৬০
আরও দু’-আড়াই বছর কেটে গেল। কত জল বয়ে গেল গঙ্গায়, টিভিতে কত সিরিয়াল শুরু হল, কত সিরিয়াল শেষ হল। আরও কত কন্যা-ভ্রুণ ধ্বংস হল। আরও কত জঞ্জাল পড়ল ধাপার মাঠে। বিজেপি-র বাজপেয়ী’কে বিদায় নিতে হয়েছিল, মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী হয়ে এসেছিলেন ২০০৪-এর সুনামির আগেই। ২০০৫ সালে লালুপ্রসাদ হেরে গেলেন বিহারে। বিহারে একটা প্রবাদ ছিল : যবতক রহেগা সামোসে মে আলু, তবতক রহেগা বিহার মে লালু। সেই লালুপ্রসাদ যাদবও হেরে গেলেন। নীতীশকুমার বিহারের নতুন মুখ্যমন্ত্রী। সপ্তম বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এল। ইরানে প্রকাশ্য ফাঁসিতে ঝুলল আটজন পুরুষ সমকামী। আর পরি বস্তির ঘর ছেড়ে ফ্ল্যাট ভাড়া নিল ট্যাংরা অঞ্চলের মুসলমান-প্রধান এলাকায় সাড়ে তিন হাজার টাকায়। ওয়ান রুম ফ্ল্যাট। নামাজের আজান শোনে। ব্যালকনি থেকে একটা কোনওরকমে টিকে থাকা আমগাছ দেখা যায়। বসন্তে আম বকুলের গন্ধ পায়, পাখিও দেখে। পরি চাকরি করে যে কোম্পানিতে, তার নাম “পিকক্’স টেল ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’। ময়ূরের পালক। ‘পিকক’ নামেই কোম্পানিটা বিখ্যাত। ওরা টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত। সিনেমার জন্য কস্টিউম বানায়। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও কাজ করে। কিছু দিন আগে এক হোটেল-মালিকের ছেলের বিয়ে হল। পাল্কিতে বর-বউ কিছুটা ঘুরবে। পাল্কি – বাহকদের কস্টিউম করল, গিন্নি-বান্নি-দাস-দাসি সবার। গিন্নিদের ঘটি হাতা ব্লাউজ। আর দাসিরা ব্লাউজহীনা। গিন্নিদের কস্টিউম ডিজাইন করা তেমন কঠিন কাজ ছিল না, কঠিন ছিল দাসিদের কস্টিউম করা। উজ্জ্বল রঙের ফেব্রিক, চমকদার ঝুটো গয়না…। এরপর পরি একটা দুর্গাপুজোর কস্টিউম করেছে। ওতেই খুব নাম হয়ে গিয়েছে ওর। ওই পুজোর থিম ছিল একশো বছর আগেকার কোনও গ্রামের দুর্গাপুজো। ঢেঁকিতে ধান কুটছে কয়েকজন গ্রাম্য নারী। ওদের গায়েও ব্লাউজ নেই, শাড়ির পাড়ে মাছের সারি, কিংবা প্রাচীন কলকা। মাত করে দিল এক নামি চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর জন্য একটা শাড়ির ডিজাইন করে। কোনও এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করা মেয়েদের সংবর্ধনা দিল। পুরস্কার তুলে দেওয়ার কথা সেই বিখ্যাত অভিনেত্রীর। পিককস টেইল-এ যোগাযোগ করা হয় সেই অভিনেত্রীর তরফ থেকে। ওই অনুষ্ঠানে পরার জন্য একটা মানানসই শাড়ি চাই। একটা সাদা খোলের শাড়িতে বেশ মোটা পাড়, এবং পাড়ে লেখা ‘বেঁচে থাকো বিদ্যেসাগর চিরজীবী হয়ে শান্তিপুরের তাঁতিরা নাকি এক সময়ে মেয়েদের শাড়ির পাড়ে এটা বুনতেন। সুতো দিয়ে বুনতে অনেক সময় লাগত, এমন একটা ব্লক করিয়ে নিয়েছিল, যেন দূর থেকে মনে হবে সুতোয় বোনা। সেই ব্লক দিয়ে প্রিন্ট করিয়ে নিয়েছিল শাড়ির দু’দিকের পাড়ে। তিন ইঞ্চি চওড়া ব্লক দূর থেকেও বেশ বোঝা যায় লেখাটা। টিভিতে দেখানো হল ওই শাড়ি-পরা মহিলা গায়ে বিদ্যাসাগর জড়িয়ে পুরস্কার দিচ্ছেন, হয়তো একটু পরেই ওই শাড়ি ছেড়ে শর্ট প্যান্ট আর গেঞ্জি পরেই ‘ধুৎ, কাছে এসো খোকাবাবু’ টাইপের গানের সঙ্গে নাচবেন, তা নাচুন গে, কিন্তু ওই যে ইমেজ বিল্ডিং, ওটা তো শাড়িটার জন্যই হল। থিমেটিক কস্টিউম-ডিজাইনার হিসেবে পরির নাম ফাটল খুব দ্রুত।
প্রফেশনে ওর নামডাক হয়েছে পরি হিসেবেই। পরিমল নামটা ব্যবহার করে না আর। পদবিও ব্যবহার করে না। এই দুচ্ছাই পরিও আজকাল দিবাস্বপ্ন দেখে নিজস্ব কোম্পানির একটা খুব ভাল বাংলা নাম ভেবেছে—পরি-কল্পনা। কিন্তু অল্প কিছু বাঙালি ছাড়া এই নামের মানে কেউ বুঝবে না। বিখ্যাত-বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনিং কোম্পানির নাম হয় হামেল, ব্রাউন বাফেলো, লিজ্ ডেভালেপমেন্ট—এসব। গ্যাপ-ও খুব নামী সংস্থা। ‘কালেকশন ডিজাইনার’ নামটা কেমন হয়?—চয়নকে জিগ্যেস করেছিল পরি। চয়ন বলেছে ভালই তো। আসলে চয়ন বুঝতে পারল না ওর নামেই কোম্পানিটার নাম ভাবা হয়েছে। ‘চয়ন’ মানে তো সংগ্রহ। সংগ্রহর ইংরেজি ‘কালেকশন’। ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড এখনও চয়নের নামে।
প্রথম-প্রথম চয়ন বলত, গাছে কাঁঠাল গোঁপে তেল। কবে কোথায় কোম্পানি হবে, আগেই নাম নিয়ে চিন্তা। পরি বলেছে নামটাই তো আগে। এই যে রবীন্দ্রনাথ, নামটা তো সবার আগে দেওয়া হয়েছিল, তারপর তো রবীন্দ্রনাথ। চয়ন বলেছে, ধুৎ, সব কিছুতে বাড়াবাড়ি। একটু বেশি-বেশি স্বপ্ন দেখিস তুই, তোর স্বপ্নদোষ আছে। স্বপ্ন তো দেখেই পরি। স্বপ্নটা দেখেছে বলেই তো দু-চার গাছা পদ্য লিখেছে। স্বপ্নটা দেখেছে বলেই তো কোর্সটা শেষ করেছে, নিজের পশ্চাদ্দেশ ওর স্বপ্নবিপণির একটা ‘আইটেম’ মাত্রই ছিল। পরি নিজের কোম্পানির স্বপ্ন দেখে। চয়ন ঠিকঠাক চাকরি পেল না তো কী হল? কাঁচকলা হল। ব্যবসা সামলাবে। অ্যাকাউন্টস টা ও পারবে না। এটা পরি নিজেও পারবে না। অ্যাকাউন্টেন্ট রাখতে হবে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট?—একটু পরে। প্রথমে না। ট্যাক্স-এর কাজটা ভাল করে জানে এমন কাউকে রাখবে। ট্যাক্স ফাঁকি দিতে হবে না? ট্যাক্স ফাঁকি দেবে? কিছুটা ফাঁকি না-দিলে কি কোম্পানির মান থাকে? আচ্ছা বাবা আচ্ছা, ট্যাক্স ফাঁকি দেবে না। হিসেব করতে হলেও তো লোক চাই। তারপর ল-ইয়ার। পিআরও। পুরোদস্তুর অফিস। কত দারুণ-দারুণ ছেলে পরি-র সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য হা-পিত্যেশ করে আছে। ও একটা খুব সুন্দর—শাহরুখ টাইপ ছেলেকে সেক্রেটারি রেখেছে। চয়নের কী হিংসে, ইস, ওর মুখটা কীরকম বোকা-হাবা হয়ে আছে। ছি ছি ছি। সেই বোকা কুমোরের স্বপ্ন দেখার গল্পটা মনে পড়ে পরির। দশটা হাড়ি বেঁচে যা লাভ হল, সেটা বেঁচে দোকান, দোকান থেকে প্রচুর লাভ, তখন আর একটা বিয়ে, আর প্রথম বউটার পেছনে এক লাথি। লাথিটা মেরেছিল কুমোর, একটার উপর অন্য হাঁড়ি রাখা হাঁড়ির সারিতে। হাঁড়িগুলো ভেঙে গিয়েছিল।
না, পরি ওরকম না। ও চয়নকে ফোটাবে না। কিন্তু চয়নের চিন্তিত মুখ দেখতে চায় জেলাস মুখ দেখতে চায়।
রেকারিং ডিপোজিট করেছে পরি, রেকারিং ডিপোজিট। প্রতি মাসে দু-হাজার টাকা করে রাখছে। দু’বছর রাখলে একসঙ্গে পঞ্চান্ন হাজার টাকা পাবে। মায়ের গয়নাগুলো সব ঠিকঠাক রয়ে গিয়েছে। একটাও বিক্রি করেনি। সেগুলোও কাজে লাগাবে। তারপর? তারপর উল্টে দেখ, পাল্টে গেছি। গয়না তো নিজের অঙ্গ সাজানোর জন্যই। গয়না বিক্রি করে নিজের অঙ্গই তো সাজাবে পরি। আস্তে-আস্তে সর্বাঙ্গে ফুটে উঠবে কমনীয় কান্তি। সর্বাঙ্গে বসন্ত বসাবে। আহা কী অনিন্দ্য-ভ্রান্তি। ভ্রান্তিবিলাস। বামন হয়ে সত্যিই-সত্যিই চাঁদকে চুমু খাবে। অপারেশন করাবে পরি। রি-অ্যাসাইমেন্ট সার্জারি। ট্যাবলেট খাওয়া ফাঁপা বক্ষ নয়, চক্ষে তাক লাগা খাপে- খাপ মাপা বক্ষ। এই হাইটে ঠিক যতটা মানায়। জল না-পাওয়া কলা গাছের কাঠালি কলার ছা টাকে পেটের তলা থেকে খসিয়ে দিয়ে ওখানে বসিয়ে দেবে সাদা অপরাজিতার ফুল। এত দিন ওদের দিকে শুধু তাকিয়ে দেখেছে, যারা মুম্বই থেকে সার্জারি করিয়ে গায়ে বসন্ত বসিয়েছে। এখন তো কলকাতাতেও হচ্ছে। খুব ইচ্ছে হয় রাতারাতি অপারেশন-টপারেশন করে চয়নকে বলবে : উল্টে দেখ পাল্টে গেছি। কিন্তু এসব অপারেশন তো রূপকথা-পুরাণের আশ্চর্য পুষ্করিণী-স্নান নয় যে, একটা ডুব দিয়ে উঠলেই সব পাল্টে গেল, এটা একটা লং প্রসেস।
চয়ন একটা স্কুলে কাজ পেয়েছে। পুরোপুরি চাকরি নয়, আংশিক। ওদের বলে ‘প্যারা- টিচার’। তাই বলে ইস্কুলে কম সময় থাকতে হয়, এমন নয়। অন্য টিচাররা যেমন থাকে, তেমনই থাকতে হয়, কিন্তু চয়নের তুলনায় ওরা পাঁচগুণ মাইনে পায়। আবার যখন এসএসসি পরীক্ষা হবে, তখন এই অভিজ্ঞতার জন্য পয়েন্ট পাবে। একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলা টিচারের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিল, কিন্তু ওদের ইংরিজিটা কেমন যেন। প্রশ্নগুলোই ঠিকমতো বুঝতে পারছিল না। ওন্না’ ‘গোন্না’ করে কী সব বলছিল যে ওরা…।
পরি এখন কী সুন্দর ইংরিজি শিখেছে। যখন ফোনে কথা বলে, অবাক হয়ে শোনে চয়ন। পরিও ‘ওন্না’’গোন্না’ বলে। পরি একদিন বোঝাচ্ছিল—’ওন্না’ নয়, ‘ওয়ানা’ হল ওয়ান্ট টু। ছোট করে ‘গোন্না’ মানে ‘গোইং টু’। এরকম আরও কত। ‘ডোন্ট ওয়ারি’ বলতে গিয়ে বলে ‘চিল’, ‘চিল’। এখনকার ছেলেপুলেরা খুব ‘ব্যাপক’ আর ‘বীভৎস’ বলে। চয়নও বলে। পরি কখনও বলে ‘কুল’, কখনও বলে ‘হট’। দারুণ পাল্টে গিয়েছেও। ব্যাপক পাল্টে গিয়েছে। নিজে তেমন কিছু করে উঠতে পারল না বলে নিজের উপর মাঝে-মাঝে ঘেন্না হয়। পরিকে একথা বলেছে চয়ন। বলেছে, আমায় একটু ঠিকঠাক ইংরেজি শিখিয়ে দে পরি…। পরি বলেছে ওগুলো ঠিকঠাক ইংরেজি নাকি, ওগুলো স্ল্যাং। কথায়-কথায় ‘শিট’, ‘বল্স’, আঁস এসব না-বললে স্মার্ট হওয়া যায় না। কথায়-কথায় আমি কিন্তু এখনও ফাকিং-টাকিং বলতে পারি না—বলে চয়নের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়েছিল পরি, একদম মেয়েদেরই মতো।
পরি চেষ্টা করে নিজের গলাটা সরু করেছে। কিছুটা, কিন্তু বিপাশার মতো পারেনি। বিপাশা তো আগে ছেলেই ছিল, অল্পস্বল্প আলাপ ছিল আগে। অনেক দিন যোগাযোগ নেই। একটা টিভি প্রোগ্রামে ওকে দেখেছিল। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একটা আলোচনায় কৃষ্ণা বসু, শাশ্বতী ঘোষদের মতো নারীবাদীদের সঙ্গে। ও কী বলছিল, তার চেয়ে বেশি মন দিয়ে শুনছিল ওর কণ্ঠস্বর। ও কি গলার ভোকাল কর্ডেও সার্জারি করিয়েছে? ওর ফোন নম্বর চেষ্টা করলে জোগাড় করা কোনও সমস্যা হত না, কিন্তু তার আগেই একজন খুব সিনিয়ার ইএনটি সার্জেনের কাছে গেল। বলল, আমায় দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি একজন ট্রান্সজেন্ডার। আমি অপারেশন করে সব ঠিকঠাক করব। তার আগে আমার ভয়েস-টা ঠিক করে দিতে পারবেন? ডাক্তারবাবু বললেন–ভোকাল কর্ডে অপারেশন করে হয়তো করা যায়, কিন্তু আমি পারব না। কারণ এই ধরনের অপারেশন তো কখনও করিনি আমি। আমি কেন, কলকাতার কেউ বোধহয় করেনি। খুব রিস্কি অপারেশন কিন্তু। মেয়েদের গলায় শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি পুরুষদের তুলনায় বেশি থাকে। বাচ্চা বয়সে ছেলেমেয়েদের গলার ফ্রিকোয়েন্সি একই থাকে। বয়ঃসন্ধিতে চেঞ্জ হয়। হরমোনের খেলা। কর্ডের টিস্যুগুলো তখন পাল্টে যায়। তোমার গলাটা চেঞ্জ করতে হলে কর্ডে ছুরি চালিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাডজাস্ট করতে হবে। কী দরকার বাবা এসব ঝামেলা করে? যেমন আছো থাকো না। কী করো? কেন বাপের পয়সা নষ্ট করতে যাচ্ছো? পরি বলে, বাপের পয়সা নয়, নিজের পয়সা। বলার সময় গলাটা গম্ভীর করে ফেলল। যেমন আরও একটু ছেলে-ছেলে। কিন্তু মেয়েরা যখন গলা গম্ভীর করে কথা বলে, তখন তো ছেলে-ছেলে লাগে না, মা তো কত বকুনি দিত, মনে হত না কোনও ছেলে বকুনি দিচ্ছে। শিকস্তি যখন ‘ওফ্, ফাক আউট’, ‘ফাক দেম আউট’ বলে ছেলেদের কায়দায় খিস্তি দিত, তখনও মনে হত না কোন ছেলে খিস্তি দিচ্ছে। নাঃ, মেয়ে হতেই হবে। শুধু মনের ভিতরে একটা নারী-আত্মা পুষে রাখলে চলবে না। পুরো মেয়ে হতে হবে। প্রতি অঙ্গে। আই ওয়ানা। ডাক্তারবাবু বললেন, কেন মেয়েদের মতো হতে চাইছ বলো তো?
পরি বলে, মেয়েদের মতো নয়, মেয়েই হতে চাইছি। পরি জিনস আর শর্টশার্ট পরে এসেছিল। একটু টাইট-ফিটিং, ছোট হাতা। ডাক্তারবাবু কেন ওর বুকের দিকে তাকাচ্ছে না? সস্তার ট্যাবলেট খাওয়া বুক বলেই না? সিলিকোন বুক হলে ঠিক লক্ষ করত। ডাক্তারবাবু বললেন, জানি তো মেয়েই হতে চাইছ। কী দরকার বাপু? পয়সাকড়ি তো রোজগার করো বলছ, কী করো? পার্সোনাল কথা বলছি বলে কিছু মনে কোরো না যেন।
আমি একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। বুক ফুলিয়েই বলল পরি।
ডাক্তারবাবু বললেন, ভেরি গুড়, ভেরি গুড। তুমি তো জামা-কাপড়ে ডিজাইন করো। ভাল কথা। নিজের বডিতে ডিজাইন করতে যাচ্ছো কেন? এটা এখন একটা ফ্যাশন হয়েছে। বছর দুই আগে তোমার মতো আর একজন এসেছিল আমার কাছে, অলোকা হালদার। একটা অ্যাড এজেন্সিতে বড় চাকরি করে। বম্বেটম্বে থেকে অপারেশন করিয়েছিল। সিরিজ অফ অপারেশন। আগে নাকি অলোক হালদার ছিল। যখন এল, বুঝতে পারিনি ও ছেলে না মেয়ে। যখন কথা বলল, তখন বুঝলাম। ও বলল আমার খোলস আমি ছেড়ে ফেলেছি। আমার শরীরে একটা পুরুষের খোলস ছিল। ফেলে দিয়েছি ওটা। আমি এখন ভিতরে-বাইরে নারী, শুধু গলার স্বরটা সরু করে দিন। আমি বলেছিলাম গলার স্বর নিয়ে কেন এত মাথা ঘামাচ্ছেন ভাই, অনেক পুরুষের গলার স্বর তো সরু হয়, আমাদের স্কুলের সংস্কৃত স্যরের গলার স্বর খুব সরু ছিল। আবার অনেক মহিলার গলা তো মোটা হয়। বোঝালাম অনেক। বুঝল না। বলতে লাগল— আপনি তো নানারকম সেমিনার টেমিনারে যান, বাইরে কোথায় এসব হয় আমায় খোঁজ দিন। আমি বললুম আমেরিকায় হয়, ওখানে তো অনেক খরচ। দেখছি সিঙ্গাপুর বা ব্যাঙ্ককে হয় কি না। ওই ভদ্রলোক সেদিনের মতো চলে গেলেন। কিন্তু ওঁর মাথা থেকে ভুতটা নামল না। আমাকে ক্রমাগত ফোন করতে লাগলেন। খোঁজ খবর নিয়ে জানলুম ব্যাঙ্ককে এ ধরনের অপারেশন হয়। ওখানে এলাকাজার নামে একটা নাচগানের দল আছে, ওই দলের সবাই ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছে। ওরা সব ওই হাসপাতালে গলা অপারেশন করিয়েছিল। আরও অনেকে ওখানে ভয়েস চেঞ্জ করায়। কি যেন নাম হাসপাতালটার ভুলে গিয়েছি। একজন অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার অপারেশন করেন। কী যেন নাম…কী যেন নাম…।
দরজা খুলে উঁকি দিল একজন। স্যর…।
ডাক্তারবাবু বললেন, সরি সরি। পরিকে বললেন, অনেক কথা আছে, চেম্বারে বলা যায় না। চেম্বার তো গল্প করার জায়গা নয়, রোববার সন্ধের পর ক্যালকাটা ক্লাবে বসি, এসো, সব বলব।
পরি তো অলোকা হালদারকে চেনে। সেই ছাত্র বয়সে যখন রবীন্দ্রসদনের ঠেকে আড্ডা হত। যে মুম্বই থেকে অপারেশন করিয়ে এসে বলেছিল, দেখলে হবে? খরচা আছে। যে রতনের বুক লক্ষ করে বলেছিল ওখানে ন্যাকড়া পোরা। রতন পরির কাছে নন্দন চত্বরে কেঁদেছিল। সেই অলোকা হালদার? হবে হয়তো।
ক্যালকাটা ক্লাবে আর যাওয়া হয়নি। ভুলেই গিয়েছিল। আজ দেখা হয়ে গেল অলোকাদির সঙ্গে। আজ রোববার। ফায়ার ছবিটার একটা বিশেষ শো ছিল নন্দনে। চয়ন আর পরি দেখতে এসেছিল। চেনা কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হল। এরা সব এলজিবিটি অ্যাকটিভিস্ট।
‘সাফো’র কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হল। ফায়ার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বলে মেয়েটা লেসবিয়ান সম্পর্কে জড়িয়ে গেল। বেসিক জায়গাটাতেই ভুল। ‘অতৃপ্ত হেট্রো সেক্সুয়ালিটি মোটেই হোমো সেক্সুয়ালিটির কারণ হতে পারে না, এ নিয়ে তর্ক হচ্ছিল। পরি দেখল সেই দঙ্গলে অলোকাদি দাঁড়িয়ে আছে। ও কোনও কথা বলছে না, শুধু শুনছে। অলোকা যখন অলোক ছিল তখন থেকেই চিনত। খুব হাত চোখ নাড়িয়ে কথা বলত, আর একটু বেশিই কথা বলত কথার মধ্যে, ভাল লাগলে ঠিকরি দিত। ঠিকরিও হাত তালি, তবে একটা হাতের সঙ্গে অন্য হাত নব্বই ডিগ্রির মতো কোণ করে আঘাত করে। আর, একটু অন্য ধরনের শব্দ হয়। অলোকদাই সবার আগে অলোকাদি হয়েছিল। ওর বাবা বোধহয় উকিল টুকিল কিছু। দাদা থেকে দিদি হওয়ার পর হইচই গিরি আরও বেড়ে গেল। ভাল বাংলায় এটাকে বলে প্রগলভতা। সেই অলোকাদি কোনও কথাই বলছে না। মৃদু মৃদু হাসছে, কিংবা কপাল কুঁচকোচ্ছে। যারা যারা আগে পরিকে চিনত তাদের কেউ কেউ ওকে দেখে খুশি হয়েছে, বলেছে কেউ আবার না চেনার ভান করেছে। হিংসে হলে যা হয় আর কি, কিন্তু অলোকাদি দেখেও কথা বলছে না। চোখাচোখি হল, তবুও না। ওরা ওই জটলা থেকে বেরিয়ে এল। সন্ধে সাড়ে সাতটার মতো, একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে বলে রাস্তার ওপর জলের পর্দা। গাছের পাতা থেকে দু’ফোঁটা এক ফোঁটা জল পড়ছে, বেশ লাগছিল। পরি দেখল নন্দন চত্বরে গাছতলায় বেশ ভিড়। সব জোড়ায় জোড়ায়। পরির মনে এল ‘একটু জায়গা দাও মাগো মন্দিরে বসি….।’ কিন্তু গাইল না, মনটা একটু অফ হয়ে আছে। ওই অলোকাদির জন্যই হয়তো। এক জায়গায় এক জোড়া উঠে গেল। পরি বলল, চলো বসি। চয়ন বলল, না বসব না, এখন মাস্টারি করি তো, যদি কেউ দেখে ফেলে…।
তো কী হয়েছে? মাস্টারমশাই হলে বুঝি কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা যায় না…।
চয়ন বলল, মেয়ের সঙ্গে তবু যায়। কিন্তু তোকে দেখতে তো এখনও ঠিক—ও বুঝেছি। হিজড়ে হিজড়ে লাগে। তাই তো?
উঠে দাঁড়ায় পরি। বলে, বুঝেছি। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলে, ওই জন্যই তো আমি অপারেশনটা করার কথা ভাবছি চয়ন। চিকেন পক্স-এর খোসার মতো, ভোট শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও দেওয়ালের ‘ভোট দিন’ পোস্টারের মতো আমার গায়ে লেগে থাকা ছেলেত্বটা ছিঁড়ে দেব, শিওর।
চয়ন চুপ করে থাকে। ও জানে এইসব অপারেশন প্রচুর খরচার ব্যাপার। এবং এ ব্যাপারে চয়নের অনেকটা দায়িত্ব আছে। অথচ ও পারছে না, তাই এই প্রসঙ্গে ক্যাবলা হয়ে থাকা ছাড়া ওর কোনও ভূমিকা থাকে না।
ঠিক আছে—তবে বাড়ি যাই…। পরি ওঠে। চয়ন বলে একটু ওদিকের রাস্তায় হাঁটলে ভাল লাগত….ওয়েদারটা বেশ, চয়ন রেস কোর্সের দিকটার দিকে আঙুল নির্দেশ করে।
পরি বলে, না, তুমি শিক্ষকমহাশয়। কেউ দেখে ফেলবে। কোথাও যাব না। আই ডোন্ট ওয়ানা গো। বাসে উঠব।
তখনই ক্যালকাটা ক্লাব চোখে পড়তে, ডাক্তার বাবুর কথা মনে পড়ল। মনে হল, একবার ঘুরে এলে হয়। সেদিন ডাক্তারবাবুকে মজার লোক মনে হয়েছিল।
চয়নকে বলল, চলো ক্যালকাটা ক্লাবে যাই।
চয়ন বলল, ওখানে কী?
পরি বলল, চলো না, ওখানে তোমার ছাত্রদের যাওয়ার কোনও চান্স নেই। হাত ধরেই পরি টেন নেয় চয়নকে। ডাক্তারবাবু সবই জানে।
বিরাট গাড়ি বারান্দা। বড় নাম। ঢুকতেই সাদা ইউনিফর্ম পরা সিকিউরিটির লোক বলল, কোথায় যাচ্ছেন?
পরি বলল, ডাক্তার এ কে সেন। আসতে বলেছেন।
সিকিউরিটি পরিকে বলল, আপনি যেতে পারেন। উনি অ্যালাওড নন। চটি চলে না।
চয়নের পায়ে চটি ছিল। পরির পায়ে নাইক সু।
চয়ন বলল, তুই যা। চয়ন ছিটকে বেরিয়ে গেল। চটাস চটাস চটির আওয়াজটা যেন একটু বেশি।
যাকগে। চয়নের পিছন পিছন ছুটল না পরি। পরি ভিতরে ঢুকল। কাজের সুবাদে বড় হোটেলে ঢুকেছে পরি, টলি ক্লাবেও একবার। এখানে প্রথম। বাঁ দিকে কাচের দরজা, ওখানে বড় বড় সোফায় বসে আছে অনেকে। দরজাটা খুলল না ও। সামনে বারান্দা। বারান্দার পরে লন। বারান্দায় একটা গোল টেবিলে ডাক্তারবাবুকে দেখতে পেল পরি। টেবিলে আরও দু’জন। টেবিলে কাচের গ্লাসে সোনালি হুইস্কি।
পরি হাত জোড় করে। চিনতে পারছেন স্যর? আসতে বলেছিলেন, আমার নাম পরি। আপনার কাছে গিয়েছিলাম, আমার গলার ভয়েসটা…।
ও, ইয়েস, হ্যাঁ, হ্যাঁ। বোসো। অন্য দু’জনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। একজন টেলিভিশনের হ্যালো ডাক্তারবাবুর অ্যাংকার, অন্যজন এটি বিখ্যাত হোটেলের শেফ্। আর পরির পরিচয় দিল আমার ইয়ং-ভেরি ইয়ং ফ্যাশন ডিজাইনার ট্রান্সজেন্ডার ফ্রেন্ড।
‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটা যেভাবে উচ্চারিত হল, তার মধ্যে কোনও সস-মেয়োনিজের প্রলেপ ছিল না।
টেবিলে ফিশ ফিঙ্গার, বাটিতে লাল সস্ এবং মেয়োনিজ। ডাক্তারবাবু বললেন, খাও। আস্তে করে বললেন, একটু হুইস্কি? ঘাড় নাড়ল পরি, নিষেধের। ডাক্তারবাবু বললেন, ওকে, ওকে এধার ওধার থেকে শব্দ ছুটে আসছে—ব্লেন্ডারস প্রাইড—আইস কিউব—সেনসেক্স জিনসেঙ—ভ্যান হুসেন—ইনসুলিন…। জুতোর শব্দ, হা-হা হাসি, গন্ধ আসছে পারফিউমের, ঝলসানো মাংসের, অ্যালকোহলের। টুকরো-টুকরো জৌলুস ঝলসানো মাংসের মতো এখানে- ওখানে ছিটানো। পরি বলল, ওই অলোকা সরকারের কথা বলবেন বলেছিলেন…।
হ্যাঁ। হ্যাঁ। ভেরি ইন্টারেস্টিং কেস, অ্যাট দ্য সেম টাইম, ইট ওয়াজ ভেরি স্যাড। বলতে চেয়েছিলাম তোমায় এটা বলতে যে, বেশি ক্রেজি হয়ো না। ওই অলোক, অর অলোকা — হোয়াট এভার, ওর জীবনের কথা বলেছিল। আমি ভাবছিলাম তোমায় বলি, বলতে শুরুও করে দিয়েছিলাম, তখন আমার সেক্রেটারি কাম কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান ঘরে ঢুকল। আমি খুব গপ্পোর লোক। ওকে বলা আছে এদিক-ওদিক বুঝলে ঘরে টোকা মেরো। তাই সেদিন বলা হয়নি। তা, ছেলেটা, সরি, মেয়েটা, হোয়াটএভার, বলেছিল সার্জারি করার আগে ওর যে সব প্রেমিক ছিল, ওরা বেশিদিন টিকত না ওর যে সব প্রেমিক জুটত, ওরা মোস্টলি বাইসেক্সুয়াল। কিছুদিন ওর সঙ্গে মেশামেশি করে তারপর আর সম্পর্ক রাখত না। মেশামিশি মানে কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছ তো? পরি ঘাড় নাড়ে।
ডাক্তারবাবু হুইস্কির গ্লাসে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বললেন, গুড। ইউ আর কোয়াইট অ্যাডাল্ট। ভোট দিয়েছিলে? পরি বলে, দু’হাজার ছ’য়ে দিয়েছিলাম। ওরা তো আমার সেক্স মেল লিখেছিল। কিছুতেই ফিমেল লিখল না। দু’হাজার ন’য়ে চেষ্টা করব যেন অন্ততপক্ষে আদার লেখানো যায়। এবার ফর্মে মেল, ফিমেল-এর সঙ্গে ‘আদার’ ছিল।
অলোক ফিমেল হিসেবেই ভোট দিতে পেরেছিল। ডাক্তারবাবু বললেন। দ্যাট ওয়াজ এ লং প্রসেস। প্রথমে তো অপারেশন। ব্রেস্ট বানাবে, ভ্যাজাইনা বানাবে। ভ্যাজাইনা থাকলেই স্ত্রী লিঙ্গ হয়ে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার। আরে বাবা, ওই ভ্যাজাইনার গোড়ায় ইউটেরাস আছে কি না, ওভারি আছে কি না—ওসব কোনও ব্যাপার নয়। ভ্যাজাইনা বানিয়ে ডাক্তার যদি সার্টিফিকেট দেয়, ব্যস হয়ে গেল। তারপর এ্যাফিডেভিট করে নাকি ও সেক্স চেঞ্জ করেছিল।
শেফ বোধহয় স্পাইস-এর গন্ধ পেয়েছে। বলল, সরি টু ইনটারাপ্ট। ওটা কি ওরিজিনাল ভ্যাজাইনার মতো হয়?
ডাক্তারবাবু বললেন, আমি কি দেখেছি নাকি, নাকি দেখেই বুঝতাম।
টিভি অ্যাংকার ছোট করে পরিষ্কার করে বলল, মা-ঠাকমাদের হাত চিপে বার করা আমের রস আর ম্যাঙ্গো ফ্রুটির ড্রিঙ্কস কি এক হয় কখনও? আমার আঙুলের আংটিতে আসল হিরে। জাতই আলাদা। আমেরিকান ডায়মন্ড চকচক করে হয়তো বেশি, কিন্তু…
ডাক্তারবাবু ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এনি ওয়ে…। কী যেন বলছিলাম…।
শেফ বলল, ভ্যাজাইনা…ভ্যাজাইনা…
ডাক্তারবাবু বললেন, তার আগে কী যেন বলছিলাম? বয়ফ্রেন্ডস। ইয়েস। অলোকার বয়ফ্রেন্ডরা কিছুদিন পর কেউ বিয়ে করে নিত, কেউ বা অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হত। ও তখন ভ্যাজাইনা বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে গেল। এর আগেই বোম্বে থেকে ব্রেস্ট বানিয়ে এসেছিল। কিছুদিন পরই ক্যাস্ট্রেশন করিয়ে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে ভ্যাজাইনা বানিয়ে নিল। এরপর ওর একটা প্রেমিক জুটল। পুলিশে চাকরি করে। কনস্টেবলের একটু উপরেই। এএসআই হতে পারে। ওই পুলিশটা নাকি ওকে সামনেও ইউজ করত, পেছনেও। কিন্তু সামনে খুব ভাল করে পারত না। অলোকা বলেছিল—ওর ভ্যাজাইনাল ক্যাভিটিটা চার ইঞ্চির মতো ছিল। স্ট্রেড হলে সাড়ে চার, হয়তো ম্যাক্সিমাম পাঁচ ইঞ্চি পর্যন্ত হত। পুলিশের ওতে হত না। হিজ থিং ওয়াজ লংগার। এজন্য দেখো, ওই পুলিশটার জন্য ও আবার অপারেশনে গেল। কারণ, যে ক্যাভিটিটা করা হয়েছিল, ওটা তো একটা ব্লাইন্ড চ্যানেল। একটা জায়গায় গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। ন্যাচারাল ভ্যাজাইনা তো ব্লাইন্ড নয়। সার্ভিস, মানে জরায়ু মুখ পর্যন্ত এমনিই একটা স্পেস আছে, তারপর চাপ পড়লে আরও সরে যায়। কিন্তু আর্টিফিসিয়াল ভ্যাজাইনাল চ্যানেল তো…এরকম…।
যেন খাঁড়ি। কোনও উৎস নেই নদীর মতো…। হাত মোছার টিস্যু পেপারে ছবি আঁকলেন ডাক্তার।
বোঝো, আবার সার্জারি। তিন সপ্তাহ পর ফিরে এসেছিল ও।
ক’ইঞ্চি করল? শেফের জিজ্ঞাসা। জানি না ঠিক। খুব বেশি তো করা যায় না। ব্লাডার প্রস্টেট বাঁচিয়ে করতে হবে।
—আচ্ছা, কথাটা উঠল যখন জিজ্ঞাসাই করে ফেলি, এই যে আর্টিফিসিয়াল ইয়েটা হয়, ওটায় ইয়ে হয়?
—মিনস? মানে?
—ভেজে?
হেসে উঠলেন ডাক্তার। ওটা তো আমারও প্রশ্ন ছিল। ঠিক এই প্রশ্নটাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওকে ফর মাই অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্ট।
ও খুব ফিলোজফিকাল উত্তর দিয়েছিল। বলেছিল, চোখের জলের মতো ভেজে। আনন্দাশ্রুর মতো ভেজে। তারপর বলেছিল, স্যর, এমনকী অন্তর আছে নারী-নরে? অন্তরে রয় যদি ধন…। হয়তো কিছুটা ফ্লুয়িড ক্ষরিত হয় প্রস্টেট থেকে। যে টিস্যুগুলো দিয়ে ভ্যাজাইনাল চ্যানেল করা হয়েছে ওরা তো ফ্লুয়িড তৈরি করতে পারে না…।
যাক গে, যেটা বলছিলাম। এত কাণ্ড করে অপারেশন করাল, কিন্তু ওর বয়ফ্রেন্ডের বায়না মেটে না। বলছে লাভ মেকিং-এর সময় ওর গলা থেকে ছেলেদের মতো শব্দ বেরয় বলে ওর নাকি লুজ হয়ে যায়। বোঝো।
এতক্ষণ পর পরি কোনও কথা বলল। ও জিজ্ঞাসা করল—শুধু ওই একটা কারণে ও ভয়েসটা চেঞ্জ করতে চাইছিল? নিজের কারণে নয়? নিজের কাছে ওর নিজের গলাটা ভাল লাগছিল?
ডাক্তাবাবু বললেন, দ্যাট্স এ গুড পয়েন্ট। ওর নিজেরও নিশ্চয়ই ভাল লাগছিল না, ও তো ওর ইন্ট্রোডিউসিং সেনটেনসেই বলেছিল আমার শরীরে একটা পুরুষের খোলস ছিল, ফেলে দিয়েছি ওটা। শুধু গলার স্বরটা ঠিক করে দিন।
যেটা বলার জন্য এত কথা। ব্যাঙ্ককের ক্লিনিকটার ঠিকানা আমিই দিয়েছিলাম ওকে। ও ব্যাঙ্কক গিয়েছিল। অপারেশন হয়েছিল। তারপর থেকে ও মাম।
মাম মানে? পরি প্রায় আঁতকে উঠে বলল।
কী আবার? কথা বলতে পারে না।
ফিরতে একটু রাত হল পরির। দোকান থেকে রুটি কিনে নিয়েছে। অন্যদিন ফ্ল্যাটের চাবি রাখা রিংটা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে ওপরে ওঠে। আজ রিংটা আঙুলে নিল না। ওর মাথায় কেবল অলোকাদি ঘুরছে। অলোকাদির গলা থেকে এখন যে শব্দ বের হয়, সেটা কি কেবল গোঙানি?
রুটি ক’টা খবর কাগজে মোড়ানো। কাগজের ওপর দেখল মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গয়না পরা ছবি। একটা পুরনো আনন্দবাজার পত্রিকা। ১৬ জুলাই ২০০৫। মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইন্টারভিউ। হেডিং—স্বামী আমার প্রতারক।
৬১
খাওয়া পরে হবে। আগে ‘ইন্টারভিউ’-টা পড়ে নেওয়া যাক। মানবীদি’র সঙ্গে যোগাযোগ নেই পরি-র। একদিন টেলিভিশনেও দেখেছিল একটা ইন্টারভিউ’-তে। বলছিল এফিডেভিট করে কীভাবে সোমনাথ থেকে ‘মানবী’ হয়েছে। ওর পিএইচডি-র রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে ‘মানবী’ নামে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে বাংলা সাহিত্যে ‘তৃতীয় সত্তা’-চিহ্ন বিষয়ে ওই গবেষণা। ইন্টারভিউ’তে মানবীদি ওর স্যরের কথা বলেছিলেন—একটাই শর্ত, যখন আমার কাছে আসবি, কানে দুল পরে আসবি না।
সেই ইন্টারভিউয়ের কয়েকটা কথা একটু-একটু মনে পড়ছিল। দৈত্যদের কবল থেকে অমৃত উদ্ধার করতে স্বয়ং বিষ্ণুকে মোহিনী বেশ ধারণ করতে হয়েছিল। এত রম্ভা-উর্বশী- মেনকা থাকতে খোদ ‘দেব-ডিরেক্টর’কে কেন মোহিনী বেশ ধারণ করতে হয়েছিল—প্রশ্ন তুলেছিলেন মানবী।
বিষ্ণুর মোহিনী-রূপ ধারণ নিয়ে যে নৃত্যধারা গড়ে উঠেছে, তার নাম ‘মোহিনী আট্যম’। মোহিনী আট্যমের সমস্ত পুরুষ শিল্পীদের নারী-সজ্জায় নাচতে হয়। ওড়িশি নৃত্যগুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের কেশবিরল মাথাটা বাদ দিয়ে দেহবিভঙ্গে অবাক হয়ে দেখতে হয় কী ম্যাজিকে একজন বৃদ্ধ লাস্যময়ী তরুণীর দেহপট গড়ে তোলেন। মানবী বলেছিলেন—সভ্যতা যত এগোবে নারী-পুরুষ সংজ্ঞার বৈষম্য ঘুচে গিয়ে, লিঙ্গ-বৈষম্য ক্রমশ লীন হয়ে গেলে ‘সমকামী’ শব্দটার কোনও মানে থাকবে? এরকম কথা যে বলেছেন, তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কেন এমন সস্তা হেডিং? একটু খারাপ লাগে পরি’র। রুটিটা আলাদা রেখে ভাঁজ করা কাগজটা টানটান করে। খবর কাগজের একটা পৃষ্ঠার অর্ধেক ছিঁড়ে রুটিগুলো ‘প্যাক’ করা হয়েছিল। ইন্টারভিউয়ের কিছুটা হয়তো বাকি অর্ধেক রয়ে গিয়েছে। খাওয়া পরে হবে। আগে পড়ে নেওয়া যাক। আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ জুলাই, ২০০৫।
.
‘পত্রিকা : শুনলাম সেক্স চেঞ্জ করে বিয়ে করেছিলেন?
মানবী : হ্যাঁ। কিন্তু জানেন… সে বড়ই বেদনার। কী সাঙ্ঘাতিক মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যে চলেছি গত দেড়টা বছর… বিশ্বাসঘাতকটা আমার শরীর-মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে… আমায় ভাসিয়ে চলে গেল!
পত্রিকা : বিয়ের কতদিনের মধ্যে?
মানবী : মাস দু’য়েকের
পত্রিকা : কিন্তু উনি তো জানতেন আপনি পুরুষ থেকে নারী হয়েছেন?
মানবী : খুব ভালভাবেই। ইনফ্যাক্ট, আমি যখন সেক্স চেঞ্জের দিকে এগোচ্ছি, তখন থেকেই ও আমার সঙ্গে। মানসিকভাবে ভীষণ সাহায্য করেছে।
পত্রিকা : তা হলে?
মানবী : সে অনেক কথা। বলতে গেলে…
পত্রিকা : বলুন না…
মানবী : আমি ঝাড়গ্রামে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকি। ওই বাড়িতে ওয়াটার ফিল্টারের একটা অফিস আছে। হঠাৎই শুনি ওই অফিস ঘরটা বড় হবে। সেই জন্য আমায় অন্য ঘরে চলে যেতে হবে। আমি কলেজে পড়াই। একা মানুষ। তবু বলামাত্র উঠে যাই সামনের ঘরে। এ দিকে আমার পুরনো ঘরে যে ভদ্রলোক এলেন, তিনি ওই অফিসের মালিকের সম্বন্ধী। নাম অভিজিৎ পাহাড়ি। এই অভিজিৎকে আমি বিয়ে করি।
পত্রিকা : বেশ তো, তারপর?
মানবী : আমার হাজব্যান্ডের ভগ্নিপতি প্রথমে আমাকে একদিন ডেকেছিল ওর ঘরে। ডাকটা অত্যন্ত কুরুচিকর। এখন বুঝতে পারছি, স্বয়ং মালিক আমায় ভোগ করতে চেয়ে পারল না বলে অভিজিৎকে মগজ ধোলাই করে আমাকে জব্দ করার প্ল্যান করল।
পত্রিকা : বুঝলাম না!
মানবী : আরে বাবা, ছোট থেকেই যেহেতু প্রতি মুহূর্তে উত্ত্যক্ত হয়েছি, ‘পীড়িত’ হয়েছি পুরুষের দ্বারা, আমি বুঝি ওই দৃষ্টির মানে… একটি মেয়েও বোঝে। তবে বুঝিনি তার দাম এভাবে দিতে হবে!
পত্রিকা : কিন্তু এ তো ভগ্নিপতির কথা। স্বামীর কথা কিছু বলুন।
মানবী : ওর কথা বলতে গেলে ওর ভগ্নিপতির কথা বলতেই হয়। কারণ, উনিই যত নষ্টের মূল… যাই হোক, স্বামীর সঙ্গে আমার পরিচয় ওই বাড়িতেই। প্রথমে আমরা পরস্পরকে দেখতাম, আমার অবাক লাগত, ভদ্রলোক ভগ্নিপতির আন্ডারে কাজ করে, দেড় হাজার টাকা মাইনে পায়… বাসন মাজে, ঘর ঝাড় দেয়—তো একদিন বলল, আপনাকে ডেমনস্ট্রেশন দেব, আমাদের ওয়াটার ফিল্টারের ব্যাপারে। ঠিক আছে… আসবেন সন্ধেবেলা। কিন্তু সেদিন এল না। সামনাসামনি ঘর। জিজ্ঞেস করলাম। বলল, শরীর খারাপ, কালকে ঠিক যাব। তবে সত্যি বলছি, প্রথম থেকেই অভিজিৎকে আমার ভাল লাগত, বেশ ভদ্র। ওর ভগ্নিপতির মতো ওর চোখে কোনও শিকারি দৃষ্টি দেখিনি। ওর চোখে দেখেছিলাম সুস্থতা… মানে যথার্থ এক পুরুষকে। কিন্তু ওমা! যেদিন ও বলল ‘কালকে’ যাব, সেদিনই রাত্রিবেলা, ওদের অফিসের চারজন হঠাৎ এসে আমায় বলে, আপনি আমাদের সহকর্মী অভিজিতের সঙ্গে প্রেম করছেন। আপনি তো আমাদের প্রডাক্ট নেন না। তা হলে ডেমনস্ট্রেশন নিচ্ছেন কেন? ভাবুন!
পত্রিকা : কেন এরকম বলল?
মানবী : কি জানি, হয়তো আমাদের দু’জনের এই ভাল লাগার ব্যাপারটা ওরা বুঝতে পারছিল।
পত্রিকা : তারপর?
মানবী : আমি খুব প্রতিবাদ করলাম। বললাম, কী ব্যাপার অভিজিৎ, এরা কী বলছে? ওমা, দেখি অভিজিৎ একেবারে সেদ্ধ ঢেঁড়স! ঘাড় গুঁজে, লজ্জা পেয়ে… পরদিন এসে আমাকে বলে কিনা, জোনাল অফিসে রটে গিয়েছে আপনার সঙ্গে আমার প্রেম। তাই ওরা আর আমাকে রাখবে না। আমিও ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দেব… বলেই ও ওর জীবনী বলতে শুরু করে। ওর কেউ নেই, সৎ মা, বাবা অল্পবয়সি এক মেয়েকে বিয়ে করেছে… বুঝলাম অভিজিৎ আমার কাছে সারেন্ডার করতে চাইছে। তা না হলে, সে আমাকে কেন দুঃখের কথা বলবে? তখন বললাম, আজ থেকে আপনি আমার বন্ধু হলেন… এরপর আমাদের সেই সম্পর্ক এমন তৈরি হল যে, ও না খেলে আমি খেতে পারি না। ও দিনের পর দিন না খেয়ে থাকত। ওকে আমিই খাওয়াতাম।
পত্রিকা : কিন্তু এই প্রেম চলাকালীন আপনার এই রূপান্তর নিয়ে ও কিছু বলত না?
মানবী : বলত। বলত, আপনি তো আর্টিফিশিয়াল নারী… কেন এটা হলেন? ওকে বোঝাতাম, সভ্যতাটাও তো আর্টিফিশিয়াল। না হলে তো গুহা ছিল প্রাকৃতিক, কী দরকার ছিল এত বড় বড় ম্যানসন তৈরি করার? আপনাদের ওয়াটার ফিল্টারও তো কৃত্রিম। প্রাকৃতিক জল খেলেই তো ভাল হত, তাই না? এ রকম নানা বিষয়ে তর্ক হত। ওর মস্তিষ্কে ঢোকাতে হত পৃথিবীর যে সুচারু, শিল্পিত জীবন, সেই জীবনটা আসলে কী।
পত্রিকা : আপনাদের এই কোর্টশিপটা কতদিন চলে?
মানবী : বেশি দিন না। ক’দিনের মধ্যেই আমরা বিয়ে করি।
পত্রিকা : কে কাকে প্রথম প্রেম নিবেদন করেছিলেন?
মানবী : ও-ই প্রথম করে। আমি বলি, আমার বিয়ে করার খুব ইচ্ছে। জীবনের সব কিছুই যখন হল, তখন বিয়েটা করতে অসুবিধে কোথায়? ভীষণভাবে একটা সংসার চাই।
পত্রিকা : শুনেই অভিজিৎ রাজি হয়ে গিয়েছিল?
মানবী : না। বলত তুমিও বিয়ে করবে না। আমিও করব না। আমরা একসঙ্গে থাকব। সেই রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরা, বিনয়কে যেমন বলেছিল। কিন্তু আমি কোনও দিন ভন্ডামি চাইনি। চেয়েছিলাম বিয়ে। কারণ, বিছানায় দু’টো শরীরকে আমি ভীষণভাবে রেসপেক্ট করি।
পত্রিকা : আপনাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল?
মানবী : ওমা, নিশ্চয়ই, আমাদের মধ্যে যখন শ্রদ্ধা আছে, প্রেম আছে, তখন যৌনতা থাকবে না? তা ছাড়া আমার যখন বুক্স, ভ্যাজাইনা, ম্যামরি গ্ল্যান্ডস তৈরি হল, সেইগুলো তো তৈরি হল ভোগ করার জন্যই। আমি তো ‘পথ’ তৈরিই করলাম সেখান দিয়ে ‘হাঁটা’র জন্য। আমার দেহ চাইছিলই সেই ‘জানলা-দরজা’গুলো খোলার জন্য। শরীরের মধ্যে একটা ছটফটানি ছিল, না হলে উন্মুক্ত হতে পারছিলাম না।
পত্রিকা : আপনাদের বিয়েটা কবে হল?
মানবী : আসছি, আসছি। পর পর বলছি। যখন ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিই…ও লিভ টুগেদারের প্রপোজাল দেয়…আমি বলি, দ্যাখো ভাই, লিভ টুগেদারের লোক অনেক পাব…আমি ভাল চাকরি করি, আর তোমার অবস্থা ভাল নয়…মানে খোঁড়ার সঙ্গে কানার বন্ধুত্ব। সে ক্ষেত্রে দু’জন সমব্যথী মানুষের বিয়ে করাটাই তো মঙ্গল। লিভ-টুগেদার করতে যাব কোন দুঃখে! পৃথিবীতে কি ছেলের অভাব?
পত্রিকা : তারপর?
মানবী : অভিজিৎ বলল, আমাকে কিছুদিন সময় দাও। তোমাকে জানাব। দিন-পনেরো পর বলল, আমি তোমাকে বিয়ে করব, মন ঠিক করে নিয়েছি। তারপরে আমরা একটা ঘরে গান্ধর্ব মতে বিয়ে করি। পরে রেজিস্ট্রি করব বলে দিন ঠিক করি।
পত্রিকা : তারিখটা কত ছিল?
মানবী : ২৩ অগাস্ট ২০০৩।
পত্রিকা : তারপর?
মানবী : রেজিস্ট্রি করার যেই কথা হল, তার দু’তিনদিন বাদে দেখলাম ওর ভগ্নিপতি এল। আমাকে, অভিজিৎ হঠাৎই বলল, ‘আমাকে যেতে হবে’। আমি বললাম, আমাদের যে রেজিস্ট্রি হওয়ার কথা? তখন ও একটি চিঠি লিখে যায়। লেখে, দিন পনেরো বাদে এসে আমরা রেজিস্ট্রি করব। কিন্তু তারপর আর ফোন করল না, কিচ্ছু না। এদিকে ভগ্নিপতি বাড়িওয়ালাকে উদ্দেশ করে একটা চিঠি লেখে, যার বিধেয় আমি। লিখেছে আমি নাকি বাড়িতে অসামাজিক কাজ করি। মানে পুরো গোলমাল পাকিয়ে দিল বাড়িওয়ালা আর ওর ভগ্নিপতি। এর পর বাড়িওয়ালা শুধু ওই চিঠিটা আমাকে ধরিয়েই দিল না, ওখান থেকে উচ্ছেদ করার জন্য শুরু করল অত্যাচার।
পত্রিকা : যদি রেজিস্ট্রি করতেন, তা হলে অসুবিধে হত না?
মানবী : কোনও অসুবিধেই হত না। আমি তো এখন গোটা এক নারীই। অসুবিধে ওর হত। আমাকে খোরপোষ দিতে হত।
পত্রিকা : আইনত এই নারী হওয়ার জন্য কী করতে হয়েছে?
মানবী : ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে গিয়ে অ্যাপ্লাই করতে হয়েছে। সেখানে মেডিকেল সার্টিফিকেট দিতে হয়েছে, যে ডাক্তাররা আমাকে মেয়ে তৈরি করেছেন, এরপর ওরা আমাকে ছাড়পত্র দিয়েছে। এবং সেটা কাগজে আমাকে ডিক্লারেশন দিতে হয়েছে।
পত্রিকা : পুরনো কথায় ফিরে আসি, আচ্ছা, এরপর অভিজিতের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগই হল না?
মানবী : হয়েছে। পরে আসছি। তবে এখন মনে হয়, ও প্রথম থেকেই ছক করেছিল। কেননা ওকে কেন্দ্র করে পুলিশ, বাড়িওয়ালার হুমকি, জল বন্ধ কী না সহ্য করেছি? বাড়িওয়ালা তার লোকজন দিয়ে আমাকে মারধর পর্যন্ত করল। সেই ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-তে তনুজাকে যেমন অসামাজিক মেয়ে হিসেবে অত্যাচার করা, তেমন। আমি ওখান থেকে পালিয়ে যাই। তবে প্রমাণ করতে চেয়েছি, আমি নারী, আমাকে মেরে কোথাও সরানো যাবে না। তখনই আমি উওমেনস কমিশন-এ আসি।
পত্রিকা : মহিলা কমিশনেও গিয়েছেন?
মানবী : হ্যাঁ। উওমেনস কমিশন’ আমায় নারী বলার পরে পরেই চিত্রটা বদলে যায়। আমার হাজব্যান্ড অভিজিৎ আমাকে ফোন করে। বলে, তুমি আমাকে একটা ফোন করলে না কেন? ও আবার ফিরে আসে আমার কাছে। এমনকী গত বছর রাসপূর্ণিমার দিন আমরা মেদিনীপুরের লজে থাকি। তখনই বুঝি ও আসলে চিটার। আমার থেকে আসলে জিনিস চায়। এটা দাও, ওটা দাও।
পত্রিকা : চিটার!
মানবী : এখন মনে হয়। কেন না ও সারাক্ষণ বলতে চাইত…
পত্রিকা : কী কী দিয়েছেন ওকে?
মানবী : অনেক কিছু। সে বলে আমি ছোট হতে চাই না। আসলে ওটা ছিল ওর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং… যাই হোক, ‘মহিলা কমিশন’ জাঁহাতক আমাকে সমর্থন করল, তখনই এস পি- টেসপি ওকে ঘিরে ধরল। এদিকে এই ইস্যু’ নিয়ে বাড়িওয়ালা যখন আমার ওপর অত্যাচার শুরু করল, আমি ঝাড়গ্রাম পুলিশ স্টেশনে গিয়ে দু’দিন অনশন করেছিলাম। ওমা, দেখি পুলিশ তখন গ্রেফতার করল বাড়িওয়ালার শালার ছেলেকে। বাড়িওয়ালাকে নয়। আমি অবাক হয়ে যাই, এই সমাজে মেয়েরা কী করবে?
পত্রিকা : আচ্ছা… তা মহিলা কমিশন কী করল?
মানবী : কী করল? স্বামীকে আজ একবছর ধরে ডেকে পাঠাচ্ছে, কিস্যু করতে পারছে না। তাদের সেভাবে কোনও ক্ষমতা নেই। মহিলা কমিশন কিছু ডি এম, কিছু এস পি, কিছু পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল। ডি এম, এস পি কী করছে? আমাকেই গিয়ে গিয়ে জুতোর সুখতলা খসাতে হচ্ছে। মহিলা কমিশনের মহিলারা প্রচুর হেল্প করছেন ঠিকই, কিন্তু কোনও ফ্রুটফুল জায়গায় পৌঁছতে পারছেন না।
পত্রিকা : আচ্ছা, আইনের একটা ৪৯৮এ ধারা আছে না…
মানবী : এই ধারার সাহায্য আমি পাব কেবল শ্বশুরবাড়ির ক্ষেত্রে। বাড়িওয়ালার ক্ষেত্রে এই আইনি সাহায্য আমি পাব না।
পত্রিকা : তা আইনের পথে আপনি আপনার অধিকার ফিরে চাইছেন না কেন?
মানবী : ঠিকই। আইনের পথে এখনও নামিনি। কিন্তু যেদিন মহিলা কমিশন বলবে, সেদিনই আইনের পথ ধরব।
পত্রিকা : আপনার সঙ্গে কি ওঁর সম্পর্ক একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে?
মানবী : কী বলব, ক’দিন আগেও এসেছিল। আমরা লজে থাকলাম। কিন্তু যেই বলছি, রেজিস্ট্রি না-করলে একটা পয়সাও আর দেব না, তখই বিগড়োচ্ছে। ফোঁস ফোঁস করছে। বলছে, “তুমি আমাকে একেবারে ফোন করবে না।’ আসলে ও বুঝে নিয়েছে ওকে আমি ভীষণ ভালবেসে ফেলেছি। সত্যিই খুব ভালবেসেছি। আমার ছাত্রীরা দেখেছে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি- দু’মাস পুরো কেঁদে কাটয়েছি। তখন থেকেই আমার সাইকিক ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছে। কারণ ওকে ছেড়ে থাকার কথা আমি ভাবতেই পারছি না।
পত্রিকা : আপনি শাঁখা-সিঁদুর পরেন নিয়মিত?
মানবী : ‘উওমেনস কমিশন’ বলেছে আপনি সিঁদুর শাঁখা ছাড়বেন না। কিন্তু অভিজিৎ কী বলে জানেন? বলে, “তুমি কি শাঁখা-সিঁদুর দিয়ে বিয়েটা প্রমাণ করতে চাও?’ আমি বলেছি, না, সম্পর্কটাকে প্রমাণ করতে চাই। আমার মনে হয় বিয়ে আর সম্পর্ক দু’টো আলাদা। মানে, আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক, সেটা সিঁদুর পরলে খুব কনস্ট্যান্ট। কিন্তু সিঁদুরে মেঘ দেখতে তুমি ডরাও, অথচ আমি সিঁদুর না-পরলে খুব ফ্রিলান্স একটা ব্যাপার থাকে… মজা… আসলে পুরুষ সব সময়ই মুক্ত বিহঙ্গ। সেই জন্য এত কিছুর পরেও বলতে পারে, ‘আমি বিয়ে করিনি’। আহা। তুমি যদি বিয়ে না-ই করো, তুমি তো রেজিস্ট্রির প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছ।
পত্রিকা : তার মানে! বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিয়ে করেনি? আপনাকে ঠকিয়েছে?’
.
বাকিটা নেই। আরও কিছু বলেছিল হয়তো…। যখন অভিজিৎ নামটা পড়ছিল পরি, তখন অরূপদার মুখটা ভেসে উঠেছিল একবার। চয়নের মুখটাও ভেসে উঠল, তক্ষুনি ভাসা-মুখটাকে ডুবিয়ে দিয়েছিল পরি। না, চয়ন ‘বিট্রে’ করবে না।
কোনও গ্যারান্টি আছে? কোনও ব্যাটাছেলেকেই বিশ্বাস করিস না পরি…। ঝাড়গ্রাম থেকে যেন বলে উঠল মানবীদি। পরি বলল অনেকদিন তো হল…। দেখছি তো চয়ন খুব কেয়ারিং।
—তোর থেকে টাকাপয়সা চায়?
—না-না, তেমন ধান্ধা নেই।
—ওর চিপ্টি-ভুখ আছে?
—কে জানে? সেটা তো বুঝতে পারি না। কোনও মেয়ের সঙ্গে ও খুব ‘ইনটিমেট’—এমন তো জানি না। ও আমাকে বেশ কয়েকবারই বলেছে ‘চিপটি’-তে ও খুব একটা মজা পায় না।
—একটা কথা বলি পরি, পুরুষগুলোকে বিশ্বাস নেই। পুরুষ জাতি ভ্রমর জাতি। এক ফুলে বেশিক্ষণ বসে না। তুই শিওর কোনও মেয়ের সঙ্গে ওর ইন্টু-পিন্টু নেই?
—কে জানে দিদি, আমায় তো কিছু বলেনি।
—একটা কথা জিগ্যেস করি। যখন ‘কড়ি সাতরা’-য় থাকিস, তখন বেশি আদর পাস, না কি…’নিহারন’ ড্রেসে …
—‘কড়ি সাতরা’ মানে ছেলেদের পোশাক বোঝাতে চাইছ তো?
—জানিস না? কাঁচা গেড়ে।
—ভাল বলেছ। টেস্ট করে দেখেছি। মেয়েদের পোশাক পরলেই যে ও বেশি এক্সাইটেড হয়—এমন নয়। আবার কড়ি ড্রেসে যখন থাকি, তখন যে অচ্ছেদ্দা-তাচ্ছিল্য করে এমনও নয়।
—শোন পরি। এখন না-হয় ফ্যাশন ডিজাইনার হয়েছিস। কলেজে তো বাংলা পড়েছিলি। ‘চিত্রাঙ্গদা’ পড়েছিলি তো, যদিও তোর সিলেবাসে ঢোকানো ছিল না।
—পড়ব না আবার?
—চিত্রাঙ্গদা অর্জুনকে দেখে প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু অর্জুন পাত্তা দেয়নি। কারণ চিত্রাঙ্গদার বাবা ওকে ছেলের মতো মানুষ করেছিল। চিত্রাঙ্গদা দেখতেও ততটা মেয়ে ছিল না। এজন্য ওকে ‘মদন থেরাপি’ করতে হল। ‘মদন থেরাপি’ মানে বুঝলি তো? মদনের কাছ থেকে রূপ- যৌবন ভিক্ষে করল। তারপর অর্জুন ওকে বলল “আই লাভ ইউ।’ মদন থেরাপি না-করে দ্যাখ তো ও কীরকম বিহেভ করে। পুরো ছেলেদের পোশাকে থাক। কখনও কাজল পরবি না। ওর সামনে বিড়ি খা। দ্যাখ না, টেস্ট কর না…
—‘মদন থেরাপি’ তো তুমিও করিয়েছিলে দিদি, এখন তো মদনদেবের ধ্যান করে ওঁকে আনা যায় না, প্লাস্টিক সার্জেনের কাছে যেতে হয়। তুমি কেন তবে সার্জনদের কাছ থেকে রূপ যৌবন ভিক্ষে করলে? ভয়ে?
—বড্ড কঠিন-কঠিন প্রশ্ন করতে শিখেছিস তুই। ভয়, মানে পাছে পুরুষমানুষ ভেগে যায় সেই ভয়? সত্যিকথা তী জানিস ভাই পরি, মনের ভিতরের একটা মন আছে, তার ভিতরে আর একটা মন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটা মনে পড়ছে রে…।
কালোগাড়ির ভিতরে আবার কালো গাড়ি
তার ভিতরে আবার কালো গাড়ি। সারবন্দী
জানালা দরজা, গোরস্থান ওলোট পালট কঙ্কাল
কঙ্কালের ভিতরে সাদা খুন। খুনের ভিতরে জীবন,
জীবনের ভিতরে মৃত্যু—সুতরাং
মৃত্যুর ভিতরে মৃত্যু।
আর কিছু নয়।
মানুষের মনের গহন কন্দরে কালো ঘরের ভিতরে আরও কালো ঘর—তার ভিতরে আরও। রূপকথার গল্পে দ্যাখ না সমুদ্রের তলায় একটা বড় গুহা, গুহার ভিতরে আরেকটা গুহা, তার ভিতরে একটা বাক্সো, বাক্সোর ভিতরে আরও একটা বাক্সো, তার ভিতরে ভ্রমরাটা। একদম ভিতরের কৌটোটায় যেটা আছে, সেটা হয়তো ভয়। কিন্তু ওটা স্বীকার করি না পরি। আমি বলি, আমি আমার শরীরের জঙ্গল ছাঁটার জন্য প্লাস্টিক সার্জেনের কাছে গিয়েছি—যেসব জঞ্জাল বিধাতার ভুলে আমার শরীরে রয়ে গিয়েছে। তুই বল না, একটা জ্যান্ত শামুকের খোলের ভিতরে কী থাকে? একটা শরীর থাকে তো? সেই শরীরটাকে কি একটা সেন্টের শিশির ভিতরে পোরা যায়? শামুকের শরীর শামুকের খোলের ভিতরেই ভাল থাকে। আমি নিজেকে মনে-প্রাণে একজন নারী মনে করি। কেন, আমার সত্তাটাকে একটা পুরুষ-খোলের ভিতরে রেখে দেব? পৃথিবীর প্রত্যেকটা রস্তুর জন্য উপযোগী ‘কনটেনার’ থাকে। টুথ পেস্ট-এর টিউব আর মরিচগুঁড়োর কৌটো আলাদা। জলের বোতলে মাখন থাকে না। একটা পুরুষ-শরীরে কেন আমার নারীত্বকে পুষব? নারীশরীর চেয়েছিলাম। আমি তাই আগাছা সাফ করে ফুলগাছ লাগিয়েছি।
—নারীশরীর মানেই বুঝি ফুল? পুরুষশরীর সুন্দর নয়? আমার বান্ধবী শিকস্তি মুম্বইতে থাকে, ডেভিডের ছবি দেখিয়েছিল। মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ভাস্কর্য ডেভিড। কী ইনোসেন্ট দৃষ্টি। ঠোঁটে কী আশ্চর্য সৌন্দর্য। ডেভিড একটা ন্যাংটো পুরুষ। ন্যাংটো নয় দিদি, নগ্ন বলতে হয়। পুজো করতে ইচ্ছে করছিল, চুমু খেতেও। শিকস্তির যা ইচ্ছে করছিল, আমারও তাই। শিকস্তি বলেছিল অরিজিনাল ভাস্কর্যটা ঘেরা, কিন্তু ওটার ‘কপি’ রয়েছে সারা পৃথিবীতে। পদতলে চুম্বনচিহ্ন…
—আমাদের কেষ্টঠাকুরই বা কম যায় কীসে রে? সিক্স প্যাক নেই বলে? তা খামোকা ডেভিডের কথাই বা উঠল কেন? তুই ডেভিড, অ্যাডাম, টম ক্রুজ, শাহরুখ যাকে খুশি চুমু খা গে যা। পারলে আমিও খাই। কিন্তু ওই শরীর আমি নিতে যাব কেন? ওটা কি আমি? আমি কি ওই শরীরে ঢুকব?
—না-না, ওসব ঠিক আছে। মেয়েদের শরীরটাকেই ফুলগাছ বলছিলে কিনা, তাই…।
—ওলো, বুঝেছি বুঝেছি। তোর পারিক-ও ফুলগাছ। ক্যাকটাস নয়। হল? তবে শোন, তোর দিদি হিসেবে, তোর চেয়ে বেশি পৃথিবীকে জানার অভিজ্ঞতায়, তোর ওয়েলউইশা হিসেবে একটা কথা বলে দি, তোর পারিক টাকে বেশি বাড়তে দিস না। ভালবাসবি ঠিকই, ভালবাসা, ভালবাসতে পারার প্রবৃত্তি ছাড়া মেয়েদের আছেটা কী, কিন্তু এমন ভালবাসা দেখাবি না যেন তুমি ছাড়া আমার জীবন পচা আলু। যেমন আধাবেকার আছে, ওকে তেমনই থাকতে দে। ভাল রোজগারপাতি করতে থাকলেই কাঁধে ডানা গজাবে। একটু পয়সা এলেই রক্ত চলাচল বেড়ে যায় ব্যাটাছেলেদের। তখন লিক্ম কড়কায় বেশি। বুঝলি রে ঢেমনি?
—তুমি এরকম করে বলছ কেন? তুমি না অধ্যাপিকা?
—তবে কি বলব ভর্তিখাদিকা? তৎসম শব্দপ্রয়োগে? জীবনে যা ঘা খেয়েছি, সব তৎসম ‘ক্যান্টাভারাস’ হয়ে গিয়েছে।
—তুমি খুব ভাল মানবীদি। জানি আমাকে খুব ভালবাস।
ভালবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাব
ভালবাসা পেলে আমি কেন আর পায়সান্ন খাবো?
ভালবাসা পেলে জানি সব হবে। ও আমাকে
ভালবাসে। ঠিক জানি। ভালবাসা পেলে আমিও
ফুল ফোটাব আমার শরীরে।
মানবীর সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথন এতক্ষণ হল। খাদ্য-মোড়ানো কাগজটা পড়ে আছে। রাত হল বেশ। পাশের ফ্ল্যাটের টয়লেটে ফ্ল্যাশ টানার শব্দ হল। সোয়া বারোটা নাগাদ এই জলশব্দ হয়। এটা প্রেম শব্দ। পোস্ট-লাভ সাউন্ড এফেক্ট। ও ফ্ল্যাটে নবদম্পতি।
মানবীদির সঙ্গে কাল্পনিক কথাবার্তা বেশ লাগল। এবার ওর সঙ্গে সত্যি-সত্যি কথা বলতে ইচ্ছে করল। ফোন নম্বরটা নেই। অনেক দিন যোগাযোগ নেই। সত্যি-সত্যি ওর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আজ থাক। ফোন নম্বর জোগাড় করা তেমন কোনও কঠিন কাজ নয়।
পরি নিজের শরীরে সার্জারি করার আগে একবার অন্তত মানবীদির সঙ্গে কথা বলে নেবে।
অলকাদির সঙ্গেও বলা যেত। কিন্তু ও যে আর কথা বলতে পারে না…!
.
অপারেশন করে সেক্স ‘চেঞ্জ’ করার কথা আগে ভেবেছে অনেক বার, কিন্তু মানবীর ইন্টারভিউ-টা পড়ার পর আরও পেয়ে বসল। ইন্টারভিউয়ের সঙ্গে যে-ছবিটা ছেপেছে, ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পরি। বেশ দেখাচ্ছে কিন্তু। ওই টুকরো কাগজটা ভাঁজ করে একটা ফাইলে রাখে, যেখানে ওর দরকারি কাগজপত্র আছে—মার্কশিট, সার্টিফিকেট, এবার আস্তে-আস্তে ওই ফাইলে জমা হবে আরও কাগজপত্র। ফাইলের নাম ‘পরিবর্তন’। ব্যাংকশাল কোর্টের এফিডেবিট বলে ‘আমি শ্রী পরিমল পাল শ্রীমতী পরি পাল নামে পরিচিত হইলাম…।’ এই ফাইলে থাকবে ডাক্তারের সার্টিফিকেট—যিনি ডিক্লারেশন দেবেন, ‘আমি ওর ভ্যাজাইনা বানিয়ে দিয়ে ওকে নারীচিহ্ন-সম্পন্না করেছি।’ ইলেকশন কমিশনে করা দরখাস্ত থাকবে। ‘আমি এফিডেবিট এবং সার্জারি-সূত্রে নারী হইয়াছি। সুতরাং আমার ভোটার কার্ডে স্ত্রী এবং F লেখা হউক।’ আরও কত রকম দরকারি কাগজে ভরে উঠবে ফাইল।
শুয়ে পড়ে পরি। এই ফ্ল্যাটে রাতে চয়নের সঙ্গে শুয়েছে বেশ কয়েক দিন। এখানে ও- বাড়ির মতো নারায়ণী মাসি সন্তুদা-মাস্তনদারা নেই। কেউ কারও ব্যাপারে উৎসাহী নয়। কিন্তু ও-বাড়িতে একটা জীবন বোঝা যেত। সকাল থেকেই কলতলার বালতির শব্দ, জলের ছ্যারছ্যার, কুকুরের ঝগড়া, জঞ্জালের ওপর কাকেদের আনন্দস্বর, অদ্ভুত সুন্দর মর্নিং টিউন। একটু পরই হাওয়া নিয়ে আসছে লঙ্কা পোড়ার ঝাঁঝ, কিংবা রসুনের গন্ধ। তারে ঝুলছে লুঙ্গি, গেঞ্জি, সায়া। জাঙ্গিয়াও ঝোলে, কিন্তু ব্রেসিয়ার গোপনে থাকে। পরিও গোপনে রাখত। কখনও ঝগড়া, কখনও গড়ানো জলের মতো ও-ঘরের এফএম, এ-ঘরের কাশির শব্দ ও-ঘর থেকে শোনা যেত, আহা রে, এখানে ওসব কিছু নেই। সব প্রাণহীন। কাঠ-কাঠ।
.
পরির ঘুম আসে না। মন ভাল নেই। মানবীদির জন্য কষ্ট হয়। অলোকাদির জন্য কষ্ট হয়। নৃসিংহ মণ্ডল কেমন আছে এখন—সেই আইআইটি-র ছাত্রটা? সেক্স চেঞ্জ করে কেমন আছে ও এখন? তিস্তা মিত্র ভাল আছে তো? টিভিতে দেখেছিল একবার। খুব সুন্দরী লাগছিল ওকে। গলার স্বরটাও পাল্টে ফেলেছে। অপারেশন না অভ্যেস? বিপাশা কেমন আছ গো তুমি? তুমি ও তো স্বর পাল্টেছ। শরীর পাল্টেছ। তোমাদের জীবনে কি ফুল ফুটেছে? আমি পরি। পরি পাল। আমিও ফুল ফোটাব। ফুল নিজের জন্য ফোটে না। তবে কার জন্য? ভোমরাদের জন্য? ওইসব অভিজিৎ পাহাড়িদের জন্য? সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আর ঋতুদা? তুমি কেমন আছো গো ঋতুদা? তোমায় যে কী চোখে দেখি তুমি জানো না। দূরের নক্ষত্রের যত তুমি। ছুঁতে পারি না, আলো দেখি। তুমি তো কিছু বলো না, মানবীদি যেমন সব বলে দেয়। কিন্তু তুমি আমাদের মনে সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছ—তুমি জানো না। ভালো আছো তো? আমাদের জন্যই ভালো থেকো…ঘুম আসছে না। আয় ঘুম, আয়। মা, ও মা, আমায় ঘুম পাড়িয়ে দাও। জল হয়ে, ছায়া হয়ে আমার পাশে এসো। কী ভাল তুমি মা, এসে গিয়েছ? আমি ঘুমোব। একবারও বলব না মা আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে। বরং বলছি তুমি আমাকে আর একবার জন্ম দেবে না মা? আমি নতুন করে তোমার ভিতরে জন্ম নেওয়ার জন্য মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করতে পারি। আমি আজ মৃত্যুর ভিতর থেকে তোমার রক্তের মধ্যে প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য জন্মকে আলিঙ্গন করছি।
আমি পরি। আমার কাঁধে ডানা গজাল। রাখাল পরির পাল লয়ে যায় মাঠে। কালের রাখাল? কেমন ঝাপসা যেন। কুয়াশা-মোড়া। অস্পষ্ট। সদ্য ডিম ফুটে বেরনো পাখি-ছানার মতো ডানা ঝাপটাচ্ছি আমি, ডানা ঝাপ্টানোর শব্দে মা-মা ধ্বনি। টলতে টলতে কালের রাখালের পিছনে পিছনে আমরা যাচ্ছি টালমাটাল পায়ে। মানবীদি, অলোকাদি, তিস্তা, বিপাশা, আমি। কোথায় যাচ্চি? কত বড় বিক্ষত প্রান্তর আমাদের সামনে। চুনাপাথরের খাদ। সেই কুয়াশা-মোড়া ঝাপসা রাখাল কাথায় যাচ্ছে? আমরা ওর পিছন পিছন…।
ফ্ল্যাটবাড়িতে সকাল হয় মোবাইল অ্যালার্মে। ছ’টায় অ্যালার্ম বাজলে ছ’টাতেই সকাল, সাতটায় বাজলে সাতটায়। আটটায় বাজলে আটটায়। সাতটায় বেজেছে আজ। চা খাবে প্রথমে। তারপর একটু কাগজ পড়া, ব্রেকফাস্ট এবং অফিস। দরজার গোড়ায় খবরের কাগজটা পড়ে আছে।
কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে বোমা ফেটেছে, সিপিএম বলছে আমেরিকার সঙ্গে নিউক্লিয়ার চুক্তিতে কিছুতেই সায় দেবে না, দরকার হলে সমর্থন উঠিয়ে নেবে। ঝাড়খন্ডে ল্যান্ড মাইন ফেটে একটা পুলিশের জিপ : এরই ফাঁকে একটা খবর ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে নাজ ফাউন্ডেশনের পিটিশন দিল্লি হাই কোর্ট গ্রহণ করল।
সেই ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারা। যার ভয় দেখিয়ে রতনের সঙ্গে গল্প করার সময়, সুখ-দুঃখের কথা বলার সময় পুলিশ ধরেছিল। যে ধারা পশুমেহনের সমান অপরাধে অপরাধ করে সমকামীদের। যদি পরস্পরের সম্মতিতেও দু’টি পুরুষ শরীরে যায়। আইনের চোখে সেটা দণ্ডনীয়। মুম্বইয়ের নাজ ফাউন্ডেশন ২০০১ সালে একটা জনস্বার্থ মামলা করেছিল দিল্লি হাইকোর্টে। ২০০৩ সালে এই মামলাটা ফিরিয়ে দেয়। সলিসিটার জেনারেল পিপি মালহোত্রা বলেছিলেন হোমোসেক্সুয়ালিটি হল সোশ্যাল ভাইস। সামাজিক পাপ। কিন্তু ২০০৬ সালে ঔপন্যাসিক বিক্রম শেঠ একটা বড় লেখা লিখলেন। বললেন, মানুষের পছন্দ- অপছন্দ মানুষের। যৌনসঙ্গী নির্বাচনেও স্বাধীনতা থাকা উচিত। দিল্লিতে তখন ইউপিএ সরকার। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবুমনি রামদস। উনি বিক্রম শেঠকে সমর্থন করলেন। ভারত সরকার স্বাস্থ্য দপ্তর ৩৭৭-এর সংশোধনী আনতে সায় দিলেও বিরোধিতা করল স্বরাষ্ট্র দপ্তর।
এর মধ্যে নাজ ফাউন্ডেশন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করল। ২০০৩ সালে ফিরিয়ে দেওয়া পিটিশনটা যেন আবার গ্রহণ করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি হাইকোর্টকে বলেছিল আবেদনটা পুনর্বিবেচনা করার জন্য গ্রহণ করতে।
আজকের খবর হল সেটা। শুনানি শুরু হবে আবার। নিশ্চয়ই LGBT-রা আনন্দ করছে। দিল্লি-মুম্বইতে বাজি ফাটবে।
খবরটা ভালই লাগল। চায়ের সঙ্গে ভালই গেল। কিন্তু পরি ভাবল—সমকামীরা একসঙ্গে নিশ্চিন্তে শোবে, এটা আর অপরাধ বলে গণ্য হবে না, তাতে ওর কী? ও তো মেয়েই।
মহা মুশকিল। মেয়ে বললেই মেয়ে? একটা জনন অঙ্গ ঝুলছে না? মেয়েদের ওই অঙ্গ কি ঝোলানো থাকে? ওই জন্যই তো কেটে ফেলা। ওই জন্যই তো অপারেশন। রিঅ্যাসাইমেন্ট সার্জারি।
যখন বাংলা অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রসদনে আড্ডা মারত, তখন অন্য একটা জীবন ছিল। কেমন একটা খেলা ছিল। রতন-টতনরা গোপনে টুক করে লেডিস টয়লেটে বাথরুম করে এসে ভাবত কিছু একটা জয় করে এসেছে। পরিও কি যায়নি?
শেয়ালদা স্টেশনে লেডিস বাথরুমে গিয়েছে—মহিলারাই হাই হাই করে উঠেছে। হিজড়েদের কিন্তু কিছু বলে না। ওরা শাড়ি পরে কিনা। সালোয়ার কামিজ পরা অবস্থায় দু’একবার ট্রাই করেছে, কিছু অসুবিধে হয়নি। পরির অফিসে এ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। যে কোনও টয়লেটেই যেতে পারে। ছোট অফিস, ছোট দু’টো টয়লেট। টয়লেট তো বলে না, ওয়াশরুম। মেয়েদেরটাতেই যায়। দরকার হলে ছেলেদের ওখানেও যেতে পারে। বসেই করতে হবে এমন নয়। রাস্তাঘাটে হিসি পেয়ে গেলে তো পেইড পাবলিক ইউরিনালে দাঁড়িয়েই কাজটা সেরে ফেলে। ওসব কেটে ফেললে আর দাঁড়িয়ে হবে না। না হোক গে।
ভাল প্লাস্টিক সার্জেন খুঁজতে হবে। চেনাজানা কেউ নেই। ভেবেছিল যারা করেছে ওদের কাউকেই জিজ্ঞাসা করে ডাক্তারের খোঁজ নেবে। গত কালকের ইন্টারভিউটা পড়ে মানবীদিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে হল।
এখন ওর নতুন মোবাইল। কত দামি। আগের সিম কার্ডের সব নম্বরগুলো সব কপি হয়েছে তো? মোবাইলে সার্চে দেখল মানবীদির নাম ফুটে উঠেছে। এখন করা যায়? আজ ভাল দিন। দিল্লি হাইকোর্টে মামলার শুনানি হবে। সব গে গুলো নিশ্চয়ই এমএমএস করে তুলকালাম করছে। একটা ফোন মানবীদিকে করাই যায়।
—গুড মর্নিং মানবীদি। আমি পরি। চিনতে পারছ?
—পরি? কবিতা লিখতিস?
—হ্যাঁ।
—লিখিস এখন? শুনেছি ফ্যাশন ডিজাইনার হয়েছিস?
—কতটা ডিজাইনার হয়েছি জানি না। ওই লাইনে কাজ করি।
—খুব ভাল করেছিস। আমাদের কাজে অনেক হ্যাপা পোহাতে হত। ডিগ্রিধারী হলেই যে শিক্ষিত হয় না, সেটা প্রতিটি পদক্ষেপে বুঝতে পারি। অস্পৃশ্যতা শুধু হাতের কারণে হয় না, শরীরের কারণেও…যাকগে। বল কেমন আছিস?
—কাল তোমার একটা ইন্টারভিউ পড়লাম। যদিও পুরনো, তিন বছর আগেকার। তবে কালই হঠাৎ করে পেলাম। তুমি যে সবার নাম-ধাম করে দিলে ঝামেলা হয়নি?
—হয়েছে তো। মানহানির মামলা করে দিয়েছিল আমার বিরুদ্ধে।
—তারপর?
—চলছে।
—মহিলা কমিশনে গিয়েছিলে?
—গিয়েছিলাম তো।
—তোমায় মহিলা বলে স্বীকার করে তো?
—করবে না মানে?
—কলেজে?
—একটু ঝামেলা তো আছেই। সোমনাথ নামে এমএ, মানবী নামে পিএইচডি করছি। আগের নামের আগে ছিল শ্রী, পরে শ্রীমতী। যতসব গণ্ডগোল পাকিয়ে রেখেছি। লেগে আছি। ঠিক করে নেব।
—বলছি কি, দিল্লি হাইকোর্ট তো আবার নাজের মামলাটা নিচ্ছে।
—তাই নাকি? কাগজ পড়িনি এখনও।
—কোথায়?
—বাড়িতে। বাবার শরীর খারাপ। বাবাকে দেখছি। বাবা বলছেন ভাগ্যিস তুই মেয়ে হয়েছিস, ছেলে থাকলে তো বউ নিয়ে চলে যেতিস। কে দেখত আমায়?
—তোমার মেয়ে হওয়া বাবা মেনে নিয়েছেন?
—খুব ভালভাবে। আমার আগে দিদিরা ছিল। আমার জন্মের পর নুঙ্কু দেখে বাড়িতে খুব শাঁখ বেজেছিল। তারপর আমার মেয়েলিপনায় মা-বাবা সবারই মন খারাপ ছিল। আজ বাবা বলছে ভাগ্যিস তুই মেয়ে হয়েছিস।
পরি এবার অনেকটা শ্বাস নিয়ে বলল, দিদি, আমিও অপারেশন করাব। একটু ব্যবস্থা করে দেবে? তোমার ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো না একবার…।
মানবী বলল—তা তো নিতেই পারি। প্রথমে একতলাটা করবি, নাকি দোতলা?
কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল শব্দের ব্যঞ্জনা বোধগম্য হতে। পরি বলল প্রথমে দোতলাটাই করি না হয়…।
৬২
মানবীর কাছ থেকে ফোন নম্বর পেয়ে সার্জেনের কাছে গেল পরি। পরির পেশার কথা শুনে বললেন, দিব্যি তো আছেন। কেন আবার এসব ঝামেলায় যাচ্ছেন?
পরি বলেছিল, আমি আমাকে আমার স্বমূর্তিতে দেখতে চাই। আমি তো মেয়ে, কেন পুরুষশরীর বহন-করে বেড়াব? আমি অন্তরে নারী, বাইরেও নারী হতে চাই স্যর, পূর্ণ নারী…
পরির কথা থামিয়ে ডাক্তার খান্না বললেন, একটা খোপের মধ্যে থাকতেই হবে? হয় পুরুষ, নয় নারী? কী দরকার? প্রফেশনে খুব কি অসুবিধে হচ্ছে?
পরি বলল, না, তেমন কিছু নয়।
—তা হলে? আপনি হুট করে কোনও ‘ডিসিশন’ নেবেন না।
—ভাবুন।
—অনেক ভেবেছি আমি।
ডাক্তারবাবু বললেন, আপনি নিজে ভাবলে হবে না। ভাল সাইকোলজিস্টের কাছে যান, ‘সিটিং’ নিন। আপনার মনটা ওরা ঠিকঠাক স্ক্যান করতে পারবেন। স্ক্যানিং মেশিনে শরীরের ভিতরের অর্গ্যানগুলো দেখা যায়। মন বোঝা যায় না। মনের ভিতরে অনেক বুদবুদ থাকে, ওরা ওসব বুঝতে পারেন কিছুটা। শুধু ‘স্টেটাস’ বাড়ানোর জন্য সার্জারির মধ্যে যাবেন না।
স্টেটাসের সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক? পরি কপাল কোঁচকায়।
—আছে, আছে। অনেকে গাড়ি কিনে ফ্যালে পাশের বাড়ির গাড়ি আছে বলে। তার নিজের হয়তো তেমন ‘ইউটিলিটি’ নেই। আপনি যে-অপারেশন চাইছেন, সে-অপারেশন আমি বেশ কিছু করেছি। অপারেশনের পর অনেককেই দেখেছি খুব ডিপ্রেস্ড হয়ে গিয়েছেন। খুব ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ হয়। এখন যে ক্রাইসিস আছে তার চেয়ে অনেক বেশি। গাছ-পাকা ফল আর কার্বাইডে পাকানো ফলে তফাত আছে না? কাৰ্বাইডে পাকানো আমকে আম পাব্লিক কি ভাল চোখে নেয়? যদিও নিজের বাগান ছাড়া গাছ-পাকা ফল পাওয়াই যায় না। এমনি মেয়ে আর সার্জিক্যাল মেয়ের তফাত আছে না? নারীসমাজের মধ্যেও ওরা ‘এলিয়েন’, পুরুষসমাজও ওদের নেয় না। ‘টোটাল সোসাইটি’-ও হ্যাটা করে। শুধু এদেশেই যে এমন হয় তা-ই নয়, বিদেশেও। পোস্ট রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির সুইসাইডাল স্ট্যাটিস্টিক্স জানো? আমেরিকাতেই টোয়েন্টি সেভেন পার্সেন্ট। অপারেশনটা করলে ট্রান্সসেক্সুয়াল-ট্রান্সজেন্ডার সমাজে হয়তো নিজের কদর বাড়ানো যায়। থাকগে, অনেক ‘পেশেন্ট’ বসে আছে বাইরে। আমার সাজেশন হল—কোনও সাইকোলজিস্টের সঙ্গে কনসাল্ট করুন, তারপর একটা সার্টিফিকেট নিয়ে আসুন। তা ছাড়া, আমার হাতে এখন অনেক কাজ, আমি তো শুধু এসবই করি না, আরও নানা ধরনের কাজ করি। আপনার কাজটা করব কি না জানি না। আমিও ভেবে- টেবেই করব। যদি করি, অপেক্ষা করতে হবে।
‘নমস্কার’ জানিয়ে চেম্বার ছাড়ে পরি। বড় ডাক্তার, প্রায়ই বিদেশে যান। কেতাই আলাদা। এটুকু সময় দিয়েছেন—তাই ঢের। ব্যাগ থেকে পার্স-টা বের করেছিল পরি, ডাক্তারবাবু বললেন—না, থাক।
এসব সার্জনদের জন্য মনে-মনে বহু দিন ধরে শ্রদ্ধা-ভক্তি পুষে রেখেছে পরি, সেই কবে থেকে। এঁরা ম্যাজিশিয়ানদের চেয়েও বড় ‘ম্যাজিশিয়ান’। ঈশ্বরের কাছাকাছি। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি করতে পারেন এঁরা। ঈশ্বর যেমন সৃষ্টি করেন, পালন করেন, বিনাশ করেন, এঁরাও তো তাই। পরির ক্ষেত্রে সিরিজ-টা না-হয় একটু পাল্টে যাচ্ছে। আগে বিনাশ, তারপর সৃষ্টি, তারপর পালন। নিনা নামে একজন মডেল আছে, ও বলেছিল, ওর নাকটা তৈরি করা। অসাধারণ নাক। বাঁশির সঙ্গে কেন উপমা দিয়েছে সংস্কৃত শাস্ত্রে কে জানে? নাকের সঙ্গে ঝাঁশির কিছুই মেলে না। কমলালেবুর কোয়ার সঙ্গে ঠোঁটের উপমা দেওয়া যায়, চেরা পটলের সঙ্গে চোখ তবুও চলে যায়, মুক্তোর সঙ্গে দাঁত ঠিক আছে। কিন্তু বাঁশির সঙ্গে নাক এক্কেবারে যায় না। নিনার নাকি আগে থ্যাবড়া নাক ছিল। মডেলদের মধ্যে কয়েকজনের ব্রেস্ট অগ্মেন্টেড। ওরা তো আর বলে না, ও জানে। এই সার্জেনরা হল সুশ্রুতদের বংশধর। এঁরা সব গণেশের কাঁধে হাতির-মাথা-বসানো লোক। চেম্বার থেকে বেরনোর সময় টেবিলে হাত ঠেকিয়ে টক করে কপালে ঠেকাল পরি। বাইরে বেরিয়ে দেখল কত মানুষ বসে আছে। কারও ঠোঁট মাঝখান দিয়ে চেরা, কারও মুখ-গলা-হাতের চামড়া কুঁচকে রয়েছে—পুড়ে গিয়েছে হয়তো। সুগন্ধ ছড়ানো এক প্রৌঢ়াকেও দেখল। মুখটা যেন চেনা। টিভির কোনও সিরিয়ালে দেখেছে হয়তো। শাড়ির আঁচলে গলাটা ঢাকা। হয়তো গলার কুঁচকে যাওয়া চামড়াকে টানটান ত্বক বানাবে। চামড়া আর ত্বকের পার্থক্য কী? কার যেন একটা পদ্যে ছিল : ‘যুবতী পোশাক আঁট, যখনই তা ঢিলা সংজ্ঞা পাল্টে তিনি হলেন মহিলা।’ ওটারই অনুকরণে বলা যায় ‘চামড়া মলিন বড়, যখন চকচক, চামড়া পাল্টে গিয়ে হয়ে যায় ত্বক।’ পরি ভাবে, ওর মায়ের চামড়া কোনও দিনই ত্বক হয়ে ওঠেনি। রোদ্দুরে বেরনোর সময় কতবার বলেছে, ‘সানস্ক্রিন’ মেখে বের হও মা, এনেও দিয়েছিল, মা মাখত না, খরচা হয়ে গেলে আবার আনতে হবে… অনেক তো দাম…পরি মাখুক পরির চামড়া এখন ‘ত্বক’। ও জানে। পরি শশার রস মাখে, গোলাপ জল মাখে, মুলতানি মাটি আর মধু-মেশানো পেস্ট দিয়ে স্কিনের ড্রাই সেল ‘স্ক্র্যাব’ করে। সেই প্রৌঢ়ার পাশে কে বসে আছে? তৃপ্তি না? সেই কলেজের তৃপ্তি। হ্যাঁ, তৃপ্তিই তো। অ্যাথলেট। একটু মোটা হয়েছে। মুখটাও যেন একটু চৌকো মতো লাগছে। ঠোটের ওপর একটা হালকা গোঁফের রেখাও।
তৃপ্তির কাছে গিয়ে দাঁড়াল পরি। কি রে? চিনতে পারছিস না?
তৃপ্তি বলল, আমি তো তোকে চিনতে পেরেছি। কিছু বলছিলাম না, দেখছিলাম, তুই আমাকে চিনতে পারিস কি না।
—কত দিন পর দেখা, তাই না? আমাকে চিনতে পেরেছিলি?
তোকে চিনতে পারব না? তোকে ভোলা যায়? তৃপ্তি বলে।
পরি হাতছানি দিয়ে তৃপ্তিকে অন্য দিকে ডেকে নেয়। এই হাতছানির মধ্যেই নিহিত ছিল ‘প্রাইভেট কথা আছে’—যে-কথা সখীর সঙ্গে হয়।
তৃপ্তি উঠে আসে।
ওই ভদ্রমহিলা তোর সঙ্গে এসেছে? পরি জিগ্যেস করে।
ভদ্রমহিলা কি রে? মালবিকা রায়। তবুও সিঁদুরের’ বড় পিসি। আমার সঙ্গে আসেনি, পাশে বসেছে।
—তুই খেলাধুলো ছেড়ে এখন এসব সিরিয়াল দেখিস না কি?
—আর বলিস না।
—তোকে যদিও অনেক দিন পরই দেখলাম এখানে, কিন্তু তোর ছবি দেখেছি কাগজে। ন্যাশনাল অ্যাথলেটিক্স না কীসে যেন দু’-তিনটে গোল্ড পেয়েছিলি…।
—না, একটা গোল্ড, দু’টো সিলভার। তারপর তো রেল-এ চাকরি পেয়ে গেলাম।
—রেলে চাকরি করিস? কী মজা। খুব ঘুরিস?
তৃপ্তি বলল, এখানে ফিসফিস করে কথা বলতে ভাল লাগছে না। বাইরে চল। আমার দেরি আছে। আমি এগারো নম্বর। সবে তিন চলছে, বাইরে বেরিয়ে তৃপ্তি পরি’র হাত চেপে ধরে।
এই তৃপ্তির সঙ্গে কলেজে খুব ভাব হয়েছিল ক’দিন। দু’জনে দু’জনের প্রাইভেট কথা বলেছিল। পরি ছিল ঠিকঠাক-ছেলে-না, তৃপ্তি ছিল ঠিকঠাক-মেয়ে-না। পরি আর তৃপ্তি দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ছিল আলিঙ্গনে। তৃপ্তি বলেছিল, পরি+তৃপ্তি কী হয়? তৃপ্তি নিজেই উত্তর দিয়েছিল—’পরিতৃপ্তি’। তৃপ্তির বাড়িতেও গিয়েছিল পরি। ওর বাবা সংস্কৃত পড়ান। ওর বাবা বলেছিল—কি করে, এই সত্ত্বঃগুণসম্পন্ন পরিবারে রজঃ এবং তমোঃ গুণসম্পন্না কন্যা জন্মাল কে জানে? নারীসুলভ কোমলবৃত্তির বড়ই অভাব। তৃপ্তি পরি’কে দেখিয়ে ওর বাবাকে বলেছিল, এই পুত্রটিরও পুরুষসুলভ কঠিন বৃত্তির বড়ই অভাব। তৃপ্তির মা বলেছিল, তা হোক গে যা…। সোনার আংটি আবার ব্যাঁকা হয় না কি? তৃপ্তি পরে বলেছিল, সোনার আংটিটার মানে আসলে কী বল তো? ল্যাওড়া। ওটা তো আবার একটু বেঁকাই হয়, তাই না? তুই তে অনেক দেখেছিস। পরি ‘যাঃ অসভ্য’ বলে তৃপ্তিকে ধাক্কা দিয়েছিল…।
তৃপ্তি এই প্লাস্টিক সার্জেনের কাছে এসেছে কেন? পেটের ভিতরে ইউটেরাস বসাতে? তৃি তো বলেছিল, ওর ইউটেরাস নেই, ওর মেন্স-ও হয় না। ও বলেছিল, ওর ছোট্ট একট ভ্যাজাইনা আছে। প্যাসেজ-টা খুব ‘ন্যারো’। ও কি প্যাসেজ বড় করাতে এল?
পরি জিগ্যেস করল, তোর এখন মেন্স-টেন্স হয়?
তৃপ্তি বলল, ধুর, ওসবের বালাই নেই। ভাগ্যিস ওসব হয়নি, ইচ্ছেমতো প্র্যাকটিস করে পেরেছি। দেখি তো অন্য মেয়েদের, মাসে ক’টা দিন কেলিয়ে থাকে। কারও কোমর ব্যথ কারও তলপেট টনটন করে, আমার ওসব বালাই নেই, বেঁচে গেছি।
—এখনও খেলিস?
—হ্যাঁ, খেলব না কেন? রেলের হয়ে খেলি তো। রেল-কে দু’বার মেডেল এনে দিয়েছি গতবার কিছু পাইনি। আমাকে কোচ করে দেবে।
অ্যাথলেটিক্সের কোন-কোন ইভেন্টে ও এক্সপার্ট—তার ডিটেল জানে না পরি। এমি দৌড়, মানে রেস ছাড়াও হার্ডল রেস না কি যেন বলে, সেটাও দৌড়য় তৃপ্তি। হার্ডল রে বোধ হয় লাফিয়ে-লাফিয়ে দৌড়। বোধহয় লোহার বলটল ছোড়ে। কলেজে তো ব্যাডমিন্টন ও খেলত ছেলেদের সঙ্গে।
কোথায় তোর অফিস রে? পরি জানতে চায়।
—ওই তো, স্ট্র্যান্ড রোডের লাল বাড়িটায়। কাজ তেমন কিছু নেই
পরি ওর পড়াশোনা আর কাজের কথা বলল।
দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল, বরং বলা ভাল দৃষ্টিবর্ষণ করল, যে-দৃষ্টি ভালবাসায় ভেজ যে-ভালবাসা শুভেচ্ছা জড়ানো। তৃপ্তি পরি’র দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলেছিল। হ্যাট্স অ গুরু। পরিও তৃপ্তিকে ওই কথাটাই বলতে চেয়েছিল। আসলে দু’জনই দু’জনের সাফল্যে খুশি হয়েছিল। দু’জন লিঙ্গ-পরিচয়ের সংকটে থাকা মানুষ। শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়াতে পারাটা শেয়া করল ওরা।
পরি দেখল, যেন কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠছে সাকসেসফুল। সাফসেসফুল। ওঁ ‘ওয়ার্ড’-টার ফন্টগুলো বড় হচ্ছে। ওর যেন মনে হল আকাশ থেকে কুচো কাগজ পড়ছে রঙিন। ওই কাগজে লেখা ‘কনগ্র্যাচুলেশন’। আগে এরকম অনুভূতি হয়নি। এই মেয়েটা সামনে এসে এরকম মনে হল ওর। ওরা দু’জন দু’জনের ফোন নম্বর নিল।
তৃপ্তি জিগ্যেস করল, তোর সেই চয়ন কি এখনও আছে?
পরি যেন একটু ব্রীড়াভঙ্গি করল। ঈষৎ ভ্রুকুটি-তে বলল, কোথায় যাবে?
—গুড। ভেরি গুড।
—আর তোর কী ব্যাপার?
—পরে বলব। দেখা হবে তো এবার থেকে। অনেক কথা আছে।
তৃপ্তি কেন এই সার্জেনের কাছে এসেছে নিজে থেকে বলেনি কিছু। পরি-ও জিগ্যেস করেি কিছু। এ ব্যাপারে পরিকেও জিগ্যেস করেনি কিছু তৃপ্তি। তৃপ্তি কেন এল এখানে? ওর সেদিনে কথা মনে পড়ে। তৃপ্তি বলেছিল, ‘আঙুল দিয়ে দেখবি, প্যাসেজ-টা কি খুব ছোট?’ ও কি ‘প্যাসেজ’ বাড়াবে? ইউটেরাস তো লাগানো যায় না। কোথাও-কোথাও নাকি চেষ্টা হয়েছিল— অন্যের জরায়ু প্রতিস্থাপনের। ফেল করেছে। যদি সম্ভব হত পরি-ই হয়তো বসানোর কথা ভাবত। পরির জানতে ইচ্ছে করছিল তৃপ্তিও কি অপারেশনের জন্য এখানে এসেছে। তার আগে নিজের কথাটা বলা উচিত। পরি বলল—আমি এখানে এসেছিলাম এসআরএস-এর ব্যাপারে জানতে।
—’এসারেস’? ওটা কি আবার? বাংলায় বল।
পরি বলল, ‘সেক্স রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি’। বলেই মনে হল ডাক্তারবাবু ঠিকই বলেছিলেন—এটা যেন সোশ্যাল আপলিফ্টমেন্ট। স্টেটাস বাড়ানো। ‘এসআরএস’ করাচ্ছি বলাটা যেন ‘হাইল্যান্ড পার্কে ফ্ল্যাট বুক করেছি’ বলার মতো।
—বললাম, না বাংলায় বলতে, এত ইংরেজি ছাড়ছিস কেন?
—ওই তো মেয়ে হওয়ার অপারেশন। বুঝ বানাবো, পুসি বানাবো…।
—আবার ইংলিশ। কাঁচা বাংলায় বল না—ম দিয়ে, গ দিয়ে…।
—তুই বল।
তৃপ্তি কাঁচা বাংলায় স্ল্যাং বলে, উইথ অঙ্গভঙ্গি। পরি মজা পায়।
—আর তুই কি বাড়াতে এসেছিস? ফুটো?
—না আমি বানাতে এসেছি।
—কী?
—দু’অক্ষরের নাম তার রান্নাবাড়ায় থাকে, এমনিতে শান্তশিষ্ট, মাঝে-মধ্যে রাগে।
বুঝলি কিছু?
পরি মাথা চুলকোয়। বলে, ও, বুঝেছি।
তৃপ্তি বলে হ্যাঁ রে…। অনেক কথা আছে তোর সঙ্গে। অপেক্ষা করবি একটু। তৃপ্তি ঘরে গিয়ে জেনে আসে এখন ছয় নম্বর চলছে।
পরি ঘড়ি দেখে। বেলা পৌনে বারোটা। অফিস যেতে হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
পরি বলে আজ আর নয়। আমার ফ্ল্যাটে আয়। ফ্ল্যাট নিয়েছি।
সত্যি? তৃপ্তি খুশি হয়। বলে, একদিন সারাদিন। কেমন?
অফিসে ঢুকল পরি। ট্যাক্সি নিয়েছিল। ট্যাক্সি থেকে নেমে দরজা বন্ধ করার সময় যে-শব্দটা হয়, সেই শব্দটা উপভোগ করে পরি। সেই শব্দ ও গায়ে মাখে। এই শব্দটা ওর মায়ের গায়ে মাখাতে পারেনি। এরকম আরও কত শব্দ, যা ছিল দূরের, যেমন ডিওডরেন্ট স্প্রে করার লম্বা শব্দ, যা বিজ্ঞাপনে থাকে। আগেও এই শব্দ পেয়েছে, বড় কৃপণ ছিল সেই শব্দ, মুহূর্তের মাত্র, একবার টিপেই হাত উঠিয়ে নিত, যেন বহু দিন যায়, যেন না শেষ হয় সহজে, এখন শুধু সুগন্ধ নয়, শব্দ-ও গায়ে মাখে। কফি মেশিনের শব্দ, প্লেটের ওপর কাঁটা-চামচের শব্দ—এই সব এসি মেশিনের শব্দও একদিন ঘরে ঢুকে যাবে, যা রূপকথার অশ্বক্ষুরধ্বনি।
নিনা বলল, মেলানকলিক কেন? চাপে আছো পরি?
পরি বলল, কী করে বুঝলে?
নিনা বলল, মুখেই রিফ্লেকশন হয়। তোমার স্কিন হল গ্লসি। এখন দেখছি ‘ম্যাট ফিনিশ’।
—তোমার বাবা একদম ঠিক নাম রেখেছিল।
নিনার পুরো নাম নিপুণা সেন। এই নামেই চেক কাটা হয়। কিন্তু ও নিনা নামেই পরিচিত। এই ধরনের প্রফেশনে নিপুণার চেয়ে ‘নিনা’ নাম ভাল খায়।
—তুমি সত্যিই নিপুণা। পরি বলে। কাজে তো নিপুণা দেখতেই পাচ্ছি। আর কীসে-কীসে নিপুণা গো?
—কীসে কীসে নিপুণা শুনবে? ‘ভেজ’ না ‘নন ভেজ’?
—’নন ভেজ’।
—x নাকি xx?
—xx।
—বেশ আগে তুমি একটা মিনিমাম xx দাও। বহু দিন ধরে ঘোরাচ্ছ। পরি হঠাৎ বলে, একটু পিছন ফেরো তো নিনা। নিনা পেছন ফেরে।
—চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। পরি বলে।
পরি আগেই দেখেছিল নিনা-র ব্লাউজের দড়িটা খুলে যাওয়ার মতো হয়েছে। স্লিভলেস ব্লাউজ, পিছনে অনেকটা কাটা, পুরো পিঠই দেখা যায়। ব্লাউজে বোতাম নেই। একটা বাহারি দড়ি দিয়ে বাঁধা। ওটা প্রায় খুলে যাচ্ছিল। পরি দড়িটা ঠিক করে বেঁধে দিল। পরি এরকম করে। যেসব মেয়ে কলিগ আছে, ওরা পরি’কে ওদেরই একজন ভাবে। পরি কারও টিপ-টা ঠিক করে দেয়, কারও চুল। নিনা বলল, থ্যাংক ইউ। তো—জোক?
পরি বলে— ওই তো, জোক হয়ে গেল, দড়ি বেঁধে দিলাম, আমার কাজ আছে না?
একটা সিনেমার কাজ। হরলাল চক্রবর্তীর ছবি। একটা মেয়ে মাওবাদীদের আস্তানা থেকে পালিয়েছে। জঙ্গলে একা। একটা পুকুর দেখতে পেয়ে শাড়িটা খুলে জলে নেমেছে। কাছেই একটা গ্রাম মতন আছে। খুব গরিব গ্রাম, মেয়েদের শাড়ির অভাব। ওর শাড়ি-ব্লাউজ ইত্যাদি চুরি করে নিয়ে যায় অন্য একটি মেয়ে। এবার পুকুর থেকে স্নান সেরে মেয়েটি দেখবে ওর পোশাক নেই। মেয়েটি তখন জঙ্গলের গাছ-পাতা-লতা দিয়ে নিজের আব্রু রক্ষা করবে। সেই আব্রু রক্ষার কস্টিউম-টা ডিজাইন করতে হবে। এটা যদি বলিউড মেন স্ট্রিম হত, নানা বাহারি পাতা দিয়ে একটা সাইকাডেলিক কস্টিউম হত। এটা বাংলা সামাজিক ছবি। হরলাল চক্রবর্তী আজকাল ফিল্মের দায়বদ্ধতা নিয়ে বলেন-টলেন। ওঁর জন্য সেমি-রিয়েল বা সিওডো-রিয়েল কস্টিউম, বানাতে হবে। কুড়িয়ে পাওয়া ছেঁড়া চট, আর জঙ্গলের লতাপাতার পোশাক। পরি চট দিয়ে একটা ডিজাইন করছে। নায়িকা নতুন, পরি দেখেছে। পা, থাই সব ভাল। অনেকটা ‘ওপেন’ রাখতে হবে। পিছনে, বাটকের দিকটায় কিছুটা ছেঁড়া থাকবে। এবং কস্টিউমটা এমন করে বানাতে হবে যেন মেয়েটা কোনওরকমে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। আসলে কিন্তু মোটামুটি শক্তপোক্ত হবে। স্টিচ থাকবে, ক্লিপ-ও থাকবে গোপনে, কারণ মেয়েটাকে লাফাতে হবে। এটাই একটা ‘জোক’। নিনা-রা এতে খুশি হবে না। মাঝে-মাঝে ওদের ফুচকা চাপে, মাঝে- মাঝে পিৎজা, আবার মাঝে- মাঝে জোক্স।
পরি জোক্স জানে, শুনেছে অনেক, চয়নের কাছ থেকেই বেশি, সব মনে থাকে না। বড্ড কাঁচা। সেদিন বলছিল, একজন ‘গে’ বাস কন্ডাক্টার ‘সেক্স’ এনজয় করছিল। আর চ্যাঁচাচ্ছিল- চলো অন্দর চলো, অউর অন্দর আগে বহুত ইসপেস হ্যায়, জলদি করো, যো দো বাহার লটক রহে হ্যায়, উন্হে ভি অন্দর করো…। বলতে পারে, কিন্তু বলবে না। নিজেদের নিয়ে ইয়ার্কি ফাজলামো নিজেদের মধ্যেই করা যায়। পরি চুপ করেই ছিল। আস্তে করে টেবিলের দিকে যাওয়ার তাল করছিল। নিনা বলল, কী হল? জোক?
পরি বলল, তুমি আগে বলো।
নিনা, মোটর সাইকেলে উত্তমকুমারের পিছনে বসা সুচিত্রা সেনের নকলে বলল, না-না তুমিই বলো।
পরি আবার বলে, না, তুমি বলো, তুমি।
নিনা বলে, আমি কতটা বেড-নিপুণা জিগ্যেস করছিলে না? নিপুণতা দেখাব কী? টাইম দেয় নাকি হ্যাজব্যান্ড? আলাপ, তারপর বিস্তার, তারপর তো ঝালা। ঝালা পর্যন্ত না-গেলে এক্সপারটাইজ দেখাব কী করে? অনেক সময় তো আলাপেই ফিনিশ। ও বলছিল, বোন গ্রাফটিং করাবে নাকি সেই বর্ধমানের এক জোতদারের মতো।
তখন একটা গল্প বলেছিল টি.কে।
—একজন লোক এল চেম্বারে। বয়স পঁয়ষট্টি মতন হয়েছে। বলছে এমন একটা ব্যবস্থা করুন যেন সব সময় খাড়া থাকে। টি.কে জিগ্যেস করেছিল, সব সময়? কেন? লোকটা বলল, দেখতে ভাল লাগে। টি.কে জিগ্যেস করল, স্ত্রী-র বয়স কত? লোকটা বলেছিল, স্ত্রী গত হয়েছে। টি.কে বলল, রক্ষিতা আছে? গার্লফ্রেন্ড? লোকটা বলল, তাও নেই। টি.কে বলল, তা হলে খাড়া রেখে কী করবেন? ক্যালেন্ডার ঝোলাবেন? লোকটা সরল মনে বলেছিল, না, ক্যালেন্ডার কেন ঝোলাতে যাব, দেখতে ভাল লাগে। টি.কে জিগ্যেস করেছিল, কে দেখবে? ও বলেছিল, কেন আমি?
টি.কে তো কিছুতেই অপারেশনটা করাতে চাইছে না, বলছে এই বয়স কেন করাতে যাচ্ছেন, কত হ্যাপা? লোকটার সেই এক কথা এটা দেখতে ভাল লাগে না।
টি.কে বলল—ভিতরে একটা হাড় ঢুকিয়ে তার ওপর মাংস চাপা দিতে হবে।
লোকটা বলল, তাই দিন।
টি.কে বলল. অনেক খরচ।
লোকটা বলল, হোক খরচ।
টি.কে বলল, পাঁজড়া থেকে একটা হাড় কেটে নেব কিন্তু।
লোকটা বলল তাই নিন।
টি.কে অবিশ্যি বোন গ্রাফটিং করেনি, কিছু একটা পলিমার জাতীয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল পেনিসে।
পরি বলল, টি.কে কে গো?
নিনা বলল, তীর্থঙ্কর। আমার হাজব্যান্ড।
—উনি প্লাস্টিক সার্জেন?
—হ্যাঁ, তো…।
পরি বলল, আমি জানতাম তোমার হাজব্যান্ড একজন ডাক্তার, কিন্তু প্লাস্টিক সার্জেন জানতাম না।
—ও জানতে না? আমরা থ্যাবড়া নাকটার জন্যই তো ওর সঙ্গে প্রেম হল। আমার নাকটা তীর্থঙ্করই অপারেশন করেছিল।
—খুব বড় ডাক্তার? পরি জানতে চায়। ডাক্তার খান্নাকে অনেক দূরের মনে হয়েছিল। বেশি নামী, কিংবা বেশি বড় মাপের বলেই হয়তো। এমন কোনও ডাক্তার হলে ভাল হয় যে ওকে বুঝবে।
নিনা বলে—খুব বড় ডাক্তার কি না জানি না, তবে আমার চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড় বারো বছরের বড়। প্লাস্টিক সার্জারিতেই এম.এস করেছে, তারপর আমেরিকাতেও কী সব ডিগ্রি নিয়েছে। ওখানেও চাকরি করেছে আট বছর। তারপর ঘরের ছেলে ঘরে এসে মায়ের কোল জুড়ে বসেছে।
পরি বলে, তোমার বরের সঙ্গে আমায় একটু আলাপ করিয়ে দেবে ভাই?
নিনা এখানকার এমপ্লয়ি নয়। মডেল। মাঝেমধ্যেই আসতে হয় ওকে। ড্রেস পরিয়ে ভিস্যুয়াল নেওয়া হয়। কাজের মধ্যেই টুকটাক গল্প হয়। ইয়ার্কি-ফাজলামোও। কিন্তু ওর ব্যক্তিগত জীবন জানে না পরি।
পরি যখন ওর বরের সঙ্গে আলাপ করার কথা বলল, তখন নিনা বলতেই পারত—আমার বর কিন্তু হোমে-টোমো নয়…। কিন্তু বলল না। ভাল বলতে হবে।
নিনা বলল—সে ঠিক আছে। এসো কোনও রোববার…।
টেবিলে যায় পরি। ওকে জঙ্গুলে পোশাক বানাতে হবে। ওর চোখের সামনে ‘ইভ’-এর ছবি এলো। টারজানের কে একজন যেন গার্লফ্রেন্ড জুটেছিল, পাতার পোশাক। ওসব মন থেকে তাড়াল। ওকে নিজের মতো কাজ করতে হবে। অরিজিনাল কাজ। পুরনো কিছুতে প্রভাবিত হলে চলবে না। ছেঁড়া বস্তার পোশাক। জুট ফেব্রিক। ওর সঙ্গে থাকবে কয়েকটা পাতা কচুপাতা? জঙ্গলমহলে কি কচুপাতা পাওয়া যায়? কচুগাছ তো একটু স্যাঁতসেঁতে এলাকায় হয়। শালপাতা-ই তো ভাল। একটা স্কেচ করতে শুরু করল পরি।
ওর টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল সিদ্ধেশ গর্গ। ‘বিজি উইথ ইওর নিউ অ্যাসাইনমেন্ট?’ সিদ্ধেশ জিগ্যেস করে। পরির কাঁধে হাত রাখে সিদ্ধেশ।
ইয়েস স্যর। পরি হাসে।
—কাজ করুন। কাম করুন। ইউ আর ডুইং ওয়েল। পরি একটু বিগলিত হাসি হাসে।
এরকম বিগলিত, সুললিত, মালায়িত হাসি বসকে দিতে শিখে গিয়েছে পরি। ‘মালায়িত মানে মালাই-সমৃদ্ধ হাসি। যা কিছুটা তৈলাক্ত। যাতে ৩০% কৃতজ্ঞতাও মেশানো আছে।
এই বসের কৃপাতেই মাইনে বেড়েছে পরি’র।
—এটার পর অউর একটা ভাল অ্যাসাইনমেন্ট দিব। রোবটকে জামাকাপড় পিন্ধাতে হবে। একটা রোবট ভাবল ও কেন আনড্রেড থাকবে? মুম্বই থেকে একটা কাজ এসেছে। পারবে না?
ইয়েস স্যর…পরি বলল।
—আই অ্যাম শিওর, ইট উইল বি ডান। পরি ওর কাঁধে গর্গের আঙুলের খেলা টের পায়। ও কাঁধটা নির্বিকার রাখে। ওই আঙুলের কলমের খোঁচাতেই তো ওর মাইনে বেড়েছে। আর মাইনে বেড়েছে বলেই ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েও ওর বাবাকে টাকা দিতে পারছে।
পরির বাবা গয়নাগুলো চেয়েছিল। বলেছিল, খাটতে পারছি না। ওগুলো আমায় দিয়ে দে বাপ। পরি দেয়নি। বলেছিল, ওসব নেই। খরচা হয়ে গিয়েছে।
—সব খরচা করে ফেললি? তো মায়ের স্মৃতি কিচ্ছু রাখলি না?
পরি কড়া গলায় বলেছিল, যেটা পড়লাম, তাতে কত খরচা জানো? তুমি দিয়েছ কোনও টাকা? আর তুমি এখন মায়ের স্মৃতির কথা বলছ, মা’কে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে কেন তখন?
কার্তিকের পিছন দিয়ে ঢোকানো গরান কাঠটাও বোধহয় অক্ষত ছিল না তখন। একেবারে কেতরে পড়েছিল। কার্তিক পাল কীরকম কাঁচুমাচু হয়ে বলেছিল—ভুল করেছিলাম, অন্যায় করেছিলাম বাপ…।
তখন এন্টালির কাছে ওই পানবাজার বস্তিতেই থাকত পরি। ওই বাড়িতেই এসেছিল ওর বাবা। ওর বাপ বলেছিল আলমারিটা খুলবি একটু? পরি বলল, না। ওর বাবা মাথা চুলকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মাইনেপত্র কেমন পাচ্ছিস বাপ?
—যা পাই চলে যাচ্ছে।
—তবে আমাকে একটু দ্যাখ না…। আমি তোর ফাদার…।
পরি মনে-মনে বলে, তুমি কি আমার নিজের ইচ্ছেয় ফাদার হয়েছ? এজন্য কি আমি দায়ী? পরি চুপ করে ছিল।
কার্তিক বলেছিল, কিছু বলছিস না যে বড়?
—কী বলব আমি?
—কিছু বল বাপ, নইলে গেট আউট বলে দে। বল, গেট আউট বল, আমি চলে যাই…
পরি তবু চুপ।
—আমার শরীর খুব খারাপ পরিমল, খুব খারাপ। খেটে খেতে পারি না। কারখানা বিক্রির টাকা শেষ হয়ে গিয়েছে। ভিক্ষে করে খেতে হবে। তোর কাছে ভিক্ষে চাইছি।
—আমাকে পরিমল বলবে না। পরি বলবে, পরি।
—হ্যাঁ, বাবা তুই ‘পরি’। পরির মতোই তো অসাধ্যসাধন করেছিস। তোর মা তোকে নিয়ে কত চিন্তা করত। তুই দাঁড়িয়েছিস। আমার কত শান্তি।
তখন ওর বাবার চোখে জল দেখতে পেয়েছিল পরি। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল। এটা নাটক নয়, সিনক্রিয়েশন নয়। আনন্দাশ্রুই। নীরস করে বলতে গেলে এটা ‘জিন’- গৌরব। কিন্তু অনাদিকাল থেকেই অশ্রুজলের একটা অনন্য আকুতি আছে। পরি বলেছিল, ঠিক আছে, যা পারব দেব।
মাথা নিচু করে চলে গেল লোকটা সেদিন। পরের মাস থেকে দেড় হাজার করে দিচ্ছিল, গত মাসে আসেনি। বাড়ি গিয়ে দেখেছিল শুয়ে আছে। দেখল ফ্যাকাশে মুখ, বলল দুর্বল। ডাক্তার দেখাল পরি। রক্তপরীক্ষায় দেখা গেল হিমোগ্লোবিন ছয়। বারো থাকা উচিত। ওষুধপত্র কিনতে হল। অ্যানিমিয়া। পরের মাস থেকে দু’হাজার টাকা দিতে হচ্ছিল। কার্তিকের খুব ইচ্ছে ছিল ছেলের কাছেই থাকে।
স্কেচ-টা অটো ক্যাডে দিয়ে টিল্ট করাচ্ছিল পরি। হট ফাইবারের ওপর কি একটু ওয়াক্স ঘষে দেবে? এটা তো মৃণাল সেন বা আদুর গোপালকৃষ্ণনের ছবি না, হরলালবাবুর। ছেঁড়া চট ও চাই। গ্লেয়ার-ও চাই। একটু ‘ওয়াক্স এফেক্ট’ করে দিয়ে দেখল কেমন লাগে। কম্পিউটার তলা থেকে একটা লুকনো হাত উঠে যায়, আর হাতের থেকে জ্যোতি বের হয়। যেন আশীৰ্বাদ। কেউ ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছে। কম্পিউটারটায় প্রথম থেকেই ছিল। ওটা ‘ডিলিট’ করেনি। থাক ওটা। ওটা মা।
কাজের ফাঁকে-ফাঁকে কার্তিকবাবুর কথাও মাঝেমধ্যে মনে হয় ওর, ইনসিডেন্টলি যিনি ওর বাবা। হিমোগ্লোবিন বাড়ছে না। শুক্লা জেঠিমার কথাও তো মনে পড়ে, কেন সেরে উঠছে না? অনেক দিন হয়ে গেল ওদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। যেতে হবে একদিন। গিয়ে কি এসব ইচ্ছেগুলোর কথা জানাবে? ইচ্ছের কুঁড়িগুলো ফুল হয়ে ফুটবে তো? ফুটবে। আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে। সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে। বড় ফাঁকা লাগে, বড় একা লাগে। মা নেই বলে সবকিছু শূন্য হয়ে গেছে মনে হয়। কাজের মধ্যে ডুবে থাকা যতক্ষণ, ততক্ষণই যেন কিছুটা মুক্তি।
চোখ কম্পিউটারে, হাতে মাউস। চটের পোশাক পরা নায়িকা কম্পিউটার স্ক্রিনে ঘুরছে। পরি ওর দিকে চেয়ে থাকে। পরি নিজের একটা ছবি বের করে নেয়। নিজের মুণ্ডটা কোট বের করে। চটের পোশাক পরা নায়িকার গলাটা কেটে দেয়। ওখানে নিজের মুখটা বসায়। দু’কাঁধে দু’টো ডানা লাগিয়ে দেয়। স্তন দু’টো বাড়িয়ে দেয়। পরি এবার সত্যিকারের ‘পরি’ হয়ে গিয়েছে। পরি উড়ছে। তেরো নদী পেরিয়ে উড়ছে। উড়তে-উড়তে ফলের বাগান। কোঁচড়ভরা ফল— আঙুর, আপেল, ডালিম। কার্তিকবাবু, অ্যাক্সিডেন্টলি আমার বাবা, এসব ফল সম্ভার তোমার হিমোগ্লোবিন বাড়াও তুমি। আর ম্যাডাম, অনিকেত বাবুর স্ত্রী, আপনাকেও গন্ধমাদন পর্বত থেকে এনে দিলাম আশ্চর্য শেকড়। এই শেকড় অনিকেত বাবুকে খাইয়ে দিও না আবার তোমার সুশীলার দশা হবে। এটা তোমার, তুমি খেও। আবার ঘর থেকে বেরবে। জানলা ছেড়ে আলনা ছেড়ে উনুন ছেড়ে বাইরে।
ওমা! ডানা খসে গেল কেন? কোথায় ‘ক্লিক’ করে ফেললাম ভুল করে। আমি পড়ে যাচ্ছি। অনেক উপর থেকে পড়ে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচাও প্লিজ…
কম্পিউটারটা শাট ডাউন’ করে দেয়। স্ক্রিন অন্ধকার।
নিনা আর সরিতা কাছে এসে বলে, কী হল তোমার পরি? আর ইউ নট ওয়েল?
৬৩
বছরখানেক আগে হঠাৎ একদিন ফোনটা পেয়ে একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিল পরি। প্রথম কথাটা ছিল ‘তুমি কেমন আছো পরি?’ গলাটা চিনতে পারেনি। মোবাইলেও নাম ওঠেনি। নতুন মোবাইল না? চওড়া স্ক্রিন, ক্যামেরাও আছে।
কে বলছেন? জিজ্ঞাস করল পরি।
—সে কী? আমাকে চিনতে পারছ না?
এবার বুঝল। অনিকেত কাকু। কিন্তু এত নরম কোমল করে বললে চিনবে কী করে? উনি তো আগে এত নরম করে কথা বলতেন না, এখন গলাটা যেন সাটিন-ফেব্রিক্।
শেষ দেখা হয়েছিল ওর মায়ের দাহ দিনে। কী হল হঠাৎ?
পরি বলে হ্যাঁ, বলুন?
ওধার থেকে শুনতে পেল—যেটা পড়ছিলে, সেটা চলছে তো?
পরি বলেছিল ‘ইয়েস’। আর পড়া শেষ করে চাকরিও করছি।
ইয়েস্ শব্দটার মধ্যে পরি নিজের অজান্তেই মিশিয়ে দিয়েছিল কিছুটা অহং, তুবড়িতে বারুদ ঠাসার মত। যার ভিতরে গোপনে থাকে ফুলকি। এই গোপন ফুলকি পরি টের পেয়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘মেয়েলি’ কথার মধ্যেও, মাঝে মাঝে। ওই ‘ইয়েস’ শব্দটার মধ্যে ভরাছিল আরও কিছু মনের কথা— হ্যাঁ অনিকেত বাবু, আপনাদের সাহায্য-টাহায্য ছাড়াই আমি পারি। সেই কবে একবার বলেছিলেন কোনও দরকার হলে বোলো, আমি আছি। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর আমাদের কোনও খোঁজখবর নেননি। মায়ের সঙ্গে আপনার তো কিছু একটা ছিল, অথচ মায়ের মৃত্যুর পর আপনি হাত ধুয়ে নিয়েছেন।
‘ইয়েস’-এর জবাবে পরি মহাসিন্ধুর ওপার থেকে শুনল, ভেরি গুড ভেরি গুড।
সামান্য নীরবতার পর পরি শুনল—একদিন সময় করে এসো না আমাদের বাড়ি, শুক্লা তোমার কথা বলছিল। তোমাকে দেখিনি বহুদিন। তোমার কাকিমা তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চায়।
পরির মনে হয়েছিল—কেন? আবার ওই ভদ্রমহিলা কেন? মায়ের কথা কিছু জানতে চাইবেন নাকি, আঁকশি বাড়িয়ে টেনে আনতে চাইবেন নাকি কোনও কুলুঙ্গিতে রাখা কোনও গোপন বাসো?
ওই ভদ্রমহিলাকে কখনও দেখেনি পরি, কাকিমা জেঠিমা বলে ডাকেনি কোনও দিন। উনি অনিকেতবাবুর স্ত্রী। অনিকেতবাবুকে তো কাকুই ডাকত, পরে জেঠু। মা ডাকত ডাবুদা। মায়ের দাদা তো মামাই হয়।
পরি বলছিল, যেতে বলছেন কেন? দরকার কিছু?
উত্তর পেল কোনও দরকার নেই পরি, তোমার কোনও দরকার নেই। বলতে পারো আমাদেরই দরকার। যদি আসতে পারো, ভালো হয়। এবার গলাটা আর নরম। সাটিনও নয়, মখমল। ঠিকানা নিয়েছিল পরি। গিয়েছিল।
অনিকেত কাকুর, সরি, জেঠুর চুল পেকে গিয়েছে অনেকটাই, মুখের গ্লসিভাব নেই, ফেডেড।
অনিকেত কাকু বললেন—ভালো আছিস তো পরি, কোথায় চাকরি করছিস রে?— —এতদিন খোঁজ নেয়া হয়নি, তোর কাকিমাকে নিয়ে খুব ঝামেলায় আছি কিনা? ও এখন কিছুটা ঠিক হয়েছে। চল। ওর কাছে নিয়ে যাই। ও গত ক’দিন ধরে তোর কথা খুব বলছে।
একটা চেয়ারে বসে ছিলেন ওই শুক্লা ম্যাডাম। অনিকেত বলল এই যে পরি। উনি মুখের ইশারায় ডাকলেন। ওটাই হাতছানি। হাতছানিটা মুখের ভিতরে ফেব্রিক করা ছিল। ওঁর পিছনের জানালায় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতাগুলি ইলিক ঝিলিক করছিল।
এই বুঝি পরি? বাঃ।
পরি সেদিন একটা ছাপ ছাপ শার্ট আর জিন্স পরেই গিয়েছিল। কানের দুলটা খুলেই গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা হাসি হাসি মুখ করে অনেক্ষণ দেখলেন। তারপর বললেন, মাকে স্বপ্ন দ্যাখো?
পরি দু’বার মাথা নাড়ায়।
তোমার মা কিন্তু তোমায় আশীর্বাদ করে চলেছেন—উনি যেখানেই থাকুন না কেন। শুনলাম ফ্যাশান ডিজাইনার হয়েছ। চাকরিও করছ। কোথায় তোমার চাকরি।
পরি কোম্পানির নাম বলে।
বেশ। খুব খুশি হয়েছি। তোমার মা যদি দেখে যেতেন। কী খুশি হতেন-বলো?
কী খাবে বলো।
পরি বলে খাওয়া-টাওয়ার ঝামেলা করতে হবে না কিছু।
—কী খেতে ভালোবাসো। চাইনিজ?
—সে তো ভালোইবাসি। কিন্তু ওসব থাক না।
—না, থাকবে কেন, এখানে দোকান হয়েছে তো। কাছাকাছি।
অনিকেতকে বলল—নিয়ে এসো না ওর জন্য…। পরির মনে হয়েছিল অনিকেতকে সরিয়ে দিয়ে এবার একা পেয়ে ওর মায়ের সঙ্গে অনিকেত কাকুর সম্পর্ক-টম্পর্কের কথা জিজ্ঞাসা করবে।
কিন্তু ওসব প্রসঙ্গ এলো না। কী ধরনের কাজ করতে হয়। কাজ করতে ভালো লাগে কি না এসব জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর বলল, মন্টু নামে একটা ছেলে ছিল আমার কাছে কিছুদিন। বুঝলে, ও আমাকে জেঠিমা ডাকত। তুমিও আমাকে জেঠিমা ডেকো, কেমন?
মন্টু কোথায় এখন!
উনি কিছু বললেন না। দীর্ঘশ্বাস পড়ল। গাছেরপাতা গুলো কাঁপল
মন্টুর ব্যাপারটা পরির জানার কথা নয়। পরি মন্টুর প্রসঙ্গে আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করল না। শুক্লাও অন্য প্রসঙ্গে এল। বলল, নিজে নিজে রান্না করে খাও?
পরি মাথা নাড়ায়। সম্মতির।
কী রান্না করো?
পরী এই প্রশ্নটার শেষে উহ্য থাকা ‘বাছা’ শব্দটাও শুনতে পেল যেন। কী রান্না কর বাছা!
পরী বলল—ডাল সেদ্ধ, ভাত, ম্যাগি, ডিমের ওমলেট…।
রান্না করতে ঝামেলা মনে হয় না?
—ভালোই তো লাগে।।
—শোনো, একটু ঘি বা মাখন রেখো, চালে ডালে বসিয়ে খিচুড়ি করে নিও, একটু ঘি ফেলে দিও, ব্যাস, সহজে হয়ে যাবে।
একটা বাকসো করে চাউমিন এনেছিল অনিকেত, প্লেটে ঢেলে দিল। পরি খাচ্ছিল, শুক্লা হাসি মুখ করে দেখছিল।
সিনেমা টিনেমা দেখো?
পরি বলল সময় কোথায় এত! মাঝে মধ্যে দেখি।
শুক্লা বলল আমি খুব দেখি। আর কীই বা করব। চোখের বালি দেখেছ, ঋতুপর্ণর?
পরি বলল, দেখেছি তো।
প্রসেনজিৎ একদম অন্যরকম, তাইনা?
পরি বলল, হ্যাঁ।
শুক্লা বলল—ঋতুপর্ণ খুব বড় ডিরেক্টার।
সেই উনিশে এপ্রিল থেকে দেখছি। ওকে অনেকে ইয়ে করে, কিন্তু…
—কিন্তু কী?
কিন্তু কী আবার। বাইরে দিয়ে কিছু হয় না, ভিতরটাই তো আসল।
পরির ভিতরটা রিনরিন করে উঠেছিল।
এই শুক্লা কাকিমা, বা জেঠিমা, হোয়াট এভার, মহিলাটিকে ভালো লেগে গেল।
পরি বলেছিল—আপনাকে জেঠিমা ডাকতে বললেন, কিন্তু অনিকেত কাকুকে তো কাকু ডাকি।
অনিকেত বলে—ওসব গ্রামাটিকাল মিস্টেক কোনও ব্যাপার নয়।
শুক্লা বলে ওকেও জেঠু ডেকো, তাহলেই তো হয়
সেদিন পরি যেন ওর সারা গায়ে ভালোবাসার পাউডার মাখা হয়ে ওর বাড়ি ফেরে।
মন্টু আর বিকাশদের সেই বিচ্ছিরি ঘটনাটা ঘটে যাবার পর টিভিতে জোড়া খুনের গল্প দেখায়। কোনও কোনও চ্যানেল নাট্যরূপান্তরও করে। বিকাশকে দুশ্চরিত্র উওম্যানাইজার হিসেবে দেখানো হয়, দেখানো হয় একটি মহিলা দু-একটা সঙ্গী নিয়ে এসে বিকাশকে খুন করে ওর এটি এম কার্ড হাতিয়ে নিয়ে চলে যায়। মন্টু মহিলাটিকে চিনে ফেলেছিল বলে ওকেও মাথায় হাতুড়ি মারা হয়। পারমিতাকেও দেখানো হয়েছিল, পারমিতার বেশ সাজগোজ, মুখে কোন দুঃখের ছাপ নেই। চুলে লক। ও বলছে এ ব্যাপারে ও কিছু জানে না। বিকাশের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না। আর মন্টুকেও চেনে না, দেখেনি কোনও দিন।
অথচ বিকাশের অফিসের পাওনাগণ্ডা সবই—ও নিয়েছে। কে জানে পারমিতা অবার বিয়ে করবে কি না, শুক্লার শরীর খারাপের খবর কি ও জানেনা? কই, কখনো ফোনটোনও করেনি তো…।
টিভির ‘পুলিশ ফাইল’ শেষ হয়ে গেল, আর মন্টুও হারিয়ে গেল।
শুক্লা একদিন বলেছিল মন্টুটার একটা ছবিও নেই কোথাও। একটা অস্তিত্ব বিলীন। কোন চিহ্ন নেই।
শুক্লা বলত, অন্যায় করেছিলাম। খুব খারাপ। এরপরই পরির কথা বলতে শুরু করে শুক্লা। পরি সম্পর্কে কিছু কথা অনিকেতের কাছেই শুনেছিল শুক্লা।
কিছুদিন আগে ঋতুপর্ণ ঘোষের একটা ইন্টারভিউ দেখছিল শুক্লা। দেখতে দেখতে বলল ওর কিরকম ঝাঁকড়া চুল ছিল। কত চুল কম এখন। মুখটাও কেমন যেন লাগছে।
এরপরই বলে পরিকে বাড়িতে আসতে বলো না গো একদিন….
মঞ্জুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে অনিকেত শুক্লাকে যে ব্যাখ্যাটা দিয়েছিল, সেটা হল-ছেলের ব্যাপারে মঞ্জুর খুব মন খারাপ থাকত। অন্যমনস্ক থাকত, এরকম অন্যমনস্ক অবস্থাতেই লাইন পার হতে গিয়ে মঞ্জুর দুর্ঘটনা। শুক্লা বলেছিল—ইশ্! মেনে নিলেই তো হত…। কাকে কী বলছি, আমিও কি মেনে নিতে পেরেছিলাম…।
পরি এরপর ও বাড়িতে এসেছে মাঝে মাঝে। পুজোর আগে জিজ্ঞাসা করেছিল পরি, তুমি কী নেবে বলো, যদি চুড়িদার চাও বলতে পারো। পরি বলেছিল, তাহলে চুড়িদাই দিন…। জেঠিমা বলেছিল, খুব ভাল হত যদি তোমার সঙ্গে নিয়ে পছন্দ করে কিনে দিতে পারতাম।
পরি ও-বাড়ি যায় মাঝেমধ্যে। ওর মন্দ লাগে না।
পরির কে-ই বা আছে নিজের বলতে? দু’-তিনরকম রান্নাও শিখিয়েছেন। রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলছেন, এবার চিংড়িটা ভেজে নাও, বেশি ভেজো না, চিংড়ি মাছ বেশি ভাজলে শক্ত হয়ে যায়, সামান্য লালচে হয়েছে, এবার তুলে রাখো, লাউতে কী ফোড়ন দেবে? জিরেও দিতে পারো, রাঁধুনিও দিতে পারো। ওই যে রাধুনি। হ্যাঁ একদম জোয়ানের মতো দেখতে। একটু মুখে দিয়ে দাঁতে কেটে দ্যাখো, জোয়ান নয়। এবারে লাউটা ছেড়ে দাও। লাউ-চিংড়িতে হলুদ দেবে না কিন্তু…। যেন নিজের মেয়েকে রান্না শেখাচ্ছে…। আবার বলছে… ছেলেদের কিন্তু রান্না শিখে রাখা উচিত। কাজ চালানোর মতো। কাজ চালানোর মতো বলছি কেন, ভাল করেই শিখে রাখা উচিত। ঘরের রান্নাটা মেয়েরাই করবে কেন বলো, ছেলেদেরও তো করা উচিত তাই না?
পরির যেন মনে হচ্ছিল, ওই ভদ্রমহিলা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না পরির সঙ্গে ছেলেদের মতো ব্যবহার করবেন, না কি মেয়েদের মতো। আসলে ‘সেক্স আইডেন্টিটি’ গুলিয়ে যাচ্ছিল, আর পরি সেটা উপভোগ করছিল। কখনও-কখনও পরি যেন পাশের বাড়ির মেয়েটা হয়ে যাচ্ছিল, যে দুপুরবেলা উল বুনতে-বুনতে কিংবা সিরিয়াল দেখতে-দেখতে গল্প করতে এসেছে। গত এক বছর ধরে প্রতিমাসে একবার করে ওদের বাড়ি যাওয়া হয়ে যাচ্ছিল পরির। চয়নের কথাও বলেছে একটু একটু। কিন্তু চয়নকে নিয়ে বেশি উৎসাহ দেখায়নি শুক্লা। শুধু একদিন বলেছিল—ওকে নিয়ে আসতে পারিস তো একদিন। চয়নকে বলেছিল পরি, চয়ন উৎসহ দেখায়নি। বলেছিল এরকম বহুত কাকিমা জেঠিমা দেখা আছে। ধান্দাটা কী ওনার?
পরি বলেছিল ধান্দা থাকতেই হবে? অন্যভাবে কিছু ভাবতে পারো না তোমরা? চয়ন বলে ওই ভদ্রমহিলা কি তোর মায়ের রিপ্লেসমেন্ট?
পরি বলে তা কেন হবে? কিন্তু কি জানি কেন ওর কাছে গেলে রোদ্দুরের মাঠে তমাল ছায়ার মত লাগে।
চয়ন বলে আরিব্বাস? তমাল ছায়া? তমাল গাছ দেখেছিস কখনো?
পরি মাথা নাড়ায়। বলে দেখিনি বলেই তো…চয়ন বলে অনেক দিন কবিতা লিখিসনি পরি। লেখ এবার।
শুক্লা জেঠিমা এখনও হাত দুটো উপরে ওঠাতে পারে না। বই পড়তে পারে না বইয়ের র্যাক থেকে। লাস্ট যেবার গেল, পরিকে বলেছিল, বিভূতিভূষণের গল্প সংগ্রহটা পেড়ে দিবি পরি? ‘মৌরীফুল’ আর ‘পুঁইমাচা’-টা পড়ব। বলেছিল, চোখেও ছানি হয়ে গিয়েছে রে, পড়ে দিবি একটু মৌরফুল-টা?
পরি পড়তে শুরু করেছিল—’অন্ধকার তখনও ঠিক হয় নাই, বাঁশবাগানে জোনাকির দল সাজ জ্বালিবার উপক্রম করিতেছিল। তালপুকুরের পাড়ে গাছের মাথায় বাদুড়ের দল কালো হইয়া ঝুলিতেছে—মাঠের ধারের বাঁশবাগানের পিছনটা সূর্যাস্তের শেষ আলোয় উজ্জ্বল। চারিদিক বেশ কবিত্বপূর্ণ হইয়া আসিতেছে।’
শুক্লা জেঠিমা হাতের ইশারায় থামতে বলেছিল। তারপর চোখ বুজে বলল, দাঁড়া, দৃশ্যটা একটু দেখে নি, কেমন…।
কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে দৃশ্য দেখছিল শুক্লা জেঠিমা। কত দিন এসব দৃশ্য দেখেনি। চোখ বুজে দেখছে। পরিও চোখ বুজে ছিল। কিন্তু কোনও দৃশ্য দেখতে পেল না তেমন। ‘বাদুড়ের দল কালো হইয়া ঝুলিতেছে’—এই দৃশ্যটা কল্পনাই করতে পারল না পরি। পরি কখনও বাদুড় দ্যাখেনি। আর জোনাকি?
শুক্লা জেঠিমা চোখ বুজে হামিং করছিল। সুরটা টের পেয়েছিল পরি। ও জোনাকি, কী সুখে ওই ডানা দু’টি মেলেছ…। তারপর জেঠিমা গাইলেন না, স্বগতোক্তির মতোই বলেছিলেন,
তুমি আপন জীবন পূর্ণ করে আপন আলো জ্বেলেছো
তোমার যা আছে তা তোমার আছে
তুমি নও গো ঋণী কারও কাছে
তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে, তারই আদেশ পেলেছ।
পরি কখনো জোনাকি দেখেনি। জোনাকির কথা শুনেছে।
‘মৌরিফুল’ গল্পে সন্ধ্যা নামার দৃশ্যের সময় জেঠিমা চোখটা বন্ধ করেছিলেন, দশ-বারো সেকেন্ড পরে খুললেন। এই সামান্য মুহূর্ত সময়ে কোথায়, কত দূরে মানস-ভ্রমণ করলেন কে জানে?
এবার বললেন—নাও, পড়ো।
পরি পড়তে থাকে। মুখুজ্জে মশাইয়ের ছেলে কিশোরীলাল, কিশোরীলালের বালিকা বধু সুশীলারা আসে। কিশোরীলালের কাছে বালিকা সুশীলা গল্প শুনতে চায়, কিশোরী গল্প বলে। খেজুর বনের জলের ফোয়ারা হইতে মণিমুক্তা উৎক্ষিপ্ত হইতেছে… পথহীন দুরন্ত মরুপ্রান্তর মৃত্যু যেখানে শিকার সন্ধানে ওৎ পাতিয়া আছে, সমুদ্রের ঝড়…. দৈত্যসঙ্কুল অরণ্যের মধ্য দিয়া নির্ভীক যাত্রা… এসব শুনিতে শুনিতে সুশীলার গা শিহরিয়া উঠিত। ঘুম ভাঙিলে ঘরের মধ্যে অর্ধরাত্রির অন্ধকার বিকটাকার জীনদেহের ভিড়ে ভরিয়া গিয়াছে মনে করিয়া ভয়ে সে স্বামীকে জড়াইয়া ধরিত। …সে নিজের স্বামীকে যাত্রা দলের রাজার পোশাক পরাইয়া দূরদেশে বিপদের মুখে পাঠাইত…এই সুশীলা ক্রমশ বড় হচ্ছিল গল্পটার মধ্যে। ওর স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল। কোথায় গেল সেই গল্প বলা।
নৌকা করে সুশীলা যাচ্ছিল আত্মীয় বাড়ি। নৌকোয় এক সঙ্গিনী জুটল। কলকাতার মেয়ে। ওর সঙ্গে মৌরীফুল পাতালো।
‘সঙ্গিনীর মুখে স্বামীর আদরের গল্প শুনিয়া সুশীলার মনের মধ্যে একটা গোপন ব্যথা জাগিয়া উঠিল। সেটা সে অনবরত চাপিবার চেষ্টা করে, তবু কি জানি কেন সেটা ফাঁক পাইলেই মাথা তোলে। প্রথম বিবাহের পর তাহার স্বামীও তো তাহাকে কত আদর করিত, রাত্রে ঘুমাইতে না দিয়া নানা গল্পে ভুলাইয়া জাগাইয়া রাখিত, সুশীল পান খাইতে চাহিত না বলিয়া কত সাধ্যসাধনা করিয়া পান মুখে তুলিয়া দিত—সেই স্বামী তাহার কেন এমন হইল। তাহার বুকটার মধ্যে কেমন হুহু করিয়া উঠিল…’
পরি, শুক্লা জেঠিমার দিকে তাকায়। দামোদরের চরের একটা দৃশ্য বয়ে যায় ওর মনে ধু-ধু বালিচর, দুরে শীর্ণ, রুগ্ণ নদীটা। বালি মেশানো হওয়া। হু-হু করছে।
শুক্লা জেঠিমার মনের ভিতরেও কি হু-হু শব্দটা কোনও দ্যোতনা দিল? নইলে আবার কেন হাতের পাঁচ আঙুল জোড়া করে পরিকে দেখাল? পরি থামল। গল্পটা শেষ অবধিই পড়েছিল। এক তান্ত্রিকের উপদেশে, সেই তান্ত্রিকপ্রদত্ত শিকড়বাটা ডালের বাটিতে মেশাচ্ছিল স্বামীকে খাওয়াবে বলে, কেউ দেখে ফেলল। সবাই ভাবল সুশীলা স্বামীকে বিষ খাওয়াচ্ছে…। একটু স্বামীর সোহাগ চেয়েছিল সুশীলা। কে না চায়? এমন কিছু বয়স হয়নি শুক্লা জেঠিমার। হয়তো মায়েরই বয়সি। অথচ কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। সর্বদা হু-হু করে মন… বিশ্ব যেন মরুর মতন। বাংলা অনার্সের ক্লাসে পড়েছিল পরি। বিহারীলাল চক্রবর্তীর লেখা। শুক্লা জেঠিমার কি ওরকম হয়?
কিন্তু হু-হু শব্দটা পরির শরীরেও খেলা করতে লাগল। ‘হু-হু’ শব্দটার ‘হ’ ধ্বনির মধ্যে যেন হায়-হায় গুপ্ত আছে। আমিও তো সোহাগিই হতে চাই চয়ন, সেই সুশীলার মতো, সেই চারুলতার মতন, কাদম্বিনীর মতন, রোহিণীর মতন….। চয়ন…চয়ন…।
সকালবেলা ব্রেকফাস্টের পর ইস্ট্রোজেন ট্যাবলেটের স্ট্রিপ থেকে একটা বড়ি আর কাচের গেলাসে টলটলে জল দিয়ে বলবে, খেয়ে নাও। আমার ব্রা-টা হুকে লাগিয়ে দেবে অফিস যাওয়ার আগে। জাঙ্গিয়াটাও এগিয়ে দেবে। লজ্জা কী এখনও তো জাঙ্গিয়াই, প্যান্টি-র দিন আসবে। বলবে সান-স্ক্রিন টা লাগাতে ভুলে যাওনি তো। ছাতাটাও ব্যাগে পুরে দিয়ে চুমো খাবে একটা। চয়ন তোমার সঙ্গে হরমোন-জীবন কাটাব…হরমোন কাটাব জীবন। চয়ন তোমার সঙ্গে কেচ্ছার জীবন কাটাব…চয়নের সঙ্গে নয়ন, শয়ন এসব শব্দ আসছে। কবিতায় যেমন হয়। কবিতা তুই ফোট, ঝলসানো রুটির মতো দরকারি গদ্যরা জীবনে এসে জোট।
কে জানে হু-হু শব্দটার মধ্যে কী দ্যোতনা ছিল, পরি পড়া থামিয়ে শুক্লার দিকে তাকায় শুক্লাও পরির দিকে। দামোদরের চর থেকে ধুলো হাওয়ায় হু-হু। পরি বলে একটা কথা বলব জেঠিমা?
কী কথা রে?
আমি না, সেক্স চেঞ্জ করব। মেয়ে হব।
৬৪
গতকাল খবরটা ছোট করে বেরিয়েছিল, মনে হয়েছিল হয়তো অন্য কোনও তৃপ্তি সামন্ত। আজ ছবি ছেপেছে কাগজে। সেই তৃপ্তিই তো! ধর্ষণের অভিযোগে ৩৭৬ ধারায় গ্রেপ্তার। একটা পুলিশ ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, বাঁ হাতে মুখটা ঢাকার চেষ্টা করছে তৃপ্তি তবুও বোঝা যাচ্ছে এই মেয়েটাই সেই তৃপ্তি। ভিতরের খবরে বলে দেওয়া হচ্ছে তৃপ্তি সামন্ত, জাতীয় পুরস্কার বিজয়িনী অ্যাথলেট, সেই সুবাদে রেল-এ চাকরি করত। সুমিতা হালদার নামে একজন মহিলা থানায় অভিযোগ করে যে, তৃপ্তি সামন্ত চাকরির লোভ দেখিয়ে সুমিতাকে একাধিকবার ধর্ষণ করেছে। ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়েছে এবং শরীরের কয়েকটি জায়গায় নখের দাগ- সহ অত্যাচারের ‘চিহ্ন’ পাওয়া গিয়েছে।
চয়নকে চমকপ্রদ খবরটা ফোনে জানাতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু এখন ও হয়তো টিউশনি-মগ্ন।
অফিসে তিন-চারটে কাগজ রাখা হয়। কোনও কাগজে হেডিং ‘উওম্যান অ্যাকিউড ফর রেপ’। কোন কাগজে হেডিং ‘প্রশ্নের মুখে ৩৭৬ ধারা’, কোনও কাগজের হেডিং ‘এবার নারীই ধর্ষক’। একটা কাগজ তৃপ্তির গলায় মেডেল ঝোলানো ছবি জোগাড় করেছে।
অফিসেও এ নিয়ে কথা চলছে। বাপি বসু ফোটোগ্রাফার। ও বলল, মেয়েরাও ধর্ষণ করতে পারে। কোনও এক লেডিজ হোস্টেলে নাকি এক ইলেকট্রিক মিস্ত্রি লাইন সারাতে এসে রেড হয়েছিল। একদম গ্যাং রেড। অন্য একজন বলল, ওঃ, বাপি, হাউ লং ইউ উইল বি আ ন্যাকা চৈতন্য? এখানে একটা উওম্যান আর একটা উওম্যানকে ‘রেপ’ করেছে। বাপি তখন মাথা চুলকে বলল, একটা মেয়ে আর একটা মেয়েকে রেপ করতেই পারে, যদি লেসবিয়ান হয়।
ওরা দু’-তিনজন তখন পরি’র দিকে তাকিয়ে আছে ওর কোনও কমেন্টের জন্য। এই মেয়ে- সাজা ছেলে এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই কিছু জানে। কিন্তু পরি কিছু বলছিল না। ওদের বস সিদ্ধেশ গর্গ একবার ওর কিউবিকূল থেকে বাইরে এল। এসে বলল, ‘নো পেনিট্রেশন—নো রেপ। দিস ইজ আইপিসি থ্রি সেভেনটি সিক্স—অ্যাজ আই নো। দ্যাট গার্ল, সুমিতা, ক্লেইম্স তৃপ্তি ডাজ হ্যাভ দ্যাট ইন্সট্রুমেন্ট টু পোক্ ইন।’ ওদের আলোচনার মধ্যে গর্গ সাহেব এইটুকু ‘পোক্ ইন’ করে আবার নিজের চেয়ারে ‘পোক আউট’ হয়ে গেলেন। এই ধরনের আড্ডায় বেশি ইনভল্ভড হওয়া ‘বস’-এর ডিগনিটি-বিরোধী। কিন্তু একেবারে না-এসেও পারা যায় না। পরি ওদের জানাতে চাইছে না যে তৃপ্তিকে ও চেনে।
.
মাসখানেক আগে ডাক্তার খান্নার চেম্বারে তৃপ্তির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখন বলেছিল যে ওর একটা পুংলিঙ্গ হলে ভাল হয়। কলেজে ওর ছেলেমি দেখেছে, ছেলেমি মানে খেলাধুলো, ডানপিটেগিরি, আবার ও জানত যে, তৃপ্তি একটা মেয়ে, কিন্তু অসম্পূর্ণ মেয়ে। ওর ঋতুচক্র নেই, পাড়ার লোক ওকে ‘নিমাই’ বলত, ও জানে, কলেজের কেউ-কেউ ‘ম্যানচেস্টার’-ও বলেছে। যে-মেয়ের ‘চেস্ট ম্যান-এর ন্যায়’—মধ্যপদলোপী তৎপুরুষ? ছোটবেলা থেকে ফ্রক পরেছে, ওর মা ওকে নাচের ইস্কুলেও ভর্তি করে দিয়েছিল ছোটবেলায়। যখন ওর মা-মাসিরা ‘হাত ঘুরালে নাড়ু দেব—নইলে নাড়ু কোথায় পাব’ বলত, ও নাকি খুব সুন্দর করে হাত ঘুরাতে পারত, তাই ছোটবেলা থেকেই নাচের ইস্কুল। এসব তৃপ্তি বলেছিল পরির ফ্ল্যাটে এসে।
ডাক্তার খান্নার চেম্বারে দেখা হওয়ার পর ফোন নম্বর আদানপ্রদান হয়েছিল। তারপর তৃপ্তি একদিন গিয়েছিল পরির ফ্ল্যাটে কোনও এক রবিবার। খুব ভাল করে পাঁঠার মাংস রান্না করবে বলে দই, হলুদ, রসুন, আদা দিয়ে মাংস মেখে রেখেছিল পরি। ফ্ল্যাটে ঢুকেই তৃপ্তি পরিকে আলিঙ্গন করেছিল। পরির মনে হয়েছিল এই আলিঙ্গন কি হোমো সেক্সুয়াল আলিঙ্গন? না কি হেট্রো সেক্সুয়াল?
বার্থ সার্টিফিকেট অনুযায়ী তৃপ্তি মেয়ে, পরি ছেলে, সুতরাং এটা হেট্রো সেক্সুয়াল। আবার পরি ওর সার্টিফিকেট মানে না। ও ওরিয়েন্টেশন-এ মেয়ে। নিজেকে মেয়ে ভাবে। সুতরাং তৃপ্তির সঙ্গে ওই আলিঙ্গন ‘সাফো আলিঙ্গন’। লেসবিয়ান। আবার পরি লিঙ্গগত-চিহ্নে পুরুষ, আর তৃপ্তি নিজেকে ‘পুরুষ’ ভাবছে। ওর পুংলিঙ্গটি নেই, বানাতে চায়। তৃপ্তিও মনে-মনে পুরুষ। সুতরাং পরির সঙ্গে তৃপ্তির এই আলিঙ্গন ‘সাদোমিক’। ‘হোমো সেক্সুয়াল’। আবার তৃপ্তি যদি মানসিকভাবে পুরুষই হয়, পরি মানসিকভাবে নারী। সুতরাং এটা হেট্রো সেক্সুয়াল অ্যাক্ট। এ তো কালিদাসের হেঁয়ালিরে ভাই। পরি আপন মনেই হেসে ওঠে।
তৃপ্তি বলে, কী হল? হাসলি কেন?
পরি জানে, এই হাসির কারণ ও তৃপ্তিকে বোঝাতে পারবে না। মনে-মনে বলল, হাসছি কেন কেউ জানে না, আর মুখে বলল, পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই। চকিতে দু’টো লাইনও মনে এল—রবীন্দ্রনাথের।
ডানা-মেলে দেওয়া মুক্তি প্রিয়ের কুজনে দু’জনে তৃপ্ত
আমরা চকিত অভাবনীয়ের ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত।
এটাও বলল, না। মাংস ম্যারিনেট হচ্ছে।
তৃপ্তি বলেছিল, খুব ঝামেলা। যা চাইছি হবে না।
—কী হবে না?
—ওটা, যা চেয়েছিলাম, রান্নাবাড়ার মধ্যে যেটা আছে। ডাক্তারবাবু বললেন, একটা ‘ভ্যাজইনা’ বানানো বরং সহজ, কিন্তু ‘পেনিস’ বানানো কঠিন। ডাক্তারবাবু ছবি এঁকে বুঝিয়ে দিলেন।
—কী বোঝালেন?
—দে, একটা কাগজ দে, বোঝাচ্ছি।
তৃপ্তি কাগজ নিল। বলল, প্রথম সমস্যা হিসি নিয়ে। হিসির যে পাইপটা, ইউরেথ্রা না কী যেন বেশ বলে, সেটা তো আমার এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপর তো বাড়াতে হবে। মেয়েদের হিসির পয়েন্ট আর বিশুর পয়েন্ট তো আলাদা। ছেলেদের একটাই। আলাদা মাংস- টাংস দিয়ে যদি পেনিস বানায়, সেটা কোথায় বসাবে?
কোনও-কোনও মেয়ে হিসু-র পয়েন্ট বসায়। একটা পাইপ ঢোকানো থাকে মাংস ভেদ করে। দেখতে ভাল লাগে না, কেউ কেউ উপরের দিকে বসায়, কিন্তু ওটা ফর শো। ওখান দিয়ে হিসুটা বেরয় না। হিসু—হিসুর জায়গা দিয়েই বেরয়।
—’বিশুর পয়েন্ট’ ‘বিশুর পয়েন্ট’ বলছিস কেন? ঠিক করে বল না ভাই, হেঁয়ালির কী দরকার আমার কাছে অন্তত? পরি বলেছিল।
তৃপ্তি বলেছিল, হেঁয়ালির কী আছে? ‘বিশুর পয়েন্ট’ মানে বিশুদারা যে-পয়েন্ট খোঁজে।
পরি বলে, আগে তো খুব কাঁচা খিস্তিটিস্তি দিতিস, এখন আর অত দিস না বুঝি?
তৃপ্তি বলে, কী বলব বল? কাঁচা বাংলায় যা বলে সেটা আমি জানি, তুইও জানিস, কিন্তু আমার কী সেটা আছে? খুঁতো তো। তাই…।
যাগ গে… আর কী বলেছিল ডাক্তার? পরি জিগ্যেস করেছিল।
তৃপ্তি বলেছিল, উনি বললেন, পেনিসটা খুব ডেলিকেট জিনিস। ওখানে প্রচুর রক্তনালি আছে। সেক্স-এর ইচ্ছে হলে মাথা থেকে সিগনাল যায়, তখন পেনিসে প্রচুর ব্লাড সাপ্লাই হয়, ওখানে স্পঞ্জের মতো কী সব আছে, রক্তে ভরে যায়, কোথায় যেন একটা লক্ মতো আছে রক্ত আটকে থাকে, ফেরত যায় না। তখন ওটা হার্ড হয়ে যায়, তারপর কাজ হয়ে গেলে রক্ত আবার ভেন-এর ফেরত যায়। তখন ‘লুজ’ হয়ে যায়। এত ডেলিকেট জিনিসটা আর্টিফিশিয়ালি বানানো যায় না। কোথায় পাবে এরকম স্পঞ্জি ইয়ে? ডাক্তাবাবু বলছিলেন, যাঁরা ‘টপ’ লেসবিয়ান, মানে পুরুষ টাইপের মেয়ে, ওরা বিশুর জায়গায় একটা মাংস টাইপের কিছু দিয়ে রাখে, ভিতরে পকেটের মতো করে দেয়, যখন কাজ-কারবার করবে, তখন পকেটের ভিতরে পলিমারের স্টিক ঢুকিয়ে দেয়, ওটা সাপোর্টের মতো আর কী, নেতিয়ে-পড়া তুলসী গাছকে বাঁশের চটা দিয়ে যেমন বেঁধে খাড়া রাখত মা। তারপর কাজ হয়ে গেলে স্টিকটা খুলে নিলেই হল। তখন ওই মাংসটা নেতিয়ে পড়বে আবার। ওদের কিন্তু হিসুর জায়গাটা আলাদাই থাকে। আর ওই পেনিস-টা হচ্ছে জাস্ট একটা গয়না। অত ঝামেলা না-করে টপ লেসবিয়ানদের অনেকে ‘ডিলডো’ ইউজ করে—কোমরে বেল্টের মতো বেঁধে। তারপর ডাক্তারবাবু জিগ্যেস করেছিলেন, আপনি কি লেসবিয়ান না ট্রান্সজেন্ডার?
তুই কী বললি? পরি জিগ্যেস করেছিল।
তৃপ্তি বলেছিল, আমি বললাম, ডাক্তারবাবু, আমি ঠিক জানি না, তবে আমার একটা খুব সুন্দর পেনিস পেতে ইচ্ছে করে।
ডাক্তারবাবু জিগ্যেস করেছিলেন, ওটা পেলে কী করবেন?
আমি বললাম, ওটা দিয়ে সবাই যা করে…।
এতক্ষণ ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা হল, কিন্তু তখনও আমার সব কিছু দেখেননি। এবার শুয়ে পড়তে বললেন। জিন্স-প্যান্টি খুললাম। উনি গ্লাভস পরে নিলেন হাতে। জায়গাটা টিপে দেখছিলেন। ওপরের দিকে হাত দিলেন। চটি বইতে পড়েছি—জায়গাটাকে ‘ছোট নাক’ বলে। মেয়েদের ওই জায়গাটা নাকি খুব সেনসেটিভ হয়।
পরি বলল, হ্যাঁ। ক্লিট। ক্লিটোরিস। শুনেছি।
হ্যাঁ, তৃপ্তি বলছিল, ওখানে হাত দিলেন, নাড়িয়ে দেখছিলেন। আমার শিরশির করছিল গা- টা। তারপর গ্লাস-পরা আঙুলে কী একটা জেলির মতন মাখিয়ে বিশুর জায়গাটায় ঢুকিয়ে দিল। আমার একটু ব্যথা লাগছিল। ডাক্তারবাবুর কপালটা দেখলাম কুঁচকে যাচ্ছে। তারপর একটা যন্তরের মতো কী যেন, একদিকে লেন্স আছে, সেটা ঢুকিয়ে দিয়ে লেন্সে চোখ দিয়ে কী সব দেখলেন। তারপর নিজেই বললেন, মেন্স হয় না নিশ্চয়ই। আমি বললাম না। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, আগে কাউকে দেখাননি?
আমি বললাম, না।
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘ভ্যাজাইনাল ক্যাভিটি’-টা ব্লাইন্ড।
ব্লাইন্ড? আমি একটু যেন আঁতকে উঠেছিলাম। উনি বলেছিলেন ক্লোজড। বন্ধ। ইউরিন পাস হয় নিশ্চয়ই এখান দিয়ে… উপরের ছোট্ট মাংস পুঁটুলিটার ওপর একটা স্টিলের রড ছোঁয়ালেন। তক্ষুনি মনে হয়েছিল ওটা যদি জাদুদণ্ড হত, আর ওই জাদুদণ্ডের স্পর্শে ওটা বড় হয়ে যেত… আমি বললাম, হ্যাঁ। ওখান দিয়েই…। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, আপনার আগে কখনও মনে হয়নি আপনি ঠিকঠাক ‘মেয়ে’ নন…। আমি বলেছিলাম, মনে হয়েছে, যখন মেন্স হচ্ছিল না, মা-বাবাকে কিছু বলেনি লজ্জায়, মা হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন…। একটা মেয়ে ডাক্তারের কাছেও। উনি বলেছিলেন, প্যাসেজ-টা সরু। বিয়ে হলে ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন সব পোশাক পরে নিন। তারপর হাত ধুয়ে লিখে দিলেন : এমআরআই, আলট্রাসোনোগ্রাফি।
ওসব করিয়েছিস? পরি জিগ্যেস করেছিল।
তৃপ্তি বলল, না রে। এরপরই তো পাতিয়ালা যেতে হল। ওখানে একটা ইন্টার রেল অ্যাথলেটিক্স ছিল।
এবার তবে করিয়ে নে… পরি বলেছিল।
—হ্যাঁ, করাব। টাইম পাচ্ছি না। আবার জব্বলপুর যেতে হবে। তা ছাড়া একগাদা টাকাপয়সা খরচা করে ওসব করিয়েই-বা কী হবে বল? ডাক্তারবাবু তো বলেই দিলেন তোরা যে ধনে ধনী সে ধন আমার হবে না। এত বড় প্লাস্টিক সার্জেন, তিনিও পারেন না।
মাংস ম্যারিনেট হচ্ছিল। এবার প্রেসার কুকারে বসাল পরি।
তৃপ্তি বলল, ছোটবেলাটাই ভাল যায় রে পরি, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হল বাল্যকাল, তাই না?
পরি মাথা নাড়ায়।
তৃপ্তি বলে, এখন আমার ঘরে কত মেডেল, কাপ, শিল্ড, সার্টিফিকেট। মনে হয় ওই সব ফালতু। জঞ্জাল। রাগ হয়। অবশ্য স্পোর্টস-ই তো আমাকে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু জানিস মাইরি, ভিতরটা হু-হু করে…।
সেই হু-হু…। শুকনো নদীখাত, রৌদ্রদগ্ধ জনহীন বালুচর। নির্জন হাওয়া।
দু’জনেই চুপ করে থাকে, শুধু প্রেশার কুকারে শোঁ-শোঁ। তৃপ্তি বলে, মেরা কুছ নেহি হ্যায়। কুছ ভি…। আবার নৈঃশব্দ।
তৃপ্তি বলে, ওই যে ছেলেটা, তোর বন্ধু, তোকে ভালবাসে, না?
পরি ছোট করে সম্মতির মাথা নাড়ে।
ইউ আর লাকি। আমার কেউ নেই রে…। এবার একটু গলা চড়িয়ে তৃপ্তি বলে—আরে বাবা, আমি ঠিকঠাক মেয়ে না-ও হতে পারি, আমার ঠিকঠাক ‘ফুটো’ না-থাকতে পারে—আমি মানুষ তো, মানুষ তো রে বাবা। সারা জীবন ধরে আমি কি সিট-আপ-বেন্ডিং-মৎস্যাসন-কুর্মাসন করে যাব নাকি? আর কত দিন ছুটতে ভাল লাগে?
গলার ‘পিচ’ বাড়ালে ওর স্বর বেশ খরখরে হয়ে যায়। এমনিতেই ওর স্বর একটু মোটা। কলেজে কিন্তু ওর গলা আর একটু সরু ছিল।
ও ইচ্ছে করে মোটা করার চেষ্টা করছে কি না ওই বলতে পারবে। পরি যেমন যতটা পারে গলাটা সরু করার চেষ্টা করে।
তৃপ্তি বলে, প্যায়ার মুহব্বত বলে যা কিছু আছে, সিনেমায় দেখেছি। লাইফ-এ দেখিনি। রাজেশ মাথুর নামে একটা কোচ ছিল, ও শুধু এক্সারসাইজ দেখিয়ে দিত, আমার ইভেন্ট থাকলে পুজো দিত, সেই পুজোর ফুল আমার মাথার চুলের ফাঁকে গুঁজে দিত, ব্যস ওইটুকুই ওর বডি টাচ। তবু ভালবাসাটা বুঝতাম, বুকের মধ্যে যেন শিল-পড়া বৃষ্টি হত। এখন মাইরি হু হু। একটা ফাঁকা রেসিং ট্রাক, চুনের দাগও উঠে গেছে, ওখানে একটা ক্রাচ নিয়ে হাঁটছি আমি। ঘুরপাক খাচ্ছি। কেউ নেই…। আই নিড সামথিং, আই নিড লাভ। বাংলায় যাকে বলে ভালবাসা…। আই নিড সেক্স টু-উ-উ…।
প্রেশার কুকার ফোঁশ করে উঠল।
পরির কলেজ জীবনের একটা দিনের কথা মনে পড়েছিল, তৃপ্তি ওর জিন্স-এর জিপার খুলে দিয়ে বলেছিল, একটু প্যাসেজ-টা দ্যাখ না রে… তোর সঙ্গে কম্পেয়ার করে…। পরি শুধু ওপর দিয়ে একবার হাত দিয়েছিল শুধু, সহানুভূতির। পরীক্ষায় ফেল করে এলে, ভাল মা যেভাবে মাথায় হাত রাখে…।
পরি বলল, তুই তা হলে এত ‘কক্’’কক্’ করছিস কেন? তোর ওই ‘ন্যারো’ প্যাসেজটাকে ঠিক করিয়ে নে… মেয়েই হয়ে যা।
তৃপ্তি বলল, ছোটবেলায় ভাবতাম… কয়েক বছর আগেও ভাবতাম…। এখন আমি বুঝতে পারছি আমি মেয়ে না। আমি কী আমি জানি না। দেখবি। দ্যাখ না, শেয়ার কর না একটু…।
পোশাক খুলে ফেলে তৃপ্তি। উন্মুক্ত হয়।
পরি ওর যৌনাঙ্গ দেখতে পায়। দেখে যোনি-ই মনে হয়। রোমাবৃত কিন্তু ওপরের অংশ, যেখানে ক্লিটোরিস থাকে, বইতে তো এরকমই ছবি দেখেছে, সেটা যেন একটু বড়। চিড়িয়াখানায় দেখা শিশু বানরের শিশুর মতো যেন।
তৃপ্তি বলে, এই আমার বিশুর জায়গা, যেটা নাকি ব্লাইন্ড, আর এই আমার হিসুর জায়গা। এখানে কোনও ভিক্টরি স্ট্যান্ড নেই। এটা আমার ‘স্পট অফ ডিফিট’। এখানে আমি হেরো। আমার কোনও বিচি-টিচিও নেই। অথচ আমার মনে হয় আমি ছেলে। মেয়েদের দিকে আকর্ষণ। আমি যে কী করি….
হঠাৎই তৃপ্তি ওর দুই হাত বরণ ডালার মতো করে, পরির লিঙ্গস্থলের কাছে নিয়ে যায়, স্পর্শ করে, বলে, ইয়ে চিজ তু মুঝে দে’ দে ঠাকুর…। প্রেশার কুকার আর্তনাদ করে চলেছে।
.
তৃপ্তি সামন্তকে নিয়ে আলোচনা তখন চলছে। কেউ বলছে, এটা ‘ব্ল্যাকমেল কেস’, থানায় নিশ্চয়ই টাকাপয়সার লেনদেন হয়েছে, নইলে একটা মেয়েকে কিছুতেই অন্য কোনও মেয়েকে ‘রেপ’ করার জন্য চার্জ করা যায় না। কেউ বলল, দ্যাখ গে, ও হয়তো আসলে ছেলেই, কমপিটিশনে জেতার জন্য জেন্ডার ভাঁড়িয়েছে। এগুলো জেন্ডার চিটিং। অন্য একজন বলল, তা কখনও হয় না কি আবার? ও কি পাড়ার স্পোর্টস-এর প্রাইজ উইনার না কি? কত বড়-বড় অ্যাথলেটিক মিট-এ প্রাইজ জিতেছে। ওরা কি টেস্ট করেনি? অন্য একজন বলল, দ্যাখগে ও হয়তো হিজড়ে…। পরি শুধু শুনছিল, ও কোনও মন্তব্য করছিল না। হিজড়ে প্রসঙ্গ আসতেই একজন পরিকে জিগ্যেস করল, অ্যাই হিজড়েদের ওই জায়গাটা কেমন দেখতে হয় রে? পরিকেই জিগ্যেস করল, যেন ও এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। পরির রাগ হল। ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, জানি না। এরপর হাসির শব্দ। সমবেত
তখন নন্দীগ্রামে সিঙ্গুর নিয়ে কলকাতা গরম। জঙ্গলমহলে রোজ মানুষ খুন হচ্ছে, কলকাতার মেট্রো চ্যানেলে সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির গাড়ি কারখানার বিরুদ্ধে বিদ্বজ্জন সমাবেশ হচ্ছে। তে-ফসলি জমিতে কৃষক উচ্ছেদ করে শিল্প : ছি-ছি চলছে। এরই মধ্যেও বিদ্বজ্জনরা ফিসফিসোচ্ছে—তৃপ্তি সামন্তর ওই জায়গাটা কেমন?
পুলিশ কাস্টোডি’তে কোনও বিজ্ঞানমনস্ক পুলিশ মোবাইলে খচ করে ওর যৌনাঙ্গের ছবি তুলে অন্য কাউকে বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য পাঠিয়ে দেয়, তারপর ছবি ফরওয়ার্ডিং চলতে থাকে জি.পি সিরিজে, মা-মাটি-মানুষের কাছে ছবি পৌঁছে যায়। সেই তমসাবৃত স্থানে ফ্ল্যাশ ঝলকেছিল ঠিকই, কিন্তু ফ্ল্যাশ সেই রহস্য-তমসা ভেদ করতে পারেনি। সেই স্যুররিয়ালিস্ট ছবিটা যে-মোবাইলগুলোতে এল না, সেই মোবাইলগুলো হীনম্মন্যতায় ভুগতে লাগল। কিছু মোবাইল ‘যে-ধনে হইয়া ধনী মণিরে মানে না মনি’ টাইপের অহংকারী হয়ে উঠল। টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ হল ‘ডাক্তারি পরীক্ষায় তৃপ্তি পুরুষ’। এবার তৃপ্তি কি সত্যিই পুরুষ? এ নিয়ে আলোচনা চলতে লাগল। একজন নারীবাদী কবি বললেন, ‘ছিদ্রসন্ধানী পুরুষতন্ত্র কেবল ছিদ্র খুঁজে যায়। ছিদ্র নিয়ে নারীত্ব বোঝা যায় না কখনও। নারীত্ব থাকে অন্তরে।’ টেলিভিশনের আলোচনায় সিরিয়াল-অভিনেতা, গায়ক, কবি-সাহিত্যিকদের দেখা যায় অর্থনীতি, নৃতত্ত্ব, এমনকী আমেরিকার সঙ্গে নিউক্লিয়ার ডিল করা উচিত কি না এসব নিয়েও মতামত দিচ্ছেন। লিঙ্গ-নির্ধারণ সম্পর্কিত এক আলোচনায় হাতে গিটার নিয়ে একজন গায়ক গাইলেন—কী বা অন্তর আছে নারী-নরে অন্তরে থাকে যদি ধন’।
তৃপ্তির সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল পরি, কিন্তু ফোন সুইচড অফ। তৃপ্তির কাছে আগেই শুনেছিল, ও এখন একাই থাকে। ওর বাবা গত হয়েছেন, মা দেশে চলে গিয়েছেন, ওখানে কাকারা থাকেন। তৃপ্তি টাকা পাঠায় মা-কে। প্রথমে রেলের কোয়ার্টারে ছিল, ওখানে থাকা লস। এখন হাউস রেন্ট অ্যালউয়েন্স থার্টি পার্সেন্ট। কোয়ার্টারে থাকলে ওই টাকাটা পাওয়া যায় না, তাই একটা ‘ওয়ান রুম’ ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে বাঁশদ্রোণীর দিকে।
মিড়িয়া মারফত জানা গেল সুমিতা হালদার একজন বিবাহ-বিচ্ছিন্না মহিলা। দু’বছর ধরে তৃপ্তির সঙ্গে থাকে। একটা টিভি চ্যানেল সুমিতা হালদারের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দেখিয়ে দিল।
প্রশ্ন : আপনি তৃপ্তি সামন্তর বিরুদ্ধে থানায় নালিশ করতে গেলেন কেন?
উত্তর : ও আমার সঙ্গে দিনের-পর-দিন খারাপ কাজ করত।
প্রশ্ন : আপনি বাধা দিতেন না?
সুমিতা : ওর সঙ্গে গায়ের জোরে পারব কেন?
প্রশ্ন : ও জোর করত?
সুমিতা : হুঁ। কখনও জোর করত, কখনও বলত আমরা তো বিয়ে করব…।
প্রশ্ন : দু’জন মহিলার মধ্যে তো বিয়ে এখনও আমাদের আইনে চলে না… তা হলে?
সুমিতা : ও তো ছেলেই! আমি দু’বছর ধরে জানি ও ছেলে। তবে অরজিনাল না, একটু কম-ছেলে। ও বলত, অপারেশন করে ‘পুরো’ ছেলে হয়ে যাব।
প্রশ্ন : কী করে বলছেন তৃপ্তি সামন্ত একজন ছেলে? মহিলা অ্যাথলেট হিসেবে কত প্রাইজ পেয়েছে…
সুমিতা : সে আমি জানি না কী করে পেয়েছে, তবে ও ছেলে। ছেলেরা যা-যা করে ও তাই করত।
প্রশ্ন : আপনার সঙ্গে কী করে আলাপ?
সুমিতা : আমি রান্না করতাম, তাপ্পর একদিন বলল, আমরা বেশ একসঙ্গে থাকব, আমি বর, তুমি বউ, সংসার করব।
প্রশ্ন : তারপর?
সুমিতা : তাপ্পর আবার কী? এখন অন্য গান গাইছে…
যখন ওইসব কথাবার্তা চলছিল, টেলিভিশন পর্দার ওপর কতগুলো অক্ষর নড়ে বেড়াচ্ছিল—exclusive…exclusive ।
হাটেবাজারে, শ্মশানঘাটে, ছাত্রাবাসে খেলার মাঠে আলোচনার বিষয় হয়ে গেল তৃপ্তি সামন্ত ছেলে, না মেয়ে। এর যে কোনও একটা হতেই হবে, না হলে হিজড়ে। কত প্রশ্ন : বাংলার বায়ুমণ্ডলে ফ্যাৎক্যাৎ সাঁইসাঁই উড়ে বেড়াতে লাগল—যেমন হিজড়েরাও কি স্পোর্টস-এ অংশ গ্রহণ করতে পারে? যদি পারে, তবে পুরুষ বিভাগে, না কি নারী বিভাগে? হিজড়েদের জন্য আলাদা স্পোর্টস কেন হয় না, যেমন অন্ধদের জন্য, খোঁড়া, সরি, প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা স্পোর্টস…। আচ্ছা, স্পোর্টস অথরিটিই বা কেমন? ওরা ন্যাজ উল্টে দ্যাখে না বকনা কি এঁড়ে? আচ্ছা, ওর মেডেলগুলো কি কেড়ে নেবে?
খবর কাগজের সাংবাদিক তৃপ্তির মায়ের সঙ্গে গিয়ে দেখা করল হাওড়া জেলার কোনও গ্রামে। তৃপ্তির মা বলেছিলেন, ওর জন্ম থেকেই তো জানি ও মেয়ে। ফ্রক পরাতুম, কপালে টিপ পরাতুম, মেয়েদের ইস্কুলে পড়েছে, নাচের ইস্কুলে দিয়েছিলুম। দিদিমণিদের জিগ্যেস করুন গে, সবাই জানে ও মেয়ে। ছেলে হলে তো ভালই হত। আমার তো ছেলের শখই ছিল। কিন্তু মেয়েই তো হল। কিন্তু মেয়ে হয়েও তো দশের এক হল। কত মেডেল আনল, আমাদের মুখ উজ্জ্বল করল। ওর বাবা বলত মেয়ে হয়েছে বলে কোনও দুঃখ নেইকো। আমার মনে হচ্ছে এর পেছনে কোনও চক্রান্ত আছে, ওই রাঁধুনে মেয়েটা ওকে ফাঁসিয়েছে। আমিই বলেছিলাম, হাত পুড়িয়ে খাচ্ছিস মা, একটা রান্নার লোক দ্যাখ। আবার বাড়িওলাও নাকি অনেকটা ভাড়া বাড়াতে বলেছিল…। কাগজে লেখালিখি হচ্ছে লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য পুলিশ কেন সরকারি হাসপাতালে না পাঠিয়ে নার্সিং হোমে পাঠাল। নার্সিং হোমের ডাক্তার সার্টিফিকেট দিয়েছে তৃপ্তি পুরুষ।
কোর্ট থেকে বলা হয়েছে ওর জিনেটিক টেস্ট করতে হবে। কিন্তু জামিন দিচ্ছে না। তৃপ্তি হাজতে। যেহেতু সরকারি চাকরি, পুলিশ কাস্টোডিতে থাকলে সাসপেন্ড হতে হয়। যদি প্রমাণিত হয় ও পুরুষ নয় তা হলেই চাকরিটা আবার ফিরে পাবে।
অন্যান্য অফিসের মতো পরির অফিসেও কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই আলোচনা চায়ের সঙ্গে চানাচুরের মতো চলছে। একটা জব্বর ইস্যু পাওয়া গিয়েছে বটে। আজ নিনা এসেছে। নিনা বলল, আই নো দ্য মিস্ট্রি। সবাই জানে নিনার হ্যাজব্যান্ড ডাক্তার, তাই অনেকেই নিনার মেডিকাল টিপস চায় যেমন জাপানি তেল কি মেড ইন জাপান, এখানে বটলিং হয়? হুইস্কি কি হার্ট ভাল রাখে? তা হলে রাম কী দোষ করল? সর্ষের তেল না সানফ্লাওয়ার? নিনাও টিপ্স দেয়। নিনা বলছে, জানো? তৃপ্তি কিন্তু ছেলেই। মাইক্রো পেনিস, হি হি।
টিকে ওর মোবাইলে একটা ছবি পেয়েছিল, ওই মেয়েটার, সরি, ছেলেটার। ওর কোনও বন্ধু ফরওয়ার্ড করেছিল। কম্পিউটার ছবি ট্রান্সফার করে, বড় করে দেখছিল।
নিনা বলছিল এ ভেরি স্মল পেনিস, কভার্ড বাই পিউবিক হেয়ার। বল্সও নেই। টি.কে বলছিল বল্স হয়তো পেটের ভিতরে রয়ে গিয়েছে। টি.কে বলছিল ছোটবেলায় ওই তৃপ্তির পেনিসটা হয়তো হাইডেড ছিল, বোঝাই যেত না, সামান্য এক্সপোস্ড হয়েছিল। তা ছাড়া ও তো স্পোর্টস ম্যান, ডোপ টোপ করে কি না কে জানে, হয়তো ডেপিংএর হরমোন এফেক্টএ ওর মলেন্ট করার ইচ্ছে হয়েছিল… ইয়ে মানে ইন্টারকোর্স সম্ভব নয়, হি হি,… টি. কে বলেছে…।
প্রীতি নামে একটা মেয়ে আছে একটু কমই কথা বলে, ও বলল আমার কম্পিউটারে দেখে যাও, স্পটেড ফিমেল হায়নাদের জেনিটাল কেমন, ‘জেন্ডার আইডেনটি সার্চ দিয়েছিলাম, উইকিপিডিয়া দেখছিলাম, এখানেই আটকে গেলাম। জাস্ট সি, শি ইজ ফিমেল, বাট জেনিটাল লুক্স লাইক মেল। বলছে ওদের ক্লিটোরিস এতটাই এনলার্জড থাকে, যে মানুষ কনফিউস্ড হয়ে যায়।
নিনা বলল মানুষ কনফিউসড হয়, কিন্তু হায় না হয়না। ঠিক হ্যায় না? হি হি
প্রীতি বলছে তোমরা যেটা স্মল পেনিস ভাবছ, সেটা তো এনলার্জড ক্লিট ও হতে পারে…
বাপি বোস বলল—আরে নিনা’স হ্যাবি ইজ এ ডকটর আফটার অল…। ক্লিট আর পেনিসের তফাত বুঝবে না ও? তুমি কটা ক্লিট দেখেছ?
নিনা বলে, বাপি যেন অনেক দেখেছে…
হ্যাঁ, দেখেছি তো… এ নাম্বার অফ…
এ সময় সিদ্ধেশ গর্গ চলে আসে।
গর্গ বলে জেন্ডার বহুত খতরনাক চিজ হ্যায়। বহুত উল্টাপাল্টা আছে। একটা কহবত, মতলব, কাহানি আছে কি, একটা ট্রাইবাল ভিলেজে একজনের বাড়িতে একজন বড় মেহমান এসে গিয়েছে। বলছে লাঞ্চ করবে। লেকিন ঘরে কিছু নাই। খালি চাওল আছে। ও কি করল, ফান্দ, মিস্ ট্র্যাপ নিয়ে বেরিয়ে গেল আর চিড়িয়া ধরে আনল। যে বড় মেহমান ছিল, সে হল কোনও ট্রাইবাল হেড। আগে মন্ত্র টন্ত্র পড়ে তারপর খায়। লোকটা চিড়িয়াটা এনে দিল। মেহমান বলল—এটা আওরত নয় তো? আমি স্ত্রী হত্যা করি না। আমি মুরগা খাই, মুরগি খাই না। খাসি খাই, ছাগল খাই না। কনফার্ম হোয়েদার দিস বার্ড ইজ মেল অর ফিমেল।
পাখিটা একটা রেয়ারটাইপের কিছু ছিল, মে বি আনকমন বার্ড, হোস্ট, গেস্ট কেউ বুঝতে পারল না কি ওটা মেল আছে না ফিমেল আছে। লোকটা বার্ডটা নিয়ে ওর নেক্সট নেবারের কাছে গেল, ও কিছু বলতে পারল না, আবার অন্য একজনের কাছে গেল, সে ভি কিছু বলতে পারল না। তখন একজন বলল মাস্টারজির কাছে যাও, মাস্টারজি বহুত লার্নেড ম্যান, ও ঠিক বাতাতে পারবে। তো আলটিমেটলি মাস্টারজি কো পাস গিয়া। মাস্টারজি চিড়িয়াকো কুছ একজামিন ভি নেহি কিয়া, বোলা–আরে ইয়েতো বহুত সিম্পল ম্যাটার হ্যায়। উসকো কুছ দানা দে দো, খানেকা। আগর খায়েগা তো জরুর পুংলিঙ্গ হোগা, অর উয়ো খায়েগী তো স্ত্রী লিঙ্গ, ব্যাস, হো গিয়া…।
চোদ্দোদিন পর জামিন পেয়েছিল তৃপ্তি। খবর কাগজ পড়ে জেনেছিল যে তৃপ্তি জামিন পেয়েছে, ওর টিস্যু কোথায় যেন পাঠানো হয়েছে জিনেটিক পরীক্ষার জন্য। পরি ফোন করেছিল। তৃপ্তিই ধরল এবার। তৃপ্তি তখন ওর দেশের বাড়িতে ছিল, মায়ের কাছে। তৃপ্তি বলল—বাড়িতে ঘর বন্ধ করে আছি। পাড়ার লোক আমাকে ভাবছে একটা আজব টাইপের কোন জন্তু। দেশের বাড়ির ক্লাব থেকে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল ওরা ভাবছে আমার দু’পায়ের ফাঁকে কী আছে? ছোটকাকা বলছিল ছোটবেলায় তো তুই বসে পেচ্ছাপ করতিস, এখনও কি ওই ভাবে, নাকি দাঁড়িয়ে?-তৃপ্তি বলছিল খবর কাগজ আর টেলিভিশনে নানা রকম কথাবার্তা হয়েছে তো আমাকে নিয়ে, অনেকের ধারণা লেজ গজানোর মতো আমার একটা নতুন ধন গজিয়েছে। —বলল, কলকাতায় ফিরতে হবে। চাকরিটা বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। তোর বাড়িতে থাকতে দিবি? তুই তো একা থাকিস।
পরি বলল—কেন, তোর বাড়ি কি হল?
বলছে আমার মতো উল্টোপাল্টা কেসকে বাড়িতে রাখবে না।
পরি বলল, ও। চুপ করে রইল।.
পরি ওকে কি করে বলে চলে আসতে এখানে? ওর বাবাকে ঘরে আনতে হবে যে…।
কার্তিক পাল, মানে পরির বাবা খবর দিয়েছিল—খুব শরীর খারাপ একদিন আয়, দেখে যা। পরি গিয়েছিল।
ওর বাবা খালি গায়ে ছিল। ওর বাবাকে দেখে অবাক। একটা বুক ফুলে উঠেছে। কী অশ্চর্য! ওর বাবারও? একটা বুক যেন প্রায় স্তন। অন্যটাও ফুলেছে, অতোটা না। বুক আর গলার মাঝে কতগুলো গুটলি। গলাতেও গুটলি বেরিয়েছে। চামড়ার ভিতরে যেন চড়াই পাখির ডিম। শরীরটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
পরি জিজ্ঞাসা করেছিল এসব কবে থেকে বেরল?
ওর বাবা বলল, হল তো তিন হপ্তার ওপর
ব্যথা করে?
ওর বাবা মাথা নাড়াল।
পরি ওর বাবার ফুলে ওঠা স্তনে হাত দিল। একটু চাপ দিল। ব্যথা লাগে?
—না।
ডাক্তার দেখিয়েছ?
দেখিয়েছিলাম তো, শর্মা ডাক্তারকে। বলল বড় ডাক্তার দেখাতে। এখন হোমিওপ্যাথি খাই। একজন বলল আব, আঁচল, টিউমার, এসব হোমিওপ্যাথিতে ভাল কাজ হয়।
ওই ডাক্তার কী বলল?
বলেছিল তো ভাল হয়ে যাবে, টাইম লাগবে।
ভাল হচ্ছে?
মাথা নাড়িয়েছিল কার্তিক।
তবে বড় ডাক্তার দেখালে না কেন?
অনেক টাকা লাগে…
টাকা পাঠাই তো…
ওতে কি হয়…
তবে কি আরও টাকা পাঠাতে বলছ?
না রে… আমার ছেলে হলেও তুই, মেয়ে হলেও তুই। আমার চিকিচ্ছেটা করিয়ে দে…।
এরপর একজন বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল পরি।
সেই ডাক্তারের খোঁজ নিনাই দিয়েছিল। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন মনে হচ্ছে লিম্ফোমা হজকিন—নাকি নন হজকিন পরে বুঝতে পরব। অনেকগুলো টেস্ট করতে হবে।
রক্তপরীক্ষা করাতে দিয়েছে পরি। রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। মনে হচ্ছে লোকটাকে ওর বাড়িতেই নিয়ে আসতে হবে। এই অবস্থায় তৃপ্তিকে ও কী করে বলবে চলে আয়?
তৃপ্তি আবার বলল তোর বাড়িতে থাকতে পারি ক’দিন? যতদিন না …
পরি বলল তোর বাড়িটা ছাড়তে যাবি কেন? ইঃ, আল্লাদ? বাড়িওলা বললেই ছাড়তে হবে নাকি? ভাড়া কিছুটা না হয় বাড়িয়ে দে…। তৃপ্তি বলল—অন্য ভাড়াটেরাও চাইছে না, আমি থাকি, ওরা নাকি হিজড়ে টিজড়েদের কিংবা লেসবিয়ান-টেসবিয়ানদের সঙ্গে থাকতে চাইছে না। পাবলিক এখনও কনফিউজ্ড আমি লেসবিয়ান না হিজড়ে? অ্যাথলেট পরিচয়টা কোনও কিছু নয়।
পরি বলে তোর স্পোর্টস লাইনের কারোর কাছ যদি…
তৃপ্তি বলে আরে ধুর, আমার এই কিচাইনে ওরা তো খুশি।
কতরকমের যে সত্যি কথা হয়, পরি ভাবে। ‘সত্য যে কঠিন বড় কঠিনেরে ভালবাসিলাম’। রবীন্দ্রনাথ লিখেই খালাস।
তৃপ্তি বলল—তোর বাবা কি এসে গিয়েছেন?
পরি বলল—না রে, শিগগিরই নিয়ে আসতে হবে। একদম দূর্বল হয়ে গিয়েছে, জ্বর হচ্ছে মাঝেমধ্যে… গায়ে কেমন গুটলি…।
তৃপ্তি বলল, তবে কাল যাই? সারাদিন কাজ করে রাতে তোর কাছে থাকব, পরদিন আবার কিছু কাজ সেরে বাড়ি ফিরব।
চয়নকে জানাল। চয়ন বলল সাবধানে থাকিস। তোকে আবার সুমিতা না করে দেয়। চয়ন ইয়ারকির ছলেই বলল। মানে, তৃপ্তিকে নিয়ে ঠাট্টা-চর্চিত, ইয়ারকি চর্চিত সমাজের চয়নও একজন।
সব কিছু চয়নকে বলতে হয়, নইলে আবার রাগ করে। বড্ড পজেসিভ। ওর বাবার কথা বাবাকে নিয়ে আসা নিয়ে ওর ভাবনার কথা বলেছে। ও গাঁইগুই করছে। কিন্তু সব সময় কেন ওর কথা শুনবে? চয়নের চেয়ে অনেক বেশি রোজগার করে পরি। টাকাকেও তো ধন বলে। ওই সব পরিবারে কী হয়? যেখানে বর-বউ এর সংসার? বরের চেয়ে সিঁদুর পরা বউ-এর রোজগার বেশি, সেসব সংসারেও বউরাই সকালের চা শাঁখা পরা হাতে স্বামীকে এগিয়ে দেয়, স্বামীর গেঞ্জি জাঙ্গিয়া কেচে দেয়, যদিও স্বামীরা কখনও বউদের অন্তর্বাস কাচে না, হাতই দেয় না, দরকার হলে সন্ধের পর স্বামীকে শশা কেটে দেয়। আলুভেজে দেয়, সঙ্গে স্বগতোক্তি—কেন যে এসব ছাইপাঁশ খায়…। সে সব বউরাও কি মাকে গরদ দেবে না তসর দেবে এ নিয়ে পরামর্শ করে? নিজের বাবাকে মাসে মাসে চ্যবনপ্রাশ কিনে দিতে হলেও কি বরের সঙ্গে পরামর্শ করে? বিধবা মাকে যদি ঘরে নিয়ে আসতে চায়? বর আপত্তি করলেও বেশি মাইনে পাওয়া শাঁখা পরা বউরা কী করে? বরের চেয়ে নিজের মতটাই খাটায়। রোজগার বেশি। ও ধনের চেয়ে এ ধনের জোরটাই বেশি। বেশি নয়? কারুক গাঁইগুই। কার্তিকবাবুকে নিয়েই আসবে। কার্তিকবাবু কেন? বাবাই তো। পিতা। পিতা ধর্ম পিতা স্বর্গ না কি যেন…শিট্। বেচারা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। মা থাকলে তো মা কবেই নিয়ে আসত।
তৃপ্তি এসেছিল রাত ন’টা নাগাদ। ও চাদর দিয়ে মুখের অনেকটাই ঢেকে এসেছিল। এখনও এমন কিছু শীত পড়েনি। যতটা আড়ালে থাকা যায়। ও জানে, খবর কাগজ আর টিভির মহিমায় ওকে এখন বহু লোক চিনে গিয়েছে। খেলায় জিতেছে, মেডেল পেয়েছে তখন, কটা লোক চিনেছে? এখন চেনে। যারা মোবাইলে ছবি পেয়েছে ওরা ওই ছবিটা জুড়ে দেয়, যারা পায়নি, ওরা কল্পনা কবে কিছু একটা বসিয়ে নেয় পদসন্ধিস্থলে।.
তৃপ্তি যা যা বলল তার সারমর্ম হল—চাকরি থেকে সাসপেন্ড হয়ে আছে বলে মাইনে খুব কম পাচ্ছে। যতদিন মামলা না মিটবে, ততদিন এরকমই পাবে। যদি মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়, তবে বকেয়া টাকা ফেরত পাবে, আর দোষী প্রমাণিত হলে তো সব গেল।
ওর উকিল বলেছে দোষী প্রমাণিত হওয়ার কোনও চান্স নেই, মামলা টিকবে না, ডাক্তারি সার্টিফিকেটে বলা আছে লিঙ্গগত ভাবে পুরুষ হলেও ও প্রায় লিঙ্গহীন।
একটা খুব ছোট্ট নুনু থাকলেও সেটা রেপোপযোকী নয়। তাছাড়া সাক্ষীও নেই। শুধু ওই সুমিতা হালদারের মুখের কথায় কেস টিকবে না। এখন শুধু টাকার খেলা। খরচাপাতি করতে পারলে মামলাটা তাড়াতাড়ি শেষ হতে পারে।
আসলে, ওই সুমিতা হালদার অনেক টাকা-পয়সা চেয়েছিল। গয়নাগাটিও। ওর একটা বিয়ে হয়েছিল, ওর স্বামী ওকে ছেড়ে দিয়েছে। ওর পুরনো স্বামীর একাট বন্ধু আছে, ওর সঙ্গে সুমিতার সম্পর্ক আছে। সেই লোকটার বুদ্ধিতেই সুমিতা থানায় এফআইআর-টা করেছে। এখন সুমিতাকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে কেসটা উঠিয়ে নেওয়াও সম্ভব নয়, ৩৭৬ ধারাটা এমনই যে এফআইআর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। কোর্টে হিয়ারিং হবে, ম্যাজিস্ট্রেট যা রায় দেবে, তাই হবে। কোর্টে তো লম্বা লম্বা ডেট পড়ে, উকিল বলেছে পেস্কার ম্যানেজ করে, আরও কি সব ম্যানেজ করে যদি ডেটগুলো একটু তাড়াতাড়ি নেওয়া যায়…। আর ওই মাসিটাকে, মানে সুমিতাকে ম্যানেজ করে, মানে টাকা-পয়সা দিয়ে যদি দুর্বল আর কনফিউজিং সাক্ষ্য দেওয়ানো যায়…
কনফিউজিং সাক্ষ্য মানে সুমিতা বলবে—’ও আমার সঙ্গে শোয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করত, গায়ে হাত দিত, খারাপ জায়গায় হাত দিত… ঘেঁষাঘেঁষি করত, আমি ভাবতাম এটাকেও রেপ বলে।’
পরি বলেছিল—তৃপ্তি, তুই তাই করতিস না কি? তৃপ্তি বলেছিল—হ্যাঁরে, করতাম তো, প্রচণ্ড ইচ্ছে হয় কোনও মেয়েকে আদর করতে। তোকে চুপি চুপি বলছি পরি, যখন তোকে মেয়ে মেয়ে মনে হয়, তোকেও। কোচিং ক্যাম্পেও তো করেছি মাঝে মাঝে দু’-একজনকে। সুমিতা কিন্তু দেখতে একদম ভাল নয়, শরীর টরীরও ভাল নয়, তবুও ওকে। কী করব। ও তো রাজিই ছিল। আমার কেবল মনে হত ছেলেদের মতো যদি আমার একটা যন্তর থাকত…। সুমিতার গায়ের ওপর যখন শুতাম, আমার কল্পনায় ওখানে একটা পেনিস বানিয়ে নিতাম
পরি জিজ্ঞাসা করেছিল তৃপ্তি, তুই যে ওসব করতিস, তোর কি কোনও তৃপ্তি হত? যাকে বলে ক্লাইম্যাক্স…
—হ্যাঁ, কিছু একটা হত। একটা ফ্লুইডও একসময় বেরত বাচ্চা টিকটিকির ল্যাজের মতো ওখানটা থেকে, তুই তো দেখেছিস…. জায়গাটা…। আমি তো চেয়েছিলাম ঠিকঠাক একটা লিঙ্গ। ‘ওই জন্যই তো ডাক্তারের কাছে…। আমি ডাক্তারের কথা মতো এম.আর.আই, ওই সব করিয়েছিলাম। ওসব দেখে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন আমার পেটের ভিতরে নাকি লুকনো অণ্ডকোষ আছে। প্রস্টেটও নাকি আছে।
ডাক্তারবাবু জানতেন আমি খেলাধুলো করি। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন ডোপিং করি কি না…। ডোপিং কি না জানি না, একটা ওষুধ তো খেতাম…। আমার কোচ খেতে বলেছিলেন। একটা ইনজেকশনও নিতাম মাঝেমাঝে। আমার কোচ একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি বলেছিলেন ওই ইনজেকশনটা নিলে শরীরটা ম্যাসকুলার হবে। মাস্ল তো দরকার স্পোর্টস-এ। তখন জানতাম না কি ইনজেকশন নিচ্ছি, অনেক পরে জেনেছি যে টেস্টাস্টেরন নিচ্ছি। ডাক্তারবাবুকে বলেছিলাম সেটা। উনি বলেছিলেন ওই হরমোনই তোমাকে আবার জাগিয়ে দিয়েছে ভাই।
ও বলছিল—দ্যাখ পরি, যখন জন্মেছিলাম, আমার তো নুনু ছিল না, চেরা ছিল, কে জানত ওটা ব্লাইন্ড, কে জানত ওটা ফলস কে জানত ওটা ধোকা? সবাই জানত আমি মেয়ে। আমিও। দিব্যি ছিলাম। খেলতাম টেলতাম, মেয়েদের কিংবা ছেলেদের—কারও দিকেই খুব একটা যৌন আকর্ষণ ছিল না, যৌবন জ্বালা ছিল না। কিন্তু পেটের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা বিচি দু’টোর কথা তো জানতাম না। বাইরের হরমোনে জেগে উঠেছে ও দুটো, বিষ ছড়িয়েছে আমার রক্তে। আমার মধ্যে জেগে উঠল ছেলেত্ব। আমি কী করব বল পরি, আমি তো মেয়েই ছিলাম। তাই তো জানতাম। খুঁতো মেয়ে, মাসিক না হওয়া মেয়ে। জানতাম বিয়ে হবে না, বর জুটবে না, কত মেয়েরই বিয়ে হয় না, আমার ফুল পিসিরই তো বিয়ে হয়নি, না হতেই পারে। ফুল পিসি তো হেড মিসট্রেস। খারাপ আছে? যখন কলেজে, আমার বুকটাও হয়েছিল। ম্যাসকুলার নয়, ফেমিনিন। পেয়ারার মতো। ডাক্তারকে বলেছিলাম সেটা। ডাক্তার বলেছিল, আগে বাইরে থেকে হরমোন নিতাম না তো, আর আমার ওই যত নষ্টের মূল অণ্ডকোষ ঘুমন্ত ছিল, অকেজো ছিল, টেস্টাস্টেরন তৈরি করতে পারত না, তাই বুকটা ফুলেছিল। এখন অনেকটাই ফ্ল্যাট আবার। আমার জিন রেজাল্ট এসে গিয়েছে। আমি নাকি শালা ছেলে, প্রতি কোষে ছেলে, অথচ আমার লিঙ্গ নেই। লিঙ্গহীন পুরুষ, অসমর্থ, অথচ রেপ কেসের আসামী। কেসে হাজিরা দিতে হবে, প্রণাম করতে হবে আমার নেই, আমি পারি না…। পারি না প্রমাণ করতে আমি কোর্টে সবার মধ্যে ল্যাংটো হয়ে বলতে পারি দ্যাখো নেই, নেই, নেই, কিন্তু তাতেও নাকি নিস্তার নেই, উকিল বলেছে, আমি ৪৬xy, আমি প্রতিটি কোষে পুরুষ, রেপ না পারি, শ্লীলতাহরণ তো পারি, মলেস্ট করতে পারি, ৩৭৬ না হোক, ৩৫৪ ধারা তো আছে…। আমি কেন ছেলে হলাম? আমার ঘুমন্ত বিচি কেন জেগে উঠল পেটের ভিতরে? কেন আমি হরমোন নিতে গেলাম? কেঁদে ফেলল তৃপ্তি…। দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, সবই অদৃষ্ট রে পরি…। অদৃষ্ট…ওর পুরনো মেয়ে সত্তা জাগে। পরির মনের মধ্যে আকাশ থেকে ছত্রিসেনাদের মতো প্যারাসুটে করে নামে লাইনটা—অদৃষ্ট রে হাস্য মুখে করব মোরা পরিহাস…।’ কিন্তু ও খারাপ কথা বলে ফেলে। এরকম কথা পরি বলে না। ও বলেছিল, অদৃষ্টের গাঁড় মারি শালা…। পরির মধ্যে পুরনো ছেলেমি। অথচ পরিও মুখ ঢাকল, চোখ ঢাকল…অভাবনীয়ের ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত।