৫৫
বেড়াল যেমন পাঁচিলের ওপর দিয়ে হেঁটে যায়, সেই কায়দায় একটা উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার নাম ‘ক্যাটওয়াক’। এভাবে হাঁটলে পোশাকের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে।
স্ক্রিনে কতগুলো ক্যাটওয়াকিং দেখানো হচ্ছিল। ক্যাটওয়াকিং-এর জন্য বিশেষ জুতো আছে। ব্ল্যাক বেলি, রেড বেলি, পিপ টো ইত্যাদি জুতোগুলোকে দেখানো হচ্ছিল স্ক্রিনে। অডিও-ভিজ্যুয়াল ক্লাস। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ-এর সাত তলার ওপরের এই ঘরে কখনও রিও ডি জেনিরো, কখনও মিলান, কখনও কোলন, কখনও প্যারিস। বিবি রাসেলের একটা শো দেখল ওরা, প্যারিসের বুকে দাঁড়িয়ে গামছার ফ্যাশন। পায়জামা আর কুর্তার ওপর কাঁধে একটা গামছা। এই গামছার দাম কত? মেয়েদের পরনে নানা রঙের গামছা জোড়া দিয়ে, মানে, অ্যাসেম্বল করে বানানো ঘাগরা, একটা চোলি, আর গামছার ওড়না। আমাদের রিকশাওলারা, কুলি-কামিনরা তো কাঁধে গামছাই রাখে, কই, ফ্যাশন তো হয় না! শশী কাপুর কিংবা দেবানন্দ কাঁধে গামছা রাখলে ফ্যাশন হয়। মা-রা স্নান করে বুকের ওপর গামছা ফেলে দিলে সেটা ফ্যাশন নয়। বিপাশা বসু কিংবা সুস্মিতা সেন বুকে গামছা দিলে ফ্যাশন। এখন বিবি রাসেল-এর মডেল’রা গামছার পোশাকে ক্যাটওয়াক করছে। ওসব দেখতে-দেখতে পরি একটা কাগজে সত্তর হাজার কে আড়াইশো দিয়ে ভাগ করে। বছরে আড়াই শো দিনের মতো ক্লাস, সত্তর হাজারটা বছরে দিতে হয়। দু’শো আশি টাকা প্রতিদিন। দু’শো আশিকে ছয় দিয়ে ভাগ করে। ছ’ঘণ্টা যদি ক্লাস হয়, তবে ঘণ্টায় সাড়ে ছেচল্লিশ টাকা। এক ঘণ্টার ক্লাস মানে তিন কিলো চাল। এই যে চল্লিশ সেকেন্ড হেঁটে গেল র্যাম্পে, এটা দেখল, মানে, একজনের একবেলার আহার। ‘আহার’ শব্দটাই মনে এল, কারণ শব্দটার মধ্যে ‘আহা’ রয়ে গিয়েছে। জাহিরুল হাসান ক্লাস নিচ্ছেন। ট্রেন্ড সেটিং আর ফ্যাশন বোঝাচ্ছেন। ইট্স আ বিগ জব। দিস ইজ এক্সক্লুসিভ। এটা হল ফ্যাশন সিগনেচার। দেখলেই বোঝা যায় এসব বিবি রাসেলের ডিজাইন। দেখলে বোঝা যায় রিতু কুমারের ডিজাইন, দেখলেই বোঝা যায় ক্যামেলিয়া জোন্স-এর ডিজাইন। ওঁর ডিজাইন হল নেচারস্যাভি। লিফ, ফ্লাওয়ার বাস এসব দিয়ে কস্টিউম ডিজাইন হয় পাওয়ার পয়েন্টে দেখাচ্ছেন জাহিরুল হাসান। একটি মডেলের বুকে দু’টো ফুল, উরুসন্ধিতে একটা পাতা।
জাহিরুল স্যর বলছেন—ফুল তো সত্যিকারের ফুল হতে পারে না, শুকিয়ে যাবে। ফেব্রিক চুজ করতে হবে। ব্রেস্ট কভারিং ফ্লাওয়ারগুলো সফ্ট কট্ দিয়ে করা হয়েছে। কট্ ফেব্রিক্স কেটে-কেটে, ভাঁজ করে, সেলাই করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ‘পেয়ার অফ ফ্লাওয়ার’ এমন করে সেট করা হয়েছে যেন ক্লিভেজ-টা বোঝা যায়। বুকে আটকে রাখার জন্য কোনও ইলাস্টিক ইউজ করা হয়নি। সিসিল ফাইবার দিয়ে বাঁধা হয়েছে। কিন্তু পাতাটা কট্ নয়। কট্ হলে অসুবিধে হত। কী অসুবিধে হতে পারত?
প্রশ্নগুলো ইংরেজিতেই হচ্ছিল। পরি বুঝতে পারছিল ঠিকই। এই প্রশ্নটার উত্তর গেস করেছে ও, পরি হাতটা উঠিয়ে দেয়।
—নাইস। হোয়াট ইজ দ্য পুফিং?
‘পুফিং’ মানে জানে। রিজেক্ট করা বলে। কেন কন নয়? বলতে গিয়ে মনে হল, ও ঠিক করে ইংরেজিতে বলতে পারবে না।
পরি হাতটা নামিয়ে নেয়। বলে, নো-নো
—হোয়াই নো নো? হোয়াট ইজ ইয়োর প্রবলেম।
পরি বলে, আই অ্যাম নট ফ্লুয়েন্ট ইন ইংলিশ।
—সো হোয়াট? স্পিক ভুল ইংলিশ।
পরি বলে—স্যর, দিস ইজ বন্য-বন্য অরণ্য ভাল থিম। দিস মডেল ইজ চাইল্ড অফ নেচার। সো শি ইজ নট অ্যালাউড টু উইয়ার প্যান্টি। উইদাউট প্যান্টি দ্যাট ক মে ক্রিয়েট আ মার্ক। ভ্যাজাইনা-র সরু প্যাসেজে কট্-টা সেঁটে গিয়ে একটা লম্বা স্কার মার্ক আই মিন একটা দাগ তৈরি করবে। দ্যাট মে লুক্স অসভ্য। কয়েকজন হাল্কা করে হেসে উঠল।
কিন্তু জাহিরুল হাসান বললেন, শিক। শিক। ভেরি রাইট। ফ্যান্টাস্টিক। ফ্যাশন ভোকাবুলারি-তে ‘শিক’ হল ভাল লাগার অ্যাডজেকটিভ। পাতাটাও সিসিল ফাইবার দিয়ে বাঁধা আছে এবং পাতাটা ঘুরিয়ে পিছনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এবং সিসিল ফাইবারে ট্যাগ করা হয়েছে। টুলি স্পিকিং, বাট্ক ক্যাভিটি-টা পাতা দিয়ে ঢাকা হয়েছে, র্যাদার ঢাকার চেষ্টা হয়েছে। কট্ হলে একটা স্কার মার্ক তৈরি হত…। পরি ভাবে, একলাইনের কথাটা কতটা ঘুরিয়ে বলতে হয়। আসল কথাটা হল, ফাঁকে ঢুকে যেত। সেটা ও বুঝেছিল, কিন্তু ওটার ইংরেজি করতে পারেনি।
…ফর দ্যাট রিজন, শি ইউজ্ড সফ্ট কোয়ালিটি পিভিসি। মিস—পলি ভিনাইল ক্লোরাইড। এর কোয়ালিটি কনের মতো নয়। এনি ওয়ে…। ইউ আর ভেরি ট্যালেন্টেড পরি, ইউ সেড রাই লি। এই প্রশংসা পরি-র খুব ভাল লাগল।
পরি এভাবেই এগোয়। ওদের ক্যাড শেখানো হচ্ছে। কম্পিউটার এইডেড ডিজাইনিং আগে হাতে স্কেচ করতে হত। এখন কম্পিউটারই করে দেয়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভার্চুয়াল মডেলটিকে দেখা যায়। কালার কম্বিনেশন কী হবে, সেটাও করে নেওয়া যায়। এছাড়াও ‘ফ্যাশন ফোটোগ্রাফি’ বলে একটা ব্যাপার আছে। ফোটোশপ-এর কিছু কাজ জানাটাও জরুরি। এজন্য নিজের একটা ক্যামেরা দরকার। পরি-র দু’টো জিনিস কিনতে হবে। একটা ক্যামেরা এবং একটি কম্পিউটার। টাকা চাই।
মায়ের সোনার গয়নার পুঁটুলিতে এখনও হাত দেয়নি। ওটা রাখা আছে। ভবিষ্যতে ফ্যাশন শো করাতে হলে টাকা দরকার হবে। মডেলরা অনেক টাকা নেয়। ভেনু ভাড়া করতে হবে। বামন হয়ে কেন যে চাঁদ ধরতে গিয়েছিল….
এই ক্লাসে বত্রিশজন আছে। কুড়িজনই মেয়ে। পিয়ার্সিং করা, ফ্রেঞ্চ জানা মেয়েটার নাম শিকস্তি সিন্হা। মেয়েটার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে পরি-র। ওকে সবাই ‘শিক’ বলে ডাকে। ছেলে মেয়েরা যেটাকে ‘ব্যাপক’ বলে, ফ্যাশন জগতে সেটা ‘শিক’। ‘গ্র্যান্ড’, ‘গ্রেট’, ‘অসাম’, ‘ফ্যান্টাস্টিক’—এসব বোঝাতে ‘শিক’ শব্দটা চালু। এর আসল মানে ‘স্টাইলিশ’। যদিও ‘ব্যাপক’-এর মতো শব্দটার মানে বহুধাবিস্তৃত। পরি ওকে জিগ্যেস করেছিল, শিকস্তি মানে কী গো? ও বলেছিল, কোনও নদীর চর জেগে উঠে যে-জমিটা তৈরি হয় তাকে বলে শিকস্তি। আমার বাপি তো ডিএম ছিলেন…। পরি জিগ্যেস করেছিল, আর যে-জমিটা নদী খেয়ে নেয়, তাকে কী বলে? বাবাকে ফোন করে জেনে নাও তো…।
শিক্ বলেছিল, জানি। ওটা পয়োস্তি। বাপির সঙ্গে আমার প্রচুর গল্প হয়। পরি বলেছিল আমি পয়োস্তি। ডুবন্ত স্থলভাগ। শিক বলেছিল শিট্। কে বলল পয়োস্তি? ইউ আর এমার্জিং ম্যা… বোধহয় বলতে যাচ্ছিল ইউ আর এমার্জিং ম্যান… ছেলেদের যেমন বলে ও। ‘ম্যান’ শব্দটা স্পষ্ট করে বলতে পারল না। বোধহয় কোনও রিফ্লেক্স কাজ করছিল। শিক বলল, আই অ্যাডমায়ার ইউ। আই ক্যান গেস ইওর ইকনমিক কন্ডিশন। স্টিল ইউ আর ফাইটিং।
ও জানে পরির মা নেই, বাবাও ঠিকঠাক নেই। ও জানে, এতটা খরচ সাধ্য কোর্সে পড়া খোঁড়া লোকের কাঞ্চনজঙ্ঘা ওঠার মতোই কঠিন ব্যাপার। মেয়েটা ওকে মাঝেমধ্যে খাওয়াতে নিয়ে যায়। বার্গার-স্যান্ডউইচ এসব খাওয়ায়। ফর আ চেঞ্জ মুড়িও।
পরি ওকে কিছুটা ওর বেঁচে থাকার গল্প বলেছে। শিক বলেছে, চলো তোমার বাড়ি, দেখব তুমি কীরকম করে বেঁচে আছো। আসলে, শিকস্তির সঙ্গে কখনও গরিব ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব হয়নি। গরিব দেখেছে রাস্তায় হেঁটে যেতে-যেতে ফুটপাথে, কিংবা গাড়ির কাচের ভিতর দিয়ে। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে জিপ-এ করে ঘুরেছে বাঁকুড়ার গ্রামে—যখন ভ্যাকেশন-এ এসেছে। ধানের মরাইয়ের পাশে খাটিয়ায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করেছে, একটা কাঁসার থালা থেকে তিন- চার ভাইবোনের সমবেত পান্তাভাত খাওয়া দেখে ওদের পাশে বসে যেতে ইচ্ছে করেছে। ধান খেতের আল ধরে হাঁটতে ইচ্ছে করেছে, রাস্তার ধারের ছাতুর হোটেলে রিকশাওলাদের ছাতুর তাল, কাঁচা পেঁয়াজ আর চাটনি দিয়ে খাওয়া দেখে একদিন বসে গিয়েছিল। ছাতুওয়ালাটা যে কতবার থালাটা ধুয়েছিল…। বস্তির ভিতরে কখনও ঢোকেনি শিকস্তি। পরি’কে বলল, একদিন নিয়ে যাবে তোমাদের ঘরে?
একদিন নিয়ে গিয়েছিল। দেখুক, সবাই দেখুক—ওর বন্ধু কারা। শুধু ব্যাটাছেলে নয়, মেয়েরাও আসে ওর বাড়িতে। ওর ঘরে গিয়ে ছবি তুলেছিল, ওদের উঠানের ছবি, টিনের ঘের দেওয়া আব্রু বাঁচানোর আদি বাথরুমের ছবি। ওকে বসিয়ে রাস্তার দোকান থেকে পেঁয়াজি এনে মুড়ি-পেঁয়াজি খেয়েছিল—লঙ্কা কামড়ে, আর ঝালে হু-হা করছিল, ওর মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। শিকস্তি স্কুলিং করেছিল কার্শিয়ং-এ। গ্র্যাজুয়েশন গোয়েঙ্কা—কমার্স। এনআইএফটি- তে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছিল, হয়নি। ওখানে পরিও পরীক্ষা দিয়েছিল। পরিরও হয়নি। পরি বলেছিল, তুমি তো দিল্লি-বাঙ্গালোর-পুনে’তে আরও ভাল জায়গায় এই কোর্সটা করতে পারতে। ও বলেছিল, বাবার বেশি টাকা খরচ করতে চাইনি, তা ছাড়া আমার দাদা আছে একটা, সেন্ট জেভিয়ার্স-এ পড়ত। বাবার গাড়িটা নিয়ে র্যাশ ড্রাইভ করতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট, স্পাইন ভেঙে ফেলেছে। এখন হুইল চেয়ারে। ট্রিটমেন্ট করানোর জন্য সিঙ্গাপুর নিয়ে গিয়েছিল বাপি। ভাল হয়নি। গাদাখানেক খরচ হয়ে গিয়েছে। ওই জন্য বাবার টাকা খসাইনি। তা ছাড়া আমরা সল্টলেকেই থাকি কিনা, কাছাকাছি হয়। কোথায় পড়ছি, সেটা খুব একটা ম্যাটার করে না। নিজের ইনোভেটিভ আইডিয়া-টাই আসল। তা ছাড়া আর একটা কারণ আছে। ভেরি কফিডেনশিয়াল। বলব?
—তোমার ইচ্ছে।
—তার আগে তুমি বলো পরি, শরীর নিয়ে তোমার কোনও ট্যাবু আছে? আই গেস ইউ আর এ গে। বম গে। অ্যাম আই রাইট?
মাথা নাড়ে পরি।
—গে না, আমি মেয়ে—উইথ বাঁবি।’
—বাঁবি মানে?
অক্ষর দু’টোর ফাঁকে ‘ড়া’ আর ‘চি’ আছে।
দু-সেকেন্ড পর মর্মার্থ বুঝল শিকস্তি। বলল, দারুণ অ্যাব্রিভিয়েশন। তুমি বলছ তুমি মেয়ে। নিজেকে তাই ভাবছ। আমরা তোমাকে গে’ ভাবছি। নাথিং রং ইন ইট। চোখটা ‘প্যান’ করে চারদিক দ্যাখে বলে—নিজের মতো করে বাঁচা কোনও অন্যায় নয়—আলেস তুমি অন্যের ক্ষতি করছ।
আলনার দিকে চোখ রেখে শিকস্তি বলে, তোমার নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ড আছে।
মায়ের আলনা। আগে মায়ের শাড়ি-ব্লাউজ থাকত পরির জামা-প্যান্টের সঙ্গে মাখামাখি করে। এখন মায়ের একখানা শাড়ি শুধু রেখে দিয়েছে, নইলে খারাপ লাগে। মায়ের শাড়িগুলো রয়ে গিয়েছে আলমারিটায়, ওগুলো পরির উত্তরাধিকার। ও পরবে একদিন। তবে শিকস্তি এখন বয়ফ্রেন্ডের প্রসঙ্গটা তুলল আলনায় ঝুলন্ত একটা পাঞ্জাবি দেখেই। ওটা চয়নের পাঞ্জাবি। অ্যাপ্লিক করে দেবে বলে রেখেছিল। ও বুঝে ফেলেছে এটা ছেলেদের পাঞ্জাবি—ওর নয়।
বয়ফ্রেন্ড প্রসঙ্গে পরি সম্মতির ঘাড় নাড়ল।
শিকস্তি জিজ্ঞাসা করল, স্টেডি?
আবার সম্মতির ঘাড় নাড়ল পরি।
ইজ হি আ হেলপিং গাই?
আবার একইরকম মাথা নাড়ল পরি। তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে পরি বলল, ‘হেল্প’ মানে—মেন্টাল সাপোর্ট দেয় ও। পাশে আছে। কিন্তু ও চাকরি-টাকরি পায়নি। টিউশনি করে। নিজের খরচটা চালিয়ে নিতে পারে।
শিকস্তি বলল, পরি, জানি তোমার টাকা দরকার। যেখানে ভর্তি হয়েছ এটা কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট। এখানে কোনও মার্সি নেই। ‘সেমিস্টার ফি’ না-দিতে পারলে ওরা তাড়িয়ে দেবে। ফ্যাকাল্টি’রা যতই ভালবাসুক, ফেভার করুক, সিমপ্যাথি দেখাক ম্যানেজমেন্ট ছাড়বে না। এছাড়া রেকারিং খরচ আছে। আমি আমার খরচের অনেকটাই নিজে আর্ন করি। ল্যাপটপটাও নিজের টাকায় কিনেছি। আমি এস্কর্ট সার্ভিস করি। যদি চাও তুমিও করতে পারো।
—এস্কর্ট? মানে কি গাইডের কাজ? পারব?
——এসকর্ট সার্ভিস জানো না?
এসকর্ট মানে তো সঙ্গে থাকা। এসকর্ট ভ্যান বলে না? ট্রেনে ব্লাইন্ড-রা একজন এসকর্ট নিতে পারে…
এটাও সঙ্গে থাকা। কিন্তু মোর ক্লোজলি। ফাকিং সার্ভিসকে ভাল করে বলি এসকর্ট সার্ভিস। জাস্ট শুই। দু’হাজার, তিন হাজার…। ইজি মানি। দু-একজন ক্লায়েন্ট আছে দে গিভ মি ফাইভ থাউজ্যান্ড ইভেন। একটা এজেন্সির থ্র-তে কাজগুলো ইনিসিয়ালি পাই, পরে ডিরেক্ট হয়ে যায়। এজেন্সি থেকে বলেছে ওদের কিছু বাট্ক ডিমান্ডিং ক্লায়েন্ট আছে। তুমি যদি চাও যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি। কোনও ঝামেলা নেই, ফোন পাবে, টাইম দেবে, তুমি কন্ডিশন দেবে, তোমার কন্ডিশনে কাজ হবে। আমি তো আমার কন্ডিশনেই কাজ করি। জানো তো, জিগালোদের খুব ডিম্যান্ড। মেয়ে-ক্লায়েন্টরা ওদের ডাকে। বাংলা বাজারে জিগালো সাপ্লাই খুব কম। আমার চেনা একটা জিগালো আছে, ব্যাপক আর্নিং। ইউ কান্ট বিলিভ দেয়ার ফি। মাঝবয়সি মহিলারা ডেকে নিয়ে যায়। যত বেশি বয়স, তত বেশি টাকা ডিম্যান্ড করে। আগেকার দিনে নাকি মহিলারা ওদের সইকে বলত, আমার একটা নাং আছে, কিংবা একটা ময়না পুষেছি। জিগালো-রা হল মডার্ন ময়না। ওদের কিন্তু খুব মেনটেন করতে হয়। রোজ সকালে আমন্ড আর কাজু বাটার শরবত খায়, শিলাজিৎ-টিলাজিৎ কী সব খায়। মাঝেমধ্যে টেস্টাস্টোরেন ইনজেকশন নেয়। ছেলেদের পক্ষে প্রতিদিন এই কম্মো করা কি সহজ নাকি? আমাদের আর কী, ঠ্যাং ফাঁক করে দিলেই হল। তোকে তো জিগালোগিরি করতে হবে না, তোর ‘বাঁবি’ নিয়ে উপুড় হবি, টাকা আসবে। …তুই’ বলে ফেললাম। আমাকেও ‘তুই’ বলিস।
পরি’কে শিকস্তি যা বলছে—পরি জানে সেটা ধুরানিগিরি। ও যখন ‘কোতি’দের আড্ডায় যেত—তখন বেশ কিছু ধুরানি-র সঙ্গেও আড্ডা মেরেছে। অনেকে স্বীকার করে না যে ধুরানিগিরি করে, অনেকে স্বীকার করত। রতন নামে যার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল ওর, যে-রতন বাড়িতে সফ্ট টয় বানাত, অলোক নামে যে-লোকটা নিজে অনেক খরচাপাতি করে ‘ব্রেস্ট’ বানিয়ে রতনকে অপমান করেছিল রতনের বুকে ন্যাকড়া গোঁজা ছিল বলে, যে-রতন রবীন্দ্রসদনে বসে পরির কাছে কেঁদেছিল, পুলিশ ধরে নিয়েছিল, অনিকেত আঙ্কেল সাম হাউ বাঁচিয়েছিল, সেই রতন ধুরানিগিরি করত—পয়সা রোজগার করে ঠিকঠাক বুক বানাবে বলে। সেই সময় ওর মা ছিল। ধুরপিট্টি করে পয়সা রোজগারের কথা মনেই আসেনি কখনও। কষ্ট করে—যেভাবে হোক মা ওর খরচ চালিয়েছে। বকাঝকা, রাগ-অভিমান সবই ছিল যেন ভালবাসার শরবতের গেলাসে লেবুর রস বিট নুন পুদিনা বাটা। তা ছাড়া অরূপদাও ছিল। সে ছিল মাস্টার লোক। কিছু-ফিডু কিনে দিয়ে পরি-র বহির্দ্বারটিকে ‘প্রবেশ দ্বার’ বানিয়ে ফেলতে পেরেছিল। সে যা হোক, কোতি-ধুরানি’র জগৎটাকে জেনেছিল পরি। লহরী-ধুরানিদের কথা জেনেছিল, যারা খুচখাচ কাজকম্মো করে, ব্যবসা হোক, ছোটখাটো চাকরি হোক, সাধারণ ছোটখাটো খদ্দের। কেউ-কেউ সোনাগাছি এলাকার মাসিদের সঙ্গে ফিট করে ও-অঞ্চলে সন্ধের দিকটা থাকে। বাটুখোরদের সার্ভিস দেয়। এসকর্ট সার্ভিস। কথাটা নতুন শিখেছে। ছোটখাটো রোডসাইড হোটেলেও লহরী-ধুরানি’রা যায়। কেউ-কেউ ভাড়া নিয়ে ট্যুর যায়। দিঘা- বকখালি। যেন দুই বন্ধু বেড়াতে গিয়েছে।
আর এক ধরনের ধুরানি আছে, যাদের নাম ‘পৌনে আটটা’। বহু দিন ধরেই এই নামটা চলছে। যারা বাটুখোর, পকেটের জোর কম—ওরা বলে আজ একটা ‘পৌনে আটটা’ তুলব। কলকাতার কিছু হোটেল-বয়, মুটে-মজুর, মোদোমাতাল, বাসের খালাসি—এই সব স্বল্প আয়ের সমকামী মহলে ‘পৌনে আট” খুব প্রচলিত শব্দ—যে-শব্দটার বিশেষ এক ধুরানিদের বোঝাতে ব্যবহার করা হয়।
সন্ধের পর কলকাতা ময়দান এলাকায় ঘুরঘুর করে বহু ছুটকো যৌনকর্মী। ওরা মেয়েই। কিছু পুরুষও ঘোরাফেরা করে। এরা আকুয়া নয়। মানে, স্ত্রী-বেশধারী পুরুষ নয়। একেবারেই পুরুষ। কারও হয়তো চলন-বলন সামান্য মেয়েলি। এই পুরুষগুলো নিজেরা খদ্দের নয়। বরং এদের কাছেই খদ্দের আসে। এরাই হল ‘পৌনে আটটা’-র ধুরানি। বোধহয় সন্ধের কিছুক্ষণ পরে দেখা পাওয়া যায় বলে এদের এরকম নাম হয়েছে। এদের চেহারার তেমন কোনও মাধুর্য নেই। এরা ‘নাগিন’ টাইপ নয়। নাগিন হলে ‘পৌনে আটটা’ হতে হত না। লহরী হয়ে যেত। গরিব ঘরের ধুরানিরা প্রথম দিকে সঙ্গীদের সঙ্গে ‘পৌনে আটটা’ হয়েই ধুরানি-জীবন শুরু করে। ওদের পকেটে ভাল লুব্রিকেটিং জেলি-ও থাকে না। স্রেফ ভেসলিন-এই কাজ সারতে হয়। শুধু ময়দান নয়, বাবুঘাট, শিয়ালদা ফ্লাইওভারের নীচে, পার্ক সার্কাস ময়দান এলাকা, হাওড়া ময়দান এলাকায় পৌনে আটটাদের ঠেক। জহুরিরা ঠিকই জহর চিনে নেয়। কোড আছে। কোনও খদ্দের বাদাম খেতে-খেতে যদি কাউকে বলে ‘নুন’ আছে, সে যদি ধুরানি হয় বলবে ‘আছে’। কটা বাজে প্রশ্নের উত্তরে কেউ যদি বলে ‘ঘড়ি স্লো’—বুঝে নিতে হবে সে ধুরানি তারপর বাকি কথা। ‘আইসক্রিম’ মানে শুধু সাকিং। জেলুসিল মানে হাতে নেড়ে মোক্ষণ করা। জেলুসিল হল একটা অ্যাসিডিটির ওষুধ। খাবার আগে ওটাকে ঝাঁকিয়ে নিতে হয়। ওষুধের গায়ে লেখা থাকে ‘শেক দ্য বট্ল বিফোর ইউজ’। আর পুরো পেনিট্রেটিভ সেক্স-এর কতগুলো সাংকেতিক শব্দ আছে—ট্রামে চড়ব, বাসে চড়ব, জুতো পরব এসব। মোজা আছে তো? মানে, কন্ডোম আছে কি না জানতে চাওয়া হচ্ছে।
বাস-লরি’র খালাসিদের জীবনের স্বপ্ন থাকে ড্রাইভার হওয়ার, সিমেন্ট-বালি সাপ্লায়াররা প্রোমোটার হতে চায়, তেমনই ‘পৌনে আটটা’-রাও লহরী হতে চায়। লহরীদের অন্ধকারে ঘুরঘুর করতে হয় না। নিজের একটা ঠেক থাকে। গণিকাপল্লি-ও হতে পারে সেই ঠেক। তারপর লহরীদের ওপরের স্তর হচ্ছে খানদান ধুরানি। গরিব ঘরের ছেলেদের খানদানি ধুরানি হয়ে ওঠা বেশ মুশকিল। ওরা ইংরেজি জানে, দামি পারফিউম মাখে, চলন-বলন আলাদা। এরা ‘হাই প্রোফাইল’। শিকস্তি পরি’কে যেটা বলছে, সেটা খানদান ধুরানিগিরি।
শিকস্তি-র ওপর রাগ হল না পরি’র। রাগ হবে কেন? ও তো ভালর জন্যই বলেছিল, পরির ভাল চেয়ে। আর পরি নিজেও জানে, ওর পায়ুটি শুধু মাত্র বাহ্যে নির্গমনের কাজে লাগেনি। অরূপদা তো রীতিমতো প্যাসেজ বড় করার জন্য এবোনাইট ‘কিডু’ প্রেজেন্ট করত, নিজ হাতে পরিয়েও দিত। অরূপদার কল্যাণেই ও নিজের পেছনটা প্রফেশনাল করতে পেরেছে। কিন্তু ও কখনও ধুরানি হয়নি—মানে ‘বাটু’ বেচে টাকা কামায়নি।
পরি এতক্ষণ চুপ করেছিল বলে শিকস্তি বলল, সরি পরি। হার্ট করলাম বোধহয়। আমি জাস্ট একটা শর্ট কাট ওয়ে বলতে চেয়েছিলাম টু আর্ন মানি। ডোন্ট থিংক আই অ্যাম এ পিম্প অর সাম বডি অফ দ্যাট এজেন্সি।
পরি শিকস্তি’র হাত চেপে ধরল।
বলল, ছিঃ, এমন করে ভাবছিস কেন ভাই? আমি কি তাই বলেছি, না কি তাই ভাবছি? তুই আমার ভালর জন্যই বলেছিলি। আমি কী বলেছি যে, করব না। ভাবছি একবার ওকে জিগ্যেস করব কি না।
—কাকে? বয়ফ্রেন্ড’কে? ও কি ‘হ্যাঁ’ বলবে ভেবেছিস নাকি? আরে ওরা খুব ‘পজেসিভ’ হয়। এভরিবডি। অল বয়ফ্রেন্ড্স।
পরি জিগ্যেস করে, তোর কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই?
—কেন থাকবে না, আছে। নাম্বার অফ।
—সেরকম বয়ফ্রেন্ডের কথা বলছি না, লাভার। একদম নিজের মতো…।
—নো। ডোন্ট হ্যাভ। তোর যে-আছে, সে কি লাভার? চোখ নিচু করে মাথা নাড়ে পরি। যেন একটু লজ্জা।
—তুই খুব সরল পরি। ভাবছিস লাভার। কিন্তু দেখবি, ওর আরও গার্লফ্রেন্ড আছে। বাঁবিওলা নয়, বায়োলজিক্যাল গার্ল। এরা সব বাইসেক্সুয়াল হয়। আমি যতটুকু জানি বললাম। পুরোটা বিশ্বাস করিস না ভাই ওদের।
ওরা এখন এমনভাবে কথা বলছে যেন দুই সই। যেন গত শতাব্দীর দুই অন্তঃপুরবাসিনী কস্টিউম পাল্টে এখানে। যেন ওদের হাতে গঙ্গাজল। যেন ওদের হাতে গাঁদাফুল। পান-খাওয়া ঠোঁটে চুপি-চুপি বলা হয়ে গিয়েছে রজনীবিলাস। গলার আঁচল সরিয়ে একজন দেখিয়ে দিল নখ বিলেখন, তক্ষুনি আঁচল ঢাকা দিল। এবার চুপ। কি লো, কথা কইছিস না যে বড়?
একটু পরেই একজন অন্যজনের কাঁধে হাত দেবে, হাত জড়িয়ে ধরবে। বলবে মিছে কয়েছিলেম গো গঙ্গাজল, ওটা ভালবাসার নখের দাগ নয়, অত্যেচারের। বলেছিলাম কেন আনবাড়ি যাও, তাই। তারপর এক গঙ্গাজলের চোখের জল আঁচলে মুছিয়ে দিচ্ছে অন্য গঙ্গাজল সই।
শিকস্তি বলল, অনেক কষ্ট পেয়েছি রে পরি। বলব পরে। বহু যুগের ওপার হতে একটা হাত এসে শিক-এর নেলপলিশ করা আঙুলের ওপর শুশ্রূষা বোলায়। পরি ওর হাত ধরে।
তুই বিয়ে করবি না শিক? পরি বলে।
—বিয়ে? আই ডোন্ট নো। আগে তো ক্যারিয়ার করি। আই মাস্ট আর্ন এ লট। অনেক রোজগার করব, তারপর ছেলেগুলোকে নাচাব। ছেলেদের কস্টিউম ডিজাইন করব আমি। ছেলে-মডেলগুলোকে র্যাম্পে হাঁটাব। ওদের জাঙ্গিয়ার সামনে মড়ার খুলি ছাপ্পা দিয়ে দেব। ওদের আন্ডারগার্মেন্ট ডিজাইন করব—খালি গায়ে জাঙ্গিয়া পরে ছেলেরা র্যাম্প-এ হাঁটছে, জাস্ট ইম্যাজিন দা সিন, ছেলেরা খালি গায়ে, কারও সিক্স প্যাক, কারও ফোর প্যাক, পরনে শুধু জাঙ্গিয়া, কারও জাঙ্গিয়ার ওপরে মড়ার খুলি, কারও জাঙ্গিয়ার প্লিটটার ওপর ব্লাডশেড, কারও গায়ে লিখে দেব আইপিসি ৪৯৮ কোথাও লেখা থাকবে ‘পেন ইজ মাইটার দ্যান সোর্ড’ নয়—’পেনিস মাইটার দ্যান শোর্ড’। কেমন হবে বল তো?
—তুই বুঝি নারীবাদী?
—নারীবাদী? ফেমিনিস্ট? আই ডোন্ট নো।
—ছেলেদের ঘেন্না করিস?
—বললাম না, আমার খুব বাজে অভিজ্ঞতা আছে। আমাকে ডিচ করেছে, রেপ করেছে, আমার রিভেঞ্জ নিতে ইচ্ছে করে। তুই বুঝি ছেলেদের খুব ভালবাসিস? অ্যাডমায়ার করিস?
—আমাকেও ডিচ করেছে। অরূপদা। আমাকে পড়াত। ছেলেরা ওরকমই। তবু কী করব? ছেলেদেরই তো বেশি ভাল লাগে। ওদের শরীর….
—তুই অবশ্য খুব একটা ভুল বলিসনি পরি। আমি হেট-ও করি, আবার অ্যাট্রাক্টেড-ও হই। ‘লাভ অ্যান্ড হেট’ সম্পর্ক। তবে আমি যখন ওদের সঙ্গে সেক্স-এ যাই, আমি অ্যাকটিভ রোল প্লে করি। অ্যান্ড আই গো আপ টু এন্ড। মনে হয়, আমিই রেপ করছি। কেউ-কেউ আগেই দ্য এন্ড করে দেয়, আমি তখন ওদের টিজ করি। খুব ভাল লাগে টিজ করতে।
—সপ্তাহে ক’দিন তুমি তোমার ওই এসকর্ট সার্ভিস করো?
—আমার টার্গেট মাসে টেন থাউজ্যান্ড। তিন দিনেও হয়ে যায়, কখনও চার দিন।
—আমার কি এত রোজগার হবে? তুমি হ’চ্ছো হাই প্রোফাইল…আমি তো ভাল দেখতে না…
—আবার তুমি-তুমি? বি ফ্র্যাংক। তুই।
পরি বলে ঠিক আছে, হয়ে যাবে।
শিকস্তি বলে—কনফেডেনশিয়াল কিন্তু। তোকেই বললাম সব। যদি চাস তো বলবি, আমি কনট্যাক্ট করিয়ে দেব। আর যদি তোর প্রেজেন্ট বয়ফ্রেন্ড ল্যাপটপ-ক্যামেরা কিনে দেয়, তা হলে তো মিটেই গেল।
পরি ওই কথা শুনে একটু হাসল শুধু। চা আর ডিমের ওমলেট ভেজে দিল পরি। ঘরের দরজা খোলা। নারায়ণী মাসি ছাড়াও দু-একজন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। দেখুক। এই হাই স্টেটাসের মেয়েটাকে দেখুক। পরি নিজের জন্যও ওমলেট করেছিল। শিক বলল, খুব ভাল হয়েছে। একটু চিজ স্প্রেড দিলে আরও ভাল হত। চিজ ওমলেট।
পরি আজকাল জানে চিজ, মেয়োনিজ, অয়েস্টার সস এসব হল হাই প্রোফাইল মশলা। মাশরুম, বেবি কর্ন, ব্রোকোলি…।
পরিও একদিন মুড়ি-বাতাসা, কুমড়ো থেকে চিজ মাশরুমে যাবে। কোর্সটা শেষ হোক…। শিকস্তি বলল, জাস্ট সি পরি, আমরা কী। আমি তোকে কতবার বললাম, কিপ দিস ডায়লগ সিক্রেট। কেন বললাম? আমি অনেক পুরুষের সঙ্গে শুই-টুই এটা জানাতে চাই না। কিন্তু ছেলেদের কাছে এটা প্রাইড। বুক ফুলিয়ে বলে যে, এত ক’টা মেয়ের সঙ্গে শুয়েছি। আমার একটা বয়ফ্রেন্ড কী বলেছিল জানিস? ফিমেল কান্ট মিন্স তালা, জেন্টস কক্ ইজ চাবি।
কোনও তালা যদি তিন-চারটে চাবি দিয়ে খুলে যায়, তা হলে সেই তালাটাকে কী বলা হয়?
—খারাপ তালা।
—আর যদি একটা চাবি দিয়েই চার-পাঁচটা তালাকে খোলা যায়—তখন সেটা “মাস্টার কি’। তাই না?
—শিট্। ‘মাস্টার কি’ দু’টো তালা পরপর খুলতে পারে না—তাই নিয়ে গর্ব।
—আমাদের তালাই ভাল, তাই না পরি?
মেয়েটা কী সুন্দর সখী! পরি ওর হাতটাকে মুঠোর মধ্যে নেয় ফের। খুব ভাল লাগল শিকস্তি’র সঙ্গে কথা বলে। ওকে এগিয়ে দিল। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে ওইসব মাছি-ভনভন ছোলা সেদ্ধর পশরা, সাইনবোর্ডের দোকান, যেখানে সবেমাত্র লেখা হয়েছে, টাটকা। ‘ফেসিয়াল’ ও ‘মেসেজ’ করা হয়—সেটা দেখল। রঙের ওপর একটা মাছি আটকে গিয়েছে।
চয়নকে কী বলবে? পরি ভাবছে। চয়নদার একটা পারমিশন নেওয়া উচিত নয় কি?
নিজেই ভাবল ফের—কেন জিগ্যেস করবে? চয়ন তো ওকে মাদিবাদি বলে। নিজেও ভাবে অনেক সময়। ওর পারমিশন নিতে যাবে কেন? ওর শরীর, এই শরীরকে কীভাবে ব্যবহার করবে সেটা ওর ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর নির্ভর করছে।
রতনের কথা মনে পড়ল আবার। বহু দিন ওর কোনও খবর জানে না পরি। কী সুন্দর সফ্ট টয় বানাত রতন। ধুরানি হল। কেউ বলেছে, ও কলকাতায় নেই। মুম্বই চলে গিয়েছে। ওখানে নাকি রোজগার বেশি। কেউ বলেছে, ও গাজা-চরস পাচার চক্রে ফেঁসে গিয়ে জেলখানায় পচছে।
শিকস্তি যেটা বলেছিল, হাই প্রোফাইল এসকর্ট সার্ভিস। মেল। এসব জেনেছে আগেও। যখন পারি ‘এলজিবিটি’ গ্রুপের মিটিংয়ে গিয়েছে, ‘প্রবর্তক’-এর ছেলেদের সঙ্গে আলাপ-টালাপ ছিল, ওদের কাছে বিদেশি পত্রিকা দেখেছিল। মিটিংয়ের পরে তো গুলতানি। নানারকম দেখনদারি। কে কত ভাল পারফিউম কিনেছে, কে ভাল পারিক জুটিয়েছে, কে কোথায় ঘুরে এসেছে এসব জাঁক। ওখানেই কার কাছে বিদেশি পত্রিকা দেখেছিল গে’ পত্রিকা। যত দূর মনে হয় পত্রিকার নাম “NEXT”।
পাতায়-পাতায় পুরুষমানুষের ছবি। কেউ রোমশ, কেউ রোমহীন, কেউ জিন্স-এর জিপ খুলে রেখেছে, কেউ জাঙ্গিয়া পরে আছে, ফুলে আছে, জানাচ্ছে নাইন ইঞ্চ কক, কেউ জানাচ্ছে স্মুদ, সফ্ট, হেয়ার-ফ্রি স্কিন। কোনও ‘গে’ লাইভ নেটওয়ার্কে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে- অ্যাসোলিউটলি বেস্ট ওয়ে টু মিট ম্যান। বিজ্ঞাপনে জানাচ্ছে—কিউট ব্লন্ড বটম বয়, ৫-৮ লুকিং টু স্প্রেড লেগ্স। কেউ জানাচ্ছে, আমেরিকান-আফ্রিকান বয়, ২৭, ইজি গোয়িং স্মুদ অ্যাস, সিক্স ম্যাচো গাই। কেউ জানাচ্ছে, মি, ককেশিয়ান মেল, হোয়াইট, ক্লিন শেভেন, নাইস ডিক, লুকিং ফর ব্ল্যাক মেল টু সাক মি অ্যান্ড পসিলি গেট ফাক্ড। এরকম কত। টপ-ব সবরকম ‘গে’ এবং ‘বাইসেক্সুয়াল’-রা তাদের আবদার, অভিলাষ এবং নিজস্ব সম্পত্তির কথা বলেছে, কেউ ছবি-সুদ্ধু।
কলকাতার কাগজেও তো বিজ্ঞাপন থাকে—’পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে বোল্ড রিলেশন করুন।’ ‘মেসাজ ক্লিনিক ফর ফল রিলাক্সেশন।’ ‘হাই প্রোফাইল পুরুষ-মহিলাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব’—এই সব। এখনও ছদ্মবেশে থাকে। ওসব দেশের মতো খোলাখুলি থাকে না হয়তো। এসব জায়গায় নানারকম প্রতারণাও হয় নিশ্চয়ই, নইলে কেন কোনও-কোনও বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে—’প্রতারণা নয়, গভর্নমেন্ট রেজিস্টার্ড প্রতিষ্ঠান, আগে পছন্দ, পরে ফি।’
চয়নকে বলেই ফেলল পরি। বলল—একটা ভাল কানেকশন পেয়েছি। রেগুলার ভাল রোজগার হবে। আমাকে উপুড় হতে হবে। যাব? মেল এসকর্ট সার্ভিস। এসকর্ট বোঝো?
—এসকর্ট বুঝি না, উপুড় হওয়াটা বুঝলাম।
—হ্যাঁ। ঠিকই বুঝেছ
চয়ন বোধহয় একটু অবাকই হল।
বলল, যাঃ।
—হ্যাঁ গো, সত্যি। কম্পিউটার-ক্যামেরা নিয়ে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা লাগবে। মায়ের গয়না থেকে কিছুটা বেচে দিচ্ছি। কিন্তু আমার তো একটা ইনকাম দরকার। টিউশনি করে যা হয়, তাতে হবে না।
চয়ন বলল, গরিবের ঘোড়া রোগ যখন হয়েই গিয়েছে, তখন আমি কী বলব বল। আমি তো বলতে পারছি না তোকে কিনে দিতে পারব। আমি তো বলতে পারছি না তোকে মাস গেলে দু’হাজার করে দেব। যদি ইচ্ছে হয় তো কর। সাবধানে।
—তুমি কিছু মনে করবে না তো? পরির গলা ধরে যায়।
চয়ন বলে, ধুর বোকা। আমি কেন বাধা দেব। আমি বাধা দেওয়ার কে? আমি যেটা করতে পারি, আরও ভাল করে চাকরির চেষ্টা করতে পারি। সব জায়গায় অ্যাপ্লাই করব। পুলিশেও। পিওনের চাকরিও ছাড়ব না।
ফোন নম্বর দিয়েছিল শিকস্তি। ওরা সদর স্ট্রিটের একটা গেস্ট হাউসের ঠিকানা এবং রুম নম্বর বলে দিল। সময়ও। কথা ছিল দু-হাজার পাবে, কাজ হয়ে গেলে কাউন্টারে ৫০০ টাকা দিয়ে যেতে হবে।
ছেলেটা কি নেপালি? নাগা-মিজো-মণিপুরিও হতে পারে। ওর হাতে উল্কি আঁকা ছিল, কাঁকড়াবিছের। জাঙ্গিয়ার রং ছিল লাল।
পশুর মতো। কুকুরের মতো। ভীষণ লেগেছিল পরি-র। পরি কাতর শব্দ করেছিল। ছেলেটা সেই শব্দ উপভোগ করছিল। পরি’র কাতর শব্দের সময় ও বলছিল, ক্যারি অন, ক্যারি অন শাউট, শাউট লাউড্লি। ছেলেটা যখন জাঙ্গিয়াটা পরল, পরি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল ওখানে মৃতের খুলি আঁকা রয়েছে।
দেড় হাজার টাকা পকেটে পুরে ঘরে ফিরল রাত ন’টা নাগাদ।
চয়নদা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
পরি’কে দেখল।
পরি কিছু বলল না। মাথা নিচু করে ঘরে ফিরছে, পিছনে চয়ন।
ঘরে ফিরেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল পরি। বালিশে মুখ।
চয়ন বলল, খুব কষ্ট হয়েছে, না রে পরি?
পরি কাঁদছে।
চয়ন বলল, সবাই কি ঠিকঠাক বোঝে?
চয়ন পরি’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
তারপর পরি’র প্যান্টের বেল্ট খুলল। টেনে নামাল প্যান্টটা।
ভেজা রুমালটা দিয়ে মুছিয়ে দিল। বলল, যা-তা ব্যাপার।
খুব যত্ন করে বোরোলিন ঘষে দিচ্ছিল। আস্তে করে।
চয়ন বলল, আর যাস না।
পরি হঠাৎ উঠে বসল।
বলল, না গিয়ে কী করব! যাব। বেশ করব যাব। দেবে তুমি টাকা? দেবে?
দু’হাতে মুখ ঢাকল পরি।
পোড়ামুখী।
৫৬
আগের টিভিটা রঙিন হলেও রিমোট ছিল না। টিভির বোতাম টিপে চ্যানেল পাল্টাতে হত। শুক্লার অসুস্থতার পর রিমোট কিনল অনিকেত—যাতে বিছানায় বা চেয়ারে বসেই শুক্লা চ্যানেল পাল্টাতে পারে।
শুক্লার ডান দিকটা ভাল কাজ করছিল না। ডান হাতের জন্য ব্যায়াম শিখিয়ে দিয়েছে ডাক্তার। জল-ভরা বেলুন নিয়ে এসেছে অনিকেত, যার গোপন নাম ইলু-ইলু, যেটা অনেকের কাছে নকল স্তন, সেটা শুক্লার হাতের মুঠোয়। আঙুলে চাপ দিচ্ছে, দেওয়ার চেষ্টা করছে শুক্লা। ‘ইলু’ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে পক্ষাঘাতের চিকিৎসায়। ডান হাতে এখনও গেলাস ধরতে পারে না। একটা চুপ করে বসে থাকা বেড়ালের গায়ে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে, পারে না। জানালার গ্রিল ফুঁড়ে আসা চাঁদের আলোয় হাত বুলোতে না-পারলেও হাতটা পেতে দেয়। সারা হাতে চাঁদ লাগে। ইচ্ছে করে সেই চাঁদ অনিকেতের গায়েও মাখিয়ে দিতে। হাতটা ওঠাতে পারে না যে। অনিকেত হাবলুর মতো, কাবলু ছেলের মতো শুক্লার মাথার সামনে চুপচাপ বসে থাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছেও করে, কিন্তু অনিকেতেরও পক্ষাঘাত। শরীরে নয়, মনে।
বাড়িতে আসার পর, একটু নিজ-হাতে সেবা করার চেষ্টা করছিল, শুক্লা বাঁ হাতটা ভোটের হাত চিহ্নের মতো সামনে ধরেছিল। খুব মৃদু অথচ তেজি দু’টো শব্দ ‘ঠিক আছে’—যেন মেলার বেলুন ফাটানোর অব্যর্থ দু’টো গুলি। অনিকেত একদিন বলেছিল—হাতটা ঠিক হয়ে গেলে প্রথমেই তোমার যেটা করা উচিত, তা হল আমাকে একটা চড় মারা। চড়ের বিশেষণ হিসেবে ‘ঠাটিয়ে’ শব্দ মনে এলেও বলতে পারেনি। কারণ শব্দটার মধ্যে একটু ‘ইয়ে’ আছে। শুক্লা সামান্য হেসেছিল। স্ট্রোকের পর থেকে হাসতে গেলে শুক্লার মুখটা সামান্য বেঁকে যায়। হাসিগুলো বিদ্রুপের মতো লাগে। আলাদা করে বোঝা যায় না—কোন হাসিটা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের, কোনটা সুখের। দু’টো ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে, মুখের কয়েকটি পেশির সংকোচন-প্রসারণে যে-অভিব্যক্তি, তাকেই তো ‘হাসি’ বলা হয়। হাসি বড় রহস্যময়। মানুষ সুখে হাসে, দুঃখেও, বিদ্রুপে, ঘৃণায়, এমনকী খুন করার পরও। হা-হা-হা অট্টহাস্য কি কেবল যাত্রার? কেবল বেদের মেয়ে জোসনার? জীবনে নেই? ‘আমি তোকে বধিব এখুনি’-হা-হা-হা’র মধ্যে যে ধমক ও ধিক্কার, সেটা শুক্লার মৃদু হাসির মধ্যেই নিঃশব্দ হয়ে আছে। এসব ছোট-ছোট হাসি মানে অনেকগুলো ‘ফাইল’ একটা ফোল্ডারে ‘জিপ’ করে দেওয়া।
এই যে এখন শুক্লা একটা জল-ভরা বেলুন মুঠোর মধ্যে নিয়ে হাতের ব্যায়াম করছে, আর অনিকেত হাবার মতো বসে দেখছে—শুক্লার মুখে একটা হাসির রেখা। এই হাসির অন্তর্গত রহস্যের কোনও মানে বুঝতে পারছে না, পরবর্তী ব্যায়ামটা হল একটা ইঞ্চি পাঁচেক লম্বা ছিপি- আঁটা জলভরা শিশি, যেটা ঝাঁকাবে। ধীরে-ধীরে ঝাঁকানোর চেষ্টা করবে। যেটা অন্য কেউ করলে অনিকেতের মুখে একটা আদিরসাত্মক হাসি ফুটে উঠত, কিন্তু এখনও ও হাসবে না। বরং তীব্র কনসার্ন নিয়ে দেখবে সাকসেসফুলি ঝাঁকাতে পারছে কি না।
অনিকেত আজকাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে। আগে দু’বেলাই আয়া ছিল, এখন শুধু দিনের বেলায় আছে। লাঠি ভর করে শুক্লা সামান্য হাটতে পারে। ডান পা-টা চলে না। রান্না করা খাবার গরম করে শুক্লার সামনে দিয়ে দেয় অনিকেত, বাঁ হাতটা সাবান দিয়ে ধুইয়ে দেয়, শুক্লা বাঁ হাতে খায়। কল্পনা মৈত্রর ইস্কুলটা বন্ধ হয়নি। ছাদেই হয়। শুক্লা ওটা বন্ধ করতে চায়নি। তা ছাড়া বাড়ির ভিতরে, বাড়িটার নিস্তব্ধতা ভাঙার কিছু উপাদান থাকা জরুরি ছিল। শুক্লার কানে নামতা পড়ার সুর গানের মতোই লাগবে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার দাপাদাপি, ঝগড়া-বকাঝকা—এসবের মধ্যেই তো প্রাণ, সেই প্রাণের ছোঁয়াটা তো এসে লাগে।
শুক্লা গতবছরে একবারের জন্যও মঞ্জুর কথা ওঠায়নি। কোনও কিছুই জিগ্যেস করেনি। এই জিগ্যেসহীনতা একটা দমবন্ধ অবস্থায় রেখে দিয়েছে অনিকেতকে। জিজ্ঞাসা-চিহ্নর বদলে একটা ফুলস্টপ দিয়ে রেখেছে শুক্লা। এই ফুলস্টপ-টা যেন একটা পাথর। এই ফুলস্টপ-টা এমন এক কৃষ্ণগহ্বর, যা থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে, বিগ ব্যাং…। গাদা গাদা জিজ্ঞাসাচিহ্ন ছুটে বেড়াবে। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার কিছু দিন পর শুক্লার কাছে একটা স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। ভেবেছিল বলবে, ওটা ছিল একটা উদাসীন সঙ্গম, প্রেমহীন। যৌনতার টানও এমন কিছু ছিল না, তবু ঘটে গিয়েছিল। কী করে বলবে তার একটা স্ক্রিপ্টও তৈরি করে রেখেছিল। খুব একটা সিরিয়াস স্ক্রিপ্ট নয়, একটু হালকা ভঙ্গিতে, যার শুরুটা এরকম—একটা ব্যাপার তোমার জানা দরকার শুক্লা, মঞ্জুর সঙ্গে আমার সম্পর্কের মধ্যে কোনও প্রেম নেই। জানোই তো, ও ছিল ছোটবেলার খেলার সঙ্গী। বড়বেলায় দেখা হল, পাকেচক্রে এই বড়বেলায় একটু খেলা হয়ে গেল। বড়দের খেলা। প্ল্যান ছিল না। আসলে ও অনেকবার বলেছে, তোর কাছে বেড়াতে যাব, আমি অ্যাভয়েড করে গিয়েছি, হঠাৎ হাজির হয়ে গেল… কোনও প্রেম নয়, ভালবাসা নয়…।
একদিন স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী শুরু করেছিল অনিকেত। বাক্যটার শেষাংশে ‘প্রেম নেই’ এর পরিবর্তে ইয়ে নেই’ বলেছিল, দ্বিতীয় বাক্যটা শুরু করতেই শুক্লার বাঁ হাতটা সাপের মতো এগিয়ে এসে প্রায় ফণা তুলল। ওর বাঁ হাতের সচল পাঁচ আঙুল। শুধু বলল, জানতে চাই না। প্রথম বাক্যটা আবার রিপিট করেছিল অনিকেত, ‘জানাটা দরকার শুক্লা…।’ শুক্লা তখন মাথা ঝাঁকিয়ে তীব্র স্বরে বলেছিল, একদম কোনও কথা বলবে না এ নিয়ে। একটা কথাও নয়।
সত্যিই এ নিয়ে কোনও অনুযোগ, কোনও তির্যক উক্তি করেনি শুক্লা। যেন মঞ্জু বলে কারও কোনও অস্তিত্বই কোনও দিন পৃথিবীতে ছিল না। মঞ্জু সম্পর্কে নির্মোহতা দেখালেও অনিকেত জানে—শুক্লার মনে মঞ্জু এখনও জীবিত। মঞ্জুর মৃত্যুর কথা শুক্লাকে বলেনি অনিকেত। মঞ্জু মারা যায় শুক্লার সেরেব্রাল স্ট্রোক হওয়ার সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই। শুক্লা তখনও বেশ অসুস্থ ওর মধ্যে ওসব বলার কথা ওঠেই না। কিন্তু পরেও বলা হয়ে ওঠেনি, কারণ, মঞ্জু-প্রসঙ্গ উত্থাপনই করতে দেয়নি শুক্লা। অফিসের কাজে কখনও দেরি-টেরি হয়ে যায়। শুক্লা কি ভাবে, ও মঞ্জুর সঙ্গে ঘুরছে? আড্ডা ছাড়া মানুষ বাঁচে না কি? আড্ডাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িতে মাঝেমধ্যে কেউ-কেউ আসে। এসব আড্ডায় শুক্লা থাকে না কখনও। থাকলে—মঞ্জু মরে গিয়েছে’ এই সুসংবাদটা কায়দা করে দিয়ে দেওয়া যেত। এখন, একটা মৃত্যুর দু’বছর পর- ‘এই জানো তো, মঞ্জু মরে গিয়েছে’ বলা যায় না। একটা মৃত্যুকে কীভাবে উপহার দেবে ভেবে উঠতে পারেনি অনিকেত এত দিনেও।
টেলিভিশনে ট্রেন দুর্ঘটনার ছবি দেখতে-দেখতে একদিন ভাবছিল বলে দেয়—ইশ, কত শিশু-মা হারা হল, বাপ-হারা হল। মঞ্জুর ছেলেটাও মা-হারা হয়েছে, জানো? বলা হয়নি। কারণ তক্ষুনি অনিকেতের মনে হয়েছিল শুক্লা জিগ্যেস করবে, কে মঞ্জু? কী বলবে তখন অনিকেত।
চেচেনিয়া’তে সুইসাইড বোম বিস্ফোরণ চলছিল, ইরাকে বম্বিং চলছিল। মানুষ মরছিল। তার মধ্যেও মঞ্জুকে গুঁজে দিতে পারত। উদাই আর কোয়াসি হোসেন, সাদ্দামের দুই ছেলেকে মেরে ফেলল আমেরিকা, প্রেসিডেন্ট বুশ হাসিমুখে মৃত্যু ঘোষণা করছেন। শুক্লার সামনে ওরকম হাসি মুখে অন্য এক নারীর মৃত্যু ঘোষণা করার সুযোগ পাচ্ছে না অনিকেত।
কল্পনা মৈত্র যদি বলে দিতেন, ব্যাপারটা অন্য দিকে গড়াত। কল্পনা মৈত্র মনে হয় জানেন ঘটনাটা। নইলে বলেছিলেন কেন—এবার একটু সামলে চলুন। অনিকেত ‘কী সামলাবো, কাকে সামলাবো, কেন সামলাবো’ এসব নিয়ে কিছু উচ্চবাচ্য করেনি। কল্পনা ম্যাডাম মাঝে-মাঝে দুপুরবেলাটা শুক্লার সঙ্গে গল্প করেন, কখনও সন্ধের সময়ও। অনিকেতের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়। দেখা হলে—কেমন আছেন? ভাল আছেন? ঠিক আছে। যখন বলেন ‘সব ঠিকঠাক চলছে তো?’—তখনই মনে হয় কথাটা ঠিকঠাক হল না। অনিকেত একবার বলেছিল, কিছুই তো ঠিকঠাক চলছে না। ‘ঠিকঠাক চলা’-টা কি এত সোজা? কল্পনা ম্যাডাম বলেছিলেন, ঠিকঠাক চালাতে গেলে স্টিয়ারিংটা ঠিকঠাক ধরতে জানতে হয়। হয়তো এটা নির্বিষ কথা, একটি নিতান্ত সরল বাক্য। কিন্তু অনিকেতের কাছে ওটা ব্যঞ্জনাময়। এসব মহিলার অনেক যোগাযোগ। অনিকেতের কর্মস্থলের কারও সঙ্গে কি পরিচয় নেই? থাকতেই পারে। ওর অফিসে তো ঘটনা চাপতে পারেনি, বরং পল্লবিত হয়েছে। কেউ-কেউ আড়ালে নিশ্চয়ই বলেছে, এই ভদ্রলোকটির কাজকর্মে ওর স্ত্রী-র স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে।
টিভি চলছে, শুক্লার বোতল ঝাঁকানোর ব্যায়ামটা শেষ। ওর হাতে রিমোট। এবারে ও বোতাম টিপে চ্যানেল পাল্টাবে। এতক্ষণ ধরে ‘ম্যায় হুঁ না’ সিনেমা হচ্ছিল। শাহরুখ খান।
অনিকেত বলল, জল খাবে?
— উঁহু।
—অনেকক্ষণ জলটল খাওনি। একটু খাও।
—আচ্ছা।
—আজ বেশ গরম।
—হুঁ।
—একটা এসি হলে হত…
—কোনও দরকার নেই। ব্যস। কথা ফুরিয়ে যায়।
কত দিন শুক্লা বলেছে—কেন সন্ধেবেলায় এখানে ভূতের মতো বসে থাকো, যাও না, অন্য কাজ থাকলে করো না।
কী অন্য কাজ করবে? কাজের লোকেরাই তো করে যায়। তবু মাঝে-মধ্যে গ্রিল মোছে অনিকেত, ফ্রিজ মোছে, এমনকী ঠাকুরের আসনও পরিষ্কার করতে যায়, শুক্লা বাঁ হাত নাড়িয়ে নিষেধ করে, তোমায় কে বলেছে? ছোঁবে না। আমি মাধবীকে দিয়ে করিয়ে নি’। মাধবী হল আয়াটির নাম।
কী কাজ করবে অনিকেত? ইচ্ছে করলে যেটা লিখছিল, সেটা শেষ করতে পারে। কিন্তু ওসব নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে ইচ্ছে করে না। যত নষ্টের মূল হল ওরা। ওইসব গে- বাইসেক্সুয়াল-ট্রান্সজেন্ডার। ওদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়েই তো মঞ্জুর খোঁজ। ওই মঞ্জুর ছেলে পরিমলকে নিয়ে ওর ভাবনা-চিন্তা শেয়ার করা। কী গাড্ডায় পড়েছিল অনিকেত। এখন অন্য গাড্ডায়। একটা কুয়োর ভিতরে বসে আছে।
যেসব চরিত্র নির্মাণ করেছিল অনিকেত, ওরা অনেকেই ওর হাত ধরে টানাটানি করে, অনিকেত ওদের খিস্তি করে তাড়িয়ে দেয়।
কিন্তু রাত্তিরে এলে কী করতে পারে? রাত্তিরেই তো ওরা আসে। কারণ রাত্তিরেই তো বিশাল একটা ফাঁকা মাঠ। শুক্লা আর অনিকেত একটা খাটে শোয়, ছয় ফুট বাই সাড়ে ছ’ফুট। ওদের দুজনের মাঝখানে তিন ফুট ব্যবধান থাকে। আসলে ওটা তিন যোজন। ওদের মাঝখানে একটা বিশাল পতিত জমি পড়ে থাকে। ওখানেই আসে চাত্তারা আসে, ঝুমকো। ময়না’রা নাচে বহু যুগের ওপর থেকে ঢোলের শব্দ ভেসে আসে। মড়াকান্নার মত গান ভেসে আসে। মাঝে মধ্যে অনিকেত যেন শুনতে পায়—
রেলের গাড়ি চলে গেল নাগর আমার এল না আজ আসি কাল আসি বলে, কেন সে গো আসে না। ঝুমকো কি বিহারের কোন রাজপুত বাড়ির উঠানে? একটা বছর চল্লিশের তাগড়া মরদ গোঁফে চুমড়ি কাটছে। বলছে দুসরা গান গাও, হিলকে হিলকে গাও। চোলিকা পিছে মালুম হায়?-
নতুন কেউ এল নাকি দলে? ওরা সবাই কেমন আছে এখন?
এই তো সেদিন হাসি বলল—তুমি তো জানো আমার আসল পরিচয়, আমার অন্তর, আমার যন্তর। আমার গতরের ঠিকুজিকুষ্ঠি। আমার পেটে বড় ব্যথা। ডাক্তার কিছু করতে পাচ্চে না, খালি ফোটোক তোলাচ্ছে। জেরবার হয়ে গেলাম গো, ছ্যাদা দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে, নাচতে পারি না, হেঁপে যাই।
হাসিকে অনিকেত তৈরি করেছিল xx ‘মেল’ হিসেবে। ওর অপরিণত অণ্ডকোষ দু’টি জন্মাবধি পেটের ভিতরে ছিল। গোনাডোট্রফিন হরমোনের অসামঞ্জস্যের কারণে দু’টো অণ্ডকোষ, তৈরি হয়েছিল, অথচ ‘ওভারি’ হয়নি। অনিকেত বইপত্রে জেনেছিল—পেটের ভিতরে লুকিয়ে-থাকা অণ্ডকোষ থেকে ক্যানসার হতে পারে একটা সময়। কারও ক্ষেত্রে এরকমটা হয়ে থাকে। হাসির বেচারা অণ্ডকোষ দু’টো গোপনে কোনওক্রমে দীনহীন হয়ে থাকা অক্ষম মাংসদানা দু’টো অকস্মাৎ স্ফীত হতে লাগল। ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ। ছড়িয়ে যাচ্ছে। ওরা বুঝতে পারছে না। একদিন মূত্রছিদ্র দিয়ে রক্তপাত হল। আর ঢোল-কাঁসর বেজে উঠল মহল্লায়। জয় মা বহুচেরা। অ্যাদ্দিনে হাসির মাসিক হয়েছে। ওলো হাসি, আজ তোর খিয়া ঢাকবার দিন। নাচ মেয়ে নাচ, তালি মেরে নাচ…।
তিন-চারদিনে মাসিক শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। হাসির চলতেই থাকে। পেটেও ব্যথা। প্রথম-প্রথম মাসিক হলে এরকমই হয়, ওরা শুনেছে। ওদের কারও কোনও দিন ঋতুস্রাব হয়নি, শুধু স্বপ্ন দেখেছে। হাসির এই রক্তপাত যেন কাঙ্ক্ষিত, যেন স্বপ্নপূরণ। তাই উৎসব। তাই ঢোল বাজে। ঢোলের চাটি অনিকেতের বুকে এসে বাজে। অনিকেত হাসির করুন মুখচ্ছবি দেখে বলে ভীষণ ব্যথা, পেচ্ছাবও আটকে যায়।
গুরুমা বলেছে—কিছু হয়নি মেয়ে। মা বহুচেরা তোকে পরীক্ষে করচে। রোজ মায়ের পুজো কর, ঢোল পুজো কর, ঠিক হয়ে যাবি।
হাসি’কে লাল চেলি পরানো হয়, খবর পেয়ে হাসি-র পুরনো প্রেমিক আসে এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে, হাসি যন্ত্রণায় মরে।
হাসি গুরুমা’কে বলে—তোমরা যা ভাবছ তা বোধহয় নয়, আমার অন্য কিছু হয়েছে।
গুরুমা চাত্তারাও জানে—ওদের যা কিছু গান সবই ভেল। ‘আমায় মেয়্যা করে দাও’—এই প্রার্থনা কখনও কোনও দেব, কোনও দেবী পূরণ করে না, তবু প্রার্থনা করে যেতে হয়। তেল- সিঁদুর, প্রদীপে, খিস্তিতে, মন্ত্রে, হাতের তালিতে যেসব নিয়ম কানুন, তা মেনে চলতে হয়। বিশ্বাস করতে হয়—লিঙ্গ-কর্তনের পর যে বদরক্ত শরীর থেকে বেরিয়ে গেল, তা হল পুরুষ- রক্ত, এবার ভিতরে নারী-রক্ত তৈরি হবে।
হাসি-র এই শরীর খারাপের মধ্যেও গুরুমা রসিকতা করে—ডাগ্তার দেখাবি বলছিস, কোন ডাক্তার দেখাবি লো? মেয়েছেলের ব্যারামের জন্য কোন ডাক্তার যেন দেখায়?
ময়ূরী বলল—গাইনি, গাইনি
—কত জানিস লো তুই, কত বিদ্যে! কী করে এত রাখিস?
ময়ূরী বলে—ওই তো, গ’য়ের অসুখের ডাক্তার হল গাইনি। এইভাবে মনে রাখি।
ডাক্তার দেখানো হয়। ডাক্তার কী করে জানবে ওর গোপন কথা। ও যে গুপ্ত অণ্ডকোষ ধারণ করে বসে আছে, কী করে জানবে পানাগড়ের সামান্য ডাক্তার। ও বড়জোর আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করাতে পারে। স্ফীত এবং নডিউলার দু’টো মাংসপিণ্ড আন্দাজ করতে পারে এবং স্বাভাবিক ভাবেই এটাকে টিউমার ভাবে।
বাইরে থেকে পেটের তলার দিকটার স্ফীতি দৃশ্যমান হয়। মহল্লার সব রসিকতা করে— তোর পেট হয়েছে হাসি!
এই অবস্থাতেও হাসি মৃদু হাসে।
টিউমার মানে অপারেশন। হিজড়েদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হ্যাপা অনেক। নিতেই চায় না। তারপর কোন ওয়ার্ডে ভর্তি নেবে? ‘মেল’ না ‘ফিমেল’? ওরা ‘ফিমেল ওয়ার্ড’-এই ভর্তি হতে চায়। অনেক সময় হয়েও যায়। কিন্তু ডাক্তার-নার্সরা পরীক্ষা করার সময় আবিষ্কার করে ফেলে শাড়ি বা ম্যাক্সির তলায় পুরুষ-লিঙ্গর অস্তিত্ব। ঝামেলা হয়। ঝামেলার ভয়ে অনেক সময় বেডেই দেওয়া হয় না, বারান্দার মেঝেতে ফেলে রাখা হয় এদের।
হাসি হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। হোমিওপ্যাথি করেছিল। ওর ক্যানসার ছড়িয়ে গিয়েছিল অন্যান্য অংশে। এরপর যা হওয়ার, মরে গিয়েছিল।
এরপর কান্নাকাটি। সে-ক্রন্দন হৃদয়ের গভীর থেকে যতটা, তার চেয়ে বেশি হল নিয়ম- পালন। রিচুয়াল। কাঁদতে হয় বলে। দুঃখ তো আছেই, এত দিন ধরে সংঘ-জীবন, একসঙ্গে নাচা-গাওয়া-ঝগড়া-গালাগালি রঙ্গরসিকতা হয়েছে। এবার সে আর নেই। সুতরাং ওদেরই তো কাঁদতে হবে। তাই এই কাঁদা পর্ব।
মধ্যরাত্রে বিছানায় অনিকেত এবং শুক্লার মধ্যবর্তী শূন্য মাঠে একটা গ্রাম্যপথ তৈরি হয়ে যায়। শবদেহ ঘিরে চরিত্ররা নিঃশব্দে শ্মশানযাত্রা করে।
কত কিছুই তো লেখা হয়নি। লেখা হয়নি দুলালী আর যাদবের বৃত্তান্ত। লেখা হয়নি মাদক- চালান চক্রে দুলালীর জড়িয়ে পড়ার কথা। দুলালী অর্জিত টাকা জমাচ্ছে গোপনে, ওই টাকা একদিন ওর মা-কে দেবে। ঘরে একটা ছেলে আছে, হয়তো ওর ঔরসজাত নয়, তবু তো ওকে কোলে নিয়েছে, গায়ে মেখেছে শিশুর ওম, শরীরে মেখেছে শিশু-গন্ধ। বাবা ডাক শুনেছে, কাঁধে চেপে ঘুরেছে গাছের ছায়ায়, চাঁদকে বলেছে টিপ দিয়ে যা, হাত ঘুরিয়ে নাড়ু দেওয়ার কথা বলেছে, পাখিকে দেখিয়ে বলেছে আয় রে পাখি ল্যাজ ঝোলা, কোকিলের গলার স্বর নকল করে শিশুকে শুনিয়েছে কু-উ-উ। ওর জন্যও কিছু টাকা নিয়ে যাবে। এবং দুলালীর মৃত্যু- পরিণতি লিখবে।
দুলালী বলে, কি গো—আমার মরণ কাহিনি লিখবে না?
টাকা-চাওয়া হিজড়েদের যেভাবে ভদ্রলোকেরা আঙুলের ইশারায় হঠিয়ে দেয়, সেভাবেই হঠিয়ে দিয়েছে অনিকেত। এদের কারও সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবে না ও।
সোমনাথ এখন মানবী। সার্জারি করেছে। পুরুষসঙ্গী জুটিয়ে কেমন আছে, কেমন চলছে ওর ঘর-সংসার—জানতে ইচ্ছে হলেও ঠোঙা ফাটানোর মতো সেইসব ইচ্ছেকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। ইচ্ছেগুলো শালা টিকটিকির ল্যাজ। কেটে ফেলে দিলেও আবার তৈরি হয়।
অফিসে ভেঙ্কটরমন নামে একজন নতুন ইঞ্জিনিয়র এসেছে। উনি তামিল। ওর কাছে শুনল আরাবানের উপখ্যাস! আরাবান নামে কোনও চরিত্র মহাভারতে আছে বলে জানত না অনিকেত। অর্জুনের এক স্ত্রী ছিল উলুপী, উলুপীর গর্ভে অর্জুনপুত্রর নাম আরাবান। আসলে ইরাবান। ইরাবান বসু রায় নামে একজন প্রবন্ধ লিখতেন। ইরাবান-ই তামিল উচ্চারণে আরাবান। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে জয় নিশ্চিন্ত করার জন্য পাণ্ডবরা এক জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিল। জ্যোতিষী বলেছিল, যুদ্ধের আগে একজন প্রকৃত-পুরুষকে বলি দিতে হবে। ‘আ পারফেক্ট মেল হ্যাজ টু বি স্যাকরিফাইড’—ভেঙ্কটরামন বলেছিল। ‘পারফেক্ট মেল’ মানে? জিজ্ঞাসা করেছিল ভেঙ্কটরমন। অনিকেত বলেছিল, আমি জানি না। তুমি জানো?
ভেঙ্কটরমন বলল, আমিও জানি না, কিন্তু ওরা বোধহয় জানত। অনেক দেখে-শুনে অর্জুনপুত্র আরাবানকে প্রকৃতপুরুষ ঠিক করে ওকে ‘বলি’ দেওয়ার জন্য ধরে আনা হল। আরাবান বলল, ঠিক আছে, পাণ্ডবদের জন্য জীবন দিতে রাজি আছি, কিন্তু মৃত্যুর আগে বিয়ে করব।
কোনও মেয়েই আরাবানকে বিয়ে করতে রাজি হল না। কেন হবে, সবাই তো জানে, দু’দিন পরই বিধবা হতে হবে। শেষ পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণ নারীর বেশে আরাবানের বউ হলেন। আরাবানের মৃত্যুর পর সেই নারী মঙ্গলসূত্র খুলে ফেলল, সঙ্গে-সঙ্গে অন্তর্হিত হল ওর স্তন, ওর নারীত্ব দক্ষিণ ভারতে অনেক মহিলাই নাকি আরাবানের পুজো করে। পারফেক্ট পুরুষ। এবং পরের দিন এক দিনের বৈধব্যপালন করে।
অনিকেত পরে জেনেছিল—দক্ষিণের হিজড়েরাও আরাবানের পুজো করে। কুড়াগামের মন্দিরে জড়ো হয় ওরা, মন্দিরে বড় গোঁফওলা ‘এক পুরুষমূর্তি। হিজড়েরা সঙ্গে নিয়ে আসে একজন করে পুরুষসঙ্গী। আরাবানের সঙ্গে বিয়ে হয়, পুরোহিতরা মন্ত্র পড়ে মঙ্গলসূত্র পরিয়ে দেয় হিজড়েদের গলায়। নাগারা বাজে, খোল-মৃদঙ্গ।
আরাবানের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর হিজড়েরা পুরুষসঙ্গীকে আরাবান ভেবে নিয়ে ওর সঙ্গেই সহবাস করে।
পরদিন আরাবানের মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয়। গ্রাম পরিক্রমা করা হয়। আরাবানকে একটা রথে বসানো হয়। সেই রথ এক জায়গায় এসে থামে। সেটা ‘বলি স্থান’। মূর্তির মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হয় ওর ধড় থেকে।
সেই সময় তুমুল ক্রন্দন করে সমবেত হিজড়ে সকল। কাঁদন পরব। এখানে-ওখানে জ্বলতে থাকে কর্পূরের মতো আগুন। হিজড়েরা মঙ্গলসূত্র ছিঁড়ে ফেলে। চিৎকার করে কাঁদে। সিঁদুর মুছে ফেলে। আর সেই পুরুষ-সঙ্গীটি? আরাবানের মৃত্যু মানে তো ওরও মৃত্যু। একরাত্রের জন্যই আরাবান।
ওই পুরুষসঙ্গীগুলোকে চুপচাপ বাড়ি চলে যেতে হয়। ওদের আর কোনও ভূমিকা নেই।
লেখা হয়নি। এসব কিন্তু লেখা হয়নি।
শুক্লা টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে।
এই বছর ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অফ রাইস’। বিশ্ব ‘চাল বৎসর’। বক্তৃতা। চালের উপকারিতা। এটা ডিডি বাংলা। ইজরায়েলি রকেট গাজা-তে হানা দিচ্ছে। এটা বিবিসি। অন্য কোথাও দেখাচ্ছে কী একটা রান্না। টেবিলের ওপর আস্ত একটা মোচা। সানফ্রান্সিসকো’তে সমলিঙ্গের বিবাহ অনুমোদিত হল। এ নিয়ে টক-শো। পাল্টাও পাল্টাও। চেচেন প্রেসিডেন্ট ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে মারা গেলেন—উনি যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহিদ স্মরণ করছিলেন। সার্বিয়াতে হাজার-হাজার ঘর পুড়িয়ে দিয়েছ, একটা ট্রেন উড়িয়ে দিয়েছে বিস্ফোরণে। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করা হচ্ছে এক মহিলার দেহ। এক বালক ছুটে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল এই নারীশরীরে, যার মুখ ছাই-মাখা, অঙ্গার-মাখা, রক্ত-মাখা। বীভৎস। ক্রন্দন। মৃত্যু। বীভৎস মৃত্যুর পটভূমিতেই কথাটা বলার জন্য শ্বাসগ্রহণ করেছিল অনিকেত, এবং বলেও ফেলল— জানো শুক্লা, মঞ্জু মরে গিয়েছে, ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে। তার আগেই রিমোটের বোতাম টিপে দিয়েছিল শুক্লা। টিভিতে তখন পেলব-মসৃণ-সুন্দর মুখ। মাস্ক মাখা হবে। চন্দন-গোলাপ- হলুদ…।
—মারা গিয়েছে?
শুক্লা ভীষণ আশ্চর্য হয়।
—কী করে? কবে?
—এ তো, তোমার স্ট্রোক হওয়ার পরে-পরেই।
—কী করে?
—ট্রেনের ধাক্কায়। অ্যাক্সিডেন্ট।
শুক্লা তীব্র চোখে তাকায়। অ্যাক্সিডেন্ট, না সুইসাইড?
না, না, অ্যাক্সিডেন্ট। অ্যাক্সিডেন্ট।
চন্দন বাটা গুলবেন গোলাপ জলে। দু’ফোঁটা লেবুর রস মধু, আর মুলতানি মাটি…।
৫৭
বিকাশ ওর ঘরের ভিতর থেকে হাঁকল—দুটো ওমলেট কর। ডাল ডিমের। তারপরই শুধরে নিয়ে বলল—একটা সিঙ্গল ডিমের। আমার আবার বেশি ডিম-টিম খাওয়া ভাল না।
আজ শনিবার। দুপুর থেকে মেয়েছেলেটা আছে। গত দু-তিন মাস ধরে প্রায়ই আসছে ওই মুখপুড়ি। কাকু ওকে ‘পারো’ ডাকে। দেবদাস সিনেমার ‘পারো’। কাকু বলে, পারো, তুমি কত কী পারো, কতরকম করে পারো… গা জ্বলে যায়।
একসঙ্গে তিনটে ডিম ভাঙল না মন্টু। প্রথমে একটা ডিম ভেঙে একটা ওমলেট ভাজল, তারপর দু’টো ডিম ভেঙে বেশি করে নুন দিয়ে ভাজল। নুনে মুখ পুড়ে যাক। ঘরে বিষ থাকলে, নুন কেন বিষ মিশিয়ে দিত। একদিন ওর জুতোর ভিতরে চেবানো সজনের ডাঁটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল মন্টু। জুতোয় পা ঢুকিয়েই ঢং করে চেঁচিয়ে উঠে কাকুর কাঁধটা খামচে ধরেছিল। পরে দেখা গেল জুতোর ভিতর থেকে চেবানো ডাঁটা বেরিয়েছে।
পারো নিশ্চিন্ত হল। ও বলল, আমি ভাবছিলাম সাপ-টাপের বাচ্চা। পায়ে ঠান্ডা লাগছিল কিনা।
বিকাশ বলেছিল, দুপুরে চেবানো সজনেডাঁটা জুতোর ভিতরে গেল কী করে? ওই মেয়েটা বলেছিল, কাক-টাক—বেড়াল-টেড়াল…।
বিকাশ বলেছিল, বেড়াল তো পুষি না। আর কাক ডাঁটা নিয়ে জুতোয় ঢোকাবে কেন?
মেয়েটা বলেছিল, কে জানে কেন? সাপ-টাপ যে নয়, তাতেই নিশ্চিন্দি। জুতোটা ঝেড়ে পরে নিল।
মেয়েটা নিশ্চয়ই গ্রামের মেয়ে। নইলে জুতোয় সাপের বাচ্চা ঢুকে থাকতে পারে এমন ভাবনা আসতই না। জুতোটাও ছিট-ছিট ভেলভেটের। চামড়ার না। বেশি দামি না। এরা হল কাগজের মেয়ে। মানে, খবর কাগজের। খবর কাগজে ‘বান্ধবী চাই বিজ্ঞাপন’ দিয়েছিল ওই কাকু। ও ঠিক জানে। ফোনে যখন কথা কইত, সেসব কথাবার্তাতেই ব্যাপারটা বুঝেছে মন্টু। নানা ধরনের নানা রকমের মেয়েছেলে ঘরে ঢুকিয়েছে কাকু। কিছু দিন হল এই মেয়েছেলেটা বেশি-বেশি আসছে। খুব পিরিত হয়েছে। কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না। তেল দিয়ে ছাড়াতে হয়। বিছানায় বিছুটি পাতা রেখে দিলে দু’জনেরই পিরিত গাধার গর্তে ঢুকে যেত
ডিমের ওমলেটের প্লেট দুটো রেখে এল। মামলেট’কে ‘ওমলেট’ বলা শিখেছে ও বাড়ির জেঠিমা’র কাছে।
এবার চা বসাবে।
মন্টু শুনতে পাচ্ছে ও ঘরের ‘ডাইলগ’।
—ইশ, নুন কটা, ভীষণ নুন।
—কই, আমারটা তো ঠিক আছে!
—জানি তোমারটা ঠিক আছে, কিন্তু ডিমে খুব নুন।
—কই দেখি, দাও একটু।
নিশ্চয়ই এবার একটু ছিঁড়ে খাইয়ে দিয়েছে।
—হ্যাঁ, তাই তো। কিন্তু আমার ওমলেট টায় কিন্তু ঠিক ছিল। তোমারটায় বেশি হল কী করে?
—মন্টু… অ্যাই মন্টু…। এত নুন হল কী করে?
মন্টু ও-ঘরে গেল। মাথা চুলকে বলল, দিদিমণি তো একটু বেশি নুন খান, তাই ওঁরটা আলাদা করে বানিয়েছি।
—একটু বেশি? মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। গাদাখানেক নুন ঢেলেছিস। মারব ঠেসে একটা থাবড়া।
পারো-দিদিমণি বলল—ঠিক আছে—ঠিক আছে। বোধহয় দু’বার দিয়ে দিয়েছে। নুন একটু বেশি খাই সত্যি কথা। একটু বেশি করে দু’বার দিয়ে দিয়েছে হয়তো।
বিকাশকাকু পারো-দিদিমণিকে বলল, ওটা খেতে হবে না তোমার। অ্যাই মন্টু, আবার তৈরি কর। ভাল করে কর।
মন্টু আবার মাথা চুলকোয়। ফ্রিজে আর ডিম নেই।
—ডিম নেই? তবে নিয়ে আয় গে যা।
—না, না, দোকানে যেতে হবে না। চা হলেই হবে।
—শুধু চা খাবে কেন?
—চায়ের সঙ্গে কিছু লাগে না আমার।
—চায়ের সঙ্গে লাগে না? মালের সঙ্গে লাগে, তাই না?
মেয়েরটা ঢঙির মতো মুখ নাড়ায়।
—দ্যাখ তো সেউই ভাজা আছে কি না…।
সেউই ছিল বয়ামে। এনে দেয়। কাজুও কেনে বিকাশ। কাজু মন্টুর জিম্মায় রাখে না। মন্টু লোভ সামলাতে পারে না, টুকটাক খেয়ে নেয়। কাজু ঘরেই রাখে। বোধহয় নেই। তা হলে নিজেই বের করে দিত। থাকবে কী করে? দুপুরে তো একপ্রস্থ বিয়ার খাওয়া হয়েছে। দরজা বন্ধ করে। ওই তো, তিনটে বোতল কেতরে পড়ে আছে। দু’প্যাকেট বিরিয়ানিও আনিয়েছিল। ওই তো, ঘরের কোনায় প্যাকেট দু’টো পড়ে আছে।
এই মেয়েটাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না মন্টু। মন্টুকে অর্ডার করে। অর্ডার করো, কিন্তু এমন টোন দিচ্ছো যেন তুমি এ বাড়ির কাকিমা। মন্টুর সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ করিয়ে দিয়েছিল কাকু, তখনই হেসেছিল। একে পেলেন কোথায়? ওকে দিয়ে আপনার সব কাজ হয়ে যায়, তাই না? হি হি হি। তখন, ও কাকুকে ‘আপনি’ করে বলত। এখন তো আদেখলাপনা করে ‘তুমি’-তুমি’ করে। বলেছিল, তোর নাম মন্টু না মিন্টু?
—কেন? মিন্টু হলে কী হত?
—মিন্টুর সঙ্গে ইন্টুপিন্টু খুব ভাল মিলত। গাইতে পারিস? কোনও জবাব দেয়নি মন্টু। দেবে কেন?
—নাচতে পারিস?
তুই নাচ। পুটকিতে রস হয়েছে খুব। মনে-মনে বলেছিল মন্টু।
‘পারো” বলে ডাকে বলে তুই কি ঐশ্বর্য রাই নাকি? না কি শতাব্দী, না রূপা গাঙ্গুলি? তোর নাম নিশ্চয়ই পারুল। পারুল গাঁয়ের মেয়েদের নাম হয়। আমাদের গাঁয়েও পারুল ছিল। ও ছিল হাবি। কথা কইতে পারত না।
একদিন মেয়েটাকে বিকাশের জামায় বোতাম লাগাতে দেখেছে মন্টু। কেন, ও তো বাইরের লোক? লাগালাগির কাজে এসেছিস, কাজ করে চলে যা। দরদ দেখাচ্ছিস কেন? বোতাম তো আমিই সেলাই করে দি’। কাকুর মাথাও টিপে দেয় নিজের কোলের ওপর মাথাটা তুলে। বহুত পয়সা খিঁচে নেয়। এমনিতে কত রেট কে জানে, যাওয়ার সময় ব্লাউজের ফাঁকে টাকা গুঁজে দেয়। ভাঁজ করা থাকে তো, তাই বোঝা যায় না কত। একদম ভেড়ুয়া বানিয়ে রেখেছে কাকুকে। ফার্স্ট দিন থেকেই এই হারামজাদিকে ভাল লাগেনি মন্টুর। ওপর-পড়া। মন্টুর সামনেই কাকুর থুতনি নাড়িয়ে দিয়েছিল মেয়েটা। ওরা যখন ঘরে ঢুকে থাকে, ঘরের দরজা- জানলা বন্ধ থাকে। এসি চলে। এসি-টা গররগরর শব্দ করে, আসলে গোঁঙায়। কেঁদে মরে। এ বাড়ির মরা ছেলেটার জন্য। বেসিনের জলের কল ছ্যারছ্যার করে ছিছি দেয়।
বন্ধ দরজার গায়ে কান লাগিয়ে অসভ্য-কথা শুনেছে, অনেক অসভ্য-কথা, আর গা জ্বলে গিয়েছে মন্টুর
মন্টু চা করল। এই মাগিটা দুধ চা খায়, কাকু লিকার।
লিকারে একটু দুধ মিশিয়ে চিনি দিয়ে ‘থুক’ করে চায়ের কাপে একটু থুথু ফেলে দিল মন্টু। চামচ দিয়ে নেড়ে দিল। মেয়েছেলেটাকে দিয়ে এল। নিন, দুধ চা। রান্নাঘরে এসে চামচটা ভাল করে ধুয়ে নিল। এবার কাকুর চায়ে অল্প চিনি।
ঘরে গিয়ে মন্টু দেখল, কাকু ওই চা-টা খাচ্ছে। ওই থুতুমারা চা।
মন্টু বলল, সে কী, আপনার তো লিকার।
বিকাশ বলল, আমার দুধ-চা খেতে ইচ্ছে করল যে, কত লিকার খাব।
পারো বলল, একযাত্রায় পৃথক ফল কেন?
কী থেকে কী হয়ে গেল। ঠিক হয়নি, পাপ হল। মন্টুর খুব মন খারাপ।
মন্টুও খায়। সব সময় নিজের ইচ্ছেয় খায় তা নয়, কাকুও মুখে পুরে দেয়। অসুখও করেছিল গলায়। কোত্থেকে অসুখ নিয়ে এসেছিল, ফোনে গল্প করতে করতে কাকে যেন বলেছিল, পেন ড্রাইভ-এ তো ভাইরাস আসবেই। মন্টুকেও একবার বলেছে মাল খেয়ে এই একই কথা। এটা কম্পিউটারের কথা, কিন্তু এর মানে মন্টুও বোঝে।
অনিকেত জেঠু তখন বড় ডাক্তার দেখিয়ে দিয়েছিল। ইনজেকশন নিতে হয়েছিল। কাকুকেও ইনজেকশন নিতে হয়েছিল। তারপর অনেক দিন ওসব বন্ধ ছিল। তারপর আবার। অবশ্য মোজা পরিয়ে। ওই রবারের গায়ে আবার আইসক্রিমের গন্ধ।
তখন বিকাশকাকু মন্টুর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কাকু ওকে ভালবাসে। কাকু তত্ত্বতালাশ নেয়—খেয়েছিস তো? বাজার থেকে মাছ কাটিয়ে আনলে পিস ছোট-বড় করে না। সব এক সাইজের পিস কাটিয়ে আনে। একদম অনিকেত জেঠুর বাড়ির মতো।
মিত্তিরবাবুর ড্রাইভারের নাম লাল্টু। লাল্টুর সঙ্গে কথাবার্তা হয় মন্টুর। লাল্টু শুধু গাড়ি চালায় না, মিত্তিরবাবুর আরও অনেক কাজ করে, বাজারও করে। ওদের বাড়িতেই থাকে। এখনও বে-থা করেনি কিনা। ও বলেছে, মাছের পিসগুলো মাঝখান দিয়ে কাটা হয় ওর জন্য আর রান্না মাসির জন্য। রান্নার মাসিই মাছের টুকরোগুলো হাফ করে নিজের হাতে। করতে হয়।
মন্টু তো সেম-সেম মাছ পায়। সেম-সেম চালের ভাত। লুচি হলে সেম-সেম লুচি।
কিন্তু সেই বিকাশকাকুকে থুতু খাওয়াল মন্টু?
ইচ্ছে করে তো নয়…।
তা ছাড়া চুমু তো থুতু-মাখানোই হয়। কাকু কোনও দিন চুমু খায়নি মন্টুকে। এখন থুতু খাচ্ছেনা তাহলে, চুমু খাচ্ছে। চুমু!
৫৮
পরির ঘরে নুপুর এসেছিল ল্যাপটপ-টা দেখতে। পরি শুধু আঙুলের ছোঁয়ায় একটা মডেলের পোশাকের রং পাল্টে দিচ্ছিল। পরি বলছিল, এই দ্যাখ, আর একটু ঝুলিয়ে দিচ্ছি টপ-টা। হাঁটুর একটু ওপরে। একটা বর্ডার লাইন বসিয়ে দিতে পারলে ভাল হয়, যাকে বলে পাড়। কী পাড় দেব নূপুর?
নুপুর বলে, বেগুনি।
বেগুনি করে দেয় পরি।
নুপুর বলে কমলা।
কমলা রঙেরই পাড় হয়ে যায়।
নুপুর বলে আমাকে তোর ওই যন্তরটার মধ্যে ঢুকিয়ে নে। তারপর খুব সুন্দরী বানিয়ে, সাজিয়ে আমায় বের করে দে। দে না রে-এ-এ…
—সুন্দরী হলে কী করবি তুই?
—তা হলে ‘মেসাজ’ করা ছেড়ে দিতাম।
নুপুর এখন ‘ম্যাসেজ’ নয়, ‘মেসাজ’-ই বলছে।
—কেন মেসাজ ছেড়ে দিতি নূপুর?
—ধুর, আর ভাল লাগে নাকি? ভাল না-লাগলেও অন্যের গা চটকানো। এক ঘণ্টা চটকে যা পাই—তার হাফ কেটে কোম্পানি আমায় দেয়।
—কোম্পানি?
—ওই আর কী।
নুপুর হিহি হাসে। নূপুর মতোই বাজে, পরির গায়ে ঢলে পড়ে।
—পার্লার-টার্লার না-বলে ‘কোম্পানি’ বলতে ভাল লাগে। রিকশাওলারা যেমন নিজেদের ‘পাইলট’ বলে। হিহি।
পরিও হাসে।
বলে, যা বলেছিস মাইরি, দালাল যেমন এজেন্ট।
নূপুর বলল, সুজি যেমন মোহনভোগ।
পরি হাত নেড়ে বলল—না রে, সুজি ভেজে ঘি-কিশমিশ বাদাম-চিনি মিশিয়ে, তার সঙ্গে ভালবাসা আর বউ-বউ ভাব মিশিয়ে মিঠিন-মিঠিন শব্দ করা খুন্তি নাড়িয়ে যেটা তৈরি হয়, সেটা হল ‘মোহনভোগ’। আজ জলে সেদ্ধ করে ভক করে একমুঠো চিনি ফেলে ঝক করে ক’টা কিশমিশ ছড়িয়ে ঠ্যাঙোর-ঠ্যাঙোর খুন্তি ঘষে যেটা তৈরি হল—সেটার নাম কী জানিস? ‘হালুয়া’।
আবার দুই সখি হেসে গড়ায়।
পরি বলে—সুন্দরী হয়ে না-হয় মেসাজের কাজ ছেড়ে দিলি, তারপর কী কাজ করবি?
—কেন, মডেলের কাজ…?
—ওটাও কি ভাল লাগত, রংচং মেখে, আজব-আজব পোশাক পরে র্যাম্পে হেঁটে বেড়ানো? বুকের খাঁজে দাদের মলমের কৌটো রেখে ছবি তোলা, শর্ট প্যান্টের সঙ্গে হাওয়াই চটি পরে নাচা, ভাল লাগবে তোর?
—হ্যাঁ, ভাল লাগবে। পয়সা তো বেশি।
—বেশি পয়সা তো পার্লারেও আছে। এক্সট্রা-অ্যাসাইনমেন্ট নিলেই তো পয়সা।
—পা ফাঁক করার কথা বলছিস তো পরি? তাতেই-বা কী পয়সা। আমাদের ওখানেও জাতবিচার আছে। ছেলেরা যতই বলুক না কেন, খেঁদি পেঁচি নুরজাহান অন্ধকারে সব সমান— সমান নয়। এই আমি, যদি গলিতে দাঁড়াতাম, একরকম পয়সা, বিউটি কেয়ার প্রফেশনে থাকলে আরও একটু বেশি, দু’টো সিরিয়ালে নায়িকার বান্ধবীর অভিনয় করতে পারলে আর একটু বেশি। মডেল খুব উঁচু জাত। আমার কি আর মডেল হওয়া হবে? ফিগার করতে হবে। অ্যাই পরি, তুই তো মডেল নিয়ে কারবার করিস। আমার ফিগারটা কেমন রে? সত্যি কথা বল।
—কেন, ভালই তো বেশ। পরি বলে। আমার চেয়ে অনেক ভাল।
—কোমরটা ঠিক আছে?
ম্যাক্সিটা উঠিয়ে সামনে দাঁড়ায় নূপুর। নাভিতে সামান্য স্পর্শ দিয়ে পরি বলে, ভালই তো। কোনও চর্বি নেই।
—চর্বি হবে কোত্থেকে রে পরি? কী খাই? যা রোজগার করি, সংসারে গাদাই। বাপের ওষুধের পেছনে গুচ্ছের টাকা। মাসে এক হাজার করে স্যাকরার দোকানে জমা হয়। বিয়ের গয়না। গাছে কাঁঠাল গোঁপে তেল।
একটা ‘লাভার’ পাওয়া সত্যি-সত্যি মুশকিল। বয়ফ্রেন্ড জোটে, ‘লাভার’ হয় না। মা ঘটক লাগিয়েছে। আমরা যদি বস্তিতে না-থেকে ভদ্রবাড়িতে থাকতাম, তা হলে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন হত ‘পাত্রী স্লিম, সুন্দরী, বিউটিশিয়ান’। ঘটক ব্যাটা ‘বিউটিশিয়ান’ মানে বোঝে? অচেনা ব্যাটাছেলের সঙ্গে পয়সার জন্য তো কত কিছুই করেছি, করি, কিন্তু বিয়ে করা যায়, বল? তোর কী ভাগ্যিরে পরি, তুই একটা ‘লাভার’ পেয়েছিস।
পরি বলে, কে জানে কতটা লাভার, ওদের চেনা খুব মুশকিল। ইস্কুলে সংস্কৃত থেকে বাংলা ট্রানস্লেশন ছিল না—কী যেন… স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি কুতঃ মনুষ্যা—একদম বাজে কথা। এখন তো গদগদ ভাব দেখাচ্ছে, চাকরি পেলেই অন্য রূপ ধারণ করবে। কিচ্ছু বলা যায় না। বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাবে, বেশ টুকটুকে বউ, ঠিক জায়গায় ঠিক ছ্যাঁদা, বলবে বাড়ি থেকে দিয়ে দিল, কী করব।
পরি এরপর এক কাণ্ড করে। আলমারির ভিতরে রাখা গয়নার পুঁটুলিটা থেকে একটা হার পরে, দুল। বলে, আমাকে কেমন লাগছে রে নূপুর?
.
চয়ন মাথা চাপড়ে বলল, চাকরিটা হল না মাইরি।
পরি বলল, আরে, এত মুষড়ে পড়ার কী হল। চাকরি কি এত সহজ নাকি?
চয়নের চোখটা লাল। পরি দেখল। শরীর খারাপ? জিগ্যেস করল পরি।
চয়ন ঘাড় নাড়ল। বলল, মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণা, আর আত্মধিক্কারে।
—আত্মধিক্কারে মাথা ধরে না, তা হলে তো আমার সব সময় মাথা ধরেই থাকত। আজ তো খুব রোদ্দুর, এজন্য। বাইরে ঘুরেছ খুব, তাই না।
—হুঁ।
বাড়িতে থাকলে কোলে মাথা রেখে টিপে দিতাম। চলো কফি খাই।
ক্লাসের পর দেখা করতে এসেছে চয়ন। কলেজের সামনে থাকে না। ফোনে জায়গা ঠিক করে নেয়। কোনও দিন সাউথ সিটি মল, কোনও দিন সেন্ট্রাল পার্ক, কয়েকবার শিয়ালদার প্রাচী সিনেমা হল-এর সামনের ফুট ব্রিজের ওপর। রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য বানানো হয়েছিল, কিন্তু কেউ ব্যবহার করে না। ওরা রেলিং-এ হেলান দিয়ে গল্প করত, নীচে বয়ে যেত কলকাতা। একবার পুলিশ ধরেছিল, মুচিপাড়া থানায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সেই পুলিশটা সম্ভবত বিহারের। ও আইপিসি ৩৭৭ ধারা জানে না, ও জানে ‘লন্ডা’ আইন। কেন থানায় যাব—জিগ্যেস করাতে চয়নকে বলেছিল—ওপেন মে লন্ডাবাজি করতে হ্যায় তুম, এগেস্ট লন্ডা-ল। উয় পুরো লেড়কি হোতে তো কুছ নেহি বলতে। শেষ পর্যন্ত কুড়ি টাকায় রফা হয়েছিল। সেই থেকে ওরা ওধারে যায় না। এখানে কেউ কিছু বলে না।
পরি ‘ক্যাফে কফি ডে’-তে নিয়ে গেল। এই সব নতুন ডিজাইনের চা-কফির দোকান হয়েছে আজকাল। ভানুদার কেবিন কানুদার কেবিনগুলো ক্রমশ উঠে যাচ্ছে—যেখানে চা- টোস্ট খেতে-খেতে অনেকক্ষণ আড্ডা মারা যেত। কিন্তু এসব জায়গায় চা-কফির দাম অনেক বেশি। তবু সেফ।
গোল-গোল টেবিল। চারজন বসা যায়। কাচের দেওয়ালের বাইরে শব্দময় ছুটন্ত শহর কাচের দেওয়ালে এধারে তরুণ-তরুণীদের নিজস্ব শব্দ।
পরি ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ-টা বার করে টেবিলে রাখল। অন করল। নীল রঙে ভেসে উঠল উইনডোজ।
পাসওয়ার্ড দিল পরি। ছ’টা তারা ফুটে উঠল।
—কী লিখলাম বলো তো চয়ন।
চয়ন বলল, তোর পাসওয়ার্ড আমি কী করে জানব?
—জানো, তুমি জানো।
চয়ন ঠোঁট কামড়ায়
পরি তারাগুলো মুছে দেয়।
এবার চয়নের দিকে ল্যাপটপ-টা ঘুরিয়ে দিয়ে বলে, তোমার নামটা টাইপ করো… সি এইচ… চয়ন টাইপ করে। ও সামান্য কিছু কম্পিউটার জানে। ‘এন্টার’ মারে। এবং সঙ্গে-সঙ্গে সুরমূর্ছনা, এবং জানালা খুলে যায়।
—আমার নামে পাসওয়ার্ড করেছিস তুই? যদি সব খুলে দেখে নি?
—খুলো…তুমিই তো খুলবে…। মুখ টিপে হাসে পরি।
চয়ন দু-একটা ফাইল খোলে। ডাউনলোড করা কী সব। ক্রুজো, ফাইবার, সালা…
—সালা কি রে?
—ওটা একটা ফ্রেঞ্চ অ্যাবরিভিয়েশন। এস এ এল এ। সিগনেচার কস্টিউম বোঝায়। মানে হচ্ছে, যে-পোশাক কারও ক্যারেক্টার বা প্রফেশন’কে রিপ্রেজেন্ট করে। একজন বুরোক্র্যাট বা একজন পেইন্টার’কে কস্টিউম দেখেই বোঝা যায়। উকিলদের আলাদা পোশাক। যারা ম্যাচো গে, টপ—ওরাও অনেকে চায় ওদের সিগনেচার কস্টিউম। কিন্তু চয়ন, তুমি হলে ছুপা। তোমায় দেখে কেউ বলবে না তুমি ‘গে’, তুমি ‘টপ’। দিব্বি পাঁচ পাবলিকের মতো দেখতে, মাথায় টোপর পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসার মতো লুক, শাশুড়িকে দেখে লজ্জায় হাবা। কে বলবে, তুমি উল্টে খেতে জানো? তোমার উচিত সোল্ডার মাস্ল-এ ট্যাটু করা, সফ্ট ফাইবারের গেঞ্জি, এমন ট্রাউজার, যাতে ওই জায়গাটা বেশ ফোলা-ফোলা দেখায়…।
চয়ন বলে—ওরকম পার্টি পেয়েছিস না কি রে পরি, কাঁধে উল্কি, ফোলা-ফোলা বাইসেপ
—হ্যাঁ, পেয়েছি তো।
—খুব শক্তি ফলায়… না? খুব চেপে ধরে?
পরি কিছু বলে না।
—খুব লাগে? মানে খুব হাঁসফাঁস লাগে, তাই না?
পরি ব্রীড়াবনত মুখ মৃদু নাড়ে দু’বার।
—এবার ছেড়ে দে পরি। কম্পিউটার তো হয়ে গিয়েছে। ক্যামেরাও। আর কী দরকার, এসব করে?
—ক্যামেরা কই হল? মায়ের সোনা আমি নষ্ট করব না। ওগুলো আমার জন্য রেখে গিয়েছে মা। ওগুলো আমি পরব।
চয়ন বলল, ঠিক আছে, ক্যামেরা কত দাম? আট-দশ হাজারে হয়ে যাবে না? আমি কিনে দিচ্ছি, ইনস্টলমেন্টে কিনে দেব, মাসে দু’শো করে দিলেই হয়ে যাবে। আমি পারব। তুই অন্য ছেলেদের কাছে যাস না।
—হিংসে হচ্ছে, তাই না চয়নদা?
—তা তো একটু হচ্ছেই। কিন্তু খারাপও লাগছে। এভাবে…
—এভাবে কী? শুয়ে টাকা কামাচ্ছি বলে? এটাও স্ট্রাগ্ল। যদি প্রফেশনে নাম করি, লোককে গর্ব করে বলব আমি এভাবে লড়াই করেছি। ছেড়ে দাও চয়নদা। তোমাকে ক্যামেরা কিনে দিতে হবে না। ওটা আমিই বুঝে নেব।
—কন্ডোম নিস তো?
—হ্যাঁ। ওসব সেফটি আমি নি। তোমার কোনও রিস্ক নেই।
—আমার রিস্কের কথা হচ্ছে না, আগে তো তোর নিজের রিস্ক।
পরি বলল, ধরো আমার এইডস হয়ে গেল, তখন তুমি ফুটে যাবে, তাই না?
—কেন ওসব নাম মুখে আনছিস ওসব হবে কেন? সেফ থাকবি…।
—এড়িয়ে গেলে। জানি তুমি ফুটে যাবে। তোমার ফুটতে হবে না। আমিই তোমাকে নিষেধ করব তখন
—বাজে কথা রাখ তো। ব্যাপারটা লাইট কর।
—না, ঠিক আছে। যদি রাধার এইড্স হত, রাধা কী করত? কৃষ্ণকে ঘেঁষতে দিত? ওর তো নিজ অঙ্গ প্রীতি ইচ্ছে ছিল না, কেবল কৃষ্ণ অঙ্গ প্রীতি ইচ্ছে। রাধা তখন অন্যভাবে কৃষ্ণকে তুষ্ট করত।
চয়ন বলল, থাম তো।
ব্ল্যাক কফি এসে গিয়েছিল, আর ছোট কেক।
চয়ন বলল, তোর এখন খুব পার্সোনালিটি হয়েছে পরি। ভালই লাগছে। নিজের সিদ্ধান্তে স্টিক করছিস। কর। তোর কোনও ক্লায়েন্টের সঙ্গে আবার স্পেশাল বন্ধুত্ব করে বসিস না যেন। তা হলে দুঃখ পাব।
—জেলাস হবে?
— হ্যাঁ।
পরি বেশ খুশি হল যেন। ওর মুখে হঠাৎ এক ঝলক আলো যেন। জেলাস হওয়া তো ভালবাসার একটা সিম্পটম।
পরি বলল, নো স্পেশাল রিলেশন। নো কোয়েশ্চেন অফ।
—ঠিক তো?
মাথা দু’বার নাড়ায় পরি। দু’পাশে। মানে একদম ঠিক।
চয়ন বলে, তা হলে একটা গল্প শোন, চারজন ‘গে’ একটা বার-এ গিয়েছে। একটাই বসার টুল। ওরা করল কি টুলটাকে উল্টে দিল। তারপর চারটে পায়ার উপর চারজন বাট্টু ঠেকিয়ে বসে গেল। মাল খাওয়া হওয়ার পর আবার টুল উল্টে, টুলটা যেমন ছিল রেখে চলে গেল।
জোক্-টা শুনে পরি-র পুরুষালি স্মার্টনেস ধ্বসে গেল। হাতটা বেঁকিয়ে, ভ্রুভঙ্গি করে চয়নের গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল—যাঃ।
পরি দু’টো ছোট চুমুক দিল। বলল, এত কড়া কফি খেতে পারি না। তুমি তো আঁতেল, কড়া কফি খাও, তাই ‘ব্ল্যাক’ বলেছিলাম।
এবার কী একটা মনে করে পরি একা-একা হাসতে লাগল।
চয়ন বলল, এখনও হাসছিস যে, খুব মজা লেগেছে, না?
পরি বলল, না, অন্য একটা কথা মনে পড়ল। টনি। বলছিলাম না, কাঁধে ট্যাটু, বাইসেপ-এ ট্যাটু, ওর নাম নাকি টনি। মজার জোক বলে। বলছিল, হোয়াট ডাজ হ্যাভ আ গে-ম্যান অ্যান্ড অ্যান অ্যাম্বুলেন্স কমন? দে বোথ গেট লোডেড ফ্রম দি ব্যাক অ্যান্ড গো Whoo-Whoo…।
চয়ন গম্ভীর হয়ে গেল।
একটু পরে বলল, শোন পরি, যেভাবে পয়সা কামাচ্ছিস, ওটা ঠিক না। ওটা প্রস্টিটিউশন। তুই অন্য কিছুও তো করতে পারিস সাইডে।
কী করব বলো? কী পারি আমি? কুঁতিয়ে কাঁতিয়ে দু’টো কবিতা লিখলে পয়সা আসবে?
চয়ন বলল, না, ধর, বিউটিশিয়ান’স কোর্স করে নিলি এক মাসের। ওতেও তো পয়সা আছে, কিংবা ধর মেক-আপ ম্যানের কোর্স…।
পরি চয়নের দিকে সোজা তাকাল। ব্ল্যাক কফির সঙ্গে মানায়, এমন গলায় বলল, বুঝলাম।
.
শিকস্তি বলল, এই যে পরি, তোর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে এত ‘ডিপ’ ছিলি, যে, আমাদের দেখতেই পেলি না? আমরা তো তোদের প্রায় পিছনেই ছিলাম। হোয়াট ওয়াজ দ্য প্রবেলম?
—কেন? প্রবলেম কেন?
—আরে, তোর মুখের শেড পাল্টাচ্ছিল যে, অবজার্ভ করছিলাম।
—না, কিছু না।
—তুই ওকে নিশ্চয়ই সব বলেছিস….
—টেক ইট ইজি বলেনি ও?
— উহু…।
—বলে কখনও? নিজে চাকরি জোগাড় করেছে?
—না।
—তোর পয়সায় খাবে বসে-বসে। ইনডাল্জ করিস না পরি। বল না ওকে রোজগার করতে।
—টিউশনি করে তো। বলছিল ক্যামেরা কিনে দেবে ইনস্টলমেন্টে।
—ধুর, টিউশনি করে ক’পয়সা? ওকে ‘জিগালো’-র কাজ করতে বল। পয়সা আছে। কানেকশন আমি দেব। আজকের কাগজেও তিনটে অ্যাড আছে : লোননি প্রেটি উওমেন সিক্স বয়ফ্রেন্ড…
এটা আশা করেনি পরি। জিগালো হবে চয়ন?
—কি রে পরি, ভাল লাগল না কথাটা?
—না রে, ও পারবে না। ও কি টনিদের মতো মাচো? ও রোজ-রোজ পারবে না।
—কে বলল, পারবে না? ইঁদুরের মতো চেহারার পুরুষমানুষকে দেখেছি একটার-পর- একটা শট দিয়ে যাচ্ছে।
—ওরা ওষুধ-টসুধ খায়, কিংবা হরমোন নেয়। আমি তো নিজেকে দিয়েই…।
কথা শেষ করে না পরি।
পরি বলতে চেয়েছিল নিজের অভিজ্ঞতায় ও বুঝেছে। আসলে পরি তো বায়োলজিকালি ‘বাঁবি’-সম্পন্ন পুরুষ। ও যখন নিজস্ব পায়ু দান করে, লিঙ্গ ঘর্ষণে অস্ত্রের পর্দার বাইরে অবস্থানরত প্রস্টেট গ্ল্যান্ডটায় সুখানুভূতি পায়, কিন্তু চরম পর্যায়ে যা ক্ষরিত হয়, তা বীর্যক্ষরণ- ই, তাতে শুক্রকীট সংখ্যা কম থাকতে পারে, কিন্তু তা প্রস্টেট এবং শুক্রথলি থেকে আসা তরল। যা নিষ্ক্রমণের পর যৌন-ইচ্ছা থাকে না। একটু যেন কাহিলও লাগে। জিগালোদের তো এ কম্মোটি বারবার করতে হবে। চয়নদার শরীর খারাপ হবে না?
শিকস্তি আবার বলে—কী, নিজেকে দিয়ে কী?
পরি বলে, না রে। চয়ন ওসব পারবে না।
—তার মানে তোর সায় নেই। অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে মিশতে দিতে চাস না ওকে। জেলাস হয়ে যাবি। তার মানে তুই খুব পজেসিভ। দিস ইজ লাভ।
.
শুক্লা অনিকেতকে বলল, কেমন ঘরকুনো হয়ে গিয়েছ তুমি।
অনিকেত বলল, এই বেশ ভাল আছি।
শুক্লা বলল, বিকাশ ঠাকুরপো কেমন আছে?
অনিকেত বলল, অনেক দিন খবর জানি না।
—আর মন্টু?
অনিকেত বলেনি মন্টুর গলায় গনোকক্কাস সংক্রমণের কথা। ডাক্তার দেখানোর কিছু দিন পর ফোন করে জেনেছিল মন্টু এখন ঠিকঠাক। সে বহু দিন হয়ে গেল।
শুক্লা বলল, মন্টুকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। পড়াশোনাটা চলছে তো? ওকে একদিন বাড়িতে নিয়ে এসো না গো…।
৫৯
আজ ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৪। আজ অনিকেত বাহান্ন বছর পূর্ণ করে তিপ্পান্ন-য় পা দিল। শুক্লা বলেছিল, একটুর জন্য তুমি যিশু হলে না। মাত্র দু’দিন আগে জন্মালেই তোমার জন্মদিনে পৃথিবী জুড়ে উৎসব হত। বছর চারেক আগে বলেছিল—তুমি তো প্রায়-যিশু। সব পাপীর পাপ তুমি ধারণ করছ।
ছোটমামা নাকি বলেছিল, এ ছেলের নাম যিশুই রেখে দাও। ঠাকমা নাকি বলেছিলেন, এরকম অলক্ষুণে নাম কেউ রাখে? একশো বছর পরমায়ুওলা কারও নামে নাম রাখো। ভীষ্ম, ব্যাসদেব এসব।
তারপর কী করে ওর নাম অনিকেত হল ও জানে না। ছোটবেলায় কেক কাটার ব্যাপার ছিল না। পায়েস করতেন মা। বড়বেলাতেও কেক কাটার প্রচলন হয়নি। যদি ওদের সন্তান থাকত, তা হলে হয়তো কেক-টেক কাটার ব্যাপার থাকত। অনিকেত একবার মন্টুকে জন্মদিন জিগ্যেস করেছিল। মন্টু বলেছিল, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। কিন্তু ইস্কুলে আছে কত যেন জানুয়ারি। একবার শুক্লা বিশ্বকর্মা পুজোর দিন কেক আনিয়েছিল, মনে পড়ে। বাঙালিরা রথের দিনে পাঁপড় ভাজা খায়, লক্ষ্মী পুজোয় খিচুড়ি, পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠে—হিন্দু বাঙালিদের কথাই হচ্ছে—আর ক্রিসমাসে কেক। কিন্তু ইদের দিনে সেমুই বা বিরিয়ানি টা ঢুকল না। যা হোক ‘কেক’ এখন বাঙালি জীবনে জড়িয়ে গিয়েছে। বাঙালি এখন ‘বেক’ করে। ‘বেকিং মেশিন’ আছে অনেক বাড়িতে। এ বাড়িতেও আছে। শুক্লা ২৫ ডিসেম্বর কেক বানাত। সেই কেক কেটে খাওয়া হত ২৭ ডিসেম্বর। এ বছর ওটা বের করা হল না। কেক কিনেই এনেছিল অনিকেত। আজ কেক কাটার কথা। শুক্লার সামনে প্লেটে রেখেছে। শুক্লা বলল, কাটো। এমনি কেক। সাধারণ। অনিকেতের হাতে ছুরি। ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ বলারও কেউ নেই। হাততালি দেওয়ারও কেউ নেই। শুক্লা এখনও দু’হাত এক করতে পারে না। অনিকেত কেকটার ওপর ছুরি বসাল। এবং অদ্ভুত একটা আর্তনাদের শব্দ কানে এল। ছুরিটার দিকে তাকাল।
কেকটা দু’ভাগ হয়ে পড়ে রইল, কিন্তু কেউ মুখে দিল না। কান্নার শব্দ এখনও আসছে। কান্নার শব্দ পাশের ঘরের টিভি থেকেই আসছিল।
আসলে গতকাল মাঝরাতে ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছে সুমাত্রার কাছে সাগর গভীরে। তীব্র সমুদ্রস্রোত এবং জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছে ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড সিংহলের উপকূলের বিরাট এলাকা। আন্দামানের কী হয়েছে কিছু বলা যাচ্ছে না। তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, ওড়িশার ওপরও আছড়ে পড়েছে জলস্রোত। দিঘাতেও জল উঠেছিল। সুনামি। গোল টেবিলে রাখা নিরীহ কেকটার উপর সুনামির হাওয়া।
শুক্লা বলল, বাঁ হাত দিয়ে আমি তোমায় খাওয়াব না। তুমি নিজেই মুখে দাও।
অনিকেত কেক-এর একটা টুকরো ভেঙে শুক্লার মুখে দিতে গেল। শুক্লা বলল, না, আগে তুমি। অনিকেত নিজের মুখেই দিল। শুক্লার এক হাত নড়ছে। অন্য হাত কাঁপছে। করতালি দিচ্ছে শুক্লা, শব্দ হচ্ছে জলস্রোতের। শুক্লা বলল, হ্যাপি বার্থ ডে। কখনও বলেনি আগে। বলল, অনেক, অনেকদিন বাঁচো। সুন্দর করে বাঁচো, রঙিন হয়ে বাঁচো। তারপর অনিকেতও এক টুকরো শুক্লার মুখে দেয়। শুক্লর গালে ছোট্ট করে চুমু খায়। সমুদ্র আছড়ে পড়ছে তখন। আজ দুপুরের পর থেকেই টিভিতে দেখাচ্ছিল। দুপুরে খোলা হয়নি টিভি। অনিকেত অফিস থেকে একটু আগে আগেই ফিরেছে। অফিসেই খবর পেয়েছিল, সুনামি নামে কিছু একটা হয়েছে।
ঘরে গিয়ে দেখল ঝড়ের তাণ্ডব। দেখছিল, জলের তোড়ে খেলনার মতো ভেসে যাচ্ছে গাড়িগুলো। মানুষ ছুটছে, পিছনে জল, নিষ্ঠুর জল। তোলপাড় জল। জল খেয়ে নিচ্ছে পলায়নপর মানুষগুলোকে। ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড শ্রীলঙ্কা ভারত সব একাকার। বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো কাঁদছে স্বজনহারাদের জন্য। জল কি তোমার কোনও ব্যথা বোঝে?
পৃথিবীর তলায় লুকনো দু’টো প্লেট একটার গায়ে অন্যটা উঠে গিয়েছে। গোপন সংঘর্ষে তৈরি হয়েছে বিরাট ব্যাপক শক্তি, তাতে কেঁপে উঠেছে মেদিনী। ফুলে উঠেছে জল। সেই তীব্র জল আছড়ে পড়েছে দেশে-দেশে। শুক্লা আর অনিকেত নির্বাক তাকিয়ে থাকে। মানুষের কান্না এবং আর্তনাদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। কান্না আছড়ে পড়ছে জন্মদিনের কেক-এ। এ সময় ফোন বেজে ওঠে। অনিকেত দেখে অচেনা নম্বর। ফোন ধরে। অচেনা গলা। বিকাশ চ্যাটার্জি নামে কাউকে চেনেন?
—হ্যাঁ। কেন? কী হয়েছে? অনিকেত ভয় পায়। বিকাশ আবার কোনও নতুন ঝামেলা পাকিয়েছে হয়তো।
ফোনের ওপার থেকে শোনা যায় : আমি শ্যামপুকুর থানার এএসআই বলছি। বিকাশবাবু খুন হয়েছেন।
সাড়ে নয় রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের উৎস ভূস্তরের ষোলো হাজার ফিট তলায় অনুমান করা হচ্ছে।
—খুন?
—খুন? দমকা হাওয়ার মতো অনিকেত চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে শুক্লাও চিৎকার করল, কে খুন? কে?
ওপাশ থেকে পুলিশ-কণ্ঠ—আমরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখি ডেড বডি। স্টিফ। হয়তো গতরাত্রেই খুন হয়ে গিয়েছে। ঘরের আলমারি তছনছ। মোবাইল ফোন নেই। ড্রয়ারে কিছু ভিজিটিং কার্ড পাওয়া গিয়েছিল। সেই কার্ডে আপনার নম্বর ছিল। বিকাশবাবুর সঙ্গে আপনার রিলেশন কী?
অনিকেত বলল, আমার মামাতো ভাই হয়। শুক্লা তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। হাওয়ায় আঁচল। বলল, বিকাশ? বিকাশ ঠাকুরপো? আর মন্টু?
পুলিশ কণ্ঠ—দু’টো ডেড বডি ছিল। বিকাশ এবং অন্য একটি ছেলের। আঠারো-উনিশ বছর বয়েস। আপনি প্লিজ এক্ষুনি চলে আসুন।
—আর কারও কার্ড পাওয়া যায়নি? শুধু আমার?
—ছিল খাবারের হোম ডেলিভারির কার্ড ছিল, ইনকাম ট্যাক্স কনসালট্যান্টের কার্ড ছিল, দিঘার হোটেলের আরও সব ছিল। কেন আপনার আসতে আপত্তি আছে? আপনার রিলেটিভ বলছেন…।
শুক্লা আবার বলে, কী গো, মন্টু?
অনিকেত মৌন।
—মন্টু খুনটা করেনি তো? অ্যাঁ? লোভে পড়ে?
—মন্টুও মরে আছে।
অনিকেত কেঁদে ফেলে, কিন্তু কান্নার তেমন শব্দ হয় না। বিশ্বজোড়া হাজার-হাজার মানুষ নিঃশব্দেই কাঁদে।
এইবার শুক্লা কেঁদে ওঠে প্রকৃত কান্নার শব্দে। বাঁ হাত দিয়ে মাথা চাপড়াচ্ছে। ডান হাতের ভিতর দিয়েও নিশ্চয়ই প্রবহমান সুনামি-তরঙ্গ। টেলিভিশন থেকে বেরিয়ে আসা কান্নাসমষ্টিতে শুক্লার কান্না মিশে যায়। স্পর্ধিত জলের মাঝখানে একটা মসজিদের চূড়া দেখা যাচ্ছে খালি, ওখানে বসে কিছু মানুষ দোয়া চাইছে, চোখে জল। এই সামান্য জল কত দুৰ্বল।
শুক্লা মাথায় চাপড় মেরে বলে, কেন পাঠালাম, কেন পাঠালাম ছেলেটাকে? এখানে থাকলে তো ওকে মরতে হত না। শুক্লা উপুড় হয় বিছানায়। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। অনিকেত টিভি বন্ধ করে দেয়। এখন শুধু শুক্লা থাক এই আহত নির্জনে। জলের তরল আলোয় থাক। অনিকেত হ্যাঙ্গারে ঝোলা জামা গায়ে গলায়। পড়ে আছে জন্মদিনের কেক। অনিকেত বলল, তবে যাই।
বাড়ির কিনারা থেকে কেঁপে ওঠে হাওয়া। দোলে স্মৃতি, দোলে দেশ, দোলে ঠান্ডা ধুনুচির অন্ধকার।
বিছানার ভিতর থেকে দলা পাকানো শব্দ ছুটে আসে, যাই না, আসি বলো।
অনিকেত বলে, হ্যাঁ, আসছি।
.
বিকাশদের ফ্ল্যাটের সামনে পাঁচ-সাতজন লোক। কাজের লোকদের দেখলেই বোঝা যায় ওরা কাজের লোক। জড়ো হওয়া মানুষদের মধ্যে কাজের লোকই বেশি। ভদ্রলোকরা এখন সোফায় বসে আয়েস করছে কেউ, কেউ-বা সুনামির ধ্বংসলীলা দেখতে-দেখতে সন্তানদের লীলাখেলা বোঝাচ্ছে। ভিতরে পুলিশ, একজন ভদ্রলোক, একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা, আর দু’টি মৃতদেহ। বাইরের কাউকে পুলিশ ঢুকতে দিচ্ছে না।
—আপনি অনিকেতবাবু?
—হুঁ।
সোফায় বসা ভদ্রলোকটি বলেন, আপনি এসে গিয়েছেন? এবার সামলান আপনি। আমি এই রেসিডেন্সের সেক্রেটারি। আমাকেই সব করতে হল। বিকাশবাবু আপনার কাজিন ব্রাদার টাইপের কিছু, তাই তো? বিকাশবাবুর চালচলন একদম ভাল লাগছিল না। ওর ছেলেটার ‘মিস হ্যাপ’ হওয়ার পর থেকেই উনি একদম বিগড়ে গেলেন। মায়া হয় লোকটার জন্য। তারপর কোত্থেকে একটা ছেলে জুটিয়েছিল, একটু ইয়ে ধরনের, ভিতরে-ভিতরে হিজড়ে কি না কে জানে? কেন যে ওকে রেখেছিল বুঝলাম না। কোমর দুলিয়ে হাঁটত, একদিন তো আমি ওকে একটা থাবড়াই মেরে দিয়েছিলাম, ন্যাকামি করছিল বলে। ওর কানেকশনেই কেউ এসেছিল কি না কে জানে, তারপর সাবাড় করে দিয়ে গিয়েছে। কোনও প্রুফ রাখতে চায়নি হয়তো….। জ্যান্ত মানুষদের কথাগুলো হচ্ছিল বাইরের ঘরে। ঘরের ভিতরে মৃত মানুষেরা। অনিকেত ওই ঘরে উঁকি দিল। দু’টি দেহই চাদরে ঢাকা। বিছানার চাদর দিয়েই ঢেকে রেখেছে। একটা দেহ খাটের উপর, অন্য দেহটা মেঝের উপর। মেঝেতে রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
পুলিশ অফিসার অনিকেতকে বলল, বসুন।
অনিকেত ডিসেম্বরের শীতেও ফ্যানটা চালিয়ে দিল।
—কী হয়েছিল? অনিকেত প্রশ্নটা হাওয়ায় ভাসাল।
—বলো, কী হয়েছিল? ফ্ল্যাট সেক্রেটারি মেঝেতে বসে থাকা মধ্যবয়স্কাকে হুকুম ছুড়ে দিল।
ও বলল—সকালে এসেছিলাম, যেমন আসি।
—ক’টায়? পুলিশ জিগ্যেস করল।
—সাড়ে সাতটায়।
—তারপর?
মন্টু নামে একটা ছেলে আছে, সে রোজদিন দোর খুলে দেয়। আজ অনেকক্ষণ কলিং টিপলাম। ভিতরে টিরিং শব্দ হচ্ছিল। কিন্তু কেউ দোর খুলল না। ভাবলাম, কোথাও গিয়েছে হয়তো। ওরা বাইরে গেলে লোহার ওই কোলাপ গেটে বাইরে দিয়ে তালা ঝোলানো থাকে, ভিতরে থাকলে ভিতরের আংটায় তালা ঝোলে। বাইরেই তালা ঝোলানো ছিল। ‘ওরা নেই’ ভেবে চলে যাই, সন্ধের সময় আবার আসি। আজও এসেছি। ভিতরে কী হয়েছে কিছু জানি। মা কালীর দিব্বি কিছু জানি না। আমাকে এবার ছেড়ে দিন, বাড়ি যাব।
অনিকেত জিগ্যেস করল, কী করে বোঝা গেল এরকম হয়ে গিয়েছে…।
সেক্রেটারি বলল, মেনটেনেন্স করাচ্ছিলাম। বাইরেটা রং হচ্ছিল। আমি রিটায়ার্ড লোক কিনা, তাই জোর-জোর করে আমাকেই সেক্রেটারি বানিয়ে দিয়েছে। সব হ্যাপা আমাকেই সামলাতে হয়। বাঁশের ভারা বাঁধা আছে, রং মিস্ত্রিরা জানালার আউট সাইড রং করবে বলে জানালাটা খুলেছে, খুলেই চিল্লামিল্লি শুরু করে দিল। তখন বিকেল চারটে-টারটে হবে। ঘরে একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম। আমায় এসে বলল, বাবু, লাশ।
—ও!
—আমি কি আর বাঁশের ভারা বেয়ে উঠতে পারি? কেয়ারটেকারটা দেশে গিয়েছে। ওই মিস্ত্রিরাই বর্ণনা দিল। বীভৎস। দুপুরবেলা কাকে আর পাব? পুলিশে খবর দিলাম। পুলিশ এসে তালা ভাঙল, দরজাও। যারা খুন করতে এসেছিল, ওরা চাবি নিয়ে দরজা লক করে বাইরে তালা মেরে গিয়েছে।
পুলিশ জিগ্যেস করল, কেয়ারটেকার কি কোনও সিকিউরিটি এজেন্সি থেকে নেওয়া?
সেক্রেটারি বলল, এজেন্সি থেকেই নেওয়া ছিল। কিন্তু লোকটা বলল, ওরা টুয়েন্টি পার্সেন্ট কেটে নেয়, ডাইরেক্ট করে দিতে। অনেক দিন ধরে কাছ করছে, লোকটা ভাল, আমরা ভাবলাম ওর পকেট যদি দু’টো পয়সা বেশি আসে, আসুক, তাই ডাইরেক্ট করে নিলাম। এখন ওর সঙ্গে সিকিউরিটি এজেন্সি-র কোনও সম্পর্ক নেই।
পুলিশ বলল, এগুলোই তো মুশকিল করেন। কাকে ধরব এখন? যে ছেলেটা এখানে থাকত, ওর কি ছবি দেওয়া আছে থানায়?
কেউ কিছু বলতে পারল না।
—কেয়ারটেকার কোথায়?
—ওর মা মারা গিয়েছে। দেশে গিয়েছে। তিন দিন হল।
—ও কি এখানে চব্বিশ ঘণ্টাই থাকে?
—হ্যাঁ স্যর। নীচে একটা ওর ঘর আছে। রান্নাবান্না করে খায়। সারা দিন বাইরেই বসে থাকে।
—ঠিক ও যখন দেশে গেল, তারপরই ঘটনাটা ঘটল? পুলিশ অফিসারের কপালে রেখাচিত্র। ওর দেশের বাড়ির ঠিকানাটা বলুন। সেক্রেটারি মাথা চুলকোচ্ছেন। জানেন না? আপনারা এতটাই ক্যালাস? ও আর আসবে না। ওই লোকটাই কাজটা করিয়েছে। ওর নাম কী? বয়স কত?
—হারাধন ঢালি। বয়স পঞ্চান্ন-ছাপান্ন হবে। বর্ধমান জেলার কুড়মুন নামে একটা গাঁ আছে, ওখানেই থাকে। কুড়মুনের গাজনের কথা বলত। গাজনের সময় দু-তিনদিনের জন্য দেশেও যেত। কিন্তু ওকে মিছে সন্দেহ করছেন স্যর। ও খুব নিরীহ লোক।
সন্দেহের বাইরে কেউ নয়। আপনিও নন, আর ওর যে ভাইটা এসেছে সে-ও নয়।
—যে থাকত, ওর হোয়ারঅ্যাবাউট জানা আছে?
অনিকেত বলল, আমি জানি। আমিই ওকে দিয়েছিলাম। ছেলেটার বাপ-মা কেউ ছিল না। ওর কাছেই রেখেছিলাম। ছেলেটা ভালই। ওর নাম মন্টু। ঠিকানা জানি। আমার ঠিকানাই ওর ঠিকানা। ‘ছেলে ছেলে’ তো বলছেন সবাই। আমিও বলছি। কিন্তু দেখবেন? —ওর পরনে কী ছিল?
চাদরের তলা থেকে সরায় পুলিশ অফিসার। ও একটা শাড়ি পরে আছে।
পুলিশ অফিসার বলল, শাড়িটাও উল্টে আমি দেখে নিয়েছি ভিতরে ব্যাটাছেলেদের যা থাকে, ওরও তাই আছে। মাথায় একটা পরচুলা পরানো আছে। মুখের কাপড় সরাব? সহ্য করতে পারবেন? অনিকেত ঘাড়টা সামান্য কাত করে নীরব সম্মতি জানায়।
দেখল একটা কালো কঠিন মুখ। চেনা যায় না। মাথায় কাঁধ ছাড়ানো হাল ফ্যাশনের চুল। সামান্য খয়েরি। শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে যেমন দেখায়, কিন্তু রক্তমাখা। জমাট রক্তে চুলগুলোও দলা পাকিয়ে গেছে। হাঁ করা মুখের ভিতরে একটা পলিথিন ব্যাগ ঠাসা। জিহ্বার মতো ব্যাগের লাল হ্যান্ডেল বেরিয়ে এসেছে। হ্যান্ডেলের গায়ে লেখা ক্রিসমাস হ্যাম্পার।
—এই আমাদের মন্টু।
ওর মুখগহ্বরে একটা শূন্য শপিং ব্যাগ। ব্যস।
—আমার ভাইটাকে একবার দেখাবেন?
কনস্টেবলটি বলে, ওর পরনে কিছু ছিল না। লুঙ্গিটা দূরে, ওইখানে। ওইখানেই আছে। আমরা কিছু সরাই নাই। বরং মুখ দেখেন। ওরও রক্তাক্ত মুখ। মাথার খুলি ফেটে গিয়েছে। বিকাশের মুখের ভিতরে কিছু গোঁজা নেই।
অনিকেত বলল, ছেলেটা যেন চিৎকার না-করতে পারে, তাই ওর মুখের ভিতরে প্লাস্টিক গোঁজা হয়েছিল। তার মানে খুনের সঙ্গে ওর কোনও যোগাযোগ নেই। ও চিৎকার করেছিল। ওসব আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। আমরা আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব। জবাব দিন। বাকিরা একটু চলে যান প্লিজ।
কাজের মেয়েটা ভাবল নিষ্কৃতি পেল। ও পুলিশের পায়ে হাত দিয়ে একটা পেন্নাম করে উঠে দাঁড়াল। পুলিশ অফিসার বলল, যাচ্ছিস কোথায়? বাইরে দাঁড়া, কথা আছে।
আজ সকালের খবর কাগজে ‘আজ আপনার দিনটি’-তে ছিল অপ্রত্যাশিত খবরে জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে। খবর তো হল। এবার জীবনের মোড় ঘোরা। হাজতে পুরে দিলেই মোড় ঘুরে যাবে। পরের লাইনে ছিল দীর্ঘদিনের সমস্যা থেকে মুক্তি। তা হলে জ্যোতিষ-বচন ঠিক। বিকাশ তো সমস্যাই হয়ে উঠেছিল। তা হলে মন্টু? মন্টু, মন্টুরা তো সমস্যাই। তবে এটাই বুঝি মুক্তি? এভাবেই?
পুলিশ অফিসারের মুখোমুখি অনিকেত। তিনি কলম বার করেছেন, নোটবুকও।
—জানতে পারলাম বিকাশবাবুর জীবনে ডিসিপ্লিন বলে কিছু ছিল না। রাইট? ঘরের কোনায় কয়েকটা মদের ফাঁকা বোতলের দিকে ওর চোখ
—হুঁ। ওর ছেলেটার মৃত্যুর পর।
মেয়েছেলের দোষও ছিল। তাই না?
—হুঁ।
—ওসব মেয়েছেলের আপনি কাউকে চিনতেন?
—না।
—ওর প্রাইভেট লাইফ সম্পর্কে কিছু জানতেন?
—না।
—তবে যে মেয়েছেলের দোষের বেলায় ‘হুঁ’ মারলেন…
অনিকেত চুপ করে থাকে। তা হলে তো কত কিছু বলতে হয়। মন্টুর গলার গনোকক্কাস ইনফেকশন… এসব বলতে ইচ্ছে করছে না এখন।
অনিকেত বলল—মনে হয়েছিল ও ওসব করে।
—কী করে মনে হল? কেন মনে হয়?
—এমনিই মনে হয়েছিল। আন্দাজ করেছিলাম।
—ওর স্ত্রী তো ওর সঙ্গে থাকে না। অফিসিয়াল ডিভোর্স হয়েছে?
—না।
—ওর পিএফ তো স্ত্রী পাবে। অন্যান্য টাকাপয়সাও। ওর স্ত্রী খুনটা করিয়ে দিতে পারে?
—ওর স্ত্রী? না, না, পারমিতা এরকম করতে পারে না।
—করতে পারে না? পুলিশের চাকরিতে কত কী দেখলাম! ‘হয় না’ বলে কিছু হয় না। ওর স্ত্রী’র ফোন নম্বর আছে?
মোবাইলটা বার করল অনিকেত। বলল, আছে।
পুলিশ অফিসার বলল, ৯৮৩১৪ দিয়ে?
— হ্যাঁ।
—ওটা নয়। পালটে ফেলেছে। পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার কাছ থেকে জোগাড় করেছিলাম। ওই নম্বরে ফোন করে পেলাম না। নতুন নম্বরটা জোগাড় করুন। ওর শ্বশুরবাড়ি কোথায়?
—নাকতলার দিকে।
—ঠিকানা?
—ঠিক জানি না।
—জোগাড় করুন। খবর দিন। অফিসিয়ালি তো উনি এখনও ওঁর স্বামী। আর এই মার্ডার কেস-এ ওর স্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলা খুব দরকার। এই লোকটার ছেলেটার ডেথ-ও খুব মিস্টিরিয়াস, যা শুনলাম আপনাদের সেক্রেটারির মুখে। মিস্টিরিয়াস। মানে উল্টোপাল্টা মেয়েছেলেকেও এই ফ্ল্যাটে ঢুকতে আপনাদের ফ্ল্যাটের কেউ-কেউ দেখেছে। আপনাদের সেক্রেটারি বিকাশবাবুকে নাকি সাবধানও করেছিলেন। অনিকেত চুপ করে থাকে।
—কাউকে সন্দেহ হয়?
অনিকেত চুপ করে থাকে।
—অন্য ছেলেটার নাম মন্টু?
— হুঁ
—পুরো নাম?
—মন্টু মৃধা
—বাবার নাম?
দু’বার ঢোক গিলে অনিকেত বলল, দুলাল মৃধা। বাইরে কেমন যেন শোঁ-শোঁ শব্দ। সুনামির ঝড় এখানেও এল?
—আপনার বাড়িতে ছেলেটা আগে কাজ করত?
—হুঁ।
—ছেলেটাকে তাড়ালেন কেন?
—তাড়াইনি। বিকাশের স্ত্রী চলে গেল বলে ও কেমন যেন হয়ে গেল, তাই ওকে যেন একটু দেখভাল করে…
—ছেলেটাকেই তো দিয়েছিলেন, তাই তো?
— হুঁ
—ছেলেটা শাড়ি পরে কেন? ঠোটে লিপস্টিক? বিকাশবাবুর পেনিসেও লালচে দাগ লক্ষ করেছি। লিপস্টিকেরই হবে। দেখবেন?
—না-আ-আ। কাতর, বড় আর্ত স্বরে বলে অনিকেত।
—বলুন, তবে বলুন এটা কী করে হয়?
—আমি জানি না, জানি না… কেঁদে ফেলে অনিকেত। সুনামি আসছে।
—কিচ্ছু গোপন করবেন না। কিছু চেপে গেলে আমরা ঠিকই ধরে ফেলব। আচ্ছা, বিকাশবাবু মরে গেলে কার কার লাভ?
—মাথা চুলকে অনিকেত বলল, ওর স্ত্রী’র?
—ঠিক। আর মন্টু মরে গেলে?
অনিকেত বলল, কারও না।
পুলিশ অফিসার বললেন, সমাজের। বলেই হাসলেন। রসিকতা কিনা…
অনিকেত বলল, এই ভাবে ভাবছেন কেন? সিম্পল চুরির কেস হতে পারে তো…।
—কীভাবে ভাবব, সেটা আমরা ভাবব। আপনাকে যা জিগ্যেস করব, তার উত্তর দেবেন।
একটু থেমে পুলিশ অফিসার বলল—যা প্রশ্ন করব, তার বাইরেও যদি কিছু ইনফর্মেশন দেন, সেটাও ‘ওয়েলকাম’ করব। বুঝলেন তো?
মাথা নাড়ে অনিকেত।
—ঘরে কি টাকাপয়সা থাকত খুব বেশি?
—জানি না। খুব বেশি কি রাখবে? মনে হয় না।
—ওর স্ত্রী’র গয়নাগাটিও নিশ্চয়ই ছিল…
—না, বিকাশ বলেছিল গয়নাগাটি নিয়ে গিয়েছে সব।
—তবে কী নিতে চোর আসবে, এবং দু-দু’টো খুন করবে? একটা মোবাইল ফোন আর কয়েকশো টাকা?
অনিকেত মাথা চুলকে বলে, ওর পার্সটা কি পাওয়া গিয়েছে?
—না, ড্রয়ারে নেই, টেবিলেও নেই। থরো সার্চ করা হয়নি। একজন সাক্ষী দরকার। ওর স্ত্রী’কে খবর দিন।
অনিকেত বলল, ওর পার্সে তো ‘এটিএম’ কার্ড থাকে…।
—কিন্তু পাসওয়ার্ড? পুলিশ অফিসার বলে।
—হ্যাঁ, ওটা যদি জেনে গিয়ে থাকে কেউ, চেনাজানা কেউ…
কিছুক্ষণ নীরব থাকে পুলিশ।
এবার বলে, লোকজন ডাকুন। লাশ দু’টো নিয়ে এখন আমাদের অনেক কাজ। থানা, হসপিটাল, মর্গ…। ঘরটা ‘সিল’ করে দিচ্ছি। খারাপ গন্ধ বেরতে শুরু করেছে। নেহাত শীতকাল, নইলে এতক্ষণে টেকা যেত না। টেবিলের ওপর একটা ডিওডোরেন্ট ছিল। জ্যান্ত বিকাশের। পুলিশের কনস্টেব্ল ওটা মরা বিকাশের ওপর স্প্রে করতে থাকল। তারপর মন্টুর গায়ে। ওখানে কম। মরার পরেও জাতিভেদ, স্ট্যাটাস ভেদ থেকে যায়।
বাড়ি ফিরতে রাত হল খুব। বাড়িতেও সুনামি হয়ে গিয়েছে মনে হয়। একটা বালিশের ভিতরের তুলো দেখা যাচ্ছে। মাথার ঘিলুর মতো।
এক হাতে কি বালিশ ছেঁড়া যায়?
দাঁতও ব্যবহার করেছিল শুক্লা?
শুক্লা উদ্ভ্রান্ত। বিধ্বস্ত করেছে নিজেকে।
মাঝখানে ফোন করেছিল। শুধু জিজ্ঞাসা ছিল—সত্যিই মরে গিয়েছে ওরা?
শুক্লার সঙ্গে কথা হল না তেমন। অনিকেত শুধু বলল, এখন মর্গে
শুক্লা খুব আস্তে স্বগতোক্তি করল যেন স্বর্গে যায়, স্বর্গে।
অনিকেত শুয়ে-শুয়ে ভাবে—মন্টু শাড়ি পরল কেন?
ঠিক আছে শাড়ি পরার ইচ্ছে না-হয় হল, হতেই পারে, ঠোঁটে লিপস্টিক না-হয় দিলই, কিন্তু পুলিশ যেটা বলছিল—বিকাশের লিঙ্গগাত্রে লিপস্টিক-চিহ্ন…।
যারা ‘নাগিন’-ছেলেদের মেয়ের পোশাক পরিয়ে এসব করে, তাদের দলে তুইও? ঘেটুপুত্র কমলাকে তুই এত কিছুর পরও ব্যবহার করিস বিকাশ?
.
কমলাকে নিয়ে সিলেট জেলায় লোককথা প্রচলিত আছে। কমলার কথা মনে পড়ে, দেড়শো বছর আগেকার কোনও কমলা।
পূর্ববঙ্গে বর্ষার তিন মাস অনেক জায়গা জলবন্দি থাকে। পয়সাওলা মানুষরা এই সময় বাড়িতে ‘ঘেটুর দল’ রাখে। ঘেটুর দলে বাজনাদার থাকে, গায়ক থাকে, আর থাকে নাচিয়ে। কোনও সুদর্শন বালকই মেয়ের পোশাক পরে নাচে। কৃষ্ণলীলার মধ্যেই অশ্লীলতা ঢোকে। শ্রীরাধিকার স্নান, প্রসাধন, অঙ্গরাগ থেকে অভিসার, কুঞ্জবনে কৃষ্ণের সঙ্গে লীলাখেলা সবই থাকে। বুকে নারকোল মালা বেঁধে ঘেটু-বালকরা বক্ষ দোলায়, পিডোফেলিক ধনাঢ্যরা ওদের ব্যবহার করে, ওই বালকরা যখন চিৎকার করে, বাজনদাররা তখন বন্ধ ঘরের বাইরে বসে বাজনা বাজায়। অনেক বাজনদারই ওদের সুদর্শন বালক পুত্রকে ঘেটু দলের ‘নাচনি’ করে। ওদের একটা ‘ঘেটুনাম’ হয়, সেটা মেয়েদের নামে। যেমন সাজ্জাদ নামে এক বালকের ঘেটুনাম হল কমলা।
ঘেটুদলে হিন্দু-মুসলমান সবাই থাকত। মুসলমান গায়করাও কৃষ্ণলীলা গাইত। তিন মাস পর এই ঘেটুদল কিছু টাকাপয়সা পেত।
যখন কোনও জমিদার বা ব্যবসায়ী ঘরে ঘেটু ঢোকাত, বাড়ির বউ খুব ব্যাজার হত। ঘেটু ছেলেদের মনে করত, সতিন। অথচ জমিদার বউরাই ঘেটু ছেলেদের সাজিয়ে দিত, গায়ে সুগন্ধি দিত, তারপর হাত ধুয়ে নিত, কারণ এরা অপবিত্র।
….দুই পায়ে আলতা দেয়, গাত্রে দেয় ননী
মাথার উপরে দেয় নকল বিনুনি
কাজল রেখায় করে বিলাল আঁখি,
মুখে থুক দিয়া বলে যা রে আবাগি…।
চন্দন-মাখা মুখের ওপর গিন্নিমা-র থুথু হাতের চেটোয় মুছে ঘেটু-বালকরা যেত কর্তার ঘরে।
কমলা উপাখ্যানের শেষে ছিল—জমিদার গিন্নি বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছিল কমলাকে। আর জমিদারের লোক সেই দেহ ফেলে দিয়েছিল হাওরের জলে।
ওগো ও কমলা তুমি পেট ভইরা খাও
ওগো ও কমলা তুমি পায়স বাটি নাও
ওগো ও কমলা খাও দধি চিনি পাতা
পাটিসাপটা পিঠা খাও শুন মোর কথা।
তারপরে পানি খায় কাঁসার ঘটিতে
অঙ্গ হেলিয়া পড়ে না পারে উঠিতে
কমলার লাশ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু একটা হাওরের নাম এখনও কমলা হাওর। হাওর মানে তো সাগর।
আর ওই যে-গানটা, ‘ভাল কইর্যা বাজাও দোতারা সুন্দরী কমলা নাচে’, ওটা ওই কমলাই কিনা…।
কমলারা মরে না। ওদের পুনর্জন্ম হয়। ধনীর ঘরেও হতে পারে, গরিবের ঘরেও।
মন্টু শাড়ি পরেছিল। লিপস্টিক মেখেছিল মরার আগে। ও জানত না ও মরবে, মরতে হবে। কে কতটা ‘গে’, কতটা ‘ট্রান্সভার্স’, কতটা ‘ট্রান্সজেন্ডার’, কতটা ‘বিপরীত সজ্জাকামী’, কতটা ‘লিঙ্গ রূপান্তরকামী’–এর কোনও মাপকাঠি নেই। ও শাড়ি পরেছিল। এবং সেদিন কেউ এসেছিল।
—সে কি ওর সতীন?
কয়েক দিন পর জানা গেল—বিকাশের পাকস্থলীতে অ্যালকোহল পাওয়া গিয়েছে এবং ফেনোবার্বিটল। মন্টুর পাকস্থলীতে অ্যালকোহল ছিল না, ফেনোবার্বিটল-ও ছিল না। এবং মৃত্যুর কারণ হাতুড়ি জাতীয় শক্ত কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত
ফেনোবার্বিটল হল বেশ কড়া ধরনের ঘুমের ওষুধ। তার মানে, প্রথমে বিকাশকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। হয়তো মদের সঙ্গে, নয়তো চায়ের সঙ্গে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ার পর ওকে হাতুড়ি মারা হয় মাথায়। যারা এসেছিল, ওরা হয়তো চেনা মানুষ। মন্টু প্রথমে হয়তো কিছু বোঝেনি। পরে আঁচ করতে পেরেছিল কিছু।
ও যেন চিৎকার না করতে পারে, যেন কোনও কথা না বলতে পারে ওই জন্য ওর মুখে ঠেসে ঢোকানো হয়েছিল পলিথিন ব্যাগ। আরও জানা গেল, যেদিন খুন হল ওরা, ২৬ ডিসেম্বর, সেদিনই রাত সাড়ে দশটায় বিকাশের এটিএম কার্ড ব্যবহার করে চব্বিশ হাজার এবং পরদিন ভোরবেলা আরও চব্বিশ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। ওর পঁচিশ হাজার ‘লিমিট’ ছিল। ২৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে বারোটায় আরও ঊনিশ হাজার টাকা তোলা হয়েছিল। সেভিংস-এ আর মাত্র এক হাজার টাকা পড়ে ছিল। অফিসের লোকজন জানতে পারে ২৮ তারিখ সকালে।
বোঝাই গেল এটিএম কার্ডটার জন্যই এই মৃত্যু।
পাসওয়ার্ড-টা হয়তো কীভাবে জেনে ফেলেছিল।
ছায়াছবির মতো দৃশ্যগুলো দেখতে পায় অনিকেত। মন্টু শাড়ি পরেছে, সেজেছে, বিকাশ ডেকেছে ওকে। তারপর ওইসব করেছে।
কোনও মহুয়া, রীতা, মিতা বা পারুল এসেছে সন্ধেবেলা। ভালবাসায় ভুলিয়েছে। ঘুম পাড়িয়েছে। যে এসেছিল, মন্টু তাকে চেনে। একটু পরই এসেছে আরও দু’জন। যাদের সঙ্গে ছিল হাতুড়ি বা ওরকম কিছু।
পুলিশ কাউকে ধরতে পারেনি। বিকাশের মোবাইল পায়নি, তবে ওর মোবাইল কোম্পানির সার্ভারে বেশ কিছু ফোন নম্বর পেয়েছিল, তার মধ্যে পারুল নামে কেউ একজন ছিল। ওকেই বেশি ফোন করত বিকাশ। টাওয়ার লোকেশনে দেখা যাচ্ছে ২৬ ডিসেম্বর সন্ধেবেলা ওই মোবাইল ‘ব্যারাকপুর’ দেখাচ্ছে।
তার মানে ও তখন ব্যারাকপুরে ছিল।
কিন্তু তার মানে তো এটাও হল, ও আগে-ভাগেই মোবাইলটা ব্যারাকপুরে চালান করে দিয়েছিল।
কেন পুলিশ এত কিছু করতে যাবে? ওরা তো বিখ্যাত কেউ নয়। ওদের হয়ে পুলিশের কাছে দরবার করার কেউ নেই। কত কমলা ভেসে যায়, নিরুদ্দেশ হয়ে যায় যুগ-যুগ ধরে।
গানে থেকে যায় কখনও, লোককথায় থাকে।
বিকাশের ফ্ল্যাটটার নতুন চাবি হয়। সেই চাবি থাকে বিকাশের স্ত্রী পারমিতার কাছে। রক্তটক্ত ধোয়ানো হয়ে গিয়েছে আগেই। বোতল-টোতল কবেই পরিষ্কার। এখন হোয়াইট ওয়াশ হচ্ছে।
শুক্লা একদিন উদাস গলায় বলল—আমাদের তবে কে রইল?
একটু থেমে বলল, মন্টুর জন্য কী আমি দায়ী?
অনিকেত বলে, তুমি কেন দায়ী হবে? নিয়তি। নিয়তি।
শুক্লা বলে, ‘নিয়তি’ শব্দটা তো তোমার মুখের নয়, ওটা আমাকে খুশি করার জন্য বলা। আমি জানি। তখন অনিকেত চুপ।
শুক্লা আবার শ্বাস নেয়। গভীর।
বলে—মঞ্জুর ছেলেটা কেমন আছে—জানো?
কতদিন—কত দিন পর মঞ্জু-নাম উচ্চারিত হল।