৪৫
আসলে, এই বাড়িটা একটা এনজিও-র ভেনু হয়ে গিয়েছে। এই যে লেখাপড়া শেখানো, ছাত্র জোগাড় করা—এসব শুক্লা একা করতে পারেনি। কল্পনা মৈত্র নামে একজন ভদ্রমহিলার অবদান। এখন ইচ্ছে হলেই হয় না। কেউ যদি ভাবে ‘দরিদ্রনারায়ণ ভোজন’ করাবে— সল্টলেকে—দরিদ্রনারায়ণ পাওয়াই যাবে না। বিনে পয়সায় সংস্কৃত শেখাতে চাইলেও ছাত্র পাওয়া যাবে না। সাক্ষরতা দিতে চাইলেও সাক্ষরতা নিতে আসার লোক যে থাকবেই, সেরকম কোনও গ্যারান্টি নেই।
কল্পনা মৈত্র-র সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল শুক্লা। ছোট-ছোট চুল, ভ্রু ছাঁটা, স্লিভলেস—। ইনি এই অঞ্চলে ফ্ল্যাট কিনে নতুন এসেছেন। শুক্লার সঙ্গে আলাপ এখানেই, একটা বাজারে। তিনটে বাচ্চাকে জিলিপি খাওয়াচ্ছিল শুক্লা, শুক্লা নাকি বলছিল : যত খুশি খা… তাই দেখেই ওঁর মনে হয়েছিল এঁকে দিয়ে হবে…।
জিলিপির ব্যাপারটা শুক্লা বলেছিল, তিন-চারটে বাচ্চাকে নিয়ে একটা লোক মাদারি-কা- খেল দেখাচ্ছিল। এই অঞ্চলে এখনও একটু-একটু ফাঁকা জায়গা ফ্ল্যাটবাড়ি হওয়ার অপেক্ষায় রয়ে গিয়েছে। ওখানেই খেলা দেখাচ্ছিল। দু’টো বাঁশের ওপর দড়ি খাটিয়ে একটা চাকার ওপর কী সুন্দর ব্যালান্সের খেলা দেখাচ্ছিল একটা বাচ্চা মেয়ে। একটু দেখলাম। তারপর অন্য কাজ সেরে ফিরছি, দেখছি—একটা চায়ের দোকানের সামনে লোকটা চা খাচ্ছে, আর বাচ্চাগুলো দাঁড়িয়ে আছে, পিছনেই জিলিপি ভাজা হচ্ছে। আমি হঠাৎ ওদের জিগ্যেস করি, জিলিপি খাবি? প্রথমে ওরা কিছু বলে না। অবাক চোখে তাকায়। আবার বলি, তিনটে ঘাড়ই একসঙ্গে বেঁকে যায়।
কল্পনা বলেন—তখনই যেচে আলাপ করি।
শুক্লা বলে—আচ্ছা, যে তিনটে মেয়েকে দিয়ে লোকটা খেলা দেখাচ্ছিল, তিনটেই কি ওর মেয়ে?
কল্পনা বলেন, আই ডোন্ট নো। পসিবলি নো। ওর নিজেরও দু-একটা হতে পারে। তবে ওরা জোগাড় করে। অন্যদের থেকে নেয়, ট্রেনিং দেয়, গার্জিয়ান’কে টাকা দেয়। তবে ওদের একটা ‘ক্ল্যান’ আছে। ওরাই এসব করে।
শুক্লা বলে, বড় হলে ওই মেয়েগুলোর কী হবে?
কল্পনা ঠোঁটটা উল্টে বলেন, তা-ও জানি না। কত কিছুই যে জানি না…
কল্পনা মৈত্রর এনজিও-টার নাম ‘আলো’। পুরো নাম হল ‘অ্যাডিশনাল লিটারেসি অফারিং’। বিভিন্ন ধরনের লিটারেসি প্রোগ্রাম আছে ওঁদের। রেড লাইট এরিয়াতেও কাজ করে। ওদের আলাদা প্রাইমার।
অনিকেতের মনে হল, ওটা আবার কেমন? ‘ক’-এ কনডোম না কি?
প্রথম আলাপে অতটা প্রগলভ হল না। তবে কল্পনা নিজে থেকেই বললেন, ক’এ কাকাতুয়ার চেয়ে কাক ওদের কাছে কাছের। চেনা। ছোটবেলা থেকেই ওরা ‘খদ্দের’ বোঝে। ‘গ’-এ গান। গান করতে বলি, যে যেমন পারে। লেখাপড়াটাকে এন্টারটেনমেন্টের মধ্যে মিশিয়ে দিতে পারলে—সেটা আনন্দদায়ক হয়ে উঠে। আর ‘লিটারেসি’ মানে তো শুধু অক্ষর-জ্ঞান নয়, নাম সই করতে পারা নয়, একটা পজিটিভ ভ্যালু তৈরি করে দেওয়া।
অনিকেত ফান্ডিং-এর কথা জিগ্যেস করেছিল। ভদ্রমহিলা ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন।
বললেন, সামান্য কিছু আসে এধার-ওধার থেকে। শুক্লা কিছু টাকাপয়সা পায় না।
অনিকেত বলেছিল, ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হল সাসা মাল। পয়সাকড়ি ঠিকই ম্যানেজ করছেন। অথচ তুমি কিছুই পাচ্ছো না।
শুক্লা বলল, আনন্দ পাচ্ছি কিন্তু। নানারকম আনন্দ। গরু সম্পর্কে বলতে বলেছি, একজন বলল, গরুর স্বামীর নাম ষাঁড়। কী কী করতে নেই জিগ্যেস করায়—সবাই যেমন বলে চুরি করতে নেই, লোভ করতে নেই, নেশা করতে নেই… তেমনই বলছে সব। একটি ছেলে বলল, মা-বাবার ঝগড়া শুনতে নেই।
আমি তো পড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গে ভাবা প্র্যাকটিস করাই। ঈশ্বর নিয়ে কে কী ভাবছে জিগ্যেস করেছি। একজন কাগজকুড়োনি ছেলে কী বলেছিল শুনবে? আমরা হলাম নোংরা কাগজ। সব নোংরা কাগজ গালিয়ে সাদা কাগজের রিল হয়। ওটা ভগবান। কাগজ টুকরো-টুকরো হয়, নোংরা লাগে, সেটা মানুষ। বোঝো, কত বড় কথা। মানুষ থেকেই ভগবান, আর ভগবান থেকেই মানুষ—কী সহজভাবে বলেছিল। আর একজন মা বলেছিল—ঈশ্বর হল দাঁত ব্যথার মত। যখন বিপদে পড়ি, খুব ডাকি, পরে ভুলে যাই।
এত আনন্দ নিয়ে পড়াচ্ছে শুক্লা, আগে কোথায় যেন ক্লাস হত সেখান থেকে তুলে বাড়ির ছাদে তুলে নিয়ে এল, অথচ আজ কেন এমন কথা বলছে?
—বাড়িতে ক্লাস করিয়ে বোধহয় ভুল হল—শুক্লা বলল।
—কেন? কী হয়েছে?
—শুক্লা চুপ।
—চুরি-টুরি হয়েছে কিছু?
—না।
—বাড়ি নোংরা করছে বুঝি?
—–না-না, ওসব কিছু নয়।
—কী তবে?
—বলছি। আমাকে বোকো না। কারণ জোরাজোরি করে মন্টুকে আমিই এনে রেখেছি এখানে। সেই মন্টু আমার সঙ্গে ‘বিট্রে’ করেছে। একদিন সিঁড়ির তলার ঘরে একটা রিকশাওলার সঙ্গে দেখে ফেলেছি। একদম হাতেনাতে। ছিঃ?
—কী দেখেছ?
—আমি সেটা বিতাং করে বলতে পারব না। বাপের স্বভাব যাবে কোথায়? এর আগেও দু- একটা ব্যাপারে সন্দেহ হয়েছিল আমার। সেদিন যা দেখলাম…। ওকে ওর বাড়িতে ফিরে যেতে বলব আমি।
—কিন্তু ওর বাড়ি কোথায়? কে আছে ওর?
—সেজন্যই তো নিয়ে এলাম। ভেবেছিলাম, ভাল করে মানুষ করব।
—পড়াশোনা কেমন করে?
—সে যাই করুক। কিন্তু এই ‘স্বভাব’ তো যাবে না। তুমি হয়তো বলবে ইগনোর করো। আমি এ ব্যাপার ইগনোর করতে পারব না। আমি চেয়েছিলাম….
অনিকেত ভাবল ও বলবে—ছেলেটা ঘরের কাজ করে দিচ্ছে, চুরিটুরি করে না। শান্ত স্বভাবেরই ছেলে। একান্ত ব্যক্তিগতভাবে যা করছে, ওতে যদি তোমার কোনও ক্ষতি না-হয়, বা কারও কোনও অসুবিধে না-হয়, তা হলে কেন এত আপত্তি। সঙ্গের ছেলেটি রিকশাওলা বলে? রিকশাওলা না-হয়ে যদি স্কুলের ফার্স্ট বয় হত?
কিন্তু বলতে পারল না। চুপ করে রইল। নিজের মধ্যেই একটা কাঁটা আছে। ভদ্রলোক মধ্যবিত্তদের অন্তঃপুরের চৌকাঠে আগল থাকে। অনিকেতের মধ্যেও আছে। মন্টুকে ও বাড়িতে আনতে চায়নি। তখন মহত্ত্ব দেখাতে পারেনি, যেটা শুক্লা দেখিয়েছিল। আসলে শুক্লার মধ্যে যে জমে থাকা, খরচ না-হওয়া বাৎসল্য পড়ে রয়েছে, বাচ্চা মানুষ করার জৈব রসায়ন রক্তের ভিতরে খেলা করছিল চুপে, তারই একটা প্রয়োগ—ব্যবহারিক প্রয়োগ ছিল—মন্টু। শুক্লার নিজের সন্তান থাকলে মন্টুকে ঘরে তোলার কোনও প্রশ্ন থাকত না। এখন মন্টুকে সরাতে চাইছে শুক্লা। মন্টুকে সরানোর একটা ইচ্ছে ওর ভিতরের মনে অবদমিত ছিল। ইচ্ছেটা বাইরের মনে এল, কিন্তু ইচ্ছেটা ইচ্ছেকুসুম হয়ে ফুটে উঠল না। খুব পুলকিত হয়ে যদি বলত—’ঠিক আছে, বেশ তো, ওকে বিদেয় করে দাও’—তা হলে শুক্লার কাছে যেন ও একটু লঘু হয়ে যেত। তাই অনিকেতও চুপ করে রইল। ভাবছিল কী বলবে। এতদিনের একটা সম্পর্কের মধ্যেও কত ভাঁজ, কত আলো-অন্ধকার, কত অভিনয়। অনিকেত মুখটা এমন করে রেখেছে যেন মন্টুকে সরাতে ওর মন চাইছে না। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছে, ঝামেলা হঠানোর একটা সুযোগ এসে গিয়েছে। অনিকেত ভাবে—শুধু দু’জনের সম্পর্ক কেন? নিজের মধ্যেও কতগুলো খোপ। এই যে অনিকেত এলজিবিটি নিয়ে এত কনসার্ন, এটা কতটুকু সহানুভূতি, কতটাই বা অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্ট? সংখ্যালঘু যৌন-মানসিকতার মানুষগুলোকে বুঝতে চেয়েছে, জানতে চেয়েছে। যেমন জানতে চায় মাটি-চাপা বেড়াচাপার ইতিহাস, কিংবা স্ফটিকের স্বচ্ছতা বা কয়লার অস্বচ্ছতার রহস্য। সেই কবে, চাকরি করতে গিয়ে, ঘটনাক্রমে কিছু মাটি-চাপা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সেই থেকে আস্তে-আস্তে এই জগতের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। কিন্তু শরীরে লাগিয়েছে হাঁসের পালক। যেমন বেণি তেমনি রবে বেণি ভিজবে না।
মন্টুকে নিয়ে টুকটাক অশান্তির কথা আগেও বলেছিল শুক্লা। বলেওছিল, ওকে নিয়ে একই সন্দেহ হচ্ছে। স্কুলের একটা ছেলেকে নিয়ে আসে, বলে একসঙ্গে পড়া করছে। দরজা বন্ধ করে কেন?
—বলো কী করব? শুক্লা বলল।
অনিকেত বলল, ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে ওর যে-জ্ঞাতিরা আছে, ওকে খাটাবে। একবার তো মেরে ফেলারও চেষ্টা করেছিল। ওকে বলতে হবে সাবধানে থাকতে। একটা কাজের ব্যবস্থা যদি করে দেওয়া যায়…। রাত্রে নয় পড়বে। তুমি পড়াবে না যদি তোমার কাছে পড়তে আসে?
শুক্লা বলল, ওমা, পড়াব না কেন? পড়াব, বইপত্র কিনে দেব, জামা-প্যান্ট দেব। কিন্তু বাড়িতে রাখব না।
অনিকেত ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে থাকে। ওকে কোথায় পুনর্বাসন দেওয়া যায়—সেটার চেয়েও বেশি করে ভাবতে লাগল—এই স্বভাব কি দুলালের কাছ থেকেই পেয়েছে?
তা হলে তো ভেবে নিতে হয়, ও দুলালের ঔরসজাত? তবে যে দুলাল বলেছিল মন্টু ওর সন্তান নয়? সন্তোষ মহাজনের সন্তান?
ধরে নেওয়া গেল, দুলাল ঠিক বলেনি। মন্টু দুলালেরই সন্তান। দুলালের একটা ক্রোমোজোম বহন করছে। তা হলে তো মেনে নিতে হয় সমকামিতা বংশগত
প্রথমে তো জানতে হবে, মন্টু কতটা সমকামী? ওর চলনে-বলনে কিছুটা মেয়ে-মেয়ে ‘ভাব’ আছে ঠিকই, এমনও তো হতে পারে, মন্টুর ওই ব্যাপারটা বয়ঃসন্ধির কৌতূহলমাত্র। বয়ঃসন্ধিতে অনেক ছেলে তো ছেলেদের সঙ্গেই গোপন-খেলা খেলে। সে রকম নয়তো? হতেও পারে। কিন্তু এ নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না অনিকেত। শুক্লা যা বলেছে, যা ভাবছে তাই : ও ব্যাটা সমকামী।
মন্টু রে, তুই তোর এই স্বভাব বাপের কাছ থেকেই পেলি?
চাইবাসা বেতার কেন্দ্রে ইন্টারনেট আছে। অনিকেত মাঝেমধ্যেই ঘাঁটাঘাঁটি করে নেট। দেখল, সমকামিতার কারণ ‘জিন’ এরকম একটা ধারণা অনেকদিন ধরেই ছিল। ওই কাল্পনিক ‘জিন’-টার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘গে’ জিন। ১৯৯১ সালে একটা বড় ধরনের গবেষণা হল আমেরিকায়। বিজ্ঞানী বেয়ি এবং পিলার্ড ‘আইডেন্টিক্যাল টুইন্স’-দের নিয়ে কাজ করলেন।
‘আইডেন্টিক্যাল টুইন্স’ হল মনোজাইগোটিক টুইন। একটি ডিম্বাণু এবং একটি শুক্রাণু নিষিক্ত হয়ে একটি ‘জাইগোট’ তৈরি করল। কোনও কারণে এটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়ে দু’টি আলাদা ‘জাইগোট’ তৈরি হয়ে দু’টি আলাদা স্যাক-এ বাড়তে থাকে, ভ্রুণ তৈরি হয়। ওদের ‘ক্যারিওটিক টাইপ’ এক। জিনেটিক উপকরণও এক। একই তো ছাঁচ। যে যমজ দু’টি জন্মাল, ওরা একইরকম দেখতে হয়। যদি ছেলে হয়—দু’টি একইরকম দেখতে ছেলে।
স্কুলে যখন পড়ত, ছনি-মনি দু’ভাই ছিল। একইরকম দেখতে। একই ক্লাসে পড়ত। স্যররাও ভুল করত। শেক্সপিয়র ‘আইডেন্টিক্যাল টুইন্স’ নিয়েই তো ‘কমেডি অফ এরর’ লিখেছিলেন। বিদ্যাসাগর সেটার অনুবাদ করেছিলেন ‘ভ্রান্তিবিলাস’ নাম দিয়ে। সিনেমাও হয়েছিল। একইরকম দেখতে দুই বাবু। উত্তমকুমারের ডাল রোল। একইরকম দেখতে দুই চাকর। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ডাব্ল রোলে। এরা ‘আইডেন্টিক্যাল টুইন্স’। বাংলায় কী বলা যায়? সদৃশ যমজ? ছনি’র ঠান্ডা লাগলে মনি’রও ঠান্ডা লাগত। ছনি-মনি দু’জনই অঙ্কে কাঁচা ছিল। ছনি-মনি দু’জনেই মোটা ছিল। আইডেন্টিক্যাল টুইন্স’দের স্বভাবচরিত্র একইরকম হয়। কিন্তু ছনি ভাল ব্যাট করত ক্রিকেটে। খুব ছক্কা মারত, কিন্তু মনি অত ভাল ব্যাট করতে পারত না। তার মানে – একটু-আধটু অমিলও হয়।
আবার যদি কোনও কারণে ওভারি থেকে একটির বদলে দু’টি ডিম্বাণু ফ্যালোপিয়ান বেয়ে নামতে থাকে, এবং দু’টি শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত হয়ে যায়—তবে দু’টি আলাদা ‘জাইগোট’ তৈরি হবে। এ ক্ষেত্রে তিনটে সম্ভাবনা থাকে। দু’টিই ছেলে হতে পারে, দু’টিই মেয়ে হতে পারে, আবার একটি ছেলে আর একটি মেয়েও হতে পারে। এরা নন-আইডেন্টিক্যাল টুইন্স। এদের জিন-সজ্জা আলাদা।
সদৃশ যমজ, বা আইডেন্টিক্যাল টুইন্স’দের নিয়ে জড়িয়ে পড়লেন গবেষকরা। যেহেতু ওদের একইরকম জিন। ১৯৯১ সালে রিচার্ড পিলার্ড বেয়ি-কে সঙ্গে নিয়ে একটা বড় প্রোজেক্টে হাত দিলেন। পিলার্ড নিজেই ছিলেন সমকামী। ওঁর ভাইও সমকামী ছিলেন, এবং আশ্চর্য, বোনও। ওঁর মনে হতেই পারে, বংশধারার মধ্যে সমকামিতার কারণ কোথাও লুকিয়ে আছে।
‘মনোজাইগোটিক টুইন্স’ জোগাড় করা সহজ নয়। সারা দেশ জুড়ে শ’দেড়েক এরকম যমজ পেয়েছিলেন। এরাই ছিল ওঁর স্যাম্পল। দেখা গেল—সদৃশ যমজদের একজন সমকামী হলেই অন্যজন সমকামী হচ্ছে না। কেউ-কেউ অবশ্য হচ্ছে। ওঁর গবেষণাপত্রে দেখিয়েছিলেন, যমজদের একজন সমকামী হলে ৫২ শতাংশ ক্ষেত্রে অন্য ভাই সমকামী হচ্ছে।
এরপর ১৯৯৪ নাগাদ রেইলি, ডাগে এবং মার্টিন অস্ট্রেলিয়াতে ৪৯০টা যমজ নিয়ে গবেষণা চালালেন। ওঁরাও শতকরা ২৪ জনের বেশি পেলেন না। ‘গে’ জিন-এর তত্ত্ব তবু মরল না। ২০০২ সালে জার্মানির বিয়ারম্যান এবং ব্র্যাকম্যান ওই গবেষণাগুলোর পদ্ধতির সমালোচনা করলেন। বললেন, ওঁদের স্যাম্পলিং মেথড ঠিক ছিল না। উনি আরও বড় স্যাম্পল সাইজ নিয়ে কাজ করলেন। শেষ পর্যন্ত যে-ফল পেলেন, সেটাও ওঁদের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারল না। ওঁরা দেখলেন, আইডেন্টিক্যাল টুইন্স’দের একজন সমকামী হলে শতকরা মাত্র সতেরোজন অপর যমজ সমকামিত্বের কথা জানাচ্ছে। এরপর ‘গে’ জিন তত্ত্বটা ফিকে হয়ে গেল। গুরুত্ব কমে গেল।
জিনের গণ্ডগোলের জন্য—লিঙ্গগত ত্রুটি হতে পারে, টার্নার বা ক্লাইনেফেল্টার সিনড্রোম—এসব হতে পারে, ছদ্ম-উভলিঙ্গত্বও হতে পারে। কিন্তু যাদের ওসব কিছু নেই, পরিষ্কার ৪৬xy পুরুষ বা ৪৬xx নারী—তাদের সমকামিত্বের কারণও জিনের মধ্যেই আছে এই তত্ত্ব দুর্বল হয়ে পড়ল। ২০০০ সালেও কাজ হল সুইডেনে। স্যাম্পল-রা যাতে সত্যিকথা মন খুলে বলতে পারে, সেরকম ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এতেও সেই একই ফল। দেখা গেল, ৩০ শতাংশ সমকামিতার ক্ষেত্রে ‘জিন’-কে দায়ী করা যেতে পারে। তা হলে বাকি ৭০ শতাংশ কার কারসাজি?
ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট, বার্কলে, হার্ভার্ড, সেন্ট লুইস ইউনিভার্সিটি এনিয়ে হাজার-হাজার ঘণ্টা কাটিয়েছে। হদিশ দিতে পারেনি।
ডিন হ্যামার একটা বিরাট কাজ করলেন। উনি হার্ভার্ড-এর ডক্টরেট। একজন চলচ্চিত্র পরিচালকও। মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি। উনিও সমকামীদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন ১৯৯৩ সালে। ওঁর স্যাম্পল-এ ৭৬ জন পুরুষ সমকামী নিলেন। তাদের বাবা, কাকা, মামা এদের সঙ্গে কথা বললেন। দেখলেন, কোনও সমকামী ছেলের সমকামী কাকার চেয়ে সমকামী মামা বেশি হয়। মানে ‘গে’-দের ‘গে’-কাকা, জ্যাঠার চেয়ে ‘গে’-মামা বেশি।
৭৫ জন ‘গে’-র ১৭ জন ‘গে’-মামা আছে, কিন্তু মাত্র ৬ জন ‘গে’ কাকা-জ্যাঠা আছে। এরপর আরও বড় স্যাম্পল সাইজ নিয়ে কাজ হল। একই রেজাল্ট। এই পরীক্ষা থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়—যদি সমকামিতার কারণ জিন-ই হয়, সেই জিন বাবার দিক থেকে আসে না, মা’র দিক থেকেই আসে। যাব্বাবা!
মা’দের y ক্রোমোজোম থাকে না। দু’টোই x ক্রোমোজোম। বাবাদের একটা x একটা y। যদি মা’দের দিক থেকেই সমকামিতা আসে, তা হলে y ক্রোমোজোম থেকে আসে না। x থেকেই আসে।
y-এর তুলনায় x ক্রোমোজোম একটু বড়। y-তে ৫০ মিলিয়ন বেস পেয়ার, ২৫১টা জিন। x-এ ১৫৩ মিলিয়ন বেস পেয়ার, ১১৬৮টা জিন থাকে। ডিন হ্যামার এবার x ক্রোমোজোম নিয়ে পড়লেন। চল্লিশ জোড়া ‘গে’-র x ক্রোমোজোম বিশ্লেষিত হল। দেখলেন ৩৩ জোড়ার x ক্রোমোজোমের বিশেষ অংশে একটু বিশেষত্ব আছে। জিনেটিক্স-এর ভাষায় ওই বিশেষত্বকে বলে ‘অ্যালেলস’। এ জায়গাটার নাম xq২৮। এখানে ৮ মেগাবাইটের মতো ‘জিনেটিক ইনফরমেশন’ থাকে। এই কাজ এগিয়ে চলল। কিন্তু কানাডাতে এই পরীক্ষা আবার হল। ডিন হ্যামার ৪০টি স্যাম্পলের মধ্যে ৩৩টিতে একই ধরনের বিশেষত্ব বা ‘অ্যালেলস’ দেখেছিলেন, যা শতকরা ৮২ শতাংশে দাঁড়ায়। কিন্তু পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে শতকরা ৫০-এর এদিক-ওদিক রেজাল্ট এল। সুতরাং xq২৮ তত্ত্বটার পক্ষেও জোর করে কিছু বলা গেল না, কিন্তু তত্ত্বটা রয়েই গেল খারিজ হল না। রাশিয়াতে মাসটাসকি হ্যামারের নির্দেশিত গবেষণা আর একটু সূক্ষ্মভাবে করে x ক্রোমোজোমের মধ্যে আর একটা অঞ্চলের কথা বললেন। নাম দিলেন zq36। কিন্তু এগুলো আবিষ্কার নয়। তত্ত্ব। হাইপোথিসিস।
জিনের মধ্যে যদি সমকামিতার বীজ না-পাওয়া যায়, তবে কি মাথার মধ্যে আছে? চলল চুলচেরা নয়—মাথাচেরা গবেষণা।
সাইমন লেভি, একজন আমেরিকান স্নায়ুবিজ্ঞানী এইড্স-এর কারণে মৃত সমকামীদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করতে থাকলেন। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের পিছনে কিছু গ্রন্থি আছে। চালের দানার সাইজের একটা গ্রন্থির ডাকনাম SCN। ভাল নামটা বেশ বড়। Supra Chiasmetic Nucleus। ডাকনামে ডাকাই ভাল। ১৯৯০ সালে অধ্যাপক সোয়াব বলেছিলেন, মেয়েদের SCN-এর আয়তন ছেলেদের দ্বিগুণ, আবার সমকামী পুরুষদের SCN-এর আয়তন বিষমকামীদের তুলনায় অনেক বড়। সাইমন লেভি’র পরীক্ষা ওই তত্ত্বকে সমর্থন দিল। SCN- এর একটি অংশ আছে, যার ডাকনাম inah৩। এই অংশটি যৌন-প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। সমকামী পুরুষদের মধ্যে ওই অংশটির একটি বিশেষত্ব শনাক্ত করেছেন।
তা হলে মন্টুর ব্যাপারটা জন্মগত-ই এমন কোনও কথা নেই। যদি ধরে নেওয়া যায় ও দুলালের সন্তান এবং যদি ধরে নেওয়া হয় সমকামিতা বংশগত; তা হলে ডিন হ্যামারের তত্ত্বানুযায়ী, x ক্রোমোজোমটা এসেছে মা-র দিক থেকে। যদি জিনে না-থাকে তবে কি মাথায়? যেখানেই থাক, সমকামিতা বায়োলজিক্যাল হার্ডওয়ার্ড’। ‘বায়োলজিক্যালি হার্ডওয়ার্ডেড’ সমকামীরা ছাড়া কিছু আচরণগত সমকামীও থাকে। যেমন, জেলখানার বন্দিরা। বন্দিদশায় ওরা সমকামী হতে পারে, কিন্তু ছাড়া পেলে ওরা বিষমকামী হয়ে যায়। হোস্টেল জীবনেও হয়। এরা আচরণগত সমকামী। আবার কোনও-কোনও পুরুষ তো লন্ডা, হিজড়ে, নাগিন — এদের সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক করে ওদের পুরুষ ভেবে নয়—নারী ভেবে। মানে, নারী নয় জেনেও, মনে-মনে নারী ভেবে। এমনও তো হতে পারে, মন্টু ‘বায়োলজিক্যালি হার্ডওয়ার্ডেড’ নয়। ব্যাপারটা সাময়িক ছিল। কৈশোরের দুষ্টুমি। সে হোকগে যাক। অনিকেত ঠিক করেছে, সামনের সপ্তাহে গিয়েই ও একটা অনাথ আশ্রমের সঙ্গে কথা বলবে। মন্টুকে একটা অনাথ আশ্রমে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। ওর অংশের যে-জমিটা রয়েছে, সেটা যেন ওর কাকা হজম করে নিতে না-পারে, সেটাও দেখতে হবে। কোনও উকিলের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কত যে কাজ। কাজ আর কাজ। এদিকে মঞ্জুও মেসেজে ‘কাঁপন’-সিরিজ পাঠিয়ে চলেছে। ‘বয়স যত বাড়ে তত বয়স খসে পড়ে। শরীর আগে স্পর্শ করো পেমের কথা পরে।’ হ্যাঁ, ওটা ‘পেম’-ই। ইংরেজি টাইপে R-টা বাদ চলে গিয়েছে। অনিকেত জানে, বেশির ভাগ প্রেমেই একটু-না-একটু খুঁত থাকে; এখানে যেমন R নেই। P বাদ গেলে ‘রেম’ হত আর কী!
এক ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ল। বিজয় লামা। ওঁর সঙ্গে একবার আলাপ হয়েছিল। রানাঘাটে ‘নীহারিকা’ নামে একটা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন উনি। উনি বলেছিলেন, বারবনিতাদের ছেলেমেয়েদের উনি লেখাপড়া শেখান, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। উনি নেপালি। মুম্বইতে চাকরি করতেন, ব্যাঙ্কের অফিসার ছিলেন। খ্রিস্টান মিশনারিদের সঙ্গে জনসেবার কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তারপরে এধারে ফিরে এসে আশ্রমটা গড়ে তোলেন। রানাঘাট-শান্তিপুর অঞ্চলে বারবনিতা এলাকা আছে। ওদের ঘরের ছেলেরা অনেকেই অপরাধ জগতে জড়িয়ে যায়, মেয়েরা মা’র পেশা গ্রহণ করে। ওদের ছেলেমেয়েদের সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসার জন্য তাঁর এই চেষ্টা।
হিজড়ের সন্তানকে কি বারবনিতার সন্তান বলা যায়? কলকাতায় এসে ফোন নম্বর জোগাড় করে বিজয় লামার সঙ্গে কথা বলে অনিকেত। মাঝে একজন ছিল, যার মাধ্যমে বিজয় লামার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে অনিকেতের বন্ধু। সাধ্যমতো ওই আশ্রমকে সাহায্য করেন।
আশ্রমটা দেখতে যায় অনিকেত।
টিনের এবং টালির চালের কয়েকটা ঘর। ছেলেদের এবং মেয়েদের আলাদা-আলাদা। সেদিন রবিবার ছিল। অনিকেত দেখছিল, একটা বেদি বাঁধানো বকুলগাছ। ওখানে মা-রা সব বসে আছে। কারও মুখে মেচেতার কালি। একজনের গালে লম্বা কাটা দাগ—ব্লেড বা ক্ষুরের স্মৃতিচিহ্ন; যা শত পাউডার প্রলেপেও অমলিন। ওদের সন্তানরা নিয়ে এসেছে নতুন বই কিংবা ড্রইং খাতা। মা’দের রাত-জাগা চোখে ভোরের পাখি ডেকে ওঠে ড্রইং খাতায় হাঁস-চরা পুকুর আর পাখি-ভরা গাছ দেখে। ড্রইং খাতায় ময়ূর, সূর্য ওঠা গ্রাম, পদ্মফোটা পুকুর, হাঁটি-হাঁটি পা- পা শিশুর হাসি মুখ, ধিতাং-ধিতাং নাচা বালিকদের ছবি। ছবির পৃথিবী কী সুন্দর! মা-রা দেখে। ঝুমঝুমি বাজে। ঝুমঝুমি বাজায় কোনও সপ্তমবর্ষীয়া বালিকা। উপহার পাওয়া ঝুমঝুমি। খুশি- ভরা ফোকলা দাঁত। এই চত্বরটা কেমন যেন খুশিময় হয়ে আছে। এখানে সন্তানদের সঙ্গে সাপ্তাহান্তিক দেখা-সাক্ষাতে কোনও বাপ নেই। সবাই মা। এরই মধ্যে আলো-ছায়ায় এক মায়ের পায়ের কাছে বসেছে এক নবমবর্ষীয়া বালিকা, মা খুব যত্নে উকুন বেছে দিচ্ছে। বিজয় লামা ঘুরে-ঘুরে অনিকেতকে দেখাচ্ছেন, ওঁর আশ্রমের আনন্দরূপ। উকুন বাছা ভাস্কর্যের সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন। ——এই যে সঙ্গীতা, ওষুধ দিসনি তো মাথায়?”
অনিকেতকে বলেন বিজয় লামা—বুঝলেন, উকুন মারার ওষুধ দেওয়া হয় সবাইকে, মাসে একবার করে ওটা দিয়ে সাবান ঘষার কথা। এই মেয়েটা কিছুতেই দেবে না। দিলেই তো উকুন চলে যাবে, তা হলে মায়ের পায়ের ফাঁকে বসার মজাটাই চলে যাবে। দু-চারটে করে চুল সরিয়ে উকুন খোঁজে ওর মা, মায়ের হাতের স্পর্শ পাওয়ার জন্য ও উকুন পুষে রাখে।
বিজয় বলেন—এই যে তুই উকুন পুষে রাখিস, তোর মাথা থেকে তো অন্যদের মাথায় উকুন যায়। কাল যদি ওষুধ না-দিস তো একমাস জিলিপি বন্ধ।
সঙ্গীতার মা’কে বলেন, সামনের সপ্তাহ থেকে উকুন বাছা চলবে না। মেয়েকে আপনি বোঝান—এই সঙ্গীতা বল তো কোনটা ভাল, উকুন না জিলিপি?
মেয়েটা মাথা নিচু করে বলে, জিলিপি।
বিজয় বলেন, প্রতি রোববার সকালবেলায় দু’টো করে জিলিপি দেওয়া হয় সবাইকে।
অনিকেত দ্যাখে, ওই বিঘেখানেক এলাকার মধ্যে দোলনা আছে, ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা আছে, এক্কাদোক্কার ছক আঁকা আছে একাধিক, মুরগির পোলট্রি আছে, গরুর গোয়াল আছে।
—ড্রইংয়ের মাস্টারমশাই আসেন, পয়সা নেন না। গানের দিদিমণি আসেন। পয়সা নেন না। সবাই মিলেই কাজটা করছি দাদা। বলেন বিজয় লামা।
অনিকেত জিগ্যেস করল—এরা কোন স্কুলে পড়ে?
বিজয় বললেন—স্থানীয় স্কুলগুলোতেই ভর্তি করিয়েছি।
—স্কুলে ওদের কোনও অসুবিধে হয় না?
—বাচ্চাদের নিয়ে কোনও প্রবলেম নেই। ওদের সঙ্গে যারা পড়ে, ওরা তো দিব্বি ওদের সঙ্গে মেশে। বড়দের নিয়ে, মানে টিচারদের নিয়ে একটু-আধটু… কেউ-কেউ দু-একটা আজেবাজে কথা বলে, ও তেমন কিছু না।
অনিকেত বলে, আপনাকে বলেছিলাম তো—একটি ছেলেকে ঘরে রেখেছিলাম। ওর বাবা হিজড়েদের দলে চলে যায়। মা আগেই ছেড়ে গিয়েছিল… ওকে মানুষ করছিলাম। কিন্তু আমার
তো বদলির চাকরি, আমার স্ত্রী’কে নিয়ে চলে যাব ওখানে, তাই ভাবছিলাম…
বিজয় বললেন—রাখতে পারেন এখানে, তবে এখন তো কোনও স্কুল ভর্তি করবে না। এখন তো আবার এপ্রিল থেকে সেশন। এই ভাঙা-মাসে ভর্তি নেবে না। পরেই দেবেন না-হয়।
—টাকাপয়সা?
—ওটা আপনার ওপর। আপনি তো সরকারি চাকরি করেন। ওর জন্য যা লাগে দিতেই পারেন। এদের থেকে তো কিছু নিই না। কী করে নেব? তবে ওরাও কিছু-কিছু দেয়। জোর করে দিয়ে দেয়। পুজোর সময় এই মারা টুকটাক বকশিস পায়, তা থেকে কিছু দিয়ে দেয় চাইতে হয় না। কতই-বা বকশিস পায়? এসব মা’দের খদ্দেররাও তো পয়সাওলা নয়।
অনিকেত জিগ্যেস করল, একটা ব্যাপার জানতে ইচ্ছে করছে খুব। এই যে বাচ্চাগুলো, হতে পারে ওদের বাবাদের কেউ-কেউ আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক, মা-রাও এরকম, বাচ্চাগুলো ‘ঠিকঠাক’?
—ঠিকঠাক মানে?
—প্রবলেম করে? অন্যায় করে? চুরি করে খাওয়া—মারপিট বা অন্যান্য অপরাধ…
বিজয় লামা বললেন, আলাদা রকম কোনও প্রবলেম তো দেখি না। যেসব বাচ্চা ৮-১০ বছরে আসে, ওরা কিছু খিস্তি-গালাগাল শিখেই আসে। ওগুলোকে ওরা গালাগাল ভাবে না। একটা আট বছরের মেয়ে সাত বছরের মেয়েকে যখন বলে—এতক্ষণ ধরে কত হাগচিস লো মুখপুড়ি মাগি, এবার বেরো… তখন হাসিই পায়। একটা বাচ্চা ছেলে অন্য ছেলেকে বলে, তোকে আবার মায়ের পেটে ঢুকিয়ে দেব শালা… এগুলো, হালকার ওপর হল। আরও সব আছে। এসব একটু সামলাতে হয়। ওদের বোঝাতে হয় খারাপ শব্দ না-বলেও কী করে মনের ক্ষোভ-জ্বালা প্রকাশ করা যায়। একজন জিগ্যেস করেছিল, ‘মুখপুড়ি’ যদি ‘খারাপ কথা’ হয়, তবে ‘ভাল কথাটা কী? আমি সত্যিই সমস্যায় পড়লাম। মুখপুড়ি-র ‘ভাল’ প্রতিশব্দ কী হতে পারে? কিম্বা ঘাটের মড়া-র? আপনার জানা আছে? অনিকেতকে প্রশ্ন করেন বিজয়।
অনিকেত মাথা চুলকোয়।
—যাকগে। এমনি ওসব ছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই?
—সমস্যা তো অনেকরকম হয়। আসলে কোন ধরনের সমস্যার কথা জানতে চাইছেন আপনি?
অনিকেত বলে, আসলে একটা তত্ত্ব আছে—অপরাধ জিনবাহিত। অপরাধীর সন্তানরা অপরাধপ্রবণ হয়। আর যারা ইয়ে, বারাঙ্গনা…
—বেশ্যাই বলুন না…. বিজয় বলেন।
—ঠিক আছে, ওই একই হল, এই কাজে অনেকে বাধ্য হয়ে আসে, প্রতারিত হয়ে আসে, কেউ-বা স্বেচ্ছায়, জেনে-শুনে। যারা জেনে-বুঝে আসে, ওরা আর্থিক প্রয়োজনেই আসে, কিন্তু একটা থিওরি আছে যে, ওই মেয়েরা অভাবেও আসে—আবার স্বভাবেও আসে। ওরা হয়তো পছন্দ করেই আসে। ওরা একটু বেশি কামুক হয়… জানি না… এরকম একটা কথা শোনা যায়। এই বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করছেন আপনি। আপনার এখানে বয়ঃসন্ধির বাচ্চারাও আছে। ওদের মধ্যে অতিরিক্ত যৌনতা….
বিজয় বললেন, না তেমন তো কিছু চোখে পড়েনি আমার। ওই ধরনের কোনও অভিযোগ তো শুনিনি। ‘অপরাধী জিন’ নামে কিছু বোধহয় নেই। যদি থাকত, রত্নাকর ‘বাল্মিকী’ হতে পারতেন? আমাদের এখানে যে ছেলেটি ড্রইং শেখায়, ওর বাবা এখনও জেল খাটছে। অপরাধ প্রবণতা ‘ইন বিল্ট’ নয়।
অপরাধ প্রবণতা ইন বিল্ট নয়, হার্ডওয়ার্ড নয়। কিন্তু সমকামিতা তো ইন বিল্ট। ওটা তো পাল্টানো মুশকিল। ওটা যে কারণেই হোক। জিনে প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কিন্তু মস্তিষ্কে প্ৰমাণ পাওয়া গিয়েছে। হাইপোথ্যালামাসের SCN-এ।
কিন্তু সমকামিতা কি অপরাধ? অপরাধ তো নয়—অনিকেতের বাইরের মন তো তাই বলে অনেক তো ভেবেছে। এই আচরণের জন্য ওরা দায়ী নয়। যারা পরিবেশের মধ্যে পড়ে গিয়ে সমলিঙ্গে যৌনতা করে—ওরা পাল্টে যায় বা পাল্টানো যায়। কিন্তু অনেককে তো কিছু করা যায় না। মন্টু হয়তো ওরকমই। কিন্তু আশ্চর্য, ও নিজেও এভাবে ভাবছে। একেবারে মনের গভীরে ঢুকে-থাকা বহু বছরের লালিত বিশ্বাস। মনোবিজ্ঞানী ইয়ুং কালেকটিভ আনকনশাস্’- এর কথা বলেছিলেন। গভীর মন—মানে ‘ইদ’-এ ঢুকে থাকা কিছু বিশ্বাস, কিছু প্রতীক, কিছু আর্কিটাইপ উপড়ে ফেলা সহজ নয়। সমকামিতা অপরাধ নয়, কিন্তু একজন সমকামীকে নিজের পরিবারের মধ্যে ‘রোল’ দেওয়ার মতো ঔদার্য শুক্লার নেই, কিন্তু ও আবিষ্কার করে— ওরও নেই। তাই যখন বিজয় বলেন, এখন তো এখানে রাখা সম্ভব নয়, কয়েকটা মাস অপেক্ষা করতে হবে, তখন ওর ভিতর থেকে কেউ বলে ওঠে—’এই সেরেছে—এবার কী হবে?’
অনিকেত জিগ্যেস করে, এখানে ক’বছর বয়স পর্যন্ত রাখা হয়?
বিজয় বলেন, মাধ্যমিকটা পাশ করিয়ে দি।
—তারপর?
—তারপর তো ভাবিনি কিছু। এ বছর দু’জন মাধ্যমিক দেবে। দু’টোই ছেলে। তারপর কী করা যায় ভাবছি। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে কথা চালাচ্ছি। দু’টো মিশনারি চার্চের সঙ্গেও। কোনও টেকনিক্যাল ট্রেনিং দেওয়া যায় কি না ভাবছি। আপনি যদি কোনওভাবে সাহায্য করতে পারেন তো বলবেন। ভাবুন না একটু…।
মন্টুর সমকামী অভ্যাসের কথা বিজয়কে বলেনি। বললে বিজয়ও কি ওকে নিতে রাজি হতেন? কে জানে? উনি কি ভাবতেন, এই ছেলেটা অন্য ছেলেদেরও ‘স্পয়েল’ করবে? কে জানে। ওসব গোপন করেই অনিকেত মন্টুকে গছাতে চেয়েছিল। যেমন করে অচল পয়সা চালায় মানুষ। ছেঁড়া-ফাটা নোট কায়দা করে, বুদ্ধি বা দুর্বুদ্ধি করে, ব্যস্ত দোকানে গছিয়ে দেওয়া হয়।
.
ফিরে এসে শুক্লার সঙ্গে কথা হয়। শুক্লা বলে, সবে তো এখন সেপ্টেম্বর। এতগুলো মাস অপেক্ষা করতে হবে?
অনিকেত বলল, কী করা যাবে? আমি তো ওকে আনতেই চাইনি। তুমিই তো মহৎ হতে গেলে। দুলালের মায়ের ঋণ শুধতে গেলে। দুলালের মা বলে গিয়েছিল, নাতিটাকে দেখো…। এরকম তো কতজনই কতরকম করে বলে।
শুক্লা বলে, আমি কী করে জানব ও এরকম হবে? কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলে না।
শুক্লা বলে, যাই বলো ওই আশ্রমটা সুবিধের নয়।
যারা ওখানে থাকে, ওরাও তো ঠিক ইয়ে’ নয়….
‘ইয়ে’-র মধ্যে যা বলতে চাইছে শুক্লা, অনিকেত বোঝে। শুক্লা বলল, রামকৃষ্ণ মিশনগুলো ভাল। ওদেরও তো অনাথ আশ্রম আছে। ওরা খুব ভাল করে মানুষ করে। চার্চেরও তো অনাথ আশ্রম থাকে। মাদার টেরিজা-র ওখানে খোঁজ কোরো না।
শুক্লার মধ্যে একটা দোটানা কাজ করছে। মন্টুর প্রতি একটা স্নেহ রয়েছে, শুভ-কামনা রয়েছে। ও চাইছে, ও ভাল থাক। ওর যদি নিজের রোজগার থাকত, হয়তো ভাল কোনও হোস্টেলে রাখত। স্বামীর রোজগারের টাকায় সেই আবদারটা করতে চাইছে না। আবার বাড়িতে রাখার মানসিকতাও আর নেই। আর অনিকেত নিজে? ও তো প্রথম থেকেই ঝামেলা- বিবর্জিত হতে চেয়েছে। ও ততটা বাৎসল্য রসে ভেজেনি এখনও। তা ছাড়া এই ঘটনাগুলোর পর…।
মাঝে একবার মন্টুর সঙ্গে সোজাসুজি কথাও বলেছিল অনিকেত। শুক্লা তখন ছাদে ওর ক্লাস নিচ্ছিল।
জিগ্যেস করেছিল—মন্টু, সিঁড়ির ঘরে তুই কাকে ঢুকিয়েছিলি?
মন্টুর ঘাড় নিচু। কথা বলেনি।
—কেন ঢুকিয়েছিলি?
মাথা নিচু চোখে পিটপিট করছে।
—কী করছিলি?
ও চুপ।
—কথা না-বললে মারব। যা বলছি উত্তর দে। বল কী করছিলি?
—দেখছিলাম।
—আর কী করছিলি?
—ধরছিলাম।
—কবে থেকে এরকম করিস? সত্যি কথা বল।
—ওই একদিনই।
—বাজে কথা বলছিস। ডাকব রিকশাওলাটাকে?
—আর একদিন। মোট দু’দিন। আর করব না।
মন্টু মাথা নিচু রেখে বলে।
রিকশাওলা ছেলেটাকে ছাড়ায়নি শুক্লা। ওকে আর পড়াবে না ভেবেছিল। কিন্তু এর আগে তো কল্পনা মৈত্রকে জানাতে হয়। কিন্তু জানাতে গেলে মন্টুর কথাও বলতে হয়। মন্টু তো এই পরিবারেরই একজন। মন্টুও জড়িয়ে যাবে বলে বলেনি কিছু। তা ছাড়া বলা যায় না—উনি হয়তো বলেই বসবেন—ওসব করেছে তো কী হয়েছে? ওসব তো ওদের পার্সোনাল ব্যাপার।
অনিকেত মন্টুকে বলে, মিথ্যে কথা বলছিস। আর একদিন নয়, অনেকদিন। এছাড়া এসব কাজের আরও সঙ্গী আছে—আমি জানি। মিষ্টির দোকানের ওই ছেলেটার কথা জানি না ভেবেছিস?
মন্টু ঘাড় নিচু করে থাকে। প্রতিবাদ করে না।
এটা সম্পূর্ণ আন্দাজেই বলেছে অনিকেত। ওকে নিয়ে বাজারে গিয়েছে কয়েকবার। মিষ্টির দোকানের এক কর্মচারী, মাঝবয়সি, মন্টুর হাতে একটা পান্তুয়া তুলে দিল সাদা কাগজে মুড়িয়ে। বলল, ছেলেটা বড় ভাল। আপনি বড় মহৎ লোক, আশ্রয় দিয়েছেন। তখন কিছু ভাবেনি। এখন হঠাৎ ছবিটা মনে এল, এবং বলে ফেলল।
মন্টু কিছু বলল না। ঘাড় নিচু এবং চোখে জল।
দু’ফোঁটা জল পড়ল মেঝেতে।
তার মানে, এটাও ঘটনা? মাথা টনটন করে ওঠে অনিকেতের। একটা থাবড়া মারবে বলে হাত ওঠায়, মন্টু মাথাটা সরানোর চেষ্টা করে না। থাপ্পড়টা যেন ওর পাওনা, থাপ্পড়টা গ্রহণ করার জন্যই দাঁড়িয়ে থাকে। শেষ মুহূর্তে অনিকেত নিজেকে সংযত করে। হাতটা মন্টুর গাল পর্যন্ত পৌঁছয় না।
অনিকেত শুক্লাকে বলে—রামকৃষ্ণ মিশনে কি এই বয়সে নেবে? যত দূর জানি ওরা ছোট অবস্থায় নেয়।
শুক্লা ‘ও…’ বলে চুপ করে থাকে। ‘ও…’ শব্দটাকে কিছুটা প্রলম্বিত করে—যা এক ধরনের হতাশার ব্যঞ্জনা দেয়।
অনিকেতের ভিতর থেকে আর-একটা-অনিকেত বেরিয়ে আসে। সে আরও স্মার্ট। চুলটা ঝাঁকড়া। ও মাথা নাড়িয়ে বলে, কি অনিকেতবাবু? খুব যে তড়পাতে…
—কী তড়পাতাম…
—ওই যে…পার্সোনাল চয়েস… স্বাধীনতা। যৌন-স্বাধীনতাও। ওই কিশোর ছেলেটাকে বাড়ি থেকে তাড়াচ্ছেন তো….
—না মানে, সংসারে থাকতে গেলে…মানে আমার স্ত্রী’র কতগুলো নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা আছে। সংস্কার-কুসংস্কার যাই বলি না কেন। ওর বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করি না। ও তো পুজোআচ্চা করে। বাধা দিই না। করুক।
—ওই এক ভ্যানতাড়া করে যাচ্ছেন। বলেছিলেন না—পৃথিবীর অনেক বড়-বড় মানুষ, লেখক-শিল্পী-চিত্র পরিচালক-সমাজকর্মী-বৈজ্ঞানিক সমকামী। ওঁদের ব্যক্তিগত যৌনতার সঙ্গে সৃষ্টির কোনও সম্পর্ক নেই। নিজস্ব ক্ষেত্রে ওঁরা বিরাট মাপের।
অনিকেত একটা যুক্তি পেয়ে যায় বলার।
ও বলে—আরে এই ছেলেটা তো কোনও কম্মের না। পড়াশোনাতেও ভাল নয়। মাস্টারমশাই রাখা আছে, তবু কোনওরকম কুঁতিয়ে-কাঁতিয়ে পাস করে যায়।
অন্য অনিকেত বলে—যদি ও ব্রিলিয়ান্ট হত? পরীক্ষায় ফার্স্ট হত? অঙ্কে একশোয় একশো? সেই সঙ্গে ডিবেটে ফার্স্ট… স্কুলের মাস্টারমশাইরা বলত, একটা স্টুডেন্ট পেয়েছি বটে, রত্ন…তা হলে? ছেলেটা ‘হোমো’ জেনেও কি ওকে রাখতেন আপনার ফ্যামিলিতে অনিকেতবাবু… রাখতেন না?
অনিকেত—সত্যি কথা বলতে কী, আমার নিজের তেমন কোনও মানে.. .শুক্লা… ওরকম হলে শুক্লা হয়তো…
জবাবটা পুরো দিতে হয় না একটা ফোন এল বলে।
—হ্যাঁ…বলছি।
…
—সে কী! কখন?
…
—তারপর?
…
—এখন কেমন আছে?
…
—বাড়ি ফিরবে কী করে?
…
—ঠিকানা? এ বাড়ির ঠিকানা?
…
—বলছি। লিখে নিন…
আশঙ্কিত চোখে শুক্লা তাকিয়ে আছে অনিকেতের দিকে। অনিকেত ফোনটা ‘অফ’ করে ছুড়ে ফেলল বিছানায়—উফ…আর পারা যায় না।
কী হয়েছে? শুক্লার উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।
বিকাশ একটা বার-এ নেশা করে পড়ে-টড়ে গিয়েছে। বোধহয় দুপুর থেকেই খাচ্ছে। মাথায় লেগেছে। ওরা বরফ দিয়েছে। ওর ফোন করারও ক্ষমতা নেই। বার-এর কাউকে দিয়ে ফোন করাচ্ছে। ওর ফ্ল্যাটের চাবিটা পাচ্ছে না, কোথাও ফেলে-টেলে দিয়েছে। এখন ট্যাক্সির ড্রাইভারকে আমাদের বাড়ির ঠিকানা ধরিয়ে দিয়ে ওকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিচ্ছে। উফ…
—তার মানে, এখানে আসবে মাতাল হয়ে, ওকে ধরাধরি করে নামাতে হবে?
—কী করব? ‘না’ করব?
—তাই তো, ‘না’ করতে পারো না, যত ঝামেলা এখানে। আমি কিছু জানি না। ওর বিছানা- টিছানা কিচ্ছু জানি না।
অনিকেত চুপ করে থাকে।
—সব সময় তুমি আমাকে…
শুক্লা গজগজ করতেই থাকে…।
অনিকেত টিভিটা চালিয়ে দেয়। তখন সন্ধে।
সে কী! টিভি-তে কী দেখাচ্ছে?
আমেরিকা আক্রান্ত।
বিমান হানায় জোড়া টাওয়ার ভেঙে পড়েছে।
সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা।
ওরা দ্যাখে, কালো ধোঁয়া। আগুন। কীরকম রূপকথার মতো একটা বিমানপোত একটা স্পর্ধাজড়ানো বাড়িতে এসে লাগল, বাড়িটার মুকুট ভেঙে পড়ল, তারপর মাথা, দেহ। রক্তের মতো গলগল করে আগুন। আগুন আর ধোঁয়া। ভেঙে পড়েছে ট্রেড সেন্টারের জোড়া টাওয়ার। চোখ কচলে অবাক হয়ে দেখতে থাকে। হতবাক।
কে হাততালি দিয়ে উঠল।
অন্য অনিকেত? অনিকেতের আঠারো বছর বয়সে?
—তুই যাসনি এখনও?
আবার ফোন। ভাগ্যিস ফোনটা….
—আমি বিকাশ বলছি। সরি টু ডিসটার্ব। চাবি পেয়েছি। বাথরুমে হিসি করার গামলাটাকে কী বলে যেন? হ্যাঁ, ওখানেই ফেলে দিয়েছিলাম। বাই। এনজয় ইয়োর গুড়ি-গুডি লাইফ।
ওই আগুন এবং ধোঁয়া সরিয়ে অনিকেত আনন্দবার্তা দিল শুক্লাকে। ‘বিকাশ আসছে না।’
বারবার দেখাচ্ছে। আগুন, ধোঁয়া, ভেঙে-পড়া, ভয়ার্ত মানুষের ছুটে পালানো…। আবার ধোঁয়া…
শুক্লা কালো ধোঁয়ার এপার থেকে বলল, বিকাশ ঠাকুরপোর খুব কষ্ট না গো?…
ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে ঘরে।
শুক্লা বলে, মন্টুটাকে যদি বিকাশ ঠাকুরপোকে দিয়ে দি, কেমন হয়?
কাশি আসে। কাশছে অনিকেত।
৪৬
জানা গেল, ওসামা বিন লাদেন নামে কেউ একজন আছে, যে আমেরিকায় ওই সন্ত্রাসের পিছনে আছে। লোকটা রহস্যময়। আরবে বিরাট ব্যবসা ছিল। তারপর নানা দেশে ঘুরছে। কিন্তু লোকটাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
টেলিভিশনে দেখাচ্ছে ‘গ্রাউন্ড জিরো’। জায়গাটার ভগ্নস্তূপ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বিক্ষত জায়গাটার স্মৃতি-স্তূপ পড়ে আছে, দুলালীর উপড়ে ফেলা গুপ্তস্থান যেন। ওখানে কান্না জমছে। ফুলও জমছে।
আর একটা ‘গ্রাউন্ড জিরো’-তে গেল অনিকেত। বিকাশের বাড়ি। ফোন করেছিল আগেই। জড়ানো গলায় বিকাশ বলেছিল, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।
অনিকেত বলেছিল, অফিস যাচ্ছিস না কেন?
বিকাশ বলেছিল, কী হবে গিয়ে?
অনিকেত বলেছিল, এখন ন্যাকামি করিস না।
কিছুক্ষণ বেল টেপার পর বিকাশ দরজা খুলল। ঘর-ভর্তি সিগারেটের টুকরো। কয়েকটা মদের বোতল মানসিক প্রতিবন্ধীদের মতো শুয়ে আছে, বসে আছে। টেবিলে পুকাইয়ের একটা হাস্যমুখর ছবি, মালা দেওয়া, মালার ফুল শুকিয়ে গিয়েছে। ডাইনিং টেবিলে কয়েকটা পাঁউরুটির খোলস পড়ে আছে। পড়ে আছে পৃথিবীর অবক্ষয়ী সহনশীলতা।
—কি বে? রগড় দেখতে এলি?
বিকাশ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল।
—আর নাটক করিস না বিকাশ। খুব হয়েছে। এবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আয়। অনিকেত ওর বিছানায় বসে বলে।
—’স্বাভাবিক জীবন’ আবার কী? আমার জীবন কী করে ‘স্বাভাবিক’ হবে ফের? বউ চলে গিয়েছে। আমার গায়ে থুথু দিয়েছে। সত্যিকারের থুথু। ওর থুথু আমি হাত নিয়ে চেটে মাথায় মেখেছি। শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আমার খোঁজ নেয়নি।
—আমি তো খোঁজ নিতে এসেছি।
—মানে, কতটা মদ খাচ্ছি জানতে? নাকি বাড়িতে আবার অন্য মেয়েছেলে ঢুকিয়েছি কি না বুঝতে?
—শোন বিকাশ, আবার বলছি নাটক করিস না। তুই আমার আত্মীয়, তুই আমার বন্ধু। অনিকেত একটু হাসে। পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করে। বলে—’সিরাজদৌল্লা’ নাটকে ছিল না? সিরাজদৌল্লা বলছে বিপদের দিনে যে-ই না কাছে এসে দাঁড়ায়, সে-ই না আত্মীয়, সে-ই না প্রকৃত বন্ধু…
বিকাশ চুপ করে থাকে।
—অফিস যাস না কেন?
—গিয়ে কী বলব? সবাই তো জিগ্যেস করবে। অফিসের কয়েকজন বাড়িতে এসেছিল। সবাই গল্প শুনতে চায়। কেন ঝাঁপ দিল? এর আগের রাতে কী করেছিল? সকালবেলায় কী খেয়েছিল? তারপর কী বলেছিল….
—বলবি, একবার বলবি। তারপর আর বলবি না।
—কী বলব? ওকে বকাবকি করেছিলাম সেটা বলে দেব? মেরেছিলাম, প্রায়ই মারতাম, সেটাও বলে দেব? ওকে আমি সৌরভ বানাতে চেয়েছিলাম, ও সৌরভ হতে পারবে না ভেবে মরে গেল—মানে ‘মেরে দিলাম’–বলে দেব? তা হলে সব বলে দিতে হয়, এভরিথিং। আমি যে আসলে বাঁজা, আমার স্পার্ম হয়টয় না—বাঁজা দোষটা মেয়েদেরই জোটে। আমি শালা বাঁজা। যখন আমাদের বাচ্চা হচ্ছিল না, তখন টেস্ট করিয়েছিলাম তো। প্রথমে পারমিতার। বারবার। ডাক্তাররা বলল, ওর সব ‘ওকে’। তারপর আমার। তখন দেখা গেল স্পার্ম কাউন্ট কম। তোদের বলিনি….
—বলেছিলি, হিন্ট দিয়েছিলি তুই। আমি বুঝে গিয়েছিলাম। তাতে কী? এরকম অনেকেরই তো হয়।
—ওই জন্যই তো—ওই জন্যই তো আমি সন্তানের মর্ম বুঝিনি। নিজের ঔরসের সন্তান তো প্রায় আমি-ই, সে তো আমারই অংশ। আমি কি আমাকে মারতে পারতাম? আমাকে নিয়ে তোদের আর ভাবতে হবে না। আমাকে আমি চিনে গিয়েছি। তোরা শালা সোহম। ‘সে-ই আমি’। সেই ঈশ্বরের অংশ তোরা। আমিও জেনে গিয়েছি ‘কো হম’–কে আমি। শয়তানের অংশ। আমি বহুত বাজে লোক। স্পার্ম নেই অথচ সেক্স আছে। পুকাই’কে অ্যাডপ্ট করেছিলাম, সেটা সবাই তো জানে। ওকে দিয়ে আমি ‘খেল’ দেখাতে চেয়েছিলাম। খেল। মিরাকেল দেখাতে চেয়েছিলাম।
অনিকেত বলল, এভাবে ভাবিস না বিকাশ। তুই একটা পুরো মানুষ। তোর পঞ্চ ইন্দ্রিয় ষড় রিপু–না কী বলে যেন—তার সব কিছুই আছে। যৌনতা যেমন আছে, বাৎসল্যও আছে। পুকাই’কে ওর ছোটবেলায় বেলুন ধরিয়ে দিসনি—ওর একটু হাসি দেখবি বলে? ওকে কোলে নিয়ে চিড়িয়াখানার বাঁদরের খাঁচার সামনে যাসনি? ওকে ঘুম পাড়াসনি পাশে শুয়ে? গল্প বলিসনি?
—হ্যাঁ, নিউটনের গল্প বলেছি, সেই আপেল পড়ার গল্প, যেন নিউটনের থেকে এথ্যু পায়। ডন ব্র্যাডম্যানের গল্প বলেছি। পক্ষীরাজ-টক্ষিরাজ বলিনি।
—যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। তোর মধ্যে ঠিকই ভালবাসা আছে। একটা অনাথ আশ্রম দেখে এসেছি রানাঘাটে। একটা লোক রাস্তার বাচ্চা ধরে এনে বাড়িতে রেখেছে। ওদের কিছু সাহায্য করবি?
—ওরা ‘জেনুইন’ তো? ঝেড়ে দেবে না তো?
—আমি তো দেখে এসেছি। জেনুইন। সেন্ট পার্সেন্ট।
—তুই বললে দেব কিছু।
—কেন দিবি?
—তুই বললি বলে।
—না। তোর মধ্যেও ভালবাসা আছে বলে। তোর রোজগারের টাকায় আরও কারও ভাল হোক—মনে-মনে চাস বলে। তোদের অফিসে যখন রক্তদান শিবির হয়, তুই ওখানে রক্ত দিস। আমি জানি। কেন দিস?
—ক্রেডিট নেব বলে।
—না কি ভালবাসা তোর ভিতরে আছে বলে? বিকাশ চুপ করে থাকে। কী খেলি আজ? অনিকেত জিগ্যেস করে।
—মদ ফুরিয়ে গিয়েছে। আনতে যেতে ইচ্ছে করছে না।
—এখন বেলা তিনটে মতো বাজে। কিছু খেয়ে নে। আমি নিয়ে আসছি। অনিকেত বলে। দুর্গাপুজো হয়ে গিয়েছে। প্যান্ডেল খোলার কাজ চলছে। এ বছর আলোর খেলায় সন্ত্রাস দেখানো হয়েছিল। আলো সাজিয়ে তৈরি এক জোড়া বাড়ি… একটা এরোপ্লেন ধাক্কা দিল, আর বাড়িটার চারদিকে লাল-লাল কুচো বাল্ব জ্বলতে লাগল—নিভতে লাগল…। মানুষ বলছিল, দারুণ। একটা থিমের পুজোর খুব নাম হয়েছিল এবার। খুব ভিড়। ‘গ্রাউন্ড জিরো’-তে দুর্গাপুজো। পোড়া গাছ থেকে হাত-পা ঝুলছে। চাপ-চাপ রক্ত। দুর্গার কাপড়টা কিছুটা পুড়ে গিয়েছে। অসুরের মুখ লাদেনের মতো। এখন প্যান্ডেল থেকে টেনে-হিঁচড়ে খুলে ফেলা হচ্ছে সন্ত্রাস। এরই মধ্যে দু’টো ঠান্ডা তন্দুরি রুটি আর এক ভাঁড় গরম তড়কা নিল। বলতে ভুলল না ‘পিঁয়াজ কাঁচালঙ্কা’ দিন। পলিথিন ঝুলিয়ে বিকাশের বাড়ি যাওয়ার পথে এদিন গান এল ওর মনে—ভীরু ভীরু চোখে তুমি চলে গেলে’…, ওখানেই আছে ‘এই যে যাওয়া আসা সেই তো ভালবাসা’… ওই লাইনটা সামান্য পাল্টে দিল অনিকেত ‘এই যে নিয়ে আসা সেই তো ভালবাসা’… টারারে টারাটারা টারররা…।
চোখের কোনায় তোর নোংরা। চোখ পরিষ্কার কর বিকাশ। দাঁত মেজে নে। স্নান কর। আমি তোকে খাইয়ে যাব। যখন এসব বলছিল অনিকেত, দেখছিল দেওয়ালে আটকে আছে পারমিতার চোখ। না, চোখ নয়, টিপ। কিছুটা খয়েরি। তাকিয়ে আছে। অপলক।
বিকাশের মাথায় হাত দিল অনিকেত। হাতটা ঘাড় পর্যন্ত টেনে আনল। আর তখন মুখে দু’হাত চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল বিকাশ, আর কী আশ্চর্য, দেওয়াল থেকে টিপ-টা খসে গেল।
বিকাশ কাঁদছে। ভালবাসা পেল বলে? কাঁদালে তুমি মোরে ভালবাসার ঘা-এ?
—এবার একটু চা খেয়ে নে।
রান্নাঘরে গেল অনিকেত।
একদম কিচ্ছু যে খাওয়াদাওয়া করেনি বিকাশ, এমন নয়। কিচেনে গিয়ে ডিমের ভাঙা- খোলা দেখল অনিকেত।
বিকাশের চোখে জল ছিল। জেনুইন। কোনও ব্যাটাছেলে সাধারণত অন্য ব্যাটাছেলের চোখের জল মুছিয়ে দেয় না। ওটা মেয়েদের। হোমো’দেরও। অনিকেত তাই ম্যাজিশিয়ানের কায়দায় হাওয়ায় হাত নাড়িয়ে চোখের জল মোছানোর মূকাভিনয় করে বলে, কাঁদিস না। বি স্টেডি। বিকাশ ফোপায়। যতটা স্বতঃস্ফূর্ত, তার চেয়ে কিছুটা বেশি। এ সময়ে কোনও পুরুষ নারী-কণ্ঠে শুনতে চায়, ‘এরকম করে না সোনা…’
কথাটা পাড়ার এটাই শুভযোগ—অনিকেত ভাবল।
বলল—যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে বিকাশ, নতুন করে আবার জীবন শুরু কর। আমি একটা ছেলেকে বাড়িতে রেখেছিলাম, জানিস নিশ্চই। শুক্লা-ই ওকে রেখেছিল। স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল। নরম টাইপের ছেলে, ওবিডিয়েন্ট। তোর কাছে থাক ও। রান্নাবান্নাও টুকটাক জানে, তবে ওকে দিয়ে রান্না করাতে হবে না, রান্নার লোক রেখে দে। ওই ছেলেটা তোর কাছে থেকে পড়াশোনা করুক, ওর কেউ নেই। ওকে নিয়ে নে। পরে ওকে কিছু একটা রোজগারপাতির ব্যবস্থা করে দিস। এমনও হতে পারে, ওকে ড্রাইভিং-টা শিখিয়ে দিলি, তুই যদি গাড়ি কিনিস, ও চালাবে। ড্রাইভার কাম সেক্রেটারি। আগেকার দিনে বড়-বড় বাড়িতে নায়েব থাকত। বাজারহাট থেকে গার্জিয়ানগিরি সব করত। এখন নায়েবের বদলে ড্রাইভার। অনেক বাড়িতে ড্রাইভারই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। পারমিতার সঙ্গে মান-অভিমান শেষ হয়ে গেলে, ও তো চলে আসবে, ওরও খুব উপকারে আসবে। একটা সারপ্রাইজ হবে বেশ।
তোরা ছাড়ছিস কেন ওকে? বিকাশের গলার স্বরে একটু করে প্রত্যয় জেগে উঠছে যেন…।
—শুক্লাকে আমার ওখানে নিয়ে যাব ভাবছিলাম তো… দুলালের মা বলে যে-মহিলাটি কাজ করত আমাদের বাড়ি, ওর নাতি ও। বাবা-মা নেই। বুড়ি বলে গিয়েছিল নাতিটাকে দেখতে শুক্লা তাই রেখেছিল ওকে। ওর জন্য শুক্লা আটকে গিয়েছে। তোর যদি উপকার হয়, তোকে দিতে পারি।
—চুরিটুরি করে পালাবে না তো? বিকাশের গলার স্বর ক্রমশ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠছে।
—না না… খুব অনেস্ট। এ ব্যাপারে গ্যারান্টি।
কাপড়ের ফেরিওলার মতো কথাটা নিজের কানেই লাগল অনিকেতের। ‘একদম পাকা রং মশাই, গ্র্যান্টি’…।
—বলছিস? একটা ছেলেটেলে হলে তো ভালই হয়… ঠিক আছে, একবার পারমিতার সঙ্গে একটু… ধুর। অভ্যেসটা গেল না। আগে সব কিছুর আগেই বলতাম তো ‘পারমিতার সঙ্গে একটু কথা বলেনি’ অভ্যেসটা রয়ে গিয়েছে। আমার বাবা খাওয়ার পরে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাত। সব দাঁত ফেলে দেওয়ার পরও খাওয়ার পর একটা কাঠি নিয়ে মুখের ভিতরে ঢোকাত। দিয়ে যাস ছেলেটাকে। ওকে একদম ছেলের মতো দেখব না। ছেলেটেলের মতো ভাবব। কোনও সেন্টিমেন্ট নয়। বয়স কত?
—চোদ্দো-টোদ্দোর মতো। অনিকেত মাথা চুলকে বলে।
—বাজে বয়স। আমার পুকাই…। হ্যাঁ, একটা কথা। ও কিন্তু পুকাইয়ের সাবস্টিটিয়ুট নয়। নেভার।
—ঠিকই তো ও কেন পুকাইয়ের সাবস্টিটিয়ুট হতে যাবে? থাকবে বাড়িতে। খাবে, লেখাপড়া করবে, দরকার হলে চা-টা করে দেবে, খাবারদাবার আনবে… এই তো…।
—ঠিক আছে। দিয়ে যাস…।
একটু আনন্দ-আনন্দ ভাব হল অনিকেতের। একটা অচল টাকা চালিয়ে দেওয়ার আনন্দ হল ওর মনে।
অটোয় উঠল। অটোয় স্টার্ট দেওয়ার শব্দে যেন শুনতে পেল আদম ব্যাপারী।
‘আদম ব্যাপারী’ কথাটা শুনেছিল এক বাংলাদেশির মুখে। যারা মানুষ পাচার করে ওদের ‘আদম ব্যাপারী’ বলে। ওই ব্যবসায়ীরা লোক পাঠায় মধ্য প্রাচ্যে, মালয়েশিয়ায়, সিঙ্গাপুরে….। শ্রমিকের কাজে পাঠায়। অটোর ঘরঘর শব্দে শোনে, দাস ব্যবসা এখনও আছে। দাদা, দাস ব্যবসা এখনও আছে… দাদা : দাস ব্যবসা… মানুষ পাচার…
বার্লিন শহরের ওপর একটা ভিডিও দেখেছিল ইন্টারনেট-এ। মনে পড়ল। আলেকজান্ডার ট্রাসে এলাকার একটা রাস্তা। পুরনো বাড়িগুলোয় বুলেটের ক্ষত। হিটলারের আমলে সমকামীদের ওখানে জড়ো করে গুলি করা হয়েছিল। তখন কে নর্ডিক, কে ইহুদি বিচার করা হয়নি। জানা গিয়েছে সমকামী, ব্যস। গুলি করে মারো। ১৯৪৩ সালের বুলেটের শব্দ এখন অটোর ইঞ্জিন থেকে বের হচ্ছে কেন? লরির কালো ধোঁয়া ওকে কি দুয়ো দিচ্ছে?
কেন এমন মনে হচ্ছে? ছেলেটাকে তো পাচার করছে না, বেচেও দিচ্ছে না নিলাম বাজারে। একটা মার্কেটের সামনে নেমে গেল অটো থেকে। মন্টুর জন্য একটা শার্ট কিনল বেশ ভাল দেখে।
পরি বলেছিল, ওর মা ওকে নিয়ে রাস্তায় বেরয় না। পরি বলেছিল, ওর মামার বাড়িতে কার যেন বিয়ে ছিল। না-গেলেই নয়। মঞ্জু একা গিয়েছিল, পরি পরি-র মতো। অনিকেত কি মন্টুকে নিয়ে খুব একটা বেরয়? বাজার-টাজার ছাড়া? বাজারে নিয়ে যায় ব্যাগটা বইবার জন্যই তো। মানুষ কেমন করে যেন তাকায়। মানুষের চাউনিকে বড় ভয়। কোনও-কোনও চাউনি আছে—নারকোল কোরানির মতো। ছেঁচে দেয়। কোনও-কোনও চাউনি—গুলতির মতো। টাই করে লাগে। কোনও-কোনও চাউনি—পিন ফোটানোর মতো।
অনিকেতের মনে পড়ে, একদিন ওর অফিসের কর্তাদের কনভিন্স করিয়ে নিষিদ্ধ আর গোপন ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিল, ‘ট্যাবু’ বিষয়গুলোর তালা খুলে দিয়েছিল, গুমরে-মরা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। বেতারে। বলেছিল, সমকাম কোনও বিকৃতি নয়। সমকামীদের সমাজের মূল স্রোতে রাখার জন্য সওয়াল করেছিল। এখন, একটা ওই ধরনের-ছেলেকে নিজের সংসার থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। হিপোক্রিট। কথায় কাজে মিল নেই।
বার্ডেন। বার্ডেন। হোমো-টোমো নয়, কোনওরকম ঝামেলাই আমি চাইনি আসলে। আমি তো আমার স্ত্রী’র চাপে পড়ে ওকে ঘরে ঢুকিয়েছিলাম…. যেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে উত্তর দিচ্ছে অনিকেত। ওর জন্য মাস্টারও রাখা হয়েছিল পড়ানোর জন্য। আমি একটা সরকারি চাকরি করি, কতই-বা মাইনেপত্র পাই? ওর জন্য তো চেষ্টা করেছিলাম…
—কী চেষ্টা?
—পড়াশোনার… খাওয়াদাওয়া আমাদেরই মতো। বরং ও ঘরে ছিল বলেই মাছটাছ আনা হত। কচুরি-সিঙাড়া-রোল। নইলে শুক্লা খুব সিম্পল লাইফ ‘লিড’ করে। এই তো দেখুন না ধর্মাবতার, জামার প্যাকেট। ব্র্যান্ডেড। মন্টুর জন্যই তো কিনলাম। বাড়ি যাওয়ার সময় বোঁদে নিয়ে যাব মন্টু ভালবাসে বলে।
মন্টুর পক্ষের উকিল বলল—ওসব তো কাঁঠালপাতা মশাই। যে-পাঁঠাকে বলি দেওয়া হয়, ওর জন্য কাঁঠালপাতা এনে রাখা হয় দ্যাখেননি? কী বলবেন অনিকেতবাবু?
—তা কেন? তা কেন? ওকে তো অন্য একটা জায়গায় ব্যবস্থা করছি। ভাল থাকবে-খাবে। ও যদি ওর বাড়িতে থাকত, ওর জ্ঞাতিরা হয়তো প্রাণেই মেরে ফেলত ওকে। বলতে গেলে উদ্ধার করে বাড়িতে রেখেছিলাম। লেখাপড়ার জন্য মাস্টারও…
—লেখাপড়ায় কেমন ছিল মন্টু?
—ভাল না, একদম ভাল না। রেজাল্ট ভাল করত না একদম। আমি নিজেও ওকে পড়াতে গিয়েছি। কিস্যু মাথায় ঢোকে না।
—ছবিটবি আঁকতে পারে? –না, সেসব গুণও নেই।
—গান গাইতে পারে?
—না, তাও না। যদি ওসব পারত, যদি জানতাম ট্যালেন্ট আছে, রেখে দিতাম ঘরে। আদর করে রেখে দিতাম। ‘হোমো’ তো কী হয়েছে? পৃথিবীতে কত গায়ক, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালকরা ‘গে’। ও তো কোনওটাই না।
—বেশ। একস্ট্রা-ট্যালেন্টেড হলে ওকে ঘরে রাখতেন। মানে মূল স্রোতে রাখতেন। তেমন ট্যালেন্টেড নয় যারা—ওদের কী হবে? দুরছাই করে বিদেয় করবেন? যদি ও আপনার নিজের ছেলে হত? নিজের ঔরসজাত, এবং ওর বয়ঃসন্ধিতে বুঝতেন ও ‘গে’, তা হলে কি করতেন?
—এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন হয়? সিম্পল উত্তর—ওকে মানুষ করতাম।
—যদি ওর ঘরে ছেলেবন্ধু ঢুকত, এবং বুঝতেন ছেলেটির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত, কী করতেন?
—আমি কিছু মনে করতাম না, তবে শুক্লা …
—সব কিছু শুক্লার ঘাড়ে চাপাবেন না। সব দোষ শুক্লার–আর, আপনি তুলসী পাতা। মনে করুন মন্টু আপনার ছেলে, এবং সে মিডিওকার। এবং ‘গে’। কী করতেন আপনি?
—আমি? আমি কাউন্সিলিং করাতাম…
—ন্যাকা? একমাত্র পরিবেশগত কারণ হলে কাউন্সেলিং-এ কাজ হয়। হোস্টেলে, জেলখানায়, মিলিটারি ব্যারাকে যেসব সমকামী সম্পর্ক তৈরি হয়, এবং পরে অভ্যেস হয়, কিংবা বয়ঃসন্ধিতে একটু-আধটু—যা নিছক কৌতূহলবশত, কাউন্সেলিং-এ তাতে হয়তো কাজ হয়। আপনি সবই জানেন অনিকেতবাবু। এখানে ওসব নিয়ে বক্তৃতা মারার জায়গা নেই।
—তবুও কাউন্সেলিং-ই করতাম। পিতা হিসেবে ওটা আমার কর্তব্য ছিল। সেটা করাতাম।
—তো, মন্টুর ক্ষেত্রে সেটা করাচ্ছেন না কেন?
—হয়তো লাভ হত না…
—দু’রকম কথা হয়ে যাচ্ছে অনিকেতবাবু। লাভ হবে কি হবে না সে তো পরের কথা। প্রথমে তো আপনি প্রাথমিক চেষ্টাটা করতেন, না কি?
—অত ঝামেলা পারব না। প্রথমে কাউন্সেলিং, তারপর ওষুধ, তারপরে শক থেরাপি, তারপরে ব্লু ফিল্ম দেখানো… তাতেও কাজ হবে কি না ঠিক নেই, আমি পারব না… আমি হাত উঠিয়ে দিলাম ধর্মাবতার। আমি ছাপোষা মধ্যবিত্ত। ব্র্যান্ডেড শার্ট কিনি না, ফুটপাথে বাজার করি, বড় রেস্তোরাঁয় ঢুকি না সাধারণত… আমি অত পারব না। যা করেছি অনেক করেছি, আমায় যা শাস্তি দেওয়ার দিন।
এজন্য তো কোনও শাস্তির নির্দেশ নেই বাবুসোনা… ধর্মাবতার হাসেন।
অনিকেত মুক্তি পায়। ওর হাঁটাটা নিজের কাছেই একটু অন্যরকম লাগছে। প্রেমার্থ কবির কবিতাটা মনে পড়ল। ‘চাঁদেতে কম ‘G’ তাই চাঁদে লাফাচ্ছি’—এরকম কিছু। হালকা লাগছে।
‘এখানে অর্শ-ভগন্দর দাদ-হাজা নারী-পুরুষের গোপন রোগ সারানো হয়।’ ‘মদ ছাড়ানো হয়’ একটা সাইন বোর্ড দেখল অনিকেত। সমকামিতা সারানো হয় এরকম বিজ্ঞাপনও দেখেছিল কোথাও। ওয়েবসাইটে বোধহয়। লং ডিস্ট্যান্স ট্রিটমেন্ট। একজন ‘যোগগুরু বলেছিলেন প্রাণায়ামে সমকামিতা সারে। পিরের দরগায় কিংবা মন্দিরের সামনের গাছে যেসব ঢিল ঝোলে, মনোবাসনার—সেখানে কি সমকামিতা-মুক্তির ঢিলও ঝোলে? মঞ্জু কি পরির জন্য ঝুলিয়েছিল ওরকম কোনও টিল?
সত্যিই যদি অনিকেতের ছেলেই হত মন্টু, বা মন্টুর মতো কেউ? শুক্লা কি খুন্তির ছ্যাঁকা দিত? না না, শুক্লা ওরকম করত না হয়তো।
একটি ছেলেকে দেখেছিল, ওর হাতের চামড়া কুঁচকে গিয়েছে। রবীন্দ্রসদনে ওদের আড্ডায় হাত নেড়ে কিছু নিষেধ করছিল। হাতের চামড়া ছিল কুঁচকানো। কেন জিগ্যেস করেনি অনিকেত। জিগ্যেস করা যায় না। শুধু খুন্তির ছ্যাঁকায় হয় না ওরকম।
এখনও তো মৃগী রোগের ওষুধ দেওয়া হয়—একদল ডাক্তার বিশ্বাস করেন সমকামিতা এক ধরনের নিউরো এপিলেটিক দশা। কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স-ও ঘটানো হয়। নগ্ন পুরুষ শরীর দেখানো হয়, ছবিতে কিংবা ভিডিওতে, এবং ওটা দেখলেই ইলেকট্রিক শক; পুরুষ শরীরের দিকে তাকালেই শক খেতে হবে এরকম একটা রিফ্লেক্স তৈরির চেষ্টা এখনও তো চলে।
কে জানে অনিকেত কী করত?
মঞ্জুকে নাকি এক কাউন্সেলর বলেছিলেন—পর্নোগ্রাফি-র বই পড়তে দিন—মেয়েদের ছবিটবি দেখুক, পারলে ব্লু।
—মা হয়ে কী করে আমি এসব করব?
—সেটা আপনি বুদ্ধি বার করুন।
অন্য এক সাইকোলজিস্ট বলেছিলেন—গান-বাজনা শুনতে দেবেন না একদম। আর্ট- ফার্টের ব্যাপারটা থেকে দূরে রাখবেন। ওগুলো হল ফেমিনিশ। ওই নন্দন, অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্র সদন চত্বরে যত কম যায় ততই ভাল।
ও যেখানে থাকে, সেখানকার একজন মহিলা বলেছিল-তোমার ছেলেকে আমি সাতদিনে ঠিক করে দিতে পারি। আমার এক বোনঝি আছে। ব্যাটাছেলে চরিয়ে খায়। একটু টাকাপয়সা নেবে, কিন্তু এমন করে দেবে যে, মেয়েছেলের জন্য পাগল হয়ে যাবে। ছলছাতুরি জানা মেয়ে চাই। তোমার ছেলের চেয়ে আমার ভাইঝি বয়সে বড়। তাতে কী, এক হপ্তা ওর সঙ্গে মেশামিশি করতে দাও, ঘর ছেড়ে দাও, গ্যারান্টি দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে। মঞ্জু এসব বলেছিল অনিকেতকে।
অনিকেত জ্ঞান দিয়েছিল, বলেছিল, এসবে কিচ্ছু হয় না।
সেই কথাটাই আবার নিজেকে বলল।
সত্যিই বোঁদে কিনল। বাড়ি এসেই মন্টুর হাতে বাক্সটা দিল অনিকেত। বলল, বোঁদে। তুই ভালবাসিস…।
মন্টু লাজুক হাসল। বাঁ হাত দিয়ে আবার হাসিটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করল। বিকাশ ঠাকুরপোকে কেমন দেখলে? শুক্লা জিগ্যেস করল।
—ওর সঙ্গে সত্যিই কারও থাকা দরকার। একা থাকলে মরে যাবে। কথা বলে এসেছি। মন্টুকে রেখে দেব ওখানে
শুক্লা দাঁতে ঠোঁট চাপল একটু। ওটা অনেকটা ‘যেতে নাহি দিব’-র বডি ল্যাংগুয়েজ। তারপর ঠোঁট থেকে দাঁতটা ছেড়ে দিয়ে ঠোঁটটা উলটে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এটা হল— ‘তবু যেতে দিতে হয়’।
শুক্লা বলল, কবে পাঠানোর কথা ভাবছ?
—এবারে পাঠিয়ে দিলেই হয়… অনিকেত বলল।
—শুক্লা আবার ঠোঁট কামড়াল।
—ওর স্কুল কী হবে, স্কুল?
—ওখানে কি স্কুল নেই? কোথাও ভর্তি হয়ে যাবে… -ভাঙা-মাসে স্কুলে ভর্তি নেবে নাকি কেউ?
—তার মানে সামনের বছর? অনিকেত বলে।
শুক্লা বলে—তা হলে আরও ক’মাস। থাকুক…। ও তো চেঞ্জও হতে পারে, তাই না? ওকে কোনও সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে গেলে হয় না?
ব্যাপারটা আবার রিওয়াইন্ড হয়ে গেল।
শুক্লা বলল, একটু ভাল থাকতে চেয়েছিলাম আমি। ভাল থাকার এত ঝামেলা? আমি ভেবেছিলাম, একা-একা ভাল থাকা যায় না, ভাল থাকা অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। নিজের ভাল থাকাটা কিছুটা অন্যকে দিতে হয়। অন্যের ভাল লাগার কিছুটা নিতে হয়। ওই জন্যই তো কল্পনাদির সঙ্গে কাজ করছি। তুমি বিজয় লামা-র কথা বলেছিলে না, কী সুন্দর করে বেঁচে আছে। আমি তো এজন্যই মন্টুকে এনেছিলাম। ও ভাল করে বাঁচবে, ওকে ভাল করে মানুষ করব…। কিন্তু …
—কিন্তু কী?
—কিন্তু ও তো ভাল থাকার নয়…। ভাল থাকছে না। পরপর কয়েকটা ঘটনায় …। অনিকেত মহা সমস্যায় পড়ল। বলে ফেলেছিল প্রায়—ওর বয়ঃসন্ধির এই আচরণ, ওর যৌনতা- সম্পর্কিত ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপর তোমার ভাল থাকা না-থাকা নির্ভর করছে কেন?
বলল না। বাঁশ কেন ঝাড়ে… না না, কী দরকার বাবা—খাচ্ছে তাঁতি তাঁত বুনে কাল হলে এঁড়ে কিনে….।
অনিকেত বলল, মন্টুর এই স্বভাব পালটাবে না। আমি দেখেছি কয়েকটা কেস। পালটায় না।
শুক্লা বলল, কল্পনাদি-র সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলব ভেবেছিলাম… কিন্তু নিজেদের ঘরের কথা… বলিনি… যদিও কল্পনাদি খুব ভাল, হেল্পফুল। বললে নিশ্চয়ই কোনও সাইকোলজিস্ট- এর সন্ধান দিতে পারবেন।
—সে তো তুমিও খোঁজ করতে পারো…।
অনিকেত বলল, খোঁজ করে দেখতেই পারি, কিন্তু মিছিমিছি সময় যাবে। আমার এত সময় কোথায়? তুমি নিয়ে যাবে? একদিন গেলে আবার হয় না… অনেকগুলো ‘সিটিং’ দিতে হয়।
শুক্লা বলল, ওর সঙ্গে বাইরে বেরতেই আমার লজ্জা করে। কেমন করে যেন হাঁটে, কেমন করে যেন তাকায়…।
—তাতে কী হয়েছে? হাঁটাচলা নিয়ে এত ভাবার কী আছে? ওর যদি একটা পায়ে ডিফেক্ট থাকত? ওর সঙ্গে হাঁটতে না?
মহৎ থাকাটাও একটা লোভ। সবাই কেমন অন্যের কাছে মহৎ থাকতে চায়। নিজের স্ত্রী- পুত্রের কাছেও। এমনকী নিজের কাছেও। অনিকেত যে মন্টুকে বিদেয় করতে ততটা আগ্রহী নয়, সেটা শুক্লার কাছে দেখাতে চায়। অনিকেত শুক্লার মনটা বুঝে ফেলার পর বলে—তোমার কল্পনা মৈত্রকে বলে দ্যাখো না, উনিই নিয়ে যাবেন। উনি নিশ্চয়ই আগ্রহী হবেন…।
শুক্লা বলল—এইমাত্র তুমি যে বললে—কাউন্সেলিং করে কিছু হয় না…। আমারও তো মনে হয়, এটা জন্মগত
অদ্ভুত একটা লুডোখেলা চলছে। কেউ সাপের মুখে পড়তে চাইছে না। একবার জোরে শ্বাস নেওয়ার সময় অনিকেতের মনে হল ই’-তে ইচ্ছে। শুক্লা বোর্ডে লিখে রেখেছে। একটা ইচ্ছে তৈরি হচ্ছে না তো…
অনিকেত শুক্লার দিকেই বলটা ঠেলে দিল। বলল, তুমি যা ভাল বোঝো…। তবে এটা ঠিক, ইচ্ছে করলেই তুমি তো বলতে পারতে কাল থেকে এই বাড়িতে তোর স্থান নেই। তা তো বলছ না। একটা অল্টারনেটিভ ব্যবস্থা করে দিচ্ছ…।
শুক্লা আবার ঠোঁট কামড়ায়।
অনিকেত বলে, পারমিতার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাও?
শুক্লা বলে, পারমিতা কিচ্ছু বলবে না। বিকাশকে নিয়ে ওর কোনওরকম ইনভলভমেন্ট নেই ও বলেছে। ফোনে কথা হয়েছে কয়েকবার। শুধু এ কারণে নয়, পুকাইয়ের মৃত্যুর জন্যই নয়, বিকাশকে নানা কারণে হেট করে ও। আমাকে বলেছে।
অনিকেতও কিছু-কিছু জানে। বিকাশ মহিলার সঙ্গ করে। কোনও মহিলার সঙ্গে শুতে পারাকে ও পৌরুষের প্রকাশ মনে করে। ওর স্পার্মহীনতা-জনিত হীনম্মন্যতা থেকেই হয়তো ওটা করে। বিকাশ সব কিছু খুলে বলেনি, তবে বিকাশকে একাধিকবার বলতে শুনেছে, কোনও মহিলাকে শোয়ানো আমার কাছে জলভাত। ভেরি ইজি টাস্ক।
হ্যাঁ, ‘টাস্ক’ শব্দটা বলে।
স্কুলের ফার্স্ট বয় উৎপলের মতোই। অনুশীলনীর শেষের কঠিন অঙ্কগুলোকে ও বলত “ইজি টাস্ক’।
শুক্লার ঠোঁট কামড়ানো শেষ হয়ে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে।
শুক্লা এবার বলল, আমি না, তুমিই বলো। তুমি যা বলবে….
অনিকেত বলল, না, তুমিই বলো।
যেন ‘সপ্তপদী’ সিনেমার উত্তম-সুচিত্রার মোটরসাইকেল ট্রিপ। ‘না না তুমিই বলো’। মুখে হাসি, চোখে ছল, প্রেমে ভরা মন।
৪৭
মঞ্জুর অফিসে হঠাৎ কার্তিকের আবির্ভাব। মঞ্জু দেখল, কার্তিকের চুলে দু তিনরকম রং। কিছুটা কালো, কিছুটা সাদা, কিছুটা বাদামি। বোঝা যাচ্ছে অনেক দিন কলপ করা হয়নি। পাজামার ওপর ঝুলছে একটা হাফ শার্ট। শার্টের ওপর একটা হাফ সোয়েটার। হাতে লাল সুতোয় বাঁধা মাদুলি দেখা যাচ্ছে।
অফিসে মঞ্জু যে-টেবিলে বসে, তার উল্টো দিকে রয়েছে চার-পাঁচটা প্লাস্টিকের চেয়ার। আগে ছিল বেঞ্চি। ক্লায়েন্টদের কনডাক্ট ট্যুরের লিস্টি দেয় মঞ্জু, কাঞ্চিপুরমে মাছ-ভাত না কি ব্রেড-বাটার, ডায়াবিটিস রোগীদের চিনি ছাড়া চা সাপ্লাই করা হবে কি না—এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়। যারা খোঁজখবর করতে আসে, ওদের নাম-ঠিকানা-ফোন নম্বর টুকে নেয়। পরে তাগাদা দেয়। কী স্যর, কবে যাচ্ছেন? হ্যান্ডবিলে যা লেখা আছে, তার থেকে শতকরা পনেরো ভাগ পর্যন্ত কনসেশনের ক্ষমতা দেওয়া আছে মঞ্জুকে। যদি পনেরো-র বদলে দশ পার্সেন্টে ক্লায়েন্ট ধরতে পারে, বাকি পাঁচ পার্সেন্টের অর্ধেক সে পায়। ফলে অফিসে একটু দরাদরি চলে। ‘কিছু করতে পারব না স্যর, এখন হেভি ডিম্যান্ড, একবার আমাদের সঙ্গে ঘুরেই দেখুন না, আবার আসবেন’—এরকম কত কথা বলতে হয়। দু-এক সময় বিনা কনসেশনেই খদ্দের শিকার হয়ে যায়। তখন বরাদ্দ পনেরো পার্সেন্টের তিনভাগের একভাগ মঞ্জুর।
তবে এরকম মার-দিয়া-কেল্লা কেস কমই হয়।
দশ পার্সেন্ট সবাইকেই দিতে হয়।
কিন্তু আশ্চর্য, কমিশনের টাকা পেলেই মনে হত, এই বাড়তি টাকাটা ছেলের জন্য খরচ করি। ছেলের চিকিৎসার জন্য। যখন পরি কথা শুনত, তখন সাইকোলজিস্টদের কাছে নিয়ে গিয়েছে। কম টাকা তো খরচ করেনি, এখন মাঝে-মাঝে লিপস্টিক, আইব্রো পেনসিল এসব নিয়ে যায়। ছেলের জন্যই, কিন্তু নিজে হাতে দিতে পারে না, বলতে পারে না যে, ‘তোর জন্য এনেছি।’ টেবিলে এমনি ফেলে রেখে দেয়। পরি-ও বোঝে এসব ওরই জন্য।
এখন মঞ্জুর উল্টো দিকে একজন মাত্র লোক বসে আছে। কেটারারের লোক। টাকা পাচ্ছে না, মঞ্জু বোঝানোর চেষ্টা করছে—এই বিষয়টা ও দেখে না। ‘ঘোষবাবু জানেন, উনি আজ আসেননি, পরে আসবেন।’ লোকটা বলছে, ‘ঘোষবাবু-ফোসবাবু বুঝি না, আপনাকে পেয়েছি, আপনাকেই ধরব। ঘোষবাবু বলেছিল আজ আসতে, অথচ নিজেই এল না। একমাস ধরে ঘুরছি। নকশা-নকশা মুখ করে বলা হচ্ছে আমি কিছু জানি না? নাটক? ডাকুন আপনার ঘোষবাবুকে।’
কার্তিক এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল টেবিলের সামনে। মঞ্জুর মুখে অবাক হওয়ার ভাবটা ফুটেও উঠেছিল। মঞ্জু বাঁ হাতে একবার চেয়ারটা দেখিয়ে বসার ইঙ্গিতও করেছিল, কার্তিক বসেনি।
ওই ছোট্ট ঘরটায় তখন আর কেউ ছিল না। লোকটা কার্তিককে দ্যাখে। বলে, আপনি এই কোম্পানির লোক?
কার্তিক বলে, আমি এই কোম্পানির কেউ না। আমি ওঁর স্বামী।
‘স্বামী’ শব্দটা ঝম করে বেজে ওঠে। সুমনের গানে ‘কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’ বলার সময় গিটারে যেমন দুর্দান্ত শব্দ ওঠে—সেরকম। মঞ্জু সেই মুহূর্তে কেমন বিহ্বল হয়ে যায়।
লোকটা একটু মিইয়ে যায়।
বলে—আপনার স্ত্রী-কে বলুন যেন আমার টাকাটার ব্যবস্থা করে দেয়। লোকটা সিট ছেড়ে উঠে যায়। বলে, পরশু আসব, যেন পেমেন্টটা পেয়ে যাই।
কার্তিক লাল চেয়ারে বসে।
মঞ্জু ওর মুখের দিকে তাকায়। ওর মুখে ধান-কাটা মাঠ, ওর মুখে পুরনো ফাইলের ধুলো। ঠোটের কোনায় জ্বরঠোসা। কার্তিক মঞ্জুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কপালের দিকে। কপালে-আঁকা সিঁদুরের চিহ্নের দিকে। মঞ্জু ‘কেমন আছো?” বলতে যাবে, ঠিক সেই সময়েই কর্তিক একই কথা বলল। ছোট্ট দু’টো বাক্য মিশে গেল, কিন্তু প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে থাকল। টেবিলে কার্তিকের দু’হাত।
মঞ্জু দেখল, কার্তিকের দু’হাতেই আংটি। আংটিতে পাথর। পাথর জৌলুসহীন। এসব পাথর ফুটপাতের। মঞ্জু দেখল শুধু পাথর নয়, আড়াই প্যাঁচ তামার তার প্যাঁচানো আংটিও আছে। ওটা অর্শের। ঘোষবাবুর আছে। আরও দেখল, একটা আংটির গায়ে লেখা ৭৮৬। ওর এন্টালি এলাকায় অনেক মুসলমান থাকে। ওদের দোকানে এরকম লেখা দেখেছে।
হঠাৎ কী মনে করে? মঞ্জু বলল।
—দেখতে এলাম।
—কেন?
—এমনি।
মঞ্জুর হঠাৎ মনে হল, টাকাপয়সা চাইবে না তো?
জিগ্যেস করে ফেলল—ব্যবসাপতি কেমন চলছে?
—একদম ভাল চলছে না। বড়-বড় কারখানা সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর একটা সামান্য লেদ কারখানা…
—চলছে তো, না কি….
—চলছে টুকটাক করে।
—আর শরীর কেমন আছে, শরীর?
কার্তিক বলল—শরীর?
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন উত্তর খুঁজছে।
কার্তিক আবার উচ্চারণ করল ‘শরীইইর’, যেন ‘হায় শরীর’ কিংবা ‘ধিক শরীর’।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফুসফুসের হাওয়াটা মুখ দিয়ে বার করে দিল—যেন ‘শরীর’ শব্দটাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিল কার্তিক। তারপর আবার অনেকটা নতুন বাতাস টেনে নিল ফুসফুসে। বলল, ঝুমা মারা গিয়েছে।
ঝুমা সেই মেয়েটার নাম। যে কার্তিককে ছিনিয়ে নিয়েছিল। যে ওর সতীন। কার্তিকের মুখ দেখে মঞ্জু বুঝল, ও দুঃখে আছে। একটা অলীক চামচিকে ‘বেশ হয়েছে, বেশ হয়েছে’ বলতে- বলতে উড়ে গেল। কিন্তু মঞ্জুর মনের ভিতরে ওই মৃত্যুসংবাদ কোনও আনন্দ দিল না। মঞ্জুর ভিতরে বসে-থাকা বারো বছর আগেকার মঞ্জুটাও হাততালি দিয়ে উঠল না। মঞ্জুর ভিতরে বরং তার যৌন-শীতলতার কারণে একটা অপরাধবোধ-ই ছিল। কৈশোরের যে যৌন- উৎপীড়নজনিত ট্রমা মঞ্জুকে শীতল করে রেখেছিল, যৌনভীতি দিয়েছিল—সেই ট্রমা হয়তো এখন আর নেই। তবে এই দীর্ঘ বিচ্ছেদে কখনও স্বপ্নেও কার্তিককে বলেনি—’পরশ করে দেখ দেখি রোমাঞ্চ জাগে কি…।’
—কী হয়েছিল? হঠাৎ কেন …
‘মৃত্যু’ শব্দটা বা ওর কাছাকাছি কোনও শব্দ মুখ দিয়ে বেরল না মঞ্জুর।
—ক্যানসার হয়েছিল… অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল…।
মঞ্জু চুপ করে রইল। এই যে এত দুঃখ লোকটার মুখে, তা বউ মরে গেল বলে, না কি টাকা খরচ হয়ে গেল বলে?
‘বউ’ কথাটা মনে আসতেই মঞ্জুর ভিতরের পুরনো মঞ্জু প্রতিবাদ করে উঠল–বউ না, বউ না। বিয়ে তো করেনি…।
এই মঞ্জু বলল—কে জানে করেছে কি না। আইনত তো পারে না। তবে নিশ্চয়ই কালীঘাট বা অন্য কোথাও…।
—কবে হল ঘটনাটা? মঞ্জু জিগ্যেস করল।
—মাসখানেক হয়ে গেল।
—অনেক দিন ভুগেছিল?
—ভুগছিল। অম্বল, পেট গরম, তারপর রক্ত পায়খানা। ক্যানসার ধরা পড়ার পর আর দু’মাস বেঁচে ছিল। ওই দু’মাসেই আমি ফতুর হয়ে গিয়েছি।
মঞ্জুর হঠাৎ মনে হল—টাকাপয়সা চাইবে না তো এবার? মঞ্জু আগ বাড়িয়ে বলে দিল— আমার কোম্পানির অবস্থা খুব খারাপ। মাইনেপত্র বাকি পড়ে আছে।
কার্তিক বলল—তা তো বুঝতেই পারছি। পাওনাদারগুলো আসছে…।
মাথা চুলকোল কার্তিক।
কার্তিককে এত কাঁচুমাচু অবস্থায় কখনও দ্যাখেনি মঞ্জু। মঞ্জুর সঙ্গে ছাড়াছাড়িটা হঠাৎ করে তো হয়নি, আস্তে-আস্তে হয়েছে। ‘ধুর ব্যাঙ, এই কাঠের সঙ্গে শোওয়ার চেয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে শোওয়া ভাল’–থেকে—’ধুর ল্যাওড়া, সামনের হপ্তাতেই চলে যাব’ হতে সময় তো লেগেছিলই। ‘এমন একটা ছেলের জন্ম দিলে তুমি, ছিঃ।’ ‘ঠ্যাং ফাঁক করো না কেন? অ্যাঁ? যেন মরচে পড়া প্লায়াস। মরচে পড়া প্লায়াস কি করে খুলতে হয় জানো? অ্যাসিডে চুবিয়ে। গর্তে ফানেল ঢুকিয়ে না, অ্যাসিড ঢেলে দেব। নাইট্রিক অ্যাসিড।’
ওরকম সম্পর্কের দিনে ওই মেয়েটাকে দেখেছে মঞ্জু বেশ কয়েকবার, কার্তিকের সঙ্গেই। একবারই জিগ্যেস করেছিল। উত্তরটা ছিল ‘ঢালার জায়গা। এই বয়সে বউ থাকতে হাওড়া- শেয়ালদা করব না কি?’ ও যখন চলে গেল বাড়ি ছেড়ে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বলল, ‘এই ঘরের ভাড়া আমি গুনতে পারব না, তোমার মাইগা ছেলের কোনও দায়িত্ব নিতে পারব না। আমি চললাম।’
আমি কী করব? মঞ্জু জিগ্যেস করেছিল। ‘যা ছিঁড়বে ছেঁড়ো—আমি কী জানি?’—এটাই ছিল জবাব।
দু’টো হ্যান্ডব্যাগ আর একটা ট্রাঙ্ক রিকশায় তুলে চলে গিয়েছিল কার্তিক। এরপরও কার্তিকের সঙ্গে দেখা হয়েছে রাস্তায়। ওই মেয়েটার সঙ্গে দেখেছে রিকশায়। দেখে মঞ্জু মুখ ফিরিয়েছে। কার্তিক নয়। কার্তিক যেন ডাঁট নিয়ে, কলার তুলে বলেছে, ‘দ্যাখো, দ্যাখো, আমার মেয়েছেলের অভাব হয় না।’
রান্না করে খাচ্ছো, না কি হোটেলে? মঞ্জু জিগ্যেস করল।
—রান্না-ফান্না কি ব্যাটাছেলের পোষায়?
—ও!
—আমারও গ্যাস-অম্বল হয়ে গিয়েছে।
—ও।
কার্তিক আবার মাথা চুলকোল। ‘গ্যাস-অম্বল হয়ে গিয়েছে’ বলার পরও মঞ্জুর নির্লিপ্ততা দেখে এবার কী বলবে ঠিক করতে পারল না। বলার কিছু পাচ্ছিল না বলেই যেন বলে ফেলল—ওর খবর কী?
‘ও’ মানে কী বলতে চাইছে মঞ্জু সেটা বুঝলেও, ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল, ‘ও’ মানে?
—ছেলেটা, ছেলেটা।
—ঠিকই আছে।
—একইরকম আছে? আগের মতোই?
—আগের চেয়ে ভাল আছে। পড়াশোনায় ভাল হয়েছে। লিখছে। বড়-বড় পত্রিকায় ওর কবিতা ছাপা হচ্ছে। গলায় দৃঢ়তা এনে বলল মঞ্জু।
কার্তিক বলল, পড়াশোনার কথা বলছি না। আগের মতোই হাবভাব? না কি একটু চেঞ্জ হয়েছে?
—কী আবার চেঞ্জ হবে? আগের মতো হাবভাব তো কী হয়েছে? মস্তানি করার চেয়ে ওরকম থাকা ভাল।
মঞ্জুর কথা মঞ্জুর কাছেই নতুন শোনাল। আর এরকমভাবে বলতে পেরে মন্দ লাগছে না। মঞ্জুর এতক্ষণ পর মনে হল একটু লৌকিকতা করা দরকার। বিয়ের পর বাড়ি এলে চা করে দিত, কিংবা বুঝে নিতে হত এখন চা খাবে কি না, বুঝে নিতে হত এখন শশা কেটে দিতে হবে কি না, না কি আলুভাজা করে দিতে হবে… ওগুলো ছিল স্ত্রী’র কর্তব্য। এখন লৌকিকতা।
মঞ্জু বলল, চা খাবে তো?
কার্তিক বলল, ভালই তো হয়।
কাছেই চায়ের দোকান। দোকানদার ভাবল নতুন ট্যুরের পার্টি। দোকানদার চায় ট্যুর কোম্পানিটা টিকে থাকুক। কয়েক কাপ চা বেশি বিক্রি হয়।
চা দোকানির নাম মিঠুন। বলল—আপনাদের সাউথ ইন্ডিয়া টিরিপটার খুব সুখ্যাত করে গেল দু’জন, এইমাত্ৰ।
মিঠুনকে এরকম শেখানো আছে।
কোনও পার্টিকে চা খাওয়াতে নিয়ে এলে এরকম দু’একটা ডায়ালগ ছেড়ে দিতে হয়। দাঁড়িয়ে রইল। বলল, গরম খেতে নিষেধ করেছে ডাক্তার। নাড়িতে ঘা হয়ে গিয়েছে কি না….
গরম খেলে জ্বালা করে।
—তবে ফুঁ মেরে খাও…মঞ্জু বলে।
—সময় দিলে সব কিছুই ঠান্ডা হয়ে যায়….বুঝলে…।
কার্তিক মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে চোখ মারার চেষ্টা করল।
মঞ্জু কোনও কথা না-বলে নিজের চায়ের গেলাসে ফুঁ দিতে লাগল।
কার্তিক বলল, বসি, অ্যাঁ?
বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসল। চায়ের গেলাসটা পাশে রাখল। আঙুল মটকাল, এবং ভক করে বলে ফেলল, আবার আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি না মঞ্জু?
মঞ্জু ভেবেছিল, রোগ-ব্যাধির কথা বলে টাকাই চাইবে। এই ধরনের প্রস্তাবও যে আসতে পারে, এমনটাও ভেবেছিল মঞ্জু? যখন কার্তিক বলছিল—সময় দিলে সব কিছুই ঠান্ডা হয়ে যায়—বোঝাতে চাইছিল ও এখন ‘ঠান্ডা’ হয়ে গিয়েছে, তখন ওর বলতে ইচ্ছে করছিল, সময় দিলে কেউ-কেউ গরমও হয়। ওর মনে পড়ছিল তসলিমার লাইন, ভাঁটার দিন তো শেষ হয়েছে জোয়ার আছে বাকি’। বলে লাভ নেই। মঞ্জু চুপচাপ চা খেতে লাগল।
—কথা বলছ না যে?
—কী বলব?
—আমি যা বললাম তার উত্তরে হ্যাঁ-না কিছু বলবে তো?
মঞ্জু বলল, আমার কথা মনে হল তোমার লাভার-টা নেই বলে, তাই তো? আগে তো দেখতাম খুব মস্তিতে ছিলে। রিকশায় ওই মেয়েটাকে পাশে বসিয়ে রঙে চলে গিয়েছ, ঠিক যেন কার্তিক ঠাকুর।
কার্তিক বলল—হুঃ, কার্তিক! কার্তিক ঠাকুর, কার্তিকের বাবরি চুল, ছাঁটা গোঁপ, মুখে মুচকি হাসি। সবাই ভাবে কার্তিক খুব ভাল আছে। ফাস্ট কেলাস আছে। এদিকে যে কার্তিকের পোঁদে গরানকাঠ ঢোকানো আছে, আর সেটা মাথায় গিয়ে ঠেকেছে—সে-কথা কার্তিক জানে আর জানে কুমোর। আমি ওর বড়ির মোহে ওর সঙ্গে গিয়েছি, কিন্তু ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছি। হাজার বায়নাক্কা। তারপর ওর চিকিৎসায় তো সর্বস্ব গিয়েছে। তাই বলছিলাম আবার যদি নতুন করে… বুঝে গিয়েছি শোয়াশুয়িই শেষ কথা নয়। দিল হল আসল। দ্যাখো না, কোনও বাচ্চা করিনি। আমি ভেবেছিলাম বিজনেসে যা হয়, যা রাখতে পারব, তোমাদেরই থাকবে। কেন মিছিমিছি দু’টো ঘরের ভাড়া দিচ্ছি। এখন তো একসঙ্গেই থাকতে পারি ভাই-বোনের মতো। পারি না?
মঞ্জু চুপ করে ছিল।
কার্তিক আবার বলে, মনে আছে? বিয়ের পরে শোলা খেলা?
মনে পড়ল মঞ্জুর। বাসি বিয়ের দিনের মেয়েলি খেলা। মাটির হাঁড়িতে জল। চোখ বেঁধে দেওয়া। হিহি হাসি, হাহা হাসি। মাছ ভাজার গন্ধ আসছে। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল একটা ছোট্ট শোলার টুকরো। এই যে বরমশাই, নৌকোটা জলে ছেড়ে দাও। মঞ্জু, তোর নৌকোটা জলে ছাড়, জলে ছাড়…। নে, এবার চোখ খোল। নাও ভাইস্যা যায়, আহা নাও ভাইস্যা যায়…. এক সঙ্গে চল… এক সঙ্গে চল…। সব মনে পড়ে। শোলার টুকরো দু’টো দু’পাশে চলতে-চলতে বেশ কিছুটা পরে আবার কাছাকাছি এসেছিল। গায়ে-গায়ে লেগেছিল। সবাই বলল, বুড়ো বয়সে খুব পিরিত হবে।
মঞ্জু বলল, এখন কিছু বলছি না। এত বছর নিজের মতো থেকে একটা জীবন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। এখন আবার নতুন অভ্যেস তৈরি করতে হবে, পারব? কে জানে? পুরনো অভ্যেস তো ভুলে গিয়েছি।
—পুরনো অভ্যেসগুলো তেমন আর নেই। পেটে আলসার কি না, সেদ্ধ-সেদ্ধ খাই। দুধভাত খাই। তোমাকে ভাজাভুজি করতে হবে না আর। শশা কাটতে হবে না। আর বললুম তো রাতেও কোন ডিসটার্ব নেই। চুপ মেরে ঘুমিয়ে থাকব।
মঞ্জু বলে, এখনই এতটা এগিয়ে ভাবছ কেন? ছেলের সঙ্গে কথা বলি আগে…।
—ছেলে তো এখনও রোজগার করে খাওয়ায় না, খাওয়াবে বলেও মনে হয় না। তুমিই ওকে খাওয়াও। কেন ওর পারমিশন নিতে যাবে? তুমি যা বলবে তাই হবে।
—তাই হয় না কি? ছেলে বড় হয়েছে না? ও যদি তোমার সঙ্গে থাকতে না চায়, পারবে ওকে আলাদা হোস্টেলে রাখতে?
—কদ্দূর লেখাপড়া করল ও?
বাংলা নিয়ে বিএ অনার্স দিল। এতক্ষণ পরে জিগ্যেস করলে, ও কী করছে…?
—ও কিছু না, ও কিছু না। তোমার সঙ্গে এতদিন পর দেখা হল কি না, এই জন্য তোমার কথাই জিগ্যেস করছিলাম। দেখছিলাম তুমি এখনও সিঁদুর দিচ্ছো মাথায়। হাতে শাঁখা, নোয়া। মনে-মনে আমাকে ত্যাগ করোনি তুমি। আর তোমার শাঁখা-সিঁদুরের জোরেই বলতে হবে আমি বেঁচে আছি। ঝুমার যখন গ্যাস-অম্বল চলছিল, তখন আমারও ওরকম চলছিল। কিছুই খাওয়া হত না। জলভাত, থানকুনি পাতার ঝোল-ভাত। তারপর ওকে যখন হসপিটালে দিলুম, তখন আমার খাওয়া নেই, নাওয়া নেই। আলসার হয়ে গেল। আমারও রক্ত পায়খানা হয়েছিল। ভাবলুম আমারও বুঝি ক্যানসার হল। তারপর পিছনে পাইপ-টাইপ ঢুকিয়ে কীসব টেস্ট হল। বলল, আলসার। ডেলি-ডেলি চল্লিশ টাকার ওষুধ খাচ্ছি। এদিকে বাড়িতেও রান্না করা হচ্ছে না। হোটেলে ভাতে জল মেখে, চটকে একটু ডালের জল আর আলুসেদ্ধ দিয়ে কোনওরকমে ভাত খাই। তুমি আমাকে বাঁচাও।
মঞ্জুর পিঠে হাত দিয়ে দিল কার্তিক। মঞ্জু আশ্চর্য কৌণিক প্রক্রিয়ায় পিঠটা সরিয়ে নিল। বাস-টাসে এভাবে এখনও এ ব্যাপারগুলো করতে হয়—এই প্রায়-মেনোপজে এসেও।
—তবে আসি? কার্তিক বলল। চোখে ভিক্ষা।
মঞ্জু বলল, ঠিক আছে।
এরকম ডাঁট কখনও দেখায়নি। ‘ঠিক আছে’ বলার সময় গলাটা উঠেছিল খাদে। মঞ্জু ওর চলে যাওয়াটা দেখল। ওটা দেখতে বেশ ভাল লাগল মঞ্জুর। আজকের খবর কাগজে দেখা রাশিফলটা মিলে গেল বেশ। লেখা ছিল ‘মনস্কামনা পূরণ হবে।’ কার্তিকের সঙ্গে মিলন হওয়ার কোনও মনস্কামনা ছিল না ওর। কোনও ঠাকুরের কাছে এরকম চায়নি। যখন পরির জন্য ঢিল বেঁধেছে কোনও অলৌকিক বৃক্ষশাখায়, সেই সঙ্গে ‘ওর সঙ্গে মিলিয়ে দাও’ বলে আর একটা ঢিল বাঁধেনি যদিও কোনও দিন। ওর মনের ভিতরে যত্নে রাখা কোনও কৌটোয় একটা ইচ্ছে পোষা ছিল?—লোকটা মাথা নিচু করে আর একবার ওর কাছে আসুক।
ওই মেয়েটার মৃত্যু মঞ্জুর মনস্কামনা মেটাল। ওই মরে যাওয়া মেয়েটার প্রতি কৃতজ্ঞ রইল মঞ্জু।
এবার হাতটা নিশপিশ করে উঠল একবার। মোবাইলটা বের করল ব্যাগ থেকে। অনিকেতের নম্বরটা ফুটে উঠল। ‘একটা খবর আছে ডাবুদা…।’ কিন্তু সবুজ বোতামটা শেষ অবদি টিপল না।
পরিকে বললে ও রাজি হবে না। এই বাড়িতে এত বছর আছে। আগে তো এখানে ছিল না। কার্তিক যখন ওর মালপত্র নিয়ে চলে গেল, তখন ছিল নয়াপট্টিতে। রাস্তার ওপর ঘর। বস্তি বাড়ি মনে হত না। জানলা ছিল কাচ লাগানো। বারান্দা কেটে বাথরুম করা ছিল। বাইরের কল থেকে পাইপ টেনে চৌবাচ্চায় জল ভরা যেত। ওই ঘরের ভাড়া বেশি ছিল। কম ভাড়ার ঘরে এসে ঠেকেছে। রাস্তা থেকে অনেকটা ভিতরে। কার্তিক যে-বাড়িতে থাকে—সেটা কেমন দেখেনি ও। ওখানে কি দু’টো ঘর আছে? পরির তো একটা নিজস্ব ঘর লাগে। ওর বন্ধুবান্ধব আসে। পড়াশোনাই করে। কেন খারাপ ভাবতে যাব? পড়াশোনা না-করলে এত ভাল রেজাল্ট হয়?
‘ঠাকুর ঠিক আছে, বুঝলি, ঠিক বিচার করে।’ এই কথাটা দিয়ে শুরু করল মঞ্জু। পরি জিগ্যেস করল, কী বিচার? মঞ্জু তখন সব বলল। কার্তিকের অনুরোধটা একটু বাড়িয়েই বলল। বলল, শতবার হাতজোড় করল লোকটা…। কতবার তোর কথাও জিগ্যেস করল।
—কী বললে?
—বললাম তোর সঙ্গে কথা বলে বলব। তোর যা ইচ্ছে।
পরি বলল—দ্যাখো মা, আমি ফ্যাশন নিয়ে পড়ব। নিজের পায়ে দাঁড়াব। এটা পড়তে গেলে কিছু টাকাপয়সা খরচ হবে। অনিকেত কাকুকেও বলেছি কোনও সোর্স থেকে যদি কোনও স্পনসরশিপ জোগাড় করে দিতে পারে। তোমার হাজব্যান্ড যদি আমাকে পড়াশোনার খরচা দেয় যেখানে থাকতে বলবে থাকব। ক’দিনই-বা থাকব? আমি তো হোস্টেলে চলে যাব।
—কলকাতা থেকে পড়া যায় না? মঞ্জু জিগ্যেস করেছিল।
বলেছিল—এখানে যেটা এনআইএফটি, ওখানে হোস্টেলেই থাকতে হয়। ওখানে চান্স পাওয়াটা খুব কঠিন। দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চণ্ডীগড় এসব জায়গায় অনেক ভাল-ভাল ইনস্টিটিউট আছে।
মঞ্জু বলল—কেনই বা ফ্যাশন-ট্যাশন পড়ছিস? বাংলায় এমএ দিয়ে কলেজে পড়া না। ওই তো তোর কাছ থেকে নাম শুনি—সোমনাথ, ও তো তাই করেছে।
—এই জন্য ওঁকে কত লড়াই করতে হয়েছে জানো? আমি পারব না! ফ্যাশন লাইনে আমাদের মতো অনেকেই যায়। ওখানে প্যাঁক দেয় না। ওখানে মন দিয়ে কাজ করতে পারব।
—কত টাকা লাগে রে ওসব পড়তে?
—মিনিমাম দু’লাখ। তিন…চার….সাত… সিমবায়োসিস-এ দশ লাখ।
—কোথায় পাব বল তো এত টাকা…
মাথা চুলকোতে থাকে মঞ্জু।
—যেভাবে হোক জোগাড় করে দিও না মা…কড়ায়-গণ্ডায় শোধ করে দেব। ‘ছেলে হয়েও ঠিকমতো ব্যাটাছেলে হল না…’ এই আফসোস ঘুচিয়ে দেব। ব্যাটাছেলের প্রধান কাজ কী মা? ধর্ষণ করা?
—ধুর। কী যে বলিস?
—বলো, প্রধান কাজ কী তবে?
—আগলে রাখা।
—আগলে তখনই রাখা যায়, যখন টাকা থাকে। নাই টাকা—সব ফাঁকা। মা, আমি তো তোমাদের চোখে মিনমিনে। যদি নেতাজির মতো আমি হাত নাড়িয়ে বলি তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। সবাই হাসবে। এসব ডায়ালগ যারা দেয় ওদের মাল ফুলো-ফুলো। কিন্তু আমি বলছি মা, তোমরা আমাকে পড়তে দাও, আমি তোমাদের স্বাচ্ছন্দ্য দেব।
কোম্পানিটা ভাল চলছে না। মালিক মারা যাওয়ার পর দুই ভাই এটা দেখাশোনা করত। ভাইদের মধ্যে গন্ডগোল। এক ভাই নর্থ ইন্ডিয়া ট্যুরের দায়িত্বে, অন্য ভাই সাউথ ইন্ডিয়া। কিছু দিন আগে রাজধানীতে নিয়ে যাবে বলে কালকায় নিয়ে গিয়েছে। থ্রি স্টার হোটেলে রাখবে বলে বাজে হোটেলে রেখেছে। লোকজন এসে টাকা ফেরত চাইছে। ছোট ভাই বলছে এসব দু’নম্বরিতে ও নেই। ছোট ভাই চাইল, এই ‘দেশ বিদেশ’ নামটা ছেড়ে দিয়ে নতুন ট্রাভেল কোম্পানি করবে। এই কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছে। টাকা দিয়ে দাও। কিছু বোধহয় দিয়ে দিয়েছে। ছোট ভাইটা এখন আর বসে না।
পরদিন অফিসে গিয়ে একের-পর-এক ফোন পেতে লাগল মঞ্জু। দিল্লি থেকে বলছে, আপনাদের লোককে পাচ্ছি না। পার্বতী হোটেলে উঠিয়ে দিয়ে ফুটে গিয়েছে। আজ ‘সাইড সিং’ করার কথা…। বেশির ভাগ ক্লায়েন্ট ‘সাইট সিয়িং’ বলে না। ফোন আসতে লাগল—এই যে দিদি, সকাল থেকে বসে আছি, এখন বেলা সাড়ে বারোটা…
ঘোষবাবু আজও আসেনি। মুখার্জিবাবু দু’টোর পর আসেন। ছোট স্যর তো আসেই না, বড় স্যরও ফোন ধরছে না।
সমগ্র উত্তর ভারত ভ্রমণের একটা টিম গিয়েছে দু’দিন আগে। চব্বিশ জনের টিম। দিল্লি থেকে শুরু। গেঁদু আর লোটন ওই টিমে গিয়েছে। লোটনকে একটা মোবাইল দিয়েছে কোম্পানি। সুইড অফ। পর-পর ফোন। ফোন ধরতে ভয় পাচ্ছে মঞ্জু। মঞ্জুর হাত কাঁপছে। অনেকক্ষণ পরে ফোনটা ধরল। হিন্দিতে গালাগাল। পার্বতী হোটেল বলছে—ওরা টাকা না-পেলে দুপুরের খাওয়া দেবে না।
বড় স্যর ফোন ধরছে না কেন? কেন গতকালও আসেনি? ঘোষবাবুও আসেনি কেন? ওর এখন কী করা উচিত? বুকের ভিতর থেকে একটা আর্ত চিৎকার বের হয়, গেঁদু, গেঁদু রে…ফিরে আয়।
গেঁদু, বিমল, লোটন, সুবলদা, অধীরবাবু এরা কেউ মাইনে করা স্টাফ নয়। এরা বহু দিন ধরে আছে। এরাই তো যায়। কেউ সাউথ-টা ভাল জানে, কেউ কাশ্মীর, কেউ নর্থ। প্রতিটা ট্যুরের জন্য টাকা পায়।
কয়েকটা হোটেলের সঙ্গে ব্যবস্থা থাকে, ওরা চেক-এ পেমেন্ট নেয়। কিন্তু ওদের হাতে অনেক ক্যাশ থাকে। ওদের কাছে লাখ দুয়েকের মতো ক্যাশ ছিল। দু’লক্ষ টাকা নিয়ে দু’জন পালাল। এরকম আগে যে কখনও হয়নি।
ঘোষবাবু আসছে না কেন? এখন অবশ্য কোনও ট্যুর নেই। একটা দল আসাম-অরুণাচল ঘুরে এল। আর একটা দল উত্তর ভারত। ঘোষবাবুই টাকাপয়সার ব্যাপারটা দেখেন, হোটেল বুকিং করেন। কনডাক্টর ঠিক করেন। মুখার্জিবাবু বেলার দিকে আসেন। হিসেবটা দেখেন খাতাপত্র ঠিক রাখেন। আবার ফোন বাজছে। ফোন চ্যাচাচ্ছে। ফোন আর্ত চিৎকার করছে। অফিস ঘরের তালা বন্ধ করে ছুটল মালিকের বাড়িতে।
দাদা-বউদি দু’জনে মিলে তারাপীঠ গিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর ফোনে পেল বড় স্যরকে। ওঁদের ‘স্যর’ বলতে হয়। ওদের বাবাকে ‘বাবু’ ডাকত সবাই। মঞ্জু ডাকত ‘বাবু স্যর’। ‘বাবু স্যর’ ছেলেদের ‘বড় খোকা’, ‘ছোট খোকা’ বলেই বলত। পরে খোকাবাবু বাদ গিয়েছে। বড় খোকাবাবুর বয়স ষাটের কাছাকাছি। ফোনটা পেয়েই বড় স্যর খোকাবাবুর মতোই বলে ফেলল, বড় বিপদে পড়ে গিয়েছি। ছোট ভাইটা মামলা করে দিয়েছে। ডায়েরি করেছে। মায়ের কাছে চলে গেলাম…মঞ্জু বলল, আরও বিপদ স্যর…ভীষণ বিপদ…
বড় স্যর সেই রাত্রেই ফিরেছিলেন। পরদিন গেঁদু এবং লোটনের নামে ডায়েরি করা হয় থানায়। এর দু’দিন পরই খবর কাগজে বের হয় ভ্রমণ সংস্থার প্রতারণা।
অনিকেত এসব কিছুই জানে না। একটা মেসেজ পায়—’পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। বাঁচা।’
অনিকেত বুঝতে পারে না ওকে কেন পুলিশে ধরবে? অনিকেত তখন কলকাতা ছিল না। চাইবাসায়। ও ফোন করে। মঞ্জু বলে, ডাবুদা ভীষণ বিপদ…।
আর কিছু শুনতে পায় না। শুধু একটা পুরুষ কণ্ঠস্বরে শোনে—মোবাইলে কথা বলা যাবে না থানায়। ওটা আমাকে দিন, দিন এক্ষুনি….।
৪৮
অনিকেত স্বপ্ন দেখছিল ‘ছেলেধরা’-’ছেলেধরা’ বলে ওর পিছনে অনেক লোক ছুটছে। তারপর ওকে ধরে বেদম মারছে। ও যে ‘ছেলেধরা’ নয়, সেটা বোঝাতে পারছে না কিছুতেই। ওর পেটে লাথি মারল কেউ। খুব ব্যথা পেল। ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নেও ব্যথা লাগে? ঘুম ভেঙে যেতে নিশ্চিন্ত হল। যাক, কেউ মারছে না। আবার ঘুমোতে চেষ্টা করল। সেই একই স্বপ্ন আবার। ইট দিয়ে মেরে ঠোঁট থেতলে দিয়েছে, দাঁত ভেঙে দিয়েছে। ও বলার চেষ্টা করছে, ‘বিশ্বাস করুন, আমি সরকারি কর্মচারী। আমি কেন ছেলেধরা হতে যাব?’ কিন্তু কথা বলতে পারছে না। দাঁত নেই, ঠোঁট নেই… একই স্বপ্ন সারারাত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। রোদ্দুর উঠে গেলে, রাস্তায় সাইকেলের কিড়িং শুরু হলে, স্বপ্নরা চলে গেল, তারপরও বেশ কিছুক্ষণ মটকা মেরে পড়ে থাকল অনিকেত। বিছানা ছাড়ল বেশ বেলাতে। জাহানাবাদিজি ছিলেন। উনি নেনুয়া-র খোসা ছাড়াচ্ছিলেন। ‘নেনুয়া’ মানে ধুদুল।
জাহানাবাদিজি বললেন, গুড মর্নিং, জয় শ্রীরামজি কি। আজ থোড়া লেট রাইজিং হো গিয়া আপকা।
অনিকেত বলল, বহুত বুঢ়া ড্রিম দেখা ম্যায়নে।
স্বপ্নের কথা ও বলল কিছুটা। জাহানাবাদি বললেন, মার খাওয়ার স্বপ্ন দেখছ কেন? মার দেওয়ার স্বপ্ন দ্যাখো। সকাল-সকাল হনুমান মন্দিরে ভোগ চড়িয়ে এসো—আর রাত্রে শোওয়ার সময় হনুমান চালিশা পড়ে নাও, তা হলে আর এরকম পড়ে-পড়ে মার খেতে হবে না।
এই ধরনের স্বপ্ন খুব একটা দ্যাখে না অনিকেত। স্বপ্নে ভগ্নপ্রাসাদ, প্রাসাদের অলিগলির মধ্যে পথ হারানোর স্বপ্ন দ্যাখে মাঝে-মাঝে। এসব স্বপ্নের ভিতরে নাকি ‘গূঢ় মানে’ লুকিয়ে থাকে। মনোবিদরা এসব স্বপ্ন বিশ্লেষণ করতে পারেন। পঞ্জিকাতে স্বপ্নতত্ত্ব থাকে। শুক্লা প্রতিপদে স্বপ্ন সুখের কারণ; দ্বিতীয়ার স্বপ্নে হয় আত্মীয় মরণ—এরকম সব থাকে। আবার প্রহর অনুযায়ীও স্বপ্নফল হয়। দ্বিতীয় প্রহরে স্বপ্ন নিষ্ফলা রয়, চতুর্থ প্রহরে স্বপ্ন ফলবতী হয়। তা ছাড়া স্বপ্নের বিষয় অনুযায়ী ফল লাভের কথাও থাকে। স্বপ্নে শৃগাল দেখিলে বন্ধুলাভ, সৰ্প দেখিলে রাজনুগ্রহ…। ফ্রয়েডের চিন্তায় ‘সাপ’ যৌন আকাঙ্ক্ষা। বিশেষত মেয়েদের। আর পুরুষের ক্ষেত্রে আপেল, কমলালেবু ইত্যাদি অবদমিত ইচ্ছার প্রতীক হিসেবে আসে। এগুলো ‘স্তন’-এর প্রতীক। জারোয়ারা আপেল দ্যাখেনি, ওরা তবে ডাব দেখবে নিশ্চয়। সাহারা-র যাযাবররা তো খেজুর ছাড়া কিছুই দ্যাখেনি, ওরা কী দেখবে? তবে ছেলেধরা-র স্বপ্ন নিয়ে খনা বা ফ্রয়েড কেউ কিছু বলেনি। তবে স্বপ্নটা তো ছেলেধরা-র নয়, মার খাওয়ার। অনেকে মিলে ওকে মারছে। মানে, স্বপ্নে মার খাচ্ছে। তবে কি ওর ‘সুপার ইগো’ বা ‘বিবেক’ বলে যে-বস্তু আছে, সেটাই ওকে মার খাওয়াচ্ছে? বলছে তোমার শাস্তি পাওয়া উচিত? ওই ‘সুপার ইগো’-টাই ছেলেধরা বানিয়ে মার খাওয়াচ্ছে? কেন মার খাওয়াচ্ছে? কী দোষ?
সকালবেলা চায়ে চুমুক দিতে-দিতে দোষ স্বীকার করে অনিকেত। সামনে বসে আছে ‘ফাদার’। ‘ফাদার’ মানে জাহানাবাদি। জাহানাবাদি তখন হনুমান-মাহাত্ম্য থেকে মেথি-র জলে নেমে এসেছেন। বলছেন, মেথিকা পানি মে পেট ঠান্ডা রহতা হ্যায় আউর পেট গরম হোনে সে ভি খতরনাক খোয়াব দেখাই দেতা হ্যায়। পেট গরম হোনে সে কভি কভি অ্যাইসা বুঢ়া খোয়াব দেখাই জাতা হ্যায়—জো কাপড়া খারাপ কর দেতা হ্যায়।
এই ‘ফাদার’-কে ত্যাগ করে অনিকেত ছাদে গেল। নব বসন্তের কচিপাতা ভরা নিম গাছ। নিম গাছই এখন ‘ফাদার’।
অনিকেত বলল, হে বৃক্ষ, আমি পাপ করেছি। এক মহিলা, সে আমার বাল্যসহচরী, কৈশোরে আমি অকস্মাৎ তার ওপরে দুষ্কর্ম করার চেষ্টা করেছিলাম। আমার এক নিকটাত্মীয়ও তার পূর্বে রোগ আরোগ্যের অছিলায় তার ওপর দুষ্কর্ম করে। ইত্যাদি কারণ হেতু একটি ট্রমা হয়, এবং পরবর্তী কালে যৌনশীতল হয়ে পড়ে। সেই মেয়েটি, মানে মহিলাটি, বিপদগ্রস্ত হয়ে আমাকে ফোন করে। বিনা দোষে ওকে পুলিশ ধরেছিল। জেল হাজতে ছিল কয়েক দিন। আমি যাইনি। ঝামেলায় জড়াইনি। এছাড়া একটি ছেলেকে আশ্রয় দিয়েছিলাম বাড়িতে। ওকে হঠালাম। ও সমকামী এ জন্যই হঠালাম। অথচ মুখে আমি….
নিমগাছ ডাল নাড়াল দু’বার।
—বুঝেছি বৎস, বুঝেছি। তুমি প্রহার পাইয়াছ, যদিও-বা স্বপনে। বুঝিলাম তোমার অনুশোচনা হইয়াছে। ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করিলেন।
ঈশ্বর না-হয় ক্ষমা করলেন। মঞ্জু কি করল? আবার একটা অন্যায় হয়ে গেল না মঞ্জুর ওপর? পরিও ফোন করেছিল। বলেছিল, খুব ঝামেলায় পড়েছি কাকু—কী করব বুঝতে পারছি না, মা’কে ধরে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ।
অনিকেত জিগ্যেস করেছিল, শুধু কি তোমার মা, না কি মালিকদেরও ধরেছে?
ও বলেছিল, হ্যাঁ, ওদের বাড়ি থেকেও দু’জনকে ধরেছে। খবর কাগজে আমার মা-র নামও উঠে গিয়েছে। কাগজে ভ্রমণ সংস্থার প্রতারণা—এইসব লিখেছে। আপনি প্লিজ আসুন। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছি না!
অনিকেতও কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ও তখন কী করে যায়? সামনে ZPCC নামে একটা মহা ঝামেলা ঝুলছে। ZPCC হল ‘জোনাল প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেশন কমিটি’। সদ্যগঠিত ঝাড়খণ্ডে যেসব রেডিও স্টেশন আছে, তাদের কর্তাব্যক্তিরা এক জায়গায় বসে একটা মিটিং করেন। ঝাড়খণ্ডের মধ্যে পড়েছে রাঁচি, জামশেদপুর, হাজারিবাগ এবং চাইবাসা স্টেশন। মিটিং তো ইটিং ছাড়া হয় না। এসব ইটিং-এর খরচা সরকারি ভাবে বেশি দেখানো যায় না। চা-বিস্কুটের বরাদ্দ করা যেতে পারে। কিন্তু তাতে তো অতিথেয়তা হয় না। বাইরে থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁরা তো গেস্ট। অতিথি। ওঁরা ট্যুরের জন্য টিএ, ডিএ ইত্যাদি পেয়ে থাকেন। কিন্তু ওঁদের তো বলা যায় না—আপনারা আপনাদের ডিএ-র টাকায় খাওয়াদাওয়া করে নিন…। অনিকেত যখন অন্যত্র মিটিংয়ে যায়, সেখানেও আতিথেয়তা পায়। মিটিং শুরু হতে-হতে বেলা হয়। কারণ দূর থেকে সবাই আসেন। শেষ হতে-হতে সন্ধে। তখন ফিরে যাওয়া যায় না। সন্ধের পর জঙ্গল পথ বিপজ্জনক। নকশাল। সতরাং রাতে থাকার ব্যবস্থা, খাওয়াদাওয়া। খাওয়াদাওয়া বলতে পানাহারও হতে পারে। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট। এসব খরচ সরকারি তহবিল থেকে সরাসরি পাওয়া যায় না। ব্যবস্থা করতে হয়।
যে-যাঁর অর্জিত বুদ্ধিতে এই ব্যবস্থা করে নেন। যদি কোনও বড় ব্যবসায়ী থাকেন, তাঁর স্ত্রী-কন্যাকে বেতারশিল্পী বানিয়ে সেই ব্যবসায়ীকে স্পনসর করে দেওয়া যায়; কোনও প্রতিষ্ঠানকে বেশ কিছুটা প্রচার দিয়ে সেই প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে লাঞ্চ এবং ডিনারের ব্যবস্থা করানো যায়; কিংবা ‘লন-এর ঘাস কাটা’ ‘জঙ্গল সাফাই’ ‘গাড়ি সারাই’ ইত্যাদির ঝুটো বিল বানিয়ে কিছু টাকা এসব সৎ কাজের জন্য তোলা যায়। এসব বুদ্ধি বার করাই তো এফিশিয়েন্টদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এখানে তো মাত্র দশ-বারো হাজার টাকা তুললেই চলে যাচ্ছে। আরও কত বেশি ‘এফিশিয়েন্ট’-দের লক্ষ-লক্ষ টাকা তুলতে হচ্ছে।
অনিকেত ব্যবসায়ীদের কাছে, বা মোটর গ্যারেজ মালিকদের কাছে যায়নি। ও একটু অন্যরকম করে ব্যাপারটা মেটাচ্ছে। কিছু দিন আগে ছৌ-নাচ নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করতে সরাইকেলা গিয়েছিল। সরাইকেলা-র রাজবাড়িতেও গিয়েছিল। বড় রাজপ্রাসাদটি এখন বহু শরিকে বিভক্ত। এক রাজপুত্রের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, যার বয়েস পঁয়ষট্টি, ছৌ আকাদেমি – র সদস্য, বাড়িতে অসংখ্য ছৌ-মুখোশ জমিয়েছেন, সেই সঙ্গে উনি খাদ্যরসিক। তাঁর ঝুল ও ঝুলে-পড়া ঝাড়লণ্ঠনের তলায় রেক্সিন চটে-যাওয়া, সোফা-সিংহাসনে বসে, মুখে পানপরাগ রাখা উচ্চারণে রাজবাড়ির খাওয়াদাওয়া প্রসঙ্গে সরাইকেলার বিখ্যাত লাড্ডুর প্রস্তুতপ্রণালী বর্ণনা করেছিলেন—কীভাবে ব্যসন দিয়ে ঝুরিভাজা বানিয়ে, সেটা চিনির গাঢ় রসে ফেলে, খোয়া ক্ষীর এবং এলাচ-চূর্ণ সহযোগে লাড্ডু বানাতে হয়। রাজপুত্র-কথিত লাড্ডুগঠন প্রণালীটা রেকর্ড করাই ছিল। ব্যবহার করা হয়নি। আবার চাইবাসা-র কেন্দ্রস্থলে কয়েকজন লোক বিকেলের দিকে চার চাকার ভ্যানে কচুরি, সিঙাড়া, জিলিপি, গজা, ভেজিটেব্ল, চপ ইত্যাদি বিক্রি করে। মাথায় এল, ‘রাজা খায় প্রজা খায়’ জাতীয় একটা প্রোগ্রাম বানালে কেমন হয়? যে ঠেলাওলাটি এসব বানায়, ওকে বলা হল সকালবেলা অফিসের ভিতরে গিয়ে পুরি, জিলিপি, গজা বানাতে হবে এবং এজন্য টাকা পাবে। একজন সহকারী নিয়ে এসেছিল। জিলিপি-গজা’র রেসিপি বলার জন্য নিয়ম অনুযায়ী ওরা দু’জন যা টাকা পেল, সেটা ওদের কচুরি কি সিঙাড়ার দামের চেয়ে বেশি। ওরাও খুশি। ‘রাজা খায় প্রজা খায়’ প্রোগ্রামটির পরিবর্তে সকালের জলখাবারটা হয়ে গেল। সার্কিট হাউসের ম্যানেজার নিজে রান্নাবান্না জানেন। দুই পাচক, এক সহকারী-সহ চারজনের প্যানেল ডিসকাশনে আধুনিক খাবারদাবার প্রস্তুত প্রণালী রেকর্ড করা হল— যথা বিভিন্ন স্যান্ডউইচ, কেক, ফ্রেঞ্চ ওমলেট ইত্যাদি। আদিবাসী অঞ্চলে চিজ স্যান্ডউইচ আর কিমা-ভরা ফ্রেঞ্চ ওমলেট কে খাবে এসব চিন্তায় গুলি মেরে ওদের যে ‘ফি’ দেওয়া হল— ‘ডিসকাশন’ বাবদ—সেটাকেই বলা হল—অফিসারগণ যে খাওয়াদাওয়া করেছেন, তার পেমেন্ট। ম্যানেজার কেটারিং-এর কাজটা সরকারিভাবে নাকরে ‘ব্যক্তিগত’ ভাবে করে দিলেন। এরকম নানা বেআইনি কাজ করতে হয়েছে। ‘বেআইনি’ বলতে নেই, ‘ট্যাক্টফুল’ কাজ করার জন্য এখানে সময় দিতে হল। এটা নিয়েই মেতে রইল। তবে এটাও ঠিক, মাঝখানে দু- একদিনের জন্য চলেও যাওয়া যেত। অন্তত যে-দিন জামিনের কেসটা ছিল। যায়নি। যত ঝামেলায় জড়াবে ঝামেলা ততই জড়িয়ে ধরবে। জড়ায়ে আছে বাধা ছাড়ায়ে যেতে চাই। অনেক হয়েছে। আর না। মঞ্জু যতই ‘কাঁপন-টাপন’ মেসেজ করুক না কেন, তেমন ইচ্ছে জাগে না। তবে ‘সম্পর্ক’ শুধু ওই কর্মের জন্যই তো নয়, আরও তো কত অভিমুখ আছে, সহমর্মিতা বোধ, আরও কত কী আছে, নইলে তো কবেই বলে দিতে পারত, মঞ্জু, আমার অনেক কাজ আছে, আমাকে ডিস্টার্ব করিস না। অনিকেত ফোনে পরিমলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। ও বেচারা একা-একা থাকছে ভেবে জিগ্যেস করেছিল, কী খাচ্ছো, কোথায় খাচ্ছো, একা থাকতে অসুবিধে হচ্ছে কি না…। পরিমল জানিয়েছিল, অসুবিধে হচ্ছে না, চয়ন থাকছে তো…।
চয়ন মানে সেই ওর কবিবন্ধু? চান্স পেয়েই ঘরে ‘পারিক’ ঢুকিয়ে দিলে বাবা? বেশ বেশ। সর্বনাশ আর পৌষমাস। চয়নই উকিল ঠিক করে দিয়েছে। পরি জানিয়েছিল। আগে ‘চয়নদা’ বলত মনে হচ্ছে। আজকাল ‘চয়ন’ বলছে।
কিন্তু সেই উকিল তো তেমন কিছু করতে পারল না। সঙ্গে-সঙ্গে জামিন তো হল না। আইপিসি চারশো কুড়ি, চারশো ছয়, আর চৌত্রিশ ধারায় মামলাটা ছিল। প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ, প্রমাণ লোপ…। বেচারা মঞ্জু। ওদের লোক যদি ক্যাশ নিয়ে পালায় মঞ্জু কী করবে? ও তো বলেছিল, অমুক হোটেলে থাকবেন, অমুক সাইটে নিয়ে যাওয়া হবে। ওর বিরুদ্ধেই প্রতারণার মামলা। দুঃখী মেয়েটা। পড়াশোনায় তো খুব একটা খারাপ ছিল না। ফেলটেল তো করত না ক্লাসে। দেখতেও খারাপ তো নয়। বিয়েটাও ভাল হল না। না-পেল দাম্পত্যসুখ, না-পেল সন্তানসুখ। চাকরিটাতেও এই অবস্থা। ও কি জানত যে, ছেলেগুলো ক্যাশ নিয়ে পালাবে? ওকে অফিস থেকেই পুলিশ ধরে। প্রথমে থানা। থানায় থাকতে হয়েছে সারা রাত। পর দিন আদালতে ওঠানো হয়। জামিন হল না। আট দিন জেল হেফাজত। এর মধ্যে পুলিশ আবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনদিন চাইল। ইশ, কী ঝামেলায় পড়ল। কল্পনা মৈত্র তো জনসেবা করেন। উনি কিছু করতে পারেন না? উনি ভাববেন, এসব ‘চিটিং কেস’-এ মাথা না-গলানোই ভাল।
এদিকে অনিকেতের অফিসেও ‘মিটিং কাম ইটিং’ শেষ। খুব সুচারু চিটিংও হয়ে গেল এখানে। কেউ জানতে পারল না। মিটিং প্রসিডিওর-এ সব কাজের কথা লেখা থাকে। ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন হুইস্কি রাম সিঙাড়া-কচুরি এসব কথা থাকে না। যাই হোক, প্রসিডিওর-টাও লেখা শেষ। এবার কলকাতা না-যাওয়া মানে স্রেফ মঞ্জুর ওপর অন্যায় করা।
শিয়ালদা কোর্টে পরিমল। সঙ্গে এক যুবক। থুতনিতে অল্প দাড়ি। জিনস্-এর ওপর পাঞ্জাবি চাপানো। অনিকেতকে দেখে পরিমল খুশি হল। উঃ, বাঁচা গেল। আপনি এসেছেন, বাঁচলাম।
অনিকেতরা এখন কোর্টের বাইরে। উকিলের জন্য অপেক্ষা করছে। অন্য কোনও কাজে রয়েছে উকিল। একটা ‘কপু’ লেখা গাড়ি ঢুকে গেল। ওখানে থেকে বের হল চারজন। মঞ্জুকেও দেখল অনিকেত। বিরস, মলিন। সোজা ভিতরে কোথাও নিয়ে গেল। পরিমল বিহ্বল তাকাল। ছেলেটা পরি-র কাঁধে হাত দিয়ে সামান্য চাপল। বলতে চাইল, বি স্টেডি। আমি তো আছি। পরিমল চয়নকে নয়, অনিকেতকেই বলল, মা আজ জামিন পাবে তো কাকু?
অনিকেত মাথা চুলকোচ্ছিল। ছেলেটা বলল, ল’ইয়ার বলেছেন আজ হয়ে যাবে। ডোন্ট ওয়্যারি। ‘ওই যে উকিল, ওই যে উকিল’। পরিমল আঙুল নির্দেশ করল। কালো কোট-পরা একজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল মাটির ভাঁড়ে। ওর দিকে ধেয়ে গেল পরিমল। পেছন- পেছন ওরা। পরিমল সোজাসুজি জিগ্যেস করল—আজ মা-কে ছেড়ে দেবে তো?
উকিল বলল—কাগজপত্র তো কিছু নেই। না আছে কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, না আছে কোনও আইডেন্টিটি কার্ড, না আছে কোনও পে-স্লিপ। তোমার মা যে ওদের একটা ‘পেটি’ কর্মচারী সেটাই তো দেখাতে পারছি না। তবে আজকের জজ সাহেব আমার ইয়ার- দোস্ত। বুঝিয়ে বলব। জজ-রা তো বেশি কথা শুনতে চান না, কাগজ চাই, কাগজ। দেখি কী করতে পারি। আজ জামিন হয়ে যাবে আশা করি।
একটু দেখবেন স্যর। হাত কচলাচ্ছে পরিমল। উকিলবাবু একটু বক্রদৃষ্টিতে পরিমলের দিকে তাকাল। পরিমলের কথার ভঙ্গি এবং শরীরী ভাষায় ওর হয়তো ইরিটেশন হচ্ছে। ছেলেটাকে ডেকে নিল, একটু দূরে গিয়ে কী যেন বলল। পরিমল অনিকেতকে জানাল, উকিলের খরচটরচ সব এখন চয়নই দিচ্ছে। আপনাকে বলেছিলাম না, চয়নের কথা, আমার বন্ধু। খুব হেল্পফুল।
কীরকম খরচাপাতি হচ্ছে সে-বিষয়ে বিশদে গেল না অনিকেত। শুধু পিছনের হিপ পকেটের ওপরে হাতটা একবার চলে গেল, যেখানে পার্স আছে। এমন সময় পরিমল হঠাৎ অনিকেতের জামাটা খামচে ধরল। ‘ওই যে, ওই যে, ওই লোকটা আমার বাবা।’
অনিকেত লোকটাকে দেখল। অনিকেত জানে, ওর নাম কার্তিক। ট্রাউজারের ওপর একটা ঝোলানো শার্ট। হাতা গোটানো। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। এবার এদিকে আসছে। পরিমল বলল, এই রে…। লোকটা এল। পরিমলকে জিগ্যেস করল, তোমার মাকে কটার সময় তোলা হবে?
পরিমল ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, জানি না।
—উকিলকে জিগ্যেস করে জেনে নাওনি?
পরিমল আবার একইভাবে বলল, জানি না যান…।
লোকটা বলল, এমন করলে চলে? বিপদের দিনে সবাইকে নিয়েই তো চলতে হয়। পরিমল ঠোঁটটা বেঁকালো। মেয়েরা ‘খুব হয়েছে ঢং’ কিংবা ‘এঃ, আদেখলাপনা’—এসব বলার সময় যেমন ঠোঁট বেঁকায়, তেমন করেই।
পরিমল বলেই ফেলল—এতদিন কোথায় ছিলেন তবে? পরিমল অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
লোকটা চলে যায়। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা বিড়ি বার করে। তারপর বিড়িটা বুকপকেটে ঢুকিয়ে একটা সিগারেট কিনে ধোঁয়া ছাড়ে। তাকিয়ে থাকে মহাশূন্যে।
পরিমল বলল, মা বোধহয় তলে-তলে লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। অ্যারেস্ট হওয়ার পরদিনই বাড়ি চলে এসেছিল লোকটা। খাট-আলমারি এসব দেখছিল শকুনের মতো। জিগ্যেস করছিল, এবার কী করব। আমি বলে দিয়েছি—যা করার দেখা যাবে। লোকটাকে বসতেও বলিনি। চলে গিয়েছিল লোকটা। আবার এসেছে। অনিকেত বলল, তুমি ওঁর সন্তান কিনা, তোমার জন্য তো ওঁর একটু টেনশন হবেই।
—ওসব ফালতু কথা। এতদিন টেনশন হয়নি? মা’কে ছেড়ে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে থাকে….।
তা হলে পরিমল হয়তো জানে না যে, সেই গার্লফ্রেন্ড আর নেই। মঞ্জু সব কথা তা হলে পরিমলকে বলে না। মঞ্জু অনিকেতকে ফোন করে জানিয়েছিল কিছুদিন আগে। এসব গন্ডগোলের আগে। ফোন করে বলেছিল—আমায় একটা ফোন কর না প্লিজ। মোবাইলের খরচ বাঁচানোর জন্য ও এরকম করে থাকে। অনিকেত সঙ্গে-সঙ্গে করেনি। ইচ্ছে করেই।
ইতিমধ্যে আবার একটা মিস্ড কল পেল, তখন ফোন করেছিল।
—অ্যাই জানিস, আমার বরের সেই মহিলাটা মারা গিয়েছে।
— তো?
—সেটা জানালাম।
—এটা সুসংবাদ, না দুঃসংবাদ?
—মানে?
—বলছি এটা খারাপ খবর, না ভাল খবর?
—কোনও মরে যাওয়ার খবর কি ভাল খবর হয়?
—তা হলে খারাপ খবর। এই খারাপ খবরটা দেওয়ার জন্য এত হাঁকুপাঁকু করার কী হল? –ভাল হোক-খারাপ হোক, এটা একটা খবর তো। খবরটা জানাতে ইচ্ছে করল, তাই জানালাম।
অনিকেত এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাল না। শুধু ‘ও আচ্ছা’ বলে চুপ করে থাকল। মোবাইল ফোনে যে কোনও দাঁড়ি-কমা, পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। নৈঃশব্দ্যর দাম অনেক। ‘ভাল থাকিস’ বলে লাল সুইচ টিপে দেওয়া এবার। ‘ভাল থাকিস’ মানে হল, ‘এবার ছাড়’—এটা এখন সবাই জানে। তক্ষুনি মঞ্জু বলল, লোকটা বড্ড একলা হয়ে গেল রে…। অনিকেত বলেছিল, তা হলে এবার তুই ওর সঙ্গে গিয়ে থাক…।
মঞ্জু বলেছিল, মাথাখারাপ? আর ওই ইস্কুলে যাই? বেশ আছি।
অনিকেত আবার বলল, ও আচ্ছা।
এবার ‘ভাল থাকিস’ বলে ছেড়ে দিল।
মনের কত রকম স্তর থাকে, কত খুপরি-ঘর…।
মঞ্জুর স্বামীর শয্যাসঙ্গিনীর মৃত্যুর খবরটায় একটু বিমর্ষ হয়েছিল। ওর তো মনখারাপের পয়েন্ট নেই, তবু কেন? ওর কি সেই মুহূর্তে ‘পজেশন’-বোধ ঝিলিক মেরে উঠেছিল? মনে হয়েছিল, মঞ্জুর ওপর ওর অধিকার কমে যাবে? ও জানে, যে কারণেই হোক, হয়তো কিছুটা অসহায়তা, কিছুটা সুবিধে পাওয়ার বাসনাজনিত কারণে মঞ্জু অনিকেতকে যথেষ্ট পাত্তা দেয়। ইচ্ছে করলে মঞ্জুকে নিয়ে অনেক কিছু করতে পারে। সেটা এবার চোট খাবে? মঞ্জু মোটেই সুন্দরী নয়, ইচ্ছে করলে অনেক ম্যানেজ করতে পারত, ‘একস্ট্রা ম্যারিটাল’ কোনও ব্যাপারই নয়—তবে সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছে হয় না, ঝামেলায় জড়াতে ইচ্ছে হয় না, তাই। কিন্তু ও ‘না’ চাইলেও ঝামেলাগুলো ঠিকই ওকে জড়াতে আসে, জড়িয়েও নেয়। ‘ঝামেলা’ রাশিতে জন্ম বোধহয়।
আচ্ছা, মঞ্জুই–বা এই খবরটা দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠল কেন? ফোন, মিস্ড কল…। ওকে জেলাস করার জন্য? দ্যাখ দ্যাখ, আমার বর এবার ফ্রি… আমার আরও ‘অপশন’ তৈরি হয়েছে এটা বোঝানোর জন্য? মন হল মোনালিসা-র হাসি। সাত রকম মানে করা যায়।
জামিন হয়ে গেল। অর্ডার হল, কিন্তু বাইরে আসতে পারল না মঞ্জু। অনেক কিছু সইসাবুদ করতে হয়, কেস তো চলবে। কেস চলাকালীন কোথাও যাওয়া যাবে না—এসব মুচলেকায় সই করতে হবে। আরও কিছু ফর্মালিটি আছে। উকিল সাহেব আছে। চয়ন বেশ করিৎকর্মা বলতে হবে।
পরি’কে বলল—চয়নটা তো বেশ কাজের ছেলে, ভেরি স্মার্ট গাই। পরি-র চোখে-মুখে- ঠোটে খুশির প্রকাশ ঘটল।
এবার মঞ্জু বাইরে এল উকিলের সঙ্গে। বাইরে এসে হাতজোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা নমস্কার করল। তারপর হাওয়ায় দু’হাত ভাসিয়ে দিল। কার্তিক একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। অনিকেত দেখল, কার্তিকও ওর দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়েছে। যেন যিশু। না কি আলিঙ্গন মুদ্রা? চোখ রাখল। মঞ্জু অনিকেতের চোখে চোখ রাখল। বলল, তুই তবে এলি শেষ পর্যন্ত? অনিকেত বলল, না-এসে পারি?
অনাহুত কার্তিকও গুটি-গুটি কাছে চলে এল। মঞ্জুর তক্ষুনি চোখ ফেটে জল বেরুল। কোনও শব্দ ছিল না। কোনও ক্রন্দনধ্বনিও ছিল না। ক্রন্দনরত অবস্থাতেই পরি’কে জড়িয়ে ধরে। বলল, তুই তো পারলি বাবা, পারলি তো আমাকে ছাড়াতে।
পরি মা’কে ছাড়িয়ে নেয়। বলল, তুমি ভেবেছিল আমি অপদার্থ। তোমরা তো তাই ভাবো।
মঞ্জু কোনও কথা না-বলে ছেলের মাথায় হাত বোলাচ্ছিল।
পরি বলল, আমি না, আমি তো কিছু করিনি। চয়ন, চয়ন।
কার্তিক বলল, খুব চিন্তায় ছিলাম। বুঝলে…।
চয়ন বলল, চলুন সবাই চলুন। সবাই মিলে একটু মিষ্টিমুখ করি।
উকিলবাবু বললেন—আরে আমার সময় কোথায়। তোমরা যাও। বিলটা কী করব? বিলটা?
চয়ন বলল, পাঠিয়ে দেবেন…। কেস তো চলবে।
উকিল বলল, লম্বা লম্বা ডেট নেব…কেস দাঁড়াবে না। যে দু’টো ছোঁড়া টাকা নিয়ে ভেগেছে, ওদের অ্যারেস্ট করতে পারলে এই কেস লিক্যুইড হয়ে যাবে। যাক, থ্যাংস গড্ড্স। বার করে আনতে পেরেছি, মালিকদের তো ছাড়েনি এবারেও।
একটু হেঁটে মিষ্টির দোকানে গেল সবাই।
মঞ্জু বলল, কী সুন্দর না?
—কী? অনিকেত বলল।
—এই পৃথিবীটা।
মঞ্জু বলল—দ্যাখ, দরবেশ যে এত সুন্দর হয় বুঝিনি কখনও। হলুদের মধ্যে কী সুন্দর লাল-লাল বুটি। যেন চুনি।
—দরবেশ খান তবে… চয়ন বলে।
—নাঃ, এত সুন্দর জিনিসটা চিবোতে ইচ্ছে করছে না।
—তা হলে রসগোল্লা?
—ওটাও তো সুন্দর।
তখন হেসে ওঠে সবাই
কচুরি আর পান্তুয়া দাও। চয়ন বলে। পান্তুয়া অত সুন্দর নয়। আমার মতো একটু কালচে কিনা, রসগোল্লার মতো ফরসা নয়। এটা খাওয়া যাবে।
আবার হাসি।
কার্তিক একটা রুমাল বের করে পকেট থেকে। রুমালে জড়ানো কিছু টাকা। পঞ্চাশ, একশো টাকার কিছু নোট। মলিন। গার্ডার দিয়ে বাঁধা।
চয়নকে বলে, এটা রাখো। পরে আবার …
অনিকেতও প্যান্টের পিছনের হিপ পকেটে হাত দেয়। পার্স বের করে।
মঞ্জুর চোখ টলটল করে ওঠে ফের। পৃথিবী কী সুন্দর!
৪৯
আকাশে মেঘ। খুব সাধুভাষায় ওটা জলধর পটল। জানলা দিয়ে স্কাইলাইন-এ দেখা যাচ্ছে নাতিউচ্চ গিরিশ্রেণি। স্কাইলাইন-কে খুব সাধুভাষায় বলে ‘দিকচক্রবাল’। ওইদিকে তাকিয়ে আছে মঞ্জু। এই দৃশ্য অনিকেতের কাছে খুব পুরনো। মঞ্জুর কাছে নতুন। মঞ্জু ওইদিকে তাকিয়ে আছে। সামনের একটা নিমগাছে একটা ঘুড়ি আটকে আছে। মৃদুমন্দ বায়ুপ্রবাহে ওই বেচারা ঘুড়িটা কাপছে। মঞ্জু বলল, তুই কী সুন্দর জায়গায় থাকিস। এখানে থাকলে মন ভাল হয়ে যায়। বেলা এগারোটা বাজে। রবিবার। অফিস নেই। সকালে বেরিয়ে একটু পাঁঠার মাংস নিয়ে এসেছিল অনিকেত। বাড়িতে ‘অতিথি’ বলে কথা।
গতকাল সকালে মঞ্জু চলে এসেছে। হঠাৎ করে না-জানিয়ে নয়, জানিয়েই। তিন-চারদিন আগে বলেছিল মঞ্জু, ফোনে—তোর কাছে যাব। যদি যাই তাড়িয়ে দিবি?
অনিকেত কিছু বলছিল না।
মঞ্জু বলল, এসটিডি-র পয়সা উঠছে। বুঝেছি, তুই ভয় পাচ্ছিস। তবে এখন না-হলে আর কোনও দিনই হবে না। আমার বরের কাছে চলে যাব আমি।
এরপরও অনিকেত নিরুত্তর।
মঞ্জু বলেছিল, বুঝেছি বুঝেছি।
ফোন কেটে দিয়েছিল।
অনিকেত একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল হঠাৎ ওই ফোন পেয়ে। এর আগে কয়েকবার মঞ্জু বলেছিল, তোর ওখানে একবার যাব অ্যাঁ? অনিকেত ঘাড় নাড়িয়ে বলত—হ্যাঁ। কিন্তু সত্যি- সত্যি চলে আসবে এমনটা ভাবেনি।
মঞ্জু ফোনটা ছেড়ে দেওয়ার পরই কোনও গ্রাম্যযাত্রার মোচওয়ালা নায়কের ‘ধিক, তোরে ধিক’ সংলাপটা বেরিয়ে এল অনিকেতের ভিতর থেকে—নারীবাঞ্ছা ফেরাস তুই, এত কাপুরুষ? ভয়? ভয়? হা-হা-হা-হা…।
ওর পৌরুষ চাগিয়ে উঠল।
কী আর ভয়? এখন কেউ থাকছে না এই কোয়ার্টারে। একতলার তেওয়ারি ছুটিতে। রাস্তায় বের হলে কৌতূহলী কেউ-কেউ জিগ্যেসও করে ফেলতে পারে। ‘মিসেস’ তো বলা যাবে না, শুক্লা তো একবার এসেছিল এখানে, ওকে অনেকে চেনে। রিলেটিভ’ বলে দিলেই হল। একটু ফুসফুস গুজগুজ হবে? হোক গে। লোকে যা বলে বলুক, ওদের কথায় কী আসে যায়। ওই তো একটা মেয়ে আছে, রীতা ওরাওঁ। খ্রিস্টান। ওর স্বামী আছে, দুই মেয়ে আছে, ওরা রাঁচিতে থাকে। এখানে বদলি হয়ে এসেছে। ওর তো একজন পুরুষ-বন্ধু প্রায়ই এসে এখানে থাকে। এ নিয়ে কথা হয়, কিন্তু সামনাসামনি কেউ কিছু বলে না তো ওকে। ওই মেয়েটা কত বোল্ড। কত সাহসী!
ধুশ শালা, যা হয় হবে—এই ভেবে মোবাইলটা মুঠোয় ধরেছিল অনিকেত।
—শোন মঞ্জু, তুই সত্যিই আসবি?
—না হলে ফোন করলাম কেন?
—কবে আসবি?
—শনিবার আসি? পরি ওর বন্ধুর সঙ্গে দিঘা যাবে শুক্রবার।
—চয়নের সঙ্গে?
— হ্যাঁ।
ভোরবেলা ট্রেন। সকাল ছ’টা দশ।
বারোটা নাগাদ এখানে পৌঁছবে। স্টেশনে থাকব।
—সত্যি?
—হ্যাঁ রে বাবা, সত্যি!
মঞ্জু আবার বলল, তোর অসুবিধে থাকলে বলে দে, আসব না।
—না না, অসুবিধে কী?
—তা হলে ফাইনাল?
—হ্যাঁ হ্যাঁ। ফাইনাল।
অনিকেত আগেই ঠিক করেছিল এই সপ্তাহটা এখানেই থাকবে। অফিসে কাজ নেই এখন খুব একটা। দুলালী উপাখ্যান আরও একটু লিখবে। অনেক দিন লেখা হয়নি। ভেবেছিল— হাসি বলে যে-মেয়েটা, নাকি ছেলেটা, যার পেটের ভিতরে দু’টো অপরিণত অণ্ডকোষ রয়ে গিয়েছে, ওর সমস্যার কথা লিখবে। ইন্টারনেট-এ দেখেছে ওই অপরিণত কোষ অনেক সময় হঠাৎ বড় হতে পারে, এবং সেই গ্রোথ ম্যালিগন্যান্ট হয়ে যায়, ডাক্তাররা বুঝতে পারে না কিছু। পরে, ছড়িয়ে গেলে বোঝা যায়। কিন্তু সেই উৎস, আদি বীজ, অজানাই থেকে যায়। এই ব্যাপারটা মাথায় রয়েছে। লগন-এর কথা জেনেছে, ওসবও লেখা হয়নি। বিহার-উত্তরপ্রদেশে গিয়ে হিজড়েরা রোজগার করে, নাচে, হোলি-র উৎসব। সারা-রা-রা…। হিজড়া নাচ, লওন্ডা নাচ। বাবুদের খাটাল ঘরে ওদের থাকার ব্যবস্থা, খাটাল ঘরেই ব্যাগ থেকে ছোট আয়নাটা বের করে ঠোঁট লাল করা, বুক উঁচু করা… শুনেছিল লগনের নাচে এক মাতাল বাবু বুক এবং কোমর দোলানিতে খুশি হয়ে এক হিজড়ের বুকে সেফটিপিন দিয়ে আটকে দিতে গিয়েছিল একটা একশো টাকার নোট। সেফটিপিনের খোঁচায় ইলু ইলু’ ফেটে জল বেরিয়ে, ব্লাউজ ভিজে গেলে ওর পিছনে জুটেছিল লাথি, এসব কত কী লেখার ছিল। লিখবে ভেবেছিল ‘ছুট’ বাগানো এবং ‘ছুট’ জমানোর কায়দা। ‘ছুট’ হল বখশিস। এতে গুরুমা-র কোনও অধিকার নেই। আর লগনের রোজগারের অনেকটাই ওদের নিজেদের। কিন্তু দুলালীকে কি লগনে পাঠানো যেত? ওর তো বয়েস বেশি, দেখতেও তেমন নয়। ঝুমকো, ঝর্না, ওদের তো পাঠানো যেত…।
অনিকেত নিজে দুলালকে দেখেছে। বা দুলালীকে। এই আবার পরিমল-মন্টুকেও। ওই জন্যই তে লেখার ইচ্ছেটা। ও তো আর লেখক-টেখক নয়, ওর সেই সাধনা নেই। লেখকদের নাকি রোজ সকালে উঠে লিখতে হয়! তারপর সেই লেখা ছাপবে কে? কে ওকে চেনে? এসব ভেবেই লেখাটা হয়ে ওঠে না। এগোয় না। কিন্তু মাঝে-মাঝে চাগাড় দেয়।
শুক্লা জানে এ সপ্তাহে কলকাতা যাচ্ছে না অনিকেত। পরের সপ্তাহে যাবে। শুক্লা বলেছিল, থাক, আসতে হবে না। যাওয়া-আসা কম ধকল নাকি? বয়সও তো হচ্ছে।
যতই আমার বাড়ছে বয়স ততই জ্বলছে দেহ
জ্বালা জুড়াই, জ্বালা জুড়াও কেহ—
মঞ্জু পরপর কয়েকটা ‘এসএমএস’ করেছিল, তসলিমা নাসরিনের কাঁপন সিরিজের না কি মঞ্জু নিজেই তসলিমার নামে চালাচ্ছে? স্টেশনে গিয়েছিল অনিকেত। ট্রেন রাইট টাইম।
কলকাত্তা সে গাড়ি আয়া, হাজার টাকা দাম
উ গাড়ি মে লিখা হ্যায়
মঞ্জু ম্যাডাম কী নাম
মঞ্জুকে দেখতে পেল। চাদরটা হাতে। চাদরের ভাঁজে-ভাঁজে বিষাদ গোঁজা। মঞ্জু অনিকেতকে দেখে হাত ওঠাল। ওর মুখে বিশুষ্ক তৃণের মতো হাসি।
মঞ্জু বলল, ঠিক চলে এলাম। তারপর বলল, ভেবেছিলাম ঠান্ডা থাকবে এখানে। বেশ গরম কিন্তু।
এপ্রিলে ঠান্ডা থাকে নাকি? –অনিকেত বলল।
মঞ্জু বলল, এপ্রিল নয়, চৈত্র মাস বলো, চৈত্র।
‘চৈত্র’ শব্দটা শুনেই অনিকেতের মনে এল ‘সেদিন চৈত্র মাস তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’
মঞ্জু বলল, ফাল্গুন-চৈত্র বসন্তকাল।
হ্যাঁ। এটা বসন্তই বটে। গাছে-গাছে এখনও কচি পাতা। শাল ফুল। কোন-কোন গ্রামে বাহা উৎসব চলছে। ‘বাহা” মানে ফুল। শালফুলের গুচ্ছ মাথায় বেঁধে নাচ। জঙ্গলের যেটুকু অবশিষ্ট আছে এই শহরের আশেপাশে, ওখানে আশ্চর্য এক গন্ধ। বসন্তের। মঞ্জু এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে কোনও পাহাড় দেখতে পেল না বলে জিগ্যেস করল, পাহাড় কই?
রিকশায় বসার সঙ্গে-সঙ্গেই কয়েকটা কোকিল ডেকে উঠল, আর একটা চলমান অটো রিকশা থেকে বেরিয়ে এল ‘ম্যাজিক-ম্যাজিক-ম্যাজিক লোশন, দাদ-হাজা-আউর হরকিসিম কা খুজলি কা ইলাজ…’
মঞ্জু বলল, তোর বউ যদি জানতে পারে আমি এখানে এসেছি, কী হবে?
অনিকেত বলল, তোর বর যদি জানতে পারে, তা হলে কী হবে?
মঞ্জু বলল, এখনও তো পুরোপুরি বর হয়নি। মানে ওর কাছে এখনও তো যাইনি।
—তোর খোঁজ-টোজ তো রাখছে। সেদিন দেখলাম কোর্টেও এসেছিল…।
—হ্যাঁ। এখন খুব টান দেখাচ্ছে। একা থাকতে পারছে না কিনা…।
—তোর বাড়ি এলে দেখবে তুই নেই…।
—দেখুক গে। অত কৈফিয়ত দিতে যাব নাকি ওকে?
—ওসব কথা ছাড়। আমি এখন তোর কাছে, ব্যস।
কী সুন্দর রাস্তা। কত গাছ। ওই তো দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে… নীল… ওই পাহাড়ে যাব, অ্যাঁ? রিকশাটাকে আরও জোরে চালাতে বল না ডাবুদা… যেন রথ… অনিকেতের হাত চেপে ধরল মঞ্জু। মঞ্জু বলল, উঃ কী মজা! এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ঝাঁকুনি খুব। যেন নিক্কোপার্কে রোলার কোস্টারে রাইড নিয়েছে ওরা। মঞ্জু দু’হাতে অনিকেতের একটা হাত চেপে ধরল।
অনিকেত দেখল, কোলে ফেলে রাখা মঞ্জুর চাদরটাও রৌদ্রে ঝিলমিল। দুই প্রায়-পঞ্চাশ এখন প্রায়-টিনএজার। মঞ্জুর কানের লতিতে হঠাৎ জিহ্বাগ্রের ছোঁয়া দিয়ে দেয়। দূরের পাহাড়ের দিকে চলে রথ। অ্যাডভেঞ্চার। অ্যাডভেঞ্চার। ‘যাই যাই’ বললেও সবটা যায় না। কিছু থাকেই। তার নাম জীবন।
—এবার বাঁদিকে-বাঁদিকে।
বাঁদিকে গেলে অফিস পাড়া। আর একটু সোজা গেলে গাছেদের পাড়া। বাঁদিকে ডিএম বাংলো—পুলিশ কর্তাদের বাংলো, জেলা জজের বাংলো, ফরেস্ট অফিস, হনুমান মন্দির, এই সব সভ্যতা। অনিকেত এবার একটু সরে বসল, সভ্য হয়ে বসল। পঞ্চাশ বছরে প্রৌঢ়দের মতো। ঘরের চাবি খোলার সময় মনে হল গুহায় ঢুকছে। আলিবাবার। চিচিং ফাঁক।
—ঝাড়ু-টাডু দিস না ঘরে? মঞ্জুর প্রথম কথা। ইশ, মশারিটার কী দশা? দেখি, রান্নাঘরটা…মঞ্জু ওর গৃহিণীপনা দেখাতে থাকল।
—আরে, আগে বোস। চা করে দি।
—তুই করে দিবি?
—হ্যাঁ। আমিই তো করে দেব। রান্না করেও খাওয়াব তোকে। আগে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। ওই যে বাথরুম। আর এইটা তোর ঘর।
—সে কী রে? এ ঘরে লিপস্টিক কেন? চুলে লাগানোর ক্লিপ? কী ব্যাপার? ঘরের দেওয়ালে গাঁথা তাকটাকে তাক করে মঞ্জু।
—ওটা মেরিলিন লাকড়া নামে এক ভদ্রমহিলার। এখানে এসে থাকেন মাঝে-মাঝে
—মাইরি? তুমি তো বাবা ভালই ডুবে-ডুবে জল খাও। কত বয়স? কেমন দেখতে? এখানে কবে থেকে গার্লফ্রেন্ড জোটালি? এখানে থাকে? রাত্রেও? একসঙ্গে সব প্রশ্নগুলো করে ফেলে মঞ্জু। তারপর সারা ঘরে চোখ বুলোয়। আরও নারীচিহ্ন খুঁজতে থাকে। একটা রামের নিপ পায় অন্য তাকে।
ওই মহিলা মাল-ও খায় না কি? এবার সেই তাকেই একটা বিড়ির প্যাকেট। একটা বিড়ি পড়ে আছে। এগুলো আবার পুরুষচিহ্ন।
অবাক চোখে তাকায় মঞ্জু। কনফিউজ্ড্।
এসব নিয়ে এখন ভাবতে হবে না। আমার গার্লফ্রেন্ডের কথা বলব। আগে ফ্রেশ হয়ে আয়।
—না, আগে বল।
তখন ভেঙে সব বলতে হয়। মেরেলিন লাকড়া আর জাহানাবাদির কথা—যারা মাঝে- মাঝে এসে এখানে থেকে কাজ করে। লাকড়া ম্যাডাম যে যৌবনহীনা বৃদ্ধা এবং পরম করুণাময় ঈশ্বর ওঁকে কৃপা করে রূপ-বঞ্চিত করেছেন, হাইপ্রেশারে ভোগেন বলে আয়ুর্বেদিক তেল ব্যবহার করেন, এবং সামগ্রিক সুস্বাস্থ্যের জন্য গোমূত্র পান করেন—সেটাও বলল অনিকেত। এবার কলঘরে গেল মঞ্জু।
কলঘর ছলভরা। সেই কলঘর। পুরনো স্মৃতি। একদা আচমকা কলঘরে ঢুকেছিল কিশোর অনিকেত। মঞ্জু তখন কিশোরী। স্মৃতি আঁচড়ায়। চায়ের জল বসায় অনিকেত।
সারা ঘরে শরীর-গন্ধ ছড়িয়ে মঞ্জু কলঘর থেকে ওর ঘরে যায়। শরীরের গন্ধ তো নয়, সাবানের। সাবান শরীরের স্পর্শ পেয়ে উতল হয়। দরজা বন্ধ হল। লাকড়া-ও দরজা বন্ধ করে, কিন্তু এই দরজা বন্ধ করার শব্দ আলাদা রকম। চায়ের গেলাসে চিনি গোলাচ্ছে অনিকেত। টুংটাং…টুংটাং…কী মেশাচ্ছে চায়ের জলে? শুধুই চিনি? না কি ভালবাসা?
দরজা খুলে দিল মঞ্জু।
অনিকেত বলল, আয়। আমার ঘরে আয়।
অনিকেতের বিছানায় বসল মঞ্জু। অনিকেত চেয়ারে। মঞ্জু কী স্নিগ্ধ। হাসছে মৃদু। জানালা খোলা। বাইরে, কিছুটা রৌদ্রের সঙ্গে চার-পাঁচটি ফড়িং মিশিয়ে, ঈশ্বর বলছেন : ওহে, আজ বসন্ত দেখহে। মঞ্জুকে দেখে মনে হচ্ছে এখন ওর হৃদয়ে কোনও ক্ষত নেই। ছোটখাটো দুঃখগুলোর লতায়-পাতায় কিছু ফুল। পুষ্পবতীও।
ছোট্ট ট্রে-টা থেকে চায়ের গেলাসটা তুলে নিয়ে, মঞ্জু, গ্লাসটা অনিকেতের হাতে ধরিয়ে দিল। চায়ের গেলাস নয়, আপেল, সেই স্বর্গের বাগানের ‘পাপ’-আপেলটা বাড়িয়ে দিল প্রৌঢ়া ইভ। গ্রহণ করল আদম-অনিকেত।
তারপর মাছভাজার গন্ধ, প্রেশার কুকারের সিটি, জলের ছরছর, থালা-বাসনের ঠুংঠাং, ও মা? সজনে ফুলের বড়া? কত গুণের ছেলে রে তুই… উঃ কী ঝাল… বেশ একটা পিকনিক হল—এইসব।
দুপুরবেলাটায় ফিরে এল সেই এক্কাদোক্কা বেলা, ঘুড়িবেলা, গুলি বেলা…। কোনও অলৌকিক ম্যাজিকওলা আশ্চর্য ঝুলি থেকে বের করে এনেছে দু’টো কৈশোর। ‘এই-এই ভাল হবে না বলছি…।’ ‘এই সুড়সুড়ি লাগে। বউকে বলে দেব সব…।’ ‘তোরও কত চুল পেকে গিয়েছে মঞ্জু…।’ ‘চুল পেকেছে কিন্তু আমি তো পাকিনি।’ ‘ভালই তো পেকেছিস…’ ‘না রে, পাকিনি। কেউ পাকিয়ে দেয়নি তো…। সেই বুড়োটা পাকাতে এসেছিল আমায়, সেই ছোটবেলায়…।’’ওসব আজ থাক মঞ্জু। ওসব ভুলে যাসনি কেন?” “ঠিক আছে, ভুলে গিয়েছি।’ ‘একটা পাহাড়ে নিয়ে যাবি?’
একটা দুপুরে একা পূর্ণজীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন।
শাল-পিয়ালের গা বেয়ে বিকেল নেমে আসে। ওরা একটা রিকশা নিয়ে কিছু দূরে গিয়ে রিকশা ছেড়ে দেয়। একটা ছোট্ট টিলা। টিলার দিকে এগোতে এগোতে অনিকেত ওর ভূগোল, জিওলজি, বটানি-র জ্ঞান বমি করতে থাকে। কাউকে পাওয়া গিয়েছে এতদিনে। এগুলো গ্রানাইট, এগুলো বেসল্ট। পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলা এখানেই। এটা ছিল গন্ডোয়ানা ল্যান্ড। ওটা অর্জুন গাছ। অর্জুন গাছের ছাল হার্টের অসুখে খুব কাজে লাগে। শালপাতা মাটিতে পড়লে বর্ষার জলে মাটির সঙ্গে মিশে খুব ভাল গন্ধ হয়। ওটা কেন্দু গাছ। ওটার ফল খেলে নাকি সেক্স বাড়ে।
—খেয়েছিস তুই?
—আমি খেয়ে কী করব? আমার তো খালি হিসি করতে কাজে লাগে। ব্যবহার না করে- করে খারাপ হয়ে গিয়েছে।
—বাজে কথা বলিস না…। দুপুরে তো বুঝেছিলাম একটু…।
দুপুরবেলায় খুনসুটি করতে করতে অনিকেত বলেছিল, এই রে, এবার নির্ঘাত আমি মরে যাব।
মঞ্জু বলেছিল, কেন—অলুক্ষুণে কথা, এখনও তো কিছুই হল না। মরে যাব বলে তো সেই চরম সময়ে। ‘ক্লাইম্যাক্স’ না কী যেন বলে, তখন।
অনিকেত বলেছিল, কেন মরে যাব বলছি। মা ছোটবেলায় বলেছিল মেয়েদের সঙ্গে বেশি মিশবি না। ওদের গায়ের সঙ্গে গা লাগাবি না, ওদের ঢাকা জায়গাগুলো ছুঁবি না। ছুঁলেই পাথর হয়ে যাবি। পাথর হয়ে গেলে কি বাঁচে?
মঞ্জু বলেছিল, সে কী—পাথর হবি কেন!
অনিকেত বলেছিল, এই তো এই জায়গাটা শক্ত হতে শুরু করেছে। ক্রমশ সারা শরীরটাই শক্ত হয়ে পাথর হয়ে যাবে। দ্যাখ না… মঞ্জু হাত দিয়ে দেখেছিল কতটা পাথর…। বলেছিল, এখন পাথর হতে হবে না।
ছড়ানো পাথরের পাশ দিয়ে ওরা টিলার ওপর উঠল। সূর্যটা লাল। পাহাড়ের গায়ে বেশ কিছু সালংকরা পলাশ গাছ নটীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। শিমুল-ও রাঙা, এসব জায়গায় সূর্যের লাল আলো। টিলার চূড়া পর্যন্ত যাওয়া হল না। একটা বড় পাথরের ওপরে বসে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখল। পাখিরা ঘরে ফিরছে। ওদের কণ্ঠে ঘরে ফেরার উল্লাস। রাখাল ছেলেটাও কতগুলো গরু নিয়ে ঘরে ফিরছে। ছেলেটা মুখ ঘুরিয়ে ওদের দেখল। কয়েকটা গরুও। গুরুদের কাছে এটা আশ্চর্য দৃশ্য। কৃষ্ণচূড়া-পলাশ-শিমুল এসব ওদের কাছে তেমন কোনও দৃশ্য নয়। সারা আকাশ লাল করে সূর্যদেবের আকাশতলে মিলিয়ে যাওয়াও কোনও দৃশ্য নয়। বরং এরকম বাবু-বিবি’র এভাবে বসে থাকাটাই একটা দৃশ্য। মাথায় জ্বালানির কাঠকুঠো বয়ে নিয়ে যাওয়া দুই রমণীও ওদের দেখল। অনিকেত এসব প্রায়ই দ্যাখে। সূর্যাস্তও দ্যাখে। কিন্তু এভাবে সুন্দর দ্যাখেনি কত দিন। এতটা মুগ্ধতা কত দিন গায়ে লাগেনি ওর। সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে। মানুষ দেখেও দ্যাখে না। মাঝে-মাঝে, দ্যাখে। কোন অসময়ে
সূর্য ডুবে গেলে, গরুরাও ধুলো উড়িয়ে ঘরপানে চলে গেলে, অদ্ভুত গোধুলি আবছায়ার মধ্যে মঞ্জু বলল, তোর কোলে একটু মাথা রাখি ডাবুদা? অনিকেত কিছু না-বলে মঞ্জুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। মঞ্জু অনিকেতের কোলে মাথা রাখে। অনিকেত মঞ্জুর মাথায় শুশ্রূষা বুলিয়ে দেয়। চতুর্দিকে ছড়ানো পাথর। সেই সৃষ্টির আদিম পাথর—মেসোজয়িক যুগের। চারিপাশে কোনও জনপ্রাণী নেই আর। পাখিরাও নেই।
মঞ্জু বলল, অহল্যা-ও পাথর ছিল। না রে?
—হ।
—আমিও পাথরই ছিলাম। কে আমায় জাগাল বল তো? অনিকেত কিছু বলে না।
মঞ্জু দু’হাতে অনিকেতকে জড়িয়ে ধরে। চুম্বনের জন্য মুখটা ওপরে ওঠায়। অনিকেত মুখটা ডুবিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর দ্যাখে আকাশে শুকতারা। অন্ধকার নেমে আসে ধীরে-ধীরে। একদিকে দূর শহরের সভ্য আলোরেখা দেখা যায়। দিগন্তের অন্য দিকে চাঁদ। কস্তুরী আভার চাঁদ। এখান থেকে যাব না, যাব না আর। মঞ্জু বলে।
অনিকেতেরও ওরকমই মনে হয়।
মঞ্জুর বিশুষ্ক বাহুর ওপরে মায়াবি চন্দ্রালোকের সম্পাত। কেশবন্ধন, মানে প্লাস্টিক ক্লিপ, পাঁচ টাকাও না, খুলে গিয়েছে, অসংলগ্ন কেশদাম অস্থির, কণ্ঠাস্থি চঞ্চল, পরিত্যক্ত গ্রাম্যপথের মতো হাতের নীল শিরা-উপশিরায় মেলার মাঠের লোক চলেছে। অনিকেতও অন্ধকারকে জড়িয়ে নেয়। অন্ধকারের স্তনের ভিতর, যোনির ভিতর, অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চায়। হে সময়গ্রন্থি, হে নিশিথ কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া, আমাকে জাগিও না। কোনও দিন জাগিব না আর। জাগিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম অবিরাম ভার…।
শেয়াল ডাকে।
এবার উঠতে হয়। মঞ্জুর ঠিক খেয়াল থাকে।
এই চাঁদ-পাথর-জোনাকির মধ্যেও প্লাস্টিকের ক্লিপ-টার কথা ভোলে না। খুঁজতে থাকে। খুঁজে পায়।
কোনও মাদক ছাড়াই নেশা হয়েছে যেন। পা টলছিল। শরীর টলছিল। অনেকটা হেঁটে এসে একটা রিকশা পাওয়া গেল। রিকশায় উঠল। মঞ্জু অনিকেতের কানে-কানে বলল, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত তুমি বলো তো?
অনিকেত মনে-মনে বলল, সুচিত্রা সেন জানতে পারলে একটা কষে থাপ্পড় মারবে। কিন্তু আসলে বলল, খুব খারাপ হত। তার মানে, ওরা আবার স্বাভাবিক, ঠিকঠাক। কারণ শহরে এসে গিয়েছে। চাঁদ নয়, মাথার ওপরে হ্যালোজেন আলো।
রাত্রে ওই কোয়ার্টারে ওরা দু’জন। তেমন কিছু নয়, খিচুড়ি-ডিমভাজা। একটু মহুয়াও। মঞ্জুকে মহুয়া ‘টেস্ট’ করাতে চাইল। মঞ্জু গন্ধ শুঁকে নাক কোঁচকাল। অনিকেত বলল, দ্যাখ না কেমন বাসমতি চালের গন্ধ। একটু মহুয়া হাতের আঙুলে নিয়ে মঞ্জুর হাতে বুলিয়ে দিয়ে বলল, শুঁকে দ্যাখ না। মঞ্জু বলল, সত্যিই তো পায়েসের গন্ধ। অনিকেত বলল, তবে? ঠিকমতো মার্কেটিং করতে পারলে শ্যাম্পেন-ট্যাম্পেন’কে হারিয়ে দিতে পারত এই মহুয়া। রতনলাল ব্রহ্মচারী নামে একজন সায়েন্টিস্ট আছেন, বাঘের ফেরোমন নিয়ে কাজ করেছেন। উনি দেখিয়েছেন, যে রাসায়নিক যৌগটার জন্য বাসমতি চালের সুগন্ধ, সেই যৌগটাই বাঘের ফেরোমন-এ থাকে। তবে বাসমতি চাল ফুটন্ত গরম জলে সেই গন্ধটা ছাড়ে, কিন্তু বাঘের ফেরোমন-এ নর্মাল টেম্পারেচারেই সেই গন্ধটা থাকে। মহুয়াতেও সেটা আছে। মহুয়া খাওয়া
মানে বাঘের ফেরোমন খাওয়া।
মঞ্জু জিগ্যেস করল, ফেরোমন কী?
অনিকেত বলল, ফেরোমন হল যৌনতার গন্ধ। তা হলে অনেক কথা বলতে হয়। অল্প একটু মহুয়া খেয়ে নে তবে, পাতলা করে বানিয়ে দিচ্ছি।
তারপর কথা। ক’য়ে কথা, খ’য়ে খুনসুটি, গ’য়ে গল্প। গল্প করতে করতে গল্প।
অনিকেত বলল, গল্পের সঙ্গে মেয়েদের একটা সম্পর্ক আছে। ৮, ১৮, ২৮, ৩৮ আর ৪৮ বছরের মহিলাদের সঙ্গে গল্পের সম্পর্কটা পাল্টে-পাল্টে যায়। বুঝলি? ৮ বছর বয়সি মেয়েদের বিছানায় নিয়ে গিয়ে গল্প শোনাতে হয়। তারপর ঘুম পাড়াতে হয়। ১৮ হলে গল্পের আছিলায় বিছানায় নিতে হয়। ২৮ হলে বেডরুমে নেওয়ার জন্য আর গল্প শোনাতে হবে না। ৩৮ হলে মেয়েটাই গল্প শোনাতে-শোনাতে বেডরুমে নিয়ে যাবে। আর ৪৮-শে…
—কী, ৪৮-এ? মঞ্জু চোখ ঘুরিয়ে জিগ্যেস করে।
‘অরিজিনাল জোক’-টাতে ছিল—আপনি ওকে গল্প শোনাবেন ঠিকই, তবে সেটা বেডরুমের বাইরে, এবং বেডরুম থেকে দূরে রাখার জন্য।
—৪৮-এ কী বললি না?
অনিকেত বলে, ৪৮-এ গল্প-টল্প নয়। কম কথা।
মঞ্জু বলে, হ্যাঁ। কথা কম। শুধু ঘুম। ঘুমের চেষ্টা।
অনিকেত বলে—না, কাজের চেষ্টা।
গল্প পেটে পুরেই ওরা বেডরুমে যায়। জানলা খোলা। তারাভরা আকাশ। গল্পভর্তি ঘর।
মঞ্জু বলল, ফেরোমন বল, ফেররওমন।
মঞ্জুর কি একটু গলা জড়িয়েছে, মহুয়ায়?
হাফপ্যান্ট পরা অনিকেত গেঞ্জিটা খুলে ফেলে মঞ্জুর গলা জড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিয়ে চেপে ধরে বলল, গন্ধ নে, ফুসফুস ভরা গন্ধ। ফেরোমন। মঞ্জু তাই করতে লাগল। নির্গত শ্বাসের উষ্ণতা এবং আর্দ্রতায় শিহরিত হচ্ছিল। পুরুষ-বুকের ছোট্ট অ্যারিওলা থেকে আশ্চর্য শিরশির প্রবাহিত হল সারা শরীরে। পিতৃদুগ্ধ বলে কিছু নেই। পুংশরীর শিশুখাদ্য দুগ্ধ উৎপাদন করে না, অথচ নিপ্প্ল আছে। কে জানে কেন? যাকগে মরুকগে। এবার ক্রম উন্মোচন। এত দিনের অবদমিত লিবিডো-র বাচ্চা সংশোধনাগারের গারদ ভেঙে বেরিয়ে এল। কে বলল প্ৰায়- মেনোপজ? কে বলল ড্রাই? ঘুঙুর বাজল, ঘুঙুর। ঘ-এ ঘুঙুর, ঙ-য় উম্ উঙঙা…তারপর চ, ছ, জ… জ-এ জাদু, ঝ-এ ঝুমঝুমি। ত-এ তরঙ্গ… ন-য়ে নিধুবন…আর ভ-এ তো ভয়। এসব শেষ হয়ে গেলে ভয় হয়। কিন্তু ভয়কে জয় করা একটা ভালবাসা দু’জনের ওপর হালকা নকশি কাঁথার মতো রয়ে যায়। ভালবাসা মানে ঘুম, শরীর-বিস্মৃত। পাশাপাশি ঘুমোনোর মতো বিসর্গ-চিহ্ন। নিঃশেষ ও নির্বিকার।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে ঘুম-জড়ানো গলায় মঞ্জু বলেছিল, আমার পরিকে তুই একটু দেখিস, কেমন! আমার বরটা ওকে দেখবে না। তারপর কিছুক্ষণ নৈঃশব্দ্যের পর অনিকেতের গায়ে হাত দিয়ে বলেছিল, এখনও শেষ হয়ে যাইনি, বল, আমার বরটা তা হলে…।
মঞ্জু কি নিজেকে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়ার জন্য এসেছিল তা হলে?
.
এখানে বেলা এগারোটা বেজে গিয়েছে।
চায়ের গেলাসগুলো পড়ে আছে। সিগারেটের টুকরো।
এখনও বাইরের কেউ এসে হানা দেয়নি।
পাগলির সঙ্গে গুহাজীবন, তারা-জীবন, চার অক্ষর জীবন কাটানো হয়ে গেল। মঞ্জু এবার গেল মাংসে নুন-হলুদ মাখাতে।
নুন-হলুদ মাংসের গায়ে লেপ্টে দিতে-দিতে মঞ্জু বলছিল-আমার বরটা ভেবেছে আমার টাকায় ও খাবে। ওর তো বিজনেসের অবস্থা ভাল না। কিন্তু আমার চাকরিটার শেষ পর্যন্ত কী হবে, আমি জানি না। মালিকরা জামিন পেয়ে গিয়েছে। গেঁদু আর লোটনের নামে ডায়েরিও করেছে থানায়। ওরা ধরা পড়েনি এখনও। ‘ছোট স্যর’ বলেছে, বিজনেস বন্ধ করবে না, বরং ভাল লোক নিয়ে ভাল করে চালাবে। থানা থেকে তো ‘সিল’ করে দিয়েছিল। কাগজপত্র দেখেছে। থানাকে ভাল টাকা দিতে হয়েছে। যারা ট্যুরে গিয়েছিল, ওদের টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিয়েছে। লস হয়ে গিয়েছে। এখনও তো সব ওলটপালট। মাইনেপত্র গত মাসে দেয়নি। পাতলা করে ঝোল করি, এ্যাঁ? ছাদে দেখছিলাম নিমগাছে কচিপাতা। পেড়ে আনবি? না, আমিই আনব?
অনিকেত বলে, তোকে ছাদে উঠতে হবে না। তুই আছিস কেউ জানে না তেমন। ভাগ্যিস আমার কোয়ার্টারটা এক সাইডে। আর আমার বাড়িতে আড্ডা মারতে স্টাফ-রা আসে না। শত হোক, ‘বস’ বলে কথা। তুই এখানে ম্যাজিক। তুই টুপির মধ্যে ঢুকে থাকা লাল ফুল, নীল ফুল, জরির শেকল।
আজ চারটের সময় ফেরার ট্রেন। সাড়ে তিনটে নাগাদ স্টেশনে পৌঁছলে হবে। অনিকেত বলল, তুই আগে স্নান করে নে, পরে যাব। তোর স্নান হয়ে গেলে মাংসটা বসিয়ে দেব।
মঞ্জু স্নান ঘরে ঢুকলে অনিকেতও হঠাৎ বলল, “হিস্ট্রি রিপিট্স’। মঞ্জু কথাটা ঠিক বুঝল না, তবে শ্রীকৃষ্ণের বস্ত্রহরণ ছবিতে গোপিনীরা যেভাবে থাকে, মঞ্জু তেমনই করল, যদিও যে কোনও গোপিনীর চেয়ে মঞ্জু ডবল-বয়সিনি। শাওয়ারের পাইপ যেন কদম্বের ডাল। ওখানে ঝুলছে প্রৌঢ়া গোপিনীর ম্যাক্সি। প্রৌঢ় কৃষ্ণ বলল, আয় সাবান মাখিয়ে দিই। গোপিনী বলল, উঃ… সেই দিনটা… কী বাজে কথা বলেছিলাম তোকে…। কেষ্টা বলল—কেস-টা কী? অ্যাঁ, ছিটকিনিটা ঠিকমতো দিসনি কেন? বলে সাবান মাখানোর চেষ্টা করতে থাকে, এবং বেরসিক সাবান হাত ফসকে যায়। এবং হাত-ফসকানো সাবান সাধারণত প্যানে পড়ে। তাই হল। সাবানলীলা অকালে শেষ হয়।
এবার মাংস-টা চাপিয়ে দেয় প্রেশার কুকারে। গত কয়েক ঘণ্টার পাপের জন্য বেশ খুশি লাগছে। জীবনে তবুও তো হল কিছু। চেষ্টা করা হয়নি তেমন আগে। তা হলে অনেক হত। না চাহিলে যারে পাওয়া যায়…। যা হোক, এতে ওর গোপন বায়োডাটায় কিছু তো লেখা যাবে। এটাই হল পৌরুষ। একদম কিছু এক্সট্রা-ম্যারিটাল হল না—তবে আর ব্যাটাছেলে কী? এটাই তো মনে গেঁথে আছে। গেঁথে থাকে। নিজ লিঙ্গটিকে উত্থিত দেখতে মহিলাদের চেয়ে পুরুষরাই ভালবাসে বেশি। এই উশকানি কর্মের জন্যই সারা পৃথিবীতে হাজার-হাজার কোটি টাকার তেল, মলম, লোশনের ব্যবসা। গন্ডার নিধন…। কে জানে ধাতব বন্দুকে বেশি খরচ করে পুরুষসমাজ, না কি প্রোটিন বন্দুকে? একটা সিগারেট ধরায় অনিকেত। বেশ মৌজ করে ধরায়। অস্ত্র ব্যবহারে খুশি ও।
ম্যাক্সিটা ধুয়ে দিয়েছে মঞ্জু। না-ধুলেও চলত। এত তাড়াতাড়ি শুকোবে না। ব্যালকনিতে মেলতে নিষেধ করল অনিকেত। মঞ্জু শাড়িটা কোনওমতে পেঁচিয়ে এসেছে বাথরুম থেকে এটাও অন্য অনুপম। অনুপম মানে—’সৌন্দর্য’ আর কী। ও তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করল। শব্দ করে ছিটকিনি দিল, যেন অনিকেত হুট করে ঢুকে যেতে পারে, সেই ভয়। ছেনালিও অনুপম লাগে। এই সব অনুপম ছেনালি, ব্যাপক ছলনা, হেব্বি ছেমো কত দিন, কত দিন, কত দিন পরে।
লিভিং স্পেসের দড়িতে মঞ্জুর ভেজা ম্যাক্সিটা মেলে দিল। ফ্যানটা চালিয়ে দিল। না- শুকোলে পলিথিনে ভরে ব্যাগে নিয়ে যাবে।
এ সময় করাঘাত। দরজায় করাঘাত। কলিং বেলটা খারাপ হয়ে আছে।
কে এখন আবার? ঘরের ভিতর থেকে অনিকেত কিছু বলার আগে ঘরের সামনে গিয়ে বলে, মঞ্জু, এখন বেরবি না। মঞ্জু কিন্তু অনিকেতের বেডরুমেই এখন। কারণ ওর ব্যাগটা পাশের ঘর থেকে গতকাল রাতেই এই ঘরে নিয়ে এসেছিল।
অনিকেত জিগ্যেস করল, কে?
হামি, মধুসূদন আইজ্ঞা।
মধু মাহাতো হল ওদের একজন গ্রুপ ডি স্টাফ। ভাল ছেলে। ওকে দিয়ে রুটি-টুটি আনায় মাঝে-মধ্যে।
—কী ব্যাপার মাহাতো? আমি একটু ব্যস্ত আছি।
—স্যর, খুলেন। গেস্ট আপনার গেস্ট।
—কোন গেস্ট?
—বউদি স্যর। আপনার মিসেস।
এবার? শুক্লা চলে এল? একা? না-জানিয়ে? কী বলবে? মঞ্জুর কথা একটু-একটু জানে শুক্লা। কিন্তু… যত দেরিতে খুলবে ততই খারাপ। দরজা খুলে দিল অনিকেত।
শুক্লা হাসছে।
কীরকম সারপ্রাইজ, অ্যাঁ? একা-একা চলে এলাম তো…। মন্টুটা নেই…। কাজ কী আমার…? বসন্তকাল বলে কথা… ট্রেনটা এক ঘণ্টা লেট করল…। ঘরে ঢুকেই গলা নামিয়ে বলল—তোমার কাছে ওই খ্রিস্টান ভদ্রমহিলা আছেন বুঝি এখন? কী লাকড়া যেন… ও আমরা ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নেব। শুকোতে দেওয়া ম্যাক্সিটার দিকে শুক্লার চোখ।
তারপর আবার বলল, ও আমরা ম্যানেজ করে নেব। মাংসের গন্ধে তো ঘরটা ম’ম করছে। ভাল দিনেই এসে পড়েছি। না-হয় তোমাদের একটু কম হবে। কাল বেশি করে এনো। আবার গলা নামিয়ে, আঙুলটা বেচারা ম্যাক্সিটার দিকে তাক করে বলল, কোন ঘরে?
অনিকেতের মাথা ঝিমঝিম করে, গা ঝিমঝিম করে। মুখে কথা নেই।
শুক্লা হাতের ব্যাগটা নামায়। মধু মাহাতো চলে যায়। লিভিংরুমে ম্যাক্সির শরীর থেকে দু- একফোঁটা জল ঝরছে ঘরের মেঝেতে।
—কিছু কথা বলছ না কেন? খুশি হওনি তুমি?
অনিকেত তখনও কোনও কথা বলে না।
শুক্লা দ্যাখে একটা ঘর খোলা, একটা ঘর বন্ধ। খোলা ঘরটায় ঢোকে। দড়িতে ঝুলছে একটা ব্রা। তাকের ওপর একটা প্লাস্টিক ক্লিপ
—কোনটা তোমার ঘর? কোনটা?
মাথা ঝাঁকিয়ে বিহ্বল শুক্লা প্রশ্ন করে।
অনিকেত পিত্তল পুত্তলি।
—কী, কথা বলছ না কেন?
অনিকেত মুঢ় ম্লান মূক
পাশের ঘরের দরজাটায় ধাক্কা দেয় শুক্লা।
মৃদু।
দরজা খোলে না।
এবার জোরে ধাক্কা দেয়। হাত মুঠো করে কিল মারতে থাকে।
অনিকেত বলে, দরজাটা খোলো মঞ্জু, শুক্লা এসেছে। আমার শুক্লা।
দরজা খুলে যায়।
মাথা নিচু করে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে।
অনিকেত বলে, মঞ্জু এসেছিল। হঠাৎ।
তক্ষুনি প্রেশার কুকার ফোঁস করে উঠল। তীব্র।
শুক্লা অবাক হয়ে দেখছে চারদিক।
অনিকেতের ঘরে একটা মেয়েলি ব্যাগ। বিছানায় একটা ব্লাউজ। বাইরে জল-চোঁয়ানো ম্যাক্সি। মাংস গন্ধ।
শুক্লা আর দ্যাখে না। চোখ বোজে। বসে যায় ঘরের মেঝেতে।
সন্ধ্যামণি কনক তারা
সন্ধ্যামণি জলের ধারা
আমি সতী নিজ ব্রতী
সিঁথির সিঁদুর ভাগ্যবতী
আয়না আয়না আয়না
সতিন যেন হয় না।
হে অন্ধকার, হে ট্রেন, ট্রেনের হুইশল,
জমি উপড়ে দিয়ে চলে গেছে চাষি
এত মাছি কেন?
শুধু কুয়াশা। ভীষণ কুয়াশা…।।
অনিকেত আর মঞ্জু মিলে শুক্লাকে শুইয়ে দেয়। মঞ্জু জলের ঝাপ্টা দিতে থাকে। অনিকেত দ্যাখে শুক্লার নাসাছিদ্র বেয়ে নেমে আসছে ক্ষীণ অথচ তিরতীক্ষ্ণ রক্তস্রোত।