হলদে গোলাপ – ৫০

৫০

বউদির কোনও খবর পাই না। প্রায়ই ফোন ‘সুইড অফ’ থাকে। গতকাল তোকে দু’বার ফোন করেছিলাম, দু’বারই ফোন কেটে দিয়েছিলি। নিশ্চয়ই কোনও অসুবিধে ছিল, থাকতেই পারে। ‘কল রেকর্ড’ থেকে ওই ‘কল’গুলো ডিলিট করে দিস। আর এই চিঠিটাও পড়া হয়ে গেলেই পুড়িয়ে ফেলবি। একদম ছাই করে দিবি। কিংবা কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে পায়খানার প্যানে ফেলে জল ঢেলে দিবি। আমার কোনও চিহ্ন রাখবি না ডাবুদা। আমি কেন এই পৃথিবীতে এলাম? আমার কোনও দরকারই ছিল না এই পৃথিবীতে। সবাইকে কষ্ট দিয়ে গেলাম শুধু। এখন বউদি কেমন আছে জানি না। জামশেদপুরের হাসপাতালে পৌঁছে তুই আমাকে চলে যেতে বলেছিলি। মানে, তাড়িয়েই দিয়েছিলি। আমি সন্ধ্যার ট্রেনে উঠে পৌঁছেছিলাম। অনেক ‘লেট’ ছিল ট্রেন। হাওড়া স্টেশনে বসেছিলাম সারা রাত। সে সব থাক। আমি অন্য একটা কথা বলার জন্য এই চিঠি লিখছি। বউদির ওই স্ট্রোকের জন্য আমিই দায়ী। আমার নিজের ওপর ঘৃণা হয়। আমার চাকরি নেই। আমার অফিসটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর এখন কোনও নতুন কাজ পাওয়ার আশা নেই। এই বয়সে কে আমাকে চাকরি দেবে? আমার এই চিঠি যখন পাবি, তখন আমি পৃথিবী ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছি। ব্যাঙ্কে আমার মোট দুই লক্ষ একত্রিশ হাজার টাকা আছে। এটা আমার সারা জীবনের সঞ্চয়। তিল-তিল করে আমি এই টাকা জমিয়েছি। এছাড়া আমার নয়-দশ ভরি সোনা আছে। মা-র কাছ থেকে যা পেয়েছিলাম। চাকরি করে একটা দুল গড়িয়েছিলাম শুধু। এছাড়া আমার একটা লাইফ ইনসিওরেন্স আছে। এক লাখ টাকার। আমার ছেলেকে ‘নমিনি’ করা আছে। সুইসাইড করলে ইনসিওরেন্সের টাকা পাওয়া যায় না। কিন্তু দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে পাওয়া যায়। ডাবুদা আমার মরণটাকে আমি এমনভাবে সাজাব, যেন মনে হয় ওটা অ্যাক্সিডেন্ট-ই হয়েছে। আমার ছেলে, আমার বর, সবাই জানবে ‘অ্যাক্সিডেন্ট’। গত কয়েক দিন ধরে ভেবে-ভেবে আমি একটা ছক তৈরি করেছি। পরি তোকে খুব শ্রদ্ধা করে। ভালবাসে। ও নিশ্চয়ই তোর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ওকে ফিরিয়ে দিস না। এই অভাগিনী তোর কাছে হাত জোড় করে এই ভিক্ষা চায়। আমাকে ঘৃণা কর, আমার মরণের পরও ঘৃণা করে যাস, কিন্তু পরি’কে ঘৃণা করিস না। পরি’কে নিয়ে তোর সঙ্গে আমার যতবার কথা হয়েছে, ততবারই তুই পরি-র ওপর সহানুভূতি দেখিয়েছিলি। আমি জানি, তুই ওকে ভালবাসিস। আমার টাকাটা যেন ও পায়, সেটা দেখিস। এই টাকাটা না পেলেও কোর্সটা করতে পারবেনা। হয়তো লেখালিখি করতে হবে, থানা-পুলিশ করতে হবে। আমি যেটা করতে চলেছি, সেটা আগেই করতে পারতাম, যেদিন হাওড়া স্টেশনে বসেছিলাম সারা রাত, সেদিন নিজের ওপর এত ঘেন্না হচ্ছিল যে, ভাবছিলাম, সেই রাত্রেই নিজেকে শেষ করে দিই। একটা করে ট্রেন ঢুকছিল, আর বলছিল, ‘আয়, আয়, ঝাঁপিয়ে পড়।’ কিন্তু নিজেকে চেক করেছিলাম। আগে কয়েকটা জরুরি কাজ শেষ করতে হবে। ফিক্সড ডিপোজিটগুলো ভাঙিয়ে সব সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমা রেখেছি। ওই অ্যাকাউন্ট-টা আমার আর পরি, দু’জনের নামেই জয়েন্ট। ও ভাঙিয়ে নিতে পারবে। ক’টা দিন ভাল করে রান্না করলাম, পরি যা খেতে ভালবাসে। ওর পড়াশোনা শেষ করতে তিন বছর লাগবে। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা—এসব জায়গার কতগুলো কলেজে চেষ্টা করছে। বলছে, তোমার টাকা খসাব মা, কিন্তু দেখো, সুদে-আসলে পুষিয়ে দেব। ও যদি বাইরে পড়ে, ওর খরচ আছে, তার ওপর কলকাতার বাড়ি ভাড়া, আমার নিজের খাইখরচ, কী করে সামলাব আমি? আর ওই কার্তিকবাবু, উনি ভেবেছিলেন আমার চাকরির টাকায় খাবেন, আর আমার রান্না করে দেওয়া হালকা ঝোল খাবেন। যখন দেখলেন আমার চাকরি নেই, তখন যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। যোগাযোগ করলেও বেকার অবস্থায় ওর সংসারে থাকতে পারতাম না। লাথি-ঝাঁটা খেতাম। তা ছাড়া নিজের ওপর ঘেন্না তো আছেই। তোর কাছেও মুখ দেখাতে পারছি না। আমি ভগবানের কাছে রোজ প্রার্থনা করি বউদি যেন তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠে। বউদিকে বলিস, তোর কোনও দোষ নেই, আমিই হঠাৎ করে জোর করে তোর কাছে গিয়েছিলাম। বউদিকে বলিস আমি সেই পাপেই মরেছি।

এক ফোঁটা জল পড়ল কাগজের ওপর, যেখানে ‘মরেছি’ শব্দটা ফুটে আছে। এই লেখাটা যদি ডটপেন না-হয়ে কালির হত, মরণ লেখাটা ঝাপসা হত একটু। জলের ফোঁটাটা শুষে নিচ্ছে কাগজ, কালো লেখাটা কালো-ই রয়ে গেল। কিন্তু পুরো পৃষ্ঠাটাই ঝাপসা দেখছে মঞ্জু। আঁচল দিয়ে একবার চোখ মোছে মঞ্জু। তুই রইলি জলে আমি রইলাম ডালে। তোর-আমার দেখা হবে মরণের কালে। চিঠিটার শেষ লাইনে ‘আমার ভালবাসা নিস’ লিখল। লিখে কেটে দিল। ভাল করে কেটে দিল—যেন কিছুতেই না পড়া যায়। তলায় লিখল ইতি, অভাগিনী মঞ্জু’। লিখে, কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। চিঠিটার তলায় আরও একটু শূন্যতা আছে। সাদা শূন্যতা। ওখানে লিখল ‘পুনঃ : চিঠিটা পড়েই ছিঁড়ে ফেলবি কিন্তু। নামটাও। কোনও প্রমাণ রাখবি না। ‘

পরের লাইনে লিখল, ‘পরি-কে দেখস, প্লিজ। ও যেন সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে। ও যেন সবাইকে দেখিয়ে দিতে পারে মেয়েলি-ছেলে হয়েও বড় হওয়া যায়। আমি ওপর থেকে দেখব, আর শান্তি পাব।’

আরও একটু জায়গা ছিল। ওখানে লিখল, ‘আমায় ক্ষমা করিস।’

কাগজটা ভাঁজ করে একবার কপালে ঠেকাল। যে কোনও শুভ কাজে হাতটা কপালে ঠেকায় মঞ্জু। খামে ভরল। ঠিকানা লিখল। ওর ব্যাগে ভরল। স্ট্যাম্প লাগিয়ে এমনি ফেলে দিলে যদি না যায়? কুরিয়ার? ওদেরও বিশ্বাস নেই। স্পিড পোস্ট-ই ভাল।

এবার মোবাইলটা নিল। অনিকেতকে যে-সমস্ত মেসেজ করেছে, ওগুলো ‘ডিলিট’ করতে লাগল। স্ক্রিনে যখন জিজ্ঞাসা ফুটে ওঠে—’ডিলিট মেসেজ?’ ও তখন পোকা মারার মতো টিপে দিতে থাকে : ইয়েস…ইয়েস…ইয়েস…। একটা মেসেজ ছিল ‘প্লিজ হেল্প মি।’ সেটার ওপর যখন জিজ্ঞাসা-চিহ্নটা এল, ওটা ডিলিট করল না। ওর মোবাইলে এই আর্তিটা শেষ পর্যন্ত লেগে থাকুক। অনিকেতের করা যে-কটা মেসেজ ছিল, মেসেজ বক্স থেকে ওগুলোও ডিলিট করে দিল। অনিকেতের সঙ্গে গত কয়েক বছরের সম্পর্কের প্রমাণ জেগে রইল শুধু প্লিজ হেল্প মি-র মধ্যে। ওটা যদি উড়িয়েও দিত, তা হলেও কি সব প্রমাণ লুপ্ত হতে পারত?

জায়গাটা দেখে এসেছে আগেই। পার্ক সার্কাস আর বালিগঞ্জের মাঝামাঝি। রেললাইন-টা পার হলে শরৎ পণ্ডিত স্ট্রিট, একটু হেঁটে গেলেই মরকতকুঞ্জ। বড় স্যরের বাড়ি। ওখান দিয়ে অনেক ট্রেন। দু’চার মিনিট পরপরই ট্রেন।

আত্মহত্যা মহাপাপ, নরকে গমন…। এমনি-এমনি মরলে—যক্ষ্মায়, ক্যানসারে, কিডনির গণ্ডগোলে… তা হলে যেন কত স্বর্গবাস হত… কী এমন পুণ্য করেছে জীবনে? পাপই তো বেশি। পাপের ফল কি নরকে ভোগ করতে হয়? না কি পরের জন্মে? এ জন্মে যে সুখ পেল না, সে কি গত জন্মের কর্মফল? এ জন্মের কর্মফল কি আগামী জন্মে যাবে? আগামী জন্মে তবে কি আরও দুঃখ?

ঘরটার প্রদক্ষিণ করল দৃষ্টিতে। খেলা ফুরল। খেলা ভাঙার খেলা। জল তেষ্টা পাচ্ছে। এতক্ষণে। তেষ্টা এগোয়, জল এগোয় না।

ডাবুদাকে একটা ফোন করবে? শেষ ফোন? শেষবারের মতো গলাটা…।

ওর নামটা দেখেই আবার ফোনটা কেটে দেবে ডাবুদা। পরশুদিন দু’বার কেটে দিয়েছিল।

গাড়িতে উঠিয়ে প্রথমে চাইবাসার সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিল। ওখানে ডাক্তাররা হাতে-হাঁটুতে ছোট হাতুড়ি দিয়ে ঠোকাঠুকি করেছিল। প্রেশার মেপেছিল, তারপর বলেছিল- প্রেশার এখনও অনেক বেশি। দু’টো ইনজেকশন দিয়েছিল, তারপর বলেছিল এক্ষুনি জামশেদপুরে নিয়ে যান। ওরা একটা অ্যাম্বুলেন্সও দিয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন সিলিন্ডারও ছিল। শুক্লা বউদির মাথার কাছে বসেছিল ডাবুদা আর মাহাতো বলে ছেলেটা। পায়ের কাছে মঞ্জু। মঞ্জু শুধু ঠাকুরের নাম করছিল। যে-আর্তনাদের মতো হুই-হুই আওয়াজটা অ্যাম্বুলেন্সের থেকে বের হচ্ছিল, আসলে ওটা মঞ্জুর বুক ফুঁড়েই বেরচ্ছিল। অ্যাম্বুলেন্সের কাচের দু’পাশের পাহাড়গুলো, গাছগুলো ক্রমাগত মঞ্জুকে দুয়ো দিচ্ছিল। মঞ্জু কিছুতেই অনিকেতের দিকে তাকাতে পারছিল না। মঞ্জু মাথা নিচু করে বসেছিল। মাহাতো বলছিল— হঠাৎ কী করে এমন হল স্যর? ম্যাডাম বহুত খোশ মে থি। রিকশা থেকে লেবে হামাকে পুছল সাহেব আছে কি নাই? হামি বললাম, একবার তো দেখেছিলাম। বাহার ট্যুরে যায় নাই। তারপর আপনার কোয়ার্টারে লিয়ে গেলাম…।

অনিকেত বলেছিল—প্রেশারের গণ্ডগোল বহু দিন থেকেই তো ছিল। কী জানি হঠাৎ কেন এমন হল। স্ট্রোক হলে এরকম হঠাৎই তো হয়। আমার শালি এসেছিল হঠাৎ। ম্যাডামের নিজের বোন নয়, কাজিন বোন। আমি ফোন করে ম্যাডামকে বললাম, চলে এসো।

—তা হলে কেন ম্যাডাম হামাকে পুছল সাহেব আছে কি নাই?

অনিকেত বলল—তা হলে হয়তো জানতে চেয়েছিল তখন ছিলাম, না কি বাজার-টাজারে গিয়েছিলাম।

মঞ্জু বুঝতে পারছিল না তখন ওর কী করা উচিত। অনিকেতের কথাতেই তো সায় দেওয়া উচিত ছিল। দু’বার ঘাড়ও নাড়িয়েছিল মঞ্জু, কিন্তু অনিকেত বা মধু মাহাতো কারও চোখের দিকেই তাকাতে পারেনি।

ট্যুর কোম্পানির চাকরিটার জন্যই হয়তো খারাপ অবস্থা সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেক সময় মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে, সত্যি-মিথ্যে বানাতে হয়েছে। মঞ্জু তখন সত্যি বানানোর চেষ্টা করছিল। মিথ্যেকে সত্যি দিয়ে মুড়ে দেওয়ার, বা সত্যিকে মিথ্যে দিয়ে…।

মঞ্জু দু’একবার শুক্লার গা ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিল—দিদি, ও ফুলদি, শুনতে পাচ্ছো? একবার আড়চোখে তাকিয়েছিল অনিকেতের দিকে। অনিকেতের কপাল কুঁচকানো

হাসপাতালে তাড়াতাড়ি ভর্তি করে নিয়েছিল ওরা। মাহাতো অনিকেতের সঙ্গে-সঙ্গে ছিল। মঞ্জু বসেছিল নীচে। হাসপাতালের ঠিক বাইরে একটা হনুমান মন্দির আর একটা শিবমন্দির ছিল। ওখানে মাথা ঠুকেছিল। ও একটা কালীমন্দিরের অভাব বোধ করছিল। ধোঁয়া-মাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, হে মা কালী আমাকে বাঁচাও। আসলে শুক্লার ‘বাঁচা’ মানে মঞ্জুরও বাঁচা।

কিছুক্ষণ পরে অনিকেতকে নামতে দেখে ছুটে গিয়েছিল মঞ্জু। ‘বেঁচে আছে, এখনও বেঁচে আছে’ বলে বোধহয় কোনও ওষুধ আনতে ছুটেছিল। তারপর দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল মঞ্জু। মাহাতোও নেমেছিল। মঞ্জুর দিকে তাকিয়েও চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে অনিকেত আবার ঢুকেছিল হাসপাতালে। বলেছিল, এমআরআই হবে।

মঞ্জুর মনে হচ্ছিল ও কীরকম অনাবশ্যক এই সময়ে। ও কোনও কাজেই লাগছে না। ওর এখানে থাকা না-থাকার কোনও মানে নেই। আরেকবার দেখা হল। সঙ্গে মাহাতো। মঞ্জু শুধু বলল, তোমরা কিছু খেয়ে নাও। সারা দিন কিছু…। ডাবুদা বলেছিল—এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।

একা বসেছিল নীচে। যারা বসেছিল, তারা অনেকে চলে গেল, নতুন কেউ এল। ওরাও চলে গেল। সন্ধে হল। ওদের খবর পাচ্ছিল না। মঞ্জু সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওদের খুঁজছিল। দোতলায় দেখল একটা চেয়ারে বসে আছে ডাবুদা। চোখ বোজা। মঞ্জু সামনে দাঁড়ানো। চোখ খুলছে না ডাবুদা। জিগ্যেস করল, এখন কেমন আছে বউদি? অনিকেত চোখ খুলল। বলল, মাথায় রক্ত জমে আছে। এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। তুই চলে যা। ঢিল ছোড়ার মতোই কথাগুলো ছুড়ে দিয়েছিল ডাবুদা।

অটো করে জামশেদপুর স্টেশন। একটা ট্রেন পেল সাড়ে সাতটায়। হাওড়া স্টেশনে যখন ঢুকল রাত বারোটা বেজে গিয়েছে। স্টেশনে সারা রাত।

পর দিন সকালে ফোন করেছিল। ডাবুদা বলেছিল, ডান দিক পড়ে গিয়েছে। এখনও জ্ঞান আসেনি।

বেশি ফোন করতে ভয় পাচ্ছিল। এদিকে ফোন না করলে খবরটাও পাওয়া যাবে না। অনিকেত ফোন ধরত না বেশির ভাগ সময়। জেনেছিল জ্ঞান ফিরেছে। সাত দিন নাকি দশ দিন হাসপাতালে ছিল। শুধু জেনেছিল এখন বাড়িতে।

মঞ্জু বলেছিল, আর ফোন করব না কখনও।

অনিকেত বলেছিল, আচ্ছা ঠিক আছে।

.

আলনায় ছেড়ে রাখা পরি-র জামাকাপড়। সবগুলো একসঙ্গে করে নিয়ে দু’হাতে মুখে চেপে ধরে। জোরে শ্বাস নেয়। পরির গায়ের গন্ধ। কী সুখ! কী সুখ! ওইসব জামাকাপড় অনেকক্ষণ গায়ে মাখে মঞ্জু। বিছানায় ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর উপুড় হয়ে থাকে। তারপর আবার ভাঁজ করে করে গুছিয়ে রাখে। ট্রাউজার, কুর্তা, ফতুয়া, গেঞ্জি, ব্রা, শর্ট…। ফতুয়াগুলো এমন করে বানিয়েছে, যেন মেয়েদের টপ। ছবি এঁকে ডিজাইন করে দেয় ও। ছবি আঁকার খাতাটা কি আছে? পাওয়া যাবে? ওর ছোটবেলার ছবি আঁকার খাতাটা? ময়ূর আঁকত, সাপুড়ে এঁকেছিল একটা, কী সুন্দর একটা আঁকা ছিল, খাতার এক কোণে কয়েকটা ফোঁটা। এটা কী সোনা? ও বলেছিল এটা তুমি। আমি কেমন করে হব? ও বলেছিল, কেন, এটা তো তোমার শাড়ির আঁচল? এই যে বুটি বুটি, এই শাড়িটাই তো। আর তুমি তো রান্নাঘরে। তোমার শাড়িটা শুধু দেখা যাচ্ছে। সেই আঁকার খাতাটা খুঁজতে গিয়ে অ্যালবামটা পেয়ে গেল। কার্তিকের সঙ্গে ওর ছবি স্টুডিওতে গিয়ে তোলা। সিংহাসনের মতো দু’টো চেয়ারে ওরা দুজন পাশাপাশি বসে আছে। কার্তিকের একটা হাত মঞ্জুর কাঁধে। মঞ্জুর সিঁথিতে অনেকটা সিঁদুর। জমিদার বাড়ির মতো থাম, জাফরি-কাটা জানলা। ওগুলো স্টুডিওর ছবি। স্টুডিওর লোকটা জিগ্যেস করেছিল, ‘পিছনে কী রাখবেন? তাজমহল না ফুলের বাগান, না কি জমিদার বাড়ি?’ এই তো সেদিন। এই তো ছোট সোনাটা। নেংটু। ওর পুরুষ-চিহ্নটা দেখল ভাল করে। ছোট্ট পরিকে চুমু খেল একবার। মঞ্জুর মায়ের ছবি। রান্নাঘরের গন্ধ, কলঘরের শ্যাওলার গন্ধ। শাড়িতে হলুদের গন্ধ মা, আমাকে তুমি আনলে যদি, ফিরিয়ে নাও। মা! বার্লির গেলাস, জ্বরের আবছা গন্ধ, তোমার ঠান্ডা-ঠান্ডা হাত আমার কপালে ছুঁইয়ে দাও। মা, তোমার ঘোমটা সামান্য টানা, ঠোটের কোনায় একটু পানের রস, সাদা-কালো ছবিতে বোঝা না-গেলেও, আছে। মা গো, শীতসন্ধ্যার বৃষ্টির মতো মন কাঁদে। পাতা উল্টে যায়, অ্যালবামের পাতা, পুরনো দিন, পুরীতে তোলা তিনজন। কার্তিকের কাঁধে পরি। সমুদ্রের ধারের ফোটোগ্রাফার তুলে দিয়েছিল। পিছনে সমুদ্র। স্থির সমুদ্রকেও এক ফোঁটা নুন জল দিল মঞ্জু। অ্যালবাম-টা গুছিয়ে রেখে দিল। আর কী কী কাজ? ভাবতেই কাকের ঝাঁকের মতো কাজগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রবল কা-কা কা…। হুশ করে তাড়াল মঞ্জু। এখন চাই নীরব শান্তি। মাথা ঠান্ডা রেখে এগোতে হবে। হে ভগবান, যেন সব ঠিকঠাক হয়।

এগারোটা নাগাদ খেয়েদেয়ে পরি বেরিয়ে গিয়েছে। কোথায় যায়, মঞ্জু জিগ্যেস করে না। কখন আসবে সেটা জিগ্যেস করে কখনও-কখনও। আজ জিগ্যেস করেছিল। পরি বলেছিল, সন্ধের পর। মঞ্জু বলেছিল, আমি যদি তখন বাড়িতে না-থাকি, তুই খেয়ে নিস বাবা। ঘুগনি করে রাখব, খেয়ে নিস। কাবলি ছোলার ঘুগনি খেতে খুব ভালবাসে পরি। প্রেশার কুকারে ভেজানো কাবলি ছোলা বসিয়ে দিল। আলমারি খুলে গয়নার পুঁটুলিটা বের করল মঞ্জু। নিজের কানের থেকে রিং দু’টো বের করে পুঁটুলিতে রাখল। পুঁটুলিটা শক্ত করে গিঁট দিল। ওর না- দেখা আগামী দিনগুলোকে বাঁধল মঞ্জু। যেন সোনার দিন হয়, সোনালি দিন হয় ছেলেটার। ব্যাঙ্কে যা আছে, ছেলের সঙ্গেই আছে। কাগজপত্রগুলো সব একটা খামে ভরা আছে। খামের ওপর মঞ্জু লিখল : ব্যাঙ্ক। সোনা-টোনাগুলো নিয়ে ওই চয়ন বলে ছেলেটা পালাবে না তো? ওকে খুব বিশ্বাস করে ছেলেটা। খুব আসা-যাওয়া করে। ছেলেটাকে তো দেখে ভালই মনে হয়। বাইরে থেকে দেখে কাউকে কি কিছু বোঝা যায়?

এই কথাটাই তো বলেছিল মাহাতো বলে ছেলেটা। নাক দিয়ে গড়ানো রক্ত দেখে ছুটে বাইরে গিয়েছিল ডাবুদা ড্রাইভারকে ডাকতে। শুক্লা বউদির তখন জ্ঞান নেই। মাথায় জলের ঝাপটা দিচ্ছিল মঞ্জু। তখন ভয়ও হচ্ছিল। যদি জ্ঞান ফিরে তাকায়, মঞ্জুকে দেখে, যদি বলে তুমি কেন এখানে? কী বলত তখন মঞ্জু? গাড়ির ড্রাইভার সেদিন ছিল না। রবিবারের ছুটিতে কোথাও গিয়েছিল। মাহাতো ছেলেটি অন্য একটা গাড়ি নিয়ে এসেছিল তাড়াতাড়ি। লোকজন জড়ো হয়েছিল। স্ট্রেচার-ও জোগাড় হয়েছিল একটা। ধরাধরি করে গাড়িতে কোনওরকমে শোয়ানো হয়েছিল শুক্লা বউদিকে। সে-সময় ছেলেটা বলেছিল ওই কথাটা।

ঘুগনির মধ্যে কয়েকটা কিশমিশ মিশিয়ে দিল মঞ্জু।

পেঁয়াজের কুচি দিল করি পরিপাটি।
তারপরে যত্ন করি ঢাকা দিল বাটি।।
তাহার উপরে লেবু এক খণ্ড রাখি।
আঁচলে মুছিল বামা জলপূর্ণ আঁখি।।

এবার দরজা বন্ধ করে মরতে যাবে। একটুও বুক কাঁপছে না তো? গলাও শুকিয়ে আসছে না। তবু একটা ছোট জলের বোতলে জল ভেরে নেয়। মোবাইলে কথা বলতে-বলতে রেললাইন পার হবে মঞ্জু। কথা বলবে, বড় স্যরের সঙ্গে। বলবে স্যর, আমার জন্য একটা কিছু করুন স্যর, আমাকে বাঁচান স্যর… সেই সময় ট্রেনটা এসে ধাক্কা দিয়ে ওর সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। কাগজে বেরবে : মোবাইলের বলি এক গৃহবধূ। অ্যাক্সিডেন্ট। সুইসাইড নয়। মোবাইলের কল রেজিস্টারে প্রমাণ থাকবে ও বাঁচতে চেয়েছিল।

হেন কালে অকস্মাৎ হল দৈববাণী।
মোবাইল তোমার হাতে না রবে তখনি।

কে যেন বলল—মোবাইল তো ছিটকে যাবে। থাকবে না তোমার হাতে। কেউ যদি ওটা নিয়ে পালায়? তোমার বাঁচার প্রমাণ তো চুরি হয়ে যাবে বাছা …।

মঞ্জু তখন অন্য একটা বুদ্ধি করল। কী করে এসব বুদ্ধি আসে এ সময়ে?

মঞ্জু আবার কাগজ-কলম বের করল।

শ্রদ্ধেয় স্যর,

আমাদের অফিসটা বন্ধ করে দিলেন। আপনি দয়াপরবশ হয়ে দুই মাসের বেতন দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এতে ক’দিন চলবে? আমাকে অন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করিয়া দিন। আপনার তো কত চেনা-জানা আছে। আমি এখন কোথায় কাজ পাইব? আপনার পায়ে পড়ি, আমার জন্য যে কোনওরকম কাজের ব্যবস্থা করিয়া দিন। দরকার হলে আপনার বাড়ির রান্নার কাজ করতেও রাজি আছি। আমার অবস্থা আপনি সবই জানেন। এত দিন আপনার দয়ায় ডাল-ভাত জুটিয়াছিল। এবার আমি কী করব? আমাকে বাঁচান স্যর।

এইটুকু লিখে কিছুক্ষণ কলম কামড়ে রইল মঞ্জু। তারপর আবার লিখল—এই আবেদন পোস্ট না-করিয়া আমি নিজ হাতে আপনাকে দিলাম। পোস্ট করিলে দেরি হইবে। মার্জনা করিবেন। ইতি।

কলমটা কপালে ছুঁইয়ে নিজের নামটা লিখল : মঞ্জু।

চিঠিটা ভাঁজ করে ব্যাগে রাখল। ও যে চাকরির জন্য দেখা করতে যাচ্ছে, এটা তার প্রমাণ।

.

চিঠিটা ব্যাগে থাকবে। আর হাতে থাকবে মোবাইল। মোবাইলেই স্যারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাবে।

ঘরে তালা দেওয়ার আগে শেষবারের মতো আর একবার দেখে নিল ঘরটাকে। পরির টেবিল।

তালাটা চাবি দেওয়ার আগে, চাবিটা কপালে ছোঁয়াল মঞ্জু। এই তালা যেন আর না-খুলতে হয় আমার। গ্রীষ্মের আকাশে তাকাল। কপালে ছোঁয়াল হাত। ঈশ্বরের কাছে মৃত্যুই চাইছে ও, কিন্তু ও বলল, ‘হে মা কালী। আমাকে বাঁচাও।’ জামশেদপুরের আকাশেও বলেছিল ‘আমাকে বাঁচাও’। মানে, শুক্লাকে। ঈশ্বরের কাছে মৃত্যু চায় না কেউ। মঞ্জুও চাইল না। ও জানে, ‘বাঁচাও’ মানে ‘নির্বিঘ্নে মরণ দাও।’

পোস্ট অফিসে গেল ও। অনিকেতকে লেখা চিঠি। জিগ্যেস করল ঠিক যাবে তো? পোস্ট অফিসের লোক বলল, যাবে তো মানে? মঞ্জু বলল, খুব জরুরি চিঠি। দরকারি। খুব দরকারি। রেজিস্ট্রি করে দেব? না কি স্পিড পোস্ট?

যা খুশি। স্পিড পোস্ট তাড়াতাড়ি যাবে। তা হলে তাই করে দিন।

ব্যাগের গহ্বর থেকে যত্নে রাখা চিঠিটা বের করল মঞ্জু। কপালে ঠেকিয়ে কাচের ফাঁকের মধ্যে সমর্পণ করল চিঠিটা। একটা ছোট্ট চিরকুট পেল। প্রমাণ। বাইরে বেরিয়ে ওই প্রমাণটাকে পাকিয়ে রাস্তার ঝাঁঝরি খুঁজতে লাগল মঞ্জু। হাঁটতে গেলে মনে হচ্ছিল ওর পায়ে শেকল পরানো আছে। শেকল ছেঁচড়ে হাঁটতে-হাঁটতে ঝাঁঝরি খুঁজতে লাগল মঞ্জু। ওকে এখনও অনেক দূর যেতে হবে, অনেক দূর। একটা ঝাঁঝরি এবং একটা ট্যাক্সি একসঙ্গেই পেয়ে গেল। মঞ্জুকে দেখে একটা ট্যাক্সি থামল। কেন থামল? মঞ্জুকে দেখে কখনও কোনও ট্যাক্সি থামে না। ট্যাক্সিওলারা বুঝে যায় এ মেয়ে ট্যাক্সির নয়। কিন্তু আজ ট্যাক্সিটা মঞ্জুর সামনে এসে প্রায় থেমে গেল। ড্রাইভার জিগ্যেস করল, যাবেন? মঞ্জু বলল, বালিগঞ্জ স্টেশন

খুব বিলাসিতা করা গেল। ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকা বের করে দিল। ব্যাগে আরও তিরিশ-চল্লিশ টাকা আছে। সবই তো ভাবতে হয়। ঝাঁপ দেওয়ার পূর্বমুহূর্তে যদি কেউ হাত ধরে টেনে নেয়? রোজ কত কী যে ঘটে যাহা তাহা—এমন কেন সত্যি হয় না আহা… দেয়াল ল্যাম্পপোস্ট চাঁদসী চিকিৎসালয় বলরাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে এ লাইনগুলো উচ্চারিত হতেই ‘চোপ এক থাপ্পড় মারব’ বলে ‘ঠিক যেন এক গল্প হত তবে’র গল্পটিকে থামিয়ে দেয়। কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে। ঘড়িতে চারটে বেজে দশ। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে। একটা মেসেজ লেখে, Ami Ektu Apnar Kachhe Jachhi Sir, Khub Darkar Amake Banchan. বড় স্যরের নম্বরে পাঠিয়ে দেয়। সব কিছু রেডি। সুইসাইড নয়। বাঁচার জন্য যাচ্ছে মঞ্জু। ভ্যানে করে ঝিঙে-ঢ্যাড়সের ঝুড়ি যাচ্ছে বাজারের দিকে। দক্ষিণের কাজের মাসি- পিসিরাও বেরিয়ে পড়েছে। ফুচকাওয়ালাটিও চলেছে এবং আইসক্রিম। চারিদিকে জীবনের আয়োজন।

এই মাত্র হুশ করে ট্রেন ছুটে গেল দক্ষিণের দিকে। লাইনের ওধারে শরৎ পণ্ডিত রোড।

রেললাইনের ধারে এসে থামে মঞ্জু। ব্যাগটা আঁকড়ে রাখে।

নয়া গাঙের পাড়ে রে ফুটিল চম্পার ফুল
কে তুমি দাঁড়াইয়া কন্যা উড়ে মাথার চুল
বাতাসে কাঁপিছে কন্যার মলিন বসনখানি
দূরের পানে চাহে কন্যা নাও-এর শব্দ শুনি
গাঙের পাড়ে বিরল বৃক্ষ চিরল চিরল পাতা
বৃক্ষ কহে কহ কন্যা তোমার মনের কথা
বৃক্ষের পক্ষী ডাক্যা কয় কন্যা থাক আশার আশে
আইজ বা গেল মন্দেরে মন্দে কাইল বা সুদিন আসে

বৃক্ষ কথা পক্ষী কথা শুনিল না নারী
অদূর দরিয়ার দিকে দিল সে যে পাড়ি।

বৃক্ষ থেকে, পক্ষী থেকে, ল্যাম্প পোস্ট, রেললাইনের পাথর, পোস্টার, আকাশ-বাতাস- চরাচরের ভিতর থেকে তীব্র আর্তনাদের মতো, চিৎকারের মতো, অট্টহাসির মতো ট্রেনের হুইশল…।

৫১

শ্মশানেই একজন ঠাকুরমশাই ধরেছিল ওরা। চয়ন, কার্তিক, পরি’র প্রতিবেশীরা ছিল শ্মশানে। মঞ্জুর মৃতদেহ পেয়েছিল তিন দিন পর। পোস্টমর্টেম-এর পর। পুলিশের ব্যাপারটা কার্তিকবাবুই দেখেছে।

মর্গে মৃতদেহকে বলে ‘লাশ’। বারবার ‘লাশ’ শব্দটা উচ্চারিত হয়েছিল তখন। মুখাগ্নির আগে ‘প্রেত’। বারবার ‘প্রেত’।

সপ্ত ছিদ্রে সাত খণ্ড সোনা লাগে। ঠাকুরমশাই বললেন।

—সোনা?

পরি-র মনে হয়েছিল, মায়ের কানে তো সব সময় পরার মতো দুল থাকত। কিন্তু মুখটা মোড়ানো। দেহটাই তো টুকরো-টুকরো হয়ে আছে। মর্গে একবার কাপড়টা উঠিয়ে মুখটা দেখিয়েছিল এক ঝলক। ডোম বলেছিল, এসব মরা দেখতে নেই। নাক আর ঠোঁটটা দেখিয়েছিল ডোম। বলেছিল, মাথার কাপড় ওঠাব না। খুলি উড়ে গিয়েছে।

কার্তিক বলল, সোনা পাব কোথায়?

ঠাকুরমশাই বললেন, অভাবে কাংস্য। ডালার মধ্যে কাংস্য নেই।

শ্মশানেই সব পাওয়া যায়। ‘দাহকর্মের ডালা’ বললেই সব দিয়ে দেয়। তিল, আতপ চাল, ঘি, মালসা—সবই থাকে। ঠাকুরমশাই বললেন, কাংস্য আলাদা কিনতে হয়।

কার্তিক বলল, ঠিক আছে, মূল্য ধরে দিচ্ছি। দশটা টাকা দেব’খনে।

ঠাকুরমশাই বলল, অপঘাতে মৃত্যু কিনা, যতটা পারা যায় শাস্ত্র মেনে কাজ করা উচিত। নইলে মুক্তি পাবেন না যে। নাও, মন্ত্র পড়ো—এহি প্রেত গম্ভীরেভিঃ পথিভিঃ…। জলের ছিটা দাও। এবার ঘি মাখানোর কথা। কিন্তু শরীর কি আছে? ঢাকা চাদরের ওপর ঘি ছড়াও। এই নাও পাটকাঠি। আগুন জ্বালাও। মুখ তো দেখা যাচ্ছে না, ঢাকনা খোলার দরকার নাই। এই যে, এইটা যদি মাথা হয় এখানেই মুখ। এইখানে জ্বলন্ত অগ্নি স্পর্শ করো। বলো, সর্বে হুতাশ গৃহীত্বা এনং দহন্তু। দহেয়ং সর্বগাত্রানি দিব্যান লোকান স গচ্ছতু….।

হাঁ-মুখ খুলে গেল। ভিতরে গনগনে হুতাশন। দিব্যলোক। কাপড়ে প্যাঁচানো লাশ। পরি এতক্ষণে কেঁদে উঠল, মা গো…। কার্তিক ওর কাঁধে হাত দিতেই এক ঝটকায় কাঁধটা সরিয়ে দিল।

ঠাকুরমশাই জিগ্যেস করলেন, অম্বলায়ন গোত্র তো মন্ত্রে বললাম। কী জাত?

কার্তিক বলল, আমরা ছুতোর। পাল লিখি।

—ক’দিনে কাজ করা হয়?

কার্তিক বলল, বাবার বেলায় তো তেরো দিনে করেছিলাম।

—এটা অপঘাত কিনা, সাতদিনে হবে। ‘সুইসাইড কেস’ হলে অশৌচ, শ্ৰাদ্ধ কিচ্ছু হয় না। আমি সুইসাইড কেস-এ ‘কাজ’ করি না। যে-ব্রাহ্মণ ‘সুইসাইড কেস’ করে, তারও প্রায়শ্চিত্তির করতে হয়। ‘অ্যাক্সিডেন্ট কেস’ বলে আমি করছি। আর ভাল কথা। মৃতের কোনও মেয়ে নেই তো? বিবাহিতা মেয়ে হলে কালই অন্নজল করতে হবে।

‘বিবাহিতা’ শব্দটা শুনতে বোধহয় পরিমল ভুল করেছিল।

পরি চয়নকে বলল, আমি তা হলে কালই করে ফেলি?

চয়ন বলল, তোর বাবা কি রাজি হবেন?

পরি একটু জোর দিয়েই বলল, শুনব না, শুনব না, ওর কথা।

চয়নও বোধহয় পুরোহিতের সব কথা খেয়াল করেনি।

পরি পুরোহিতকে বলল, অন্নজল করতে কী লাগে?

—চাল, ফলমূল, হরীতকী, গীতা আর দক্ষিণা পিত্তল বা কাংস্য পাত্রে দান করতে হয়, আর মৃতাকে জলদান করতে হয়।

পরি বলল, কালই তবে করব। ঘাটে এসে করতে হবে?

কার্তিক বলল, কাল কেন? কী সব বলছিস?

পুরোহিত বলল, বিবাহিতা কন্যার ক্ষেত্রে চতুর্থ দিনে।

—অবিবাহিতা হলে?

—সাত দিনেই হবে।

—ওঃ।

রণে ভঙ্গ দেয় পরি।

কিছুক্ষণ পর একটা মালসায় ধোঁয়া-ওঠা একটা ছাই-ঢাকা কালচে মাংস দিয়ে ডোম বলল, তোমার মায়ের নাভি।

গন্ধ পাচ্ছে পরি।

মায়ের গন্ধ কত দূর থেকে পেত। ঘরে এলেই বুঝতে পারত। এখনও চাদরে, শাড়িতে মায়ের গন্ধ লেগে রয়েছে। আর এটাও মায়ের পোড়া গন্ধ

প্লেটে করে ধোঁয়া-ওঠা চাউমিন নিয়ে আসত মা। এখন মালসায় ধোঁয়া-ওঠা-মা’কেই নিয়ে যাচ্ছে পরি। গঙ্গায় নাভি ভাসিয়ে স্নান করতে হবে। প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে আছে। সিঁড়ির ওপর। কার্তিকবাবুর হাতে একটা নতুন কোরা কাপড়, কাঁধে গামছা। প্রতিবেশীদের কে যেন একটা চাবিও জোগাড় করে সুতোয় বেঁধে দিয়েছে। কার্তিকের হাতে ঝুলছে সেই চাবি। পরির পরনে একটা ফুলপ্যান্ট এবং হাওয়াই শার্ট। ওকে এবার এসব খুলতে হবে। নাভি বিসর্জন দিয়ে গামছা পরে অবগাহন করতে হবে। তারপর ধরাচুড়ো পরতে হবে।

পরি হাতছানি দিয়ে চয়নকে কাছে ডাকল। চয়নের কাঁধ ধরে ওর কানে-কানে বলল, আমি কী করে সবার সামনে খালি গা হব?

চয়ন বলল, ওদের বলে দে মাথায় জল ছিটিয়ে বাড়ি গিয়ে ধরাচুড়ো পরবি।

পরি বলল, ওসবই বা কী করে পরে থাকব? গায়ে কী দেব?

চয়ন দাড়িটা চুলকে বলল, ওসব বাড়ি গিয়ে দেখা যাবে। এখন বলে দে যে, তুই স্নান করবি না। শরীর খারাপ করবে।

পরি যদি বলে, আমি এখন জামা খুলে খালি গায়ে স্নান করতে পারব না, সবাই হাসাহাসি করবে। যদি খালি গায়ে স্নান করে, তা হলেও সবাই হাসাহাসি করবে। অনেকের কাছে সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে।

পরি-র তেরো-চোদ্দো বছর বয়সের সময় ওর বুকটা ফুলে গিয়েছিল, একটু বড় হয়ে গিয়েছিল। পরে জেনেছিল, বয়ঃসন্ধির এই ব্যাপারটাকে বলে ‘গাইনিকোম্যাস্টিয়া’। বয়ঃসন্ধিতে শরীরে অনেক তোলপাড় হয়। নতুন-নতুন কেমিস্ট্রি সব। ওই সময় কিছুটা ইস্ট্রোজেন-ও তৈরি হয়ে যেতে পারে। তার প্রভাবেই ‘গাইনিকোম্যাস্টিয়া’ হয়। আবার কমেও যায়। পরি-র কমেনি। তাতে খুশিই হয়েছিল পরি। গত কয়েক বছর ট্যাবলেট খাচ্ছে ও। ওর বুকটা অন্য ছেলেদের মতো নয়, একটু বড়ই। আয়নায় দেখে বেশ লাগে। ওর বাড়ির প্রায় সবাই জানে এটা। প্ৰায় বস্তির মতো জায়গায় থাকে। ছেলেরা বাইরে স্নান করে, মেয়েদের জন্য ঘেরা স্নানঘর আছে। পরি তো ওই ঘরে স্নান করতে পারে না, বাইরেই করতে হয়, গায়ে গামছা ঢাকা দিয়ে ঘরে আসে।

আজ গঙ্গায় মা-র দেহাবশেষ ভাসাতে গিয়ে ঘাটের সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হল, কতগুলো মানুষ গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে আছে জলের ভিতরে একটা ইরোটিক শো-র প্রতীক্ষায় পরি সিঁড়ি বেয়ে সোজা ওপরে চলে আসে।

কি রে, ডুব দিলি না? নারায়ণী মাসি বলে ওঠে।

পরি মুখ ফিরিয়ে সমুদ্রের-দিকে-ভেসে-যাওয়া ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, না। ডুব দেব না।

গলাটা যতটা সম্ভব কঠিন করার চেষ্টা করে পরি।

সে কী? ডুব দিতে হয়। তোর বাবা কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওটা পরে আগুন ছুঁয়ে, লোহা ছুঁয়ে, দাঁতে নিমপাতা কেটে বাড়ি ঢুকবি। সব ব্যবস্থা করে রেখিচি যে…!

পরি যতটা সম্ভব পুরুষ হতে চেষ্টা করে। দু’হাত আড়াআড়ি রাখে, স্বামী বিবেকানন্দ-র ছবিতে যেমন। বলে, কে বলেছে ওসব ব্যবস্থা করতে? আমি ওসব মানি না। নারায়ণী মাসি বলে, এ কী অলুক্ষুণে কথা বলে, অ্যাঁ? তোর মা তোকে কত ভালবাসত, তোর মায়ের ওপর কর্তব্য নেই? মায়ের গতি করবিনে? তুই ছাড়া তোর মায়ের কে ছিল বল? একমাত্তর ছা। অ্যাক্সিডেনে মরেছে। অপঘাত মরণ। শাস্তরের যা নিয়ম আছে তা করতে হবে নে?

এমন সময় অনিকেত এসে পড়ে। পরি ফোনে জানিয়েছিল। অনিকেত দোটানায় ছিল। ভেবেছিল আসবে না। শেষ পর্যন্ত এসেই পড়ল। এবং এসে এসব শুনছিল, এবং ব্যাপারটা বুঝতে পারল।

অনিকেত বলল, কেন ওকে জোর করছেন সবাই? যদি নিমতলা শ্মশানে না-এনে কেওড়াতলায় নেওয়া হত, ওই নোংরা জলে ডুব দেওয়ার জন্য বলতেন?

ওই ভদ্রমহিলা অনিকেতের দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল। তারপর বলল, আপনি ক্যা? চিনছি না তো? ওর কে হন? তারপর আবার এমন তাকাল যেন অনিকেতকে ক্যাবলা করে দেবে। বলল, অ! চিনিচি। একদিন দুকুরবেলায় দেখেছিলুম তো মঞ্জুর ঘরে। রান্নাঘরের গ্যাস জ্বালিয়ে এমন মশগুল ছিল যে, আমি গ্যাস নিব্বে না-দিলে অ্যাক্সিডেন হয়ে যেত। আমি যাকে একবার দেখি, ভুলি নে…।

সবাই এবার গঙ্গার ধারের সিঁড়ির গ্যালারি থেকে অনিকেতকে দেখতে থাকল।

অনিকেত এবার সাহস অবলম্বন করল। বলল, হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছিলেন। একটা কাজে এসেছিলাম একবার।

—একবার এসেই এত?

চোখ নাড়িয়ে বলল ওই মহিলা।

পরি ততক্ষণে মাথায় জল ছিটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। ওর পাশে চয়ন। পরি শুর বাবার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। অনিকেতের কাছে এল। বলল, শেষ পর্যন্ত এলেন তা হলে কাকু…।

অনিকেত পরিমলের মাথায় হাত দিল। কার্তিক অনিকেতকে চেনে। মঞ্জুর জামিনের দিন আলাপ হয়েছিল। কার্তিক ওর এক হাতে একটা সাদা থান, অন্য হাতে একটা পলিথিন ব্যাগ ধরে ফ্যালফ্যাল দাঁড়িয়ে আছে।

পরি অনিকেতকে জিগ্যেস করল, এবার আমি কী করব কাকু?

বাড়িতে কেউ আছে? অনিকেত জিগ্যেস করল।

—বড় মাসি এসেছিল, এখনও আছে।

—ক’দিন থাকবেন উনি?

—আর দু-চারদিন হয়তো। একটা শ্রাদ্ধ তো করতে হবে…। না হলে টেকা যাবে না।

অনিকেত মৃদু মাথা নাড়াল শুধু। কার্তিক এসে অনিকেতের হাতে থান কাপড়টা ধরিয়ে দিল। আর প্লাস্টিকের ব্যাগ। বলল, এখানে আসন আছে, লোহা আছে। আমার কর্তব্য আমি করলাম। শ্রাদ্ধের দিনেও আমি আসব, খরচাপাতি যা লাগে দেব, শ্রাদ্ধ এই ঘাটেই হবে, ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে। বামুনভোজন-টা এই ‘বাবা তারকনাথ হিন্দু হোটেল’- এ করিয়ে দেব। পাঁচজন বামুন দরকার। ঠাকুরমশাই একজন, আর আপনিও থাকুন না, আপনি তো বামুন। অনিকেতকে বলল কার্তিক।

অনিকেত হ্যাঁ, না কিছুই বলল না।

—আর বাকি তিনজন আমি জোগাড় করে নেব।

এবার দু-তিনটে সিঁড়ি ওপরে উঠে হাতজোড় করে বলে, শ্মশানবন্ধুদের বলছি, আগামী তরশু দিন, শনিবার, আপনারা সবাই এই ঘাটে দুপুরবেলা আসবেন। আমার স্ত্রী মঞ্জুর আত্মার শান্তির জন্য ঘাটকাজ করব, আপনারা সবাই দুপুরে ভোজন করবেন।

কার্তিক এবার একটা হাত দিয়ে অন্য হাতটা ঘষে নিল। যেন হাতের ধুলো ঝেড়ে নিল।

প্রৌঢ়া মহিলাটি, যে মঞ্জুদের পাশের ঘরে থাকে, তাকেই যেন ‘আপন লোক’ মনে হল কার্তিকের।

বলল—আমার সঙ্গে কোনও কানেকশন রাখত না ওর মা, তবুও কর্তব্য করলাম। আর ওই ছেলেটার কথা কী বলব? আজব একখান চিজ, আপনারা সবই জানেন। ওর কাছ থেকে আমি কিছু আশা করি না। মঞ্জুকে যখন পুলিশে ধরে নিয়েছিল, ছুটে গিয়েছি। মরার পরও ছুটে এয়েচি। ওপরওলার কাছে আমি কিলিয়ার। কেমন কিনা?

নারায়ণী নামের ওই মহিলাটি বলল, আপনি আপনার ডিউটি করেচেন। কিন্তু ছেলে যদি ছেলের ডিউটি না-করে, আপনি কী করবেন আর আমিই বা কী করব। পাশের ঘরে থাকত মেয়েটা, ওর মনের কথা বলত। ছেলেটা বিচিত্তির হয়েছে। ছোটবেলাতেই যখন রং-ঢং করত—থাবড়া মারা উচিত ছিল, খালি থাবড়া। মায়ের মন, পারেনি। আপনি ঘরে থাগলে হয়তো অমন হত না। যাক, যা অদেষ্ট, যার কপালে যা নেকা।

কার্তিক ঘাড় নাড়ছিল, মাঝে-মাঝে জিভ দিয়ে ঠোঁটের কোনার ছোট্ট ঘা-টা স্পর্শ করছিল। ওরা উঠে এল। শ্মশানঘাটের কাছে সাধারণত ট্যাক্সি থাকে। পরি-র হাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট গুঁজে দেয় অনিকেত। সবার জায়গা হল না। চয়ন আর পরি উঠল। নারায়ণী আর একজন মহিলা। কার্তিক কী করবে বুঝতে পারছিল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু বিড়বিড় করল। তারপর সামনের সিটে উঠে বসল।

অনিকেত সেদিন হাসপাতালেই প্রতিজ্ঞা করেছিল, অনেক হয়েছে আর নয়। এই মঞ্জু, এবং ওর গুষ্টির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবে না। ও বলেছিল, শুক্লাকে বাঁচিয়ে দাও। কাকে বলেছিল? ভগবানকে? বহু দিন ভগবানের কাছে কিছু চায়নি ও। কিছু জানতেও চায়নি ঈশ্বরের কাছে। বরং জানতে চেয়েছে ইন্টারনেট-এর কাছে। কিছু প্রার্থনাও করেনি কত দিন। বিস্ময়ের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে, সেটাকে ‘ঈশ্বর’ বলে ডাকাডাকি করাটা বন্ধ করেছে বহু দিন। কিন্তু যখন ডাক্তার বলল, সেরিব্রাল স্ট্রোক, কিচ্ছু বলা যাচ্ছে না, তক্ষুনি অদৃশ্য-ঈশ্বর মাথার ওপরের ফ্যানটায় দুলে উঠলেন। হাসপাতালের সবুজ পর্দায় নড়ে উঠলেন, নার্সদের হিলতোলা জুতোর ঠকঠক শব্দে প্রকট হলেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার, স্যালাইন বোতলের তরল পদার্থ, সব কিছুর দিকে তাকিয়ে অনিকেতের ভিতর থেকে একটা প্রার্থনা উঠে এল : ওকে বাঁচাও। নীচে নেমে ইলেকট্রিক ও টেলিফোন তার এবং হোর্ডিং-এ আড়াল করা ঘোলা ধূলিধূসর আকাশটার দিকেও তাকিয়েছিল অনিকেত।

নীচে নেমে যতবার মঞ্জুকে দেখেছে, ততবার মনে হয়েছে ডাইনি। মনে হয়েছে, ওর জীবনের এই বিচ্ছিরি অঘটনের জন্য দায়ী ওই মহিলা।

মঞ্জুকে চোখের সামনে থেকে বিদায় করেছিল অনিকেত।

মঞ্জু যখন আর নয়নসম্মুখে ছিল না, তখন হৃদয়ের মাঝখানে ছিল অ-বিশ্বাস-করা, অ-জানা ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরই অনিকেতের সারা গায়ে থুথু ছেটাচ্ছিল। বলছিল, পাষণ্ড, তুমি সাধুপুরুষ? মঞ্জু ডাইনি? তুমি জিতেন্দ্রিয়? বানচোদ কোথাকার।

অনিকেত বলেছিল, হ্যাঁ ঈশ্বর, আমি তাই। আপনি যা বলবেন। সকলই আপনার ইচ্ছা স্যর। ওকে বাঁচিয়ে দিন।

ডাক্তারবাবু স্ক্যান এবং এমআরআই রিপোর্ট দেখে বলেছিল, মাথার বাঁ দিকে রক্ত জমে রয়েছে। বেশ কিছু ব্রেন সেল কাজ করছে না। ডান দিকে রিফ্লেক্স নেই।

মানে ডানদিক ‘পড়ে গেল’? তার মানে যদি শুক্লা বেঁচেও যায়, তা হলে ও ঠিকমতো হাঁটতে পারবে না, খাওয়াদাওয়া করতে পারবে না। শুয়ে থাকবে শুক্লা?

ঈশ্বর কোথায় বাস করেন কে জানে? কিন্তু শয়তান মানব শরীরেই থাকে। ঠিক শরীরে নয়, মনে। মনের গভীরে ওর বাস। শয়তানটা অনিকেতকে বলে, তুই শালা বুদ্ধ। ভগবানের কাছে কী সব ফালতু প্রেয়ার করছিস! বরং আমায় বল, আমি মেরে দি’। মধ্যবিত্তগুলোর এই হল ফ্যাচাং—ভগবানের কাছে কখনও কারও মৃত্যুকামনা করে না। করতে নেই। যে তোর শত্তুর, সব সময় তোর ক্ষতি করে যাচ্ছে, ভগবানের কাছে তখনও তোরা বলবি না, ওকে সাঁটিয়ে দাও ভগবান। যে-শালা একগাদা টাকা ধার নিয়ে বসে আছে, ওর পাওনাদার খিস্তি মেরে যাচ্ছে, সে-ও বলে না—ভগবান, পাওনাদারকে মেরে ফেলে আমাকে উদ্ধার করো। বল দেখি, পক্ষাঘাতে পড়ে থাকবে তোর বউ—সারা জীবন তোকে সেবা করে যেতে হবে, ঘরবন্দি হয়ে থাকবি, কোথাও যেতে পারবি না—সেটা ভাল, না কি…। অনিকেত কাকে নালিশ করবে আর? নিজেকেই করে, না কি ভগবানকে? দ্যাখো না… আমাকে কুমন্ত্রণা দিচ্ছে…

অনিকেতের এক বন্ধুর কথা মনে পড়েছিল। বন্ধুটির ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার, খুব ভাল বৈবাহিক সম্বন্ধ এসেছিল। ধনী পরিবারের মেয়ে। দেবে-থোবে ভাল। কিন্তু ওপরের দাদার বিয়ে না-হলে ছোট ভাইয়ের বিয়েটা হয় কী করে? পশ্চিমবঙ্গের বনেদি সুবর্ণবণিক সমাজ। তাড়াহুড়ো করে ফরসা দেখে একটি পাত্রী ঠিক করা হয়েছিল বন্ধুটির জন্য। বিয়ের পর বোঝা গেল মেয়েটির গভীর মানসিক গন্ডগোল আছে। স্কিৎজোফ্রেনিক। কিছু দিন পর বন্ধুটির মনে হল, ওর স্ত্রী’র স্তনে টিউমার হয়েছে। এবং ক্যানসার সম্ভাবনায় মনে হর্ষ উপস্থিত হচ্ছিল। এবং হর্ষ উপস্থিত হলেই অপরাধবোধে ভুগত। বন্ধুটি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে বুঝেছিল, ওটা টিউমার নয়, তারপরও মনে হত টিউমার হয়েছে। ওর ঘুম হত না। ওর মন দু’টো ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারত না। চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকত। অনিকেতকে বলেছিল, আমি কতবার গরম খুন্তি দিয়ে নিজের হাতে ছ্যাঁকা দিয়ে বলেছি : আর কখনও টিউমার ভাববি? তবু টিউমার ভাবতাম।

ওর স্ত্রী পরে মারা যায়। ইলেকট্রিক হিটার গোবর জলের ত্যানায় মুছে ‘শুদ্ধ’ করতে গিয়ে ইলেকট্রিক শক-এ। ও মুক্তি পেয়েছিল, কিন্তু অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পায়নি বহু দিন। এখনও তিন পেগ খেলেই বলে ‘আমার বউ অ্যাক্সিডেন্টে মরেছে বলে আমি খুশি হয়েছি। মার আমাকে।’

জামশেদপুরে বেশ কয়েকটা দিন থাকতে হয়েছিল অনিকেতকে। মাহাতো বলে ছেলেটাও দু’দিন ছিল অনিকেতের সঙ্গে। ওকে একটার-পর-একটা মিথ্যা বলতে হয়েছে। বলতে হয়েছে -শুক্লা খুব হাই প্রেশারের রোগী। যে আগের দিন এসেছিল, ও হল শুক্লার মামাতো বোন। দুই বোনে খুব ভাব। শুক্লা জানত, মঞ্জু আসবে। মাহাতো প্রথম-প্রথম দু-একটা পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, যেমন—ম্যাডাম কেন তবে অন্য ম্যাডামকে দেখে অবাক হলেন? আসলে মাহাতো শুক্লার সঙ্গেই এসেছিল। ও তো সবই দেখেছে। স্যরের ইন্টু-পিন্টু কেস’ আঁচ করতে পেরে এ নিয়ে পরে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। তবে সারাক্ষণ বলে গিয়েছে, ঘাবড়াইয়ে মাত স্যর, কুছ নেহি হোগা।

জ্ঞান ফেরার পর, শুক্লা অবাক চোখে তাকিয়েছিল অনিকেতের দিকে। অনিকেত নিজের চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। আর শুক্লা প্রথম কথা যেটা বলেছিল—তোমার কিছু হয়নি তো? কী বোকার মতো মাথা নাড়িয়েছিল অনিকেত, হাবার মতো।

তার কিছুক্ষণ পর শুক্লা বলেছিল, আমি হাসপাতালে। একটা প্রশ্নচিহ্নও ছিল যেন। যেন ‘কেন হাসপাতালে?’ প্রশ্নটা ভাঁজ করে রাখা ছিল।

অনিকেত তখন স্যালাইন স্ট্যান্ডের মতোই স্থির দাঁড়িয়েছিল।

এবার শুক্লা একটা ছোট্ট শব্দ উচ্চারণ করল—’বুঝেছি’।

কামানের গোলার মতো যেন একটা ছোট্ট নিরীহ শব্দ।

এরপর আর কিছু বলার ছিল না অনিকেতের।

এসব নিয়ে কোনও কথাই বলেনি শুক্লা। বাড়ি ফেরার পর, একদিনই শুধু কী একটা টিভি সিরিয়ালে পরকীয়া দেখতে-দেখতে বলেছিল—ওই মেয়েটা তো মঞ্জুই ছিল, না কি….

হ্যাঁ-হ্যাঁ, ওই তো ছিল। ও টাকা নিতে এসেছিল। ওর খুব টাকার দরকার ছিল। ছেলেটাকে ভর্তি করাবে, এদিকে চাকরি নেই… শুক্লা বাঁ হাতটা সামনে এগিয়ে হাতের পাঁচটা আঙুল ছড়িয়ে দিয়েছিল। মানে : থাক, থাক, ঠিক আছে।

ও ওর বাম হাতটাই ব্যবহার করতে পেরেছিল ওই শরীরী-নির্দেশের জন্য। ডান হাতটা পারেনি। কারণ ডান হাতটা কাজ করছিল না।

এসব খবর তো চাপা থাকে না, টেস্টি-টেস্টি খবর। কলকাতা অফিসের সহকর্মীরাও জেনে গেল। কেউ-কেউ ফোনে জিগ্যেস করতে লাগল, আপনার স্ত্রী না কি হঠাৎ আপনার কাছে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কী হয়েছিল?

একটি ‘সর্বজনীন বক্তব্য’ বা ‘প্রেস রিলিজ’ তৈরিই করে রেখেছিল, সেটা হল— — ওটাই, মাহাতোকে যা বলেছিল। কিন্তু ‘শালি’ শব্দটাই তো কালি লেপে দেয়। ‘শালি’ খুব প্রভাবশালী শব্দ। মাহাতোকে ‘বোন এসেছিল’ বললেই হত। হ্যাজব্যান্ডের বোন তো ননদ। ননদ-বউদিতে তো ভাব থাকতেই পারে। ‘শালি’ শব্দটা উহ্য রেখেই অফিসের লোকজন শুক্লার কথা জিগ্যেস করছিল। কিন্তু ব্যাপারটা যে বেশ ছড়িয়েছে, সেটা দু-একটা ফোন থেকেই বোঝা গেল। শোভন পাঠক ফোন করে কোনও ভনিতা না করেই জিগ্যেস করল, কী রাজা শালিবাহন? রানিমাতা এখন ঠিকঠাক আছে তো?

শুক্লাকে ফিরিয়ে নেওয়ার সময় বিকাশকে খবর দিয়েছিল। গাড়ি নয়, ট্রেনেই একটা স্লিপার নিয়েছিল। শুইয়ে হাওড়া, তারপর হুইল চেয়ারে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। বিকাশ না-এলে খুবই অসুবিধে হত। বিকাশের কাছে গোপন করল না অনিকেত। একজন তো চাই, যাকে সব বলতে হয়। নইলে তো গাছের কোটরে মুখ নিয়ে বলতে হয়। বিকাশ বলল, তোর কোনও দোষ নেই ডাবু। যা করেছিস বেশ করেছিস। কিন্তু যেটা হয়েছে, সেটা অ্যাক্সিডেন্ট। তোর কিছু করার ছিল না। শক পেয়েছে শুক্লা বউদি। কেন? শক পাওয়ার কী হল? তুমি তোমার সব কিছু বিসর্জন দিয়ে বসে আছ, এদিকে একটা ব্যাটাছেলে কি আঙুল চুষবে? আমার বউ ভেগেছে বলে কি আমি ও বিধবার মতো একাদশী করছি ভেবেছিস? এই কথাটা বলেই কিন্তু বিকাশ হঠাৎ থম মেরে যায়। বলে, বউ থাকবে কেন? খুনির কাছে কেন থাকবে? ও বলে, এই শোন, আমি একটা গেঁড়ে। আমার কোনও মতামত নেই।

বিকাশ অনেক রোগা হয়ে গিয়েছিল, মদ খাওয়া আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। দিনের বেলাতেও খেয়েছে।

কলকাতা এনে আবার নার্সিং হোম। এখনও ছুটিতে আছে। সেই যে এসেছে, আর ওখানে ফিরে যায়নি অনিকেত। হাসপাতালের অনেক কাগজপত্র জমে গিয়েছে। সেই সব কাগজপত্র গেঁথে ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্নাকাটি করে দরখাস্ত করেছে দিল্লিতে। ‘থ্রম্বোসিস’ গ্রাউন্ডে ট্রান্সফারটা হয়েই যাবে। দিল্লির নেতাদেরও ফোন করেছে। নেতারাও ‘আহা থ্রম্বোসিস ইশ থ্রম্বোসিস’ করেছে। আর ঘাপটি মেরে বসে থাকা শয়তানটা বলেছে, জয়, থ্রম্বোসিসের জয়।

মাসখানেক হয়ে গেল বাড়িতেই রয়েছে অনিকেত। কলকাতার অফিসেও খুব একটা যায়নি। বাড়িতে রান্নার লোক জোগাড় করে দিয়েছে কল্পনা মৈত্র। ছাদের ইস্কুলটা বন্ধ করেনি। শুক্লার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা খোঁজখবর নেয়। প্রথমে দু’বেলাই লোক ছিল শুক্লার দেখাশোনা করার জন্য, এখন একবেলা আছে। ফিজিওথেরাপি চলছে।

এর আগে মঞ্জুর ফোন এসেছিল কয়েকবার। একবার শুধু ‘ভাল আছে’ বলেই কেটে দিয়েছে অনিকেত। শেষ কয়েকবার ফোনই ধরেনি। ও মনে-মনে স্থির করে নিয়েছিল, আর কোনও ঝামেলায় জড়াবে না। মঞ্জুর সঙ্গে জড়ানোর কোনও যুক্তিই ছিল না। যদি কোনও সুন্দরী, প্রখর-যৌবনার সঙ্গে জড়াত, জড়িয়ে যেত, তারও কোনও একটা মানে হত। এই জড়ানোর কোনও মানেই ছিল না। ও ঠিক করেছিল, অ্যালুফ থাকবে ও, অ্যালুফ।

মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অ্যালুফ থাকা যায়? রাত্রি ন’টা নাগাদ ফোন পেয়েছিল অনিকেত। পরি- র গলা। মা আর নেই কাকু…।

—ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট। পুলিশ বলছে ‘সুইসাইড’। কিন্তু মা আমাকে ফোন করে বলেছিল, মালিকের বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ নাকি লোকজনদের জিগ্যেস করে জেনেছে—মা লাইনের ধারে দাঁড়িয়েছিল, তারপর একটা ট্রেন এলে…।

অনিকেত থানায় যায়নি। ওই রাত্রে শুক্লাকে ফেলে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। যত ভাবে, ঝুট- ঝামেলায় জড়াবে না, তত ঝুট-ঝামেলাগুলো মাছির মতো ওর কাছে ধেয়ে আসে।

সুইসাইড? আত্মহনন? কেন? ওর মধ্যেও কি পাপবোধ কাজ করছিল? অপরাধ বোধ? তা হলে তো পুলিশ কেস। তদন্ত। মোবাইল তো রয়েছে। মোবাইলে কি ওর নাম নেই? ওকে পাঠানো মেসেজ? যদি ‘টাওয়ার লোকেশন’ চেক করে, পুলিশ জানতে পারবে ওর কাছে গিয়েছিল।

এ তো মহা মুশকিল! সব প্রমাণ রয়ে যায়। প্রমাণ মুছে দেওয়া যায় না। তোমার মহাবিশ্বে প্রভু হারায় না তো কভু।

এবার পুলিশ যদি ডেকে পাঠায়? ডেকে পাঠালে বলবে, হ্যাঁ চিনি। যদি বলে আপনার কাছে গিয়েছিল? বলবে, হ্যাঁ গিয়েছিল। বেশ করেছিল। আপনার কী?

অনিকেত যায়নি। পরদিন ও একবারের জন্যও ফোন করেনি পরিকে। তার পরদিন মঞ্জুর চিঠিটা পায়।

সেই কাতর চিঠিটা। চিঠিটা একবার, দু’বার, তিনবার পড়ে। পড়তে-পড়তে প্রতিবারই বুক ভারি হয়। চোখে জল ছলছল করে। তারপর চিঠিটা ভাঁজ করে জামার বুকপকেটে ভরে। বুকের ভিতরে তুমুল রেলগাড়ি ছুটে যায়। সারা শরীর ঝিনঝিন করে। ছাদে যায় অনিকেত খামসমেত চিঠিটার শরীরে আগুন ধরায়। জ্বলছে। মঞ্জু জ্বলছে।

চিতা বহ্নিমান।

৫২

নারায়ণী মাসি পরি’কে বলল—শোন বাবা, তুই আমার ছেলের মতো। ছোটবেলা থেকে তোকে দেকচি। একটা কথা বলি, তোর মা সহ্য করেচে, আমরা কিন্তু সহ্য করব না। এখানে ওসব চলবে না। পরি-র এখন সাহস বেড়েছে। বলেছে, আমার ঘরের ভিতরে যা করব—সেটা আমার ঘরেই করব। রান্নাবান্না, পড়াশোনা, আর যা-যা করছি আমার ঘরে। প্রতি মাসে ভাড়া দি।

নারায়ণী মাসি বলল, ও বাব্বা, মাগীপনা করলে কী হবে, চোপা তো ভালই হয়েছে!

পরি বলল, মাগীরা মুখ করে না বুঝি? এ বাড়িতে তো তোমরা ডেলি ঝগড়া করছ। নারায়ণী বলল, দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতর কী হয় সবই বুঝি। নিতাইরা বলছিল, ওই দাড়িওলা ছেলেটাকে প্যাঁদাবে। কী দরকার অশান্তি করে? তাই ভাল কথা কইছিলুম।

পরি বলল, প্যাদাক না দেখি, নিতাইদাদের বলে দিও…!

এ বাড়িতে চার ঘর ভাড়াটে। মাঝখানে উঠোন। পরি-র বয়সের একজনই আছে নুপুর। ছোটবেলায় নুপুরের সঙ্গে পুতুল খেলেছে, রান্নাবাটিও।

নুপুর লেখাপড়ায় ভাল ছিল না, পরির ভাল রেজাল্ট। এ নিয়ে একটু দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তখন প্রায়ই আড়ি করত নূপুর। বলত, মেয়েদের মতো এক্কাদোক্কা খেলতে আসিস, লজ্জা করে না? বলত, এ মা, মেয়েদের মতো গামছা গায়ে দিয়ে চান করিস, লজ্জা করে না…। এখন কিন্তু নুপুরের সঙ্গে কথা হয়। নুপুর কিছুটা হয়তো বোঝে পরি’কে। মনের কথাও বলে। নুপুর একটা বিউটি পার্লার-এ কাজ করে। চার মাস কাজ শিখে কাজটা পেয়েছে। নুপুর বলেছে, পার্লারের মালিক বলেছে ‘মেসেজ’ শিখে নিতে। কোথায় শেখানো হয় বলে দিয়েছে। ‘মেসেজ’ শিখলে অনেক পয়সা। পরি বলেছিল, ‘মেসেজ’ নয়, ‘ম্যাসাজ’ বলিস। কিন্তু ম্যাসাজ-এ কী করে পয়সা হয় জানিস তো…।

নুপুর বলেছিল, জানি। এখন আমার আর কিছুতেই কোনও আপত্তি নেই।

নিতাইদা তো বছর খানেক আগে ‘বেশ বাগিয়েছিস তো’ বলে পরি-র বুকে হাত দিয়েছিল হঠাৎ। পরি কাউকে বলেনি। ওর মা’কেও নয়, বললে ওর মা বলত : তোরই তো দোষ, বেশ করেছে। নুপুরকেই বলেছিল পরি। নূপুর বলেছিল আমাকেও রে…। যা কিছু একটু ফোলা দেখলেই ওদের হাত নিশপিশ করে।

নিতাইদা পাশের বাড়িতে থাকে। পরি নারায়ণীকে বলল, নিতাইদাকে বলে দিও যেন পরের ধানে মই না-দেয়। পরি কখনও ধানে মই দেয়া দেখেনি। ধানে মই দিলে কী হয়, সেটাও জানে না। কিন্তু ওই কথাটার মানে জানে। এইসব প্রবাদ-টবাদ ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই বেশি ব্যবহার করে। পরিও।

নারায়ণী মাসি চোখটা বড়-বড় করে একবার পরি-র দিকে তাকাল, তারপর চলে গেল।

আইএফটি-তে ভর্তি হয়ে পরি-র মনে অনেক আত্মবিশ্বাস এসেছে। ওখানে পরি’কে সবাই ভালবাসে বেশ। পরিরও খুব ভাল লাগে।

‘আইএফটি’ মানে ইনস্টিটিউট অফ ফ্যাশন টেকনোলজি’। তিন বছরের কোর্স। দু’লক্ষ দশ হাজার টাকা কোর্স-ফি। বছরে সত্তর হাজার করে দিতে হয়। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে টাকাটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। এই ‘কোর্স’-টা শেষ হলে চাকরি পাবেই। নিজেও বুটিক খুলতে পারে, কনসালটেন্সি করতে পারে। মা দেখল না…। মা-এর মৃত্যুটাই এখানে ভর্তি করাতে পারল। ইনসিওরেন্সের টাকাটা না-পেলে কি সম্ভব হত এই কোর্সটা করা?

পুলিশকে নাকি একজন উইটনেস দিয়েছিল যে, মা নাকি লাইনের ধারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। অসাবধানে যদি অ্যাক্সিডেন্ট হত, তবে দাঁড়াবে কেন? ‘সুইসাইড’ হলেই সামনে দাঁড়ায়, কনসেনট্রেট করে…।

অনিকেত আঙ্কেল, মানে অনিকেত কাকুর জন্যই পুলিশ রিপোর্টটা ঠিকঠাক গিয়েছে, নইলে ইনসিওরেন্স থেকে টাকাটা পাওয়া যেত না। পুলিশ কি সহজে ছাড়ে? যদিও ওর মোবাইল ফোনটা কাছাকাছিই পাওয়া গিয়েছিল, ওখানে মেসেজও ছিল, ব্যাগটাও শরীর থেকে ছিটকে যায়নি যদিও মাথার খুলিটা ছিটকে গিয়েছিল, কোমর থেকে খুলে গিয়েছিল পা, ব্যাগে চিঠিও পাওয়া গিয়েছিল, তবুও পুলিশকে তো সন্তুষ্ট করতে হয়েছে। হয়তো প্রেসের লোক বলে কিছুটা সুবিধে পেয়েছে, কিন্তু ছুটোছুটি তো করতে হয়েছে। প্রথমে থানা পুলিশে পার ইনস্যুরেন্স অফিসে।

চেক-টা পাওয়ার পর অনিকেত আঙ্কেল বলেছিল, আমার কাজ শেষ, এবার আর আমাকে কোনও কিছুতে ইনভল্ভড কোরো না, যেমন করে পারো কোর্স-টা শেষ করো।

মায়ের সঙ্গে অনিকেত কাকুর কিছু একটা ছিল। নিশ্চয়ই ছিল। মা খুব অন্যমনস্ক থাকত, কথা বলত না বেশি। দিঘা থেকে ফিরে এসেই দেখেছিল, মা কীরকম যেন হয়ে গিয়েছে। ঠিকঠাক খাচ্ছিল না। পরিকে হঠাৎ করে যেন বেশি আদর করছিল। গায়ে হাত বুলিয়ে দিত, একদম বকত না। চাউতে চিকেন-সেদ্ধ মিশিয়ে দিত, আর বেশ কয়েকবার বলেছে অনিকেত কাকুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবি। মা মাঝে-মাঝেই বাইরে গিয়ে ফোন করত, আর ব্যাজার মুখে ফিরে আসত। একদিন বিছানায় মোবাইলটা ছুড়েই ফেলে দিয়েছিল, রাগ হলে ‘দুচ্ছাই’ বলে যেমন করে ছুড়ে দেয়। একদিন চুপিচুপি মোবাইলের ‘কল লিস্ট’-টা ঘেঁটেছিল পরি। ডায়াল্ড নম্বরে বারবার ভেসে উঠেছিল ডাবুদা। ‘ডাবুদা’ মানে তো অনিকেত আঙ্কেল। ডাবুদা ফোন ধরেনি। কখনও ‘কল ডিউরেশন’ দশ সেকেন্ড, বারো সেকেন্ড। ‘আমি এখন ব্যস্ত’ কিংবা ‘আমাকে বিরক্ত কোরো না’ বলতে যতটা সময় লাগে আর কী…। মা কি অনিকেত আঙ্কেলের কাছে টাকা চাইত? চাকরি চাইত?

অনার্স নিয়ে পাস করার পর মা তো বলেইছিল, এবার চাকরি দ্যাখ। স্কুলে অনেক লোকজন নিচ্ছে। পরি বলেছিল, ওসব জায়গায় টিকতে পারব না মা, সবাই প্যাঁক দিয়ে অস্থির করবে। বেশ কয়েকটা দৃষ্টান্ত জানা ছিল পরি-র। একজন তো সরকারি চাকরি পেয়েছিল পরীক্ষা দিয়ে। ইন্টারভিউয়ের সময়েই বুঝে গিয়েছিল ওর চাকরিটা হবে না। এবং হয়নি। ‘এফিমিনেট’ বলেই হয়নি। একটু ‘মেয়েলি’ বলেই হয়নি। শেষ পর্যন্ত একটা এনজিও-তে কাজ পেয়েছে, দুর্বার মহিলা সমন্বয়ে। ওখানে ও হ্যাপি। মেয়েরা ওকে মনের কথা বলে। ও না হয় তাও একটা জায়গায় কিছু করছে, কিন্তু পার্থ? ওকে তো সুইসাইড করতে হল। ও চাকরি করত একটা ছোটখাটো বেসরকারি অফিসে। একটু ‘ব্যাকিং’ ছিল, দু-একজনকে খুশি করে দেওয়ার ব্যাপারও ছিল। কিন্তু পারল না। চাকরিটা করতে পারল না শুধু নয়, বাঁচতেই পারল না। গলায় দড়ি দিয়েছিল ওই অফিসেই, কাগজে উঠেছিল। কাগজে যেটা ওঠেনি—সেটা হল সর্বক্ষণ বহুজনের কাছে ওকে শুনতে হত : চুষে দিবি? চুষে দিবি?

পরি দেখেছিল—ওর মতো যারা, তারা অনেকেই মেক আপ ম্যান হয়, কেউ নাচ শেখায়। আগে ওরা নাটকের নারী-চরিত্রে অভিনয় করত। চপল ভাদুড়ী তো এখনও বেঁচে আছেন, অভিনয়ও করছেন। যাত্রায় আগে মেয়েরা অভিনয় করত না। ওরাই করত—’আলকাপ’ দলে ‘ছোকরা’ বলে যাদের। একটু মেয়েলি, যারা নাচতে পারে, গাইতেও, ওরাই নারী-চরিত্রে অভিনয় করত। ‘আলকাপ’-এর অনেক মদ্দা ব্যাটাছেলে ওদের প্রেমেও পড়ত। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসে এসব লেখা আছে। কিন্তু আজকাল তো মেয়েরাই যাত্ৰা- থিয়েটারে অভিনয় করে। আলকাপ-টালকাপ প্রায় নেই। থাকলেও পরি-র পক্ষে সম্ভব নয়। কিছু এনজিও-তে কাজ করা যায়, কিন্তু ফ্যাশন কোর্স-এর বুদ্ধিটা দিয়েছিল চয়নদা-ই। বলেছিল, এই প্রফেশনে এখন অনেক ছেলেমেয়ে এবং ট্রান্সজেন্ডার-রা আসছে। ওখানে কেউ এসব ‘বদার’ করে না তুমি কীভাবে কথা বলছ, কেমন করে হাঁটছ, তোমার সেক্সুয়াল চয়েস কী—তা নিয়ে। চয়নদা বেশ কয়েকজন বড়-বড় ফ্যাশন ডিজাইনার-এর নাম বলেছিল, যাঁরা ট্রান্সজেন্ডার। যাঁরা অনেক টাকার মালিক। জ্যাক নোরা নামে একজনের কথা বলেছিল, যিনি নাকি বয়ফ্রেন্ড ফ্যাশন নামে একটা পেটেন্ট নিয়ে কোটি-কোটি ডলার কামাচ্ছেন। নামটা অদ্ভুত। ‘জ্যাক’ আবার নোরা। ‘নোরা’ তো মেয়েদের নাম, আর ‘জ্যাক’ ছেলেদের নামই হয়। আনন্দসুন্দরী আমাদের এখানে কেন নাম হয় না? আনন্দসুন্দর হয়। আনন্দ কি সুন্দরী হতে পারে না? আনন্দ পুংলিঙ্গ কেন? তবে হ্যাঁ, কৃষ্ণকালী ভট্টাচার্য নামে একটা নেম প্লেট আছে বটে। এটা কি কৃষ্ণ আর কালীর সম্মীলিত রূপ? না কি কালীর বিশেষণ হিসেবে ‘কৃষ্ণ’ শব্দটা এসেছে। কালো কালী। যাক গে। জ্যাক নোরা ‘বয়ফ্রেন্ড ফ্যাশন’-টা বানিয়েছিলেন। এটা মেয়েরাই পরে, কিন্তু আসলে ছেলেদেরই পোশাক। ছেলেদের জিন্‌স, পাজামা, টি-শার্ট সামান্য পাল্টে দেওয়া যাতে—কন্ট্যুর-টা বোঝা যায়। দেখে মনে হবে যেন বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে ধার করে আনা হয়েছে। বয়ফ্রেন্ড ফ্যাশনের পোশাকগুলোর সাইজ একটু বড়ই হয়। একটু যেন ঢিলে-ঢিলে, আসলে কিন্তু সুক্ষ্মভাবে ফেমিনিন টাচ থাকে। জিন্‌স-টা যেন কোমর থেকে পড়ে যাচ্ছে, নাভির তলায় নেমে গিয়েছে। অথচ পাছাটা-উরুটা বোঝা যাচ্ছে বেশ। শার্টেও ওরকম সুক্ষ্ম চাতুরি। এখন ব্যাপারটা বোঝে পরি। কিন্তু বয়ফ্রেন্ড ফ্যাশন, থ্রিপটিং, ‘অঁত কেওয়র’— এসব কথা চয়নের কাছ থেকেই তো জেনেছিল পরি। পরি বলেছিল, ওর মা-কে, এসব নিয়েই পড়াশোনা করবে। মঞ্জু খরচাপাতির কথা জিগ্যেস করেছিল, পরি তখন বলতে পারেনি, লজ্জায়।

পরি জানে, ওর মা নিশ্চয়ই বুঝেছিল এটা করতে অনেক খরচ। এজন্যই কি অনিকেত কাকুর কাছে টাকা চেয়েছিল মা? মোবাইলটা পুলিশ ফেরত দেওয়ার পর মেসেজগুলো দেখেছিল পরি। অনিকেত কাকুকে করা ‘প্লিজ হেল্প মি’ জমাটবাঁধা রক্তের মতো স্ক্রিনে ফুটে উঠেছিল। বোতাম টিপে নয়, হাতের আঙুল দিয়ে লেখাটা মোছার চেষ্টা করেছিল পরি, পরির মনে হয়েছিল, আঙুল—ওর আঙুলটা ভিজে গিয়েছে। অনিকেত কাকু শ্মশানে এসেছিল যদিও, তেমন কোনও কথা বলেনি। দুটো-একটা ব্যাপারে কেমন যেন প্রশ্নচিহ্ন লেগে আছে। গয়নার পুঁটুলি তে মা-র দুলটাও কেন রাখা ছিল—যে-দুলটা সব সময় মায়ের কানে থাকত, সেটা কেন খুলে রেখে গেল? ব্যাঙ্কের কাগজপত্র সব একটা খামে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছিল? কেন বেশি-বেশি করে আদর করত মা, আগে তো কখনও করেনি, কেন সেই কাবলি ছোলার ঘুগনি? সন্ধের সময় যখন লেবু চিপে পেঁয়াজ-কুঁচি মিশিয়ে ঘুগনি খাচ্ছিল- তখন মা টুকরো-টুকরো হয়ে আছে রেললাইনে।

থানা থেকে পরদিন ডেকেছিল। জিগ্যেস করেছিল আর কে আছে বাড়িতে? বাবা কেন একসঙ্গে থাকে না? ঝগড়া হত কি না? শেষবার কবে ঝগড়া হয়েছে?

পুলিশ বলেছিল, তোমার হাবভাব, চাল-চলনটা তো ভাল নয়, এ নিয়ে তোমার মায়ের দুঃখ ছিল না?

পরি বলেছিল—না।

পুলিশ বলেছিল, যদি বলি এই দুঃখেই তোমার মা আত্মঘাতী হয়েছে?

পরি বলেছিল, দুঃখ কেন হবে, আমি তো ভাল রেজাল্ট করি। মা বলত, কবে চাকরি-বাকরি করবি—সুখের দিন দেখব…

—বিয়ে দিয়ে নাতির মুখ দেখব বলত না? চোখ দিয়ে যেন শরীরটা চাটছিল থানার লোক। একটা ঢিলে শার্ট পরেছিল পরি। ওদের কি এক্স রে চোখ? খুব বিচ্ছিরিভাবে তাকাচ্ছিল। একটা আঁচল বা ওড়নার অভাব বোধ করছিল পরি।

কী করা হয়?

স্টুডেন্ট।

আর কী করা হয়?

ক-এর দীর্ঘ ই-কারটা লম্বা করে টেনে দিয়েছিল।

—আর কী করব?

—’ধুরানি’ মানে জানো?

এবার হেঁঃ হেঃ হেঃ শব্দ, সেটা ব্র্যাকেটে, শোনা যাচ্ছে না।

একটু কড়া চোখে তাকাল পরি, ও যতটা পারে আর কী। —হ্যাঁ, জানি।

এ নিয়ে আর ঘাঁটেনি ওরা।

—তোমার মা যে ট্রাভেল কোম্পানিতে কাজ করত, ওটার নামে তো বদনাম আছে, চিটিং কেস। তোমার মায়ের নামেও কেস আছে। ঝুলছে ওটা। ওটাও তো মেটেনি। ওসব নিয়েও নিজের ওপর ধিক্কার ছিল… পরি কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বলল—মায়ের কী দোষ? মা তো একজন সামান্য কর্মচারী…

—ওই জন্যই তো তোমার মায়ের দুঃখ। যাগ গে। টাকাপয়সা কি নিজের নামেই ছিল ব্যাঙ্কে, না কি তোমার সঙ্গে জয়েন্ট…।

—জয়েন্ট।

—যাক। বাঁচা গিয়েছে।

‘বাঁচা গিয়েছে’ শব্দটা ঠাস করে লাগল পরি-র গালে। পরি কপাল কুঁচকে তাকাল।

—ইনসিওরেন্স-এর পলিসি-টলিসি ছিল?

—ছিল তো একটা।

—এই সেরেচে। তবে তো ক্যাচাল কেস। পলিসিওলা-রা চাইবে যেন সুইসাইড দেখানো যায়। এখানে পুলিশের রিপোর্টটাই কিন্তু মেন। গুছিয়েগাছিয়ে লিখতে হবে আমাদের। বড় কেউ আছে? গার্জিয়ান? যে এসব ডিল করবে? তুমি তো…।

আবার পরি-র গায়ে দৃষ্টি ঘুরল।

বড় কে আছে ওর? কে ওর গার্জিয়ান? একবার ভগবানের কথা মনে হল। যাকে জানা যায় না, দেখা যায় না। ঘরের দরজার ওপর মা কালীর ছবি আছে। মা বেরনোর আগে রোজ হাতজোড় করত। ওই চিরকালীন জিভ বের করা উলঙ্গিনী মহিলা, হাতে কাটা মাথা। উনিই গার্জিয়ান? এরকম একজন গার্জিয়ান সত্যি-সত্যি হলে মন্দ হত না। দেখলেই এদের তড়পানি থামিয়ে দিত। হে মা কালী? যেন ঠিকঠাক হয়। কে ওর গার্জিয়ান? বাবা? বাবা না ল্যাবা? চয়ন? চয়ন কি গার্জিয়ান? বললে কি আসত? অনিকেত কাকু কি গার্জিয়ান? মা মরেছে, ব্যস। হাত ধুয়ে নিয়েছে।

সেবার রবীন্দ্রসদনের ঘটনাটা মনে পড়েছিল। পুলিশে ধরেছিল যখন, অনিকেত কাকুই তো এসে ব্যাপারটা ম্যানেজ করেছিল। বলেওছিল—আমি তোমার পাশে আছি। বলেছিল তো। কিন্তু সেই অনিকেত কাকুই তো বারবার মায়ের ফোন কেটে দিয়েছে। ‘প্লিজ হেল্প মি অক্ষরগুলো মায়ের মোবাইলের মধ্যে মন্দিরে লাগানো পাথরের মতো রয়ে গিয়েছে।

—আমরা পুলিশের লোক। জানি কী করে কেস সাজাতে হয়। তোমার মা যে ওই অ্যাক্সিডেন্ট-টা সাজায়নি, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। কেস-টা খুব প্ল্যান করে সাজিয়ে যে সুইসাইড করেনি—কে বলতে পারে? একটা সাক্ষী আছে—বলছে, লাইনের ধারে ঘোরাফেরা করছিল। দাঁড়িয়েছিল লাইনের ধারে। ওসব লিখে দিলেই ইনসিওরেন্স-এর টাকাটা ভোগে চলে যাবে।

হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়েছিল পরি। ওর ওই মাতৃশোকের মধ্যেই পুরোহিতের দেওয়া তিল- হরীতকী-বস্ত্র-শয্যা-ছত্র-পঞ্চগব্য-কুশ…লেখা কাগজের উল্টো দিকে হিসেব করে ফেলেছিল দু’লাখ ত্রিশ প্লাস এক লাখ প্লাস বোনাস, প্লাস দশ ভরি সোনা এক লাখ আশি হাজার…। ওর কোর্স-ফি ছাড়াও শরীরে সার্জারি করে নারীশরীর বানানোর জন্যও কিছুটা সংস্থান হ’য়ে আছে ইনসিওরেন্সের টাকাটা না-পাওয়া গেলে তো সব হিসেব ছারখার হয়ে যাবে।

সিনেমায় নায়িকার যখন হাত বাঁধা, তলায় আগুন জ্বলছে, ভিলেন বন্দুক তাক করে আছে, গুলিটা ছুড়তে যাবে, তক্ষুনি কাচের দরজা চুরমার করে বচ্চন-শাহরুখ-প্রসেনজিৎ-চিরঞ্জিৎ’রা ঢুকে পড়ে, ঠিক তেমন করেই সেদিন থানায় ঢোকে অনিকেত। পরি’কে দেখতে পেয়ে অনিকেত বলে, তুমিও আছ?

পরি অবাক হয়।

অনিকেত বলে এমনিই এসেছিলাম। থানায় একটু দরকার আছে। পুলিশের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলে—এই কেসটা যিনি দেখছেন, তার সঙ্গে একটু কথা আছে।

—সেই কথাই তো হচ্ছে। আপনি কে?

—আমি ওদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড।

বসতে বললে অনিকেত বসেছিল।

অনিকেত ওর মোবাইলটা বের করে। পুলিশের অফিসারের দিকে বাড়িয়ে দেয়। বলে এই মেসেজ’-টা পড়ুন।

—প্লিজ হেল্প মি।—তো?

অনিকেত বলে—এই যে ছেলেটা, পরিমল, ভাল স্টুডেন্ট, হায়ার এডুকেশন নিতে চায়। ওদের বাবা থেকেও নেই, ওর মা সামান্য চাকরি করত, সেটাও চলে গেল। আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। আমার স্ত্রী পক্ষাঘাতে পঙ্গু

—তো?

এই ইনফর্মেশনগুলো দিলাম, যদি আপনাদের কাজে লাগে। খুবই ডিস্টার্ব মাইন্ডে ছিল। একটা চাকরির জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিল। আমিও চেষ্টা করছিলাম ওর একটা কাজের জন্য। কিন্তু এর মধ্যেই অ্যাক্সিডেন্ট-টা হয়ে গেল।

—অ্যাক্সিডেন্ট তো? সুইসাইড-ও তো হতে পারে।

অনিকেত বলল, হতেই পারে না। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার কোনও ইচ্ছাই ছিল না ওর। একমাসের মধ্যেই ওর একটা চাকরি হয়ে যেত…

পুলিশ হাসলেন। অনিকেতের কথা থেমে গেল। পুলিশ বললেন, আরে সব খেলা মশাই, খেলা। এই দুনিয়াটাই খেলা। শেক্সপিয়র বলেছিল না—এই দুনিয়াটা খেলার মাঠ…। সবাই খেলতে এসেছি। ভগবান নিজেই খেলছেন। একটা গান আছে না, আমার মেয়ে গায়, খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে… আর কেসগুলোও হল অক্ষরের খেলা। দু-চারটে অক্ষর বসিয়ে দিলেই অ্যাক্সিডেন্টটার পাশে কোয়েশ্চেন মার্ক বসে যাবে। ভদ্রমহিলার একটা লাইফ ইনসিওরেন্স পলিসি আছে না?

অনিকেত বলল, ওসব খারাপ অক্ষর বসাবেন কেন। এজন্যই তো আমি এসেছি।

পরিমলকে অনিকেত বলেছিল, একটু বাইরে যাও। আমার সঙ্গে ওঁদের কথা আছে।

পরিমল বাইরের বেঞ্চিতে বসেছিল। একজন পাহারাদার পুলিশ ‘শুকতারা’ খুলে হাঁদাভোঁদা পড়ছিল। থানার সামনে উঠোন, ওখানে একটা মাঝারি বটগাছ, গাছতলায় শিব, ফুল, গাছে গায়েও ঢিল বাঁধা দড়ি, একটা ছাগল ঢুকে পড়ে শিবের মাথার ফুলগুলোয় মুখ দিল। গার্ড হাঁদাভোঁদা ফেলে ছাগলকে ডান্ডা প্রহার করল। ছাগল কি জানে, এটা থানা? ছাগলের বদলে যদি ষাঁড় আসত? ষাঁড় কি মার খেত? ষাঁড়কে কিচ্ছু বলত না। শিবের বাহন শিবের জিনিস খেয়েছে, বেশ করেছে।

কিছুক্ষণ পর অনিকেত ঘর থেকে বের হয়ে এল। পরি’কে বলল, চলি। আর কিছু নয়। পরি বলল, আমি এবার কী করব? অনিকেত বলেছিল, যা খুশি করো।

পুলিশ রিপোর্টটা ঠিকঠাকই ছিল। ঠিকঠাক করতে গিয়ে কী-কী তুকতাক করতে হয়েছিল পরি তার ডিটেল জানে না। ইনসিওরেন্সের টাকাটা একমাসের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল। অনিকেত সার্টিফিকেটের জেরক্স-টা চেয়েছিল, বলেছিল, বাড়িতে আসতে হবে না, ক্যুরিয়ারে পাঠিয়ে দিতে। দিয়েছিল। চেক-টা হাতে পেয়ে অনিকেতকে ফোন করে পরি বলেছিল, কী করে যে ধন্যবাদ দেব… অনিকেত কাকু বলেছিল—’ঠিক আছে, ঠিক আছে। ব্যস।’ এরপর অনিকেত কাকু আর ফোন-টোন করেনি। ওই যে, একটা শব্দ বলেছিল—’ব্যস’-এর মানে কি বোঝেনি পরি? ‘ব্যস’ মানে দিস ইজ দ্য এন্ড। ‘ব্যস’ মানে এনাফ ইজ এনাফ। ভর্তি হওয়ার পর একটা মেসেজ করেছিল—আজ অ্যাডমিশন নিলাম। আধঘণ্টা পর মেসেজের উত্তর এসেছিল—অল বেস্ট উইসেস। গো অ্যাহেড।

এরপর ফুল স্টপ। একটা কৃষ্ণগহ্বর যেন। ওটার মধ্যে ঢোকানো আছে ‘ব্যস’। পরি জানে।

.

তিন মাস হয়ে গেল, ক্লাস চলছে। স্টাইলিং অ্যান্ড ইমেজ ডিজাইন, ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ফ্যাশন ফোটোগ্রাফি, ফ্যাশন কমিউনিকেশন—এসব পড়ছে, জানছে।

সোনালি ম্যাডাম ফ্যাশন কমিউনিকেশন-এর ক্লাস নেন। প্রথম দিন বোর্ডে লিখলেন HAUTE COUTURE. কেন কে জানে, পরিকেই জিগ্যেস করলেন, বলো কী লিখলাম? পরি বলল হাউটে কুটার। ছোট্ট একটা হালকা হাসির শব্দ শুনেছিল পরি। ম্যাডাম বলেছিলেন—যারা এটা আগেই জেনে বসে আছো, তারা ভেবো না সব কিছু জেনে গিয়েছ। যারা জানে না, ওদের সম্মান করতে শেখো। সবাই জানবে। শিখবে। শেখার চেষ্টাটাই হল আসল কথা। ম্যাডাম ইংরেজিতেই বলেছিলেন। ম্যাডাম বললেন, দিস ইজ আ ফেঞ্চ ওয়ার্ড। উচ্চারণ হল ‘অঁথ কইওর’। ইংলিশ মিনিং–হাই কস্টিউম, কিন্তু সেই ‘হার্ড মিনিং’-টা এখন আর নেই। এখন ‘অঁথ কইওর’ বলতে বোঝায় কারও উপযোগী করে তৈরি করা, মানে কারও জন্য ‘স্পেশাল’ কিছু। এরপর লিখলেন pret-a-porter.

অন্য একজনকে জিগ্যেস করলেন ম্যাডাম। সে একটা মেয়ে। মাথার চুল হর্সটেল করা। কানে ঝুলন্ত দুল। ভ্রু-র ওপর পিয়ার্সিং করা। ও বলল প্রেতা পঁর্তে। র-ফলা একটু অন্যরকম করে উচ্চারণ করল। র-সাউন্ড-টার মধ্যে বেশ কায়দা ছিল। ম্যাডাম জিগ্যেস করেছিলেন, ডু ইউ নো ফ্রেঞ্চ?

ও কাঁধটা একটু শ্রাগ মতো করে বলেছিল, আঁ পে। হাতের আঙুলের মুদ্রায় বোঝা গেল অল্প-অল্প। পরি সত্যিই তখন একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। কোথায় এসে পড়ল রে বাবা! হংস মধ্যে বক নয়। ময়ূর মধ্যে কাক।

ম্যাডাম বললেন, ইয়েস, ‘প্রেতা পঁর্তে’ ইজ ভেরি কমনলি ইউজ্‌ড্। মানেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এর মোদ্দা কথাটা হল—যেটা সবার জন্য। স্পেশাল কিছু নয়। তেমন আলাদা করে বানানো নয়। মানে গড়পড়তা। ও বুঝল—ওই কাঁধ শ্রাগ করা মেয়েটা হল ‘অঁথ কইওর’, আর পরি হল, ‘প্রেতা পর্তে’।

মায়ের ছবিটাকে ‘অঁথ কইওর’ করে বানিয়েছিল পরি। শ্রাদ্ধের দিনে অন্য কোনও ছবি পায়নি। বিয়ের পর তোলা, পিছনে জমিদার বাড়ির বাবা-মা’র ভিতর থেকে শুধু মা-কে কেটে নিয়ে ছবিটা বানিয়েছিল। আর কোনও ছবি ছিল না তখন। সেটাই বড় করে বাঁধিয়েছিল। কার্তিক বাবু চেয়েছিল ছবিটা, পরি দেয়নি। শ্রাদ্ধের কাজটা ওই ছবিতে হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ওই ‘মা’ পরি-র অচেনা ছিল। মায়ের কাঁধে কার্তিকবাবুর হাত, মায়ের মুখে লজ্জা-লজ্জা হাসি, চোখটা সামান্য নত। মুখের মধ্যে বেশ একটা সুখচ্ছায়া। এই মা অচেনা। বরং ‘চেনা মা’ ছিল ভোটার কার্ডে। সেই বিচ্ছিরি ছবিটাকে বড় করিয়েছে। ফোটোশপ-এ নিজেই একটু-আধটু টাচ দিয়েছে। এই মুখে একটা দুঃখমেঘ রয়ে গিয়েছে। এটাই চেনা মা। এটাই ওর ‘অঁথ কইওর’। এই ছবিটায় মাঝেমধ্যে মালা দেয়। আজ দিয়েছে।

এখন ওর ঘর থেকে ক্যাপসিকাম, চিকেন, অজিনামটো, ব্রকোলি আর সয়া সস-এর সম্মিলিত গন্ধ বেরচ্ছে। রজনীগন্ধা আর ধুপ গন্ধ মিলে গিয়েছে এইসঙ্গে। বাইরে নারায়ণী মাসির গলা শোনে, মা-কে মেরে মায়ের টাকায় ফুটুনি। ছোঃ।

আজ স্পেশাল নুডুল্স বানাচ্ছে পরি। চয়ন আসবে। চয়নের জন্য একটা লম্বাটে ফতুয়া-র ডিজাইন স্কেচ করে রেখেছে। গলাটা একটু নামানো। বুকের রোমরাজির অল্প আভাস বোঝা যাবে তাতে। ট্রাউজারের সঙ্গে দিব্যি পরা যাবে, পায়জামার সঙ্গেও। পকেটে কনট্রাস্ট কালার। একটা লম্বা স্ট্রিপ জুড়ে দেবে ডান পাশে। দারুণ লাগবে ওকে।

এটা চয়নের স্পেশাল। ‘অঁথ কইওর’।

চয়ন এল।

ঘরে ঢুকতেই পরি চয়নকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমো খেল। চয়নও

মা দেখছে।

মা, আমার সুখ দ্যাখো। তুমি তো চেয়েছিলে যেন সুখী হই।

ওই অটোওলাগুলো, লরিওলাগুলো, ওরা স্নব—যারা লেখে সুখ স্বপনে, শান্তি শ্মশানে।

৫৩

চয়ন বলেছে, আমাকে একটু দাঁড়াতে দে, আর একটু মাল কামাতে দে, একটা ফ্ল্যাট কিনে নেব।

—তখন এরা দেখবে আর জ্বলবে, লুচির মতো ফুলবে।

পরি হাততালি দিয়ে বলল।

‘এরা’ মানে ওর প্রতিবেশীরা।

ব্যাঙ্কের পরীক্ষাটা দিলাম। যদি লেগে যায়, ব্যস। কোনও চিন্তা নেই, তোকে খুব ভাল করে রাখব।

পরি বলল, এটা ঠিক বললে না চয়নদা, রাখারাখি আবার কী? তুমি আমায় রাখবে? ‘রাখা’- টা তোমারই রাইট না কি? তোমাদের? আমি তোমায় রাখতে পারি না? পুরুষতন্ত্রের বাইরে বেরতে পারলে না চয়নদা।

চয়ন বলল, তুইও বেশি মাদিবাদী হয়ে হয়ে উঠেছিস দেখছি।

—আবার মাদি? শিট। বলেছি না—মাদি’ বলবে না!

—কেন? ‘মাদি’ বললে ব্যাকরণের ভুল হয় না কি? মাদি ছাগল, মাদি খরগোশ, মাদি হাঁস বললে দোষ হয় না…।

—আমরা তো জন্তু-জানোয়ার নই, মানুষ

—আচ্ছা ঠিক আছে, মানুষ। মানুষ তো কী হয়েছে? আমাকে ‘মদ্দা’ বল না, আমি রাগ করব? পুরুষতন্ত্রকে ‘মদ্দাতন্ত্র’ অনায়াসেই বলতে পারিস, পুরুষতন্ত্রের তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। খবরের কাগজে ‘ফিমেল এলিফ্যান্ট’ বোঝাতে লিখছে ‘স্ত্রী-হাতি’, কিন্তু ‘পুরুষ-হাতি বোঝাতে ‘মদ্দা’র কোনও বিকল্প নেই। দ্যাখ না, ‘মদ্দা’ শব্দটাই কেমন পুরুষালি। একটা ‘দ’- এর ঘাড়ে আর একটা ‘দ’ চেপে বসে আছে কেমন। অক্ষরবিন্যাসটাই পুরুষালি।

—এই ‘চেপে’ রাখতে পারাটা নিয়ে তোমাদের খুব গর্ব, তাই না চয়নদা?

—হ্যাঁ, তার কারণ তোরা ‘চেপে’ থাকতে চাস। ওটাই প্লেজার তোদের। আমাকে চয়নদা ডাকিস কেন? কতবার বলেছি চয়ন ডাকবি। চানু-ও ডাকতে পারিস। সব সময় জানাতে হবে আমি বয়সে ছোট। লুলুপুলু ভাব।

পরি এবার চয়নের হাতে ছোট্ট একটা চিমটি কেটে দেয়। যদি সুযোগ থাকত, চয়নের দাড়িময় গালে পুচ করে একটা চুমু খেয়ে ফেলত। ওরা বসেছিল সল্টলেকের সিটি সেন্টারে। কিছু দিন হল চালু হয়েছে। কত সব রেস্তোরাঁ। কতরকম দোকান। কাফে। ওসব জায়গায় ঢোকার পয়সা নেই ওদের, বাইরে বসেই আড্ডা দিচ্ছে ওরা। অনেক ছেলেমেয়ে এই চত্বরে বসে গল্প করে। পরি-র কলেজটাও কাছেই। কলেজের পর চয়ন মাঝে-মাঝে চলে আসে। সত্যি বলতে কী, পরি-ই চয়নকে আসতে বলে। ওখানে ভাঁড়ে চা নেই আশেপাশে। সস্তা বলতে টি- জংশন। চায়ের কাপ দশ টাকা। ক্যাফে কফি ডে-তে দাম আরও বেশি। তবু এখানেই আসতে বলে, কারণ, ওদের কলেজের অনেকে এখানে আসে। আড্ডা মারে। দেখুক ওর একটা স্টেডি লাভার আছে।

পরি বলল, মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘তুমিই বলো মার্কস’ পড়লাম। মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে?—দারুণ, না?

—এতদিন পরে পড়লি? দারুণ লাগল? কেন? মেয়েরা বুঝি বিপ্লবের সেবাদাসী হতে পারে না? কেন পারে না? বিপ্লবের সেবাদাস ছেলেরাই কেন হবে শুধু? পুরুষ, নারী, না-পুরুষ, না-নারী সবাই বিপ্লবের সেবা করবে।…শোন, ভাল কথা। একটা বিপ্লব হতে যাচ্ছে। জানিস আইপিসি ৩৭৭ ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে একটা মামলা করেছে। নাজ ফাউন্ডেশন। দিল্লি হাই কোর্ট মামলাটা নেয়নি, নাজ ফাউন্ডেশন সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে। জানিস বিক্রম শেঠ “থ্রি সেভেনটি সেভেন’-এর এগেনস্টে দারুণ আর্টিকেল লিখেছেন একটা। মুম্বইতে গে’রা মিছিল করেছে।

—এখন আর ‘গে’-টে নিয়ে অত ইন্টারেস্ট নেই আমার। আমি ‘গে’ নই। আমি মেয়ে। আমি নারীবাদী। নারীবাদী কাজকর্ম নিয়েই আমি বেশি উৎসাহ ফিল করছি। পবন রঞ্জন বাসবদের সঙ্গে আমার আর তেমন লিঙ্ক নেই। রতনের সঙ্গে একটু আছে। একটা কবিতা লিখেছি চয়নদা, আচ্ছা আচ্ছা, চয়ন, শুনবে?

অর্ধেক আকাশ বলো?—সে আকাশ মেঘে ঢাকা আছে
মেঘের বিদ্যুৎভাণ্ড জেগেছে, এবার জেগেছে
বজ্রপাত হবে।
তোমাদের ব্যর্থ বীর্যপাত ধুয়ে যাবে বাজ-ভাঙা জলে
বলছে আদম পুত্র, তুমি এবার ভোলাবে কী ছলে?

চয়ন বলল, জোর করে নারীবাদী হতে হবে না। তোর জামার ভিতরে ম্যানা’টাকে ওষুধ খেয়ে একটু ফোলাতে পেরেছিস বলে নিজেকে একেবারে মেয়েছেলে ভেবে ফেলে মেয়েছেলে নিয়েই কবিতা লিখবি শুধু? তোর সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটার কথা ভাব, যে-কবিতাটা শুনে তোর সঙ্গে যেচে আলাপ করেছিলাম—ওটা তো কোনও নারীবাদী কবিতা ছিল না। লাইন দু’টো আজও মনে আছে :

কাগজের নৌকো আমি, নেমেছি জলে ভেঙেছি বাঁধ।

যদিও বামন, চুম্বন করি চাঁদ।

বাঁধভাঙা জলে কাগজের নৌকোটার ছবি ভেসে উঠেছিল। ভাল কবিতা। নিজেকে মেয়ে বলে জাহির করার জন্য জোর করে ওসব লিখতে হবে না।

—জোর করে লিখছি কে বলল? নিজের ভিতর থেকেই তো আসছে।

—যদি সত্যি-সত্যি ভিতর থেকে আসে তো ভাল কথা। কিন্তু আমরা তো পুরুষবাদী কবিতা লিখি না। একসময় ‘ওয়ার পোয়েট্রি’ লেখা হত। ওগুলো ‘মেল পোয়েম্স’। পুরুষবাদী কবিতা যদি বলি—মেয়েদের রূপ নিয়ে। যৌবন নিয়ে। নারীশরীরের যন্ত্রপাতি নিয়ে। নারীবাদী কবিরা বাঁবি নিয়ে লেখেন না কেন? তুইও তো লিখতে পারিস।

—’বাঁবি’ মানে?

—আরে ছেলেদের যন্ত্রপাতির কথা বলছি। আরও দু’টো অক্ষর—মানে দুটো সাউন্ড অল্টারনেটিভলি ঢুকবে।

ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল পরি-র। বুঝে—কী অসভ্য’ বলে আড়চোখে চয়নের দিকে তাকাল।

এই চাউনিটা চয়নের ভালই লাগল। আশ্বস্ত হল, আইএফটি-র হাই-ফাই ব্যাপার পরিকে এখনও বেশি পাল্টাতে পারেনি।

সন্ধে নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ হল। ওরা ওঠে। পরি এখন বাইশ তেইশ। চয়নের ত্রিশ-বত্রিশ। এমএ পাশ করেছে বাংলায়। এমএ সেকেন্ড ক্লাস। তাও পঞ্চাশ পার্সেন্টের কম। অনার্সেও ওরকমই ছিল। কলেজে চাকরি জোটার কোনও আশাই নেই। বিএড দিয়েছে। স্কুলের চাকরির জন্য এসএসসি চালু হয়েছে। দু’বার বসেছে চয়ন, হয়নি। চয়ন বলে, পার্টির লোক ছাড়া চাকরি হওয়া মুশকিল। পার্টির কিছু লোকজনের সঙ্গে আলাপ আছে, ওরা নিচু লেভেলে। প্রকৃতপক্ষে ওরাও চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেদের জন্য। চয়ন বলে আমি হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু তোর ওই কবিতাটা আমাকে আবার এন্ধু দিল। একটা কাগজের নৌকো বাঁধ-ভাঙা জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, বামন চাঁদের গায়ে চুমু খাবে খাবে, কচুরিপানা-ভরা পচাপুকুর নীল-নীল ফুল ফুটিয়ে জলপরিদের, ফুলপরিদের ডাকে। আবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে চয়ন। ব্যাঙ্কের পরীক্ষা দিতে পারছে না, অঙ্কে কাঁচা, কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। আরও দু-একটা পরীক্ষা দিয়েছে। একটা চাকরি জোগাড় করতেই হবে। নইলে নোটবই লিখবে। মলাটে লেখা থাকবে কোনও বড় অধ্যাপকের নাম। এখনও টিউশনি করে।

চয়ন মল্লিক জমিদারের বাচ্চা। স্কুলে ওর নাম ছিল চয়নেন্দ্রনাথ। ওর এক দাদার নাম নয়নেন্দ্রনাথ। ছোট ভাইয়ের নাম জয়েনেন্দ্রনাথ। কোনও মানেই হয় না। ওর বাপ এসব নাম লিখে দিয়েছিল ইস্কুলে। ও নিজেকে চয়ন মল্লিক বলেই পরিচয় দেয়। ওর দাদা নয়ন, ভাই জয়। চয়নের বাবা হারীন্দ্র পারিবারিক বিগ্রহের গয়না বেচে দিয়েছিল, জ্ঞাতিরাই পুলিশে ধরিয়ে দেয়। পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, এবং জেলেই হার্ট অ্যাটাক। চয়নের পিতামহের ঔরসে কিছু দুলে-বাগদি রমণীর গর্ভে সন্তান উৎপন্ন হয়েছিল। ব্যাপারটা নিয়ে তখন হইচই হয়নি। দুলে- বাগদি’রা যেমন পুকুরপাড়েই থাকত, তেমনই থাকত, তবে কোলে-কাঁখে কয়েকটা তীক্ষ্ণনাসা গৌরবর্ণ সন্তান। কিন্তু ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার আসার পর ওই নিয়ে হট্টোগোল হয়, এবং দেশের বাড়ি ছোট জাগুলিয়ার বেশ কিছু জমি ওদের নামে লিখে দিতে হয়। তখন অনেক দুলে-বাগদি-বাউড়িই জমি বাগিয়ে নিয়েছিল। চয়নের বাপ-কাকা-জ্যাঠারা বাধ্য হয়েছিল লিখে দিতে। চয়নের প্রপিতামহ-ই জমিদারিটা বাগিয়েছিলেন। সাহেবদের নেটিভ মেয়ে সাপ্লাই করতেন। এরকম এক পরিবারের ছেলে চয়ন। বিধস্ত জমিদার বাড়িটা রয়েছে শশীভূষণ দে স্ট্রিটে। ঝুল বারান্দা ভেঙে পড়েছে। গাছ গজিয়েছে বেশ কয়েকটা। বাড়িতে কাঁকড়াবিছে আছে, কার্নিশে ভেলভেটের মতো সবুজ শেওলা। একটা মাথা-ভাঙা পরির গলার সঙ্গে সিংহর ল্যাজের দড়ি বাঁধা আছে, ওখানে লুঙ্গি-সায়া-ম্যাক্সি শুকোয়। ওই বাড়িটায় এখন এগারো- বারোটা ভাগ। যেসব শরিক বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনে অন্যত্র সরে গিয়েছে, তারাও অংশ ছাড়েনি। চয়নের মা মারা গিয়েছিলেন ছোটবেলায়। শুনেছে স্টোভ বার্স্ট করে। মামারবাড়িতে বড় হয়েছে। কিন্তু মামারবাড়িতেই শুনেছে, ওর মা’কে পুড়িয়ে দিয়েছে ওর বাবা। চয়নের বাবা আবার বিয়ে করেছিল। চয়নের একটা সৎ ভাই, আর একটা সৎ বোন আছে। মামার বাড়িতেও বেশি দিন থাকতে পারেনি। দাদু, মানে মায়ের বাবার মৃত্যুর পর, মামাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল, চয়ন কার কাছে থাকবে, এ নিয়েও ঝগড়া। চয়ন আবার ফিরে এল ওর বাড়িতে। তখন ওর বয়স বারো-তেরো। চয়ন ওর নতুন মায়ের সঙ্গে কথা বলত না। মা বলে ডাকতেই ইচ্ছে করত না। কিন্তু কী ডাকবে? মাসি? কাকিমা? বাবার হুকুমে ‘মা’ ডাকতে হত। ব্লেড দিয়ে কত দিন ওর মায়ের সায়া কেটে দিয়েছে। বডিজ-এর ফিতে কেটে দিয়েছে। ওর মা শরিক বউদের সঙ্গে ঝগড়া করেছে। বাবার নতুন বউয়ের এক ছেলে, এক মেয়ে। দু’চক্ষে দেখতে পারত না চয়ন। বাবা ওদের নিয়ে ঠাকুর দেখতে যেত, চয়ন যেত না। ওর বাবার একটা ব্যবসা আছে। একটা ছোট্ট কারখানা, প্লাস্টিকের চিরুনি, চামচ, এইসব হয়। কী একটা আইসক্রিম কোম্পানির জন্য চামচ বানায়, আইসক্রিম কাপের সঙ্গে যে-চামচ দেয়। এরকম একটা বাড়ির ছেলে চয়নেন্দ্র। কী করে যে কবিতা-ভূত চাপল, এটা বড় রহস্যের। পড়ত জুবিলি ইস্কুলে। বাড়িতে বইপত্র কোথায়? কী একটা খুঁজতে গিয়ে তাকের পিছনে পেয়েছিল কয়েকটা ‘যৌবন সুধা’ আর ‘পুষ্পধনু’ পত্রিকার কয়েকটা সংখ্যা ব্যস। ব্যাকরণ বইটাই দায়ী। ওখানে ভাবসম্প্রসারণ করার জন্য কবিতার লাইন দেওয়া ছিল। ‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে’—নিজের মতো করে লিখেছিল চয়ন, বাংলার স্যর রাজেনবাবু খুব প্রশংসা করলেন, গায়ে হাত বুলোলেন। এখনও ভাল কিছু লিখে ফেললে রাজেনবাবুর হাত চয়নের পিঠে লাগে।

পাড়ার লোকজন চয়নকে ভালবাসে। পাড়ার লোকদের মতে, এই ছেলেটা কোনও মেয়েকে দেখে হিড়িক দেয়নি, কোনও ছোঁকছোঁকানি নেই। খুব ভাল ছেলে।

পরি চয়নের কাঁধ খামচে তর্জনী উঁচিয়ে চাঁদ দেখাল। উজ্জ্বল-উচ্ছল নিওন-হ্যালোজেন- সিএফএল ছাড়িয়ে সল্টলেকের আকাশে চাঁদ। পরি বলল, চলো হাঁটি।

চয়ন বলল, এই যে আলো, তোর মুখে পড়েছে, এর মধ্যে কিন্তু চাঁদের আলোও মিশে আছে।

পরি বলল, এই চাঁদ তোমার-আমার। হিহি।

হিহি-টা হল নিজের ন্যাকমিটা বুঝিয়ে দেওয়া। চয়ন পরি-র দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল।

পরি বলল, চয়ন, তুমি অরূপদা হবে না তো?

চয়ন পরি’র হাত চেপে ধরল। বলল, সেসব কোনও চান্স নেই। আমার বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে যাবে না।

—আর গার্লফ্রেন্ডগুলো?

—ধুর। কোথায় গার্লফ্রেন্ড দেখছিস? যাদের সঙ্গে কথা-টথা বলি—ওদের প্রতি কোনও অ্যাট্রাকশন আছে নাকি আমার, ধুর, ওইসব পিত্তলপুত্তলি। ওদের আছেটা কী? বলো না…।

— তাই?

—তাই তো।

—আচ্ছা চয়নদা, ওকে, ওকে চয়ন, একটা কথা জিগ্যেস করছি। সত্যি কথা বলবে তো?

—কেন বলব না? অবিশ্বাস করছিস?

—না, আসলে এই প্রশ্নটা তো কখনও করিনি তোমায়, খুব পার্সোনাল প্রশ্ন কিনা, বলছি, তুমি কখনও কোনও মেয়েকে ‘করেছ’?

চয়ন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল—একটা এক্সপেরিয়েন্স হয়েছিল আমার, খুব বাজে। খুব খারাপ লেগেছিল। ওদিকে আমার ইন্টারেস্ট নেই। তা ছাড়া দ্যাখ—শুধু তো ‘সেক্সুয়াল অর্গান’ দিয়েই রিলেশন তৈরি হয় না। তোকে আমি অ্যাডমায়ার করি, ভালবাসি। অনেক কারণ আছে। চল, এবার বাসেটাসে উঠি।

একটা বাসে উঠল ওরা। চয়ন উল্টোডাঙা নেমে গেল। ওর টিউশনি আছে, আটটা থেকে। বাসে পরি একা।

রবীন্দ্রনাথের ওই গানটায় ‘চয়ন’ শব্দটা আছে—

আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন আকাশে
আকাশ কুসুম করেছি চয়ন হতাশে…।
চয়ন কি আকাশকুসুম?
বাসের জানালা দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছিল।
আকাশকুসুম
ও চাঁদ চুমু খাবো—যদিও বামন।

৫৪

মন্টুর বেশ কিছু দিন ধরে কাশি হয়েছে। প্রথম-প্রথম নুনজলে কুলকুচি করেছে, তুলসী পাতা চিবিয়েছে, কমেনি, তারপর ডাক্তারও দেখিয়েছে। কমেনি। মন্টুর এখানে ভাল লাগে না। একদম ভাল লাগে না। দমবন্ধ অবস্থা। ওর সেই খাজাইতলা-ই ভাল ছিল। নাবাল জায়গা দিয়ে হাঁটলে কচুরিপানাগুলোর ফটাস-ফটাস কী সুন্দর, কী সুন্দর বাঁশপাতা, ঝরাপাতা, ছাগল ডাকছে, পুকুরের জলে ঝাঁপাচ্ছে বাচ্চারা, মুখে খড় নিয়ে উড়ছে শালিক, পায়ে আলতা দিচ্ছে কোনও ঠাকমা, একটা বাচ্চা চাল ছড়াচ্ছে, আর ইহি-ইহি হাসছে…। খাজাইতলায় ওর জ্যাঠা- খুড়োরা আছে। ওর-ও তো অংশ আছে। ছেড়ে দেবে?

জেঠিমা বলেছিল, ভিটেটা তুই ছাড়বি কেন? জেঠিমা মানে গাঁয়ের জেঠিমা নয়, শুক্লা জেঠিমা।

বলেছিল, একটা ব্যবস্থা করে দেবে। ও বাড়ির তো পাট চুকল, কিন্তু ওসব কিচ্ছু হল না। এই কাকুর কাছে ও-কথা একবার তুলেছিল। এই কাকু বলেছে ‘গুলি মার’।

এই কাকুটা ছিটেল। কখনও-কখনও প্যাকেট করে ভাল-ভাল খাবার নিয়ে আসে। নরম- নরম, কালো-কালো মুরগির মাংস। চিলি চিকেন। কখনও বিরিয়ানি। দু’জনে মিলেই খাওয়া হয়। কাকুটা হুইস্কি দিয়ে খায়। মন্টুকেও দু-একবার গেলাসে ঢেলে দিয়েছিল। একচুমুক- দু চুমুকে কিছু বোঝা যায় না। তারপরই কেমন যেন লাগে। মনের মধ্যে বোশেখ মাসের কালো মেঘ জড়ো হয়, কাঁদতে ইচ্ছে করে। এই জীবনটা নিয়ে কী যে করি, কী যে করি মনে হয়।

এই কাকুটাকে যত ভাল ভেবেছিল, তত ভাল নয়। ওর ছবি তুলে থানায় দিয়ে এসেছে। ওর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে এসেছে। ওকে বিশ্বাস করে না। আলমারির চাবি সব সময় আগলে – আগলে রাখে। যখন পায়খানা যায়, চানে যায়, ওটা সঙ্গে নিয়ে যায়। আগের জেঠুটা এরকম করত না। দরজার একটা চাবি ওর কাছেই থাকে। কিন্তু সেই চাবি দিয়ে কাকুর ঘরে যাওয়া যায় না। ওই ঘরের চাবি কাকুই সঙ্গে নিয়ে যায় সব সময়। কী করবে ও কাকুর ঘরে গিয়ে? নরম বিছানা? না কি ভাবছে চুরি করে বোতল খাবে?

বোতল খেতে যাবে কেন? কোন দুঃখে? বোতল খেলে দুঃখই পায় শুধু। খায় না। কাকু দিলেও খেতে চায় না, তাই আজকাল আর দেয় না। বোতল খেলে মনে হয়—হিজড়ে হয়ে যাবে। ওদের দলে চলে যাবে। ওদের সঙ্গে নাচবে, গাইবে, ঠাট্টা-ইয়ার্কি করবে, মস্তি জীবন। এই জীবনে কী আছে?

এর চেয়ে ও-বাড়ি ভাল ছিল। অনেক ভাল ছিল। ওই অনিকেত কাকু বলেছিল গ্র্যাজুয়েট পাস হলে বিউটিশিয়ান কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেবে। তা হলে ভাল-ভাল পার্লারে চাকরি পাওয়া যেত।

কিন্তু ওরা রাখল না। কেন রাখবে? বালিবাজি ধরা পড়ে গেল যে। বাট্‌লিবাজিতেই যত দোষ। যদি চিটিবাজি ধরা পড়ত, তবে এত দোষ হত না।

কতবার ভেবেছিল আর করবে না। কিন্তু ঠিক নুনে নুন হয়ে যায়। কোত্থেকে জুটে যায়, কয়েকবার ধরা পড়ে গেল। কাকিমা রাখবে কেন?

এই লোকটা তো চাকর বানিয়ে রেখেছে। চাকর প্লাস রাঁধুনি। চাকর প্লাস রাঁধুনি প্লাস ম্যাসিওর না কী বলে…গা-হাত-পা টেপার লোক। প্লাস…। কী পড়াশোনা করছে, স্কুলে যাচ্ছে কি না—ওসব কিচ্ছু খবর রাখে না।

.

এরই মধ্যে মাধ্যমিক পাস করেছে মন্টু। বছর নষ্ট হয়েছে যদিও, এখন ইলেভেন। আর্টস পড়ে। আগে শুক্লা কাকিমা খোঁজখবর করত, বই কেনার টাকা দিত। দেখা করতে যেত কিনা মন্টু, গেলে খুশি হত। এখন আর টাচ নেই। অসুখ করেছে। একদিন দেখতে যেতে হবে। একাই যাবে। এখন ক’দিন খুব শরীর খারাপ যাচ্ছে। খুব কাশি। ভাল হলে যাবে। বারো ক্লাস পাস করে তারপর কী করবে মন্টু? বিএ পড়বে? পড়াবে? তারপর? কোথাও কি পিওনের চাকরি হবে? ছোট-মোটো কোনও চাকরি? বিকাশকাকু কি কোনও কাজের ব্যবস্থা করে দেবে? কে জানে? চাকরি হলেও কি করতে পারবে ও? সবাই প্যাঁক দেবে না? নার্স হওয়া যায় না? মেয়েরাই কেন নার্স হয় শুধু? ছেলেরাও তো নার্স হতে পারে। সেবা করা। সেবা পরম ধর্ম। সেবা করতে তো ভালোই লাগে। খাইয়ে দাও, স্নান করিয়ে দাও, ঘুম পাড়িয়ে দাও…।

এখানে এই বিকাশকাকুর ঘরে সন্ধের সময় মাঝেমধ্যেই আসর বসে। ওর বন্ধুরা বলে, তোর মাইচা-টা কোথায়, ওকে একটু সোডা আনতে বল, বরফ আনতে বল।

বন্ধুরা ওকে নিয়ে ঠাট্টা করে, মশকরা করে। মাইচা-লন্ডা-হিজড়া কত কী বলে। একজন বলেছিল, একটু নেচে দেখা তো। সোহাগ চাঁদবদনী ধনি নাচো তো দেখি। একজন বলেছিল আইসক্রিম খাস? আইসক্রিম? সাদা মনে কাদা নেই। ও ঘাড় কাত করে বলেছি, হ্যাঁ…। তখন চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন—কাপের আইসক্রিম না কাঠির আইসক্রিম? কাঠির আইসক্রিম চুষতে বেশি ভাল লাগে, তাই না? এসবের মানে তো ও জানে।

তিন-চারবার রান্না করার মাসি পাল্টেছে এই কাকু। সবগুলোই পাল্টেছে তা নয়, দু’জন ইচ্ছে করে ছেড়ে গিয়েছে। বিকাশকাকু হাত ধরে টানাটানি করেছে। ভাল কথায় এটাকেই বলে শ্লীলতাহানি। এসব কথা তো কাগজে ওঠে না, থানাতেও ওরা বলে না। এসব ঘটনা রাস্তার কর্পোরেশনের কলে এমনি-এমনি জল পড়ে যাওয়ার মতো হতেই থাকে। আর মন্টুদের বেলায়? প্রশ্নই নেই। ওদের শ্লীলতাহানি বলে কিছু নেই। বিকাশকাকুর ওই ঠেকের এক বন্ধু একদিন দুপুরবেলায় এসে মন্টুর মুখে ঠেসে ধরল যন্তর। চোষ, চোষ না, টাকা দেব। ও করেনি। বলেছিল, কাকুকে বলে দেব। লোকটা বলেছিল, বলিস। আমি বলব, তুই আমাকে ডেকেছিলি। তুই তো বিকাশের আইসক্রিম টা খাস। খাস না?

এসব কথা ও রাঁধুনিদের বলে। যারা ছেড়ে গিয়েছে, তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল শান্তি। ওকে মাসি বলত না। দিদি বলত। মন্টুর চেয়ে খুব বেশি বড় না। মন্টু ওকে মনের কথা বলত, শান্তিদিও। শান্তিদি বলত, এই বাড়ির কর্তার নজর খারাপ। আমি সব নজর চিনি। বলত, আমি যখন সকালে এসে রান্না করি, বাবু তোকে বাজারে পাঠায়, বাবু রান্নাঘরে আসে, গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, বলে কী রান্না করছ দেখছি, বলে, আমায় রান্নাটা শিখিয়ে দেবে? দেখি তো ভাজা মাছটা উল্টোতে পারি কি না। কাঁধে হাত দিয়ে মাছ উল্টানোর তাল করে। ন্যাকা। ভাজা মাছ উল্টোতে জানে না।

ওর বাড়ির কথাও বলত, একটা ছেলে হয়েছে, এখন দু’বছর। বলেছে ভাল করে মানুষ করবে, আর বাচ্চা করবে না। মন্টুকে বলে, কন্ডোম ছাড়া এক্কেবারে করতে দিই না।

মন্টুর কাছে লজ্জা ছিল না শান্তিদির। দু’বছরের বাচ্চা এখনও মাই খায়। এখন দুধ নেই, তবু চুষবে। ছেলে তো, হিহি।

বিকাশ অফিসে বেরিয়ে যেত ন’টা-সোয়া ন’টা। মন্টু বেরত আরও পরে। রান্নার দিদি- মাসিরা দু’বেলার রান্না করত। ন’টার মধ্যে হত না। বিকাশ অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরও, কিছুক্ষণ ওরা থাকত। তখনই গল্পগুজব হত।

শান্তিদি একদিন সকাল থেকেই বলছিল—সারা গা চুলকোচ্ছে রে মন্টু, পাঁচিলের ওপর শাড়ি-ব্লাউজ মেলে দি, ওখানে কী একটা গাছে শুঁয়োপোকা হয়। ব্লাউজে বোধহয় শুঁয়ো ছিল। বাবু থাকলে চুলকোতেও পারছি না।

বিকাশ চলে গেলেই বাথরুমে ঢুকেছিল শান্তি। সামনে গামছা চাপা দিয়ে উদলা গায়ে বেরিয়ে এসেছিল। বলছিল, পিঠটা পারছি না রে, খুন্তি দিয়ে ভাল করে ঘষে দিবি?

মন্টু বলেছিল, ওতে শুঁয়ো যায় না। চুন দিতে হয়। আমি জানি। চুন শুকিয়ে গেলে চেঁছে ফেলতে হয়, তা হলে শুঁয়ো বেরিয়ে যায়।

—চুন এখন কোথায় পাবি? শান্তি বলেছিল।

—ময়দা দিয়েও হয়। মন্টু ময়দার কাঁই করে পিঠে মাখিয়ে দিয়েছিল। কী সুন্দর পিঠ। মাঝখানে একটা দাগ। ব্রা-এর। যেন ওদের খাজাইতলার খালের ওপরের বাঁশের সাঁকো। ময়দা লেপে দিয়ে দুষ্টুমি করে একবার সামনে হাত দিয়েছিল মন্টু। শান্তি বলেছিল, অ্যাআই…। ওটা ধমক না। মন্টু জানে। মন্টু শান্তির ভরাট বুক ছোঁয়, বুক-মাখা হাতটা নিজের বুকে মেখে নিয়েছিল।

ফ্যানের হাওয়ায় শুকিয়ে গেলে ভেজা গামছা দিয়ে ময়দা মুছে দিয়েছিল মন্টু। শান্তি বলেছিল, তুই কত কী জানিস রে। এখন শান্তি।

একটা রোববার মন্টুকে কচুরি আনতে পাঠিয়েছিল বিকাশকাকু। তিনজনের জন্য দশটা। শান্তি চারটে, আমরা তিনটে করে। আর জিলিপি। বলেছিল, গরম ভাজিয়ে আনবি। ফিরে এসে দেখে খুব মুখ করছে শান্তিদি। বলছে—দরকার নেই কো এই দশদিনের মাইনে। এমন ছোটলোকের বাড়িতে আর আসব না। ইজ্জত নেই? গরিব বলে কি ইজ্জত নেই আমাদের? এই চললুম। হনহন করে বেরিয়ে গিয়েছিল শান্তিদি।

আর একজন ছিল বিলাসিনী। আর একটু বেশি বড়। মন্টু তখন নতুন এসেছে। প্রথম-প্রথম বিকাশকাকুকে মন্দ লাগত না। ওর জন্য মায়া হত। ছেলেটা মরে গিয়েছে, সেই দুঃখে বউটাও নেই। ভিতর থেকে একটা ‘আহা রে আহা রে’ ভাব আসত। অফিস থেকে মাঝে-মাঝে টাল হয়ে বাড়ি ফিরত। ফিরে এসে ঢকঢক জল খেত। শুয়ে পড়ত বিছানায়—জামাকাপড় না ছেড়েই। দু’আঙুল দিয়ে কপালের রগ টিপে ধরত।

মন্টু বলত, মাথা টিপে দেব কাকু?

—দিবি? তবে তো ভালই হয়।

মাথা টিপে দিত, চুল টেনে দিত। এরপর পাও টিপে দিত। তারপর হাত-পা-গা-পিঠ সব। লুঙ্গিটার গিঁট আলগা করে দিত…।

বিকাশ বলত, তুই খুব ভাল মন্টু। ডাবু আমাকে একটা ভাল ছেলে দিয়েছে। আমি ওর কাছে গ্রেটফুল। তোর কাছেও রে মন্টু, তোকে না-পেলে আমি মরে যেতাম। ঘরেই আসতাম না রোজ। রাস্তাঘাটে পড়ে থাকতাম। তুই আমাকে বাঁচিয়েছিস।

এরপর বিলাসিনীকে দিয়েও গা-হাত-পা টেপাত। দরজা বন্ধ করে দিত। খুব হিংসে হত মন্টুর। বন্ধ দরজার গায়ে কান লাগিয়েছে মন্টু। ‘আর একটু আর একটু’ শুনেছে। ‘…ইস নোংরা জায়গা’ শুনেছে, “অনেক হয়েছে আর না’ শুনেছে বিলাসিনীর গলায়। ‘তুমি একটু সাবান-টাবান মাখো না কেন’–শুনেছে বিকাশকাকুর গলায়। এরকম আরও। বিলাসিনীর নিজের জন্য করা চায়ে জল ঢেলে দিয়েছে মন্টু, ও দুপুরে খেত। ওর বাড়া ভাতে ছাই দিতে ইচ্ছে করত, ছাই কোথায় পাবে, নুন দিয়েছে ডালে। খাবার সময় বলেছে, এত নুন তো দিইনি ডালে, উনি তো খেয়ে গেলেন। কে দিল? ক্যা?—

মন্টু চুপ করে থেকেছে।

বিলাসিনীকে তাড়াতে হল, ও কেবল মাইনে বাড়ানোর কথা বলত বলে। বিলাসিনী বলত, এই টাকায় সব কিছু হয়? বিকাশ বলত কেন? কত তো বাড়িয়েছি। মাঝে-মাঝেই তো এক্সট্রা টাকা ধরে দি।

‘এস্পেশাল’ কাজের জন্য ওই টাকায় হয়? এক্সট্রা কাজ করলে মাসে এক হাজার বাড়াও, নয়তো প্রতিবার তিনশো করে দাও, নইলে আমি আর পারব না। বিলাসিনী ‘তুমি’ করে বলত, যেন বয়ফ্রেন্ড। মাইনে বাড়াল বিকাশ।

মন্টু বলেছে, কেন, ওর এত মাইনে বাড়াচ্ছেন কেন? বড্ড খাঁই ওর।

একবছরের মধ্যে যখন তৃতীয়বার মাইনে বাড়াতে বলল, বিকাশ রাজি হল না।

মন্টুর খুব শান্তি হয়েছিল।

যখন একজন চলে যায় আবার কেউ আসে, মাঝের গ্যাপগুলোয় রান্নাবান্নার কাজটা মন্টুই করে। মন্টু নিজেকে মনে করে বাড়ির গিন্নি। দুপুরে একা শোয়, পাজামা পরেই, মনে হয় যেন কাজকর্ম সেরে ম্যাক্সিটা গায়ে দিয়ে একটু শুল, সন্ধের আগেই আবার উনুন ধরাতে হবে। একা থাকলে কখনও যেন চাবির ঝুনঝুন বাজে, যে-চাবি আঁচলে থাকে। খবর কাগজওলাকে বকতে খুব ভাল লাগে—যেদিন দেরি করে কাগজ দেয়।

এখন কোনও রান্নার লোক নেই। গত পনেরো দিন হল। কিন্তু এখন সেই মজাটা পাচ্ছে না মন্টু। কারণ ওর শরীরটা ভাল লাগছে না। জ্বর-জ্বর লাগছে। কাশিটা কমছে না। কাশির সঙ্গে মনে হল যেন রক্ত।

কাশির সঙ্গে রক্তর কথা বলল ওর বিকাশকাকুকে। বিকাশ শুনেই বলল, সে কী? কাশির সঙ্গে রক্ত? গাঁড় মারিয়েছে। তোকে আর রান্না করতে হবে না। দেশে চলে যা।

—দেশ? ওরা তো থাকতে দেবে না।

—কবে থেকে রক্ত যাচ্ছে?

—আজ সকালে দেখলাম।

—কাশছিস কত দিন?

—এক-দেড় মাস হয়ে গেল।

মহা ঝামেলা বাঁধাতে পারিস। কাল যাব ডাক্তারের কাছে।

ডাক্তারবাবু বেশ কিছু টেস্ট লিখে দিলেন। রক্ত পরীক্ষা, এক্স রে, হাতের চামড়ার তলায় কী একটা ইনজেকশন দিয়ে দু’দিন পর আসতে বললেন। এই টেস্ট-টার নাম বেশ মজার। ওর নামে টেস্ট। মন্টু টেস্ট। কে জানে কেন?

পরে জানতে পারল—মন্টু নয়, মান্টু টেস্ট ওটা।

ডাক্তারবাবু বললেন—যা ভয় পেয়েছিলেন সেটা নয়। টিবি নয়। থ্রোট ইনফেকশন। ইএসআর-টা একটু বেশি আছে বটে, সব ইনফেকশনেই থাকে। কমে যাবে। অ্যান্টি-বায়োটিক দিয়ে দিচ্ছি।

দশ-বারো দিন পরেও কমল না। ডাক্তারবাবু ওষধু পাল্টে দিলেন, গার্গল করার জন্য একটা ওষুধ দিলেন। ক’দিন কম, কিন্তু আবার শুরু হল।

কাশি, কেমন যেন লালা বেরিয়ে আসে গলা থেকে। একটু লালচে। যেন রক্ত।

কাকুকে আর জ্বালাতন করতে ইচ্ছে করল না। একদিন হাসপাতালে গেল। টিকিট করে বসে রইল। ডাক্তার দেখল দু’ঘণ্টা পর। হাঁ করতে বলল। টর্চ দিয়ে দেখে বলল, টনসিল পেকেছে। ওষুধ লিখে দিল।

মন্টু দেখল, অ্যামক্সিসিলিন লিখেছেন ডাক্তারবাবু।

মন্টু বলল, এই ওষুধ তো খেয়েছি।

ডাক্তারবাবু বললেন আরও খেতে হবে।

বিকাশ তো মহা মুশকিলে পড়ল। ছোঁড়ার কাশিটা কমছে না। ক’দিন কমে তো আবার হয়।

বিকাশ অনিকেতকে ফোন করল। বলল, তোর তো অনেক চেনাজানা ডাক্তার আছে, একটা ভাল ডাক্তার দেখিয়ে দে।

মন্টুর ধারাবাহিক কাশির কথাটা জানাল বিকাশ

অনিকেত বলল—এসব ঝুটঝামেলা আর নেব না আমি। আমি আছি নিজের প্রবলেমে। ফিজিওথেরাপিতে শুক্লা তেমন কিছু ইমপ্রুভ করছে না। কথা একদম জড়ানো। কী বলে বোঝা যায় না। কানেও শুনতে পায় না ভাল। অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফিরে আসি আমি। আমি আর কোনও ঝামেলায় নেই।

বিকাশ বলল, ঝামেলায় তো তুমিই আমাকে ফাঁসিয়েছ গুরু। জাস্ট একটা ডাক্তার দেখিয়ে দাও। ভাল ডাক্তার। ওকে বাঁচাতে হবে তো?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, একজন ইএনটি দেখিয়ে দিচ্ছি প্রথমে।

পেশেন্টকে নিয়ে আসতে বলেন ডাক্তার ইন্দ্রনীল সেন। অনিকেত বিকাশকে দিনক্ষণ জানায়। মন্টুকে সঙ্গে করেই নিয়ে যায় বিকাশ। মন্টু অনেক দিন পর জেঠুকে দেখল। জিগ্যেস করল কেমন আছে-টাছে। অনিকেত তেমন কিছু জিগ্যেস করল না। কী হয়েছে তাও না। নাম ডাকলে চেম্বারে ঢুকল ওরা তিনজন। ডাক্তার গলাটা দেখলেন। ওদের মাথায় কোহিনুরের মতো একটা আয়না থাকে। গোল আয়না। ওই আয়নার আলো গলায় পড়ে। হাতে টর্চ ও থাকে। কাগজপত্র দেখলেন ডাক্তারবাবু। বললেন, বাব্বা। সবরকম অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়ে গিয়েছে দেখছি। অ্যামক্সিসিলিন, অ্যারিথ্রোমাইসিন, এমনকী ডক্সিসিলিন-ও ঠুসে দিয়েছে। আর চেস্ট ক্লিয়ার। স্ট্রেঞ্জ!

আবার ভাল করে দেখলেন।

বললেন, আপনারা বেরিয়ে যান, ওর সঙ্গে একটু প্রাইভেট কথা আছে।

মিনিট তিনেক পরে বেল বাজল। ওরা ফিরে এল। বলল, আর একটা টেস্ট করাব।

অনিকেত নিজের একটু বিদ্যে জাহির করার জন্য বলল, ব্রঙ্কোস্কপি?

ডাক্তারবাবু বললেন, না, একটা সোয়াব টেস্ট করাব। আমিই গলা থেকে নিয়ে নিচ্ছি, আমিই ল্যাবে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনাদের কোনও টেনশন নেই।

দু’দিন পর ড. সেন অনিকেতকে ফোন করে জানাল সোয়াব টেস্টের রেজাল্ট পেয়েছি। নিসেরিয়া গনোরি পাওয়া গিয়েছে, গনোরি। গনোরি বুঝলেন তো?

—গনোরিয়া?

— হ্যাঁ।

—গলায়?

—হ্যাঁ, গলায়। ওরো-জেনিটাল কনট্যাক্ট। চিন্তার কিছু নেই, পেনিসিলিন দিলেই কমে যাবে।

—মানে?

—মানে ওর গলায় গনোরিয়া। কোন জননাঙ্গ থেকে ইনফেকটেড, মানে সংক্রামিত হয়েছে। ওর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি ওর সাক করার হ্যাবিট আছে। মেল জেনিটালিয়া। বিকাশ যেন শক্ পায়। চুপ করে থাকে। ডাক্তারবাবু টেলিফোনের ওধার থেকে বলতে থাকেন—ও যার পেনিস সাক করে, তার গনোরিয়া আছে। অনিকেত আঁতকে ওঠে।

ভয় পায়। ওর তবে গনোরিয়া আছে? মন্টু কি ডাক্তারবাবুকে বিকাশের নাম বলে দিয়ে দিয়েছে নাকি! ডাক্তারবাবু বলতে থাকেন—

যিনি তার জেনিটেলিয়ায় গনোরিয়া পুষছেন, তিনি কিন্তু কোনও মহিলার কাছ থেকেই পেয়েছেন। তিনি নিশ্চয়ই একাধিক নারীসঙ্গ করেন।

অনিকেত লক্ষ করে—ডাক্তারবাবু হঠাৎ তিনি-তিনি’ করেছেন।

অনিকেতের যেমন আশ্চর্য লাগে। একটু মাথা ঘুরছে যেন। গলায় গনোরিয়া? এটা বিকাশ অর্জন করেছে বাইরের কোনও মেয়েছেলর কাছ থাকে এবং সেটা এখন মন্টুর গলায়?

অনিকেত জিগ্যেস করে, সেই পুরুষটিরও তো তবে গনোরিয়া হয়েছে, তার অসুবিধা হচ্ছে না কিছু?

ডাক্তার সেন বলেন–হয়তো হচ্ছে না তেমন, লেটেন্ট আছে, কিংবা একটু-আধটু হচ্ছে, উনি ইগনোর করছেন। দুনিয়া বড় বিচিত্র। ছেলেটির সঙ্গে আমার একটু পার্সোনাল কথা হয়েছিল, আপনাদের সরিয়ে দিয়ে ওকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করেছিলাম। ওই ভদ্রলোকটি কে? যে আপনার সঙ্গে এসেছিল? দুর্বল স্বরে অনিকেত বলল, আমার রিলেটিভ, রিলেটিভ, বন্ধুর মতো…।

ফোনের ডায়াল টিপে কড়া স্বরে অনিকেত বিকাশকে বলল, ছিঃ, তুই মন্টুকে দিয়ে চোষাস? অ্যাঁ? রাসকেল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *