হলদে গোলাপ – ৫

গোপালদা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। জিপগাড়িতে সকালের অ্যানাউন্সার আনতে যাওয়ার পথে ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা মেরেছে গাড়ি। দুর্ঘটনা।

এই দুর্ঘটনার কয়েকটি অভিঘাত হল—

১. জিপগাড়িটার কাচ ভাঙল, সামনের দিকটা তুবড়ে গেল।

২. পুলিশ কেস হল।

৩. সকালের অ্যানাউন্সার-কে ঠিক সময়ে আনা গেল না।

৪. ফলে ডিউটি অফিসার অবাঙালি ছেলে খালকোকেই সকালের সম্প্রচার জ্ঞাপন করতে হল।

৫. গোপালদা আহত হল। ওর কপালে কাচ আর গিয়ার স্ট্যান্ড-টা তলপেটে ঢুকে গেল। গোপালদা অনেক পুরনো ড্রাইভার। ওর কাছে অনেক পুরনো কথা শোনা যায়। নজরুল ইসলামের জন্য একটা পিক ফেলার ডিবে থাকত, ইন্দুবালা’কে আদর করে নানী ডাকতেন, গাড়িতে কাজীদা আর ইন্দুবালা-র ডুয়েট শুনেছে, কমলা ঝরিয়াকেও বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে এই গোপালদা। ঘরে যাওয়ার আগে মুড়ি আর ফুলুরি কিনতে পাঠাতেন কমলা ঝরিয়া। ফুলুরি ঠান্ডা বলে একবার গোপালদা কমলা ঝরিয়াকে জিগ্যেস করেছিলেন—দিদিন, ফুলুরি একদম ঠান্ডা! উনি বলেছিলেন, ঠান্ডাই ভাল। বেশি মুড়ি খাওয়া যাবে না, আর ঠান্ডা ফুলুরিতে অম্বল হবে, তাতে খিদে আরও মরে যাবে। কৃষ্ণমূর্তি নামে এক সাহেবের কথা শুনেছি গোপালদার কাছে, যিনি নাকি স্টেশন ডিরেক্টর ছিলেন, এবং গান-পাগলা। ল্যান্ডমাস্টার গাড়ির পিছনের সিটে বসে গুনগুন করে গান গাইতেন। একবার রাস্তায় কতগুলো হিজড়ে নাচাগানা করছিল। কৃষ্ণমূর্তি গাড়িটা থামাতে বললেন। ওখানে দাঁড়িয়ে শুনলেন। একজন হিজড়ের গলাটা খুব পছন্দ হয়েছিল। ওকে রেডিও-তে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু ও বলল, ও একা যাবে না, গেলে সবাই যাবে। ওরা ৬/৭ জন ছিল। গাড়িতে এত কি জায়গা হয়?…

দুর্ঘটনার ফলে গোপালদার আহত হওয়ার ব্যাপারটা সবার শেষে রেখেছি, যদি সম্প্রচার শুরু হতে এক মিনিটও দেরি হত, তা হলে দুর্ঘটনার অভিঘাত হিসেবে দেরিটাই এক নম্বরে যেত। কিন্তু খালকো ঠিক সামলে দিয়েছিল। ফেডার-টা তুলে ‘বন্দেমাতরম্’ বলাটা সহজ। তারপরই তো আসল কেদ্দানি। ক্রিস্টোফার খালকো একজন খ্রিস্টান আদিবাসী। ওরাওঁ। অনুপস্থিতিতে ও আগেও দু-একবার ঘোষকের কাজ করেছে। কিউ শিট ইংরেজিতে লেখা থাকে। ওটা দেখে পড়তে গিয়ে লোকগীতি গায়ক শাসন গাইনকে শ্মশান গাইন’ বলেছে। শশাঙ্ক দে-কে বলেছে শ্মশান্-কো’ দে। ওই জন্য খালকোর নামই হয়ে গেল শ্মশান্-কো’। ঠিক পাঁচটা তিপ্পান্ন মিনিটে সিগনেচার টিউন বেজেছে, পঞ্চান্ন-য় ‘বন্দেমাতরম্’ বলে খালকো ওপেনিং করে দিয়েছে। যাক, সিচুয়েশন সেভড়। নইলে গোপালদার জন্য কী কেলেঙ্কারিটাই না হত!

গোপালদার চোখে ছানি। ওকে রাত্তিরের ডিউটি থেকে ‘অফ’ করে দেওয়া হয়েছে বহুদিন। কিছুতেই ছানিটা কাটাবে না। ও যা গল্প বলে, তাতে তো ওর বয়স সত্তর ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু তখনও ‘রিটায়ার’ করেনি। বয়সে কত জল-মেশানো কে জানে? বলে তো যুদ্ধের সময় ঢুকেছিল। ওর বয়স তখনই আঠারো।

হাসপাতালে একদিন গোপালদাকে দেখতে গেল অনিকেত, আরও কয়েকজন। সঙ্গে আইভি-ও ছিল।

গোপালদা’কে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছিল। সবাইকে দেখে মুখে একটু হাসি ফুটল। আস্তে, মৃদু স্বরে বলল, শেষ দেখা দেখে নিলুম আপনাদের, বাঁচব না। অনিকেত বলল—বাঁচবেন না কেন, কিছু হয়নি আপনার। গোপালদা বলল আমার ছোট ছেলেটা চাকরি পায়নি। ড্রাইভারি শিখেছে, বড় স্যরকে বলে আমার জায়গায় ঢুকিয়ে দেবেন। আমি চললুম।

কেন আজে-বাজে কথা বলছেন? আপনার কিচ্ছু হয়নি।

কী হয়েছে শুনবেন? ওঁকে একটু দূরে যেতে বলুন… আইভি-র দিকে তাকালেন গোপালদা।

আইভি একটু দূরে গেল। অনিকেত ছাড়াও আরও দু’জন পুরুষ ছিল।

গোপালদা বললেন, যা হয়ে গেল আমার, সেটা মেয়েছেলের সামনে বলা যায় না। তাই ওঁকে সরে যেতে বললুম।

একজন বলল—কোনও দরকার ছিল না। ও তো ব্যাটাছেলেই। বাইক চালায়, সিগারেট খায়, প্যান্ট-শার্ট পরে…!

গোপালদা মিনমিন স্বরে বললেন—সে যাই হোক, দাঁড়িয়ে পেরেস্বাব করতে পারেন না উনি, তাই ওঁর সামনে বলা যায় না। এটিকেট বলে একটা কথা আছে। মরার আগেও সেটা ভুলতে পারব নাকো। ড্রাইভার হতে পারি, কিন্তু মিত্তির বংশের ছেলে।

‘মরব’ ‘মরব’ করছেন কেন? ছোটখাটো চোট লাগলে কেউ মারা যায় না কি?— একজন বলে।

—যেখানে ব্যাটাছেলের প্রাণ থাকে, সেটাই তো কেটে বাদ দিয়ে দেবে বলছে।

—কোথায় ব্যাটাছেলের প্রাণ থাকে আবার!

—তাও জানেন না। অণ্ড থলিতে।

—ওটা বাদ দিতে যাবে কেন খামোকা?

—আমার তো হাইড্রোসিল ছিল, ঢোলা প্যান্ট পরতুম বলে হয়তো বুঝতে পারতেন না। গাড়ির গিয়ারের ডান্ডাটা তো ওখানেই মেরেছে, ওটা নাকি বাস্ট করে গিয়েছে। ডাক্তার বলেছে ওটা কেটে ফেলতে হবে।

অনিকেত বলল, ধুর, যদি বাদ দিতেই হয়, তো হবে, কী হবে তাতে? লোকের অ্যাপেনডিক্স, টনসিল, গলব্লাডার বাদ দিচ্ছে না?

ওগুলো আর এটা এক হল? ব্যাটাছেলের তো এখানেই প্রাণ…।

এখন বেশি বুঝিয়ে লাভ নেই, অনিকেত ভাবে। শুধু ফেরার সময় বলে আসে, কিচ্ছু ভাববেন না গোপালদা, ওটা বাদ গেলেও কিস্সু হবে না। দিব্যি থাকবেন। গোপালদা বলেন, বাঁচলেও ওটা কি বেঁচে থাকা? ব্যাটাছেলের আসল জিনিসটাই চলে গেল…।

অনিকেত বলে—আপনি তো আর বাবা হতে যাচ্ছেন না এখন আর? কী হবে ওটা দিয়ে? ফালতু ঝামেলা…। আপনি হাসপাতাল থেকে ফিরে চোখের ছানিটা কাটিয়ে নেবেন, ব্যস, আবার গাড়ি চালাবেন।

আইভি সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে বলল—সব কথা শুনেছি। ওই ঝোলাটার জন্য শালা তোমাদের যত রং। ভাবছ কী? আমার তো ওই বস্তুটা নেই, তাই বলে কি কমতি আছি না কি? পারবে এরকম?—বলে দু’টো-তিনটে করে সিঁড়ির ধাপ ছেড়ে-ছেড়ে লাফিয়ে থেমে যায়। সবার আগে নেমে ও ওর শার্টের কলার-টা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

বেশ বুঝতে পারে অনিকেত, আইভি মনে-মনে পুরুষ হতে চায়। কিন্তু প্রকৃতি ওকে পুরুষ করেনি। এজন্য কিছু-কিছু পুরুষালি কাজ করে।

পুরুষালি কাজ আর মেয়েলি কাজের কি কোনও সংজ্ঞা হয়? সংজ্ঞা নেই। সমাজ মোটামুটি ভাবে বলে দেয়। ছেলেরাই হুটোপুটি করবে, মারপিট করবে, জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটবে, ঘুড়ি ওড়াবে, লাট্টু ঘোরাবে, খিস্তি দেবে, সাইকেল কিংবা বাইক চালাবে; আর মেয়েরা ছোটবেলায় রান্নাবাটি খেলবে, পুতুল খেলবে, জোরে কথা বলবে না, পাড়া বেড়াবে না, পুকুরে ডুব দিয়েই গায়ে গামছা জড়িয়ে মাথা নিচু করে ঘরে চলে আসবে। এসব যারা করে তারা লক্ষ্মী মেয়ে। যারা পাড়া বেড়ায়, উঁচু গলায় কথা বলে, তারা গেছো মেয়ে—যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ গল্পের মৃন্ময়ী। কিন্তু মৃন্ময়ীও লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে যায়, যখন ওর মনে প্রেমের উন্মেষ হয়। প্রথম মহিলা পাইলট দুর্বা ব্যানার্জি রেডিও-তে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন ‘মহিলা মহল’-এ। বেলা দে ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন। অনিকেত অবাক হয়ে দেখছিল প্যান্টের ভিতরে শার্ট-গোঁজা দুর্বা ব্যানার্জিকে। ১৯৮২-৮৩ সালের কথা। বেলাদি জিগ্যেস করেছিলেন—দূর্বা, তুমি যে আকাশে প্লেন ওড়াও, তোমার হেঁশেল দেখে কে?

দুর্বা ব্যানার্জি রাগ করেননি। বলেছিলেন, হ্যাঁ, সেটা তো হয়ে ওঠে না। অন্যরাই তো দেখে, আমি তো দেখতে পারি না ওটা…।

মানে, বেলাদির মতো সে-সময়ের আধুনিকা’ মহিলারও মনে হয়নি একজন পাইলটকে হেঁশেল-সম্পর্কিত প্রশ্ন করার কোনও মানে হয় না। দুর্বা ব্যানার্জিও হেঁশেল সামলানোর প্রশ্ন শুনে ভুরু কোঁচকাননি। যেন ওটাই নিয়ম। আমাদের প্রথম মহিলা-ডাক্তার কাদম্বিনী দেবী ডাক্তারি পাশ করেও চিকিৎসা করতে পারেননি এদেশে। মেয়েরা ডাক্তারি করবে, তা আবার হয় না কি? বিলেতে গেলেন। আরও পড়াশোনা করলেন। তারপর দেশে ফিরে এসে ডাফরিন হাসপাতালে যোগ দিলেন। কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। মেয়েরা ডাক্তারি করতে পারে মেনে নিয়েছি এখন, মেয়ে ফুটবলার, ক্রিকেটার, বক্সারও মেনে নিয়েছি আস্তে-আস্তে। কিন্তু সে- সময়ের মহিলা ক্রিকেট ক্যাপ্টেন শ্রীরূপা ব্যানার্জিকে ক্রিকেটের সঙ্গে-সঙ্গে লাউ-চিংড়িটাও দেখতে হয়েছিল, ঘরের পর্দা খাটানোর ব্যবস্থা, বিছানা পাতা, এবং দশমীতে সিঁদুর খেলা সবই করতে হয়েছে হয়তো।

হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় আইভি বলছিল, বাই ডিফল্ট মেয়ে হয়ে জন্মেছি, মানে আপনারা আমাকে মেয়ে বলছেন, কারণ আমার বুকটা উঁচু, আর ওই ঝোলাটা নেই, এই জন্যই আমি গঙ্গার পাড়ে বসে তেল মেখে স্নান করতে পারি না, ভীষণ ইচ্ছে করলেও পারি না। রাত্তিরের শহরটা একা-একা ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করে। আপনাদের কাছে সুন্দরবন ভ্রমণের গল্প শুনেছি, ঝাড়খালি না কোথায় কোন চাষির ঢেঁকি-ঘরে খড়ের বিছানায় রাত কাটিয়েছেন। আমি শুধু গল্পটাই শুনেছি। আমারও তো ইচ্ছে হয়, ভীষণ ইচ্ছে হয়। পারি না। বৃষ্টিতেও ভিজতে পারি না, শালা সেঁটে যায়। এ জন্যই তো মোটা জামা পরি। আপনার ওই প্রোগ্রামে এসব কথা থাকবে তো? অনিকেত মাথা নাড়ে।

গোপালবাবুর চোট-লাগা জায়গাটায় শেষ পর্যন্ত শল্যচিকিৎসাই হল, কিন্তু গোপালবাবু অপারেশন টেবিলেই মারা গেলেন। গন্ডগোলটা হয়েছিল অ্যানাসথেসিয়া নিয়ে। কম বেশি কিছু একটা হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান আর ফেরেনি। শেষ পর্যন্ত গোপালবাবুর তত্ত্বটাই যেন প্রমাণিত হয়ে গেল। যে, পুরুষের অণ্ডকোষেই প্রাণ থাকে। ইস্, গোপালবাবু জানতে পারলে খুব খুশি হতেন!

গোপালবাবুর প্রসঙ্গ অবতারণার কারণ একটি ডাকে-আসা চিঠি। ‘সন্ধিক্ষণ’-এর কোনও এক শ্রোতার নিরীহ প্রশ্ন।

পুরুষের অণ্ডকোষেই কি প্রাণ থাকে?

এরকম আরও অনেকের অনেক প্রশ্ন জমা আছে—অনিকেতের কাছে। হিংটিংছট প্রশ্ন সব।

গরিবের মেয়েরা তো দুধ খেতে পারে না। দুধ কেন, কোনও ভাল খাবারই খেতে পারে না। অথচ কী করে ওদের শরীরে দুধের মতো পুষ্টিকর সামগ্রী তৈরি হয়? আমরা কেন মাড়ভাত থেকে দুধ তৈরি করতে পারি না?

আপনারা বলে থাকেন রক্তদান মহান দান। মহিলারা কি রক্তদান করতে পারে? মহিলাদের বিশেষ করে জিগ্যেস করার কারণ, আমি একজন মহিলা। আমাদের প্রতি মাসে রক্তস্রাব হয়। শরীর থেকেই তো রক্ত যায়। এর পরও কি রক্ত-দান করা যায়?

আমাদের দেশের ছেলেরা ফরসা মেয়ে পছন্দ করে। যখনই বিয়ের সম্বন্ধ আসে, প্রথমেই জিগ্যেস করে পাত্রী ফরসা তো? এবার আমার প্রশ্ন কেন এরূপ পছন্দ? ডারউইন-এর তত্ত্ব অনুযায়ী কি ইহাকে ব্যাখ্যা করা যায়? আফ্রিকার অনেক দেশে সবাই কালো। আমাদের দেশের মতো কেহ কালো কেহ ফরসা নাই। এবার প্রশ্ন করি, কালো ছেলেরাও কি ওই দেশে নিজেদের দেশের পাত্রী অপেক্ষা মেম-পাত্রী পছন্দ করে? কিংবা যে-দেশে সবাই সাদা, তাহারা কি কালো পছন্দ করে? যত দূর জানি, সাহেবরা কালো পছন্দ করে না। ইহার বৈজ্ঞানিক কারণ জানিতে ইচ্ছা করি।

আর একটা চিঠি :
হে আকাশবাণী, উত্তর দাও, উত্তর দাও মোরে
প্রজাপতি কেন ছন্দে ছন্দে ওড়ে
নারীর বক্ষে দুগ্ধের লাগি স্তন
পুরুষের বুকে কেন তবে উহা স্তনের মতন?
পুরুষের বুকে দুগ্ধ হয় না কেন তবে প্রয়োজন?
পুরুষের বুক কৈশোরকালে ফুলিয়া ফুলিয়া যায়
তার পরে কেন আর নাহি বাড়ে হায়?
পুরুষের মুখে গোঁফ-দাড়ি হয়, নারীর মুখে হয় না
গোঁফ-দাড়ি তবে বিধাতার দেওয়া পুরুষের মুখে গয়না?
পুঁটি মাছের পুচ্ছে কেন এক ফোঁটা কালো দাগ?
তোতা পাখির বুকের তলায় জড়িয়েছে লাল ফাগ।
বুলবুলিটির মাথার ওপরে কিবা প্রয়োজন ঝুঁটি?
কত রঙে কত গন্ধে কেন ফুলগুলি উঠে ফুটি?
সৌন্দর্য সৃষ্টির তরে সবই বিধাতা রচন?
নাকি ইহার পিছনে আছে সৃষ্টির প্রয়োজন?
আমি এক গ্রাম্য কবি, জানিবারে চাই।
আমাকে ত্বরা করি উত্তর দাও ভাই।

এই কাব্যপত্র লিখেছেন প্রেমার্থ কবি। কাব্য নীড়। ভাতার। সেই পত্রদাতা। যিনি নারী সম্পর্কে লিখেছিলেন—তুমি মম হৃদয়ের ঝিমঝিমা। সেই চিঠিটার প্রথম লাইনে ছিল—তুমি নারী নিউটন ফেল আকর্ষকরণী।’ এই কবি তো মহা মুশকিলে ফেলে দিল। এসব তো কঠিন দার্শনিক প্রশ্ন। শুধু নিউটন ফেল কেন, ডারউইন-মর্গান-পাভলভ এমনকী চার্লস ডকিন্স-ও ফেল। ইচ্ছে হয়, ওই প্রেমার্থ কবির সঙ্গে গিয়ে একদিন দেখা করে আসে। এটা নিশ্চয়ই ওর ছদ্মনাম। ওর আসল নাম হয়তো হারাধন রানা, কিংবা কানাই সামন্ত বা ওরকম কোনও সাধারণ নাম। হয়তো বেকার, বাড়ির গঞ্জনা সহ্য করে। কবিতার পোকা ঢুকে আছে মনে। কবিতা- ব্যাকটেরিয়ার কোনও অ্যান্টিবায়োটিক নেই। কবিতা লেখে, পত্রপত্রিকায় হয়তো ডাকে পাঠায়। দু’টো-একটা ছাপা হলে ফুল্লকুসুমিত হয়। এইসব মানুষগুলোর মনে কত গূঢ় প্রশ্ন।

কী উত্তর দেবে ও? উত্তর মেলে না।

সৃষ্টি বড় বিচিত্র। তল পাওয়া যায় না। অনিকেতের তো উপদেষ্টামণ্ডলী আছে। বিশেষজ্ঞরা আছেন। ওঁরাও তো ভ্রমেন বিস্ময়ে। সবই সৌন্দর্য সৃষ্টি? না কি জাগতিক প্রয়োজন? মধুর, তোমার শেষ যে না পাই।

আমি এক গ্রাম্য কবি, জানিবারে চাই

আমাকে ত্বরা করি উত্তর দাও ভাই।

“ভাই” শব্দটা শুধু অন্ত্যমিলের জন্যই? না কি অন্তর থেকে আসা?

কিন্তু কী উত্তর দেবে! প্রথম দিনের সূর্যও প্রশ্ন করেছিল নতুন-সৃষ্টি-হওয়া বিশ্বকে—কে তুমি? উত্তর মেলেনি। অনিকেত তো চুনোপুঁটির চাইতেও চুনো।

ও কী করবে? প্রেমার্থ কবি তো ‘ভাই’ বলে ডেকেছে। কেরোসিন শিখা মাটির প্রদীপকে ভাই বলে ডেকেছিল। কেরোসিন শিখা বলেছিল—ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে। অনিকেত পাবলিক মিডিয়ায় কাজ করে। ও তো বলতে পারে না, ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে।

একবার কী মুশকিলেই না পড়েছিল অনিকেত। একটা চিঠি পেয়েছিল অনিকেত। একটি উস্কোখুস্কো কিশোর রিসেপশনে দাঁড়িয়েছিল চিঠিটা হাতে নিয়ে। ছেলেটাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। অনিকেতকে সামনে পেয়ে রিসেপশন থেকে বলে, ছেলেটি আপনার হাতেই দেবে বলছে, রিসেপশনে রাখতে বললাম, রাখল না। ছেলেটা বলল, বাবা বলেছে যেভাবেই হোক চিঠিটা আপনাকেই দিতে। তাই দাঁড়িয়ে আছি।

অনিকেত দেখল ছেলেটির হাতে একটি খাম। খামের ওপরে লেখা ‘অতি জরুরি’।

অনিকেত জিগ্যেস করল, তোমার বাবার কী নাম?

ছেলেটি বলল, উদয় বিশ্বাস।

ওই নামে কাউকে অনিকেত চেনে না।

চিঠিটা খুলল। চিঠিটা এরকম : আমার নাম শ্রীউদয় বিশ্বাস। আমার নিবাস বাগনান। গতকাল পিজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। আমার বেড নং অমুক। আমার অপারেশন হবে। আপনাকে আমার দরকার। অবশ্যই আগামীকাল আমার কাছে একবার আসবেন। আপনি না- এলে আমার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। যত কাজই থাক আগামীকাল অবশ্যই আসবেন…।

কী অপারেশন হবে তোমার বাবার? অনিকেত জিগ্যেস করে।

বাইপাস।

তোমার বাবা কী করেন?

ইস্কুলের মাস্টার।

তবে তো টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করুন বলবে না।

কী ব্যাপার বুঝতে পারে না। পরদিন ওই বেড নম্বর খুঁজে অনিকেত একটা বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আপনি কি উদয়বাবু?

লোকটা ব্যস্ত হয়ে শায়িত অবস্থা থেকে উঠে বসে।

আপনি নিশ্চয়ই অনিকেত বসু। গলাটা শুনেই চিনতে পেরেছি। কত দিনের পরিচিত গলা। আপনার গলায় কত কী শুনেছি। জোরে ছোটার জুতো, নিমকি কেন খাস্তা হয়, রাতের ফুল সাদা কেন, ইয়েতি রহস্য…। রোজ কলকাতাতে ‘জানা অজানা’ আমি শুনবই—যতই কাজ থাক।

যেদিন ছেলে পড়াই, ওই পাঁচ মিনিট রেডিও-টা খুলে রাখি। আমিও শুনি, ওরাও শোনে। গত মঙ্গলবার ‘লেজের আমি লেজের তুমি’-টা অসাধারণ। শান্তনু ঘোষ বলেছিলেন। কিন্তু আপনার ‘চীজ কি চিজ’ অনবদ্য। নামটাও দেন দারুণ। চীজ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না আগে। তা ছাড়া মাস দু’য়েক আগে অন্বেষা-য় সাপের ওঝা-র সঙ্গে আপনার ইন্টারভিউটা…।

বাব্বা! ইনি তো রেডিও-র পোকা! এরকম কিছু মানুষ আছেন ভাগ্যিস, তাই চাকরিটা বজায় আছে। অনিকেত বলে—আপনি এত রেডিও শোনেন?

—না না, রেডিওর সব কিছু শুনি না। গান-ফান, নাটক-ফাটক শুনি না। শুধু সায়েন্স-এর প্রোগ্রাম শুনি।

একটা নতুন এবং আশ্চর্য কথা শুনল অনিকেত। গান-ফান। নাটক-ফাটক। বলে কী! রেডিও-র যাবতীয় জনপ্রিয়তা গান আর নাটকের জন্যই তো…।

উদয়বাবু বললেন—আমি নিজে কেমিস্ট্রি-র টিচার। গান-টান অত বুঝি না। নাটক শোনার সময় নেই। তাই বিজ্ঞানের অনুষ্ঠানগুলোই শুনি। আপনি আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। ভাল আছেন?

অনিকেত অবাক হয়।

বলে, এবার বলুন কী জন্য আমাকে ডেকেছেন? উদয়বাবু চারদিক তাকিয়ে নিলেন ভাল করে। উদয়বাবুর সবুজ চাদর বিছানো বিছানার একদিকে দাঁড়িয়ে আছেন হলুদ শাড়ি পরা এক মহিলা। ওঁর কপালে ও সিঁথিতে অনেকটা জ্যাবজেবে সিঁদুর। মাথার কাছে একটি ফ্রক-পরা মেয়ে, অন্য পাশে সেই ছেলেটা। অনিকেত বোঝে উদয়বাবুর পরিবার।

উদয়বাবু ওঁর পরিবারের সবাইকে বলেন—তোমরা একটু বাইরে যাও, অনিকেতবাবুর সঙ্গে আমার একটু দরকারি কথা আছে।

কী এমন দরকারি কথা যে আমাদের সামনে বলা যায় না?

উদয়বাবুর স্ত্রী কিছুটা উষ্মা কিছুটা আশ্চর্য হওয়া মিশিয়ে বললেন।

উদয়বাবু বললেন—প্রাইভেট কথা, তোমরা প্লিজ সবাই একটু বাইরে যাও। পাঁচ মিনিট, মাত্র পাঁচ মিনিট।

ওঁরা চলে গেলে উদয় বিশ্বাস বললেন, অনিকেতবাবু, আপনাকে বিশ্বাস করে একটা কাগজ দেব, কাগজটার মর্যাদা রাখবেন কিন্তু।

কাগজ?

অনিকেত ঘাবড়ে যায়।

হ্যাঁ। কাগজ। আমার শেষ ইচ্ছা।

উইল-টুইল। লোকটার মাথা ঠিকঠাক তো?

উদয় বিশ্বাস বললেন—আমার তো বাইপাস অপারেশন হবে, বাঁচব কি মরব ঠিক নেই, যদি মরে যাই তা হলে আমায় যেন পুড়িয়ে নষ্ট না করা হয়। রেডিও-তে দেহদান, রক্তদান, চক্ষুদান এসব নিয়ে তো কত আলোচনা হয়। ব্রজ রায় মশাই সেদিন কী সুন্দর বললেন। ওটা শুনেই আমি একটা অঙ্গীকার-পত্র আনিয়ে নিয়েছি। ওটা ফিল-আপ করে সই করে দিয়েছি। বলা তো যায় না, বাইপাস অপারেশন। ওপেন হার্ট। ওই জন্যই কাগজটা আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি। যদি না মরি, তা হলে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলবেন, আর যদি মরেই যাই তা হলে আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে যেন আমাকে পুড়িয়ে ফেলা না হয়। আমার বউকে বোঝাতে হবে—যেমন আপনারা রেডিও-তে বোঝান। মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই আই ব্যাঙ্কে খবর দিয়ে চোখটা সংগ্রহ করাতে হবে, তারপর বডি-টা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি ছাত্রদের ব্যবহার করার জন্য দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি আপনাকে বউ-ছেলেমেয়ের সামনে বললাম না কেন জানেন? ওরা ঘাবড়ে যেত। আমি তো ওদের বোঝাচ্ছি এই অপারেশনটা কি নয়, সিম্পল অপারেশন, এর মধ্যেই যদি দেহদানের অঙ্গীকার-পত্র নিয়ে কথা বলি, ওরা ভাববে তা হলে হয়তো মরেই যাব। তা ছাড়া যদি না-মরি, যতদিন বেঁচে থাকব বউ ঘ্যানঘ্যান করবে—তুমি তোমার ওই ছাইপাঁশ কাগজ ছিঁড়ে ফেল, কেন ওইসব করেছ, সবার থেকে আলাদা হতে চাও, তাই না? আমার স্ত্রী একটু কুসংস্কারগ্রস্ত কিনা…অনিকেত বলে এই গুরুভার আমাকে দিচ্ছেন কেন? আপনার কোনও বন্ধুবান্ধবকে বললেই তো ভাল হত।

উদয়বাবু কয়েক মুহূর্ত অনিকেতের চোখের দিকে চেয়ে থাকলেন। যেন খুব আশ্চর্য হয়েছেন। তারপর বললেন—এ কী? আপনি যে সবসময় বলেন—শ্রোতাবন্ধু-উ-উ। খুব তো বন্ধু ডাকেন। সেটা কি মিথ্যে? ‘বন্ধু’ ডাকেন বলেই তো আপনাকে বন্ধু ভাবছি। বন্ধুকেই তো এই ভারটা নিতে বলছি।

কী আতান্তরে পড়ল অনিকেত। শ্রোতাবন্ধু বলাতেই এই বিপদ?

রেডিও-তে তো হামেশাই বন্ধু ডাকতে হয়। শ্রোতাবন্ধু তো একটা লব্‌জ। একটা জার্গন। একটা অভ্যাস। এই হামেশা উচ্চারিত শব্দটাকে কেউ এভাবে গ্রহণ করবে ভাবা যায়?

তা হলে সম্প্রচারে কী বলে সম্বোধন করা উচিত? সভা-সমিতিতে যেভাবে সম্বোধন করা হয়—বন্ধুগণ, সুধীবৃন্দ, কমরেডস, সবই তো জাৰ্গন।

ভাই-ও তো ডাক হয়। চাষিভাইদের বলছি, শ্রমিকভাইদের বলছি এসব।

একজন কৃষক চিঠি লিখেছিলেন—আমাদের তো চাষিভাই বলেন। বিভিন্ন সময়ে কুমোরভাই, কামারভাই-ও বলেন। এটা অন্তরঙ্গতা, না কি অবজ্ঞা? আপনারা কি ডাক্তারভাই, উকিলভাই, ইঞ্জিনিয়ার ভাই, শিক্ষকভাই বলতে পারেন? তা হলে খামোকা আমাদের ‘ভাই’ ডাকা কেন?

এরকম তো সমস্যা আছেই। হরদম বলা হয়। মা-বোনদের বলছি। কই, বাবা-ভাইদের বলছি তো বলা হয় না…।

উদয় বিশ্বাসের অপারেশনের দিন হাসপাতালে শেষ পর্যন্ত গিয়েছিল অনিকেত। সব ঠিকঠাক ছিল। দু’দিন পরে দেখা করেছিল অনিকেত। উদয় বিশ্বাসের মুখে লজ্জা জড়ানো প্রসন্নতা। এ-যাত্রায় ওটা হল না। বেঁচে গেলাম। ‘বেঁচে গেলাম’ বলার পর একটা অদ্ভুত হাসি। ওটা যুদ্ধ জয়ের আনন্দ।

দেহদান আন্দোলনকে প্রশ্রয় দিয়ে আরও একবার বিপদে পড়তে হয়েছিল অনিকেতকে। মেদিনীপুর জেলার সবং থেকে এক ভদ্রলোক তাঁর মুমূর্ষু মা-কে নিয়ে কলকাতা এলেন। কলকাতায় থাকার জায়গা নেই। মা-কে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে উনি হোটেলে থাকতে লাগলেন। ওই ভদ্রলোক ‘বিজ্ঞান আন্দোলন’ করেন। চরম নাস্তিক। বাড়িতে ওঁর বাবা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, প্রতিদিন নারায়ণ পুজো করতেন। ওঁর বাবার মৃত্যুর পর নারায়ণ শিলা দিয়ে আদা-রসুন থেঁতো করে মুরগির মাংস রান্না করেছিলেন। ওঁর মা-কে কলকাতায় আনার উদ্দেশ্য ছিল মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই মায়ের দেহটা দান করে দেবেন। মা-কে দিয়ে অঙ্গীকার-পত্রে টিপ সই করিয়ে রেখেছিলেন। ওই ভদ্রলোকের নাম নারায়ণ পণ্ডা। কিন্তু নারায়ণবাবুর মা কিছুতেই মরছিলেন না। স্যালাইন-অক্সিজেন নিয়েও বেঁচেছিলেন। ভদ্রলোকটির চিকিৎসা খরচ ছাড়াও হোটেল- ভাড়া গুনতে হচ্ছিল। সেই ভদ্রলোক অনিকেতের কাছে এসেছিলেন, বলেছিলেন হোটেল- ভাড়া গুনতে হচ্ছে, বিনে পয়সায় বা কম পয়সায় থাকার কোনও উপায় করে দেওয়া যায় কি না। উনি বলেছিলেন, আপনাদের কথায় মায়ের দেহটা দান করব ঠিক করলাম, এখন আপনারা আমায় না দেখলে…।

অনিকেত ওর এক বাউন্ডুলে বন্ধুর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

কিন্তু নারায়ণবাবুর মা শেষ পর্যন্ত সে-যাত্রায় মরলেন না। অনিকেত একদিন হাসপাতালে গিয়েছিল। ওঁর মায়ের নাক থেকে ততদিনে অক্সিজেনের নল খোলা হয়ে গিয়েছে। ওই বৃদ্ধা বলেছিলেন—কী করে যাই বাবা বলো, এই খ্যাপা ছেলেটা বে-থা করলে না, আমি ছাড়া কে দেখবে বলো…।

এত কথা এল ‘ভাই’ প্রসঙ্গে। প্রেমার্থ কবি ‘ভাই’ সম্বোধন করেছে। ওই ভাই শব্দটা নেহাত ‘চাই” শব্দটার সঙ্গে অন্ত্যমিলের প্রয়োজনে। তবুও তো আন্তরিক ভাবে উত্তর চেয়েছে। বিশ্বাস করেই চেয়েছে। গ্রামের মানুষ এখনও রেডিওকে বিশ্বাস করে। ভাবে রেডিও মিথ্যে বলে না। রেডিও-র সঙ্গে ঘড়ি মেলায়।

একদিন প্রেমার্থ কবি-র সঙ্গে দেখা করতে পারলে ভাল হয়।

পরের চিঠিটার দিকে হাত বাড়ায় অনিকেত।

সনৎ ব্যানার্জি অনিকেতের ঘরে ঢুকলেন। দুষ্টুমি-ভরা মুখ। অনিকেত তখন চিঠিপত্র দেখছিল। সনৎ ব্যানার্জি অনিকেতের হাতটা টেনে নিজের নাকের সামনে নিয়ে শুঁকলেন। বললেন, ইঃ, কী বিচ্ছিরি গন্ধ, অনেক্ষণ ধরে নোংরা ঘাঁটছিস তো, বাড়ি যাওয়ার আগে ভাল করে হাত ধুয়ে যাস। নইলে বউ প্যাঁদাবে।

অনিকেত বলে, তুমি যে খিস্তি করো তাতে?

সনৎ ব্যানার্জি বলেন, করি, কিন্তু বাড়ি যাওয়ার আগে মুখশুদ্ধি করে যাই।

কীভাবে মুখশুদ্ধি করো?

একটু মাল খেয়ে নি, যদি না-হয় কড়া চা খেয়ে ঘরে ঢুকি।—দেখি তোর নোংরা নোংরা চিঠিগুলো দেখি।

জোরে-জোরে পড়তে লাগলেন একটা। ঘরে অন্য একজন এসে যাওয়াতে থেমে গেলেন সনৎদা। বলেন, কী যে হল দেশটার… নিজেদের গোপন কথা সব ওপেন করে দিচ্ছে…।

যিনি ঘরে ঢুকলেন, তাঁর নাম ভারতী বসু মজুমদার। গাইনো। এই টিমে আছেন। প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন।

তিনি বললেন—আমার একটা সাজেশন আছে অনিকেত। যারা চিঠি লিখছে, বেছে-বেছে তাদের কয়েকজনকে স্টুডিওতে নিয়ে এসো। ওদের সঙ্গে ইন্টার‍্যাক্ট করা যায়।

অনিকেত বলে, ওরা এলেও সামনাসামনি এসব বলতে পারবে? মনে হয় না। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না বলে চিঠি দিচ্ছে।

ভারতীদি বললেন—চিঠি দিয়ে আনিয়েই দ্যাখো না কী হয়!

অনিকেত বলল, ভাবা যাবে।

অনিকেত চিঠিগুলোর গোছা ভারতীদির হাতে তুলে দেয়। বলে, আপনি দেখে নিন কোনগুলোর উত্তর দেবেন। ইতিমধ্যে ডাক্তার বিষ্ণু মুখার্জিও এসে গেলেন। ওঁরও আসার কথা ছিল।

বিষ্ণু মুখার্জি চিঠিগুলো দেখতে-দেখতে বললেন—আমার নিজের ছোটবেলাটা মনে পড়ছে। এই সব প্রশ্ন আমার মনেও উঁকি দিত। মাছির মতো ভনভন করত। মাছিগুলোকে উড়িয়ে দিতাম, আবার ভনভন করত…।

বিষ্ণু মুখার্জি একটা চিঠি মেলে ধরলেন। বললেন—এটা তো আমার বিরুদ্ধেই কমপ্লেন দেখছি…।

পুরুলিয়া থেকে আসা একটা চিঠি :

‘আপনাদের অনুষ্ঠান শুনে বিস্মিত হলাম। ডাক্তার বিষ্ণু মুখার্জি বলেছেন স্বপ্নদোষ স্বাভাবিক ব্যাপার। পরিমিত হস্তমৈথুনও স্বাভাবিক ব্যাপার। কী করে একজন ডাক্তার হয়ে এমন কথা বললেন তিনি? ছিঃ। বীর্য হল শরীরের সার-পদার্থ। নীলমণি দাসের ‘যোগব্যায়াম’ বইতে এ কথা লেখা আছে। রক্ত থেকে মাংস তৈরি হয়, মাংস থেকে হাড়, হাড় থেকে মজ্জা, এবং মজ্জা থেকে শুক্র। ইহা তো বিজ্ঞান। এক ফোঁটা বীর্য = ৮০ ফোঁটা রক্ত। মুনিঋষিরা বলে গিয়েছেন। আমি এই কুঅভ্যাস থেকে বিরত থাকার জন্য নিয়মিত গোমুখাসন করি, সত্ত্বযোগ বড়ি খাই, বেলপাতার রস খাই, তবুও পাপকাজ করে ফেলি, তখন হাতে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিই, যেন ভবিষ্যতে এই কাজ না-করি। আমার দাদুকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। তিনি বিবাহের আগে কঠোর ব্রহ্মচারী ছিলেন। আমার দাদু এক সাধুর শিষ্য ছিলেন। সাধুর অনেক গুণই দাদু পেয়েছিলেন। দাদু বলেছেন, স্বপ্নদোষ পুরোপুরি আটকানো যায় না, কিন্তু ব্রহ্মচারীর স্বপ্নদোষ হলে সেই বীর্যের হবে পুষ্প-গন্ধ। যাই হোক, আমি অনুরোধ করছি সঠিক কথা বলুন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপথে চালিত করার পিছনে আপনাদের কোনও স্বার্থ কাজ করছে?”

এটার উত্তর দেবেন বিষ্ণুবাবু?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই…

কী বলবেন?

ঠিক বলে দেব। বলব, গোমুখাসন ভাল। ঠিকমতো যোগাসন করা খুব ভাল। বেলপাতার রস খেতে যেও না, হাতে ছ্যাঁকা দিও না। নিজের ক্ষতি কোরো না। মন দিয়ে রবীন্দ্রনাথ- বিবেকানন্দর বই পড়ো, খেলাধুলো করো—ওসব চিন্তা যত কম করা যায় ততই ভাল—এইসব বলব। এই তো আর একটা চিঠি আছে আমার সাপোর্টে।

চিঠিটা অনিকেতই বেছেছিল। লেখক হিঙ্গলগঞ্জের শওকত আলি।

‘আমি কৈশোর থেকে যথেচ্ছভাবে জীবনটা নষ্ট করেছি। আমার হস্তমৈথুনের কুঅভ্যাস ছিল। দিনে-দিনে রোগা হয়ে যেতাম, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে লাগল। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়েও, ওই পাপকাজ থেকে নিরস্ত হতে পারিনি। দুই বৎসর আগে ভেবেছিলাম আত্মহত্যা করব, কিন্তু সফল হতে পারিনি। আমি ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়ে পড়লাম। বিএসসি-তে ভর্তি হয়েও পড়াশোনা ছেড়ে দিলাম। সেদিন ‘সন্ধিক্ষণ’ অনুষ্ঠানটা শুনলাম। ডাঃ বিষ্ণু মুখার্জি বললেন—এসব খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। স্বপ্নদোষ কোনও দোষ নয়। প্রত্যেক পুরুষেরই হয়, মহাপুরুষেরও হয়। যারা ভাবে স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে, সেটা অপরাধবোধ থেকে হয়। শরীরের দুর্বলতাও অপরাধবোধ থেকে হয়। শুনে মনে বল পেলাম। রেডিও মিথ্যা বলে না। আশীর্বাদ করুন যেন আবার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারি। আমার এই চিঠি লেখা সম্ভব হত না, যদি তখন আত্মহত্যা করতে গিয়ে সফল হতাম।

বিষ্ণুবাবু গোটা দশেক চিঠি বেছে নিলেন।

ভারতীদি’রও বাছা হয়ে গিয়েছে। এবার স্টুডিওতে রেকর্ডিং-এর জন্য যাবেন ওঁরা। অনিকেতের বুক ধুকপুক করে।

ভারতীদি চিঠিগুলো অনিকেতকে দিয়ে বললেন—একবার দেখে নাও।

ভারতী বসু মজুমদার একজন সিনিয়ার গাইনি। অনিকেতের চেয়ে বয়সে অনেক বড়। কখনও আপনি করে বলেন, কখনও তুমি। অনিকেত বলেছে, তুমি করেই বলবে।

ভারতীদি’র বাছা চিঠিগুলো পড়তে গিয়ে অনিকেতের ধুকপুকানি আরও বেড়ে যায়। কীসব চিঠি? একটা মেয়ে তো যা-তা লিখেছে। ইস। অনিকেতের নিজেরও খারাপ লাগে। এসব নিয়ে আলোচনা চালালে চাকরিটা থাকবে তো? ওই চিঠিটি ভারতীদিকে ফেরত দিয়ে অনিকেত বলে—এটারও উত্তর দেবেন?

ও মা! কেন দেব না? ছেলেদের বেলায় এন্টারটেন করার, আর মেয়েদের বেলায় করব না, এ কেমন বিচার? অনিকেত আর কিছু বলে না তখন।

বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না—এই কনসেপ্ট-টা খুব ভাল লাগে তোমাদের, তাই না? মেয়েরা তো এখন তবু নিজেদের কথা বলছে, বলতে পারছে। জানতে পারছে অন্তত। এতদিন তো জানাতেও পারত না। এখন প্রতিবাদও করছে কখনও।

চাকদার এই মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে, ওর বাড়িওলাটার সঙ্গে একটু দেখা করা যায়? আচ্ছা করে কড়কে দিতাম…বলেই বললেন—তা কতজনকে কড়কাব? সারা দেশ জুড়েই তো এই অবস্থা।

যে-চিঠিটা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটা এরকম :

‘আমি আপনাদের অনুষ্ঠান শুনি। আমি আমার একটি সমস্যার কথা বলতে চাই। আমার বাবা একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী, মালিকের বাড়িতেই আমরা ভাড়া থাকি। আমার ছোট দুই ভাই আছে। আমার বয়স ১৭, আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের টানাটানির সংসার। বাড়িওলার বাড়িতে ভালমন্দ রান্না হলে মাঝে-মাঝে ডেকে খাওয়ায়। আমাদের বাড়ি ভাড়াও বাকি থাকে। আমাদের বাড়িওলার কিছু একটা অসুখ হয়েছে। পা ফুলে যায় মাঝে- মাঝে, পেটও ফুলে যায়, ভেলোরে নিয়ে গিয়েছিল। ওঁকে আমি দাদু ডাকি। দাদু একদিন আমাকে ডাকলেন, তারপর বললেন, একমাত্র তুই আমাকে বাঁচাতে পারিস, তোর কাছেই আমার প্রাণ, আগে বল তুই আমাকে বাঁচাবি কি না…। তারপর কুপ্রস্তাব দিলেন। এখন আমি কী করব? আমাদের ৫/৬ মাসের ঘরভাড়া বাকি। যদি আমাদের উনি উঠিয়ে দেন, যদি বাবাকে বলেন আজ থেকে তোমাকে আর দরকার নেই, তখন আমি কী করব? আমার ভীষণ ভয় করছে।’

হঠাৎই একটা ফ্ল্যাশব্যাক অনিকেতের মনে। কয়েক মুহূর্তের জন্য পিছনে যায়, কিন্তু কোনও-কোনও সময় মুহূর্তটাই অনেক লম্বা হয়ে যায়। সময় নাকি ইলাস্টিক। সময় নিজের প্রয়োজনে লম্বা হয়, ছোট হয়।

অনিকেতের একজন পিসেমশাই ছিলেন। বড় পিসেমশাই। একসময়ে মিলিটারিতে চাকরি করতেন তিনি। ওঁর কোনও ছেলেমেয়ে ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান যখন হেরে গেল, তখন জাপানের দখল নিতে ব্রিটিশের পক্ষ হয়ে জাপান গিয়েছিলেন। ওঁর বাড়িতে মিলিটারি পোশাক-পরা একটা ছবি ছিল। কিন্তু অনিকেত কখনও মিলিটারি পিসেমশাইকে দেখেনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বড় পিসেমশাইকে দেখেছে গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মুখে দাড়ি। পরনে ধুতি, গায়ে নামাবলি। কপালে তিলক। পুজো করেন নানা জায়গায়। অনিকেতকে খুব ভালবাসতেন। আইসক্রিম খাওয়ার পয়সা দিতেন, পুজোর সময় ফুচকা খাওয়ার পয়সা দিতেন। অনিকেতদের বাড়ির কাছাকাছি একটা টিনের চালার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ওই বাড়িটা ছিল লম্বা। পাশাপাশি অনেকগুলো ঘর। সেই ঘরগুলোতে আরও সব ভাড়াটে।

সেই বড় পিসেমশাইয়ের গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ল। চোয়ালের তলায় গলার ওপর একটা মাংসপিণ্ড। চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসাপাতালে দেওয়া হয়েছে, কাজ হয়নি। অনিকেতের বাবা ছুটোছুটি করছে হাসপাতালে। অপারেশন করতে হবে। আবার ভর্তি হবে হাসপাতালে। বড় পিসিমা কান্নাকাটি করছে। বলছে, সব সময় যে লোকটা ঠাকুর-দেবতা নিয়ে থাকে, সেই লোকটার কেন এই রোগ হল? ভগবানের এ কেমন বিচার?

হাসপাতালে ভর্তির দিন ঠিক হল। কয়েকদিনের মধ্যেই ভর্তি হতে হবে। বড় পিসিমা ছোটকাকুকে নিয়ে সক্কালবেলা চলে গিয়েছে তারকেশ্বরের মন্দিরে। সারাদিন হত্যে দিয়ে সন্ধেবেলা ফিরবে। মা বড় পিসেমশাইয়ের জন্য গলা-ভাত করেছে, মাছের ঝোলের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ভাত। শিঙিমাছের কাঁটা বেছে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। বড় পিসেমশাই চামচ দিয়ে খেয়ে নেবে। মা টিফিন বাটিটা অনিকেতের হাতে দিয়ে বলল বড় পিসেমশাইকে দিয়ে আয়। খাবার সময় সামনে বসে থাকিস। দরকার হলে, খাইয়ে দিস। অনিকেতের তখন ক্লাস টেন চলছে।

বাটিটা নিয়ে ও-বাড়ি যায় অনিকেত। তখন দুপুর বারোটার মতো হবে। দেখল, ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। এই অসুস্থ লোকটা দুপুরবেলায় গেল কোথায়? অনিকেত কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। একবার ভাবে পাশের কোনও ভাড়াটের কাছে রেখে যাবে। পাশেই এক কম্পাউন্ডারের ঘর। ওদের সঙ্গে বড় পিসেমশাইদের বেশ ভাব। কম্পাউন্ডারের একটা মেয়ে আছে, মঞ্জু। মঞ্জু অনিকেতেরই বয়সি। যদিও নাইন-এ পড়ে। ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়, বলেনি কখনও, কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে ভাব করার ইচ্ছেও ছিল অনিকেতের মেয়েটার সঙ্গে মাঝে-মাঝেই চোখাচোখি হয়, মেয়েটার চোখের ভাষাতেও কিছু একটা বোঝে অনিকেত। কিন্তু তেমন কথা হয়নি। মেয়েটা স্বপ্নে এসেছে একাধিকবার। স্বপ্নের পাপে। স্বপ্নের দোষে। স্বপ্ন ভেঙে গেলে লজ্জা পেয়েছে, ভেজা-লজ্জা। অনিকেত একবার ভাবে মঞ্জুদের ঘরেই গিয়ে দিয়ে আসবে বাটিটা। মঞ্জু থাকলে ও যদি নেয়, বেশ হয়। হাতে যদি হাত লেগে যায়, বেশ হয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, থাক গে। আর একটু দেখি। এক্ষুনি আসবে। অসুস্থ লোকটা যাবে কোথায়? আরও মিনিট পাঁচেক ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে অনিকেত। গরম লাগছে। গরমের ছুটি চলছে। ঘরের ভিতর থেকে ফ্যান ঘোরার খটখট শব্দ আসছে। ফ্যান-টা অফ করেনি যখন—এক্ষুনি আসবে। আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা। উনি আসেন না। বাড়িটার ডানদিকে একটা বালির গাদা। এক চুন-বালির কারবারি ওখানে বালি ডাঁই করে রাখে। মাঝে- মাঝে বালির লরি এসে ওখানে বালি ফেলে যায়, আবার ওই বালি বস্তায় পুরে খুচরো বিক্রি হয়। ছোটবেলায় বালির গাদায় হুটোপুটি করেছে অনিকেত। ওই বালির গাদার পাশে একটা জানলা আছে। অনিকেত ভাবে, ওই জানালা দিয়ে বাটিটা রেখে যাবে। ঘরে ফিরে এসে ঠিক দেখবে। হয়তো বড় পিসেমশাই কোনও মন্দিরে গিয়েছেন কষ্ট করে, প্রার্থনা করতে। অনিকেত বালির গাদায় নেমে যায়। জানালাটা বন্ধ। জানালায় ধাক্কা দেয়, জানালা খুলে যায়। এক বিচ্ছিরি দৃশ্য। অনিকেত বাটিটা ছুড়ে দেয়। পালিয়ে যায়। মেঝেতে একটা ধাতব আর্তনাদ শোনে অনিকেত।

এই বড় পিসেমশাইয়ের সঙ্গে আর কোনওদিন কথা বলেনি অনিকেত। ঘেন্না করেছে। বাতাসে থুথু ছিটিয়ে বলেছে, এই থুথু বড় পিসেমশাইয়ের গায়ে পড়ুক। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর দেখতে গিয়েছে, কিন্তু কথা বলেনি। বড় পিসেমশাই একদিন খুব মৃদুস্বরে অনিকেতের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—তোকে একটা কথা জানানোর ছিল….। কিন্তু সেই কথা আর জানাতে পারেননি উনি। ওঁর কথা বন্ধ হয়ে যায়। অনিকেত দেখতে গেলে ওর ঠোঁটটা তিরতির করে কাপত, গলার উঁচু হয়ে ফুলে থাকা বিচ্ছিরি অর্বুদটার পাশ দিয়ে গ্রাম্যরাস্তাটার মতো বয়ে যাওয়া নীল শিরাটার কম্পনে কোনও সাংকেতিক বার্তাও হয়তো থাকত।

অপারেশনের পর চারদিন বেঁচেছিলেন উনি। বাড়িতে দেহটা আনা হয়েছিল। পিসিমারা তো কাঁদবেই, মা-ও, কিন্তু মঞ্জু কেন কাঁদছিল? মঞ্জুর ওপর খুব ঘেন্না হয়েছিল। শুধু মঞ্জু কেন, মেয়েদের ওপরই কেমন যেন ঘেন্না জন্মে গিয়েছিল। নিজের বোনদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করল অনিকেত। খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল।

অনিকেত ততদিনে অনেক কিছু জেনে গিয়েছে। বুঝে গিয়েছে। একসময় ওর নিজের মা- বাবার ওপর একটা বিরাগ জন্মেছিল, পরে সেটা মিটে যায়। ও বুঝতে শিখেছিল, পৃথিবীর এটাই নিয়ম। এগুলো প্রকৃতিরই নিয়ম। কিন্তু বৃদ্ধ এক ক্যান্সার রোগীর সঙ্গে কোনও কিশোরীর দৈহিক ব্যাপার তো প্রকৃতির নিয়ম হতে পারে না।

তা হলে কি হাবুলের কথাই ঠিক? ভানুদার কথাই কি ঠিক? ওইসব চটি বইগুলোর গপ্পোগুলিই কি সত্যি? হাবুল এইট-এ একবার ফেল করেছিল, টেন-এও একবার। হাবুল মাঝে মাঝেই ইস্কুলে আসত না, বলত বউদি ডেকেছিল। সব বর্ণনা দিত। ও বলেছে, মেয়েরাই বেশি হিটু হয়। ভানুদা বলেছিল, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ষোলো গুণ বেশি মজা পায়। এসব নাকি ‘কোকশাস্ত্ৰ’-তে লেখা আছে। চটি-চটি বইগুলোতেও কত সব কাণ্ডকারখানার বর্ণনা থাকে।

অনিকেত ভাবত—ওসব মিথ্যে, বাজে কথা। হাবুল, ভানুদা সবাই গুলবাজ। কিন্তু সেদিনের ঘটনাটা অনিকেতের চিন্তাভাবনা কীরকম ওলটপালট করে দিল। বড় পিসেমশাইয়ের মতো একটা বৃদ্ধ, ক্যান্সার রোগীর কাছে কী করে নিজেকে সমর্পণ করতে পারল মঞ্জু? রুচিতে বাধল না? শরীরের খিদে কি এত বেশি মেয়েদের?

হয়তো সব মেয়ের নয়, হয়তো মঞ্জুরই খুব খিদে। মঞ্জুর যদি বেশি খিদে হয়, তা হলে অনিকেত নিজে অ্যাকশনে নয় কেন?

এরপর অনিকেত কয়েকবার মঞ্জুকে স্বপ্নে পেয়েছে। একদম অরণ্যদেবের ডায়না-র মতন করে। একদম ‘সঙ্গম’ সিনেমার বৈজয়ন্তীমালার মতো করে ক্যা করু রাম মুঝে বুড্‌ঢা মিল গয়া…। অনিকেত বলছে, বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নেহি…। মঞ্জু বলেছে হোগা…হোগা…হোগা…।

ওসব তো স্বপ্নে। দিনের বেলাতেও শত কাজে মঞ্জুচিন্তা। জ্যামিতির এক্সট্রার মধ্যে মঞ্জু, ইংরেজি প্রেসির মধ্যে মঞ্জু, সমাস-কারক-বিভক্তিতে মঞ্জু। এই নয় যে মঞ্জুকে খুব ভালবেসে ফেলেছে অনিকেত, ব্যাপারটা হল মঞ্জুকে ঠিকঠাক স্পর্শ করতে হবে। পূর্ণ নারী কখনও দেখেনি। কুমোরটুলিতেই দেখেছে, কিংবা চটি বইয়ের ছবিতে। একবার মঞ্জুকে চাই। কী বলবে? কী করে বলবে? বড় পিসেমশাই কীভাবে বলেছিল?

বড় পিসেমশাইয়ের মৃত্যুর পর বড় পিসিমা একাই থাকত ও-বাড়ি। অনিকেত মাঝে-মাঝে যেত। অনিকেতকে দেখলে মঞ্জু ও-ঘরে ঢুকত না। রাস্তাঘাটেও একা পেল না। একা পেলে কী জিজ্ঞাসা করত অনিকেত নিজেও জানে না। কিন্তু হ্যাবড়া-জ্যাবড়া অ্যালজেবরা আলু-কুমড়োর পচা লাবড়ার ওপর ভনরভনর মাছির মতো মঞ্জুচিন্তা ওর টেন থেকে ইলেভেন-এর রেজাল্ট খারাপ করল।

কিন্তু ইলেভেন-এ ভাল করতেই হবে। ওই চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য হস্তমৈথুন। কিন্তু ওটা করার পর মনে হতে লাগল, স্মৃতিশক্তি কমে যাচ্ছে। স্মৃতিশক্তি কমে গেলে কী করে ভাল রেজাল্ট হবে? একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। মঞ্জু কেস-টা মিটে গেলেই একদম পুরোদমে পড়ালেখা শুরু করে দেবে।

এরকম অবস্থায় অনিকেতদের বাড়িতেই পেয়ে যায় মঞ্জুকে। ওদের বাড়ির এক ভাড়াটে প্রভাতবাবুর ক্লাস ফাইভ-এর মেয়েকে পড়াচ্ছে মঞ্জু।

অনিকেতের সঙ্গে মঞ্জুর সামনাসামনি দেখা হয়ে গেলেও অনিকেত মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে অ্যাকশনটা ভুল হয়ে গেল। ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে হবে।

অনিকেত লক্ষ করে মঞ্জুর আসা-যাওয়া। পড়িয়ে ফিরছে মঞ্জু। অনিকেত বেড়ালের মতো পিছু নেয়। মঞ্জু ‘নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা’ সুরটা গুনগুন করতে-করতে নামছে। এবার কি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরবে? কেউ নেই। পা টিপে-টিপে অনিকেত পিছনে। সময় চলে যাচ্ছে। সিঁড়ির তলার কলঘরে ঢুকল। কলঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল ও। সময় ঝরঝর করে পড়ে যাচ্ছে কল থেকে। ছিটকিনি খোলার শব্দটা যেন যাত্রাপালার ঝন। দরজাটা একটু খুলতেই কলঘরের ভিতরে গলে গেল অনিকেত। দরজার ছিটকিনিটা দিয়ে দিল।

মঞ্জু বলল, কী ব্যাপার, কী ব্যাপার? অনিকেত বলল কিছু নয়। হাতটা থাবার মতো মঞ্জুর বুকের দিকে…।

মঞ্জু এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিল। বলল—ছিঃ!

এত জোরে বলল, যে থুথু ছিটাল। চিৎকার করে উঠল।

বলল, আপনি না ভদ্রবাড়ির ছেলে! লজ্জা নেই। লজ্জা নেই? এ কী করছেন, অ্যাঁ? ও আর বলতেই পারল না—বড় পিসেমশাই তা হলে কীভাবে…

অনিকেত দরজা খুলে বেরিয়ে যায় দ্রুত। সোজা রাস্তায়। মাথা নিচু করে রাস্তায় চলতে থাকে। ওর সারা গায়ে অন্ধকার লেপ্টে রয়েছে। রাস্তার আলোটা যেন ওর পাপে ফিউজ হয়ে গেল। মঞ্জু তো কখনও ‘আপনি’ বলেনি, আজ আপনি বলল। ‘ছিঃ’ শব্দটা মাছির মতো অনিকেতের সঙ্গে ঘুরছে। মঞ্জু কি ওর মা-কে বলে দেবে? তারপর ওর মা কি বড় পিসিকে বলে দেবে? কী হবে তা হলে?

উঃ! মেয়েরা কী অদ্ভুত চরিত্রের হয়। কিছুই মেলাতে পারে না। যে একজন গলায় টিউমার-ঝোলা অসুস্থ বৃদ্ধকে শরীর খুলে দিতে পারে, সে ওর মতো একটা ছেলেকে এভাবে ফুটিয়ে দিল।

এই অপমানটা অনিকেতের জীবনের একটা ট্রমা। সব সময় মনে হত, ও একটা চরম অন্যায় করেছে। রাস্তায় মঞ্জুর সঙ্গে দেখা হোক ও চাইত না। খবরের কাগজে শ্লীলতাহানি’ শব্দটা দেখলেই ওর বুকে ধক করে বাজত। মনে হত এই পাপে, এই দোষে অনিকেত ও দোষী। ‘বলাৎকার’ শব্দটাও একইরকম ভাবে মুখ ভ্যাংচাত অনিকেতকে। বড় পিসির বাড়ি যাওয়া কমিয়ে দিল অনিকেত, পাছে মঞ্জুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মাঝে-মধ্যে মঞ্জুর সামনাসামনি পড়ে গেলে, অনিকেত মাথা নিচু করত যেন চোখাচোখি না-হয়। বড় পিসেমশাইয়ের সঙ্গে কেন ও এরকম কাজ করেছিল সেই প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়ে গেল। জানার কোনও উপায় নেই।

মঞ্জু কি ওর মা-কে বলেছিল কিছু? নইলে কেন মঞ্জুর মা-ও অনিকেতের সঙ্গে কথা বলত না?

ঘটনাটা একটা কালো দাগের মতোই অনিকেতের জীবনে রয়ে গেল। মেয়েদের এড়িয়ে চলত। কোনওরকম ভাবেই ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত না।

পড়াশোনাতে ভালই ছিল মঞ্জু। অনিকেতের সঙ্গে আর কথা হয়নি কোনও। মঞ্জু কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তারপর ওর বিয়েও হয়ে যায়। বিয়ে হওয়াতে অনিকেত ভেবেছিল, যাক, বাঁচা গেল, রাস্তাঘাটে দেখা হয়ে যাওয়ার অস্বস্তিটা আর হবে না।

কিছুদিন পর ওই বাড়িটা ভাঙা হল। ওখানে একটা পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি উঠেছে। বাড়িটার নাম এখন ‘কুসুম কানন’। ওই ফ্ল্যাটের পাশ দিয়ে হাঁটলে কাননের কুসুমকলির ছোট-ছোট কাঁটা আজও খোঁচা মারে এই বয়সেও। মঞ্জু হারিয়ে গিয়েছে, কিন্তু কালো দাগ বা ক্ষতচিহ্ন রয়ে গিয়েছে আজও। রহস্যটাও রয়ে গিয়েছে। কেন ওই বৃদ্ধকে ভালবাসা দিল, যেটা অনিকেত পেল না।

এই যে চাকদা-র পত্রলেখিকা, তাকে এক অসুস্থ বৃদ্ধ আহ্বান করছে। মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলছে। বলছে তুই আমার প্রাণ। মেয়েটি কি শেষ পর্যন্ত…। কিন্তু এখানে ওই বৃদ্ধটি হল বাড়িওলা, মেয়েটির বাবার চাকরিদাতা…। ফলে আরোপিত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু মঞ্জুর ক্ষেত্রে তো ওরকম কিছু ছিল না, তবে কেন? কিছু কি লোভ দেখিয়েছিল বড় পিসেমশাই? টাকাপয়সা? তবে কি নেহাত টাকার জোরে? দাদাঠাকুরের একটা কথা ছিল, পৃথিবীটা কার বশ? পৃথিবী টাকার বশ। তার মানে টাকার বিনিময়ে মঞ্জু ওই কাজ করতে রাজি হয়েছিল? কে জানে!

ফ্ল্যাশব্যাক শেষ করে ফিরে এসেছি সেই চিঠিতে। অনিকেত জিগ্যেস করল, কী বলবেন চাকদা-র ওই মেয়েটিকে।

ভারতীদি বললেন—বলব প্ররোচনায় পা দিও না। ওরা সব বাজে লোক। বলব, ভাল করে পড়াশোনা করে স্বাবলম্বী শুধু নয়, পরিত্রাতা হও। বাবাকেও সাহায্য করো। মনে জোর আনো…. এইসব বলব। ঠিক বলে দেব, এই লোকগুলো। পারভার্টেড। বুঝিয়ে বলে দেব।

হুঁ। মৃদু মাথা নাড়ায় অনিকেত। ওঁরা স্টুডিওতে ঢোকেন।

অনিকেত নিজে বলল না, কিন্তু ওর মনে হল ওর বউ শুক্লার দরকার ছিল এই মুহূর্তে, যে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলবে দুর্গা-দুর্গা।

শুক্লা বলল, ছি ছি, কী সব প্রোগ্রাম করছ, দুলালের মা বলছিল। খুব বাজে, নোংরা।

—দুলালের মা রেডিও শোনে না কি? কী করে শুনবে? সকালবেলা তো ও কাজে থাকে।

—ও শুনবে কেন? ও অন্যের বাড়িও কাজ করে তো, না কি?

—কী বলছিল দুলালের মা?

—পাশের বাড়ির যূথিকারা বলাবলি করছিল, এ-বাড়ির লোকটার এই বয়সেই ভীমরতি হয়েছে।

‘রতি’ শব্দটা শুনেই অনিকেতের মনটা কয়েক মুহূর্তের জন্য এধার-ওধার হয়ে গেল। যা সব ঘাঁটছে, ওর মধ্যে এই শব্দগুলো অন্য ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে। কোথায় যেন পড়েছিল ভীমরতি-র সঙ্গে রতি-র কোনও সম্পর্ক নেই। ভীমের মতো রতি করেন যিনি—এরকম ব্যাসবাক্য-সহ বহুব্রীহি সমাস এটা নয়। এই শব্দটা এসেছে সংস্কৃত ‘ভ্রমতি’ থেকে। মানে ‘ভ্ৰম’ করা। ভুলভাল হয়ে যাওয়া আর কী। বুড়ো বয়সে অনেকেরই সোডিয়াম-পটাসিয়ামের গণ্ডগোল হয়, তখন ভুলভাল বকে। শুক্লা বলল—এমন সব কথাবার্তা নাকি বলেছ, যা মুখেও আনা যায় না। তোমার গলা তো সবাই চেনে, তোমার মুখে ওসব বাজে কথা শুনে ওরা অবাক। ওরা বলেছে কী করে ভদ্রলোক ওসব কথা মুখে আনতে পারলেন?

এসব নিয়ে শুক্লার সঙ্গে অনিকেতের খুব একটা আলোচনা হয়নি আগে। অফিসে কিছু মজার ব্যাপার-স্যাপার হলে বউকে হয়তো বলে, যেমন অ্যানাউন্সার বাসবীদি শাড়িতে একটা প্রজাপতি ক্লিপ লাগিয়ে এসেছিল, হাঁটলেই প্রজাপতিটার ডানা দু’টো নড়ে, কিংবা পীড়িত পুরুষপতি পরিষদ থেকে এক ভদ্রলোক দেখা করে বলেছেন, উনি পত্নীদের অত্যাচার মোকাবিলায় পতিদের কর্তব্য-বিষয়ে একটি বক্তৃতা দিতে চান, তার ব্যবস্থা করা যায় কি না— এই ধরনের অফিসের কথা হয়, কিন্তু কী-কী অনুষ্ঠান হচ্ছে, না-হচ্ছে—এ নিয়ে শুক্লার সঙ্গে কোনও পরামর্শ সাধারণত করে না।

—কী বলেছিলে তুমি বলো তো? ওরা কেন এরকম বলছে?

অনিকেত মাথা চুলকোয়। বলে, কী আবার বলব, রেডিও-তে কি খারাপ কথা বলা যায় নাকি?

—তবে যে ওরা বলছে?

—রাখো তো ওদের ন্যাকামি…

—দাঁড়াও, আমি শুনব। কবে যেন হয়? রোববার, সকাল আটটা-য়, তাই না?

অনিকেত মনে-মনে ভাবে—এই রে… ভারতীদি আর ডা. মুখার্জি যেটা রেকর্ড করে গেলেন—সেই এপিসোডটাই তো আগামী রবিবার আছে।

শুক্লার বিয়েতে ওর বাবা ওকে একটা ডায়েরি উপহার দিয়েছিলেন, সেই ডায়েরি-ভর্তি বাণী। মানে, ভাল-ভাল কথা। গীতা, উপনিষদ, বাইবেল, জাতক—এসব বই থেকে নেওয়া, তা ছাড়া প্লেটো, সক্রেটিস, শেক্সপিয়র, শংকরাচার্য, চাণক্য, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রাধাকৃষ্ণণ—এঁদের উদ্ধৃতি। শুক্লার বাবা বলেছিলেন, রোজই দুই-এক পাতা করে পড়তে শুক্লা তাই করে থাকে। নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রানিনেনং দহতি পাবকং… অস্ত্র দিয়া আত্মাকে কাটা যায় না, আগুন ইহাকে পোড়াইতে পারে না, বায়ু ইহাকে শোষণ করিতে পারে না, জল ইহাকে সিক্ত করিতে পারে না… শুক্লা এসব পড়ে কী আনন্দ পায়? কিংবা, জাহাজ যে-দিকে থাক না কেন, কম্পাসের কাঁটা উত্তরেই থাকে, তাই জাহাজের দিক ভুল হয় না। মানুষের মন যদি ভগবানের দিকে থাকে, তার কোনও ভয় থাকে না। শুক্লা অনিকেতকে বলেছে, তুমিও তো রোজ দু-এক পাতা পড়তে পারো, মনটা তো ভাল থাকে এতে।

অনিকেতেরও একটা ডায়েরি আছে। ওটাও উদ্ধৃতি লেখার ডায়েরি। আগে ওটা কবিতা লেখার ডায়েরিই ছিল। কবিতা লেখার চেষ্টা করত। বুঝেছিল হচ্ছে না। অনিকেত ব্যর্থ কবি,- ও জানে, জেনেও গিয়েছে। ব্যর্থ কবিদের কবিতা লেখার খাতায় পরবর্তীকালে উষ্মা মন্তব্য পূর্ণ স্বগতোক্তি লেখা হয়ে থাকে। অনিকেত তা করেনি। অন্যের কিছু ভালোলাগা কবিতার লাইন টুকে রেখেছে। মানে—টুকে রেখেছিল, এখন এই অভ্যাসটাও নেই। সেখানে নানারকম উদ্ধৃতি আছে। শিবরাম চক্রবর্তী সৈয়দ মুজতবা আলি যেমন আছেন, সুভাষ-নীরেন্দ্রনাথ-শঙ্খ-সুনীল থেকে জয়-মৃদুল-জয়দেব বসু-রাহুল-চৈতালী-জামালও আছেন। যেমন—মাটির ভিতরে জমে অন্ধকার মাটি নিজে আর জানে না ফসল/তোমার চোখের জলে ভরে ওঠে/ছোট ছোট ফল। কিংবা—লেজে ভর দিয়ে দাঁড়াইনি চাঁদ খাবো বলে… এইসব।

শুক্লাকে মাঝে-মাঝে শুনিয়েছে এইসব। ও বলেছে, তুমি যদি পারো ল্যাজে ভর দিয়ে দাঁড়াও, আমার ল্যাজ নেই, চাঁদ খাবারও ইচ্ছে নেই।

—’সারাটা জীবন একটা গরম কড়াইয়ের উপর নেচে গেলাম’—এই লাইনটা পড়ে বলল—এটা ডায়েরিতে টুকে রেখেছ? কী আনন্দ দিচ্ছে তোমাকে কথাটা? জাস্ট এর সঙ্গে কম্পেয়ার করো, উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্যবরান্ নিবোধত…. যা আমার ডায়েরিতে আছে…।

—তুমি বুঝবে না… বোঝাতে পারব না। অনিকেত বলে।

শুক্লাও একই কথা বলে। অনিকেতের এই বউ প্রেমজ বিবাহের ফল নয়। ওর দ্বারা প্রেম- ট্রেম হয়ে ওঠেনি। মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা-টলার বিপক্ষে একটা শক্তি কাজ করে গিয়েছে, সেটা ওই মঞ্জু-ঘটিত ট্রমা। অনিকেতের ছোট বোনটির বিয়ে ঠিক হলে, বাড়িতে একজন কোনও ‘মেয়ে’ দরকার বলে—ওর বিয়ে। পিসিরা বলল, কী রে অনি, রেডিওতে তো কাজ করছিস, নিজে থেকে কিছু ঠিকঠাক করেছিস না কি?

অনিকেত বলেছিল, না।

‘না’ বলতে একটু ইগো প্রবলেম হয়েছিল বইকি। অনিকেতের বাবার সময়ে এই ধরনের প্রশ্ন করার অবকাশই ছিল না। যদি জিগ্যেস করা হত, অনিকেতের বাবা গর্বের সঙ্গে বলত : না। অন্তর্নিহিত ভাবটা হল, আমি নিজে নিজের বিয়ে ঠিক করব? ছিঃ। একেই বলে কালপ্রবাহ। এখন কোনও ছেলের যদি গার্লফ্রেন্ড না-থাকে, বা কোনও মেয়ের বয়ফ্রেন্ড, বন্ধুমহলে সে হেয়। এরকম তো কত চিঠি পায় অনিকেত—–আমার সামনের দাঁত উঁচু বলে আমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই। আমি কি দাঁত উঠিয়ে সুন্দর দাঁত বসাব? রুট ক্যানাল ব্যাপারটা কী? আমার যে গার্লফ্রেন্ডটি আছে, সে কেবলই চকোলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি খেতে চায়। বাবা আমায় যা হাতখরচ দেয়, সব ওর পিছনে চলে যায়। মাঝে-মাঝে ভাবি ওকে আমি ফুটিয়ে দি। কিন্তু আমার হাতে আর কোনও গার্লফ্রেন্ড নেই। বাবার পকেট থেকে মাঝে-মাঝে টাকা চুরি করি। বাবা মা-কে বকাবকি করে। বাবা ভাবে, মা-ই টাকা চুরি করেছে। এজন্য বাবা একদিন মা-কে মারল। মা খুব কান্নাকাটি করছে। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার গার্লফ্রেন্ডকে মুখ ফুটে বলতেও পারছি না—বাদাম-ঝালমুড়িতে সন্তুষ্ট থাকতে না-পারলে আমি খেলব না। আমি কি আমার গার্লফ্রেন্ডকে সব খুলে বলব?…। কিংবা, আমার বয়েস ১৭+, কিন্তু বুকটা খুব অপরিণত বলে আমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই। কাগজে নানারকম তেলের বিজ্ঞাপন দেখি যা মালিশ করলে…।

বর্ণালী গড়াই-এর কথা ফের মনে পড়ে অনিকেতের। বর্ণালী গড়াইকে নিয়ে কিছু একটা লিখতে হবে। হয়তো গল্পই।

কবিতায় ব্যর্থ হয়ে গল্প-টল্প মাঝে-মধ্যে লিখত অনিকেত। দু-চারজন লেখক-বন্ধুও হয়েছিল। কফি হাউসেও যেত।

বিয়ের পরপরই একটা চটি-বই ছাপিয়েছিল অনিকেত নিজের পয়সায়। ওর শ্বশুরবাড়িতে খবর চলে গিয়েছিল ও একটা বই লিখেছে। অনিকেতের শ্বশুরমশাই ছিলেন স্থানীয় একটি স্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই। তিনি একদিন বলেন, বইটা দেখালে না, দেখতাম কেমন লিখেছ… শুক্লা বলে, বাবাকে এই বই দিতে হবে না। কিন্তু শ্বশুরমশাইয়ের কথা অমান্য করবে কী করে অনিকেত? বইটা দেয়।

কয়েকদিন পর বইটা ফেরত পায় অনিকেত। শ্বশুরমশাই বলেন, পড়তে পারলাম না। আমাদের বাংলা সাহিত্যের আদর্শ বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র। আর কিছু বললেন না। অনিকেত বইটা নিয়ে এসে দেখে, মাস্টারমশাই ভাষা-সংশোধন করেছেন। যেখানে ‘গু’ আছে, সেটা কেটে পাশে পেনসিলে লিখেছেন বিষ্ঠা। ‘রাঁড়’ কেটে করেছেন ‘বিধবা’, ‘হাগতে যাব’ কেটে করেছেন বাহ্যে যাব’।

‘শুয়োরের বাচ্চা’-ও কেটেছেন। ‘বরাহনন্দন’ করেছেন। কিন্তু এক জায়গায় আছে সন্তান কাজ না-করে স্কুলে যাচ্ছে বলে ওর খেতমজুর বাবা বলছে—এবার স্কুলে গেলে, এ্যাড় ছিচে দুব… এই জায়গাটা শুধু আন্ডারলাইন করে ছেড়ে দিয়েছেন। সংশোধনের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন।

এই ঘটনাটা বলা হল শুক্লার বাড়ির ঐতিহ্য বোঝানোর জন্য। এই আবহাওয়াতেই শুক্লা বড় হয়েছে। তাই রেডিও-র ওই ‘সন্ধিক্ষণ’ অনুষ্ঠান নিয়ে শুক্লার সঙ্গেও আলোচনা করেনি অনিকেত। ওকে শুনতেও বলেনি কখনও। অনিকেত এ-ব্যাপারে খুবই একা এবং নিঃসঙ্গ।

পরের রোববার সাড়ে সাতটা নাগাদ বাজার করতে বেরিয়ে গেল অনিকেত। শুক্লা ট্যাংরা মাছ ভালবাসে, ট্যাংরা মাছ কিনল। আটটার সময় ওই অনুষ্ঠানটা শুরু। শুক্লার কি মনে আছে? শুক্লা ট্যাড়সও ভালবাসে। কচি ঢ্যাঁড়স নেবে বলে উবু হয়ে বসে। ঢ্যাঁড়সের পিছনের দিকটা ফাটাতে-ফাটাতে অনিকেত দেখল উল্টো দিকে একটা নতুন হনুমান মন্দির। পাড়ায় অবাঙালি আসতে শুরু করেছে। একবার মন্দিরের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে অনিকেত বলল, বাবা হনুমান, শুক্লা যেন ভুলে যায়।

শুরুতে একটা ছোট্ট স্কিট আছে। বদমেজাজ নিয়ে। সাইকোলজিস্টরা বলেন অ্যাগ্রেশন। নিজের অস্তিত্ব বোঝানো। কিশোর কালের এটা একটা বৈশিষ্ট্য। এটা আট মিনিট। তারপরই প্রশ্নোত্তর। প্রথম দু’টো প্রশ্ন যা হোক করে ম্যানেজেল। থার্ড প্রশ্নটাই তো সমস্যায় ফেলে দেবে…। হিসেব করে দেখল আট-টা আঠারো মিনিটটা সংকটজনক সময়। ঠিক ওই সময় একটা ফোন করবে অনিকেত। জিগ্যেস করবে খয়রা মাছ উঠেছে, ওটা আনবে কি না, দুলালের মা কি মাছ কুটে দেবে? না কি ও রাগ করবে? এসব জিগ্যেস করে মিনিট তিন-চার সময় পার করে দেবে। দরকার হলে মাঝখানে একবার ফোন কেটে দেবে, যেন এমনিই কেটে গেল। কিছুটা সময় নষ্ট হবে। নষ্ট কেন, নষ্ট কেন, কিছুটা সময় বেঁচে যাবে। তারপর আবার ফোন করবে… বলবে—বলছিলাম কি, পাঁচফোড়ন-টাচফোড়ন আছে তো?

এইসব দুষ্টুবুদ্ধি ভূতে জোগায়। আর একেই তো বলে স্ট্রাগ্ল ফর এজিস্ট্যান্স। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না, বুথে গিয়ে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ফোন লাগাল বাড়িতে।

শুক্লা ধরল। বলল—বাজারে খয়রা মাছ উঠেছে… শুক্লা বলল—যা খুশি আনোগে যাও, আমি এখন তোমার ওই সব শুনছি। ফোনটা রেখে দিল শুক্লা।

এরপর অনিকেত দাঁড়িয়ে থেকে ট্যাংরা মাছ কুটিয়ে নিল। পুঁটি আর মৌরলা মাছ কিনেছিল, ওগুলোও কুটিয়ে নিতে-নিতে ঘণ্টাখানেক কাবার করল। তারপর বাড়ি ফিরল।

কলিং বেলটা টিপতে আবার কয়েক সেকেন্ড দেরি করল। যেখানে যেভাবে যতটা সময় খাইয়ে দেওয়া যায়।

ও তো আর শালা-টালা বলতে পারে না, নইলে দরজা খুলেই বলত—লজ্জা করে না শালা…। দরজাটা শুক্লাই খুলল।

মুখটা হাসি-মাখা। ইলেকট্রিকের তারে ঝোলা কাটাঘুড়ির মতো ওর মুখে রগড় ঝুলে আছে।

ব্যাপারটা কী? অনিকেত নিজেই ভাবে, মেয়েরা মাইরি আজব চিজ। কিচ্ছু বোঝা যায় না। এজন্যই বলে দেবা ন জানন্তি। শুক্লার সঙ্গে এতদিন ঘর করেও কিছু বোঝা গেল না!

অনিকেত বলল, মাছ-টাছ কুটিয়ে এনেছি। শুক্লা কিছু বলল না।

অনিকেত এবার বলল, জলখাবার কী হবে? লুচি? থাক, লুচি-টুচি করতে হবে না। চিঁড়ে দিয়ে দাও। এগুলো সব শুক্লাকে খুশি করার চেষ্টা। শুক্লা এবার বলল, ওসব কথাগুলো যখন বললে, মুখে একটুও আটকাল না? প্রশ্নটা ছুড়েই দিল, কিন্তু ঢিল ছোড়ার মতো নয়, নদীর বুকে জাল ছুড়ে দেওয়ার মতো। জাল তো ছোড়ে না, বিছিয়ে দেয়। কিংবা এমনভাবে বলল, যেন, বিষ্ঠা নিয়ে কাজ করা কোনও রিসার্চ-স্কলার’কে তার গাইড জিগ্যেস করছে—পারলে এত নোংরা ঘাঁটতে?

‘তোমার মুখে একটুও আটকাল না?’ এই প্রশ্নের উত্তরে শিশুর মতো মাথা নাড়ল অনিকেত। যেন শিশুটিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘তোমার অন্ধকারে যেতে ভয় করে না সোনা?’ শুক্লা আবার বলল—যে-মেয়েটার চিঠিটা তুমি পড়লে, সেটা কি মেয়েটা সত্যি-সত্যিই লিখেছিল? না কি তুমি ওটা বানিয়েছ?

অনিকেত মাথা ঝাঁকিয়ে বলল – হ্যাঁ, সত্যি মাইরি, চিঠিটা তো লিখেছিল মেয়েটা।

শুক্লা বলল, বাব্বা, এখনকার মেয়েরা পারেও। ওই যে কথা আছে, বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না—ওগুলো এখন বাতিল প্রবাদ।

অনিকেত সাহস পেল। বলল, তোমার খারাপ লাগেনি তো?

শুক্লা বলল, খারাপ তো লেগেইছে। রুচিতে তো বাধে। সেই ছোটবেলা থেকে একটা কনসেপ্ট তৈরি হয়েছে, কনসেপ্ট ঠিক নয়, মানে একটা ইয়ে।

একটা সংস্কার? অনিকেত কথা জোগায়।

–সংস্কার? বলতে পারো…

—তা হলে কুসংস্কার?… অনিকেতের খুব বাড় বেড়েছে।

–ন্-না-না, কুসংস্কার বলব কেন?—বরং এই একটা ধারণা, মানে বোধ, মানে, রুচিবোধ।

—হ্যাঁ। তো?

—ওটায় আঘাত করলে খারাপ লাগে।

অনিকেত বলল—একটা তো রুচিবোধ গড়ে উঠেছিল স্বামী মারা যাওয়ার পর অবশিষ্ট যে ‘স্ত্রী’ থাকে, মানে বিধবা, ওদের কর্তব্য-অকর্তব্য নিয়ে। সেই রুচিবোধ বা সংস্কার—যাই বলি না কেন, বিদ্যাসাগর কি আঘাত করেননি সেই রুচিবোধকে?

—ছিঃ, তুমি নিজেকে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তুলনা করতে পারলে?

—ছিঃ, তা করতে যাব কেন? আমি? কোথায় চাঁদ আর কোথায়…‘পাদ’ কথাটা মুখে এসেছিল। সামলে নিল অনিকেত।

যে-প্রসঙ্গটা নিয়ে এত সব, সেটা হল একটা চিঠি। মুর্শিদাবাদের ডোমকল থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মেয়ে চিঠি লিখেছিল, ‘আপনারা যে-সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, তার সিংহভাগই ছেলেদের সমস্যা। আমার মতো মেয়েদেরও অনেক সমস্যা আছে। প্রকৃতির নিয়মে আমরাও চিরকাল শিশু থাকি না। দেহের পরিবর্তন হয় যৌবনের চিহ্ন ফুটে ওঠে। ওইসব চিহ্ন আড়াল করার জন্য আমরা পোশাক জড়িয়ে রাখি। কিন্তু ছেলেদের বেলায় এমন বিধান নেই। ছেলেরা দিব্যি খালি গায়ে ঘুরে বেড়ায়। ওদের বুকেও তো লোম ওঠে। ওগুলো আমরা দেখি। দেখতে ভালই লাগে। প্রশস্ত বুকে মাথা রাখতেও ইচ্ছা করে। কিন্তু ওইসব ইচ্ছা অবদমন করি। বিবাহের পূর্বে ওইসব ঠিক নয়—এই সামাজিক বিধান মেনে চলি। প্রকৃতিতে জীবজন্তুর ক্ষেত্রে অবদমনের কোনও ব্যাপার নেই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে আছে। কোনও ছেলে জীবনে প্রতিষ্ঠিত না-হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করে না। কিন্তু ছেলেদের মধ্যে কামভাব থাকে। সেই কামনা থেকে কিছুটা নিবৃত্তির জন্য নিজের হাতেই একটা উপায় বেছে নেয়, ওটাকেই হস্তমৈথুন বলা হয়। আপনারা ওইসব নিয়ে আলোচনা করেছেন, এবং ডাক্তার বিষ্ণু মুখার্জি বলেছেন ওই ব্যবস্থা খুব খারাপ কিছু র, এর সপক্ষে তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েদেরও একই সমস্যা আছে। বাল্যবিবাহের দিন শেষ। কামনা তো আমাদেরও আছে। প্রকৃতির নিয়মেই আছে। কামনা সত্য। ‘বিসর্জন’ নাটকে রঘুপতি বলেছিলেন, কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ? এ জগৎ মহা হত্যাশালা…। হত্যা অরণ্যমাঝে, হত্যা লোকালয়ে, হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে কীটের গহ্বরে।…চলেছে নিখিল বিশ্বহত্যার তাড়নে…। এখানে স্যর ‘হত্যা’ শব্দটির পরিবর্তে যৌনতা শব্দটি বসিয়ে দেওয়া কি ভুল হবে? কিন্তু, সর্বোপরি, আমরা সামাজিক। সুতরাং যা-খুশি করতে পারি না। কিন্তু কারও কোনও ক্ষতি না-করে, কাউকে প্রোপোজ-ট্রোপোজ না-করে যদি নিজেই কিছুটা কাম নিবৃত্তি করি, সেটা সমর্থন করবেন? বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে? আমি আরও স্পষ্ট করে জানতে চাই—মেয়েরা কি হস্তমৈথুন করতে পারে? যদি পারে, কীভাবে? করলে কি কোনও ক্ষতি হয়? আমি বাংলা অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।

এই চিঠির কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে পড়েছিল অনিকেত। শেষের দিকটা বাদ দেয়নি। ওটাই তো আসল প্রশ্ন। ভারতীদি উত্তরে বলেছিলেন—না, কোনও ক্ষতি হয় না। আঙুলের নখটা যেন বড় না-থাকে, আর আঙুল যেন পরিষ্কার থাকে। ক্লাইটোরিস কী বস্তু, সেটাও বলেছিলেন; বলেছিলেন কলম, পেনসিল বা ওই জাতীয় কোনও কিছু ব্যবহার কোরো না। এইসব বলে শেষকালে বলেছিলেন—শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে মন। মনের তৃপ্তিই সবচেয়ে বড় তৃপ্তি। ভাল গান শোনো, খেলাধুলো করো, বই পড়ো, মানুষের উপকারে লাগো, এতেই মন পূর্ণ হবে। সেইসঙ্গে অনিকেত যোগ করে দিয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত লাইন—শরীর, শরীর, তোমার মন নাই কুসুম?

অনিকেত শুক্লাকে বলে ফেলল–ডোমকলের ওই মেয়েটার মনে যে-প্রশ্ন এসেছে, এই ধরনের প্রশ্ন তোমার মনে আসেনি—তোমার ওই বয়সে?

শুক্লা একটু হাসল। বলল—একদম আসত না সেটা বলি কী করে? আসলে ওটা-কে খুব নোংরা জায়গা ভাবতাম। টাচ করতাম না। মায়েদের দেখতাম প্রতিমাসে অশুচি হত। তখন কিছু ছুঁত না। কাকিমারা রান্না করত। একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল, ওটা খুব নোংরা জায়গা।

—সাবান-টাবানও দিত না…

ধুস, জানি না যাও। কেবল নোংরা কথা। এখন আর নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না শুক্লা—অনিকেত বুঝে নিল। কিন্তু অনিকেত নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি করছে বলে বকাবকি করল না তো? এতে ওরও সায় আছে না কি?

একটা স্মৃতি মনে পড়ে। বিয়ের পর একটু বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। ‘হনিমুন’ কথাটা তখনও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের সংসারে ঢং-এর কথা। বকাটে কথা। বউদের গায়ে ম্যাক্সি খুব একটা চড়েনি, বিউটি পার্লারের রেওয়াজ হয়নি। সায়াটা কেচে প্রকাশ্যে তারে ঝোলানো গেলেও, ব্রা-টাকে একটু আড়াল করে, সম্ভব হলে ওটার ওপরে কিছু চাপা দিয়ে শুকোতে হত। ‘হনিমুনে যাচ্ছি’ না-বলে বলতে হয়েছিল : যাই, জগন্নাথ মন্দিরে একটু পুজো দিয়ে আসি। সম্বন্ধ করা বিয়ের পর, কিছুদিন পরস্পরকে ইম্প্রেস করার ব্যাপার থাকে। আর আমি তোমার প্রতি কতটা ‘লয়াল’ বোঝানোর ব্যাপার থাকে, এবং লয়ালিটি বোঝানোর জন্য কিছু-কিছু স্বীকারোক্তি পর্বও থাকে।

সমুদ্রের ধারে বসে, অনিকেত ওর খুচখাচ পাপ কবুল করেছিল। সবাই সব কিছু কবুল করে না। অনিকেতও করেনি। মঞ্জুর ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিল। শুক্লাও ওর ছাত্রী-জীবনের কথা বলেছিল একটু। কলেজে ওর দিকে অনেক ছেলেই তাকাত, কিন্তু—ও কারও দিকে তাকাত – টাকাত না। একটি ছেলে, সে ব্যাঙ্কে নতুন চাকরি পেয়েছিল, ও শুক্লাকে ‘ফলো’ করত, শুক্লা বাসে উঠত, ছেলেটাও সেই বাসে উঠত। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকত। ওদের ক্লাসের কয়েকটা ছেলের সঙ্গে একটু বেশি আলাপ-পরিচয় হল ‘শ্যামা’ করার সময়। শুক্লা গান গেয়েছিল। সেই সূত্রে পরিচয়-হওয়া একটা ছেলে বলেছিল, একটা ছেলে তোর সঙ্গে আলাপ করার জন্য পাগল। ছেলেটা ব্যাঙ্কে কাজ করে। আমাদের পাড়ায় থাকে। তোর সঙ্গেই বাসে ওঠে। আমাদের চেয়ে একটু বড়। তোর সঙ্গে খুব মানাবে। আমি তোর সঙ্গে পড়ি জেনে আমাকে ধরেছে। তোর সঙ্গে একটু ‘মিট’ করিয়ে দেব। আমি তো কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না, ও রোজ বলত। তারপর একদিন ‘ঘোষ সুইট্স’-এ গেলাম। ওখানে কচুরি বলল। ভাজা হচ্ছিল তখন। ওই ছেলেটাও এসেছিল। কাঁচুমাচু মুখ করে বসেছিল। আমার ক্লাসমেট-টা ওর আরেকটা বন্ধুকেও নিয়ে এসেছিল। সেই ছেলেটার নাম সুনীল। ও করল কী, কী পাজি—একটু পরেই টেবিলের তলায় আমার পা-টা টাচ করল। তারপর নিজের পা আমার পায়ের পাতার ওপর তুলে দিল। ওর চটি খুলে চাপ দিচ্ছিল। আমার তো ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল। আমি আমার পা- টা সরিয়ে নিলাম।

অনিকেত জিগ্যেস করেছিল, আর ওই ছেলেটা, মানে ব্যাঙ্কে কাজ করা ছেলেটা—তখন কী করছিল? শুক্লা বলেছিল—কিচ্ছু না। কী নিয়ে পড়েন, কোথায় থাকেন—এসব জিগ্যেসা করছিল।

অনিকেত বলেছিল, এরপর আর এগোল? শুক্লা বলেছিল, ধুৎ, আমি তো পাত্তাই দিইনি। নাম কী ছেলেটার? অনিকেত জিগ্যেস করেছিল।

—নাম? কী যেন বলেছিল। মনে নেই।

—ওই ছেলেটার নাম মনে আছে? যে তোমার ক্লাসমেট, যে তোমাদের ওই ‘ঘোষ সুইট্স’-এ নিয়ে গিয়েছিল?

একটু আকাশের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে শুক্লা বলেছিল, উঁহু, ওই ছেলেটার নামটাও মনে পড়ছে না। অনিকেত বলল : অথচ দ্যাখো, ওর নাম ভুলে গেলে, যে তোমার প্রেমে পড়ল, ক্লাসমেটের নামটাও মনে নেই, অথচ যে তোমার পায়ের ওপর পা রেখেছিল, তার নামটা দিব্যি মনে আছে, সুনীল।

একটু যেন বেকায়দায় পড়ল শুক্লা। বেচারা আকাশ ও সমুদ্রের দিকে চেয়ে রইল। দিগন্ত- বিস্তৃত সুনীল ওটা তো বহু পুরনো ব্যাপার। হঠাৎ মনে পড়ল। কেন মনে পড়ল? মনের ব্যাপার মনও জানে না।

অনিকেত আজ হঠাৎ জিগ্যেস করল—আচ্ছা শুক্লা, সেই সুনীলকে মনে আছে?

—কে সুনীল!

যে ‘ঘোষ সুইটস’ তোমার পায়ের ওপর পা…

—যা ব্বাবা হঠাৎ আজ একথা! এসব তো ভোলো না দেখছি।

—তুমিও তো ভোলোনি।

—তা, ওর কথা কেন আজ হঠ।!

—বলছি কী, আজ যদি সুনীল আবার তোমার পায়ের ওপর পা উঠিয়ে দেয়, কী করবে?

—কী আবার করব? পা-টা ধুয়ে নেব!

কুমুদ’দার ফেয়ারওয়েল হয়ে গেল। কুমুদদাকে দেওয়া হল একটা চাকা-লাগানো ট্রলি ব্যাগ। আগেকার দিনে ফেয়ারওয়েল-এ দেওয়া হত লাঠি, শাল, ‘রামায়ণ’/’মহাভারত’/ ‘রামকৃষ্ণকথামৃত’। নিত্যানন্দ’দা ট্রলি ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বললেন—এটা দেখেই বুঝতে পারছি, আমরা পাল্টাচ্ছি।

নিত্যানন্দ’দা একবার শেয়ালের ডাক রেকর্ড করতে গিয়ে সাপের কামড় খেয়েছিলেন। রাত্রে যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়েছিলেন বাদুড়িয়া-র দিকে কোথাও। নাটকে দরকার এমন অনেক সাউন্ড এফেক্ট ওঁর হাতে করা। বহুদিনের পুরনো মানুষ উনি। যখন রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থাও ছিল না, নাটক লাইভ হত, তখন নাটকের দরকার মতো সাউন্ড এফেক্ট দিতে হত। এক গামলা জলে নানা কায়দায় নদীর কলকল, জলপ্রপাতের কুলুকুলু, বৃষ্টির টুপটাপ কিংবা ঝমঝম, এমনকী সাঁতারের ঝপাৎ ঝপাৎ করতে হত। পাথরের ওপর খোলামকুচি ঠুকে অশ্বক্ষুরধ্বনি, খালি পাউডারের কৌটোয় স্ক্রু-ডাইভার ঠুকে অসিযুদ্ধ, কাগজের ঠোঙা ফাটিয়ে বোমার শব্দ, হাঁড়ির ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে কথা বলে ভৌতিক আওয়াজ, শিশিতে ফুঁ দিয়ে জাহাজের ভোঁ, মাইকের সামনে ফুঁ দিয়ে ঝড়—এরকম কত কী করতে হয়েছে একসময়। টেপ রেকর্ডার আসার পর ওই ধুমসো রেকর্ডার নিয়ে কত কী ‘শব্দ’-সংগ্রহ করেছেন। কুকুরের ল্যাজ মাড়িয়ে, কুকুরকে চিমটি কেটে, কুকুরকে বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে, কুকুরদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে কতরকমের কুকুরের ডাক রেকর্ড করেছিলেন তিনি। রেকর্ডার নিয়ে বাংলা মদের ঠেকে গিয়ে রেকর্ড করেছেন মাতালের কোলাহল, রিকশার ঠুনঠুন শব্দের সঙ্গে মাতালের গাওয়া শ্যামাসংগীত- ও ‘আকাশবাণী’র শব্দ-সংগ্রহে আছে।

উনি ফেয়ারওয়েল-এর বক্তৃতায় ওই সব শব্দ-সংগ্রহের অভিজ্ঞতা বলছিলেন। রাজাবাগান বস্তির কলের লাইনের একটা বালতি চুপিচুপি সরিয়ে দিয়ে বস্তির ঝগড়া রেকর্ড করার গল্প করলেন উনি। ‘পটলডাঙার পাঁচালি’-তে ওই ঝগড়া ব্যবহার করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু পারেননি। প্রযোজক রাজি হননি শব্দগুলোর জন্য। বড্ড কাঁচা খিস্তি ছিল। এই ধরনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বললেন, সব কিছুর শব্দ হয় না, আবার সব শব্দের রেকর্ড হয় না। ফুল ফোটার শব্দ নেই। ফুল তো ফট করে ফোটে না। গন্ধও শনশন করে ছোটে না। ধুপধাপ করে হিম পড়ে না, চাঁদ ডোবার সময় ঝুপ শব্দ করে না, বুকটাও ফটাস করে ফাটে না। কিন্তু ওইসব নিঃশব্দ শব্দগুলো বুঝতে হয়।

কুমুদদা শেষদিন পর্যন্ত কাজ করেছেন। অনিকেতের ‘সন্ধিক্ষণ’ প্রোডাকশন-এর একটা ছোট নাটিকায় একটা স্বগতোক্তি ছিল—’তা হলে মুখের পাউডারে একটু ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে নিই?’ ওখানেই শেষ।

এর আগের ঘটনাটা হল, একটি কালো মেয়েকে পাত্রপক্ষ পছন্দ করছে না। মেয়েটি ফরসা হওয়ার জন্য অনেক কিছু করছে। মুসুরি ডাল, দুধের সর, হলুদ বাটা…

ব্লিচিং পাউডার পর্বটি ছিল শেষ সংলাপ। এরপরই মিউজিক। একটা জুতসই মিউজিক খুঁজছিল শেষ সংলাপটির পর ফেড ইন করানোর জন্য। কুমুদদাকে কাছেই দেখল অনিকেত বলল, একটা মিউজিক বেছে দিন না কুমুদদা…। কুমুদদা চার মিনিটের স্কিট-টা শুনলেন। তারপর বললেন, সারেঙ্গি-সত্তরে কিছু হবে না দাঁড়া, আমি ব্যবস্থা করছি। শিরিষ কাগজ ঘষে একটা শব্দ তৈরি করলেন। কীরকম যেন আর্তনাদের মতো। শেষ সংলাপের পর ওই শব্দটা জুড়ে দিলেন।

ফেয়ারওয়েল-এর পর কুমুদদা সবার ঘরে গিয়ে দেখা করলেন। অনিকেতের ঘরেও এলেন। সঙ্গে সন্তুদাও ছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে কুমুদদার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল অনিকেত

সনৎদা বলল—নখ-টখ ঠিকমতো কাটা আছে তো, দেখিস, সরি সরি, তুই তো আলিঙ্গ করছিস না, কুমুদদার দিকে হাত বাড়িয়েছিস। ইঙ্গিতটা কুমুদদা বুঝলেন। কুমুদদা অনিকেতের হাতটা ঝাঁকিয়ে বললেন, গো ফরোয়ার্ড। মেয়ে বলে কি ওদের ইয়ে নেই না কি? আমার নাতনিটা নেহাত ছোট। নইলে ওকেও শুনতে বলতাম। ১৫/১৬ বছর আগে যদি এই সব হত ….

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস কুমুদদার। নিজের মেয়েটার কথাই কি ভাবলেন? অনিকেত শুনেছিল কুমুদদার মেয়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। আত্মহত্যা। বোধহয় গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। কুমুদদা অনিকেতের কাঁধে হাত রাখলেন। যেন বলতে চাইলেন ‘সঙ্গে আছি।’

কুমুদদা বললেন, “আকাশবাণী’-র লোগো-তে লেখা আছে ‘বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়’। আছে না? কাজীদা, মানে নজরুল যখন এখানে ছিলেন, ওঁকেও কচুরিপানা নিধন নিয়ে ফিচার লিখতে হয়েছে, মশা নিয়ে গান বাঁধতে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের ‘আকাশবাণী’ স্বাধীনতা সংগ্রামে তেমন কিছু করতে পারেনি বটে, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক কিছু করেছে। আরে, কলা মুলো পটলের জন্য কম করেছি না কি আমরা? ‘পল্লীমঙ্গল আসর’-এর ভুবনদার জ্বরটর হলে আমি অনেক প্রক্সি দিয়েছি। জৈবসার, গোবর সার এসব কম বলেছি না কি। ব্যাটাছেলেগুলোকে রান্না শিখিয়েছে ‘মহিলামহল’…

সনৎদা কুমুদদার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল—হ্যাঁ, এখন মেয়েদের আলি করা শেখাচ্ছে রেডিও। বহুজন সুখায়…।

কুমুদদা বলল, বেশ করেছে শেখাচ্ছে…। সনৎদা বলল, আমিও তো বলছি বেশ করেছে। গার্জেনরা আশীর্বাদ করবে তোদের। আরে সব গার্জেনই তো চায় ওদের ছেলেমেয়ের যেন সুখ হয়। আমাদের মানিকদার গল্পটা শোনো, মানিকদা মানে সারেঙ্গি আর্টিস্ট। গিয়েছিল পাড়ায়। দরাদরি হচ্ছে। মেয়েছেলেটা একশো দিয়ে শুরু করল, মানিকদা দরদারি করতে- করতে দশ টাকায় নামাল। আমাকে মানিকদা পরে কী বলেছিল জানিস, কী ভুল হয়ে গেল সনৎ, এমন জানলে ছেলেটাকেও নিয়ে আসতাম, দশ টাকায় হয়ে যেত। চব্বিশ বছর বয়েস, ও কি আর আমার মতো এত ভাল দরাদরি করতে পারত? কুমুদদা বললেন—মানিক গুল মেরেছে বটে, কিন্তু ওর বুকের ভিতরের ‘গুল’, মানে গোলাপটা ফুটে উঠল ওই গুল-এ। বুঝতে পারছিস? পিতৃস্নেহ…। আমি বলছি অনিকেত, ইয়ার্কি করছি না, এটা কিন্তু বহুজন সুখায়, বহুজন হিতায়-ই হচ্ছে। সনৎদা মাঝের আঙুলটা নাড়াতে নাড়াতে বলল, রাইট। বহুজন সুখায়- ই তো হচ্ছে।

কয়েকজন অভিভাবকের কয়েকটা চিঠি সত্যি-সত্যিই পেয়েছে অনিকেত। একজন লিখেছিলেন, ‘আমার স্ত্রী যখন গত হন, আমার মেয়ের বয়স তখন দশ। মায়ের অভাব কখনও বাবা মেটাতে পারে না। আমি আর বিবাহ করিনি। যখন আপনাদের ‘সন্ধিক্ষণ’ অনুষ্ঠান শুরু হয়, তখন আমার মেয়ের বয়স চোদ্দো। আমি কখনওই নিজের মেয়েকে বলতে পারতাম না, যা মায়েরা বলে। আপনারা মায়ের কাজ করেছেন।’

আর একজন লিখেছিলেন—’রেডিও শোনার অভ্যাস আমার বহুদিনের। আমার একটি দর্জির দোকান আছে। সবসময় রেডিও চলে। একদিন ‘সন্ধিক্ষণ’ নামক অনুষ্ঠান শুনিলাম। শুনিয়া মনে হইল এই অনুষ্ঠানটি আমার পুত্রেরও শোনা উচিত। ছেলেকে বলি এই অনুষ্ঠানটি শুনিতে। আমরা যদিও সংস্কারবশত এক ঘরে বসিয়া এক রেডিওতে অনুষ্ঠানটি শুনিতে পারি না, আমরা দুইজনে, দুই ঘরে একই অনুষ্ঠান শুনি। কোনও একটি কারণে পুত্রের সহিত আমার দূরত্ব তৈয়ারি হইয়াছিল। এখন মাঝে-মাঝে ওই অনুষ্ঠানের বক্তব্য সম্পর্কিত দুই-এক কথা পিতা-পুত্রের মধ্যে আলোচনা হয়। আপনারাই আমাদের মধ্যে সেতু গড়িয়া দিয়াছেন…।’

এই চিঠিগুলোই তো জল। টবের গাছ এরকম জল পেলে বেড়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় কথা—শুক্লাটাও খুব একটা খচল না। সময়টা ভালই তো যাচ্ছে।

চিঠিপত্রগুলো ফাইল করছিল অনিকেত। একই বিষয়ের চিঠিগুলো একসঙ্গে ক্লিপ করছে। যে-বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে—ওগুলো ফেলেই দিচ্ছে। বেশ কিছু চিঠি আসছে, যেখানে অভিভাবক সম্পর্কে অভিযোগ। ‘মা বলছে বন্ধুদের সঙ্গে মিশবি না, বন্ধুদের টিফিন দিবি না, অথচ আমার খুব বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে, খেলতে ইচ্ছে করে। বাবা-মা’র কথা শুনতে হয়, বাবা-মা’কে ভক্তি করতে হয়। কিন্তু আমার বাবা-মা সবসময় ঝগড়া করে। ওদের একদম ভক্তি করতে ইচ্ছে করে না। আমাদের বাড়িতে কাজের মাসি আছে। যখন মা থাকে না, আমার বাবা ওকে ডেকে ছাদে নিয়ে যায়। চিলেকোঠা পরিষ্কার করায়। আর এইসব নিয়েই ঝগড়া হয়। বাবাকে আমার একটুও ভাল লাগে না। মা-কেও নয়। ওদের কথা শুনব কেন? যদি বলে কাউকে টিফিন দিবি না, কারও সঙ্গে খেলবি না, ওসব অমান্য করা কি অন্যায়? দয়া করে উত্তর দেবেন। আমার নাম বলবেন না। আমি রবিবার সকালবেলা আমার পড়ার ঘরে চুপিচুপি রেডিওতে এই অনুষ্ঠান শুনি। তখনও আমার বাবা ঘুমিয়ে থাকে, মা কাজ করে।’

এই চিঠির কী উত্তর দেওয়া উচিত? পিতা-মাতাকে মান্য করিবে, কদাচ পিতামাতার অবাধ্য হইবে না—অনিকেত, অনিকেতের বাবা, ঠাকুরদা—সবাই বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ থেকে জেনেছে। বিদ্যাসাগরের সময়ে ঘুষখোর, লম্পট, মাতাল বাপের কমতি ছিল না। ওরকম কোনও বাপের ছেলে যদি বিদ্যাসাগরকে জিগ্যেস করত : আমার এরূপ পিতাকে কি ভক্তি করিব? বিদ্যাসাগর মশাই কী উত্তর দিতেন কে জানে? যদি অনিকেতের সামনেই এই প্রশ্নটা ফেলা যায়? অনিকেত কী বলবে? এসব মালা ভদ্র জানেন। সমাজতাত্ত্বিক মালা ভদ্র। সত্যিই কি জানেন তিনি? উনি তো বলবেন ভাগ করে খাও, ভাগ করে বাঁচো, একা-একা বাঁচা যায় না। এই কথাই তো বলবেন, নাকি প্রসঙ্গটা ঠিক এড়িয়ে যাবেন?

কত প্রশ্ন পৃথিবীতে। প্রশ্নোত্তরের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে নিতে মন্দ লাগে না অনিকেতের। নিজের ছোট্ট পরিবারের ছোট বৃত্তটা কত বড় হয়ে যায়।

কিন্তু ছেলেপিলেগুলোকে নিয়ে কী করা যায়? বেশ কয়েকটা চিঠি আলাদা একটা ফাইলে জমিয়ে রাখা হয়েছে।

মহাশয়, আমি একজন পুরুষ, কিন্তু নিজের ওপর ঘৃণা হয়। কেবল মনে হয় আমি যদি মেয়ে হতাম, খুব ভাল হত। আমি পুরুষ হয়েও মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করি না; বরং পুরুষদের ভাল লাগে। আমার বয়স ২১, কো-এডুকেশন কলেজে পড়ি। ইচ্ছা করে মেয়েদের সঙ্গে বসি, ওদের সঙ্গে গল্প করি আর ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করি। একটা ছেলের প্রতি আমি খুব আকৃষ্ট। কিন্তু সে-কথা ওকে বলতে পারি না। আমার এই স্বভাব কি অস্বাভাবিক? যদি অস্বাভাবিক হয় তবে প্রতিকারের উপায় কি?

এরকম আর একটা—’আমরা এক ভাই, তিন বোন। বোনরা হার পরে, দুল পরে, কী সুন্দর রঙিন ফ্রক পরে। আমার ওইসব পরতে ইচ্ছে করে। দিদি নখে নেলপালিশ লাগায়। আমি যদি নেলপালিশ লাগাই, আমার মা বলে, কেন এগুলো নষ্ট করছিস? ওরা নখে লাগালে নষ্ট নয়, আমি লাগালেই নষ্ট? আমি হার পরেছিলাম বলে মা আমাকে মেরেছিল। কিন্তু বাড়িতে গোপাল ঠাকুর আছে। মা রোজ পুজো করে। গোপালকে খুব সুন্দর করে সাজায়। গলায় হার পরিয়ে দেয়। গোপালের হাতেও বালা আছে। আমার বাবার সোনা-রুপোর দোকান আছে। গোপালের জন্য গয়না নিয়ে আসে। গোপালও তো ব্যাটাছেলে। গোপাল সাজলে দোষ হয় না, আমি সাজলে দোষ হবে কেন?

আমি একদিন চুপিচুপি বোনের ফ্রক পরতে চেষ্টা করেছিলাম, তখন ফ্রকটা ছিঁড়ে যায়। বাবা-মা বুঝল, ওটা আমার কাজ। আমাকে মারল। এত সুন্দর-সুন্দর ক্লিপ, ফিতে, পুতুল— সবই কি মেয়েদের জন্য? আমি ক্লাস এইট-এ পড়ি। আমার মনের কথা বলার কোনও বন্ধু নেই, তাই আপনাদের আমার মনের কথা বললাম…।’

আর একটি চিঠি : ‘আমি একজন যুবক। বয়স ২৬। আমার ইচ্ছে একটি ছেলের সঙ্গে আজীবন থাকি। ও আমার মেসের রুমমেট। পড়াশোনার জন্য বসিরহাটে থাকতাম। ও আমার চেয়ে বয়সে ছয় বছরের ছোট। ওর কথাবার্তার ধরন মেয়েলি। আমি এখন চাকরি পেয়েছি। বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বলছে। বিয়ে করার পরও ওই ছেলেটির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই। আমি ওই ছেলেটির সঙ্গে যৌনকার্য করি। পুরুষে-পুরুষে সংযোগ খারাপ কাজ বলেই শুনেছি। কিন্তু এই খারাপ কাজ করছি। হয়তো নরকে পুড়তে হবে। এই অবস্থায় আমার কোনও নারীকে বিবাহ করা কি উচিত? নারীর প্রতিও আমার যে একেবারে আকর্ষণ নেই তা নয়। কিন্তু পুরুষের প্রতিই বেশি। বিশেষত ওই বন্ধুটির প্রতি। ওই বন্ধুটির সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী’র মতো সম্পর্কে উৎসুক। বন্ধুটিও তা-ই চায়। সে এখন একটি আচার কারখানায় কাজ করে। তাকে সবাই লেডিজ, বউদি এসব নামে ডাকে। এতে ও কিছু মনে করে না। ও-বাড়িতে এসে মাঝে-মাঝে শাড়ি পরে।

আমি মনের সব কথা লিখে পাঠালাম, এবার আমি কী করব—এই উপদেশ চাই। আ.মণ্ডল।’

আ.মণ্ডল জিগ্যেস করেছে, আমি কী করব?

অনিকেত কী করবে?

স্টেশন ডিরেক্টর সুমিত চক্রবর্তীর উপদেশ চায়। সুমিতবাবু বলেন—মহা মুশকিলে ফেললেন। কী যে বলি, এইসব হোমো-সেক্সুয়ালিটি বড় বাজে সাবজেক্ট, কীভাবে ডিল করা উচিত হবে জানি না। আফটার অল, এটা তো প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ব্যাপার। হেটেরো সেক্সুয়ালিটি-ই হচ্ছে নেচার-এর চয়েস। অপোজিট জেন্ডার-এর প্রতি আকর্ষণটাই তো স্বাভাবিক। সেম

জেন্ডার-এর দিকে আকর্ষণটা অস্বাভাবিক। এই সাবজেক্ট-টাকে অ্যাভয়েড করা যায় না?

অনিকেত বলল, চিঠিপত্র কিন্তু আসছে। দশ-বারোটা চিঠি অলরেডি পেয়ে গিয়েছি। —দশ-বারোটা চিঠি এমন কিছু নয়। কতদিন ধরে চলছে অনুষ্ঠানটা?

—চার মাসের বেশি। সাড়ে চার মাস।

—এ পর্যন্ত কত চিঠি পেয়েছেন?

—পাঁচশো মতো।

—পাঁচশো চিঠির মধ্যে দশ-বারোটা কোনও পার্সেন্টেজে আসে না। ব্যাপারটাকে ইগনোর করুন। অ্যাভয়েড করুন। আমার তো তা-ই মত।

এর আগেও এমন দু-একটা চিঠি পেয়েছিল—যা পড়ে অনিকেতের কান গরম হয়ে গিয়েছিল। এরা এসব লিখছে কী করে? ভেবেছিল অ্যাভয়েড করবে। কিন্তু ওই ধরনের প্রশ্ন আরও আসতে লাগল। তখন আর অ্যাভয়েড করার উপায় থাকল না। কয়েকটা এরকম চিঠি গাইনি ভারতীদি’কে দেখাল অনিকেত। জিগ্যেস করল, এগুলোর কী উত্তর দেওয়া যায়? উনি চিঠিগুলো পড়লেন। বললেন—নেক্সট মিটিং-এ এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। মিটিং ডাকা হল।

অনিকেত কয়েকটা চিঠি পড়ল। বলল, পনেরোটা মতো চিঠি রয়েছে এই ফাইলে। এবার আমরা কী করব?

সাহিত্যিক বিভাস রায় বললেন—এসব এন্টারটেন করাই উচিত নয়। অ্যাবনর্মালিটি। মনোবিদ দেবলীনা সান্যাল বললেন, হোয়াই অ্যাবনর্মালিটি? দিস ইজ আদার কাইন্ড অফ সেক্সুয়াল প্র্যাকটিস। অন্য ধরনের যৌনতা। অ্যাবনর্মালিটি বলতে রাজি নই।

ডাক্তার মুখার্জি বললেন—অন্য ধরনের যৌনতা মানে তো একসেপশন। প্রকৃতি তো চেয়েছে বাই-সেক্সুয়ালিটি। এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবের ইভলিউশন হল কেন? একজিসটেন্স-এর জন্য। বৈচিত্রের জন্যও বটে। কোনও সেল-এর মধ্যে যদি ডিফেক্ট থেকে থাকে, তা হলে সেই সেল ডিভিশন হলে ডিফেক্ট-টা প্রতিটি সেলেই থেকে যাবে। এজন্যই তো মাইটোসিস থেকে মিয়োসিস। দু’টো প্রোডাকটিভ সেল দু’টো আলাদা সোর্স থেকে এলে ডিফেক্ট-টা কমে যেতে পারে। এগুলো খুব সাধারণ ব্যাপার। সবাই জানেন। প্রকৃতি চেয়েছে দু’টো ডিফারেন্ট সোর্স। ক্রোমোজোম ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এজন্যই স্পার্ম অ্যান্ড ওভাম। এজন্যই বিপরীত লিঙ্গে সংযোগ। সম-লিঙ্গের সংযোগ প্রকৃতি চায় না। যা প্রকৃতি চায় না, সেটাই অ্যাবনর্মাল।

সমাজতাত্ত্বিক মালা ভদ্র বললেন—দেখুন ডক্টর মুখার্জি, মানুষ একটা আলাদা প্রাণী। জীবজন্তুর সঙ্গে মানুষের বিচার করাটা ঠিক হবে না। মানুষের বুদ্ধি, মেধা, আবেগ, অনুভূতি এবং ক্রিয়েটিভিটি মানুষকে অন্যরকম করেছে। সুতরাং, মানুষের বিহেভিয়ারাল প্যাটার্ন-এর মধ্যে নানারকম কালার আসতেই পারে। সমকামিতাও একটা কালার।

সাহিত্যিক বললেন—সমকামিতা ব্যাপারটা বাজারে খাচ্ছে ভাল। বিশেষত মহিলা সাহিত্যিকরা অশ্লীল কিছু লিখলেই ‘হট কেক’ হচ্ছে। কিন্তু সরকারি মাস মিডিয়া এসব কেন ঘাঁটাঘাঁটি করবেন? কী মেসেজ দেবেন? বলবেন হোমো-টোমো সব ঠিক আছে? সব নর্মাল ব্যাপার? তোমরাও হোমো করতে পারো? মনে রাখবেন, এটা কিন্তু বাচ্চাদের প্রোগ্রাম। এমনিতেই তো কয়েকটা পত্রপত্রিকা ওদের মাথা খাচ্ছে…।

মালা ভদ্র বললেন—এভাবে ভাবছেন কেন? আমরা তো বলতেই পারি, যারা সো-কল্ড মেয়েলি ধরনের পুরুষ, যারা নিজেদের মেয়ে ভেবে পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তারাও মানুষ। ওদের ঘেন্না কোরো না।

সাহিত্যিক রেগে উঠলেন। কেন ঘেন্না কোরো না? ওরা তো ঘেন্নারই পাত্র। এই বয়স্ক হোমোগুলো বাচ্চাছেলেদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। যা-তা সব কাণ্ড করে। একদিন – তো দেখছিলাম একটা স্কুলের ছেলে রিঅ্যাক্ট করল। পেছনে ফিরে বলল, কী হচ্ছে কী কাকু, ছিঃ, ঠিক করে দাঁড়ান। মাঝবয়সি লোকটা বলল, বাসে যা ভিড়…ছেলেটা বলল ভিড়ের চাপ আলাদা, আর আপনি যা করছেন সেটা বুঝি না ভেবেছেন?

তারপর তো অন্য প্যাসেঞ্জার সব ছ্যা-হ্যা করে উঠল। একজন কন্ডাক্টর’কে বলল, এই লোকদের মুখ দেখে রাখো, বাসে ওঠাবে না।

মালা ভদ্র বললেন—দেখুন, একটা কথা বলছি, মাইন্ড করবেন না, আপনারা সাহিত্য রচনা করেন কল্পনায় ভেসে। সব কিছু তো কল্পনা করে নিলে হয় না, আপনি কল্পনা করে নিয়েছেন ওই লোকটা হোমো-সেক্সুয়াল। তা তো নয়। ওদের বলে পিডোফিল। ওটা একটা বাজে মানসিক রোগ।

সাহিত্যিক বললেন, এ তো দেখি এক্কেবারে কূটতর্ক লাগিয়ে দিলেন, কে এত সুক্ষ্মবিচার করতে যাচ্ছে ম্যাডাম? পিডোফিল’রা তো সমকামীদেরই একটা স্তর, না কি?

—একদম বাজে কথা। একটু পড়াশোনা করে নেবেন। পিডোফিল-রা শিশুদের সঙ্গে যৌনতা চায়। এটা অন্যায়। পিডোফিলদের কখনওই সমর্থন করা যায় না। কিন্তু পিডোফিলদের সঙ্গে সমকামীদের গুলিয়ে ফেলবেন না।

—সবই তো গোলানো ব্যাপার। এই মিটিং-এ আসবই না। ক’টা টাকা দেয়? এই সময়ে দশ-বারো পৃষ্ঠা লেখা হয়ে যেত। মিটিং-এ আসব না আর, কিন্তু এসে গিয়েছি যখন সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিবাদ করব। সাহিত্যের কাজ হল সমাজের হিতসাধন। বঙ্কিমচন্দ্র তা-ই তো .বলেছিলেন। রেডিওর ও রেডিওর তাই কাজ বলেই জানতাম। আকাশবাণী-র লোগো-তে লেখা থাকে ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’। প্রথম যখন শুরু করেছিলেন অ্যাপ্রোচ-টা অন্যরকম ছিল। আমি লাস্ট কয়েকটা এপিসোড শুনেছি, কোথায় নিয়ে ফেলেছেন ‘বহুজন সুখায়…’। গারবেজ। স্টেশন ডিরেক্টর অন্যান্যদের জিগ্যেস করলেন—আপনাদের এ ব্যাপারে কী ওপিনিয়ন? আপনারা শুনছেন তো?

উত্তরগুলো এরকম

—আমি ভাই ভুলেই যাই… সরি।

—আমি বেশি রাতে শুই তো, রোববারটা একটু বেলায় উঠি।

—মাঝে দু-একটা শুনেছিলাম, তবে ফাস্ট এপিসোড শুনেছি। কাউন্সেলিং করার জন্য লোকজন এসে যায় কি না… সানডে বিকেলটা অবশ্য ফ্রি করে রাখি। বিকেলে ব্রডকাস্ট করলে পারতেন।

স্টেশন ডিরেক্টর কথা বাড়ান না। অ্যাডভাইসরি বোর্ড এরকমই হয়, তবু রাখতে হয়।

শ্রোতারা কী বলছেন? কোনও অ্যাডভার্স কমেন্ট পেয়েছেন? অনিকেতকে জিগ্যেস করলেন এসডি।

—এখনও খারাপ কিছু পাইনি, বরং অ্যাপ্রিসিয়েশন-ই পেয়েছি।

—তা হলে আপনি কী বলছেন মিসেস সান্যাল? এই হোমো-সেক্সুয়াল’দের ব্যাপারে। বিষয়টা কী রাখব?

দেবলীনা সান্যাল বললেন—আমি তো বলছি বিষয়টা আসা উচিত। এটা হল ‘আদার কাইন্ড অফ হ্যাবিট’। কাউন্সেলিং করে হ্যাবিট-টা চেঞ্জ করানো যায়।

ডা. মুখার্জি বললেন—এটা হল ইনার থিং। জেনেটিক, হরমোনাল। মনোরোগ নয়। কাউন্সেলিং করে কী হবে?

সাহিত্যিক বললেন—ওই তো, কাউন্সেলিং। সব কিছু কাউন্সেলিং। বাচ্চা কেন পাতলা পায়খানা করছে—কাউন্সেলিং। কাউন্সেলিং করাতে পারলেই তো ক্লায়েন্টগুলো ঠিক থাকে। স্টেশন ডিরেক্টর বললেন—প্লিজ, ব্যাপারটা পার্সোনাল লেভেল-এ নিয়ে যাবেন না।

মালা ভদ্র বললেন—শুধু আমরা কেন, সারা পৃথিবী জুড়ে ঝগড়া চলছে। কেউ বলছে এটা মানসিক রোগ, কেউ বলছে জেনেটিক, কোন দেশে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, আমাদের দেশের ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী পশুমেহন যেমন অপরাধ, সমকামিতাও। আবার অনেক দেশে সমকামিতার স্বীকৃতিও আছে, সমকামীরা বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে পারে। দেখুন, কথা হচ্ছিল ‘ এটা অসুখ কি না—এ নিয়ে। আমাদের দেশে সবরকম অসুখ নিরাময়ের জন্য কতরকম পোস্টার। লোধবাবুদের, চাঁদসীদের, তান্ত্রিকদের। অর্শ-ভগন্দর, যৌনশীতলতা, ধাতুদৌর্বল্য সব কিছু সারানো হয়, কই সমকামিতা সারানো হয় এরকম কোনও বিজ্ঞাপন কখনও চোখে পড়েছে? গুপ্তরোগের লিস্টিতে এটা এখনও ঢোকেনি। গোপনে মদ ছাড়ানো থেকে গোপনে প্রেম ছাড়ানোর জন্য ফোন নম্বর গাছে-গাছে ঝুলছে। সমকামিতা সারানো দেখেছেন কখনও? নেট খুলুন—সমাধান নেই। সব কনফিউজিং। কেউ বলবে এটা রোগ নয়, রোগের উপসর্গও নয়। কেউ বলবে—এটা চূড়ান্ত অস্বাভাবিক ও অন্যায়। নেট-এ হয়তো বিদেশি কাউন্সেলারদের নামও পাবেন, যারা সমকামিতা সারায়। আবার ভূরি ভূরি সমকামীদের পত্রিকা পাবেন, ওদের বক্তব্য পাবেন, কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা খুব পরিষ্কার নয়। তবে ওরা সামাজিকভাবে খুব কোণঠাসা।

স্টেশন ডিরেক্টর বললেন—আমরা তা হলে একটা জিনিস করতে পারি। বিষয়টা নিয়ে আলোচনা রাখতে পারি। ভাল-খারাপ নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। পিডোফিলদের কথা বলতে পারি, ওদের থেকে সাবধান থাকার মেসেজ দিতে পারি। মেয়েলি ধরনের ছেলেরা, যারা অনেকেই ছেলেদের প্রতিই বেশি আকর্ষণ বোধ করে, মানে হোমো-সেক্সুয়াল, ওদের যেন ব্যঙ্গ না-করা হয়, হ্যাটা না-করা হয়—এটা বলতে পারি।

স্টেশন ডিরেক্টর যেন ছোট্ট করে জিভ কাটলেন। বোধহয় ‘হ্যাটা’ শব্দটা উচ্চারণের জন্য। ডিরেক্টরের মুখে ‘হ্যাটা’ মানায় না। মালা ভদ্র বললেন—যাঁরা চিঠি লিখছেন আপনাদের, নিজেদের সমকামী বলছেন, ওঁদের ডেকে আনুন না, কথা বলুন না…। অনিকেত বলল—ওরা তো গ্রামের ছেলে। আসতে বললেই আসবে কি না, ঠিক নেই। তা ছাড়া ওরা থাকবে কোথায়? রেডিও তো হোটেল খরচ দেবে না, সেই প্রভিশন-ই নেই। তা ছাড়া ওরা চিঠিতে যা লিখছে, আমাদের সামনে বলবে কেন? চিঠিতে তো মুখ থাকে না। মালা ভদ্র বললেন—ওদের আনতে পারলে ভাল হত। যারা ওদের মনের কথা বলবে, মনের ব্যথা বলবে…। অনিকেত মিসেস সান্যালকে বললেন—যারা আপনার কাছে কাউন্সেলিং করাতে আসে—এমন কেউ নেই?

মিসেস সান্যাল বললেন—ওরা নিজেদের এক্সপোজ করবে বলে মনে হয় না। ঘড়ি দেখলেন ম্যাডাম। স্টেশন ডিরেক্টর অনিকেতের চোখের দিকে চেয়ে বললেন—চেষ্টা করে দেখুন না, পাওয়া যায় কি না!

অনিকেতকে এবার সমকামী খুঁজে বার করতে হবে। কোথায় খুঁজবে ও!

অনিকেত কীভাবে যেন শুনেছিল কার্জন পার্ক-এর আশেপাশে কিছু সমকামী ঘোরাফেরা করে। ওরা পেছনের দিকে হাত রেখে চলাফেরা করে। অনিকেত তো বহুবারই কার্জন পার্ক-এর পাশ দিয়ে চলাফেরা করেছে, কিন্তু কখনও পেছনে হাত দেওয়া ছেলেদের চোখ পড়েনি তো। কিন্তু হেরম্বদা বললেন, উনি শিওর, কার্জন পার্ক-এ ওদের ঠেক আছে।

হেরম্বদা একজন ক্যাজুয়াল অ্যানাউন্সার। খুব মোটা গলা। যাত্রা করেন। হা-হা-হা-হা অট্টহাস্যে ওস্তাদ। রাবণ, কার্ভালো, কাপালিক—এসব যাত্রার ডায়লগ মুখস্থ। ভিলেন চরিত্রে পটু। রামকৃষ্ণ যাত্রাপালায় গিরিশচন্দ্র ঘোষের পার্ট-টা উনিই করবেন, রিহার্সাল চলছে। উনিই বলেছিলেন, কার্জন পার্ক-এর কথা। হেরম্বদা এসব নানারকম খোঁজখবর রাখেন। উনি আবার একটা স্কুলের শিক্ষকও। একদিন গল্প করছিলেন, সোনাগাছিতে একটা ঘর থেকে বেরিয়েছেন, দরজার সামনেই ওঁর এক ছাত্রের সঙ্গে মুখোমুখি। ছাত্রটি না-দেখার ভান করে ঢুকে যাচ্ছিল, উনিও না-দেখার ভান করে চলে যেতে পারতেন, কিন্তু সেটা ঠিক হত না। হেরম্বদার ভাষ্যে : আমি খপ করে ওর হাতটা ধরলাম। বললাম, অ্যাই বিলে, এখানে এসেছিস? সব দেখে নেওয়া ভাল, কিন্তু জীবনে একবার বা দুবার। ব্যস। অভ্যেস হয়ে গেলে খুব বিপদ। ভাবছিস স্যর এখানে কেন? তাই তো? আরে, শ্রীরামকৃষ্ণ পালায় গিরিশ ঘোষের পার্টটা করতে হচ্ছে তো? এসব একটু চাক্ষুষ না-দেখে গেলে অভিনয়টা জীবন্ত হবে কী করে? বুঝলি না? আমি জানি ও-ব্যাটাও স্কুলে কিছু বলবে না। তা-ই হল।

অনিকেত কার্জন পার্ক-এর চারদিকে সন্ধের পর অনেকক্ষণ ধরে ঘুরছিল, কিন্তু পিছনে হাত দেওয়া কাউকে দেখল না। কার্জন পার্ক-এর ওই দিকটায়, মানে ডেকার্স লেন-এর উল্টো দিকে, বেশ কিছু মূক-বধির জড়ো হয়। ওরা নিজেদের সাংকেতিক গল্প করে। ওরা শুধু আঙুল নাড়ায়, মাঝে-মাঝে ঠোঁট নড়ে, চোখের কিছু অভিব্যক্তি হয়, ওরা হেসে ওঠে, রাগ হয়, বিরক্তি প্রকাশ করে। ট্রাম গুমটির দিকটায় কয়েকজন বেদে-বেদেনীর ঝুপড়ি। ওরা জড়িবুটি বিক্রি করে। ফ্লাইং কলগার্লও কয়েকজন ঘোরাফেরা করে। অনিকেতকে ঘুরতে দেখে একজন হাতছানি দিল। একজন পাশের জনকে বলল, ঢ্যামনার ইচ্ছে আছে, কিন্তু সাহস নেই। দু- তিনটে পাক দেওয়ার পর মার্কস-এঙ্গেল্স-এর মূর্তির সামনে একটু দাঁড়ায় অনিকেত। একটা লোক, অনিকেতের দিকে এগিয়ে আসে। বেশ মোটা গোঁপ। প্যান্টের মধ্যে শার্ট গোঁজা। কোমরে বেল্ট। অনিকেতের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মারল। অনিকেতের মনে হল, এই লোকটা তা হলে হতে পারে। কিন্তু অনিকেত কী বলবে তার কোনও স্ক্রিপ্ট তৈরি ছিল না। ফার্স্ট ডায়লগেই কী বলবে না কি ‘আপনি হোমো?’ অবশ্য তার আগেই লোকটা বলে : ঠেক ফিট আছে? অনিকেত একটু ঘাবড়ে যায়। ও মাথা নেড়ে দেয়। মানে, নেগেটিভ। মানে-না। লোকটা ঠিক আছে, আমিই নিয়ে যাচ্ছি। বাট্টু সালসা তো? তার মানে ওই লোকটা অনিকেত- কেই পুরুষ যৌনকর্মী ভাবছে। ‘বাট্টু’ মানে বোধহয় পায়ু। তার মানেটা দাঁড়াচ্ছে, এই অঞ্চলে এদের পাওয়া যায়। অনিকেত বুঝতে পারছে না। যেসব মানুষজন ঘোরাফেরা করছে, তাদের মধ্যেই হোমো আছে। অনিকেত চিনবে কী করে, ওই লোকটাই ভুল করল। ভুল লোককে চিহ্নিত করল।

অনিকেত বলল, আপনি বোধহয় ভুল করছেন। তবে আপনি যাদের খুঁজছেন, আমিও তাদের খুঁজছি। আমি একজন জার্নালিস্ট, রেডিও-জার্নালিস্ট। ওদের দরকার আমার।

লোকটা বলল, সরি সরি, ডোন্ট মাইন্ড। আপনি অনেকক্ষণ ধরে ঘোরাফেরা করছিলেন তো তাই ভাবছিলাম…।

অনিকেত বলল—আপনাকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করব? আমার একটু হেল্প হয়…।

-–বলুন…

—আপনি কি হোমোদের খোঁজে এদিকে আসেন?

—ধুরানির খোঁজে আসি। আসতাম। বহুদিন পর এলাম। এখন দেখছি না। বোধহয় পুলিশ রেড-টেড করছে।

—ধুরানি মানে?

—কিছুই তো জানেন না, আপনি কী রিপোর্টিং করবেন?

—কিছু মনে করবেন না, আপনি কি ‘হোমো’?

—আমি সব। ওকে। চলি। গুড লাক। লোকটা হনহন করে হেঁটে যায়।

কার্জন পার্ক-এ ওর লাভ হল না সেদিন। সেদিন ওখানে ঘুরে-বেড়িয়ে মন্দ লাগছিল না। একটু বুক ধুকধুক করছিল যদিও, কিন্তু ব্যাপারটা রেলিশ করছিল। বেশ একটা খোঁজ। একটা তদন্ত। একটা ইনভেস্টিগেশন।

অনিকেতের এক বন্ধু আছে, বয়সে ছোট, একটা খবর কাগজের সাংবাদিক। ক্রিমিনাল রিপোর্টিং করে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওকে জানায় ও কী করতে চায়। সেই সাংবাদিক বলে সাদার্ন অ্যাভিনিউ-তে সন্ধের পর লেকের ধারে কিছু ‘গে’ ঘোরাফেরা করে। মেয়েদের মতো পোশাক, এছাড়া কিছু ‘গে’ কালীঘাট এবং যতীন দাস পার্ক মেট্রো স্টেশনের সামনে আড্ডা মারে। ওদের অনেকেই এক কানে দুল পরে।

অনিকেত দক্ষিণ কলকাতা ভাল করে চেনে না। লেক-টেকের দিকে তেমন যায়নি। একদিন ওধারে গেল। একা-একাই হাঁটছিল। লেকের ধারে জোড়ায় জোড়ায় গল্প করছে। গায়ে গা। চুমুটুমু খেতেও দেখছে।

তখনও ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রকাশ্য মেলামেশার বহর এখনকার মতো ছিল না। রবীন্দ্রসদন এবং নন্দন চত্বর এতটা সহনশীল ছিল না। লেক-এর উল্টোদিকের একটা গলির মোড়ে তিন-চারজন মেয়েকে দেখল অনিকেত। জিন্‌স আর টাইট গেঞ্জি পরা। চড়া রঙের লিপস্টিক। ভাল করে তাকালে মনে হয় ঠিক মেয়ে নয়। ঘাড় বেঁকিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলছে। মেয়েরা কিন্তু এতটা অঙ্গভঙ্গি করে না। একজন ফুচ করে মুখ থেকে পানপরাগের পিক ফেলল। মেয়েরা সাধারণত পানপরাগ খায় না। মেয়ে-বেশ্যারা হয়তো খায়। একটা গাড়ি এল, ওদের সামনে দাঁড়াল। একজন গাড়িতে ঢুকে গেল। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে অনিকেত। সামনে যেতে একটু ভয় করল। এভাবে হবে না। অনিকেত বুঝতে পারল, এরা হল পুরুষ যৌনকর্মী। মেয়েদের মতো সাজসজ্জা করে দাঁড়ায়, পয়সা রোজগার করে। এরা যাদের সঙ্গে শারীরিক ভাবে লিপ্ত হয়, তারা পুরুষ। এদের দিয়ে ওর কাজ হবে না।

যতীন দাস পার্ক মেট্রো স্টেশনের কয়েকটা গেট আছে। একটা গেটের সামনে সত্যি- সত্যিই কয়েকটা ছেলেকে দেখা গেল। ওরা মেয়েদের পোশাকে নেই। শার্ট-প্যান্ট, জিন্‌স- পাঞ্জাবি, জিন্‌স-টি শার্ট এসবই পরনে। একজনের এক কানে একটা দুল দেখা গেল। ওরা ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলছে। অনিকেত ওদের কাছাকাছি দাঁড়ায়। যেন কাউকে খুঁজছে, বা কারও আসার কথা। মাঝে-মাঝে ঘড়ি দেখছে আর ওদের কথা শুনছে।

—দ্যাট গাই ইজ ফ্যান্টাস্টিক। আড়িয়াল। আড়িয়াল পাক্কি।

–তোর তো সবই আড়িয়াল।

—মাইরি বলছি। খাম্বা লিকম্। —কড়ি কর। কড়ি কর।

—রোল খাবি?

—নো ইয়ার।

—চ, খিদে পেয়েছে।

—পেটের খিদে না বাটু-র খিদে?

—না মাইরি। চ, রোল খাই।

–পরে যাচ্ছি। অ্যাই, রোববার ডায়মন্ড হারবার যাবি সবাই মিলে?

—কেন? বাই উঠল কেন? পারিক আছে ওখানে?

—না রে, বাবাকে বলেছি গাড়িটা একদিন নেব। দেবে বলেছে।

—ইয়োর ফাদার ইজ রিয়েলি গুড। লাভিং ফাদার। আমার বাপটা শালা গান্ডু। আমার সঙ্গে তো কথাই বলে না। সাইকোলজিস্ট-এর কাছে যাব না বলেছি, তাই। আরে সাইকোলজিস্ট কী করবে? খালি মালকড়ি খিঁচে নেয়। বাপ যদি আলটিমেটলি ফুটিয়ে দেয়, কোথায় যাব মাইরি? কোন খোলে যাব?

—মাল্টি-মিডিয়াটা নে। চাকরি শিওর।

—বাপ তো সেই টাকাও দেবে না।

—ধুরানিগিরি করে রোজগার কর তবে।

ওরা চারজন একটু পর জায়গাটা ছেড়ে চলে যায়। কোনও কথা হল না, তবে এদের দিয়ে কাজ হবে মনে হচ্ছে।

ওদের কথাবার্তায় কিছু অচেনা শব্দর মানে আন্দাজ করতে পারছে অনিকেত। ‘ধুরানি’ মানে বোধহয় যারা পয়সার বিনিময়ে যৌনকর্ম করে। ‘লিকম্’ মানে পুরুষাঙ্গ। রেডিও-তে এসব শব্দ তো চলবে না, ওরা আসতে রাজি হবে কি না কে জানে? তবে রেডিও-তে অনুষ্ঠান করলে টাকা পাওয়া যায়। টাকা পেলে যাবে নিশ্চয়ই। কী কী প্রশ্ন করা হবে সেটা ভেবেচিন্তে ঠিক করতে হবে।

অনিকেতের অফিসে রটে গিয়েছে ও ‘হোমো’ খুঁজছে। এ নিয়ে একটু হাসাহাসিও হচ্ছে। একজন বলল, শেয়ালদা স্টেশন থেকে বেরিয়ে দু’নম্বর প্লাটফর্ম বরাবর রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকান আছে। ওখানে হোমো-রা আড্ডা মারে। অনিকেত জিগ্যেস করল, আপনি কী করে জানেন? উনি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সেকশনে কাজ করেন। বললেন—আরে গত কুড়ি বছর ধরে ইছাপুর থেকে ডেলি পাষণ্ডারি করছি। শেয়ালদার আনাচ-কানাচ জানি। যদি কোনও দিন বসার সিট জুটে যায়, চোখ বুজি, শেয়ালদা স্টেশনে ঢোকার মুখে ঘটাংঘট শুনে বুঝে যাই কত নম্বর প্ল্যাটফর্মে গাড়ি দিচ্ছে। বুঝলেন না? কতগুলো ব্যাটাছেলে আসে টিটাগড়, নৈহাটি থেকে। ব্যাটাছেলেদের বাথরুমে ঢুকে শাড়ি পরে, লিপস্টিক পরে। তারপর বিজনেস করে, তারপর ফেরার সময় মেয়েদের বাথরুমে ঢুকে মুতে-টুতে ড্রেস চেঞ্জ করে ব্যাটাছেলে হয়ে বাড়ি ফেরে। সবই তো দেখি। যেদিন ফিরতে একটু রাত হয়, সেদিন দেখি, কিছু মেয়ে ভাড়া খেটে ফিরছে। কিছু “মওগা’ দাঁড়িয়ে থাকে ওই যে বললাম, চায়ের দোকানটার সামনে। ওখানে একদিন গিয়ে দেখুন

অনিকেতের দেখতে ইচ্ছে করে। ব্যাপারটা বুঝতে ইচ্ছে করে। ওদের হয়তো রেডিওতে ইন্টারভিউ নেওয়া যাবে না, কারণ বোঝাই যাচ্ছে ওরা হচ্ছে পুরুষ যৌনকর্মী। ‘সন্ধিক্ষণ’ অনুষ্ঠানে যৌনকর্মীর সন্ধান দেওয়ার কোনও দরকার থাকতে পারে না। তবে একদিন দেখে এলে হয় ব্যাপারটা।

অনিকেত একদিন সন্ধেবেলায় গেল শেয়ালদা স্টেশনে। ১৯৯৬ সালে শেয়ালদা স্টেশন অন্যরকম ছিল। নতুন বাড়িটা শেষ হয়নি। সামনেই লোহা-লক্কড়। বাইরের চত্বরে কয়েকটা টেবিলে পশরা। ফল, বিড়ি-সিগারেট, গেঞ্জি-মোজা-জাঙ্গিয়া-রুমাল—চায়ের দোকানও কয়েকটা। ‘মওগা’ জাতীয় কাউকে চোখে পড়ল না।

‘মওগা’ ব্যাপারটার সামান্য কিছু ধারণা আছে ওর। রেডিওতে আসার আগে কয়েকটা চাকরি করতে হয়েছিল অনিকেতকে। প্রথম চাকরিটা ছিল মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। বিহারে থাকতে হয়েছিল। সাসারামে একটা বেশ বড়সড় ‘মওগা’ বসতি দেখেছিল। সালোয়ার-কামিজ পরা বুক উঁচু করা কিছু মানুষ, কিন্তু চোয়াল কঠিন, গাল দেখে মনে হয় দাড়ি কামানো। লম্বা চুল, নাকে নথ, খাটিয়ায় শুয়ে আছে, অথচ পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি। ওটা হয়তো বিশ্রামের পোশাক। হিন্দি সাইনবোর্ড পড়ে জানা যায়, বিয়েবাড়ি বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে নাচার বায়না নেওয়া হয়। সাইনবোর্ডে নাচের ছবিও ছিল। পাশাপাশিই ব্যান্ডপার্টির ঠেক। বিহারে ওদের খুব চাহিদা। ছটপুজোর সময় দেখেছে মওগা নাচ। বিয়ের সময় বরযাত্রীরা ওদের নিয়ে যায়। অনিকেতের ধারণা ছিল ওখানে মেয়ে-নাচনিওয়ালি পাওয়া যায় না বলেই ছেলেরা মেয়েদের পোশাক পরে সেই চাহিদা মেটায়। তখন বুঝত না অনিকেত যে—এক ধরনের মানুষের কাছে নারীর বিকল্প ‘মওগা’ নয়, ‘মওগা’ বা ‘লন্ডাই ওদের দরকার। ওরা এদেরই চায়। আর এই ‘মওগা’ বা ‘লন্ডা’–রা শুধু জীবিকার জন্যই নয়, নিজেদের দেহের এবং মনের চাহিদায় এরকম মেয়েদের মতো থাকতে ভালবাসে।

হিজড়েদেরও একটা পাড়া ছিল সাসারামে। তখন হিজড়ে আর ‘মওগা’-দের মধ্যে তফাত বুঝত না। এখন যেন অনেকটা বোঝে। কত রকমের ভাঁজ, কত আলো-অন্ধকার। কত সূক্ষ্ম তফাত। মানসিক স্তরের তফাত ওদের জীবনধারাটাই বদলে দিয়েছে। বাঁচার নিয়মটাই বদলে দিয়েছে। গোষ্ঠীবদ্ধ হিজড়ে সমাজের মধ্যে বেশ কিছু নিজস্ব আচরণ আছে, রীতি-নীতি আছে, যা নিয়ে কিছুটা গবেষণাও হয়েছে, কিন্তু ‘মওগা’ বা ‘লন্ডা’-দের নিয়ে কি আলাদা কোনও গবেষণা আছে? কে জানে?

তা, অনিকেত তো গবেষণা করতে শেয়ালদা যায়নি, ও গবেষক নয়। ওর অত এলেম নেই। কিছুটা কৌতূহল বশতই গিয়েছে।

কিন্তু কোথায়? ওইসব মওগা-টওগা তো চোখে পড়ল না…। তিন-চারটে চায়ের টেবিলের এপাশে-ওপাশে ঘুরঘুর করছিল অনিকেত। একটা চা-ওলাকে জিগ্যেস করেই ফেলল— দাদা শুনেছিলাম এখানে কিছু ‘হোমো’ আসে, আমি একজন সাংবাদিক, ওদের একটু দরকার…। চা- ওলা অবাক হল। বলল—ক্যা? হোমো ক্যা?

অনিকেত বুঝতে পারেনি, ওই চা-ওলাটি অবাঙালি। কিন্তু বাঙালি হলেই বা কী হত? ‘হোমো’ মানে বুঝত? মধ্যবিত্তের শালীনতাবোধ ওর মুখ দিয়ে ‘মওগা’ উচ্চারিত হতে দিল না।

অনিকেত কিছু বলল না। ওখানে ঘুরঘুর করছিল। মাথায় লাল ফিতে বাঁধা একটি মেয়ে ওর কাছে এল। বলল, কী গো, বসবে না কি? মেয়েদের মাথায় ফিতে তো উঠেই গিয়েছে। দু’পাশে বিনুনি, আর দুই বিনুনির ওপরে দু’টো লাল ফুল। বেশ অবাক হল অনিকেত। মেয়েটাকে দেখতে লাগল। হয়তো দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কোনও গ্রাম থেকে এসেছে। ওখান থেকে এখনও লাল ফিতে উঠে যায়নি। রান্নাবাটি খেলা উঠে যায়নি, এক্কাদোক্কা উঠে যায়নি। শিবের মতো বর পাওয়ার জন্য নীলষষ্ঠীর ব্রত? মেয়েটা বলে, ওদিকে চলো।

অনিকেত মৃদু ঘাড় নাড়ায়।

মেয়েটা বলে, কাউকে খুঁজছ?

অনিকেত বলে, শুনেছিলাম এখানে নাকি কিছু ছেলে আসে, ওরা ছেলেদের সঙ্গে করে। সত্যি?

মেয়েটা হেসে ওঠে। বলে, ও, তুমি বাড়ুখোর? চলে যায়। একটু পরেই সঙ্গে দু-তিনজন মেয়েকে নিয়ে আসে। একজন বলে অ্যাই, শোনো—’ধুরানি’-গুলোকে এখান থেকে হাটিয়েছি। ওরা বহুত ঝামেলা করে। ফোটো এখান থেকে। যাও। সামনে দিয়ে হয় না শালাদের। পেছন চাই। যাও। ফোটো…।

অনিকেত কিছুটা বুঝতে পারল ব্যাপারটা। এখানে কিছু পুরুষ-যৌনকর্মীও আসত ঠিকই, কিন্তু নারী-যৌনকর্মীদের সঙ্গে ব্যবসা-সংক্রান্ত কারণেই গণ্ডগোল হয়েছে। নারী-যৌনকর্মীরা ওদের আর আসতে দেয় না এখানে।

অনিকেত এসব অ্যাডভেঞ্চারের কথা বাড়িতে বলে না। শুক্লা এটা মজায় নেবে না। অথচ ব্যাপারগুলো এমন, কাউকে না বলেও পারা যায় না। অফিসের দু-একজনকে বলে। ওরা জিগ্যেস করে, তারপর তুমি কী করলে? অনিকেত বলে, তারপর আবার কী করব? ওরা অসম্পূর্ণ গল্প শুনতে চায় না। এন্ডিং চায়। হ্যাপি এন্ডিং। কী হলে এন্ডিং-টা হ্যাপি হয়?

এর মধ্যে ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ পড়ল অনিকেত। লেখকের নাম অমিতরঞ্জন বসু। লেখাটা ৩৭৭ ধারা নিয়ে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭৭ ধারাতে সমকাম-কে অজাচার, পশ্বাচার ইত্যাদির সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছে, এবং বলা হয়েছে, সমকামিতা আইনত সিদ্ধ নয়। প্রবন্ধটিতে এর প্রতিবাদ করা হয়েছে। অমিতরঞ্জন বসু বলতে চেয়েছেন, এটা ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিরোধী। যৌন অভ্যাস মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। যদি সমাজের কোনও ক্ষতি না- করে অন্য কোনও ব্যক্তির অসুবিধে না-ঘটিয়ে কেউ যৌনাচার করে, তবে তার ব্যক্তিগত যৌনাচারে রষ্ট্রের নাক গলানো উচিত নয়। অমিত বসুর সঙ্গে অনিকেতের পরিচয় হয়েছিল আগেই। উনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। বেশ কিছুদিন আগে রেডিওতেই একটা ধারাবাহিক অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল অনিকেতকে। নেশার বিরুদ্ধে। মদ, গাঁজা, ড্রাগ এসবের কুফল নিয়ে। যেহেতু অমিতবাবু মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, ওঁকে ডাকা হয়েছিল গাঁজার নেশার মানসিক কুফল নিয়ে কিছু বলার জন্য। উনি এসেছিলেন, কিন্তু জানালেন, আমি ভাই নিজের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারব না। গাঁজার বিরুদ্ধে আমি কী বলব? আমার বলার কিছু নেই।

অনিকেত বলেছিল, কেন? বলবেন গাঁজা খেলে স্মৃতিশক্তি কমে যায়, বুদ্ধিনাশ হয়, ইত্যাদি কত কথাই তো আছে।

উনি বললেন, এসব রাবিশ। কে বলেছে গাঁজা বুদ্ধিনাশ করে? গাঁজা বরং কল্পনাশক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। সাধু-সন্ন্যাসী-বাউলরা গাঁজা খায়। ওদের কি বুদ্ধি কম? ওরা কত ভাল-ভাল কথা বলে। শিব গাঁজা খেতেন। ক্রিমিনাল-রা ক্রাইম করার আগে অনেক সময় মদ খায়। কিন্তু একটা উদাহরণ দিতে পারেন, যেখানে কেউ গাঁজা খেয়ে রেপ করেছে? কেউ খুন করার আগে গাঁজা খেয়েছে? গাঁজা খেয়ে কেউ ক্রুড হতে পারে না। গাঁজা খেয়ে কেউ নৃশংস হতে পারে না। গাঁজার একটা সুদিং এফেক্ট আছে। আমি ‘সেভ ক্যানিবাস’-এর মেম্বার। ‘সেভ ক্যানিবাস’ নামে একটা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন আছে। গাঁজার বিরুদ্ধে যে সব অপপ্রচার হয়, আমরা তার প্রতিবাদ করি। বরং ড্রাগ নিয়ে বলতে বলুন, আমি বলব। ব্রাউন সুগার নিয়ে বলতে বলুন, বলব। কিন্তু গাঁজার বিরুদ্ধে কোনও কিছু বলতে পারব না।

উনি শেষ অবধি বলেননি। অন্য লোক ধরতে হয়েছিল।

অমিতরঞ্জন বসু-র ফোন নম্বর অনিকেতের কাছে ছিল। অনিকেত যোগাযোগ করল। অমিতবাবু জানালেন, ‘গে’-দের দু-একটা সংস্থা আছে কলকাতায়, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। ‘থটশপ’ নামে একটি সংস্থার কথা বললেন অমিতবাবু, এবং ওই সংস্থার সেক্রেটারি পবন ধল-এর ফোন নম্বরটাও দিলেন।

পবন ধল বললেন, আমাদের একটা ঠেক আছে, আমরা এক জায়গায় বসি। মিড্লটন রো- তে। ওখানে চলে আসুন। এত নম্বর মিলটন রো, ওখানে একটা গার্ডেন রেস্তোরাঁ আছে। ওই সময় মোবাইল ফোনের রমরমা ছিল না। তখন মোবাইল ফোন ছিল আকারে অনেক বড়। বলা হত সেল ফোন, এবং খুব কম লোকের কাছেই ওই যন্ত্র থাকত। বেশ খরচা সাপেক্ষ ছিল। ফোন এলেও পয়সা দিতে হত, ফোন করতে হলে তো বটেই। অনিকেত বলল, আমি চিনব কী করে? পবন বলল—ওখানে গিয়ে বলবেন, পবনের সঙ্গে দেখা করতে চাই, যে কেউ দেখিয়ে দেবে। কিন্তু কবে আসবেন?

অনিকেত বলল, আগামিকাল?

পবন বলল ওকে, কাম আফটার সেভেন পিএম। অনিকেত গেল ওখানে। একটা ছোট গেট। গেট দিয়ে ঢুকলেই বাগান। ওরকম এলাকায় যে এরকম একটা বাগান থাকতে পারে, বাইরে থেকে বোঝার কোনও উপায় নেই। অনেকগুলো রঙিন ছাতা। কয়েকটা কাউন্টার। কোল্ড ড্রিংক্স বিক্রি হচ্ছে, রঙিন আলো-টালো দিয়ে সাজানো আছে। ওখানে পবনকে পেয়ে যায় অনিকেত। খুব সুন্দর দেখতে। স্মার্ট। শার্ট-প্যান্ট পরা। কোনওরকম মেয়েলিপনা নেই। অনিকেত অমিত বসুর পরিচয় দিয়েই ওদের সঙ্গে যোগাযোগটা করেছিল। পবন বলল, অমিতদা ইজ ওয়েল উইশার অফ আস। ইউ গাই আর ফ্রম আকাশবাণী। টেল মি হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ।

সমকামী সম্পর্কে অনিকেতের ধারণাটাই পাল্টে গেল। ‘পাল্টে গেল’ কথাটা বোধহয় ভুল হল। ব্যাপারটা জটিলতর হল। ধারণা ছিল, ওরা মেয়েলি ধরনের হয়, কথাবার্তায় একটা সুর থাকে, অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলে। কিন্তু পবনকে দেখে তো সেরকম মনে হচ্ছে না।

অনিকেত বলল, আপনাদের সাহায্য আমাদের দরকার। রেডিও তো একটা মাস মিডিয়া, এর মাধ্যমে কিছু ভুল ধারণা দূর করতে চেষ্টা করছি। কত দূর কী করতে পারব জানি না।

পবন ধল হাতটা বাড়াল। বলল, আই হ্যাড আ টক উইথ অমিতদা। আপনার কথাও কিছুটা শুনেছি। লেখেন-টেখেন…।

—ওই আর কী। তেমন কিছু নয়।

পবন বলল, আসুন, কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম রঞ্জন, এর নাম অনির্বাণ, এ হল সঞ্জয়, আর ইনি হলেন বক্সী। সবাইকেই প্রথম নামে পরিচয় করাল পবন, শুধু বক্সীর বেলায় পদবি। বক্সী-র বয়স ওদের চেয়ে বেশি। বেশ বড় চেহারা। প্রায় ছ’ফুট লম্বা। চওড়া কাঁধ। ঠোঁটের ওপর বেশ চওড়া গোঁপ। গোঁপের মধ্যে কয়েকটা রুপোলি রেখা। এই মধ্যবয়সি ভদ্রলোকও ওদের বন্ধু? অবাক ব্যাপার। রঞ্জন লম্বামতো, রোগা। সঞ্জয়ের এককানের লতিতে চকচক করছে একটা দ্যুতি। হিরে? কে জানে? গলাতেও একটা হার। নখ চকচক করছে। ভাল করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, ঠোঁটেও হাল্কা করে লিপস্টিক বোলানো আছে। পবন বলল, আমাদের একটা ম্যাগাজিন আছে, ম্যাগাজিনটার নাম ‘প্রবর্তক’। অনির্বাণ হল এডিটর। আপনাকে কয়েকটা ইস্যু দেব।

ওরা ওই বাগান-রেস্তোরাঁয় একটা ছাতার তলায় বসল। গোল টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে। কফি এল। পবন সেতার বাজায়। বারো বছর বয়স থেকে সেতার শিখছে। রেডিও-তে কখনও অডিশন দেয়নি। ওসব ভাবেওনি কখনও। ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। অনির্ণ, যে ওদের পত্রিকা প্রবর্তক-এর সম্পাদক, ও একটা কলেজে ইংরেজি পড়ায়। সঞ্জয় একটা অ্যাড এজেন্সি-তে চাকরি করে। ভিজ্যুয়ালাইজার। মি. বক্সী এক্স-মিলিটারি। এখন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিকিউরিটি অফিসার।

পবন বলল—উই ডোন্ট হেজিটেট টু ডিক্লেয়ার দ্যাট উই আর গে। বাট নট দ্যাট—উই আর প্রাউড অফ বিয়িং গে। এবারে বলুন আমরা কী করতে পারি? অনিকেতের নিজেকে একটু নার্ভাস লাগছিল। এত স্মার্ট ‘হোমো’ হতে পারে ভাবেনি আগে। কতরকম দেখল। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।

পবনকে জিগ্যেস করল অনিকেত, এরকম একটা সংস্থা করার কথা কীভাবে মাথায় এল?

পবন বলল, পুণেতে কিছুদিন ছিলাম। ওখানে ‘বোম্বে দোস্ত’ নামে একটা কাগজ বেরুতে দেখতাম। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। দেখলাম, ওরা ‘গে’-দের অধিকার নিয়ে ভাবছে। সামাজিক অপমানের বিরুদ্ধে অ্যাওয়ারনেস তৈরি করছে, এড্‌স সম্পর্কে অ্যাওয়ারনেস করছে। ভাবলাম, কলকাতাতেও কিছু করি।

অনিকেত বলল, আপনারা চারজন আমাদের অফিসে আসুন। কোন চারজন আসবেন— নিজেরাই ঠিক করে নেবেন। তারিখ জানিয়ে দেব।

কী করতে হবে ওখানে?

নিজেদের অনুভূতির কথাই বলবেন। আমরা ঠিক করে নেব কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। মোট কথা একটা পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিষয়টা দেখব। এই আর কী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *