হলদে গোলাপ – ১

তুমি নারী নিউটন-ফেল আকর্ষকরণী
তুমি নারী আলফা বিটা গামা গামিনী
তুমি নারী চুমি তব নিশিতি যাপনি
তুমি মম সিগ্ধ প্রতিমা
তুমি স্তনদ্বয়ে মণ্ডিতা
তুমি মম পুষ্প রূপিণী
তুমি আকাশের চন্দ্রের সমা
তুমি মম হৃদয় মহিমা
তুমি রহিমা, তুমি গরিমা
তুমি মম হৃদয়ের ঝিমঝিমা।
কিন্তু তুমি সত্যিই কি নারী?

.

কবি ছদ্মনামে লিখেছেন। সাক্ষর-প্রেমার্থ কবি। ঠিকানা কাব্যনীড়। গ্রাম ও পোঃ ভাতার, জেলা বর্ধমান। চিঠিটা অনিকেতের টেবিলে। ওর টেবিলে অনেক চিঠিই আসে। কারণ অনিকেত আকাশবাণীর স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ের প্রযোজক। শ্রোতারা নানা বিষয় নিয়ে চিঠি লেখেন প্রশ্নোত্তরের আসরও আছে। নানা বিষয়ের প্রশ্ন পাঠান শ্রোতারা।

এই চিঠিটা ডিরেক্টরের নামে এসেছে, কিন্তু যাঁরা বাছাবাছি করে বিভিন্ন বিভাগে পাঠান, তাঁরা সাহিত্য বিভাগে না পাঠিয়ে বিজ্ঞান বিভাগেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণটা বোধহয় প্রথম দু’লাইন। নিউটন এবং আলফা বিটা গামা শব্দগুলো ওখানেই অবস্থান করেছে। কবিতাটা পড়ে মজা পায় অনিকেত। তুমি রহিমা…তুমি গরিমা…। রহিমা ব্যাপারটা কী? তুমি মম হৃদয়ের ঝিমঝিমা। আহা। কিন্তু শেষ লাইনটা অমোঘ। কিন্তু তুমি সত্যিই কি নারী?

তবে কে ওই কবির ‘তুমি’? যাকে একটু সন্দেহ হচ্ছে প্রেমার্থ কবির? কবির সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভাল হত।

এরকম অনেক ‘ভাল হত’ চাপা পড়ে যায় কাজের চাপে। লোকজন নেই। বহু কাজ সামলাতে হয়। লেপ্রসি মিশন রে, রক্তদান শিবির রে, এইড্স এইচ আইভি রে…।

হ্যাঁ, আইভি কেও সামলাতে হয় বইকি। কতদিন বলেছে চলো অনিকেতদা, বাইকে করে তোমাকে পৌঁছে দিই। আইভি বাইক চালায়, আবার বক্সার। মহিলা বক্সিং-এর ন্যাশনাল প্লেয়ার। স্পোর্টস দপ্তরটা আইভি দ্যাখে।

প্রযোজকদের সরকারি ভাষায় বলে প্রোগ্রাম একজিকিউটিভ। সংক্ষেপে পেক্‌স। নিজেরা নিজেদের বলে পেকু। অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা আর পরিকল্পিত অনুষ্ঠানগুলোকে কার্যকরী করাই ওর কাজ। ওকে বিজ্ঞান আর স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো দেখতে হয়।

এখানে টেলিভিশন এসেছিল ১৯৭৫ সালে। ‘৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় টেলিভিশন। প্রথমে ছিল শুধুই সরকারি টেলিভিশন-দূরদর্শন। এখন তো কত শত চ্যানেল। গ্রামেও পৌঁছে গিয়েছে কেব্‌ল। আকাশবাণীর অবস্থা জলসাঘরের বিশ্বন্তরের মতো। ঝুলপড়া ঝাড়বাতি আছে। কিন্তু আলো জ্বলে না। সেই আগেকার মতো শিশুমহল- মহিলামহল-গল্পদাদুর আসর-শুক্রবারের নাটক সবই হয়, কিন্তু সেই জৌলুস নেই। নেই নেই করেও এখনও কিছু শ্রোতা আছেন। অধিকাংশই গ্রামের। শহরের কিছু বয়স্ক মানুষ আছেন, যাঁরা অভ্যাসবশত রেডিও শ্রোতা।

এই আখ্যানের শুরু ১৯৯৫ সালে। তখনও এতগুলো চ্যানেল বাজারে দাপাদাপি শুরু করেনি। টিনএজারদের জন্য ম্যাগাজিন চালু হয়নি—যেখানে ‘ছোটদের বাৎসায়ন’ টাইপের কিশোর উপযোগী সেকস টিপস থাকে। সিনেমা থিয়েটারের সংলাপে খিস্তি চালু হয়নি, ভূমি চন্দ্রবিন্দু-ফসিল আসেনি। আকাশবাণীর তখনও বেশ কিছু নিয়মিত শ্রোতা রয়েছে, যদিও শতকরা ৯৫ ভাগই গ্রাম-গঞ্জের শ্রোতা। পশ্চিমবাংলার অনেক গ্রামেই এখনও বিদ্যুৎ নেই। ‘৯৫ সালে তো আরও ছিল না। যেখানে বিদ্যুৎ গিয়েছে, সেখানেও সবার ঘরে টেলিভিশন নেই। টেলিভিশন থাকলেও কেবল পৌঁছয়নি। ক’জনই বা ডিশ অ্যান্টেনা কিনে নানারকম চ্যানেল আঁকশি দিয়ে ধরতে পারত। ফলত, নেই-নেই করেও শ্রোতা আছে। সম্প্রচারে ঘড়ঘড় শব্দ সত্ত্বেও কিছু মানুষের বিনোদন ও জিজ্ঞাসা নিরসনের উপায় রেডিও।

১৯৯৫ সালের কোনও একদিনে অনিকেতের টেবিলে অনেক চিঠি। ‘প্রেমার্থ কবি’র চিঠিটা ব্যাগে রাখল। অনিকেতের একটা হবি আছে, পাগলের চিঠি জমানো। ওই ফাইলে ঢুকে যাবে এটা। ওই ফাইলে রাজ্যপালের কাছে কিংবা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে লেখা বা সুচিত্রা সেন-কে লেখা চিঠি আছে। কপি টু স্টেশন ডিরেক্টর। সহকর্মীরা সবাই জানে অনিকেতের পাগলা-ফাইল আছে। তাই এ ধরনের চিঠিগুলো শেষ পর্যন্ত অনিকেতের কাছেই যায়। কেউ মুখ্যমন্ত্রীকে লিখছে ওকে চক্রান্ত করে নোবেল প্রাইজটা দেওয়া হচ্ছে না, কেউ লিখছে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার যন্ত্র আবিষ্কার করতে চায়, কেউ লিখছে সুসংবাদ। সুসংবাদ! আমি যদিও পুরুষ, তবুও গর্ভধারণ করিয়াছি। আমার এখন সাত মাস চলিতেছে। চালতার আচার খাইতেছি…।

প্রেমার্থ কবি-র চিঠিটা ব্যাগে পোরার পর বাকি চিঠিগুলো খুলতে থাকে অনিকেত। নানা ধরনের চিঠি। বাতব্যাধি নিয়া একদিন বিস্তারিত আলোচনা প্রচার করুন, পাইখানা কষিয়া গেলে ঢ্যাড়স খাইলে কি উপকার হয়? পেটের গ্যাস কয় প্রকার? কচু খাইলে কি সুগার বৃদ্ধি হয়?—ইত্যাদি নানারকম প্রশ্ন-সংবলিত চিঠি। এর ভিতর একটা চিঠি একটু অনরকম। বানান অবিকৃত রেখে পুরো চিঠিটাই উদ্ধৃত করছি।

মাননীয় মহাশয়, আমি এক গ্রামের ছেলে। দশম শ্রেণির ছাত্র। আপনাদের স্বাস্থ্য জিজ্ঞাসা অনুষ্ঠান শুনি। কত সমস্যার কি সুন্দর উত্তর দিয়া দেন। এখন আমি আমার এক গোপন সমস্যার কথা বলি। রাত্রে প্রায়ই আমার প্যানিসের দ্বার দিয়া শরীরের সারমশলা নির্গত হইয়া যায়। কিছুতেই চেক করিতে পারি না। খারাপ খারাপ স্বপ্নও দেখি। ভয়ে কোনও কোনও দিন রাত্রে ঘুমাই না। কি রূপে উদ্ধার পাইব? আগে হস্তমোচন করিতাম। ওই কু-অভ্যাস ছাড়িয়া দিয়াছি। এখন রাত্রে শুইবার আগে রবারের গার্ডার দিয়া প্যানিস আটকাইয়া রাখি। তা সত্ত্বেও ওই পদার্থ নির্গত হইয়া যায়। রবার দিয়া আটকানোর ফলে ওই অঙ্গ ফুলিয়া যায়, খুব বেথাও হয়। কী মুশকিলে পড়িলাম, আমার পড়াশোনা করিতে ইচ্ছা করে না। আমাকে উদ্ধার করুন।

এই ধরনের আরও চিঠিপত্র আসে। প্রথম দিকে এসব ফেলে দিত অনিকেত, কিছুদিন যাবৎ বিন-এ না-ফেলে অন্য একটা ফাইলে জমিয়ে রাখছে। নানা ধরনের সমস্যা। ছেলেরাই বেশি লিখছে, কিশোর কিংবা সদ্য-যুবার সংখ্যা বেশ ভালই।

অনিকেত কিছুদিন ধরেই ভাবছিল কিশোর-কিশোরীদের নিজস্ব সমস্যা নিয়ে একটা আলাদা ধারাবাহিক করা যায় কি না, যা একান্তই ওদের সমস্যা। যার উত্তর ওরা পায় না। পাড়ার দাদা- দিদিদের কাছ থেকে ভুল উত্তর পায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রশ্নগুলো তুলতেই পারে না। অনিকেত একদিন কেন্দ্র-অধিকর্তাকে প্রস্তাব দেয় কিশোর-কিশোরীদের নিজস্ব সমস্যা নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? কেন্দ্র-অধিকর্তা বললেন—ওদের নিজস্ব সমস্যা মানে? অনিকেত ব্যাখ্যা করে—যেমন ধরুন স্যর, কোনও কিশোর লিখছে, ও মাস্টারবেট করে, ফলে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, অথচ মাস্টারবেট না-করেও পারছে না। এখন ও কী করবে? কেউ লিখছে গোঁফ বেরুচ্ছে বলে লজ্জা করছে। ঠোটের ওপরে চুন লেপে দিচ্ছে যেন গোঁফ না বের হয়। গোঁফ বেরনো মানেই তো বড় হয়ে গেল। বড় হতে ওর ভাল লাগে না। কেউ লিখছে বাসে- ট্রেনে দাঁড়ালেই ওদের পিছনে কোনও বয়স্ক পুরুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। পেছনে চাপ দিচ্ছে। এক ধরনের আনক্যানি ফিলিং হচ্ছে। কোনও কিশোরী মেয়ে লিখছে মেনস্‌ট্রুয়েশনের সময় যে ব্লিডিং হয়, এতে তো শরীরের রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে, তা হলে শরীরের কী কী ক্ষতি হতে পারে…

কেন্দ্র-অধিকর্তা থামিয়ে দেন। ঠিকাছে ঠিকাছে…। এরকম অশ্লীল প্রোগ্রাম রেডিওতে করার কথা কী ভাবে ভাবছেন? তা কি হয় নাকি? এখান থেকে মহালয়া হয়। বীরেন ভদ্র-বাণীকুমার- পঙ্কজ মল্লিক-ভিজি যোগ-লীলা মজুমদাররা এখানে কাজ করে গিয়েছেন। এখান থেকে ‘ডাকঘর’, ‘রক্তকরবী’, ‘পথের দাবী’, ‘আনন্দমঠ’ হয়। এসব অশ্লীল প্রোগ্রাম রেডিওতে হয় না কি?

অনিকেত তো যতটা সম্ভব যৌনতা-বাচক শব্দগুলোকে ইংরেজিতেই বলেছিল। হস্তমৈথুন না বলে মাস্টারবেট, মাসিক না বলে মেনস্‌ট্রুয়েশন এরকম। ব্লাড না বলে রক্ত-ও বলেছে। রক্ত তো নিরীহ শব্দ। যদি পুংলিঙ্গ বলার দরকার হত তা হলে পেনিস বলত। যৌনতাবাচক শব্দগুলোকে বাংলায় বললে ভদ্রলোকের কানে অশ্লীল লাগে, কিন্তু ইংরেজিতে বললে অনেকটাই মেরামত হয়ে যায়। বাঙালি মধ্যবিত্তরা ডাক্তারদের কাছে গিয়ে পেটের ওপরকার সমস্যা হলে বাংলাতেই বলে। যেমন বুক ধড়ফড় করে, চোখ কটকট করে, কান ভোঁ-ভোঁ করে, মাথা ব্যথা করে। আবার হাঁটুর তলাকার সমস্যাগুলোও বাংলায় বলতে দোষ নেই। ঝামেলা হয় পেলভিক রিজিওন-এর শব্দ এবং সমস্যাগুলো বলার সময়। পায়খানা পরিষ্কার হচ্ছে না বলতে গেলে ভদ্রোচিত বাক্য হল বাথরুম ক্লিয়ার হচ্ছে না। এখন হাগু-র বদলে পটি কথাটার আমদানি হয়েছে। ভদ্রলোক অর্শ কিংবা ফিসচুলা রোগীদের বড় সমস্যা। কুঁচকিতে দাদ হলেও মুশকিল। কুঁচকির ইংরেজি জানা থাকে না।

অনিকেত স্টেশন ডিরেক্টরের সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে যায় না। তবু একবার বলে – স্যর, শরীর নিয়ে সবরকম প্রোগ্রামই তো করছি—বেস্ট ফিডিং, কন্ট্রাসেপটিভ, এড্‌স, এসবও তো করছি। অশ্লীল তো কেউ বলছে না….

বস বললেন, আরে উই মাস্ট ডু দোজ প্রোগ্রাম। বিকজ উই আর ইনস্ট্রাকটেড ফ্রম ডেহি। এড্স নিয়ে করা এক জিনিস আর মাস্টারবেশন নিয়ে রেডিওতে টক-দেওয়া অন্য জিনিস। আপনি মাস্টারবেশন সম্পর্কে কী বলবেন? অনিকেত বলল—স্যর, কিন্তু ভুল ধারণা বাজারে আছে, যেমন ৮০ ফোঁটা রক্ত থেকে এক ফোঁটা সিমেন তৈরি হয়। ওসব বেরিয়ে যাওয়া মানে শরীরের সার পদার্থ চলে যাওয়া। এসব তো ভুল ধারণা…।

—তাহলে কি আপনি রেডিওতে বলবেন—ছেলেরা, তোমরা যত খুশি মাস্টারবেট করো, ওতে শরীরের কিচ্ছু ক্ষতি হয় না…।

—না, ঠিক তা নয় স্যর…।

—ঠিকাছে।

বসদের মুখের ‘ঠিক আছে’ মানে কিচ্ছু ঠিক নেই। এই ঠিক আছে-র মানে হল তুমি এবার যেতে পারো। অনিকেত চলে যায়।

ওর কী যায় আসে? প্রোগ্রামটা না-করলেও যা মাইনে পাবে, করলে তো আর বেশি কিছু মাইনেপত্তর পাবে না, উল্টে খাটাখাটনি বাড়বে। ঠিকাছে, যেমন চলছে, চলুক।

স্টেশন ডিরেক্টরের সঙ্গে অনিকেতের ওই যে কথাবার্তার কথা বললাম, তখন স্কুল-টুলে সেক্স এডুকেশন নিয়ে কিছু ভাবার কথা কল্পনাই করা যেত না। এড্‌স রোগটার কথা সবে শোনা যাচ্ছে। সমকামীদের সম্পর্কে কোনওরকম আলোচনাই পত্রপত্রিকায় হত না। এনজিও-দেরও যৌনশিক্ষা-টিক্ষা নিয়ে কোনওরকম কাজ করার কথা মাথাতেই আসত না। কিশোর-কিশোরীদের জন্য আলাদা পত্রপত্রিকা দু-একটা ছিল। যেমন ‘কিশোর ভারতী’। ওই সব পত্রিকায় ছাপা হত অ্যাডভেঞ্চার, মহাপুরুষদের জীবনী, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কাহিনি, যোগব্যায়াম—এইসব। ওই সময় মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া শুরু করে দিয়েছে, কিন্তু মেয়েরা তখনও রাস্তায় টাইট গেঞ্জি আর চামড়া আঁকড়ে ধরা নিম্নাঙ্গের পোশাক পরে কলেজে যেত না। কলেজে সালোয়ার-কামিজই চলত, কখনও জিন্‌স এবং শার্ট। টেলিভিশনে হুইস্পার জাতীয় স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞানপন-টিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে। নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েরাও ঋতুকালীন মা-মাসিদের ন্যাকড়া অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, পয়সা বেশি লাগলেও। ফলে প্যান্টির ব্যবহার এসেছে। ঋতুকালীন অবস্থা ছাড়াও প্যান্টি ব্যবহৃত হতে লাগল। ৭০ বা ৮০-র দশকেও শাড়িপরা মহিলারা প্যান্টি পরতেন না। বাড়িতে বাচ্চা এলে হিজড়েরা চলে আসত। হিজড়েদের ভাবা হত এরা জন্ম থেকেই না-পুরুষ না-মহিলা। ভাবা হত এরা ঈশ্বরের ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট। অনিকেত যে স্টেশন ডিরেক্টরের কাছে ওই প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল, তাঁর বয়েস তখন চুয়ান্ন। রিটায়ার করতে আর ক’বছর বাকি, তা ছাড়া উনি স্বামী স্বরূপানন্দ মহারাজের শিষ্য।

তাঁরও ভাগ্য ভাল, অনিকেতেরও ভাগ্য ভাল, উনি প্রোমোশন পেয়ে দিল্লি চলে গেলেন। একনজ নতুন স্টেশন ডিরেক্টর এলেন। তিনি প্রায় অনিকেতেরই বয়সি। একটা সময় কলকাতায় কাজ করতেন। অনিকেত এখন যা কাজ করে, উনিও তাই করতেন। পাকেচক্রে কিংবা ভাগ্যবলে উনিই স্টেশন ডিরেক্টর। অনিকেতের সঙ্গে কিছুটা ভাবসাবও ছিল। ওঁর নাম সুমিত চক্রবর্তী।

ইতিমধ্যে আরও কিছু চিঠিপত্র জড়ো হয়েছে, এবং ওগুলো ফাইল-বন্দিও করা হয়েছে। এইসব চিঠিপত্র তো ফাইল-বন্দি করার মতো কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয়। সবই ফেলে দেওয়া হয়। শুধু চিঠিপত্র কেন, কত সব অমূল্য নথিপত্রও নষ্ট হয়ে যায় বা নষ্ট করে ফেলা হয়। আকাশবাণী-তে কে না এসেছেন! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্টুডিওতে এসে কোনও দিন অংশগ্রহণ করেননি ঠিকই, ওঁর কবিতা পাঠ কালিম্পং-এ রেকর্ড করা হয়েছিল। কিন্তু নজরুল ইসলাম দীর্ঘকাল আকাশবাণী-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধ সান্যাল, গজেন মিত্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীহাররঞ্জন রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, শিবরাম চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, অম্লান দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, পরিমল গোস্বামী…কে নয়? তাঁরা যা পাঠ করেছিলেন বা যে-বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দিতে হত, তার একটা পাণ্ডুলিপি জমা দিতে হত। সেই মূল পাণ্ডুলিপি প্রোগ্রাম ফাইলে রাখা হত বা এখনও হয়। উদ্দেশ্য হল, যদি কোনও কারণে যান্ত্রিক গন্ডগোলে রেকর্ড করা অনুষ্ঠান ব্যাহত হয়, তখন ঘোষক নিজেই পড়ে দেবেন। কিংবা যদি কোনও বিতর্ক হয়, ওই পাণ্ডুলিপিটাই প্রমাণ হিসেবে থাকে। সম্প্রচারের দিন একটি ফাইল ডিউটি রুমে জমা দেওয়া হয়। ওই ফাইলে থাকে সারাদিনের অনুষ্ঠান সূচি, বিভিন্ন ঘোষণা, নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা, চিঠিপত্রের উত্তর, আবহাওয়ার খবর, আলু-পেঁয়াজ-আনাজের বাজারদর, এবং সেই সঙ্গেই গাঁথা থাকতে পারে অমলেন্দু দে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, বুদ্ধদেব গুহ, সুধীর চক্রবর্তীর পাণ্ডুলিপি। এইভাবেই গাঁথা থাকত জীবনানন্দ দাশের কবিতা, সুনীতিকুমারের প্রবন্ধ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গল্প। সম্প্রচারের পর ওই প্রোগ্রাম ফাইল একটা জায়গায় ডাঁই করে রাখা হয়। মাস তিনেক পরে এগুলো কাজ মিটে যাওয়া বাজে কাগজ হিসেবে নষ্ট করে দেওয়া হয়। আলু-পেঁয়াজের দর আর বিকাশ সিংহের বক্তৃতা একইভাবে ধাপার মাঠে ঢ্যাডস ফলায়। যদি সুকুমার সেন-সুনীতিকুমার-নীহাররঞ্জন রায় হারিয়ে যেতে পারেন, তো খোলাপোতার নিবারণ সর্দার কিংবা হিঙ্গলগঞ্জের আব্দুল সুকুরের চিঠিও থাকার কথা নয়।

কিন্তু বেশ কয়েকটা চিঠি জমিয়ে রেখেছিল অনিকেত। কয়েকটা চিঠি সঙ্গে করে সুমিত চক্রবর্তীর ঘরে গেল স্টেশন ডিরেক্টর হলেও ওঁকে সুমিতদা সম্বোধন করে অনিকেত।

বলল সুমিতদা, একটা প্রোপোজাল নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। প্রোপোজালটা দেব। তার আগে কয়েকটা চিঠি পড়াতে চাই।

প্রথমে নিরীহ চিঠিটা ধরায়।

ছন্দা রাণী মণ্ডলের লেখা একটা পোস্ট কার্ড, গ্রাম রাজধরপুর, পোঃ ভট্টবাটি, জেলা মুর্শিদাবাদ।

মাননীয় মহাশয়, আমার বয়স একুশ বৎসর। মাধ্যমিক পাশ দিয়া আর কিছু করি না, বাড়িতে মায়ের সঙ্গে গৃহস্থালী কাজ করি। আমি বাড়ির বোঝা। কারণ গায়ের রং কালো। কিন্তু আমার মা আমার মতো কালো নয়। বাবাও খুব কালো নয়। কিন্তু আমি খুব কালো। পাত্রপক্ষ আমাকে কিছুতেই পছন্দ করিতেছে না। কেহ বলিয়াছিল কাঁচা দুধ মাখিলে রং ফরসা হয়। গোপনে নিজেদের গরুর দুধ মাখিয়াছি। কিছু লাভ হয় নাই। কি করিলে গায়ের রং ফরসা হইবে দয়া করিয়া জানাইয়া দিবেন। আমার মাঝেমাঝে মনে হয় এ জীবন রাখিব না। ফলিডল খাইয়া মরিব। আমাকে আপনারা মরিতে দিবেন না কি বাঁচাইবার চেষ্টা করিবেন। একটু ফরসা হইবার উপায় জানাইয়া দিন।

স্টেশন ডিরেক্টর সুমিতবাবু বললেন পড়লাম। কী করতে চান?

অনিকেত বলল বলছি, সুমিতদা, আর একটা চিঠি পড়ে নিন, তারপর বলছি।

চিঠিটা একটা ইনল্যান্ডে। প্রেরকের নাম-ঠিকানা ইংরেজিতে লেখা। ডি. কে মাহাতো। ভিলেজ কালাঝোরি, পোস্ট অফিস সোলাঝোরি, জেলা-পুরুলিয়া।

শ্রদ্ধেয় অনিকেতদা, ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে আপনার প্রশ্নোত্তরের অনুষ্ঠানগুলো নিয়মিত শুনে থাকি। খুব ভাল লাগে। ডাক্তারবাবুকে দিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া করাবেন। আমার নাম আর গ্রামের নাম উল্লেখ করবেন না, শুধু বলবেন পুরুলিয়া থেকে ডি. কে। আমি ঠিকই বুঝে নেব। আমি ২৩ বছরে পা দিয়েছি। উচ্চতায় সাড়ে পাঁচ ফুট। আমি বি.এ পাশ। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের পরীক্ষা দিয়াছি। আমার সমস্যার কথা বলি। আমার লিঙ্গ মুণ্ডটি চামড়ায় ঢাকা। যখন উত্থিত হয়, তখনও চামড়ায় আবৃত থাকে। আমার ঠাকুরদাদার লিঙ্গ আমি দেখেছি। শিথিল অবস্থাতেও লিঙ্গর মুখ মুক্ত থাকে। আমার বন্ধু-বান্ধবরাও বলেছে লিঙ্গ মুণ্ড চামড়ায় ঢাকা থাকা পৌরুষের লক্ষণ নয়। যদি এটা বংশানুক্রমিক হয় তবে আমার ঠাকুরদাদার লিঙ্গটি তো চামড়ায় আবৃত নয়। আমার পিতার কেমন ছিল আমি জানি না। কারণ শৈশবেই আমি পিতৃহারা হয়েছি। কি করলে লিঙ্গমুণ্ড পরিপূর্ণ মুক্ত করা যায়? হাত দিয়ে টেনে মুক্ত করার চেষ্টা করলে চামড়ায় ভীষণ টান লাগে এবং যন্ত্রণা হয়। একবার জোর করে টেনে ছিলাম, তখন রক্তপাত হয়েছে। এ নিয়ে আমার খুব চিন্তা হয়। বন্ধুরা বলেছে আমি বিয়ের পর স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে পারব না। তার মানে জীবনের একটি অধ্যায় থেকে আমাকে বঞ্চিত হতে হবে। দু-তিনবার ব্লেড নিয়ে কেটে চামড়া ছাড়াতে গিয়েছি। আমার এক বন্ধু বলেছিল একটু খানি কেটে দিলেই চামড়াটা ছেড়ে দিবে। কিন্তু একটুখানি কাটিলেই যন্ত্রণায় আর পারি নাই। প্রচুর রক্তপাত হতে শুরু করল, তখন চুন আর চিনি দিয়েছি। তারপর আবার প্রবল জ্বালা। রক্ত বন্ধ হলেও এখনও স্থানটি ফুলিয়া আছে প্রস্রাব করিতে গেলে জ্বালা করে। লজ্জায় হাসপাতালে যেতে পারি না। ওখানে প্রকাশ্যে বের করে দেখাতে হবে। এবার আমি কী করব? আমাকে বাঁচান। আমার সমস্যার সমাধান করে দিন। আর একটা কথা বলি। আমার একটি প্রেমিকা আছে। শরীরের নয়, হৃদয়ের। প্রণাম অন্তে ডি. কে।

পুনশ্চ : ডিম খেলে কি বেশি স্বপ্নদোষ হয়? ডিম খাওয়া বন্ধ করে দিলে কি স্বপ্নদোষ বন্ধ হবে?

—আপনি এসব চিঠিপত্র জমিয়ে রেখেছেন? লোকে ভাববে আপনি পারভারটেড। ডেট তো দেখছি ছ’মাস আগেকার।

—আপনিও একথা বলছেন সুমিতদা?

—আর কেউ বলেছে বুঝি?

আমাদের আগের স্টেশন ডিরেক্টরের কাছে প্রোপোজালটা এনেছিলাম, উনি এককথায় খারিজ করে দিয়েছিলেন।

সুমিত চক্রবর্তী বললেন—এটা সামলাতে পারবেন তো? অনিকেত বলল প্রোপোজালটা অ্যাপ্রুভ করে দিন আগে, তারপর দেখি কী করে এগোন যায়। একটা অ্যাডভাইসরি বোর্ডও করে নেওয়া যাবে। সাইকোলজিস্ট, গাইনকলজিস্ট, শিক্ষাবিদ, স্যোসিওলজিস্ট, এঁরা সব থাকবেন…

সুমিত চক্রবর্তী বললেন—ওরা তো কফি খাবে, মিটিং ফি নেবে আর বাকতাল্লা দেবে। যা করার আপনাকেই করতে হবে। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। এই ধরনের একটা ঝামেলাওলা প্রোগ্রাম করার কথা আপনার মাথায় এল কী করে?

অনিকেত বলল—ওই তো, নানা ধরনের চিঠিপত্র, জিজ্ঞাসা…। দেখুন, আমরা কৃষি সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিই, কখন কী সার, পোকা মারার বিষ কীভাবে দেব, মহিলা মহলে বলি শুক্তোয় কী ফোড়ন দেব, চোখের তলার কালি কমাতে গেলে কী করতে হবে—এসব তো বলি। সংগীত শিক্ষার আসরে সুর তাল লয় সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিই, ছাত্রছাত্রীদের ক্যারিয়ার সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিই। মেঘ কেন ডাকে, পিলে কেন চমকায় এসবও তো বলি। শরীর-স্বাস্থ্য বিষয়ে গ্যাস অম্বল বুক ধুকপুকের বাইরে যেতে পারি না?

সুমিত চক্রবর্তী বললেন—যেতে পারি না এমন নয়, কিন্তু, যাইনি কখনও। আমাদের নাটকের সংলাপে শালা শব্দটা ইউজ হয়? আমরা তো কেটে দিই। তেভাগা আন্দোলনের ওপর লেখা একটা নাটকের সংলাপে ছিল এক চাষিকে পুলিশ জিজ্ঞাসা করছে, তোর ছেলে কোথায়? চাষি বলেছিল, হাগতে গিয়েছে। ড্রামা প্রডিউসার ওটা কেটে বাহ্য ত্যাগ করতে গিয়েছে করেছিলেন। কত গান আমরা বাজাতে পারি না। যে সব চিঠির নমুনা দেখালেন, জানি না কী করে ওসব সামলাবেন। কিন্তু এটাও বুঝি আপনি যা বলছেন, ভুল বলছেন না। কিন্তু এটা সরকারি চাকরি কিনা, এখানে আবেগের কোনও জায়গা নেই। আমাদের অফিসের রিটায়ার করা লোকরা একটা ক্লাব করেছে। অবকাশ নাম, ওদের একটা সুভেনিরে পড়ছিলাম একটা ঘটনা। শুনবেন? সময় আছে?

এ যে দেখি উল্টো। অনিকেত কোথায় ওর বসকে বলবে আমি আপনার সময় নষ্ট করছি না তো স্যর?

এসডি বললেন—বেশ ইন্টারেস্টিং একটা লেখা। অজয় দাশগুপ্ত নামে একজন অ্যানাউনসার ছিলেন, তাঁরই লেখা এটা। তখন এক বছরের কন্ট্রাক্ট দেওয়া হত, কন্ট্রাক্ট রিনিউ হত।

একদিন তিনি রবিবারের দুপুরে অনুরোধের আসর চালাচ্ছিলেন। সন্ধ্যা মুখার্জির গানে মোর কোন ইন্দ্ৰধনু চালিয়ে দিয়ে একটু টয়লেটে গেলেন। গানটায় ইন্দ্রধনুর নু-তে গিয়ে একটা অদ্ভুত গলা কাঁপানোর কাজ আছে। রেকর্ডটা ট্রাকব্যাক করছিল একটা মোক্ষম জায়গায়। নু তে গিয়ে। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কত অশ্লীল। পাক্কা এক-দেড় মিনিট ধরে নু তে ট্র্যাকব্যাক করল। ভাবুন কী অশ্লীল। অজয়বাবুর কন্ট্রাক্ট রিনিউ হল না। চাকরিটা গেল। যদি বন্দেমাতরমেও ট্র্যাকব্যাক করত, বারবার তরমতরম হত, তা হলে কিন্তু চাকরি যেত না।

সুতরাং যা করবেন, ভেবে করবেন। আমার চাকরিটা অন্তত বাঁচাবেন।

প্রোপোজালটা রেখে যান।

একটা মিটিং বসেছে।

প্রথমে অনুষ্ঠানটার একটা নাম ঠিক করা হবে। তারপর ঠিক হবে, ধারাবাহিকটা কীভাবে এগোবে। কী কী বিষয় থাকবে। সপ্তাহে, একদিন করে, এক বছর ধরে চলবে। মানে বাহান্নটা পর্ব।

অনিকেত কতগুলো নাম সামনে রাখল।

চৌকাঠ।

সন্ধিকাল।

বয়ঃসন্ধি।

জীবন যেরকম।

সন্ধিক্ষণ।

মনোবিদ দেবলীনা সান্যাল আছেন, ডাক্তার বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় আছেন, গায়নোকলজিস্ট ভারতী বসু মজুমদার আছেন, সমাজতাত্ত্বিক মালা ভদ্র আছেন। একজন সাহিত্যিককেও রাখা হয়েছিল।

সাহিত্যিক বললেন—’গোপন কথাটি রবে না গোপনে’ নামটা কেমন হয়?

মনোবিদ বললেন—আবার রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনছেন কেন? তা ছাড়া এত কাব্যিক নাম দরকার কী? একদম স্ট্রেটকাট নাম রাখুন।

সাহিত্যিক বললেন—তাহলে ওই রবীন্দ্রসংগীতটা দিয়ে প্রতিদিন অনুষ্ঠানটা শুরু করা যেত আর কী!

সমাজতাত্ত্বিক বললেন, চৌকাঠ নামটা মন্দ নয়। একটা ফেজ থেকে একটা নতুন ফেজ-এ যাচ্ছে। স্টেশন ডিরেক্টর বললেন, আমার মনে হয় ‘সন্ধিক্ষণ’ নামটাই থাকুক।

সবাই ঘাড় নাড়ল। স্টেশন ডিরেক্টরের ওপর তো কথা চলে না।

এবার কী কী বিষয় রাখা যায় বলুন আপনারা। মনোবিদ দেবলীনা সান্যাল বললেন— অ্যাডোলেসেন্স সাইকোলজি খুব ইম্পর্ট্যান্ট। সাইকোলজি-র দিকটা তো রাখতেই হবে। এসময় ওরা নিজেদের শিশুও ভাবতে পারে না, আবার অ্যাডাল্টও ভাবতে পারে না। একটা আইডেনটিটি ক্রাইসিস তৈরি হয়। অনেকের বাইপোলার সিনড্রোম তৈরি হয়, হাইপোকনড্রিয়াসিস হয়ে যেতে পারে, অ্যাংজাইটি তো আছেই, কেউ কেউ খুব মেলানকলিক হয়ে যায়। ফাংশনাল মেন্টাল ইলনেস ব্যাপারটাতে জোর দিতে হবে।

ডাক্তার বিষ্ণু মুখার্জি বললেন—শরীর ব্যাপারটাকে তো জানাতে হবে। শুধু মনের কথা বললেই কী হবে? হরমোনের কাজ, কেন গোঁফ ওঠে, কেন স্তন তৈরি হয়, কেন এবং কীভাবে স্পার্ম তৈরি হয়, এসব বলা দরকার তো। রিপ্রোডাকশন সিস্টেম-টাকে জানিয়ে দেওয়া দরকার।

গায়নোকলজিস্ট বললেন—এখন ভীষণ অ্যাবোরশন হচ্ছে। রাস্তায়-রাস্তায় হ্যান্ডবিল সাঁটা- তিন মিনিটেই বিনা কষ্টে গর্ভপাত। গর্ভপাত ব্যাপারটা মোটেই ভাল নয়, এই বয়সেই সেটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। সমাজবিদ বললেন—তা হলে কি কন্ট্রাসেপশনও শেখানো উচিত? আপনি ‘কী বলেন? স্টেশন ডিরেক্টরকে জিজ্ঞাসা করলেন মালা ভদ্র। স্টেশন ডিরেক্টর বললেন—টিনএজারদের কন্ট্রাসেপশন শেখানোর পরিস্থিতি আমাদের দেশে তৈরি হয়নি এখনও। তা হলে তো ফোরপ্লেও শেখাতে হয়…।

অনিকেত এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। অনিকেত বলল, আমি কয়েকটা ঘটনা বলি। একদম সত্যি ঘটনা। একটি ছেলে, বছর ষোলো-সতেরো বয়েস। খুব ভাল ফুটবল খেলে। ওদের গ্রামের জুনিয়র টিম ওকে ছাড়া ভাবাই যায় না। হঠাৎ ও খেলাধুলো বন্ধ করে দিল। মাঠেই যায় না। খেলার সঙ্গীদের দেখলেই এড়িয়ে চলে। ওদের কোচ একদিন ছেলেটার কাছে গেল, দেখল ছেলেটা কীরকম মনমরা। মুষড়ে আছে। জিগ্যেস করল, কী হয়েছে তোর? খেলতে যাস না কেন? ছেলেটা কিছুই বলছিল না। অনেকবার জিগ্যেস করার পর বলল, আমি আর মাঠে যাচ্ছি না, আমি খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছি, আমার দ্বারা আর খেলা হবে না।

কেন খেলা হবে না তোর, তুই তো খুব ভাল খেলিস।

ছেলেটা মাথা নিচু করে আছে।

কোচ বললেন, কিছু কি লুকোতে চাস? আমার কাছে বলে ফ্যাল। নিঃসংকোচে বলে ফ্যাল। ছেলেটা মাথা নিচু করে বলল—আমার খুব স্বপ্নদোষ হয়। আমি খুব দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। কোচ তখন ছেলেটার পিঠে হাত রাখল। ওই কোচই আমাকে ঘটনাটা বলেছে আর কী, সে বোঝাল ফালতু ভয় পাচ্ছিস তুই, জলের ট্যাঙ্কি ওভারফ্লো করে না বুঝি? যে-শুক্রটা তোর তৈরি হচ্ছে, যেখানে তৈরি হয়, সেই অঙ্গটার নাম বলেছিল কোচ, প্রচলিত স্ল্যাং-এ, সেই শুক্রটা একটা থলিতে এক ধরনের তরলের মধ্যে জমা থাকে। ওই তরল পদার্থটা বেশি হয়ে গেলেই ট্যাঙ্কি ওভারফ্লো করে পাইপ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এরকম সবার হয়। আমারও হত, এখনও হয়। এ নিয়ে একদম দুশ্চিন্তা করবি না।

ছেলেটা তারপর থেকে আবার মাঠে আসছে।

সাহিত্যিক বললেন—আরে এটাকে ডায়লগ বসিয়ে নাটক করে নিন না কেন? নাটকের মধ্যে দিয়ে তো খুব ভাল করে বলা যায়।

স্টেশন ডিরেক্টর বললেন, ইট্স আ গুড আইডিয়া। অনিকেত বলল, আর একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ফাল্গুন মাসে হাড়োয়াতে একটা মেলা হয়। গোরাচাঁদের মেলা। গোরাচাঁদ একজন পির ছিলেন। ওখানে বিরাট মেলা বসে ১২ ফাল্গুন। ওখানে একটা জায়গায় খুব ভিড়। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে যাই। একটা লোক মাদুলি বিক্রি করছে। স্বপ্নদোষের মাদুলি। এই ধরনের লোকেরা খুব ভাল-ভাল কথা বলতে পারে। খুব কনভিন্‌সিং কথাবার্তা বলে। ও বলছে স্বপ্নদোষের ফলে কী ভয়ানক বিপদ হয়। জীবন শেষ হয়ে যায়। তিলে-তিলে জীবন শেষ হয়ে যায়। টিবি পর্যন্ত হতে পারে। ছেলেটা একটা জনমজুর। মেলায় এসেছিল একটা জামা কিনবে বলে। ওর জামা কেনা হল না। একান্ন টাকা দিয়ে একটা মাদুলি কিনে নিল। অনেক সো কল্ড বৈদ্যরাজের হ্যান্ডবিল দেখেছি। আপনারাও নিশ্চয়ই দেখেছেন। ওরা লেখে জলে নামলে পেচ্ছাপের বেগ পাওয়াটা নাকি খুব খারাপ। এটা যৌন-রোগের পূর্বাভাস। এটা তো অনেকেরই হয়। ওই সব হ্যান্ডবিলের কথা বিশ্বাস করে বহু লোক মিছিমিছি টাকা খরচ করে। বৈদ্যরাজরা বলে লিঙ্গ বাঁকা একটা খুব খারাপ রোগ। প্রথমে একটুখানি বাঁকা, পরে আরও বেঁকে যাবে…এরকম কত যে ভুল ধারণা আছে, কী বলব…। আর একটা হার্ড রিয়েলিটি হ’ল গ্রামের নব্যসাক্ষর-রা অ-আ-ক-খ-র পর যে রিডিং ম্যাটিরিয়াল পায়, তা হ’ল ভোটের পোস্টার আর এইসব হ্যান্ডবিল সরি, বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি…।

সমাজতাত্ত্বিক মালা ভদ্র বললেন—আরে, সবই তো ছেলেদের প্রবলেম বলছেন। মেয়েদেরও তো কত প্রবলেম, কত ভুল ধারণা। গাইনি ভারতী বসু মজুমদার বললেন— রেডিও গ্রামের মানুষই বেশি শোনে, তাই তো? গ্রামের মেয়েরা মেন্‌সট্রুয়েশনাল হাইজিন নিয়ে একদম অ্যাওয়্যার নয়। টিভি-তে তো এত স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন। গরিব মানুষরা কিনতে পারে? ভাবতেই পারে না, এর জন্য মাসে তিরিশ-চল্লিশ টাকা খরচ করার কথা। ওরা স্রেফ ন্যাকড়া ব্যবহার করে। কিন্তু ন্যাকড়া তো শাড়ি থেকেই আসে। ক’টাই বা শাড়ি? ছেঁড়া শাড়িও তো পরতে হয় যতদিন সম্ভব পরা যায়। সুতরাং ওই ন্যাকড়া রিসাইকেল করতে হয়। রক্তে ভেজা ন্যাকড়া ফেলে দিতে পারে না। ধুয়ে আবার ব্যবহার করে। কিন্তু শুকোবে কোথায়? পুরুষের চোখের আড়ালে শুকোতে হয়। এটা যেন অপরাধ, এটা যেন অন্যায়। এই স্ত্রী-রক্ত অপবিত্র, অশুচি। ঝোপেঝাড়ে ছায়ায় শুকোতে দেয়। ভাল করে শুকোয় না। হয়তো দু’সেট ন্যাকড়া আছে, ভাল করে না শুকোনোর আগেই পরে নেয়। ভেজা অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়। ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়। কত কেস পেতাম, যখন গ্রামের হাসপাতালে কাজ করতাম। সেটা অবশ্য কুড়ি বছর আগেকার কথা, কিন্তু অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি সেটা বুঝলাম যখন মেডিকেল টিম নিয়ে সুন্দরবনে গেলাম কিছুদিন আগে একটা এনজিও-র কাজে। এখনও মাসে দু’বার করে যাই। একইরকম অবস্থা। বলি, খটখটে রোদ্দুরে শুকোতে দাও না কেন? ঘোমটা টেনে, জিভ বের করে ওইসব মেয়ে বলে, এ মা, কী লজ্জা, ব্যাটাছেলেরা দেখে ফেলবে না…মালা ভদ্র বললেন—সত্যিই এসব নিয়ে কখনও মিডিয়া কাজ করেনি। সরকারি প্রচারও কিছু নেই। আর একটা ব্যাপার দেখুন, নিজেদের শরীরের ওপর এই আধুনিক প্রজন্মের কোনও ‘সে’ নেই। সবই মিডিয়া-নিয়ন্ত্রিত। মিডিয়া বলে দিচ্ছে তোমাদের শরীর কেমন হবে। কোনও বিজ্ঞাপন বলছে, অমুক তেল ব্যবহার করো, তাতে তোমাদের ব্রেস্ট বাড়বে। ব্রেস্ট ছোট থাকা খুব খারাপ। নারীই হলে না তুমি। আবার মিডিয়াই বলছে জিরো ফিগারই হল আইডিয়াল। রোগা হও। স্তন ছোট রাখো। ছোটখাটো ফিগারের মেয়েরাই হল সুন্দরী। মেয়েরা ডায়েটিং করছে। কিচ্ছু খাচ্ছে না। দুর্বল হয়ে পড়ছে। খবরকাগজে কিছুদিন আগে একটা খবর বেরিয়েছিল—একটা বস্তাবন্দি কিশোরীর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। তদন্তে যেটা উঠে এল সেটা ভয়ংকর ব্যাপার। ওই মেয়েটার বয়স বছর কুড়ি। মেয়েটার স্তন ছোট ছিল। কোথায় একটা বিজ্ঞাপনে দেখেছিল কী একটা তেল মালিশ করলে স্তন বড় হয়ে যায়। একটা ওষুধের দোকানে গিয়ে ওই তেল কিনতে গিয়েছিল। ওখানকার দোকানদার ওকে বলেছিল, নিজে-নিজে মাসাজ করলে কিছু লাভ নেই, মাসাজের একটা কায়দা আছে। ছেলেটা, যাকে বলে, মেয়েটাকে পটায়। ছেলেটা মাসাজ করার নাম করে নিয়মিত মেয়েটাকে ইউজ করতে থাকে। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে। তারপর একটা কোয়াককে দিয়ে অ্যাবোর্ট করাতে গিয়ে মেয়েটাকে মেরে ফ্যালে। তারপর বডিটা…

.

১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে হরিমতি নামের এক দশ বছরের বালিকা খুন হয়। পরিকল্পনা মাফিক খুন নয়, স্ত্রী-র কাজ করতে গিয়ে মেয়েটি মারা যায়। দশ বছরের বালিকার সঙ্গে স্ত্রী-সংসর্গ করতে গিয়ে তার স্বামীদেবতা মেয়েটিকে বলাৎকার করে মেরে ফেলেছিল। সে সময়ের পত্রপত্রিকায় ধ্বরটা প্রকাশিত হয়েছিল। কিছুটা হইচইও হয়েছিল। জনৈক বিভূতিভূষণ শর্মা বঙ্গবাসী পত্রিকায় চিঠি লিখেছিলেন, এই মৃত্যু দুঃখজনক হইলেও শাস্ত্রীয়। কারণ শাস্ত্রানুযায়ী, প্রত্যেক স্বামীরই কর্তব্য রজোদর্শনের পর গর্ভাধান করা।

হরিমতির স্বামীর সাজা হওয়া তো দূরস্থান, কোনও সামাজিক নিন্দাও হয়নি। হরিমতির বাড়ির লোকরাও এটা একটা দুর্ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিল। এই ক্রান্তীয় অঞ্চলে দশ বছরের বালিকার রজোদর্শন তো হতেই পারে। এবং দশবিধ সংস্কারের মতো গর্ভাধানও গুরুত্বপূর্ণ বটে-ই, আর হরিমতির স্বামীও শুভদিনেই শুভকর্মটি সমাধা করতে গিয়েছিলেন।

তবে ওই ঘটনায় ইংরেজ শাসকরা সহবাস সম্মতি আইন প্রণয়ন করে বিয়ের ন্যূনতম বয়স ধার্য করতে চেয়েছিলেন বারো বছর। সম্রাট আকবরও ১৫৮০ সালে মেয়েদের বিয়ের বয়স চোদ্দো বছর করে দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রবল বিরোধিতায় পিছিয়ে যান। ব্রিটিশ-রাজের প্রস্তাবিত ওই আইনের প্রতিবাদে ১৮৯১ সালে কলকাতায় যে-জনসভাটি হয়েছিল, সেটাই কলকাতায় প্রথম প্রকাশ্য জনসভা। বিদ্যাসাগর মশাই অল্প কিছুদিন আগে দেহ রেখেছেন। ওই প্ৰতিবাদ সভা তিনি দেখেননি। তবে সহবাস সম্মতি আইন প্রণয়নে বিদ্যাসাগরের প্ররোচনা এবং চেষ্টা ছিল। বিদ্যাসাগর আগেই বলেছিলেন সহবাস সম্মতির ন্যূনতম বয়স বারো বছর ধার্য হলেও, স্বামীর অত্যাচার থেকে স্ত্রী-জাতিকে রক্ষা করা যাবে না। এ দেশে কন্যারা কম বয়সেই ঋতুমতী হয়, কিন্তু ঋতুমতী হলেও ওদের অঙ্গ সকল তখনও সুগঠিত হয় না। সন্তান ধারণের উপযোগী হয় না। তিনি আকবরের আইনটিকে আবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এতটা সাহসী হয়নি। মৌলবাদী চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছিল।

কিছুদিন আগে দক্ষিণ এশিয়ার কিশোর-কিশোরীদের সমস্যা নিয়ে দিল্লিতে একটা আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। ওই আলোচনা সভায় কিশোর-কিশোরীদেরও হাজির করা হয়েছিল। সম্মেলনের পর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে ভারতে, প্রতি পাঁচজনে একজন কিশোরী মা হতে বাধ্য হয় ধর্ষিতা হয়ে। অবশ্য, স্বামীর দ্বারা ধর্ষণ ও এর মধ্যে ধরা আছে। ওই নাবালিকারা তখনও ঠিকমতো জানতেই পারেনি—যৌনতা কী বস্তু। শ্রীলঙ্কা ছাড়া অন্যান্য দেশের কিশোর-কিশোরীরা জানিয়েছে, তাদের শরীর ঘিরে যেসব প্রশ্ন জাগে, তার উত্তর তারা শিক্ষক বা অভিভাবকদের কাছ থেকে পায় না। একমাত্র ব্যতিক্রম শ্রীলঙ্কা। ওদেশের স্কুলেই এ-বিষয়ে দরকারি কিছু তথ্য জানিয়ে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি ভারতের ছ’টি মেট্রো শহরের সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, যৌনকর্মীদের আঠাশ শতাংশের বয়েস আঠারোর কম। এবং ১৯৯৩ সালের একটা সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে সাড়ে পঁচিশ লক্ষ বিবাহিতা কিশোরী এবং সোয়া এগারো লক্ষ বিবাহিত কিশোর রয়েছে, যাদের বয়স দশ থেকে চোদ্দোর মধ্যে। পনেরো থেকে উনিশ বছর বয়সের মধ্যে দাম্পত্য শুরু করে দিয়েছে এক কোটি পঁচাত্তর লক্ষ কিশোর-কিশোরী। এরা অনেকেই নিজেদের শরীর জানে না, অঙ্গগুলোর কাজ জানে না, জন্ম-নিয়ন্ত্রণের নিয়ম জানে না।

এরকম কোনও সমীক্ষার খবর আমাদের জানা নেই, যা থেকে আমরা বুঝতে পারব— সারা দেশে কত গর্ভপাত হয়, কতজনকে গর্ভপাত করতে বাধ্য করাতে হয়, তার মধ্যে বিবাহিতা এবং অবিবাহিতার সংখ্যা কত, গর্ভপাতকালীন মৃত্যুর সংখ্যাই বা কত—এগুলো জানার কোনও উপায় নেই।

সম্প্রতি বাঁকুড়ায় একটি ওষুধের দোকানের ভিতরে গর্ভপাতের সময় বর্ণালী গড়াই নামে এক কিশোরীর মৃত্যুর ঘটনা কাগজে বেরিয়েছে। অপর একটি ওষুধের দোকানের হিসেবের গোপন খাতা থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে যে, তিন মাসে পঁচাশিটি গর্ভপাত ঘটানো হয়েছিল—তার মানে ওইসব চোরা কুঠুরিগুলো কোনওদিন খালি থাকেনি।

এরকম চোরাকুঠুরি ছেয়ে যাচ্ছে গ্রামে, মফস্সলে। পাঁচ মিনিটে সাকশান পদ্ধতিতে বন্ধ ঋতু নিয়মিত করা হয়—লাল ত্রিকোণ আঁকা এরকম সব মাতৃমঙ্গল কেন্দ্রের মহা সমারোহ আলুর আড়তের পিছনে, সারের দোকানের পাশে, বকুল গাছের নীচে নকুল দাসের কোয়াক চেম্বারে। এসব জায়গায় যাদের যেতে হচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশই কমবয়সি কন্যা। শরীর এবং প্রজনন-সংক্রান্ত এদের অজ্ঞানতার সুযোগ নেয় একদিকে কিছু শরীর-লোভী পুরুষ, অন্যদিকে ওই গর্ভপাতের ক্লিনিকগুলো। যারা ফিসফিস কোরাসে বলেছিল ও কিছু নয়, ও কিছু নয়। শুধু গর্ভপাত ক্লিনিকগুলোই নয়, প্রচুর ‘বৈদ্যরাজের’ দেখাও পাওয়া যায় হাটে বাজারে, যারা কিশোর বয়সের স্বাভাবিক ঘটনাগুলোর বিকৃত ব্যাখ্যা করে ব্যবসা করে থাকে।

আসলে, ঠিক তথ্যগুলোকে ঠিক ভাবে সরবরাহ করা হয় না বলেই আমরা অনেক অসম্পূর্ণতা নিয়ে বড় হই। পাড়ার ভেঁপো দাদা বা স্কুলের পাকা বাবুদের কাছ থেকে আমরা যে শরীর-শিক্ষা লাভ করি, তা প্রায়শই ভুল। আমরা আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকেই চিনি না। একটি শিশু, সে কোথা থেকে এল; এই স্বাভাবিক প্রশ্নের কত রকমের উত্তর শোনে। হাসপাতাল থেকে কেনা হয়েছে, ভগবান দিয়ে গিয়েছে, পরি এসে রেখে গিয়েছে। এরকম আরও। শিশুরা ঠিকই বোঝে এগুলো মিথ্যে। বাবা-মা-কে মিথ্যেবাদী ভাবতে শেখে। শিশুরাও তো বিশ্বপ্রকৃতি দেখে। মানুষের যেমন বাচ্চা হয়, কুকুর, বেড়াল, গরু, ছাগলেরও বাচ্চা হয় ওদের বাচ্চার জন্য তো ছাগলের মা-কে হাসপাতালে যেতে হয় না, ভগবানও দিয়ে যায় না। এক্ষেত্রে অবশ্য গ্রাম শহরের কিছুটা পার্থক্য আছে। গ্রামের শিশুরা প্রকৃতির কাছাকাছি থাকে বলে প্রকৃতিই তাদের পাঠ দেয়। কিন্তু সুস্থভাবে স্বাস্থ্য শেখানো সম্ভব। যৌন স্বাস্থ্যও তো স্বাস্থ্যের মধ্যেই পড়ে।

ছেলেমেয়েরা জানতে চায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের সেই সেমিনারে মহারাষ্ট্রের একটি মেয়ে বলেছিল—বড়রা তো অনেক কিছুই নিষেধ করে। নিষেধের কারণ বলে না। কারণ বলে না, তাই নিষেধ শুনি না। সবকিছু ঠিক মতো বুঝতে পারলে আমরাই ঠিক করতে পারব কীসে বিপদ, কতটা বিপদ, কেন বিপদ। সাবধান হব। একই রকম কথা শ্রীলঙ্কার নয়নতারা কক্ষপতির। নয়নতারা বলেছিল আমাদের জানতে দাও, নইলে জোর করে জানব। হয়তো ভুল জানব, কিন্তু জানাটাকে ছিনিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। বড়রা আমাদের পথ দেখাও, নইলে নিজেরাই পথ ঠিক করে নেব, হয়তো সেটা ভুল পথ হবে।

আমরা কী করে জানব এবং জানাব তা আমাদের ভাবতে হবে।

হরিমতির মতো ঘটনা আজকাল কমে গেলেও বর্ণালি গড়াই-রা তো ভুগছে। মুশকিল হচ্ছে, এখন বিদ্যাসাগরের মতো কেউ নেই। তা বলে কি অবস্থার পরিবর্তন হবে না?

.

এই যে একটা প্রতিবেদন লেখা হল, তার মধ্যে স্বয়ং এই লেখক কি অনেকটাই যেন প্রকট হয়ে গেল? লেখক নিজস্ব মন্তব্য করে ফেলল। হয়তো অন্যভাবেও বলা যেত। কিন্তু আমাদের অনেক আখ্যানেই দেখা গিয়েছে লেখক স্বয়ং নিজস্ব মন্তব্য করে থাকেন। বঙ্কিমচন্দ্র থেকেই তো আমরা এই ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছি। এই আখ্যানে অনিকেত নামে একটা চরিত্র রাখা হয়েছে। এই লেখক এবং অনিকেত তো এক ব্যক্তি নয়, ওরা দু’জন আলাদা। লেখাটা তো উত্তমপুরুষেও করা যেত, তা হলে তাঁর চোখের আড়ালে কিছু দেখানো যেত না, ফলে অনিকেত থাকতনা। সুতরাং অনিকেতেই ফিরে আসি।

.

ওই মিটিংটার পর অনিকেত ভাবতে থাকে অনুষ্ঠানটাকে কীভাবে আস্তে-আস্তে এগিয়ে নেওয়া যায়। আর একবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার এই ঘটনাটা ১৯৯৫ সালের। তখনও পশ্চিমবাংলার স্কুলে জীবনশৈলী জাতীয় পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ২০০৭ সাল নাগাদ অ্যাডোলেসেন্‌স এডুকেশন জাতীয় একটা পাঠ্যক্রম চালু হয়, কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষক- শিক্ষিকা এটা ভাল ভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। এখন ও-পাঠ উঠেই গিয়েছে। তবে যৌনশিক্ষা নিয়ে লেগে পড়েছে বেশ কিছু এনজিও। টিনএজারদের টার্গেট করে কিছু পত্রিকাও বেরিয়ে গিয়েছে। বাজারে উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে খাচ্ছেও। কিন্তু তখন, ১৯৯৫-এ, অনিকেতের সহকর্মীরা বলছে—কী ব্যাপার, আপনি নাকি ছেলেমেয়েদের পাকাবার জন্য প্রোগ্রাম ফেঁদেছেন? একজন সিনিয়র দাদা বললেন, রেডিওটা এবার সত্যিই উঠে যাবে। একজন সিনিয়র দিদি বললেন, অনিকেতের সন্তান নেই কিনা, তাই অন্যদের বাচ্চাদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই। পাকাচ্ছে।

অনিকেতের নিজের বাচ্চা নেই। ভেবেছিল হবে, অনিকেতের স্ত্রী শুক্লার মনে একটা গভীর দুঃখ আছে। এখন এই বর্তমানে, মুখে-মুখে ফেরা গানটা—’যেটা ছিল না ছিল না সেটা না পাওয়াই থাক/সব পেলে নষ্ট জীবন’ শুক্লা শুনে বলে : ঢং। ওই গানটা ওকে শুশ্রূষা দেয়নি। একটা রবীন্দ্রসংগীত, যেটা খুব একটা শোনা যায় না, সেই গানটা কোথায় শুনেছিল কে জানে—ওটা গুনগুন করত— অনেকদিনের শূন্যতা মোর ভরতে হবে/মৌনবীণার তন্ত্র আমার জাগাও সুধারবে।’

আরও কিছু-কিছু গান করত—’বনে যদি ফুটল কুসুম নেই কেন সেই পাখি’, কিংবা ‘নাই যদি বা এলে তুমি’–এইসব। এসব তো মনখারাপের গান। এগুলো কি ব্যথার মলম? রবীন্দ্রনাথ যত রকমের ব্যাথার মলম তৈরি করেছিলেন?

অনিকেত চেষ্টা করেছে। নিজের পরীক্ষাটাও করিয়েছিল। শুক্লারও। দেখা গেল ফ্যালোপিয়ান টিউবে সিস্ট। টিউমার অপারেশন হল, কিছুদিন পর আবার গজাল। কিছুদিন পরে ওভারির ওপরেও সিস্ট। অপারেশন। এরপর ওভারিতে টিউমার আবার। ডাক্তাররা বললেন, দু’টো ওভারিই ফেলে দিন। কতবার কাটাছেঁড়া করবেন? তা ছাড়া বারবার টিউমার হলে ক্যান্সারের সম্ভাবনাও থেকে যায়।

অগত্যা ছেঁটে ফেলতে হল ওভারি দু’টো। ওভারি চলে যাওয়া মানেই ইস্ট্রোজেনের জোগান কমে যাওয়া, যার ফলে ক্যালসিয়াম মেটাবলিজ্ম-এর ব্যাঘাত, হাড় ক্ষয়ে যাওয়া, হাঁটুব্যথা, খিটখিটে হয়ে যাওয়া…। এরই মধ্যে শুক্লা ‘সেই ভাল সেই ভাল’ গাইলে অনিকেত তার ওপর দিয়ে শ্যামল মিত্রের ‘যাক যা গেছে তা যাক’ গেয়ে ফেলেছিল। শুক্লা তখন তিন- চারটে শব্দ ছুড়ে দিয়েছিল মুখের ভিতর থেকে। ‘নিষ্ঠুর, ভীষণ নিষ্ঠুর তুমি। বাজে।’ সঙ্গে ছলকানো মৃদু থুতু। অনিকেত তখন ‘যাব্বাবা’-টাও বলতে পারল না। মনে-মনে বলল ওটা। ও তো সান্ত্বনাই দিতে চেয়েছিল। শ্যামল মিত্রের গানে কি সান্ত্বনা হয় না? আসলে ওটাও হাইপো- ইস্ট্রোজেনের এফেক্ট। কথায়-কথায় রেগে যাওয়া, খিটমিট করা, এসব তো হবেই।

কিছু-কিছু বাজে ঘটনা ঘটতে থাকল। অনিকেত-এর ভাগ্নির বিয়েতে গিয়েছিল। কোনও একটা মেয়েলি অনুষ্ঠানে পাঁচ এয়ো-র দরকার হয়। অনিকেতের বোন শুক্লাকে ডাকল। তখন অনিকেতের বোনের শাশুড়ি কানে-কানে কিছু বলল ওর বউমাকে। অনিকেতের বোন তখন শুক্লাকে বলল, থাক গো, তোমায় কুলো ধরতে হবে না। শুক্লা থপথপ করে পিছনের দিকের একটা চেয়ারে বসে পড়ল। কিছু মুখে দিল না। শুক্লা অনিকেতকে বলেছিল কেন ওরা আমাকে কুলো ধরতে বারণ করল বলো তো!

—কেন!

—আমি বাঁজা বলে…।

অনিকেত বলেছিল—ছি ছি, এরকম ভাবছ কেন? অসুখের ওপর কি কারও হাত থাকে? কত লোকের তো গলব্লাডার ফেলে দিতে হয়…

–গলব্লাডার ফেলে দিলে বাঁজা হয় না। ওভারি ফেলে দিলে হয়।

—না, তাই বলে ‘বাঁজা’ শব্দটা বলছ কেন?

—তবে কী বলব? সন্তানধারণে অক্ষমা? অন্ধকে অন্ধ বলিও না, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না…তুমি কি সেই থিওরি দিচ্ছ নাকি? একদিন শুক্লা বলল—আচ্ছা, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয়, লিভারও নাকি ট্রান্সপ্লান্ট হয়, ওভারি হয় না?

অনিকেত হাল্কা ইয়ার্কি করার চেষ্টা করে। বলে, তোমার যদি কিডনি খারাপ হয়, সেটা নয় আমি দেব, কিন্তু আমার তো ওভারি নেই, তবে, যেটা আছে সেটা যদি তোমায় দিয়ে দিই, আমি তো বাপ হতে পারব না।

শুক্লা বলেছিল, ধুর, তুমি কেন, কত তো বউ আছে, একটা-দু’টো বাচ্চা হওয়ার পর অপারেশন করে নিয়েছে। ওদের তো ওভারি আছে। দিতে পারে না? টাকা দেব, টাকা দিয়ে কিনে নেব, যেমন ধরো দুলালের মা। ও তো বিধবা। ওর তো আর বাচ্চা হবে না। যদি ওকে টাকা দিয়ে ওর ওভারি নেওয়া যেত… অবশ্য ওর ওটাও তো অ্যাদ্দিনে শুকিয়ে গেছে…।

না গো, সেটা হয় না…। অনিকেত বলেছিল। অন্যের তাজা ওভারিও ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা যায় না। একটা ডিম্বাণু পুরো বংশধারাটা বহন করে কিনা…। অনিকেত শুক্লার মাথায় হাত রেখেছিল।

কতদিন পর ‘গো’ বলেছিল অনিকেত। হ্যাঁগো, ওগো-র কথা হচ্ছে না; ওই যে ‘না গো’ বলেছিল, ওর মধ্যে অসহায়তা আর সহমর্মিতা বোধহয় চন্দন বাটার মত মিশে গিয়েছিল। নইলে শুক্লা অকস্মাৎ অনিকেতের বুকে মাথা রাখবে কেন? উল্টোদিকে আয়না ছিল। অনিকেত দেখছিল শুক্লার গাল বেয়ে জল পড়ছে। দেবী চৌধুরাণীর ওই জায়গাটা মনে পড়ল—ব্রজেশ্বর না বুঝিয়া-সুঝিয়া আ ছি ছি, আ ছি ছি, ধিক ব্রজেশ্বর যেখানে জল গড়াইয়া আসিতেছিল, সেইখানে চুম্বন করিলেন।

শুক্লা কাক-কে খেতে দেয় তিনবেলা। কাকেদের সঙ্গে কথাও বলে। কাকগুলো সবই তো – একরকম দেখতে হয়। শুক্লা বোধহয় কয়েকটা কাক-কে আলাদা করতে পারে। নইলে কেনই বা বলবে—’অ্যাই, তুই বড্ড হ্যাংলা, তুই তো একটু আগে খেয়ে গেলি, তোর দাদাকে পাঠিয়ে দে।’

শুক্লার কাক-প্রীতি দেখে পাখির হাট থেকে খাঁচায় ভরা ময়না কিনে এনেছিল অনিকেত। শুক্লা পাখি দেখেই রেগে গেল। বলল, ছিঃ পাখি দিয়ে ভোলাচ্ছ আমায়!

মনে-মনে আবার যাব্বাবা’ বলে অনিকেত। ওর ভালর জন্যই তো আনতে গিয়েছিল পাখি। এতদিন বিবাহিত জীবনযাপন করার পরও ওর বউকে চিনতে পারল না অনিকেত। ও মিনমিন করে বলেছিল—কাক ভালবাস কিনা, তাই একটা ময়না এনেছিলাম …

খাঁচার পাখি এনেছ আমার জন্য? কীরকম তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল শুক্লা। তারপর খাঁচার দরজাটা খুলে দিল।

ময়নাটা খাঁচা থেকে বের হল। দু’পা এগোল। একবার ডানা ঝাপ্টাল, তারপর আবার গুটিগুটি করে খাঁচার ভিতরে ঢুকে গেল।

দুলালের মা যখন বিধবা হয়, দুলালের বয়স তখন তিন, আর দুলালের মায়ের বয়স উনিশ। দুলালের মায়ের একটা নাম আছে, থাকারই কথা। কারণ ওর একটা রেশন কার্ড আছে। রেশন কার্ডে তো দুলালের মা লেখা থাকে না। দুলালের মায়ের একটা ভোটার কার্ডও আছে। সেখানে নিশ্চয়ই ওর নাম, স্বামীর নাম লেখা আছে। ভোটার কার্ডে চন্দ্রবিন্দু থাকে না।

দুলালের মা অনিকেতদের বাড়িতে কাজ করে কুড়ি বছর ধরে। অনিকেতের বিয়েতে মশলা বেটেছে, মাছ কুটেছে, উলু দিয়েছে। অনিকেতের বাবার সেবা করেছে, অনিকেতের মায়ের পায়ে আলতা পরিয়ে দিয়েছে। আবার ওই পায়েরই ছাপ তুলেছে সাদা কাগজে। অনিকেতকে বলেছে ভাল করে রেকে দাও দাদাবাবু, মায়ের পদচিন্ন।

দুলালের মা একদিন শুক্লাকে বলেছিল অল্প বয়সে বেধবা হয়েছি—তা কী করব, কপালে নেকা ছিল, কিন্তু আমার নারী জম্মো সাথক। পেটে তো ধরিচি, দুলাল তো হয়েছে। দুলালকে তো পেইচি। কিন্তু দুলালের মা এখন দুলালকে দেখাতে পারবে না। কারণ দুলাল নেই। দুলাল নিরুদ্দেশ। আট বছর হয়ে গেল। কেউ বলেছে, দুলালকে দেখলাম সাগর মেলায়, সাধু হয়ে গিয়েছে। কেউ বলল, স্মাগলিং করতে বাংলাদেশে গিয়েছিল, সেখানে ওরা আটকে রেখেছে। দুলাল কাঁচা-আনাজের ব্যবসা করত। চাষিদের কাছ থেকে মাল কিনে হাটে বেচত। দুলালের ‘সাইকিল’ ছিল না। অনিকেতের বাবা দুলালকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছিল।

দুলালের মা কাজে আসার সময় মাঝে-মাঝেই হাতে ধরে লাউটা-মুলোটা নিয়ে আসত। একেবারে শিশিরে-ভেজা ফুলকপিও এনেছে দুলালের মা। ওই কাজটা ভাল লাগত না দুলালের। লস খেত। কাঁচা-আনাজের ব্যবসা ছেড়ে আলতা-সিঁদুর-নেলপালিশ-পাউডার বেচত গাঁয়ে-গাঁয়ে ঘুরে, সাইকেল সাজিয়ে।

এই মুকুন্দপুরে অনিকেতদের বহুদিনের বাস। এই অঞ্চলে মাহিষ্য বারুজীবী ছাড়াও ক্যাওট জাতের লোক ছিল প্রচুর, কিছু সর্দারও ছিল। এধারে নাকি নীল চাষ হত এককালে। নীল চাষের জন্য বাইরে থেকে লোক আমদানি করা হয়েছিল। মুকুন্দপুরের কাছেই একটা গ্রাম আছে, গ্রামটির নাম উইলার হাট। ওটা বোধহয় উইলিয়াম নামে কোন নীলকরের নাম থেকে এসেছে। নীল চাষ কবে শেষ, উইলিয়াম রয়ে গিয়েছে! যখন কাঁকুড়গাছির কাছ দিয়ে বাস যায় কন্ডাক্টর রত্না-রত্না করে চেঁচায়। অনেকে টিকিট কাটার সময় কন্ডাক্টরকে বলে ‘রত্না’। আসলে ওখানে অনেক আগে রত্না কেবিন বলে একটা চায়ের দোকান ছিল। রত্না কেবিন উঠে গিয়েছে কবে, রত্না রয়ে গিয়েছে। মুকুন্দপুরে এখন বিরাট একটা হাসপাতাল। রংবাহারি বাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্ট। এইসব বাড়িগুলোরও বাহারি বাহারি নাম। মোনালিসা, কারুবাসনা, মায়ামৃদঙ্গ, লাপিস লাজুলি…। আশপাশের এলাকাগুলোর নাম শুঁড়া, পুরকুড়িয়া, বকচোরা, হোগলিয়া…। গরুর হাটে একটা শিশুউদ্যান হয়েছে। পোস্টার পড়ে—গরুর হাটের শিশুউদ্যানে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। ওইসব পুরকুড়িয়া, হোগালিয়াতেও এখন ফ্ল্যাটের চাষ। লাউলতায় ছাওয়া পুরনো খড়ের ঘরও দু’-একটা আছে। ছিটকালিকাপুরে বিরাট একটা সরকারি বাড়ি হয়েছে— লোক সংস্কৃতি কেন্দ্র। পোস্টারে, হোর্ডিং-এ ওরা লেখে লোকোগ্রাম। লিখুকগে। লোকমুখে ওটা ছিটকলগেপুর। ওই ছিটকলগেপুরের পাশের রাস্তা দিয়ে আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর জমিটা নিচু হয়ে যায়। বর্ষায় জল জমে। ওখানে ফ্ল্যাটের চাষ শুরু হয়নি। কপি, মূলো, পালংয়ের চাষ হয় শীতে। নাবাল জমি পেরিয়ে একটা গ্রাম। গ্রামটা প্রাচীনই হবে, নইলে ওখানে একটা মাজার রয়েছে কেন? একটা পিরের মাজার। একটা বটগাছের ছায়ায় একা-একা ঝিমোয় একটা মাজার। মাজারের লাল ইটগুলো বেরিয়ে পড়েছে, ইটের ফাঁকে শেকড় বসিয়েছে আর একটা বটগাছ। লাল-লাল ইটের ফাঁকে-ফাঁকে সবুজ-সবুজ শেওলা। শেওলার মধ্যেই তো ইতিহাস। এই পিরের নাম নাকি খাজাই পির। ধূপ-ধুনো পড়ে না, কেউ চাদর দেয় না, কেউ আতর ঢালে না, ফুল দেয় না। অযত্নে পড়ে থাকে পিরের ওই মাজার। বটগাছের ডালে অল্প কিছু ঢিল বাঁধা। মনস্কামনাগুলো বাতাসে দোলে। বছরে একবার কারা সব আসে। ফুল দেয়। ঢিল বাঁধে। চাদরও কেউ-কেউ দেয়, কিন্তু গাঁয়ের কেউ-না-কেউ সেই চাদর তুলে নিয়ে যায়। গ্রামটির নামও পিরের নামে। খাজাইতলা। ওই খাজাইতলা গ্রামেই দুলালের মা থাকে। ওখান থেকে মুকুন্দপুরে আসতে হেঁটে আধ ঘণ্টা মতো লাগে। মাঝখানের নাবাল জমিটার জন্য ঠিকঠাক রাস্তা তৈরি হতে পারেনি। ভ্যানে যেতে গেলে বেশ কিছুটা ঘুরে যেতে হয়। চার কিলোমিটারের মতো দূরত্ব হয়ে যায়। দুলালের মা যখন না-বলে, না-কয়ে কামাই করেছে, খোঁজ নেওয়ার জন্য অনিকেত ওর গাঁয়ে গিয়েছে বার দুয়েক। একবার গিয়ে দেখল জ্বর, আর একবার গিয়ে দেখল দুলালের মা মাথা চাপড়াচ্ছে, কারণ কে নাকি খবর দিয়েছিল লগার মাঠে বাঁওড়ের ধারে একটা ব্যাটা ছেলের বডি পাওয়া গিয়েছে, তার মাথা নেই। হাতে চৌকো মাদুলি। চৌকো মাদুলি শুনেই দুলালের মা অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর বলে দুলালের কাছে নিয়ে চলো। গাঁয়ের লোকরা নিয়ে যায়। লগার মাঠ ওখান থেকে আধঘণ্টার পথ। সঙ্গে দুলালের ছেলেটাকেও নিয়ে যায়। গায়ের লোকেরা দুলালের বউকে বলে, কি গো, সোয়ামীর বডি দেখে চিনতে পারবে তো? বউ চুপ ছিল। দুলালের মা নাকি তখন বলেছিল, চলো, আমাকেই নিয়ে চলো। আমি ঠিক চিনতে পারব। নিজের ছেলেকে চিনতে পারব না?

গাঁয়ের লোকেরা বলল—ও যে দুলাল, তার কোনও ঠিক নেই, খালি চৌকো মাদুলিখানা আছে। দুলালের মা বলেছিল ওকে আমি চিনব নে? খালি কি মাদুলি? ওর সর্বাঙ্গ চিনি। ছোটবেলা থেকে বড় কল্লাম, নিজের ব্যাটাকে দেখে বুঝব না?

দুলালের বউ যায়নি। দুলালের ছেলেটাকেও সঙ্গে নেয়নি, দুলালের মা-ই গিয়েছিল। সেই মুণ্ডহীন দেহটা ওই বাঁওড়ের ধারে ছিল না। থানায় চলে গিয়েছিল। সেদিন আর থানায় যাওয়া হয়নি। পরদিন মর্গে। থানার পুলিশরাই গাড়ি হাঁকিয়ে মর্গে নিয়ে গিয়েছিল দুলালের মা-কে। বডি দেখে দুলালের মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ অপেক্ষা করেছিল জ্ঞান হওয়া পর্যন্ত। চোখে-মুখে জল ছিটিয়েছিল পুলিশ। জ্ঞান হওয়ার পর আবার লাশের কাছে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। দুলালের মা খুব জোরে মাথা নড়ে বলেছিল জানি না, জানি না, জানি না গো। পুলিশ বলেছিল জানি না বললে হবে না। হয় বলো ও তোমার ছেলে, নইলে বলো ও তোমার ছেলে নয়।

দুলালের মা বলেছিল—না, ও আমার ছেলে নয়। অনিকেত যখন গেল, দেখল দুলালের মা মাথা চাপড়াচ্ছে; আর দুলাল, আমার দুলাল রে’ বলে সুর করে কেঁদে চলেছে। শহরের মানুষ সুর করে কাঁদে না। আবেগকে প্রশ্রয় না-দেওয়াটাই শহুরেপনা। অনিকেতকে দেখে ওর কান্না বেড়ে গেল। একটা ছোট ছেলে চুপচাপ বসে আছে দুলালের মায়ের পাশে। ওর চোখে জল নেই। দুলালের মা অনিকেতকে বলল, কী সব্বোনাশ হয়ে গেল দাদাবাবু গো…। আমার দুলালকে কারা মেরে ফেলেছে…।

দুলালের বউ খুন্তি হাতে সামনে এল। খুন্তির মাথায় কিছু লেগে আছে, ওখান থেকে ধোঁয়া উঠছে। দুলালের বউ বলল—তবে যে পুলিশকে বললে ও তোমার ব্যাটা নয়! এখন তবে কাঁদচো কেন?

দুলালের মা কান্না থামিয়ে ওর দিকে কটমট করে তাকাল। সব্বনাশী, ভাতার খাকি, নজ্জা নেই, প্যাজ-রসুন দে ক্যাংড়া রাধচিস… ঢং দেকাচ্চি…

ক্যাংড়া খাব না তো কি খাব? দুধকলা? কোত্থেকে খাব। ক্যাংড়া তো বিলে-বাদাড়ে ধরি।

তুই খা। সাধ করে খা। আমি খাবনে…।

ইশশ্ তুমিও তো বেধা। মাছ-ডিম-প্যাজ-রসুন যখন যা পাও খাও। এখন আবার কী হল? ঢং দেখে বাঁচিনে। ঢং আমার নাকি, ঢং তো তোমার। পুলিশকে বলে এলে ও তোমার ব্যাটা নয়, এখন পা ছড়িয়ে কাঁদচো…।

অনিকেতের দিকে তাকায় দুলালের মা। বলে, আচ্ছা, আপনিই বলুন দাদাবাবু, যদি বলতাম ওটাই আমার দুলাল, তা হলে তো সব শেষ হয়ে যেত। এরপর তো কথাই চলত না আর। এখন যেমন ভাবি দুলু ফিরবে। ঠিক ওর মায়ের কাছে ফিরবে, সেটা তো আর ভাবতে পাত্তুম না। সে আশা তো কবরে দিতুম, তাই জন্য তো বলেছি ও আমার দুলাল নয়কো।

তবে কি ওই দেহটাই দুলাল? দুলালের মা কি সেটাই ভাবছে? অনিকেত এ নিয়ে আর কিছু বলতে পারে না। দুলালের ছেলেটাকে দেখতে থাকে। বাচ্চা ছেলেটার হাতে একবাটি মুড়ি। মুড়িগুলো একটা-একটা করে মাটিতে সাজিয়েছে। একটা ফুল বানিয়েছে, একটা-একটা করে মুড়ি সাজিয়ে লিখেছে-বাবা। হঠাৎ একটা দমকা বাতাস এল, মুড়ির ফুল, আর মুড়ির অক্ষরগুলো এলোমেলো করে দিল।

নিজের বাবাকে কতটুকু দেখেছে ওই বালক? দুলাল যখন হারিয়ে যায় তখন ও দু’বছরের শিশু। দুলালের মা ওর নাতিটাকে সঙ্গে নিয়ে আসত মাঝে-মাঝে! অনিকেতের মা ওই বাচ্চাটাকে বলত, হাত ঘুরোলে নাড়ু দেব, নইলে নাড়ু কোথায় পাব…। বাচ্চাটা হাত ঘোরাত। আর সত্যিকারের নাড়ুই পেয়ে যেত বাচ্চাটা। নাড়ু বানাত অনিকেতের মা। নাড়ু না-থাকলে লাড্ডু, কিংবা অন্য কোনও কিছু। বাচ্চাটা একটু সুখাদ্য পাক, এই আশাটা সঙ্গে নিয়েই বাচ্চাটাকে এত দূর নিয়ে আসা। বাচ্চাটা একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর দুলালের মা ওকে সঙ্গে করে এতটা পণ আনতে পারত না। কিন্তু অনিকেতের মা মাঝে-মাঝেই এটা-ওটা দুলালের মা- কে দিয়ে বলত, তোমার নাতিকে দিও। পুজোয় নাতির জামা কেনার জন্যও টাকা দিত। অনিকেত এবং শুভ্রা দুলালের মা-কে মাসিই ডাকে। ‘মাসি’ শব্দটা বাঙালি মনের অবচেতনে যেভাবে গেঁথে থেকে যেরকম ছবি তৈরি করে, দুলালের মা সেরকমই ছবি। পা ছড়িয়ে গল্প করা, পান চিবুতে-চিবুতে একটু-আধটু ঘোষবাড়ির বউ সম্পর্কে মন্তব্য—”বয়স হলে কী হবে, খুকিপনা যায় না।’ কিংবা টিভি দেখতে-দেখতে কোনও দজ্জাল বউয়ের মন্তব্য শুনে বল — ‘আ মোলো যা’। মাঝে-মাঝে অনিকেতের জামা-কাপড়ও কেচে দিত ওই মাসি, কিন্তু জাঙ্গিয়া কাচতে দিত না। ওর মা-কেও ওটা কাচতে দিত না অনিকেত। ওই ছোট্ট পোশাকটা বড়দের কাছে গোপন রাখতে হয়।—এটাই শিখেছে অনিকেত। কিশোরবেলায় ওর বাবা এসব কিনে দেওয়ার কথা ভাবেনি। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে, তার সঙ্গে ড্রয়ার থেকে মায়ের পয়সা চুরি করে একটা জাঙ্গিয়া কিনেছিল। জাঙ্গিয়ার দোকানের কাউন্টারে—একটা জাঙ্গিয়া দিন বলেই একগাদা খুচরো পয়সা ঢেলে দিয়েছিল বলে দোকানদার একটু যেন অবাক হয়েছিল, তারপর একটু মুচকি হেসে বলেছিল, হুঁ, বুঝেছি। তোমার তো?

মেঝের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়িয়েছিল অনিকেত।

সাইজ জানো না, তাই তো?

আবার মাথা নাড়াল।

কাগজে মুড়ে দিয়েছিল একটা সাদা রং-এর।

ওটাকে প্যান্টের ভাঁজের মধ্যে লুকিয়ে রাখত অনিকেত।

তখন তো হাফ প্যান্ট।

পরপর অনেকদিন পরল। ব্যবহার করলে তো নোংরা হবেই। তারপর কেচে শুকনো কোথায় শুকোবে ও? কী যে সমস!! টেবিলের পিছনে একটা জায়গা আবিষ্কার করেছিল ও। রোদ্দুর ঢোকার কোনও গল্পই নেই ওখানে। ভেজা-ভেজা অন্তর্বাসটাই আবার পরতে হত। এভাবে পরতে-পরতে উরুসন্ধিতে চুলকানি। তারপর বন্ধুদের পরামর্শে ঢোল কোম্পানির মলম। কী জ্বালাপোড়া! এভাবে এক-দেড় বছর। তারপর হঠাৎ বিপ্লবমনস্ক হয়ে যাওয়া। বেশ করেছি তারে মেলেছি, মেলবই তো। এরকম মানসিক বল সঞ্চয় করে প্রকাশ্যে রোদ্দুরে জাঙ্গিয়া মেলে দেওয়া। শুকিয়ে গেলে মা ঘরে তুলে আনতেন। মা কখনও ওটাকে জাঙ্গিয়া বলতেন না, বলতেন শর্টপ্যান্ট।

সে যাক। যা গেছে তা যাক। এ জন্যই তো এইসব প্রোগ্রাম করা। ‘সন্ধিক্ষণ’।

কথা হচ্ছিল দুলালের মা নিয়ে।

দুলালের মা একদিন এসে জানাল দুলাল ঘরে ফেরেনি।

অনিকেতের মা বলেছিল, ঠিকই ফিরবে। দ্যাখো গে কোথায় যাত্রাটাত্রা করতে গিয়েছে।

দুলাল যাত্রা করত, সেটা অনিকেতের মা জানত। আর এটাও জানত, দুলাল মেয়েদের রোল করতে পটু। ব্যবসায়ী সমিতি প্রতিবছর অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন করে, ওখানে যাত্ৰাও হয়। ওরা নিজেরাই যাত্রা করে। দুলাল নাকি যশোদা করেছিল। একবার শচীমাতা-ও করেছিল। অনিকেতের মা একবার দেখতে গিয়েছিল। খুব সুখ্যাতি করেছিল দুলালের। দুলালের মা বলেছিল ছেলের খুব বিষ্ণুপ্রিয়া করার ইচ্ছে ছিল, শচীমাতা দিয়েছে বলে খুব মনখারাপ

দুলাল ফিরল না। দুলালের মা বলল – আমার দুলাল আমাকেই শচীমাতা করে দিয়ে কোথায় চলে গেল! অনিকেতের মা বলেছিল বউ-বাচ্চা ফেলে কোথায় যাবে ও, পাখির মতো ঠিকই বাসায় ফিরবে। দেখোগে শিবের মাথায় জল ঢালতে গিয়েছে। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছে?

ও ঝগড়া কী করবে? ও তো মিনমিনে। মুখ তো করে ওর বউ। বউয়ের বড্ড চোপা।

তবে দেখো, ঠিকই ফিরবে।

কিন্তু দুলাল আর ফিরল না।

দুলালের মা আশায় আশায় পথ চেয়ে থাকত, প্রতিদিনই সকালে উঠে ভাবত আজ দুলাল এসে বলবে, ফিরে এলাম গো মা…।

আস্তে-আস্তে নিত্যদিনের কলমি শাকে, কুড়নো কাঁকড়ায়, হাঁটুর ব্যথায়, দুলালের শোক ফিকে হয়ে গেল। এরকমই হয়।

দুলাল হারিয়ে যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই দুলালের মা একদিন জানাল বউটা ভেগেছে।

বউ চলে গিয়েছে? বলো কী? বাচ্চাটা?

পাষাণী মাগি। তিন বছরের বাচ্চাটাকে ফেলে ভেগে গেল গা।

কোথায় গেল।

কে জানে কোন ব্যাটাছেলের সঙ্গে গেল, স্বভাব-চরিত্তির তো ভাল ছিল না, অনেকের সঙ্গেই ঢলানি ছিল। দুলাল থাকতেই ওসব করত। দুলাল আমার ওসব নিয়ে কিচ্ছুটি কইত না। আমিই বরং একটু-আধটু কইতাম। নাতিটার জন্য কষ্ট হচ্ছে গো দিদি। কেবল মা-মা করছে। শুক্লা তখন ‘আহা রে’ শব্দটা উচ্চারণ করে ফেলেছিল। ওই ‘আহা রে’ শব্দটার মধ্যে এমন কী ছিল কে জানে, দুলালের মা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, এবং বাসন মাজা আঁশটে কাপড়েই শুক্লাকে জড়িয়ে ধরল। শুক্লা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল না। এটা একটু আশ্চর্যই বটে। কারণ শুক্লার একটু পয়-পরিষ্কার বাতিক আছে। অনিকেতের মায়ের চেয়েও বেশি। বাইরে থেকে ঘরে এলে বাথরুমে গিয়ে হাত-পা-টা ধুতেই হয়। জামায় চড়াই পাখি পটি করলেও পুরো জামাটা ধুয়ে দেবে। আঁকড়ে ধরা দুলালের মা-কে ছাড়াল না শুক্লা। শুক্লার চোখেও জল দেখতে পেল অনিকেত।

মানুষের শরীর থেকে কত কিছু সিক্রেয়েশন হয়। বাইরে, ভিতরে। আমাদের রাগ, অনুরাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, আক্রোশ, ক্রোধ সব কিছুর জন্যই দায়ী রক্তের ভিতরে গোপনে মিশতে থাকা অন্তঃস্রাবী তরল। অ্যাড্রিনালিন, এন্ড্রোজেন, ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন, থাইরকসিন কত কী। ওগুলো আমরা দেখতে পাই না। দেখতে পাই বহিঃস্রাব। মল, মূত্র, সর্দি, বীর্য, চোখের জল। এই চোখের জলের অপর নাম অশ্রু। আহা অশ্রু। এই অশ্রুধারার বড় মাহাত্ম্য। মানুষকে শুদ্ধ করে। অশ্রুবিন্দু-সমৃদ্ধ শুক্লার গণ্ডদেশটিকে প্রভূত মমতায় অবলোকন করছিল অনিকেত। চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল। শুক্লা একটু পরেই দুলালের মায়ের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল; কিন্তু গালের দু’পাশে অশ্রুবিন্দু লেগে ছিল।

শুক্লার ঘোমটা-টোমটা নেই। প্রফুল্ল-র মুখে ঘোমটা ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের দেবীচৌধুরানী উপন্যাসের প্রফুল্ল-র কথাই বলছি। সেকালের মেয়েরা একালের মতো নহে। ধিক একাল। তা সে ঘোমটাটুকু প্রফুল্লকে ধরিয়া বসাইবার সময় খুলিয়া গেল। ব্রজেশ্বর দেখিল প্রফুল্ল কাঁদিতেছে।

ব্রজেশ্বর না বুঝিয়া—আ ছি ছি। বাইশ বয়সই ধিক। ব্রজেশ্বর না-ভাবিয়া না-চিন্তিয়া যেখানে বড় ডবডবে চোখের নীচে দিয়া এক ফোঁটা জল গড়াইয়া আসিতেছিল—সেই স্থানে আ ছি ছি ব্রজেশ্বর হঠাৎ চুম্বন করিলেন।

অনিকেত শুক্লাকে বলেছিল, এসো। ঘরে এসো। একালের ছেলেরা সেকালের মতো নহে মায়ের সামনেই শুক্লার পিঠে হাত দিয়ে ঘরে নিয়ে গেল অনিকেত। ধিক একাল! ঘরে গিয়ে অনিকেত ব্রজেশ্বর হয়ে গেল।

শুক্লার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে অনিকেত বলল, দত্তক নেবে, দত্তক?

শুক্লা মাথা নাড়াল।

না, দুলালের ওই ছেলেটার কথা বলছি না, অন্য কোথাও থেকে, মাদার টেরিজা-র…

শুক্লা বলল, না, দেরি হয়ে গিয়েছে…। অনিকেত বলল, কীই বা এমন বয়স হয়েছে, আমরা এখনও অনেকদিন বাঁচব।’

শুক্লা তবুও মাথা নাড়ল নিষেধের। ওদিকে পাশের বারান্দায় দুলালের মা ঘ্যানোর ঘ্যানোর করেই চলেছে—সারাদিন বাইরে থাকি, বাচ্চাটাকে দেখার কেউ নেই গো। কী করে পারলি তুই? নিজের বাচ্চা, কত মায়ের একটা বাচ্চা নেই, একটা বাচ্চার জন্য হা-পিত্যেশ করে মরছে, মাদুলি বাঁধছে, হত্যে দিচ্ছে, অথচ তুই তোর পেটে-ধরা বাচ্চাটাকে এমনি করলি, বাচ্চাটাকে তো তুই নিজে পেটে ধরেছিলি, অন্য কেউ তো তোর ঘরে বাচ্চাটাকে গুঁজে দিয়ে যায়নি….

অনিকেত বেশ বুঝতে পারছিল বাচ্চাটাকে এখানেই গুঁজে দিতে চায় দুলালের মা। অনিকেতের এতে খুব একটা সায় নেই। দুলালের তো বাচ্চা, এদের আইকিউ কত আর ভাল হবে? যতই ভাল মাস্টার রেখে পড়াও না কেন, যতই নিউট্রিশন দাও না কেন, আইকিউ-টাই হচ্ছে আসল। দুলালকে তো দেখেছে অনিকেত, কেমন ম্যাদামারা চেহারা, পুতুপুতু ভাব পাউডার পমেটম বেচে, বরং টমেটম বেচলেও একটু কথা ছিল। স্মার্ট হত। ওরই তো জিন। ওকে মানুষ করা নিয়ে প্রবলেম আছে। এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে, মাদার টেরিজা কিংবা অন্য কোনও ডিগনিটিওলা সংস্থা নিলেই যে আইকিউ ভাল হবে তার কোনও মানে আছে?

না। কোনও মানে নেই, ভ্যান হুসেন বা অ্যাডিডাস থেকে পোশাক কিনলে ঠকার ভয় নেই—মধ্যবিত্তরা এরকমই ভাবে, কিন্তু শিশু দেখে তো বোঝার কোনও উপায় নেই, কারণ সব শিশুই সুন্দর। শিশুরা মাতৃক্রোড়ে না-থেকেও সুন্দর। ওইসব কুচুমুচু শিশুদের পেডিগ্রি জানার কোনও ব্যবস্থা নেই, সুতরাং কিছুটা ভাগ্যর ওপরই ছেড়ে দিতে হয়। লটারির মতো কিন্তু এখানে তো পেডিগ্রি-টা জানা হয়েই গিয়েছে। দুলালের বাচ্চা। কী করে ভাল হবে?

ওইসব হোম-টোম থেকেও দিব্যি ব্রিলিয়ান্ট বাচ্চা পাওয়া যায়। অনিকেতের মামাতো ভাই বিকাশ তো পেয়েছিল। বাচ্চাটাকে নিয়ে বড় গর্ব বিকাশের।

বিকাশ অনিকেতেরই বয়সি। বন্ধুরই মতো। ও এজি বেঙ্গলে কাজ করে, অনিকেতের অফিসের কাছেই ওর অফিস। ওর সঙ্গে মাঝে-মধ্যেই দেখা হয়, গল্পগাছা হয়, একসঙ্গে দোসা- টোসা খাওয়া হয়।

ও ওর দত্তক-পুত্র সম্পর্কে খুব গর্বিত ছিল। বাচ্চাটার বুদ্ধির প্রশংসা করত খুব। বাচ্চাটার নাম রাখা নিয়ে খুব সমস্যায় পড়েছিল। ওর নাম রাখতে চেয়েছিল আইনস্টাইন। বিকাশের মা- বাবা এবং বিকাশের স্ত্রীও খুব আপত্তি করেছিল। বলেছিল বাঙালির ছেলের এরকম নাম হয় না কি? ওকে ডাকতে খুব অসুবিধে হবে। বিকাশ বলেছিল—হওয়ালেই হয়। বাংলাদেশের তো একজন বিখ্যাত কবির নাম স্ট্যালিন। বাঙালিদের ঘরের প্রচুর মেয়ের নাম আছে ম্যাডোনা, মিনার্ভা, মোনালিসা। আইনস্টাইন হলে ক্ষতি কী? বিকাশের বাবা একটু পঞ্জিকাপ্রেমী। শুভদিন দেখে দত্তকের কাগজপত্র তৈরি করিয়েছিলেন। যেহেতু বাচ্চাটা ছিল কুড়িয়ে পাওয়া, জন্মদিন সঠিক জানা সম্ভব নয়, দত্তক রেজিস্ট্রির দিনটাই জন্মদিন ভেবে জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী ওর নামের আদ্যাক্ষর হওয়া উচিত ছিল ‘স’ কিংবা ‘ন’ দিয়ে। বিকাশের বাবা বলেছিলেন সায়েন্টিস্টের নামেই যদি নাম রাখবে, তা হলে সত্যেন রাখো। আমাদের সত্যেন বোস কম কী? বিকাশের বালিগঞ্জী স্ত্রী-র আপত্তি ছিল। সত্যেন বসু বড় বিজ্ঞানী হতে পারেন, কিন্তু নামটা বড় ‘কমন’ নাম। এই নাম রাখা নিয়ে বড় চিন্তায় পড়েছিল বিকাশ। অনিকেতের সঙ্গে প্রায়ই আলোচনা করত। বাবার পঞ্জিকা-মনস্কতা, নিজের বিজ্ঞান-মনস্কতা, স্ত্রী-র বালিগঞ্জী-মনস্কতার সমন্বয়-সাধন নিয়ে বড্ড ঝামেলায় পড়েছিল। ‘র’ হলেও একটা সমাধান ছিল। রামন রাখতে পারত হয়তো, বেঙ্কটরামনের নামে। কিন্তু রামন-টা দ্রুত রমণ হয়ে যেত। বিশেষত ইংরিজি বানানে। রমণ মানেটা তো সুবিধের নয়, যদিও রাধারমণ বাঙালি দিব্যি মেনে নিয়েছে। তখন কথায়-কথায় ইন্টারনেট সার্চ করার চল ছিল না। জেনারেল নলেজ বইতে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকদের নাম দেখতে-দেখতে নীল্স বোর নামটা পছন্দ হল। যিনি প্রোটন-নিউট্রন-কে ঘিরে ইলেকট্রন কীভাবে ঘোরে সেটা আবিষ্কার করেছিলেন। ‘বোর’ অংশটা বাদ গেল। নীল নাম রাখা হল। আদ্যাক্ষর দন্ত্য ন। সবার সাধ মিটল। বিকাশ এরপর প্রায়ই নীলের বিভিন্ন কীর্তি, বুদ্ধি, অনুসন্ধিৎসা ইত্যাদি টীকা-টিপ্পনী, ব্যাখ্যা, সরলার্থ, ভাবসম্প্রসারণ-সহ বর্ণনা করত। যেমন : বুঝলি, নীল এমন সাহসী যে বোম-পটকার শব্দতেও চমকায় না। কালীপুজোর সময় এত আওয়াজ, চমকাল না একদম। অন্যান্য বাচ্চা তো চমকে যায়। আসলে বুঝলি, ওকে কালীপুজোর আগেই ট্রেন করেছি। ওর কাছে কাগজের ঠোঙা ফাটিয়ে ওকে ইমিউন করে দিয়েছি। এবং ও এত ইন্টেলিজেন্ট যে, সহজে ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছে।

নীল আর একটু বড় হলে বিকাশ বলল—বুঝলি, নীলের গায়ে মশা বসেছিল, ও চাপড়ে মশাটা মেরে দিল। ওর হাতে রক্ত লেগে গেল। নীলের ইন্টেলিজেন্ট লেভেলটা বোঝ, আমাকে জিজ্ঞাসা করল—বাবা, এটা কি আমার রক্ত? আমি বললাম হ্যাঁ নীল, তোমার রক্ত। মশার পেটে ছিল। নীল তখন জিগ্যেস করল—তা হলে মশার রক্ত কোথায় গেল?

আর একটু বড় হল যখন, বিকাশ বলল, কী জবাব দিই বলত? নীল জিগ্যেস করছে বাবা, তোমার গায়ের গন্ধ কেন আমার ভাল লাগে না, কিন্তু মায়ের গন্ধটা কী যে ভাল লাগে…। এসব অনেক পুরনো কথা, কিন্তু হারানো নয়। মায়ের গন্ধ-র জন্য বুকের ভিতরটা রিনরিন করে উঠল অনিকেতের। রান্নাঘরের গন্ধ, ঠাকুরঘরের গন্ধ, নারকোল তেলের গন্ধ মিলেমিশে— মায়ের গন্ধ। আর ফিরে পাবে না।

‘সন্ধিক্ষণ’ অনুষ্ঠানটা শুরু হয়ে গেল কলকাতা বেতারে। প্রথম কয়েকটা পর্ব প্রচারিত হল। যা ভয় পেয়েছিল, তেমন কিছু হল না। গালাগাল দেওয়া কোনও চিঠিপত্র পেল না এখনও। অবশ্য প্রথম দিকে তো অনেকটাই নিরামিষ ব্যাপার ছিল। বিবর্তন, কোষ, ক্রোমোজোম… প্ৰজনন থেকেই ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিল। অনিকেত গোটা ধারাবাহিকটা এই ভাবে সাজিয়েছিল—

জীব জগতের বিবর্তন।

কোষ, ক্রোমোজোম, জিন ইত্যাদি।

প্রজনন প্রক্রিয়ার বিবর্তন। মানে এককোষী জীবের প্রজনন থেকে বহুকোষী জীবের প্রজননের ধারাবাহিকতা।

মানব দেহ ও প্রজনন অঙ্গ।

ডিম্বাণু, শুক্র, বীর্য, ঋতু ইত্যাদি।

স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক যৌনতা।

যৌনতা সম্পর্কিত কুসংস্কার।

গর্ভপাত ও এর কুফল যৌন স্বাস্থ্যবিধি।

শুধু কথায় নয়, মাঝে-মাঝে ছোট-ছোট নাটক রাখা হবে, এরকম পরিকল্পনা ছিল।

ওই যে ফুটবল খেলোয়াড় কিশোরটি, যে স্বপ্নদোষের কারণে খেলা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, কিংবা সেই কিশোরীটি, যে বিজ্ঞাপনের মোহে দোকানে গিয়ে নারীসুষমার মালিশ কিনতে গিয়ে ধর্ষিতা হয়েছিল, ওই সব গল্প তো নাটকীয়। ওখানে নাটকের প্রয়োগ করাই যায়। সেই ছেলেগুলোর কথা কি এই ধারাবাহিকের আওতায় আসবে, যারা মেয়েদের মতো সাজুগুজু করতে ভালবাসে? ওসব পরে ভাবা যাবে’খন। প্রতিটি পর্বের পর চিঠিপত্র আহ্বান করা হচ্ছে। শ্রোতারা চিঠিতে প্রশ্ন করবে, সেই চিঠিপত্রের উত্তর দেবেন বিশেষজ্ঞরা।

এইভাবেই চলছিল। বস বলেছিল, ঠিকঠাকই তো হচ্ছে, চালিয়ে যান।

সনৎ ব্যানার্জি নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন, অনিকেতের সহকর্মী। খুব ফিচেল। এরকম ফিচেল লোক সব অফিসেই দু’-একজন থাকে। ওর ফিচলেমির দু’-একটু নমুনা দেওয়া যেতে পারে। এক মহিলা লাইব্রেরিয়ানকে ও বলল—এই, আমাকে দিবি? এত বেঁধে-ছেদে যত্ন করে রেখেছিস, আমাকে একবারের জন্য দেখা..না। তুই কী ভাবছিস? আমি তো মহিষাসুরমর্দিনীর অরিজিনাল টেপটার কথা বলছিলাম…।

কিংবা কথাটা একটু জড়িয়ে, আলগা উচ্চারণে কোনও সিনিয়র অফিসারকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল—রাঁড়বাড়িতে লাস্ট কবে গিয়েছিলেন স্যর? স্যর বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই বলল, বলছিলাম স্যর লাইব্রেরিতে লাস্ট কবে গিয়েছিলেন?

সেই সনৎ ব্যানার্জি একদিন অনিকেতের ঘরে গেল। বলল, শোন, তোকে একটা বুদ্ধির প্রশ্ন করি।

একটা গাঁয়ে একটা লোক আমগাছের তলায় ছায়ায় বসে-বসে রেডিও শুনছিল। গাছে তখনও আম পাকেনি। কচি কচি কাঁচা আম। হঠাৎ লোকটা দেখল ঝপঝপ করে আম পড়ছে। এবার বল দেখি এরকম কেন হল?

অনিকেত মাথা চুলকোচ্ছিল। সনৎদা বলল, পারলি না তো…কেশের পরীক্ষা দিয়ে তোরা চাকরি পেয়েছিলি।

‘কেশের’ সনৎদার নিজস্ব গলাগাল-বাচক শব্দ। ‘কেশ’ মানে চুল। ‘চুল’ বোঝাতে সনত্দা বিশেষ অঞ্চলের চুলের কথাই বোঝাতে চাইছেন।

অনিকেত বলল, দমকা বাতাস উঠেছিল হঠাৎ…সনৎদা বলল—ওই আমগাছের তলায় বসে লোকটা রেডিওতে তোদের ‘সন্ধিক্ষণ’ অনুষ্ঠান শুনছিল। আমগুলো তাতেই পেকে পড়ে গিয়েছে।

কয়েকজন পুরনো দিনের অ্যানাউন্সার ছিলেন। যাঁরা কাজী সব্যসাচীর সঙ্গে কাজ করেছেন, বিকাশ রায় বা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কাজ করেছেন, যাঁরা নিজেদের রেডিও-র স্বর্ণযুগের সোনাভাঙা গুঁড়ো মনে করেন, ওঁদেরও কেউ-কেউ বললেন—এ সব কী হচ্ছে অনিকেত, মানুষের কতকগুলো গোপন ব্যাপার আছে। মানুষই নিজের কতকগুলো অঙ্গ ঢেকে রাখে। জন্তুরা রাখে না। তুমি ঢাকনা উঠিয়ে দিচ্ছ। ঠিক হচ্ছে না বোধ হয়। কিন্তু স্পোর্টস দ্যাখে যে-মেয়েটা, আইভি রায়, যে বাইক চালিয়ে অফিসে আসে, মাঝে-মধ্যে সিগারেটও খায়, ও বলল, কনগ্র্যাট্স অনিকেতদা, তুমি যে এ জিনিস করতে পারবে, ভাবিনি! তুমি কিন্তু হেবি মিচকে আছ।

বাইক-আরোহিতা আইভি’র সঙ্গে দু-একবার রাস্তায় দেখা হয়েছিল। বাইকে লিফ্ট দিতে চেয়েছিল আইভি। অনিকেত এড়িয়ে গিয়েছিল। ও ভেবেছিল, এতে ওর পৌরুষ চোট খাবে। লোকেরা প্যাক দেবে। ছেলেরা বাইক চালায়, মেয়েরা পিছনের সিটে বসে ছেলেটাকে পেঁচিয়ে রাখে—এটাই তো নিয়ম। আইভি চালাবে, অনিকেত পিছনে বসবে—এটা ঠিক মেনে নিতে পারা যায় না। মেয়েরা পেয়ারা খাওয়ার বায়না করবে, ছেলেরা লাফিয়ে লাফিয়ে পেড়ে দেবে, এটাই তো নিয়ম। একবার অফিস পিকনিকে গিয়ে আইভি বলল, কে কে পেয়ারা খাবেন…পেড়ে দিচ্ছি। একটা ঢিপি মতোও ছিল। পাথর ফেলে নকল পাহাড় বানানো হয়েছে। কয়েক জন উঠতে গেল। আইভি বলল, ম্যায় ভি যায়েঙ্গে। ‘যাউঙ্গি’ বলল না কিন্তু। ও তো হিন্দিটা ভালই জানে। আইভি জিজ্ঞাসা করল—কত দূর যাবে অনিকেতদা?

কীসে কদ্দুর?

ওই প্রোগ্রামটায়?—একটা চোখ মারল আইভি।

—দেখি কদ্দুর যাওয়া যায়!

বিকাশের সঙ্গে দেখা হল টাউন হল-এর সামনে জিলিপিওলার ঠেলাগাড়ির পাশে। গরম- গরম জিলিপি পাওয়া যায়। পাশেই রুটি-তরকারি, সঙ্গে কাঁচালঙ্কা-পেঁয়াজ। লঙ্কা কামড়ে খুব ঝাল লাগলেই জিলিপি মারো। ডায়াবিটিস মিষ্টিও পাওয়া যায়। কচুরি-শিঙাড়া যেমন আছে, হজমি শরবতও আছে। ওখানে বিকাশ জিলিপি খেতে-খেতে বলল, শোন, তোর সঙ্গে কথা আছে।

অনিকেত বিকাশকে একটু এড়িয়েই চলতে চায়। কারণ মাঝে মাঝেই বোরিং মনে হয়। সুযোগ পেলেই ও নীলকীর্তন করে। নীল হাঁ করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে, নীল কল খুলে জলের শব্দ শোনে—এইসব বলে—কানের কাছে ফিসফিস করে বলে—বলা যায় না ওর বাপ হয়তো কবি ছিল, কিংবা ও ফটাফট যোগ করে দিচ্ছে, বিয়োগও শিখে গিয়েছে। কেটলির জল যখন ফুটতে থাকে ও অবাক হয়ে বাষ্প দেখে। জেম্স ওয়াটও এরকম দেখতে-দেখতে স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার করেছিলেন।

বিকাশ বলল—ছেলেটা বুঝলি, এঁচোড়ে পাকা হয়ে গিয়েছে।

অনিকেত কিছু বলল না।

আচ্ছা, তুই নাকি ছেলেমেয়েদের পাকানোর জন্য রেডিওতে কী একটা করছিস…বউ বলছিল।

বিকাশ বলল, শোন, নীলের পাকামো শোন। ওকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছি, ব্যাটা হঠাৎ বলে কী জানিস? বলে, বাবা, ওই মেয়েটার না, গোগো হচ্ছে। একটা মেয়ের দিকে আঙুল দেখায়। দেখি মেয়েটার বুকে একটা গুটলি মতো হয়েছে। বুঝলাম ওটাকেই ও গোগো বলছে। এসব ওকে কে শোনাল বল তো? ক্লাসেই শিখেছে।

তখন তুই কী বললি?

অনিকেত জিগ্যেস করল।

বিকাশ বলল—তখন আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। মেয়েটা ওর ক্লাসেও পড়ে না। ফোর-ফাইভে পড়ে হয়তো। জিগ্যেস করলাম, ওটার নাম ‘গোগো’ তোমায় কে বলেছে? নীল বলল, কেউ বলেনি। আমি জানি। ওর মায়ের জিনিসটাকে ও তো দুদু-ই বলত নিশ্চয়ই। ওটা যে দুদু নয়, সেই তফাতটা ব্যাটাচ্ছেলে বুঝে ফেলেছে। ‘গোগো’ শব্দটা ওরই আবিষ্কার

অনিকেত বলল, বাঃ!

আরে এখানে কি শেষ হয়ে গেল নাকি? এরপর কী বলল শোন…বলছে বাবা, সব মেয়েরই তো গোগো হয়?

তুই কী বললি তখন? অনিকেত জিগ্যেস করে।

বললাম, হ্যাঁ হয়। ভাবলাম ব্যাপারটা মিটল। নেক্সট কোয়েশ্চেন ইজ—বাবা, ওই মেয়েটা তো মেয়ে, আর আমার মা-ও মেয়ে। তাই তো?

আমি বললাম, হ্যাঁ, তাই।

তা হলে ওই মেয়েটা যখন বড় হবে, ওর গোগোও বড় হবে?

আমি বললাম, হ্যাঁ, তাই

যখন সিক্স-এ পড়বে, আরও বড়, যখন সেভেন-এ পড়বে আরও বড়?

তখন আমি কী ভাবলাম জানিস?

কৌতূহলটা মিটিয়ে দেওয়া উচিত। ব্যাপারটা চেপে যেতেই পারতাম, কিন্তু সেটা করলাম না।

বললাম—ঠিকই বলেছ।

ও বলল, তা হলে বুঝেছি, মেয়েরা যত বড় হয়, গোগোও তত বড় হয়।

তখন আমি বললাম, তার কোনও মানে নেই সোনা, তোমার মায়ের চেয়ে তোমার দিদা কত বড়। তা হলে তো তোমার দিদার গোগো বিরা-আ-আট বড় হয়ে যেত। তা কি হয়? আসলে তো গোগো-র ভিতরেই দুদু তৈরি হয়, তুমি যখন ছোট ছিলে, তোমার মায়ের গোগো থেকে তুমি দুদু খেতে। কোথায় থাকবে ওই মিল্ক? এম আই এল কে মিল্ক। মিল্ক মানে দুদু। বুঝলি না? এই সুযোগে ইংরেজিটাও একটু ঝালিয়ে দিলাম, এবং ওকে জানিয়েও দিলাম যে তুমি তোমার মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়েছ।

হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল বিকাশ। আসলে তো বাচ্চাটা ওর মায়ের দুধ পায়নি কখনও। আর প্রকৃতিটাও এমন, গর্ভধারণ না-করলে দুধ তৈরি হয় না।

গম্ভীর গলাতেই বিকাশ বলল –বাবা হিসেবে ঠিক করেছি না? বাবাত্ব আক্রান্ত বিকাশ বলে।

বিকাশ প্রকৃত বাবা নয়, কিন্তু যথাসম্ভব বাবা হতে চায়। আপ্রাণ বাবা হতে চায়।

অনিকেত ঘাড় নাড়ল। সম্মতির।

বিকাশ বলল, ব্যাটাচ্ছেলেটা সহজে ছাড়ল না। এমন একটা প্রশ্ন করল মাইরি এর কী উত্তর দেব বুঝে পেলাম না। আর প্রশ্নও আসে বটে। জিগ্যেস করল—বাবা, তা হলে এতজন মেয়ে, সবার গোগোতেই দুদু আছে, এত দুদু কারা খায়?

তুই তখন কী বললি? অনিকেত জিজ্ঞাসা করে।

বিকাশ বলল, ভাবলাম বলি—এসব বড় হয়ে বুঝবে। কিন্তু ভাবলাম এভাবে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। বললাম, সব সময় কি দুধ তৈরি হয়? যখন বাচ্চারা ছোট থাকে, দাঁত ওঠে না, ভাত খেতে পারে না, তখন ওরা মায়ের দুধ খায়। বাচ্চারা যখন বড় হয়ে যায়, তখন তো আর দুধ খেতে হয় না, ভাত-টাত খায়। তখন আর ওদের বুকে দুধ তৈরি হয় না।

অনিকেতও লক্ষ করল—বিকাশ এই পর্যায়ে দুদু বলল না, দুধ বলল। গোগো বলল না। বুক বলল।

বিকাশ বলল কেমন জবাবটা দিয়েছি বল?

অনিকেত বিকাশের পিতৃগর্ব অনুভব করল।

অনিকেত বলল, দারুণ বলেছিস তো বিকাশ, একদম এক্সপার্টের মতো বলেছিস।

বাপ হওয়ার ইন্টারভিউতে পাস করে যাব, বল?

হুঁ। অনিকেত মাথা নাড়ে।

আমার বউ হলে এভাবে বলতে পারত না।

অনিকেত মন্তব্য করে না।

বিকাশ বলে কেসটা এখনও শেষ হয়নি। নেক্সট কোয়েশ্চেনটা শোন, বলছে আমি তো ভাত খেতে পারি, রুটি খেতে পারি চিবিয়ে-চিবিয়ে। তা হলে আমাকে দুধ খেতে বলো কেন তোমরা?

বললাম, দুধ খেলে শরীরে শক্তি হয়, তাই।

নেক্সট কোয়েশ্চেন—তা হলে আমি কার দুধ খাই?

কেন, গরুর দুধ?

গরুর দুধ? ছেলেটা চিন্তায় পড়ে। জিগ্যেস করল, গরুর বাচ্চারা তা হলে কী খায়?

কী যে মুশকিলে পড়লাম মাইরি, কী বলি? উত্তর তো একটা দিতেই হবে। বললাম, গরুর অনেক দুধ হয়। গরুর বাচ্চারা খেয়েও অনেকটা বেশি থাকে তো, তাই মানুষের বাচ্চাদের খেতে দেওয়া হয়।

ও জিগ্যেস করল, প্যাকেটের মধ্যে গরুর দুধ তা হলে কীভাবে আসে?—একদম খাপে খাপ প্রশ্ন।

শুনেছি, আইআইটি-আইআইএম-এ কোনও সাবজেক্টের প্রশ্নের উত্তর লেখার চেয়েও জোর দেওয়া হয়, প্রশ্ন তৈরি করার ওপর। ব্যাটাচ্ছেলের প্রশ্নগুলো দ্যাখ একেবারে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে…। প্যাকেটে দুধ কীভাবে আসে? আসলে তো ওরা গরু-ছাগলের বাচ্চাকে দুধ খেতে দেখেনি!

যখন ওর স্কুলে অ্যাডমিশন টেস্ট দেওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম, জিগ্যেস করেছিল, মাছ কোথায় থাকে? বলেছিল, ঝোলে। তারপর বাড়িতে একটা অ্যাকোয়ারিয়াম এনেছি। ভাবছি, একদিন একটা খাটাল দেখাতে নিয়ে যাব। সব দেখা ভাল। গোবর-টোবর দেখবে…। এরা তো কোনও দিন খুঁটে দেখল না।

অনিকেত বলে—খাটালে নিয়ে গোবর দেখাবি! বেশ, বলবি ওগুলো হল গরুর পটি। কিন্তু তখন যদি কোনও গরু পাল খায়—কী বলবি তুই বিকাশ?

বিকাশ হা-হা করে হাসে। বলে, বলব খেলা করছে।

অনিকেত ভাবে, যদি ওর নিজের ছেলে হত, আর জন্মরহস্য জিগ্যেস করত, ও কী বলত? নিজের শৈশবের কথা মনে হয়। ভাড়া বাড়ি, বহু ভাড়াটে।

দেখেছে শিখার মা, ডলির মা-রা হাসপাতালে যায়, তারপর হাসপাতাল থেকে একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে বাড়ি ফেরে। নিজের মা-কেও হাসপাতালে যেতে দেখেছে, এবং হাসপাতাল থেকে কাঁথা জড়িয়ে ভাই নিয়ে এসেছে, বোন নিয়ে এসেছে। তার মানে হাসপাতালে ছোট বাচ্চা পাওয়া যায়। বড় পিসিমাকেও বলতে শুনেছি, তোর মা হাসপাতালে যাবে, গিয়ে একটা ভাই কিনে নিয়ে আসবে। এরপর, মনে আছে, একটা জিনিস খেয়াল করল, হাসপাতালে যাওয়ার আগে পেট-টা উঁচু হয়ে থাকে, হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে পেট-টা ঠিক হয়ে যায়। এছাড়া পিসিমা ঠাকুমাদের মুখে ‘পোয়াতি’ শব্দটা খুব শোনা যেত। ‘পোয়াতি’ শব্দের মানেটাও বোঝা গেল, মানে পেটে বাচ্চা আছে। তার মানে হাসপাতাল থেকে বাচ্চা কিনে আনার ব্যাপারটা মিথ্যে। পেটের মধ্যেই বাচ্চা থাকে।

একদিন শিখার মা, ডলির মা’দের দুপুরের আড্ডায় ছোট অনিকেত জিগ্যেস করে হাসপাতালে ছোট্ট বাচ্চারা কীভাবে আসে গো কাকি? ডলির মা বলে ভগবানের দূত এসে নিয়ে যায়। শিখার মা বলল, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে হয়, তা হলেই ভগবানের দূত আসে।

অনিকেত বলল, মেজপিসি যে বলেছিল হাসপাতাল থেকে বাচ্চা কিনে আনতে হয়?

ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। মেজপিসি তখন ছিল না। অনিকেতের মা সামলে দিল। বলল, ভগবানের দূত যদি না রেখে যায়, তখন কিনেই আনতে হয়।

অনিকেত তখন বলেই ফেলেছিল—তা হলে যে ঠাকুমা বলে সন্ধ্যাবেলা পেটে বাচ্চা লইয়া ছাদে যাইও না বউমা, তারপর হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে তোমাদের পেট ছোট হয়ে যায় কেন?

শিখার মা, ডলির মা-রা অনিকেতের মা-কে বলেছিল—ও মা, তোমার ছেলেটা কী পাকা গো… অনিকেতের মা বলেছিল, যা, তুই এখান থেকে যা…।

অনিকেত জবাব পায়নি। মনে হয়েছিল, এর মধ্যে একটা গোপন ব্যাপার আছে।

অনিকেতদের বাড়ির একতলার সিঁড়ির তলায় একটা নেড়ি কুকুর থাকত। ওর চারটে বাচ্চা হল ওকে কিন্তু হাসপাতালে যেতে হল না, আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিল কি না— কে জানে? কিন্তু মেজপিসি, মা ওরা কি সবাই মিথ্যে বলেছে? তা হলে কি ভগবান চারটে বাচ্চা কোলে নিয়ে এ বাড়ির সিঁড়ির তলাতেই এসেছিলেন! মানুষের ভগবান আর কুকুরের ভগবান কি এক?

এদিকে ট্যাংরা মাছ, বেলে মাছ এসব মাছের পেটের ভিতরে কী সুন্দর ডিম! ডিম খেতে কী ভাল লাগে। মাছের পেটের ভিতরে ডিম কেন হয়? মুরগিরও ডিম হয়। একটা খেলনা দিয়েছিল অনিকেতের বাবা। প্লাস্টিকের মুরগি। মুরগিটার পেটে চাপ দিলেই টুক করে একটা গোল ডিম পেটের তলার ফুটো দিয়ে বের হয়ে যায়। সোনার ডিম-পাড়া হাঁসের গল্পও পড়েছিল অনিকেত। ডিম তা দিলে বাচ্চা হয়। অনিকেত বুঝে যায়, ডিম বা বাচ্চাকে ভগবান বহন করে আনে না।

অনিকেতের ছোট পিসিমণির বিয়ে হল। কিছুদিন পরই ছোট পিসিমণির পেট উঁচু হয়ে যাওয়া লক্ষ করেছিল অনিকেত।

মনের ভিতরে প্রশ্ন বুড়বুড়ি কাটে—বিয়ে হওয়ার সঙ্গে বাচ্চা হওয়ার কী সম্পর্ক? এই সব প্রশ্ন যখন মাথায়, স্কুলে তখন ফাইভ-সিক্স। পড়ানো হচ্ছে পরাগমিলন। পুংকেশর, গর্ভমুণ্ড, ডিম্বাশয়…। প্রশ্ন আসে, গাছের বীজ তৈরির জন্য যদি পুং-রেণু দরকার হয়, তা হলে প্রাণীদের জন্যও কি পুরুষ-রেণু দরকার? দরকারই যদি হয়, তবে পুরুষ-রেণু কী? পুরুষ-রেণু থাকে কোথায়? তবে কি এমন জায়গায় থাকে যেটা আমরা ঢেকে রাখি? কাকে জিগ্যেস করবে অনিকেত? গুরুজনদের এসব জিগ্যেস করলে হয়তো কান মুলে দেবে। রাস্তার কুকুরদের গায়ে চাপাচাপি দেখেছিল অনিকেত। আগে ভাবত মারামারি। পরে বুঝল মারামারি নয়, মারামারি হলে পাড়ার ছেলেরা এরকম হাসাহাসি করে কেন? ক্লাস সিক্স-এ পড়ার সময় অসীম নামে একটা ছেলে অনিকেতকে ওই রহস্য বোঝায়। কুকুররা যেটা করে তাকে কী বলে, জানিয়েছিল অসীম। চার অক্ষরের ওই শব্দটা স্কুলের পেচ্ছাপখানায় দেখেছে লেখা থকে। অসীম বলেছিল সবাই এটা করে। এভাবেই বাচ্চা হয়। ছেলেদের ওই জায়গাটা থেকে মশলা বের হয়, সেই মশলা মেয়েদের ওখানে দিয়ে ঢুকে যায়। তারপর বাচ্চা হয়।

ওই মশলা-টাই তা হলে পুং-রেণু?

জন্মরহস্যের ওই ব্যাপারটা জেনে ফেলে ভীষণ শক পেয়েছিল অনিকেত, আজ মনে পড়ে। মনে-মনে ভেবেছে এরকম না হলেই ভাল হত। সবার বাবা-মা ওইরকম করে করুক, অনিকেতের বাবা-মা করে না। কিন্তু তা কী করে হবে? নিয়ম তো একটাই। ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণ—এটার তো নড়চড় হয় না। কোনও ত্রিভুজে কোণগুলোর সমষ্টি তিন সমকোণ হতে পারে না।

কতদিন বাবা-মা’র সঙ্গে ভাল করে কথা বলতে পারেনি অনিকেত। মা যখন কোনও কারণে অনিকেতকে বকাবকি করত, অনিকেত বিড়বিড় করত,

মা না ঘা
বাবা না ঢ্যাবা

কিছু দিন পরে অনিকেত বুঝেছিল, ওর আবার ভাইবোন হবে। ও বলছিল—মা না ঘা, বাবা না ঢ্যাবা। তারপর সুর করে বলেছিল, এক কড়া পোয়া গণ্ডা…দুই কড়া আধ গণ্ডা…তিন কড়া পৌনে গণ্ডা…চার কড়ায় এক গণ্ডা। মায়ের চোখে জলের ধারা দেখেছিল।

বিকাশের ওই বেশি আই-কিউ’ওলা বাচ্চা এখনও প্রশ্ন করেনি—আমি এলাম কোথা থেকে?

ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’ কবিতায় থাকতে পারে, এর ব্যাখ্যা-ভাব সম্প্রসারণও হতে পারে। যদিও এই লাইনটার ব্যাখ্যা-ভাব সম্প্রসারণ হয় না। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে এই কবিতাটা নেই। এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু কবিতার ওই ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে-র কোনও উত্তর হতে পারে না। অনিকেতের যদি সন্তান থাকত, এই প্রশ্নটাই যদি করত, কী উত্তর দিত অনিকেত? মেয়েদের নিজস্ব পত্রিকা-টত্রিকা যে সব আছে, সেখানে সাজগোজ-ফেসিয়াল ইত্যাদির সঙ্গে এসব সমস্যাও থাকে, সে রকম একটা পত্রিকায় দেখেছিল—সন্তানের দুষ্টু প্রশ্ন—মায়ের মিষ্টি উত্তর—এই হেডিং-এ প্রশ্নের উত্তরটা হল—আমি আর তোমার বাবা মিলে তোমাকে চেয়েছিলাম, তাই তুমি আমার পেটের ভিতরে এসেছিলে।

পরের দুষ্টু প্রশ্ন—তা হলে আমি কী করে তোমার পেটের ভিতর থেকে বাইরে এলাম?

মিষ্টি উত্তর—ডাক্তারবাবু পেট কেটে বের করে দিয়েছে।

এবার বিশেষজ্ঞার উপদেশ—আপনাদের অনেকেরই তো আজকাল সিজার হয়। পেটের সেলাইয়ের হালকা দাগটাও দেখিয়ে দিতে পারেন।

অনিকেত ভাবে, আহা রে, বিকাশের বউ কী বলবে? ওর পেটে তো সেলাইয়ের দাগ নেই। ওর তো সহজ সত্যি কথা স্টকেই ছিল, “মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’ থেকে তোমায় এনেছি। কিন্তু এই গূঢ় সমাচারটা তো ওকে দেওয়া যাবে না।

দুষ্টু প্রশ্নের মিষ্টি উত্তরে এরকম অনেক প্রশ্নের জবাবই ছিল। কিন্তু অনিকেতের মাথায় আরও কিছু দুষ্টু প্রশ্ন এল। অনিকেত যেন শিশু।

মিষ্টি উত্তর দেওয়া মা-কে প্রশ্ন করছে অনিকেত।

অনিকেত—কী করে বাইরে এলাম মা?

মিষ্টি মা—কেন, ডাক্তার বাবু পেট কেটে অপারেশন করে আমার কোলে তুলে দিল…ছোনামণি—।

অনিকেত—তা হলে ছাগলের মা কী করে ডাক্তারের কাছে যায়?

মিষ্টি মা—ছাগল তো মানুষ না, ছাগলের ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না। পেট থেকে পিছন দিয়েই বাইরে চলে আসে। কীভাবে পটি করো তুমি?

অনিকেত—পেচোন দিয়ে, হি, হি।

মিষ্টি মা—ঠিক বলেছ। ছাগলের বাচ্চাও সেভাবে মায়ের পেট থেকে বাইরে পৃথিবীতে আসে।

অনিকেত—তা হলে আমি যখন একদম ছোট্ট-ও-ও ছিলাম। ভীষণ ছোট্ট-ও-ও, তখন কি তোমার পেটের ভিতরে তোমার হাগুর মধ্যে ছিলাম মা?

মিষ্টি মা-র ধৈর্যচ্যুতি হল। বলল, বেশি পাকা! জানি না—যা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *