চা-কফি-টফি…।
আইভি বলে, এত ম্যাদা মেরে গিয়েছ কেন?
অনিকেত বলে, কেন? চা খাব বললাম বলে বলছ?
আইভি বলে, তোমার বডি ল্যাঙ্গোয়েজ-টাই তো বলছে ম্যাদা মেরে গিয়েছ। জাস্টলাইক বাসি নিমকি।
আইভি একটা জিন্স পরেছে, একটা কলার ছাড়া হাফ শার্ট। পকেটে কুমিরের মুখ।
অনিকেত বলে, কেমন আছ আইভি?
আইভি বলে, বিন্দাস। এরপর বলল, ফোন-টোন করোনি কেন?
অনিকেত বলে ফোন-টা হারিয়ে গিয়েছিল….
—দেখি, মোবাইলটা দেখি, তোমার আগের ফোনটা আমার পুরো মনে আছে। রিকশাওয়ালাদের যেমন ফোন হয়, তোমার ফোন-টা সেরকম ছিল।
অনিকেত ফোনটা পাল্টেছিল, ‘নতুন মডেল চাই’ বলে না, আগের ফোনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলে। নতুন ফোন-টা পকেট থেকে বের করে দেখল।
—মিস্ড কল দিচ্ছি, সেভ করো।
‘মিস্ড কল’ দিল আইভি, দেখার কিছু ছিল না, ওর নামটাই তো ফুটে উঠেছিল। অনিকেত ‘সেভ’ করার অভিনয় করল। এ তো খুব ছোট মাপের অভিনয়। আরও কত নিত্য অভিনয় লীলা চালাতে হয় জীবনযাপনে। এসপ্ল্যানেডের অঞ্চলে চায়ের দোকান আর কোথায়, যেখানে আড্ডা মারা যায়।
আইভি বলল, বার-এ চলো, বার-এ…। বলেই চোখ মটকে একটা লাইন গেয়ে দিল – বারে বারে কে যেন ডাকে আমারে…মানবেন্দ্রর গান…। কিন্তু অনিকেত বারে-টারে যেতে চাইছে না, গেলে দেরি হয়ে যাবে, তারপর মুখের গন্ধ দূরীকরণের জন্য কসরত করতে হবে, ঘুরতে হবে এখানে-ওখানে। অনিকেত বলল, না আইভি, তোমার বউদির শরীরটা ঠিক নেই…তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
অনিকেত জানে না, আইভি মঞ্জু—বৃত্তান্ত জানে কি না। জানালে আকাশবাণীরই কেউ জানাবে। অনিকেত জিগ্যেস করল, আমাদের অফিসের কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়?
আইভি বলল—টুকটাক খবর পেয়ে যাই গুরু, একটা ম্যালি কাজ করছ শুনলাম, বাইরে ট্রান্সফার নিয়ে—
—কার কাছে শুনলে—
—সোর্স ডিসক্লোজড করতে নেই গুরু…। বলো, একটু ডিটেল-এ বলো…।
অনিকেত মাথা চুলকে বলে, আজ বললাম না, তাড়া আছে। তুমি কি আগের অর্গানাইজেশনেই আছ?
আইভি বলল, না, দু’বছর হল ছেড়ে দিয়েছি। এখন দুর্গাপুরের একটা এডুকেশন কমপ্লেক্সের আমি চিফ সিকিউরিটি অফিসার। একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, একটা ম্যানেজন্টে কলেজ, একটা ল’ কলেজ—সব একটা ক্যাম্পাসের মধ্যে। পুরো এরিয়াটা আমি দেখি। আমার আন্ডারে ছ-ছ’টা সিকিউরিটি অফিসার, তিরিশটা সিকিউরিটি গার্ড। ওরা সব শিটে কাজ করে। ওদের সকালে ওয়ার্ম আপ করাই, প্যারেড করাই, আমার হাতে ব্যাটন থাকে, ব্যাটন।
অনিকেতের মনে হল, যেন আইভির ঠোঁটের ওপরে হাবিলদারি মোচ তৈরি হচ্ছে। দু’পাশে শুঁড় উঠবে, যাতে ‘তা’ দেওয়া যাবে।
ওরা স্যালুট দেয়।—আইভি বলে।
—সাব-অর্ডিনেট-রা কী বলে, ম্যাম, না স্যর?
খিলখিল হাসে আইভি। হ্যাঁ, খিলখিলই হাসিরও জেন্ডারভেদ আছে। মেয়েদের হাসি খিলখিল, ছেলেদের হাসি হো-হো। ও বলে, ভুল করে কখনও-কখনও ‘স্যর’ বলে দেয়।
অনিকেত বলে, না কি ভুল করে ‘ম্যাম’ বলে?
এবার হো-হো হাসে আইভি।
অনিকেতের কাঁধে হাত দিয়ে বলে—তুমিই আমাকে কিছুটা বোঝো মাইরি।
এসপ্লানেড মেট্রোর সামনে দাঁড়িয়েই ভাঁড়ে চা নেয়।
দুর্গাপুরে তোমার নিজের কোয়ার্টার আছে?—অনিকেত জিগ্যেস করে।
—ইয়েস। থ্রি রুম, টু টয়লেট্স, টু ব্যালকনি। চলে এসো, মুরোদ আছে?
—একাই থাকো?
—একটা কনস্টেব্ল থাকে। আই মিন কনস্টেব্লিনী। মেয়ে কনস্টেবল। কিন্তু বলীনি টাইপের নয়। দারুণ ফিগার মেয়েটার। খুব সুইট দেখতে। ও-ই কিন্তু রান্নাবান্না করে। আমার কোয়ার্টারেই থাকে। কনস্টেল মানে ‘সিকিউরিটি গার্ড’ আর কী।
অনিকেত বলে, এই সেরেছে। তৃপ্তি সামন্ত-সুস্মিতা হালদার কেস হয়ে যাবে না তো?
আইভি ভ্রু নাচাল। বলল, রিলেশনটা অনেকটা ঠিকই গেস করেছ অনিকেতদা, আটার অল ইন্টেলিজেন্ট গাই। খবরের কাগজ আর টিভি মাইরি, ঘরের মধ্যে শুধু নয়, আন্ডারগারমেন্টের ভিতরেও ঢুকে যাচ্ছে। তবে শোনো আমাদের তৃপ্তি কেস’ নয়। আমি শালা মেয়ে, মেন্স হয়, বন্ধ করতে পারিনি। তৃপ্তির মতো ছেলে নই, মে বি হি ইজ আ মেল উইদাউট পেনিস অর উইথ আ মাইক্রোপেনিস। বাট, জেনেটিক্যালি হি ইজ আ মেল। আর ওই মেয়েটা তো ব্ল্যাকমেল করেছিল। আমার তো সে সব চান্স নেই। এই মেয়েটারও স্বামী ছিল, অত্যাচার করত। ওর স্বামী হল কার্পেন্টার, বউ সিকিউরিটি-র লোক, অথচ মেয়েটা নসিকিওর্ড ছিল। মেয়েটার হাতে ডান্ডা ছিল, কিন্তু ছুতোরটার দু’পায়ের ফাঁকে ডান্ডা ছিল, গাবো অনিকেতদা, কোন ডান্ডার জোর বেশি। মেয়েটাকে ওর বর নাকি মারত। মেয়েটা লেছে, ও আগে জানত না ‘আদর’ কাকে বলে…। যাকগে দেরি করাব না, বউদির কাছে ক্ষ্মীছেলের মতো চলে যাও।
যত উল্টোপাল্টা, প্রথাছাড়া ব্যাপার-স্যাপারগুলো অনিকেতের সামনেই এসে পড়ে। ও কী পালে কে জানে? ও এর মধ্যে ঢুকবে না। ও ব্যাপারটা সাম-আপ করে নিল। ও বুঝল—এটা লসবিয়ান কেস। আইভি পুরুষ নয়, মেয়েই, তবে একটা ছেলেত্ব আছে। একটা পেনিস- সিনাও আছে। তবে ও ট্রান্সজেন্ডার হয়তো নয়, ক্রশড্রেসার বা ট্রান্সভেসটাইট। বিপরীত াজসজ্জাকামী। এবং ‘টপ’ লেসবিয়ান বা অ্যাকটিভ লেসবিয়ান। লেসবিয়ান রিলেশনের সময় অ্যাকটিভ পার্ট নিতে পছন্দ করে। আর ওর ওই সিকিউরিটি গার্ড-টি শুধু স্বামীর অত্যাচারেই ামী ছেড়ে আইভির সঙ্গে শোয়—তা নয়। ওই মেয়েটিও লেসবিয়ান। ‘ফায়ার’ বলে যে- নেমাটা এসেছিল, ওখানে দেখানো হয়েছিল একটা মেয়ের স্বামী ওকে পাত্তা দিত না, ব্যবহার করত বলে ওর ননদের সঙ্গে শরীর সম্পর্কে গেল—ওটা কিন্তু ঠিক নয়, ওদের মধ্যে প্ত লেসবিয়ানিজম না-থাকলে ওরা শরীর ‘শেয়ার’ করত না। কেইনস-এর স্কেলে ওরা কেউ ক-দুই ইউনিটে ছিল না। ৪/৫-এ ছিল। আর তৃপ্তি সামন্ত আর সুমিতা হালদারের সম্পর্ক লসবিয়ান কেস নয়, হেট্রো-সেক্সুয়াল কেস। তৃপ্তি তো ছেলেই। কম-কম ছেলে। ফিটনেস ড়ানোর জন্য যে-হরমোন নিত, সেটাই ওর ছেলেত্বকে জাগিয়েছিল। একটি মেয়েকে কাছে াওয়ার চেষ্টা করেছে। তারপর ওই মেয়েটা সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করেছে। যা কিছু ল্টোপাল্টা কেস, ওর জীবনেই এসে জুটছে।
‘উল্টোপাল্টা’ কেস মানে কী? আনকমন? না কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ? টর্নেডো তো উল্টোপাল্টা কস, কিন্তু টর্নেডো কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ? অল্প এলাকার ওপর দিয়ে বহে যায়, তছনছ করে, কিন্তু কৃতিরই তো অঙ্গ এটা, বাইরে তো নয়…। আমরা বেশির ভাগই তো ডানহাতি। বাঁহাতি, ানে ন্যাটা যারা, ওরা কম, প্রকৃতিবিরুদ্ধ তো নয়। সেই কবে পবন ধল, গে অ্যাকটিভিস্ট, লেছিল গোলাপ ফুলকে সবাই ভাবে ‘পিঙ্ক’-ই হবে। ‘ইয়ালো রোজ’ কি হতে পারে না? লদে গোলাপ? এটাও তো প্রকৃতিতেই আছে।
কিছু দিন আগে একটা আর্টিকেল পড়ছিল অনিকেত, হোমোসেক্সুয়ালিটি-র একটা ব্যাখ্যা,। ডারউইনের তত্ত্বকে সমর্থন করে। পাঁচ-সাত বছর আগে হলে ওসব লেখা কেটে রাখত বা জরক্স করে রাখত। লেখাটার সার পদার্থ হল : পতঙ্গ জগতে স্টেরাইল ওয়ার্কার থাকে। যেমন মিক পিঁপড়ে, শ্রমিক মৌমাছি। এরা বন্ধ্যা সৈনিক। এরা সন্তান জন্ম দেয় না, কিন্তু সমাজের াজে লাগে। ওর শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করে, খাবার জোগাড় করে, পাহারা দেয়। আদিম মাজে এইসব মেয়েলি পুরুষেরা বংশবৃদ্ধির কাজে লাগায়নি নিজেদের, বরং সেবা-র কাজে লাগিয়ে বংশরক্ষা করতে সাহায্য করেছে। যখন আদি সমাজের পুরুষেরা শিকারে বা খাদ্য সংগ্রহে যেত, তখন এই ‘গে’-চাচারাই শিশু এবং মহিলাদের দেখভালের দায়িত্ব নিত। এদেরই রবর্তী ধাপ হল খোজা প্রহরী। ঠাকুমাদের কাছে কুমড়ো-কাটা ভাসুর ঠাকুরদের গল্প শুনেছে অনিকেত। একান্নবর্তী পরিবারে এমন দু’-একজন থাকত, যারা বিয়েটিয়ে করত না। মেয়েলি চালচলন, অথচ ব্যাটাছেলে বলে বউমাদের সঙ্গে গল্পগাছাও করতে পারত না, বউরা ওদের কাছেই আসত চালকুমড়োটা দু’-আধখানা করার জন্য। মেয়েদের চালকুমড়ো কাটতে নে কিনা। ওই লেখাটারই শেষকালে ছিল ইতালির একটা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যেসব পরিবা সমকামী পুরুষ আছে সেসব পরিবারের মেয়েদের ফার্টিলিটি বিষমকামী পরিবারের চে বেশি। মানে দাঁড়াচ্ছে, যে-জিন মেয়েদের ফার্টিলিটি বাড়ায়, সেই জিনই ছেলেদের মে সমকামী প্রভাব ছড়ায়। ডিন হ্যামারও বলেছিলেন, ‘The same gene that causes men like men also causes women to like men.’ যে ‘দুষ্টু’ জিনটা ছেলেদের বলে ছেলেদে কাছে যাও, সেই জিনটাই মেয়েদেরও বলে ছেলেদের কাছে যাও।
সবই জানে, মোটামুটি বুঝেও গিয়েছে, তবুও যেন মনে হয় এসব কেস না-হলেই ভা হত। হয়। জোড়া কলা, সাদা কাক, শীতের শিলাবৃষ্টির মতো এসব ঘটনা ওর জীবনে এ পড়ে। আজ আবার পরি আসার কথা আছে। আসুক, এলে ঝামেলা ঠিকই। কিন্তু ধূ ক্যানভাসে কিছুটা আঁচড় পড়ে।
.
বিকেলে পরি এল। আসার কথাই ছিল। জিনসের ওপর একটা মেরুন পাঞ্জাবি, কি পাঞ্জাবির গলাটা বড়, একটু নামানো, বুকপকেট নেই, তার ওপর একটা জয়পুরী কাজে জ্যাকেট, গোল-গোল কাচ বসানো। দু’কানের লতিতে মুক্তো। বেশ লাগছে। শুক্লাে অনিকেতকে নিচু হয়ে প্রণাম করল। অনিকেত দেখল ওর পিঠে ব্রা-স্ট্র্যাপের উদ্ভাস। চে ফিরিয়ে নিল। মঞ্জুর অন্তিম কাজের দিনটা মনে পড়ল। কিছুতেই খালি গা হবে না। পরে গাম জড়িয়ে…। জল-ভরা বেলুন বা স্পঞ্জ ভরা ব্রা হলে ঠিক আছে। ইস্ট্রোজেন নেয়-টেয় না তে
আপনাকে অনেক ভাল দেখছি কাকিমা… পরি বলে।
তোমাকে তো ভাল দেখাচ্ছে—শুক্লা বলে।
স-ও-ও-ত্তি? পরি উচ্ছ্বসিত।
তোমার জামার ডিজাইনটি বুঝি তোমার?—শুক্লা জানতে চায়।
—হ্যাঁ, আমিই করেছি। ভাল হয়েছে?
—খুব মানিয়েছে।
—পরি মাথা নিচু করে কমপ্লিমেন্ট-টা গ্রহণ করল, ‘থ্যাঙ্কস’ শব্দটা উচ্চারণ করল না।
বাবা কেমন আছেন এখন?—অনিকেত জিগ্যেস করে।
—লিম্ফোমা-ই। নন-হজকিন বলছে। নন-হজকিনের নাকি অনেক রকম টাইপ আে কোনও-কোনও টাইপ নাকি পাঁচ-সাত বছর বেঁচে যায়। এটা খুব ভাল টাইপের নয়। জ্বর হে মাঝে-মাঝে। কেমোথেরাপি করাতে হবে।
অনিকেত বলতে যাচ্ছিল, সে তো অনেক খরচার ব্যাপার। জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল, মায়ের গয়নাগাটির কিছু অবশিষ্ট আছে কি না, চেপে গেল।
শুক্লাই কথাটা পাড়ল। টাকাপয়সার সমস্যা হলে বোলো…যতটা পারি…।
পরি এবার ‘থ্যাঙ্কস’ শব্দটা বলল। তারপর বলল, ওসব হয়ে যাবে।
তা হলে তো ভালই। শুক্লা বলল। খুব ভাল চাকরি করছ। মা দেখলে কত খুশি হত. এবার বিয়েটিয়ে করো…মিষ্টি করে হাসল শুক্লা।
—আমিও তাই ভাবছি…।
পরির এ ধরনের উত্তরটা বোধহয় আশা করেনি শুক্লা। ওর মুখের হাসির ম্যাগনিচিউড কমে গেল।
বলল, মেয়ে ঠিক করছ? বলেই শুক্লার মনে হল, কথাটা ঠিক হয়নি, যেন আগের কথাটা কেটে দিয়ে বলল, পার্টনার, পার্টনার ঠিক করেছ? সে কি চয়ন? উম্?
পরি কুড়ি পার্সেন্ট আনন্দ, তিরিশ পার্সেন্ট লজ্জা, আর পঞ্চাশ পার্সেন্ট রহস্য মেশানো, চোখে-ভ্রুতে মুখের পেশিগুলোয়, টিস্যুগুলোয়, মাথাটা ওপর-নীচ নাড়াল দু’বার।
শুক্লা অভিব্যক্তি গোপন করতে শিখে গিয়েছে? না কি গোপন নয়, পরিবর্তন? শুক্লার কপাল কুঁচকে গেল না, কপালে ভাঁজ পড়ল না। হাল্কা হাসিটা ঠোঁটে-মুখে ছিল, ফেড-আউট হতে কয়েক সেকেন্ড লাগল।
—ভালই তো, ভালই তো, শিক্ষিত ছেলে…। শুক্লা দাঁতে ঠোঁটটা কামড়াল।
এবার বলল, আমাদের দেশে কি এরকম রেজিস্ট্রি হয়? ছেলে-ছেলেতে?
অনিকেতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা আলতো করে রাখল।
পরি বলল, এজন্যই তো মেয়ে হতে হবে আগে। সার্জারি করতে হবে। বাবার কেমো-টা হয়ে যাক, দেখি কেমন থাকে, তারপর…।
—খুব তো কাটাছেঁড়া…খুব কষ্ট হবে তো….
শুক্লাকে সত্যিই উদ্বিগ্ন দেখাল।
—না-না। অজ্ঞান করে তো…। অনেকেই তো করেছে। শুক্লা কিছু বলে না। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে—সবার ভাল হলেই ভাল বাবা…। যেন সকালের ডায়েরির লাইনটাই বলল, ‘সর্বে ভবন্তু সুখীনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ’।
—কেমোটা কোথায় করাব? ঠাকুরপুকুর ভাল?
পরি জিগ্যেস করেছিল।
তোমার ডাক্তার কী বলছে?
নিনার স্বামীর পরিচিত ডাক্তারকে দেখাচ্ছিল পরি। দু’-তিনটে নার্সিং হোমের সঙ্গে যুক্ত।
পরি বলল, ডাক্তার তো নার্সিং হোমের কথা বলছে…অনেক খরচ।
অনিকেত বলল, চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে কার্ড করিয়ে নাও। ঠাকুরপুকুরও ভালই।
—চেনা আছে?
অনিকেত বলল, দেখছি।
পরিকে একটু এগিয়ে দিতে গিয়ে অনিকেত বলল, সত্যি-সত্যিই তুমি ‘এসআরএস’ করতে চাও?
পরী বলে, হ্যাঁ।
—মনস্থির করেছ?
পরি বলে, ডিসাইডেড।
যাকগে মরুক গে, বলে, ওর পাঁঠা ও ল্যাজে কাটবে না গলায় বলে ব্যাপারটা ছেড়ে দিতে পারছে না অনিকেত। মঞ্জু যে-চিঠিটা লিখেছিল, যে-চিঠি পঞ্চভূতে, কিন্তু সেই চিঠির আত্মাটা যেন ঘুরে ঘুরে আসে—’ছেলেটাকে দেখিস।’
সন্ধের পর কম্পিউটারে বসল অনিকেত। গুগলে টাইপ করল ‘সেক্স রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি’। অনেক রকম সাইট এল। কেউ-কেউ এরকম সার্জারি করে থাকে, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, লস অ্যাঞ্জেলেস, প্যারিস এসব জায়গার হাসপাতাল এবং বিশেষজ্ঞদের নাম ধাম চলে এল। ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন ভেসে এল ম্যাসাচুসেট্স থেকে মুকুন্দপুরে। ‘We rearrange alphabets, Lemon to Melon.’ লেটারগুলো একটু এধার-ওধার করে দিলেই লেবুকে তরমুজ করা যায়। ভেসে এল কোনও ভ্যাজিনোপ্লাস্টির স্পেশাল ক্লিনিক সফ্ট অ্যান্ড স্লিপারি, যারা কৃত্রিম যোনিপথে কোন টিস্যুর গ্রাফটিং-এ পারদর্শী। যারা যোনিপথ মসৃণ করবে। কোলন তো নাড়িভুঁড়ির একটা অংশ, যেখানে মল জমা থাকে। কোলন টিস্যুও কাজে লাগে? জানত না অনিকেত। ওয়েবসাইটগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখল, এশিয়ার মধ্যে তাইল্যান্ডের পর সবচেয়ে বেশি ‘এসআরএস’ হয় ইরানে। এ কী কথা? ওখানে দুই পুরুষের শরীর মিলন, বা সাদোমি তো মারাত্মক অপরাধ। জানা গেল আয়াতুল্লা খোমেইনি ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, ‘সাদোমি’ অপরাধ, কিন্তু কোনও পুরুষ যদি নারীতে পরিণত হয় তা হলে সেটা আর ‘সাদোমি’ হয় না। এজন্য ইরানের বিভিন্ন ক্লিনিকে এই সার্জারি হয়।
পুরুষ নারী হতে পারে এরকম গল্প ভারতের পুরাণ-কথায় যেমন আছে, সেমিটিক পুরাণে, বা লোককথায় আছে। নারদ-ও তো বিষ্ণুর মায়ায় এক সরোবরে অবগাহন করে স্ত্রীরূপ প্রাপ্ত হয়েছিলেন, এবং তালধ্বজ রাজার স্ত্রী হয়েছিলেন। তালধ্বজ রাজাকে সন্তান দিতে পারেননি। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে, ভীষ্ম রাজা ভঙ্গাসনের কথা বলেছিলেন, যে-পুরুষ হয়ে জন্মেছিলেন শতপুত্রের জনক ছিলেন, একটা সরোবরে স্নান করে নারীতে পরিণত হলেন, ঘরে ফিরলেন না আর, এক ঋষির স্ত্রী হলেন, এবং অনুভব করলেন, মিলনকালে নারীর স্পর্শসুখ অধিক হয়। রামায়ণে রাজা ‘ইল’-এর কথা আছে, ইল রাজা মৃগয়া করতে তখন গভীর জঙ্গলে। সেই জঙ্গল গভীরে হর-গৌরী কামরত। মহাদেব স্ত্রীরূপ ধারণ করে গৌরীর সঙ্গে লীলা করছেন। মানে, মহাদেবেরও একটু লেসবি-লীলা করতে শখ হয়েছিল আর কী। মহাদেব যখন স্ত্রীরূপ ধারণ করেছিলেন, তখন মহাদেবের ইচ্ছায় বনের সমস্ত পশুপাখির জেন্ডার পাল্টে গিয়েছিল। সবাই ফিমেল। রাজা ইল-ও নারী হয়ে গেল। তারপর মহাদেবের সাধনা করে পুরুষত্ব ফিরে পেতে চাইল, কিন্তু মহাদেব খেয়ালি লোক, বললেন, ঠিক আছে, একমাস পুরুষ এবং একমাস নারী। সেটাই মেনে নিতে হল রাজ ইল’কে। আশ্চর্য বটে।
৬৬
ডা. তীর্থঙ্কর বসুর চেম্বারে নয়, বাড়িতেই গিয়েছে পরি। নিনা বলল, তোমাদের ডিপ-পার্সোনাল কথাবার্তার মধ্যে আমি নেই। এটাও এক রবিবারের বসন্ত-সকাল। স্প্রিং। নিনা একবার এসে জিগ্যেস করল—চা, না কফি? পরি বলল, চা। সজনেফুলের বড়া খাবে? পরি দু’দিকে মাথা নাড়াল আহ্লাদে। স্প্রিং ফ্রাই করতে পারবে? স্প্রিং ফ্রাই? কোকিলের মৃদুস্বর শোনা গেল দশ তলার ওপরে। মানে? নিনা ঘাড় কাত করে জিগ্যেস করে।
—মানে, ‘চিকেন স্প্রিং ফ্রাই’ আনালে না কাল? দ্যাখো না সজনেফুলেরও যদি স্প্রিং ফ্রাই হয়…।
আহা, একে বলে সংসার-সুখ!
—দেখুন, ‘এসআরএস’ করতে গেলে ধাপে-ধাপে করতে হয়। ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি, দরকার হলে অ্যাবডোমেনোপ্লাস্টি, ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট, কেউ আবার ‘জ’ মানে চোয়ালও ঠিকঠাক করে নেয়।
আগে ‘ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট’-টা বলি। এটা খালি ট্রান্সজেন্ডার’রাই করে তা নয়, CIS জেন্ডাররাও করে। ও, ‘CIS জেন্ডার’ মানে হল ‘বায়োলজিক্যাল সেক্স’ আর ‘মেন্টাল ওরিয়েন্টেশন’ যাদের এক, মানে, সে নিজেকে যে-সেক্স মনে করে, তার সঙ্গে যদি নিজের সেক্স অর্গ্যান ম্যাচ করে যায়। যেমন আমি, যেমন নিনা। CIS জেন্ডাররাও কসমেটিক সার্জারির পার্ট হিসেবে ‘ব্রেস্ট অগমেন্টেশন’ করে। কেউ বড় করে, কেউ ছোট করে, ব্যাপারটা বুঝে নিন, তারপর ফাইনাল ডিসিশন। ওকে?
বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়ায় পরি। এরপর বলে, আপনি কেন, তুমি বলবেন, হ্যাঁ?
একটা প্যাডের কাগজে ছবি আঁকে তীর্থঙ্কর। একটা স্তন। তারপর নিজেই বলল, দু’টো না- হলে ভাল দেখায় না, না? স্তনে ছোট গোল বৃত্তে অ্যারিওলা দিল, বিসর্গ চিহ্নকে দু’ভাগ করে দু’টো নিল বসাল। স্তনবৃত্ত।
তীর্থঙ্কর বলল, হাওয়ায় বেলুন বাড়ে। তাই তো?
পরি ঘাড় নাড়ায়। ও জানে, জলেও বাড়ে। জলের বেলুন একটু অন্যরকম। মোটা। ‘ইলু’ বলে। ব্যবহার করেছে কত…!
তীর্থঙ্করের ডটপেনের সূচিমুখ স্তনের উপরে।
—এটাকে বাড়াতে হলে ভিতরে, মানে চামড়ার ভিতরে, কিছু ভেজাল দিতে হবে, এমন ভেজাল, যার কনট্যাক্টে শরীরের কোনও ক্ষতি হয় না। ঠিক চামড়ার তলায় একটু ফ্যাটের আস্তরণ থাকে মেয়েদের। ছেলেদের তেমন থাকে না। বুকের চামড়া এবং ফ্যাটের তলায় সেই ‘ভাল’ ভেজালটা ঢোকাতে হবে। ওই ভেজাল-টাকে বলে ‘ইমপ্ল্যান্ট্স’।
কাগজের ওপর তীর্থঙ্কর লিখল ‘ইম্প্ল্যান্ট্স’।
—মোটামুটি তিনরকম ইমপ্ল্যান্ট হয়। স্যালাইন, সিলিকোন, আর কম্পোজিট। ‘কম্পোজিট’ মানে মেশানো। সয়া তেল-ও ব্যবহার হত। ১৯৮৫ সালের আগে ‘ব্রেস্ট ইম্প্ল্যান্ট’ করতে ‘অ্যাডিপোজ টিস্যু’, মানে, চর্বি ব্যবহার করা হত। তারও অনেক আগে, বুকের চামড়া কেটে হাতির দাঁতের তৈরি বাটি ঢুকিয়ে দেওয়া হত। এরপর ‘প্যারাফিন’ ইনজেকশন করেও ব্রেস্ট অগ্মেন্ট করার চেষ্টা হয়েছিল, খুব খারাপ রেজাল্ট। আমি কিন্তু ‘স্যালাইন ওয়াটার’ কিংবা সিলিকোন জেল ইউজ’ করি। সিলিকন নয় কিন্তু। সিলিকন তো একটা মেটাল, আর সিলিকা, মানে ‘সিলিকন ডাই-অক্সাইড’ হল বালি। ‘সিলিকোন’ হল ‘ডাইমিথাইল সিলোক্সেন’-এর পলিমার। নরম, ইনার্ট। রক্ত বা হিউম্যান টিস্যুর কোনও ক্ষতি করে না। আর এমনি জল না-দিয়ে নুন জল কেন? যেন রক্তের সঙ্গে ম্যাচ করে। রক্তও নোনতা কিনা। নুন জলে খরচ কম, সিলিকোনে খরচ বেশি। সিলিকোন-ই ভাল, ন্যাচারাল ব্রেস্টের মতোই ‘লুক’।
ফিলিং? পরি জিগ্যেস করে।
—’ফিলিং’ একইরকম। স্কিনের তলায় তো ইম্প্ল্যান্ট যাচ্ছে। স্কিনেই তো নার্ভ নেটওয়ার্ক থাকে, তাই ‘ফিলিং’ নিয়ে প্রবলেম নেই।
তীর্থঙ্কর বলল, ইম্প্ল্যান্ট তো দেব, কিন্তু কীভাবে? ইনজেকশন করে? না। একটা কন্টেনার-এর মধ্যে ইম্প্ল্যান্ট’ ইনপুট করা হয়। প্রথমে আমরা প্রতিটি ব্রেস্টের তলায় ‘কন্টেনার’ ঢুকিয়ে দিই। এই ‘কন্টেনার’-কে বলা হয় ‘এলাস্টোমার’। আমরা বলি, ‘স্যাক’। এই ‘স্যাকগুলোও ভাল পলিমার। ভিকো ইলাসটিক। এখন তো আরও ভাল ‘স্যাক’ বেরিয়ে গিয়েছে—লং চেন প্রোটিন। ১৯৬০ থেকে আজ পর্যন্ত এই ‘স্যাক’-এর পাঁচটা জেনারেশন হয়ে গেল। সেই ‘রবার স্যাক’ থেকে শুরু।
ভাজা হয়ে গিয়েছে বউদি…একটা গলা শোনা গেল।
তার মানে নিনা নয়, কাজের মেয়েটা বড়া ভেজেছে। কিন্তু সুন্দর প্লেটে সুন্দর ট্রে করে নিয়ে এল নিনা। নিতান্ত দেশি সজনেফুলে বিঁধে আছে বিদেশি ফর্ক।
ওকে কাউন্সিলিং করছ, না জ্ঞান দিচ্ছ? নিনা বলে। জ্ঞান দেওয়ার চান্স পেলেই হল…।
ফর্কে কেটে বড়া মুখে দিল পরি। ‘বিউটিফুল’ বলতে গেল, ঠিক মানাচ্ছে না, বলল, অ’সাম, অ’সাম। আর বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী জোড়া লাগিয়ে দু’বার ঝাঁকাল।এবার চা।
তীর্থঙ্কর বলল, ডাক্তার ‘স্যাক’-টা প্লেস করার আগে বড়-বড় ফিল্মস্টারদের, মডেলদের জিগ্যেস করে নেয়—টাবা, না টুবা? আমাদের টাবা-টুবায় দরকার নেই, তাই না?
নিনার দিকে তাকিয়ে একটু ফিচেল হাসল তীর্থঙ্কর।
পরি কিছু না-বুঝে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। নিনা বোধহয় কিছু বুঝেছে। ও নিশ্চয়ই সুডৌল বুক বানিয়েছে টাবা-টুবা করে।
পরি’র তাকানো দেখেই তীর্থঙ্কর বলল, সব ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। TABA হচ্ছে ‘ট্রান্স- অ্যাক্সিলারি ব্রেস্ট অগ্মেন্টেশন’। বগলের তলায় কাটা হয়, ওখান দিয়েই সুড়ঙ্গ করে বুকের চর্বি-চামড়ার তলায় ‘স্যাক’-টা ঢোকানো হয়। তা হলে, কাটা দাগটা একদম বোঝা যায় না। আর TUBA হল ‘ট্রান্স অ্যাম্বিলিক্যাল ব্রেস্ট অগ্মেন্টেশন’। মানে, বেলি বট্-এর গর্ত দিয়ে যন্তর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ‘বেলি ব’ মানে নাভি। অ্যাম্বিলিক পয়েন্ট। এখানেই জন্মের সময় নাড়িটা কাটা হয়। নাভির ইনোসেন্ট গর্তটা ব্যবহার করা হয়। কারও কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই। আমি এটা করি না। ‘টাবা’ করেছি, টুবা’ করিনি কখনও। IMF-ই ভাল, সহজ, তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। IMF হল ইন্ট্রা-ম্যামারি ফোল্ড। বুকের তলায়। মানে, স্তনের তলায় কেটে ভিতরে বুকপকেট বানাতে হয়, সেই পকেটে ইমপ্ল্যান্ট ভরে দেওয়া। ‘বুকপকেট’ বানানোটাই আসল বাহাদুরি, আর কত ছোট করে কাটা যায়, যেন স্কার, মানে, কাটা দাগটা একদম বোঝা না যায়। স্তনের তলায় দিকে যে-ভাঁজটা, ওখানে কাটলে দাগটা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, স্তনটা একটু ঝুলে থাকে তো? ওপরের দিকে ঠেলে তুললে তবে স্কার-টা বোঝা যেতে পারে। ওটাও চায় না অনেকে, তাই ‘টাবা’। আর কেউ-কেউ NAC এরিয়াতেও ইনসারশন দেয়। NAC মানে ‘নিল অ্যারিওলা কমপ্লেক্স’, ছোট করে ‘ন্যাক’। ছবিটা দেখায় তীর্থঙ্কর। স্তনবৃত্তকে কেন্দ্র করে একটা বৃত্ত। ও বলে, এই অ্যারিওলা স্কিন কালারের তুলনায় অনেক ‘ডার্ক’ হয়। ফরসাদের গোলাপি, শ্যামলাদের কালো। একটু শ্যামলা মেয়েদের ‘ন্যাক’ এরিয়াতে ‘স্কার’ থাকলে তেমন কিছু বোঝা যায় না। তবে ‘মিল্ক ডাক্ট’ একটু ড্যামেজ হতে পারে। ছেলেদের তো আর ‘মিল্ক ডাক্ট’ রাখার ব্যাপার নেই। তা হলে কিন্তু একটা প্রশ্ন হতেই পারে, ছেলেদের কেন ছোট হলেও নিপ্প্ল আছে, অ্যারিওলা আছে?
পরি মনে-মনে বলে, ভাগ্যিস আছে…!
তীর্থঙ্কর বেশ ফ্রেশ মেজাজে আছে। ইতিমধ্যে দু’টো ফোন এসেছিল, কেটে দিয়েছে। এবার ‘অফ’ করে দিল।
তীর্থঙ্কর বলল, একটা গল্প বলি। একটা গাড়ির শো-রুমে গাড়ি বিক্রি হচ্ছে। আধুনিক গাড়ি। সব কিছু অটোমেটিক। সুইচ টিপলেই স্টার্ট হয়। গিয়ার-টিয়ার সব অটোমেটিক। গাড়ির সঙ্গে ফ্রিতে কিছু অ্যাক্সেসারিজ দিয়েছে : বাল্ব, টায়ার, রেচ… সঙ্গে একদা ‘দ’-এর মতো লোহা। ওটা স্টার্টার। ছোটবেলায় দেখেছি—লরি-টরি স্টার্ট না-হলে সামনে ওই ‘দ’-এর একটা মাথা গাড়ির ইঞ্জিনে ঢুকিয়ে, অন্য মাথাটা ধরে ঘোরাতে। দু’-তিনবার ঘোরালেই গাড়ি স্টার্ট দিত। ওই প্রিমিটিভ স্টার্টার টা দেখে এক খদ্দের বলল, এ গাড়ি আমি নেব না, মাঝপথে গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলে ‘দ’ ঢুকিয়ে আমি গাড়ি স্টার্ট দিতে পারব না।
সেল্সম্যান বলল, সেই প্রশ্নই উঠছে না। এ গাড়ির স্টার্ট তো সুইচে হয়।
—তবে দ-টা দিচ্ছেন কেন? নিশ্চয়ই দরকার হয়। রাস্তায় নেমে ‘দ’ মারতে পারব না।
সেল্সম্যান বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘দ’ মারার কোনও প্রশ্নই নেই। খুব ভাল গাড়ি এটা, আসলে এটা ‘ট্রাডিশন’। একশো বছরের পুরনো কোম্পানি। প্রথম থেকেই গাড়ির সঙ্গে ‘দ’ দেওয়া হত। সেই ট্রাডিশন টা রয়ে গিয়েছে। এটা একটা একি ব্যাপার ছাড়া অন্য কিছু নয়। খদ্দেরটা বলছে, ওসব শুনব না। ‘দ’ যখন গাড়ির সঙ্গে দিচ্ছেন, নিশ্চয়ই এটার ব্যবহার হবে।
সেল্সম্যান তখন বলল, স্যর, কিছু মনে করবেন না। আপনার বুকের দু’পাশে দু’টো নিপ্ল আছে। ছোট হলেও আছে। কোনও দিন কোনও কাজে লাগবে? আপনি কি আপনার বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবেন কোনও দিন? তা হলে কেন আছে? একি বিউটি।
তারপর খদ্দের কনভিন্সড হল।
তীর্থঙ্কর এবার বলল, ভগবান বলো, প্রকৃতি বলো, ওরা জানে, ছেলেদেরও এটা দরকার হয়ে যেতে পারে, যেমন তোমার দরকার হচ্ছে পরি। ওই ছোট্ট অ্যারিওলা আর নিল আছে বলেই তো বাড়ানো যাচ্ছে। প্রকৃতি জানে, কখনও নিশ্চয় কোনও ছেলে মেয়ে হতে চাইবে। যার জন্য ছেলেদের বুকেই সেনসেশন দিয়েছে। তাই না?
পরি ঘাড় নেড়ে সমর্থন করে। চয়নের কথাও মনে পড়ে।
তীর্থঙ্কর বলে, পরি, তোমার ব্রেস্ট শেপ-টা দেখে নেব। না, এখন নয়, পরে। বুকটা ফুলে উঠে যখন একটু ঝুলে যাবে, স্কার মার্কটা একদম ঢেকে দেবে।
কেন? ঝুলে যাবে কেন? পরির কথাটা পছন্দ হয় না।
—ও গড! একটু ঝুলবে না? গ্র্যাভিটেশন নেই? একটুও না-ঝুললে তো নিউটন ফেল। তাই না?
ঘাড় নাড়ায় পরি। ওর মনে ‘পীন্নোনতা পয়োধরা’ শব্দটার একটা ‘ইমেজ’ ছিল। দেবীমূর্তিদের পয়োধর সমুন্নতই দেখেছে যে…।
তীর্থঙ্কর বলে, ‘ইনসিশন’ দিয়ে ‘এলাস্টোমার’ বা ‘স্যাক’-টা ইনসার্ট করে সিলিকোন জেল ইনজেকশন করে দিতে একটা ব্রেস্টের জন্য দেড় ঘণ্টা সময় ‘এনাফ’। আর ব্রেস্টটা কত বড় হবে, সেটা ৩২, ৩৪, ৩৬ সাইজ হিসেবে করা হয় না, মানে ইঞ্চিতে নয়, সিসি-তে। 350 cc, 450 cc, 600 cc এরকম। একটা মানানসই ভল্যুমের জেল দেওয়া হয়। তারপর ‘ন্যাক এরিয়া ম্যানেজমেন্ট’। মেয়েদের নিয়ে সমস্যা নেই, ওদের অ্যারিওলা, নিপ্প্ল সব থাকে। অ্যারিওলা- র মধ্যে ছোট-ছোট ফুসকুড়ির মতো যেটা থাকে, তার নাম ‘মন্টগোমরি বাড্স’। ছেলেদের জন্যই বুদ্ধি খরচা করতে হয়। আগেকার দিনে অ্যারিওলা-টা বড় করার জন্য ব্রাউন কালারের ‘ট্যাটু’ করে দেওয়া হত। চামড়া পুড়িয়ে যে-ট্যাটু, সেটা থেকে যায়। এখন তো কসমেটিক ট্যাটু’তে চামড়া’ পোড়ানো হয় না। তবে এমন সব রং আছে, দু’বছর থেকে যায়। ছেলেদের ‘ন্যাক’ এরিয়াটা ছোট হয়। কিন্তু একটু বাম্প করিয়ে দেওয়া যায়। মানুষের কনুইয়ের চামড়াটা অনেকটা অ্যারিওলা-র মতোই দেখতে। বিদেশে অনেকে কনুইয়ের চামড়াটা গ্রাফ্ট করে। সমস্যাটা নিপ্প্ল নিয়ে। নিপলের তলায় অন্য টিস্যু ভরে দেওয়া যায়, ফোর টু সিক্স মিলিমিটার উঁচু করা যায়, কিন্তু নর্মাল নিপ্প্ল সাইজ এইটু টু টেন মিলিমিটার। তবে স্টিফ্ করানো মুশকিল। উত্তেজনায় নিল স্টিফ হয়ে যায় না? ইরেক্টাইল টিস্যু আমরা পাব কোথায়? বিদেশে পেনিস গ্লাস নিয়ে চেষ্টা হয়েছে, সাকসেসফুল-ও হয়েছে। ‘পেনিস গ্লান্স’ হল ‘টিপ অফ দি পেনিস’। লাল মতো জায়গাটা। যারা পেনেক্টমি করে, মানে পেনিস ‘রিমুভ’ করে, ওদের গ্লান ইউজ করা যায় নিপ্ল বানাতে। কী দরকার বাবা? বাইরে বেরনোর সময় বাংলা নিপ্ল বসিয়ে দাও ভাল রবারের, রিমুভ করা যায়, চেঞ্জ করা যায়, নাকের নথের মতো। ব্যস।
সব নিয়ে মাত্র দু’ঘণ্টায় হয়ে যাবে? পরি জিগ্যেস করে।
—আবার কী? সিম্পল তো। কমপ্লেক্স করলে কমপ্লেক্স।
—কেমন খরচ?
—ভাল পলিমারের এলাস্টোমারে সিলিকোন জেল দিয়ে ‘আইএমএফ’ করলে পঁচাত্তর হাজারেই করে দেব। সকালে ভর্তি হবে, বিকেলে বাড়ি যাবে। ব্যস।
—ব্যস?
এই তো ব্যাপার। পরি ভাবে। অথচ যারা ব্রেস্ট করিয়েছে, ওরা কত না ফাট মারে। ব্রেস্ট তো নয়, বুঝ বলতে হয়, বুঝ। পরি বলে দোতলাটা বুঝলাম। একতলা?
তীর্থঙ্কর বলে, আর একদিন।
—থিওরিটিক্যাল ক্লাসটা আজই হয়ে যাক না।
—একতলাটাও করবে না কি?
—ভাবছি তো।
—তোমার বাবার টাক ছিল?
—টাকের সঙ্গে কী সম্পর্ক?
—সম্পর্কটা হল, বাবার টাক থাকলে ছেলেরও টাক পড়তে পারে। টাকটা সাধারণত ছেলেদেরই হয়। এত কষ্ট করে সব কিছু করা হল, তারপর টাক পড়তে শুরু করল। তারপর উইগ পরো…।
—আমার বাবার টাক ছিল না। এখন চুল নেই। সে অন্য কথা। ‘উইগ’ পরলে ক্ষতি কী? সাজার জিনিস তো। আই ল্যাশ লাগানো যায়, স্পঞ্জি প্যাড লাগানো যায়, উইগ কী দোষ করল…।
—তবে তো ঠিকই আছে। মনের সায় হলেই হল। ‘উইগ’ পরলে অনেকের মাথা গরম হয়ে যায়।
—আমার কিন্তু দেখলেই…
শেষ বাক্যটা জোরে।
বাইরে থেকে নিনার গলা—কোনও ছেলেকে চুল ডাই করতে দেখলেও আবার আমার মাথা গরম হয়ে যায়।
এই তো সংসার। পরির মনে হয়। সংসার সুখের হয় দু’জনের গুণে। কী মিষ্টি খিটিমিটি।
—এই অপারেশনটাকে ‘ভ্যাজিনোপ্লাস্টি’ বলে। একটা ভ্যাজাইনা বানানো হয়, ল্যামিনা মিজোরা, ল্যামিনা মিনোরা, একটা ক্লিট-ও বানাতে হয়, ভ্যাজাইনা দেখেছ তো?
একটু লাজুক সম্মতি পরির।
—ভাল করে দেখেছ, দরজা-টরজা খুলে?
—মানে?
—তা হলে ভাল করে দ্যাখোনি। অন্দরমহলে যাওয়ার একটা দরজা থাকে জানো তো, ল্যামিনা মিনোরা।
—জানি।
—গুড। ওসব বানাতে হয়, তারপর একটা প্যাসেজ…। এছাড়া প্রস্টেটটাকেও ‘রিমুভ’ করে দিতে হয়, ‘স্ক্রটাম’টাও…।
.
দুলালের ও লিঙ্গচ্ছেদ হয়েছিল, ক্যাস্ট্রেশনের বর্ননাও দিয়েছিল—যখন দুলালকে নিয়ে অনিকেত কিছু লেখার চেষ্টা করেছিল। সেটা ছিল ছিবড়ানো। আর পরি যেটা করতে চায় সেটা হ’ল পেনেকটমি। পেনেকটমি মানে রিমুভাল অফ পেনিস। লিঙ্গচ্ছেদন। তারপর অরচিডেকটমি। মানে রিমুভাল অফ স্ক্রটাম, – অণ্ডকোষ ছেদন। তারপর তো ভ্যাজিনোপ্লাস্টি—যোনি গঠন। এস.আর.এস. করতে গেলে পরিকে এইসব করতে হবে।
শুক্লা বেশ কয়েবার জিজ্ঞাসা করেছে এইসব অপারেশনে কোন রিস্ক নেই তো? অনিকেত বলেছে—রিস্ক তো অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশনেও আছে, কিন্তু করাচ্ছে তো…
কী যে ভূত চাপল ওর… শুক্লা বলেছিল।
ভূত? তাইতো। অনিকেতের মনে হয়। “তবু সে দেখিল কোন ভূত? কেন ঘুম ভেঙ্গে গেল তাঁর?’
তারপরের লাইনটা মনে পড়তেই অনিকেত ভয় পেল।
‘লাশ কাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার..’।
না-না। কতই তো হচ্ছে আজকাল। বিজ্ঞান কত এগিয়ে গেছে।
উইকিপিডিয়া খুলল কম্পিউটারে। ব্যাপারটা ভাল করে জেনে নিতে হয়।
পড়তে-পড়তে যেন কানে একবার বেজে উঠল মহিষাসুরমর্দিনী-র ওই জায়গাটা। দেবতাদের সম্মিলিত গুণ থেকে তৈরি হলেন তিলোত্তমা। বৃষ্টি দেবতা বরুণ দিলেন পেলবতা, অগ্নি দিলেন তেজ, ব্রহ্মা দিলেন কমণ্ডলু, ইন্দ্র দিলেন আয়ুধ…। পেনাইল ফ্ল্যাপ থেকে ল্যামিনা মিজোরা, স্ক্রটাম স্কিন থেকে ল্যামিনা মিনোরা, বাক্কাল টিস্যু গ্রাফ্ট হবে ভ্যাজাইনাল অরিফিস এ…।
অনিকেত দেখল ইউ টিউবে একটা ভিডিও আছে, যেখানে ভ্যাজিনোপ্লাস্টির নির্বাচিত অংশ দেখানো আছে। সঙ্গে একটু কমেন্ট্রি। বলছে, এটা সেকেন্ড ফেজ অফ অপারেশন, প্রথম ফেজ-এ প্রস্টেট-টা সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অপারেশন টেবিল। একটি নিরীহ জননাঙ্গ। ফুটপাথের অনাথের মতো পাশ ফিরে শুয়ে আছে। এক জোড়া অণ্ডকোষ। একটা হাত, হাতে সূচিমুখ যন্ত্র। লিঙ্গটাকে একটা গ্লাস পরা হাত পেটের সঙ্গে লাগিয়ে চেপে ধরল। একটা সাঁড়াশির মতো যন্ত্র টেনে ধরল অণ্ডকোষের চামড়া। একটা তীক্ষ্ণ ছুরির ডগা কেটে দিল সেই চামড়া। ভেতরে শ্বেতশুভ্র কোষ, এখানেই তৈরি হয় জন্মবীজ। চামড়ার ওপরে চাপ দিল গ্লাস পরা হাত, কাটা জায়গাটা দিয়ে বেরিয়ে এল রক্তমাখা সাদা কোষ, পিছনে সুতোর মতো জট। বলছে, ওসব শুক্রনালি। শুক্র তৈরি হয়ে ওই নালিপথে শুক্রস্থলীতে যায়। একটা ছোট সাঁড়াশি টেনে বের করল ওই নালিগুচ্ছ। কোনও কাজে লাগবে না আর। একটা কাঁচি কেটে দিল ওই নল। ট্রে-র ওপরে পড়ে রইল শুক্রনালি বিজড়িত শুক্রকোষখানি। ভিতরে কিছু সেলাই হল। রক্ত-ফেনা মাখা, পাশাপাশি অণ্ডকোষ দু’টি এখন কোষমুক্ত। অগুস্থলী এখন শূন্য। কমেন্ট্রি বলছে, এই স্কিন খুব ইলাসটিক। টেনে অনেকটা বাড়ানো যায়। এই স্কিন লেবিয়াপ্লাস্টি’তে কাজে লাগবে। ল্যামিনা মিনোরা এবং ভ্যাজাইনাল প্যাসেজ…। তৈরি করা যায় এই স্কিন দিয়ে…।
এবার পেনেটকমি। একটা যন্ত্র লিঙ্গটি টেনে ধরল, একটা সূক্ষ সূচের মতো যন্ত্র লিঙ্গত্বকটা কেটে ফেলল। উঃ! না, ও তো অজ্ঞান, বুঝতে পারছে না। ভিতরে নরম, কোমল রক্তরাঙা বেচারা মাংসখণ্ড। লিঙ্গত্বককে টানা হচ্ছে, কমেন্ট্রিতে নানারকম সার্জিকাল যন্ত্রের কথা বলছে, স্ক্যালপেল, ফরসেপ, স্প্যাচুলা, ক্ল্যাম্পস…। লিঙ্গত্বককে কেটে উল্টে দেওয়া হল। একে ‘বলে পেনাইল ইনভারশন। আর ওই চামড়াটা পেনাইল ফ্ল্যাপ। বলছে খুব কাজের জিনিস এটা, নার্ভ-জালিকা আছে এই চামড়ার ভিতরে। খুব সংবেদনশীল। তাই এই চামড়া দিয়েই তো তৈরি হবে যোনিখানি। একটা স্প্যাচুলা টেনে ধরল লিঙ্গশরীর। একটা কাঁচি ভিতরে ঢুকে গেল। একটা গ্লাস পরা হাতের রক্তশোষার কাপড় শুষে নিচ্ছে চলকে ওঠা রক্ত। একটি স্প্যাচুলা টেনে আনল লিঙ্গশরীর, যা পেটের ভিতরেই থাকে বেশ কিছুটা, যা এখন সামান্য নলমাত্র, দুই উরুর মধ্যবর্তী স্থানে এবার যোনিপথ তৈরি হবে। তার আগে মূত্রনালি বাঁচিয়ে সাবধানে প্রস্টেটটিকে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল। কী দরকার প্রস্টেটে? ওটা তো পুরুষের একান্ত নিজস্ব। দু’টো সূক্ষ্মমুখ ছুরি কাটতে থাকে দুই উরু মধ্যবর্তী ‘জিরো পয়েন্ট’। একটি যন্ত্র বের করে আনে শুক্রস্থলী। কী হবে ওসব আর?
এই জিরো পয়েন্টে তৈরি হবে একটি পথ, যাকে ওরা ‘যোনিপথ’ বলে ভাববে। এই পথটা তৈরি হবে ব্লাডার আর রেক্টামের মাঝখান দিয়ে। ‘রেট্রোপ্রস্টেটিক ফ্যাসিয়া’ হল একটা পর্দা, যা প্রস্টেট আর ব্লাডারকে রেক্টাম থেকে আলাদা করে রেখেছে। প্রস্টেট নেই, ব্লাডার তো আছে। ওই পর্দাটা থাকবে।
মাংস কেটে পথ করছে। মাংসই তো, ওরা বলছে অনেক কিছু। মাংসর কত নাম, কত ভাগ…।
লিঙ্গ আবরণের যে-চামড়াটা রেখে দিয়েছিল শরীরে, যার নাম পেনাইল ফ্ল্যাপ, পেনাইল শ্যাফ্ট-ও বলছে কখনও, সেই চামড়াটা দু’পাশ থেকে টেনে ‘গ্রাউন্ড জিরো আবৃত করে দেওয়া হল। ক্ষত ঢেকে গিয়েছে চর্ম-আবরণে। সেলাই হল তলাটা। মাঝখানটায় ফাঁক আছে, ওখানে যোনিদ্বার হবে। সলিউশনে ডোবানো ঠান্ডায় রাখা গুটলি পাকানো নালি, যাকে ‘লিঙ্গ’ বলা হত, বলা হত রড, কক, বা ডিক, বাংলায় দার্ঢ্য দু’অক্ষর, তার শেষ প্রান্তে সামান্য লাল রঙের মাংস, টিপ্ অফ দ্য পেনিস, বা গ্লাস ভাল বাংলায় যা শিশ্ন বা লিঙ্গমুণ্ড, তা দিয়ে ক্লিটোরিস হবে। কারণ এটা ইরেক্টাইল টিস্যু। রক্তজালিকা এবং নার্ভ সমৃদ্ধ। লিঙ্গ-আবরক যে-চামড়াটা, যা দু’পাশ থেকে টেনে সম্মুখ-যোনি করা হল, সেই চামড়ার কিছুটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। সেই চামড়ার পিছন দিকটা, যা পেনাইল ইনভারশন, যোনিপথ নির্মাণের কাজে লাগে। আর কোষহীন যে-অণ্ডস্থলীটি কুঁচকে পড়ে ছিল, এবার কাজে লাগবে। লিঙ্গ- আবরক চামড়া যদি কম পড়ে—পড়তেই পারে, অনেকের লিঙ্গই তো ছোট হয়, তখন অণ্ডস্থলীর চামড়া যোনিপথ নির্মাণের কাজে লাগে। আর, যোনিদ্বার, বিশেষত ল্যামিনা মিনোরা বানানো হয় এটা দিয়েই। এটা লেবিয়াপ্লাস্টি।
কিন্তু এই সব চামড়ার ক্ষরণ হয় না। পিছল নয়। এজন্য ওই চামড়ার ওপর অন্য টিস্যু জুড়লে ভাল হয়। যাকে বলে ‘গ্রাফটিং’। মুখের ভিতরে গালের থেকে কিছুটা টিস্যু নেওয়া যেতে পারে, একে বলে ‘বাক্কাল টিস্যু’ বা ‘ওরাল মিউকোসা। অনেক সার্জন কোলন থেকে টিস্যু সংগ্রহ করে লাইনিং করেন। এইসব টিস্যু নিঃসরণ করতে পারে পিচ্ছিলতা।
অনিকেত বাইশ মিনিটের ওই ভিডিওটির শেষে দেখল কী সুন্দর একটি যোনি তৈরি হয়ে গিয়েছে। ওরা ভাল্ভা বলছে, বলুক। অনিকেত দেখল কুর্মাকৃতি যোনি, শঙ্খিনী? পুরো অপারেশন করতে নাকি তিন ঘণ্টা পনেরো মিনিট লেগেছে। বাইরে ঝুলে আছে একটি ক্যাথিটারের নল।
বলছে, এরপরও আরও দু’-তিনবার আসতে হবে সার্জারি টেবিলে। বলছে, এই সব সার্জেন এক-একজন শিল্পী। প্রতিটি অপারেশন এঁদের কাছে সৃষ্টি। বলছে, ডেনমার্কের ক্রিস্টিন জরগেনশন শুরু করেছিলেন ১৯৫২ সালে, তারপর ইংল্যান্ডের রেনে রিচার্ডস, জার্মানির এলমার বেল্ট, আমেরিকার হপকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের চেষ্টায় এখন এই সার্জারির কত উন্নতি ঘটেছে। ভিডিওটা শেষ হওয়ার পর অনিকেতের মনে হচ্ছিল স্ক্রিনে রক্ত লেগে আছে। মনে হচ্ছিল মাছি আসবে। উঃ, এত কষ্ট। ছেলেটার শরীরে এত সব হবে? রিফ্রেশ বোতাম টেপে কম্পিউটারে। এতে কম্পিউটার নিজে রিফ্রেশ হয় হয়তো, ও তো হবে না। গুগলে গিয়ে ফুল সার্চ করে। রোজ। গোলাপ।ইয়েলো রোজ’ নামে একটা সাইট দেখে। ক্লিক করে দেয়। ফুটে ওঠে ‘মাই মনোলগ’। পড়তে থাকে। ‘অল রোজেস আর নট পিংক আই অ্যাম ইয়েলো রোজ।’ একজন রূপান্তরকামী বলছে নিজের কথা। তার মানে, সেই কবে পবনরা যেটা বলেছিল সেটা ওদের কথা নয়, শিক্ষিত রূপান্তরকামীদের মধ্যে এই লব্জটা চালু আছে।
অনিকেত পড়তে থাকে। ওই একই কথা, নিজেকে মেয়ে ভেবেছে ছোটবেলা থেকে, যদিও লিঙ্গচিহ্নে পুরুষ। পুরুষদের সঙ্গে যৌনমিলন করেছে, ছেলেটির বাড়ি মিশিগানে, ছেলেটি ব্ল্যাক। একটা সময় মনে হয়েছে পর্নস্টার হবে। টাকা কামাবে। ও অপারেশন করায়। অপারেশনের পর নানা অসুবিধার কথা খোলাখুলি বলেছে ওই পেজ-এ। ও যেটা লিখছে, তা হল অপারেশনের পর দেখলাম আমার একটা যোনি হয়েছে। যেটা আমার স্বপ্নে ছিল। যোনিদ্বার দিয়ে রক্ত পড়ত। প্রথমটায় খুশি হয়েছিলাম। আহা, একেই তো বলে মেনস্ট্রুয়েশন। কিন্তু রক্ত পড়া বন্ধ হল না, ভেতরে জ্বালা যন্ত্রণাও। ডাক্তারের কাছে যেতে হল। দেখা গেল, ইনফেকশন হয়েছে। পুরুষ থাকার সময় প্রস্রাবের বেগ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। প্রস্টেট সেক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। খুব অসুবিধা হচ্ছিল যোনিছিদ্রটি নিয়ে। ডাক্তার বলেছিল ডায়ালেটর ব্যবহার করতে নিয়মিত। ওটা এক যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। হিউম্যান বডি আর্টিফিশিয়াল ভ্যাজাইনা’কে সহজে মেনে নেয় না, শরীর মনে করে ওটা একটা ক্ষত। যে কোনও ক্ষত ‘হিল’ করতে চায় শরীর। এই ছিদ্রটাও বুজিয়ে ফেলতে চায়। রক্তপাত চলাকালীন আমি কয়েক দিন ডায়ালেটর ব্যবহার করিনি, ফলে ভ্যাজাইনাল অরিফিস-টা ব্লক হয়ে গিয়েছিল, তাই আমাকে আবার সার্জারি টেবিলে উঠতে হয়।
ও আরও কত অসুবিধার কথা লিখেছে, নিয়মিত ইস্ট্রোজেন নেওয়ার ফলে নানা শারীরিক অসুবিধে, মাথা ঘোরানো, এসব তো আছেই, আরও লিখছে—প্রকৃতিতে দেখি যারা পুরুষ হয়ে জন্মেও টেটিস বাদ দিয়েছে, ওদের মেটাবলিজম অন্যরকম হয়ে যায়। ভেড়া, শুয়োর, গরু— সবার ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে অণ্ডচ্ছেদনের পর ওরা গায়ে-গতরে বাড়ে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ওজন বাড়ছিল, খাওয়াদাওয়া কমিয়েও লাভ হচ্ছিল না, তাই আমি অ্যাবডোমিনোটমি করিয়েছিলাম। স্টমাক ছোট করে দিয়েছিলাম যেন বেশি খেতে না-পারি। কারণ আমার ফিগার ঠিক রাখতে হবে। আমি স্টার। পর্নস্টার হলেও তো স্টার। আমার আর্টিফিসিয়াল স্তন, আর্টিফিসিয়াল ভ্যাজাইনা দেখিয়ে পয়সা রোজগার করেছি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, উনি দৃশ্যকামুক মানুষের সংখ্যা দুনিয়ায় ভালই রেখেছেন। আমার রোজগার ভালই ছিল, কারণ একই সঙ্গে কিংবা আলাদাভাবে আমি অ্যানাল পেনিট্রেশন’ এবং ‘ভ্যাজাইনাল পেনিট্রেশন’ শুট করতে পারতাম।
শেষ প্যারাগ্রাফে লিখেছে, এখন আমার বয়স তেতাল্লিশ। এই বয়সে এসে মনে হচ্ছে আমি বৃথাই এত কষ্ট করেছি। আমি খুব একা। আমার কোনও প্রেমিক নেই। আমাদের কোনও স্থায়ী পুরুষসঙ্গী হয় না। আমার একজন বয়ফ্রেন্ড ছিল—যাকে আমি প্রেমিক মনে করতাম, সে আমার অনেক টাকাপয়সা নিয়ে টরেন্টো চলে গিয়েছে। এখন আমার তেমন টাকাপয়সা নেই। পা ফাঁক করতে, নিচু হতে, উপুড় হতে আর ভাল লাগে না। একটা নাচের স্কুল করেছিলাম, চলেনি, আমার গায়ে পচা আলুর গন্ধ লেগে আছে। যিশুর কাছে প্রার্থনা করেছি : শান্তি দাও। ফাদার বলেছে, রিপেন্ট করো। আর কত রিপেন্ট করব। আমার সমস্ত পাপড়িগুলো খসে পড়ার আগে কাঁপছে। কিছু করতে চায়, মানুষের কাজে লাগতে চায়। আমাকে মানুষ অবজ্ঞা করেছে একসময়। কিন্তু প্রতিশোধ নয়। সমস্ত মানবস্রোতের মধ্যে একজন হয়ে কিছু করতে চাই। আমাকে হেল্প করুন স্যর, হেল্প করুন ম্যাডাম…।
যাব্বাবা। রবীন্দ্রনাথ কি এঁর কথাও জানতেন নাকি, না কি রবীন্দ্রনাথই এঁর কথা বলেছেন—
নয়ন তোমার নত করো,
দলগুলি কাঁপে থরোথরো
চরণ পরশ দিয়ো দিয়ো, ধূলির ধনকে করো স্বর্গীয়-
ফুল বলে ধন্য আমি মাটির পরে।
এই লেখাটা কি পরিকে পড়ানো যায়? ওর মেল আইডি জানে না। জানতে হবে। এই পেজ-টা কপি করে রাখে অনিকেত। ওই ভিডিওটা দেখার পর অনিকেতের মনটা কেমন যেন দুর্বল হয়ে যায়। সবই তো বোঝে ও। এত দিন এসব নিয়ে নাড়াঘাঁটা করেও মনে হয়, পরি কেন এসব করতে চাইছে? ওর একটা পিতৃসত্তা জেগে ওঠে। বোধহয় বাৎসল্য। বাৎসল্যের মধ্যে অনেকটা স্নেহ মেশানো থাকে। ‘স্নেহের স্বভাবই এই, অমঙ্গল আশঙ্কা করে।’ বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন।
এত যে কাণ্ডকারখানা, রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি, গালের ভিতর থেকে, কোলন থেকে, লিঙ্গগাত্র থেকে টিস্যুসংগ্রহ, শরীর পাল্টানো, এটা একটা জেদের মতো হয়ে যাওয়ার পর জেদ শেষ। আন্তিনিওনি-র একটা ছবির কথা মনে পড়ে, সম্ভবত ‘ব্লো-আপ’। একজন অতিজনপ্রিয় পপ গায়কের গিটারটি ভেঙে যায়। দর্শকদের মধ্যে ছুড়ে দেয় সেই গিটারটি। দর্শকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। একজন কেউ ওটা পায়, ওটা নিয়ে ছোটে, পিছনে ছুটছে আরও অনেক মানুষ। যার অধিকারে ছিল গিটারটি, তার মনে হয় পাওয়া তো হয়েই গিয়েছে, আর কী হবে? পিছনের জনতার দিকে ছুড়ে দেয়। ওখানেও আবার কাড়াকাড়ি শুরু হয়। একজন কেউ পায়, ছোটে, পিছনে জনতা…।
পরির এই ইচ্ছেটা কেন? পরিদের? ‘মেয়েলি’ হওয়া সমাজ ভালভাবে নেয় না, হ্যাটা করে, বিদ্রূপ করে। তার চেয়ে মেয়ে হয়ে যাওয়া ভাল, এই ভাবনায়?
না, শুধু যৌনতার জন্য নয়। পুরুষশরীর রেখেও তো নারীদের যৌনতা পাওয়া যায়। পেয়েছে তো। কতটুকু দিতে পারে কোলন লাইনিং? কতটুকু দিতে পারে সিরিঞ্জ-হরমোন? পিটুইটারি-র কালও একদিন শেষ হয়।
শরীর প্রবীণ হয়। বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে।
ও প্রাসাদে কারা থাকে? কেউ নেই—সোনালি আগুন চুপে জলের শরীরে নড়িতেছে— জ্বলিতেছে।
সে আগুন জ্বলে যায়—দহেনাকো কিছু।
নিমীল আগুনে ওই আমার হৃদয় মৃত এক সারসের মতো।’
শেষ অবধি বোধহয় বাৎসল্য-ই জয়ী হয়!
বাৎসল্য মানে ‘এলআইসি’র লোগো। দু’হাতে একটা প্রদীপকে আগলে রাখা। কোন অ্যাড্রিনালিন-অক্সিটোসিন-ইস্ট্রোজেন-প্রজেস্টেরনে এর ব্যাখ্যা নেই। এই যে বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেন, সন্তান ধারণ করেননি, দত্তক নিয়েছেন শিশু। এই যে মানবী ব্যানার্জি, এত কাণ্ড করল, এখন নাকি একটা কিশোর ছেলেকে পুষ্যি নিয়েছে, গরিবের ছেলে। দত্তক আইন আমাদের যা আছে, এতে করে ‘সিঙ্গল মাদার’ দত্তক নিতে পারে না। ও হয়তো তাই কোনও শিশুসন্তান দত্তক নিতে পারেনি, কিন্তু পুষ্যি নিয়েছে।
এই বিশ্ব সংসার কিছু মায়া। কিছুটা মায়াবী।
এখন পরির জন্য অদ্ভুত একটা অনুভব হচ্ছে।
৬৭
তীর্থঙ্কর’কে অপারেশন-এর বিষয়টা খুঁটিয়ে জিগ্যেস করেছিল পরি, বুকের ‘সিলিকন প্রসথেসিস’ সম্পর্কে বিস্তারিত বললেও ভ্যাজিনোপ্লাস্টি নিয়ে বিস্তারিত বলল না। তীর্থংকর শুধু বলেছিল—অত কিছু জানার দরকার নেই। যখন করে দেব, তখন বুঝবে—’উল্টে দেখি পাল্টে গেছি’। কোন জায়গা থেকে কী মাংস, কী চামড়া নেওয়া হবে—তা বিস্তারিত বলল না তীর্থঙ্কর। শুধু বলেছিল শরীরেই সব আছে, এধার-ওধার করে দেওয়া শুধু। একটা মজার কথা বলেছিল, বলল, ঠোঁট থেকে পায়ুদ্বার পর্যন্ত প্রায় একই জাতের টিস্যু আছে। পিঙ্ক। জিভ, গাল, খাদ্যনালি, কোলন, পায়ু, ভ্যাজাইনা—সব পিঙ্ক রঙের। ঠোঁটে লঙ্কা ঘষে দিলে জ্বালা করে, আবার লাস্ট এন্ড মলদ্বারেও লঙ্কা ঘষে দিলে জ্বালা করে। ওই টিস্যুই এধার-ওধার করা আর কী। তোমার কথা মতো ‘দোতলা’ হোক, পরে নয় ‘একতলা’ হবে। পরিও এমনটাই ভেবেছে।
ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। ২ জুন, ২০০৯ তারিখে দিল্লি হাই কোর্টের রায় বেরিয়ে গেল। কোর্ট বলল, সমকামিতা অপরাধ নয়। সেই কবে ‘নাজ ফাউন্ডেশন’ মামলা করেছিল। হাই কোর্ট খারিজ করে দেয়। সুপ্রিম কোর্ট বলে মামলাটা চালু করতে হবে। ২০০৮ সাল থেকে আবার শুনানি শুরু হয়। এবার মিটল। জাস্টিস অজিত প্রকাশ শা এবং জাস্টিস মুরলীধরন ১০৫ পাতার একটা রায় দিলেন। বললেন, ৩৭৭ ধারার একটা অংশ ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারার বিরুদ্ধে যায়, যেখানে ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের একইরকম সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে। যৌনসঙ্গীর ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে না। সমকামীদের ক্ষেত্রে ‘অ্যাবনর্মাল’ শব্দটার পরিবর্তে ‘ডিফারেন্ট’ শব্দটা প্রযুক্ত হল। সম্মতি সাপেক্ষে যে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মহিলার সমলিঙ্গের সঙ্গে শরীর-সম্পর্ক আইনের সম্মতি পেল। ৩৭৭ ধারা চালু রইল সম্মতিহীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং শিশুমেহনের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন গোলাম নবি আজাদ। কেন্দ্রে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার। ১২ জুন কেন্দ্ৰীয় আইনমন্ত্রী বীরাপ্পা মইলি ৩৭৭ ধারা থেকে ‘হোমো সেক্সুয়ালিটি’ বাদ দিলেন। দেড়শো বছরের পুরনো আইন সংশোধিত হল। এরপর তো দেশ জুড়ে ‘এলজিবিটি’-দের উৎসব চলতে লাগল। শুধু সমকামী কেন, উভকামী এবং রূপান্তরকামীরাও শামিল। ভুবনেশ্বরে Gay Pride Parade হল। দিল্লির রামলীলা ময়দানে পনেরো হাজার ‘এলজিবিটি’ নাচ-গান করল। বাঙ্গালোর, মুম্বই, সর্বত্র। কলকাতাও বাদ যাবে কেন?
পরির-ও আনন্দ হল প্রচুর। অফিসের সবাইকে ফিশ ফ্রাই খাওয়াল। ওর বস সিদ্ধেশ গর্গ ওকে কনগ্র্যাচুলেশন’ জানালেন। পরি এই আন্দোলন থেকে নিজেকে বেশ বিচ্ছিন্ন-ই রেখেছিল। অহংকার নয়, নিজের আপাতপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার কারণেও নয়, ওদের চালচলন সব সময় পছন্দ হচ্ছিল না পরির। আর অতটা গোষ্ঠীবদ্ধতাও ভাল লাগছিল না পরির। পরিও মেসেজ পেতে থাকল। সব পুরনো বন্ধুর। কেউ মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে অসংখ্য ‘ভি’ পাঠাল, কেউ পাঠাল ‘উই শ্যাল ওভারকাম’, কেউ লিখল ‘ওহ্ ফ্রিডম’। কেউ লিখল, ‘এনজয়, এনজয়’। তৃপ্তি-ও একটা এসএমএস পাঠাল, আর কী বাধা, এবার বিয়ে কর, সুখী হ। এই এসএমএস-টির মধ্যে তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে। এই আইন সংশোধনে ওর কী? ওর তো ৩৭৬ ধারার রেপ কেস। কেস টিকবে না, কিন্তু কেস চলছে। এখনও চাকরিতে জয়েন করতে পারেনি। কিন্তু তৃপ্তি হয়তো জানে না—৩৭৭ ধারার সংশোধন মানে সমলিঙ্গের বিয়ে স্বীকার করা নয়। পরি এবং চয়নের বিয়ে রেজিস্ট্রি হবে না। কিন্তু বিয়েটা করবে। মালাবদল করে, মাথায় মুকুট পরে।
‘প্রান্তিক’ বলে একটা পত্রিকা ৩৭৭ ধারা সংশোধন উপলক্ষে একটা আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। ওখানে যাওয়ার জন্য একটা আমন্ত্রণ পেল পরি। পত্রিকাটা দেখেছে পরি। মলাটে লেখা ‘প্রান্তিক মানুষদের নিজস্ব কাগজ’। আলোচনার বিষয় ‘সংশোধন, কাটাকুটি, এবং এরপর’। ‘সংশোধন বা কাটাকুটি’ তো জয় গোস্বামীর একটা গল্পের নাম ছিল। এখানে ‘কাটাকুটি’ শব্দে অপারেশন ইঙ্গিত করা হচ্ছে না কি? কার্ডে লেখা ছিল অনেক কৃতী মানুষ আসবেন। ‘ভারত সভা’ হলে এই অনুষ্ঠান। সম্পাদক নিজে ফোন করে পরিকে বললেন, আসবেন কিন্তু। পরির কেমন বেশ শ্লাঘা বোধ হয়েছিল, গণ্যমান্যদের মধ্যে ও পড়ছে তা হলে। খবর কাগজে ওর নামটাম ছাপা হচ্ছে তো। লাইফ স্টাইলের পাতায়।
পরি নিজের জন্য একটা ইনোভেটিভ ড্রেস বানিয়েছে। একটা কুর্তা, কিন্তু টিপিক্যাল মেয়েদের মতো নয়, গোল গলা, বেশি নামানো নয়, লেগিংস, পায়ের দিকটা কাজ করা, একটা ওড়না। কানে দুলও পরল, গলায় হার পরল না।
পরি দেখল, “ভারত সভা’ হল-এর দরজার সামনে জটলা মতো। ‘এলজিবিটি’-রা সব এসেছে। লেসবিয়ানদের দেখে বোঝা যায় না, পুরুষ সমকামীদেরও দেখে সব সময় আঁচ করা যায় না। বাইসেক্সুয়ালদেরও বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু রূপান্তরকামীদেরই দেখে বোঝা যায়। ওদের চলন-বলন, আর পোশাকের জন্য। কেউ-কেউ চড়া রঙে ঠোঁট রাঙিয়েছে, ব্রেস্ট অগ্মেন্ট করিয়েছে, কয়েকজন উর্ধ্বাঙ্গে এমন পোশাক চড়িয়েছে যেন ক্লিভেজ-টা বেশ ভাল করে দেখা যায়। সি-থু শাড়ি পরেছে দু’-একজন। বিশেষত যারা ফর্সা, পেট প্রদর্শন করছে, একটা পানের দোকানে ক্লোরোমিন্ট কিনতে গিয়ে শুনল—একজন ধুতি- পাঞ্জাবি পরা মুখে জর্দা পান চর্বণরত অবস্থায় বলল, কালে কালে কোটো কি ডেকটে হল, ভারট সভা হলেও হিজড়েরা মিটিং করছে। লুঙ্গি-পরা পানওলা বলল, লেকিন লিখাই-পড়াই হিজড়া…।
মিটিংয়ের শুরুতে সম্পাদক বললেন, এই পত্রিকা প্রান্তিক মানুষদের কথা বলে। নির্যাতিতদের কথা বলে। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে যেমন বলে, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধেও বলে। আমাদের সমাজে এলজিবিটি-রা প্রান্তিক, এবং সংখ্যালঘু। নির্যাতিত ও উপেক্ষিত। যে কোনও প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম আমাদের সংগ্রাম। এই জয়ও আমাদের জয়। আদিবাসী, ওবিসি, এলজিবিটি সবার লড়াইকেই এক সূত্রে গাঁথতে হবে।
এই সংবিধান সংশোধনকে অভিনন্দন জানিয়ে ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে বিশিষ্টজনরা যা বলেছেন, সেটা পড়লেন একজন ‘স্যাফো’ অ্যাকটিভিস্ট। অরুন্ধতী রায়, অনিতা দেশাই, শশী থারুর, হর্ষ ভোগলে, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষরা কী বলছেন, এঁদের মন্তব্য পড়া হল। স্যাফো-র মীনাক্ষী সান্যাল বললেন, অনেকেই বলেন দেশের প্রধান সমস্যা হল অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। এর মধ্যে ৩৭৭ নিয়ে কেন হইচই? আসলে এই প্রান্তিক মানুষরা যখন সমাজবিচ্যুত হয়—এদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান কোনওটাই থাকে না। আমাদের দেশে এদের সংখ্যা এক কোটি…। খুব হাততালি পড়ল। অভ্যাগতদের মধ্যে কয়েকজন লেখক-কবিদেরও দেখা গেল। পরি পিছন দিকে বসেছিল। উদ্যোক্তাদের একজন ওকে সামনে ডেকে নিয়ে গেল। ওখানে বাসবদা, রঞ্জনদা ওদের দেখল। অনেক দিন পর। আলোচনা হল আধঘণ্টা ধরে, চারজন বক্তা ছিল। সব কেমন পুক-পুকিং মনে হল। কেউ বলল, ‘এসসি’, ‘এসটি’, ‘ওবিসি’-দের মতো ‘এলজিবিটি’দের জন্যও রিজার্ভেশন রাখতে হবে। কেউ বলল, বেসরকারি সেক্স চেঞ্জ সার্জারিতে এখন অনেক খরচ, তাই সরকারি হাসপাতালগুলিতেও সেক্স চেঞ্জ সার্জারির ব্যবস্থা রাখতে হবে। একজন এনজিও কর্তা বলল, অনেক কিয়স্ক তৈরি করতে হবে, যেখানে ‘কয়েন’ দিলেই কন্ডোম পাওয়া যায়। সবাই ওদের মতো করে ভাবে। এসব নিম্নবিত্ত মানুষগুলো যেন টেলারিং, কার্পেন্টারি বা হাতের কাজ শিখে নিজেদের ভাত-রুটির ব্যবস্থা করতে পারে, এ নিয়ে কেউ কিছু বলল না। এরপর একজন কিশোর, বোঝা যায় রূপান্তরকামী, কবিতা পড়তে লাগল হাত নাড়িয়ে। যতটা সম্ভব, গলাটা সরু করে: প্রথম কবিতাটা পড়ছি কবি জয় গোস্বামীর ‘কুরূপ কাহিনী’।
তুমি কি নারীই? কিন্তু লাবণ্য স্বীকার করোনি তো?
গলার আওয়াজ শক্ত। প্যান্টের পকেটে একটা হাত
অন্য হাত উঁচু করে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে বাকিদের
তোমাকে কি করে কারও ভালো লেগে যায়?
এই ধরো আমার?
কাজের সূত্রেই গেছি তোমাদের বাড়ি
খেতে বসবার আগে হাতে-মুখে জল দিয়ে নিতে
ঢুকেছি স্নানঘরে—লম্বা বাথটব—বড় আয়নাটায়
আমার মুখের ছায়া পড়েছিল।
তোমার পোশাক-হারা শরীরের ছায়াটি যেখানে
রোজ দেখা দেয়, স্তনহীনা।
তোমার বৃত্তের মুখ কেউ কখনও দাঁতে চেপে ধরেছিল কিনা
তখনো জানি না।
তোমার পাঁজরসার বুকে মাথা রেখে শুলাম;
ক্যান ইউ ফিল মাই হার্ট বিট?
তখনো গলার স্বর অতই কর্কশ, কিন্তু শ্বাস শব্দ মিশে
কী যে একটা হয়ে আছে।
তোমার শরীর পুড়ল আমার আঙুলে মাখা বিধে
সেদিনই বুঝলাম তুমি পুরোপুরি নারী।
তারপর হঠাৎ এই তিন বছর বাদে মুখোমুখি।
শাড়িতে অনেকটা লম্বা, কাঁধ ছাপানো চুল
শরীর সেরেছে বেশ। তন্বীসীমা পেরনো যুবতী
কোনোদিনই সাজগোজ ছিল না। আজ নাকে হীরে, কানে ঝুমকো দুল
আরে এই যে, ভাল আছেন! চিনতে পারছেন!
সে কি, চিনব না কেন?
একেবারে অন্য কেউ। আমি যাকে চিনতাম, সে নয়।
সঙ্গের যুবকটি এক পা দিয়ে বাইকে আঘাত করছে।
তোমাকেও ওইভাবে আঘাত করে না? করে তো? জানি
আঘাত পছন্দ করো তুমি
সে পছন্দ একদিন জেনেছিল এই অনধিকারীর মরুভূমি
যুবকটি হাই বলল। আমি নমস্কার।
রাজেন্দ্রনন্দিনী তুমি, তোমাকে মাত্রই দু-একবার
পেয়েছি—দৈবের বশে—কুরূপা আমার…।
.
হাততালির মধ্যেই অনিকেতের পাশে বসা বাসব, কাগজে চাকরি করে এখন—বলল— ওই বাইকে চড়া লোকটা কিন্তু কিছু দিন পরেই ফুটিয়ে দেবে ওকে। শিওর।
ছেলেটাকে দেখে পরির মনে হয়, ওর ফেলে আসা দিন। ও যেন সেই পুরনো পরি। ‘রাজেন্দ্রনন্দিনী’ হওয়ার স্বপ্ন দেখা পরি। ওই ছেলেটাও মায়ের বকা খায়, পাড়ার লোকের প্যাক…।
কয়েকজন কবি টবিও এসেছে। ৩৭৭ বিরোধী হওয়া মানে তো প্রগতিশীলতা। চৈতালী চট্টোপাধ্যায় ‘কিন্নরী’ নামে একটা কবিতা পড়ল—
না, কোন লক্ষ্মীশ্রীর কথা পড়তে আসিনি…
মা আমাকে সব সময় কুর্তি পরিয়ে রাখে…
আমার বিয়ের জন্য কোন ব্যাংক সেভিংস নেই…
এলজিবিটিরা কবিতা শুনছে না তেমন, নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। চপল ভাদুড়িও এসেছেন। একজন বয়স্ক কেউ পাকাচুল, বোধহয় সাংবাদিক, বল্লেন বলে দিলাম, লিখে নিন, দিল্লি হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ হবে সুপ্রিম কোর্টে। এটা মেনে নেবে নাকি মর্দ সোসাইটি। কাগজে দেখলাম এক গুরুদেব বলেছে দিল্লি হাইকোর্টের জজগুলো অধার্মিক।
একটু পর নিচে নেমে এল পরি। বাসবও। নিচে তিন-চারজন গুলতানি করছে। কাগজের বাঁশি বাজাচ্ছে একজন, যে-বাঁশি ফুঁ দিলে নলাকৃতি কাগজ ফুলে লম্বা হয়ে লাফিয়ে ওঠে। তালি দিচ্ছে। উচ্ছ্বাস উচ্ছ্বাস।
বাসব বলল, তোমার তো নামটাম দেখেছি কাগজে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগই রাখো না তো। ‘এসআরএস’-এর কথা ভাবছ?
পরি বলে, ভাবছি।
—পার্টনার?
—আছে।
—ম্যারেড?
—না।
—আনম্যারেড? তুমি তো লাকি।
পরি কিছু বলে না।
বাসব বলে, ওদের বেশি মাথায় উঠিও না। ‘তুমি ছাড়া চলবে না’ এমন ভাব দেখিও না। চাকরি করে?
—ভাল চাকরি?
—না।
—সেই ভাল।
—তোমার অর্গানাইজেশনে ভাল পজিশনেই হয়তো আছ, পারো তো তোমার আন্ডারে কাজ করাও ওকে, যেন তোমার কন্ট্রোলে থাকে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা নিংড়েই তোমায় এই সাজেশন।
এখন বর্ষা চলছে। ৩৭৭-এর সেলিব্রেশনটা সবচেয়ে ভালভাবে করা যেত বিয়েটা করে নিতে পারলে। ওরা যে যাই বলুক না কেন, চয়ন ওর। ও বিট্রে করবে না। পড়ার খরচ মেটানোর জন্য পরি যখন ওইসব কুকর্ম করেছে, চয়ন কি মলম লাগিয়ে দেয়নি পায়ুপথে? মাথায় হাত বুলিয়েছে, বিপদে-আপদে পাশে থেকেছে, দু’-একটা মেয়ের সঙ্গে যা একটু হয়েছে ওর, পরিকে লুকোয়নি। ও চয়নকে বিশ্বাস করে। কত দিন এমন হয়েছে, চয়ন আর পরি দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।
দু’জনের চোখে দেখেছি জগৎ, দোঁহারে দেখেছি, দোঁহে
মরুপথতাপ দু’জনে নিয়েছি, সহে
ভাগ্যের পায়ে দুর্বল প্রাণে ভিক্ষা যেন না যাচি
কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয়—তুমি আছ আমি আছি।
এই লাইনগুলো রেডিওর প্রেমের নাটকে শুনেছে কত। ওগুলো হেট্রো-প্রেম। এখানে মনে এলেও বলা যায় না। বিয়ের প্রস্তাব চয়নকে তো দিয়েছে ও, চয়ন আপত্তি করেনি। তবে এখন তো খেলা-খেলা বিয়ে হবে। আইনি বিয়ে হওয়াতে গেলে ওকে মেয়ে হতে হবে। একতলা, দোতলা, সবরকম অপারেশন করিয়ে, ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে, কোর্টে কাগজ করিয়ে…. সে অনেক ঝামেলা। তার আগে রেজিস্ট্রি না-হোক, এমনি-এমনি বিয়েটা সেরে ফেলতে পারলে বেশ হত। মানবীদের মতো শাখা-সিঁদুর শো করবে না। চুলের ফাঁকে একটু অল্প একটু সিঁদুর লাগিয়ে রাখবে। অনেক নারীবাদীরাও তো সিঁদুরের পরশ রাখে।
চয়ন বলেছিল, বিয়ে করলেও কাউকে বলতে পারবে না। বাড়িতে তো নয়ই, বন্ধুবান্ধবদের কাছেও বলতে পারবে না। স্কুলে জানতে পারলে হয়তো চাকরিটাই চলে যাবে। ও তো পার্মানেন্ট টিচার নয়, স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে চাকরিটা পায়নি। চাকরিটা পেয়েছে ব্যাকিং-এ। প্যারাটিচার। সেক্রেটারির ভাগ্নেকে প্রায় বিনে পয়সায় পড়িয়ে, তেল মেরে, ছাত্রটির বাড়িতে বর্ষায় ইলিশ, শীতে পাটালি নিয়ে গিয়েছে চয়ন। ওরা যদি জানতে পারে এই টাইপের কাউকে বিয়ে করেছে ছোঁড়াটা, চাকরি চলে যাবে। ছাড়িয়ে দেবে ওরা। এই চাকরি ছাড়ানো কোনও ব্যাপার নয়, স্কুল কমিটির ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর ঝুলছে চাকরিটা। পরি একবার চয়নকে জিগ্যেস করেছিল, অন্য চাকরি পেলে করবে কি না। ও বলেছিল, বেশি মাইনে পেলে নিশ্চয়ই করব। এখানে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা পাই। অন্য চাকরি করতে-করতেও সরকারি চাকরি বা বেটার কোনও চাকরির চেষ্টা করা যায়। পরি ঠিক করল, ওর বস গর্গকে বলবে। সব খুলেই বলবে। গর্গ কিছুটা তো জানেই
‘বিয়ের ফুল’ বলে কেন? প্রথমে কুঁড়ি হয়, তারপর ফোটে বলে। উন্মেষ? ফুল ঝরেও যায়। ঝরুকগে। বিয়ে মানে নারীত্বের স্বীকৃতি। পরি ওর বাবাকেও বলে দিয়েছে। পরির বাবা এখন পরির কাছেই থাকে। কেমোথেরাপি করার পর শরীরটা খুব খারাপ হয়েছিল, এখন হিমোগ্লোবিন বেড়ে নয় ছড়িয়েছে। খুব কাতর স্বরে ডাকে পরি, পরি…। খুব যখন জ্বর, প্রলাপ বকতো, মা, গো মা এইসব কাতর ধ্বনি করত, পরি কপালে হাত বুলিয়ে দিত, জলপট্টিও। একদিন পরির হাত ধরে বলেছিল, মা গো মা…।
একদিন বলেছিল পরি, তুই ছেলে হলেও মেয়ের গুণ তোর। আমাকে যত্ন করিস। যদি ছেলে হতিস, বউ নিয়ে আমায় ছেড়ে চলে যেতিস। মেয়ের মত বলেই আমাকে দেখছিস রে…। মেয়েদেরই মায়া-মমতা বেশি হয়।
পরি ওর বাবাকে বলল, বিয়ে করব ভাবছি।
কার্ত্তিক ওর মুখের দিকে তাকায়। বিয়ে করবি? বউটা আমায় তাড়িয়ে দেবে না তো?
পরি বলে—বউ নয়, চয়ন, চয়ন।
চয়ন? ও বুঝেছি, তুই চয়নের বউ-এর মত হয়ে থাকবি…।
বউদের মত কেন? বউ হয়েই থাকব। আমি তো অপারেশন করাব, মেয়ে হয়ে যাব, একদম মেয়ে, চিনতেই পারবে না। তুমি আর একটু ভালো হয়ে গেলেই অপারেশন করিয়ে নেব।
চয়ন আমাকে তাড়িয়ে দেবে না তো?
ইশ্—বল্লেই হল? ঘাড় কাত করে বলেছিল পরি। কার্তিক পরির হাত চেপে ধরল। বলল পরি মা। পরি টিভি সিরিয়ালের আহ্লাদিনীর মত বলেছিল, তোমার কোনও আপত্তি নেই তো বাবা!
এই প্রথম পরি ওর ভিতর থেকে এরকম বাবা সম্বোধন করেছিল।
পরির বাবা বলেছিল—আমি কে আপত্তি করার? ভালোই তো। আমার অসুখ, আমার জ্বর আমার সব খাদগুলো পুরিয়ে দিয়েছে।
এই অসুখটাই হয়তো কার্তিককে পাল্টে দিয়েছে। মানুষের অসহায়তাও মানুষকে পাল্টায়। ‘থাকিলে ডোবাখানা হবে কচুরিপানা’—স্বভাব তো কখনও যাবে না, কথাটা চিরসত্য নয়?
বিয়েটা করে ফেললে হয় এবার। কালীঘাটে করলে লোকজন সত্যিকারের প্যাঁক দেবে আওয়াজ করে। হয়তো পাণ্ডারাও রাজি হবে না। দরকার নেই কালীঘাট, দরকার নেই মন্দির- টন্দির। চন্দ্র-তারা, আর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব সাক্ষী রেখে একটা কোথাও করতে হবে। এলইডি লাইটের আলোকসজ্জা নয়, জোনাকি জ্বলবে। জোনাকি কোথায়? তারা-ই জ্বলুক আকাশে। ফুল গাছগুলো দুলুক, গন্ধ ছড়াক বাতাসে, পাখিরা ডাকুক…। রাত্রে বিয়ে হলে প্যাঁচা ছাড়া কোন পাখিই-বা ডাকবে? কিন্তু রোমান্টিক ভাবনায় আহা কী রোমাঞ্চ!
না, বিয়েটার কথা সত্যি-সত্যি ভাবছে পরি। বাড়িতে বাংলা ক্যালেন্ডার নেই। একটা ছোট পঞ্জিকাই কিনে নিল। পরি যে খুব সংস্কারপরায়ণ তা নয়, তবে এই সব রোমান্টিক ব্যাপারে ট্রাডিশন-টা রাখতে চায়। এই তো শ্রাবণ মাসটা চলে যাবে। ভাদ্র মাসে কি বিয়ে হয়? সেই অঘ্রানের আগে নয়। সব যেন ঠিকঠাক থাকে। হে ভগবান, বাবাটাকে বাঁচিয়ে রেখো।
এখন শ্রাবণ চলছে। হাতে আর তিন মাস। এর মধ্যে শরীরটা পাল্টাতে হবে। নিজের জন্য একটা সুন্দর বিয়ের ড্রেস তৈরি করতে হবে। অবশ্য বিয়ের ড্রেস আর কী হবে, ও তো রাজকুমারীর ড্রেস চাইছে না, বেনারসী শাড়ি পরেই হবে, কিন্তু একটা মানানসই ব্লাউজ বানাতে হবে। ওরা শাড়ির সঙ্গে যে ব্লাউজ পিস’টা দেবে শুধু ওইটুকু দিয়ে ‘প্রেতাপর্তে’ নয়, স্পেশাল, ‘অঁথ কইওর’। যা হবে নতুন পাওয়া পয়োধরের জন্য সেলিব্রেশন। আহা, পয়োধর। পীন পয়োধর। ‘পীন’ বিশেষণটা যেন শুধু পয়োধরের জন্যই। ‘ব্রেস্ট অগ্মেন্টেশন’ বা ‘সিলিকন প্রসথেসিস’ বলতে ভাল লাগে না। কী বলা যায়? স্তনের কী-কী প্রতিশব্দ হয়? কুচ। ‘কুচযুগ শোভিত মুক্তা হারে’—সরস্বতী বন্দনায় আছে। আর কী হয়? ‘মাই’ খুব বাজে। পয়োধর-টা বেশ শুনতে ভাল, কিন্তু ‘পয়োধর’ মানে মেঘও হয়, নারকোলও হয়। মানে—যা জল ধারণ করে। দুধ ধারণ করে বলেই ‘পয়োধর’ নাম হয়েছে। এই নবস্তন দুগ্ধধারণে অক্ষম, দুগ্ধ সৃষ্টিতেও। তা হলে কুচ। ‘কুচ কুম্ভ’ শব্দটা বেশ লাগে শুনতে। ‘কুম্ভ’ মানে তো ঘট। তারচে’ ব্রেস্ট অগ্মেন্টেশন ব্যাপারটাকে ঘটস্থাপন বললেই তো বেশ হয়। ‘ঘটস্থাপন’ শব্দটার মধ্যে কী সুন্দর একটা রিচ্যুয়াল রিচ্যুয়াল ভাব আছে, পুজো-পুজো ভাব। পঞ্জিকায় পূজা পদ্ধতিতে আছে যে কোনও পূজার প্রারম্ভে ঘটস্থাপন করতঃ, ঘটশুদ্ধি করিবে।
ঘটস্থাপন-টা করে নেবে পরি। শিগগিরিই। কত বড় ঘট বসাবে? ৩৬ মানাবে না। ও তো পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। কাঁধটাও চওড়া নয় খুব। ৩৪-ই ভাল। মানে বোধহয় ৩৮০ সিসি। মেয়ে হলে ওকে ভালই মানাবে, যেমন তিস্তা মিত্রকে মানিয়ে গিয়েছে। মানবীদির কাঁধটা চওড়া, হাইটও বড্ড বেশি। অলোকাদির মুখটা চৌকো ছিল। পরির মুখটা ওভাল, থুতনি গোল, ওকে মানাবে। ও পুরোটাই করবে। ক্রজো। পুরো সেট। পিস মিল না-করে ত্রুজো করাই তো প্রেস্টিজের। সব্যসাচী মুখার্জি, রিতু কুমার’রা সিনেমা আর্টিস্টদের বিয়ে ‘ক্রজো’ করে। পুরো সেট। বিয়ের তিন দিন আগে থেকে হনিমুন ড্রেস পর্যন্ত। পরি এখনও কোনও ক্রুজো অর্ডার পায়নি, শরীরটাকেই ক্রজো করাবে।
জানালার ফাঁক দিয়ে মেঘ-মাখা আকাশ। জলভরা মেঘ। পয়োধর। অঞ্জন ঘন পুষ্পচ্ছায়ায় সম্বৃত অম্বর। আকাশের দিকে তাকিয়ে পরি বলে, বেশ করব ত্রুজো করব করবই তো।
চয়নও বলেছিল শরীরটাকে নিয়ে এত কাটাকুটি নাই-বা করলি, এমনিতেই তো ঠিক আছে। চয়ন-ই ওর ইস্ট্রোজেনের অভ্যাসটা বন্ধ করিয়েছে। বলেছিল, উল্টোপাল্টা খাস না, সাইড এফেক্ট আছে। ওই সব খেয়ে পরি ওর বুক কিছুটা তো বানিয়েছে, যদিও তেমন কিছু নয়, একটা সফেদা আধখানা করে যেন দু’দিকে সাঁটা। সেখানে এবার ঘট বসবে। ঘটস্থাপন। হেরো গো কমলাসন জননী লক্ষ্মীর হেরো গো নারী হৃদয়ের পবিত্র মন্দির। রবীন্দ্রনাথ কত বছর বয়সে লিখেছিলেন ‘স্তন’ কবিতাটা? বাইশ বছর বয়সে। এটা হয়ে গেলে এক দেড় মাস টাইম নিয়ে বাকিটা। সেক্স চেঞ্জ যখন করবই, আধখামচা নয়। পরি ভাবে। হ্যাজার্ড? হোক গে হ্যাজার্ড। চয়ন যেন আনবাড়ি না যায়।
না, কোনও রিস্ক নয়, বাসবদার কথামতো চয়নকে তাঁবে রাখতে হবে।
গর্গ সাহেবকে একদিন বলেই ফেলল পরি—স্যর, আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে। আমার একজন বন্ধু আছে, স্মার্ট, কম্পিউটার জানে, ওয়ার্ড, ডিটিপি, একসেল…. ওকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিন স্যর…।
সিদ্ধেশ গর্গ মুচকি হাসলেন। বললেন, টেল মি মোর ফ্র্যাঙ্কলি।
—হি ইজ মাই ফ্রেন্ড…।
আর কীভাবে ফ্র্যাঙ্কলি বলবে? কিন্তু ভেবেছিল তো সব খুলেই বলবে…।
গর্গই খুললেন। ইওর বেড পার্টনার?
মাথা নাড়ায় পরি।
—পাওয়ার পয়েন্ট আতা হ্যায় উনকো? ফর প্রেজেন্টেশন?
—থোড়া বহুত। দ্যাট হি উইল ডু।
—নো প্রবলেম, দেখেঙ্গে। বাট নট হিয়ার। আই উইল ট্রাই টু পুট হিম ইন আ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি। ‘মিরাল এন্টারপ্রাইস’-টা খুব ভাল, ভাস্কর বোস আছে, আমার নিজের লোক, ওর অনেক উপকার করেছি আমি, অ্যান্ড, সো ফার অ্যাজ আই নো, কোম্পানি ইজ এক্সপ্যান্ডিং। কিন্তু কথাটা হল, তুমি এই কোম্পানিতে থাকছ তো, অফার পেয়ে অন্য জায়গায় চলে যাবে না তো? ডোন্ট গো—অ্যাজ লং আই অ্যাম হিয়ার। ইউ উইল গেট এ গুড ইনক্রিমেন্ট নেক্সট ইয়ার। ডোন্ট ডিসক্লোজ ইট টু এনিবডি।
ঠিক আছে, এখন চয়নকেও বলার দরকার নেই।
এবার কাজগুলো এক-এক করে সেরে ফেলতে হবে। নিনাকে জানাল। নিনা বলল—তুমি আমার কম্পিটিটর হতে চাইছ কেন বাবা? পরি বলল, ভয় নেই, মডেলিং করব না। কিন্তু মনে- মনে বলল, তুমি তোমার ক্লিভেজ-বিভা দেখাও নিনা, দেখে নিও আমিও পারি কি না।
তীর্থঙ্করের সঙ্গে দেখা করে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহেই একটা দিন ঠিক করে ফেলল পরি। ডাক্তার তীর্থঙ্কর বসু বলল, এর আগে কতগুলো পরীক্ষা করিয়ে নিতে। সুগার, এক্স-রে, হরমোন লেভেল ইত্যাদি। একটা ফর্মও দিয়েছিল। সেখানে লিখে দিতে হবে কত সিসি বাল্ব করবে, অ্যারিওলা, নিপ্প্ল সাইজ সব।
একটা দিন ঠিক করে নিল ভর্তি হওয়ার। লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া নয়, জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া করেই অপারেশনটা করবে ঠিক করল। ডাক্তারবাবুরও তাই মত।
অনিকেতকে একদিন ফোনে জানাল পরি। বলল, সার্জারিটা একটু করিয়ে নেব বিয়ের আগে। আপনাদের একটু জানিয়ে রাখলাম। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে গুলতির মতো একটা শব্দ ছুটে এল যেন—সে কী?’
পরি বলল, অবাক হচ্ছেন কেন? আমি তো বলেছিলাম…।
অনিকেত বলল, তুমি এসো একদিন, তাড়াতাড়ি একদিন এসো ভর্তি হওয়ার আগে।
কয়েকবার এসে আর তো আসছ না। ব্যস্ত খুব?
৬৮
অপারেশনের ব্যাপারটা নিয়ে মনটা খিঁচখিঁচ করছে অনিকেতের। ইউটিউবে দেখা ভিডিওটার কথা বারবার মনে পড়ছে। অনিকেত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না পরিকে ওই ভিডিওটা দেখে নিতে বলবে কি না। শুক্লাকে দেখায়নি। প্রশ্নই ওঠে না। যদিও শুক্লার জীবনে অনেক অপারেশন ঘটেছে। অপারেশন টেবিলে গেছে, অজ্ঞান হয়েছে, জ্ঞান ফিরেছে, ব্যস। কী হয়েছে ও জানে না। এই অপারেশনটা দেখলে ওর ট্রমা হয়ে যাবে। লিঙ্গচামড়া পুরোটা উল্টে নিয়ে লিঙ্গের নরম মাংস কেটে নেওয়া, অঙ্গকোষের সাদা বীজভাণ্ড খুবলে বের করা, মাংস কেটে যোনিপথ তৈরি করা লিঙ্গের আবরণের চামড়াটা টানটান করে সেলাইকরা—যা নাকি যোনি হবে…ভাবা যায় না। কী করে পরিকে দেখাবে? যদি দেখায়-তবে ও ট্রমাটাইজড্ হবে। হোক না, তাহলে যদি সিদ্ধান্ত পাল্টায়…।
নাকি হিতে বিপরীত হবে! হয়তো এমনভাবে গেড়ে বসেছে জেদ, সেই ভূত ও করবেই। জেদ বা প্রবল ইচ্ছে বনাম ভয়ের টানাপোড়েনে খারাপ কিছু করে ফেলাও অস্বাভাবিক নয়। অপারেশনটা কি খুব দরকার? মনে মনে মেয়ে হয়ে থাকলে তো বাইরের খোলস পাল্টে মেয়ে হতে হয় না। যদি আমাদের লোকজন, সমাজ পুরুষের জন্মগত মেয়েলিপনা মেনে নিত, তাহলে হয়তো জোর করে মেয়ে হতে হত না। পশ্চিমের দেশে, ইয়োরোপ আমেরিকাতে কত মানুষ মেয়েলি স্বভাবের হয়েও মূল স্রোতে থাকতে পারে। অধ্যাপক, বৈজ্ঞানিক, শিল্পী, সবই তো হয়। ওরা তো ঠিক ঠাকই আছে।
তখনই মনে হয় অনিকেতের–পশ্চিমের দেশেও অনেকেই এইসব সার্জারি করে। আসলে অস্তিত্বের সংকট, নিজের পরিচয় এবং সামাজিক পরিচয়—এসব এত জটি লতা, একজন ট্রান্সজেন্ডারের আইডেনটিটির সংকট CIS জেন্ডারদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
এরই মধ্যে অফিস থেকে একটা কাজের ভার দেওয়া হয় ওকে। ‘ঐতিহ্যের সন্ধানে’ নামে একটা সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান চলছিল। বাংলার মন্দির, গড়-দুর্গ, কুটিরশিল্প, লোকনৃত্য, ধর্মভাবনা এসব নিয়ে আধ ঘণ্টার ফিচার। প্রথম দিকে তরজা গান নিয়ে একটা ফিচার অনিকেত করেছিল, ওটা ফাঁকিবাজি, বাইরে যেতে হয়নি, কিছু তরজা গান তো স্টকে ছিলই, দু’জন তরজা গায়ককে ডেকে এনে ইন্টারভিউ করে, মাঝে-মাঝে কিছু বকবক করে কেটে জুড়ে দিয়েছিল। এগুলো কোনও ব্যাপার নয়।
এটাও কি এক ধরনের প্লাস্টিক সার্জারি? হয়তো তাই, রক্তপাতহীন। অনেক দিন হয়ে গিয়েছে ওটা, আবার একটা করার জন্য তাড়া দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ওর মাসে একটা করে তৈরি করার হুকুম ছিল, অথচ তিনমাস কেটে গিয়েছে। অন্যদের করা ফিচার রিপিট মেরে চলছে। খুব গেঁতো হয়ে গিয়েছে অনিকেত। অথচ চার-পাঁচ বছর আগেও এসব কাজ আগ বাড়িয়ে করত। মিটিংয়ে অনিকেতকে বলা হয়েছে তাড়াতাড়ি একটা ফিচার করুন। সুধীর চক্রবর্তী মশাই একটা কথিকা বলে গেলেন—’চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব সাধনা’। ওটা ডিরেক্টর সাহেব শুনে ফেলেছেন। এখন অবশ্য আগের ডিরেক্টর নেই। উনি ছিলেন বিজ্ঞানপ্রেমী। এখন াহিত্যপ্রেমী। মিটিং-এ অনিকেতকে বলা হল, ওই বিষয়টা নিয়ে একটা ফিচার নামিয়ে দিতে। বকেলে লিখিত আদেশও পেল। সুতরাং এড়ানোর উপায় ছিল না।
সুধীরবাবুর টেপটা বাজিয়ে শুনল অনিকেত। ‘বলরামী’, ‘কর্তাভজা’, ‘সাহেবধনী’ এরকম মনেক সম্প্রদায়ের কথাই বলেছেন উনি। এ সম্পর্কিত অনেক লেখা আগেও পড়েছে মনিকেত। এই কথিকায় উনি ‘রাতাইলিয়া’ সম্প্রদায়ের কথাও বললেন—যারা সারা রাত রিক্রমা করে, নির্জন রাস্তায়, মাঠে-বিলে কৃষ্ণনাম গায় করতাল বাজিয়ে, আর বললেন, ‘মঞ্জরী াধনা’-র কথা, যারা নিজেদের মনে করে শ্রীরাধার সখী। এই সম্প্রদায়ের পুরুষরা স্ত্রী-বেশ ারণ করে, এবং নিজেদের নারী ভাবে। যেন ওরা বিশাখা-চপলা-চন্দ্রাবলী। এই বিষয়টা বেশ নে ধরল অনিকেতের।
সুধীরবাবু কৃষ্ণনগরে থাকেন। ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা রেকর্ড করলেই অনেক মেটেরিয়াল পাওয়া যাবে। তারপর যদি নবদ্বীপের কোনও আখড়ায় গিয়ে এই সখি-সাধনার সখীদের পাওয়া যায়…। সঙ্গে দু’-একটা গান জুড়ে দিলেই ফিচার রেডি হয়ে যাবে। রাত্রে না-থাকলেও লবে। শুক্লার অসুস্থতার কারণে রাত্রে কোথাও থাকতে চায় না অনিকেত। এই ফিচারটা তে চাইছে পরির জন্য। এরা তো সখী সেজে, সখী ভেবে দিব্য আছে। ওরা তো এসআরএস’ করাতে যাচ্ছে না, হরমোন-ও খেতে হচ্ছে না ওদের।
সুধীরবাবুর সঙ্গে কথা বলে ওঁর বাড়িতে হাজির হল অনিকেত। উদ্দেশ্য জানানোই ছিল। টপ রেকর্ডারটা টেবিলে অন। উনি বলে যাবেন। প্লাস্টিক সার্জারি পরে।
সুধীরবাবু বলছেন, “বৈষ্ণব সমাজে, বুঝলে, দু’টি ধারা চালু আছে। একটা উচ্চবর্গের ধারা, চাঁরা বৃন্দাবন পরিচালিত, আর একটা অবতল সমাজের, যাঁরা ততটা শাস্ত্রপরায়ণ নন, বরং হিজিয়া সাধনার পথে খানিকটা প্রতিবাদী, যা অনেকটা গুপ্ত, গুহ্য, প্রধানত গুরুবাদী। যৗনাচারও আছে।’
অনিকেতের মনে হল, আচরণগত উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গ ভেদ সর্বত্রই। তথাকথিত এলজিবিটি- দর দু’টো বর্গ। উচ্চবর্গে এনজিও, সেমিনার, সিনেমা, সংবিধান সংশোধন; আর নিম্নবর্গে ইজড়া, গুরুমা, লন্ডা, ঘাটু। উচ্চবর্গে এসআরএস, নিম্নবর্গে ছিন্নি। খালাসি ড্রাইভার হতে চায়, যাবার সোডা বেকিং পাউডার হতে চায়, মামলেট চায় ওমলেট হতে। ব্যবসা করে সামান্য য়সা হাতে পাওয়া বাগদি-বাউড়ি ঘরের পুজো-আচ্চায় দেহুরির বদলে বামুন, ভদ্রলোক- দ্রলোক খই আর পয়সা ছিটিয়ে শবযাত্রা…। ‘এই নিম্নবর্গের বৈষ্ণবরা বৈধী সাধনাকে মানেন।। এরকম প্রতিবাদী ধরনধারণের জন্য নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব সমাজ, যাঁরা মঠ-মন্দির-আখড়া গড়ে তিষ্ঠিত, তাঁরা এঁদের ভাল চোখে দেখেন না। কিন্তু অন্ত্যজ বৈষ্ণবরা ওঁদের মতো কাজ করে গান…।’
এরাও ফ্যাতাড়ু বুঝি? ওই যে সেমিনারে যখন ভাষণ-কবিতা পাঠ চলছিল, ওরা বাঁশির দ্মবেশে থাকা রাংতা-কাগজের পুংলিঙ্গ ফোলাচ্ছিল ফুসফুসের ফুঁয়ে, ফ্যাতাড়ু ওরাও। ঠিকরি’-মারা হিজড়েরাও। কাপড় তুলে ওদের প্রতিবাদ, খিস্তিতে, অ্যানার্কিতে…. নিজেদের বংস করে…।
সুধীরবাবু বলছেন—
“বলরামী-সাহেবধনীদের সঙ্গে বৃন্দাবন বা গৌড়ীয় মঠের সম্পর্ক নেই। একটা সম্প্রদায় আছে, যারা গদাধরী। জয়ানন্দ ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ নিতাই-গদাধরের সম্পর্কের কথা লিখেছিলেন :
একদিন নবদ্বীপে শচীঠাকুরানী
গদাধর জগদানন্দ কোলে করা আনি।
সমুদ্রমথনে যেন লক্ষ্মীর উদয়
গৌরাঙ্গের কেবল গদাধর প্রেমময়
গৌরচন্দ্র বলেন মা গদাধরে আমি
নানা অলঙ্কার দিয়া ঘরে রাখ তুমি
শ্রীরামের সীতা যেন কৃষ্ণের রুক্মিণী
গৌরাঙ্গের গদাধর জানিও আপনি…।
চৈতন্য-অনুগামী এই সম্প্রদায় নিজেদের ‘গদাধর’ ভাবে। সেজে-গুজে থাকে, প্রায় নারীস্বভাবে চৈতন্য সেবা করে। কিন্তু জানো, সমন্বয়ও হয়। বাঙালি খুব সমন্বয়পন্থী। সত্যপিরের সঙ্গে নারায়ণের সমন্বয় ঘটিয়েছে, আবার চাউমিনে ধনেপাতা। দ্যাখো, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করে যে, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং চৈতন্যরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন প্রেমের তিনটি স্বরূপ আস্বাদন করার জন্য। রাধার প্রেমমহিমা কেমন, শ্রীরাধার কেমন অনুভব প্রেমনিবেদনে; দ্বিতীয়ত, রাধার কেমন অনুভব কৃষ্ণপ্রেম আস্বাদনে; তৃতীয়ত, শ্রীকৃষ্ণের কেমন অনুভব শ্রীরাধার নিবেদিত প্রেমমাধুর্যে? তিনটি বিষয়ের জ্ঞানপিপাসায় রাধাভাবদ্যুতি সুবলিত শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয় শচীমাতার গর্ভে। শ্রীচৈতন্য স্বয়ং রাধা-ভাবে কৃষ্ণকে যাচনা করেছিলেন, এরপর কি সাধারণ বৈষ্ণবদের রাধা-ভাবে ভজনা করা সাজে? চৈতন্য তিরোধানের বেশ পর, নতুন একটি ধারার উদ্ভব হল—সখী-ভাবে সাধনা করা। রাধা-ভাব নয়, সখী-ভাব। শ্রীরাধার যারা সখী ছিল, ললিতা, বিশাখা, চন্দ্রাবলী প্রমুখ—এরা রাধা-কৃষ্ণ সেবা করত। এই সখী- সাধনাকে বলা হয় ‘মঞ্জরী সাধনা’। উচ্চবর্গের বৈষ্ণবরাও এই সাধনা করতে লাগল, অন্যরকম ভাবে নিম্নবর্গের বৈষ্ণরাও। সুধীরবাবু বলছেন, ‘আমাদের মাস্টারমশাই চিন্তাহরণ চক্রবর্তী মঞ্জরী সাধনার কথা বলেছিলেন প্রথম। মঞ্জরী সাধনা যারা করে, তারা নিজেদের শুধু সখী ভাবে না। সখীদের সখী। মানে, আরও সামান্য নারী। বড় কঠিন সাধনা। শুধু মনে নয়, চলাফেরায়, কথাবার্তায় একেবারে মেয়েদের মতো লজ্জাশীলা হতে হবে। নিচুস্বরে কথা বলা, আস্তে হাঁটা, ঘোমটা টেনে মুখ ঢাকা…।”
অনিকেত বোঝে, এই মেয়েলিপনাও কেমন আরোপিত হয়। চাপানো। এই নিচুস্বরে কথা বলা, ঘোমটা টানা, এগুলো প্রাক্-ঔপনিবেশিক মেয়েলিত্ব। উচ্চবর্গের মেয়েলিত্ব আর নিম্নবর্গের মেয়েলিত্ব এক নয়। আদিবাসীদের মেয়েলিত্ব আর ব্রাহ্মণ্য মেয়েলিত্ব এক নয়। প্রাক্-বিশ্বযুদ্ধ আর যুদ্ধোত্তর মেয়েলিত্ব এক নয়। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’-র নসুর মেয়েলিত্বে ছিল পান সাজা, সুপুরি কাটা, রান্নার কাঠ জোগাড় করা, পিঠে-পায়েস করা, ব্রত করা; আর পরিদের মেয়েলিত্বে ভ্রু-প্লাক করা, নেলপালিশ পরা, পারলে নারীবাদী কবিতা লেখা।
সুধীরবাবু বলতে লাগলেন—চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর একটা জিজ্ঞাস্য ছিল আদি নবদ্বীপ কোথায় ছিল? নানাজনকে জিগ্যেস করে ঠিকমতো জবাব পাননি। একজন বললেন, নবদ্বীপের ললিতা সখীর কাছে চলে যান, উনি প্রমাণ দিয়ে ঠিক কথাটাই বলবেন। উনি মহাপণ্ডিত। উনি এখন সখী-সাধনা করেন। নিজেকে একেবারে মেয়েদের মতো করে ফেলেছেন। খুব ভোরে উঠে দাঁড়িগোঁপ কামিয়ে শাড়ি পরে নেন, ঘোমটা টেনে আশ্রমে এমন ঢং-এ চলা ফেরা করেন, আর মেয়েদের মতো করে কথা বলেন যে কেউ বুঝতেই পারে না যে উনি মূলে একজন পুরুষ। ওঁর কাছে চলে যান।
চিন্তাহরণবাবু ওই আশ্রমে গেলেন। অভিলাষ জানালেন। ওই আশ্রমের একজন বললেন, ভাল দিনে এসেছেন। ললিতা সখী আজ দর্শন দেন। দর্শন পাওয়া গেল বিকেলে। রাধাকৃষ্ণের দিবানিদ্রার ব্যবস্থা করে তিনি কম্বলের আসনে বসেছেন, ঘোমটা-টানা মুখ। একজন পুরুষ, ইউনিভার্সিটিতে এমএ পর্যন্ত পড়ে গোল্ড মেডেল পেয়েছেন, তারপর ভক্তিপথে দীক্ষা। উনি মাথা নিচু করে একটা হাতের ওপর অন্য হাতটা রেখে মৃদুস্বরে জিগ্যেস করলেন, কী আপনার জিজ্ঞাস্য? স্যর জানতে চাইলেন, প্রকৃত নবদ্বীপে কোথায়, নয়খানি দ্বীপ কি ছিল? শ্রীচৈতন্য ঠিক কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন…?
উনি কম্বলের ওপর আঙুলের আঁকিবুকি কেটে মাথা নিচু করে বলেছিলেন, আমি ব্রজনারী। গোয়ালার মেয়ে। অত সব কি জানি? এই বলে উঠে গেলেন। পায়ের নুপুর বাজল।
সুধীরবাবু বললেন, এ তো আমার স্যর চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর কথা।
আমি নিজেও দেখেছি। মালদহ বইমেলায় বক্তৃতা করতে গিয়েছি, কমিটি থেকে বলল, বক্তৃতা বিকেলে, সকালে একটু ঘুরে আসুন, কাছেই রামকেলি, চৈতন্য মহাপ্রভু এসেছিলেন এখানে। পথেই রাজগ্রাম, রাধা-দামোদরের মন্দির। সেখানে আশ্চর্য হয়ে যাবেন সেবাময়ীকে দেখে। সত্যিই আশ্চর্য হলাম গান গাইছেন সেবাময়ী, আর চন্দন ঘষছেন। পরনে তসরের শাড়ি, কপালে চন্দন টিপ, খালি পা, আলতা পরা, লম্বা চুল খোলা, মুখে স্নিগ্ধ হাসি, যেন বৈশাখী ভোর। ইনি নাকি পুরুষ। সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় এক অধ্যাপক। উনি আমাকে দেখিয়ে বললেন, ইনি একজন অধ্যাপক। ইনি জানতে চান আজ ভোর থেকে কী কী করলে?
কমনীয় কণ্ঠে সে বলল—আমি তো কিছুই করিনি, তাঁদের সেবাকর্ম তিনিই করিয়ে নিয়েছেন আমাকে দিয়ে। এ হল আমাদের আত্মবৎ সেবা। ভোরে করতালি দিয়ে রাধা- দামোদরকে সতর্ক করে মন্দিরে প্রবেশ করি, তারপর তাঁদের সিংহাসনে বসিয়ে ভেজাফুল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিই, বাইরে পাখির কুজন চলে, ওঁরা শোনেন, তারপর নিজে একটা কীর্তন শোনাই, তারপর একটু ক্ষীর দিই—এরকম আর কী।
আরও তো কত কী করো, দুপুরের সেবা, শয়ন, বিকেলে জাগরণ…
সেবাময়ী ছোট্ট করে জিভ কেটে বলল, সেবা-র কথা কি অত ফলাও করে বলতে হয়? আমি হলাম সখীর সখী। যতটা পারা যায় প্রচ্ছন্ন থাকতে হয়। যাকগে। একটু প্রসাদ আছে। সেবা নেবেন।
যেন বাড়ির বড় বউদি। না খাইয়ে ছাড়বে না। আমার সঙ্গের অধ্যাপকটি সহজে ছাড়ার পাত্র নন। উনি জিগ্যেস করলেন, রাধা-দামোদর’কে মাঝে-মাঝে চমকে দিতে ইচ্ছে করে না? লাজুক হেসে বলেন, তা তো করে বইকি। যেমন ধরুন, কখনও স্নানের জলে মিশিয়ে দিলাম অগরু, রাতের শয়নে বস্ত্রে দিলাম কস্তুরী, হঠাৎ করে একদিন কয়েতবেল মাখা, মাঝেমধ্যে বেলের শরবত, কখনও মুচকুন্দ ফুলের শরবত।
—মুচকুন্দ ফুল? আফ্রোডেজিয়াক বলে খ্যাতি আছে না? অনিকেত বলে।
সুধীরবাবু বললেন, ঠিকই ধরেছ। তবে আরও কী জানো? ওই অধ্যাপক আমার কানে- কানে পরে বলেছিলেন, মাসে চারদিন সেবাময়ী মন্দিরে ঢোকে না। ঋতুচক্রে থাকে কিনা, তখন অন্য সেবাময়ীরা এই কাজগুলো করে।
সুধীরবাবুর রেকর্ডিংটার পর নবদ্বীপ গিয়েছিল অনিকেত, কোথায় ‘সখী সাধনা’ হয় জেনে নিয়েছিল। ওখানে এরকম কোনও সেবাময়ীর সাক্ষাৎ না-পেলেও দু’-একজন গোস্বামীকে পেয়েছিল, যাঁরা ভোগ-রাগ-আরতির সময় শাড়ি পরেন, গান ও রেকর্ড করতে পেরেছিল, ‘হে রাধিকা প্রাণাধিকা আমি তব সেবিকা, এই সংসার বৃন্দাবনে সদা পাই তব দেখা।’
অনুষ্ঠানটা তৈরি করল অনিকেত। ‘সখী সাধনা’। বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের গানটার দু’টো লাইন ব্যবহার করে শুরু করেছিল। ‘রাই জাগো রাই জাগো’ গানটারও দু’লাইন, স্টক থেকে, তারপর সুধীরবাবুর কথার ফাঁকে-ফাঁকে নিজস্ব লিংকিং ন্যারেশন। মূল প্রতিপাদ্য ছিল, নারীত্ব-পুরুষত্ব মনের ব্যাপার, বাইরে কে কী লিঙ্গচিহ্ন ধারণ করে আছে, সেটা গৌণ। ‘কী বা অন্তর নারী-নরে অন্তরে রয় যদি ধন।’
যেন পরি-র জন্যই।
ওর কথা ভেবেই অনুষ্ঠানটা তৈরি।
পরি-র ‘মেল আইডি’-টা জোগাড় করেছিল অনিকেত। একটা চিঠি লেখে পরিকে—
স্নেহের পরি, তোমার প্রতি আমার একটা সফট কর্নার আছে, তুমি সেটা জানো। তোমার মানসিকতা আমি অনেকটাই বুঝি। তুমি আনুষ্ঠানিক ভাবে তোমার সঙ্গীকে স্বীকৃতি দিতে চাও, এটা ভাল কথা, আমাদের সমর্থন আছে। কামনা করি, এই সঙ্গী যেন স্থায়ী জীবনসঙ্গী হয়। তুমি জানিয়েছ, এই অনুষ্ঠানটির আগে তোমার শরীরটাকে সাজিয়ে নিতে চাও। অর্থাৎ সার্জারির সাহায্য নিতে চাও। দ্যাখো পরি, এতে অনেক হ্যাজার্ডস। আমি একটা ফাইল-ও ‘অ্যাটাচ’ করে দিচ্ছি তোমায়, ‘My monolouge’। একজন ‘এসআরএস’-করা লোক নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। পড়ে দেখো। সেই সঙ্গে বলি, আগামী রবিবার রাত ন’টায় কলকাতা ক-তে একটা অনুষ্ঠান শুনো। তোমার হয়তো কলকাতা ‘ক’ ধরার মতো রেডিও নেই। তা হলে সোমবার দিন রাত দশটায় ‘এফএম রেনবো’ শুনো। প্লিজ শুনো। শরীর তোমার। তোমার শরীরে তোমারই অধিকার। কিন্তু ঝোঁকের বশবর্তী হয়ে এমন কিছু কোরো না—যা তোমাকে নানা সমস্যায় বিড়ম্বিত করবে। মনটাই আসল। মন-ই হরমোনের নিয়ন্ত্রক। বাইরের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে ভিতরের মন। বাইরের শরীরটা ইগনোর করতে পারলে, সমস্যা নেই। একটা উপন্যাস পড়লাম, তিলোত্তমা মজুমদারের, ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’। ওখানে নারীদেহধারী পুরুষ এবং পুরুষদেহধারী নারীর নিবিড় সম্পর্ক দেখলাম। দেহ গঠন বাধা হয়নি। তা ছাড়া, শরীর-চাহিদা আর ক’দিনের শেষকালে দেখো যেটা থাকে, সেটা ভালবাসা। বাৎসল্য হল ভালবাসার একটা উচ্চতর স্তর। যা করবে ভেবে করবে। আর ওই অনুষ্ঠানটা আমার বাড়িতেই কোরো। তোমার কাকিমা তা-ই চায়।
বাংলায় লেখা চিঠিটা স্ক্যান করে পরির মেল-এ পাঠিয়ে দিল অনিকেত।
অনিকেত যেটা লিখতে পারল না, তা হল : পায়ুমেহনেই যদি তোমাদের যৌনতা মেটে, তবে কেন মাংস কুঁদে-কেটে যোনি নির্মাণ?
৬৯
পরি মেল-টা পেয়েছিল, পেয়ে ভাল লেগেছিল। ওর জন্য এতটা ভাবে অনিকেত কাকু? যা লিখেছে, অন্তর থেকেই লিখেছে। রেডিও-র ফিচারটাও শোনে, যদিও ওটা পরির মনে খুব একটা দাগ কাটে না, ওসব তো রিচুয়াল্স। বিশ্বাস। সুফিদের একরকম সাধনা, বাউলদের আরেকরকম। ওরা সখী-’ভাবে’ সাধনা করে কৃষ্ণকে কাছে পায়, কিন্তু পরির এই ব্যাপারটা তো সাধনা নয়, বিশ্বাস নয়, সম্পূর্ণ জাগতিক কিছু পাওয়ার লড়াই। পরি আগেই ঠিক করেছিল- ‘একতলা’–র কাজটা পরে করাবে, আগে ‘দোতলা’-টা করে নেবে। বিয়ে করবে, সাজবে না? বডি-টা সাজাবে না? নইলে কী সমর্পণ করবে চয়নকে? কোমল, বিকশিত যৌবনের বসন্ত সমীরে কুসুম হয়ে ওই ফুটেছে বাহিরে, সৌরভ সুধায় করে পরান পাগল।’
স্তন, আহা স্তন, হোক সিলি সিলিকোন।
পরি উত্তর দিল, লিখল, ‘আই উইল অনার ইওর সাজেশন। মে নট গো ফর মেজর সার্জারি।’ তারপর ফোনও করেছিল। বলেছিল, আমার ছোট শখটুকু মেটাতে দিন কাকু।
পঞ্জিকা দেখল। শ্রাবণ মাসের শেষে কবে-কবে বিয়ের দিন আছে। ২২, ২৪ আর ২৭। 22 শে শ্রাবণ পড়েছে ১৫ অগাস্ট। মন থেকে বেরিয়ে এল ‘বন্দেমাতরম্’ ‘জয় হিন্দ’ ওই দিনেই বিয়েটা সারতে হবে। দারুণ দিন। তীর্থঙ্করের সঙ্গে ঘটস্থাপনের দিনটাও ঠিক করে নিল। ২০ জুলাই।
এবার একটু বুক ধুকপুক করছে। অ্যানাস্থেসিয়া করে অপারেশন। বুকের চামড়া কেটে স্যাক ঢুকবে, তাতে সিলিকোন ঢুকবে। স্যাক বন্ধ হবে, চামড়া সেলাই হবে। নিপলের তলায় অন্য ট্যিসু দিয়ে নিল ফুলিয়ে দেবে। চামড়া টেনে অ্যারিওলা বড় করবে। দু’-আড়াই ঘণ্টা সময়, যদি জ্ঞান না-আসে?
চয়ন কয়েকবার বলেছে, টাকা-পয়সাগুলো ‘জয়েন্ট’ কর, যে কোনও কারও সঙ্গে। ‘সিঙ্গল অ্যাকাউন্ট’ রাখা কি ঠিক? ও সোজাসুজি বলেনি ওর সঙ্গেই করতে, কিন্তু ইচ্ছেটা এরকমই। কিছু টাকা চয়নের সঙ্গে ‘জয়েন্ট’ করল। বলল, কিছু একটা হয়ে গেল বাবাকে দেখো। চয়ন বলেছিল, যত্ত আনসান কথা। তারপরই চয়ন বলেছিল, বাকি টাকা? পরি বলেছিল, কেন? ফিরব না নাকি? ওটা তো আনসান কথা ছিল। নিজের নামেই আছে।
তারিখ দু’টো জানাতে অনিকেত কাকুর কাছে গিয়েছিল। মিষ্টির বাক্সো নিয়ে। ‘দোতলা’-র কাজটা করাবে সেটা বলবে। ওদের তো ‘দোতলা’র কাজ, ‘ঘটস্থাপন’ এসব বলতে পারবে না, ‘বুক্স মেকিং’-ও নয়, ‘ব্রেস্ট অগমেন্টেশন’-ই ভাল
পরি বলল, ২৭ শ্রাবণ বিয়ের দিন ঠিক করেছি।
—তাই নাকি? শুক্লা জেঠিমা খুশি-খুশিই দেখাল। অনিকেত কাকুকে বলল, পঞ্জিকাটা দাও দেখি। পঞ্জিকা খুলে বললেন, তুমি তো খুব ভাল দিন বেছেছো গো…
পরি ‘গো’ শব্দটা লক্ষ্য করে। ‘বেছেছো হে’ বলতেই পারতেন শুক্লা জেঠিমা। একদম গোধূলি লগ্নে বিয়ে। শুক্লপক্ষের দ্বাদশী। তার মানে সূর্যটা ডুবলেই আকাশে চাঁদ বেরুবে।
—ওই অনুষ্ঠানে কি বেশি লোকজন বলবে?
পরি বলে, না, কাকে আর বলব? অফিসের দু’-চারজন, চয়নের একটা ছোটবেলার বন্ধু আছে। ওদের বাড়ির কেউ থাকবে না। আমার বাবা, আর আমরা। সব নিয়ে দশজন, ব্যস।
তা হলে আমার বাড়িতেই তোমরা সবাই তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি নিজে হাতে তো রান্নাটা করতে পারছি না এখনও, আমি করিয়ে নেব। হোম ডেলিভারি আনব না।
পরি বলে, বেশি ঝামেলা করতে যাবেন না। খুব সিম্পল আইটেম।
—তাই বলে তো কুমড়োর ছোকা আর মটরের ডাল দিয়ে তো সারা যাবে না। সে দেখা যাবে।
পরি বলল, তার আগে বিশে জুলাই আর একটা কাজ করাব। ব্রেস্টটা একটু ঠিক করিয়ে নেব।
শুক্লা বলল, অপারেশন?
পরি বলল, ছোট্ট অপারেশন। পঞ্জিকাটা আবার হাতে নেয় শুক্লা।
অনিকেত শুক্লার টেনশন কমাতে চায়। বলে, না কোনও রিস্ক নেই।
শুক্লা বলল, জানি, মডেল, অ্যাকট্রেস-রা করায়….।
আবার পঞ্জিকা দেখতে বসে শুক্লা। বলে, ওমা! ওই দিন তো আবার পৈতেরও দিন। দোসরা শ্রাবণ। ভালই তো হল। তুমি দ্বিজ হবে।
অনিকেত শুক্লাকে বুঝতে পারছে না। আজও বুঝতে পারল না। ও ভাবতেই পারেনি শুক্লা এভাবে ব্যাপারটা দেখবে।
কিছু কেনাকাটা আছে। অপারেশনটা হয়ে গেলে বেশি টাইম পাওয়া যাবে না। চার-পাঁচদিন তো পুরো শুয়েই থাকতে হবে। তারপর বেশি ঘোরাঘুরি করতে পারবে না। নিনাকে নিয়ে বেরল পরি। পারফিউম, চটি, ফুলদানি, এসব কিনল। দু’টো গেঞ্জি পছন্দ করেছিল নিনা, গেঞ্জিতে লেখা ‘প্রেস’ আর একটা স্মাইলি। বোঝাই যাচ্ছে এই ‘প্রেস’ মানে সংবাদঘটিত কিছু নয়, চাপো, চাপ দাও। প্রেস করো। প্রেস এখানে ‘ভার্ব’। আর একটা গেঞ্জিতে একটা মাকড়সার ছবি ছিল। পরি বলল, এসব গেঞ্জি ‘মাচো’দের মানায়। ও তো ততটা ওরকম নয়…। পরি তারপর বলল, জানো তো, কপুলেশনের পর মেয়ে মাকড়সা ছেলে মাকড়সাদের খেয়ে নেয়। মাকড়সার ছবি একদম কিনব না। আর একটা গেঞ্জির ওপর লেখা ‘ককটেল’। নিনা এটাও বাছল। পরি বলল, যত সব অসভ্য লেখার দিকের নজর। শেষ অবধি গেঞ্জির ওপর দু’টো সমান্তরাল রেখা, মানে প্যারালাল লাইন আঁকা গেঞ্জিটা পছন্দ করে পরি। তলায় লেখা ‘এন্ডলেস’। বলে, হরাইজেন্টাল লাইন দু’টোর জন্য ওর বুকটা আরও চওড়া দেখাবে।
নিনা বলছিল, আমার একটু বেশ চওড়া কাঁধ, ম্যাসকিউলিন ছেলেদের ভাল লাগে। কিন্তু সলমন খান, শাহরুখ খানদের মতো ওয়াক্সি বডি ভাল লাগে না। যতই প্যাক থাক। আমার কিন্তু হেয়ারি ভাল লাগে।
পরি, আমারও।
—তীর্থঙ্করদা কি হেয়ারি রে? পরি জিগ্যেস করে ফেলে।
অ্যাই…আমার বরের দিকে নজর দিবি না…একটা কপট হুমকি দেয়। তারপর বলে ইয়েস।
পরি বলে, চয়নও তাই, কিন্তু মাসকুলার নয়, একটু গোলগাল টাইপ। আমার জিম করা ট্রিম বডি অত ভাল লাগে না। আমার ভাই মনটাই বেশি টানে। তারপর গুনগুন করে গায় এই মনটাই করে যত গোলমাল। পরি বলে শোন, তোর বর তো আমার সব দেখবে। দেখুক গে, কিন্তু বলে দিস, বুক দু’টো যেন বেশ ভাল ক’রে করে দেয়!
আজ সেইদিন। পঞ্জিকা অনুযায়ী পৈতের শুভদিন। সকাল থেকেই সুবাতাস বইছে। একটি পরবর্তী জীবনের লোভ বয়ে আনছে প্রভাত বাতাস। চয়ন এসেছে। ট্যাক্সি ডেকে এনেছে একটা। পরি ওর মায়ের ছবিতে প্রণাম করল, মা গো, দুঃখী মা, সবই তো তোমারই জন্য, জীবন নিংড়ে দিলে আমার জন্য। আমি একটা কন্যা উপহার দেব মা, যেন পারি, আশীর্বাদ করো। নির্মল জল পরির দু চোখে। বাবার পায়েও আঙুল ছোঁয়ায় পরি। ট্যাক্সিতে ওঠে। ট্যাক্সি নয়, ভেলা। গাঙুরের জলে ভাসালাম নিজেকে মা গো। অমরায় যাব।
নার্সিংহোমটার নাম অমরাবতী। চেয়ারে, বেঞ্চিতে মানুষের স্তূপ চুপ করে আছে। তীর্থঙ্করের চেম্বারে গিয়ে বলল এসে গেছি।
এর আগে কখনও হাসাপাতালে ভর্তি হতে হয়নি পরিকে। হাসপাতালের আলো, হাসপাতালের গন্ধের মধ্যে ডুবে গেল পরি, কাচের দরজার গায়ে লেখা অপারেশন থিয়েটার। কে জানে থিয়েটার লেখা থাকে কেন?
ঘরের ভিতরে নিস্তব্ধতা। ডাক্তারের গায়ে হিম সাদা অ্যাপ্রন। আরও দুজন নার্স।
তীর্থঙ্কর দুটো পাঁশুটে রঙের জিনিস একটা বাক্স খুলে বার করলেন। ডাক্তারের হাতে নেচে উঠল ও দুটো। বললেন এটা তোমার স্যাক্। বুকের তলায় প্লেস করে দেব। তারপর সিলিকোন ভরে দেব। নার্সকে বললেন–স্টেরিলাইজ করো। টেবিলে শুয়ে আছে পরি। পরির পোশাক নেই, সাদা চাদরে ঢাকা। গলা থেকে পেট পর্যন্ত ভেজা তুলোর শীতল স্পর্শ। স্টেরিলাইজ্ড হচ্ছে পরি। নার্স দিদিদের মুখে স্মিত হাসি। মোনালিসার মুখ থেকে ধার করা। কিছুটা রহস্য কিছুটা বিদ্রূপ মেশানো। এসির ঘড়ঘড় শব্দে ভেসে আসছে রগড় রগড়…। স্যালাইন বোতল ঝুলল। কোনও ব্যথা লাগবে না, একটু-একটু…। একটা চ্যানেল করা হল হাতে। ব্যথা। ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে, তখন আপনি এসে দ্বার খুলে দাও। ডাকো তারে। কাঁটার পথে ধায় সে তোমার অভিসারে….। একটা ইনজেকশন। ধূসর…ধূসর…। আমার যাত্রা হল শুরু।
অপারেশন হল। জ্ঞান ফিরতেই দেখল আই লেভেল পাল্টে গিয়েছে। আগে শুয়ে শুয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল দেখতে পেত, এখন পাচ্ছে না। চোখের সামনে আড়াল। মোহিনী আড়াল। নীল চাদরে ঢাকা। একটা হাতে স্যালাইন চলছে বুঝতে পারল। অন্য হাত দিয়ে একবার ছুঁতে ইচ্ছে করল এই নব স্তন। হাতটা বাঁধা। নার্স এগিয়ে এল। ছুঁতে ইচ্ছে করছে? একদম না। এই জন্যই তো হাতটা বেঁধে রাখা হয়েছে। ছটফট করবেন না। ঘুমোন। তার আগে হাঁ করুন।
দু’চামচ জল খাইয়ে দিল।
বুকের ওপর একটা অদ্ভুত ধরনের ভার। ঘট ভরেছে। মঙ্গল ঘট। পারে না, আবার চোখ বুজে যায়। চিনচিনে ব্যথা টের পায় পাঁজরায়। এ ব্যথা ভাল ব্যথা। চোখ বোজে। আবার যখন চোখ খুলে দেওয়ালের ঘড়িতে দেখল সাড়ে চারটে। ন’টা বাজতে পাঁচে টেবিলে ওঠানো হয়েছিল। ডাক্তার তীর্থঙ্কর বলেছিল বিকেলে এসে বলবেন সন্ধের সময় ছাড়া যাবে কি না, না কি কাল সকালে।
নার্সকে ডাকল, বলল, হাতটা খুলে দিন, নাকটা চুলকোচ্ছে। নার্স বলল, আমি নাক চুলকে দিচ্ছি। একটু পর চয়ন এল। চয়ন প্রথমেই বলল, বাঃ ভাল হয়েছে তো। মাথায় হাত বোলাতে গেল। নার্স বলল, গায়ে হাত দেবেন না এখন। ডা. তীর্থঙ্কর এল। চয়নকে বাইরে যেতে বলল। চাদরটা সরাল, একটা সাদা হাউসকোট পরানো আছে, হাল্কা বাঁধনের বেল্ট খুলে দিল। চোখের সামনে আয়না একটা ধরল। পরি দেখল ওর স্তন। উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে! প্রেমের সংগীত যেন বিকশিয়া উঠিছে পড়িছে ধীরে হৃদয়ের তালে। ডাক্তার বললেন, কী খুশি তো? হাতে একটা গ্লাভস পরে নিল ডাক্তার। একটা খুন্তির মতো জিনিস দিয়ে বুকটা নাড়াল সামান্য। হাতে ধরল না। হোক সিলিকোন, মেয়েদের বুক কিনা। বলল, বুকের তলায় সেলাই আছে। একটা দাগ থাকবে, পরে অনেকটা মিলিয়ে যাবে। এখন একটা ব্যান্ডেজ আছে। আজ এখানে থেকে যাওয়া ভাল। কাল সকালে বরং ছেড়ে দেব। তিনদিন পরে আসবেন। এখন দিন পনেরো যেন কোনও প্রেশার না পড়ে। বি কেয়ারফুল। প্রিউইক্স হলে ভালো।
হাতটা খুলে দিল। স্যালাইনটাও উঠিয়ে নিল। বলল, একদম টাচ করবেন না আজ।
ডাক্তার চলে যেতে চয়ন এল। ছুঁল না। পরি বলল, পরে, অ্যাঁ? চয়ন সুবোধের মতো ঘাড় নাড়ল। পরি বলল, বাবাকে দেখো।
পরির তো ওয়ানরুম ফ্ল্যাট। ওর বাবা থাকত ঘরে, পরি ডাইনিং স্পেস-এ ডিভানে। যখন রাতে আয়া ছিল, বাবার ঘরে। আজ আয়ার ব্যবস্থা আছে। কয়েকদিন থাকবে। চয়ন নিশ্চয়ই ও বাড়িতে কিছুক্ষণ থেকে রাতে চলে যাবে।
সাতদিনের ছুটি নিয়েছে পরি। বিশ্রাম। টিভি, বই। সঞ্চয়িতা থেকে লিপিকা আর কণিকার ছোট কবিতাগুলি পড়ছিল বারবার। এখানে একটু আটকে গেল।
কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে
আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কিরে? থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে
আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে।
ওর সেই প্রথম যৌবনের বন্ধুদের মনে পড়ে। রতন…। দেবু…। ওরা নেই। ওদের ছিল ন্যাকড়া গোঁজা বুক। পরিরও তাই ছিল। এখনও কতজনের ন্যাকড়া গোঁজা বুক আছে, যারা দামী ইমপ্লান্ট নিতে পারেনি…। আমি কি হয়েছি আলাদা? পরির মনে হয়।
অনিকেত একদিন খুঁজে খুঁজে চলে এল এ বাড়িতে। এই প্রথম। ফল নিয়ে এসেছিল অনেক। আম, জাম। পরির মুখের দিকে তাকিয়ে কখনও, অন্যদিকে তাকিয়ে কখনও কথা বলল। বুকের দিকে তাকালই না। পরি একটা ম্যাক্সি পরেছিল। পরি বলল, আমাকে ভাল দেখাচ্ছে জেঠু? অনিকেত বলল, খুব সুন্দর। তবে আর কিছু করতে যেও না। এই ঠিক আছে। পরির বাবার সঙ্গে কথা বলল কিছুক্ষণ। পরির বাবা বলল, আপনাদের আশীর্বাদে পরি চাকরি বাকরি করছে। আমার জন্য ও অনেক করেছে। আমি তো ওদের ছেড়ে গেসলুম, ও না দেখলে আমাকে রাস্তার কুকুর-শকুন ছিঁড়ে খেত।
যেন রোজই একবার করে আসে, ওর বাবার ওষুধ কিনে দিয়ে যায়, ওকেও ওষুধপত্র খেতে হয়। চয়ন নিয়ে আসে। কোনও দিন বলে তোমার দুটো ওষুধের দাম আমিই দিলাম, তোমার থেকে নিইনি। সবটাই আমারই দিতে ইচ্ছে করে, জানো? পরি টুকরো হাসি দেয়। চয়ন একদিন বলল—একটু দেখাও না পরি, যেমন হল দেখতে ইচ্ছে করে না বুঝি…। পরি হাউসকোটের বেল্ট আলগা করে। পরি দুষ্টুমি ভরা হাসি হেসে উন্মুক্ত করে, সঙ্গে সঙ্গেই ঢেকে দেয়। চয়ন বলে ছুঁই! একবার ছুঁয়ে দেখি? পরি বলে না, একদম না। ডাক্তার বলেছেন তিন সপ্তাহ কিচ্ছু না। রইলোই তো, তোমারই জন্য
চয়ন ওর মোবাইলটা ভুল করে ফেলে গেল। আওয়াজ হল বিপ্ বিপ্। চয়নের মোবাইলে ভেসে উঠল একটা এস.এম.এস.। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা শব্দ। PUJA ইনবক্স এ এক বন্ধ খামের ছবি। তলায় লেখা Amar Sathe korle keno a….. মোবাইলের open অপশনে আঙুল চলে যায় পরির। ওপেন করলে পুরে মেসেজটা দেখতে পাবে। দ্রুত আঙুল সরিয়ে নিল পরি। কে পূজা? আমার সাথে করলে কেন… কী? একটা ‘a’ অক্ষর পড়ে আছে। বাকিটা ভিতরে। খামের ভিতরে।
‘a’ দিয়ে কী হয়? আড়ি? অভিমান? অভিনয় ও তো হয়। আমার সঙ্গে করলে কেন অসভ্যতা নয়তো…আবার ভার্চুয়াল নামটা খোলার জন্য আঙুল চলে যায়। আবার সরিয়ে নেয়।
থাক। এটা চয়নের পার্সোনাল মেসেজ। খুললেই ও বুঝে যাবে। বলবে আমার মেসেজ খুললে কেন? অথচ একটু আগেই পরি খুলে দিয়েছিল ওর জামা। চয়ন, তোমার বন্ধ খাম আমার কাছে খোলোনি, অথচ আমার সব কিছু। সব কথা বলেছি তোমায়। আমি তোমার জন্যই তো কাঁটাপথে অভিসারে চলেছি। অথচ তুমি……
কে পূজা? পূজা কে?
ওর কোনও ছাত্রী এরকম মেসেজ করবে কেন? করতেও তো পারে। আমার সাথে করলে কেন অনিয়ম হতে পারে না বুঝি! ঠিক মত পড়াতে আসছে না, আমার কাছে আসতে হচ্ছে তো…। তাই যেন হয়। মেসেজ বক্সের দিকে তাকিয়ে থাকে পরি। যেটা এইমাত্র এল, সেটা খোলে না। ইনবক্স এ আরও মেসেজ আছে। পরির মেসেজও আছে। গত কালকের করা দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি। এই তো রয়েছে। এরপরই পূজার মেসেজ। ‘খুব মাথা ধরেছে’। মেসেজগুলো দেখতে লাগল পরি। ‘কাল ঠিক ঠাক হয়েছিল।’ তিন দিন আগেকার একটা মেসেজ পেল রিলেশনশিপস আর লাইক বার্ডস্। ইফ ইট হোল্ড টাইটলি, দে ডাই, হোল্ড লুজলি, দে ফ্লাই। ছাত্রী? ছাত্রীর সঙ্গে রিলেশনশিপ নিয়ে কি কথা হতে পারে? পারে। পারে। কিন্তু কাল কী ঠিক ঠাক হয়েছিল? কী? কী? কী? ট্রানশ্লেশন। বাক্যরচনা। আর কিছু নয় খারাপ ভাববোনা।
এর আগেও চয়ন মোবাইল রেখে দোকানে গেছে, চা করতে গেছে, পরি কখনও ঘাঁটেনি। কোনও কৌতূহল দেখায়নি। আজ হাতে নিয়ে…. শক্ত করে মোবাইলটা চেপে ধরে। হোল্ড টাইটলি, দে উইল ডাই। মুঠি আলগা করে। উড়ে যা উড়ে যা…।
মাথা ভোঁ ভোঁ করে পরির। চয়ন, তুমিও?
চয়ন ফিরে আসে। বলে মোবাইলটা ফেলে গিয়েছিলাম।
পরি হাতে তুলে দেয়। চয়ন মোবাইলটা পকেটে নেয়। বাইরে গিয়ে মেসেজ বক্স খুলে অক্ষত যোনি, অচ্ছিন্ন সতীচ্ছদের খাম গন্ধ পূজার মেসেজটা পাবে। চয়নই খুলবে ওটা।
চয়ন চলে যায়। পরি জল খায়। খুব তৃষ্ণার্ত লাগছে।
পূজা। ও একটা মেয়ে। পূজা যোনিসম্পন্না। পূজা ভ্যাজাইনাবতী। চয়ন কি এজন্যই পূজার কাছে যায়?
চয়ন তো কতদিন বলেছে ভ্যাজাইনা ওর ভাল লাগেনি। লুজ। ও বলেছে শ’ধুর গালাকে বলতা হ্যায় এক গাঢ়। বাজে কথা? আমিও ভ্যাজিনা বানাবো। ভ্যাজিনাবতী হব। ফুল্লকুসুমিত যোনিধারিণী হব। দেখব কোন পূজা চয়নকে কেড়ে নিতে পারে। আমার সব আছে। আমার পেছন আছে। বুক আছে, ভ্যাজিনাও বানাব। প্লাস আমার টাকা আছে। প্লাস তোমার চাকরিটাও থাকবে আমার কন্ট্রোলে। আমি পুরোপুরি হব। পরি নতুন করে সিদ্ধান্ত নির্মাণ করে। এখন পূজা টুজার কথা তুলবে না। সাতাশে শ্রাবণটা যাক।
.
অফিসে গেলে শোর পড়ল। রাখি বলল টাচউড, দারুণ লাগছে। ‘ওয়েল কাম বেবি’-গৰ্গ বলল। বাপি বলল, ওহ! সেকেন্ড ফেজ অফ লাইফ। শুঁয়োপোকা টু প্রজাপতি। চিত্রা বলল, শুঁয়োপোকা বলিস না, আগে কি ও শুঁয়োপোকা ছিল নাকি? আগেও বেশ সুন্দর ছিল। নতুন আর কী দেখলি ওর, শুধু তো…।
হ্যাঁ, ওটাই তো অনেকখানি। বাপি চোখ নাচিয়ে বলল। সেলিব্রেট! সেলিব্রেট! কেউ বলল। পরি চকলেট আনাল। অনেক কাজ জমেছে। একটা সিনেমার নাচগানের সিনে দশরকম ড্রেস। রেল লাইন, পুকুর পাড়, ময়দান, চোলাই ঠেক, বাঁশের সাঁকো, মিড ডে মিলের রান্নার আসর এরকম দশটা সিনে চাষির মেয়ের সঙ্গে বিডিওর নাচ। কাজে মন দেয়। পাথর বসানো রেল লাইনে জিরাফ দাগের ড্রেস বেশ ফিট করছে, পুকুর পাড়ে শাপলা ফুলছাপ জামা, বাঁশের সাঁকোয় নায়িকার ওড়নাটা আটকে যাবে। ওড়নাটার রং সবুজ, নাকি সাদা? এরই মাঝে বারবার প্রশ্নটা। কে পূজা?
তবু সে মাথার চারিপাশে,
তবু সে চোখের চারিপাশে,
তবু সে বুকের চারিপাশে।
গর্গের কাছে যায়। জিগ্যেস করে চয়নের চাকরি নিয়ে কথা হয়েছে কিনা। গর্গ বলে ডোন্ট ওয়ারি। তোমার বন্ধুর সিভিটা তো ভাস্করকে ফরওয়ার্ড করে দিয়েছি। এগেইন, হ্যাড এ টক উইথ হিম। ইওর ফ্রেন্ড উইল রিসিভ এ লেটার সুন ফর ইন্টারভিউ। পরি বলল, থ্যাঙ্ক ইউ স্যর, প্লিজ সি টু গেট ইট ডান হিয়ার। এখানে হলে দু’জনে….সেম ট্যাক্সি…সেম…। গর্গ বললেন, ওকে…আগে তো মিরাকেল এ জয়েন করুক, পরে দেখছি…]
তার মানে ‘মিরাকেল’-এ চাকরিটা হয়ে যাবে চয়নের? সত্যি? মিরাকেলই তো। এত সহজে? এর নাম সোর্স। নিশ্চয়ই পাঁচ হাজারের চেয়ে বেশি মাইনে হবে। ওই অফিসে আবার ক’টা মেয়ে আছে কে জানে? কে জানে মেয়েগুলো কেমন? এখানে কাজটা হলে চোখে চোখে রাখা যেত।
দিন এগিয়ে আসছে। ২৭ শ্রাবণ অফিসের সবাইকে বিয়েতে বলবে না। অনিকেত জেঠুর বাড়িতে অত জায়গা কোথায়? ৩০ শ্রাবণ, মানে ১৮ অগাস্ট। এই অফিসেই একটা পার্টি দেবে। সবাইকে খাওয়াবে। ফিশ ফ্রাই, বিরিয়ানি আর আইসক্রিম। বিয়েতে শুধু নিনা আর বাপিকে বলেছে। ভাল দেখে ফাঁকা কার্ড কিনে এনে নিজে হাতে লিখেছে, একটু রং এর ছোঁয়াও। রং আছে, কিন্তু অন্তর নেই। লিখছে—আন্তরিক ভাবে চাই, কিন্তু যেন ওটা কথার কথা। পরি খুব একা। ভীষণ একাকী। এখন কার্ড লেখার সময় বেশি করে মনে হল।
তৃপ্তিকে কার্ড পাঠিয়েছিল। ফোনেও বলেছিল। তৃপ্তি একদিন এসেছিল সন্ধের পর। বলল, কী ভাল খবর। বলল, কী সেক্সি দেখাচ্ছে তোকে। ওর মামলা মেটেনি এখনও। সাসপেন্ড হয়েই আছে। বলল, তোর মতো বুক লাগিয়ে যদি কোনও মেয়ের সঙ্গে শুতাম… আমার হয়তো কিছু হয় না। একটা মেয়ে কোনও মেয়েকে নাকি ধর্ষণ করতে পারে না। কোনও ছেলেকেও নাকি আইনত পারে না। বায়োলজির বিচারে, আমি নাকি ছেলে, আমার মেডেল টেডেল গুলো কেড়ে নেবে নাকি, কে জানে। আমিও এরকম নারীত্ব কিনে নেব শালা। পয়সা দিয়ে যদি নারীত্ব কেনা যায়, তবে আইন কিছু করতে পারবে না। আবার মেয়েদের জড়িয়ে শোব।
তৃপ্তি একটু পরে বলল, পরি, প্লিজ, একটু দেখাবি? ভীষণ দেখতে কৌতূহল হচ্ছে কেমন হয়েছে। পরি বলল, শুধু দেখবি কিন্তু। তৃপ্তি বলল তাই করব। টাচ করব না। পরি খুলে দেয়। তৃপ্তি অবাক হয়ে দেখে। বলে আমার হাত বেঁধে দে পরি। আমার নিষেধ শুনছে না। কেমন করে উঠছে সারাটা শরীর। দেখ, ছোট্ট পুন্টুটা কীরকম শক্ত হয়ে গিয়েছে। তৃপ্তি দু’হাত দিয়ে স্পর্শ করে পরির স্তন। আর কিছু নয়। পরি হাউস কোটের বেল্ট বাঁধে।
একদিন গর্গ স্যর ডাকলেন বললেন সিনেমার ডিজাইনটা প্রডিউসার অ্যাডমায়ার করেছে, ওই যে গ্রিন প্রন। গ্রিন পন মানে? ওই যে সবুজ প্রাণ…। সিনপসিসে তো গ্রিন প্রন লিখেছে। গর্গ সাহেবের বোঝার সুবিধের জন্য সিনেমাওলাদের কেউ সিনপসিস লিখে দেয়। ওরা সবুজ প্রাণকে গ্রিন প্রন লিখেছে। এটা বুঝতে পারল পরি। গর্গ বললেন, ইট ইজ ইওর ক্রেডিট। তারপর বললেন, তোমার রিসেপশনে থাকতে পারব না। মুম্বই যেতে হবে। প্লিজ কাম টু মাই হোম অন ইলেভেন্থ অগাস্ট ইভিনিং। হ্যাভ ডিনার। একটা ছোট গিফ্ট ভি দেব। পরি পলল ডিনার করলে রাত হয়ে যাবে। বাড়িতে বাবা একা, হি ইজ নট ওয়েল। গর্গ বললেন ওকে দেন, সফ্ট ড্রিংকস হার্ড ড্রিংকস, চা-কফি, যা চাইবে।
গর্গের বাড়ি যায়নি কোনওদিন আগে। গর্গই সঙ্গে করে নিয়ে গেল। পাম অ্যাভিনিউতে ওর ফ্ল্যাট। চাবি খুলল। গর্গ সাহেব নিজেই বলল, মিসেস নেই। একটা ফিনানথ্রপিকাল ওয়ার্কে গিয়েছে। কুন প্রবলেম হবে না। চা কফি আমি বানাতে পারি, অ্যান্ড আই অ্যাম শিওর—ইউ টু। এসি অন করে দিলেন গর্গ সাহেব। হাল্কা মিউজিক চালিয়ে দিলেন। বোধহয় চৌরাসিয়া। ইউ ক্যান ফ্রেশ ইওর সেলফ। টয়লেটের দিকে আঙুল। এখন ওয়াশরুম বলতে হয়। গৰ্গ সাহেবও অন্য একটা ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে পাজামা-ফতুয়া পরে এল।
একটা বয়াম থেকে কাজু বাদাম বার করল। বলল, ওয়াইন চলবে, রেড ওয়াইন? বাঁ হাতের দু’টো আঙুল দিয়ে পরিমাণ বোঝানোর চেষ্টা করল।
ওয়াইন খেতে মন্দ লাগে না। পরি বলল হ্যাঁ, অল্প। গর্গ সাহেব বলল, আমার কাছে ওয়াইন ফঁ-পা।
এটা ফ্যাশন জার্গন যার সঙ্গে যেটা চলে না বোঝাতে বলা হয়। যেমন পাঞ্জাবির সঙ্গে চামড়ার বেল্ট ফঁ-পা।
গর্গ বললেন, পিৎজা আছে। গরম করে দেব? চিকেন বল আছে, হাফ কুক্ড। ফ্রাই করে নিলেই হবে।
পরি বলল, দিন আমি ফ্রাই করে নিচ্ছি ‘
গর্গ বলল, হুইস্কিতে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল নো-নো ইউ আর মাই অনার্ড গেস্ট, এ ক্রিয়েটিভ ট্যালেন্ট, আই…আই…কী বলাটা এখন ঠিক বুঝতে পারছে না গর্গ। রেসপেক্ট, অ্যাডোর, রিগার্ড? মোডটা পাল্টাল গর্গ। আই শুড নট অ্যালাও ইউ টু গো টু কিচেন।
গর্গ সাহেব হাতে গেলাসটা নিয়ে একটা পিৎজা মাইক্রো আভেন এ দিলেন, প্যানে তেল বসিয়ে ফ্রিজ থেকে একটা প্যাকেট বের করে কতগুলো বল তেলে দিলেন, বাঁশির শব্দে মিশল চিকেন ফ্রাইয়ের চিড়চিড়। ঘরের রং ক্রিস্টালের শোপিস, ছবি দেখতে দেখতে ওয়াইনটুকু শেষ করে দিয়েছিল পরি। গর্গ আর একটু ঢাললেন। নিজের গেলাসেও হুইস্কি। পরি বলল স্যার আর ইউ থিংকিং ফর মাই ফ্রেন্ড টু গেট ইনটু হিয়ার ইটসেল্ফ?
গর্গ পরির কাঁধে হাত দিয়ে বলল, আমার সব মনে আছে তো বাবা…। আগে ওখানে জয়েন করুক। সেপ্টেম্বর থেকেই কাজে লাগবে। পরে ইধারে নিয়ে নিব।
পরি বলল, এখনও ইন্টারভিউ লেটার পায়নি।
গর্গ বলল, কালকেই কথা বলব। কাঁধে মৃদু চাপড় মারলেন। যেন আশ্বস্ত করলেন। পিৎজা, চিকেন টেবিলে সাজানো। পরির ক্ষিধেও ছিল। খাচ্ছিল পরি। গর্গ বলল, ইউ আর লুকিং ভেরি চার্মিং, রিয়েলি। পরি ওর দৃষ্টির মানে বুঝতে পারছিল। গর্গ এবার ঘরে গিয়ে একটা ছোট লাল রং এর বাক্সো নিয়ে এল। বলল, তোমার জন্য আমি নিজে পসন্দ করে কিনেছি। একটা ডায়মন্ড নোজ রিং। বাক্সের ডালাটা খুলে পরির সামনে ধরলেন গর্গ।
পরি বলে আমার নাকে তো নেস্ট্রাল পিয়ার্সিং নেই। গর্গ বলে ওসব দরকার নেই। স্প্রিং মতো আছে। আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।
নাকে লাগিয়ে দেন। হিরে জ্বলে ওঠে। কাঁধে হাত দিয়ে বলে চলো আয়নায় দেখো কেমন লাগছে। ঘরে নিয়ে যায়। বেডরুম। থুতনিটা ধরে হাল্কা আদর করে। তারপর বলে, পরি, আই লাইক টু হ্যাভ এ ফুল ভিস্যুয়াল। তোমার এই নথ পরা মুখ, আর ভরা বুক একবার দেখতে দাও, প্লিজ। পরি বলে, আমার তো চারদিন পরে বিয়ে…।
গর্গ বলে বিয়ে তো কী হল, বিয়ে তো আছেই, তোমাদের এই একস্ট্রা অর্ডিনারি বিয়েটার পরে তোমার সঙ্গে কোনও একস্ট্রা ম্যারিটাল রিলেশনে যাব না। কেন যাব? আই অ্যাম নট পারভারটেড। আমার খুব ইচ্ছে করছে আর্টিফিসিয়াল বুক দেখি।
গর্গএর গলার স্বর পাল্টে যায়। আই ওয়ানা সি ইয়োর বুবস্…।
পরি স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। ওর হাতটা বোতামের দিকে দিয়ে নিয়ে যায়। বোতাম খোলে। ওপেন, ওপেন অল, পুরো খুলে দাও। পরি বলে—না, এইটুকুই।
গর্গ বলে আরে ইয়ার, এটা তো কভার দেয়া আছে, কভারটা খলো…। আজকাল দেখছি আসলির চেয়ে আর্টিফিসিয়াল বেশি ভালো হচ্ছে। এই প্ল্যান্টকে দেখো-পরির কাঁধে হাত দেয় গর্গ, ওটা কিন্তু প্লাস্টিকের আছে। একটা শিশু বাঁশ গাছ দেখে পরি, কাঁধ থেকে হাত নেমে আসে, ক্ষমতার হাত। এই হাতে পরির ইনক্রিয়েন্ট। এবার দুই হাত। জামাটা খুলে নেবার চেষ্টা গর্গ। পরি বলে আমি খুলছি স্যার, আমি….প্রলাপের মত বলে আর চারটে দিন পরই আমার বিয়ে স্যার, আমার বয়ফ্রেন্ডও এখনো… গর্গ বলে, আরে ইয়ে তো আসলি চিজ থোড়ি হ্যায়, আর্টিফিসিয়াল, পিয়োর আর্টিফিসিয়াল…। দশটা আঙুল পঙ্গপাল হয়ে নেমে আসে ফসলের মাঠে। পরি বলে স্যার, চয়নের চাকরিটা…। আরে হোগা..হোগা। বুকের ভিতরে মুখ ডুবিয়ে দেয় গর্গ। তছনছ, তছনছ। খসে পড়ে নকল নিল। শ্বেতশুভ্র মেঝেতে পড়ে গিয়ে গড়ায় কোথাও।
গর্গ ওর দু’হাতে চেপে ধরে সিলিকোন স্তন। হাতে তাঁর রোমশ উচ্ছ্বাস। পরি এবার বাধা দেয়, বলে এনাফ এনাফ। গর্গ বলে—এমন কেন করছ…গর্গের ঠোঁটের কোনায় ফেনা—আর্টিফিসিয়াল না…। গর্গের হাত বাজপাখি হয়ে যায় ফের। পরি বলে সতীত্ব নয় স্যার, ডাক্তার বলেছিল থ্রি উইক্স একদম যেন প্রেশার না পড়ে। গর্গ বলে—ওকে, কই বাত নেহি, সফ্টলি, সলি…। কয়েক মুহূর্ত পরই আর সফ্ট থাকে না হাত। পরি এবার একটা বালিশ বুকে চোপ আঁকড়ে ধরে। ‘মৃত্যুর অঙ্গার মাখা স্তন তার পাখির শিশুর মতন’। গর্গ বলে ওকে, ওকে আই আন্ডারস্টুড। থ্যাংক ইউ। এবার সব লাগিয়ে যাও। মে বি আর্টিফিসিয়াল, বাট থিং ইজ ভেরি গুড। বেটার দ্যান অরিজিনাল। অ’সাম। আজকাল আলি জিনিসের চেয়ে নকলি বেটার হচ্ছে।
পরি ওর নিল দুটো খুঁজে নেয়। অন্তর্বাস কুড়িয়ে নেয়, বুক বাঁধে। গর্গ বলতে থাকে—আমি লাখনোর লোক। একটা কহবত আছে লাখনউ শহর গুলদস্তা লৌন্ডে মাহাঙ্গা, রেন্ডি শস্তা। তোমার মত লোকের আমাদের এরিয়ায় খুব ডিমান্ড আছে।
পরি জামার বোতাম লাগায়। তারপর নাকের নথটা খুলে ফেলে। বলে স্যার, প্লিজ নিয়ে নিন এটা। আমি ভাবতে পারিনি এরকম করবেন…। গর্গ বলে—ওঃ ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল। আমার বহুত কিওরেসিটি ছিল কি আর্টিফিসিয়াল বুস কিরকম হয়। ওকে। আই অ্যাম সরি। প্লিজ ডোন্ট রিফিউজ মাই গিফ্ট। আবার পরির হাতে তুলে দেয় গর্গ।
পরি বাক্সটা ব্যাগে রাখে। তারপর উদাস হাওয়ার মত ধীরে বলে চয়নের চাকরিটা…চাকরিটা দেখবেন স্যার…হাতের তালুতে চোখের জল মোছে।
জল কি তোমার ব্যথা বোঝে?
এ ঘটনা বলেনি কাউকে। চয়নকেও নয়। পূজার কথাও বলেনি কাউকে। শুধু জলের মতো ঘুরেছে বিষাদ।
১৩ অগাস্ট স্নান করার সময় পরি আয়নায় দেখল ওর ডানদিকে কাঁধের কাছে দু’টো গুটলি মতো কি যেন। ক্লিভেজের ওপরেও দু’টো মটর দানার মতো ছোট লাম্প। না, বাঁদিকে নেই ডান দিকেই। পাঁজরার কাছেও ডান দিকে একটা গুটলি, রাজমার দানার মতো।
পরি ওর বাবার শরীরের গুটলিগুলোকে আবার ভাল করে দেখে। মনে হয় ওরও এইরকমই। বাবার কাঁধের আর বগলের তলার গুটলিগুলো আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে, টেপে, একটু সরে গেল। ওর নিজের শরীরের গুটলিগুলোও তো ওরকমই।
ওরও কি লিম্ফোমা হল? ক্যান্সার?
লিম্ফোমা কি ছোঁয়াচে? ওর বাবার থেকে হল? নাকি সিলিকোন থেকেই হল? সিলিকোন কি কার্সিনোজেনিক? কাকে দেখাবে? ওর বাবাকে যিনি দেখেন, নাকি যিনি এই ইমপ্ল্যান্টটা বসিয়েছেন?
তীর্থঙ্করকে ফোন করে পরি। সুইচড অফ। সকাল সাড়ে ন’টা। নিশ্চয়ই অপারেশনে। বমি পাচ্ছে। বাবারও প্রায়ই বমি পায়। বমি হয়। কিন্তু অফিসে যেতেই হবে। কাজ আছে। লিম্ফোমা হলে তো এখনি কিছু হচ্ছে না, অফিস যায়। গিয়েই বমি করে বেসিনে। বেলা একটা নাগাদ তীর্থঙ্করকে ফোনে পায়। বলে বুকের চারিপাশে গুটলি তৈরি হয়েছে ডাক্তারবাবু…। তীর্থঙ্কর বলে বিকেলে চলে আসুন চেম্বারে।
তীর্থঙ্কর দেখলেন। জিগ্যেস করলেন খুব সেক্স করা হয়েছিল? পরি চুপ করে থাকে। তীর্থঙ্কর বলে বলেছিলাম তো যেন প্রেশার না পড়ে…। পরি বলে আপনি তো বলেছিলেন দশদিন যেন কোনও প্রেশার…। হয়েছে তো পরশু…। প্রায় তিন সপ্তাহ পর…।
তীর্থঙ্কর বলে আপনার বয়ফ্রেন্ড কি খুব…মানে খুব হাঙ্গরি ছিল? ভিতরের একটা স্যাক্ লিক করে গিয়েছে। একে বলে সিলিকোন ব্লিডিং…।
ব্লিড?
হ্যাঁ। সিলিকোন ব্লিডিং।
কী হবে এবার?
কী আর হবে? ফুটো তো রিপেয়ার করা যাবে না। আবার নতুন আর একটা এলাস্টোমার বসিয়ে জেল ভরতে হবে। তার আগে ছড়িয়ে পড়া জেলগুলো মাসল আর টিস্যুর ফাঁক ফোকড় থেকে চেঁচে বের করতে হবে। দু’-চারদিন পরে করলেও চলবে। এই জেল ইনার্ট। শরীরের ক্ষতি করে না। তবে লিক যখন হয়েই গিয়েছে ৩৮০ সিসি জেল তো ছড়াবে চারদিকে। নার্ভে চাপ দেবে। ব্যথা হতে পারে।
—আমার তো পরশু দিন…।
—জানি তো। মিটে যাক, তারপর হবে…।
১৫ অগাস্ট সকালবেলা পরি দেখল ডানদিকের বগলের আশেপাশেও কয়েকটা লাম্প হয়েছে। ব্লিড করছে পরি।
আস্তরণ ছিঁড়ে গিয়ে শরীরে ছড়াচ্ছে সিলিকোন। ছড়াক। আবার বানাবে। তার আগে ছড়িয়ে পড়া যৌবন-পুঁটুলিগুলো বের করে নিতে হবে। আবার অপারেশন? হোক।
‘থিং ইজ ভেরি গুড, বেটার দ্যান অরিজিনাল, অ সাম’—গর্গের ওই কথাটা বারবার ঘুরে ঘুরে আসে। আর্টিফিসিয়াল হলেও পুরুষের ভালোলাগে? গর্গের ভালো লেগেছিল। একটা টেস্ট তো হয়ে গেল। আর একটা অপারেশনের মূল্যে একটা পরীক্ষা। চয়নেরও ভালো লাগবে। পূজার চেয়েও নিশ্চই এটা ভালো।
না, পূজা সম্পর্কে কোন কথাই জিজ্ঞাসা করেনি চয়নকে। গর্গের ব্যাপারটাও না। কেউ জানে না। চয়ন তো দেখবে। বলবে এমনিই ফেটে গেছে।
সামনের মাসে আবার বাবাকে কেমোথেরাপির জন্য ভর্তি করাতে হবে। ব্লিড করছে পরি।
চয়ন সকালে এল। চয়নকে এখনও বলেনি কিছু। চয়ন ফুলশয্যায় দেখবে ওর ব্লিডেড হার্ট। ব্লিডেড হার্ট একটা ফুলের নাম। চয়নকে চুমু খেল। ওর ঘাড়ের, কাঁধের, গলার গন্ধ নিল। আসলে কোনও মেয়েলি গন্ধ খোঁজ করছিল পরি। পূজা-গন্ধ
বিয়ের পোশাকটা চয়নের হাতে তুলে দিল পরি। দুই কাঁধে দু’টো ডানা অ্যাপ্লিক করেছে পরি, আর পাঞ্জাবিতে পাখির পালকের আভাস। পাঞ্জাবিতে অভিমান এঁকেছিল পরি। উড়ে যেয়ো, যদি মনে করো।